বিপুল মুনাফার বিরোধাভাসে সীমাহীন দারিদ্র
poverty hints at huge profits

ভারতের শীর্ষ ব্যাঙ্ক আরবিআই জানালো, ২০১৯-২০’তে ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট ৮৪,৫৪৫টি জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যার আর্থিক মূল্য হল ১,৮৫,৭৭২ কোটি টাকা। আর, এই সমস্ত আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে ব্যাঙ্কের কতজন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জড়িত, সে ব্যাপারে আরবিআই জানাচ্ছে এই সংখ্যাটা এখনও জানা যায়নি।

শীর্ষ ব্যাঙ্কের কাছে তথ্য জানার অধিকার আইনে একজন কর্মী অভয় কোলারকার প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা পাঠানোর পর এই তথ্য পেয়েছেন।

এদিকে, সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি ২৮ মে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে দেখালো যে, নির্দিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জে যে সংস্থাগুলো নথিভুক্ত রয়েছে, তারা মার্চ ২০২১ বিত্তবর্ষের শেষে বিপুল মুনাফা কামিয়েছে। প্যান্ডেমিকে দ্বিতীয় তরঙ্গে সাধারণ মানুষ, দেশের অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত, সেই বিরাট বিপর্যয়ের মধ্যে অকল্পনীয় হারে এই মুনাফা লাভ রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা।

বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত ৪,৪০৬টি কোম্পানি ২০২০’র সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে যে মুনাফা কামিয়েছে তার পরিমাণ হল যথাক্রমে ১.৫২ লক্ষ কোটি ও ১.৫৩ লক্ষ কোটি টাকা! ২০২১’র মার্চেপ্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ৯৩৫টি নথিভুক্ত কোম্পানি ১.৫৮ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আগের ত্রৈমাসিকে তাদের আর্থিক লাভের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট এখনো তিন-চতুর্থাংশ নথিভুক্ত সংস্থা প্রকাশ করেনি। এই কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে ২৫০ বিলিয়ন টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। পরিহাস এটাই, সংস্থাগুলো পর পর তিনটি ত্রৈমাসিকে ধারাবাহিকভাবে যতই বিপুল মাত্রায় মুনাফা কামাক না কেন, দেখা গেল ৩১ মার্চে প্রকাশিত ২০২০-২১এ ভারতের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ৭.৩ শতাংশ হারে।

সিএমআইই এই মুনাফা বৃদ্ধির হারকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে অ-বিত্তীয় সংস্থগুলোর (নন ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি) মুনাফা সংকুচিত হয়ে পড়ে, আর অপরদিকে বিত্তিয় পরিষেবা সংস্থা বা ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসে মুনাফা কেন্দ্রীভূত হয়। যদিও, মার্চের ত্রৈমাসিকে অ-বিত্তিয় সংস্থার অভিমুখে মুনাফা বৃদ্ধির হারে পরিবর্তন ঘটে, যা অর্থনীতির ক্ষেত্রে পণ্য পরিষেবা উৎপাদন করে থাকে। যে অ-বিত্তিয় সংস্থাগুলো ২০২০’র সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে যথাক্রমে ১১ এবং ১ শতাংশ লোকসান করে, তারাই ২০২১’র মার্চে লাভ করে ১৮.৬ শতাংশ হারে। অন্যদিকে, বিত্তিয় সংস্থাগুলোর লাভ হয় ২.১ শতাংশ।

দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট সেক্টরের ক্ষেত্রে অ-বিত্তিয় সংস্থাগুলোর মোট মুনাফা ২০২০’র সেপ্টেম্বরে ছিল ৭৩ শতাংশ, যা পরে ২০২১’র মার্চ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৭৮ শতাংশ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই মুনাফা এসেছে উৎপাদন খরচ হ্রাস করে — শ্রম সংকোচন করে, মজুরী কমিয়ে, নতুন কোন নিয়োগ না করে অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে অনেক বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া, নতুন কোন বিনিয়োগ না করা, ইত্যাদি। এটা স্পষ্ট, যে কোম্পানিগুলো মুনাফা যতই কুক্ষিগত করুক না কেন, তা দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে কোন ভূমিকাই রাখতে পারছে না। আর্থিক দুনিয়ার এক মেরুতে উৎকট কেন্দ্রীভবন, আর বিপরীতে সীমাহীন দারিদ্র ও দৈন্য — আজ কোভিড সময়ের নির্মম বাস্তবতা।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক।

গত মাসে ফোর্বস এক রিপোর্ট প্রকাশ করে দেখায়, কোভিড১৯’র টিকার উপর একচেটিয়া অধিকার কায়েম করার ফলে নতুন ন’জন অর্বুদপতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আর বাকি যারা রয়েছেন, তাদের সম্পদ কয়েক মাসে চোখ ধাঁধানো পর্যায় গেছে। এতো বিপুল মুনাফা অর্জন করা সত্ত্বেও কোথাও কাজের বাজারে গতি এলোনা। অর্থনীতিও পরিত্রাণ পেলনা সংকট থেকে।

এই সংকট আজ বিশ্বব্যাপী। ক’দিন আগে অক্সফাম এক রিপোর্ট প্রকাশ করে, ‘দ্য হাংগার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’। ওই রিপোর্ট জানিয়েছে, প্রতি মিনিটে বিশ্বে ১১ জন মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাচ্ছে। আর, সারা দুনিয়ায়, গত বছরের তুলনায়, দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা ছ’গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অতিমারির সময়ে ও দুনিয়া জুড়ে সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে ৫১ বিলিয়ন ডলার — বিশ্ব ক্ষুধা রোধ করতে রাষ্ট্রসংঘের যে তহবিল প্রয়োজন, এটা তার ছ’গুণ বেশি!

অতিমারি ছোবল মারার আগে থেকেই অর্থনীতির মন্থর গতি ও বিপুল মাত্রায় বেকারত্বের সাথে এই প্রথম কোভিডের দৌরাত্বে ৩২ লক্ষ মধ্যবিত্ত অবলুপ্ত হয়েছে — ভারতীয় অর্থনীতিতে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। কোভিডের আসন্ন তৃতীয় ঢেউ আবার দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে তা ভবিষ্যৎই বলবে।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-28
সংখ্যা-27