কমরেড রামযতন শর্মা ও কমরেড অরবিন্দ সিং-এর মৃত্যুতে আমরা হারিয়েছি আমাদের চমৎকার দুই কমরেডকে যাদের কমিউনিস্ট হিসাবে যাত্রা শুরু হয়েছিল তুমুল আলোড়ন জাগানো সত্তরের দশকে। কমরেড রামযতন শর্মা ছোট ভাই কমরেড সুরেশের (সিদ্ধেশ্বর শর্মা) শহীদের মৃত্যু বরণের পর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সরকারি চাকরি ছেড়ে সর্বক্ষণের সংগঠক হিসাবে আন্দোলনে যোগ দেন। কমরেড সুরেশ কলেজে পড়ার সময় সিপিআই(এমএল)-এ যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৪ মে ভাগলপুর জেলভাঙার অভিযানে শহীদ হন। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কমরেড অরবিন্দ সিং জরুরি অবস্থার সময় সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে যুক্ত হন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েও আমৃত্যু তিনি ছিলেন এক একনিষ্ঠ পার্টি কর্মী।
সত্তরের দশকের শুরুতে প্রাথমিক ধাক্কার পর, দশকের শেষের দিকে বিহারের মাটিতেই সিপিআই(এমএল) নতুন করে উঠে দাঁড়ায়। কমরেড জহরের (সুব্রত দত্ত) নেতৃত্বে কমরেড চারু মজুমদারের শহীদের মৃত্যু বরণের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হয়। ১৯৭৫’র ২৯ নভেম্বর ভোজপুরের এক গ্রামে কমরেড জহর ভারতীয় রাষ্ট্রশক্তির সামরিক নৃশংসতার বলি হওয়ার পরও পার্টি ভেঙে যায়নি, কমরেড বিনোদ মিশ্রের নেতৃত্বে গয়ায় দ্বিতীয় কংগ্রেস করার পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। রাষ্ট্র যদি ভেবে থাকে তার নিপীড়নই শেষ কথা, বিপ্লবী আন্দোলনেরও জানা ছিল কীভাবে এক দৃষ্টান্তমূলক কৌশলী অধ্যবসায়ে তাকে অতিক্রম করতে হয়।
১৯৭০’র শেষার্ধ সিপিআই(এমএল)-এর ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামের এক ইতিহাস হয়ে আছে। পাটনা হয়ে উঠেছিল ১৯৭৪ সালের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু, যে আন্দোলন নকশালবাড়ির বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের পর, যুক্তিগ্রাহ্যভাবেই হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা-উত্তর দ্বিতীয় বৃহত্তম যুব জাগরণ। যখন পাটনার রাজপথে যুব আন্দোলন ফুঁসছে, তখন নিপীড়িত গ্রামীণ জনতার বিদ্রোহ পাটনার গ্রামাঞ্চলে আর সংলগ্ন জেলা শাহবাদ ও মগধে ছড়িয়ে পড়ছে। দুই আন্দোলন অনিবার্যভাবেই পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছিল। জরুরি অবস্থার জমানায় জেলগুলো হয়ে উঠেছিল বৈঠকের চমৎকার জায়গা। আর ১৯৭৭-এ কংগ্রেস উৎখাতের বিরাট স্বস্তি ও ক্ষণস্থায়ী জনতা পার্টির প্রতি মোহমুক্তি এই কথাবার্তার সঠিক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল।
সিপিআই(এমএল) এই পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির নীরব দর্শক ছিল না। ১৯৭৪’র আন্দোলন এবং ১৯৭৭’র নির্বাচনী অভ্যুত্থান থেকে বিপুল অনুপ্রেরণা নিয়ে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে পার্টি নিজের শক্তি বাড়িয়েছিল। পার্টির কৌশলগত পন্থা, গণকার্যকলাপ, গণসংগ্রাম এবং গণসংগঠনের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন পার্টির ভাবনায়, মতাদর্শগত উপলব্ধিতে ও অনুশীলনে এক নতুন গতি ও প্রাণশক্তি ভীষণভাবে দাবি করছিল। ১৯৭৯এ সংগঠনের বিশেষ সম্মেলনের পর, পার্টির গণমুখী প্রচার ও প্রসার নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ পথে বাড়তে শুরু করে এবং চিন্তার সৃজনশীল মন্থন, নতুন নতুন উদ্যোগের বিকাশ, প্রাত্যহিক কাজকর্মের সুসংবদ্ধতা এবং সাংগঠনিক জীবনের নিয়মানুগ হয়ে ওঠার মাঝে পার্টিও এক ক্রমবর্ধমান সর্বভারতীয় চরিত্র অর্জনের পথে এগিয়ে যায়।
কমরেড রামযতনজী এবং কমরেড অরবিন্দজী আপন আপন স্বকীয়তায়, ১৯৭৯ পরবর্তী পর্যায়ে সিপিআই(এমএল)-এর এই আলোড়ন ও বিস্তারের পর্বের আদর্শ প্রতিনিধি ও সংগঠক হয়ে ওঠেন। রামযতনজী, পাটনার কমরেডদের কাছে যিনি আলোকজী নামেই পরিচিত ছিলেন, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে থেকে কমরেডদের নিয়ে তাদের বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। আর অরবিন্দজী, কোর-টিম যা জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনমত’ প্রকাশ করত তার সদস্য হিসেবে, হিন্দি প্রকাশনার ক্ষেত্রে পার্টির প্রবেশকে সম্ভব করেছিলেন নিশ্চিত স্থির প্রত্যয়ে, গভীর অধ্যবসায়ে। আলোকজী হয়ে উঠেছিলেন ভার্মাজী এবং উত্তর প্রদেশের পার্টি সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি যথাক্রমে ছত্তিশগড় ও ঝাড়খণ্ডের দায়িত্ব সামলে আবার ফিরে আসেন বিহারে। প্রথমে রাজ্য সম্পাদক হিসেবে ও পরে মগধ অঞ্চলের ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রামযতনজী পার্টির কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ছিলেন। আর ২০১৮-তে কমরেড অরবিন্দজীও পার্টির এই শীর্ষ শৃঙ্খলারক্ষা সংস্থার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কমরেড রামযতন শর্মা তরুণ কমরেডদের সামিল করে মার্কসবাদী চিন্তাধারাকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং মার্কসীয় পাঠচক্র পরিচালনার ব্যাপারে দারুণ আগ্রহী ছিলেন। পার্টির ধারাবাহিক গণবিস্তারকে ধরে রাখা ও সুসংহত করার জন্য চাই পার্টি ক্যাডারদের মতাদর্শগতভাবে অনুপ্রাণিত ও সুসজ্জিত বাহিনী। আর রামযতনজী সদাসতর্ক তীক্ষ্ম মনোযোগে রেখেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রায়শ উপেক্ষিত এই বিষয়টিকে। একাধিক প্রজন্মের অনেক পার্টি ক্যাডার যাদের মধ্যে নেত্রীরাও আছেন, কমরেড রামযতনজীকে শ্রদ্ধাভরে মনে রেখেছেন ক্যাডারদের গড়ে তোলা ও পার্টি শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর তন্নিষ্ঠ মনোযোগের জন্য। ইদানিং এই অতিমারী আবহে যখন যোগাযোগ ও বৈঠকের স্বাভাবিক ধরনগুলি ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তিনি মার্কসবাদী শিক্ষা ও প্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়া অব্যাহত রাখতে দারুণ আগ্রহে ডিজিট্যাল প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করছিলেন।
আন্দোলনে পোড়খাওয়া এই সংগ্রামী নেতাদের বিদায় জানানোর মুহূর্তে, কমিউনিস্ট সংগঠক হিসাবে তাঁদের আদর্শ গুণগুলি তাঁদের ক্লান্তিহীন কর্মোৎসাহ, জনগণের প্রতি আশা ও ভরসা এবং বিপ্লবী কমিউনিস্ট ব্রতের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা আমাদের নিজেদের জীবনেও অবশ্যই আয়ত্ত ও আত্মস্থ করার অঙ্গীকার নিতে হবে।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য