নতুন সিনেমাটোগ্রাফ আইন – আবার নতুন কায়দায় কণ্ঠরোধ
Again in a new way

সত্যজিৎ রায়ের ১০০ বছর চলছে। আর আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদী শাসকেরা যে সত্যজিৎ রায়দের মতো সিনেমা পরিচালকদের ভয় পেয়ে থাকেন, তা আবারো প্রমাণ করলেন। তাঁদের মধ্যে যে ভয় আছে, যে সিনেমা বা ছবি অনেক সময়ে দর্শকদের তাতিয়ে দিতে পারে, সেই ভয় থেকেই তাঁরা নিত্য নতুন আইন আনছেন। অথচ ভাব করছেন তাঁরা যেন কত গণতান্ত্রিক।

গত ২৫ জুন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি অসাধারণ টুইট করেছেন। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ১৯৭৫ সালের কথা, যেদিন মধ্যরাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর ২৬ জুন সকাল থেকেই লাগু হয়েছিল জরুরি অবস্থার সমস্ত নিয়মনীতি, বন্ধ হয়েছিল মত প্রকাশের অধিকার। এই বছরের ২৬ জুন একটি সর্বভারতীয় দৈনিকের উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছেন এখন আমাদের যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর কলমেও একই কথা উঠে এসেছে যে ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্র কতটা খারাপ ছিল এবং এই একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যদি কথা না বলা যায় আজকে, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর। তাহলে কি আমরা এই মুহূর্তে ২০১৪ সাল থেকে অত্যন্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে আছি? এখন কি আমাদের মত প্রকাশের অধিকারের ওপর কোনও বাধাই নেই? এখন কি যেকোনও মাধ্যমে আমরা আমাদের মতো সরকারের সমালোচনা করতে পারি? সামাজিক মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম এমনকি সিনেমা টিভি বা হালের ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণ করার যে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন খবর আসছে তা সম্পুর্ণ মিথ্যে?

তথ্য কিন্তু তাই বলে না। এই তো কিছুদিন আগেই মঞ্জুল বলে এক ব্যঙ্গচিত্র শিল্পীকে সামাজিক মাধ্যম টুইটার চিঠি পাঠায় যে কেন তাঁর আঁকা নরেন্দ্র মোদীর ব্যঙ্গচিত্রটি টুইটার থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না? শুধু সেখানেই বিষয়টি থেমে থাকেনি, মঞ্জুল যে সংস্থায় কাজ করতেন সেখান থেকেও তাঁর চাকরি গেছে। ঘটনাচক্রে সেই সংস্থার যিনি কর্ণধার এবং সেই সর্বভারতীয় দৈনিক যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উত্তর সম্পাদকীয় ছাপা হয় দুজনেই একই ব্যক্তি। আসলে ১৯৭৫-এ যা ঘোষণা করে জারি হয়েছিল, তা ২০১৪ সাল থেকে অঘোষিতভাবেই জারি আছে।

গত ফেব্রুয়ারী মাসে যে নতুন আইন আনা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে যে এই সময়ে প্রতিটি সামাজিক মাধ্যম সংস্থাকে একজন করে ভারতীয় অফিসার নিয়োগ করতে হবে, যিনি দেখবেন যে, কোনও মানুষ সামাজিক মাধ্যমে কোনও দেশ বিরোধী লেখা বা ছবি বা ভিডিও পোষ্ট করছেন কি না, যদি করেন তাহলে তা চিহ্নিত করে সরকারকে জানাতে হবে, না হলে এরপরের দায় শুধুমাত্র সেই পোষ্ট যিনি করেছেন শুধু তাঁর উপরেই পড়বেনা, ওই সামাজিক মাধ্যম সংস্থার উপরেও বর্তাবে। সরকার মামলা করলে পোষ্ট যিনি করেছেন এবং সেই সংস্থা, দুজনের বিরুদ্ধেই করতে পারেন। সরকার কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। সরকার বলেছে, বিভিন্ন যে ছবি বা সিনেমা তৈরি হচ্ছে তাঁদের আরও সেন্সর করার অধিকার চেয়েছে। এই আইনটির একটি পোশাকি নাম আছে। সিনেমাটোগ্রাফ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০২১, যাতে বলা হয়েছে, যে সেন্সরের ছাড়পত্র পেয়ে একটি সিনেমা বের হয়ে যাওয়ার পরে যদি দর্শকেরা কোনও কিছু নিয়ে অভিযোগ করেন, তাহলে সরকার ইচ্ছে করলে আবার সেই দৃশ্যকে বাদ দিতে পারবে। যদিও মন্ত্রক থেকে বলা হয়েছে যে এই নিয়ম আগেই ছিল যে, কোনও সিনেমা যদি সেন্সরের শংসাপত্র পেয়ে রিলিজও হয়ে যায় তাহলেও পরে তা নিয়ে আবার নতুন করে ভাবনাচিন্তার অবকাশ থাকে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে যে একবার কেন্দ্রীয় ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড শংসাপত্র দিয়ে দিলে তা আর ফেরানো যায় না। কিন্তু সরকারের যুক্তি যে ওই আইনের ৫বি ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও সিনেমাতে দেখা যায় যে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতা ধবংস হচ্ছে, তাহলে সরকারের সেই ছবির অংশকে বাদ দেওয়ার অধিকার ছিলই। যদিও এই নিয়ে আইনি লড়াই চালু হয়েছে, কিন্তু এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে সরকার এই বিষয়ে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে রাজি নয়। এছাড়াও তাঁরা কেবল টিভি এবং ছোট ছোট সংবাদ সংস্থার জন্যেও একই ধরনের আইন আনতে চাইছে।

যদি খেয়াল করা যায়, প্রথম যখন কৃষক আন্দোলন চালু হয়, ছোট ছোট খবরের সংস্থার খবরই থাকতো সামাজিক মাধ্যম জুড়ে। তারপর সেই খবর দেখার পর যখন দেখা গেল ওই অবস্থানে বসেই অন্তত দুশো কৃষক মারা গেছেন, তখন বিদেশের নানা তারকারা এই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কথা বলতে শুরু করেন। সরকার সেদিনই প্রমাদ গোনে, তাঁদের মনে হয় এরফলে সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে, তখনই তাঁরা ওই আইটি আইন আনার কথা ভাবেন। তাঁরা জানেন যে, বড় বড় সংবাদসংস্থা সরকারের কথা শুনে চলতে বাধ্য, কিন্তু এই ধরনের ছোট সংস্থা বা টিভি সিরিজ বা সিনেমা অথবা লোকাল কেবল টিভি দিয়ে যদি দেশবিরোধী চিন্তা জাগ্রত হয়ে যায়, তাই ছোট ছোট সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আসলে একদিকে তাঁরা জরুরী অবস্থার বিরোধিতা করবেন আর পাশাপাশি সেই একই নিয়ম চালিয়ে যাবেন, অর্থাৎ গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করবেন, এটাই এই সরকারের মুলমন্ত্র। যাতে সরকারের স্বরূপ সাধারণ মানুষ সহজে চিনতে না পারে। কিন্তু আমরা কি চিনতে পারছি না? আমরা কি ইতিহাসকে ভুলে যাবো? আমরা কি জানি না, যে ফ্যাসিবাদ আসলে কায়েম করা হয়, সাংস্কৃতিক জগত দিয়েই? আমরা কি ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্রকে হারাই নি? আমরা কি ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে যে হিটলারের ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল তাকেও পরাজিত করিনি?

আসলে ক্ষমতা থাকলে তার বিরোধিতাও থাকে, তাই এই নতুন সিনেমাটোগ্রাফ আইনের বিরোধিতায় প্রাথমিক ভাবে শাবানা আজমি, অনুরাগ কাশ্যপ, নন্দিতা দাশ সহ ১,৪০০ জন সিনেমা জগতের মানুষ চিঠি লিখেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীকে, যে এই আইন অবিলম্বে ফেরত নিতে হবে। লড়াই ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার লড়াই, ‘দড়ি ধরে মারো টান’ এর লড়াই।

- সুমন সেনগুপ্ত

খণ্ড-28
সংখ্যা-25