বৈচিত্র্যময় ভারতীয় সমাজ।
বামপন্থী, প্রগতিবাদী শিবিরের গণ আন্দোলনের কর্মীরা যত বেশি এই বৈচিত্র্য সচেতন থাকতে পারবেন, ততই ছোট-বড় হস্তক্ষেপে গণ আন্দোলনের বৃহত্তর বৃত্তে সংগঠিত করার কাজটা আরো মসৃণ হয়ে উঠতে পারে।
৩০ জুন হুল দিবস। এটি শুধুমাত্র একটি দিবস পালন নয়, আসলে এটি এক সচেতনতা; ভারতীয় সমাজের গঠনের চলমান প্রক্রিয়ায়, সামাজিক-রাজনৈতিক বিকাশে ভারতীয় সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নানা অংশের ভূমিকা সম্পর্কে সামগ্রিক বোধ সঞ্চারের ও তার স্বীকৃতির জন্য লড়াইয়ের দাবি নিয়ে আসে হুল দিবস।
এই স্বীকৃতি থেকে জনজাতির মানুষ আজও বঞ্চিত। কলকাতার বুকে রাস্তার নাম জননায়ক সিদো-কানহুর নামাঙ্কিত করে দায়িত্ব শেষ হয় না। হুল দিবসের মঞ্চে তাই অবাক জিঞ্জাসায় প্রশ্ন ওঠে, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুদের জন্মদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্র পালন করা হয়, কিন্তু ব্রিটিশ দখলদারদর বিরুদ্ধে জনজাতি গণবিদ্রোহের দুধর্ষ নেতানেত্রী সিদো-কানহু-চাঁদ-ভৈরঁ-ঝানো-ফুলো-বীরসাদের জন্মদিন কেন সর্বজনীন পালনীয় নয়!!
৩০ জুন, ১৮৫৫-তে বিদ্রোহের শুরু, শেষ ১৮৫৬-তে। বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি, গ্রামের পর গ্রাম সেদিন রক্তাক্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ সহ এদেশীয় মহাজন, জমিদার অত্যাচারীদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিলেন সিদো, কানু, চাঁদ, ভৈরো, ফুলো, ঝানো ভাইবোনেরা। প্রাণ দিয়েছেন, ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতীয় কৃষকের জাগরণের এই দিনে পথে নামতে প্রস্তুত থাকেন বাংলার কৃষক জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ভাগীদার আদিবাসী কৃষকরা। সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং তার সহযোগী আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এই জাগরণ, এই বিপ্লবী চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আদিবাসী কৃষকদের স্বাতন্ত্র্যকে বিশেষ মর্যাদা দিতেই ২০১৭-তে বাঁকুড়ার মাটিতে গড়ে ওঠে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ। হাসা, ভাষা, লায়লাকচার (জমি, ভাষা, সংস্কৃতি)-কে কেন্দ্রীয় শ্লোগান রেখে আত্মপরিচিতির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ে কয়েক হাজার আদিবাসী মানুষ ২০১৮-র নভেম্বরে সমবেত হয়েছিলেন কলকাতার বুকে, অধিকার যাত্রায়।
২০২১-এ নির্বাচন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আয়ারলা ও আদিবাসী মঞ্চের হুগলি জেলা নেতৃত্ব ৩০ জুন ‘হুল ক্রান্তি’- কৃষক জাগরণের দিন রূপে পালনের ডাক দেয়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে পৌঁছানোর ডাক দেওয়া হয়। দেখা গেল, ধনেখালি, পোলবা, বলাগড়ের বহু গ্রামে আদিবাসী জনগণ মঞ্চের ডাকে সাড়া দেন। সকাল থেকেই বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী জনগণের সমাবেশ থেকে লোকনায়ক সিদো, কানুর পাশাপাশি দুই বীরাঙ্গনা ফুলো, ঝানোকে স্মরণ করা হয়। এই কৃষক বিদ্রোহীদের পথেই আজকের অধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়া হয়।
দুপুর ২টা থেকে পান্ডুয়ার তিন্না মোড়ের কাছাকাছি একটি আদিবাসী মারঘাটীর সামনের মাঠে মঞ্চ বেঁধে অধিকার মঞ্চের জেলা সভানেত্রী ময়না কিস্কুর নেতৃত্বে স্থানীয় আদিবাসী জনগণ ব্যাপক ও আন্তরিক অংশগ্রহণ করেন। আয়ারলার জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন বাগের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান কেন্দ্রীয় কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অনুষ্ঠান সুচারুভাবে পরিচালনা করেন মঞ্চের জেলা নেত্রী সরস্বতী বেসরা। শুরু থেকেই অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত থেকে সহায়তা সুনিশ্চিত করেন কিষান মহাসভার জেলা সম্পাদক মুকুল কুমার। তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্যে ৩০ জুনের তাৎপর্য সবার মনে দাগ রেখে যায়। মঞ্চের জেলা সম্পাদক পাগান মুর্মু, জেলা নেতা সজল দে সহ অন্যরা বিশেষ সম্বর্ধনা স্বরূপ উপহার তুলে দেন অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক স্থানীয় আদিবাসী মাঝিবাবাদের হাতে। কিষান ক্রান্তির বার্তা বারংবার তুলে ধরার পাশাপাশি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করে।
পরবর্তী আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে শেষ হয় ২০২১-এর হুল ক্রান্তি দিবস পালন। সিদো, কানু অমর রহে। শহীদ কমরেড ফুলো, ঝানো লাল সেলাম।
পাগান মুর্মু
সজল অধিকারী