“এখন আগুন চাই আমাদের এই কুঁড়েঘরে”
fire in this hut

কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়ের ৫০তম শহীদবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য

‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ আমূল নাড়া দিয়েছিল দেশের, বিশেষ করে বাংলার যুবসমাজকে। পরাধীন ভারতে নির্মম সামন্তী শোষণ আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বর্বর শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তেভাগা, তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, আর অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের আত্মদানের কথা তাদের শৈশব কৈশোরে বেড়ে ওঠার পরতে পরতে মিশে গিয়েছিল। বহু আকাঙ্ক্ষিত, রক্তে ধোওয়া স্বাধীনতার দুটি দশক পেরিয়ে গেলেও কোথায় মানুষের সসম্মানে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা, স্বস্তির দু’মুঠো অন্ন? শান্তির আশ্রয়? কোথায় বৈষম্যহীন সমাজ? এইসব প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত সময়েই, ১৯৬৭তে ঘটে গেল ‘নকশালবাড়ি’।

গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার, শ্রমিক-কৃষকের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন আরও হাজারো তরুণ-তরুণীর মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র মুরারিকেও উদ্বেল করে তুলেছিল। দক্ষিণেশ্বর আড়িয়াদহের যুবক, কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়। নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিন্তু সংস্কৃতি-অনুরাগী পরিবারের সন্তান মুরারি। সংগীত-প্রেমী স্কুলশিক্ষক বাবা সন্তোষ মুখোপাধ্যায় গ্রামোফোন কেনার মত আর্থিক সাচ্ছল্য না থাকায় নিজেই একটি তৈরি করে নিয়েছিলেন। কবিতা লেখা ও আবৃত্তি করার সূত্রে মুরারি এলাকার বিভিন্ন গণসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই সময়ে আড়িয়াদহ দক্ষিণেশ্বরে ছাত্রদের একটা অংশ প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। আড়িয়াদহ দক্ষিণেশ্বর তখন হয়ে উঠেছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের ত্রাসের জায়গা। টেক্সম্যাকো কারখানার লড়াকু শ্রমিক নেতা কানাই ভট্টাচার্য এবং যতীন দাস সহ বারাসাত গণহত্যাকাণ্ডের আট শহীদের সকলেই ছিলেন আড়িয়াদহ দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা। ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর হাত বাঁধা অবস্থায় বারাসাতের বড় রাস্তার ওপর পাওয়া গিয়েছিল অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত ৮ জন যুবকের মৃতদেহ। এঁরা হলেন কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশ ঘটক, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, তরুণ দাস, সমরেন্দ্র দত্ত ও স্বপন পাল।

মুরারি এলাকার যুবছাত্রদের বিপ্লবী রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্রী কোচিং সেন্টার চালাতেন, সাংস্কৃতিক পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতেন। নকশালবাড়ির রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ায় এমএ ফাইনাল পরীক্ষা আর দেওয়া হল না। সিপিআই(এমএল) গঠনের পরে তিনি আড়িয়াদহ-দক্ষিণেশ্বর আঞ্চলিক পার্টির দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি গ্রামে চলে যান এবং পার্টির ‘বাংলা বিহার উড়িষ্যা সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটি’র কাজের সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ মুরারি, ওরফে আনন্দকে, পুরুলিয়ার বহড়াগাড়ো-চাকুলিয়া অঞ্চল থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ঠাঁই হয় বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই দুপুর আড়াইটায়, জেলে কারারক্ষীদের লাঠি ও গুলিতে শতাধিত বন্দী আহত হন, মারা যান মুরারি সহ ১৬ জন। রাষ্ট্রের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর বর্বরতায় শহীদ হলেন মুরারি মুখার্জী, বিজন, মিশ্র, ডি কে, ডাম্বেল, বাবি, চির, প্রদীপ, বেণু, অলক, সুনীল, গণেশ, গুরুচরণ, রবীন অধিকারী, মাধবানন্দ এবং সমীর। ২৬ বছরের তরুণ মুরারি সহ ঐ শহীদদের মৃতদেহ পর্যন্ত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার সাহস হয়নি খুনী প্রশাসনের।

মুরারি পার্টির প্রতি কর্তব্যে ছিলেন অটল। দৃঢ়সংকল্প মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকশন মুহূর্তেও থাকতেন সংযত, ধীর। কথিত আছে তিনি বোমের মশলাভর্তি ব্যাগের মধ্যে রবীন্দ্ররচনাবলীও সঙ্গে রাখতেন। জীবনে স্বাভাবিকভাবেই প্রেম এসেছিল, কিন্তু বৃহত্তর সংগ্রামের আহ্বানে ঘর ছেড়ে ছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবী কবি মুরারি।

সব রাজ্যের মতো বিহার সরকারও সেন্ট্রাল জেলের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের জন্য তদন্ত কমিশন বসিয়েছিল, কিন্তু সেই কমিশনের রিপোর্ট দিনের আলোর মুখ দেখেনি কোনোদিন।

৫০তম শহীদ বার্ষিকীতে, সিপিআই(এমএল)-এর নেতা ও নকশালবাড়ি আন্দোলনের সংগঠক শহীদ কমরেড মুরারি মুখোপাধ্যায় সহ সমস্ত শহীদদের জানাই লাল সেলাম।

- তথ্যসূত্র: ‘মিলনসাগর’

খণ্ড-28
সংখ্যা-28