সংসদের বাদল অধিবেশনের আগে মোদী সরকার মন্ত্রীসভার বড় রকম রদবদল কার্যকর করল। তার আগে বেশ কিছু মন্ত্রী, পরিবর্তনের স্বার্থে ইস্তফা দিলেন, কারও কারও দায়িত্ব অদলবদল হল বা গুরুত্ব বাড়ানো-কমানো হল, কেউ কেউ আবার একেবারে আনকোরা — এই প্রথম মন্ত্রীত্বে ‘অভিষেক’ হল। মোদীর স্ব-ঘোষিত নীতিবাক্য — ‘ন্যূনতম প্রশাসন অধিকতম শাসন’ দ্রুত একেবারে উল্টোমুখে ঘুরে হয়ে গেল ‘গোদা প্রশাসন, অশ্বডিম্ব শাসন’!
এই বিরাট তৎপরতার তাৎপর্য কী? গুরুত্বপূর্ণ যেসব দপ্তর এই রদবদলে নাড়া খেয়েছে, সেগুলো অতিমারী পরিস্থিতিতে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম, পরিবেশ, তথ্য ও সম্প্রচার এই সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের সব ক’টিরই মাথায় বদল ঘটেছে। নিঃসন্দেহে, সরকার এর মধ্যে দিয়ে এই বার্তাই তুলে ধরতে চাইছে যে তার কাজ কর্মের উন্নতি ঘটাতে সে বদ্ধপরিকর। যেসব মন্ত্রী ভালো কাজ করতে পারেননি তাদের সরতে হয়েছে — এই সরকারি প্রচারই বিভিন্ন মহলে গুঞ্জরিত হচ্ছে।
এই মেগা রদবদল একটা প্রশ্নকে প্রকট করে তুলেছে। অতিমারী পরিস্থিতিতে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক যদি কাজে ব্যর্থ হয়ে থাকে, তাহলে গোটা সরকারটাই ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবে না কেন? সরকারের এই ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কেন মুখ্যত দায়ী হবেন না? ইঞ্জিনই যখন অচল, তখন কয়েকটি বগি পাল্টে আর কী উপকার হবে? নতুন নতুন বলির পাঁঠা খোঁজাটা স্পষ্টতই এর উত্তর নয়!
কোভিড১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় মোদী সরকারের পর্বতপ্রমাণ অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলাজনিত ব্যর্থতা এবং পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে বিজেপি’র প্রচণ্ড থাপ্পড় খাওয়া — বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি’র অন্দরে মতবিরোধকে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। মন্ত্রীসভার এই পরিবর্তন আসলে সেই সংকটকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা। নির্বাচনমুখী উত্তর প্রদেশ পেল সাত সাতজন মন্ত্রী। নির্বাচন-উত্তর পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে বিজেপি জনতার রায়কে বানচাল করে দিতে এবং রাজ্য সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলতে আদা-জল খেয়ে লেগেছে, সেখান থেকে এলেন একধিক মন্ত্রী, যাদের মধ্যে একজন আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র ডেপুটি। অন্যান্য মন্ত্রীদের অনেকেই অন্য রাজ্যগুলি থেকে একই ধরনের ‘বিবেচনা’ থেকেই নির্বাচিত হয়েছেন।
বিজেপি’র রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই, নতুন মন্ত্রীদের অনেকেই নানা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত। অনেকেই তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের জন্য কুখ্যাত। এই নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীই অ্যালোপ্যাথি সম্পর্কে তাচ্ছিল্যসূচক চপল মন্তব্য করেছিলেন। মন্ত্রী বাছাইয়ে সবচেয়ে নির্লজ্জতা প্রকাশ পেল অনুরাগ ঠাকুরের ক্ষেত্রে — ইনি সেই বিজেপি নেতা যাকে দিল্লী নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন প্রচার থেকে বিরত করেছিল তার আগুন-লাগানো হুঙ্কার ‘গোলী মারো’র জন্য। এই হুঙ্কার গত বছর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লীতে সত্যিই হিংস্র তাণ্ডব জ্বালিয়ে তুলেছিল যা কয়েক ডজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ভারতে যদি সত্যিই আইনের শাসন বহাল থাকতো, তাহলে অনুরাগ ঠাকুরের এখন জেলের ভিতর থাকা উচিত ছিল। পরিবর্তে তাকে তথা ও সম্প্রচার মন্ত্রকের ক্যাবিনেট মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
মন্ত্রীসভার রদবদল চিত্রনাট্যের সবচেয়ে ষড়যন্ত্রমূলক এবং বিস্ফোরক অংশটি হল — অমিত শাহ’র সহযোগিতার জন্য এক নতুন মন্ত্রক সৃষ্টি যার মাথায় থাকবেন তিনিই। কৃষি ও সমবায় ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিল অনুযায়ী রাজ্যের বিষয়। গতবছর মোদী সরকার কৃষিকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিসরে অনুপ্রবেশ করে তিনটি আইন পাশ করে, যে আইন বাতিলের দাবিতে গণবিক্ষোভ জ্বলে ওঠে এবং এক শক্তিশালী আন্দোলন জারি রয়েছে। এবার সরকার অমিত শাহ’র অধীনে নতুন সমবায় মন্ত্রক তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে আরেক বার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দিল।
এই পদক্ষেপ গভীর আশঙ্কাময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বার্তা বহন করছে। সমবায় ক্ষেত্র গ্রামীণ অর্থনীতির এক শক্তিশালী অংশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, বিশেষ করে বিপণন ও ব্যাঙ্কিং-এর ক্ষেত্রে। অনেক রাজ্যেই ডেয়ারি, চিনি/আখ সমবায়, সুতা কাটা ও বস্ত্র বয়ন এবং এই ধরণের যৌথ দরকষাকষি সংস্থাগুলি গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সমবায় ব্যাঙ্কগুলি কৃষকদের ও গ্রামীণ উৎপাদকদের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে ঋণ সরবরাহের প্রধান উৎস। মোদী সরকার ইতিমধ্যেই কৃষি এবং ব্যাঙ্কিং, উভয় ক্ষেত্রকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে দুটি ক্ষেত্রেই বড় ধরনের সংস্কারে হাত দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সমবায় মন্ত্রক তৈরি করা আসলে সেই অভিমুখে আরও একটি পদক্ষেপ।
সমবায় ক্ষেত্রগুলি বিভিন্ন রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক সক্রিয় শক্তিগুলির মধ্যে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিজেপি ক্রমশ গোটা কৃষক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে অ-বিজেপি শাসনে থাকা রাজ্যগুলি ক্রমশ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এই দুটি বিষয়কে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে, উপরের ক্ষেত্রগুলিতে বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, বিজেপি’র বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের পাওয়ার লবি তৈরির উদ্দেশ্য নগ্ন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘকালীন কৃষি সংকট এবং প্রলম্বিত অতিমারি এবং লকডাউন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির বিপর্যয় ও ধ্বসের কারণে অনেক জায়গাতেই গ্রামীণ সমবায়গুলি খুব সংকটজনক অবস্থায় আছে। এই সংকট এবং কর্পোরেট আগ্রাসনের চাপের মোকাবিলার জন্য চাই ব্যাপকতর অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সরকারি সহায়তা। অন্যদিকে মোদী সরকার এই সংকটে সমবায়ক্ষেত্রের দখল নেওয়া এবং এটিকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনা তথা আরও বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের বিজেপি’র ছককে কাজে লাগানোর আরেকটা সুযোগ খুঁজছে।
- এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়