রাষ্ট্রের চাপানো অভিযোগ খারিজ করল আদালত, মুক্তি পেলেন অখিল গগৈ
Akhil Gogoi was released_0

জেল থেকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসামের শিবসাগর আসন থেকে তিনি জয়ী হয়েছেন। এবার জেল থেকে তাঁর মুক্তি ঘটল – এনআইএ’র বিশেষ আদালত দানবীয় ইউএপিএ আইনে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে। তিনি আসামের সমাজ এবং মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রাইজর দলের নেতা অখিল গগৈ। রাষ্ট্রের চোখে তাঁর অপরাধ ছিল এই যে, তিনি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে তৈরি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর নির্দেশে এনআইএ তাঁকে গ্ৰেপ্তার করে জেলে পোরে। তাঁর বিরুদ্ধে মোট তেরটি অভিযোগ দায়ের হয়, আনা হয় মাওবাদী সংযোগের অভিযোগ; আরও অভিযোগ করা হয়, তিনি কয়েক হাজার জনতাকে সহিংস প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে হিংসায় উস্কিয়ে তুলেছিলেন, যে জনতা তারপর ইট-পাথর ছোড়ে এবং ভাঙচুর চালায়। তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগও ছিল যে, তিনি সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু এনআইএ’র আদালত বলেছে, “আপাতদৃষ্টিতে এমন কোনো নিদর্শন” পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যায়। রায়ে বিচারপতি বলেছেন, তাঁকে “হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না, যে ধ্বংসাত্মক এবং সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতির ক্রিয়াকলাপ চলে তার সঙ্গে তাঁকে সংযুক্ত করার মত কোনো নিদর্শনও নেই; বিপরীতে, হিংসা না চালানোর পরামর্শই তিনি জনগণকে দিয়েছেন এবং আন্তরিকভাবেই তা করেছেন বলে মনে হয়।” আদালত আরও বলেছে, আইনকে তার অনুমোদিত সীমার মধ্যেই প্রয়োগ করতে হবে, তার গণ্ডির বাইরে যাওয়া যাবে না। এরজন্য নির্দিষ্ট সংস্থা, এক্ষেত্রে এনআইএ’কে লাগাতার ‘চেতনাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত’ করে যেতে হবে। অখিল গগৈয়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যে কোনো ভিত্তি ছিল না, এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলন দমনের লক্ষ্যেই যে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়েছিল, আদালতের রায়ে তা সংশয়হীনভাবে বিধৃত। অখিল গগৈয়ের সঙ্গেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পেয়েছেন তাঁর তিন সহকর্মী — ধৈয্য কানোয়ার, মানস কানোয়ার ও বিটু সোনওয়াল।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অখিল গগৈ দাবি জানিয়েছেন, “আমার বিরুদ্ধে এনআইএ’র করা দুটো মামলাই খারিজ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এবং এনআইএ’র ডিজি’কে পদত্যাগ করতে হবে।” অখিল গগৈয়ের এই দাবির মধ্যে নির্দিষ্ট রূপে ধরা পড়েছে প্রশাসনিক সেই মাধ্যম যা ভারতকে এক পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্রিয়। নরেন্দ্র মোদী যদি রাষ্ট্রের সংবিধান-বিরোধী, গণতন্ত্র-বিরোধী দিশার কেন্দ্রীয় পরিচালক হয়ে থাকেন, তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, বিভিন্ন তদন্তকারী ও প্রশাসনিক সংস্থা এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরা কেন্দ্রের কামনার নির্দিষ্ট অভিমুখে রাষ্ট্রকে চালিত করার যন্ত্র হয়ে উঠেছে।

এনআইএ’র বিশেষ আদালত অখিল গগৈয়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আনা অভিযোগ খারিজ করতে গিয়ে যা বলেছে, তারমধ্যে প্রতিধ্বনিত দিল্লী দাঙ্গায় তিন অভিযুক্তর জামিন মঞ্জুরিতে দিল্লী হাইকোর্টের রায়। আসিফ ইকবাল তানহা, নাতাশা নারোয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতার জামিন মঞ্জুর করে দিল্লী হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে বলেন, “রাষ্ট্র সংবিধান প্রতিশ্রুত ‘প্রতিবাদের অধিকার’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের’ মধ্যে ভেদরেখাকে মুছে দিয়েছে এবং এইভাবে ‘গণতন্ত্রকে বিপন্ন’ করে তুলেছে”। ২০২০র ফেব্রুয়ারির দিল্লী দাঙ্গায় অভিযোগের যে জাল বোনা হয় তা যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তৈরি নীল নকশার অনুসারি সে কথা সুবিদিত। ওয়াকিবহাল মানুষ মাত্রেই জানেন, ঐ দাঙ্গার মূল প্ররোচকদের আড়াল করে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়। প্রাক্তন পুলিশ কর্তা জুলিও রিবেইরো পর্যন্ত দিল্লী পুলিশ কমিশনার শ্রীযুক্ত শ্রীবাস্তবের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে এই রাষ্ট্রীয় অনাচারের উন্মোচন না ঘটিয়ে পারেননি, “দিল্লী পুলিশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু যারা বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণ দিয়ে উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে দাঙ্গা উস্কিয়ে তোলে, সজ্ঞানে তাদের বিরুদ্ধে আদালতগ্ৰাহ্য অভিযোগ দায়ের করা থেকে তারা বিরত থেকেছে”। যারা দিল্লীর দাঙ্গার মূল হোতা বলে জুলিও রিবেইরো ইঙ্গিত করেছেন তারা যে বিজেপি ও আরএসএস নেতা ও কর্মী তা অকাট্য প্রমাণে ধরা আছে।

যে কোনো ধরনের সরকার বিরোধী প্রতিবাদকে নিশ্চিহ্ন করার মোদী সরকারের তৎপর উদ্যমের পরিণামে বহু সংখ্যক মানবাধিকার ও সমাজ আন্দোলনের কর্মী বছরের পর বছর জেলে পচছেন। তদন্ত শেষ করতে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর অনাগ্ৰহ এবং তদন্তকে স্বেচ্ছাকৃতভাবে প্রলম্বিত করায় অভিযুক্ত আটকদের জামিন লাভ অসম্ভব হয়ে উঠছে। ইউএপিএ এবং দেশদ্রোহ আইনের আকছার প্রয়োগ গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত করছে। তবে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু এবং নির্বিচার নিপীড়ন সত্ত্বেও জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিন্তু থেমে থাকেনি। দিল্লী হাইকোর্টের রায় এবং অখিল গগৈকে সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতির এনআইএ বিশেষ আদালতের রায় রাষ্ট্রের দমননীতিকেই কাঠগড়ায় তুলেছে। এই রায় দুটোতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কুশিলবদের কাছে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলার ইশারা – জেলে আটক সমস্ত মানবাধিকার কর্মী ও বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি সোচ্চার হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।

খণ্ড-28
সংখ্যা-25