ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের তিন স্টুডেন্ট-কর্মীকে জামিনে মুক্তি দিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের রায় বহু প্রতীক্ষিত এক মুক্ত বাতাসের মতো আসে। গণতন্ত্রের শ্বাসরুদ্ধ করে দিল্লি পুলিশ গত বছর থেকে যে গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি দেবে এই রায় : সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর-এর মতো অন্যায় বৈষম্যমূলক ফ্যাসিস্ট আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গণতন্ত্রের সংগ্রামে আশা ও সাহস জুগিয়েছে।
আসিফ ইকবাল তানহা, নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কলিতা — জামিনে মুক্তি পাওয়া এই তিনজন ছাত্রছাত্রী সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যেতে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে নিজেদের অটল রাখেন। কারাগারে নিক্ষেপ (এবং নাতাশার ক্ষেত্রে, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বাবাকে শেষ দেখা দেখতে না পাওয়া) এই তরুণ লড়াকু সাথীদের স্তব্ধ করে দিতে পারেনি।
দিল্লি হাইকোর্টের পক্ষ থেকে জামিনের এই নির্দেশ সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদের কর্মীদের দিল্লি পুলিশ দ্বারা সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে খাড়া করার অন্তঃসারশূন্যতাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। “গণতন্ত্রের পক্ষে দুঃখজনক দিন” বলে অভিহিত করে দিল্লি হাইকোর্ট বলে, “বিরোধিতা দমন করতে মরিয়া হয়ে এবং সবকিছু হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার অসুস্থ ভীতির কারণে রাষ্ট্র সংবিধান বর্ণিত ‘প্রতিবাদের অধিকার’ আর ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’-এর মধ্যেকার পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছে” এবং “গণতন্ত্রকে বিপন্নতার পথে” নিয়ে চলেছে।
দিল্লি পুলিশ মোদি-শাহ-রাজের দাবার বোড়ে মাত্র এবং মোদি-শাহর প্রতিনিধিরা দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়কে অবমাননা ও তাচ্ছিল্য করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সরকারপক্ষ সুপ্রীম কোর্টে গিয়ে এই জামিনের বিরুদ্ধে আবেদন করেছে। সুপ্রীম কোর্ট জামিনে স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেছে, কিন্তু একই সাথে এই নির্দেশও দিয়েছে যে দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় অন্যান্য ইউএপিএ মামলায় নজির হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, মামলাটি আপাতত সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকছে।
অন্যায়ভাবে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে এই মহামারীকালে প্রাণসংশয়ে থাকা ব্যক্তিদের জামিনের ক্ষেত্রে দিল্লি হাইকোর্টের রায় যে ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু অন্তর্বর্তী রায়ে সুপ্রীম কোর্ট আপাতত তা আটকে দিল। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আসিফ, নাতাশা ও দেবাঙ্গনার জামিন-মুক্তি আটকাতে না পারলেও মোদি সরকার সুপ্রীম কোর্টের এই অন্তর্বর্তী রায়কে হাতিয়ার করে অন্যান্য সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের দিল্লি হাইকোর্টের যুক্তি ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে পারবে।
যাই হোক, দিল্লি হাইকোর্টের রায় কার্যত ঘোষণা করেছে যে ‘শাসক ন্যাংটা’, দিল্লি পুলিশের ইউএপিএ চার্জশিটের কোনও অন্তর্বস্তু নাই “ভাসা ভাসা বুলিসর্বস্ব অতিশয়োক্তি” মাত্র। এই “বিপজ্জনক বুলিসর্বস্ব বাগাড়ম্বর”-এর ধোঁয়াজালে বিভ্রান্ত না হয়ে হাইকোর্ট স্পষ্ট প্রতীয়মান সত্যকে তুলে ধরে বলেছে : সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে যে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে তা নিছক প্রতিবাদকেই প্রমাণ করে, তাকে “সন্ত্রাসবাদ” হিসেবে চিহ্নিত করা চলে না।
গত এক বছর ধরে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনের কর্মীরা যে কথা বারবার বলে আসছে — সংসদে পাশ হওয়া আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, চাক্কা জ্যাম বা রাস্তা অবরোধের ডাক দেওয়া ইত্যাদি দেশদ্রোহিতা বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ তো নয়ই, কোনও অপরাধই নয় — হাইকোর্ট সেই কথাটাই প্রতিষ্ঠা করেছে। আইন অমান্য আন্দোলন বা প্রতিবাদ সংগঠিত করাকে “সন্ত্রাসবাদ” আখ্যা দেওয়া এবং প্রতিবাদীদের অনির্দিষ্টকাল জেলবন্দী রাখতে ইউএপিএ ব্যবহার করা গণতন্ত্রকেই বিপদে ফেলে।
অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকারকেও হাইকোর্ট সঠিকভাবেই ডিমান্ড করেছে। ভারতে বিচারাধীন বন্দীরা বছরের পর বছর জেলে পচতে থাকে কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা জামিনের অযৌক্তিক শর্তগুলি পূরণ করতে বা খরচ জোগাড় করতে পারে না। এইসব বিচারাধীন বন্দীদের অধিকাংশই যে দলিত, আদিবাসী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ তা নিছক কাকতালিয় ঘটনা নয়। আর অধিকাংশ বিচারাধীন বন্দীই দরিদ্র। বীভৎস ইউএপিএ আইন সুপ্রীম কোর্টের সংকীর্ণ ও পশ্চাদমুখী ব্যাখ্যার সহায়তায়, জামিনের আবেদন শোনার যোগ্যতা বিবেচনা করে দেখতেও আদালতকে বিরত রেখে এরকম সুব্যবস্থিত অবিচারের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। মানবাধিকার কর্মীদের অনির্দিষ্টকাল জেলে পুরে রাখার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ইউএপিএ। কারণ পুলিশ ও এনআইএ-র মতো সংস্থা “তদন্ত” টেনে নিয়ে চলে বছরের পর বছর, আর সেই সময় জুড়ে অস্বীকার করে চলা হয় জামিনের আবেদন। দিল্লি হাইকোর্ট এর সংশোধন এনেছে কেরালা হাইকোর্টে নাজিবের জামিন মামলার নজির টেনে, যে মামলাকে সুপ্রীম কোর্টও ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। এবং দিল্লি হাইকোর্ট সমস্ত আদালতকেই একথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিচারাধীন ব্যক্তিদের দীর্ঘ কারাবাস এড়াতে জামিনের ব্যবস্থা করা আদালতেরই দায়িত্ব। এডিশনাল সলিসিটর জেনেরাল প্রস্তাব দেয়, “সংবিধানের ২১ নং ধারায় বর্ণিত দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকার সম্পূর্ণভাবে ও সর্বতভাবে লঙ্ঘিত হলে তখনই একমাত্র আদালতের উচিৎ অভিযুক্তকে রিলিফ দেওয়ার কথা ভাবা”। দিল্লি হাইকোর্ট এই প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
গণতন্ত্রের স্বপক্ষে লড়াই করা কর্মীরা গত বছর ধরে বলে আসছে যে দিল্লি পুলিশের তদন্ত অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের, বিশেষত ওই “দাঙ্গা” (বাস্তবে যা এক পরিকল্পিত সংগঠিত হিংসা)-র সবচেয়ে বড় শিকার যারা সেই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর জন্য দিল্লি পুলিশ ষড়যন্ত্রের উদ্ভট গল্প ফেঁদেছে। দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় সেই বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর বা অন্যান্য যেসব বিজেপি ও আরএসএস নেতারা ভিড় জমিয়ে প্রতিবাদীদের গুলি করে হত্যা করার জন্য প্রকাশ্য ডাক দিয়েছিল এবং দিল্লির রাস্তায় হিংস্র সশস্ত্র ভিড়কে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে নির্ধারণ করে দেওয়া নীতির সাথে সাযুজ্য রেখে প্রত্যেক ইউএপিএ বন্দীর অবশ্যই জামিন পাওয়া উচিৎ। কিন্তু শুধু ওটুকুতেই সুবিচার নিশ্চিত হতে পারে না। সুবিচার নিশ্চিত করতে দিল্লি পুলিশের এই তদন্তকে সম্পূর্ণত বাতিল করে দিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের তত্বাবধানে নতুন করে তদন্ত শুরু হওয়া দরকার; নিছক এক “ভাসা ভাসা বাগাড়ম্বর” দিয়ে তৈরি করা চার্জশীটের ভিত্তিতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের কারাবন্দী করা রাখার অপরাধে জড়িত পুলিশ অফিসারদের শাস্তি দেওয়া দরকার। এবং সর্বোপরি, দিল্লি পুলিশের প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ফলে এই মহামারীকালে জেলে থাকতে বাধ্য হলেন যারা সেই সব প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা দরকার।
(লিবারেশন সম্পাদকীয়, জুলাই ২০২১)