নয়া শ্রমকোড ও আমলা নির্ভর সরকারি ব‍্যবস্থায় বঞ্চিত অসংগঠিত শ্রমিকদের অধিকার
The rights of unorganized workers deprived

আমাদের দেশে আমলাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার শ্রেণীচরিত্রের কারণে অসংগঠিত শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা যেন একটা স্বাভাবিকতা লাভ করেছে। ফ‍্যাসিষ্ট বিজেপি সরকার কল‍্যাণকর চিহ্নগুলোকে ক্রমশ মুছে দিয়ে সমস্ত কিছুকেই বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে। অর্থাৎ ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের হাতে বেশি কড়ি দেওয়া চলবেনা। শ্রম আইনে যতটুকু অধিকার শ্রমিকদের ছিল তা কেড়ে নিয়ে ৪টি লেবার কোড তৈরি করে পুঁজির দ্বারা নির্মমভাবে শ্রম শোষনের বাজারে শ্রমিকদের নিক্ষেপ করে দিচ্ছে। তারফলে সম্পদ বন্টনের বৈষম‍্য বেড়েই চলেছে‌। ১ শতাংশের হাতে ৭৬ শতাংশ সম্পদ চলে গেছে। উল্টোদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ‍্যা বেড়ে চলেছে।

দেশের সমগ্র শ্রমজীবীদের ৯৪ শতাংশ অসংগঠিত। তাদের মধ‍্যে বড় অংশই নির্মাণ শ্রমিক। এদের মধ‍্যে স্বনিয়োজিত ও বড় নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত নির্মাণ শ্রমিকের সংখ‍্যা আনুমানিক ৭/৮ কোটি। এদের একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে যারা কর্মরত তাদের সুরক্ষার জন‍্য আইন থাকা সত্ত্বেও সরকার ও আমলাদের আমানবিক চরিত্রের জন‍্যই পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে এবং অনেকের নাম পৃথিবীর খাতা থেকে চিরদিনের জন‍্য হারিয়ে যায়।

নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষার জন‍্য ১৯৯৬ সালে গৃহ ও অন্যান্য শ্রমিক কর্মচারি নিয়োগ ও কাজের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ আইন (ধারা ২৭, ১৯৯৬) এবং পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য শ্রমিক কর্মচারি নিয়োগ ও কাজের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ রুলস্ ২০০৪ তৈরি হয়। এই আইনবলে নির্মাণ সংস্থাগুলি ১-২ শতাংশ সেস দেবে রাজ‍্য নির্মাণ কল‍্যাণ পর্ষদে এবং সেই অর্থ দিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের কল‍্যাণ করা হবে।

সমস্ত রাজ‍্য মিলিয়ে কল‍্যাণ পর্ষদে এযাবৎ কাল মোট জমাকৃত তহবিলের পরিমাণ ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর তা থেকে খরচ করা হয়েছে মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ শ্রমিকদের সরকারিভাবে নাম নথিভুক্ত হয়েছে আনুমানিক চার ভাগের একভাগ। আধুনিকীকরণের নামে প্রায় চার বছর ধরে কল‍্যাণ পর্ষদের কাজ অনিয়মিত এবং করোনার অজুহাতে বন্ধ হয়ে গেছে। মুনাফার জন‍্য ওয়ার্ক ফর্ম হোম চলবে, কিন্ত শ্রমজীবি মানুষের কাজ করা যাবেনা। নয়া লেবার কোডে নির্মাণ শ্রমিকদের আইন ও কল‍্যাণ পর্ষদ তুলেই দিতে চাইছে। এক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার চুপিসারে খর্ব করে দেওয়ায় এবং আমলা নির্ভর হয়ে পড়ায় শ্রমিকদের বঞ্চনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

new labor code and bureaucratic government system

 

নির্মাণ শ্রমিক ছাড়াও সুবিশাল অন‍্যান‍্য অসংগঠিত শ্রমিক আছেন। তাদের জন্য ২০১০ সালে তৈরি হয়েছিল ১,০০০ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় তহবিল। প্রতি বছর ৫০০/৬০০ কোটি টাকা করে ঐ তহবিলে দেওয়া হত। ২০১৬-১৭ সালে কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা (সিএজি) দেখতে পায় যে অব‍্যবহৃত মোট ১,৯২৭ কোটি টাকা রাজকোষে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার খাতে বরাদ্দ বাজেট থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালে রাজ‍্য সরকার নির্মাণ সহ অন‍্যান‍্য অসংগঠিত শ্রমিকদের জন‍্য অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে এসএসওয়াই ২০১৭ (সামাজিক সুরক্ষা যোজনা) চালু করলো। তা জন্মসূত্রেই রক্তশূন‍্য, আজ গতিরুদ্ধ।

কোভিড, আমফান, ইয়াস, লকডাউন নানা আঘাতে অসংগঠিত শ্রমিকরা আজ অসহায়। চিল-চিৎকার করেও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তৃতীয় লকডাউনের চোখরাঙানি শুরু হল বলে। ফলে অসংগঠিত শ্রমিকদের কর্মহীনতা দীর্ঘসূত্রিতায় পরিণত হবে।

  • এই সুবিশাল অসংগঠিত শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তিকরণ, পেনশন সহ অন‍্যান‍্য সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলোর পুনর্বিন্যাস ও প্রাপ‍্যগুলো দ্রুত দেওয়ার জন‍্য বিশেষ ব‍্যবস্থা সরকারকে অবিলম্বে করতে হবে।
  • নির্মাণ শিল্প থেকে সেস আদায়ের পরিমাণ ২% করে অন‍্যান‍্য অসংগঠিত শ্রমিকদের জন‍্য বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে।
  • নির্মাণ সহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন‍্য তহবিলে বাজেটের ৩% শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
  • ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার সুরক্ষিত করার সাথে সাথে পঞ্চায়েত ও পৌরসভাকে বিশেষ উদ‍্যোগী করে তুলতে হবে।
  • কল‍্যাণ পর্ষদগুলির বৈঠক নিয়মিত করতে হবে এবং তাতে শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।
  • বড় বড় নির্মাণ শিল্পে সরকারি স্তরে শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তিকরণ বাধ‍্যতামূলক করতে হবে।
  • সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সমস্ত দাবিগুলো রাজনৈতিক স্তরে জোরালোভাবে উত্থাপন করা দরকার।

আশু দাবিগুলি হল

(১) নির্মাণ সহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের ১০ কেজি রেশন ও মাসিক ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে।
(২) অবিলম্বে ব্লক স্তরে নতুন নাম নথিভুক্তিকরণ ও আবেদন পত্র জমা নিয়ে তা দ্রুত প্রাপ‍্য অধিকারগুলো দিতে হবে।

- কিশোর সরকার 

খণ্ড-28
সংখ্যা-23