২০১৮ সাল থেকে প্রতিরক্ষা দপ্তর ২৭৫টি নন কোর আইটেম বাজার থেকে কেনা শুরু করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিকর্মচারীরা ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে ৭২ ঘন্টা ধর্মঘট করেছেন। ২০১৯ সালে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা শিল্প শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এআইডিইএফ, আইএনডিডব্লিউএফ এবং বিপিএমএস ঐক্যবদ্ধভাবে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একমাসব্যাপী (২০ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ) ধর্মঘটের আহ্বান রেখেছিল। ধর্মঘটে ‘ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লয়ীজ ফেডারেশন (এনপিডিএফ)’ যা টিইউসিসি, এলপিএফ এবং এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ফেডারেশন। এই ফেডারেশন ধর্মঘটে মহত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে ফ্লোরে ইউনিয়নগুলোর ‘জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’ তে ইউনিয়ন সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে থাকে। অর্ডন্যান্স কারখানার শ্রমিকরা পাঁচ দিন ধর্মঘট করে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এই ধর্মঘটে শ্রমিকদের আর্থিক দাবি দাওয়া ছিল না, সরকারি সংস্থাকে বেসরকারিরণের বিরুদ্ধে নীতিগত লড়াই ছিল।
কেন্দ্রীয় সরকার ধর্মঘটের পাঁচদিনের মাথায় বাধ্য হয়ে দ্বিপাক্ষিক মিটিং-এ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই মুহূর্তে কর্পোরেশন করা হবে না। ইউনিয়ন ধর্মঘট স্থগিত করে এবং ২৬ আগস্ট শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। কিন্তু শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কা ছিল।
মোট ৪১টি অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার এবং পাঞ্জাবে ছড়িয়ে আছে। এই কারখানাগুলোতে তৈরি হয় – ছোট অস্ত্র, বিমানের অস্ত্রের তালিকা, বিমান বিরোধী যুদ্ধবিগ্রহ, নৌ-অস্ত্র, জাহাজ বিরোধী যুদ্ধাস্ত্র, ডুবোজাহাজ বিরোধী যুদ্ধাস্ত্র, ট্যাঙ্ক বিরোধী যুদ্ধাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র এস, ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার, রকেট, রকেট লঞ্চার, বোমা, গ্রেনেড, মর্টার, মাইন, ধাতু, মিশ্র, মেশিন টুলস, সামরিক যানবাহন, ইঞ্জিন, সাঁজোয়া যান, প্যারাসুট, অপটিক ইলেক্ট্রনিক্স, রাসায়নিক, পোশাক, আর্টিলারি, গোলাবারুদ, চালক যন্ত্ৰ, বিস্ফোরক দ্রব্য সামগ্রী ইত্যাদি।
কারওয়া, আমেঠিতে ভারত-রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘ইন্ডো-রাশিয়া রাইফেলস প্রাইভেট লিমিটেড’। এখানে এ কে-২০৩ রাইফেল তৈরি হয়। এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে কালাশনিকভ সংস্থা, রোসোবোরোনেক্স পোর্ট এবং ও এফ বি-কে।
অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির মোট আয় - $৩.৫ বিলিয়ন (₹২৩,৬৮৭.২২ কোটি) এবং কর্মীসংখ্যা - ৮২ হাজার। প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার হাতে ৬০ হাজার একর জমি আছে। সেনাবাহিনী নিজের প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ এই ৪১ টি কারখানা থেকে কেনে। আরও ৫০ শতাংশ অর্ডার দিলে তা যোগান দেওয়ার ক্ষমতা ও এফ বি-র আছে। কিন্তু সরকার দাম বেশি ও গুণমান কম – এই অজুহাতে বাইরে থেকে কিনছে। ২০১৬ সালে এ কে সাক্সেনা অতিরিক্ত কন্ট্রোলার জেনারেল প্রতিরক্ষা বাজেটে বলেছিলেন সামরিক বাহিনীর সব কিছুরই দাম অতিরিক্ত বেশি। পোশাক থেকে ট্যাঙ্ক। এই তথ্যগুলো প্রচার করে কর্পোরেটায়ন করার রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে।
বহুবছর ধরে কর্পোরেটায়ন করার পরিকল্পনা ভারত সরকারের আছে। এর আগে কর্পোরেটায়নের সুপারিশগুলি জর্জ ফার্নান্ডেজ, প্রণব মুখার্জী, একে অ্যান্টনি কেউই বিশেষ আমল দেননি। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং কর্পোরেশন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বেসরকারিকরণ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে যে কমিটিগুলো হয়েছে তারা বেশ কিছু পরামর্শ ও সুপারিশ করে চলেছে। ২০০০ সালে টি কে এ নায়ার কমিটির পরামর্শ – ও এফ বি-কে পরিবর্তন করে ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি কর্পোরেশন’ করা হোক। ২০০৪ সালে একই প্রস্তাব বিজয় কেলকর দেন। ২০১৫ সালে ভাইস এডমিরাল রামন পুরি কমিটির সুপারিশ ও এফ বি-কে তিন বা চারটি ভাগে ভাগ করা হোক। যেমন- অস্ত্র, গোলা-বারুদ এবং যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত গাড়ি।
শ্রমিকদের উদ্বেগ ও শঙ্কা বাস্তব হল। অতিমারী ও লক ডাউনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার 'অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড' ভেঙে দিল। ‘ও এফ বি’ ১৯ জুন ২০২১ তারিখে সার্কুলার দিয়ে জানিয়ে দিল অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলো ৭ টা ভাগে কর্পোরেশনে ভাগ হচ্ছে। (১) গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক। (২) ভেইকেলস। (৩) অস্ত্র ও সরঞ্জম। (৪) ট্রুপ কমফোর্ট আইটেম। (৫) সহায়ক শিল্প। (৬) অপটিক ইলেকট্রনিক। (৭) প্যারাসুট। মোট ৪১ টি কারখানাকে এইভাবে ৭ টি ইউনিটে ভাগ করা হল।
‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড’ ভেঙ দিয়ে প্রতিরক্ষা শিল্পে দ্রুত বিদেশি কোম্পানিগুলোর ঢোকার রাস্তা খুলে দিল এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি ও আন্দোলনে বড় আঘাত হানলো। এর বিরুদ্ধে ‘এআইডিইএফ’, ‘আইএনডিডাব্লিউএফ’, 'বিপিএমএস' তিনটি ফেডারেশন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছে। এনপিডিএফ ২৫ জুন সারা দেশে প্রতিরক্ষা শিল্পের ৪১টি কারখানায় কালো দিবস পালন করবে। এই দিনে রাতে মিটিং করে পরবর্তী কার্যক্রম ঘোষণা করবে। ফেডারেশন অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি দেবে, যাতে তারাও জাতীয় স্বার্থে কেন্দ্রকে কর্পোরেটাশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দেয়।
দানবীয় দিল্লির সরকার খুব দ্রুত নিজেদের এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করছে, শ্রমিকরা লড়ছেন, নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে এগিয়ে আসুন। ফ্যাসিবাদকে রুখতে কারখানা, বন্দর, ক্ষেত-খামারে আওয়াজ উঠুক।
--- নবেন্দু দাশগুপ্ত