যে জমি কেনা হল ২ কোটি টাকায়, মাত্র পাঁচ মিনিট পরই তা বিক্রি হল সাড়ে আঠারো কোটি টাকায়! বলতে গেলে, চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই জমির দামে ৯০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি, পৃথিবীর কোথাও কি ঘটে? ঘটা সম্ভব? কিন্তু ঘটেছে, এ দেশেরই অযোধ্যায়। আর সন্দেহজনক, অবিশ্বাস্য এই লেনদেনে জড়িয়ে রয়েছে সংঘ পরিবার, জড়িয়ে গেছে তাদের সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি। রেজিস্ট্রি অফিসের নথি বলছে, এ বছরেরই ১৮ মার্চ সন্ধে ৭টা ১০ মিনিটে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদ তথা নির্মীয়মাণ রামমন্দিরের লাগোয়া বাগ বিজৈসী গ্ৰামের ১.২০৮ হেক্টর জমি ২ কোটি টাকা দিয়ে হরিশ পাঠক ও কুসুম পাঠকের কাছ থেকে কেনেন সুলতান আনসারি ও রবি মোহন তিওয়ারি। রেজিস্ট্রি অফিসের নথি আরও বলছে, সে দিনই সন্ধে ৭টা ১৫ মিনিটে ঐ জমি সুলতান আনসারি ও রবি মোহন তিওয়ারি বিক্রি করেছে ১.২৯ কোটি টাকার স্ট্যাম্প ডিউটি সহ ১৮ কোটি ২৯ লক্ষ টাকায়। আর, অত চড়া দামে ঐ জমি কিনল রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট। প্রসঙ্গত, রামমন্দির নির্মাণের জন্য ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট গঠন করে দেয় মোদী সরকার, যার সদস্যদের মধ্যে ১২ জনই সরকার মনোনীত। এই জমি কেলেঙ্কারি কাণ্ডে মূল পাণ্ডা হিসাবে সামনে এসেছে ট্রাস্টের সচিব চম্পৎ রায়ের নাম, যিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা। রেজিস্ট্রি অফিসের নথিতে দেখা গেছে দুটি দলিলেই (হরিশ পাঠক ও কুসুম পাঠকদের কাছ থেকে সুলতান আনসারি ও রবি মোহন তিওয়ারির কেনা জমির দলিলে এবং ট্রাস্টকে তাদের বিক্রি করা জমির দলিলে) সাক্ষী হিসাবে সই রয়েছে আরএসএস নেতা অনিল কুমার মিশ্র এবং অযোধ্যার মেয়র বিজেপি নেতা ঋষিকেশ উপাধ্যায়ের। অনিল মিশ্র এবং ঋষিকেশ উপাধ্যায় দুজনেই নরেন্দ্র মোদী ঘনিষ্ঠ বলে চর্চায় উঠে এসেছে। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের কেনা এটাই একমাত্র জমি নয় যাতে দুর্নীতির গন্ধ রয়েছে। এই ধরনের জমি ট্রাস্ট আরও কিনেছে, যার একটা হল ঋষিকেশ উপাধ্যায়ের ভাগ্নে দীপ নারায়ণ উপাধ্যায়ের ৪৭ লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা জমি ট্রাস্টকে ২.৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা (সংবাদ বেরিয়েছে, দীপ উপাধ্যায় যে জমি বিক্রি করেছে সেটা আসলে ‘নজুল’ জমি, যেটা সরকারের অধীনস্থ, সরকার ঐ জমি কাউকে লিজ দিতে পারে, কিন্তু ঐ জমি বিক্রির অধিকার কারুর নেই)।
উল্লেখ্য, রামমন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে সংঘ পরিবার কয়েক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা যাদের হেফাজতে আছে, নানান কৌশলে সেই টাকাকে বিভিন্ন গন্তব্যে পাচারের অধিকার তাদের করায়ত্ত হওয়াটাও একেবারে অভাবিত নয়। জমি কেনার দামকে চূড়ান্ত মাত্রায় বাড়িয়ে অর্থ তছরুপের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন চম্পত রায় এবং সংঘ পরিবারের অন্যান্য সংগঠনের নেতারা। যাঁদের হাত ধরে এই কেলেঙ্কারি উন্মোচিত হয় তাঁরা হলেন রাজ্যসভার আপ সাংসদ সঞ্জয় সিং এবং সমাজবাদী পার্টির নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক পবন পাণ্ডে। সঞ্জয় সিং-এর সরকারি ফ্ল্যাটে ১৫ জুন হামলা (অভিযোগ, বিজেপি দুষ্কৃতীদের), দুর্নীতি নিয়ে অযোধ্যার সাধুদের ক্ষোভ প্রকাশ ও আদালতে যাওয়ার হুমকি এবং সাধুদের ‘নরম’ করতে আরএসএস’এর আসরে নামা থেকে বোঝা যাচ্ছে, রামমন্দিরের জন্য সংগৃহীত অর্থের তছরুপের অভিযোগের ডালমে জরুর কুছ কালা হায়।
এবার নজর ঘোরানো যাক কেরলের দিকে। ঘটনা এবছরের এপ্রিলের গোড়ায় বিধানসভা নির্বাচনের সময় ও তাকে কেন্দ্র করে হলেও বিভিন্ন কারণে তা নিয়ে চর্চা এখনও জারি আছে। ঘটনার মূলে আসা যাক। প্রকাশ পেল কেরলের বিজেপি প্রধান কে সুরেন্দ্রনের সঙ্গে জেআরপি দলের কোষাধ্যক্ষ প্রসিথা আঝিকোডের কথোপকথনের অডিও ক্লিপ। সেই কথোপকথনে আঝিকোডে সুরেন্দ্রনকে জানাচ্ছেন, জেআরপি দলের উপজাতি নেত্রী কে কে জানু এনডিএ-তে ফেরার শর্ত হিসাবে ১০ কোটি টাকা দাবি করেছেন। সেই পরিমাণ অবশেষে ১০ লক্ষ টাকায় রফা হয় এবং জানু এনডিএ-তে যোগ দিয়ে সুলতান বাথেরি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
ঘুষ কেলেঙ্কারি এখানেই থামেনি। অভিযোগ, বিজেপি প্রধান সুরেন্দ্রন যে কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, সেই মাঞ্জেসরম কেন্দ্র থেকে বিএসপি প্রার্থী কে সুনডারাকে সরে দাঁড়ানোর জন্য তিনি ২.৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। পরে সুনডারা স্বীকার করেন, তাঁকে আড়াই লক্ষ টাকা, একটা মোবাইল ফোন ও একটা মদের দোকানের বিনিময়ে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করা হয়।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপির কেরল কেলেঙ্কারির এখানেই শেষ নয়। কেরলে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৬ জুন। তার তিনদিন আগে থ্রিশুর ও কোচির মাঝে কোডাকারায় জাতীয় সড়কে একটি গাড়িকে থামিয়ে তার থেকে টাকা লুট করা হল। ডাকাতি ৩ এপ্রিল হলেও ভোট শেষ হওয়ার পরদিন, অর্থাৎ ৭ এপ্রিল গাড়ির চালক শামজির সামসুদ্দিন থানায় গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা লুট হওয়ার অভিযোগ দায়ের করলেন। এবং জানালেন টাকাটা এ কে ধর্মরাজনের, যিনি ব্যবসায়ী এবং আরএসএস নেতা। কিন্তু গ্ৰেপ্তার হওয়া লোকেদের কাছ থেকে (ডাকাতির ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ২০ জনকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে) তথ্য পেয়ে এবং তদন্ত চালিয়ে পুলিশ দাবি করেছে, লুট হওয়া টাকার পরিমাণ ২৫ লক্ষ নয়, আরও অনেক বেশি। পুলিশ গ্ৰেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে লুট হওয়া ৩.৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ভোট কেনার লক্ষ্যে বেঙ্গালুরু থেকে হাওয়ালা পথে ঐ টাকা কেরলে আনা হয়েছিল।
জাতীয় সড়কে ডাকাতির ঘটনায় থ্রিশুরের বিজেপি কোষাধ্যক্ষ সহ বিজেপি কর্মীরা যুক্ত বলে অভিযোগ। ডাকাতি হওয়া টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে থ্রিশুরের ডাভানপল্লির এক টিকা কেন্দ্রে ৩১ মে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে তর্কাতর্কি শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষে পরিণত হয়, এবং এক বিজেপি কর্মীকে ছুরিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হতে হয়। পুলিশের অভিমত হল, ডাকাতি আসলে “নির্বাচনে অব্যবহৃত টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে” স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের “চালানো এক নাটক”।
সর্বশেষ পাওয়া সংবাদে জানা গেছে, আদালতের নির্দেশে কেরল বিজেপি প্রধান কে সুরেন্দ্রনের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর দায়ের হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ঘুষ দিয়ে এক বিএসপি প্রার্থীকে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারে বাধ্য করার জন্য, আর দ্বিতীয় এফআইআর দায়ের হয়েছে ১৭ জুন ওয়েনাড জেলার সুলতানি বাথেরি থানায় উপজাতি নেতাকে দেওয়া ঘুষ কাণ্ডে। এরই সাথে অভিযুক্ত হয়েছেন ঘুষ প্রাপক জেআরপি নেত্রী কে কে জানু। তবে, কেরল নির্বাচনে বিজেপির এত টাকার খেলা, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে অর্থের পেশিতে প্রভাবিত করার চেষ্টার পরও নির্বাচন কমিশন বিজেপির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে বলে জানা যায়নি।
অযোধ্যায় জমি কেনার যে সমস্ত ঘটনা নিয়ে রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের বিরুদ্ধে অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে তা ঘটেছিল এবছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ। সামনেই ছিল এপ্রিল মাস জুড়ে চলা চারটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচন। তছরুপের ঐ টাকা ঘুরপথে হাওলা মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে খাটানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় – একমাত্র যথার্থ তদন্তের মধ্যে দিয়েই তার উন্মোচন সম্ভব। সিবিআই ও ইডি-কে দিয়ে তদন্তের যে দাবি উঠেছে, তার যৌক্তিকতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। আর, রামমন্দিরের জন্য সংগৃহীত অর্থ যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিজেপির পক্ষে প্রভাবিত করতে কাজে লাগানো হয়েও থাকে, তাতে অস্বাভাবিকতার খুব কিছু থাকবে না। আদবাণীর নেতৃত্বে চালানো রামমন্দির প্রচারাভিযানের মধ্যে শুরু থেকেই রাম ভক্তির চেয়ে আরএসএস ভক্তিই ছিল অনেক বেশ – আরএসএস-এর হিন্দুরাষ্ট্রের এজেণ্ডাই সেই জনসমাবেশের প্রধান অভিমুখ হয়ে উঠেছিল। রামের নাম নিয়ে সংঘ পরিবার সংঘটিত অনাচারের অন্ত ছিল না। তবে, জমি কেনা কেলেঙ্কারিতে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ এবং কেরলের নির্বাচনে বিজেপির ব্যাপক মাত্রার আর্থিক দুর্নীতি আরও একবার দেখিয়ে দিল যে, সংঘ পরিবার ও তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি আপাদমস্তক ডুবে আছে দুর্নীতিতে। যে দাবি উঠেছে, তাকে মেনে নরেন্দ্র মোদী কি জমি কেনার দুর্নীতির এই অভিযোগে তদন্তের নির্দেশ দেবেন? মোদী সরকারের চালচলনের যে পরিচয় আমরা পেয়েছি, তাতে সে সম্ভাবনা সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়। তিনি তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিজেপি ও সংঘীয় সংস্থাগুলোর দুর্নীতিকে আড়াল করতে সমস্ত প্রশাসনিক শক্তিকেই কাজে লাগিয়েছেন। তবে, সংঘীয় দুর্নীতি প্রশাসনিক আশীর্বাদে পুষ্ট হলেও এবং তাদের দুর্নীতিতে আদালতের অব্যাহতির ছাপ পড়লেও তাতে যে সবসময় বাস্তব ও সত্যের যথার্থ প্রতিফলন থাকে না তা সুবিদিত। তাদের আর্থিক প্রতিপত্তি এবং সেই অর্থের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে জনগণ প্রায়শই অবহিত থাকেন। সংঘ পরিবার ও দুর্নীতি একাকার হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে মোদীর সেই দুর্নীতি-বিরোধী অঙ্গীকার এক নতুন রূপে সামনে আসছে। “না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা”র অন্তর্বস্তু সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে এখন যা দাঁড়িয়েছে তা হল, “জরুর খাউঙ্গা, বহুত খাউঙ্গা”।