অশীতিপর প্রতিবাদী মানবাধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু একটি ঠাণ্ডা মাথায় খুন-সুপরিকল্পিত হেফাজত-হত্যা। পার্কিনসন-রোগাক্রান্ত অশক্ত এক বৃদ্ধের কাছে, বিশেষ করে এই কোভিড-১৯ অতিমারী পরিস্থিতিতে, কারাযন্ত্রণাকে যে ‘মৃত্যুদণ্ড’ করে তোলা হয়েছিল — এটা সকলের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই রকম একটি মানুষকে গ্রেফতার করে ও বিনা বিচারের বন্দী হিসাবে কারারুদ্ধ করে, জাতীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থা আসলে জেনে বুঝে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে তাকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিল। বিভিন্ন আদালতে ফাদার স্ট্যান বার বার জানিয়েছেন তার জীবন বিপন্ন এবং জেলে বেশি দিন বাঁচতে পারবেন না, মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিবারই তারা যেভাবে তার আবেদনের প্রতি নির্মম ঔদাসীন্য দেখিয়েছে তা মানুষকে হতবাক করেছে; শুধু তাই নয়, এনআইএ-র প্রাণঘাতী চক্রান্ত থেকে বৃদ্ধকে রক্ষা করার তাদের দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়েছে। তরল খাবার গ্রহণের জন্য একটা স্ট্র পর্যন্ত যাকে দেওয়া হয়নি, অবলম্বন ছাড়া হাঁটতে অক্ষম কোভিড-১৯ সংক্রমিত সেই মানুষটির জামিনের আবেদন আদালতে বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই আচরণ কারা-নির্যাতনের সামিল যা ফাদারের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আর সময়ের কী বিচিত্র পরিহাস, তিনি ঠিক সেই মুহূর্তেই চলে গেলেন যখন তাঁর আরেকটি জামিন-শুনানির প্রহসন শুরু হতে যাচ্ছিল!
এনআইএ খুব ভালো করেই জানে-ভীমা কোরেগাঁও মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে, একজন অভিযুক্তকেও আদালত অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারবে না। তাই তাদের কৌশল হল বিচার প্রক্রিয়াকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত করা। আর মানবাধিকার কর্মীদের বাকি জীবনটা জেলে আটক রেখে নির্যাতন চালানোর জন্য তারা দানবীয় আইন ইউএপিএ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যাকে কাজে লাগিয়েছে। এই জেলে পচানোর প্রক্রিয়ায়, বৃদ্ধ হোন বা না হোন, বন্দী মানবাধিকার কর্মীদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ করে দিয়েছে অতিমারি পরিস্থিতি। এনআইএ অতিমারীর এই ভয়ঙ্কর বিপন্নতায় পাওয়া এই ‘বাড়তি’ সুযোগকে পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে! এদিকে সরকার বলছে, “আইন তার নিজের পথে চলুক” — সরকার খুব ভালোভাবেই জানে, আইনের ‘সেই’ পথ অসংবেদনশীল দুর্বলচিত্ত আদালতের ‘সৌজন্যে’ তাদের মেরে ফেলতে পারবে যারা তার অপরাধগুলো জনসমক্ষে ফাঁস করে দিয়েছেন।
দিল্লী হাইকোর্ট সম্প্রতি তিন ছাত্র আন্দোলনকারীকে জামিন মঞ্জুর করার সময়ে সঠিকভাবেই বলেছে — একটি সরকার, যে প্রতিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদকে এক করে দেখছে, তার জন্য গণতন্ত্র আজ অত্যন্ত বিপন্ন। ফাদার স্ট্যান-এর হেফাজত-হত্যা সর্বত্র সমস্ত ভারতীয়ের জন্য এক সতর্ক বার্তা। এনআইএ এবং আদালত — কেউই মানবাধিকার কর্মী এবং প্রতিবাদী কণ্ঠকে শেষ করে দিতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না ভীমা কোরেগাঁও মামলার, দিল্লী দাঙ্গা মামলার সমস্ত অভিযুক্ত; আদিবাসী দলিত মুসলিম; সাংবাদিক, বামপন্থী কর্মী যারা দানবীয় আইনে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাযন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন; এবং অন্যান্য সমস্ত রাজনৈতিক বন্দি মুক্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ আমরা ক্ষান্ত হব না। আমরা ফাদার স্ট্যান-এর জন্য ন্যায় বিচার চাই। আর যে সরকার তাঁর হত্যার জন্য দায়ী, জনগণের আদালতে তার শাস্তি পাওয়া সুনিশ্চিত করতে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। ফাদার স্ট্যান স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশে সেটিই হবে আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৬ জুলাই ২০২১