করোনাকালীন পরিস্থিতিতে নারীর বিপন্নতা বেড়েছে। গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে, নিজস্ব পরিসর কমছে, কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে, সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান কমেছে। সমাজের সর্বস্তরের মহিলাদের মধ্যেই কর্মচ্যুতর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু আরেক দিকে এক রূপোলি রেখাও স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। সংকট এত সূচিমুখ হয়ে উঠছে বলেই, সমান তালে বিভিন্ন মাত্রায় চলছে লড়াই। পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা রীতিনীতির শেকলে ঘা পড়ছে প্রতিনিয়ত।
‘বিবাহ’ এক বিশেষ প্রতিষ্ঠান, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এক অচ্ছেদ্য অংশ। যার মাধ্যমে ‘স্বামী’ স্ত্রীর ভরণ পোষণ ও মানসম্ভ্রম রক্ষার ভার বহনে প্রতিশ্রুত হন। এবং যার মাধ্যমে পিতা সালঙ্কারা কন্যাকে ‘উপযুক্ত’ পাত্রকে সম্প্রদান করেন, মানে ‘সম্পত্তি’ হিসাবে দান করেন।
ভরণ পোষণ? মানসম্ভ্রম রক্ষা? অন্য সবকিছু বাদ দিলেও, রাষ্ট্রের নিগ্রহ, নিপীড়ন থেকে স্বামী কী করে স্ত্রীকে বাঁচাবেন? অসমে এনআরসি’র বলি হয়েছেন মহিলারাই সবচেয়ে বেশি। লকডাউনে নিরুপায় স্বামী অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে চোখের সামনে মরতে দেখেছেন। স্বামী দায়ভার বহন করুন আর নাই করুন, মরিয়া সমাজ কিন্তু এখনও স্ত্রীকে স্বামীর ‘সম্পত্তি’ হিসেবেই দেখতে নাছোড়বান্দা।
কখনও নুসরতের বিয়ে বা তার সন্তানের পিতৃত্ব, কখনও আমির-কিরণের ডিভোর্স এরকম হাজার এক প্রশ্ন ঘিরে উঠে আসছে সেই আঘাত, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আমরা ছোটবেলা থেকেই একরকম পরিবার প্রতিষ্ঠানে তার নিজস্ব রীতিনীতি ধ্যান ধারণার মধ্যে আর পিতৃতান্ত্রিক, হেটেরোনরমেটিভ সমাজে বড় হয়ে উঠতে উঠতে সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। সমাজে এই প্রতিষ্ঠিত একক পরিকাঠামোকে মানতে আমরা বাধ্য। আর এই সমাজই ‘ভালো সম্পর্ক’ বা বলা ভালো ‘ভালো মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়। তথাকথিত ‘ভালো’ সম্পর্ক মানে যেখানে ‘আমি শুধু তোমার’ বলে মনের দরজায় খিল এঁটে বসে থাকি। ভালো মেয়েরা নিজেদের চাহিদার কথা বলেন না, পুরুষ চাইলে সোহাগে মোড়া হিসেবেই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও সবকিছু মেনে নেন। তাদের আর কাউকে কস্মিনকালেও ভালো লাগতে পারে না। নিজের শরীরের উপরেও তাদের কোনও অধিকার থাকতে পারে না। যৌন চাহিদার কথা বাদই দিলাম, গর্ভধারণও পরিবার ও স্বামী কর্তৃক নির্ধারিত, অত্যন্ত অবমাননাকর হলেও, সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখতে হবে সংসার সন্তানের কথা ভেবে, দরকার হলে পায়ে ধরে। এগুলোই বছরের পর বছর সংবাদমাধ্যমের প্রচার সৌজন্যে বা তথাকথিত নীতিকথার মোড়কে আমাদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌঁছে যায়। চলতে থাকে নিজেকে তৈরি করার প্রক্রিয়া, কমোডিফিকেশন। তাই সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালের উপর আঘাত সমাজ মানতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
এই কিছুদিন আগে গায়ের রং কালো বলে এক অভিনেত্রীকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল, চটুল মন্তব্য সহ্য করতে হয়েছে। কেন? তাঁর ‘অপরাধ’ সমাজ প্রতিষ্ঠিত ‘সুন্দর’এর সংজ্ঞা না মেনে তিনি অভিনয় জগতে কাজ করতে নেমেছেন! অর্থাৎ তাঁর অভিনয় ক্ষমতা নয়, তার গাত্রবর্ণই প্রধান বিবেচ্য! পুরুষের অভ্যস্ত ‘চোখ’কে তিনি কতটা ‘সুখ’ দিতে পারছেন, তার উপর তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করছে! কারণ এই সমাজ নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখতে শিখিয়েছে। পুরোমাপের একজন ‘মানুষ’ হিসেবে নয়!
এই করোনা পরিস্থিতিতে অনেক রকম ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, একাকীত্ব, মানসিক অবসাদ আমাদের গ্রাস করছে। প্রভাব ফেলছে সম্পর্কের উপরেও। স্বাধিকারের লড়াইটা বহু দিন আগে থেকেই প্রচ্ছন্ন থাকলেও, এই চার দেওয়ালে বন্দী হওয়ার দরুণই বোধহয় তা প্রকট হয়ে উঠছে। নারীর স্বাধিকার বোধ তীব্র হচ্ছে। মনের ‘খিল’ একটু হলেও শিথিল হচ্ছে। সেজন্যই হয়ত নুসরাত দৃঢ়ভাবে অন্তত বলছেন যে সন্তানের ‘পিতৃপরিচয়’ তিনি নিজে জানলেই যথেষ্ট বা আমির কিরণ প্রকাশ্যে বলছেন, তাঁরা সম্পর্কে হয়ত থাকবেন না কিন্তু পারস্পরিক সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। আর আমরা এতটাই বৈষম্যমূলক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ যে এই বিষয়গুলো মোটেই সহজভাবে নিতে পারছি না।
সমাজে সম্পর্কের মূল্যবোধের ধারণাকেও করোনা ঘা মেরেছে। সম্পর্কের ফাঁক ফোকরগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, ফাঁকিবাজিটা নগ্ন করে দিয়েছে। পরস্পরকে ভালোবেসে নিজেদের পছন্দে স্বামী-স্ত্রী বা লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা দু’টি নারী পুরুষ আগে বাইরের জগতে নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসরকে উপভোগ করার সুযোগ পেত — লকডাউনে চব্বিশ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক মুখোমুখি থাকার জীবনে যা হারিয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই নিজের ইচ্ছায় নিজস্ব পছন্দের জীবন বেছে নেওয়াটাই কি যথেষ্ট স্বাধীনতা নয়! নাহ, একদমই নয়। সম্পর্কটা একক প্রেম হোক, ‘স্পেস’ সম্পর্কিত হোক বা সম্পর্কটা বহুগামী হোক সেক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর দরুণই মহিলা এবং প্রান্তিক যৌনকামী মানুষজন নিপীড়ন বা শোষণের শিকার হয়ে পড়েন। কারণ ক্ষমতার নিরিখে এই উভয় সমাজ পুরুষের তুলনায় বহুধাপ নিচেই আছে। কাজেই সেই লড়াইটাও চালাতে হবে সমান তালে। সমাজে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কগুলোতে ‘দরকারের সময় পাশে থাকার’ একটা নিশ্চয়তা বা অঙ্গীকার থাকে যেটা সামাজিক নিরাপত্তা ও ‘ভালো’র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। লকডাউনে এই ‘ভালো’র খোলসগুলো আলগা হয়ে এসেছে। তাই উঠে আসছে এই বিতর্কগুলো, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের গোড়ায় আঘাত লাগার ফলে বাড়ছে অতীব বীভৎস ভাষায় আক্রমণ।
প্রেম বা সম্পর্ক মানে একজনের আরেকজনের উপর ‘দখলদারি’ নয়, একজন অপরজনের ‘সম্পত্তি’ নয়! ‘দখলদারি’র মনোভাব থেকেই আসে নিরাপত্তাহীনতা। সেটা থেকে বেরিয়ে এসে, একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করেই একে অপরের ভালো লাগা, ভালো থাকাগুলোকে জায়গা করে দিলে সম্পর্কগুলো আর ‘দমবন্ধ’ হয়ে, আধমরা হয়ে যাবে না। সেই বোঝাপড়া থেকে অনেক সম্পর্ক আবার সারা জীবন অটুট থাকে। এতক্ষণ যা নিয়ে কথা বললাম সেটার মতো এটাও সত্যি ও বাস্তব। কোনওটাই একটু বেশি ঠিক বা একটু বেশি ভালো নয়। এই গল্পগুলোই কিরণ আমির, নুসরতরা সটান বলেছেন বলে আমাদের গায়ে লেগেছে। কিন্তু অচলায়তন তো এভাবেই ভাঙে! আমরাও ভাঙব, শিখব এভাবেই একটু একটু করে।
- সৌমি জানা