ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা যে মোদী সরকারের আমলে উত্তরোত্তর খারাপ হচ্ছে তা অনুভব করার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার কোনো দরকার নেই। আমজনতা তা রোজ বুঝতে পারেছে। তবে রামধাক্কার চোটে তা আমাদের মস্তিষ্কের কোষে যথাবিহিত আঘাত করছে কিনা সেটাই বিবেচ্য। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের চরম ঋণাত্মক বৃদ্ধিকে বাদ দিলে বা তার পরের দুটি ত্রৈমাসিকের ঋণাত্মক ও প্রায় শূন্য বৃদ্ধিকে ধর্তব্যে না এনেও জিডিপি বৃদ্ধির হার ২০২০-২১’র শেষ ত্রৈমাসিকে ১.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৮-১৯’র শেষ ত্রৈমাসিকে ৭.১ শতাংশ ছিল। ২০২০-২১’র মাথাপিছু আয় ৯৯,৬৯৪ টাকায় নেমে এসেছে যা ২০১৭-১৮ সালে ১,০০,২৬৮ টাকা ছিল। আদতে ভারতের মাথাপিছু আয় এখন ২০১৬-১৭ সালের স্তরে পৌঁছেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী জনসাধারণের সঞ্চয়ও কমছে। ফলে অর্থনীতিতে সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তা। যেকোনো বৃদ্ধিকেই প্রবল ঢাকঢোল বাজিয়ে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো বলে প্রমাণ করতে সরকার বদ্ধ পরিকর। সম্প্রতি প্রকাশিত মে, ২০২১’র পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রচেষ্টা দেখা গেল। গত ২০২০ সালের মে মাসের তুলনায় এবছরের মে মাসে ১৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। সরকার তা নিয়ে উল্লসিত। কিন্তু সরকার বলছে না যে গত বছরের মে মাসে ওই ক্ষেত্রের হ্রাস ঘটেছিল ২১.৪ শতাংশ। ফলে ২০১৯ সালের মে মাসের তুলনায় ২০২১ সালের মে মাসের পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন কমেছে ৮.২ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৯ সালের মে মাসে যদি ওই পরিকাঠামোক্ষেত্রের উৎপাদন হত ১০০ টাকা, তাহলে ২০২১ সালের মে মাসে উৎপাদন হয়েছে ৯১ টাকা ৮০ পয়সা। ২ বছর বাদে পরিকাঠামো শিল্পগুলিতে উৎপাদনের এই বিপুল হ্রাসকে উন্নতি বলেনা। বলে চরম অবনতি। একে উন্নতি বলে দেখানোর প্রচেষ্টাই আসলে মোদী সরকারের মিথ্যাচারের দর্শন।
সাম্প্রতিক অন্যান্য সমীক্ষাও দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করছে। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে দেশের দ্রব্য প্রস্তুতকারী ক্ষেত্রের (ম্যানুফ্যকচারিং ক্ষেত্র) কাজকর্ম বাড়ছিল। অর্থাৎ, গত বছরে ২৪ মার্চ থেকে শুরু করা মানুষমারা লকডাউনের পরে ম্যানুফ্যকচারিং ক্ষেত্র ধীরে হলেও উৎপাদন বাড়াচ্ছিল। কিন্তু সেই গতি দেশের ওই ক্ষেত্রটি হারাতে শুরু করেছে। ম্যানুফ্যকচারিং ক্ষেত্রের বৃদ্ধি বা হ্রাসের সূচক মাপা হয় মরশুমের জন্য আইএইচএস মার্কিট ইন্ডিয়া ম্যানুফ্যকচারিং পারচেজিং ম্যানেজারস ইন্ডেকস (পিএমআই) দ্বারা। ওই সূচকের (পিএমআই) মান ৫০ পেরোলে বৃদ্ধি বোঝায়, ৫০’এর কম হলে হ্রাস। গত মে মাসে তার মান ছিল ৫০.৮। জুন মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮.১। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে শুরু করে ১০ মাসের যে বৃদ্ধি তা জুন মাসে হ্রাসে পরিণত হয়েছে। ওই সমীক্ষা অনুসারে কারখানার অর্ডারে, উৎপাদনে, রফতানিতে, ক্রয়ের পরিমাণে সঙ্কোচন পুনরায় দেখা যাচ্ছে। তাছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে নৈরাশ্যব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে কর্ম সঙ্কোচন ক্রমাগত চলছে। কোভিড-১৯ জনিত নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদাকেও কমিয়ে দিয়েছে, ফলে ১০ মাসে এই প্রথম রফতানির অর্ডারে হ্রাস পরিলক্ষিত হয়েছে। অপরদিকে সমস্ত কাঁচা মালের দাম বেড়েছে, বেড়েছে পরিবহণ খরচ, যার ফলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। সমীক্ষা অনুসারে সবথেকে উৎপাদন কমেছে মূলধনী দ্রব্যের ক্ষেত্রে, কাজও কমেছে ওই ক্ষেত্রটিতে।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর জন্য মোদী সরকারের কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যদিও গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের উপরেই সর্বাধিক ধাক্কা লেগেছে তবুও তাদের হাতে নগদ দিয়ে ক্রয়ক্ষমতা বাড়নোর বদলে যোগানের দিকের অর্থনীতিতেই মোদী সরকারের জোর দেওয়া চলছে।
চলতি আর্থিক বছরে কেন্দ্র সরকার সাকুল্যে ৫০ হাজার কোটি টাকা অতিমারির জন্য অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করছে, যার মধ্যে রয়েছে সারে বর্ধিত ভরতুকি ও নভেম্বর মাস পর্যন্ত দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যশস্য প্রদান। অর্থনীতিকে চাঙা করতে গেলে সরাসরি সাহায্য দরকার একথা সরকার মানতেই চাইছে না। কেবল যোগানের দিক থেকেই সমস্যা সমাধান করতে চাইছে। গত বছরেও সকল অর্থনীতিবিদরা চাহিদা বাড়ানোর জন্য দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের হাতে সরাসরি নগদ পৌঁছানোর কথা বলেছিল। কিন্তু সরকার যে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ তৈরি করেছিল তাতে ওই ঋণ-নিশ্চয়তা এবং সংস্থাগুলিকে নগদ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধে প্রদানের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বন্দোবস্তের কথা ছিল। কিন্তু তারফলে অর্থনীতি চাঙা হয়নি। ২০২০-২১এ মোট মূলধন গঠন ও ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয় উভয়ই বিপুল পরিমাণে কমেছে। দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময়েও সরকার একই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। ফলও একই রকম হবে।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ৬.২৮ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনৈতিক উজ্জীবনের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন যার মাধ্যমে অর্থনীতির ধুঁকতে থাকা ক্ষেত্রগুলি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিলে সরকার গ্যারান্টর হিসেবে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে অতিমারীর জন্য সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ভ্রমণশিল্পের মালিকরা জানিয়েছে যে এমনিতেই তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, ওদিকে বেড়াতে আসার কোনো নিশ্চয়তা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঋণ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। ভ্রমণ ব্যবস্থাপক, হোটেল ও রেস্তোরা মালিকরা ওই ঋণের গ্যারান্টিতে কোনো সুরাহা খুঁজে পাচ্ছে না কেননা, ঋণ শোধ দেওয়ার জন্য দরকার আয়। ওই প্যাকেজেই ৫ লক্ষ বিদেশী পর্যটক ভিসায় ফি ছাড় দেওয়া হলেও তাতে যতদিন ভ্যাকসিনেশন না হবে ততদিন বিদেশীরা বেড়াতে আসবে বলে মনে করছেনা পর্যটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি। ওদিকে সামগ্রিক টিকাকরণের ভগ্নাংশ পরিমাণ সম্পূর্ণ হওয়ায় পর্যটক আগমনের ক্ষেত্রে কোনো আশার বাণী নেই। পর্যটন, রেস্তোরা, হোটেল ও পরিবহণ যেহেতু শ্রমনিবিড় ক্ষেত্র, তাই এখানে বিপুল পরমাণ মানুষ নিয়োজিত থাকে। দ্রুত গণ-টিকাকরণের দ্বারাই এই ক্ষেত্রকে চাঙা করা যেতে পারে। তা না হলে ঋণের গ্যারান্টি গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া হবে। সিএমআইই তথ্য অনুসারে অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ’এ ৯৭ শতাংশ শ্রমিকের উপার্জনে ক্ষতি হয়েছে, যুবকদের মধ্যে বেকারির হার এপ্রিল-মে মাসে ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ঋণ-নিশ্চয়তা প্রকল্প এক্ষেত্রে কোনো উদ্দীপক প্রভাব ফেলতে পারবে না।
ফারজানা আফ্রিদি, অমৃতা ধীলন ও সঞ্চারি রায় একটি সমীক্ষা করেছেন দিল্লীতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের উপরে। প্রায় ৩,০০০ মানুষের উপরে গত ২০২০ সালে লকডাউনের সময়ে দুটি পর্যায়ে, একটি প্রথম পর্যায়ে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত যখন কঠিনতম লকডাউন চলছিল তখন ও দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন লকডাউন কিছুটা শিথিল হয়েছিল ২০ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত সমীক্ষাটি করেছিলেন। এরপরে লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে আগস্ট থেকে অক্টোবর, ২০২০ পর্যন্ত, এবং সম্প্রতি এপ্রিল ২০২১ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত, যখন স্থানীয় স্তরে লকডাউন চলেছে, তখন পুনরায় ওই মানুষদেরই মধ্যে সমীক্ষাটি করা হয়।
পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে অতিমারীর প্রথম পর্যায়ে কাজে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ৯১ শতাংশ থেকে কমে ৬৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। তা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৭ শতাংশে পৌঁছেছিল, কিন্তু গোড়াতে থাকা ৯১ শতাংশে ফেরত যায়নি। ফলে বলা যায় যে কোভিড স্থায়ীভাবেই প্রায় ১৪ শতাংশ পুরুষের কাজ কেড়ে নিয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে নুতন করে কাজ হারিয়েছে পুরুষেরা। কাজে নিযুক্ত মানুষের পরিমাণ ৬০ শতাংশে নেমে এসেছিল। ফলে কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে নিযুক্ত ৯১ শতাংশ পুরুষের এক-তৃতীয়াংশের বেশি কোভিডের দ্বিতীয় পর্যায়ে কর্মহীন অবস্থায় রয়েছে। কোভিডের প্রথম পর্যায়ের পরে বেতনভোগী চাকুরিজীবীরা স্বনিযুক্ত বা অনিয়মিত শ্রমজীবীদের তুলনায় অধিক অনুপাতে কাজ ফিরে পেয়েছিল। ৮১ শতাংশ বেতনভোগী, ৭৮ শতাংশ স্বনিযুক্ত ও ৭৫ শতাংশ অনিয়মিত শ্রমজীবী মানুষ কাজ ফিরে পেয়েছিল। কোভিডের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৪ শতাংশ অনিয়মিত ক্যাজুয়াল কর্মী, ১৮ শতাংশ স্বনিযুক্ত ও ১৪ শতাংশ বেতনভোগী কর্মচারী কাজ খুঁইয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে যত গরিব বা যার জীবন যত অনিশ্চিত তিনি তত বেশি কষ্টে নিমজ্জিত হচ্ছেন।
আয় এবং চাহিদার উপরে গত কয়েক বছরের ধাক্কার প্রভাব যথেষ্টই। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, ২৩ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নীচে নেমেছে। পাশাপাশি পিউ রিসার্চের সমীক্ষাও বলছে যে বিশ্বে যত মানুষ মধ্য আয় থেকে নিম্ন আয়ের স্তরে নেমেছে তার ৫৭ শতাংশ ভারতের জনতা। অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় ঢেউ-এর প্যাকেজেও সেই মানুষগুলির জন্য কোনো সুরাহা নেই। ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মোদী-খোয়াব এখন ভারতের জনগণের দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। মোদীর এক দশকের শাসনকাল দেশের বুকে অন্যতম নিকৃষ্ট অর্থনৈতিক দশক হতে চলেছে, যেখানে অর্থনৈতিক বন্ধ্যা, বেকারি, মুদ্রাস্ফীতি, সঞ্চয়, আয়, বিনিয়োগ সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যর্থতাই দেখা যাবে।
- অমিত দাশগুপ্ত