আজকের ভারতে ৩০ জুন দিনটা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জল, জঙ্গল আর জমির ওপর থেকে ভূমিপুত্রদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে আগ্রাসী ধনবাদ। অথচ ইতিহাস বলছে এই ভূমিপুত্ররাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে নিজেদের হাতে সড়কি বল্লম তীরধনুক তুলে নিয়েছিল। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন শুরু হওয়া এই বিদ্রোহ ১৮৫৭’র সিপাহী বিদ্রোহে মিশে যায়। তবে ইতিহাসবিদদের মতে বাংলার মাটিতে শুরু হওয়া এই হুল বিদ্রোহকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিদ্রোহ বলে গণ্য করা হয়।
কোভিড অতিমারি বিশ্বজুড়ে যে তান্ডব চালাচ্ছে তাতে সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে উঠছে এই আগ্রাসী ধনবাদ। সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমরা আরও একবার স্মরণ করি সেই হুল বিদ্রোহীদের। সিধু কানহুর ডাকে এই জুন মাসেই ভাগনাডিহির মাঠে দলে দলে সমবেত হয়েছিলেন অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষেরা। আজ মানুষের বড় দুঃসময়। এই সময়েই তাই আরও একবার হুল বিদ্রোহের সেইসব বিদ্রোহী মানুষের লড়াইকে স্মরণ করা উচিত।
মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ-নিপীড়ন এবং ব্রিটিশ পুলিশ-দারোগাদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত ভূমিপুত্ররা মুক্তির লক্ষ্যে ১৮৫৫ সালে এক আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। সিধু মুর্মু ও কানহু মুর্মু এবং দুই ভাই চান্দ ও ভাইরো এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভাগনাডিহতে। ভূমিপুত্ররা মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের নিপীড়নে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল সে সময়। মহাজনের ঋণের ফাঁদে পড়তে হতো বংশপরম্পরায়। স্ত্রী-পুত্ররা মহাজনের সম্পত্তি হয়ে যেত। পুলিশের সহায়তায় তাদের গবাদিপশু ও জমি কেড়ে নেওয়া হতো। প্রতিবাদ করলে চলতো পাল্টা মার। এমনকি সে সময় ব্রিটিশ সরকারের উল্টো খড়্গ নেমে আসত তাদের ওপর। তবে ভূমিপুত্রদের এই পুঞ্জীভূত ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের সীমারেখা ছাড়িয়েছিল আরও ৭৫ বছর আগেই। ১৭৮০ সালে সাঁওতাল জননেতা তিলকা মুর্মু যাকে আবার তিলকা মাঞ্জহী বলেই বেশির ভাগ মানুষ চেনেন, তাঁর নেতৃত্বেই শোষকদের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রদের গণসংগ্রামের সূচনা হয়। তিনি সর্বপ্রথম ভূমিপুত্রদের মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ১৭৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর তীরের আঘাতেই ভাগলপুরের ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮১১ সালে বিভিন্ন নেতার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার গণআন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৮২০ সালে তৃতীয়বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থবার ভূমিপুত্রদের গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
অবশেষে শোষণহীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন, ৩০ হাজারেরও অধিক সাঁওতাল জনতাকে নিয়ে সমাবেশ এবং কলকাতা অভিমুখে প্রথম গণযাত্রা করেন বীর সিধু-কানহু’রা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য মিছিল বা গণযাত্রার সূচনা হিসেবে এটাকেই প্রথম মিছিল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়; যার ধারাবাহিকতায় আজও উপমহাদেশে যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে মিছিল-লংমার্চ হয়। পদযাত্রার সময় অত্যাচারী মহাজন কেনারাম ভগত ও জঙ্গিপুরের দারোগা মহেশাল দত্ত ছ’সাতজন সাঁওতাল নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করেন। সিধু ও কানহু’কে গ্রেপ্তার করতে উদ্যত হলে বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল বিপ্লবীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহাজন কেনারাম ভগত, মহেশাল দত্তসহ তাঁদের দলের ১৯ জনকে হত্যা করে এবং সেখানেই বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়। এরপর টানা আট মাস ধরে চলে বিদ্রোহ। ২১ জুলাই কাতনা গ্রামে ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। জুলাই মাসেই বীরভূমের বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র নাগপুর বাজার ধ্বংস করে বিপ্লবীরা, যেখানে জনগণকে ন্যায্যমূল্যে মালামাল দেওয়ার পরিবর্তে অত্যাচার করা হতো। ৩০ জুলাই লেফটেন্যান্ট রুবি কর্তৃক মুনহান ও মুনকাতারা গ্রাম ধ্বংস করা হলে পরে ১৭ আগস্ট ইংরেজ সরকার কর্তৃক আত্মসমর্পণের ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয় এবং ভূমিপুত্ররা তা প্রত্যাখ্যান করেন। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিধু-কানহু’র বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার ‘অস্বা সামরিক আইন’ (অস্ত্রশস্ত্র বহনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা) জারি করে। ইংরেজ সরকার সামরিক আইন জারি করলেও বিদ্রোহের মুখে ১৮৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়। আট মাসব্যাপী বিদ্রোহের শেষ পর্যায়ে লেফটেন্যান্ট ফেগানের পরিচালিত ভাগলপুরে হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর হাতে ভূমিপুত্রদের পরাজয় ঘটে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব যে শুধুই সিধু-কানহু বা চান্দ-ভাইরোরা দিয়েছেন তা নয়, তাঁদের সঙ্গে ভূমিকন্যারাও যোগদান করেছিলেন। দুই বোন ফুলো মুর্মু ও ঝানো মুর্মু এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করেন। ব্রিটিশ সেপাইরা ফুলো মুর্মুকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ রেললাইনে ফেলে রেখে যায়। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে ভূমিজ মানুষেরা তাঁকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিধু নিহত হন এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে কানহু’কে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ভূমিজ মানুষেরা পরাজয় বরণ করলেও তারা শোষকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তারই ধারাবাহিকতায় তেভাগা আন্দোলন ও আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিজ মানুষদের অবদান অবিস্মরণীয়।
-- সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী