পশ্চিমবাংলায় নির্বাচন পরবর্তী হিংসা ও সন্ত্রাসের মামলা গড়িয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। দায়ের হয়েছে এক জনস্বার্থ মামলা রাজ্যের শাসকদল, সরকার ও তার পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা তৃণমূল তার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া লোকদের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে, পুলিশ-প্রশাসন সব দেখেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অভিযোগের বিহিত চেয়ে মামলা গড়ায় কলকাতা হাইকোর্টে। তাতে ইতিমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে জমা পড়া কয়েক হাজার অভিযোগের প্রতিলিপিও জুড়ে দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের তরফে এইসব ঘটনাপ্রবাহকে উপেক্ষার আচরণ করে আসা হচ্ছিল। কিন্তু হাইকোর্ট কারণ দর্শাতে বলায় রাজ্য সরকার কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। বরং হাইকোর্ট ইতিমধ্যে আরও যে নির্দেশ দিয়েছে তা পুনর্বিবেচনা ও প্রত্যাহারের জন্য রাজ্য সরকার ওকালতি করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের উপরোক্ত পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ ইতিমধ্যে এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে বলেছে তদন্ত কমিটি গঠন করতে। কমিশন ঐ কমিটি গঠন করেছে জাতীয় ও রাজ্য স্তরের প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে। কমিটির মাথায় রয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান, সঙ্গে রয়েছেন জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের ভাইস চেয়ারপার্সন, জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্য, কমিশনের একজন ডিজি ও ডিআইজি সহ রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের রেজিস্ট্রার ও রাজ্য লিগ্যাল সার্ভিসের একজন সদস্য। কমিটিতে জাতীয় স্তরের প্রতিনিধিত্বের ভার অনেক বেশি। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের সূত্রও বলছে আদালতে জোরদার হবে সংঘাত। এরপর তদন্ত কমিটি কতদিনে কিভাবে কাজ সারবে, কবে রিপোর্ট করবে, তাতে রাজ্য সরকার কেমন সহযোগিতা করবে, পাশাপাশি আদালতে কেন্দ্র-রাজ্যের মারপ্যাঁচ কেমন কতদিন চলবে, এ সবই অপেক্ষার বিষয়।
কিন্তু অপেক্ষা করে থাকতে পারে না তৃণমূলের নৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যালোচনা, যার কেন্দ্রে রয়েছে গণতন্ত্রের প্রশ্ন।
পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা নির্বাচন পর্বে তৃণমূলের কোনও বড় মাত্রার সন্ত্রাস ছিল না। অন্তত বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে চালানো সন্ত্রাসের তুলনায় রাজ্যের শাসকদল সন্ত্রাসী হয়নি। বরং বিপরীতে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি বিদ্বেষ, প্ররোচনা, হুমকি, এমনকি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে শীতলখুচির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। শাসকের ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে পরিবেশকে বিষিয়ে দেওয়ার আগ্রাসনে একতরফা আধিপত্য বিস্তার করেছিল বিজেপি ও কেন্দ্র। তাছাড়া গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে প্রাক বিধানসভা নির্বাচন পর্ব পর্যন্ত তৃণমূলের একদল নেতার পরপর বিজেপিতে দলবদল তার মাটিও অনেকটা ওদিকে করে দেয়। তৃণমূল বহিরঙ্গে যাইই বলুক, এই সবকিছুর প্রতিশোধের অপেক্ষায় জ্বলতে থাকে তুষের আগুনের মতো, আর নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর বদলার সন্ত্রাস শুরু করে দেয়। কে কাকে ভোট দেবে না দেবে, ঠিক বুঝে হোক বেঠিক বুঝে হোক, প্ররোচিত বা প্রভাবিত হয়ে হোক সেটা একজন সাধারণ নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। এবিষয়ে কোনও জোর খাটানো যায় না। শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রচারে গেছে, ভোট দিয়েছে বলে সন্ত্রাস চালাতে হবে; ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, ঘরছাড়া করে দেওয়া, ত্রাণ না দেওয়া, একশ দিনের কাজ না দেওয়া, হাতে মারা-ভাতে মারা চলতে পারে না। এসব গণতন্ত্রের ওপরই হামলা। কোনও ভোটাধিকারী নাগরিককে যদি ফ্যাসিবাদীদেরও প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হয় তবে গণতান্ত্রিক আবেদনের মাধ্যমে করাই গণতন্ত্রে স্বীকৃত। হামলা হলে প্রতিরোধের অধিকারও গণতন্ত্রে স্বীকৃত, কিন্তু কখনই ‘প্রতিরোধের’ নামে হামলা গণতন্ত্র সম্মত নয়। রাজ্যের শাসকদল গণতন্ত্রের এই রীতিনীতি কতটা মানছে বোঝা দুস্কর, কারণ হাইকোর্টের ঠ্যালায় সন্ত্রাস কিছুটা কমে এলেও এখনও চলছে।
বাংলার গণরায় তার ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে রুখে দিলেও বিজেপি তা মানতে চায়নি, আক্রোশবশত নবনির্বাচিত সরকারকে যে কোনও উপায়ে উল্টে দিতে উঠে-পড়ে লাগে। এটা হয়ত আগে থাকতেই দ্বিতীয় ছক ছিল। শপথ অনুষ্ঠান বয়কট, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তদন্ত টিম পাঠানো এবং রাজ্যপালকে উৎকটভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের ইস্যুটি সামনে আনতে থাকে। আইনের শাসন না থাকার কারণ তুলে বাতাসে ভাসাতে থাকে তবে কি ৩৫৬ ধারাই ভবিতব্য? বিজেপির এই দুরভিসন্ধি আরও ধরা পড়ে রাজ্য সরকারকে বিশেষ করে কোভিড মোকাবিলা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকার থেকে প্রবঞ্চিত করে চলার মধ্যে। সুতরাং বিজেপি যে রাজ্যে ‘গণতন্ত্র নেই’ রব তুলছে কেন্দ্রের সর্দারির পরিবেশ তৈরি করতে এটা স্পষ্ট।
কিন্তু তা বলে গণতন্ত্রের প্রশ্নে তৃণমূলকে ছাড় দেওয়া যায় না। এবারের বিধানসভা নির্বাচন ছিল ফ্যাসিবাদী বিজেপির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সেই মেরুকরণেই মিলেছে যেমন গণরায়, তেমনি তার লাভ গেছে মূলত তৃণমূলের ঘরে। তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয়বস্তু ছিল একদিকে বিজেপির দখলদারির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারের সপক্ষে সোচ্চার হওয়া, অন্যদিকে জনগণের বিভিন্ন অংশের জন্য রাজ্য সরকারের গৃহীত কিছু কল্যাণ প্রকল্প রূপায়ণে সার্থকতা তুলে ধরা। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার তথা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্রের বিষয়কে এক মূল হিসেবে তৃণমূল কখনই নিজে সামনে আনতে চায়নি বা অপরাপর কোনো দলকেও অবাধে তুলতে দেয়নি। কিছু বুলি আউরে চলার বাইরে সবসময় কার্যত অস্বীকার করে এসেছে। দল ও সরকার পরিচালনায় ক্ষমতার চূড়ান্ত মালিক একজন নেত্রীই – এটাও একটা বিশেষ কারণ তৃণমূলের অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়ার। বিধানসভা নির্বাচনে আর যে সমস্ত দল, সংগঠন, মঞ্চ, ফোরাম বিজেপির ফ্যাসিবাদকে রুখে দেওয়া মূল লক্ষ্য স্থির করেছিল তারা ঐ সময়ের জন্য তৃণমূলের সমান বিরোধিতা করতে চায়নি, তৃণমূল শাসনের গণতন্ত্র দমন বা হরণের ঘটনা ও প্রবণতাকে তুলে ধরে বিঁধতে চায়নি। কিন্তু গণতন্ত্রের বিষয়ে তৃণমূলের বরাবর গুরুতর স্খলন রয়েছেই। রাজ্যে বিরোধী সভা-সমাবেশ-মিছিল-ধর্ণা ইত্যাদি করতে গেলে অনুমোদনের প্রশ্নে পুলিশ-প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতাই প্রথম ও শেষ কথা। সংবিধান স্বীকৃত ধর্মঘট করলে শাস্তির পদক্ষেপ করা হয়। এরাজ্যে বিনা বিচারে বহু রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বন্দী রয়েছেন বছরের পর বছর। তাদেরকে এমনকি জরুরী চিকিৎসা পরিষেবা পর্যন্ত দেওয়া হয় না। মিথ্যা মামলা চাপানো হয় রাজ্যের শাসকের বিরোধিতাকে শায়েস্তা করতে। বহু মামলা ফেলে রাখা হয়েছে, যেমন নন্দীগ্রাম মামলা। না আগ্রহ আছে বিচারব্যবস্থার পরিকাঠামো সমৃদ্ধ করে তোলার বিষয়ে, না কর্মতৎপরতা থাকে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করার তাগিদে। এখানেও বন্দীদের অনেকের ওপর চাপানো রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন। অর্থাৎ তৃণমূল শাসন অগণতান্ত্রিক আচরণে যথেষ্ট কলঙ্কিত। এই পটভূমিতেই বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাসের বাস্তবতা সহজে বুঝে নেওয়া যায়। সময় থাকতে যদি এ বন্ধ না হয়, যদি এর প্রতিকার না মেলে, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে আবার আলোড়িত হবে পশ্চিমবাংলা। কারণ, প্রশ্নটি গণতন্ত্রের।
-- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
মার্চ-এপ্রিলে যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল তার মধ্যে বাংলার নির্বাচনই সবচেয়ে বেশি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই রাজ্যে বিজেপি ২০১৯’র সাধারণ নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে ১৮টি লোকসভা আসন ও ৪০% ভোট হাসিল করে চোখ ধাঁধানো উত্থান ঘটিয়েছিল। একমাস ধরে আট পর্বে প্রলম্বিত নির্বাচনের পুরো ছকটাই ছিল বিজেপিকে বিশেষ সুবিধা করে দেওয়ার জন্য। সম্পূর্ণ বশংবদ কেন্দ্রীয় সংস্থা, কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং বিপুল অর্থবল ও মিডিয়ার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিজেপির বাংলা জয়ের আয়োজন প্রায় নিশ্ছিদ্র করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেল প্রায় নাগালের মধ্যে চলে এসেও বাংলা জয় বিজেপির জন্য সুদূরপরাহতই থেকে গেল। ২০১৯’র চূড়া থেকে সামান্য নেমে ভোট কমল দুই শতাংশ, আর আসন সংখ্যা আটকে গেল ৭৭-এ।
২০১৯’র হিসাবে লীড পাওয়া ১২১টি আসনের নিরিখে এটা উল্লেখযোগ্য অবনমন হলেও ২০১৬’র ফলাফলের তুলনায় এ অবশ্যই এক বিপুল উল্লম্ফন – ভোট শতাংশের হিসেবে প্রায় চারগুণ (১০.১৬% থেকে ৩৮.১%), আর আসন সংখ্যার হিসেবে পঁচিশ গুণ (৩ থেকে ৭৭)। তার থেকেও বড় ব্যাপার হল বিজেপি এখন বিধানসভার অভ্যন্তরে একমাত্র বিরোধীপক্ষ হিসেবে উঠে এল। বিধানসভার মল্লভূমিতে বিজেপি নিশ্চয় এই ‘নয়া সমীকরণ’ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে, নিজের অবস্থান সুসংহত করবে আর একে কাজে লাগিয়ে বাংলায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র করার অপচেষ্টা চালাবে। ওরা ইতিমধ্যেই বাংলার গণরায়কে ‘মুসলিম ভেটো’ তকমা দিয়ে দিয়েছে। রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি ও রাজ্যের ভিতরে সংঘ-বিজেপি বাহিনীর যোগসাজশে গণরায়কে নস্যাৎ করার ও উল্টে দেওয়ার এক মরিয়া অভিযান শুরু হয়ে গেছে।
নির্বাচনের ফলাফলের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাচ্ছে বিজেপি প্রধানত নির্ভর করেছিল দ্বিমুখী রণকৌশলের ওপর – পরিচিতি-ভিত্তিক সামাজিক কারিগরি আর মুসলমান-বিরোধী মেরুকরণ – প্রথম দিকটির খাপে খাপে দ্বিতীয় দিকটিকে গুঁজে দিয়ে এক সর্বব্যাপী ছক বুনেছিল। এই দুইটি দিকের নিরিখেই বিজেপি ভালো মাত্রায় সফল হয়েছে, কিন্তু নির্ধারক সুবিধা পাওয়ার যে প্রত্যাশা তারা করেছিল তা আর শেষ পর্যন্ত হাসিল করতে পারেনি। টিএমসি প্রায় ১০% ভোট-ব্যবধানে বিজেপিকে আটকে দিতে সক্ষম হয়েছে যা টিএমসি’র ঝুলিতে এনে দিয়েছে বিজেপির প্রায় তিনগুণ আসন। একদম উত্তরের চারটি জেলা – দার্জিলিং, কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি – বিজেপি প্রায় পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে, পশ্চিমের পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাদুটিতে জিতে নিয়েছে অধিকাংশ আসন, আর বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া নদীয়া ও দক্ষিণ দিনাজপুরে জিতেছে অর্ধেক সংখ্যক আসন। বাংলার বাকি অংশে, বিশেষত বৃহত্তর কলকাতায়, টিএমসি-র বিজয়-ঝড় বয়ে গেছে।
অন্যান্য অনেক দলের বিপরীতে টিএমসি অনেক বেশি মনোযোগ সহকারে দেওয়ালের লিখন পড়ার চেষ্টা করেছে। দু’হাজার উনিশের লোকসভা নির্বাচনের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের চলার পথ প্রয়োজন মতো শুধরে নিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে সচেষ্ট হয়েছে। ক্রমবর্ধমান শাসক-বিরোধী মনোভাবের মুখে দাঁড়িয়ে টিএমসি-র গণসংযোগ প্রচেষ্টা বহুক্ষেত্রে বিজেপির অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করতে সাহায্য করেছে। টিএমসি-র কলঙ্কিত নেতাদের বিজেপিতে যোগদানও নিজেদের বোঝা হালকা করতে এবং শাসক-বিরোধি সেন্টিমেন্ট বিজেপির ঘাড়ে চালান করে দিতে তাকে সাহায্য করেছে। যে ডজন খানেক বিধায়ক দল বদলে বিজেপির টিকিটে নির্বাচন লড়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন জিততে সক্ষম হয়েছে। এদের মধ্যে একজন নন্দীগ্রামের শুভেন্দু অধিকারী, যার জয় যথেষ্ট বিতর্কিত এবং ব্যবধান অত্যন্ত সামান্য।
টিএমসি-র ভেতর থেকে দল ভাঙ্গানোর খেলা চালিয়ে ভোট বাড়াতে সক্ষম হওয়ার বদলে বিজেপির বরং ২% ভোট কমেই গেছে। অন্যদিকে টিএমসি তার ভোট প্রায় ৫% বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়। স্পষ্টতই টিএমসি-র নিজস্ব ভোট ছাড়াও, বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করতে উৎসুক ভোটারদের উল্লেখযোগ্য অংশকেই টিএমসি নিজের দিকে টানতে পেরেছে। বিজেপি-বিরোধী ভোটের এই মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী অবদান রেখেছে সুসংহত ফ্যাসি-বিরোধী অভিযান। বিহার নির্বাচনের অব্যবহিত পরে সিপিআই(এমএল) সুস্পষ্টভাবে বিজেপিকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার পরই এই বিতর্কের সূত্রপাত হয় এবং ‘#নোভোটটুবিজেপি’ বা বিজেপি হারাও, বাংলা বাঁচাও শ্লোগানের রূপে রাজ্যজুড়ে তা গুঞ্জনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
সিপিআই(এম) ও তার পুরনো বামফ্রন্ট শরিক, কংগ্রেস এবং সদ্যগঠিত ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টকে নিয়ে গঠিত তৃতীয় শিবির ভোটের ফলাফলে অনেক পেছনের তৃতীয় অবস্থানে। সব মিলে প্রায় ১০% ভোট তারা পেয়েছে এবং একটি আসন জিতেছে। সিপিআই(এম) বা কংগ্রেস নয়, আসনটি পেয়েছে আইএসএফ (যারা আসলে বিহার ভিত্তিক একটি দল রাষ্ট্রীয় সেকুলার মজলিস পার্টির নামে নির্বাচনে লড়েছিল)। সংযুক্ত মোর্চা নাম নেওয়া এই জোট পশ্চিম বাংলায় নিজেদের একমাত্র বিকল্প হিসেবে প্রচার করেছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে তাদের জনসভার মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা ছিল: আমরাই বিকল্প, আমরাই ধর্মনিরপেক্ষ, আমরাই ভবিষ্যৎ। বাংলার লড়াইটাকে অন্ততপক্ষে ত্রিমুখী করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই জোট। কিন্তু তার ধারে কাছেও গেল না বাস্তব ঘটনা। প্রায় ৯০% আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হল মোর্চার।
নির্বাচনের আগে আমরা যখন বিজেপিকে পয়লা নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, যখন বিজেপির বাংলা দখলের অভিযানকে প্রতিহত করার কথা বলেছিলাম, তখন সিপিআই(এম) যুক্তি দিয়েছিল যে এটা বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে, লোকসভা নয় এবং টিএমসি সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনরোষকে কেন্দ্র করেই রাজ্যের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। ‘বিজেপিকে পরাস্ত করতে আগে টিএমসিকে হারাও’ – এই ছিল সিপিএমের আহ্বান, যার বার্তাটা ছিল টিএমসিকে হারিয়ে দেওয়াই আশু কর্তব্য। বিজেপি ও টিএমসি আসলে এক ও আঁতাত করে লড়ছে – এই ধারণা থেকে টিএমসি ও বিজেপিকে একাকার করে সিপিএম এক মনগড়া ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব খাড়া করে। আর পার্টির সমগ্র নির্বাচনী প্রচার এই মনগড়া নিশানাকে নিরন্তর আক্রমণ করতে থাকে। এমনকি যখন প্রশ্ন তোলা হয় যে যদি ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হয় তখন দলের অ্যাপ্রোচ কী হবে, তখনও বিজেপি আর টিএমসি মিলে সরকার গড়ুক – এই ছিল তাঁদের উত্তর।
রাজ্যে রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার মরিয়া প্রচেষ্টায় সিপিএম’এর তুরুপের তাস ছিল এবার নবগঠিত দল আইএসএফ। ২৮ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশকে বস্তুত এই নতুন পার্টির লঞ্চিং প্যাডে পর্যবসিত করে দেওয়া হয়। নতুন এই দলকে জোটের তৃতীয় বৃহত্তম অংশীদার হিসেবে জায়গা দিয়ে সিপিআই(এম) পশ্চিমবাংলার প্রেক্ষিতে আইএসএফ-কে সামাজিক ন্যায় ও বহুজন উত্থানের একটি মঞ্চ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এখানে এ’কথা স্মরণে আনা দরকার যে জোটভুক্ত হওয়ার আগে টিএমসি ও এআইএমআইএম-এর সাথেও আইএসএফ’র কথাবার্তা চলেছিল। কংগ্রেস কিন্তু আইএসএফ-কে জোটের পার্টনার হিসেবে ঠিক মেনে নেয়নি, আর আইএসএফ-ও শেষ পর্যন্ত বহু জায়গায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়।
নতুন এই দলটির পারফরম্যান্সের দিকে ভালোভাবে নজর করলে দেখা যাবে, সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করা যে বিশটি আসনে তারা ১০,০০০ এর ঊর্ধ্বে ভোট পেয়েছে তারমধ্যে সতেরোটি আসনে ২০১৬’র নির্বাচনে সিপিআই(এম) বা তার বামফ্রন্টের অন্য শরিকেরা লড়েছিল। এই আসনগুলিতে ২০১৬-তে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা মোট ভোট পেয়েছিল ১,২২৩,৮৭১, আর এবছর আইএসএফ/আরএসএমপি পেয়েছে ৭৫৭,৯৭৯ ভোট। দক্ষিণ ২৪ পরগণাতে কেবল দুটি আসনে (ভাঙ্গর, যেখানে তাদের প্রার্থী শেষ পর্যন্ত জিতেছে, আর ক্যানিং পূর্ব যেখানে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে) তার ২০১৬ নির্বাচনে বাম প্রার্থীদের পাওয়া ভোটের থেকে সামান্য বেশি ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ, আইএসএফ/আরএসএমপি টিএমসি-র গণভিত্তিতে কোনও ফাটল ধরাতে পারেনি, পাঁচ বছর আগে বামপন্থীদের পাওয়া ভোটের উপরেই আজ আইএসএফ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আইএসএফ-এর এই ফলাফল অবশ্যই বিজেপিকে হতাশ করেছে। আইএসএফ-এর দ্বারা মোর্চা মুসলমান ভোট ভাগ করে দেবে এবং তার ফলে বিজেপি সুবিধে পাবে – এই ছিল বিজেপির হিসেব। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। নবজাতক আইএসএফ মূলত সিপিআই(এম)/বাম সাপোর্টের ওপর ভর করে সামান্য কিছু বিস্তার ঘটিয়েছে, মিম কোনও দাগই কাটতে পারেনি, আর কংগ্রেস মুর্শিদাবাদ, মালদা আর উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় তার চিরাচরিত মুসলমান গণভিত্তিকেও ধরে রাখতে পারেনি। মুসলিম ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ টিএমসি-র পক্ষে চলে যাওয়ায় টিএমসি-র ব্যাপক জয়ের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে সংযুক্ত মোর্চায় আইএসএফের প্রাধান্যকে বিজেপি তার মতো করে কাজে লাগায়, এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফলে দু’হাজার ঊনিশে বিজেপির দিকে চলে যাওয়া বাম ভোটের প্রত্যাবর্তনের আশাও আবার ধাক্কার মুখে পড়ে।
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে এখন সিপিআই(এম) যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করছে তা আগের ব্যাখ্যা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পার্টি এখন মেনে নিচ্ছে যে বাংলার এই নির্বাচনটা ছিল বিজেপি-বিরোধী নির্বাচন এবং টিএমসি ব্যাপকভাবে জয়ী হল কারণ তারাই বিজেপিকে হারাতে পারবে বলে মনে করেছে মানুষ। নির্বাচনের আগে কেন এই বিষয়টি ধরতে ব্যর্থ হল তারা? কেন নিজেদের বিজেপি-বিরোধী দৃঢ় শক্তি হিসেবে তুলে ধরল না? টিএমসি বিগত দশ বছর ধরে বাংলার ক্ষমতায় আছে। যদি এতদিন ধরে জমা হওয়া প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভকে সে প্রশমিত করে জয়ী হতে পারে তাহলে তার প্রাথমিক কারণ হল নিজেদের বিজেপি-বিরোধী অবস্থান ও বিভিন্ন কল্যাণ প্রকল্পের প্রভাব। টিএমসি-র এই দুটি শক্তিশালী দিককেই সিপিআই(এম) এমনভাবে নস্যাৎ করে দেয় যে তাদের বক্তব্য অন্তঃসারশূন্য ও বুলিসর্বস্ব হয়ে ওঠে এবং তা শেষ পর্যন্ত এমনকি নিজেদের কর্মী সমর্থকদেরও সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
টিএমসি ও বিজেপির মধ্যে আঁতাতের এক মনগড়া ধারণার ওপর ভর করে সিপিআই(এম) ক্রমাগত ‘ম্যাচ ফিক্সিং’র গল্পটা চালিয়ে যায় আর সমস্ত কল্যাণ প্রকল্পগুলিকে নিছক চুরি হিসেবে নাকচ করে দেয়। আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমিউনিস্টের কাছে যে মতাদর্শগত দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতা প্রত্যাশিত তা নিশ্চয়ই কেউ টিএমসি-র কাছে আশা করবে না, কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে টিএমসি-র বিজেপি-বিরোধী ভূমিকাকে অস্বীকার করা সম্পূর্ণ অবাস্তব। সিপিএম যখন রাজ্যে দীর্ঘ সময় ধরে শাসন ক্ষমতায় ছিল তখন তার দুটো প্রধান প্রচার ছিল জনগণের আশু স্বার্থ রক্ষা এবং রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা আদায় করা। আজ টিএমসিও নিজের মতো করে সেই দুই প্রশ্ন – ফেডেরালিজম আর পপুলিজমের ওপরই নির্ভর করছে। টিএমসি-র পপুলিজমকে নিছক চুরি এবং প্রকৃত পরিবর্তন ও অধিকারের বিপরীতে সামান্য ভিক্ষাদান প্রকল্প হিসেবে নস্যাৎ করে সিপিআই(এম) আসলে বিরোধীপক্ষ হিসেবে সরকারকে দায়বদ্ধ করা ও নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার দায়িত্ব থেকেই সরে এসেছে।
ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হয়ে বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালনে সিপিএম-এর অনীহা বা ব্যর্থতা নিছক মানসিকতার প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা শুরু হয়েছে ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৪ সালে কেন্দ্রে যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে ছিল আর ইউপিএ সরকার গঠিত হয়েছিল, সংসদীয় ক্ষেত্রে সেবারই বামদেরও সবচেয়ে ভালো ফল হয়েছিল। যে দুটি প্রধান কারণে সেবার বাজপেয়ি-আডবাণী জমানার অবসান ঘটেছিল তা হল গুজরাট গণহত্যার বিভীষিকা এবং বিজেপি প্রচারিত ‘ইণ্ডিয়া শাইনিং’-এর বিপরীতে কৃষক আত্মহত্যা ও অনাহার মৃত্যুর নির্মম বাস্তবতা। মানুষের দেওয়া এই বার্তাটা কংগ্রেস কিছুটা গ্রহণ করেছিল, আর্থিক সংস্কারের ‘মানবিক মুখ’ ও সুরক্ষা কবচ সুনিশ্চিত করার কথা বলে ইউপিএ সরকার তখন বন অধিকার আইন, কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন বা খাদ্য সুরক্ষা আইনের মতো একপ্রস্থ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পশ্চিমবাংলাতে ঠিক সেই সময়েই সিপিএম উলটো পথে হাঁটতে শুরু করে, তার দৃষ্টি এবং উদ্যোগ তখন কেন্দ্রীভূত হয় শিল্পায়নের নামে জমি অধিগ্রহণ, এসইজেড গঠন আর বৃহৎ পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার দিকে।
২০০৬ সালে পশ্চিমবাংলায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ জয় অর্জন করেছিল সিপিআই(এম)। এই বিপুল মাত্রার জয় কী অন্ধ তাত্ত্বিক অহংকার ও চরম দাম্ভিক আচরণের জন্ম দিতে পারে আর দেখতে না দেখতে কীভাবে তা তিন দশকের এক সরকারের পতন ডেকে আনে তা আগামী বহু বছর বামপন্থীদের কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। সিঙ্গুরের মাটিতে কৃষকের স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ জ্যোতি বসুর মতো প্রশাসককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমাদের কৃষক সভার নেতারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে’! অশোক মিত্র অত্যন্ত আন্তরিক আগ্রহে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করেছিলেন সিঙ্গুর মডেলের কু-মন্ত্রণার বিরুদ্ধে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিকল্প উৎস ও পন্থার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এইসব পরামর্শ ও আইডিয়াকে ‘লুডাইট’ ও ‘নারোদনিক’ বলে দেগে দিয়ে দাম্ভিকভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন সেদিনের সিপিএম নেতৃত্ব। গণতন্ত্র ও আলোচনার টেবিলে সমাধানের প্রশ্ন সামনে এনেছিল নন্দীগ্রাম। কিন্তু সিপিএম তার জবাব দিয়েছিল ‘দমদম দাওয়াই’ (ষাটের দশকে মুনাফালোভী মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ একশানের শ্লোগান) এর নামে পুলিশী নির্যাতন, গণহত্যা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে সমর্থন করে, ‘আমরা ২৩৫ ওরা ৩০’ মার্কা অহংকারে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়ে।
১৯৭৭ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাগিদই বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় এনেছিল। জমি বিতরণ ও অপারেশন বর্গার মাধ্যমে, নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে, জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলে বামফ্রন্ট সরকার তার সামাজিক সমর্থনকে শক্তিশালী ও সংহত করে তুলেছিল। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্যায়ে এসে এই সমস্ত অর্জন ধূলিসাৎ হতে শুরু করে, বামফ্রন্টের সামাজিক সমর্থনে ফাটল ধরে, তিন দশক ধরে যে গ্রামীণ গরীব ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবি মহলের সমর্থন এই ক্ষমতাকে ধরে রেখেছিল তা সংকুচিত হতে শুরু করে। এবারের নির্বাচনী প্রচার দেখিয়ে দিল যে সিপিআই(এম) তার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের সংবেদনহীন দাম্ভিকতার জালেই এখনও আবদ্ধ হয়ে আছে।
‘উন্নয়নের সিঙ্গুর মডেল’-এর সাথে এসেছিল এক অদ্ভুত শ্লোগান, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’, যে শ্লোগান এই পর্বেও সিপিএম আউড়ে গেছে।
যে হুগলি জেলাতে সিপিআই(এম) সিঙ্গুরকে এক ‘শিল্পসমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ’ হিসেবে তুলে ধরেছিল, সেই জেলারই যে এক উজ্জ্বল ‘শিল্পময় অতীত’ ছিল তা কি আমাদের মনে নেই? পাট, কাগজ, রাসায়নিক ও কারিগরি শিল্প ছাড়াও সেখানে ছিল অটোমোবাইল শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি বড় ইউনিট, বিড়লা গ্রুপের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি তৈরির হিন্দমোটর কারখানা ও সাহাগঞ্জের ডানলপ টায়ার কারখানা। এই কারখানাগুলো যেখানে একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে শিল্পের নামে জোর করে বহুফসলী জমি দখল করে তাকে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের উৎসব হিসেবে মানুষ কী করে মেনে নেবে?
আজ তো গুজরাটেও সেই ন্যানো গাড়ি আর তৈরি হচ্ছে না, টাটারা নিজেরাই সেই প্রকল্পকে এক ভ্রান্ত আইডিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে, অথচ সিপিআই(এম) আজও সেই ‘সিঙ্গুর সিন্ড্রোমেই’ আটকে রয়েছে। আজ কৃষি গভীর সংকটে এবং সেই সংকটের সুযোগ নিয়ে সরকার কৃষি বিপণন ও উৎপাদন এবং সেই সুবাদে ব্যাপক ভূমি সম্পদকে কর্পোরেট হাতে তুলে দিতে মরিয়া, অন্যদিকে এর বিপরীতে কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ব্যাপক কৃষক জাগরণ। বেসরকারীকরণ প্রতিরোধ আজ আর শুধু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অ্যাজেন্ডা নয়, ব্যাপক সামাজিক প্রশ্ন। এমন অবস্থায় সকলের জন্য স্বাস্থ্য, সকলের জন্য শিক্ষা, সব হাতে কাজের দাবিতে দেশ জোড়া এক বড় আন্দোলনের পথে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার বিপরীতে সিপিএম এবারের নির্বাচনেও সেই ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত’এর ফাঁপা বুলিতে আটকে রইল।
নির্বাচন পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আজ এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ছলেবলে কৌশলে বাংলা দখল করার বিজেপির উদগ্র অভিযানের বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলা এক জোরালো রায় দিয়েছে। কিন্তু বিজেপি এই রায় মেনে নিতে রাজী নয়। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংঘ-বিজেপির আগ্রাসন আরও উগ্র চেহারা নিয়েছে। ‘হিন্দু-বিরোধী হিংসা’ ও আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মিথ্যা রব তুলে এবং যাবতীয় কেন্দ্রীয় সংস্থাকে নির্লজ্জভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে বিজেপি বাংলাকে অস্থির করে তুলতে বদ্ধপরিকর। রাজ্যপাল রাজ্যের বিজেপি নেতাদের সাথে প্রকাশ্যে হাত মিলিয়ে এই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পশ্চিম বাংলার বামপন্থীদের এই গেমপ্ল্যানটা বুঝতে হবে এবং চোরা পথে বাংলার গণরায়কে উলটে দিতে বিজেপির এই শয়তানি ছকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রাজ্য সরকারকে অবশ্যই তার প্রতিশ্রুতি পালনে দায়বদ্ধ করতে হবে, কিন্তু তা করতে হবে বাংলার মাটিতে সর্বভারতীয় ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধের মজবুত ঘাঁটি গড়ে তুলেই।
এই সন্ধিক্ষণে এই দায়িত্ব পালন করতে বামপন্থীদের অবশ্যই শুধু বিজেপি নয়, বরং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সমাজের যে বঞ্চিত অংশের মাঝে ও প্রত্যন্ত এলাকায় আরএসএস ঘাঁটি গাড়তে চাইছে সেখান থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরুদ্ধে কার্যকর রণনীতির বেশ কিছু উপাদান আমরা এই নির্বাচনেও প্রত্যক্ষ করেছি। এই উপাদানগুলিকে বিকশিত ও সংহত করা আজ সময়ের দাবি। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রেণী চেতনা ও শ্রেণী সমাবেশ অনেক দুর্বল হয়ে গেলেও, বিজেপির কর্পোরেট-মুখী ধনিক-প্রেমী স্বরূপকে উন্মোচিত করে ব্যাপক গরীব মেহনতী মানুষকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। বিজেপির নারীবিদ্বেষী রাজনীতির বিরুদ্ধে মহিলারা এই নির্বাচনে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন। নারীর সম্মান, স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলে সংঘ বাহিনীকে প্রতিহত করতে হবে।
এই নির্বাচনে বিজেপিকে রুখে দিতে জোরালো ভূমিকা রেখেছে বাংলার প্রগতিশীল ও বহুত্ববাদী ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের প্রাণবন্ত ধারা। মতাদর্শের ময়দানে সংঘবাহিনীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিদ্বেষমূলক বিষাক্ত অভিযানের বিরুদ্ধে বাংলার বামপন্থী চেতনা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস আজও শক্তিশালী প্রতিরোধের প্রাচীর। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে এই সমস্ত উপাদানকে সমাবেশিত ও সমন্বিত করে বাংলার মাটিতে বিজেপিকে আবার বিচ্ছিন্ন করতে হবে। বিধানসভার বাইরে জনগণের যাবতীয় সংকটে ও গণতন্ত্রের প্রতিটি প্রশ্নে গণউদ্যোগ ও গণআন্দোলনের ময়দানে বামপন্থীদের সংগ্রামী ভূমিকাকে উজ্জীবিত করে তুলে বিধানসভায় বামপন্থীদের অনুপস্থিতিকে ছাপিয়ে যেতে হবে।
পেট্রোপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের দায় থেকে কেন্দ্রীয় সরকার সরে আসায় মোদী জমানায় রিলায়েন্স সহ তেল কোম্পানিগুলির আয় বেড়েছে বিদ্যুৎ গতিতে। মোদী জমানায় পেট্রোলের দাম বেড়েছে ২৪০ শতাংশ আর ডিজেলের দাম বেড়েছে ৭৯৪ শতাংশ। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম যখন নিম্নমুখী তখন এ দেশে শুধু মে-জুন মাসেই তেল কোম্পানিগুলি ২৫ বার দাম বাড়িয়েছে। করোনা অতিমারিতে লকডাউনে বন্দি দেশবাসীর যখন সর্বনাশ তখন আম্বানি-আদানিদের পোষ মাস। মূল্যবৃদ্ধির সামান্যতম সুরাহা করার পরিবর্তে মোদী সরকার তেলের উৎপাদন শুল্ক ক্রমাগত বাড়িয়েই চলেছে। মূল্যবৃদ্ধির এই চরম জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে পার্টির আহ্বানে ২২ জুন রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি হুগলী জেলাতেও যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে পালিত হয়।
সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় কর্মসূচিটি অনুষ্ঠিত হয় জেলার সদর শহর চুঁচুড়ার কেন্দ্রস্থল আখনবাজারে। বেলা সাড়ে দশটায় শুরু হওয়া ব্যানার, পোস্টার, লাল ঝান্ডায় সুসজ্জিত এই কর্মসূচি শহরবাসীকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে। লকডাউনে নানা অসুবিধা সত্বেও ভালো সংখ্যক কর্মী-সমর্থক করোনা বিধি মেনে কর্মসূচিতে সামিল হন। চটকল ও নির্মাণ শ্রমিকদের সাথে সাথে সদ্যগঠিত বাস শ্রমিক সংগঠনের কর্মীরাও মূল্যবৃদ্ধি রোধের দাবিতে শ্লোগানে গলা মেলান। আখনবাজারের মূল বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটি সদস্য ভিয়েৎ ব্যানার্জী, গণ নেতা সনৎ রায়চৌধুরী, সুদর্শন বসু ও বাস শ্রমিক সংগঠক আকবর হোসেন। বিক্ষোভ সভা শেষে এক মিছিল ঘড়ি মোড় হয়ে বাস টার্মিনাসে শেষ হয়। বাস টার্মিনাসে সংক্ষিপ্ত সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য সদস্য চৈতালি সেন, শ্রমিক নেতা সুদর্শন প্রসাদ সিং ও বর্ষীয়ান পার্টি নেতা কল্যাণ সেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার ও অন্যতম জেলা নেতা বটকৃষ্ণ দাস উপস্থিত ছিলেন।
জেলার শহরাঞ্চলের দ্বিতীয় বিক্ষোভ সভাটি অনুষ্ঠিত হয় বেলা পৌনে এগারটায় হিন্দমোটর বিপিন ভিলা মোড়ে। ‘তেলের দাম লাগামছাড়া, নরেন্দ্র মোদী হতচ্ছাড়া’, ‘মন কি বাতের ভাঁওতা ছাড়ো,মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর’ – ইত্যাদি শ্লোগান তুলে পার্টির যুব কর্মীরা সভাস্থল মাতিয়ে তোলেন। সভায় মুখ্য বক্তা ছিলেন পার্টির তরুণ জেলা কমিটি সদস্য সৌরভ রায়। তিনি তাঁর বক্তব্যে বপেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মোদী সরকারকে দায়ী করার সাথে সাথে মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণ নীতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং করোনা কালে সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের নগদ অর্থ প্রদান ও শ্রমিক বিরোধী ৪টি শ্রম কোড প্রত্যাহারের দাবি জানান।বিক্ষোভ সভায় উপস্থিত নেতৃত্বের মধ্যে প্রদীপ সরকার, সুজয় দে, স্বপন মজুমদার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
গ্রামাঞ্চলে দুটি জায়গা যথাক্রমে পান্ডুয়া ও ধনেখালিতেও বিক্ষোভ কর্মসূচি যথেষ্ট সাড়া ফেলে। পান্ডুয়ায় বেলা পৌনে বারটায় মেলাতলার পার্শবর্তী ইন্ডিয়ান অয়েলের পেট্রোল পাম্পের সামনে প্রতীকী বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ব্যানার ও পোস্টারে সজ্জিত এই কর্মসূচিতে বেশ কয়েকজন মেহনতী ঘরের তরুণ ছাত্রদের উপস্থিতি কর্মসূচিকে উজ্জ্বল করে তোলে। ডিজেলসহ পোট্রোপণ্যের ওপর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চাপানো সমস্ত কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এখানে বক্তব্য রাখেন পার্টির পান্ডুয়া ব্লক সম্পাদক মুকুল কুমার। তিনি ২০০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাস বহুল সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প বাতিল করে সেই অর্থ করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতিতে খরচ করা এবং লকডাউন পর্বে ভুখা মানুষকে অনাহারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মাসিক ৩০০০ টাকা নগদ অর্থ প্রদানের দাবিকেও তুলে ধরেন।
ধনেখালি গঞ্জে এই দিন সকালে মদন মোহন তলা থেকে সিনেমাতলা পর্যন্ত এক মিছিল সংগঠিত করা হয়। এর পর নিকটবর্তী পেট্রোল পাম্পের সামনে এক প্রতীকী বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানানোর সাথে সাথে এখানে করোনা চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা ও দ্রুত সর্বজনীন টিকাকরণেরও দাবি জানানো হয়।কর্মসূচিটির নেতৃত্বে ছিলেন সজল অধিকারী, সজল দে, পাগান মুর্মু, গোপাল রায়, শৈলেন মাঝি, রুমা আহিরি প্রমুখ নেতা-নেত্রীরা।
– মুকুল কুমার
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, দুয়ারে রেশনের জন্য আধার ও রেশন কার্ড লিঙ্ক বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে, সবার জন্য রেশনের দাবিতে কামারহাটি পৌরসভার সামনে বিক্ষোভ অবস্থান হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়াও কামারহাটি পৌর প্রশাসককে নিম্নলিখিত দাবি সহ স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
১) কামারহাটি পৌরসভার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বৃষ্টিতে জল জমছে। নিকাশি ড্রেনের অব্যাবস্থাই এরজন্য দায়ী।
২) জমা জলে মশা থেকে ডেঙ্গি হওয়ার সম্ভবনা আছে। মশা মারার দ্রুত ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।
৩) আমরা জানি কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতার জন্য কোভিড ভ্যাকসিনের অভাব আছে, তা সত্ত্বেও আপনার কাছে অনুরোধ বরিষ্ঠ নাগরিকদের বাড়িতে গিয়ে টিকাকরণের ব্যবস্থা করা।
৪) প্রবর্তক জুট মিল বন্ধ, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে হোশিয়ারি, ব্যাগ, অটো, টোটো, রিক্সা চালক সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিড়াট সংখ্যক মানুষ অর্ধাহার, অনাহারে আছেন, তাদের জন্য যদি কিছু সাহায্য করা যায়।
৫) কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি আইন, নতুন শিক্ষানীতি, শ্রমকোড, সেইল অফিস তুলে দেওয়ার আমরা প্রতিবাদ করছি।
আশাকরি আপনি বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।
পেট্রোল ডিজেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজ্যব্যাপী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে দঃ ২৪ পরগণার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। দঃ ২৪ পরগণা জেলা অফিসের সামনে সংগঠিত কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকার। উপস্থিত ছিলেন কমরেড অঞ্জন ঘোষ, কমরেড দেবাশীষ মিত্র, যুবনেতা কমরেড সেখ সাবির (রাজা) সহ আরো অনেকে। বজবজ গ্রামাঞ্চলে দু-জায়গায় কর্মসূচি সংগঠিত হন। উপস্থিত ছিলেন গ্রাম লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড ইন্দ্রজিৎ দত্ত, জেলা নেত্রী কমরেড দেবযানী গোস্বামী সহ আরো অনেকে। দুটি স্থানেই মহিলা কমরেডদের নজরকাড়া উপস্থিতি চোখে পড়ে। পূজালী অঞ্চলে যুবনেতা কমরেড আশুতোষ মালিকের নেতৃত্বে কর্মসূচি সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলানেত্রী কমরেড অঞ্জনা মাল। বাখরাহাটে বিবিরহাট পেট্রোল পাম্পে কর্মসূচি সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা নেতা কমরেড দিলীপ পাল, কমরেড নিখিলেশ পাল সহ আরো অনেকে।
২২ জুন রাজ্যের অন্যান্য জায়গার সাথে শিলিগুড়ি শহরের হাশমিচকে পেট্রোপণ্যের ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, কোভিড চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর জিএসটি লাগু করা, সেইল সংস্থার আর.এম অফিস রাজ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণ, আয়কর বহির্ভূত শ্রমজীবি পরিবারগুলিকে মাসিক ৭,৫০০ টাকা কোভিড ভাতা প্রদানের দাবিতে বিক্ষোভ দেখানো হয়। বিক্ষোভ কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য কমিটির সদস্য বাসুদেব বোস, মোজাম্মেল হক, গৌতম চক্রবর্তী, মীরা চতুর্বেদী, দীনবন্ধু দাস, অর্ধেন্দু চতুর্বেদী, শাশ্বতী সেনগুপ্ত প্রমুখ। বিক্ষোভে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বোস। বিক্ষোভ চলাকালীন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জেলা সম্পাদক বলেন কোভিড মহামারী দ্বিতীয় পর্যায়ে মানুষের যখন না খেতে পেয়ে কাজ না পেয়ে দিশেহারা অবস্থান মধ্যে আছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের এ ধরনের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। এবং উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়ার যে দাবি রাজ্য বিজেপির একাংশ করে চলেছে, সেই বিভেদকামী সিদ্ধান্তর বিরুদ্ধে জনগণকে সামিল করে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালানো হবে।
২২ জুন পেট্রল ডিজেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মুল্য বৃদ্ধি ও অন্যান্য দাবিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এর রাজ্য কমিটির আহ্বানে রাজ্য জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয় ।
পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের কুসুমগ্রাম বাজারে সকাল ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত করোনা বিধিনিষেধ মেনেই বিক্ষোভ সংগঠিত করা হল। প্লাকার্ড পতাকা হাতে শ্লোগান ও বক্তব্য রাখার মাধ্যমে জনগণের সামনে দাবি গুলো তুলে ধরা হয়। বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড আনসারুল আমন মন্ডল। মানুষ উৎসাহ নিয়ে বক্তব্য শোনেন। কুসুমগ্রাম বাজারে ভালো প্রভাব পড়ে। দাবি ছিল পেট্রোল ডিজেল এর দাম বাড়ানো হচ্ছে কেন কেন্দ্রীয় সরকার জবাব দাও। অবিলম্বে গামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলিতে বিনা মুল্যে প্রতিটি মানুষের ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ।মাথাপিছু রেশনে ১০কেজি চাল/গম সহ ডাল তেল আলু সব্জি দিতে হবে। বছরে ২০০ দিন কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। পরিবার পিছু মাসিক ৭৫০০টাকা করোনা ভাতা দিতে হবে। প্রতিটি জবকার্ডধারীকে ৫০ দিনের মজুরি অনুদান হিসেবে দিতে হবে । মোট ১৬টি দাবি তুলে ধরা হয়।
কালনা ২ নং ব্লকের শিরিষ তলা বাস স্ট্যান্ডে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এর কালনা লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ সংগঠিত করা হল। বিক্ষোভে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর কালনা লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রফিকুল ইসলাম ।
পূর্বস্থলী ২নং ব্লক এর ফলেয়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় পুর্বস্থলী এরিয়া কমিটির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়। বিক্ষোভে বক্তব্য রাখেন এরিয়া কমিটির সম্পাদক কমরেড শিবু সাঁতরা। প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয় মেমারী ১নং ব্লকের নিমো বটতলা, সদর ১নং ব্লকের বন্ডুল বাজার, পূর্বস্থলী ১নং ব্লকের ইসলামপুর গ্রামে ও কাটোয়া ২নং ব্লক-এর সাহাপুর গ্রামে।
১৭ জুন দেশ জুড়ে আর ওয়াইএর ডাকে “সবার জন্য রোজগার ও সবার জন্য স্বাস্থ্য” এই দাবিতে দাবি দিবস পালন করা হয়। তারই অংশ হিসেবে পূর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া স্টেশনে, মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট ও মুরুলিয়া গ্রাম, কালনা ২নং ব্লকের বৈদ্যিপুর ও মেমারী ১নং ব্লকের নিমোতে দাবি দিবস পালন করা হয়।
২০ জুন করোনা মহামারীতে মৃত স্বজন হারানোর স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে বর্ধমান শহর, কালনা ২নং ব্লক, মেমারী ১নং ব্লক, সদর ২নং ব্লক, মন্তেশ্বর ও পূর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়ায় স্মরণ অনুষ্ঠান করা হল ।
কালনা ২নং ব্লকের অকালপোষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ ঝিকরা বাজিতপুর গ্রামের দুই শতাধিক মানুষ গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজের জন্য আবেদন করেন ১৫ দিনের বেশি হয়ে গেল। কিন্ত কাজ দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে না। করোনার বিধিনিষেধ আরোপ এর ফলে গ্রামে গরীব মানুষের কোনও কাজ নেই, চরম অর্থনৈতিক সংকট চলছে। অথচ বার বার অনুরোধ করেও কাজ পাচ্ছেন না মানুষ। তাই বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
২১ জুন আগ্রাদহ গ্রামের বাস স্ট্যান্ড এলাকায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও আয়ালার পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করা হয়। মিছিলে গ্রামের গরীব মেহনতীদের ভালো অংশগ্রহণ ছিল। মিছিল গ্রামে ভালো প্রভাব বিস্তার করে।
কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েক দিন আগেই ১৫ জুন পর্যন্ত সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে করোনার ২য় ঢেউ গ্রামাঞ্চলে ছড়ানোয় কাজের চাহিদা কমেছে। আসলে মানুষের থেকে কাজের আবেদনই গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাই এই ধরনের সমীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়ে মানুষকে বঞ্চিত করার চক্রান্ত করছে। কাজের আবেদন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেই কাজের দাবির লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা কমিটি ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা কমিটির উদ্যোগে গত ২১ জুন ইয়াস ঝড়-বিধ্বস্ত ও তার সাথে গঙ্গার বাঁধ ভেঙ্গে জলপ্লাবনে বিপর্যস্ত গ্ৰামে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। জায়গাটি কুলতলি থানার জয়নগর ২ ব্লকের অন্তর্ভুক্ত সোনা টিকারি গ্রাম পঞ্চায়েতের নলগোড়া গ্রাম। প্রায় ১০০ জন মহিলা উপস্থিত ছিলেন। এদের বেশিরভাগ চাষবাস করেন, অনেকে মাছ ধরেন, কেউ চাষের সব্জি নিয়ে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান। এই মহিলারা বারে বারে বোঝাতে চাইছিলেন কী করুণ অবস্থা তাদের। নোনা জল ঢুকে বাড়িঘর, চাষজমি সব ভেসে গেছে। সামনের স্কুল বাড়িতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। ওরা বললেন, “সরকারি কোন ত্রাণ এখনো আসেনি। দু-এক বার দেখে গেছে মাত্র। আপনারাই প্রথম এলেন।” আমরা যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম সেটি এত খারাপ যে গাড়ি প্রায় উল্টে যাচ্ছিল। মাটির রাস্তা। অবহেলিত গ্ৰাম বলতে যা বোঝায়। দু-ধারে ধান জমি সব জলে ডোবা। যারা ত্রাণ নিতে এসেছেন কারও মুখে মাস্ক নেই। ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে একটা দেশলাই পর্যন্ত দিতে হল। সেটাও ওদের ছিল না। সরকার নাকি এত ব্যবস্থা করেছে! অথচ ওদের প্রায় সব শেষ হয়ে গেছে। যত গ্ৰামের ভিতর ঢোকা যাবে তত করুণ অবস্থা চোখে পড়বে। মাঠ থেকে যে শাক তুলে খাবে সেও জলে ডুবে গেছে। এত নোনা জল ঢুকেছে যে আগামীদিনে কী করে চাষ করবেন ওরা জানেন না। সরকার উন্নয়নের দায়িত্ব তার আমলাদের হাতে তুলে দিয়েছে। গ্ৰামের মহিলারা ভোট দেবেন উন্নয়নের আশা করে আর নিজের ভাগ্যকে ভগবানের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। এই তো দেশের মহিলাদের অবস্থা!
ত্রাণ কাজে উপস্থিত ছিলেন মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত, কাজল দত্ত, দেবযানী গোস্বামী ও লোকাল কমিটির নেত্রী সুলেখা পাল, পূর্ণিমা হালদার, রেখা ও ছাত্রী অনিন্দিতা।
- কাজল দত্ত
উত্তরপ্রদেশে দুর্বৃত্ত-পুলিশ-রাজনীতি গাঁটছড়া যে কত শক্তিশালী ও গভীর তা আরও একবার প্রকট হল ‘এবিপি গঙ্গা’ ও ‘এবিপি নিউজ’এর সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক সুলভ শ্রীবাস্তবের মৃত্যুতে। উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ের এই সাংবাদিক গত ১৩ জুন কাজ সেরে রাত ১১টার সময় বাড়ি ফিরছিলেন। কিন্তু এক ইটভাটার কাছে তাঁর মুখ থেঁতলানো দেহ ও পাশে মোটর সাইকেল পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্থানীয় মানুষদের সাহায্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। পুলিশ প্রথমে বলে, শ্রীবাস্তবের মৃত্যুর কারণ একটা দুর্ঘটনা। একটা টিউব ওয়েলের সঙ্গে তাঁর মোটর বাইকের ধাক্কা লেগেই নাকি ঐ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এবং তাদের দুর্ঘটনার সিদ্ধান্তকে জোরালো করতে পুলিশ এই ইঙ্গিতও দেয় যে, সেদিন বাড়ি ফেরার আগে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মদ্যপানও করেছিলেন। কিন্তু পরদিন সুলভ শ্রীবাস্তবের স্ত্রী রেণুকা শ্রীবাস্তব মদ-মাফিয়াদের হাতেই তাঁর স্বামী খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ করায় পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে খুনের এফআইআর দায়ের করে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণও খুনেরই সংকেত দেয়। তাঁর মুখ যেমন থেঁতলানো ছিল, তেমনই জামা ও প্যান্টও খোলা ছিল, নিছক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যা হওয়ার নয়।
মদ মাফিয়াদের হাতে শ্রীবাস্তবের খুনের অভিযোগ এই কারণেই উঠছে যে, কয়েকদিন আগেই তিনি মদ-মাফিয়াদের নিয়ে লেখার পর থেকেই তাদের কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছিলেন। সেকথা তিনি পুলিশকে জানিয়েও ছিলেন। এলাহাবাদ জোনের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল প্রেম প্রকাশকে হিন্দিতে লেখা চিঠিতে তিনি জানান, “আমি আমার সূত্রর কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে, মদ-মাফিয়ারা আমার ওপর অসন্তুষ্ট। গত দু’দিন ধরে যখনই আমি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, মনে হচ্ছে যে কেউ আমার পিছু নিচ্ছে। আমার আশঙ্কা, মদ-মাফিয়া আমার বা আমার পরিবারের ক্ষতি করতে পারে।” মদ-মাফিয়াদের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশ সর্বজনবিদিত। এই অভিযোগ পাওয়ার পরও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, তাঁকে সুরক্ষাও জোগায়নি।
শ্রীবাস্তবের মৃত্যুর দিন পনের আগে বিষাক্ত মদ খেয়ে আলিগড়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেই ঘটনা থেকে অবৈধ মদ ব্যবসা নিয়ে চর্চায় উঠে আসে মদ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী এক কার্টেলের কথা। এবং এটাও প্রকাশ পায় যে এই কার্টেল পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। সেই কার্টেলের মূল মাথা বা চাঁই হিসাবে সামনে এসেছে অনিল চৌধুরী ও ঋষি শর্মার নাম। এরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভূত শক্তিশালী। অবৈধ মদ ব্যবসায় যুক্ত থাকার জন্য কয়েক বছর আগে এরা ধরাও পড়েছিল, গুণ্ডা দমন আইন, রাজ্য আবগারি শুল্ক আইন ও অন্যান্য আইন এদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয়েছিল। কিন্তু এদের রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রতিপত্তির হাত এতই লম্বা যে প্রশাসন ও আইনকে তাদের প্রভাব ও ওপরতলার সঙ্গে তাদের সংযোগের কাছে বশীভূত হতে হয়। এরা এবং এদের স্ত্রীরা কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত উত্তরপ্রদেশ পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়, বিজেপি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠতা এবং বিজেপি নেতাদের সঙ্গে এদের গলাগলি হওয়ার ছবিও সামনে আসে। মদ-মাফিয়াদের নিয়ে চর্চায় এই অভিমতও উঠে আসে যে, ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে অবৈধ মদ ব্যবসা চলছে, সেই দেড় দশকেরও বেশি সময়কালে লক্ষ্ণৌয় চলা বিভিন্ন সরকার ও শাসক দলগুলোর রাজনীতিবিদদের মদত ছাড়া তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে লক্ষ্ণৌয় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পর ‘এনকাউন্টার’ তথা পুলিশের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সংঘর্ষকে দুর্বৃত্ত দমনের কৌশল বলে জাহির করতেন। সাংবাদিকদের সামনে যোগী দম্ভ ভরে ঘোষণা করতেন – এধরনের কত হাজার সংঘর্ষ পুলিশ চালিয়েছে, কত সংখ্যক দুর্বৃত্ত নিহত হয়েছে, কত শতকে আহত করা হয়েছে এবং কত হাজারকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে। তবে, যোগীর দম্ভকে ম্লান করে মাঝেমধ্যেই দুর্বৃত্ত দাপটের আখ্যান মঞ্চস্থ হত উত্তরপ্রদেশের নানান অকুস্থলে। যেমন, বিকাশ দুবে আখ্যান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে ও মদতে এই দুর্বৃত্ত শিরোমণির প্রতাপ মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে এবং সে প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বছরখানেক আগে তার সাঙ্গপাঙ্গরা যখন গুলিতে ঝাঁঝরা করে এক ডিএসপি সহ আট পুলিশ কর্মীকে হত্যা করে, সে সময় পুলিশের হানাদারিতে আসার খবর তাদের কাছে পাচার করেছিল পুলিশ-প্রশাসনের লোকজনই। এবং আত্মসমর্পণের পর যখন তাকে নিয়ে আসা গাড়ির উল্টে যাওয়া, তার পালানোর চেষ্টা এবং ফলে পুলিশের গুলিতে তার নিহত হওয়ার আখ্যান নির্মিত হল, তখনও কথাটা উঠেছিল যে – ওপরতলার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও আদানপ্রদানের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়াকে আটকাতেই তাকে নিকেশ করা হয়েছিল।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন তথা দুর্বৃত্ত-পুলিশ-রাজনীতিবিদ গাঁটছড়া আজ ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। চলতি অর্থনীতির আঁতুরঘড়েই তার জন্ম, ফলে তার অপ্রতিহতভাবে সচল থাকা। উত্তরপ্রদেশের আধিপত্যকারী রাজনীতির চলতি ধারা, তার জোরালো সামন্ততান্ত্রিক অনুষঙ্গ, সাম্প্রদায়িক অভিমুখ, তাতে জাতপাতবাদী উপাদানের জোরালো উপস্থিতি রাজ্যটাকে দুর্বৃত্ত সক্রিয়তার স্বর্গরাজ্য করে তুলেছে। সাংবাদিক সুলভ শ্রীবাস্তবের রহস্যজনক মৃত্যু যেমন দুর্বৃত্ত দমনের যোগী দাবির অসারতাকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তেমনি এই বিষয়টাকেও জানিয়ে দিল যে – অপরাধ জগৎ ও রাজনীতির জগৎ পরস্পরকে পুষ্ট করছে এবং করে চলবে।
২০ জুন ত্রিপুরায় ভোরবেলায় চাম্পাহাওয়র থানা এলাকা থেকে তিনজন যুবক পাঁচটি গরু নিয়ে একটি বোলেরো গাড়িতে করে আসছিল। গাড়িটি যখন মুঙ্গীয়াকামী থানার উত্তর মহারানীপুরে আসে, তখন একদল জনতা গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সন্দেহে গাড়িটিকে আটক করে। এই গাড়ি থেকে পাঁচটি গরু উদ্ধার করে এবং তিনজন যুবককে গরু চোর সন্দেহে আটক করে। স্থানীয় একদল জনতা ক্রুদ্ধ হয়ে বিচার বহির্ভূতভাবে ঐ তিনজন যুবককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে, দু’জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। একজন হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়। চিকিৎসার কোন সুযোগ মেলেনি। মৃত তিনজন হলেন জায়েদ হোসেন (২৮ বছর), গ্রাম রাঙ্গামাটি; বিল্লাল মিঞা (৩০ বছর), গ্রাম শ্রীমন্তপুর; সাইফুল ইসলাম (১৮ বছর), গ্রাম বড়দুয়াল, সোনামুড়া মহকুমা।
এটা একটা আইন ও বিচার বহির্ভূত সংগঠিত হত্যাকান্ড। দেশে আইনের শাসন দুর্বল হলেই একমাত্র এভাবে একদল মানুষ ইচ্ছামত কাউকে ‘দোষী সাব্যস্ত’ করে খুন করে শাস্তি দিতে পারে। বার বার এইধরনের হত্যার ঘটনা ঘটছে। তাই ত্রিপুরায় সবার আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হাইকোর্টের একজন কর্মরত বিচারপতির তত্বাবধানে এই হত্যাকান্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। এই হত্যাকান্ডে জড়িত দোষী ও খুনীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। মৃতদের পরিবারকে দশ লক্ষ টাকা করে সরকারী আর্থিক সাহায্য করতে হবে। বিচার বহির্ভুত হত্যা রোধে প্রয়োজনীয় আইন প্রনয়ণ করতে হবে। এই দাবিগুচ্ছ তুলেছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি।
পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট গত ২ জুন তারিখে একটি প্রশংসনীয় পর্যবেক্ষণ করেছেন। ডিভোর্সের পর বাচ্চার কাস্টডি কার হাতে থাকবে, সেই সংক্রান্ত এক মামলায় অনুপিন্দর সিং গ্রেওয়াওলের বেঞ্চ বলেছে, এমনকি যদি মায়ের অন্য সম্পর্কও থাকে, তাহলেও তিনি খারাপ মা হয়ে যান না। এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল দু-তিন বছর আগে৷ দম্পতি অস্ট্রেলিয়ার থাকতেন। মা স্বাবলম্বী। তিনি ২০১৯ সালে থেকেই ডিভোর্স চাইছেন। বাবা জোর করে বাচ্চাকে নিয়ে যান। এখন বাবার বক্তব্য, মায়ের অন্য সম্পর্ক আছে। তিনি বাচ্চাকে সময় দেবেন কী করে? আদালত বলেছে – ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর নৈতিক চরিত্রের প্রতি আঙুল তোলা সোজা। অনেক ক্ষেত্রেই সেই দোষারোপ ভিত্তিহীন। আর যদি সত্যিই কারও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক থাকে, তাহলেও এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে তাঁকে সন্তানের কাস্টডি দেওয়া যাবে না।’
ভারতীয় প্রেক্ষিতে এমন পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যুগ যুগ ধরে এখানে আদালতে মায়ের অন্য সম্পর্ক সন্তানের কাস্টডি হারানোর অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ আমাদের সুযোগ দেয় মাতৃত্ব নিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারণাটি ফিরে দেখার।
রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় শিশুপুত্রের কল্পনায় মা হল অসহায় নারী, যাকে শিশু হয়েও পুত্রটি উদ্ধার করতে চায়। ‘মনে পড়া’ কবিতায় মায়ের সঙ্গে পবিত্রতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। পুজোর গন্ধে, আশ্বিনের শিউলি বনে, ভোরের শিশিরে মায়ের উপস্থিতি। নজরুল ‘মা’ কবিতায় বলেন, ‘হেরিলে মায়ের মুখ, দূরে যায় সব দুখ/ মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরাণ।’ মায়ের ডাকে বিদ্যাসাগরের জীবন বাজি রেখে ভরা দামোদার সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার অতিরঞ্জিত গাল-গল্প তৈরি হয়ে যায় সহজেই।
অর্থাৎ সমাজ-সংস্কৃতিই শেখায়, মা হবেন নিঃস্বার্থ, পবিত্র, ছায়াদায়ী, কিন্তু অসহায়। মহত্ত্বের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে নীরব নির্যাতন। অথচ বাস্তবে তাঁরও আছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, জৈবিক চাহিদা। অনেক বিধবা এবং ডিভোর্সী নারী আজও দ্বিতীয় বিয়ে করেন না সন্তানের মুখ চেয়ে। আবার অনেকে সন্তানের কারণে আজীবন গৃহহিংসা সহ্য করেন। নিজের আলাদা সত্তার ডাক মা এড়িয়ে যান লোকনিন্দার ভয়ে।
এই সামাজিক পাঠ নিতে নিতে আপামর নারী শেখে, ‘ভালো মা’ হয়ে ওঠাই মোক্ষ৷ এই দীক্ষা কি পিতৃতন্ত্রের সুবিধার্থে নয়? আড্রিয়ান রিচ ‘অফ উওম্যান বর্ন’-এ ‘ভালো মা’ নামক সামাজিক নির্মাণটির কাটাছেঁড়া করেন। বলেন, ধনী মা ও দরিদ্র মা, বিবাহিত মা ও একাকী মা — এদের পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতা সমান নয়। তাদের থেকে একই সামাজিক প্রত্যাশা কেন?
ষাটের দশকেই বেটি ফ্রিড্যান ‘ফেমিনাইন মিস্টিক’-এ বলেছিলেন, ‘ভালো মা-র সংজ্ঞার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মাতৃত্বের বাইরে অন্য সব পরিচিতি হারিয়ে ফেলেন নারী। যেন তাঁর অন্য কোনো লক্ষ্য, ইচ্ছা বা চাহিদা নেই।’ পরিবার টিকিয়ে রাখতে এই মাতৃত্বের ধারণা জরুরি। এঙ্গেলস ‘অন অরিজিন অফ ফ্যামিলি, প্রাইভেট, প্রপার্টি অ্যান্ড স্টেট’-এ বলেছেন, বংশ পরম্পরায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা নিশ্চিত করতেই সন্তানের মাতৃপরিচয়ের বদলে পিতৃপরিচয়কে আবশ্যিক করা হয়। একগামিতা চালু হয়। নারীর স্বাধীনতা খর্ব হয়।
‘ভালো মা’— অর্থাৎ নম্র, সহনশীল, সর্বগুণসম্পন্না, বিষমকামী কিন্তু প্রায় অযৌন এক মূর্তি-র আদর্শে পৌঁছতে গিয়ে নারীদের মধ্যে সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে। নারীরাই মা হিসেবে অন্য নারীর ব্যর্থতা বিচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বুকে যথেষ্ট দুধ আসছে কিনা, ঠিক মতো সন্তানকে খাওয়ানো-নাওয়ানো হচ্ছে কিনা, সে বিচারে মেয়েদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন মেয়েরাই। পরবর্তী কালে সে দায়িত্ব নেয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি — যেমন, বাচ্চার স্কুল, আদালত বা সংবাদ মাধ্যম। পার্ক স্ট্রীটে সুজেট জর্ডন যখন ধর্ষিতা হয়েছিলেন, তখন গণমাধ্যম আলোচনা করেছিল, দুই সন্তানের মায়ের বার-এ যাওয়া উচিত কিনা। ডিভোর্সী নারী বিবাহ নামক ‘পবিত্র’ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে একেই সমাজের বিরাগভাজন। সেই নারীর শুদ্ধিকরণের শেষ উপায় ‘আদর্শ মা’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা। সেই মা যখন বার-এ যান, তখন তিনি ধর্ষিতা হলেও সমাজ সহমর্মিতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। একই মানসিকতা কাজ করে ডিভোর্সের কাস্টডির মামলায়। আদালত মেপে দেখে, মায়ের জীবনযাত্রা শৃঙখলাবদ্ধ তো? সর্বোপরি তাঁর কোনো ছেলে বন্ধু বা স্বতন্ত্র যৌন জীবন নেই তো?
পাশ্চাত্যে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আইন নারীর পক্ষেই থাকে। রাষ্ট্রের দায় থাকে সিঙ্গল মায়ের সন্তানের প্রতি। গৃহহিংসার আইনেও নারীর স্বার্থকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, উক্ত পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টের কেসে আলোচ্য মা যেহেতু অস্ট্রেলিয়াবাসী, তাই পাঞ্জাব হাইকোর্ট উল্লেখ করেছে যে, অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুসারে রাষ্ট্র বাচ্চার জন্য একলা মাকে অনুদান দেবে। তদুপরি মা চাকুরিরতা, তাই সন্তানের ভরণপোষণে সমস্যা হবে না। অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে, আইন কেন নারীবান্ধব হবে? এ কি পক্ষপাত? নারী ও পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনও। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন রাষ্ট্র ও আইন নারীদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব নেবে, এটাই স্বাভাবিক৷ আমাদের দেশে আইন যতটা নারীবান্ধব হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। অথচ ৪৯৮ক-এর একটি দুটি অপব্যবহারের নিদর্শন দেখিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজবোদ্ধারা ‘হায় হায়’ রব তোলেন।
মাতৃত্বের ধারণায় আছে লিঙ্গভিত্তিক শ্রমের বাধ্যবাধকতা। ধরে নেওয়া হয়, মায়ের কাজ প্রতিপালন, আর বাবার কাজ সেই প্রতিপালনে আর্থিক সহায়তা। নতুন সময়ে মা ‘বাইরের কাজ’-এ অংশ নিয়েছেন, অর্থাৎ উপার্জনশীল হয়েছেন৷ কিন্তু ‘বাড়ির কাজ’, অর্থাৎ প্রতিপালনের দায়িত্ব ভাগ হয়নি সব ক্ষেত্রে। যেহেতু আদালতের মাথাতেও লিঙ্গনির্ধারিত শ্রমের ধারণা গাঁথা, তাই মা চাইলে তাঁকে ‘অপেক্ষাকৃত যোগ্যতর পালিকা’ ভেবে আদালত সচরাচর তাঁর হাতেই বাচ্চাদের সমর্পণ করে। আবার ওই একই কারণে আদালত আশা করে যে সেই মা হবেন হিন্দি সিনেমার নিরূপা রায়ের মতো। উপার্জনশীল হলেও তাঁর ‘ব্যস্ত’ হওয়া চলবে না। ‘মা খুব ব্যস্ত’ — এটাকেও বিপক্ষের উকিল ‘যুক্তি’ হিসেবে খাড়া করেন অনেক ক্ষেত্রে৷ আর মায়ের অন্য সম্পর্ক অবশ্যই থাকা চলবে না। পিতৃতন্ত্রে সন্তানহীন নারী নিন্দার্হ, কিন্তু ‘খারাপ মা’ আরও নিন্দনীয়।
ডিভোর্সকামী অনেক মেয়েকে তাই এখনও ট্রমার মধ্যে দেখি যে, হয়ত প্রতিশোধস্পৃহাতেই বর ‘বাচ্চাকে কেড়ে নেবে’ এরকম নানা সত্য-মিথ্যা যুক্তি সাজিয়ে। এ কারণেই বিচারব্যবস্থার অনেক হতাশাজনক রায়ের মধ্যে কোনো বিচারকের এহেন পর্যবেক্ষণ এক টুকরো আশার আলো। ক্রমশ হয়ত এই ধারণাও স্পষ্ট হবে যে মাতৃত্ব একটা চয়েস, মোক্ষ নয়। যারা সন্তান চাইছে, যারা চাইছে না, যারা এই মুহূর্তে চাইছে না, যারা শারীরিক কারণে পেরে উঠছে না, যারা নিজস্বতা বজায় রেখেই একলা মা হতে চাইছে — তাদের সকলের পাশে দাঁড়াক রাষ্ট্র।
-- শতাব্দী দাশ
(২৩ জুন নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্মদিন ছিল। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রইলো এই লেখাটি)
“ঘাটের দু ধারে বসার রোয়াক। বাঁ দিকটাতে তিনজন বসেছিল। একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে মোটা আর তিননম্বরকে দেখলেই বোঝা যায় পাগলাখ্যাঁচা। ... এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক যে, বাঁ দিকের তিনজন হল ফ্যাতাড়ু যারা গোপন একটি মন্ত্রের বলে উড়তে পারে এবং নানা ধরনের অনুষ্ঠান বা সুখের সংসারে ব্যাগড়া দিয়ে থাকে। ফ্যাতাড়ু আরও অনেক আছে। কিন্তু আপাতত এই তিনজনকে চিনলেই কাফি। ঢ্যাঙা মালটা হল মদন। ওর ফলস দাঁত পকেটে থাকে। বেঁটে কালো মোতাটা হল ডি এস। ওই নামে একটি হুইস্কি আছে – ডিরেক্টরস স্পেশাল। ওর তোবড়ানো – মচকানো ব্রিফকেসের দু পাশে নাম ও পদবির আদ্যক্ষর সাঁটা আছে যদিও পড়া কঠিন। তিন নম্বর স্যাম্পেলটা হল কবি পুরন্দর ভাট।”
পাঠকের সাথে ফ্যাতাড়ুদের নবারুণ প্রথম পরিচয় করালেন খানিকটা অনাড়ম্বর ভাবেই। কিন্তু ফ্যাতাড়ুরা ও তাদের চমকপ্রদ কার্যকলাপ (মালসাট কথাটির অর্থ মল্ল আস্ফোট বা বানরদের হাতের আস্ফালন। দ্রষ্টব্য – বাঙ্গালা ভাষার অভিধান – জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস – দ্বিতীয় খন্ড – পৃ-১৭৬২, সাহিত্য সংসদ প্রকাশনা) সমকালীন বাংলা আখ্যান সাহিত্য ও সেই পরিধি পেরিয়ে সার্বিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এমনকী সমাজতত্ত্ব রাজনীতি জগতেও সাড়ম্বর চর্চার বিষয় হয়ে উঠল অনতি বিলম্বেই। ১৯৯৯ এর শেষ মাসটিতে প্রমা পত্রিকায় প্রথমবারের জন্য ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেন নবারুণ, ‘’কাঙাল মালসাট’ এর দ্বিতীয় কিস্তি নতুন শতাব্দীর প্রথম মাসে ফ্যাতাড়ুদের পরিচয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কাঙাল মালসাট ছাড়াও বিভিন্ন ছোটগল্প সংকলনে ফ্যাতাড়ুরা এসেছে, যেমন ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক’ এ বা ‘ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক’ এ। ফ্যাতাড়ুদের বিচিত্র কার্যকলাপ এর এপিসোডিক বিবরণ সেখানে পাওয়া যাবে। আপাতত আমাদের আলোচনা ‘কাঙাল মালসাট’কে নিয়েই।
কাঙাল মালসাটে ফ্যাতাড়ুদের প্রথম উন্মোচন, যেখানে ফ্যাতাড়ু আর চাকতিদের যৌথ ফ্রন্ট ওয়ার ঘোষণা করে লালবাজার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। এর আগে নকশালবাড়ি ও সেইসূত্রে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ এর ধারণাকে নবারুণ নানাভাবে নিয়ে এসেছেন ‘হারবার্ট’ ও ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’তে। নকশালবাড়ির কিছু উল্লেখ ‘কাঙাল মালসাট’ এও আছে, কিন্তু তার খানিক অপরিকল্পিত প্রস্তুতির কথাই এখানে ইঙ্গিত করেন নবারুণ। তবে নয়া রাষ্ট্রবিপ্লবে সেখান থেকে প্রেরণা নেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্যই আছে। “নকশালদের কোনও পরিকল্পনা ছিল কি? থাকলেও আগেভাগেই তো তারা মরে গেলো”। অথবা “প্রথমে আরসিপিআই, পরে নকশাল – সবই আনপ্রিপেয়ার্ড স্ট্রাগল। অথচ স্বপ্ন দেখা তো থামেনি। সেই বন্দুক আজ আমরা হাতে হাতে, ঘরে ঘরে ...”
রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পুরোদস্তুর এক মিলিটারি স্ট্রাটেজির কথা ভাবে ফ্যাতাড়ু-চাকতি যৌথ ফ্রন্টের কমাণ্ডার মার্শাল ভদি এবং উপন্যাসের অগ্রসরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রমশ সেই পরিকল্পনার সাথে পরিচিত হই। অবশ্যই ‘কাঙাল মালসাট’ একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক উপন্যাস কিন্তু ফ্যাতাড়ু-চাকতিদের রাজনীতিটা টানা কোনও ন্যারেটিভ বা বর্ণনার মধ্য দিয়ে এখানে আভাসিত নয়। বরং চলতি রাষ্ট্র ও রাজনীতি কাঠামোর একটি পুরোদস্তুর ক্রিটিক হিসেবেই তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ। সেই রাষ্ট্র ও রাজনীতি কাঠামোর বিভিন্ন দিকগুলিকে নবারুণ উপন্যাসের বিভিন্ন পরিসরে ছড়িয়ে রাখেন। ফ্যাতাড়ুদের ডিসরাপশান অভিমুখী কার্যকলাপের সঙ্গে আখ্যানের এই প্যাটার্নটা বিশেষ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই উপন্যাস যখন লিখছেন নবারুণ তখন ভারতে নব্য উদার অর্থনীতির জমানা এক দশকের বেশি সময় অতিক্রম করে ফেলেছে। সমস্ত কিছু সহ ছোটদের খেলাধূলাকেও পণ্য বানাবার কারবার সাফল্য পেয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় রমরমিয়ে চলছে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প। “আজ বাঙালি অন্য নানা খেলার মতো ফুটবলেও কেলিয়ে পড়েছে এবং ক্রিকেট বা টেনিসে গুচ্ছের টাকা বলে বাঙালি বাপ মায়েরা বাচ্চাগুলোকে হ্যাঁচকা টানে ঘুম থেকে তুলে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নাকি হুদো হুদো কোচ, যারা বরং কোচোয়ান হলে আরও ভালো হত।”
ফ্রেডরিক জেমসন যাকে ‘কালচারাল লজিক অব লেট ক্যাপিটালিজম’ বলেছিলেন ‘পোস্টমর্ডানিজম’ নামাঙ্কিত তাঁর বিখ্যাত বইতে, তা তখন ভালোরকম ফ্যাশানেবল। দেরিদা ফুকো লাঁকা বাখতিন আদি ব্যক্তিবর্গ উচ্চারিত হন কিন্তু তাদের চিন্তার ছকভাঙা প্যাটার্নের বাইরে থাকতেই পছন্দ করে এসব আউড়ানো বুদ্ধিজীবী আজ্ঞাবহ দাসকুল। বস্তুতপক্ষে কাক কাকের মাংস খায় না এই প্রবাদকে এড়িয়ে গিয়েই সমকালীন বুদ্ধিজীবী মহল/লেখক সমাজকে নিয়ে নবারুণ ভালোরকম তামাশা করেছেন এখানে। “আজ বাঙালি কথায় কথায় সেমিনারে বাখতিন ফুকো ঝাড়ে, ভবানীপুর এলাকায় পাঞ্জাবি ও গুজরাটিদের দাপট ও রোয়াব সম্বন্ধে গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্ব আওড়ায়, বিগ ব্যাং হইতে স্মল ব্যাঙাচি সকলই তার নখের ডগায় ডগোমগো হইয়া রহিয়াছে ...” কিন্তু আসলে বুলি সর্বস্ব এরা আজ্ঞাবহ দাস বৈ অন্য কিছু নয়। পুরন্দর ভাটের কয়েকটি ‘অমোঘ লাইন’ এর মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ক্রিটিকটাকে স্যাটায়ারের বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নবারুণ
“আজ্ঞাবহ দাস, ওরে আজ্ঞাবহ দাস
সারা জীবন বাঁধলি আঁটি,
ছিঁড়লি বালের ঘাস,
আজ্ঞাবহ দাসমহাশয়, আজ্ঞাবহ দাস!
যতই তাকাস আড়ে আড়ে,
হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে,
বাম্বু ভিলার রেকটো – কিলার,
গাঁট – পাকানো বাঁশ,
আজ্ঞাবহ দাস রে আমার, আজ্ঞাবহ দাস।”
বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতাধরের সঙ্গে হাঁটার স্পৃহা ও সময় বিশেষে নিরপেক্ষ থাকার আড়ালে গা বাঁচানো মনোভাবটি নবারুণ আবার ফিরিয়ে আনেন স্বাক্ষরিত নির্বিষ সব বয়ান প্রকাশনার মধ্যে দিয়ে দায় সারার মানসিকতার সূত্রে।
“এ কথা কে না জানে কোথাও কোনো গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা কালবিলম্ব না করেই সদলবলে একটি ঘোষণাপত্র বা আবেদন বা একটি ফাঁকা থ্রেট প্রকাশ করে থাকেন যাতে বড় থেকে ছোট, শুডঢা থেকে কেঁচকি, লেখক শিল্পী, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র শিল্পী থেকে শুরু করে সকলেই সই দিয়ে নিজেরাও বাঁচেন অন্যদের বারটা বাজাবার রসদ যোগান। শুধু এই ধরনের আবেদনে বা প্রতিবাদপত্রে সই করেই অনেকে লেখক বলে নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছেন। কেউই এই ধরনের ব্যাপারে সই দেওয়া থেকে বাদ পড়তে চান না। বাদ পড়ে গেলে খচে লাল হয়ে যান।”
ফ্যাতাড়ু ও রাষ্ট্রশক্তির যুদ্ধের সময়ে তারা নাকি লিখেছিল “সংগ্রাম যেমন দরকার তেমন বিশ্রামেরও দরকার। শেষোক্ত প্রয়োজনটি আমাদের খুবই বেশি।”
উপন্যাস রচনার সমকালে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার শিল্পায়ন উন্নয়নের নতুন মডেলের কথা সোচ্চারে সামনে আনছিল। নবারুণ কিন্তু ‘ক্লাস লাইন’ থেকে সরেননি একটুকুও। শিল্পায়নের ঢক্কানিনাদ এর তলায় আসলে বহমান বি-শিল্পায়নের বাস্তব ছবিটা তুলে আনেন তিনি। উপন্যাসের সপ্তম পর্বে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এর সম্মেলন ও সেই সূত্রে ‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে নতুন জোয়ার আসছে’ এই সরকারী প্রচারকে নিয়ে রঙ্গ-তামাসা রয়েছে, রয়েছে উন্নয়নের সামগ্রিক মডেলটিকে নিয়েই তীব্র খেউড়। বস্তুতপক্ষে চাকতি ও ফ্যাতাড়ুদের দ্বারা সাবঅল্টার্ন সাবভার্সান এর ব্যাকড্রপ হিসেবে এই পলিটিকাল ক্রিটিকটাকেই ক্রমশ সামনে আনতে থাকেন নবারুণ।
“আজ চেয়ারম্যান (উক্ত ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের) শালা নার্সিংহোমে গেছে, এর পরে দেখবি কি হয়। কোনো ঢপবাজকে আমরা রেয়াত করব না। কম করে ৫০ হাজার ছোট বড় কারখানা হয় বন্ধ নয় হাঁপের টানে ধুঁকছে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই, বাড়া ডাউনস্ট্রিম মারাচ্ছে। ফরমুলা ওয়ান রেসিং! হোটেল! কার পার্কিং প্লাজা! সামলাও এবার চাকতি।”
বন্ধ কলকারখানার প্রসঙ্গ যেমন এখানে আসে, তেমনি আসে হকার উচ্ছেদ অভিযানের কথাও। আমাদের ভুলে যাবার নয় উপন্যাস রচনার কাছাকাছি সময়ে হকার উচ্ছেদ তথা ‘অপারেশন সানসাইন’ নিয়ে বিপুল আলোড়ন এর কথা।
অভিমুখ বদলের পেছনের কারণকে সামনে আনেন নবারুণ। স্পষ্টভাবেই। লেফট ফ্রন্ট সরকার নিও লিবারাল অর্থনৈতিক নীতিমালার সঙ্গে কীভাবে আস্তে আস্তে সমীকৃত হয়ে যাচ্ছে সেটা দেখান তিনি। ধরে দেন বদলে যাওয়া নেতৃত্বের চেহারাটিও। সি এম-এর মধ্যে যদি জ্যোতি বসুর ছায়া দেখি আমরা, তবে কমরেড আচার্য নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর আদলটিকে মনে করিয়ে দেয়। সমকালীন সিপিএম-এ ‘দু লাইন’-এর দ্বন্দ্বও এখানে এসেছে, এসেছে তার মধ্যে কমরেড আচার্যর দোদুল্যমান অবস্থানের কথা।
উপন্যাস রচনার সেই সময়টিতে সিপিএমের মধ্যে সমীর পুততুণ্ড, সৈফুদ্দিন চৌধুরীরা তখন প্রকাশ্যেই ‘বাধাহীন উন্নয়ন’-এর পক্ষে সওয়াল করছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলছেন। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক লাইন গ্রহণের প্রশ্নে কমরেড আচার্যর মতো অনেকেই তখন দোদুল্যমান। আসলে দক্ষিণমুখী অভিযাত্রার প্রবক্তাদের নিয়ে সাংগঠনিকভাবে কী করা হবে দ্বন্দ্ব এখানেই তো সীমিত ছিল না, পুঁজিবাদী উন্নয়নকে ব্যবহার করে নেওয়া যায় কিনা – সেই ভাবনায় কমরেড আচার্যরাও বেশ দ্বিধাগ্রস্থ তখন। পরবর্তী এক দশকের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে সে যাত্রায় দক্ষিণপন্থী অভিযাত্রীরা পার্টির বাইরে চলে গেলেও ক্রমশ উন্নততর বামফ্রন্টের নামে গোটা সরকার ও তার প্রধান নায়কেরা নিজেরাই সরবে দক্ষিণমুখী অভিযাত্রায় সামিল হয়েছেন। সে পর্ব অবশ্য উপন্যাসের আলোচ্য সীমা চোহদ্দির বাইরে। এখানে কমরেড স্ট্যালিনের সঙ্গে আধা তন্দ্রার ঘোরে থাকা কমরেড আচার্যর যে কল্প সংলাপ শুনিয়েছেন নবারুণ, তা আসলে বিপ্লবী বামপন্থা ও সংশোধনবাদী প্রবণতার মধ্যে চলমান দ্বিরালাপই।
“বিপ্লব করেছিস? কাকে বলে জানিস ? … করিস ত শালা ভোট। আর কিছু করতে পারবি বলেও ত শালা মনে হয় না। যেগুলো আলটু ফালটু গাঁইগুঁই করছে সেগুলোকে এত তোয়াজ করছিস কেন ? ...”
“গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা ওদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যেখানে দু মাস বরাদ্দ সেখানে তিন মাস ...”
“ওদের কথা বাদ দে। তর মনটা কোন দিকে? সেটা কি ঠিক করেছিস ?” ...
“কিছু তো ভেবে উঠতে পারছি না”।
“কুকুর যেভাবে বমির কাছে ফিরে যায় সেভাবেই ওরা বুর্জোয়া গলতায় গিয়ে ঢুকবে...”
কমরেড আচার্য তার দোদুল্যমানতা নিয়েও শেষমেষ সি এম-এর নির্দেশে প্রধান শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে হাজির থাকেন। ফ্যাতাড়ু চোক্তাররা তাদের কার্যকলাপ শুরু করতেই পুলিশ কমিশনারকে রাষ্ট্রযন্ত্রের যা করার তা করতে নির্দেশ দেন, কেবল মানবাধিকার কমিশনের সম্ভাব্য ফ্যাকড়াগুলি মাথায় রেখে।
নবারুণ আমাদের চেনা কথাটাই আর একবার মনে করিয়ে দেন – এই গোটা পরগাছা শ্রমজীবী ঠকানো আর্থিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখা হয় রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার প্রধান সশস্ত্র অঙ্গ পুলিশ/মিলিটারি দিয়ে। ফ্যাতাড়ু/চাকতিরা তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের কোলকাতার হেডকোয়ার্টার লালবাজার ও অন্যান্য থানাগুলির ওপর এবং তার কর্তাব্যক্তিদের ওপর ‘ওয়ার ডিক্লেয়ার’ করে। এই যুদ্ধের দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা নবারুণ বিভিন্ন পর্বে দিয়েছেন। বোমার বারুদের মশলার ভাগ থেকে ছোট পর্তুগীজ কামানের ব্যবহার, চাকতি ও ফ্যাতাড়ুদের ওড়ার ক্ষমতাকে বোমারু বিমানবাহিনী হিসেবে কাজে লাগানোর নিপুণ পরিকল্পনা, ম্যানহোলের ভেতর থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে শত্রুপক্ষকে চমকিত ও ঘায়েল করার কৌশলগুলি প্রায় গেরিলা ওয়ারফেয়ার ম্যানুয়াল থেকেই যেন নিয়ে এসে তাকে ফ্যান্টাসাইজ করেন নবারুণ।
নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের কথা এখানে আছে তার ফ্যান্টাসিধর্মিতা আমাদের চোখ এড়ায় না। কিন্তু ফ্যান্টাসি নির্মাণের মধ্যেও নবারুণ তার ‘ক্লাস লাইন’কে ধরে রাখেন। একদিকে সরকার পক্ষ থেকে যখন উন্নয়ন শিল্পায়ন-এর ফ্যান্টাসি রচনা করে মুক্ত পুঁজির লুঠেরা চরিত্রকে অবাধ বিচরণের জায়গা দেওয়া হয়, তখন তার বিপ্রতীপে নবারুণ রাষ্ট্রবিপ্লবের ফ্যান্টাসি নির্মাণ করেন নিম্নবর্গের মানুষগুলিকে তার সেনাবাহিনীর পুরোভাগে রেখে। দেখান তাদের আগ্রাসনের সামনে শেষপর্যন্ত রাষ্ট্র পিছু হটে এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে শেষমেষ আপোষরফায় বাধ্য হয়। ঘরে বাইরে পিছু হঠার বাস্তবিক সময়ে ফ্যান্টাসির জগতে হলেও রাষ্ট্রবিপ্লব পরিকল্পনার দুরন্ত বৈপ্লবিক স্পর্ধাই ‘কাঙাল মালসাট’কে বিশিষ্ট করে তোলে।
-- সৌভিক ঘোষাল
যে জমি কেনা হল ২ কোটি টাকায়, মাত্র পাঁচ মিনিট পরই তা বিক্রি হল সাড়ে আঠারো কোটি টাকায়! বলতে গেলে, চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই জমির দামে ৯০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি, পৃথিবীর কোথাও কি ঘটে? ঘটা সম্ভব? কিন্তু ঘটেছে, এ দেশেরই অযোধ্যায়। আর সন্দেহজনক, অবিশ্বাস্য এই লেনদেনে জড়িয়ে রয়েছে সংঘ পরিবার, জড়িয়ে গেছে তাদের সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি। রেজিস্ট্রি অফিসের নথি বলছে, এ বছরেরই ১৮ মার্চ সন্ধে ৭টা ১০ মিনিটে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদ তথা নির্মীয়মাণ রামমন্দিরের লাগোয়া বাগ বিজৈসী গ্ৰামের ১.২০৮ হেক্টর জমি ২ কোটি টাকা দিয়ে হরিশ পাঠক ও কুসুম পাঠকের কাছ থেকে কেনেন সুলতান আনসারি ও রবি মোহন তিওয়ারি। রেজিস্ট্রি অফিসের নথি আরও বলছে, সে দিনই সন্ধে ৭টা ১৫ মিনিটে ঐ জমি সুলতান আনসারি ও রবি মোহন তিওয়ারি বিক্রি করেছে ১.২৯ কোটি টাকার স্ট্যাম্প ডিউটি সহ ১৮ কোটি ২৯ লক্ষ টাকায়। আর, অত চড়া দামে ঐ জমি কিনল রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট। প্রসঙ্গত, রামমন্দির নির্মাণের জন্য ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট গঠন করে দেয় মোদী সরকার, যার সদস্যদের মধ্যে ১২ জনই সরকার মনোনীত। এই জমি কেলেঙ্কারি কাণ্ডে মূল পাণ্ডা হিসাবে সামনে এসেছে ট্রাস্টের সচিব চম্পৎ রায়ের নাম, যিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা। রেজিস্ট্রি অফিসের নথিতে দেখা গেছে দুটি দলিলেই (হরিশ পাঠক ও কুসুম পাঠকদের কাছ থেকে সুলতান আনসারি ও রবি মোহন তিওয়ারির কেনা জমির দলিলে এবং ট্রাস্টকে তাদের বিক্রি করা জমির দলিলে) সাক্ষী হিসাবে সই রয়েছে আরএসএস নেতা অনিল কুমার মিশ্র এবং অযোধ্যার মেয়র বিজেপি নেতা ঋষিকেশ উপাধ্যায়ের। অনিল মিশ্র এবং ঋষিকেশ উপাধ্যায় দুজনেই নরেন্দ্র মোদী ঘনিষ্ঠ বলে চর্চায় উঠে এসেছে। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের কেনা এটাই একমাত্র জমি নয় যাতে দুর্নীতির গন্ধ রয়েছে। এই ধরনের জমি ট্রাস্ট আরও কিনেছে, যার একটা হল ঋষিকেশ উপাধ্যায়ের ভাগ্নে দীপ নারায়ণ উপাধ্যায়ের ৪৭ লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা জমি ট্রাস্টকে ২.৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা (সংবাদ বেরিয়েছে, দীপ উপাধ্যায় যে জমি বিক্রি করেছে সেটা আসলে ‘নজুল’ জমি, যেটা সরকারের অধীনস্থ, সরকার ঐ জমি কাউকে লিজ দিতে পারে, কিন্তু ঐ জমি বিক্রির অধিকার কারুর নেই)।
উল্লেখ্য, রামমন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে সংঘ পরিবার কয়েক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা যাদের হেফাজতে আছে, নানান কৌশলে সেই টাকাকে বিভিন্ন গন্তব্যে পাচারের অধিকার তাদের করায়ত্ত হওয়াটাও একেবারে অভাবিত নয়। জমি কেনার দামকে চূড়ান্ত মাত্রায় বাড়িয়ে অর্থ তছরুপের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন চম্পত রায় এবং সংঘ পরিবারের অন্যান্য সংগঠনের নেতারা। যাঁদের হাত ধরে এই কেলেঙ্কারি উন্মোচিত হয় তাঁরা হলেন রাজ্যসভার আপ সাংসদ সঞ্জয় সিং এবং সমাজবাদী পার্টির নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক পবন পাণ্ডে। সঞ্জয় সিং-এর সরকারি ফ্ল্যাটে ১৫ জুন হামলা (অভিযোগ, বিজেপি দুষ্কৃতীদের), দুর্নীতি নিয়ে অযোধ্যার সাধুদের ক্ষোভ প্রকাশ ও আদালতে যাওয়ার হুমকি এবং সাধুদের ‘নরম’ করতে আরএসএস’এর আসরে নামা থেকে বোঝা যাচ্ছে, রামমন্দিরের জন্য সংগৃহীত অর্থের তছরুপের অভিযোগের ডালমে জরুর কুছ কালা হায়।
এবার নজর ঘোরানো যাক কেরলের দিকে। ঘটনা এবছরের এপ্রিলের গোড়ায় বিধানসভা নির্বাচনের সময় ও তাকে কেন্দ্র করে হলেও বিভিন্ন কারণে তা নিয়ে চর্চা এখনও জারি আছে। ঘটনার মূলে আসা যাক। প্রকাশ পেল কেরলের বিজেপি প্রধান কে সুরেন্দ্রনের সঙ্গে জেআরপি দলের কোষাধ্যক্ষ প্রসিথা আঝিকোডের কথোপকথনের অডিও ক্লিপ। সেই কথোপকথনে আঝিকোডে সুরেন্দ্রনকে জানাচ্ছেন, জেআরপি দলের উপজাতি নেত্রী কে কে জানু এনডিএ-তে ফেরার শর্ত হিসাবে ১০ কোটি টাকা দাবি করেছেন। সেই পরিমাণ অবশেষে ১০ লক্ষ টাকায় রফা হয় এবং জানু এনডিএ-তে যোগ দিয়ে সুলতান বাথেরি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
ঘুষ কেলেঙ্কারি এখানেই থামেনি। অভিযোগ, বিজেপি প্রধান সুরেন্দ্রন যে কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, সেই মাঞ্জেসরম কেন্দ্র থেকে বিএসপি প্রার্থী কে সুনডারাকে সরে দাঁড়ানোর জন্য তিনি ২.৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। পরে সুনডারা স্বীকার করেন, তাঁকে আড়াই লক্ষ টাকা, একটা মোবাইল ফোন ও একটা মদের দোকানের বিনিময়ে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করা হয়।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপির কেরল কেলেঙ্কারির এখানেই শেষ নয়। কেরলে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৬ জুন। তার তিনদিন আগে থ্রিশুর ও কোচির মাঝে কোডাকারায় জাতীয় সড়কে একটি গাড়িকে থামিয়ে তার থেকে টাকা লুট করা হল। ডাকাতি ৩ এপ্রিল হলেও ভোট শেষ হওয়ার পরদিন, অর্থাৎ ৭ এপ্রিল গাড়ির চালক শামজির সামসুদ্দিন থানায় গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা লুট হওয়ার অভিযোগ দায়ের করলেন। এবং জানালেন টাকাটা এ কে ধর্মরাজনের, যিনি ব্যবসায়ী এবং আরএসএস নেতা। কিন্তু গ্ৰেপ্তার হওয়া লোকেদের কাছ থেকে (ডাকাতির ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ২০ জনকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে) তথ্য পেয়ে এবং তদন্ত চালিয়ে পুলিশ দাবি করেছে, লুট হওয়া টাকার পরিমাণ ২৫ লক্ষ নয়, আরও অনেক বেশি। পুলিশ গ্ৰেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে লুট হওয়া ৩.৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ভোট কেনার লক্ষ্যে বেঙ্গালুরু থেকে হাওয়ালা পথে ঐ টাকা কেরলে আনা হয়েছিল।
জাতীয় সড়কে ডাকাতির ঘটনায় থ্রিশুরের বিজেপি কোষাধ্যক্ষ সহ বিজেপি কর্মীরা যুক্ত বলে অভিযোগ। ডাকাতি হওয়া টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে থ্রিশুরের ডাভানপল্লির এক টিকা কেন্দ্রে ৩১ মে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে তর্কাতর্কি শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষে পরিণত হয়, এবং এক বিজেপি কর্মীকে ছুরিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হতে হয়। পুলিশের অভিমত হল, ডাকাতি আসলে “নির্বাচনে অব্যবহৃত টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে” স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের “চালানো এক নাটক”।
সর্বশেষ পাওয়া সংবাদে জানা গেছে, আদালতের নির্দেশে কেরল বিজেপি প্রধান কে সুরেন্দ্রনের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর দায়ের হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ঘুষ দিয়ে এক বিএসপি প্রার্থীকে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারে বাধ্য করার জন্য, আর দ্বিতীয় এফআইআর দায়ের হয়েছে ১৭ জুন ওয়েনাড জেলার সুলতানি বাথেরি থানায় উপজাতি নেতাকে দেওয়া ঘুষ কাণ্ডে। এরই সাথে অভিযুক্ত হয়েছেন ঘুষ প্রাপক জেআরপি নেত্রী কে কে জানু। তবে, কেরল নির্বাচনে বিজেপির এত টাকার খেলা, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে অর্থের পেশিতে প্রভাবিত করার চেষ্টার পরও নির্বাচন কমিশন বিজেপির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে বলে জানা যায়নি।
অযোধ্যায় জমি কেনার যে সমস্ত ঘটনা নিয়ে রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের বিরুদ্ধে অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে তা ঘটেছিল এবছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ। সামনেই ছিল এপ্রিল মাস জুড়ে চলা চারটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচন। তছরুপের ঐ টাকা ঘুরপথে হাওলা মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে খাটানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় – একমাত্র যথার্থ তদন্তের মধ্যে দিয়েই তার উন্মোচন সম্ভব। সিবিআই ও ইডি-কে দিয়ে তদন্তের যে দাবি উঠেছে, তার যৌক্তিকতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। আর, রামমন্দিরের জন্য সংগৃহীত অর্থ যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিজেপির পক্ষে প্রভাবিত করতে কাজে লাগানো হয়েও থাকে, তাতে অস্বাভাবিকতার খুব কিছু থাকবে না। আদবাণীর নেতৃত্বে চালানো রামমন্দির প্রচারাভিযানের মধ্যে শুরু থেকেই রাম ভক্তির চেয়ে আরএসএস ভক্তিই ছিল অনেক বেশ – আরএসএস-এর হিন্দুরাষ্ট্রের এজেণ্ডাই সেই জনসমাবেশের প্রধান অভিমুখ হয়ে উঠেছিল। রামের নাম নিয়ে সংঘ পরিবার সংঘটিত অনাচারের অন্ত ছিল না। তবে, জমি কেনা কেলেঙ্কারিতে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ এবং কেরলের নির্বাচনে বিজেপির ব্যাপক মাত্রার আর্থিক দুর্নীতি আরও একবার দেখিয়ে দিল যে, সংঘ পরিবার ও তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি আপাদমস্তক ডুবে আছে দুর্নীতিতে। যে দাবি উঠেছে, তাকে মেনে নরেন্দ্র মোদী কি জমি কেনার দুর্নীতির এই অভিযোগে তদন্তের নির্দেশ দেবেন? মোদী সরকারের চালচলনের যে পরিচয় আমরা পেয়েছি, তাতে সে সম্ভাবনা সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়। তিনি তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিজেপি ও সংঘীয় সংস্থাগুলোর দুর্নীতিকে আড়াল করতে সমস্ত প্রশাসনিক শক্তিকেই কাজে লাগিয়েছেন। তবে, সংঘীয় দুর্নীতি প্রশাসনিক আশীর্বাদে পুষ্ট হলেও এবং তাদের দুর্নীতিতে আদালতের অব্যাহতির ছাপ পড়লেও তাতে যে সবসময় বাস্তব ও সত্যের যথার্থ প্রতিফলন থাকে না তা সুবিদিত। তাদের আর্থিক প্রতিপত্তি এবং সেই অর্থের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে জনগণ প্রায়শই অবহিত থাকেন। সংঘ পরিবার ও দুর্নীতি একাকার হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে মোদীর সেই দুর্নীতি-বিরোধী অঙ্গীকার এক নতুন রূপে সামনে আসছে। “না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা”র অন্তর্বস্তু সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে এখন যা দাঁড়িয়েছে তা হল, “জরুর খাউঙ্গা, বহুত খাউঙ্গা”।
আজকের ভারতে ৩০ জুন দিনটা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জল, জঙ্গল আর জমির ওপর থেকে ভূমিপুত্রদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে আগ্রাসী ধনবাদ। অথচ ইতিহাস বলছে এই ভূমিপুত্ররাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে নিজেদের হাতে সড়কি বল্লম তীরধনুক তুলে নিয়েছিল। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন শুরু হওয়া এই বিদ্রোহ ১৮৫৭’র সিপাহী বিদ্রোহে মিশে যায়। তবে ইতিহাসবিদদের মতে বাংলার মাটিতে শুরু হওয়া এই হুল বিদ্রোহকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিদ্রোহ বলে গণ্য করা হয়।
কোভিড অতিমারি বিশ্বজুড়ে যে তান্ডব চালাচ্ছে তাতে সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে উঠছে এই আগ্রাসী ধনবাদ। সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমরা আরও একবার স্মরণ করি সেই হুল বিদ্রোহীদের। সিধু কানহুর ডাকে এই জুন মাসেই ভাগনাডিহির মাঠে দলে দলে সমবেত হয়েছিলেন অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষেরা। আজ মানুষের বড় দুঃসময়। এই সময়েই তাই আরও একবার হুল বিদ্রোহের সেইসব বিদ্রোহী মানুষের লড়াইকে স্মরণ করা উচিত।
মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ-নিপীড়ন এবং ব্রিটিশ পুলিশ-দারোগাদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত ভূমিপুত্ররা মুক্তির লক্ষ্যে ১৮৫৫ সালে এক আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। সিধু মুর্মু ও কানহু মুর্মু এবং দুই ভাই চান্দ ও ভাইরো এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভাগনাডিহতে। ভূমিপুত্ররা মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের নিপীড়নে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল সে সময়। মহাজনের ঋণের ফাঁদে পড়তে হতো বংশপরম্পরায়। স্ত্রী-পুত্ররা মহাজনের সম্পত্তি হয়ে যেত। পুলিশের সহায়তায় তাদের গবাদিপশু ও জমি কেড়ে নেওয়া হতো। প্রতিবাদ করলে চলতো পাল্টা মার। এমনকি সে সময় ব্রিটিশ সরকারের উল্টো খড়্গ নেমে আসত তাদের ওপর। তবে ভূমিপুত্রদের এই পুঞ্জীভূত ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের সীমারেখা ছাড়িয়েছিল আরও ৭৫ বছর আগেই। ১৭৮০ সালে সাঁওতাল জননেতা তিলকা মুর্মু যাকে আবার তিলকা মাঞ্জহী বলেই বেশির ভাগ মানুষ চেনেন, তাঁর নেতৃত্বেই শোষকদের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রদের গণসংগ্রামের সূচনা হয়। তিনি সর্বপ্রথম ভূমিপুত্রদের মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ১৭৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর তীরের আঘাতেই ভাগলপুরের ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮১১ সালে বিভিন্ন নেতার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার গণআন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৮২০ সালে তৃতীয়বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থবার ভূমিপুত্রদের গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
অবশেষে শোষণহীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন, ৩০ হাজারেরও অধিক সাঁওতাল জনতাকে নিয়ে সমাবেশ এবং কলকাতা অভিমুখে প্রথম গণযাত্রা করেন বীর সিধু-কানহু’রা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য মিছিল বা গণযাত্রার সূচনা হিসেবে এটাকেই প্রথম মিছিল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়; যার ধারাবাহিকতায় আজও উপমহাদেশে যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে মিছিল-লংমার্চ হয়। পদযাত্রার সময় অত্যাচারী মহাজন কেনারাম ভগত ও জঙ্গিপুরের দারোগা মহেশাল দত্ত ছ’সাতজন সাঁওতাল নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করেন। সিধু ও কানহু’কে গ্রেপ্তার করতে উদ্যত হলে বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল বিপ্লবীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহাজন কেনারাম ভগত, মহেশাল দত্তসহ তাঁদের দলের ১৯ জনকে হত্যা করে এবং সেখানেই বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়। এরপর টানা আট মাস ধরে চলে বিদ্রোহ। ২১ জুলাই কাতনা গ্রামে ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। জুলাই মাসেই বীরভূমের বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র নাগপুর বাজার ধ্বংস করে বিপ্লবীরা, যেখানে জনগণকে ন্যায্যমূল্যে মালামাল দেওয়ার পরিবর্তে অত্যাচার করা হতো। ৩০ জুলাই লেফটেন্যান্ট রুবি কর্তৃক মুনহান ও মুনকাতারা গ্রাম ধ্বংস করা হলে পরে ১৭ আগস্ট ইংরেজ সরকার কর্তৃক আত্মসমর্পণের ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয় এবং ভূমিপুত্ররা তা প্রত্যাখ্যান করেন। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিধু-কানহু’র বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার ‘অস্বা সামরিক আইন’ (অস্ত্রশস্ত্র বহনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা) জারি করে। ইংরেজ সরকার সামরিক আইন জারি করলেও বিদ্রোহের মুখে ১৮৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়। আট মাসব্যাপী বিদ্রোহের শেষ পর্যায়ে লেফটেন্যান্ট ফেগানের পরিচালিত ভাগলপুরে হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর হাতে ভূমিপুত্রদের পরাজয় ঘটে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব যে শুধুই সিধু-কানহু বা চান্দ-ভাইরোরা দিয়েছেন তা নয়, তাঁদের সঙ্গে ভূমিকন্যারাও যোগদান করেছিলেন। দুই বোন ফুলো মুর্মু ও ঝানো মুর্মু এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করেন। ব্রিটিশ সেপাইরা ফুলো মুর্মুকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ রেললাইনে ফেলে রেখে যায়। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে ভূমিজ মানুষেরা তাঁকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিধু নিহত হন এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে কানহু’কে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ভূমিজ মানুষেরা পরাজয় বরণ করলেও তারা শোষকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তারই ধারাবাহিকতায় তেভাগা আন্দোলন ও আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিজ মানুষদের অবদান অবিস্মরণীয়।
-- সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
আমাদের দেশে আমলাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার শ্রেণীচরিত্রের কারণে অসংগঠিত শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা যেন একটা স্বাভাবিকতা লাভ করেছে। ফ্যাসিষ্ট বিজেপি সরকার কল্যাণকর চিহ্নগুলোকে ক্রমশ মুছে দিয়ে সমস্ত কিছুকেই বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে। অর্থাৎ ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের হাতে বেশি কড়ি দেওয়া চলবেনা। শ্রম আইনে যতটুকু অধিকার শ্রমিকদের ছিল তা কেড়ে নিয়ে ৪টি লেবার কোড তৈরি করে পুঁজির দ্বারা নির্মমভাবে শ্রম শোষনের বাজারে শ্রমিকদের নিক্ষেপ করে দিচ্ছে। তারফলে সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বেড়েই চলেছে। ১ শতাংশের হাতে ৭৬ শতাংশ সম্পদ চলে গেছে। উল্টোদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
দেশের সমগ্র শ্রমজীবীদের ৯৪ শতাংশ অসংগঠিত। তাদের মধ্যে বড় অংশই নির্মাণ শ্রমিক। এদের মধ্যে স্বনিয়োজিত ও বড় নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক ৭/৮ কোটি। এদের একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে যারা কর্মরত তাদের সুরক্ষার জন্য আইন থাকা সত্ত্বেও সরকার ও আমলাদের আমানবিক চরিত্রের জন্যই পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে এবং অনেকের নাম পৃথিবীর খাতা থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়।
নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালে গৃহ ও অন্যান্য শ্রমিক কর্মচারি নিয়োগ ও কাজের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ আইন (ধারা ২৭, ১৯৯৬) এবং পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য শ্রমিক কর্মচারি নিয়োগ ও কাজের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ রুলস্ ২০০৪ তৈরি হয়। এই আইনবলে নির্মাণ সংস্থাগুলি ১-২ শতাংশ সেস দেবে রাজ্য নির্মাণ কল্যাণ পর্ষদে এবং সেই অর্থ দিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ করা হবে।
সমস্ত রাজ্য মিলিয়ে কল্যাণ পর্ষদে এযাবৎ কাল মোট জমাকৃত তহবিলের পরিমাণ ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর তা থেকে খরচ করা হয়েছে মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ শ্রমিকদের সরকারিভাবে নাম নথিভুক্ত হয়েছে আনুমানিক চার ভাগের একভাগ। আধুনিকীকরণের নামে প্রায় চার বছর ধরে কল্যাণ পর্ষদের কাজ অনিয়মিত এবং করোনার অজুহাতে বন্ধ হয়ে গেছে। মুনাফার জন্য ওয়ার্ক ফর্ম হোম চলবে, কিন্ত শ্রমজীবি মানুষের কাজ করা যাবেনা। নয়া লেবার কোডে নির্মাণ শ্রমিকদের আইন ও কল্যাণ পর্ষদ তুলেই দিতে চাইছে। এক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার চুপিসারে খর্ব করে দেওয়ায় এবং আমলা নির্ভর হয়ে পড়ায় শ্রমিকদের বঞ্চনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
নির্মাণ শ্রমিক ছাড়াও সুবিশাল অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিক আছেন। তাদের জন্য ২০১০ সালে তৈরি হয়েছিল ১,০০০ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় তহবিল। প্রতি বছর ৫০০/৬০০ কোটি টাকা করে ঐ তহবিলে দেওয়া হত। ২০১৬-১৭ সালে কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা (সিএজি) দেখতে পায় যে অব্যবহৃত মোট ১,৯২৭ কোটি টাকা রাজকোষে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার খাতে বরাদ্দ বাজেট থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালে রাজ্য সরকার নির্মাণ সহ অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে এসএসওয়াই ২০১৭ (সামাজিক সুরক্ষা যোজনা) চালু করলো। তা জন্মসূত্রেই রক্তশূন্য, আজ গতিরুদ্ধ।
কোভিড, আমফান, ইয়াস, লকডাউন নানা আঘাতে অসংগঠিত শ্রমিকরা আজ অসহায়। চিল-চিৎকার করেও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তৃতীয় লকডাউনের চোখরাঙানি শুরু হল বলে। ফলে অসংগঠিত শ্রমিকদের কর্মহীনতা দীর্ঘসূত্রিতায় পরিণত হবে।
আশু দাবিগুলি হল
(১) নির্মাণ সহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের ১০ কেজি রেশন ও মাসিক ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে।
(২) অবিলম্বে ব্লক স্তরে নতুন নাম নথিভুক্তিকরণ ও আবেদন পত্র জমা নিয়ে তা দ্রুত প্রাপ্য অধিকারগুলো দিতে হবে।
- কিশোর সরকার
২০১৮ সাল থেকে প্রতিরক্ষা দপ্তর ২৭৫টি নন কোর আইটেম বাজার থেকে কেনা শুরু করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিকর্মচারীরা ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে ৭২ ঘন্টা ধর্মঘট করেছেন। ২০১৯ সালে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা শিল্প শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এআইডিইএফ, আইএনডিডব্লিউএফ এবং বিপিএমএস ঐক্যবদ্ধভাবে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একমাসব্যাপী (২০ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ) ধর্মঘটের আহ্বান রেখেছিল। ধর্মঘটে ‘ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লয়ীজ ফেডারেশন (এনপিডিএফ)’ যা টিইউসিসি, এলপিএফ এবং এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ফেডারেশন। এই ফেডারেশন ধর্মঘটে মহত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে ফ্লোরে ইউনিয়নগুলোর ‘জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’ তে ইউনিয়ন সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে থাকে। অর্ডন্যান্স কারখানার শ্রমিকরা পাঁচ দিন ধর্মঘট করে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এই ধর্মঘটে শ্রমিকদের আর্থিক দাবি দাওয়া ছিল না, সরকারি সংস্থাকে বেসরকারিরণের বিরুদ্ধে নীতিগত লড়াই ছিল।
কেন্দ্রীয় সরকার ধর্মঘটের পাঁচদিনের মাথায় বাধ্য হয়ে দ্বিপাক্ষিক মিটিং-এ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই মুহূর্তে কর্পোরেশন করা হবে না। ইউনিয়ন ধর্মঘট স্থগিত করে এবং ২৬ আগস্ট শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। কিন্তু শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কা ছিল।
মোট ৪১টি অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার এবং পাঞ্জাবে ছড়িয়ে আছে। এই কারখানাগুলোতে তৈরি হয় – ছোট অস্ত্র, বিমানের অস্ত্রের তালিকা, বিমান বিরোধী যুদ্ধবিগ্রহ, নৌ-অস্ত্র, জাহাজ বিরোধী যুদ্ধাস্ত্র, ডুবোজাহাজ বিরোধী যুদ্ধাস্ত্র, ট্যাঙ্ক বিরোধী যুদ্ধাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র এস, ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার, রকেট, রকেট লঞ্চার, বোমা, গ্রেনেড, মর্টার, মাইন, ধাতু, মিশ্র, মেশিন টুলস, সামরিক যানবাহন, ইঞ্জিন, সাঁজোয়া যান, প্যারাসুট, অপটিক ইলেক্ট্রনিক্স, রাসায়নিক, পোশাক, আর্টিলারি, গোলাবারুদ, চালক যন্ত্ৰ, বিস্ফোরক দ্রব্য সামগ্রী ইত্যাদি।
কারওয়া, আমেঠিতে ভারত-রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘ইন্ডো-রাশিয়া রাইফেলস প্রাইভেট লিমিটেড’। এখানে এ কে-২০৩ রাইফেল তৈরি হয়। এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে কালাশনিকভ সংস্থা, রোসোবোরোনেক্স পোর্ট এবং ও এফ বি-কে।
অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির মোট আয় - $৩.৫ বিলিয়ন (₹২৩,৬৮৭.২২ কোটি) এবং কর্মীসংখ্যা - ৮২ হাজার। প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার হাতে ৬০ হাজার একর জমি আছে। সেনাবাহিনী নিজের প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ এই ৪১ টি কারখানা থেকে কেনে। আরও ৫০ শতাংশ অর্ডার দিলে তা যোগান দেওয়ার ক্ষমতা ও এফ বি-র আছে। কিন্তু সরকার দাম বেশি ও গুণমান কম – এই অজুহাতে বাইরে থেকে কিনছে। ২০১৬ সালে এ কে সাক্সেনা অতিরিক্ত কন্ট্রোলার জেনারেল প্রতিরক্ষা বাজেটে বলেছিলেন সামরিক বাহিনীর সব কিছুরই দাম অতিরিক্ত বেশি। পোশাক থেকে ট্যাঙ্ক। এই তথ্যগুলো প্রচার করে কর্পোরেটায়ন করার রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে।
বহুবছর ধরে কর্পোরেটায়ন করার পরিকল্পনা ভারত সরকারের আছে। এর আগে কর্পোরেটায়নের সুপারিশগুলি জর্জ ফার্নান্ডেজ, প্রণব মুখার্জী, একে অ্যান্টনি কেউই বিশেষ আমল দেননি। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং কর্পোরেশন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বেসরকারিকরণ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে যে কমিটিগুলো হয়েছে তারা বেশ কিছু পরামর্শ ও সুপারিশ করে চলেছে। ২০০০ সালে টি কে এ নায়ার কমিটির পরামর্শ – ও এফ বি-কে পরিবর্তন করে ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি কর্পোরেশন’ করা হোক। ২০০৪ সালে একই প্রস্তাব বিজয় কেলকর দেন। ২০১৫ সালে ভাইস এডমিরাল রামন পুরি কমিটির সুপারিশ ও এফ বি-কে তিন বা চারটি ভাগে ভাগ করা হোক। যেমন- অস্ত্র, গোলা-বারুদ এবং যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত গাড়ি।
শ্রমিকদের উদ্বেগ ও শঙ্কা বাস্তব হল। অতিমারী ও লক ডাউনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার 'অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড' ভেঙে দিল। ‘ও এফ বি’ ১৯ জুন ২০২১ তারিখে সার্কুলার দিয়ে জানিয়ে দিল অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলো ৭ টা ভাগে কর্পোরেশনে ভাগ হচ্ছে। (১) গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক। (২) ভেইকেলস। (৩) অস্ত্র ও সরঞ্জম। (৪) ট্রুপ কমফোর্ট আইটেম। (৫) সহায়ক শিল্প। (৬) অপটিক ইলেকট্রনিক। (৭) প্যারাসুট। মোট ৪১ টি কারখানাকে এইভাবে ৭ টি ইউনিটে ভাগ করা হল।
‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড’ ভেঙ দিয়ে প্রতিরক্ষা শিল্পে দ্রুত বিদেশি কোম্পানিগুলোর ঢোকার রাস্তা খুলে দিল এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি ও আন্দোলনে বড় আঘাত হানলো। এর বিরুদ্ধে ‘এআইডিইএফ’, ‘আইএনডিডাব্লিউএফ’, 'বিপিএমএস' তিনটি ফেডারেশন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছে। এনপিডিএফ ২৫ জুন সারা দেশে প্রতিরক্ষা শিল্পের ৪১টি কারখানায় কালো দিবস পালন করবে। এই দিনে রাতে মিটিং করে পরবর্তী কার্যক্রম ঘোষণা করবে। ফেডারেশন অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি দেবে, যাতে তারাও জাতীয় স্বার্থে কেন্দ্রকে কর্পোরেটাশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দেয়।
দানবীয় দিল্লির সরকার খুব দ্রুত নিজেদের এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করছে, শ্রমিকরা লড়ছেন, নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে এগিয়ে আসুন। ফ্যাসিবাদকে রুখতে কারখানা, বন্দর, ক্ষেত-খামারে আওয়াজ উঠুক।
--- নবেন্দু দাশগুপ্ত
২০১৯ সালে গোড়ায় কেন্দ্রীয় সরকার আরও দ্রুততার সাথে OFB এর কর্পোরেশনের প্রক্রিয়া তরান্বিত করে। এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ফেডারেশন ও স্বাধীন ইউনিয়নগুলো, এ্যাসোশিয়েশন গুলোকে সঙ্গে নিয়ে ২৩, ২৪ ও ২৫ জানুয়ারী, ২০১৯ তিন দিনের ধর্মঘটের ডাক দেয়। তিন দিনের ধর্মঘটের জেরে সরকার কর্পোরেশন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে এবং ফেডারেশনের সাথে আলোচনা করেই যাকিছু হবে বলেই প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু সরকার আদতে কর্পোরেশনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেনি। শ্রমিক কর্মচারীরাও এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়।
পরবর্তী কালে ফেডারেশনগুলো বাধ্য হয়ে ২০ আগষ্ট ২০১৯ থেকে প্রতিরক্ষা শিল্পে এক মাসের ধর্মঘটের ডাক দেয়। সমস্ত স্বাধীন ইউনিয়ন ও এ্যাসোশিয়েশন গুলোও এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানায়। ধর্মঘট চলাকালীন গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরী কাশীপুরে জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন বিশেষ ভুমিকা পালন করে যা এই ফ্যাক্টরীর শ্রমিক আন্দোলনে ছাপ ফেলে। ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন প্রথমে এআইসিসিটিইউ-র অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে এআইসিসিটিইউ, এলপিএফ ও টিইউসিসি মিলিতভাবে ন্যাশানাল প্রোগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লয়ীজ ফেডারেশন (এনপিডিইএফ) গঠন করে। ধর্মঘট চলাকালীন চীফ লেবার কমিশনার (সেন্ট্রাল)-এর উপস্থিতিতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সরকার পক্ষ কর্পোরেশন গঠন প্রক্রিয়া শুরু করার আগে পর্যালোচনার জন্য ফেডারেশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি High Level Official Committee (HLOC) গঠনে সম্মত হয়। এই প্রতিশ্রুতি মতো ফেডারেশান গুলো পাঁচদিন পর ঘর্মঘট প্রত্যাহার করে। পরবর্তী পর্যায়ে এই কমিটির তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হলেও কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি।
১৬ মে অর্থমন্ত্রী কোভিড-১৯ অতিমারীর জন্য ২০ লক্ষ কোটি টাকার রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এই প্যাকেজ থেকে বেরলো প্রতিরক্ষা উৎপাদনে কর্পোরাটাইজেশন ও ৭৪ শতাংশ FDI করার সিদ্ধান্ত। শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ফেডারেশনগুলি পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন করে। NPDEF, AIDEF, INDWF ও BPMS চারটি ফেডারেশনের উদ্যোগে ৪১টি ফ্যাক্টরীতে স্ট্রাইক ব্যালট নেওয়া হয়। ৯০ শতাংশ শ্রমিক ধর্মঘটের সমর্থনে রায় দানের ফলে AIDEF, INDWF ও BPMS যৌথভাবে এবং NPDEF আলাদাভাবে ৪ আগষ্ট, ২০২০ স্ট্রাইক নোটিস প্রদান করে, ১২ অক্টোবর ২০২০ থেকে প্রতিরক্ষা উৎপাদন কারখানায় অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘটের জন্য। চীফ লেবার কমিশনার (কেন্দ্রীয়)এর উদ্যোগে ইন্ডাস্ট্রীয়াল ডিসপিউট এ্যাক্ট-১৯৪৭ অনুযায়ী সরকার ও ইউনিয়ন নেতৃত্বের মধ্যে কনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৯ অক্টোবর, ২০২০ ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ডি পি এস নেগি, চীফ লেবার কমিশনার উপস্থিতিতে বৈঠক হয় উনি বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকারকে ইউনিয়ন নেতৃত্বের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কথা বলেন।
ফলসরূপ ইউনিয়ন নেতৃত্বও এই সমাধান সূত্রে রাজি হয়ে ধর্মঘট আপাতত স্থগিদ রাখতে সম্মত হন ।
প্রসঙ্গত এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, কেন্দ্রীয় ভাবে দিল্লিতে যখন ফেডারেশন নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা চলছিল, কলকাতাতে নিজামপ্যালেসে ডেপুটি লেবার কমিশনার(সেন্ট্রাল)এর উপস্ফিতিতে গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জি এস এফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ঘোষিত ধর্মঘট নিয়ে কনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া জারি ছিল।
৯ অক্টোবর, ২০২০ মিটিং-এর শর্ত অনুযায়ী চারটি ফেডারেশনের সঙ্গেই সরকারের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করার কথা, কিন্তু সরকার পক্ষ ও NPDEF এর সঙ্গে কোন বৈঠক হয়নি। শোনা যায় রেকগনাইজড ফেডারেশন গুলির বাধা দানে, NPDEF আন-রেককগনাইজড হওয়ার জন্য সরকার পক্ষ NPDEF-কে দ্বিপাক্ষিক মিটিং-এ ডাকতে পারেনি। শ্রমিক শ্রেণীর ওপর চলমান আক্রমনের মুখে ফেডারেশনগুলোর এই সংকীর্ণ মনোভাব শ্রমিক ঐক্যকে দূ্র্বল করে।
১১ জুন, ২০২১ পরবর্তী মিটিং হয়। এই পরিস্থিতিতেও একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে, CLC(C)-এর এই Conciliation Meeting-এ NPDEF থাকুক এটা AIDEF মেনে নিতে পারছে না। ঐ দিনও এক সঙ্গে মিটিং-এ থাকার জন্য অসম্মতি প্রকাশ করে। যদিও বাকি দুটি ফেডারেশনের মনোভাব এব্যপারে ইতিবাচক। এ দিনের মিটিং-এও কোনও সমাধান সূত্র না বোরোনোয় ১৫ জুন, ২০২১ পরবর্তী মিটিং-এর দিন ধার্য হয়।
১৫ জুন, ২০২১ NPDEF ছাড়া বাকি তিনটি ফেডারেশন অনুপস্থিত থাকে। দুঃখে বিষয় এই দিনের মিটিং-এ অনুপস্থিত থাকবে এই কথাটা NPDEF-কে জানানোর প্রয়োজনটুকও বোধ করে না। এতে কি সরকারের সামনে ফেডারেশনগুলোর অনৈক্যের চেহারাটা ফুটে উঠল না?
চীফ লেবার কমিশনার কনসিলিয়েশন প্রসিডিংস ফেল্ড ঘোষণা করলেন। সরকার যেন ওত পেতে ছিল, এই অতিমারির পরিস্থিতিতেও “Conciliation Proceedings Failed” এই রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১৬ জুন,২০২১ OFB-কে ভেঙে সাতটি কর্পোরেশনে ( DPSU) পরিণত করার সিদ্ধান্ত ক্যাবিনেট অনুমোদন করে।
এবারও তিনটি রেকগনাইজজড ফেডারেশন AIDEF, INDWF ও BPMS যৌথভাবে NPDEF-কে বাদ দিয়ে ১৯ জুলাই থেকে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘটের ডাক দেয় ও NPDEF-কে সমর্থনের অনুরোধ জানায়। সিদ্ধান্তের গ্রহনে সময়ে কেন্দরীয় স্তরে JAC গঠনে অনিহা, রেকগনাইজড আনরেকগনাইজড-এর বিভাজন আর লড়াইয়ের ময়দানে পাশে ডাকা তিনটি ফেডারেশনের পুরনো অভ্যাস। এ বিষয়ে NPDEF পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় JAC-এ সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে যুক্ত সমস্ত ইউনিয়নকে বৃহত্তর স্বার্থে। INDWF-এর পক্ষ থেকেও আলাদা ভাবে এই দাবি তোলা হয়। তিনটি ফেডারেশনের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যক্ত সমস্ত ইউনিয়নকে নিয়ে আগামী ২৭ জুন, ২০২১ বিকেল ৪টায় ভার্চুয়াল মিটিংএর আয়োজন করা হয়েছে। এই মিটিং এর সিদ্ধান্ত নিয়ে OFB কর্পোরাটাজেশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পূর্বের ঘোষণা মতো NPDEF ও AICCTU-এর নেওয়া সারা দেশে প্রতিবাদ দিবস পালিত হবে শ্লোগান সাউটিং, ডেমনস্ট্রেশন ও কালো পতাকা প্রদর্শনের মাধ্যমে।
সমস্ত সংকীর্ণতা কে সরিয়ে রেখে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তবেই দীর্ঘস্থাই লড়াই সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়া যাবে এবং সাফল্যও পাওয়া যাবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক নয়, রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, কয়লা, স্টীল, কৃষি সমস্ত স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে করোনার থেকেও ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস কে প্রতিহত করতে হবে।
-- জয়দেব দে
(‘বিকল্প’ বামের বেহাল দশা কেন, সে প্রশ্নও উঠুক একটি লেখা এই সময় কাগজে লিখেছিলেন সৌমিত্র দস্তিদার। সেই লেখাটির পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাটি লিখেছেন নবেন্দু দাশগুপ্ত)
সৌমিত্রবাবু পাঠকদের বোঝাতে চেয়েছেন নকশালপন্থা হল কয়েকটি গোষ্ঠীর সমাহার। নির্দিষ্ট কোনও দল নয়। এই চালাকির মাধ্যমে তৃতীয় ধারাকে অপ্রাসঙ্গিক করার কসরৎ তিনি করেছেন। ‘সংযুক্ত মোর্চা’র ভরাডুবির জন্য নকশালপন্থীদের দায়ী করেছেন। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘কলঘরের বিশ্রী ঝগড়া’য় ওনার নজরে পড়েনি ‘চটি চাটা’ ‘ডেপোঙ্কর’ ইত্যাদি টুম্পা মার্কা সংস্কৃতির বুলিগুলি। তথ্যচিত্র নির্মাতা হয়ে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলুন! লিখেছেন ‘নকশাল আন্দোলনের বয়স এখন চুয়ান্ন’। ‘যে রাজ্যে নকশালবাড়ি, সেখানেই কেন তার এই বেহাল দশা’। এরপরের প্রশ্ন হবে তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ কেন বেহাল? শেষে করবেন মার্কসের জার্মানি, লেনিনের রাশিয়ার কেন এই হাল? গুড বাই। আমরা কিন্তু প্রশ্ন করবো না আইএসএফ হুগলির জাঙ্গিপাড়া বিধানসভায় বেহাল এবং ভাঙড়ে কেন বাজিমাত করল।
আপনার কল্পকথা – “আধা বা পুরো সামন্তবাদ কিংবা লগ্নি না মুৎসুদ্দি পুঁজি, নয়া না জনগণতন্ত্র, এসব তাত্ত্বিক কচকচানি তো অনেক হল। গ্রামের বা শহরের গরীব দুটো ভাত চায়। পরনের কাপড় চায়, ছেলেমেয়ে যেন লেখাপড়া শিখে বড় হতে পারে, তার স্বপ্ন দেখে”। দায়িত্ব নিয়ে বলছি এই বিতর্ক এম-এল ঘরানায় নেই। মধ্যবিত্ত চালাকি দিয়ে নিজের অজ্ঞানতাকে খামোখা কেন জাহির করছেন!
আপনি সনাতনপন্থী বা প্রাচীনপন্থী চশমা চোখে দিয়ে সেকালের নকশালবাড়িতে আছেন, একালের নকশালপন্থায় আসুন। দেখবেন পরিবর্তন হয়ে চলেছে, আর আত্মসমালোচনা তার ভিতরেই আছে। আনুষ্ঠানিক আত্মসমালোচনা করার তাত্ত্বিক কাঠামো ৮০ দশকেই লিবারেশন ভেঙে দিয়েছে। আপনি লিখেছেন পার্টি কর্মসূচি, রাষ্ট্রের চরিত্র বা কৃষি অর্থনীতি মোটামুটি ষাটের দশকে আটকে আছে। কোনো কিছু না পড়ে না জেনে খবরের কাগজে লিখে দিলেন! লিবারেশন ইতিমধ্যেই দশম কংগ্রেস সম্পন্ন করেছে। লিবারেশনের আরকাইভে সব দলিল পেয়ে যাবেন। পড়ে তারপর মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখুন, সমালোচনা করুন। তা না হলে ২০০৭ সালের বাংলার শিল্প ও বিরোধীদের ভূমিকা নিয়ে তৈরি করা ফরমায়েশি তথ্যচিত্রের মতো হয়ে যাবে।
তথ্যচিত্র নির্মাতা লিখছেন ‘মিডিয়ার একটা অংশও লিবারেশন, কিংবা বলা ভালো তাদের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে আগামীর বাম আইকন হিসেবে যে সামনে আনছেন, সেটা বোঝা যায়’। ইনি বলতে চান নকশালপন্থীরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে কেন সামনের সারিতে থাকবেন বা প্রচার পাবেন! তারজন্য তো ওনার সংযুক্ত মোর্চার জোটই যথেষ্ট। লিবারেশনকে নিশানা বানিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি শিবের গীত গেয়েছেন। শ্রেণি ভিত্তি মধ্যমবর্গ ইত্যাদি নিয়ে কাচের ঘরে বসে গবেষণা করে চলেছেন। উনি জানেন না বিহার বিধানসভা নির্বাচনে যে ১৯ জন লিবারেশন প্রার্থী ছিলেন তাঁরা সবাই দলিত, ওবিসি এবং মুসলমান। উনি খবর রাখেন না লিবারেশনের সাংগঠনিক কাঠামোগুলোর। একদম ফিল্মি ডায়লগ দিয়েছেন ‘ফের গ্রামমুখী হতেই হবে’। আর উনি শহর সামলাবেন। আপনার কথা ‘দুর্বল’ নকশালপন্থা। সেই নকশালপন্থাকে শেষ করতে মুলুক, করন্দা, কৃষ্ণনগরের গোপালপুর কত গণহত্যা হয়ে গেল, কিন্তু তারা শেষ হয় না! আপনার পছন্দের বামদল আবার তাদের নিয়েই কর্পোরেট হামলার বিরুদ্ধে, শ্রমকোডের বিরুদ্ধে, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে, নতুন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে, নারীর অধিকারের দাবিতে একসাথে মিছিলে হাঁটে। এটাই একালের নকশালপন্থা। নকশালপন্থীরা কয়েকটি পকেটে আছে ঠিকই লিখেছেন, মূল্যায়ন তো করতেই হবে কেন লাফিয়ে লাফিয়ে সংগঠন বাড়ছে না। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়, যাদের অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখাই যায় না, তাদের ‘বিজেপি কে ভোট নয়’ প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার ৩০ শতাংশ ভোট অন্যের বাক্সে জমা হল কিভাবে, এই অনুসন্ধানটা করুন। আর মোদীজীর মতো ‘আরবান নকশাল ভূত’ যদি মাথায় ঢুকে যায়, তা হলে রাতের ঘুম গেল। বাম বিকল্প সব বামেদের নিয়েই হবে, তবে এই বামফ্রন্টের কাঠমোতে নয়। নতুন আঙ্গিকে, নতুন দিশায়। নকশালপন্থীদের জন্যে অন্য কিছু হবে না।
আন্তর্জাতিক চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করে মোদী সরকার ভারতে করোনা তান্ডব শুরু হতে সাহায্য করেছিল। আমরা বিনা চিকিৎসায় হাজার হাজার মানুষকে মরতে দেখেছি, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঐতিহাসিক দুর্দশা দেখলো বিশ্ব, দেখলো কিভাবে কোনো সরকার মানুষের জন্যে আপৎকালীন চিকিৎসা ও খাদ্যের ব্যবস্থা না করে কর্পোরেট হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলোকে মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে, জ্বালানির দাম বাড়াচ্ছে, জিএসটি নিচ্ছে কোভিড চিকিৎসা আনুষাঙ্গিকের ওপর। দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেনের অভাবেই হাজার হাজার মানুষ মারা গেলেন, পেলেন না যথাযত চিকিৎসা। একইভাবে করোনার একদম শুরুর দিকে চীন ফেরৎ এক মার্কিনির করোনার উপসর্গ ধরা পড়ে, আত্মীয় স্বজনরা তাকে করোনা টেস্টিং-এর জন্যে নিয়ে যেতে চাইলে উনি প্রথমে যেতে চাননি, ভয় ছিল বিল মেটাতে পারবেন না। যাই হোক পরীক্ষার পর বেসরকারি ল্যাব তার ওবামা কেয়ার-এর টাকা কেটে আরো ১,০০০ ডলার তাকে বিল পাঠায়।
যে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে চাইছি সেটা হলো সোশ্যাল মেডিসিন বা একটা সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা দেশের আপামর গরীব মানুষের রোগ মহামারী থেকে বাঁচার একমাত্র সাথী। আর এই ধারণা ১৯৩০ সালের দিকে প্রথম আসে ইউরোপ, এর প্রথম প্রয়োগের পরিকল্পনা করেন চিলির প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি ও একজন প্যাথলজিস্ট ডঃ সালভাদোর অ্যালেন্ডে।
তবে এর বাস্তব রূপায়ণ করেছিলেন ডঃ চে আর্নেস্তো গেভারা। তাই উন্নত দেশগুলি যা পারেনা গরীব দেশ হয়েও কিউবা তা অনায়াসে করে দেখায়।
পৃথিবীতে তাঁর সংক্ষিপ্ত ৩৯ বছরের জীবনে চে গেভারা তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও বিপ্লবী মতাদর্শের জন্যে জীবন উৎসর্গ করে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের কাছে নায়কের মর্যাদা পেয়েছেন। আর এই বিষয়টি ঢেকে দেয় তার বিপ্লবী সত্বা কত গভীর সেই চেতনাকে, জনগণের প্রতি, তাদের স্বার্থের প্রতি চে’র আবেগ শুরু হয়েছিল জনস্বাস্থ্য দিয়ে। তার চিকিৎসা ও তার সার্বজনীন প্রয়োগের প্রকল্প লাতিন আমেরিকার সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উত্তরাধিকারকে রূপদান করেছিল।
এলার্জিক হাঁফানি চে’র জন্মগত রোগ। ১৯৪৭এ ডাক্তারি পড়তে গেলেন, তিন বছর পরে তাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল এই প্রচন্ড হাঁফানির কষ্ট নিয়ে, কয়েক বছর পরে একটু সুস্থ হয়ে উঠে আবার পড়তে যান এবং ১৯৫৩ সালে তার মেডিকেল ডিগ্রী সম্পূর্ণ করেন। মাঝখানের এই সময়টা বিখ্যাত হয়ে আছে তার মোটরসাইকেল ডায়েরি নামে এক অভিযানের জন্যে। চে তার বন্ধু চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী আলবার্তো গ্রানাডো জিমনেজ-এর মোটর সাইকেলের সঙ্গী হয়ে এক আন্তঃমহাদেশীয় ভ্রমণ অভিযান শুরু করেন। এই যাত্রাটিকে চে, হেনসেন-এর রোগ বা কুষ্ঠ রোগীদের মধ্যে সমীক্ষা চালানোর কাজে ব্যবহার করলেন। এই ভ্রমণের সময়ই তিনি লাতিন আমেরিকা জুড়ে আয়ের বৈষম্য এবং বর্ণ বৈষম্যের বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করলেন। এই যাত্রা তাকে শুধু সমাজতন্ত্রের অপরিহার্যতা অনুভব করালো না, পাশাপাশি একটি সার্বজনীন সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপরিহার্যতার বিষয়টিও অনুধাবনে আনলো, চে গেভারা যার নাম দিলেন ‘রেভলিউশনারী মেডিসিন’ বা ‘বৈপ্লবিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’।
১৯৫৫ সালে চে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা করলেন এবং কিউবার স্বাধীনতার জন্যে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক সকালে বিশ্ববাসী জানলো মার্কিন বসম্বদ স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ফ্লুজনিয়ো বাতিস্তাকে উচ্ছেদ করে কিউবার বিপ্লব সফল হয়েছে। পরবর্তীতে এই বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ধ্যানধারণার আরো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন বিপ্লবের অন্যতম নেতা চে গেভারা। চে কেবল কাস্ত্রোর আর্থসামাজিক পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, তাকে সমভাবে স্বাস্থ্যনীতিকেও আমূল পরিবর্তনের ভাবনায় প্রভাবিত করে ফেললেন। এবং সেই পথের অনুসরণ আজ শুধু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তই নয় করোনার প্রতিটি মারক আঘাতের বিরুদ্ধে কিউবার রুখে দাঁড়ানো, করোনার থাবায় ধুঁকতে থাকা শিল্পোন্নত দেশগুলিতে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো গেভারার সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বোধকে আরো আরো তত্বগতভাবে শক্তিশালী করে চলেছে, পুঁজিবাদের ফাঁপা বেলুন ক্রমশ চুপসে যাচ্ছে। সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বোত্তম উদাহরণগুলি লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতেই দৃশ্যমান। ইংরেজি ভাষী বিশ্বে দীর্ঘকাল অবহেলিত এই সামাজিক স্বাস্থব্যবস্থার কার্যকারিতা এখন প্যাথলজি ও মহামারী সংক্রান্ত বিষয়ে সমগ্র বিশ্বে গবেষণা, শিক্ষা ও অনুশীলনের বিষয়।
চে মেক্সিকোতে একটি এলার্জি কনফারেন্সে ‘অর্ধ পাচ্য এন্টিজেন’ সম্বন্ধীয় একটি পেপার দাখিল করেন, যা অত্যন্ত প্রশংসা পায়, তার গবেষণা ও সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের রূপরেখা বিচ্ছিন্ন গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিকভাবে সমাজ পরিবর্তনকে বা সেই সম্বন্ধীয় প্রকল্পকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। তিনি একটি ম্যাগাজিনের জন্য নিবন্ধে লিখেছিলেন “আমরা আমাদের প্রিয় লাতিন আমেরিকার মহামারীগুলির জন্য আমাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে ঔষধ আবিষ্কারের কিছু সূত্র প্রয়োগ করেছি, যা দ্রুত বৈজ্ঞানিক সত্যের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।” আজ কিন্তু কিউবা বা কিছুটা হলেও আর্জেন্টিনা সেই পরিকল্পনার সুফল উপভোগ করছে। বলতে গেলে এই করোনাকালে সমগ্র বিশ্বই এর প্রয়োজনীয়তাকে বারবার অনুভব করছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাস্থ্য, রোগ এবং চিকিৎসা চর্চাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। জনস্বাস্থ্য সামাজিক সংপৃক্তির বিষয়, যা আমরা আমাদের দেশে দেখতে পাইনা, জনস্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয় সবচেয়ে কম, মহামারী হলে সেখানে থেকেও টাকা কামায় কর্পোরেট। আর সেখানে চে’র রূপায়িত সার্বজনীন সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্বন্দ্বের উপর ভিত্তি করে একটি মার্কসবাদী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। সামাজিক চিকিৎসা সামাজিক শ্রেণীর উপর জোর দেয়, যেমন অর্থনৈতিক উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা সংজ্ঞায়িত। সামাজিক চিকিৎসার অনুশীলনকারীরা দেখিয়েছেন যে কিভাবে শ্রমের শোষণ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বঞ্চনার অন্তর্নিহিত শর্ত হিসাবে থেকেই যায়। তাই এই সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য বা অসুস্থতাকে একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হয় যা পুঁজিবাদে একচেটিয়া ব্যবসার বাজার তৈরির উপাদান। সোজা কথায় একদিকে মানবিকতা, পরিবেশ, সমগ্র সমাজকে নিয়ে ভাবনা, যার প্রয়োগ আমরা কিউবা ছাড়াও ভিয়েতনামে ও অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি। এছাড়া জাপান ও নরওয়েতে অনেকটাই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র একটা ঘটনায় এই পদ্ধতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কম শৈলজা চীনে করোনা দেখা দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই ব্লকে ব্লকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার তৈরি করা শুরু করেছিলেন, তখন মোদী ট্রাম্পকে নিয়ে আমেদাবাদের রাস্তায় দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। এর উল্টো দিকে শুধু শোষণ, বঞ্চনা ও অনৈতিক অর্থের বৈভব। কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, শুধু ভারতবর্ষে করোনার দুটো ঢেউতে মোদী সরকার কী কী করেছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মানুষের কি হাল হয়েছে একটু খেয়াল করলেই সেটা বোঝা যায়। করোনা অতিমারী আমাদের দেখিয়ে গেলো চে গেভারা এবং তার রূপায়িত বৈপ্লবিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কর্পোরেট অত্যাচারে জর্জরিত দরিদ্র, মধ্যবিত্তকে বাঁচানোর একমাত্র পথ। এবছর চে’র ৯৩তম জন্মবার্ষিকী। লাল সেলাম কমরেড চে গেভারা।
-- মৃনাল
৩১ মে অত্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও করন্দা গণহত্যার শহীদ দিবস পালিত হয়। গ্রামের কমরেডদের সাথে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের সুকুমার সোম, নন্দদুলাল চ্যাটার্জী ও জেলা কমিটি সদস্য শ্রীকান্ত রাণা, তরুণ কান্তি মাজি উপস্থিত ছিলেন। পতাকা উত্তোলন ও মাল্যদানের পর শহীদ স্মরণে নিরাবতা পালন করা হয়। বক্তব্য রাখেন শ্রীকান্ত রাণা। ফ্যাসিবাদের হামলার সামনে করন্দার মতো গ্রামে গ্রামে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা কত জরুরি সে বিষয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি।
২০ জুন ২০২১ বেলঘরিয়ায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠীত হয় শ্রদ্ধা ও স্মরণ। গতবছর থেকে আজ পর্যন্ত ৮ জন স্থানীয় পার্টি নেতা ও কর্মী প্রয়াত হয়েছেন। তাঁরা হলেন কমরেড বাপী চাকলাদার, কমরেড বাবলু দাস, কমরেড কানু (কমল) বোস, কমরেড হিমাংশু (রামু) বিশ্বাস, কমরেড শুভজিৎ দে, কমরেড সুখময় (বাচ্চু) দাস, কমরেড খুকু পাল এবং কমরেড শান্তা গুহরায়। বিভিন্ন কমরেডরা প্রয়াত কমরেডদের স্মৃতিচারণ করেন।
--- সমাপ্ত ---