দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে আগামী ৩১ জুলাই ২০২১’র মধ্যে দেশের সব রাজ্যের সমস্ত মানুষের রেশন কার্ডের সঙ্গে যেন আধারের সংযোগ ঘটানোর প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। এই রায় দেওয়ার একটাই কারণ গত লকডাউনে যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের দীর্ঘ হাঁটা সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় তখন ওই আদালত তিরষ্কার করে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে দেশে যদি করোনার মতো অতিমারী আসে সরকার তা সামলাতে পারবে না? কেন মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবেন? কেন কতজন পরিযায়ী শ্রমিক এই মুহূর্তে কাজ করছেন, তার কোনও তথ্য নেই, সেই প্রশ্নও কেন্দ্রীয় সরকারকে করেছে সর্বোচ্চ আদালত। সরকার অজুহাত হিসেবে বলেছে, রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ হচ্ছে না তাই মানুষ রেশন পাচ্ছে না। আদালত তাই আদেশ দিয়েছে, ঠিক আছে, সেটা তবে করা হোক।
এই আদেশের পর সব রাজ্যেই আধার সংযোগের কাজ শুরু হয়ে গেছে। হওয়ার কথা ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণের কাজ, তা কোথায় কি করা হল খবর নেই, চালু হয়েছে আধার সংযোগের কাজ। তবে ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে আধারের এবং রেশন কার্ড সংযোগ করার পরেও রেশন না মেলার অভিযোগ আসছে। বিভিন্ন সময়ে কাজের ধরন, বয়সের কারণ বা অন্যান্য অনেক কারণে মানুষের হাতের ছাপ মেলে না, তাহলে কি সেই মানুষটির অস্তিত্ব থাকেনা? রাজ্য সরকার দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে রেশন কার্ডের সঙ্গে আধারের সংযোগ করাচ্ছেন, কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? যেখানে আধারের তথ্য ভান্ডার কোনোদিন পরীক্ষিত হয়নি, কত ভুয়ো আধার আছে তা জানা নেই, দেশের নানান প্রান্তে বহু সময়ে যাঁদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে ধৃত দাবি করা হয়েছে তাঁদের কাছে ভুয়ো আধারও পাওয়া গেছে। আধার শুধু বাদ দেওয়ার উপকরণ নয়, এক ধরনের বড় দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাও বটে। একজন মানুষের পরিচয় যখন একটি সংখ্যায় পর্যবসিত হয় তখন সেই মানুষটির কি অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না?
২০১৩ সালে যে খাদ্য নিরাপত্তা আইন লাগু হয় তাতে বলা হয় যে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে রেশন কার্ড দিতে হবে। ২০১১’র জনগণনার নিরিখে সেই কাজ শুরু হয়েছিল, আর এই মুহুর্তে দেশের ৬০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৮০ কোটি মানুষের কাছে রেশন পৌঁছানোর জন্য যা করার তাই করতে হবে। কিন্তু তা কখনোই আধার সংযোগ নয়। খাদ্য সুরক্ষা আইন বলে একজন মানুষ ৫ কেজি খাদ্য শস্য পেতে পারেন অথবা পরিবার পিছু ৩৫ কেজি মাসিক খাদ্য শস্য পাবেন অন্তোদ্যয় যোজনায়। প্রতিটি অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট রেশন দোকান থেকে ওই মানুষেরা তাঁদের জন্য বরাদ্দ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতেন এতদিন। তাহলে ‘এক দেশ এক রেশন’ নতুন কি সুবিধা দেবে? যা বোঝা যাচ্ছে তা হল, এই প্রকল্পের ফলে একজন বিহারের মানুষ যদি বাংলায় বা কেরালায় কাজ করতে যান, তিনি সেই রাজ্যে যেখানে থাকবেন সেখানকার কোনও রেশন দোকান থেকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে পারবেন।
শুনতে আকর্ষণীয় মনে হলেও বেশ কিছু প্রশ্ন এসেই যায়।
প্রথমত, সরকারের কাছে কি এই তথ্য আছে যে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক এই সরকারি খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা থেকে আগে থেকেই খাদ্য শস্য সংগ্রহ করতেন? কিংবা কতজনের রেশন কার্ড আদৌ আছে? আত্মনির্ভর ভারতের যে ঘোষণা করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে, তাতে বলা হয়েছে যে আট কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে গণবন্টন ব্যবস্থার মধ্যে, তার মানে অন্তত ন্যূনতম এই সংখ্যার মানুষের কোনও রেশন কার্ড ছিল না।
দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকেরা গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যান, বেশিরভাগ সময়ে পরিবারকে গ্রামে রেখেই যান, পরিবারের মানুষেরা রেশন দোকান থেকে খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে সংসার চালাতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বেশিরভাগ রাজ্যেই যেহেতু পরিবার পিছু একটি করে কার্ড তাই তাঁদের ক্ষেত্রে এটা সবসময়েই সত্যি যে তাঁরা শহরে কাজে গেলেও তাঁদের পরিবারের কার্ডটি বাড়িতে থাকে। তাহলে যদি কোনও ব্যক্তি তর্কের খাতিরে ধরা যাক রেশন কার্ডটি নিয়ে যেতে হয় তার আগে তো মাথা পিছু কার্ড তৈরি করতে হবে। নাহলে যে যেখানে থাকছেন অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁর পরিবার কিভাবে পাবেন তাঁর বা তাঁদের প্রাপ্য খাদ্যশস্য? যদি আমাদের রাজ্যের মতো প্রত্যেকটি মানুষের জন্যে আলাদা কার্ডও থাকে তাহলেও শহরে এবং গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে রেশন নিতে গেলে যদি মানুষেরা অসুবিধার সম্মুখীন হন, সেই অসুবিধা সামলানো যাবে কি করে? কোনও একজনকে যদি বলা হয় যে তাঁর প্রাপ্য রেশন তোলা হয়ে গেছে, তিনি কি করে প্রমাণ করবেন যে তোলা হয়নি? গ্রামের মহিলারা কি এতোটা প্রযুক্তি বান্ধব হয়ে উঠেছেন, কিংবা এতোটা সোচ্চার হতে পারবেন যদি চোখের সামনে দুর্নীতি হয়েও যায়? যদি বলা হয় যে শহরে তাঁর পরিবারের প্রাপ্য রেশন তোলা হয়ে গেছে, তাহলে তিনি কিভাবে তার প্রতিবাদ করবেন?
তৃতীয়ত, বেশ কিছু রাজ্য, কেন্দ্রের যে খাদ্য শস্য দেওয়ার প্রকল্প চলছে তার বাইরে গিয়ে আরও বেশ কিছু জিনিষ দিয়ে থাকে। তামিলনাডু, ছত্তিশগড় এবং হিমাচল প্রদেশ ডাল এবং ভোজ্য তেলও সরবরাহ করে ভর্তুকি দিয়ে। যেখানে কেন্দ্র শুধু চাল এবং গম দেয়, সেখানে রাজ্য সরকারের তরফে এই তেল, ডাল দেওয়ার ফলে মানুষ উপকৃতই হচ্ছেন। কেন্দ্র যেমন চালের জন্য পয়সা নিয়ে থাকে, কোনও কোনও রাজ্য বিনামুল্যে চাল দিয়ে থাকে। তাহলে একজন বাঙালী শ্রমিক যদি তামিলনাডুতে কাজ করতে যান, তাহলে তিনি বিনামুল্যে চাল পাবেন, এবং ভর্তুকিতে তেল, ডাল পাবেন। নাকি তাঁকে বলা হবে যে তিনি ওইসব পাওয়ার যোগ্য নন, যেহেতু বাংলায় এই খাদ্য দ্রব্য তাঁর পাওয়ার কথা নয়? এরসঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের বিষয়টিও আছে, একজন মানুষের যদি শুধু ভাত খাওয়ার অভ্যাস থাকে, তিনি যদি রাজস্থানে বা পাঞ্জাবে যান তাহলে কি তাঁকে রুটি খেয়ে থাকতে হবে, যেখানে গণবন্টন ব্যবস্থা দিয়ে শুধু গমই সরবরাহ করা হয়? সমস্ত খাদ্যাভ্যাসকে এক করে দেওয়াও তো এক ধরনের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বটে। আপনি কি খাবেন না-খাবেন সেটাও তো রাষ্ট্রের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত করা হয়ে যায়। রাজ্য রাজ্য প্রকার ভেদে রসদ সংক্রান্ত চাহিদা ও যোগানের সমস্যাও তৈরি হবে। আগে কোনও একটি অঞ্চলের রেশন দোকানে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাদ্য দ্রব্য ফুড কর্পোরেশন বা কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে আসতো, কিন্তু ‘এক দেশ এক রেশন’ কার্ড যদি জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কত মানুষের জন্য খাদ্য দ্রব্য আনতে হবে তা হিসেব করাও মুশকিল হবে। ধরা যাক বিহার থেকে ২০ জন শ্রমিক বাংলার একটি জেলায় কাজ করতে এসেছেন এক মাসে, পরের মাসে সংখ্যা বাড়তে পারে কমতেও পারে, তাহলে কোনও একটি রেশন দোকানে খাদ্য শস্য সরবরাহ হবে কি হিসেবের ওপর দাঁড়িয়ে? তারফলে অঞ্চলে যারা স্থায়ী বাসিন্দা তাঁরা ঠিকঠাক পরিমাপ মতো খাদ্যশস্য পাবেন তো?
‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ হয়তো সম্ভব, কিন্তু তারজন্য যা যা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা করতে হবে তা কি করা হচ্ছে? হচ্ছে না। গত লকডাউনের সময়ে বেশ কিছু রাজ্য আধার দিয়ে যাচাই বা বায়োমেট্রিক্স দিয়ে মানুষ চেনার পদ্ধতি সাময়িকভাবে বাতিল করেছে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন তো ক্ষমতায় আসার পরেপরেই এই প্রক্রিয়াতে মানুষ বাদ পড়ছেন বলে বাতিল করেছেন। যখন উচিত বিভিন্ন রাজ্যে আরো বেশি বেশি যৌথ সরকারি রান্নাঘরের, যখন প্রয়োজন শহরে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের জন্য তৈরি খাবারের বা রেশন ব্যবস্থাকে আরও সর্বাঙ্গীণ করে তোলার তখন আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডকে সংযোগ করলে সমস্যা বাড়বে বই কমবেনা। বেশ কিছু রাজ্য কিন্তু সবার জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু করে ফেলেছে, যারা ইচ্ছুক তাঁরা যাতে সরকারি ব্যবস্থা থেকে খাদ্যদ্রব্য নিতে পারেন, কিন্তু তাতে আধার সংযোগ বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এই করোনা পরিস্থিতিতে একটি পিওএস মেশিন অর্থাৎ পয়েন্ট অফ সেল মেশিনে সমস্ত মানুষজন হাত দিয়ে আঙুলের ছাপ মিলাচ্ছেন সেটাও কি খুব সমীচিন হচ্ছে?
সারা দেশের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে আধারের কারণে বিভিন্ন রাজ্যে বহু মানুষ বাদ পড়ছেন। আমাদের পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ডের একটি উদাহরণ দেখা যাক। কয়েকবছর আগেই বহু সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছিল একটি খবর। ১১ বছরের সন্তোষী ‘ভাত ভাত’ করতে করতে মারা যায়। তার পরিবারের রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার যুক্ত না থাকার ফলে সরকারি রেশন না পেয়ে খিদের জ্বালায় মারা যায় কিশোরীটি। যদিও তৎকালীন সরকারের তরফে এই মৃত্যু আধারের কারণে বঞ্চনার জন্য তা মেনে নেওয়া হয়নি, কিন্তু এটা স্বীকার করা হয়েছিল অপুষ্টি জনিত অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হয়। অর্থনীতিবিদ জাঁ দ্রেজ এই বিষয়ে বিশদে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন যে শুধুমাত্র এই বায়োমেট্রিক দিয়ে বা আধার দিয়ে চিনতে গিয়ে বহু মানুষ রেশন পাচ্ছেন না। শুধু ঝাড়খন্ডেই বহু মানুষ রেশন না পেয়ে মারা গেছেন এরকম অজস্র উদাহরণ আছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণের যে রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে তার পরিবর্তে আধারের যাঁতাকলে রেশন উপভোক্তাদের সুচতুরভাবে ছেঁটে ফেলা যে কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই করবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
- সুমন সেনগুপ্ত