২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের মৃত্যুদিন, ১৯৭২ সালে তাঁকে পুলিশী হেফাজতে হত্যা করা হয়েছিল। এবার ছিল ৪৯ তম শহীদ স্মরণ বার্ষিকী। ২৮ জুলাই আবার একইসাথে পার্টি কেন্দ্র পুনর্গঠনেরও দিন, পার্টি কেন্দ্রের পুনর্নির্মাণ হয় ১৯৭৪ সালে।
প্রত্যেক বছরের মতো এবছরেও ২৮ জুলাই যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে শহীদ স্মৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও অন্যান্য কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। কর্মসূচি সংগঠিত হয় রাজ্যজুড়ে জেলায় জেলায় অঞ্চলে অঞ্চলে। মিটিং, মিছিল, কর্মীসভা, গণ শপথগ্রহণ, সদস্যপদ প্রদান আলোচনা সভা, শিল্পকলা ও ডিজিটাল প্রদর্শন, সাংস্কৃতিক পরিবেশন ইত্যাদির মাধ্যমে দিনটি মনে রাখার মতো করে উদযাপন করা হয়। দাবি তোলা হয় — ইউএপিএ, সিডিশন অ্যাক্ট, এনএসএ ইত্যাদি রাষ্ট্রদ্রোহ আইন সহ সমস্ত দমন আইন প্রত্যাহার কর! মিথ্যা মামলা সহ রাজনৈতিক বিষয় ও আন্দোলন সম্পর্কিত সমস্ত মামলা তুলে নাও! সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাই! পার্টি নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও সমর্থকশক্তি একসাথে আরও একবার পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান নিয়ে চর্চা করেন। পার্টিকে জনগণের মধ্যে শক্তিশালী করে তোলা, ব্যাপক গণপ্রচার এবং আন্দোলন সংগঠিত করার সমন্বয়ে পার্টি সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, বিস্তার ঘটানোর অঙ্গীকার করা হয়।
কিছু কার্যক্রমের কথা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। শিলিগুড়িতে কমরেড চারু মজুমদারের বাসভবনে তাঁর মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়।
এছাড়া শহীদ স্মরণে মিছিল করে গিয়ে বাঘাযতীন পার্কে শহীদের আবক্ষ মূর্তির সামনে সভা করা হয়। বক্তব্য রাখেন অভিজিৎ মজুমদার, বাসুদেব বসু ও অন্যান্যরা। কলকাতায় পার্টির রাজ্য অফিসের সামনে শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়, বক্তব্য রাখেন দিবাকর ভট্টাচার্য। অফিস ঘরে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন অতনু চক্রবর্তী। পার্টির যাদবপুর-ঢাকুরিয়া আঞ্চলিক কমিটি এক আলোচনা সভার আয়োজন করে গড়ফা “সংস্কৃতি চক্র” সভাঘরে। বিষয় ছিল ‘রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর রাষ্ট্রের আক্রমণ’। বক্তব্য রাখেন বন্দীমুক্তি আন্দোলনের সুপরিচিত সংগঠক ছোটন দাস, পিইউসিএল-এর অম্লান দত্ত, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক প্রসেনজিৎ বসু, অধ্যাপক শুভনীল চৌধুরী, অধ্যাপক মানস ঘোষ এবং নিজের জীবনে ইউএপিএ আইনের নিপীড়ন কি দুর্বিষহ বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল সেকথা বলেন ডাঃ বিনায়ক সেন।
কৃষ্ণনগরে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ও মানবাধিকার আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সমন্বিত করে শহীদ স্মরণে মিছিল শহরের একাংশ পরিক্রমা করে। পরে তা এক সংক্ষিপ্ত সভার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন তাপস চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল চ্যাটার্জী ও জয়তু দেশমুখ। সঞ্চালনা করেন অমল তরফদার।
পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কার্যালয়ে (বেলঘরিয়া) দিনের বিশেষ কর্মসূচি ছিল আঞ্চলিক কমিটির পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে সভা। বিশেষত ছাত্র-মহিলা-শ্রমিক কমরেডদের উপস্থিতিতে এক প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। সভাকে সমৃদ্ধ করতে সহজবোধ্য বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত, সেই সঙ্গে উজ্জীবিত করে তোলা উপলব্ধি রাখেন ছাত্র সংগঠক দীপায়ন; স্থানীয় সংগঠক তন্ময় নন্দীর সমাপ্তি বক্তব্য ছিল প্রাঞ্জল।
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে এদিন গণ শপথকরণের মধ্য দিয়ে নতুন পার্টি সদস্যপদ প্রদান করা হয়। পার্থ ঘোষ দীর্ঘ কয়েক মাস যাবত কঠিন অসুস্থ থাকার মধ্যেও এদিন সংগঠনের উত্তরপাড়া-কোন্নগড় আঞ্চলিক সভায় আসেন এবং বক্তব্য রাখেন। কার্তিক পাল ছিলেন আসানসোলে শহীদ স্মরণ কর্মসূচিতে ও আলোচনা সভায়।
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ” শ্লোগানের শতবর্ষ পূর্ণ হল।
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ” শব্দবন্ধের স্রষ্টা মওলানা হাসরত মোহানি।
মওলানা “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” শব্দ বন্ধটি শ্লোগান হিসেবে সৃষ্টি করেন ১৯২১ সালে। তাঁর জন্ম হয় ১৮৭৫ সালের ১ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলার মোহানে, তাঁর জীবনাবসান হয় ১৯৫১ সালের ১৩ মে লক্ষ্ণৌতে।
মওলানার প্রকৃত নাম ফজল-উল-হাসান।
‘হাসরত’ তাঁর কলম নাম, যা তিনি উর্দু কবিতায় ব্যবহার করতেন, আর মোহানি শব্দটি যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেই মোহান স্থানটি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
মওলানা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চারজন প্রতিষ্ঠাতার একজন। তিনি শুধু “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” শ্লোগানের স্রষ্টা নন, পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষক-ও ছিলেন।
[বন্ধু গালিবের কাছ থেকে তথ্যটি পেয়েছেন] — অধ্যাপক শায়ক মুখোপাধ্যায়, বাংলা বিভাগ, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৈরি কমিটি পশ্চিবাংলার নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাসের তথ্য সম্বলিত রিপোর্ট পেশ করেছে। তবে তার কোনও সত্যতা পুনর্নির্বাচিত মমতা সরকার মানতে রাজি নয়। শাসকদল তৃণমূলের অবস্থানও যথারীতি তথৈবচ। এনএইচআরসি-কে কমিটি গঠন করে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। এক-দুই সদস্যের নয়, পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ। রাজ্য সরকার বলেছিল তার কোনও প্রয়োজন নেই। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ-প্রশাসন সব ম্যানেজ করে নেবে। কিন্তু সেই সওয়াল দাঁড়ায়নি। এখন বলছে, পেশ হওয়া রিপোর্ট রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মূলক এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সমস্ত অভিযোগ প্রবলভাবে অস্বীকার করছে। রাজ্য সরকারের বলছে — তদন্ত কমিটি গঠন, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ, গন্তব্যস্থল, তথ্যপ্রমাণ দাখিল — কোনোকিছুই প্রকৃত নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে হয়নি। আরও প্রশ্ন তুলেছে, গুজরাট-উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যে কোনও তদন্তের টিম পাঠানো হয় না কেন? উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর মধ্যে যুক্তি আছে। সন্দেহাতীতভাবে সিবিআই, নিয়া, ইডি ইত্যাদি কেন্দ্রীয় বিশেষ বিশেষ গোয়েন্দা পুলিশের জাল ও জাতীয় স্তরের মানবাধিকার কমিশনের নিয়ন্ত্রণ থাকে কেন্দ্রের হাতে, আর কেন্দ্র ওইসব হাতিয়ার ব্যবহার করে নিজপক্ষের কায়েমী স্বার্থে। এবারও তার অন্যথা হয়নি। কমিশনের তৈরি তদন্ত কমিটির মাথা সহ অন্তত তিনজনের নানারূপে বিজেপি সংস্রবের ডিএনএ রয়েছে। সত্যিই, যে উত্তরপ্রদেশ-গুজরাট হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক ফ্যসিবাদী আগ্রাসনে, বর্ণবাদী বা জাতপাতের হিংসায়, সংঘটিত হত্যা-গণহত্যায়, মুসলিম-দলিত-নারী-সাংবাদিক নিধন ও নিগ্রহে — সবকিছুতে সরকারের মদতে বা খোদ সরকারের সন্ত্রাসে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে; সেখানে কোনও স্তরের কোনও কমিশনের তদন্ত হতে দেখা যায় না। এই অর্থে এরাজ্যে সন্ত্রাসের ক্ষত খতিয়ে দেখতে মোদী সরকারের পদক্ষেপ যে বিজেপির স্বার্থেই তা আর অস্পষ্ট নেই।
কিন্তু মোদীর কেন্দ্র এবং বিজেপির বদ মতলব আছে বলেই রাজ্য সরকার আর শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ সব খারিজ হয়ে যায় না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৈরি কমিটির পেশ করা রিপোর্টে অভিযোগের সংখ্যা চৌদ্দশতাধিক। কমিটির টিম চক্কর দিয়েছে ঝড়ের গতিতে। সঙ্গে কেবল বিজেপির সাংসদ-বিধায়ক-নেতা-পারিষদদের দল। যদি ধরেও নেওয়া হয়, তৈরি রিপোর্টে প্রচুর রঙজল মেশানো, তবু আশ্চর্যের বিষয়, রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনে কোনও অভিযোগ পেশ হল না! থানায় সন্ত্রাসের কোনও এফআইআর জমা পড়ল না! এই মাত্রায় বৈসাদৃশ্য নিয়ে রাজ্যের শাসকেরা এতটুকু লজ্জ্বিত নয়, বিচলিত নয়, পরন্তু গলাবাজি করছেন!
রাজ্য সরকারের যখন ‘নিরীহ নির্দোষ’ নাম কেনার এতই ইচ্ছা, এতই দম্ভ, তাহলে রাজ্যের তরফে সন্দেহাতীত উদ্যোগ-সক্রিয়তা নেওয়া হচ্ছে না কেন? কেন রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনকে মাঠে নামানো হচ্ছে না? নিদেনপক্ষে থানাকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না কেন? কেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের দপ্তর এপ্রশ্নে মূক ও বধির? সবার ওপরে যাঁর অধিষ্ঠান, মুখ্যমন্ত্রী, তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সন্ত্রাসের অভিযোগ খতিয়ে দেখার পদক্ষেপ করবেন না কেন? নির্বাচনে জয়ের হ্যাটট্রিক আসলেই সন্ত্রাসের অভিযোগ স্বয়ংক্রিয় ভাবে নাকচ হয়ে যায় না। ‘পেগাসাস’ নিয়ে তো মুখ্যমন্ত্রী তুরন্ত্ তদন্ত কমিশন বসালেন। সন্ত্রাসের প্রশ্নে সেই সততা থাকছে না কেন? বিজেপি নিজেকে জাহির করার ফিকির খুঁজতে দাবি করছে সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে কেবল ‘তার কর্মী-সমর্থকরাই’। এই অপকৌশল ধর্তব্যের নয়। উপরন্তু হুমকি দিচ্ছে রাজনীতির বাজার তৈরি করতে। শোনা গেল বিজেপির দলনেতার ধমকি। জেলার পুলিশ সুপারের উদ্দেশ্যে। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশী তদন্ত বন্ধ না হলে কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে বদলি করে দেওয়া হবে জম্মু-কাশ্মীরে! বিজেপি বড় হয়ে ওঠার জমি পেতে শুরু করে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে। সেবার ব্যাপক ভোট পায় প্রধানত সিপিআই(এম) প্রভাবিত জনগণের অংশ থেকে। আর এবার ২০২১-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট বাড়ে তৃণমূল দলবদলুদের হাত ধরা কিছু অংশ থেকে। কিন্তু যারা সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন তাদের মূল পরিচয় হল তারা জনগণ। তারা সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন জনগণের বিভিন্ন অংশ হিসেবে। নিজস্ব বিচারের ভিত্তিতে ঠিক-ভুল যাইই হোক, তৃণমূলকে ভোট দেয়নি বলে। কিন্তু তা বলে তাদের ওপর তৃণমূলের সন্ত্রাস চালানোর এ্যক্তিয়ার জন্মে যায় না। গণতন্ত্রের অন্যতম মূল শর্ত হল বিরোধী ও সংখ্যালঘু মতের নিরাপত্তা ও সম্মান থাকতেই হবে। মমতা সরকার এই প্রশ্নে আদৌ গণতান্ত্রিক নিয়ম নিষ্ঠ নয়। তৃণমূল আমলের সবচেয়ে কলঙ্কের মুখ্য দুটি বিষয় হল, দুর্নীতি আর সন্ত্রাস। দু’দশকের এই প্রেক্ষাপটে তৃতীয় বার জিতে আসার পর বিরুদ্ধে চলে যাওয়া শক্তিগুলোর ওপর সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ খুবই সম্ভাব্য। তার জবাব দিতেই হবে তৃণমূলকে।
ইজরাইলি কোম্পানির কাছ থেকে কেনা পেগাসাস সফটঅয়্যার দিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে আড়ি পাতার কলঙ্কজনক ঘটনা প্রকাশিত হতে থাকায় মোদি সরকার যা প্রতিক্রিয়া দেখাল তা তাদের অপরাধি মনোভাবকেই খোলাসা করেছে। মন্ত্রীদের জবানে সরকার যা বলছে তা হল: “পেগাসাসকে আমরা আড়ি পাতার কাজে লাগিয়েছি এমনটা আপনারা কখনই প্রমাণ করতে পারবেন না। কিন্তু আড়ি পাতার কাজ যেটুকু করা হয়েছে তা আইনিভাবেই করা হয়েছে। অনেক দেশই পেগাসাস ব্যবহার করে। তাহলে শুধু ভারতকে কেন্দ্র করেই এত কথা কেন? পেগাসাস প্রজেক্ট তদন্ত আসলে বিজেপিকে ও ভারতের সরকারকে বদনাম করার ষড়যন্ত্র। যাই হোক না কেন, মাওইস্টদের ওপর আড়ি পাতার জন্য আমরা কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করছি না করছি তা বলব কেন?” এইসব গা-বাঁচানো কথাবার্তায় একটা জিনিস খুব স্পষ্টরূপে নজরে আসে। তা হল, সরকার পরিস্কার করে বলতে পারছে না যে তারা পেগাসাস কেনেনি বা ব্যবহার করেনি। যদি তারা পেগাসাস কিনে থাকে আর তা আইনি পথেই ব্যবহার করে থাকে তাহলে তা স্পষ্ট করে বলতে কোথায় আটকাচ্ছে?
পেগাসাস সফটওয়্যার দিয়ে যাদের ওপর ভারতে আড়ি পাতা হয়েছে সেই তালিকায় আছেন ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং প্রতিরক্ষা ও ইন্টেলিজেন্স প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা। আছেন সুপ্রিম কোর্টের এক বর্তমান বিচারক, বিরোধী দল নেতারা, সিবিআই-এর উচ্চ পদাধিকারীরা, বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক। আছেন ৬০ জন মহিলা যার মধ্যে এমন একজন আছেন যিনি যৌন হেনস্থার অভিযোগকারি, আবার এমন অনেকে আছেন যারা কোনও জনপ্রতিনিধি বা পাব্লিক ফিগার নন। ফোন প্রতি দেড় (১.৫) কোটি টাকা খরচ করে এরকম নির্বিচার আড়ি পাতার সিদ্ধান্তটা কোথায় বসে নেওয়া হয়েছিল? কাকে কী কারণে পেগাসাসের নিশানা বানানো হবে তা কে কোথায় বসে ঠিক করছিল? এবং, এইসব সিদ্ধান্ত কি কখনও কোনও সাংবিধানিক কর্ত্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল? ইজরায়েল রাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ একটি ইজরায়েলি সংস্থাকে ভারতের নাগরিকদের, এমনকি সেনাবাহিনী, ইন্টেলিজেন্স, রাজনীতি, সরকার ও বিচার বিভাগের মতো ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বে থাকা নাগরিকদেরও ব্যক্তিগত তথ্য এভাবে দিয়ে দেওয়া হল কেন? ভারতের সংসদে এবং জনতার সামনে এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে সরকারের এত অনীহা কেন?
কেবিনেট মিনিস্টার মীনাক্ষি লেখি গর্জে উঠে বললেন যে “মাওইস্ট”-দের ওপর নজর রাখতে সরকার কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করল না করল তা কাউকে জানাতে বাধ্য নয় সরকার। ভারত সরকার সাংবাদিকদের, বিরোধী নেতাদের, বিচারকদের, যৌন নির্যাতনের অভিযোগিকারীকে, মানবাধিকার রক্ষা কর্মিদের বা সরকারের নিজের মন্ত্রীদের ও আর্মি অফিসারদের কিসের ভিত্তিতে “মাওইস্ট” তকমা দিচ্ছে? স্পষ্টতই শাসক দল যাকে প্রতিপক্ষ মনে করছে তাদের তকমা দিতে “মাওইস্ট” শব্দটা সরকারি কোড হয়ে গেছে। এই স্পাইং আসলে ডাইনি-শিকার। তথ্য হল ক্ষমতা: সুতরাং এইসব নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে আড়ি পাতাটা আসলে সাংবাদিক, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও আন্দোলনকর্মিদের ওপর শাসক দলের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার হাতিয়ার। যে দেশে সাংবাদিক, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র সেনা, বিরোধী পক্ষ তথা মানবাধিকার রক্ষককে সর্বদা শাসক দলের রক্তচক্ষুর আতঙ্কে থাকতে হয় সে দেশ গণতান্ত্রিক দেশ হতে পারে না।
সরকারি নীতি নির্ধারণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সাংবাদিকরা মোদি সরকারের দ্বারা “এন্টি ন্যাশনাল” তকমা পাচ্ছে আর বে-আইনি চরবৃত্তির শিকার হচ্ছে। পেগাসাস চরবৃত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে মোদি সরকার “এন্টি ন্যাশনাল” বলে চিহ্নিত করছে। একইভাবে যেসব সাংবাদিক ও মিডিয়া হাউস কোভিড-মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে মোদি সরকারের আড়াল করা সত্যকে সামনে এনেছে তাদের হুমকি দিয়ে লাইনে আনতে ইনকাম ট্যাক্স রেইডের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যে গুটিকয় মিডিয়া হাউস কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ধাক্কার খবরাখবর তথা মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা আন্তরিকভবে তুলে এনেছে তার মধ্যে ‘দৈনিক ভাস্কর’ খবরের কাগজ ও ‘ভারত সমাচার’ টিভি চ্যানেল অন্যতম।
প্রকৃত পক্ষে দৈনিক ভাস্করের সর্বভারতীয় সম্পাদক নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি উত্তর-সম্পাদকীয় লিখেছেন, “গঙ্গা মৃতদেহগুলি ফিরিয়ে দিচ্ছে : গঙ্গা মিথ্যা বলে না” শিরোনামে। এই লেখায় তিনি চাঁছাছোলা ভাষায় “মোদি সরকারের নির্বোধ অবজ্ঞা”-কে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসার মূল ইন্ধন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কুম্ভ মেলা ও তারপর “গোটা রাজ্যে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটগুলিতে অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর ও বেড এবং শব দাহ ও দাফনের জায়গার চরম অভাব প্রকট হওয়া” সত্বেও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর “অস্বীকার ও হুমকি”-কে তুলে ধরেছেন তিনি। এবং তিনি তাঁর পত্রিকার তদন্তমূলক সংবাদদাতাদের সম্পর্কে লিখেছেন যারা গঙ্গায় ২০০০ শব ভেসে যেতে দেখেছেন, গঙ্গার তীরে ৭০টি শব জলে ধুয়ে যেতে দেখেছেন এবং ৪০০০ মরদেহ গঙ্গার তীরে সামান্য মাটিচাপা দিয়ে কবর দিতে দেখেছেন। সাংবাদিকদের যা প্রকৃত কর্তব্য দৈনিক ভাস্কর সেটা করেছে বলেই মোদিরাজের আক্রমণের শিকার হয়েছে।
ভারতের জনসাধারণের অধিকার আছে সত্যটা জানার : কোভিড মৃত্যু সম্পর্কে আর পেগাসাস চরবৃত্তি সম্পর্কে। প্রতিটি কোভিড মৃত্যুর হিসাব থাকতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পেগাসাস চরবৃত্তি কেলেঙ্কারির তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসর প্রাপ্ত বিচারক মদন লোকুর ও কলকাতা হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে প্যানেল গঠন করেছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। অগ্রণী সাংবাদিকেরাও তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে গেছেন। পেগাসাস চরবৃত্তির তদন্ত করার ব্যাপারে মোদি সরকার যতই অনীহা দেখাক বা নিজের অপরাধী মনোভাব প্রকাশ করুক না কেন, একটি নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া নিতান্ত জরুরি। এবং বিদেশি একটি সংস্থার সাথে হাত মিলিয়ে এভাবে আমাদের সংবেদনশীল ও ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক করার প্রতিটি কুকম্মের সমুচিত শাস্তি হওয়া দরকার।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ২৭ জুলাই ২০২১)
বর্তমান কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক কর্তৃক গত মার্চ মাসে রাজ্য সরকারগুলোর প্রতি একটি এ্যডভাইজারী বা নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা আইনে বিভিন্ন বর্গ বিশেষ করে তপশীল জাতি ও উপজাতিদের কাজের হিসাব আলাদা করে রাখতে হবে এবং তাদের জাতিগত শংসাপত্র দেখাতে হবে। এই এ্যডভাইজারী কার্যকরী না করলে কাজের বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে এই প্রকল্প বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অজুহাত তুলেছিলেন। কিন্ত গ্রামীণ কর্মসংস্থানের একমাত্র প্রকল্প বন্ধের চক্রান্তের বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভের ফলে তা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে বারবার বিভিন্ন ধরনের ফরমান জারীর মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজ সংকুচিত করার চেষ্টা চলেছে। ২০০৫ সালে তৈরি এই আইনে গ্রামীণ জনগণের চাহিদা-ভিত্তিক সমস্ত পরিবারের জবকার্ড ও কাজ পাওয়ার অধিকার আছে। সেখানে কোন জাতি/উপজাতির প্রশ্ন নেই। এক্ষেত্রেও কৃষি আইন, শ্রমকোর্ড ও অন্যান্য সরকারি সম্পত্তির বিলগ্নীকরণ করার মত সংসদকে এড়িয়ে করা হয়েছে। এই এডভাইজারী কার্যকরি হলে কাজ ও মজুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। তাই দেশের ৮টি কৃষিমজুর সংগঠন দিল্লীতে বৈঠক করে এই এ্যডভাইজারী প্রত্যাহারের দাবিতে ২৬ জুলাই জেলাশাসকের দপ্তর ও ব্লকে ডেপুটেশন সংগঠিত করার কর্মসূচি নেয়। জেলাশাসক ও বিডিও মারফত রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকপত্র পাঠানোর কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে পুর্ব বর্ধমান জেলাশাসকের কাছে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয় এবং জেলাশাসক মারফত রাষ্ট্রপ্রতির কাছে স্মারক পত্র পাঠানো হয়। দাবি ছিল, (১) কেন্দ্রীয় সরকারের এমএনআরইজিএ প্রকল্প হত্যার চক্রান্তকারী এসসি-এসটি শংসাপত্র দেওয়া ও আলাদা হিসাব রাখার এ্যডভাইজারী তুলে নিতে হবে। রাজ্য সরকারকে এই এ্যডভাইজারীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রে প্রতিবাদ জানাতে হবে। (২) এমএনআরইজিএ প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে বছরে ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমানে রাজ্য জুড়েই রেশন কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিংক করা হচ্ছে। ডিলাররা প্রচার করছে আধার কার্ড লিংক না হলে রেশন পাবে না। অনেক ক্ষেত্রেই আধার কার্ড সবাই পায়নি। অন্যদিকে আধার কার্ডে ভুল থাকার জন্যেও আধার লিংক হওয়ার সমস্যা হচ্ছে। তাই দাবি তোলা হয়েছে আধার কার্ড লিংক বাধ্যতামূলক করে গরিব মানুষকে রেশন থেকে বঞ্চিত করা চলবেনা। রেশনে ডাল, তেল, আলু ও সব্জি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে গ্রামীণ জনগণের থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ পাওয়ার জন্য আবেদন নেওয়া হয়েছিল। কিন্ত সেইসব আবেদনের এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থাই হল না। তাই দাবি করা হয়েছে সমস্ত আবেদনকারীদের প্রকল্পের সুযোগ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সুযোগ পাওয়ার অযোগ্য হলে কারণ জানাতে হবে। ‘আবাস প্লাস’ প্রকল্পের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এবং প্রকৃত প্রাপকদের ঘর পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে সমস্ত মানুষকে বিনামূল্যে অবিলম্বে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
অতিরিক্ত জেলাশাসক ডেপুটেশন গ্রহণ করেন, রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন বলেন। অন্যান্য দাবিগুলো নির্দিষ্ট দপ্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন জানান। তবে তিনি বলেন আধার লিংকের সাথে বর্তমান রেশন বন্টনের কোন সম্পর্ক বা বিধিনিষেধ নেই। ডেপুটেশনে প্রতিনিধিত্ব করেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমান মন্ডল ও সজল পাল। ডেপুটেশনের শুরুতে বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও পতাকা হাতে বর্ধমান শহরের কার্জন গেট থেকে মিছিল করে গিয়ে জেলাশাসকের অফিসের সামনে বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়।
আয়ারলার রাজ্য কমিটি ও পুর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী ২নং ব্লক, পূর্বস্থলী ১নং ব্লক, কালনা ২নং ব্লক, মন্তেশ্বর ও বর্ধমান সদর ১নং ব্লকে গত ২২ জুলাই বিডিও ডেপুটেশন সংগঠিত করা হয়। দাবি ছিল,
১) গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে সমস্ত গরিব মানুষের অবিলম্বে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
২) গ্রামীণ ‘আবাস প্লাস’ যোজনায় ঘরের তালিকা জনসাধারণের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। ঘর নিয়ে দলবাজি দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত প্রাপকদের অবিলম্বে ঘর পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) রেশন কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিংক বাধ্যতামূলক করা চলবেনা। আধার লিংকের অজুহাতে গরিব মানুষকে রেশন থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। রেশনে ডাল, তেল, আলু ও সব্জি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) সমস্ত গরিবদের ১০০ দিনের কাজ দিতে হবে, মজুরি কম দেওয়া চলবে না। ১০০ দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতি-দলবাজী বন্ধ করতে হবে।
৫) মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সমস্ত অনথিভুক্ত ভাগ, লিজ ও চরের খাস জমিতে গরিব কৃষকদের ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের সুযোগ দিতে হবে।
৬) মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিমত সমস্ত গরিব পরিবারের মহিলাদের ৫০০/১০০০ টাকার মাসিক ভাতা দিতে হবে।
৭) শস্যবিমার ক্ষতিপূরণ সমস্ত কৃষকদের দিতে হবে। সব্জি চাষিদের শস্যবীমার আওতাধীন করতে হবে।
সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং সারা ভারত আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষ থেকে ২৭ জুলাই বাঁকুড়া জেলা শাসকের কাছে মিছিল করে গিয়ে এক ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
মূল দাবিগুলি ছিল,
১) সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে এক পরামর্শ পাঠিয়েছে, যাতে বলা হয়েছে তফশিলি জাতি ও উপজাতি মানুষদের জন্য আলাদা তহবিল গড়তে হবে অর্থাৎ জবকার্ডে এবং ব্যাঙ্কের খাতায় তাদের শংসাপত্র যোগ করতে হবে। এটা আসলে এমএনআরইজিএ প্রকল্পের সর্বজনীন ও চাহিদা নির্ভর যে চরিত্র তাকে বদলে দেওয়া। এই বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়ে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিক।
২) রেশনে আধার সংযুক্তি আসলে বহু গরিব মানুষকে এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার চক্রান্ত। এটা করা চলবে না।
৩) আবাস যোজনার প্রাপকদের তালিকা প্রকাশ্যে টাঙাতে হবে।
৪) এলাকায় এলাকায় ক্যাম্প করে সকলকে বিনামূল্যে করোনা টিকা দিতে হবে।
৫) লোকাল ট্রেন চালু করে গরিব মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৬) বনের জমিতে বসবাসকারী আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদ না করে পাট্টা সহ বাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।
ডেপুটেশনের আগে মাচানতলা সুভাষ মুর্তির পাদদেশে বিক্ষোভসভা হয়। বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জেলা সম্পাদক রামনিবাস বাস্কে, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষ থেকে মঙ্গল মুর্মু এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী। ডেপুটেশন গ্রহণ করেন এডিএম (সাধারণ) প্রলয় চৌধুরী। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এআইকেএম নেতা বৈদ্যনাথ চীনা, এআইসিসিটিইউ নেতা দিলবার খান, এআইএআরএলএ নেতা অমল বিশ্বাস, জিতেন দিয়াসী ইত্যাদি।
কৃষি আইন বাতিল, আন্দোলনরত কৃষক নেতৃত্বের ওপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, কৃষককে কর্পোরেটের সেবাদাস বানানোর চক্রান্তকে ধ্বংস করা, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, বিদ্যুৎ বিল ২০২০ প্রত্যাহার সহ বেশ কিছু দাবিতে ২২ জুলাই দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের রাণীডাঙ্গা বাজারে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও সারা ভারত কিষাণ সভা’র যৌথ উদ্যোগে মিছিল ও প্রচারসভা হয়। সভা পরিচালনা করেন এআইকেএম-এর দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ। বক্তব্য রাখেন অভিজিৎ মজুমদার সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
লকডাউনে গ্রামীণ মজুরদের ভরসা ১০০ দিনের কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প। কিন্তু তাতে কাজ হয়েছে খুবই নগণ্য! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল সেই কাজ পেলেন কারা? লকডাউনের কর্মহীন সংকটকালে গ্রামের সমস্ত গরিব মজুররা কাজ পেলেন কি? এ প্রশ্নের জবাবে পঞ্চায়েত প্রধান বললেন, মেম্বাররা কাজের আবেদন ৪ক পূরণ করে যাদের নাম জমা দিয়েছে,তারাই কাজ পেয়েছে! মেম্বাররা কেন? জবকার্ডধারী মজুররা আবেদন করেনি? আমতা আমতা করে তিনি বললেন, হ্যাঁ লেবাররাই করেছে, তবে মেম্বার সাহায্য করেছে। তাহলে কাজ হবে বলে আগাম কোনও প্রচার করা হয়নি কেন? আইনে লেখা আছে কাজ শুরুর আগে মাইক দিয়ে বা সংসদ সভা ডেকে গ্রামের সকলকে জানাতে হবে। সে সব হয়নি কেন? বেছে বেছে বিরোধী দলের গরিবদের নাম বাদ দিয়ে কাজ হল কেন? দলবাজি চলছে কেন? পঞ্চায়েত প্রধান নিরুত্তর!
২৭ জুলাই নদীয়ার ধুবুলিয়া ব্লকের নওপাড়া ২নং অঞ্চলে ডেপুটেশনে গিয়ে সিপিআই(এমএল) প্রতিনিধিরা এই প্রশ্নগুলি তুলে ধরলেন। দাবি জানালেন, সমস্ত গরিবদের কাজ দিতে হবে, আইনসঙ্গত মজুরি দিতে হবে, কাজের হিসাব বা মাস্টার রোল দিতে হবে। চাপের মুখে প্রধান রাজি হলেন। এদিকে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী লাগাতার বলে চলেছেন ১০০ দিনের কাজ সম্পূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, সারা দেশে বাংলা নাকি রেকর্ড গড়েছে! কিন্তু বাস্তবটা ঠিক তার বিপরীত! এই অঞ্চলে বিগত কয়েকমাসে কাজ হয়েছে মাত্র ৬ দিন! ডেপুটেশনের পর সোনাতলার মোড়ে এক প্রতিবাদ সভায় আরও বলা হয়, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার লাগাতার ১০০ দিন কাজে বরাদ্দ কমিয়ে চলেছে। এখন তপশীলী জাতি উপজাতি শংসাপত্র না থাকলে মজুরি পাবে না এই বিধি চালু করে ওরা গরিব মজুরদের এই প্রকল্প থেকে বাদ দিতে চাইছে। বস্তুত নাগরিকত্ব যেমন ধর্ম দিয়ে হয় না, মজুরের পরিচয় জাতপাত দিয়ে হয় না। বিজেপি শুরু করেছে জাতের নামে বজ্জাতি।
সম্প্রতি গ্রামাঞ্চলে আবাস যোজনার একটা লম্বা লিস্ট বার করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে সেই তালিকায় এক একটি গ্রামে ৩০০/৪০০ নাম আছে। এমনকি একই পরিবারের মধ্যে ২/৩ জনের নাম আছে। পাকা বাড়ি রয়েছে, কিন্তু গোয়াল ঘর কিংবা রান্নার চালাঘরের ছবি তুলে নাম লেখানো আর কি! সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত গ্রামীণ মানুষের কাছে এটাই যেন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই তালিকায় এখন জবকার্ড নম্বর সংযোগ করার কাজ চলছে। পঞ্চায়েত প্রধান জানালেন ঝাড়াই বাছাই করে পরবর্তীতে চুড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হবে। প্রখমে নিমরাজি হলেও অবশেষে সেই তালিকা আমাদের দেওয়া হবে বলে আশ্বাস পাওয়া গেল। গ্রামে গ্রামে মানুষের নজরদারী চালু করে প্রকৃত আবাসহীনরা যাতে বঞ্চিত না হয় সেটা সুনিশ্চিত করতে পাল্টা তালিকা জমা দেওয়া হবে বলে প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিলেন। এই কর্মসূচিতে ছিলেন নওপাড়া পঞ্চায়েতে পার্টির একমাত্র মেম্বার ছবি বিশ্বাস,স্থানীয় নেতা সাইদুল মোল্লা, কলমউদ্দিন সেখ, শংকর রায় ও জয়তু দেশমুখ।
যন্তর-মন্তরে ঐতিহাসিক কিষাণ সংসদের আজ ছিল চতুর্থ দিন। গতকাল মহিলা কিষাণ সংসদের উদ্যোগে শুরু হওয়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য (সংশোধন) আইন ২০২০ নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রেখে আজ একই বিষয়ে আলোচনা হয়। কিষাণ সংসদে এই বিষয়টি লক্ষ করা গেল যে সারা পৃথিবীর ক্ষুধা সূচকে (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) ভারতের অবস্থান অত্যন্ত নিচের দিকে এবং তার ক্রমাগত অবনতি হয়ে চলেছে। এটি নজরে এসেছে যে ১৯৫৫ সালের আইনে আনীত গত বছরের সংশোধনীগুলি খাদ্যদ্রব্যের মজুতদারী ও কালোবাজারিকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এই সংশোধন সাধারণ উপভোক্তা ও কৃষকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী এবং বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আনা হয়েছে। কিষাণ সংসদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণহীন করে দেওয়ার ফলে, ব্যবস্থাটিতে বড় বড় কর্পোরেট ও বিশ্বব্যাপী খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন সংস্থাগুলির আধিপত্য বাড়িয়ে তুলবে। গতকালও মহিলা কিষাণ সংসদে যেমন জোর দিয়ে বলা হয়েছিল এবং এই সংসদও তেমনি সাধ্যের মধ্যে দামে প্রত্যেকের জন্য খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বের কথা অনুভব করে, কিন্তু আইনের এই সংশোধনীগুলি শুধুমাত্র বাজারে “অস্বাভাবিক দাম বাড়লে তবেই সরকারকে মজুতের সীমা আরোপ করার ক্ষমতা দেয়”। আরও খারাপ বিষয় হল, এমনকি জরুরি পরিস্থিতিতেও অনেক সংস্থার ক্ষেত্রে মজুতের সীমাবদ্ধতা মেনে চলার দরকার নেই, আইনের সংশোধনীতে কিছু ব্যাতিক্রম রাখার জন্য এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমিত করে দেওয়ার জন্য এমন পরিস্থিতি হয়েছে। কিষাণ সংসদে প্রস্তাব নেওয়া হয় যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য (সংশোধন) আইন ২০২০ সংসদ দ্বারা বাতিল করা উচিত। আজ যে কিষাণ সদস্যরা বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন বোম্বাই হাইকোর্টের মাননীয় প্রাক্তন বিচারক বি জি কোলসে পাতিল।
ক্রমবর্ধমান দাম নিয়ন্ত্রণের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা মসুর ডালের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে শূন্যে নামিয়ে আনা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপন্ন মসুর আমদানি করা বা সেখান থেকে রফতানির জন্য শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করে দেওয়া কৃষকের স্বার্থ রক্ষার্থে, এই বলে ভারত সরকার যে দাবিগুলি করছে তা সর্বৈব মিথ্যা। এছাড়াও, কৃষি পরিকাঠামো উন্নীত করার জন্য কৃষি পরিকাঠামো ও উন্নয়ন সেস (এআইডিসি) বর্তমান ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। সরকারের এই কৃষকবিরোধী পদক্ষেপের নিন্দা জানায় এসকেএম।
কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী কিষাণ সংসদকে ‘নিরর্থক’ বা ‘অর্থহীন’ বলেছেন। তিনি এই কথা বলতে পেরেছেন তার কারণ তিনি এবং তার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিই হল যে কৃষকদের বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা, কৃষকদের আট মাসেরও বেশি সময় ধরে রাস্তায় পড়ে থাকা এবং ৫৪০ জনেরও বেশি সহকর্মীকে হারানো সবটাই ‘নিরর্থক’। মন্ত্রী আজ বিরোধী সংসদ সদস্যদেরও বলেছেন যে “তারা যদি কৃষকদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন তবে তাদের উচিত এই সংসদকে কাজ করতে দেওয়া”। কৃষকরা ‘জনতার হুইপ’এর মাধ্যমে বিরোধী দলের সংসদদের যা করতে বলেছিল, তাই তারা করছেন, এই সত্যটি মন্ত্রী এড়িয়ে যেতে চাইছেন। সাধারণ নাগরিকদের যখন জীবন-মৃত্যুর লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে, তাও সেটা যখন মোদী সরকারেরই চাপিয়ে দেওয়া, তখন সরকার কখনোই ‘স্বাভাবিক কাজকর্ম’ আশা করতে পারে না!
প্রস্তাব-১
কৃষিক্ষেত্রে মহিলাদের অসামান্য অবদান থাকা সত্ত্বেও, তাঁরা আমাদের দেশে উপযুক্ত মর্যাদা, স্বীকৃতি ও আসন পাননি। তাদের কঠিন পরিশ্রম, যোগ্যতা, জ্ঞান ও গুরুত্বের কথা আমাদের সমাজ এবং জনআন্দোলনগুলিকে বিবেচনা করতে হবে। সুচিন্তিত পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃষক আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা ও ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে হবে।
প্রস্তাব-২
এই মহিলা সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল, পঞ্চায়েত এবং পুর কমিটি ইত্যাদি স্থানীয় সমিতিগুলির মতো, সংসদ এবং বিধানসভায় মহিলাদের ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব রাখার জন্য সংবিধান সংশোধন করা উচিত।
ভারত সরকার কি কোভিড মৃতের প্রকৃত সংখ্যাকে গোপন করছে? এখন পর্যন্ত কতজন ভারতবাসীর প্রাণ কেড়েছে এই মারণ ভাইরাস?
২০ জুলাই ভারত সরকারের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রমানিয়াম ও সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ও হাভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা এক গবেষণাধর্মী নিবন্ধে জানিয়েছেন, জানুয়ারি ২০২০ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৪০ হাজার থেকে ৪ লক্ষ ৭০ হাজার হবে, যা মোদী সরকারের প্রদত্ত তথ্যের থেকে দশগুণ বেশি!
এই সমীক্ষা অনুযায়ী, স্বাধীন ভারতে এটা বৃহত্তম মানবিক ট্রাজেডি। দেশভাগের সেই মর্মান্তিক, হাড় হিম করা ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায়ও এতো মৃত্যু আমাদের দেশ কখনো দেখেনি। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ডাটাবেস থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতে এখনো দৈনিক ৪০,০০০ নতুন সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে, আর মৃত্যুর সংখ্যা দৈনিক ৫০০। এখন পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ টিকা পেয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করেছেন, সরকার মৃতের যে সংখ্যাটা দেখাচ্ছে, তা বাস্তবের থেকে অনেক অনেক কম।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশের শীর্ষ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছে, কোভিড মৃত্যুর জন্য এককালীন ক্ষতিপুরণ মৃতের পরিবারকে দিতে হবে। কিন্তু, ক্ষতিপূরণের অঙ্ক সরকারকেই ঠিক করতে হবে। এখন, অর্থের পরিমাণ যথাসম্ভব কমানোর ঘৃণ্য লক্ষ্যে মোদী সরকার এই অস্বচ্ছ, মিথ্যা পরিসংখ্যান তৈরি করছে। কী বিপুল সংখ্যক মৃতদেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তা আজও অজানা। রাতের আকাশকে আলোকিত করে শয়ে শয়ে চিতা জ্বলে উঠেছে। এমনকি, নদীর পাড়ে পুঁতে দেওয়া মৃতদেহগুলোকে ছিঁড়ে খেতে দেখা গেছে কুকুরকে।
তাই, মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার এই ধুম্রজালকে ছিন্ন করে প্রকৃত তথ্য সামনে আনা দরকার।
“কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা হোক বা কচ্ছ থেকে কোহিমা, আন্দোলনের প্রশ্নে বিজেপি বিরোধী সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে আমরা প্রস্তুত”।
(বিমান বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ জুলাই ২০২১)
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়তেও প্রস্তুত? বিমান বাবুর জবাব, “বিজেপি ছাড়া যে কোনও দলের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত”। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতা কমরেড বিমান বসু দলের যুক্তমোর্চা নীতি জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। যদিও একটা তাৎক্ষণিক বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা গেল। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অতিপরিচিত কমরেড সুজন চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, “তৃণমূল কংগ্রেস কোনদিন বিজেপির বিরোধিতা করেনি। তাই রাজ্যে তৃণমূল বিরোধিতার নীতির কোন বদল হচ্ছে না”। (প্রতিদিন, ২৭ জুলাই ২০২১)
সিপিআই(এম) দলের কোনও কোনও মহল থেকে বিমানবাবুর কথা নিয়ে বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যাচারকে গালাগালি করা শুরু হয়েছে। আমরা বরং বিমানবাবুর কথাটাকে একটু যাচাই করে নিই — বক্তব্যটির দুটো অংশ আছে। প্রথম অংশটা একটু সাদামাটা। যেখানে তিনি বলেছেন, “সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এটা বহুবার ঘটেছে।... আন্দোলনের প্রশ্নে বিজেপি বিরোধী সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে আমরা প্রস্তুত”। এজন্যই সাদামাটা যে, এর কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা লাগছে না। অনেকগুলো ফাঁকফোকর আছে। “কবে, কখন, কোথায়, কোন প্রশ্নে সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি বিরোধী আন্দোলন করেছেন” এর কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই। এতদিন তো বলে গেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস আঞ্চলিক দল, রাজ্যের বাইরে এর কোনও অস্তিত্বই নেই। ফলে এরসঙ্গে সর্বভারতীয় স্তরে কোনও যৌথ কার্যকলাপ করার প্রশ্নই নেই। এর থেকেও বড় কথা, যেটা সুজনবাবু বলেছেন, “তৃণমূল কখনই বিজেপির বিরোধিতা করেনি”। যে দল কখনই বিজেপির বিরোধিতা করেনি, তার সঙ্গে বিজেপি বিরোধী আন্দোলন হবে কি করে? কিন্তু বিমানবাবুর গতকালের বিবৃতির দ্বিতীয় অংশ অনেক বেশি নির্দিষ্ট। সাংবাদিক বন্ধুর প্রশ্ন ছিল সুনির্দিষ্ট, “তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কোন যৌথ কার্যকলাপের/কর্মসূচির সম্ভাবনা আছে কিনা?” বিমানবাবুর উত্তরও ছিল স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট। “বিজেপি ছাড়া যে কোনও দলের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত”। বিমানবাবুর বক্তব্য নিশ্চয় গীতার কোন উদ্ধৃতি নয় যে বহু ব্যাখ্যার অবকাশ থাকবে। তবে তাঁদের দল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে কিনা সেটা সিপিএমের নেতৃবৃন্দই স্পষ্ট করতে পারবেন। তবে বিমান বসু এবং সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে দল এই প্রশ্নে স্পষ্টতই বিভক্ত। কতভাগে বিভক্ত তা এখনও পরিস্কার নয়। বিমানবাবুর গতকালের বিবৃতির পর একটা তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল নিচেরতলার কর্মীদের মধ্যে। একজন লিখেছেন, “... পুনশ্চ: যে সমস্ত পরিবার থেকে ধারাবাহিকভাবে শহীদ হয়েছেন, তারা এই সমঝোতা মেনে নিয়েছেন তো?” কেউ বলেছেন, “কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হল”। কেউ কেউ ৮১ বছর বয়স্ক বিমানবাবুকে অবসর নিতে বলেছেন, অন্য কথাগুলো না হয় বাদ দেওয়াই গেল।
দলের রাজ্য কমিটির সদস্য ও উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী অবশ্য একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “সর্বভারতীয় স্তরে সিপিএমের বলিষ্ঠ (!) নেতৃত্বে বিজেপি বিরোধী যে লড়াই চলছে, তা চলবে, কিন্তু এরাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে কোন জোট হচ্ছেনা।” একথাটাই আর একজন কমরেড ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে, “তৃণমূল আছে এই যুক্তিতে যদি আমরা সর্বভারতীয় যৌথ উদ্যোগ থেকে সরে থাকি তবে তাতে তৃণমূলেরই লাভ হবে এই প্রচার করার যে সিপিআই(এম) তলায় তলায় বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।” তবে এই ব্যাখ্যা দিয়ে কমরেড নিজেই সন্তুষ্ট নন। তাই লিখছেন, “বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় জোটে তৃণমূলকে পাঠিয়েছে বিজেপির পরিচালক আরএসএস’ই। এব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে”। এধরনের বহু ব্যাখ্যা হাজির হচ্ছে, শুধু তাই নয়, সাঁইথিয়া, সিউড়ি সহ বেশকিছু কলেজে/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএফআই’র ছাত্রছাত্রীরা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সিপিআই(এম) যদি তৃণমূলের সাথে কোনও বোঝাপড়া করে তবে তারা সংগঠন ছেড়ে দেবেন (যদিও এই তথ্যের কোন বিশ্বাসযোগ্যতা আছে কিনা জানা নেই)। তাহলে সিপিএমের সমস্যাটা ঠিক কোথায়? দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নতুন কী কী দিক বিকাশ লাভ করেছে তার সুস্পষ্ট কোন বিশ্লেষণ ও একে মোকাবিলা করার স্পষ্ট দিকনির্দেশ ও পদক্ষেপ সম্পর্কে অস্পষ্টতা এই বিভ্রান্তি ও দিশাহীনতার কারণ বলে অনেকে মনে করেন। যে দল আগ বাড়িয়ে ৫০ বছর আগে ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস ও আধা ফ্যাসিস্ট শক্তিকে চিহ্নিত করে ফেলেছিল, আজ সেই দলই ভারতের বুকে ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান, বিকাশ ও আগ্রাসনকে দেখতে পাচ্ছে না। এর কারণ ঐ দলের নেতৃবৃন্দই বলতে পারবেন। দ্বিতীয়ত ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর থেকে এই দলটি শক্তিশালী বিরোধীপক্ষের রাজনীতি অনুশীলন করার পরিবর্তে কত দ্রুত রাজ্যের ক্ষমতায় ফিরে আসা যায়, তার অনুশীলন করতে ব্যস্ত থেকেছে। এই ‘ব্যস্ততা’ দলটিকে নিয়ে গেছে অনীতিনিষ্ঠ সমঝোতায়। সবই ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে।
এরাজ্যে ১৭/১৮ দলের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে নির্বাচনী বোঝাপড়া/জোট গড়ে তোলা হল। এমনকি অন্য একটি ভ্রাতৃপ্রতীম বামপন্থী দল যারা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তারা যখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নে কিছু বিষয় তুলে ধরছে, তখন তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার পরিবর্তে কুৎসার অভিযানকে উৎসাহিত করা হল। নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তাকে নিন্দা করা ও বন্ধ করার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ কারও নজরে পড়লো না। এইভাবে এই রাজ্যে ঐক্যবদ্ধ বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও প্রচারাভিযানকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হল। এতে শত্রুপক্ষ যে উৎসাহিত ও লাভবান হচ্ছে, সেটুকু ভাবতে পর্যন্ত সিপিআই(এম) নেতৃত্ব রাজি নন। কর্মীবাহিনীর রাজনৈতিক মান যে তলানিতে পৌঁছচ্ছে, সেটা পর্যন্ত ভাবার অবকাশ নেই নেতৃত্বের। আজ সিপিআই(এম) যখন তার কর্মনীতি ও কর্মকৌশলের ভুলগুলি শুধরে নিতে চেষ্টা করছে, তখন দলেরই একটি স্বার্থান্বেষী অংশ তাকে বাধা দিতে শুরু করেছে। এখন দেখার, এই বাধা দল ও দলের নেতৃত্ব অতিক্রম করতে পারে কিনা।
- পার্থ ঘোষ
সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। অধিকার কর্মীদের ক্ষীণকণ্ঠের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগুলির কিছুটা জোরালো কণ্ঠস্বর যুক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই সংযুক্তিকে সমস্তরকম ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা অধিকার কর্মীদের দায়িত্ব।
রাজনৈতিক বন্দী বলতে সাধারণভাবে আমরা কাদের কথা বলছি? কারা রাজনৈতিক বন্দী, কারা নয় — এই প্রশ্নটা কিন্তু এখনও স্পষ্টভাবে মীমাংসিত নয়। সাধারণভাবে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের কর্মী বন্দী হলে তাঁদের রাজনৈতিক বন্দী বলা হবে। এটা খুবই অস্পষ্ট সংজ্ঞা। নকশালপন্থী বা মাওবাদী ভাবধারার আন্দোলনের কর্মীদের এই সংজ্ঞায় রাজনৈতিক বন্দী বলাই যাবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে ‘মুসলিম সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত করে যে অসংখ্য যুবককে বন্দী করে রাখা হয়েছে তারা কি রাজনৈতিক বন্দী? আমরা কি তাঁদের মুক্তির দাবি জানাব? না কি জানাব না? অনেকে বলেন, ওরা যেহেতু ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের (থেওক্র্যাটিক স্টেট) কথা বলেন তাই তাঁদের কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মী বলা যাবে না, তবে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার বা দমনপীড়নের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদার জন্য যে লড়াই সে লড়াইয়ে ওরা ব্রাত্য। এই বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই আরো হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয়। রাজনৈতিক বন্দী নিয়ে আগামী দিনে লড়াই আরো জোরদার হবে। বন্দীসংখ্যা আরও বাড়বে — কাজেই এসব প্রশ্নের যথাযোগ্য গুরুত্ব সহযোগে আলোচনা হওয়াটা দরকার। মীমাংসা হওয়া সম্ভব না হলেও ধারণাগুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার।
কেন আমরা রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাইছি, কোন যুক্তিতে — এটাও বন্দীমুক্তি আন্দোলনের কাছে পরিস্কার থাকা দরকার। টিএমসি দলের বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০১১ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বন্দিমুক্তি — তাই কি আমরা বন্দীমুক্তি চাইছি? এটা নিশ্চয় দাবি জানানোর সময়ের একটা বাড়তি যুক্তি। কিন্তু মূল যুক্তি নয়। এই প্রতিশ্রুতি না থাকলে কি আমরা বন্দীমুক্তির দাবি জানাতাম না? নিশ্চয়ই জানাতাম। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি জানানোর ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান যুক্তি হল এই বন্দীরা যা করেছেন তা তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শের জন্য করেছেন। তাঁরা ব্যক্তিস্বার্থে বা পরিবারের স্বার্থে বা ব্যক্তিগত লাভ, লোভ-লালসার বশে কোনও কাজ করেননি। করেছেন বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে। তাই তাঁদের কখনই সাধারণ অপরাধীদের সঙ্গে এক করে দেখা যাবে না। তাঁরা যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনও হিংসাশ্রয়ী কাজ, এমনকি খুনও করে থাকেন তবুও তাকে সাধারণ অপরাধী বা খুনি হিসেবে দেখা যাবে না। তাঁদের রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। স্মরণ থাকতে পারে ১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার এবং কেন্দ্রে জনতা সরকার প্রতিষ্ঠার পর যে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দও ছিলেন। খুনের অভিযোগে বন্দী তো অসংখ্য ছিলেন। তাঁদের সবারই নিঃশর্ত মুক্তি সেদিন আদায় করা হয়েছিল। বামফ্রন্টের সময় পশ্চিমবঙ্গে তৈরি আইন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কারেকশনাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট ১৯৯২-তে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল যেখানে এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা ছিল যে, রাজনৈতিক কারণে খুন করে জেলে গেলেও তাঁকে রাজনৈতিক বন্দী বলা হবে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সুযোগগুলো তার প্রাপ্য হবে। ২০১৩ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সমস্ত প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে এই আইনটি আমূল বদলে দেয়। এবং এসব ধারা বাতিল করে দেয়।
আইনে যাই থাকুক, রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির আন্দোলনে কোনও রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কী অভিযোগে মামলা সাজিয়েছে বা তিনি আদালতের দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত কি না সেটা মোটেও দেখা হয় না। দেখা হয়, তিনি রাজনৈতিক কাজের জন্য বন্দী কি না। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে বিচারাধীন এবং দণ্ডপ্রাপ্ত দুই ক্ষেত্রেই মামলা প্রত্যাহার করে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়ার ধারা আছে। সে সব ধারা বামফ্রন্ট যেমন ব্যবহার করেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারও টিএমসি কর্মীদের ও গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহারের জন্য ব্যবহার করেছে। একটি দুটি নয় বহু ক্ষেত্রে। এমনকি খুনের মামলা প্রত্যাহার করেও মুক্তি দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের জেলে এই মুহূর্তে মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বন্দী আছেন ৭২ জন। তাঁদের মধ্যে ৫০ জনই জঙ্গলমহলের বাসিন্দা। ৬ জন মহিলা। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী মাওবাদী দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের নেতা ছিলেন — এরকম কয়েকজন এরাজ্যের জেলে বন্দী আছেন। যেমন আদুলা রামকৃষ্ণ, অসীম ভট্টাচার্য, অনুপ রায়, কল্পনা মাইতি, ভেঙ্কটেশ্বর রেড্ডি (তেলুগু দীপক), দীপক কুমার প্রমুখ। জঙ্গলমহলের বন্দীদের মধ্যে অধিকাংশ বয়সে তরুণ। কিন্তু অন্য বন্দীদের মধ্যে ৬/৭ জনের বয়স ৭০ বছর বা তার উপরে। বুদ্ধদেব মাহাতো, আদুলা রামকৃষ্ণ, কল্পনা মাইতি, পারো প্যাটেল — এরা খুবই অসুস্থ।
টিএমসির দশ বছরের শাসনকালে জেলেই ৭ জন রাজনৈতিক বন্দীর মৃত্যু ঘটেছে। কার্যত বিনা চিকিৎসায় তাঁদের মৃত্যু ঘটেছে বলে সহবন্দীদের অভিযোগ। ৭২ জন জেলবন্দীর মধ্যে ৮ জন আছেন সাজাপ্রাপ্ত। বাকিরা ১০-১২ বছর ধরে ‘বিচারাধীন’ অর্থাৎ বিনা বিচারে বন্দী আছেন। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪ জনের ১৭ বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। যাবজ্জীবন মানে ১৪ বছর জেল খাটার কথা। কিন্তু তা সত্বেও সরকার তাঁদের মুক্তি দিচ্ছে না বারবার আবেদন জানানো সত্বেও। ৭২ জনের মধ্যে ৬০/৬২ জনের ইউএপিএ ধারায় মামলা আছে।
মাওবাদী বন্দী ছাড়া এসইউসিআই(সি)-র দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ওই দলের ১৬ জন বন্দী আছেন। এরা সবাই বামফ্রন্টের সময়ের বন্দী। সবাই সাজাপ্রাপ্ত। সম্প্রতি ৯৪ বছর বয়সে বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁদের এক বন্দীর মৃত্যু ঘটেছে বলে এসইউসিআই(সি)-র পক্ষে প্রেস বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। মাওবাদী এসইউসিআই(সি) ছাড়াও তথাকথিত মুসলিম সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত এরকম বন্দী আছেন অন্তত ৭০ জন। তাঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই ইউএপিএ ধারায় মামলা আছে।
প্রসঙ্গত রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি আন্দোলনে মামলা প্রত্যাহারের দাবিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় আন্দোলনের সময়ের বহু মামলাই বছরের পর বছর ধরে চলছে। বহু বন্দী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মামলাগুলি চলছে। ৩০/৪০ টা মামলা দেওয়া হয়েছে এরকম বন্দীও কম নয়। ৮/১০টা তো প্রায় সবার। ফলত, জামিনে মুক্তি পেলেও মামলা লড়তে লড়তেই তাঁদের জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ঘটিবাটি বিক্রি হয়ে যায়। কাজেই শুধু জেলবন্দীদের মুক্তিই নয়, একই সঙ্গে মামলা প্রত্যাহারের দাবি তোলাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই শেষ বিচারে জামিনে মুক্ত থাকলেও তাঁদের রাজনৈতিক বন্দীর তালিকায় রাখা দরকার এবং মামলাগুলি প্রত্যাহারের জন্য জোরদার দাবি জানানো দরকার।
সারা দেশেই সম্প্রতি বেকসুর খালাস পাওয়া রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিটা উঠে আসছে। এরাজ্যে এবিষয়ে ক্ষীণভাবে দাবি উঠলেও এভাবে খালাস পাওয়া বন্দীরা মামলা করতে উৎসাহী না হওয়ায় ব্যাপারটা আর এগোয়নি। কিন্তু ক্ষতিপূরণের দাবি এবং মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তারের জন্য অফিসারদের শাস্তির দাবিও তোলা দরকার। নানা রাজ্যেই এবিষয়ে মামলা হয়েছে। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে জেলে থাকার সময়ে বন্দীর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে এবং এজন্য বন্দীর পরিবারকে নিয়মিত মাসোহারা দিতে হবে — এই দাবিও তোলা দরকার। এটা নতুন কিছু নয়। এরাজ্যে বিষয়টি তেমন চালু নেই। এব্যাপারে ভারত সরকারের স্কীমও আছে। যদিও রাজনৈতিক বন্দীদের সরকারের টাকা নেওয়ার ব্যাপারে প্রবল নৈতিক আপত্তি থাকে। তবুও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। দীর্ঘ কারাবাসের ফলে বন্দীদের পরিবারগুলিকে যে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয় তার দায় অবশ্যই সরকারের। কাজেই সরকারকেই তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত — এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দাবিটা তোলা দরকার।
- রঞ্জিত শূর
যেদিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, প্রতিহিংসার চরিতার্থতায় এর প্রয়োগ হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করলেন, ঠিক সেদিনই হরিয়ানায় ১০০ কৃষককে এই আইনে অভিযুক্ত করা হল। কেন্দ্রের তৈরি তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত কৃষকদের মিছিলে ঢুকে পড়ল একটা গাড়ি, যাতে ছিলেন হরিয়ানা বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার এবং এক বিজেপি নেতা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হল, কৃষকদের সঙ্গে তাঁদের বাদানুবাদ ও কথা কাটাকাটি চলল এবং কৃষকদের ছোড়া ঢিলে তাঁদের গাড়ির পিছনের কাঁচ ভাঙল। কৃষকদের এই, ‘দুর্বিনীত’ আচরণকে হজম করাটা তাঁদের পক্ষে মর্যাদাকর মনে হলনা। কৃষকদের শত্রুজ্ঞানে শায়েস্তা করতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকেই তাঁরা অস্ত্র করলেন। বিরোধীদের ঢিট করতে সর্বাগ্ৰে একটা দানবীয় আইনকে হাতিয়ার করার ভাবনা মোদী জমানায় বিজেপি রাজনীতিবিদদের একটা প্রিয় প্রবণতা হয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদী ও যোগী আদিত্যনাথ সম্পর্কে ‘সমালোচনামূলক’ ও ‘মানহানিকর’ মন্তব্যের জন্য দেশদ্রোহ আইনে মামলা দায়ের হয়েছে যথাক্রমে ১৪৯ ও ১৪৪টা। ফলে, ইউএপিএ ও রাষ্ট্রদ্রোহের মতো দানবীয় আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ এই জমানার এক অভিজ্ঞান রূপে সামনে এসেছে।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের উৎপত্তি ব্রিটিশ জমানায়। কোনো সৎ উদ্দেশ্যে যে আইনটা তৈরি হয়নি, এই আইনে ভুরি-ভুরি মামলায় স্বাধীনতা সংগ্ৰামীদের অভিযুক্ত হওয়াটা তার সাক্ষ্য বহন করছে। তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনাকে স্তব্ধ করতে, স্বাধীনতা আন্দোলনে রাশ টানতে ঔপনিবেশিক শাসকরা এই আইনকে কাজে লাগাত। ব্রিটিশরা এই আইন প্রয়োগ করে শাস্তি দিয়েছে গান্ধী, বাল গঙ্গাধর তিলক, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেহরু এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যান্য নেতাদের। ব্রিটিশদের কাছে যা ছিল তাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে নির্ঘোষে লাগাম পরানোর অস্ত্র, স্বাধীনতা সংগ্ৰামীরা সেটাকে ঘৃণার বস্তু ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতেন না। এই আইনে গ্ৰেপ্তার হওয়ার পর গান্ধী তাই বলেছিলেন, “আইনের চোখে যেটা ইচ্ছাকৃত অপরাধ, ... নাগরিক হিসাবে আমার কাছে সেটা মহত্তম কর্তব্য”। যে আইন আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক পীড়নের অঙ্গ ছিল এবং আজ তার ঐতিহ্য বহন করছে, স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর পর তার অস্তিত্বের পক্ষে কোনো যৌক্তিকতা কি থাকতে পারে? ভগৎ সিং আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন — স্বাধীনতার পর ক্ষমতা বুঝিবা শ্বেত সাহেবদের হাত থেকে বাদামি সাহেবদের হাতে আসবে। আর সেটা ঘটলে বাদামি সাহেবদের হাতে গণতন্ত্রও খুব একটা কামনার বস্তু হবেনা। স্বাধীনতা আসার পর বাদামি সাহেবদের কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাই সহনীয় কোনো গুণ হিসাবে প্রশ্রয় পায়নি। ফলে, সংবিধান থেকে ‘সেডিশন’ বা রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দটা উঠে গেলেও সরকারের সমালোচনা বন্ধের উপায় হিসাবেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারাকে বজায় রাখার পথেই তাঁরা গেছেন এবং রাষ্ট্রকে সামলাতে এটা কত কাজের তার যুক্তিও ফেরি করেছেন। যারা এই আইন প্রণয়ন করেছিল সেই ব্রিটিশরা ২০০৯ সালে তাদের দেশে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনকে বিদায় জানালেও আমাদের শাসকরা সযত্নে এই আইনকে আজও লালন করে চলেছেন।
কেউ যদি এমন কোনো কথা বলেন বা লেখেন বা অন্য কোনো উপায়ে আইনি পথে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা করেন, তাকে অমান্য কিংবা অসম্মান করেন অথবা তার বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তবে সেটা হবে একটা জামিন অযোগ্য অপরাধ। আর এই অপরাধের জন্য শাস্তি হবে কম করে তিন বছরের এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তারসাথে জরিমানাও হতে পারে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহ এইভাবেই বিধৃত হয়েছে। অর্থাৎ, কেউ সরকারের সমালোচনা করলে, সরকার গৃহীত নীতির প্রতি বিরোধিতা দেখালে, প্রশাসনিক অপদার্থতা ও অরাজকতার দিকে আঙুল তুললে সরকার সেটাকে দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা অনুসারে অপরাধ বলে গণ্য করে সেই ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে উদ্যত হতে পারে। কিন্তু সংবিধান তো আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও বুনিয়াদি অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। আর তাই দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা এবং সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারা (মত প্রকাশের স্বাধীনতা) কি পরস্পর বিরোধী নয়? শাসকদের বিচারে এই দুটো একসঙ্গে অবস্থান করলে তা কোনো মৌলিক বিরোধকে চিহ্নিত করেনা এবং আদালতও তাদের ব্যাখ্যায় ১২৪ক ধারাকে সাংবিধানিক বৈধতার অনুগামী বলে রায় দিয়েছে।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে কখনও প্রশ্ন ওঠেনি এমন নয়। কিন্তু যখনই তা হয়েছে, সরকার ১৯৬২ সালে কেদার নাথ সিং মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ঢাল করেছে। কেদার নাথ সিং ছিলেন বিহারের ফরোয়ার্ড কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। সরকারের সমালোচনা করায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি আবার তাঁর বিরুদ্ধে চালানো এই অনাচারকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলা তুলে নিলেও রায় দেয় যে — সংবিধানের স্পিরিটের সঙ্গে দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারার কোনো মৌলিক বিরোধ নেই। অতএব রং নির্বিশেষে সরকারগুলোর কাছে রাষ্ট্রের সুরক্ষায় এই ধারাকে এক অপরিহার্য হাতিয়ার বলে গণ্য করতে কোনো বাধা হয়নি। সিপিআই নেতা ডি রাজা ২০১১ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে একটা বিল নিয়ে এসে এই ধারাকে তুলে দেওয়ার আবেদন জানান। তিনি বলেন, “যারা জনগণের হয়ে লড়াই করে, এই ধারা মূলত তাদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ হয়।” মনমোহন সিং সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী তখন সংসদে বলেন, “এই ধারা অবশ্যই রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষে এটা অপরিহার্য। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা গণতন্ত্রের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ।” আর ২০১৯ সালের জুলাই মাসে নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রীসভার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজ্যসভায় বলেন, “জাতি-বিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী লোকজনদের সক্রিয় মোকাবিলায়” এই ধারা একান্তভাবেই জরুরি, এবং এটাকে তুলে নেওয়ার কোনো অভিপ্রায় সরকারের নেই। এইভাবে, বর্ণ যতই আলাদা হোক না কেন, সব সরকারের কাছেই ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রের নির্ণায়ক উপাদান হিসাবে রাষ্ট্রদ্রোহের ধারা অত্যন্ত অভিপ্রেত বিষয় হিসাবে অবস্থান করেছে। এবং রাষ্ট্রশক্তির কাছে এমন আবশ্যকীয় বস্তু হওয়ায় এই ধারার প্রয়োগেও বিরতি নেই, আর বর্তমান জমানা এর ব্যবহারে অন্যান্য জমানাকে অনেক ছাড়িয়ে গেছে।
মূলত সরকারের সমালোচকরাই এই ধারার শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। অর্থৎ, সংবিধান নিজস্ব মত প্রকাশকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিলেও তার অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত অনুশীলনকে সরকার বাঞ্ছিত বলে মানতে চায় না। সরকার তাই তার সমালোচকদের কাছে এই বার্তাই পাঠাতে থাকে যে — সরকার বিরোধিতায় মুখ বন্ধ না করলে দেশদ্রোহ আইনে শাস্তি পেতে হবে। আবার, সরকারের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ ঘনিয়ে উঠলে তার দমনে ঐ আন্দোলনের মূল সংগঠকদের নিরস্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে দেশদ্রোহ আইন সরকারের কাছে এক বড় অবলম্বন হয়ে ওঠে। গত দেড় দশকে দেশদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত হওয়ার কয়েকটি নিদর্শন হল — বিনায়ক সেন (২০০৭), তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে নির্মিত পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো কয়েক হাজার মানুষ (২০১১-১২), কানহাইয়া কুমার (২০১৬), ঝাড়খণ্ডের খুন্তি জেলায় জমি গ্ৰাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হাজার-হাজার মানুষ (২০১৯), সাংবাদিক কমল শুক্লা (২০১৮), আসামের স্কলার হীরেন গোঁহাই (২০১৯)। সাংবাদিক বিনোদ দুয়া ২০২০ সালের জুন মাসে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় মোদী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলাকে নিজ দলের পক্ষে ভোট টানার কাজে মোদী লাগিয়েছিলেন বলেও তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই মত প্রকাশকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হিংসায় প্ররোচনা দান বলে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ আইনে মামলা দায়ের করেছিলেন হিমাচল প্রদেশের বিজেপি নেতা অজয় শ্যাম ভিল। এছাড়া, ২০২১’র ২৬ জানুয়ারি দিল্লীর কৃষক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভুয়ো খবর’ ছড়ানোর অভিযোগে দেশদ্রোহের অভিযোগ দায়ের হয় কংগ্ৰেস নেতা শশি থারুর, সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই, ন্যাশনাল হেরল্ড পত্রিকার সম্পাদক মৃণাল পাণ্ডে, ক্যারাভ্যান পত্রিকার সম্পাদক পরেশ নাথ ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে। এঁরা নাকি “ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উস্কিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, হিংসা ও দাঙ্গার মত পরিস্থিতি সৃষ্টির বীজ বপন করেছিলেন।” অতএব, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের কর্মী, উত্তরপ্রদেশের হাথরসে গণধর্ষণের প্রতিবাদকারী, পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ব্যক্তি, বিভিন্ন জনআন্দোলনে যুক্ত হাজার-হাজার মানুষ — যাদেরই সরকার অসুবিধাজনক ও অস্বস্তিকর মনে করেছে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন দিয়ে তাদের নিরস্ত করার পথে সে এগিয়ে গেছে।
বিরোধী স্বরের দমনে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের নিয়মিত প্রয়োগ হলেও এর গণতন্ত্র-বিরোধী চরিত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠাকে থামানো যায়নি। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, সংবিধানের স্পিরিটের সঙ্গে তার অসংগতির কথা তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি বেশ কয়েকটা মামলা দায়ের হয়েছে। একটা মামলা করেছেন দুই সাংবাদিক — মনিপুরের কিশোর চন্দ্র ওয়াংখেমচা এবং ছত্তিশগড়ের কানহাইয়া লাল শুক্লা। দুজনেই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, এবং কানহাইয়া লাল শুক্লা আগাম জামিন পেলেও কিশোর চন্দ্র ওয়াংখেমচাকে ২১০ দিন কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। আর একটা মামলা করেছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর এস জি ভেম্ববাটকেরে। তৃতীয় একটি মামলা দায়ের হয়েছে অসরকারি সংস্থা ‘কমন কজ’ এবং প্রাক্তন বিজেপি নেতা অরুণ শৌরির পক্ষে যৌথভাবে। তিনটে মামলারই মূল স্বর হল — এই আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতার কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্ক রূপে হাজির হচ্ছে, যেকোনো বিরোধী মতের দমনে শাসক দলগুলো সারা দেশেই এই আইনকে ক্রমেই বেশি-বেশি করে প্রয়োগ করছে, এই আইন সম্পর্কে ৬০ বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত ঠিক হলেও আজকের পরিস্থিতিতে এই আইন সাংবিধানিক বৈধতার স্বীকৃতি পেতে পারেনা। এই আইনকে তাই বাতিল করা হোক। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ ভি রমণাও আইনটার অসংগত প্রয়োগের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন — “সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ করে এর অপব্যবহার করছে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে কোনো দায়বদ্ধতা নেই।” স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও এই আইনের কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, সেই প্রশ্নও তিনি তুলেছেন। দেশে এখন চলছে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা, কেন্দ্রের শাসকদের হাতে গণতান্ত্রিক অধিকারের হরণ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে, কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের অধিকারের বঞ্চনায় কোনো যতি নেই, স্বৈরাচারী শাসনের ভারে জনগণ ক্রমেই আরও ন্যুব্জ হয়ে পড়ছেন। এই অবস্থায় দানবীয় এই আইনকে বিদায় জানানোটা একান্ত আবশ্যক, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় দানবীয় আইনের কোনো ঠাঁই থাকতে পারে না।
- জয়দীপ মিত্র
কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপে একটি আবাসিক স্কুলে ২১৫ জন আদিবাসী শিশুর গণকবর আবিষ্কার হওয়ার খবরে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত। শত-শত বছর ধরে উপনিবেশিক ভয়ানক অত্যাচার চলেছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন আদি জনজাতিদের উপর। এই ঘটনা যে কেবল সুদূর অতীতের তা নয় বরং কানাডার বর্তমান প্রজন্মের আদিবাসীদের ওপর তার কষ্টদায়ক স্মৃতির প্রভাব রয়েছে।
কানাডার ‘ভারতীয় আবাসিক স্কুল ব্যবস্থা’র মূল প্রোথিত রয়েছে দেশের উপনিবেশিক অতীতে পাশ হওয়া ‘ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট ১৮৭৬’ আইনটির মধ্যে। এই স্কুলগুলির ঘোষিত উদ্দেশ্য হল দেশের জনজাতিদের সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে ঐ শিশুদের ইউরোপীয়-কানাডিয় সমাজ সভ্যতায় অভ্যস্ত করে তোলা। ২০০৮ সালে গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন অফ কানাডা (টিআরসি), কানাডা সরকার ও প্রায় ৮৬,০০০ আদিবাসী মানুষ যাঁরা আবাসিক স্কুলে শৈশব অতিবাহিত করেছেন তাদের মধ্যে একটা চুক্তি সম্পন্ন করেন সত্যতা নিরুপণের জন্য। টিআরসি তার রিপোর্টে বলেছে, ঔপনিবেশিক শাসকরা এই ধারণা পোষণ করতেন যে, বুনো অসভ্য জনজাতি যারা নিজেরা কখনই সভ্য হয়ে উঠবেনা তাদের সভ্য বানানোর জন্য তাঁরা এই স্কুল ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন। তাদের এই ‘সভ্য বানানো’র উদ্দেশ্য মূলগতভাবে বর্ণবিদ্বেষ ও সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতার প্রকাশ মাত্র।
৭ থেকে ১৬ বছরের আদিবাসী শিশুদের এই আবাসিক স্কুলে জোর করে নিয়ে আসা হোত। তাদের পরিবারের সাথে শিশুরা যাতে কোনও সংস্পর্শে না আসে তাই স্কুল স্থাপন করা হোত আদিবাসীদের বাসস্থান থেকে বহুদূরে। শিশুরা মাতৃভাষায় কথা বললে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। বর্তমানে আদিবাসীরা ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন তাদের ওপর শারীরিক ও যৌন অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সোচ্চার হচ্ছেন শিশুদের ওপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর অভিযোগ নিয়ে। অভিযোগ করছেন তাদের প্রায়শই প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া হোতনা।
এই প্রথমবার মৃত্যুর এই ঘটনা জনসাধারণের সামনে আসছে এমন নয়। টিআরসি’র হিসাবে প্রায় ৪,১০০ শিশু এই আবাসিক স্কুলগুলির হেফাজতে মারা গেছে। যদিও টিআরসি মনে করে হয়তো মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশী হতে পারে। বহু স্কুল অচিহ্নিত জায়গায় শিশুদের কবর দিয়েছে এবং তাদের পরিবার ঐ শিশুদের কি ঘটেছে আজও জানে না। টিআরসি কানাডা সরকারের কাছে ১৫ লক্ষ ডলার অনুদান চেয়েছেন অচিহ্নিত কবর খোঁজার কাজ চালানোর জন্য। কিন্তু সরকার তা মঞ্জুর করেনি।
আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদীদের আদিবাসী সংস্কৃতিকে বিস্মৃত করার পরিকল্পনা
আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে, কানাডা এবং অন্যান্য দেশ যখন তাদের ভয়াবহ অতীতকে মিটমাট করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তখন আরএসএস এবং তার সহযোগীরা আজ দেশে আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আত্তীকরণের কার্যকলাপ চালাচ্ছে। ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী, জনজাতি শিশুদের প্রায়শই অপহরণ করে সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলে ‘শিক্ষিত’ করে তোলা হয়। এই স্কুলগুলি সচরাচর এনজিও-দের অর্থে পরিচালিত হয়। এইসমস্ত এনজিও সেইসব কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত যারা আদিবাসীদের বিতাড়িত করে তাদের জমির দখল চায়। আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে মুছে ফেলে তাদের হিন্দু বানানোর এই চক্রান্ত কানাডার আবাসিক স্কুলের পুরোনো ছকের থেকে আলাদা নয়।
১৯৫০ সালে আদিবাসীদের ‘খ্রিস্টান’ ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর ধুয়ো তুলে গড়ে তোলা হয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম — আদপে যা একটি হিন্দুত্ব’র কর্মসূচি। মূল উদ্দেশ্য হল — জনজাতিদের সুস্পষ্ট পরিচিতি মুছে ফেলে হিন্দুত্বে আত্তীকরণ (ভার্জিনিয়াস কাকা রিপোর্ট ২০১৪)। আত্তীকরণের এই পরিপ্রেক্ষিত ভারতের নৃতত্ত্ববিদ্যার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি যেমন জি এস ঘুরাই এবং এ ভি ঠাক্কর (ঠাক্কর বাপা) প্রমুখ ব্যক্তিরা উল্লেখ করেছেন। ঠাক্কর বাপা আশ্রমশালা-মডেল গড়ে তোলেন যা বেশ প্রভাব বিস্তার করে। অলিম্পিকে হকিতে স্বর্ণ পদক জয়ী জয়পাল সিং মুন্ডা যিনি ১৯৪৯ সালে সাংবিধানিক সভার সদস্য ছিলেন — তিনি ঠাক্কর বাপাকে সভায় চলা বিতর্কে প্রতিবাদ করে বলেন যে তাঁর স্কুলে জনজাতিরা তাদের নিজেদের ভাষা ব্যবহারে অসমর্থ।
মালবিকা গুপ্তা এবং ফেলিক্স প্যাডেল বলেছেন যে আদিবাসীদের পরিচিতি শুধু মোছা হচ্ছেনা, আরও একটি উদ্দেশ্য হল ঐ শিশুদের নিম্ন মজুরির শ্রমিক হিসাবে তৈরি করে তোলা। আদিবাসীদের জন্য ১৯৬০ সাল থেকে এই আবাসিক স্কুল দ্রুতই বেড়ে উঠেছে তাদের শিল্পীয় শ্রমিক, কর্মচারী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। ১৯৯০ সাল থেকে সরকার পরিচালিত নতুন স্কুল চালু হয় যেমন — কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়, একলব্য মডেল আবাসিক স্কুল ইত্যাদি। বেসরকারি স্কুলও চালু হয় ভুবনেশ্বরে — কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অফ সোস্যাল সায়েন্সেস (কেআইএসএস)। বেদান্ত এবং নালকো’র মতো কোম্পানিগুলো যারা আদিবাসীদের গ্রাম থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ ঘটিয়েছে তারা, কেআইএসএস-এর যে প্রকল্প — মাওবাদী অধ্যুষিত আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে আদিবাসী শিশুদের আবাসিক স্কুলে তুলে এনে ভর্তি করা — এই প্রকল্পকে সমর্থন করে। আদিবাসী পরিচিতিকে চেপে দিয়ে হিন্দু উৎসবগুলিতে উৎসাহ দেওয়ার ঘটনা লক্ষ্যণীয়। রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত স্কুলেও একই ঘটনা দেখা যায়। গোন্ডী, মারিয়া, হালবি, এবং ছত্তিশগড়ী যাদের মাতৃভাষা তাদের নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এইভাবে আদিবাসী শিশুরা তাদের মাতৃভাষা ভুলতে বসেছে।
কানাডার আবাসিক স্কুল এবং কর্পোরেট-হিন্দুত্ব পরিচালিত আবাসিক স্কুল সমান্তরালভাবে আদিবাসী শিশুদের ছুটির অবকাশে বা উৎসবের সময় তাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়া প্রতিহত করে। এর উদ্দেশ্য হল শিশুদের মনে আদিবাসী সংস্কৃতি সম্পর্কে লজ্জা বা ঘৃণার ধারণা গেঁথে দেওয়া। তাদের বোঝানো হয় আদিবাসী এবং হিন্দু সংস্কৃতির এই পার্থক্যর কারণ হল আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক জীবন যাপনের রুগ্নতা। এরফলে শিশুরা ক্রমশ তাদের নিজেদের সমাজ সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকার জন্য তাদের স্বনির্ভর জীবিকার যে অর্থনীতি তা ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা আপাত মুক্ত হয়ে নিম্ন মজুরির শ্রমিকে পরিণত হয় বড়ো বড়ো বহুজাতিক কর্পোরেশনের জন্য। বহু আবাসিক স্কুলের খরচের একটা ভালো অংশ আসে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আর্থিক কর্মসূচি থেকে। এই কর্মসূচি কতটা অকার্যকরি এবং নিজেদের লভ্যাংশ তোলার একটা হাতিয়ার মাত্র তা প্রমাণিত হয়।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির দরিদ্র পরিবার থেকে একইভাবে শিশুদের অপহরণ করে বিভিন্ন সংগঠন যেমন ‘সেবা ভারতী’ ভিন্ন রাজ্যে তাদের চালান করে ‘হিন্দুত্ব মূল্যবোধ’এর ধারণা মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য।
সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণকারী আরএসএস ও তার সহযোগীদের এবং রাষ্ট্রের এই সাংস্কৃতিক বিলুপ্তিকরণের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদের এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।
- লিবারেশন, জুলাই ২০২১ সংখ্যা থেকে
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে নারীর বিপন্নতা বেড়েছে। গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে, নিজস্ব পরিসর কমছে, কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে, সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান কমেছে। সমাজের সর্বস্তরের মহিলাদের মধ্যেই কর্মচ্যুতর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু আরেক দিকে এক রূপোলি রেখাও স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। সংকট এত সূচিমুখ হয়ে উঠছে বলেই, সমান তালে বিভিন্ন মাত্রায় চলছে লড়াই। পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা রীতিনীতির শেকলে ঘা পড়ছে প্রতিনিয়ত।
‘বিবাহ’ এক বিশেষ প্রতিষ্ঠান, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এক অচ্ছেদ্য অংশ। যার মাধ্যমে ‘স্বামী’ স্ত্রীর ভরণ পোষণ ও মানসম্ভ্রম রক্ষার ভার বহনে প্রতিশ্রুত হন। এবং যার মাধ্যমে পিতা সালঙ্কারা কন্যাকে ‘উপযুক্ত’ পাত্রকে সম্প্রদান করেন, মানে ‘সম্পত্তি’ হিসাবে দান করেন।
ভরণ পোষণ? মানসম্ভ্রম রক্ষা? অন্য সবকিছু বাদ দিলেও, রাষ্ট্রের নিগ্রহ, নিপীড়ন থেকে স্বামী কী করে স্ত্রীকে বাঁচাবেন? অসমে এনআরসি’র বলি হয়েছেন মহিলারাই সবচেয়ে বেশি। লকডাউনে নিরুপায় স্বামী অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে চোখের সামনে মরতে দেখেছেন। স্বামী দায়ভার বহন করুন আর নাই করুন, মরিয়া সমাজ কিন্তু এখনও স্ত্রীকে স্বামীর ‘সম্পত্তি’ হিসেবেই দেখতে নাছোড়বান্দা।
কখনও নুসরতের বিয়ে বা তার সন্তানের পিতৃত্ব, কখনও আমির-কিরণের ডিভোর্স এরকম হাজার এক প্রশ্ন ঘিরে উঠে আসছে সেই আঘাত, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আমরা ছোটবেলা থেকেই একরকম পরিবার প্রতিষ্ঠানে তার নিজস্ব রীতিনীতি ধ্যান ধারণার মধ্যে আর পিতৃতান্ত্রিক, হেটেরোনরমেটিভ সমাজে বড় হয়ে উঠতে উঠতে সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। সমাজে এই প্রতিষ্ঠিত একক পরিকাঠামোকে মানতে আমরা বাধ্য। আর এই সমাজই ‘ভালো সম্পর্ক’ বা বলা ভালো ‘ভালো মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়। তথাকথিত ‘ভালো’ সম্পর্ক মানে যেখানে ‘আমি শুধু তোমার’ বলে মনের দরজায় খিল এঁটে বসে থাকি। ভালো মেয়েরা নিজেদের চাহিদার কথা বলেন না, পুরুষ চাইলে সোহাগে মোড়া হিসেবেই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও সবকিছু মেনে নেন। তাদের আর কাউকে কস্মিনকালেও ভালো লাগতে পারে না। নিজের শরীরের উপরেও তাদের কোনও অধিকার থাকতে পারে না। যৌন চাহিদার কথা বাদই দিলাম, গর্ভধারণও পরিবার ও স্বামী কর্তৃক নির্ধারিত, অত্যন্ত অবমাননাকর হলেও, সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখতে হবে সংসার সন্তানের কথা ভেবে, দরকার হলে পায়ে ধরে। এগুলোই বছরের পর বছর সংবাদমাধ্যমের প্রচার সৌজন্যে বা তথাকথিত নীতিকথার মোড়কে আমাদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌঁছে যায়। চলতে থাকে নিজেকে তৈরি করার প্রক্রিয়া, কমোডিফিকেশন। তাই সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালের উপর আঘাত সমাজ মানতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
এই কিছুদিন আগে গায়ের রং কালো বলে এক অভিনেত্রীকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল, চটুল মন্তব্য সহ্য করতে হয়েছে। কেন? তাঁর ‘অপরাধ’ সমাজ প্রতিষ্ঠিত ‘সুন্দর’এর সংজ্ঞা না মেনে তিনি অভিনয় জগতে কাজ করতে নেমেছেন! অর্থাৎ তাঁর অভিনয় ক্ষমতা নয়, তার গাত্রবর্ণই প্রধান বিবেচ্য! পুরুষের অভ্যস্ত ‘চোখ’কে তিনি কতটা ‘সুখ’ দিতে পারছেন, তার উপর তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করছে! কারণ এই সমাজ নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখতে শিখিয়েছে। পুরোমাপের একজন ‘মানুষ’ হিসেবে নয়!
এই করোনা পরিস্থিতিতে অনেক রকম ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, একাকীত্ব, মানসিক অবসাদ আমাদের গ্রাস করছে। প্রভাব ফেলছে সম্পর্কের উপরেও। স্বাধিকারের লড়াইটা বহু দিন আগে থেকেই প্রচ্ছন্ন থাকলেও, এই চার দেওয়ালে বন্দী হওয়ার দরুণই বোধহয় তা প্রকট হয়ে উঠছে। নারীর স্বাধিকার বোধ তীব্র হচ্ছে। মনের ‘খিল’ একটু হলেও শিথিল হচ্ছে। সেজন্যই হয়ত নুসরাত দৃঢ়ভাবে অন্তত বলছেন যে সন্তানের ‘পিতৃপরিচয়’ তিনি নিজে জানলেই যথেষ্ট বা আমির কিরণ প্রকাশ্যে বলছেন, তাঁরা সম্পর্কে হয়ত থাকবেন না কিন্তু পারস্পরিক সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। আর আমরা এতটাই বৈষম্যমূলক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ যে এই বিষয়গুলো মোটেই সহজভাবে নিতে পারছি না।
সমাজে সম্পর্কের মূল্যবোধের ধারণাকেও করোনা ঘা মেরেছে। সম্পর্কের ফাঁক ফোকরগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, ফাঁকিবাজিটা নগ্ন করে দিয়েছে। পরস্পরকে ভালোবেসে নিজেদের পছন্দে স্বামী-স্ত্রী বা লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা দু’টি নারী পুরুষ আগে বাইরের জগতে নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসরকে উপভোগ করার সুযোগ পেত — লকডাউনে চব্বিশ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক মুখোমুখি থাকার জীবনে যা হারিয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই নিজের ইচ্ছায় নিজস্ব পছন্দের জীবন বেছে নেওয়াটাই কি যথেষ্ট স্বাধীনতা নয়! নাহ, একদমই নয়। সম্পর্কটা একক প্রেম হোক, ‘স্পেস’ সম্পর্কিত হোক বা সম্পর্কটা বহুগামী হোক সেক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর দরুণই মহিলা এবং প্রান্তিক যৌনকামী মানুষজন নিপীড়ন বা শোষণের শিকার হয়ে পড়েন। কারণ ক্ষমতার নিরিখে এই উভয় সমাজ পুরুষের তুলনায় বহুধাপ নিচেই আছে। কাজেই সেই লড়াইটাও চালাতে হবে সমান তালে। সমাজে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কগুলোতে ‘দরকারের সময় পাশে থাকার’ একটা নিশ্চয়তা বা অঙ্গীকার থাকে যেটা সামাজিক নিরাপত্তা ও ‘ভালো’র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। লকডাউনে এই ‘ভালো’র খোলসগুলো আলগা হয়ে এসেছে। তাই উঠে আসছে এই বিতর্কগুলো, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের গোড়ায় আঘাত লাগার ফলে বাড়ছে অতীব বীভৎস ভাষায় আক্রমণ।
প্রেম বা সম্পর্ক মানে একজনের আরেকজনের উপর ‘দখলদারি’ নয়, একজন অপরজনের ‘সম্পত্তি’ নয়! ‘দখলদারি’র মনোভাব থেকেই আসে নিরাপত্তাহীনতা। সেটা থেকে বেরিয়ে এসে, একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করেই একে অপরের ভালো লাগা, ভালো থাকাগুলোকে জায়গা করে দিলে সম্পর্কগুলো আর ‘দমবন্ধ’ হয়ে, আধমরা হয়ে যাবে না। সেই বোঝাপড়া থেকে অনেক সম্পর্ক আবার সারা জীবন অটুট থাকে। এতক্ষণ যা নিয়ে কথা বললাম সেটার মতো এটাও সত্যি ও বাস্তব। কোনওটাই একটু বেশি ঠিক বা একটু বেশি ভালো নয়। এই গল্পগুলোই কিরণ আমির, নুসরতরা সটান বলেছেন বলে আমাদের গায়ে লেগেছে। কিন্তু অচলায়তন তো এভাবেই ভাঙে! আমরাও ভাঙব, শিখব এভাবেই একটু একটু করে।
- সৌমি জানা
‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ আমূল নাড়া দিয়েছিল দেশের, বিশেষ করে বাংলার যুবসমাজকে। পরাধীন ভারতে নির্মম সামন্তী শোষণ আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বর্বর শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তেভাগা, তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, আর অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের আত্মদানের কথা তাদের শৈশব কৈশোরে বেড়ে ওঠার পরতে পরতে মিশে গিয়েছিল। বহু আকাঙ্ক্ষিত, রক্তে ধোওয়া স্বাধীনতার দুটি দশক পেরিয়ে গেলেও কোথায় মানুষের সসম্মানে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা, স্বস্তির দু’মুঠো অন্ন? শান্তির আশ্রয়? কোথায় বৈষম্যহীন সমাজ? এইসব প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত সময়েই, ১৯৬৭তে ঘটে গেল ‘নকশালবাড়ি’।
গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার, শ্রমিক-কৃষকের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন আরও হাজারো তরুণ-তরুণীর মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র মুরারিকেও উদ্বেল করে তুলেছিল। দক্ষিণেশ্বর আড়িয়াদহের যুবক, কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়। নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিন্তু সংস্কৃতি-অনুরাগী পরিবারের সন্তান মুরারি। সংগীত-প্রেমী স্কুলশিক্ষক বাবা সন্তোষ মুখোপাধ্যায় গ্রামোফোন কেনার মত আর্থিক সাচ্ছল্য না থাকায় নিজেই একটি তৈরি করে নিয়েছিলেন। কবিতা লেখা ও আবৃত্তি করার সূত্রে মুরারি এলাকার বিভিন্ন গণসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই সময়ে আড়িয়াদহ দক্ষিণেশ্বরে ছাত্রদের একটা অংশ প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। আড়িয়াদহ দক্ষিণেশ্বর তখন হয়ে উঠেছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের ত্রাসের জায়গা। টেক্সম্যাকো কারখানার লড়াকু শ্রমিক নেতা কানাই ভট্টাচার্য এবং যতীন দাস সহ বারাসাত গণহত্যাকাণ্ডের আট শহীদের সকলেই ছিলেন আড়িয়াদহ দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা। ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর হাত বাঁধা অবস্থায় বারাসাতের বড় রাস্তার ওপর পাওয়া গিয়েছিল অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত ৮ জন যুবকের মৃতদেহ। এঁরা হলেন কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশ ঘটক, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, তরুণ দাস, সমরেন্দ্র দত্ত ও স্বপন পাল।
মুরারি এলাকার যুবছাত্রদের বিপ্লবী রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্রী কোচিং সেন্টার চালাতেন, সাংস্কৃতিক পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতেন। নকশালবাড়ির রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ায় এমএ ফাইনাল পরীক্ষা আর দেওয়া হল না। সিপিআই(এমএল) গঠনের পরে তিনি আড়িয়াদহ-দক্ষিণেশ্বর আঞ্চলিক পার্টির দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি গ্রামে চলে যান এবং পার্টির ‘বাংলা বিহার উড়িষ্যা সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটি’র কাজের সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ মুরারি, ওরফে আনন্দকে, পুরুলিয়ার বহড়াগাড়ো-চাকুলিয়া অঞ্চল থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ঠাঁই হয় বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই দুপুর আড়াইটায়, জেলে কারারক্ষীদের লাঠি ও গুলিতে শতাধিত বন্দী আহত হন, মারা যান মুরারি সহ ১৬ জন। রাষ্ট্রের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর বর্বরতায় শহীদ হলেন মুরারি মুখার্জী, বিজন, মিশ্র, ডি কে, ডাম্বেল, বাবি, চির, প্রদীপ, বেণু, অলক, সুনীল, গণেশ, গুরুচরণ, রবীন অধিকারী, মাধবানন্দ এবং সমীর। ২৬ বছরের তরুণ মুরারি সহ ঐ শহীদদের মৃতদেহ পর্যন্ত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার সাহস হয়নি খুনী প্রশাসনের।
মুরারি পার্টির প্রতি কর্তব্যে ছিলেন অটল। দৃঢ়সংকল্প মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকশন মুহূর্তেও থাকতেন সংযত, ধীর। কথিত আছে তিনি বোমের মশলাভর্তি ব্যাগের মধ্যে রবীন্দ্ররচনাবলীও সঙ্গে রাখতেন। জীবনে স্বাভাবিকভাবেই প্রেম এসেছিল, কিন্তু বৃহত্তর সংগ্রামের আহ্বানে ঘর ছেড়ে ছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবী কবি মুরারি।
সব রাজ্যের মতো বিহার সরকারও সেন্ট্রাল জেলের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের জন্য তদন্ত কমিশন বসিয়েছিল, কিন্তু সেই কমিশনের রিপোর্ট দিনের আলোর মুখ দেখেনি কোনোদিন।
৫০তম শহীদ বার্ষিকীতে, সিপিআই(এমএল)-এর নেতা ও নকশালবাড়ি আন্দোলনের সংগঠক শহীদ কমরেড মুরারি মুখোপাধ্যায় সহ সমস্ত শহীদদের জানাই লাল সেলাম।
- তথ্যসূত্র: ‘মিলনসাগর’
নকশালবাড়ী কৃষক আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা কমরেড যোগেন বিশ্বকর্মকার ২৯ জুলাই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভোরবেলা প্রয়াত হন। তিনি কানু সান্যালের দলের নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে আমাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হয়ে প্রচার করেছিলেন। তাঁর আকাঙ্খা ছিল আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে থাকবেন। মেডিক্যাল কলেজ থেকে আমাদের ফাঁসিদেওয়া অফিসে তাঁর মরদেহ আনা হয়। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান পার্টির পক্ষ থেকে পবিত্র সিংহ, নেমু সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, শরৎ সিংহ, দীপক ঘোষ, পঞ্চা বর্মন প্রমুখ।
২৭ জুলাই শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালে প্রয়াত হন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বালি-বেলুড় লোকাল কমিটি সদস্য এবং মহাদেও জুটমিলের বিসিএমএফ নেতা দীর্ঘদিনের লড়াকু কমরেড রাজেন্দ্র গুপ্তা (সাউ)। তিনি দূরারোগ্য গলার ক্যান্সারে ভুগছিলেন। মহাদেও জুটমিলে প্রথম পর্যায়ে তৈরির প্রক্রিয়ায় সিপিএমের সেই সময়ের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কমরেড রাজেন্দ্র গুপ্তা (সাউ) অন্যতম। মিলের পিএফ ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচনে কমরেড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং সেই নির্বাচনে জয় আসে। রাজ্যে পালাবদলের পরে তৃণমূলের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করেও জুটমিলে সংগঠনের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন মহাদেও জুটমিলের সামনে যখন অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন কোনোরকম কর্মসূচি নেয়নি শাসক দলের ভয়ে।
রাজেন্দ্র গুপ্তা ছিলেন বিসিএমএফ-এর রাজ্য কাউন্সিল, এআইসিসিটিইউ-র হাওড়া জেলা কমিটি এবং পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমরা হারালাম মহাদেও জুটমিলের এই জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা এবং পার্টি নেতাকে। এক অপূরণীয় ক্ষতি হোল শ্রমিক আন্দোলন এবং পার্টির। তাঁর প্রয়াণে থেকে গভীর শোকপ্রকাশ করেন বিসিএমএফ-এর পক্ষে নবেন্দু দাশগুপ্ত, এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, অতনু চক্রবর্তী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তাঁর মরদেহ প্রথমে তাঁর পুরানে বাড়ি বালি রাসবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আনা হয় বালিতে পার্টির জেলা অফিসে। সেখানে রক্তপতাকা দিয়ে কমরেডকে শ্রদ্ধা জানান পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, বিসিএমএফ-এর মহাদেও জুটমিলের পক্ষে সমীর মজুমদার, বালি জুটমিলের পক্ষে তপন ঘোষ, পার্টির রাজ্য কমিটি ও জেলা কমিটি সদস্য নিলাশিস বসু, জেলা কমিটি সদস্য মাধব মুখার্জি, বালি-বেলুড় লোকাল কমিটি সদস্য অঙ্কিত মজুমদার, রঘুপতি গাঙ্গুলি, দিলীপ ঘোষ, অমিতাভ বিশ্বাস, ধনঞ্জয় দাস, আইসার পক্ষে তীর্থ, পার্টির বর্ষীয়ান নেতা অমিতাভ ব্যানার্জী, অলোক দাস প্রমুখ কমরেড সহ প্রয়াত কমরেডের ছেলে রাহুল। নীরবতা পালন এবং সর্বহারার আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে কমরেড রাজেন্দ্র গুপ্তা (সাউ)-কে বিদায় জানানো হয়।
কমরেড রাজেন্দ্র গুপ্তা (সাউ) লাল সেলাম!
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর দূত শ্রী মানিক সমাজদার ২৮ জুলাই কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর যাতায়াত ছিল আমাদের মধ্য কলকাতায় রাজ্য অফিসে। এক উষ্ণ সম্পর্কও ছিল। তাঁর প্রয়াণ আমাদের ব্যথিত করেছে। তাঁর স্মৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের উদ্দেশ্যে সমবেদনা জানাই।
== সমাপ্ত ==