প্রত্যাশা মতোই , প্রধানমন্ত্রীকে তার সমস্ত ক্যাবিনেট সহযোগী এবং এনডিএ মুখ্যমন্ত্রীরা, ১৮-৪৪ বছরের সকলকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার বিলম্বিত ঘোষণার জন্য ধন্য ধন্য করে চলেছেন। আর সাধারণ জনমত সরকারের স্বেচ্ছাচারী অযৌক্তিক টিকা-নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগের জন্য শীর্ষ আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, কারণ এর জন্যই এক সপ্তাহের মধ্যে সরকার নীতি সংশোধনে বাধ্য হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী তার আধ ঘন্টার ভাষণে মূলত তিনটি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা করেছেন : (১) কেন্দ্রীয় সরকার ১৮-৪৪ বছরের সকলের বিনামূল্যে টিকা পাওয়া সুনিশ্চিত করতে, টিকা সংগ্রহ করবে এবং রাজ্য সরকারগুলিকে সরবরাহ করবে, (২) বেসরকারি হাসপাতালগুলি টিকার প্রতিটি ডোজ-এর মূল্য ছাড়াও পরিষেবা ফী বাবদ সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা ধার্য করতে পারবে, (৩) আগামী দীপাবলি পর্যন্ত দরিদ্রদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
কিন্তু মোদীর যা চিরাচরিত অভ্যাস! তিনি প্রবচন আউড়ে ধর্মোপদেশ দেওয়ার নিজস্ব ঢংয়ে এই ঘোষণাগুলিকে ভাষণে পরিণত করে ফেললেন। এবং যথারীতি নির্দিষ্ট বিষয়গুলি, তার মহিমাকীর্তনের দুরূহ বিমূর্ত বাকচাতুর্যের আড়ালেই থেকে গেল। বিষয়টা নির্দিষ্টভাবে কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে, অথচ তার ভাষণের বেশিরভাগটা জুড়ে তিনি সাধারণভাবে ভ্যাকসিন নিয়ে কথা বলে গেলেন। যখন কোভিড মৃত্যুর প্রসঙ্গ আসে, এই সরকার তখন শতাংশের হিসেবে কথা বলে; আর টিকার ডোজ-এর প্রশ্নে, একেবারে নির্দিষ্ট সংখ্যায় হিসেব দেয়। গত পাঁচমাসের টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় যে জনসংখ্যার ৪%-কেও টিকা দিয়ে উঠতে পারা যায়নি, সেই সত্যিটা আড়াল করতেই এই কৌশল-চাতুরী!
ভারতের ভ্যাকসিন সরবরাহকে নির্দিষ্টভাবে ভাগ করার ক্ষেত্রে সরকারের ভুল সূত্র কিছু অনাবশ্যক জটিলতা তৈরি করেছিল। মোদীর ৭ জুনের ভাষণে সেগুলোকে বাদ দিলেও এই বক্তব্য একটি যুক্তিসঙ্গত টিকা নীতির স্পষ্ট প্রকাশ এবং তার উৎসাহী রূপায়ণ নিয়ে কোনও আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারেনি।
আমরা এখনও জানি না, কেন গুজরাট তামিলনাড়ুর চেয়ে বেশি টিকা পাচ্ছে এবং কীসের ভিত্তিতে রাজ্যগুলির মধ্যে টিকা বণ্টন করা হচ্ছে। ন্যূনতম সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে সর্বাধিক মানুষকে টিকা দেওয়াই যদি ‘ভাবনা’ হয়, তাহলে বাস্তব সরবরাহের উপর গুরুত্ব দিতে হবে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে নথিভুক্ত চাহিদার উপরে নয়। ভারতে বাধ্যতামূলক ডিজিটাল নথিভুক্তি এখনও ব্যাপক ও স্বচ্ছ গণ সরবরাহকে সহজতর ও ত্বরান্বিত করতে যত না কাজে লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজে লাগে ‘বাদ দেওয়ার মাধ্যম’ হিসেবে। এই সময়ের জরুরি প্রয়োজন -- দ্রুত সর্বজনীন টিকাকরণ সুনিশ্চিত করার জন্য জোরদার প্রচার; কিন্তু মোদীর ভাষণ এই অভিমুখে পথনির্দেশের ক্ষেত্রে আমাদের কোন ভরসা জোগাতে পারেনি।
আগামী দীপাবলি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা চালু রাখার প্রতিশ্রুতিটি আরেকটি জাঁক করে বলা কথা। কিন্তু আসলে এতে কী পাওয়া যাচ্ছে? প্রতি মাসে জনপ্রতি ৫ কেজি চাল বা গম, সঙ্গে এক কেজি করে ছোলা (যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেওয়াই হয় না)। ব্যস! খাদ্য সুরক্ষা আর সর্বজনীন গণবন্টনের গোটা বিষয়টাকে এই নামমাত্র ন্যূনতমে এনে দাঁড় করানো আমরা কি মেনে নিতে পারি? ডাল, ভোজ্য তেল, মশলা এবং ন্যূনতম আয় সহায়তা -- কিছুই নেই। গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণকে শুধুমাত্র পিএমজিকেএওয়াই-এর এই নামমাত্র ছিটেফোঁটার ভরসায় বেঁচে থাকতে হবে?
মোদীর ‘ভ্যাকসিন ডিগবাজি’ আমাদের বলছে, সরকার আর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ এবং পুঞ্জীভূত গণক্রোধের চাপকে উপেক্ষা করার অবস্থানে নেই। আসুন, আমরা কৃষি আইন ও নতুন শ্রম কোড বাতিল করা, সরকারি সম্পত্তি বেচা বন্ধ করা, দ্রুত গণটিকাকরণ এবং শ্রমজীবী জনতার জন্য ন্যূনতম আয় ও খাদ্য সহায়তা সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারের উপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়িয়ে যাই!
এম এল আপডেট, সম্পাদকীয় খণ্ড - ২৪, সংখ্যা - ২৪ ( ৮ - ১৪ জুন ২০২১)