লকডাউনে নারীর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ততার ক্ষয়
Loss of women's freedom

ভারতবর্ষের শ্রমজীবী ও গরিব মানুষদের জীবন ও জীবিকায় ধারাবাহিক লকডাউন চূড়ান্ত ভোগান্তি ডেকে এনেছে। বর্তমান অতিমারীকে সামলাতে ও মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সরকার ব্যর্থ। তার পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর জনগণের জীবিকা, খাদ্য-সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধির দিকে নজর না দিয়ে অপরিকল্পিত লকডাউন লাগু করা হচ্ছে বারংবার। সমাজের বিভিন্ন অংশে এই ধারাবাহিক লকডাউনের প্রভাব ভিন্নতর। লকডাউন লাগু করার প্রক্রিয়া অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়েছে এবং অনেক বেশি মানুষকে দারিদ্র্য সীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে। উপরন্তু, জনসংখ্যার দলিত ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের জন্য অধিকতর অমানবিক হয়ে উঠেছে এই লকডাউন। লকডাউনকে ঢাল করে মুসলিম মানুষদের নিশানা বানানোর দৃষ্টান্ত বেড়েছে। এবং সমাজে নারীর অবস্থানকে সামগ্রিকভাবে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদনটির আলোচনা এগোবে নারীর কর্মসংস্থান ও স্বায়ত্ততার নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ভিত্তি করে।

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষপ্রধান সমাজের একটি রূঢ় বাস্তব লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারী ও অন্যান্য নিপীড়িত লিঙ্গের মানুষদের প্রান্তিকীকরণ। নারীকে অধীনে রাখা সামাজিক অনুশীলন যেটিকে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা অনেক বেশি শক্তিশালী করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। মোদী পরিচালিত বিজেপি সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে নারীর উপর নির্ধারিত মনুবাদী নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত। ঐতিহাসিকভাবে, নারীকে দমিয়ে রাখার অন্যতম অস্ত্রগুলি হল তার শ্রমের স্বীকৃতি না দেওয়া, অর্থনৈতিক উপার্জনের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা, গার্হস্থ্যের পরিধির মধ্যে তার চলাফেরাকে সীমিত করে দেওয়া এবং নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা। নারীর উপর দমনের সবকটি অস্ত্রকেই তীব্রতর করে তুলেছে লকডাউন।

লকডাউনে বাড়তে থাকা বাড়ির-কাজ ও হিংসা

সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে থাকার মোট সময় বেড়ে যাওয়ার দরুন, পরিবারের ক্ষমতার চেনা ছকগুলি নারীদের উপর গৃহ-কাজের বোঝা বাড়িয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সারা বিশ্ব ও ভারত জুড়ে নারীর উপর গৃহ-হিংসা ও হেনস্থা নানাভাবে বেড়ে চলেছে।

বাড়িতে থাকার সময় বাড়ার জন্য গৃহ-শ্রম ও পরিজনদের যত্নের কাজের ভারও বেড়েছে। পরিবারে নারীর সমাজ-নির্দিষ্ট লিঙ্গ-ভিত্তিক ভূমিকার দরুন লকডাউনে বেড়ে যাওয়া গৃহ-শ্রমের ভার অসমভাবে নারীর কাঁধেই চেপে বসেছে। ২০২০’র লকডাউনের উপর সিএমআইই’র তথ্যানুযায়ী, লকডাউনের আগের সময়ের তুলনায় বর্তমানে পুরুষদের গৃহ-শ্রমের জন্য বরাদ্দ গড় সময় বেড়েছে। কিন্তু অবৈতনিক গৃহ-শ্রমে নারীর বরাদ্দ গড় সময় পুরুষদের অনুপাতে অনেকটাই বেশি। দৈনিক ০.৫ থেকে ৪ ঘন্টা বাড়ির কাজে সময় দেওয়া পুরুষের শতকরা হার যেমন লকডাউনে বেড়েছে, তেমনই লকডাউনে বাড়ির কাজে ০ ঘন্টা দেওয়া পুরুষের শতকরা হারও বেড়েছে। গৃহস্থালিকে সচল রাখার জন্য কাজ না করে উপায় নেই নারীর, অন্যদিকে পুরুষদের সামাজিক অবস্থানের কারণে তারা চাইলেই উপেক্ষা করতে পারেন গৃহশ্রমের দায়ভার/দায়বদ্ধতা। মহিলাদের উপর বাড়তি গৃহ-শ্রমের বোঝাকে বুঝতে হবে বেকারত্বের লিঙ্গ-ভিত্তিক তাৎপর্য ও লকডাউনে মহিলাদের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের নিরিখে।

জীবিকা ও বাড়তে থাকা লিঙ্গ-ভিত্তিক ফারাক

নারীর উপর লকডাউনের প্রভাব নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করার আগে মনে রাখতে হবে, বিশেষত ২০১৪ সাল থেকে ভারত ধারাবাহিকভাবে বেকারত্ব ও লিঙ্গ-গত বিভেদের বৃদ্ধির মুখোমুখি হচ্ছে। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য থেকে জানা যায় গত ৪৫ বছরে ভারতে বেকারত্বের হার শীর্ষে পৌঁছেছে ২০১৭ সালে। পিএলএফএস-এর তথ্য দেখায় যে, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৭১ শতাংশ পুরুষ ভারতের কর্মক্ষেত্রের অংশ, অন্যদিকে মাত্র ২৩ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত।

শেষ কয়েক বছরে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিষয়ে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের দিকে নজর দিলে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রকৃতিটি বিশদে বোঝা যাবে। কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার বোঝায় একটি দেশের জনসখ্যার কত শতাংশ কর্মক্ষম ও কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে আগ্রহী। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে ২০০৪-০৫ ও ২০১৭-১৮’র মধ্যে শিক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-ভিত্তিক ফারাক কমেছে, অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে এই ফারাক বেড়েছে। নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার ২০০৬এ ৩৪ শতাংশ থেকে ২০২০তে ২৪.৮ শতাংশে নেমে গেছে (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৬ মার্চ ২০২০ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী)। কাজের সহজলভ্যতার ক্ষেত্রে বাড়তে থাকা লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য থেকে স্পষ্ট কীভাবে নারীদের উপর সামাজিক নিয়ম ও অবৈতনিক গৃহ-কাজের বোঝা চাপানো হচ্ছে। বর্তমান সময়েও এই পরিসংখ্যান বিস্ময়কর নয়, কারণ, দেশ চালাচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক দল যাদের আদর্শই হল নারীকে বাড়ির চৌহদ্দিতে বন্দী রাখা। আমরা বারংবার বিজেপির বহু নেতা, মন্ত্রীকে নারীদের উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে বা নারীকে দমিয়ে রাখার আদর্শ ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে দেখেছি। কেন্দ্রের মসনদে বসে থাকা দলটির রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল মনুবাদী আদর্শের প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করছি অর্থনৈতিক উপার্জনের সুযোগে নারীর অংশগ্রহণের ক্রমাগত ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে।

চাকরি ক্ষেত্রে তথৈবচ অবস্থার মাঝেই দেশে প্রথম লকডাউনের আগমনে ভেসে গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ ভারতীয়র জীবিকা। আজিম প্রেমজী ইউনিভার্সিটির ‘কর্মক্ষম ভারত ২০২১’ রিপোর্টের সিএমআইই-সিপিএইচএস তথ্য থেকে জানা যায় যে ২০২০’র এপ্রিল-মে মাসের লকডাউনে ১০ কোটি ভারতবাসী জীবিকা হারিয়েছে। ২০২০’র শেষের দিকে লকডাউন শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, অন্তত ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ জীবিকা ফিরে পাননি।

মহিলাদের চাকরি হারানোর পরিসংখ্যান পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ। কোভিড-১৯ লকডাউনের উপর আজিম প্রেমজী ইউনিভার্সিটির ‘কর্মক্ষম ভারত ২০২১’ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬১ শতাংশ পুরুষের জীবিকায় লকডাউনের কোনো প্রভাব পড়েনি, অথচ মহিলাদের জন্য এই পরিসংখ্যানটি মাত্র ১৯ শতাংশ। লকডাউনের পর ৭ শতাংশ পুরুষ নিজের জীবিকা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, যেখানে ৪৭ শতাংশ মহিলার পক্ষে নিজের কাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়েনি। এরথেকে স্পষ্ট যে বেকারত্বের কোপ মূলত মহিলাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে।

লকডাউনের ফলে নারীর উপর চাপানো অসম শ্রম-ভারের জন্য নারীর শ্রমকে মূল্য না দেওয়া লিঙ্গ-ভিত্তিক সামাজিক ভূমিকার স্পষ্ট অবদান রয়েছে। আসুন আরো বিশদে বোঝা যাক বিষয়টি।

কোভিডে সামনের সারির কর্মীদের মধ্যে বৃহত্তর অংশ মহিলারাই, যেমন আশা, অঙ্গনওয়ারী, এএনএম, মিড-ডে-মিল কর্মী, রন্ধন কর্মী, নার্স, রেশন ও জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব-প্রাপ্ত স্কুল টিচার প্রমুখ। বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি কাজে যুক্ত থাকার জন্য কোভিডে সংক্রমণের ঝুঁকি এদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু শ্রমিক হিসাবে ন্যূনতম আইনি স্বীকৃতিটুকু এরা পান না। এই স্কিম-ওয়ার্কারা বাধ্য হন অত্যন্ত কম ভাতায় (সাম্মানিকে) কাজ করতে। শ্রমমর্যাদা, ন্যায্য-মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষার কোনোটিই প্রাপ্য হয়না সামনের সারিতে কর্মরত নারীদের জন্য। প্রকল্প-কর্মীদের শ্রমের এই নির্মম অস্বীকৃতির জন্য মূলত দায়ি লিঙ্গ-বৈষম্য। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়, এই কর্মক্ষেত্রগুলিতে যুক্ত হয়ে মেয়েরা অতিরিক্ত ঝুঁকি নেন, কিন্তু কাজের জায়গাতেও তাদের শ্রম অস্বীকৃত থেকে যায়।

জরুরি কাজ ছাড়াও, হোটেল, হসপিটালিটির ব্যবসা, পাইকারি, রিটেলিং-এর কাজ ও ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকদের এক বড় অংশ মেয়েরা। বিশ্বজুড়ে, কোভিডের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রিগুলিই।

বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে লকডাউনের লিঙ্গ-ভিত্তিক প্রভাব দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ভারতের মতো একটি দেশে, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত ফারাক সবচেয়ে বেশি, সেখানে নারীর উপর লকডাউনের অসম বোঝা একটি রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত। যতদিন না সরকার ও সরকারি নীতি-প্রণয়নকারীরা নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের উপর লকডাউনের এই প্রভাবকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হচ্ছে, ততদিন লকডাউনের প্রভাব থেকে সেরে ওঠার যে কোনো চেষ্টাই বৃথা। বর্তমানের রাজনৈতিক নিয়তি স্বরূপ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটির নারীকে সম-নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ন্যূনতম উদ্দেশ্যটুকু নেই। এদের শাসনকালেই, মেয়েদের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও কাজের উপর আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। এই আক্রমণকে চিহ্নিত করা ও নারীর সম-অধিকারের লক্ষ্যে লড়াইকে তীব্রতর করা বর্তমানের শ্রমিক ও নারী আন্দোলনের আশু দায়িত্ব। নিজেদের উপর নেমে আসা অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্কিম ওয়ার্কারদের দৃপ্ত ও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ, আজকের শ্রমিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। শ্রমিক-বিরোধী শ্রম-কোড, অসংগঠিত শ্রমক্ষেত্রের সবিস্তার ও শ্রমক্ষেত্রে বাড়তে থাকা লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্রতর সংগ্রাম গড়ে তোলা আজকের প্রয়োজন ও সময়ের দাবি।

- সুচেতা দে
(ভাষান্তর: সম্প্রীতি মুখার্জি, ওয়ার্কার্স রেজিস্ট্যান্স, জুলাই ২০২১ থেকে)

খণ্ড-28
সংখ্যা-26