দিল্লী সীমান্তে কৃষক আন্দোলনের নবতর ঝড়ের সংকেত
A signal of a new storm

সামনের ২৫ জুলাই রাজধানী দিল্লীকে অবরুদ্ধ করে রাখা কৃষকদের ঐতিহাসিক অবস্থান আন্দোলনের আট মাস পূর্ণ হচ্ছে। পুরো শীতের মরশুম পার করে, প্রখর গ্রীষ্মের দিন কাটিয়ে বর্ষার মুখে দাঁড়িয়েও হাজার হাজার কৃষক খোলা আকাশের নিচে আজও দিন কাটাচ্ছেন। মাইলের পর মাইল জুড়ে পথেই তারা আস্তানা গেড়েছেন। পথের ওপরেই তারা ছাউনি বানিয়েছেন, অজস্র-অগণিত। ফসল খেতের দেখভালের জন্য একদল বাড়ি গেছেন তো গ্রাম থেকে অন্যরা এসে সে জায়গা পূরণ করেছেন। এখন খারিফ চাষের সময়। অনেকেই ঘরমুখী। ছাউনিগুলিতে লোক সমাগম আগের তুলনায় কিছু হ্রাস পেয়েছে। কিন্ত বোঝার তো উপায় নেই। প্রতি দুশো মিটার অন্তর এক একটা লঙ্গরখানা। কিছু দূর অন্তর অন্তর পাঞ্জাব ও হরিয়ানার এক এক জেলার মানুষেরা গান গাইছেন। কবিতা, আবৃত্তি, নাট্যানুষ্ঠানে জমিয়ে তুলছেন সকাল থেকে রাত অবধি। বলা বাহুল্য, মহিলারাও আছেন ভালো সংখ্যায়। দীর্ঘ অবস্থানে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষদের চিকিৎসার জন্য গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বহু মেডিক্যাল ক্যাম্প। সামনে সংসদের বাদল অধিবেশন। নির্বিকার মোদী সরকারকে আরও চাপে ফেলার জন্য আন্দোলনকারী কৃষকরা নতুনতর রণকৌশল গ্রহণ করছেন। কিন্তু মোদী সরকার যদি এত কিছুর পরেও তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করে? কৃষকদের সাফ জবাব — দরকারে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই অবস্থান চলবে। তাঁরা জানেন, এত দীর্ঘ সময়ধরে গণঅবস্থান খুবই বিরল ঘটনা যা সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে। তাঁদের চূড়ান্ত জয় অর্জনের অর্থ ফ্যাসিস্ট মোদী সরকারের পরাজয়। ধৈর্য্য তাঁদের প্রধান অস্ত্র, সঙ্গে সঙ্গে বিপুল গণসমর্থন তাঁদের প্রধান ভরসা। যে কারণে তাঁরা জানেন, এ শুধু এক কৃষক আন্দোলন নয়, এ হল কোম্পানীরাজ খতমের জন্য ব্যাপক জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন — যেখানে এসে মিলেছে ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক সহ সর্বস্তরের জনগণের দেশজোড়া সমর্থন। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রকে নির্মূল করতে চায়। বিপরীতে বিরোধী স্বরকেও মর্যাদা দেওয়া এবং শুধু সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ — গণতান্ত্রিকতার এটাই মূল সুর। এই অর্থেও দিল্লীর কৃষক আন্দোলন অনন্য। বাম, অ-বাম, সমাজবাদী, গান্ধিবাদী, সংস্কারপন্থী — নানা বিচিত্রধারার ছোট বড় প্রায় পাঁচশ কৃষক সংগঠনের সর্বোচ্চ মঞ্চ হল সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। সর্বোচ্চ এই মঞ্চ থেকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগুলিই কেবল কর্মসূচি বলে ঘোষিত হয়। যেমন সংযুক্ত মোর্চার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল — (১) প্রত্যেক সাংসদের কাছে, সংসদের বাদল অধিবেশনের প্রারম্ভে ‘ভোটারদের হুইপ হিসেবে’ নির্দেশিকা পাঠানো হবে। নির্দেশিকা অনুসারে একজন সাংসদকে কৃষি আইন প্রত্যাহারের জন্য সংসদ কক্ষে প্রস্তাব আনতে হবে। অন্যথায় অধিবেশনের সব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে সাংসদকে দলীয় হুইপ অমান্য করতে হবে। (২) সংসদের অধিবেশন চলাকালীন, বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে প্রতিদিন দুশো কৃষক সংসদ ভবনের সামনে ধর্ণা দেবেন।

A signal of a new storm_Delhi-Border

 

সংসদের বাদল অধিবেশনের পূর্বাহ্নে ‘দিল্লী সীমান্তগুলিতে’ আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে নবতর উদ্দীপনা সঞ্চারের লক্ষ্যে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা (এআইকেএম) ১৫-১৯ জুলাই একের পর এক মিছিল ও জমায়েত সংগঠিত করে। ১৫ জুলাই শাজাহানপুর বর্ডারের (দিল্লী-জয়পুর সড়ক) সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এআইকেএম’এর সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং, সংগঠনের রাজস্থান রাজ্য সভাপতি ফুলচাঁ ঢেবা প্রমুখ নেতৃবর্গ। ১৬ জুলাই টিকরি বর্ডারে (দিল্লী-ভাতিন্দা জাতীয় সড়ক) জমায়েতে বক্তব্য রাখেন রাজারাম সিং, কার্তিক পাল, পুরুষোত্তম শর্মা (উত্তরাখণ্ড) ও এআইকেএম সর্ব ভারতীয় সভাপতি রুলদু সিং। ২৭ তারিখ সিঙ্ঘু বর্ডারে (দিল্লী-চন্ডীগড় জাতীয় সড়ক) অবস্থান মঞ্চে বক্তব্য রাখেন জনপ্রিয় কৃষক নেত্রী যশবীর কাউর। ১৯ জুলাই গাজিপুর বর্ডারে (গাজিয়াবাদ-লক্ষ্ণৌ জাতীয় সড়ক) বর্ণাঢ্য মিছিলে মুখ্যত উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা অংশ নেন। এখানে বলা দরকার, গাজিপুর বর্ডারেই গত ২৮ জানুয়ারী পুলিশী মদতে বিজেপি-আরএসএস গুন্ডারা কৃষকদের ওপর হামলা চালাতে এলে এবং যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসন কৃষক নেতাদের গ্রেফতারের তৎপরতা নিলে জীবন বিসর্জনের হুমকি দেন কৃষকনেতা রাকেশ টিকায়েত। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৯ তারিখ রাত থেকেই কাতারে কাতারে জাঠ সম্প্রদায়ের কৃষক ধর্ণাস্থলে এসে হাজির হয়ে বিজেপি-আরএসএস’কে উচিত শিক্ষা দেন। সত্যিকার অর্থে গাজিপুর বর্ডার হয়ে উঠেছে জাঠ ও শিখদের ঐক্যের প্রতীক। এখানে ধর্ণা মঞ্চে বক্তব্য রাখেন রাজারাম সিং। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রতিটি ধর্না মঞ্চের পাশে এআইকেএম’এর পাশাপাশি ছাত্রসংগঠন আইসা ও শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ’রও শিবির রয়েছে। এই ছাত্র ও শ্রমিক কমরেডরা পালা করে গত ২৬ নভেম্বর থেকেই লাগাতার ধর্ণাস্থলে উপস্থিত থাকছেন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে এআইকেএম কার্যত টিকরি বর্ডারকে সঞ্চালন করছে। সিঙ্ঘু বর্ডারে এআইকেএম’এর দুটি শিবির রয়েছে। একটি শিবির পাঞ্জাবের গুরদাসপুর জেলার কৃষকরা ভরিয়ে রেখেছেন। শিবিরটি পরিচালনায় রয়েছেন প্রবীণ কৃষকনেতা বলবীর সিং রনধাওয়া। অপর শিবিরটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন ফতেগড় সাহিব অঞ্চলের কৃষকরা।

দিল্লী বর্ডারে কৃষকদের ধর্ণা আরো দীর্ঘতর হতে পারে। নানা কারণে এই ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রাম দেশের সর্বত্র সমানভাবে আলোড়িত হয়নি। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে শুধু কৃষকদের স্বার্থই নয়, কৃষিমজুর, অসংগঠিত শ্রমিক, স্বল্পবিত্ত মানুষ — সকলেরই স্বার্থ জড়িত। সে কারণে এই আন্দোলনের বার্তাকে দেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে দেওয়া এবং এক এক রাজ্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও নির্দিষ্ট আরো কিছু দাবি যুক্ত করে কৃষক আন্দোলনকে দেশব্যাপী বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে এআইকেএম’এর জাতীয় কার্যকরী কমিটির সভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভা অনুষ্ঠিত হয় সিঙ্ঘু বর্ডারের নারেলায় ১৭-১৮ জুলাই। স্থির হয়, (১) আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত অবস্থান চালিয়ে যেতে হতে পারে এই বাস্তবতার মুখে সংগঠনের প্রতিটি রাজ্য ইউনিটকে পর্যায়ক্রমে বছরে কয়েকবার ভাল সংখ্যক কৃষক-কর্মীদের অন্তত চারদিন করে ধর্ণাস্থলে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। (২) আগামী ৯ আগস্ট ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ দিবসে দেশের সর্বত্র জেলা সদর ও ব্লকগুলিতে ‘মোদী, হয় তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার কর নয় তো গদী ছাড়ো’ দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশে কৃষি ও গ্রামীণ মজুরদেরও সামিল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। (৩) ২৮ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিংএর জন্মদিবসে ‘কালো ইংরেজ তখত থেকে দূর হটো’ আওয়াজ সামনে রেখে রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ব্যাপক জনগণকে সামিল করে গণসমাবেশ সংগঠিত করা হবে।

- দিল্লীর ধর্ণাস্থল থেকে এআইকেএম নেতা মুকুল কুমার

খণ্ড-28
সংখ্যা-27