পশ্চিমবাংলায় নির্বাচন পরবর্তী হিংসা ও সন্ত্রাসের মামলা গড়িয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। দায়ের হয়েছে এক জনস্বার্থ মামলা রাজ্যের শাসকদল, সরকার ও তার পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা তৃণমূল তার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া লোকদের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে, পুলিশ-প্রশাসন সব দেখেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অভিযোগের বিহিত চেয়ে মামলা গড়ায় কলকাতা হাইকোর্টে। তাতে ইতিমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে জমা পড়া কয়েক হাজার অভিযোগের প্রতিলিপিও জুড়ে দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের তরফে এইসব ঘটনাপ্রবাহকে উপেক্ষার আচরণ করে আসা হচ্ছিল। কিন্তু হাইকোর্ট কারণ দর্শাতে বলায় রাজ্য সরকার কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। বরং হাইকোর্ট ইতিমধ্যে আরও যে নির্দেশ দিয়েছে তা পুনর্বিবেচনা ও প্রত্যাহারের জন্য রাজ্য সরকার ওকালতি করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের উপরোক্ত পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ ইতিমধ্যে এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে বলেছে তদন্ত কমিটি গঠন করতে। কমিশন ঐ কমিটি গঠন করেছে জাতীয় ও রাজ্য স্তরের প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে। কমিটির মাথায় রয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান, সঙ্গে রয়েছেন জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের ভাইস চেয়ারপার্সন, জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্য, কমিশনের একজন ডিজি ও ডিআইজি সহ রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের রেজিস্ট্রার ও রাজ্য লিগ্যাল সার্ভিসের একজন সদস্য। কমিটিতে জাতীয় স্তরের প্রতিনিধিত্বের ভার অনেক বেশি। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের সূত্রও বলছে আদালতে জোরদার হবে সংঘাত। এরপর তদন্ত কমিটি কতদিনে কিভাবে কাজ সারবে, কবে রিপোর্ট করবে, তাতে রাজ্য সরকার কেমন সহযোগিতা করবে, পাশাপাশি আদালতে কেন্দ্র-রাজ্যের মারপ্যাঁচ কেমন কতদিন চলবে, এ সবই অপেক্ষার বিষয়।
কিন্তু অপেক্ষা করে থাকতে পারে না তৃণমূলের নৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যালোচনা, যার কেন্দ্রে রয়েছে গণতন্ত্রের প্রশ্ন।
পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা নির্বাচন পর্বে তৃণমূলের কোনও বড় মাত্রার সন্ত্রাস ছিল না। অন্তত বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে চালানো সন্ত্রাসের তুলনায় রাজ্যের শাসকদল সন্ত্রাসী হয়নি। বরং বিপরীতে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি বিদ্বেষ, প্ররোচনা, হুমকি, এমনকি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে শীতলখুচির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। শাসকের ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে পরিবেশকে বিষিয়ে দেওয়ার আগ্রাসনে একতরফা আধিপত্য বিস্তার করেছিল বিজেপি ও কেন্দ্র। তাছাড়া গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে প্রাক বিধানসভা নির্বাচন পর্ব পর্যন্ত তৃণমূলের একদল নেতার পরপর বিজেপিতে দলবদল তার মাটিও অনেকটা ওদিকে করে দেয়। তৃণমূল বহিরঙ্গে যাইই বলুক, এই সবকিছুর প্রতিশোধের অপেক্ষায় জ্বলতে থাকে তুষের আগুনের মতো, আর নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর বদলার সন্ত্রাস শুরু করে দেয়। কে কাকে ভোট দেবে না দেবে, ঠিক বুঝে হোক বেঠিক বুঝে হোক, প্ররোচিত বা প্রভাবিত হয়ে হোক সেটা একজন সাধারণ নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। এবিষয়ে কোনও জোর খাটানো যায় না। শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রচারে গেছে, ভোট দিয়েছে বলে সন্ত্রাস চালাতে হবে; ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, ঘরছাড়া করে দেওয়া, ত্রাণ না দেওয়া, একশ দিনের কাজ না দেওয়া, হাতে মারা-ভাতে মারা চলতে পারে না। এসব গণতন্ত্রের ওপরই হামলা। কোনও ভোটাধিকারী নাগরিককে যদি ফ্যাসিবাদীদেরও প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হয় তবে গণতান্ত্রিক আবেদনের মাধ্যমে করাই গণতন্ত্রে স্বীকৃত। হামলা হলে প্রতিরোধের অধিকারও গণতন্ত্রে স্বীকৃত, কিন্তু কখনই ‘প্রতিরোধের’ নামে হামলা গণতন্ত্র সম্মত নয়। রাজ্যের শাসকদল গণতন্ত্রের এই রীতিনীতি কতটা মানছে বোঝা দুস্কর, কারণ হাইকোর্টের ঠ্যালায় সন্ত্রাস কিছুটা কমে এলেও এখনও চলছে।
বাংলার গণরায় তার ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে রুখে দিলেও বিজেপি তা মানতে চায়নি, আক্রোশবশত নবনির্বাচিত সরকারকে যে কোনও উপায়ে উল্টে দিতে উঠে-পড়ে লাগে। এটা হয়ত আগে থাকতেই দ্বিতীয় ছক ছিল। শপথ অনুষ্ঠান বয়কট, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তদন্ত টিম পাঠানো এবং রাজ্যপালকে উৎকটভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের ইস্যুটি সামনে আনতে থাকে। আইনের শাসন না থাকার কারণ তুলে বাতাসে ভাসাতে থাকে তবে কি ৩৫৬ ধারাই ভবিতব্য? বিজেপির এই দুরভিসন্ধি আরও ধরা পড়ে রাজ্য সরকারকে বিশেষ করে কোভিড মোকাবিলা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকার থেকে প্রবঞ্চিত করে চলার মধ্যে। সুতরাং বিজেপি যে রাজ্যে ‘গণতন্ত্র নেই’ রব তুলছে কেন্দ্রের সর্দারির পরিবেশ তৈরি করতে এটা স্পষ্ট।
কিন্তু তা বলে গণতন্ত্রের প্রশ্নে তৃণমূলকে ছাড় দেওয়া যায় না। এবারের বিধানসভা নির্বাচন ছিল ফ্যাসিবাদী বিজেপির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সেই মেরুকরণেই মিলেছে যেমন গণরায়, তেমনি তার লাভ গেছে মূলত তৃণমূলের ঘরে। তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয়বস্তু ছিল একদিকে বিজেপির দখলদারির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারের সপক্ষে সোচ্চার হওয়া, অন্যদিকে জনগণের বিভিন্ন অংশের জন্য রাজ্য সরকারের গৃহীত কিছু কল্যাণ প্রকল্প রূপায়ণে সার্থকতা তুলে ধরা। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার তথা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্রের বিষয়কে এক মূল হিসেবে তৃণমূল কখনই নিজে সামনে আনতে চায়নি বা অপরাপর কোনো দলকেও অবাধে তুলতে দেয়নি। কিছু বুলি আউরে চলার বাইরে সবসময় কার্যত অস্বীকার করে এসেছে। দল ও সরকার পরিচালনায় ক্ষমতার চূড়ান্ত মালিক একজন নেত্রীই – এটাও একটা বিশেষ কারণ তৃণমূলের অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়ার। বিধানসভা নির্বাচনে আর যে সমস্ত দল, সংগঠন, মঞ্চ, ফোরাম বিজেপির ফ্যাসিবাদকে রুখে দেওয়া মূল লক্ষ্য স্থির করেছিল তারা ঐ সময়ের জন্য তৃণমূলের সমান বিরোধিতা করতে চায়নি, তৃণমূল শাসনের গণতন্ত্র দমন বা হরণের ঘটনা ও প্রবণতাকে তুলে ধরে বিঁধতে চায়নি। কিন্তু গণতন্ত্রের বিষয়ে তৃণমূলের বরাবর গুরুতর স্খলন রয়েছেই। রাজ্যে বিরোধী সভা-সমাবেশ-মিছিল-ধর্ণা ইত্যাদি করতে গেলে অনুমোদনের প্রশ্নে পুলিশ-প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতাই প্রথম ও শেষ কথা। সংবিধান স্বীকৃত ধর্মঘট করলে শাস্তির পদক্ষেপ করা হয়। এরাজ্যে বিনা বিচারে বহু রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বন্দী রয়েছেন বছরের পর বছর। তাদেরকে এমনকি জরুরী চিকিৎসা পরিষেবা পর্যন্ত দেওয়া হয় না। মিথ্যা মামলা চাপানো হয় রাজ্যের শাসকের বিরোধিতাকে শায়েস্তা করতে। বহু মামলা ফেলে রাখা হয়েছে, যেমন নন্দীগ্রাম মামলা। না আগ্রহ আছে বিচারব্যবস্থার পরিকাঠামো সমৃদ্ধ করে তোলার বিষয়ে, না কর্মতৎপরতা থাকে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করার তাগিদে। এখানেও বন্দীদের অনেকের ওপর চাপানো রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন। অর্থাৎ তৃণমূল শাসন অগণতান্ত্রিক আচরণে যথেষ্ট কলঙ্কিত। এই পটভূমিতেই বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাসের বাস্তবতা সহজে বুঝে নেওয়া যায়। সময় থাকতে যদি এ বন্ধ না হয়, যদি এর প্রতিকার না মেলে, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে আবার আলোড়িত হবে পশ্চিমবাংলা। কারণ, প্রশ্নটি গণতন্ত্রের।