৮৪ বছর বয়সী জেসুইট সমাজ সেবক ফাদার স্ট্যান স্বামীর হেফাজত-হত্যার বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ড সহ সমগ্র ভারতের দরিদ্র নিপীড়িত জনতার ক্ষোভ ও শোকের অংশীদার সিপিআই(এমএল)। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) মোদী-শাহ রাজের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। ‘ভীমা কোরেগাঁও মামলা’র পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশের যেসব অগ্রণী মানবাধিকার কর্মীরা, এনআইএ তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে। এবং জামিন না দিয়ে অনির্দিষ্টকাল বিনা বিচারে কারাগারে ফেলে পচানোর জন্য কুখ্যাত ইউএপিএ ধারা চাপিয়েছে। ফাদার স্ট্যান স্বামীকেও এই মামলার সূত্রেই গ্রেপ্তার করেছিল ওরা।
এনআইএ এবং মোদী-শাহ রাজ খুব ভালো করেই জানে যে ভীমা কোরেগাঁওয়ের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা ভিত্তিহীন, হাস্যকর। ওরা ভালো করেই জানে যে শুনানি চললে শেষ পর্যন্ত সকল অভিযুক্তই বেকসুর খালাস পাবে। কিন্তু ইউএপিএ ধারায় আটক করে তারা এই ‘বিচার প্রক্রিয়া’কেই হেফাজত-নির্যাতনের কাজে এমনকি মৃত্যুদণ্ডের কাজে লাগিয়ে নিতে চেয়েছে।
ফাদার স্ট্যান স্বামীর জামিনের শুনানিপর্ব ভারতের বিচারবিভাগের ইতিহাসে এক অত্যন্ত কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে গণ্য হবে। কুখ্যাত এডিএম জাবালপুর মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একদা জরুরি অবস্থার হাত থেকে সাংবিধানিক স্বাধীনতা রক্ষা করতেও ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু স্ট্যান স্বামীর জামিন-শুনানি তার থেকেও হীন নজির স্থাপন করল। এই শুনানিগুলিতে বিচারকেরা দুটি গোটা মাস অতিবাহিত করে দিয়েছে শুধুমাত্র ফাদার স্ট্যান স্বামীর জল খাওয়ার অসুবিধা দূর করে একটা স্ট্র ব্যবহার করার অনুমতি দিতে। বৃথাই তিনি বারবার আবেদন জানিয়েছেন যে তিনি হাঁটাচলা করতে পারেন না, জেলসঙ্গীরা চামচ দিয়ে খাইয়ে দিলে তবেই কেবল খেতে পারেন। এইসব আবেদন আদালত উড়িয়ে দিয়েছে ‘বার্ধক্যের লক্ষণ’ বলে। বিচারাধীন বন্দীর জামিন পাওয়ার কারণ হিসেবে এগুলো নাকি গ্রাহ্যই হবেনা। যে যে বিচারক ফাদার স্ট্যান স্বামীর জামিন নাকচ করেছেন তাঁদের সকলের হাতে এই হত্যার রক্ত লেগে থাকবে।
যে তদন্তকারী সংস্থাগুলি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ভূয়ো মামলা সাজিয়ে বিচারাধীন অবস্থাতেই জেলের ভেতর নির্যাতন এমনকি মৃত্যুর ব্যবস্থাপনা পাকা করেছিল সেই সব সংস্থারই মাথায় বসে আছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পরিহাসের বিষয় হল, এই অমিত শাহ আবার ২১ মাস চলা জরুরি অবস্থায় কীভাবে গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ নেমেছিল তার বর্ণনা দিয়ে ধিক্কার জানিয়ে ইংরেজি দৈনিকপত্রে উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছেন।
ফাদার স্ট্যান স্বামীর জন্য শোকদুঃখ প্রকাশ যথেষ্ট নয় – এই হেফাজত-হত্যার প্রতিবাদে গর্জে ওঠা জরুরি। ফাদার স্ট্যান স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের একমাত্র পথ হল ভারতের সবচেয়ে নিপীড়িত মানুষের জন্য সুবিচার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলা এবং যে ফ্যাসিস্ট শাসকেরা আজ ভারত শাসন করছে তাদের প্রতিটি হামলার বিরুদ্ধে সাহসভরে রুখে দাঁড়ানো।
- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি
ভারতের অবস্থা এখন ত্রাহি ত্রাহি। কর্মহীনতাও বাড়ছে, বেঁচে থাকার উপকরণের নাগাল না-পাওয়ার যন্ত্রণাও বাড়ছে, কারণ সবকিছুই এখন অগ্নিমূল্যের। গত দেড় বছর যাবত গোটা বিশ্ব, ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, কোনোটাই আর আগের মতো চলছে না। কারণটা অভিন্ন — কোভিডের সর্বনাশা হানা। তবু বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কোভিডের সার্বিক প্রকোপ মোকাবিলার মত ও পথ খুঁজে নিতে লড়ছে, সাফল্যও পেয়ে চলছে। বিপরীতে কিছু দেশ কেবল দেখিয়ে চলছে ব্যর্থতার ঘুরপাক খাওয়ার অপদার্থতা। এই তালিকায় নিঃসন্দেহে ভারতের স্থান সবার উপরে। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণের মোদী নিনাদ উন্মোচিত হচ্ছে বুলি সর্বস্ব হিসেবে। চূড়ান্ত মতিভ্রম আর নিষ্ঠুর মানবতাবিরোধী কাকে বলে বাস্তবে সেই বার্তাই বাকি বিশ্বকে জানান দিচ্ছে ভারত সরকার। ভারত এখন কোভিডের শবদেহ মাটি চাপা কিংবা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া ‘গণতান্ত্রিক’ দেশ! শুধু কি তাই! এখানে শাসকের ক্ষমতায় পথের বাধা মনে করলে নৃশংসতার কোনও সীমা রাখা হয় না। সেই নাগরিক সত্তাকে ইচ্ছে মতো লাশ বানিয়ে দেওয়া হয় মাঠে-ঘাটে-রাষ্ট্রীয় হেফাজতে! ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘দেশ বিরোধী’, ‘জাতীয়তা বিরোধী’ তকমা সেঁটে দিলেই হয়।
কোভিড চলমান জনজীবনে এখন এক ভয়ঙ্কর পরিণাম। দ্বিতীয় ঢেউ থেমে যাওয়ার লক্ষণ এখনও অদেখা। তার মধ্যেই আবার উঁকি মারছে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা। সর্বোপরি শাসক পক্ষের নির্মম নীতিহীনতার কারণে সমাজদেহে সবদিক থেকেই এখন করোনার সর্বনাশ। আবার এই পরিস্থিতিই ভারতীয় কর্পোরেট শ্রেণীর কাছে চরম মুনাফা কামিয়ে নেওয়ার পৌষমাস। সেটাও কেন্দ্রের অকৃপণ সহযোগিতায়। এ জন্য অতিমারী জনিত কোনও কর বসায়নি কেন্দ্র। এই যাতনাময় জীবনে আর্থজীবন ও কর্মজীবন কীভাবে আটকে যাচ্ছে, তার সমাধানের দাবিতে চর্চা হওয়া দরকার।
এযাবত বহু দাবি ও সুপারিশ সত্ত্বেও কেন্দ্র কাজ হারা শ্রমজীবী মানুষের জন্য অতিমারী অবস্থায় কোনও নগদ আর্থিক সাহায্য দেয়নি। অথচ কেন্দ্রের শাসক বাবুমশাইদের আমিরীতে বা রাজধানীর বুকে অহেতুক পুরাতন স্থাপত্যের ভাঙচুর করে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় তথাকথিত ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ নির্মাণে ঢালা হচ্ছে দেদার অর্থ। সরকার না করেছে সংকট জর্জরিত জনজীবনে — বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য জরুরি এক-দুকালীন আর্থিক অনুদানের পদক্ষেপ, না নিয়েছে কোভিড বিধি মানা সহ কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখার ও নতুন নতুন কর্মপ্রকল্প প্রণয়ন করার গতিমুখ। কেবল রেশনে কিছু পরিমাণে চাল-ডাল বরাদ্দ সহ শেকল পরানো লক ডাউন কায়েম রেখে দিয়েছে।
লক ডাউন এখনও চলছে অঞ্চল ভিত্তিতে আংশিকভাবে। কিন্তু কর্মসংস্থান বা কাজের পরিবেশ পুনরুদ্ধার হওয়ার লক্ষণ বহুক্ষেত্রেই অনিশ্চিত, বাকি ক্ষেত্রে অত্যন্ত ধীর গতির। সবরকমের কাজের অবস্থাই গোলমেলে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ মোদীরাজ কায়েমের প্রথম পর্বে একটা গতিতে বেকারি বৃদ্ধি ঘটছিল। সেটা পূর্বতন মনমোহন আমলের তুলনায় বেশি হারে। কারণ, মোদীর হাতে উদারীকরণ-বিলগ্নীকরণ-বেসরকারিকরণের গতি অনেক বেড়ে যায়। ২০২০-তে কোভিড পর্ব শুরু হওয়ার পর কাজ বন্ধ, ছাঁটাই, কর্মসংকোচন, কর্মবিহীনতা, কাজের নিরাপত্তাহীনতা, কাজের সুযোগ ও পরিবেশের গুণগত আবশ্যিকতা এক ধাক্কায় ক্ষুণ্ণ হওয়া বহু মাত্রায় বেড়ে যায়।
সিএমআইই-র সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা বলছে, ২০২০-র এপ্রিল-মে থেকে ভারতে শ্রমের বাজার এখনও পর্যন্ত মারাত্মক উদ্বেগজনক। বেকারির হার ২০২১-এর মে মাস নাগাদ পৌঁছেছিল ১১.৯ শতাংশে। এবং এটা বেড়েই চলছে। শ্রমের বাজারে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ২০২১-এর এপ্রিল-মে সময়ে হ্রাস পেয়ে পর্যবসিত হয়েছিল প্রথমে ৪০ শতাংশে, তারপরে হ্রাস পাওয়া কিঞ্চিৎ কমে দাঁড়ায় ৩৯.৭ শতাংশে। গত মে ও জুন মাসে শ্রমের অংশগ্রহণের হার থিতু হয় যথাক্রমে ৩৫.৩ ও ৩৪.৬ শতাংশে। সিএমআইই-র পর্যবেক্ষণ হল, ২০২০-তে অতিমারী প্রথমবার ধেয়ে আসার পর লক ডাউনের পরিণামে শ্রমের ক্ষেত্রগুলো ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। তারপরে করোনার প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে লক ডাউন শিথিল হয় এবং তার ফলে কাজের সুযোগ কিঞ্চিৎ পুনরুদ্ধার হয়। কিন্তু অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ আসায় কাজের সুযোগ আবার বেশ নষ্ট হয়। কাজ মার খায় সব ধরনের শ্রম ক্ষেত্রে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অপ্রচলিত ক্ষেত্র অসংগঠিত ক্ষেত্র। যদিও লক ডাউন ফের শিথিল হওয়ার সাথে সাথে কাজের দিন আবার ফিরছে, তবু তার গতি এখনও বহু ধীর প্রকৃতির। ২০২১-এর জানুয়ারিতে মোট নন ফার্ম সেক্টরে কাজ চলে যায় ৩৬.৮ মিলিয়ন হাতের। এর মধ্যে দিন মজুরদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি, প্রায় ২৩.১ মিলিয়ন। বেতনপ্রাপক কর্মচারীর অংশ ছিল ৮.৫ মিলিয়ন। বাকি ভাগে রয়েছেন উৎপাদক সংস্থাসমূহের স্টাফেরা। শ্রম নিয়োগের ক্ষেত্রগুলো খুলতে থাকলেও ভারতীয় অর্থনীতির ২০১৯-২০-র অবস্থা পুনরুদ্ধার হওয়া বেশ কঠিন। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি প্রত্যাহার হয়ে গেলে লক ডাউন পর্বে চলে যাওয়া মোট কাজের দুই-তৃতীয়াংশ ফিরে পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
গ্রাম ভারতে কোভিডের প্রথম ঝড় না পৌঁছানোয় কৃষি অ-কৃষি মিলে মোট শ্রমের ক্ষেত্র বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু জীবিকায় চাপ সৃষ্টি করেছিল লক ডাউনের কোপে কাজ খুইয়ে গ্রামাঞ্চলে ফিরে আসা আড়াই কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের ভীড়। এমএনআরইজিএ কাজে আবেদনকারীর সংখ্যা একলাফে তিন কোটিতে পৌঁছে যায়। কিন্তু সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ নীতির চাপে প্রতি পাঁচজন পিছু এক-দুজনকে জব কার্ড দেওয়ার প্রশ্নে বঞ্চিত করা হতে থাকে। দাবি ওঠে পরিবার পিছু নয়, মাথা পিছু জব কার্ড দিতে হবে। তবু কেন্দ্র তার অবস্থান পাল্টায়নি। কেন্দ্র কোভিড পরিস্থিতির চাপে একদিকে রাজ্যগুলোকে বলছে এমএনআরইজিএ কাজে সংস্থান বাড়াতে, অন্যদিকে এই খাতে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে প্রথমে যে পরিমাণ বরাদ্দ করেছিল, তারপরে তার আরও সত্তর শতাংশ বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কেন্দ্রের অবস্থানে ফের লক্ষ্য করা গেল অদ্ভুত পশ্চাদগামী প্রত্যাবর্তন। বরাদ্দ সংকোচন করে নিয়ে আসা হয় পূর্বাবস্থায়। এই আর্থিক বোঝা রাজ্যগুলোর ওপর চালান করে দেওয়ার অভিসন্ধি খুব স্পষ্ট। কর্মসংস্থানের জ্বলন্ত দাবিগুলো নিয়ে কেন্দ্রকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া যায় না। একইসঙ্গে এইসমস্ত প্রশ্নে রাজ্য স্তরের সরকারকেও, যেমন পশ্চিমবাংলার মমতা সরকারকে গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমজীবী স্বার্থ বিরোধী পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপোষণ, দলতন্ত্র চালাতে দেওয়া যায় না। সামনে আসছে দিন জোর লড়াইয়ের, প্রস্তুত হতে হবে গ্রাম ও নগরে।
অশীতিপর প্রতিবাদী মানবাধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু একটি ঠাণ্ডা মাথায় খুন-সুপরিকল্পিত হেফাজত-হত্যা। পার্কিনসন-রোগাক্রান্ত অশক্ত এক বৃদ্ধের কাছে, বিশেষ করে এই কোভিড-১৯ অতিমারী পরিস্থিতিতে, কারাযন্ত্রণাকে যে ‘মৃত্যুদণ্ড’ করে তোলা হয়েছিল — এটা সকলের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই রকম একটি মানুষকে গ্রেফতার করে ও বিনা বিচারের বন্দী হিসাবে কারারুদ্ধ করে, জাতীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থা আসলে জেনে বুঝে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে তাকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিল। বিভিন্ন আদালতে ফাদার স্ট্যান বার বার জানিয়েছেন তার জীবন বিপন্ন এবং জেলে বেশি দিন বাঁচতে পারবেন না, মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিবারই তারা যেভাবে তার আবেদনের প্রতি নির্মম ঔদাসীন্য দেখিয়েছে তা মানুষকে হতবাক করেছে; শুধু তাই নয়, এনআইএ-র প্রাণঘাতী চক্রান্ত থেকে বৃদ্ধকে রক্ষা করার তাদের দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়েছে। তরল খাবার গ্রহণের জন্য একটা স্ট্র পর্যন্ত যাকে দেওয়া হয়নি, অবলম্বন ছাড়া হাঁটতে অক্ষম কোভিড-১৯ সংক্রমিত সেই মানুষটির জামিনের আবেদন আদালতে বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই আচরণ কারা-নির্যাতনের সামিল যা ফাদারের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আর সময়ের কী বিচিত্র পরিহাস, তিনি ঠিক সেই মুহূর্তেই চলে গেলেন যখন তাঁর আরেকটি জামিন-শুনানির প্রহসন শুরু হতে যাচ্ছিল!
এনআইএ খুব ভালো করেই জানে-ভীমা কোরেগাঁও মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে, একজন অভিযুক্তকেও আদালত অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারবে না। তাই তাদের কৌশল হল বিচার প্রক্রিয়াকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত করা। আর মানবাধিকার কর্মীদের বাকি জীবনটা জেলে আটক রেখে নির্যাতন চালানোর জন্য তারা দানবীয় আইন ইউএপিএ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যাকে কাজে লাগিয়েছে। এই জেলে পচানোর প্রক্রিয়ায়, বৃদ্ধ হোন বা না হোন, বন্দী মানবাধিকার কর্মীদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ করে দিয়েছে অতিমারি পরিস্থিতি। এনআইএ অতিমারীর এই ভয়ঙ্কর বিপন্নতায় পাওয়া এই ‘বাড়তি’ সুযোগকে পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে! এদিকে সরকার বলছে, “আইন তার নিজের পথে চলুক” — সরকার খুব ভালোভাবেই জানে, আইনের ‘সেই’ পথ অসংবেদনশীল দুর্বলচিত্ত আদালতের ‘সৌজন্যে’ তাদের মেরে ফেলতে পারবে যারা তার অপরাধগুলো জনসমক্ষে ফাঁস করে দিয়েছেন।
দিল্লী হাইকোর্ট সম্প্রতি তিন ছাত্র আন্দোলনকারীকে জামিন মঞ্জুর করার সময়ে সঠিকভাবেই বলেছে — একটি সরকার, যে প্রতিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদকে এক করে দেখছে, তার জন্য গণতন্ত্র আজ অত্যন্ত বিপন্ন। ফাদার স্ট্যান-এর হেফাজত-হত্যা সর্বত্র সমস্ত ভারতীয়ের জন্য এক সতর্ক বার্তা। এনআইএ এবং আদালত — কেউই মানবাধিকার কর্মী এবং প্রতিবাদী কণ্ঠকে শেষ করে দিতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না ভীমা কোরেগাঁও মামলার, দিল্লী দাঙ্গা মামলার সমস্ত অভিযুক্ত; আদিবাসী দলিত মুসলিম; সাংবাদিক, বামপন্থী কর্মী যারা দানবীয় আইনে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাযন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন; এবং অন্যান্য সমস্ত রাজনৈতিক বন্দি মুক্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ আমরা ক্ষান্ত হব না। আমরা ফাদার স্ট্যান-এর জন্য ন্যায় বিচার চাই। আর যে সরকার তাঁর হত্যার জন্য দায়ী, জনগণের আদালতে তার শাস্তি পাওয়া সুনিশ্চিত করতে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। ফাদার স্ট্যান স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশে সেটিই হবে আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৬ জুলাই ২০২১
ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের তিন স্টুডেন্ট-কর্মীকে জামিনে মুক্তি দিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের রায় বহু প্রতীক্ষিত এক মুক্ত বাতাসের মতো আসে। গণতন্ত্রের শ্বাসরুদ্ধ করে দিল্লি পুলিশ গত বছর থেকে যে গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি দেবে এই রায় : সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর-এর মতো অন্যায় বৈষম্যমূলক ফ্যাসিস্ট আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গণতন্ত্রের সংগ্রামে আশা ও সাহস জুগিয়েছে।
আসিফ ইকবাল তানহা, নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কলিতা — জামিনে মুক্তি পাওয়া এই তিনজন ছাত্রছাত্রী সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যেতে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে নিজেদের অটল রাখেন। কারাগারে নিক্ষেপ (এবং নাতাশার ক্ষেত্রে, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বাবাকে শেষ দেখা দেখতে না পাওয়া) এই তরুণ লড়াকু সাথীদের স্তব্ধ করে দিতে পারেনি।
দিল্লি হাইকোর্টের পক্ষ থেকে জামিনের এই নির্দেশ সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদের কর্মীদের দিল্লি পুলিশ দ্বারা সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে খাড়া করার অন্তঃসারশূন্যতাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। “গণতন্ত্রের পক্ষে দুঃখজনক দিন” বলে অভিহিত করে দিল্লি হাইকোর্ট বলে, “বিরোধিতা দমন করতে মরিয়া হয়ে এবং সবকিছু হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার অসুস্থ ভীতির কারণে রাষ্ট্র সংবিধান বর্ণিত ‘প্রতিবাদের অধিকার’ আর ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’-এর মধ্যেকার পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছে” এবং “গণতন্ত্রকে বিপন্নতার পথে” নিয়ে চলেছে।
দিল্লি পুলিশ মোদি-শাহ-রাজের দাবার বোড়ে মাত্র এবং মোদি-শাহর প্রতিনিধিরা দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়কে অবমাননা ও তাচ্ছিল্য করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সরকারপক্ষ সুপ্রীম কোর্টে গিয়ে এই জামিনের বিরুদ্ধে আবেদন করেছে। সুপ্রীম কোর্ট জামিনে স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেছে, কিন্তু একই সাথে এই নির্দেশও দিয়েছে যে দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় অন্যান্য ইউএপিএ মামলায় নজির হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, মামলাটি আপাতত সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকছে।
অন্যায়ভাবে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে এই মহামারীকালে প্রাণসংশয়ে থাকা ব্যক্তিদের জামিনের ক্ষেত্রে দিল্লি হাইকোর্টের রায় যে ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু অন্তর্বর্তী রায়ে সুপ্রীম কোর্ট আপাতত তা আটকে দিল। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আসিফ, নাতাশা ও দেবাঙ্গনার জামিন-মুক্তি আটকাতে না পারলেও মোদি সরকার সুপ্রীম কোর্টের এই অন্তর্বর্তী রায়কে হাতিয়ার করে অন্যান্য সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের দিল্লি হাইকোর্টের যুক্তি ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে পারবে।
যাই হোক, দিল্লি হাইকোর্টের রায় কার্যত ঘোষণা করেছে যে ‘শাসক ন্যাংটা’, দিল্লি পুলিশের ইউএপিএ চার্জশিটের কোনও অন্তর্বস্তু নাই “ভাসা ভাসা বুলিসর্বস্ব অতিশয়োক্তি” মাত্র। এই “বিপজ্জনক বুলিসর্বস্ব বাগাড়ম্বর”-এর ধোঁয়াজালে বিভ্রান্ত না হয়ে হাইকোর্ট স্পষ্ট প্রতীয়মান সত্যকে তুলে ধরে বলেছে : সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে যে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে তা নিছক প্রতিবাদকেই প্রমাণ করে, তাকে “সন্ত্রাসবাদ” হিসেবে চিহ্নিত করা চলে না।
গত এক বছর ধরে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনের কর্মীরা যে কথা বারবার বলে আসছে — সংসদে পাশ হওয়া আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, চাক্কা জ্যাম বা রাস্তা অবরোধের ডাক দেওয়া ইত্যাদি দেশদ্রোহিতা বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ তো নয়ই, কোনও অপরাধই নয় — হাইকোর্ট সেই কথাটাই প্রতিষ্ঠা করেছে। আইন অমান্য আন্দোলন বা প্রতিবাদ সংগঠিত করাকে “সন্ত্রাসবাদ” আখ্যা দেওয়া এবং প্রতিবাদীদের অনির্দিষ্টকাল জেলবন্দী রাখতে ইউএপিএ ব্যবহার করা গণতন্ত্রকেই বিপদে ফেলে।
অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকারকেও হাইকোর্ট সঠিকভাবেই ডিমান্ড করেছে। ভারতে বিচারাধীন বন্দীরা বছরের পর বছর জেলে পচতে থাকে কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা জামিনের অযৌক্তিক শর্তগুলি পূরণ করতে বা খরচ জোগাড় করতে পারে না। এইসব বিচারাধীন বন্দীদের অধিকাংশই যে দলিত, আদিবাসী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ তা নিছক কাকতালিয় ঘটনা নয়। আর অধিকাংশ বিচারাধীন বন্দীই দরিদ্র। বীভৎস ইউএপিএ আইন সুপ্রীম কোর্টের সংকীর্ণ ও পশ্চাদমুখী ব্যাখ্যার সহায়তায়, জামিনের আবেদন শোনার যোগ্যতা বিবেচনা করে দেখতেও আদালতকে বিরত রেখে এরকম সুব্যবস্থিত অবিচারের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। মানবাধিকার কর্মীদের অনির্দিষ্টকাল জেলে পুরে রাখার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ইউএপিএ। কারণ পুলিশ ও এনআইএ-র মতো সংস্থা “তদন্ত” টেনে নিয়ে চলে বছরের পর বছর, আর সেই সময় জুড়ে অস্বীকার করে চলা হয় জামিনের আবেদন। দিল্লি হাইকোর্ট এর সংশোধন এনেছে কেরালা হাইকোর্টে নাজিবের জামিন মামলার নজির টেনে, যে মামলাকে সুপ্রীম কোর্টও ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। এবং দিল্লি হাইকোর্ট সমস্ত আদালতকেই একথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিচারাধীন ব্যক্তিদের দীর্ঘ কারাবাস এড়াতে জামিনের ব্যবস্থা করা আদালতেরই দায়িত্ব। এডিশনাল সলিসিটর জেনেরাল প্রস্তাব দেয়, “সংবিধানের ২১ নং ধারায় বর্ণিত দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকার সম্পূর্ণভাবে ও সর্বতভাবে লঙ্ঘিত হলে তখনই একমাত্র আদালতের উচিৎ অভিযুক্তকে রিলিফ দেওয়ার কথা ভাবা”। দিল্লি হাইকোর্ট এই প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
গণতন্ত্রের স্বপক্ষে লড়াই করা কর্মীরা গত বছর ধরে বলে আসছে যে দিল্লি পুলিশের তদন্ত অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের, বিশেষত ওই “দাঙ্গা” (বাস্তবে যা এক পরিকল্পিত সংগঠিত হিংসা)-র সবচেয়ে বড় শিকার যারা সেই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর জন্য দিল্লি পুলিশ ষড়যন্ত্রের উদ্ভট গল্প ফেঁদেছে। দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় সেই বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর বা অন্যান্য যেসব বিজেপি ও আরএসএস নেতারা ভিড় জমিয়ে প্রতিবাদীদের গুলি করে হত্যা করার জন্য প্রকাশ্য ডাক দিয়েছিল এবং দিল্লির রাস্তায় হিংস্র সশস্ত্র ভিড়কে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে নির্ধারণ করে দেওয়া নীতির সাথে সাযুজ্য রেখে প্রত্যেক ইউএপিএ বন্দীর অবশ্যই জামিন পাওয়া উচিৎ। কিন্তু শুধু ওটুকুতেই সুবিচার নিশ্চিত হতে পারে না। সুবিচার নিশ্চিত করতে দিল্লি পুলিশের এই তদন্তকে সম্পূর্ণত বাতিল করে দিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের তত্বাবধানে নতুন করে তদন্ত শুরু হওয়া দরকার; নিছক এক “ভাসা ভাসা বাগাড়ম্বর” দিয়ে তৈরি করা চার্জশীটের ভিত্তিতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের কারাবন্দী করা রাখার অপরাধে জড়িত পুলিশ অফিসারদের শাস্তি দেওয়া দরকার। এবং সর্বোপরি, দিল্লি পুলিশের প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ফলে এই মহামারীকালে জেলে থাকতে বাধ্য হলেন যারা সেই সব প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা দরকার।
(লিবারেশন সম্পাদকীয়, জুলাই ২০২১)
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) বিপ্লবী পরম্পরাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। মাও সেতুঙ-এর অনুপ্রেরণাময় নেতৃত্ব ও সিপিসি’র পরিচালনায়, চীনের বীর জনগণ, সিপিসি’র জন্মের মাত্র আটাশ বছরের মধ্যেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছেন এবং এর পরে সাত বছরের ব্যবধানে এক অনগ্রসর কৃষিপ্রধান সমাজের বুনিয়াদী সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন।
সামন্তপ্রভু, বৃহৎ বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের আধিপত্য থেকে বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশের মুক্তি সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এবং বিশেষত ভারতের মতো ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে প্রভূত উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে। মহান তেলেঙ্গানা সংগ্রাম ও পরবর্তীতে নকশালবাড়ী আন্দোলনে চীনের সশস্ত্র কৃষিবিপ্লব ছিল অনুপ্রেরণার এক বৃহৎ উৎস। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিনগুলিতে আন্তর্জাতিক মহা বিতর্কের সময় বিশ্বজুড়ে আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের সিপিসি নেতৃত্ব প্রদান করেছে এবং তা ভারতে সিপিআই(এমএল)-এর উদ্ভবে বড়মাত্রায় অবদান জুগিয়েছে।
১৯৪৭-এ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর ভারতের যাত্রাপথের সঙ্গে ১৯৪৯এ (স্বাধীনতা অর্জনের) চীনের যাত্রাপথের তুলনার মাধ্যমে, আমরা চীন বিপ্লবের সম্পূর্ণ তাৎপর্যকে হয়ত উপলব্ধি করতে পারি। জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জননী ও শিশুমৃত্যুর হার সমেত সমাজ কল্যানের অধিকাংশ সূচকের নিরিখে চীন ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে এবং এই বাস্তবতাকে কেবলমাত্র এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় যে, বিপ্লবী চীন তার প্রগতির জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক আমূল রূপান্তরের পদক্ষেপগুলির মধ্যে ভিত্তি স্থাপন করেছে যার বিপরীতে ভারতীয় মডেল নির্ভর করেছে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের সঙ্গে সমঝোতা ও একচেটিয়া বেসরকারি পুঁজি ও বিদেশী কর্পোরেশনগুলিকে তোষণের উপর।
এই সমস্ত বিপ্লবী সাফল্য ও অবদানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার পাশাপাশি আমরা বিগত কয়েক দশকে কিছু অস্বস্তিকর প্রবণতা ও বিকাশ সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ ধ্বনিত করাকে আমাদের কর্তব্য বলেই মনে করি।
সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণ, চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক বাজার অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সিপিসি’র রেকর্ড কেবলমাত্র তার বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে জায়গা করে নেওয়ার চমকপ্রদ অর্থনৈতিক বিকাশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে দুস্তর অগ্রগতিকেই সূচিত করে না বরং ক্রমবর্ধমান সামাজিক, আঞ্চলিক ও লিঙ্গ বৈষম্য, বেড়ে ওঠা ক্রোনিতন্ত্র ও দুর্নীতি, মতাদর্শগত-সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং প্রতিবাদী স্বরের নির্মম দমনকেও সূচিত করে।
২০১৭-র অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সিপিসি’র ১৯তম কংগ্রেস বা সাম্প্রতিক শতবার্ষিকী উদযাপনকালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ভাষণে অনুসৃত পথের ভুলগুলি, বিশেষত ব্যক্তি বা সমষ্টিগত প্রতিবাদ, তিব্বত ও শিনজিয়াঙ অঞ্চলের জাতিসত্তা আন্দোলন তথা হংকং ও ম্যাকাও-এর স্বায়ত্ত শাসন আন্দোলন এবং উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘু জনগণের সমস্যায় পার্টির পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল শুধরে নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় না। কড়া রাষ্ট্রীয় নজরদারির ক্রমবর্ধমান বিস্তারও আর এক উদ্বেগের বিষয়।
প্রেসিডেন্ট শি’র বক্তৃতায় ‘পার্টির নেতৃত্ব’, নির্দিষ্টভাবে ‘পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ও সামগ্রিকভাবে পার্টিতে সাধারণ সম্পাদকের মৌলিক অবস্থান’, সাথে সাথে ‘নেতৃত্বের কেন্দ্রকে অনুসরণ করা এবং কেন্দ্রীয় পার্টি নেতৃত্বের সাথে সারিবদ্ধ হওয়া’কে ‘চীনা চরিত্র সম্পন্ন সমাজতন্ত্রের নির্ধারক বৈশিষ্ট্য’ বলে বর্ণিত হয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির থেকে একপ্রকার বিচ্যুতি কেননা সেখানে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকাকে এইভাবে মহিমান্বিত করা হয়না বা সেখানে দেশ বা রাষ্ট্রকে পার্টির সমার্থক ভাবা হয়না। উৎপাদনের উপকরণসমূহ ও শ্রমের উপর প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের (শ্রমিক-কৃষকদের) নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করাই হতে পারে সমাজতন্ত্রের একমাত্র পরশ পাথর।
শি জিনপিং-এর ভাষণের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল জাতীয় পুনরুজ্জীবন যা যথেষ্ট সদর্থক, কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, যে প্রশ্নগুলি নিয়ে প্রত্যেকের প্রত্যাশা ছিল তার প্রতিফলন ঘটল না, যেমন: চীন ও বিশ্বজুড়ে শ্রমিক ও জনগণের পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সংহতির কোন অভিব্যক্তি; সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি দায়বদ্ধতা, বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীদের বিরুদ্ধে অগণিত গণআন্দোলনে ঐক্য স্থাপনের কোন আহ্বান। স্পষ্টতই, প্রেসিডেন্ট শি’র ভাষণে ঘটনাক্রমে যার উৎপত্তি চীন থেকেই — সেই চলমান কোভিড অতিমারী জনিত সুদূর প্রসারী সংকটের বিষয়টিও অনুচ্চারিত থেকে গেছে।
সিপিসি’র বিপ্লবী ঐতিহ্যকে অভিনন্দন জানানোর সাথে সাথে অর্থবহ সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতি সাধন ও চীনের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য এবং স্থায়ী বিশ্বশান্তি ও এক সমতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে চীনা জনগণ ও চীনা কমিউনিস্টদের প্রতি আমরা উষ্ণ আকাঙ্খা পোষণ করি। ভারত ও চীন – দুই দেশের ও জনগণের মৈত্রী ও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতাকে আমরা উর্দ্ধে তুলে ধরি।
- কেন্দ্রীয় কমিটি
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)
জেল থেকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসামের শিবসাগর আসন থেকে তিনি জয়ী হয়েছেন। এবার জেল থেকে তাঁর মুক্তি ঘটল – এনআইএ’র বিশেষ আদালত দানবীয় ইউএপিএ আইনে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে। তিনি আসামের সমাজ এবং মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রাইজর দলের নেতা অখিল গগৈ। রাষ্ট্রের চোখে তাঁর অপরাধ ছিল এই যে, তিনি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে তৈরি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর নির্দেশে এনআইএ তাঁকে গ্ৰেপ্তার করে জেলে পোরে। তাঁর বিরুদ্ধে মোট তেরটি অভিযোগ দায়ের হয়, আনা হয় মাওবাদী সংযোগের অভিযোগ; আরও অভিযোগ করা হয়, তিনি কয়েক হাজার জনতাকে সহিংস প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে হিংসায় উস্কিয়ে তুলেছিলেন, যে জনতা তারপর ইট-পাথর ছোড়ে এবং ভাঙচুর চালায়। তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগও ছিল যে, তিনি সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু এনআইএ’র আদালত বলেছে, “আপাতদৃষ্টিতে এমন কোনো নিদর্শন” পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যায়। রায়ে বিচারপতি বলেছেন, তাঁকে “হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না, যে ধ্বংসাত্মক এবং সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতির ক্রিয়াকলাপ চলে তার সঙ্গে তাঁকে সংযুক্ত করার মত কোনো নিদর্শনও নেই; বিপরীতে, হিংসা না চালানোর পরামর্শই তিনি জনগণকে দিয়েছেন এবং আন্তরিকভাবেই তা করেছেন বলে মনে হয়।” আদালত আরও বলেছে, আইনকে তার অনুমোদিত সীমার মধ্যেই প্রয়োগ করতে হবে, তার গণ্ডির বাইরে যাওয়া যাবে না। এরজন্য নির্দিষ্ট সংস্থা, এক্ষেত্রে এনআইএ’কে লাগাতার ‘চেতনাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত’ করে যেতে হবে। অখিল গগৈয়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যে কোনো ভিত্তি ছিল না, এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলন দমনের লক্ষ্যেই যে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়েছিল, আদালতের রায়ে তা সংশয়হীনভাবে বিধৃত। অখিল গগৈয়ের সঙ্গেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পেয়েছেন তাঁর তিন সহকর্মী — ধৈয্য কানোয়ার, মানস কানোয়ার ও বিটু সোনওয়াল।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অখিল গগৈ দাবি জানিয়েছেন, “আমার বিরুদ্ধে এনআইএ’র করা দুটো মামলাই খারিজ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এবং এনআইএ’র ডিজি’কে পদত্যাগ করতে হবে।” অখিল গগৈয়ের এই দাবির মধ্যে নির্দিষ্ট রূপে ধরা পড়েছে প্রশাসনিক সেই মাধ্যম যা ভারতকে এক পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্রিয়। নরেন্দ্র মোদী যদি রাষ্ট্রের সংবিধান-বিরোধী, গণতন্ত্র-বিরোধী দিশার কেন্দ্রীয় পরিচালক হয়ে থাকেন, তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, বিভিন্ন তদন্তকারী ও প্রশাসনিক সংস্থা এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরা কেন্দ্রের কামনার নির্দিষ্ট অভিমুখে রাষ্ট্রকে চালিত করার যন্ত্র হয়ে উঠেছে।
এনআইএ’র বিশেষ আদালত অখিল গগৈয়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আনা অভিযোগ খারিজ করতে গিয়ে যা বলেছে, তারমধ্যে প্রতিধ্বনিত দিল্লী দাঙ্গায় তিন অভিযুক্তর জামিন মঞ্জুরিতে দিল্লী হাইকোর্টের রায়। আসিফ ইকবাল তানহা, নাতাশা নারোয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতার জামিন মঞ্জুর করে দিল্লী হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে বলেন, “রাষ্ট্র সংবিধান প্রতিশ্রুত ‘প্রতিবাদের অধিকার’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের’ মধ্যে ভেদরেখাকে মুছে দিয়েছে এবং এইভাবে ‘গণতন্ত্রকে বিপন্ন’ করে তুলেছে”। ২০২০র ফেব্রুয়ারির দিল্লী দাঙ্গায় অভিযোগের যে জাল বোনা হয় তা যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তৈরি নীল নকশার অনুসারি সে কথা সুবিদিত। ওয়াকিবহাল মানুষ মাত্রেই জানেন, ঐ দাঙ্গার মূল প্ররোচকদের আড়াল করে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়। প্রাক্তন পুলিশ কর্তা জুলিও রিবেইরো পর্যন্ত দিল্লী পুলিশ কমিশনার শ্রীযুক্ত শ্রীবাস্তবের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে এই রাষ্ট্রীয় অনাচারের উন্মোচন না ঘটিয়ে পারেননি, “দিল্লী পুলিশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু যারা বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণ দিয়ে উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে দাঙ্গা উস্কিয়ে তোলে, সজ্ঞানে তাদের বিরুদ্ধে আদালতগ্ৰাহ্য অভিযোগ দায়ের করা থেকে তারা বিরত থেকেছে”। যারা দিল্লীর দাঙ্গার মূল হোতা বলে জুলিও রিবেইরো ইঙ্গিত করেছেন তারা যে বিজেপি ও আরএসএস নেতা ও কর্মী তা অকাট্য প্রমাণে ধরা আছে।
যে কোনো ধরনের সরকার বিরোধী প্রতিবাদকে নিশ্চিহ্ন করার মোদী সরকারের তৎপর উদ্যমের পরিণামে বহু সংখ্যক মানবাধিকার ও সমাজ আন্দোলনের কর্মী বছরের পর বছর জেলে পচছেন। তদন্ত শেষ করতে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর অনাগ্ৰহ এবং তদন্তকে স্বেচ্ছাকৃতভাবে প্রলম্বিত করায় অভিযুক্ত আটকদের জামিন লাভ অসম্ভব হয়ে উঠছে। ইউএপিএ এবং দেশদ্রোহ আইনের আকছার প্রয়োগ গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত করছে। তবে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু এবং নির্বিচার নিপীড়ন সত্ত্বেও জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিন্তু থেমে থাকেনি। দিল্লী হাইকোর্টের রায় এবং অখিল গগৈকে সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতির এনআইএ বিশেষ আদালতের রায় রাষ্ট্রের দমননীতিকেই কাঠগড়ায় তুলেছে। এই রায় দুটোতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কুশিলবদের কাছে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলার ইশারা – জেলে আটক সমস্ত মানবাধিকার কর্মী ও বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি সোচ্চার হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
ফাদার স্ট্যান স্বামীকে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার বিরুদ্ধে ৬ জুলাই কলকাতায় মৌলালিতে ধিক্কারসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার উদ্যোক্তা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, ছাত্র সংগঠন আইসা, মহিলা সংগঠন আইপোয়া প্রভৃতি। ধিক্কারসভায় স্থানীয় চার্চের সিস্টাররা অংশগ্রহণ করেন। সভার শুরুতে ফাদারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয়। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) নেতা অতনু চক্রবর্তী, কার্তিক পাল, চার্চের জনৈক সিস্টার, মানবাধিকার কর্মী ছোটন দাস, অধ্যাপক শামিম আমেদ, আইসার নেতা অভিজিৎ সরকার, আইপোয়া নেত্রী ইন্দ্রানী দত্ত, গণআন্দোলনের কর্মী অসিত রায়। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন কল্লোল দাশগুপ্ত, নীতীশ রায়। সভার শেষে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। কর্মসূচি পরিচালনা করেন বাসুদেব বসু।
রাজ্যের জেলায় জেলায় একই প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়।
নদীয়া
স্ট্যান স্বামীর হত্যার বিরুদ্ধে আজ সারা দেশ উত্তাল। তারই অঙ্গ হিসাবে আরওয়াইএ এবং সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে নদীয়া জেলার ধুবুলিয়া নেতাজী পার্কে সংগঠিত হয় এক প্রতিবাদ সভা। নেতৃবৃন্দ বলেন, হাসপাতালে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে বন্দী থাকাকালীন তিনি প্রয়াত হয়েছেন। ঘটনাক্রমে রাষ্ট্র তাকে হত্যা করেছে। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঝাড়খন্ডে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। আজ তাকে হত্যা করে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন করতে চাইছে। কেবল বিজেপি নয়, এ রাজ্যের শাসক তৃণমূলও আজ গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরছে। এ রাজ্যেও আন্দোলনকারীদের উপর কালাকানুন ইউএপিএ জারি করা রয়েছে। কিন্তু ইতিহাস শিক্ষা দেয়, যে শাসকদলই গণতন্ত্রকে হত্যা করবে মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেই। ফাদার স্ট্যান স্বামীর সংগ্রামী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে, রাস্তায় মানুষের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানিয়ে ধুবুলিয়ার প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন আরওয়াইএ নেতা রণজয় সেনগুপ্ত, সন্তু ভট্টাচার্য, সিপিআই(এমএল) জেলা নেতা কাজল দত্তগুপ্ত ও জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ।
বাঁকুড়া
২১-এর ডাক অভিযানের ব্যানারে আজকে বাঁকুড়া শহরের মাচানতলায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গত ক'দিন আগে পুলিশ হেফাজতে আদিবাসী অধিকার আদায়ের নেতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ফাদার স্ট্যান মারা যান এটা আসলে রাষ্ট্র কর্তৃক একটি হত্যা। এতে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র দপ্তর যেমন যুক্ত তেমনি বিচার বিভাগ ও সমান দায়ী কারন ৮৪ বছরের একজন মানুষ যিনি কঠিন পারকিনসন রোগে ভুগছিলেন। নিজের হাতে খেতে পারতেন না এমনকি গ্লাসে চুমুক দিয়ে জলও খেতে পারতেন না। এইরকম রোগীকে জল খাওয়ার জন্য স্ট্র ব্যবহারের অনুমতি না দিয়ে দিনের পর দিন জামিন নামঞ্জুর করে ইউএপিএ ধারায় আটক করে রাখলো। যে আইন আসলে পরাধিন ভারতে ইংরেজদের তৈরি রাউলাট অ্যাক্টের সমতুল। এইরকম একজন মানুষের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। কুখ্যাত এই ইউএপিএ আইন বাতিল করে আমাদের রাজ্য সহ সারা দেশে আটক রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। এই প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন বাঁকুড়া কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী অভিষেক বিশ্বাস, ছাত্র আন্দোলনের নেতা ফারহান হোসেন খান, যুব নেতা সঞ্জু বরাট, জেলার বিশিষ্ট কবি আলোক মন্ডল, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী শান্ত ব্রত সেন, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের রামনিবাস বাস্কে। সভা পরিচালনা করেন ২১-এর ডাক অভিযানের পক্ষে বাবলু ব্যানার্জী।
সারা জুন মাস ধরে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পার্টির বিষ্ণুপুর ব্রাঞ্চের কমরেডরা বিষ্ণুপুর পৌরসভার ২, ৫, ৬, ১৫ ও ১৯ নং মোট পাঁচটি ওয়ার্ডের কিছু বস্তি এলাকায় সমীক্ষা করেছিল প্রায় ৫০০টি পরিবারে। এই সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে বহু মানুষের বাড়ি নেই তার সংখ্যা প্রায় এইসব ওয়ার্ডে সাড়ে ৩৫০র বেশি। রেশন কার্ডের সমস্যা রয়েছে প্রায় ১০০টি পরিবারের। বেশিরভাগ মানুষ বস্তি এলাকাতে এখনও এই লকডাউন পরিস্থিতিতে ত্রিপল টাঙিয়ে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে রয়েছে কারোবা বাড়ির চাল ফুটো, কারো আবার দেওয়াল ভেঙে পড়েছে এরকম অসহায় অবস্থায় তারা অনাহারে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এই সমস্ত বস্তি এলাকাতে সব বাড়িতেই প্রায় বেশিরভাগ মানুষদের করোনা ভ্যাকসিন-এর টিকাকরণ এখনো হয়নি। বস্তি এলাকাগুলোতে নোংরা আবর্জনার বিশাল স্তূপ এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তুলেছে। লকডাউনে বেশিরভাগ বাড়ির ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা লাটে উঠেছে। বাড়ির মহিলারা বিভিন্ন মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির কাছ থেকে কিংবা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাছ থেকে লোনে জর্জরিত হয়ে উঠেছে এবং লোন এজেন্ট বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
এই সমীক্ষার ভিত্তিতে সমস্ত তথ্যগুলিকে বিশ্লেষণ করে আগামী ২৫ জুন ২০২১, বিষ্ণুপুর মহকুমা শাসকের কাছে এই সমস্ত সমস্যার দাবি জানিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে সভা করে একটি ডেপুটেশন দেওয়া হয়। এই ডেপুটেশনে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পার্টির বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জি এবং বিষ্ণুপুর পার্টি ব্রাঞ্চের সম্পাদক তিতাস গুপ্ত ও সায়ন্তন এবং লোকাল কমিটির অন্যতম নেতৃত্ব ফারহান খান।
উক্ত ডেপুটেশনের ভিত্তিতে বিষ্ণুপুর মহকুমা শাসক আশ্বাস দেন সমস্যাগুলি মেটানোর এবং ডেপুটেশনের অন্যতম দাবি সরকারি ঘর বানানো তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা, এব্যাপারে পৌরসভার নেতৃত্বের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন।
ডেপুটেশন পরবর্তী পর্যায়ে যে সমস্ত ওয়ার্ডে সমীক্ষা করা হয়েছিল সেই সমস্ত মানুষদের সাথে যোগাযোগ করে মিটিং করা হয় বিষ্ণুপুর পার্টি অফিসে গত ২৭ জুন ২০২১। বর্তমানে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করার পর্যায় এসে দাঁড়িয়েছে, ঘর পাওয়া থেকে শুরু করে ভ্যাকসিনেশন ও রেশন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা চেয়ে এবং আগামী দিনে ঘরের তালিকা প্রকাশ বা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হওয়ার হিসাব চাইতে পৌরসভা ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা চলছে। একই সাথে ব্যাপক মানুষের বাস্তু পাট্টার দাবিতে আন্দোলন বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বলে জনতার দাবি উঠে আসছে।
প্রতিনিধি দলের কাছ থেকে এসডিও রেশন কার্ডহীনদের তালিকা নিয়েছেন এবং সমাধান করে দেবেন বলেছেন। দ্রুত সমাধান না হলে আবার ঘেরাও করা হবে। সমীক্ষা চলাকালীন তৃণমূল নেতৃত্ব স্রেফ গাত্রদাহর কারণে আমাদের সমীক্ষক দলের সদস্যদের ভয় দেখাতে এসেছিল, কিন্তু কোনো ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে জনগণকে আটকাতে পারেনি। ওই এলাকাতেই আমরা পাড়ার সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে স্মরণ অনুষ্ঠান সংগঠিত করি।
পেট্রোপণ্যের অগ্নিমূল্যের বিরুদ্ধে বাঁকুড়ার মাকুড় গ্রামে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। সারা বিশ্বে যখন পেট্রোপন্যের দাম কমছে আমাদের দেশে তখন পেট্রোল-ডিজেল সেঞ্চুরির পথে। কোনো কোনো রাজ্যে যা পেরিয়ে গেছে। এর কারণ আমাদের দেশের সরকার পেট্রোল-ডিজেলের উপর শতকরা ৬০-৭০ ভাগ কর ও সেস নেয়। এরফলে ডাল-তেল-ডিম সহ সমস্ত জিনিসের দাম আজ আকাশছোঁয়া। জনগণের দাবি, অবিলম্বে এই সব জিনিসের দাম কমাতে হবে। মানুষ যখন করোনার টিকা না পেয়ে, হাসপাতালে বেড অক্সিজেন না পেয়ে মারা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মোদী তখন ‘মন কি বাত’ ভাষণ দিচ্ছেন। তাই আমরা বলি ভাষণ ছাড়ো, এলাকায় এলাকায় ক্যাম্প করে সব মানুষদের বিনামুল্যে করোনা টিকা দাও। টিকার ক্ষেত্রে স্বজনপোষন বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে গরিব পরিবারগুলোকে নগদ ৭,৫০০ টাকা লকডাউন ভাতা দিতে হবে। বাংলার মানুষ যখন সারা দেশের সাথে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে, লকডাউনে কাজ হারা গরিব মানুষ নিজের ছেলেমেয়েদের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার লড়াই করছে, বিজেপি তখন বাংলার নির্বাচনে গণরায়ে তাদের হার মানতে না পেরে নানা রকম চক্রান্ত করেই চলেছে। সবশেষে চক্রান্ত করছে বাংলাকে ভাগ করার। কারণ এই বাংলা বিজেপির কৃষক বিরোধী কৃষি আইন, শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোডের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ে আছে। মানুষের এই মনোবল ‘বাংলা ভাগ’এর নামে ভেঙ্গে দিতে চাইছে। এই বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। মাকুড় গ্রামের প্রতিবাদী কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন সিপিআই(এমএল) বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী এবং কৃষক নেতা বৈদ্যনাথ চীনা, ছাত্র নেতা ফারহান হোসেন খান।
পেট্রোল ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেল। ডিজেল ও কাছাকাছি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু মোদী এই দিকে নজর না দিয়ে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো আচ্ছে দিনের ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে। মোদী পেট্রোলে লিটারে ৩৩ টাকা এবং রাজ্য সরকার ১৯ টাকা কর নেয়। ভাষণ ছেড়ে কেন্দ্র এই করটা একটু কমিয়ে দিলে আমজনতার লাভ হয়। এর বিরুদ্ধে এবং আমাদের রাজ্যে অবিলম্বে ত্রুটিমুক্ত শিক্ষক নিয়োগের তালিকা বের করে শিক্ষক নিয়োগ সহ এলাকায় এলাকায় সব মানুষদের বিনামূল্যে করোনা টিকা দেওয়ার দাবিতে ৪ জুলাই বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরের রবীন্দ্র মুর্তি থেকে মিছিল করে ইন্দিরা মার্কেটে এসে সংক্ষিপ্ত সভা এবং জনবিরোধী সরকারের প্রতিভু নরেন্দ্র মোদীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এই কর্মসূচী নেওয়া হয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, আরওয়াইএ এবং এআইএসএ-র পক্ষ থেকে। নেতৃত্ব দেন পার্টির জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী, ছাত্র-যুব সংগঠনের পক্ষে ফারহান হোসেন খান ও প্রান্তিক দাশগুপ্ত। এছাড়া কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন এক ঝাঁক উদীয়মান সংগঠক বিল্টু ক্ষেত্রপাল, গৌরব ব্যানার্জি, শুভম দে, শুভঙ্কর রায়, আবির ঘোষ, সৌরভ কারক, সেখ রোহিত, রাজদীপ গিরি এবং সায়ন্তন রায়।
কৃষ্ণনগর বাসষ্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সারি সারি বাস, কিন্তু যাত্রী সংখ্যা খুবই সীমিত। জ্বালানির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে পরিবহন শিল্প চরম সংকটে। বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবহন শ্রমিকদের রুটি রুজি। ইতিপূর্বে লকডাউনে কাজ না থাকায় আধপেটা খেয়ে তাঁদের কোনোরকমে দিন গুজরান করতে হয়েছে। এখন ডিজেল পেট্রোলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ প্রভাবে কাজ কমে যাওয়ার কারণে তাঁদের রোজগার কমে গেছে। সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া সংকটকে আরও তীব্রতর করে তুলেছে। এই অবস্থায় কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ডে প্রচার কর্মসূচি সংগঠিত করল সিপিআই(এমএল), কিষাণ মহাসভা ও এআইসিসিটিইউ। এক ঘন্টাব্যাপী প্রচার মিছিল পরিক্রমা করে পুরসভার সামনে শেষ হয়। প্রচারে দাবি তোলা হয়, পরিবহন শ্রমিকদের ৭৫০০ টাকা লকডাউন ভাতা দিতে হবে, অবিলম্বে ডিজেলের দাম কমাও, সরকারি করের বোঝা কমাও, আম্বানীদের স্বার্থে এই দামবৃদ্ধি করা চলবে না, তেল কোম্পানিগুলোকে অতিমুনাফা পাইয়ে দেওয়া চলবে না, সাধারণ মানুষের উপর মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশে ডিজেল এবং পেট্রোলের দাম আজ লিটার প্রতি প্রায় ১০০ টাকা হয়ে গেছে। সবাই জানে যে সাধারণ মানুষ জ্বালানীর জন্য যে দাম দেন, তার ৬৫% সরকারকে ট্যাক্স হিসাবে দেন। প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায় এখন ভারতে জ্বালানীর দাম অনেক বেশি। প্রকৃতপক্ষে, কৃষকের মতো সাধারণ নাগরিকরা সেচের জল সরবরাহের কাজে পাম্প মেশিনে যে জ্বালানি ব্যবহার করে, তার তুলনায় বিমানের জ্বালানির দাম সস্তা ! কৃষিকাজে ব্যবহৃত এই ডিজেলের দাম বৃদ্ধি কৃষকদের চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। তাই কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে ডিজেল সরবরাহের দাবিও তুলে ধরা হয়।
এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে এবং শ্রমিক আন্দোলনের উপর দমন নামিয়ে আনতে কালা অর্ডন্যান্স জারি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। মানবাধিকার কর্মী ও আদিবাসী আন্দোলনের নেতা ফাদার স্ট্যান স্বামীর হেফাজতে হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো হয়। উপস্থিত ছিলেন, এআইসিসিটিইউ জেলা কমিটি সদস্য অমল তরফদার, জীবন কবিরাজ, সিপিআই(এমএল) জেলা কমিটি সদস্য সন্তু ভট্টাচার্য, স্বপন দাস, সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, আরওয়াই নেতা রণজয় সেনগুপ্ত প্রমুখ।
“যারা জন্মায় আর খাটে
খাটে আর মরে
যারা পিঁপড়ের মতো
পোকামাকড়ের মতো
শীতরাত্রির ঝড়া পাতার মতো...
যাদের দেখার জন্য
এবং ঠকাবার জন্য
আপনারা বিরাট মঞ্চে
উঠে দাঁড়ান ...”
(বেকারের চিঠি, মণিভূষণ ভট্টাচার্য)
করোনা লকডাউন অথবা বিধিনিষেধের প্রভাবে মাত্র এক সপ্তাহেই দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে গ্রামাঞ্চলের বেকারত্ব। কৃষিকাজে মন্দার ফলে এখন কার্যত সঙ্কটের মুখে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি। এই প্রেক্ষাপটে দাবি উঠেছে ১০০ দিনের কাজ চাই। কিন্তু নদীয়ার গ্রামাঞ্চল ধুবুলিয়ার নওপাড়া অঞ্চলে বেছে বেছে দলীয় আনুগত্য দেখে অত্যন্ত সীমিত সংখ্যককে কাজ দেওয়া হচ্ছে। বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে ব্যাপক কর্মহীন গ্রামীণ শ্রমজীবীরা। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয় স্থানীয় সোনাতলা মোড়ে। স্থানীয় সিপিআই(এমএল) কর্মী কলমউদ্দিন বিশ্বাস বললেন, এই অঞ্চলে গত বছর স্বল্প সংখ্যক কিছু মানুষ কাজ পেয়েছে ৭০ দিন, আর ব্যাপক জবকার্ডধারীরা? কেউ পেয়েছে ৭ দিন! আদৌ কাজ পায়নি বহুসংখ্যক। এইভাবে তৃণমূলের রাজত্ব চলছে। যেখানে কাজের কোন হিসাব নেই, স্বচ্ছতা নেই, চলছে গোপন দুর্নীতির চক্র। অপরদিকে কেন্দ্রের মোদী সরকার কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ কমিয়ে দিয়ে এটাকে কার্যত তুলে দিতে চাইছে।
এদিনের প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন আরওয়াইএ নেতা রণজয় সেনগুপ্ত, অমিত মন্ডল, সিপিআই(এমএল) নেতা জয়তু দেশমুখ, স্থানীয় নেতা সায়দুল মোল্লা প্রমুখ। ডিজেল পেট্রোল সহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকারী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো হয়। এরাজ্যে নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, শূন্য পদে নিয়োগের দাবিতে শ্লোগান প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রোগ্রামে জনবহুল সোনাতলার মোড় সরগরম হয়ে ওঠে। বহু মানুষ দাঁড়িয়ে বক্তব্য শোনেন। এরাজ্যে করোনা ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারি মদতে যে দুর্নীতির কারবার চলছে তার বিরুদ্ধে এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে বক্তারা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে গত ৯ মে দেশে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৭.২৯%। মাত্র এক সপ্তাহ পরে ১৬ মে সেই বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ১৪.৩৪%। ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ সূত্রে মিলেছে এমনই পরিসংখ্যান।
বেকারত্বের ছায়া দেখা যাচ্ছে শহরাঞ্চলেও
সেখানে মে মাসের এক সপ্তাহে ৩% বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারত্ব। সপ্তাহের শেষে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ১৪.৭১%। সম্মিলিতভাবে বেকারত্বের হার এই এক সপ্তাহে ৮.৬৭% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.৪৫% হয়েছে। মোদী সরকার সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। চলছে ব্যাপক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস। ফিরিয়ে আনা হচ্ছে পরোক্ষ দাস শ্রমিক প্রথা। ঠিকা-চুক্তি প্রথা, চরম অনিশ্চিত বা অসন্মানজনক কাজ সৃষ্টি করে চলেছে আধা বা ছদ্ম বেকারত্ব! এই মারাত্মক অবস্থায় কাজের অধিকারের দাবিতে এলাকায় এলাকায় যুবকদের সমাবেশিত করার কর্মসূচি নিয়েছে যুব সংগঠন আরওয়াইএ। প্রচারের পরিসমাপ্তিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে করোনাকালে প্রয়াতদের স্মরণে শ্রদ্ধা ও শোকজ্ঞাপন কর্মসূচি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সরকারী নিয়োগে দুর্নীতি অনিয়মের উচ্চ-পর্যায়ের তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবিতে ও মেধাতালিকা ধরে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে এবং লকডাউনে কাজ হারানোদের মাসিক ৭,৫০০ ক্ষতিপুরণের দাবিতে রাজ্যজুড়ে আরওয়াইএ’র পক্ষ থেকে ৪ জুলাই প্রতিবাদ দিবস পালন করার কর্মসূচি নেওয়া হয়। ঐদিন পুর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের মেড়তলাগ্রাম পঞ্চায়েতের চন্ডিপুর গ্রামে, পুর্বস্থলী ১নং ব্লকের নাদনঘাট গ্রাম পঞ্চায়েতের ইসলামপুর গ্রামে, কালনা ২নং ব্লকের আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ডে, মেমারী ১নং ব্লকের নিমো ও মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়।
৪ জুলাই স্বজন হারানোর স্মরণ অনুষ্ঠান করা হয় মন্তেশ্বর, কালনা ২নং ব্লকের আগ্রাদহ গ্রামে।
বৈচিত্র্যময় ভারতীয় সমাজ।
বামপন্থী, প্রগতিবাদী শিবিরের গণ আন্দোলনের কর্মীরা যত বেশি এই বৈচিত্র্য সচেতন থাকতে পারবেন, ততই ছোট-বড় হস্তক্ষেপে গণ আন্দোলনের বৃহত্তর বৃত্তে সংগঠিত করার কাজটা আরো মসৃণ হয়ে উঠতে পারে।
৩০ জুন হুল দিবস। এটি শুধুমাত্র একটি দিবস পালন নয়, আসলে এটি এক সচেতনতা; ভারতীয় সমাজের গঠনের চলমান প্রক্রিয়ায়, সামাজিক-রাজনৈতিক বিকাশে ভারতীয় সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নানা অংশের ভূমিকা সম্পর্কে সামগ্রিক বোধ সঞ্চারের ও তার স্বীকৃতির জন্য লড়াইয়ের দাবি নিয়ে আসে হুল দিবস।
এই স্বীকৃতি থেকে জনজাতির মানুষ আজও বঞ্চিত। কলকাতার বুকে রাস্তার নাম জননায়ক সিদো-কানহুর নামাঙ্কিত করে দায়িত্ব শেষ হয় না। হুল দিবসের মঞ্চে তাই অবাক জিঞ্জাসায় প্রশ্ন ওঠে, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুদের জন্মদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্র পালন করা হয়, কিন্তু ব্রিটিশ দখলদারদর বিরুদ্ধে জনজাতি গণবিদ্রোহের দুধর্ষ নেতানেত্রী সিদো-কানহু-চাঁদ-ভৈরঁ-ঝানো-ফুলো-বীরসাদের জন্মদিন কেন সর্বজনীন পালনীয় নয়!!
৩০ জুন, ১৮৫৫-তে বিদ্রোহের শুরু, শেষ ১৮৫৬-তে। বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি, গ্রামের পর গ্রাম সেদিন রক্তাক্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ সহ এদেশীয় মহাজন, জমিদার অত্যাচারীদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিলেন সিদো, কানু, চাঁদ, ভৈরো, ফুলো, ঝানো ভাইবোনেরা। প্রাণ দিয়েছেন, ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতীয় কৃষকের জাগরণের এই দিনে পথে নামতে প্রস্তুত থাকেন বাংলার কৃষক জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ভাগীদার আদিবাসী কৃষকরা। সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং তার সহযোগী আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এই জাগরণ, এই বিপ্লবী চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আদিবাসী কৃষকদের স্বাতন্ত্র্যকে বিশেষ মর্যাদা দিতেই ২০১৭-তে বাঁকুড়ার মাটিতে গড়ে ওঠে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ। হাসা, ভাষা, লায়লাকচার (জমি, ভাষা, সংস্কৃতি)-কে কেন্দ্রীয় শ্লোগান রেখে আত্মপরিচিতির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ে কয়েক হাজার আদিবাসী মানুষ ২০১৮-র নভেম্বরে সমবেত হয়েছিলেন কলকাতার বুকে, অধিকার যাত্রায়।
২০২১-এ নির্বাচন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আয়ারলা ও আদিবাসী মঞ্চের হুগলি জেলা নেতৃত্ব ৩০ জুন ‘হুল ক্রান্তি’- কৃষক জাগরণের দিন রূপে পালনের ডাক দেয়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে পৌঁছানোর ডাক দেওয়া হয়। দেখা গেল, ধনেখালি, পোলবা, বলাগড়ের বহু গ্রামে আদিবাসী জনগণ মঞ্চের ডাকে সাড়া দেন। সকাল থেকেই বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী জনগণের সমাবেশ থেকে লোকনায়ক সিদো, কানুর পাশাপাশি দুই বীরাঙ্গনা ফুলো, ঝানোকে স্মরণ করা হয়। এই কৃষক বিদ্রোহীদের পথেই আজকের অধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়া হয়।
দুপুর ২টা থেকে পান্ডুয়ার তিন্না মোড়ের কাছাকাছি একটি আদিবাসী মারঘাটীর সামনের মাঠে মঞ্চ বেঁধে অধিকার মঞ্চের জেলা সভানেত্রী ময়না কিস্কুর নেতৃত্বে স্থানীয় আদিবাসী জনগণ ব্যাপক ও আন্তরিক অংশগ্রহণ করেন। আয়ারলার জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন বাগের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান কেন্দ্রীয় কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অনুষ্ঠান সুচারুভাবে পরিচালনা করেন মঞ্চের জেলা নেত্রী সরস্বতী বেসরা। শুরু থেকেই অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত থেকে সহায়তা সুনিশ্চিত করেন কিষান মহাসভার জেলা সম্পাদক মুকুল কুমার। তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্যে ৩০ জুনের তাৎপর্য সবার মনে দাগ রেখে যায়। মঞ্চের জেলা সম্পাদক পাগান মুর্মু, জেলা নেতা সজল দে সহ অন্যরা বিশেষ সম্বর্ধনা স্বরূপ উপহার তুলে দেন অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক স্থানীয় আদিবাসী মাঝিবাবাদের হাতে। কিষান ক্রান্তির বার্তা বারংবার তুলে ধরার পাশাপাশি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করে।
পরবর্তী আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে শেষ হয় ২০২১-এর হুল ক্রান্তি দিবস পালন। সিদো, কানু অমর রহে। শহীদ কমরেড ফুলো, ঝানো লাল সেলাম।
পাগান মুর্মু
সজল অধিকারী
বিজাপুর ও সুকমা জেলার সীমান্তে জঙ্গল কেটে সাফ করে সিআরপিএফ’এর ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। গত ১২ মে থেকে ছত্তিসগড়ের সুকমা জেলার সিলগার গ্রামে ঐ ক্যাম্পের বিরুদ্ধে হাজার হাজার আদিবাসী প্রতিবাদ করছেন। ১৭ মে পুলিশ ও সিআরপিএফ ক্যাম্পের প্রাঙ্গনে ৩ জন আদিবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। একজন আদিবাসী অন্তঃসত্ত্বা মহিলা ৫ দিন পর মারা যান।
তারপর থেকে ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবাদ আন্দোলন চলছে। দক্ষিণ ছত্তিসগড়ে কমপক্ষে ১২ জায়গায় অক্টোবর ২০২০ থেকে এই ধরনের আধাসেনা ক্যাম্প-বিরোধী আন্দোলন হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন উন্নয়নের জন্য সড়কপথ নির্মাণের দোহাই দিয়ে এই সিআরপিএফ ক্যাম্পগুলি গড়ে তোলে। কিন্তু আদিবাসীরা জানেন প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠের জন্য কর্পোরেটদের রাস্তার প্রয়োজন। বিশেষত জঙ্গল সাফ করে খনিজ সম্পদ পরিবহনের জন্য। এছাড়া মাওবাদী আক্রমণ দমনের নামে দমন-পীড়ন চালানো এবং নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের প্রতিবাদের ভয়ে সড়ক নির্মাণ প্রশাসকের পক্ষে জরুরি। গ্রেফতার, ইচ্ছেমতো আটক করা, অত্যাচার, হত্যা ধর্ষণ, ক্যাম্পগুলিতে এবং চেকপোস্টে প্রতিদিন তল্লাশী চালানো এসব চলছেই।
গ্রামসভার বিনা অনুমতিতে এবং পঞ্চায়েত (তফশিলী অঞ্চল) আইন লঙ্ঘন করে ক্যাম্পগুলি বসানো হয়েছে। উক্ত আইনের ৪(ক) ধারায় বলা হয়েছে পঞ্চায়েত (তফশিলী অঞ্চল) বা গ্রামসভার সাথে আলোচনা করে তবেই উন্নয়নের কর্মসূচি বা তৎজনিত কারণে পুনর্বাসন, পুনঃস্থাপন, জমি অধিগ্রহণ করা যাবে। ছত্তিসগড়, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড এবং মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী অঞ্চলে (পঞ্চায়েত এক্সটেনশন টু শিডিউল্ড এরিয়াস অ্যাক্ট, ১৯৯৬) সংক্ষেপে ‘পেসা’ আইনটি লাগু করার নিয়মকানুনই এখনও ঠিক করা হয়নি। ২০১৮ সালে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ‘পেসা’ লাগু করার আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু আড়াই বছর পরও জোর করে সিআরপিএফ ক্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে।
৩০ মে, ১৮ বছরের আদিবাসী তরুণী পেকি বেকোকে ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ডের (ডিআরজি) জওয়ানরা তার বাড়ি বিজাপুর জেলার নেলসানার থেকে তুলে নিয়ে যায়। তার পিতা মাতা পুলিশের পিছু ধাওয়া করে নাগাল পায় না তাদের কন্যার। পরে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে তাঁরা মেয়ের ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখে আঁতকে ওঠেন। পুলিশের বয়ান অনুযায়ী পেকি একজন ‘মাওবাদী’ সন্ত্রাসী এবং সংঘর্ষে নিহত হয়েছে। পরিবারের লোকেদের অভিযোগ এটি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা।
বস্তারে এরকম ঘটনার লম্বা তালিকা – ছত্তিসগড় পুলিশ ধর্ষণ, হত্যা ঘটিয়েই চলেছে। ২০১১-তে তরুণী মীনা খালকোর গণধর্ষণ ও হত্যা হয় – ছত্তিসগড় পুলিশ বলে মেয়েটি মাওবাদী ছিল ও সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে। পরে বিচার বিভাগীয় তদন্তে জানা যায় পুলিশ ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। কিন্তু অপরাধীর বিচার এখনও হয়নি। এআইপিএফ’এর রিপোর্টে জানা গেছে পেকির মতো পান্ডিকে তার স্বামীসহ গ্রেফতার করে পুলিশ বাড়ি থেকে। পান্ডি ও তার স্বামীকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে পুলিশ, ও পান্ডিকে মাওবাদীদের উর্দি পরানো হয়। তাদের শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন দেখা গেছে, যার দ্বারা প্রমাণ হয় এটি একটি ভূয়ো সংঘর্ষের ঘটনা। এআইপিএফ’এর তথ্য বলছে, দুটি তরুণী – ভানজাম শান্তি এবং সিরিয়াম পজ্জি – বয়স ১২/১৩, এদেরও ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে পুলিশ। পুলিশের বয়ান হল, ওরা ‘মাওবাদী স্কোয়াড’এর সদস্য এবং সংঘর্ষে নিহত হয়েছে।
অক্টোবর ২০১৫, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশ, কমপক্ষে ১৬জন মহিলা – প্রাথমিকভাবে বোঝা যাচ্ছে তাঁরা ধর্ষিত, যৌন লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত হয়েছেন। অবশ্যই ছত্তিসগড়ের বিজাপুর জেলার পুলিশের দ্বারা।
সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো সিলগারের আন্দোলনে সামনের সারিতে রয়েছে আদিবাসী যুবক-যুবতীদের একটি টীম। যাঁরা এমএলএ, এমপি ও সরকারের সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে এবং আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
৩ জুন সিলগার আন্দোলনে ১৭ থেকে ২৫ বছর বয়সের ছাত্রদের ১০ সদস্যের একটি টীম গঠিত হয়। এদের সঙ্গে রয়েছেন এদের শিক্ষক ও সমাজকর্মী সোনি সোরি (যিনি পুলিশ হেফাজতে ধর্ষিত হন)। এঁরা সরকারি প্রতিনিধিদের একটি দলের – যে দলে কংগ্রেসের ৮ এমএলএ, বস্তারের এমপি, জেলা কালেক্টর, বিজাপুর ও সুকমার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ও বস্তার ডিভিশনের আইজি প্রমুখ ছিলেন।
টীমের দাবি ছিল, প্রতিবাদীদের সামনে খোলাখুলি আলোচনা চলুক। প্রতিবাদীদের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা দাবি করলেন, সিআরপিএফ ক্যাম্প হটাতে হবে, যে পুলিশরা প্রতিবাদীদের ওপর গুলি চালিয়েছে তাদের বরখাস্ত করতে হবে, সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে দিয়ে গুলি চালানোর ঘটনার তদন্ত করাতে হবে, পুলিশকে আদেশ দিয়ে নিহত প্রতিবাদীদের জন্য স্মৃতিসৌধ বানিয়ে দিতে হবে। পুলিশ ও প্রশাসনকে গ্যারান্টি দিতে হবে যেন ভবিষ্যতে কোনো প্রতিবাদীকে হয়রানি না করা হয় এবং গ্রামসভার সাথে আলোচনা না করে কোনো পুলিশ ক্যাম্প তৈরি করা যাবে না। বস্তার ডিভিশনের সাতটি জেলার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে, যাদের সাথে আলোচনা না করে কোনো সুরক্ষা ক্যাম্প গড়ে তোলা যাবে না। এই দাবিগুলি নিয়ে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি কারণ সরকার বেআইনিভাবে গড়ে তোলা ক্যাম্প সরাতে রাজি হয়নি এবং অন্যান্য দাবিগুলি মানার জন্য লিখিত আশ্বাস দিতেও রাজি হয়নি।
১২ জন সদস্যের ‘ছত্তিসগড় বাঁচাও’ আন্দোলনের একটি প্রতিনিধি দলকে ৬ জুন সিলগারের আগে নেলসানার থানার কাছে আটকে দেওয়া হয়। এমনকি তাঁদের বিজাপুর জেলার সদরেও যেতে দেওয়া হয়নি। প্রতিনিধি দলে ছিলেন ‘ছত্তিসগড় বাঁচাও’এর আহ্বায়ক অলোক শুক্ল, ছত্তিসগড় কিসান আন্দোলনের আহ্বায়ক সুদেশ টিকম, ছত্তিসগড় কিসান সভার নেতা সঞ্জয় পারাতে, এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক ব্রিজেন্দ্র তিওয়ারি, সমাজকর্মী বেলা ভাটিয়া এবং ইন্দু নেতাম প্রমুখ। তাঁরা এই চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানান এবং ছত্তিসগড় সরকারের এই অত্যাচারী কার্যকলাপ ও পূর্ববর্তী সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণের জন্য নিন্দা প্রকাশ করেন।
নরেন্দ্র মোদীর কর্পোরেট প্রীতির কথা উঠলেই একযোগে উচ্চারিত হয় আদানি-আম্বানিদের নাম। নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় এই কর্পোরেট ঘরানাগুলো যেমন লাভবান হয়েছিল, তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের জমানাতেও এদের অগাধ শ্রীবৃদ্ধির পিছনে তার সঙ্গে এদের দোস্তির সম্পর্কই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থেকেছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। তবে, আদানি-আম্বানিরাই একমাত্র কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব নন যাঁদের স্বার্থ রক্ষাই মোদীর ভাবনায় প্রাধান্য পায়। এই অতিমারীর সময়, দেশবাসীর চরম বিপর্যয়কালেও নরেন্দ্র মোদী টিকা প্রস্তুকারক কর্পোরেট সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষার কথা, তাদের বিপুল মুনাফাবাজিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলতে পারলেন না। মোদী সরকার তাদের টিকা নীতিতে পরিবর্তন এনে বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য মোট উৎপন্ন টিকার এক ভালো অংশ সংরক্ষিত রাখা এবং টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোকে বেসরকারি হাসপাতালের কাছে বিক্রির দাম নির্ধারণ করতে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেয় তা আপামর জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে কর্পোরেট স্বার্থকে সুনিশ্চিত করারই নির্ধারক পদক্ষেপ।
প্রাপ্ত বয়স্কদের সবচেয়ে বড় অংশকে, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের বিনামূল্যে টিকা না দেওয়ার মোদী সরকারের প্রথম দিকের সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্টের ‘স্বেচ্ছাচারী ও অন্যায্য’ বলা এবং টিকার জন্য বাজেটে বরাদ্দ ৩৫,০০০ কোটি টাকা থেকে তাদের বিনামূল্যে টিকা দেওয়া সম্ভব নয় কেন প্রশ্ন তোলার পর মোদী সরকার তাদের টিকা নীতিতে পরিবর্তন আনে। সরকার জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করে যে ২১ জুন থেকে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের, অর্থাৎ, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদেরও বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার দায় সরকার নেবে। কিন্তু এর সাথেই সরকার আরও সিদ্ধান্ত নেয়, দেশে মোট যে টিকা উৎপন্ন হবে এবং বিদেশ থেকে যে টিকা আমদানি করা হবে তার ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এই নীতির নাম দেয় ‘উদারিকৃত টিকা নীতি’ এবং সরকারি উদারতার অভিমুখ যে টিকা তৈরির কর্পোরেট সংস্থা ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দিকেই নির্দেশিত তা নীতির বিধানের মধ্যেই সুস্পষ্ট। বেসরকারি হাসপাতালগুলো টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তাদের নির্ধারণ করা, কি দামে টিকা কিনবে তাও সরকার বলে দেয়। প্রতি ডোজ টিকার এই দাম কোভ্যাক্সিনের জন্য হল ১,৪১০ টাকা, কোভিশিল্ডের জন্য ৭৮০ টাকা এবং স্পুটনিক ভি’র জন্য ১,১৪৫ টাকা, তিনটি দামের মধ্যেই হাসপাতালগুলোর প্রাপ্য সার্ভিস চার্জ ধরা আছে ১৫০ টাকা। দুটি ডোজ নিতে গেলে মোট খরচ যে এর দ্বিগুণ হবে এবং তা যে ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণের সাধ্যের অতীত হবে তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থাকতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের হিসেব, এই দাম থেকে টিকা প্রস্তুকারক সংস্থাগুলো ২,০০০ থেকে ৪,০০০ শতাংশ মুনাফা করবে এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোও যথেষ্ট লাভ করতে পারবে। এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটাও উঠছে যে -- বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য মোট টিকার ২৫ শতাংশ বরাদ্দ কি ধনীদের জন্যই সংরক্ষণ নয়?
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য ২৫ শতাংশ টিকা বরাদ্দ হলেও সরকারি ক্ষেত্রে টিকার বড় ধরনের আকাল চলছে। বিভিন্ন রাজ্যেই সরকারি টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে লম্বা লাইন পড়ছে, রাত থেকেই মানুষরা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, কিছু মানুষ টিকা পাচ্ছেন এবং অনেককেই টিকা না নিয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কিছু রাজ্য সরকারকে শুধু দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ওপর জোর দিতে হচ্ছে, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকা দান উপেক্ষিত হচ্ছে। এর মূল সমস্যাটা কোথায়? সরকার জানিয়েছে, টিকা পাওয়ার যোগ্য প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মোট সংখ্যা ৯৯.৪০ কোটি। এদের সবাইকে দু’ডোজ করে টিকা দিতে প্রয়োজন ১৮৬ থেকে ১৮৮ কোটি ডোজ। গত ৩০ জুন পর্যন্ত ভারতে টিকা দেওয়া হয়েছে সাড়ে তেত্রিশ কোটি ডোজ, এবং দু’ডোজ করে টিকা পেয়েছে প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার মাত্র ৪.৫ শতাংশ। সরকার দাবি করছে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কর টিকা দান সম্পূর্ণ করা হবে। তা করতে গেলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন হবে। এখন যা অবস্থা তাতে ভারতে তৈরি হওয়া এবং আমদানি করা টিকা মিলিয়ে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব নয়। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এবছরের এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে দেওয়া হয়েছিল ২৯.৯ লক্ষ ডোজ, মে মাসে ১৯.৬ লক্ষ ডোজ, ১ জুন থেকে ২০ জুন গড়ে ৪০.৩ লক্ষ ডোজ এবং ২১ থেকে ২৮ জুন গড়ে ৫৭ লক্ষ ডোজ। জুলাই মাসের জন্য সরকার ৩৬টা রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ করেছে ১২ কোটি ডোজ। এই সংখ্যাগুলো প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় এক কোটি ডোজ থেকে অনেক কম, এবং সাধারণ যুক্তি বলে উৎপাদনকে অল্প সময়ের মধ্যে এমন পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব নয় যা প্রয়োজনীয় পরিমাণের কাছে যেতে পারে। এবছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কর টিকাকরণ সম্পূর্ণ করার যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে, তা পূরণ করা যে সম্ভব নয় সে কথা স্বীকারে সরকারের কুণ্ঠা হচ্ছে। কিন্তু ঢাক পেটানো তো দরকার, আর তাই নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে সরকার বলছে যে, আমেরিকায় ৩২ কোটি ডোজ টিকা দিতে সেখানকার প্রশাসনের লেগেছিল ১৯৩ দিন, আর ভারত ১৬৩ দিনে, অর্থাৎ, তাদের চেয়ে এক মাস কম সময়েই এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু সংখ্যার হিসেব দিলেও তাদের পক্ষে অস্বস্তিকর বলে শতাংশের হিসেবকে এড়িয়ে যাচ্ছে। ঐ সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশের দু’ডোজ করে টিকাকরণ সম্পূর্ণ করেছে, ভারত সেখানে করেছে মাত্র ৪.৫ শতাংশের!
এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য ২৫ শতাংশ টিকার সংরক্ষণ কতটা যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত? ভারতে ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণ দরিদ্র, তাঁরা দারিদ্র সীমার নীচে ও গ্ৰামাঞ্চলে বাস করেন। টিকা পাওয়াটা এই মানুষদেরও অধিকার এবং তাঁদের কখনই সরকারি অনুকম্পার প্রাপক বলে গণ্য করা যাবে না। অতএব সাধারণ জনগণের টিকাকরণের হারকে বাড়াতে হবে এবং তারজন্য সরকারের হাতে টিকা বেশি মজুতও করতে হবে। কোভিড সংক্রমণের ছড়িয়ে পড়া এবং সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউকে রোখার জন্যও এটা জরুরি। আশু পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন এবং আমদানিকৃত টিকার বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য সংরক্ষিত টিকা নিজেদের হাতে নিয়ে রাজ্যগুলোকে বন্টন করলেই কেন্দ্রীয় সরকার সর্বজনীন টিকাকরণের দায়বদ্ধতার প্রতি সুবিচার করতে পারবে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশ পেল বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য সংরক্ষিত টিকা সম্পর্কে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের অভিমত। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিবকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, ঝাড়খণ্ডে ৭৫ শতাংশ মানুষ গ্ৰামাঞ্চলে বাস করেন এবং বেসরকারি হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত দাম দিয়ে টিকা কেনার সামর্থ্যও তাদের নেই। তিনি তাই অনুরোধ করেছেন, টিকা বন্টনকে ন্যায্য করতে ঐ রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য ২৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ টিকা বরাদ্দ করা হোক এবং এদের জন্য বরাদ্দের বাকিটা, অর্থাৎ, ২০ শতাংশও সরকারি কেন্দ্র থেকে টিকাদানের জন্য রাজ্য সরকারকে দেওয়া হোক। সরকারের রিপোর্ট থেকেই জানা যাচ্ছে, মে মাসে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে যে টিকা বিক্রি করা হয়েছিল তার ৫০ শতাংশই হস্তগত করেছিল সারা দেশের মাত্র ৯টা কর্পোরেট চালিত হাসপাতাল এবং বাকি ৫০ শতাংশ কিনেছিল ৩০০টা ছোট বেসরকারি হাসপাতাল। দেখা যাচ্ছে, মোদী সরকারের ‘উদারিকৃত টিকা নীতি’ যেমন টিকা প্রস্তুকারক কর্পোরেট কোম্পানিগুলো এবং গুটিকয়েক কর্পোরেট চালিত বেসরকারি হাসপাতালের জন্য বিপুল লাভ এনে দেবে, তেমনি সরকারি টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে টিকার আকাল সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণকে টিকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে। এরই সাথে শহরাঞ্চলের ধনীরাও লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়িয়ে অনায়াসে ও দ্রুত টিকা নিতে পারবেন। সরকার গৃহীত টিকা নীতির মধ্যেই এইভাবে অন্তর্নিহিত বৈষম্য ও বিভেদের সুনির্দিষ্ট আয়োজন। কাজেই দাবি উঠেছে — সরকারের টিকা নীতি কর্পোরেট স্বার্থমুখী হওয়ার বদলে গণমুখী হতে হবে, উৎপাদিত ও আমদানিকৃত টিকার ১০০ শতাংশই সরকারকে নিজের হাতে নিয়ে বিনামূল্যে আপামর জনসাধারণের টিকাকরণ অভিযানে লাগাতে হবে। সর্বজনীন টিকাকরণের জন্য এটা যে অপরিহার্য তার স্বতঃসিদ্ধতা নিয়ে বোধকরি কেউ প্রশ্ন তুলবেন না। পোলিও, গুটিবসন্ত এবং অন্যান্য টিকার ক্ষেত্রে যে ধারা অনুসৃত হয়েছে, বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের যে দায়িত্ব সরকার পালন করে এসেছে, আজ তার থেকে বিচ্যুত হয়ে টিকা নীতিকে ‘উদারিকৃত’ করার কোনো যুক্তিগ্ৰাহ্য বিবেচনা থাকতে পারে না।
- জয়দীপ মিত্র
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলমন্ত্রক ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তৃণমূল তখনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায়। রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থলাভিষিক্ত হলেন ব্যারাকপুরের তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী। তিনি পেশ করলেন পরবর্তী রেলবাজেট। আর তারপরেই ঘটল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ইউপি মন্ত্রীসভার অন্যান্য শরিকেরা সেই রেল বাজেটকে অভিনন্দন জানালো, কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তৃণমূল সেই বাজেটকে ভাড়া বৃদ্ধির কারণে পুরোপুরি নাকচ করে দিল। এত তীব্র ছিল নিজেদের মন্ত্রীর বাজেটের বিরুদ্ধে সেই প্রতিবাদ যে দীনেশকে রেলমন্ত্রক থেকে সরে যেতে হল, নতুন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের হাত ধরে নতুন সাজে রেলবাজেট পাশ হল। ভাড়া বাড়ল না।
রেলের নিরাপত্তা, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য, আধুনিকতার খাতিরে অনেকেই বলতেন রেলের ভাড়া বৃদ্ধির কথা। লালুপ্রসাদের জমানাতে এর আগে রেলে দীর্ঘদিন জেনারেল বা স্লিপার ক্লাসে ভাড়া বাড়েনি, অথচ খরচ বেড়েছে ক্রমাগত। তাই ভাড়া বৃদ্ধি করে ‘রেলের উন্নয়ন’এর জন্য সওয়াল করছিলেন একদল মানুষ। বিপরীতে অন্য একটি মতও ছিল প্রবল। ভারতের মতো গরিব দেশে রেল, তার সাধারণ কামরাগুলি হল গণপরিবহনের লাইফ লাইন। তার ভাড়া বৃদ্ধির অর্থ দেশের কোটি কোটি মানুষের ওপর চাপ বাড়ানো। রেলকে ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির বাইরে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে দেখে ভাড়া না বাড়িয়েই তার সুযোগ সুবিধে বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল ছিল এই পক্ষের। অনেক তর্জা চলেছিল অনেকদিন ধরে, কিন্তু সকলেই মেনে নিয়েছিলেন যে রেল হল ভারতের লাইফ লাইন। তাকে ঘিরে যে নীতিমালা তা সরাসরি ভারতের কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের জীবন জীবিকা ও স্বার্থের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত।
আরো বছর দু’তিন যদি পিছিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে আমরা দেখব ২০০৯ সালে লোকসভায় বিপুল বিজয়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী হলেন, তখন তার রেল বাজেটগুলির মুখ্য অভিমুখ ছিল ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য পরপর কয়েকটি রেল বাজেটে নানা রেল কারখানা, হাসপাতাল, স্কুল, নার্সিং কলেজ ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জন্য একগুচ্ছ নতুন ট্রেনের কথাই শুধু সেখানে এল না, এল নতুন নতুন মেট্রো প্রকল্পের কথা। তাই নিয়ে বিপুল আগ্রহও তৈরি হল মানুষের মধ্যে। এমনকি মেট্রো তৈরি শুরু হবার ঢের আগেই প্রস্তাবিত মেট্রো রুটগুলির আশেপাশের জমি বাড়ি আবাসনের দাম বাড়ল হু হু করে। বোঝা গেল শহর মফস্বলের গণপরিবহণের ক্ষেত্রে মেট্রো রেলের কি বিপুল চাহিদা। গত এক দশকে নানা রাজ্য রাজধানী সহ দেশের বড় বড় অনেক শহরেই মেট্রো রেল চালু হয়েছে এবং সেগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এই অতীতচারিতা কেন? শুধু জানা কথাটাকেই আরো একবার সামনে আনার জন্য যে ট্রেন বা মেট্রো রেল হল ভারতের লাইফ লাইন। কোটি কোটি মানুষের জীবন যাপনের সঙ্গে তা সরাসরি সম্পর্কিত। লোকাল রেল ও মেট্রো আমাদের রাজ্যে এখন অনেকদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে রাজ্য সরকারের কোভিড বিধিনিষেধের কারণে। এই নীতির বিরুদ্ধে মানুষ ক্রমশ সরব হচ্ছেন, প্রতিবাদে নামছেন। নানা মহল থেকে লোকাল ট্রেন ও মেট্রো চালুর জন্য রাজ্য সরকারের কাছে নিয়মিত আবেদন জানানো হচ্ছে। কিন্তু সরকার এখনো তাতে কর্ণপাত করছেন না।
ক্রমশ অফিস কাছারি সবই খুলেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাওই কিছু তেমন বন্ধ নেই, মানুষকে কাজের প্রয়োজনে যাতায়াত করতে হচ্ছে প্রতিদিন। অথচ এই যাতায়াতের প্রধান অবলম্বনগুলিই বন্ধ হয়ে আছে। রাজ্য সরকার ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে অটো বাস চালানোর কথা বলেছেন। এই নির্দেশিকার বাস্তব বিপরীতটি কি? কয়েকটি রুটের বাসে এমন ভিড় হচ্ছে যে পাদানিতে পর্যন্ত দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। স্টাফ স্পেশাল নামে যে নামমাত্র কয়েকটি ট্রেন চলছে তাতে গাদাগাদি ভীড়, অধিকাংশ মানুষ উঠতেই পারছেন না। অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ববৃদ্ধির যে কারণ দেখিয়ে লোকাল ট্রেন ও মেট্রো বন্ধ রাখা হয়েছে, কার্যক্ষেত্রে বাস ও স্টাফ স্পেশালের মারাত্মক ভীড় তাকে হাস্যকর জায়গায় নামিয়ে আনছে। অন্যদিকে এগুলি যেহেতু লোকাল ট্রেন ও মেট্রোর যাত্রীদের সামান্য এক ভগ্নাংশকেই কেবল বহন করতে পারে, তাই এগুলি যা চলছে তা দিয়ে প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা এক হাস্যকর অবাস্তব পরিকল্পনা। এমনিতেই এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে আমাদের গণপরিবহন যথেষ্ট দুর্বল। মেট্রো ও মূলত লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় তা এক গভীর সঙ্কটে পড়েছে।
একটি বাস্তব অবস্থার কথা বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক নৈহাটির একটি পরিবারের কোনও একজন কেউ মেডিকেল কলেজ বা পিজি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বা ধর্মতলা চত্বরে কেউ অফিসে আসবেন নৈহাটি থেকে। এইবারে নৈহাটি থেকে তিনি মেডিকেল কলেজ বা পিজি বা ধর্মতলায় আগে কীভাবে পৌঁছতেন আর এখনই বা কীভাবে পৌঁছবেন? কতটা বেশি সময় লাগবে আর অর্থই বা কতটা বেশি খরচ হবে?
আগে নৈহাটি থেকে একজন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে যেতেন কমবেশি একঘন্টায়। সেখান থেকে হেঁটে মেডিকেল কলেজ বা বাসে ধর্মতলা যেতে তার সময় লাগত আরো মিনিট পনেরো। পিজি হলে সেটা হয়ত আরো দশ মিনিট বেশি। খরচ হত ট্রেনে দশ টাকা আর বাসে আরো দশ বারো টাকা। তাঁর কাছে আরেকটা বিকল্প ছিল ট্রেনে দমদমে এসে সেখান থেকে মেট্রোয় একেবারে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া। তাতে খরচ আরো পাঁচ দশ টাকা বাড়লেও সময়ের সাশ্রয় হতো অনেকখানি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পথটুকু বাস আর অটো মিলে পেরোতে তার সময় লাগবে কম করে তিন ঘন্টা। একটানা আসার সুযোগ তেমন নেই। বেশ কয়েকবার ভেঙে ভেঙে আসতে হবে। খরচ বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। সেটা হিসেব করে ওঠাই বেশ কঠিন। তবে পাঁচগুণ বা দশগুণ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। ওলা উবের জাতীয় অ্যাপ ক্যাবের সাহায্য নিতে হলে তো আর কথাই নেই। ট্রেন না চলায় ভীড় যে বাসগুলিতে কেমন হবে, ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে – তা সহজেই অনুমেয়।
এই যে উদাহরণটি এখানে দেওয়া হল সেই যাত্রাপথটি কিন্তু কোনও কল্পিত উদাহরণ নয়। বেশ কয়েক হাজার মানুষের দৈন্যন্দিন বাস্তবতা। নৈহাটির জায়গায় বনগাঁ, বসিরহাট, বজবজ বা বারাসাত করে নিলেও বাস্তবতাটা একই রকম সমস্যা জনক থাকবে।
এরসঙ্গেই যদি যোগ করে নেওয়া যায় ট্রেন চললে স্টেশন চত্বর ও তার আশপাশ ঘিরে চলা নানা ব্যবসা, অটো, টোটো, রিক্সা ইত্যাদি পরিবহণ বা রেল হকারদের কথাটা – তাহলে লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়ের আরো বেশ কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি নজর পড়ে। লোকাল ট্রেন না চলায় এইসব পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা কতটা সঙ্কটে, রেলের নিত্যযাত্রী না হয়েও তারা কতটা হাহুতাশ করছেন ট্রেন চলছে না বলে আর দুশ্চিন্তা নিয়ে রোজ খবর নিচ্ছেন ট্রেন কবে চলবে – তা তাদের সঙ্গে কথা বললেই টের পাওয়া যাবে স্পষ্টভাবে।
রাজ্য সরকারের কাছে এই সমস্ত খবর নেই তা নয়। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও তারা প্রতি পনেরো দিন অন্তর যে নতুন নতুন নির্দেশিকা দিচ্ছেন, তাতে লোকাল ট্রেন আর মেট্রো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে অনড় থাকছেন। একদিকে তারা দুয়ারে সরকার কর্মসূচির কথা বলেন, মানুষের পাশে থাকায় তাদের অঙ্গীকার বোঝাতে চান। অন্যদিকে মানুষের অন্যতম চাহিদা ও দাবিকে তারা উপেক্ষা করে চলছেন। তাদের বোঝা দরকার গণপরিবহনের লাইফ লাইন বন্ধ রেখে মানুষকে সুরাহা দেওয়া সম্ভব নয়।
- সৌভিক ঘোষাল
সত্যজিৎ রায়ের ১০০ বছর চলছে। আর আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদী শাসকেরা যে সত্যজিৎ রায়দের মতো সিনেমা পরিচালকদের ভয় পেয়ে থাকেন, তা আবারো প্রমাণ করলেন। তাঁদের মধ্যে যে ভয় আছে, যে সিনেমা বা ছবি অনেক সময়ে দর্শকদের তাতিয়ে দিতে পারে, সেই ভয় থেকেই তাঁরা নিত্য নতুন আইন আনছেন। অথচ ভাব করছেন তাঁরা যেন কত গণতান্ত্রিক।
গত ২৫ জুন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি অসাধারণ টুইট করেছেন। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ১৯৭৫ সালের কথা, যেদিন মধ্যরাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর ২৬ জুন সকাল থেকেই লাগু হয়েছিল জরুরি অবস্থার সমস্ত নিয়মনীতি, বন্ধ হয়েছিল মত প্রকাশের অধিকার। এই বছরের ২৬ জুন একটি সর্বভারতীয় দৈনিকের উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছেন এখন আমাদের যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর কলমেও একই কথা উঠে এসেছে যে ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্র কতটা খারাপ ছিল এবং এই একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যদি কথা না বলা যায় আজকে, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর। তাহলে কি আমরা এই মুহূর্তে ২০১৪ সাল থেকে অত্যন্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে আছি? এখন কি আমাদের মত প্রকাশের অধিকারের ওপর কোনও বাধাই নেই? এখন কি যেকোনও মাধ্যমে আমরা আমাদের মতো সরকারের সমালোচনা করতে পারি? সামাজিক মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম এমনকি সিনেমা টিভি বা হালের ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণ করার যে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন খবর আসছে তা সম্পুর্ণ মিথ্যে?
তথ্য কিন্তু তাই বলে না। এই তো কিছুদিন আগেই মঞ্জুল বলে এক ব্যঙ্গচিত্র শিল্পীকে সামাজিক মাধ্যম টুইটার চিঠি পাঠায় যে কেন তাঁর আঁকা নরেন্দ্র মোদীর ব্যঙ্গচিত্রটি টুইটার থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না? শুধু সেখানেই বিষয়টি থেমে থাকেনি, মঞ্জুল যে সংস্থায় কাজ করতেন সেখান থেকেও তাঁর চাকরি গেছে। ঘটনাচক্রে সেই সংস্থার যিনি কর্ণধার এবং সেই সর্বভারতীয় দৈনিক যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উত্তর সম্পাদকীয় ছাপা হয় দুজনেই একই ব্যক্তি। আসলে ১৯৭৫-এ যা ঘোষণা করে জারি হয়েছিল, তা ২০১৪ সাল থেকে অঘোষিতভাবেই জারি আছে।
গত ফেব্রুয়ারী মাসে যে নতুন আইন আনা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে যে এই সময়ে প্রতিটি সামাজিক মাধ্যম সংস্থাকে একজন করে ভারতীয় অফিসার নিয়োগ করতে হবে, যিনি দেখবেন যে, কোনও মানুষ সামাজিক মাধ্যমে কোনও দেশ বিরোধী লেখা বা ছবি বা ভিডিও পোষ্ট করছেন কি না, যদি করেন তাহলে তা চিহ্নিত করে সরকারকে জানাতে হবে, না হলে এরপরের দায় শুধুমাত্র সেই পোষ্ট যিনি করেছেন শুধু তাঁর উপরেই পড়বেনা, ওই সামাজিক মাধ্যম সংস্থার উপরেও বর্তাবে। সরকার মামলা করলে পোষ্ট যিনি করেছেন এবং সেই সংস্থা, দুজনের বিরুদ্ধেই করতে পারেন। সরকার কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। সরকার বলেছে, বিভিন্ন যে ছবি বা সিনেমা তৈরি হচ্ছে তাঁদের আরও সেন্সর করার অধিকার চেয়েছে। এই আইনটির একটি পোশাকি নাম আছে। সিনেমাটোগ্রাফ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০২১, যাতে বলা হয়েছে, যে সেন্সরের ছাড়পত্র পেয়ে একটি সিনেমা বের হয়ে যাওয়ার পরে যদি দর্শকেরা কোনও কিছু নিয়ে অভিযোগ করেন, তাহলে সরকার ইচ্ছে করলে আবার সেই দৃশ্যকে বাদ দিতে পারবে। যদিও মন্ত্রক থেকে বলা হয়েছে যে এই নিয়ম আগেই ছিল যে, কোনও সিনেমা যদি সেন্সরের শংসাপত্র পেয়ে রিলিজও হয়ে যায় তাহলেও পরে তা নিয়ে আবার নতুন করে ভাবনাচিন্তার অবকাশ থাকে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে যে একবার কেন্দ্রীয় ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড শংসাপত্র দিয়ে দিলে তা আর ফেরানো যায় না। কিন্তু সরকারের যুক্তি যে ওই আইনের ৫বি ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও সিনেমাতে দেখা যায় যে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতা ধবংস হচ্ছে, তাহলে সরকারের সেই ছবির অংশকে বাদ দেওয়ার অধিকার ছিলই। যদিও এই নিয়ে আইনি লড়াই চালু হয়েছে, কিন্তু এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে সরকার এই বিষয়ে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে রাজি নয়। এছাড়াও তাঁরা কেবল টিভি এবং ছোট ছোট সংবাদ সংস্থার জন্যেও একই ধরনের আইন আনতে চাইছে।
যদি খেয়াল করা যায়, প্রথম যখন কৃষক আন্দোলন চালু হয়, ছোট ছোট খবরের সংস্থার খবরই থাকতো সামাজিক মাধ্যম জুড়ে। তারপর সেই খবর দেখার পর যখন দেখা গেল ওই অবস্থানে বসেই অন্তত দুশো কৃষক মারা গেছেন, তখন বিদেশের নানা তারকারা এই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কথা বলতে শুরু করেন। সরকার সেদিনই প্রমাদ গোনে, তাঁদের মনে হয় এরফলে সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে, তখনই তাঁরা ওই আইটি আইন আনার কথা ভাবেন। তাঁরা জানেন যে, বড় বড় সংবাদসংস্থা সরকারের কথা শুনে চলতে বাধ্য, কিন্তু এই ধরনের ছোট সংস্থা বা টিভি সিরিজ বা সিনেমা অথবা লোকাল কেবল টিভি দিয়ে যদি দেশবিরোধী চিন্তা জাগ্রত হয়ে যায়, তাই ছোট ছোট সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আসলে একদিকে তাঁরা জরুরী অবস্থার বিরোধিতা করবেন আর পাশাপাশি সেই একই নিয়ম চালিয়ে যাবেন, অর্থাৎ গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করবেন, এটাই এই সরকারের মুলমন্ত্র। যাতে সরকারের স্বরূপ সাধারণ মানুষ সহজে চিনতে না পারে। কিন্তু আমরা কি চিনতে পারছি না? আমরা কি ইতিহাসকে ভুলে যাবো? আমরা কি জানি না, যে ফ্যাসিবাদ আসলে কায়েম করা হয়, সাংস্কৃতিক জগত দিয়েই? আমরা কি ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্রকে হারাই নি? আমরা কি ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে যে হিটলারের ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল তাকেও পরাজিত করিনি?
আসলে ক্ষমতা থাকলে তার বিরোধিতাও থাকে, তাই এই নতুন সিনেমাটোগ্রাফ আইনের বিরোধিতায় প্রাথমিক ভাবে শাবানা আজমি, অনুরাগ কাশ্যপ, নন্দিতা দাশ সহ ১,৪০০ জন সিনেমা জগতের মানুষ চিঠি লিখেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীকে, যে এই আইন অবিলম্বে ফেরত নিতে হবে। লড়াই ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার লড়াই, ‘দড়ি ধরে মারো টান’ এর লড়াই।
- সুমন সেনগুপ্ত
== সমাপ্ত ==