উত্তরপ্রদেশে দুর্বৃত্ত-পুলিশ-রাজনীতি গাঁটছড়া যে কত শক্তিশালী ও গভীর তা আরও একবার প্রকট হল ‘এবিপি গঙ্গা’ ও ‘এবিপি নিউজ’এর সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক সুলভ শ্রীবাস্তবের মৃত্যুতে। উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ের এই সাংবাদিক গত ১৩ জুন কাজ সেরে রাত ১১টার সময় বাড়ি ফিরছিলেন। কিন্তু এক ইটভাটার কাছে তাঁর মুখ থেঁতলানো দেহ ও পাশে মোটর সাইকেল পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্থানীয় মানুষদের সাহায্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। পুলিশ প্রথমে বলে, শ্রীবাস্তবের মৃত্যুর কারণ একটা দুর্ঘটনা। একটা টিউব ওয়েলের সঙ্গে তাঁর মোটর বাইকের ধাক্কা লেগেই নাকি ঐ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এবং তাদের দুর্ঘটনার সিদ্ধান্তকে জোরালো করতে পুলিশ এই ইঙ্গিতও দেয় যে, সেদিন বাড়ি ফেরার আগে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মদ্যপানও করেছিলেন। কিন্তু পরদিন সুলভ শ্রীবাস্তবের স্ত্রী রেণুকা শ্রীবাস্তব মদ-মাফিয়াদের হাতেই তাঁর স্বামী খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ করায় পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে খুনের এফআইআর দায়ের করে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণও খুনেরই সংকেত দেয়। তাঁর মুখ যেমন থেঁতলানো ছিল, তেমনই জামা ও প্যান্টও খোলা ছিল, নিছক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যা হওয়ার নয়।
মদ মাফিয়াদের হাতে শ্রীবাস্তবের খুনের অভিযোগ এই কারণেই উঠছে যে, কয়েকদিন আগেই তিনি মদ-মাফিয়াদের নিয়ে লেখার পর থেকেই তাদের কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছিলেন। সেকথা তিনি পুলিশকে জানিয়েও ছিলেন। এলাহাবাদ জোনের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল প্রেম প্রকাশকে হিন্দিতে লেখা চিঠিতে তিনি জানান, “আমি আমার সূত্রর কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে, মদ-মাফিয়ারা আমার ওপর অসন্তুষ্ট। গত দু’দিন ধরে যখনই আমি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, মনে হচ্ছে যে কেউ আমার পিছু নিচ্ছে। আমার আশঙ্কা, মদ-মাফিয়া আমার বা আমার পরিবারের ক্ষতি করতে পারে।” মদ-মাফিয়াদের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশ সর্বজনবিদিত। এই অভিযোগ পাওয়ার পরও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, তাঁকে সুরক্ষাও জোগায়নি।
শ্রীবাস্তবের মৃত্যুর দিন পনের আগে বিষাক্ত মদ খেয়ে আলিগড়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেই ঘটনা থেকে অবৈধ মদ ব্যবসা নিয়ে চর্চায় উঠে আসে মদ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী এক কার্টেলের কথা। এবং এটাও প্রকাশ পায় যে এই কার্টেল পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। সেই কার্টেলের মূল মাথা বা চাঁই হিসাবে সামনে এসেছে অনিল চৌধুরী ও ঋষি শর্মার নাম। এরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভূত শক্তিশালী। অবৈধ মদ ব্যবসায় যুক্ত থাকার জন্য কয়েক বছর আগে এরা ধরাও পড়েছিল, গুণ্ডা দমন আইন, রাজ্য আবগারি শুল্ক আইন ও অন্যান্য আইন এদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয়েছিল। কিন্তু এদের রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রতিপত্তির হাত এতই লম্বা যে প্রশাসন ও আইনকে তাদের প্রভাব ও ওপরতলার সঙ্গে তাদের সংযোগের কাছে বশীভূত হতে হয়। এরা এবং এদের স্ত্রীরা কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত উত্তরপ্রদেশ পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়, বিজেপি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠতা এবং বিজেপি নেতাদের সঙ্গে এদের গলাগলি হওয়ার ছবিও সামনে আসে। মদ-মাফিয়াদের নিয়ে চর্চায় এই অভিমতও উঠে আসে যে, ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে অবৈধ মদ ব্যবসা চলছে, সেই দেড় দশকেরও বেশি সময়কালে লক্ষ্ণৌয় চলা বিভিন্ন সরকার ও শাসক দলগুলোর রাজনীতিবিদদের মদত ছাড়া তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে লক্ষ্ণৌয় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পর ‘এনকাউন্টার’ তথা পুলিশের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সংঘর্ষকে দুর্বৃত্ত দমনের কৌশল বলে জাহির করতেন। সাংবাদিকদের সামনে যোগী দম্ভ ভরে ঘোষণা করতেন – এধরনের কত হাজার সংঘর্ষ পুলিশ চালিয়েছে, কত সংখ্যক দুর্বৃত্ত নিহত হয়েছে, কত শতকে আহত করা হয়েছে এবং কত হাজারকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে। তবে, যোগীর দম্ভকে ম্লান করে মাঝেমধ্যেই দুর্বৃত্ত দাপটের আখ্যান মঞ্চস্থ হত উত্তরপ্রদেশের নানান অকুস্থলে। যেমন, বিকাশ দুবে আখ্যান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে ও মদতে এই দুর্বৃত্ত শিরোমণির প্রতাপ মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে এবং সে প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বছরখানেক আগে তার সাঙ্গপাঙ্গরা যখন গুলিতে ঝাঁঝরা করে এক ডিএসপি সহ আট পুলিশ কর্মীকে হত্যা করে, সে সময় পুলিশের হানাদারিতে আসার খবর তাদের কাছে পাচার করেছিল পুলিশ-প্রশাসনের লোকজনই। এবং আত্মসমর্পণের পর যখন তাকে নিয়ে আসা গাড়ির উল্টে যাওয়া, তার পালানোর চেষ্টা এবং ফলে পুলিশের গুলিতে তার নিহত হওয়ার আখ্যান নির্মিত হল, তখনও কথাটা উঠেছিল যে – ওপরতলার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও আদানপ্রদানের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়াকে আটকাতেই তাকে নিকেশ করা হয়েছিল।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন তথা দুর্বৃত্ত-পুলিশ-রাজনীতিবিদ গাঁটছড়া আজ ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। চলতি অর্থনীতির আঁতুরঘড়েই তার জন্ম, ফলে তার অপ্রতিহতভাবে সচল থাকা। উত্তরপ্রদেশের আধিপত্যকারী রাজনীতির চলতি ধারা, তার জোরালো সামন্ততান্ত্রিক অনুষঙ্গ, সাম্প্রদায়িক অভিমুখ, তাতে জাতপাতবাদী উপাদানের জোরালো উপস্থিতি রাজ্যটাকে দুর্বৃত্ত সক্রিয়তার স্বর্গরাজ্য করে তুলেছে। সাংবাদিক সুলভ শ্রীবাস্তবের রহস্যজনক মৃত্যু যেমন দুর্বৃত্ত দমনের যোগী দাবির অসারতাকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তেমনি এই বিষয়টাকেও জানিয়ে দিল যে – অপরাধ জগৎ ও রাজনীতির জগৎ পরস্পরকে পুষ্ট করছে এবং করে চলবে।