আমাদের চারপাশের অজৈব পরিবেশটি একটি বৃহৎ বাস্তুতন্ত্রের অংশ। কিন্তু তা যেন আর জড় বস্তুটির মতো আচরণ করছে না। তারা ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। গরগর করছে, থাবা ঘসছে। তারপর আছড়ে পড়ছে সমস্ত জগত সংসারের উপর। কেন? জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ বিশেষ করে কিছু লোভী-স্বার্থান্বেষী মানুষ তাকে যত্রতত্র যেমন খুশি আঘাত করছে, হত্যা করছে। বৃক্ষনিধনে উষর মরুভূমি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরফ গলছে। সমুদ্র জল-তলের উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গরমে এসি চলছে, ফ্রীজ তো আছেই। এরা বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করছে। আর তা গ্রীন হাউস রক্ষাকারী ওজোন স্তর ফুটো করে দিচ্ছে। পৃথিবীতে প্রবেশ করছে অতিবেগুনী রশ্মি। জল বাতাস মাটি আজ সব দূষিত। আমপান, ইয়াস ইত্যাদি যা দেখছি তা সেই নিধনেরই সন্তান। যেন শোধ নিচ্ছে অন্যায় অত্যাচারের। কিন্তু শোধটা যে ভুল জায়গায় পড়ছে। অসহায় গরিব মানুষ তো কোনো অন্যায় করেনি। অথচ তাদের নাকের উপর দিয়ে জল যাচ্ছে।আর আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “সমুদ্রে যদি বিপ্লব হয়, নদীতে যদি বিদ্রোহ হয় আর গাছে যদি তাণ্ডব হয় - তাহলে তার থেকে কী করে উদ্ধার পেতে হয় তা একমাত্র আল্লা-ঈশ্বরই জানেন।” ভক্তদের মতো বলতে হয়, পরিবেশের কাছে মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। এবার একজন যুগাবতারের আবির্ভাব প্রয়োজন। না, তিনি তো এসেই গেছেন। এসেছেন বিভিন্ন রূপে। যেমন, বজ্রপাত, ঘুর্ণিঝড়, প্লাবন, টর্নেডো, সুনামী, ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি। এ পৃথিবীতে প্রত্যেকেরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তা সে জৈবই হোক আর অজৈবই হোক।
ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে সমুদ্রোপকুলবর্তী হতদরিদ্র মানুষের হাহাকারে বাতাস এখনও ভারী। তারমধ্যেই আবার ভারী বৃষ্টির সতর্কতা জারি হল। এই অসহায় নির্দোষ মানুষের কী হবে? উদ্ধার, ত্রাণ? সে নিয়েও অনেক কথা আছে। কিন্তু স্থায়ী ব্যবস্থা? এরজন্য পরিকল্পনা আছে সরকারের। তবে তা পুঁথিবন্ধ হয়ে ফসিলে পরিণত হচ্ছে। এই স্থায়ী ব্যবস্থার প্রথম ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল – স্থানীয় মানুষকে নিয়ে পরিকল্পনাকে জীবন্ত করার। আরও একটি সমস্যা হল, কথায় বলে “বিশ্ব নিয়ে ভাবো আর কাজ কর স্থানীয়ভাবে”। আমরা শহুরে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করছি নিজের ঘরে পাখার তলায় বসে। এটা করাতে আমার অধিকার আছে কি? খুব অসহায় বোধ করছি। তবুও কিছু কথা পরিকল্পনার পাতা থেকে নিয়ে ও নিজেদের ভাবনাচিন্তার মিশেল দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করা যাক।
স্থায়ী ব্যবস্থাগুলি হল, ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের পুনঃসৃজন, আইন মেনে কিছু বাছাই নদীর পাড় বাঁধাই, ফসল চাষ হয় এমন জমিতে নুন ও বালি ঢুকে যায় সেই মাটিকে চাষযোগ্য করে তোলা, এলাকার মানুষদের হাতে সারা বছর ধরে কাজ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইলেকট্রিক ব্যবস্থা চালু রাখা, ইকোট্যুরিজিম ইত্যাদি।
ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন পুনঃসৃজন
ম্যানগ্রোভ হল এমন কিছু গাছ যা নোনাজল ও মিষ্টি জলের মিলনস্থলে বেড়ে ওঠে। সুন্দরবন অঞ্চলে গাছগুলির নাম সুন্দরী, গেওয়া ও গরান। একসময় এই বাদাবন কতদূর বিস্তৃত ছিল জানলে বিস্মিত হতে হয়। সে বৃটিশ শাসনের সময়। গ্রাম পত্তন হবে। নাহলে তাদের পুরীষ সাফ করবে কে? কোনো মহিলাকে ধরে এনে অত্যাচার করবে? কাটা হতে লাগল বাদাবন। কাটতে কাটতে থামল ক্যানিং-এ এসে। সাহেবরা বাংলো খুলে বসে গেল। আজ যদি সেই পরিমাণ বাদাবন থাকত তাহলে ঘূর্ণিঝড় নিশ্চয় একটু ভাবতো। কী এমন ক্ষমতা আছে এই জঙ্গুলে গাছগুলোর, যা তীব্র গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়ের গতিরোধ করতে পারে?
এই বাদাবনের গাছ ছোট্টবেলা থেকেই সমুদ্রের জোয়ার ভাটায় ঢেউয়ের সাথে দুলে দুলে খেলাধুলো করতে করতে সৈনিকের প্রশিক্ষণ নেয়। নোনাজল ছাড়াও এরা মাটিতে, বালিতে, পাথুরে জমিতেও বাঁচতে পারে। জলে পা ডুবিয়ে প্রবালের উপরও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এদের শ্বাসমূল মাটির উপর উঠে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। পৃথিবীর সমুদ্র তীরবর্তী অনেক দেশে এর জঙ্গল দেখা যায়। ছোটো জঙ্গুলে গাছ ১০ মিটার উচ্চতাও হতে পারে। বাঁচে ১০০ বছরেরও বেশি। যখন বন্যা বা ঝড়ে সমুদ্র ও নদী ফুঁসে ওঠে তখন এই গাছগুলো তাদের মোটা শক্তিশালী ঘন সন্নিবিষ্ট গুঁড়ি বা ঠেসমূল দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। জল থেকে বালি ও মাটি সরিয়ে পরিশ্রুত করে। এভাবে মিষ্টি জল সৃষ্টি করে সংলগ্ন নদীতে সরবরাহ করে।
এই গাছ নিজেই একটি প্রাকৃতিক বাস্তুব্যবস্থা সৃষ্টি করে। এখানে মাছ, ঝিনুক, নানারকম চিংড়ি ইত্যাদি পাওয়া যায়। এমনকি গাছগুলো বড় হলে তা জলের উপরে এসে পড়ে। তখন কিছু আনুবীক্ষণিক জীব তা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। মৎস্যজীবিদের কাছে এমন জায়গা হল স্বর্গ। মাছ দিয়ে হাজার রকম খাদ্য হয়। এর কাঠ দিয়ে নৌকা হয়, জ্বালানির কাঠ হয়। এরসাথে ফল-ফুলের চাষ যদি করা যায়, তাহলে পাখি-কীটপতঙ্গও আসবে। এভাবে মধুর চাষও হবে। সুন্দরবনে নাকি ফল ফলানো গাছ নেই। তাই এখানে পাখিদের কাকলিও নেই। বলেছিলেন স্থানীয় একজন গাইড। পশু-চারণভূমি হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমরা গর্বিত যে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চল হল আমাদের সুন্দরবন অঞ্চল। কিন্তু অবিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে জীবজগতের পরমবন্ধু অসাধারণ গুণসম্পন্ন এই বৃক্ষরাজি। সরকার বলছে স্থানীয় লোকেরা এরজন্য দায়ী। অথচ সত্যিটা হল এই যে, ভারতীয় জলাভূমির ৪০০ লক্ষ একর (এক একর = তিন বিঘা) ম্যানগ্রোভ বন সরকার নিজেই অন্য কাজে ব্যবহার করছে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সৃজন একটা সরকারি প্রকল্প। কিন্তু তা করতে হবে স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ করতে হবে। সেই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন বীজতলা করবে, গাছ বসাবে ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। সমুদ্র বা নদীর ধারে ধরে এই জঙ্গল সৃষ্টি হবে। যা এখানকার মানুষের হাতে লাভের কড়ি তুলে দেবে। সমুদ্রজাত মাছ রপ্তানি করা যায়। এভাবে প্রতি একর জমিতে কয়েক লক্ষ টাকা আয় আসতে পারে। ফল, ফুল ও মধু চাষ করেও আয় বাড়াতে পারবেন। কিন্তু প্রাথমিক ও নিয়মিত ফান্ডিং তো সরকারকেই করতে হবে। যার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। অথচ সুন্দরবনের সুন্দরী, গরান, গেওয়া গাছেরা কিন্তু শেষ নিশ্বাস নিচ্ছে।
নদীর পাড় বাঁধাই
এটি নিয়ে বিতর্ক চলছেই। কারণ এতে জলের স্বাভাবিক জীববৈচিত্র নষ্ট হয়। পাড় বাঁধালে বাদাবন-সৃজন ব্যাহত হবে। পরিবেশবিদরা মাটির বাঁধ তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রবল জলোচ্ছ্বাস খুব সহজে এটি ভেঙে দেয়। পাড়ের মাটির চাঙড় নিয়ে ঝুপ-ঝুপ করে মাটির বাঁধ ভেঙে পড়ে। তারপর আবার তা নির্মাণ করতে কৃষকের জমি ধরে টানাটানি হয়। আর ক্ষতিপূরণের ঠিকঠাক পয়সাও মেলে না। এসব মাটি হল পৃথিবীর উপরিভাগের মাটি, যা চাষের জন্য সর্বোত্তম ও উর্বরও। কিছু ঘরোয়া কাজেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ঝড়ে ভাঙা বানে ভাসা মানুষকেও তো বাঁচতে ও বাঁচাতে হবে।
তাই কয়েকটি শর্ত মেনে কিছু বাছাই নদীর পাড় বাঁধানোর ব্যবস্থা করাই যায়। যেমন, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে কোনোমতেই কোনো ক্ষতি করা যাবে না। ‘কোস্টাল রেগুলেশন অঞ্চল’ খুঁজে বের করে সেখানে পাড় বাঁধানোর কাজ করতে হবে। এবিষয়ে আইনও আছে। আমাদের দেশের সমুদ্রপোকুলবর্তী অঞ্চলের ৭,৫০০ কিমি ধরে ৯টি রাজ্যে কাজটি হচ্ছে। তবে তা কতটা আইন মেনে হচ্ছে তাতে সন্দেহ। এর নির্দিষ্ট উচ্চতা ও অন্যান্য দিকগুলি মেনে বানাতে হবে। মাটির বাঁধ একেবারেই চলবে না। পাড়ে লোহার জালে পাথর ভরে ফেলতে হবে। এর উপরে মাটি ফেলেও ঘাস রোপন করা যায়। যাতে ক্ষয় কম হয়। চাষের ও পশু-চারণ এলাকার ক্ষতি করা যাবে না। বাইরের কোনো নোংরা মেশানো চলবে না। স্লুইস গেটগুলি ঠিক সাইজে ও কাঠামোয় বানাতে হবে। নির্মাণে স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করতে হবে। সেই জিনিষগুলি ব্যবহারের আগে পরীক্ষা করে নিতে হবে। বাইরের ঢালে ঘাস লাগাতে হবে। ফুল ও ফলের গাছ লাগানো যায়। যেখানে পাখি ও ছোটো প্রাণীরা তাদের বসবাসের জায়গা পেয়ে যায়। মাছের ভেড়ি করা যায়। এভাবে এলাকার মানুষের আয়েরও কিছু ব্যবস্থা হয়। পাড় বাঁধালেই কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছেনা। দরকার নিয়মিত দেখভাল। ফাটলের খোঁজ রাখা ও তা দ্রুত সারাই করা প্রয়োজন। জলে কোনো বাধা সৃষ্টি হচ্ছে কিনা, নোংরা জমছে কিনা, কোনো জল দুষণ হয়ে জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা, রোপিত বৃক্ষগুলি, ঘাসজমি ইত্যাদি অক্ষত থাকছে কিনা, এসবও নিয়মিত দেখভালের দাবি রাখে।
অতিরিক্ত জলের জন্য জায়গা ছেড়ে রাখা
সমুদ্র বা নদীতে যে জলোচ্ছ্বাস হয়ে জল পাড়ে উপচে পড়ে তারজন্য কিছু পরিমাণ জমি ছেড়ে দিতে হবে। মাঠের তুলনায় তা হবে নিচু ও ছড়ানো। ছড়ানো হলে তা শুকিয়ে উঠবে দ্রুত। স্লুইস গেটগুলো যেখানে থাকবে তা খুলে দিতে হবে সময়ে সময়ে। এই জল বসতবাড়িতেও ঢুকে পড়ে। সেক্ষেত্রে বাড়ির সামনে একটি পুকুর কেটে রাখে অনেকে। যা উঠোনের তুলনায় নিচু। জলোচ্ছ্বাসের জল বাড়ি ঢুকতেই সেই পুকুরে পড়বে। কিন্তু এতটা জায়গা কি এভাবে নষ্ট করা উচিৎ? তাই পুকুরের পাড়ে জাল বিছিয়ে লতা শ্রেণীর সবজি চাষ করা যায়। জাল বিস্তৃত হয়ে পুকুরের উপর কিছুটা বাড়িয়ে নিতে হবে। মশারির ছাদের মতো। লাউ, শশা, পুঁইশাক যত বাড়বে তা ওই জালের উপর চলে যাবে। জালের নিচে দিয়ে লাউ বা শশা কেটে নেওয়াও যাবে।
নোনামাটিকে চাষের উপযুক্ত করা
এটি সাইক্লোন পরবর্তী একটি প্রয়োজনীয় কাজ। মাটি থেকে নুন সরানো খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ৫ থেকে ৭ বছর সময় প্রয়োজন হয়। নানানভাবে এই নুন মাটি থেকে বের করে দেওয়ার প্রস্তাব আছে সরকারের। যেমন মাটি চেঁচে ফেলা বা লাগাতার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা, বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা, ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো কোনো কাজের নয়। যেমন, জল ঢেলে বা জমিয়ে মাটি ধোওয়ার কথাও আছে। কিন্তু জলের সাথে মাটিও তো চলে যাবে! যাকে বলে ভূমিক্ষয়। যার ফল, ফসলের ক্ষতি ও শেষমেশ আর্থিক ক্ষতি। বরং অনেক আগে নোনা মাটিতে আমাদের প্রপ্রপিতামহরা যে চাষআবাদগুলি করতেন, সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে।
যেমন বেশিমাত্রায় নুন থাকলে সেই মাটিতে খেজুর, বিট, বার্লি, তুলো, পালং, সূর্যমুখী ইত্যাদি চাষ করা যায়। নুনের ভাগ মধ্যমমানের হলে সেখানে গম, ধান, টমেটো, ওটস, কপি, গাজর, আলু, পেঁয়াজ, শশা, ডুমুর, আলু, বেদানা, চাষ করা যেতে পারে। এভাবে কয়েকটি চাষ ওঠাবার পর জমির নোনাভাব নিজেই চলে যাবে।
বৃক্ষরোপন
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। এটা করতেই হবে। নদী বা সমুদ্রের কাছাকাছি বাড়ি হলে এই দুই-এর মধ্যবর্তী স্থানে সারি সারি গাছ লাগাতে হবে। এরা হবে ঝড়ের সামনে সৈন্যসারি। ঝড়ের গতি যাবে কমে। কম হবে ক্ষয়ক্ষতি।
স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ
ঝড়ের সাথে ঝুঝতে পারে এমন বাড়ি চাই। সরকারি আবাস যোজনা আছে। কিন্তু আবাস নির্মাণ হয়নি বা তার মান অত্যন্ত খারাপ। কোনো কোনো স্থানে কয়েকটি করে বাড়ি দেখা গেছে। ইটের গাঁথনি দিয়ে দেওয়াল তোলা। ছাদে টিন বা টালি বা অ্যাসবেসটস।
অথচ, সুন্দরবনের বনাঞ্চল ও সমুদ্রোপকুলবর্তী কিন্তু জঙ্গল নয় এমন জায়গায় বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারকে পাকা বাসস্থান বাবদ ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দেওয়ার কথা রাজ্য সরকারের।
সে বাড়ি কেমন হবে? বিদেশে গ্রানাইটের বাড়ি এখন।
আমাদের জন্য ইট, বালি আর সিমেন্ট। আরসিসি একটি নতুন টেকনোলজি। অনেক বেশি টেকসই এটা। কিন্তু আমাদের জন্য দরজা তৈরি হবে ধাতুর পিপে কেটে, স্ক্রু দিয়ে জোড়া দিয়ে। জানালাতেও ওই ব্যাপার। না হলে জালের বিনুনি পেঁচিয়ে। অভঙ্গুর কাঁচের ব্যবহার আমাদের বিলাসিতা হয়ে যাবে। ছাদ হবে পিরামিডের মতো ও তার মাথাটি সরু হয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে যাবে। জল বেরোনোর নালাগুলো ঠিক কাজ করছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। মেঝে থাকবে পরিষ্কার, যাতে চলাচলের সুবিধা থাকে। এরসাথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, গ্রামের মানুষদের এরকম বাড়ি বানাতে উৎসাহিত করতে হবে, বাড়িটি কোথায় হবে সেই স্থানটি খুঁজে বের করা হবে প্রথম কাজ এবং বাড়ির চারপাশে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক।
আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা
ঝড় বা বন্যার সতর্কতা জারি হলে আশ্রয়স্থল নির্মাণ করার তৎপরতা দেখা যায়। কেন? এটা সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নয় কি? অস্থায়ীর থেকেও অস্থায়ী একধরনের আশ্রয়স্থল সরকারি গাইডলাইনে আছে। এগুলি কেমন? ঘর থেকে তুলে উঁচু জায়গায় রাখা। খুব বেশি হলে একটা তাঁবু মিলতে পারে। এবার নাকি ৪,০০০ আশ্রয়স্থল তৈরি হয়েছে। কোভিডের কারণে বেশি সংখ্যায় করে। আবার বলছে, ২০ লক্ষ মানুষকে সরানো হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে ৫০০ জন পিছু এক একটি আশ্রয়স্থলে ছিল বা আছে। কোভিডের বাজারে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই কাঠামোগুলিও অবশ্য আগে থেকেই করে রাখা দরকার। তাছাড়া গ্রামের স্কুল, পুজো মন্ডপ বা আটচালাগুলোও ব্যবহার করা যায়।
গৃহপালিত প্রাণীগুলোর জন্যও কিছু আশ্রয় ও খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এরা গরিবের সন্তানতুল্য। আয়ের উৎসস্থলও। এটা আমরা ভুলে না যাই।
বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা অক্ষত রাখা
এ নিয়ে সরকারি নির্দেশ আছে। কিন্তু সেও তাত্ত্বিক। যেমন, মাটির নিচে দিয়ে কেবল নিয়ে যাওয়া। এর প্রধান অসুবিধা হল অত্যধিক চড়া দাম। যেখানে নতুন আবাসন শহর আছে, অর্থাৎ অধিবাসীদের ঘনত্ব যথেষ্ট বেশি, সেখানে চড়া দামটা উঠিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু গ্রামে দূরে দূরে এক একটা বাড়ি। সেখানে ফ্রীজ, এসি এসব কোথায়! সেখানে এটা করা মানে বিদ্যুৎ কোম্পানির বিশাল আর্থিক ক্ষতি। এর ওপর সমস্যা হল কেবল্ চুরি। এ ঠেকানো মুশকিল। ইঁদুরেরাও কেটে দিতে পারে। টেলিফোনের যোগাযোগ থেকে কম শক্তিশালী বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফাইবার অপটিক লিঙ্কের মাধ্যমে আসতে হবে যাতে গ্লাস মাধ্যম প্রয়োজন। কিন্তু এটাও অসম্ভব। কারণ কাঁচ তৎক্ষনাৎ ফেটে যায়। বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারগুলো উঁচুতে তুলে দেওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো খুবই কম ক্ষমতা সম্পন্ন। তাহলে সৌরশক্তি কি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে? সেক্ষেত্রে প্রাথমিক খরচটা বেশি হলেও পরের খরচ সামান্য। এখানে একটা সমস্যা – সৌরশক্তিকে ব্যাটারির মাধ্যমে ধরে রাখা যায়। কিন্তু ব্যাটারিগুলোর মূল্য যথেষ্ট চড়া। আর তাই তা চুরিও হয়। কিন্তু দিনের বেলা স্কুলে, বা ঘরে পাখা চালাতে ব্যবহার করা যায়। সমস্তটা বিচার করলে মাটির নিচে কেবল-ই সব থেকে কার্যকরি। তবে সরকারকে একটু বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। গ্রামগুলিতে না হলেও শহর বা শহরতলি অঞ্চলে মাটির নিচে কেবল্ পাতা যেতে পারে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
সড়কপথে যাতায়াত করার রাস্তাগুলো নির্দিষ্ট করতে হবে। বাস, অ্যাম্বুলেন্স, টোটো এগুলোও হাতের কাছে রাখা উচিত।
টেলিযোগাযোগ
ইয়াসে তেমন গাছ পড়েনি। কিন্তু আমপানে সেটাই যেন ছিল ভয়াবহ। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়েছিল। আলো না হলেও চলে। কিন্তু জল? কাকে জানাবে? কীভাবে জানাবে? টেলি-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রাজ্যজুড়ে মানুষের বিক্ষোভ। বিএসএনএল’কে সরকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে জিও’কে জীবন দিচ্ছে, সেই বিএসএনএল’কে দায়িত্ব দেওয়া হল। পরে জিও এসে বলল, “৭০% কাজ আমরা করে দিয়েছি”।
তিনটি কোম্পানি মিলে একটি অস্থায়ী মোবাইল স্টেশন করেছে এরাজ্যের কোথাও কোথাও। একে বলে ‘ইন্টার সার্কল রোমিং’ (আইসিআর)। যার ফোনে বিএসএনএল-এর সিম, তিনি হয়তো সে লাইনটি পাচ্ছেন না। তখন আইসিআর-এর মাধ্যমে ওই তিনটি কোম্পানির যে কোনো একটির যোগাযোগ পেতে পারেন। এই তিনটি কোম্পানি হল জিও, এয়ারটেল ও ভোডাফোন। তবে দীর্ঘ সময় বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ব্যহত হলে এই ব্যবস্থা কার্যকরি হবে না। এসব অতিরিক্ত কাজ করতে অতিরিক্ত সেলও হুইলে চাপানো দরকার। আর তা করতে যথেষ্ট পরিমাণে ডিজেল ও ব্যাটারি স্টোর করতে হবে। আরও যা লাগবে তা হল টেলিকম টেকনিশিয়ান। এরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লাগাতার খেয়াল রাখবেন ওভারহেড ফাইবার অপটিক কেবল্-এ কোনো ত্রুটি দেখা দিচ্ছে কিনা। তাহলে তারা সাথে সাথেই সেটা সারিয়ে তুলবেন। এই কাজগুলি যারা করবেন তাদের শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাবে বিপুল গতিসম্পন্ন ঝোড়ো হাওয়া। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে হবে তাদের। তাই তারা কাজের এলাকার কাছাকাছি আশ্রয় ও খাদ্যবস্তুর দাবি তুলেছেন।
আমপানে যে বিক্ষোভ হয়েছিল তা নাকি উপরতলা ও নিচেরতলার মধ্যে বোঝাবুঝির অভাবজনিত। আসলে বিষয়টা হল অতিরিক্ত টিম হাতে ছিল না। এছাড়া মাইকিং, হ্যান্ড মাইক, হুইসেল ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
সরকার কী কী করছে
সরকার প্রচুর প্রচার করেছিল। মানুষকে কী কী করতে হবে সেসবও জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার নিজে কী কী দায়িত্ব পালন করেছে? সুন্দরবনে যারা গেছে ত্রাণ ইত্যাদি দিতে তারা তেমন কোনো আশ্রয়স্থল দেখতে পায়নি, খাবার জল নেই, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা দু’একদিন বাদে-বাদে খিচুড়ি দিয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘দুয়ারে ত্রাণ’ হয়ত এসে ফিরে গেছে, দুয়ার খুঁজে পায়নি কিনা! কিন্তু সবথেকে বড় অপরাধ করেছেন তিনি, দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। আমজনতার সামনে তিনি বলেছেন যে, ব্রিজগুলো এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ল কেন? ১৩৫টা ফাটল কেন হল? দু’বছর হয়ে গেল ব্রিজ তৈরি হল না কেন? অনেকে মনে করলেন, এই তো মুখ্যমন্ত্রী এবার নড়ে বসেছেন। এবার একটা কিছু হবে। কিন্তু দু’দিন পরই যখন মাননীয়া দলত্যাগী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করে বললেন যে, রাজীব কিছুই করেনি, চুরি করা ছাড়া – তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে ।
আমাদের অন্যভাবে ভাবতে হবে
১) যে পরিকল্পনাই হোক না কেন, সেখানে বেশ কিছু স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে রাখতে হবে।
২) আমাদের সরকারের উচিত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এক বিরাট প্রতিনিধিত্ব সহ কৃষি বিজ্ঞানী, ম্যানগ্রোভ বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ, বিদ্যুৎ ও টেলিকম বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এখনই একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম ও কর্মসূচি বানানো।
৩) বাদাবনের পুনঃসৃজন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ওইসব এলাকার মানুষদের জীবনও পুনঃস্থাপনের কর্মসূচি বানাতে হবে। সুন্দরবনের বহু দ্বীপ আছে যা ক্রমশ জলের নীচে চলে যাচ্ছে। সেখানকার মানুষদের আগে উদ্ধার করতে হবে। সাইক্লোনপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষদের তুলে আনতে হবে এবং ধীরে ধীরে সব মানুষকেই সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
৪) সরকার তাদের জমি নির্দিষ্ট মূল্যে ক্রয় করে বৃক্ষরোপণ করতে পারে।
৫) শহরের কাছাকাছি আবাসন নির্মাণ করে শুরু হবে তাদের নতুন জীবন। সেখানে স্কুল, বাজার, সড়ক যোগাযোগ থাকবে।
৬) পেশা কী হবে? ম্যানগ্রোভ বনসৃজনই তো বিরাট শ্রমনিবিড় এক কর্মকাণ্ড। তাছাড়া মাছধরা, মধুসংগ্রহ এগুলোও থাকবে।
৭) ইকোটুরিজম – সুন্দরবনের সৌন্দর্য শুধু নয়নের সুখ নয়, অনেক শিক্ষাও নেওয়ার আছে ওদের কাছ থেকে। লঞ্চে ঘুরতে ঘুরতে চা পান করে যেই না কাপটা জলে ছুঁড়তে গেছি, গাইড ছেলেটি চেচিয়ে উঠল, “না না জলে না, আমাকে দিন”। নদীতে কিছু ফেলা নিষিদ্ধ, ফেললে ওদের ফি থেকে কেটে নেবে কর্তৃপক্ষ। ছোটো ছোটো চা দোকানেরও একই ছবি। অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলিতেও তাই। আমরা অবাক! আমরা শহুরে তো! যখন ফিরে আসছি তখন জোয়ারের টলটলে জলে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ। গাছগুলো সব জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে কাগজ পড়ে থাকলে এই ছবিটার তাল কেটে যেত। সরকারি থাকার জায়গা আরও করা দরকার। কলকাতার এত কাছে, সেরকম হলে ভ্রমণপাগল বাঙালি ছুটবে।
৮) স্থানীয়দের সচেতন করা – এমন কিছু কঠিন ব্যাপার বলে মনে হয়নি।
আমরা যদি সত্যিই কিছু করতে চাই তাহলে আমাদের অকুস্থলে যেতে হবে। হুড়মুড় না করে ধৈর্য ধরে ওখানকার মানুষদের কথা শুনতে হবে, দেখতে হবে কী কী ব্যবস্থা বর্তমানে কী অবস্থায় আছে। এরজন্য ওখানে থাকা প্রয়োজন। ওখানে বেশ কয়েকটি জায়গায় আমাদের সাথীরা যখন যাচ্ছেন অনেক নতুন মানুষের মধ্যে তার প্রভাব পড়ছে। এগুলো আমাদের সাহায্য করবে।
শহরাঞ্চলে আলোচনা বা সেমিনারও করা যায়। কারণ অনেক বিতর্কিত বিষয় আছে। সেগুলো বুঝে নেওয়া দরকার। আর হ্যাঁ, সেখানে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদেরও নিতে হবে।
- অশনি সাংকৃত্যায়ন
(সহযোগিতায় : অনির্বাণ চক্রবর্তী, কৃষি বিজ্ঞানী ও অর্চিস্মান রায়, প্রযুক্তিবিদ, বিদ্যুৎ বিভাগ)