খবরা-খবর
ইয়সে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াও -- অধিকার ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের বন্ধু বানাও
make friends with the rights and democracy movement

গত ১১ জুন আমাদের জেলার প্রান্তিক পাথরপ্রতিমা ব্লক, হেরম্বগোপালপুর অঞ্চলের কুয়েমুড়ি গ্রামে ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাথে একাত্ব হতে গিয়েছিলাম।

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কতটা ক্ষতি হয়েছে তা অনুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখতে কেন্দ্রের আমলা-মন্ত্রীরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পরিদর্শনে বেরিয়েছেন। তাদের পরিমাপ কবে শেষ হবে এবং কবে আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা পাবো, তা নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েন চলবে। জনগণের তদারকি বন্ধ করে, দুর্নীতি বন্ধ করতে আমলা নির্ভর ব্যবস্থা ক্ষতিপূরণে কতগুলো পরিবারেরর হিসাব যথার্থ এবং দ্রুত করতে পারবে জানা নেই।

বাংলা বাঁচাতে বাংলার মানুষ প্রথমেই বিজেপি’র মতো ভয়ঙ্কর ভাইরাসকে বাংলা দখলের স্বপ্নকে চুরমার করেছে। দ্বিতীয়ত করোনার হাত থেকে বাংলাকে বাঁচাতে, করোনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার কেন্দ্রের টিকাকরন ভুল নীতির বিরোধীতা করার সাথে সাথে নানা রং-এর কোভিড ভলেন্টিয়াররা রুগী বাঁচাতে মরণপন লড়াই চালাচ্ছে। একইভাবে রেশন ছাড়া কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের অনুপস্থিতিতে বিপর্যস্ত মানুষগুলোকে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে নানা ব‍্যক্তি, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন।

অনেকের মতো আমরাও সিন্ধুতে বিন্দুর মতো ২০০ পরিবারের জন‍্য চিড়ে, মুড়ি, বাতাসা, বিস্কুট, চানাচুর, সাবান, দেশলাই, মাস্ক, সানিটারি ন্যাপকিন ও বড় মশারি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা দিয়েছিলাম।

কমরেড চারু মজুমদারের আহ্বান “জনগনের স্বার্থই, পার্টির স্বার্থ” ও গ্রামে চলো ডাককে বাস্তবায়িত করতে আইসা ও আরওয়াইএ সাথীরা বিগত কয়েকদিন যুদ্ধকালীন উৎসাহ নিয়ে অর্থ ও সামগ্রী সংগ্রহে মানুষের কাছে পৌছেছে। ছাত্ররা যখন পুঁথিগত জ্ঞানের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর পাঠশালায় পৌছে কুয়েমুড়ি গ্রামের কৃষক ও মেহনতিদের হাতে সামগ্রী তুলে দিয়ে তাদের হাতে হাত মেলায় তখন তারা নিজেরাই ধন‍্য হয়।

পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ‍্য সম্পাদক গণকবিয়াল নিতিশ রায়, নাট্টকার অরিন্দম সেনগুপ্ত ও অধ‍্যাপক নিত্যানন্দ ঘোষ এবং আরো দুজন সামগ্রী নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে উপস্থিত থেকে তাদের অধিকার নিয়ে লিফলেট বিলি করেন।

ইয়াস ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অধিকার ও প্রয়োজন নিয়ে  সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা কমিটি প্রথম থেকে সচেতন ছিল। তাই (১) ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আশু ও স্থায়ী সমস্যা সমাধানে একগুচ্ছ দাবিসনদ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নিকট পেশ করা হয়েছে। (২) অধিকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগাম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় থেকে যুবদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন (যাদের সাহায্যেই সুষ্টভাবে সামগ্রী এলাকার জনগণদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। জেলা পার্টির অন্যতম সদস্য নব কুমার বিশ্বাস ও জয়দেব নস্কর। (৩) সামগ্রী নিয়ে মানুষের মধ্যে সরাসরি চলে যাওয়া।

আগামী কয়েকদিন পর সামগ্রী নিয়ে অন্যস্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। একই সাথে এই অঞ্চলের মানুষের অধিকারের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলুক।

 কিশোর সরকার

friends with the rights and democracy movement

 

গেছিলাম ইয়াস পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দঃ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমা ব্লকের হেরম্বগোপালপুর পঞ্চায়েত অন্তর্গত কুয়েমুড়ি গ্রামে। বাখরাহাট থেকে যাত্রা শুরু। যাওয়ার পথে দাঁড়ানো হ‍ল রায়দীঘি বিধানসভা অন্তর্গত শঙ্কর রোড অঞ্চলে। যেখানে আগে থেকেই ত্রাণ সামগ্রীর একটা অংশ গোছগাছ করতে গিয়েছিলেন জেলা কমিটির দুজন নেতৃত্ব, কমরেড নবকুমার বিশ্বাস এবং কমরেড জয়দেব নস্কর। তারুণ্যে ভরা ১০ জন যুবকের তৎপরতায় যেখানে ত্রাণসামগ্রীর গোছগাছ সম্পন্ন হয়েছে আগের দিনই। আলাপচারিতা চলল, সাথে করে খবর পাওয়া গেল এই এলাকাতেই ৭০ দশকের এক কমরেডের বসবাস। কমরেড শঙ্কর মন্ডল। অল্প সময়তেই পৌঁছে গেলাম তার কাছে। বয়স্ক কমরেড নবযৌবনকে হাতের কাছে পেয়ে আপ্লুত। কথাবার্তা চলল, পেলাম পাশে থাকার বার্তা। আলাপচারিতার পর পুনরায় যাত্রা শুরু হেরম্বগোপালপুরের দিকে। রায়দীঘি পেরিয়ে নদীর বুকচিরে গড়ে ওঠা এলাকার সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভার টপকে কিছুটা গিয়ে গ্রামে প্রবেশ। ত্রাণকার্য শুরু হল এলাকার যুবকদের উদ্যোগেই। আমরা ছাত্র-যুবরা কথা বলা শুরু করলাম গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে।

মূলত চাষ-বাস, ক্ষেতমজুরি, সমুদ্রে মাছ ধরা (ট্রলারে), মাছ চাষ, গরু, ছাগল পালন এগুলোই জীবিকা এলাকার মানুষের। বছরে দুটো চাষ হয়, ১) বরো, ২) আমন। এক বিঘা জমিতে গড়ে ১২ বস্তা (১৮ মন) মতো ধান হয়। ধান ছাড়া উচ্ছে, করোলা এবং টমেটো চাষের কথা জানা গেল, এছাড়া মাছ চাষ প্রায় সব পুকুরেই হয়। ইয়াসের ফলে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে পুকুরের মাছ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত। জলের তলায় এখনো যে জলাজমি রয়েছে তাতে আগামী ২ বছর কোনোরকম ফসল হবেনা একথাও জানা গেল। গ্রামগুলোর কিছু লোক কলকাতায় কাজ করে বিভিন্ন অসংগঠিত শ্রমিকের, কেউ বা পরিযায়ী শ্রমিক, তবে এ সংখ্যা কম। দুটি এলাকা এখনো জলের তলায় আছে, সেসব অঞ্চলে ঘরবাড়ি, পশু, মাছ, ধানের তলা সব ক্ষতিগ্রস্ত। এলাকার লোক নিজেদের তৎপরতায় জল নিকাশ বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। প্রশাসনের কথা জিজ্ঞাস করলে জানা গেল “কারোর ভরসায় বসে থাকলে কি আর বাঁচা যাবে ভাই, আমরাই এগুলো করি, পরে টাকাপয়সা ওরা ব্যবস্থা করে দেয়, যদিও না করে দেয় তাতে আর কি করব, আমাদের তো বাঁচতে হবে।” একশ দিনের কাজ নিয়ে একটা ক্ষোভ রয়েছে। একশ দিনের কাজে দূর্নীতি, মজুরি দেওয়ার সময় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের উপদ্রব, যাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন গ্রামীণ মহিলারা। এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে বোঝা গেল প্রশাসনের কাছে দাবি পুনর্বাসন দিতে হবে, মজবুত নদীবাঁধ বানাতে হবে, অরণ্য ধ্বংস করা চলবে না, ম্যানগ্রোভের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, মজবুত রাস্তাঘাট বানাতে হবে, বেকারত্ব কমানোর পরিকল্পনা করতে হবে। নদীবাঁধ নির্মাণে সরকারী ব্যর্থতা, দুর্নীতির বিষয়গুলো নিয়েও কথাবার্তা হল।

পুরানো ইতিহাস সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল আগে এসব অঞ্চলে এক একটা জোতের মালিক এক এক জন ছিল, পরে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ফলে জমি কৃষকের হাতে আসে। এখন জোতের মালিক কেউ নেই, মোটামুটি কৃষকের হাতেই জমি আছে। পূর্বে যারা মালিক ছিল তাদের বেশিরভাগটাই এখন কলকাতার বাসিন্দা, কারো বা এখানে খুব সামান্য জমিজমা রয়েছে, কিন্তু তারা গ্রামে আর কেউ আসে না।

এরপর ফেরার পালা। ফেরার পথেও প্রবীণ কমরেড শঙ্কর মন্ডলের সাথে পুনরায় দেখা করে নিলাম। বললাম কমরেড নতুন করে সংগঠন এই অঞ্চলে গড়ে তুলব, আপনাকে পাশে দরকার। পাশে থাকার অঙ্গীকার করলেন, নবীন প্রবীণের মেলবন্ধনে নকশালবাড়ির ধারা এভাবেই সারা জেলায় স্থাপন করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ফিরলাম নিজ এলাকায়।

- শুভদীপ পাল

খণ্ড-28
সংখ্যা-22