পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট গত ২ জুন তারিখে একটি প্রশংসনীয় পর্যবেক্ষণ করেছেন। ডিভোর্সের পর বাচ্চার কাস্টডি কার হাতে থাকবে, সেই সংক্রান্ত এক মামলায় অনুপিন্দর সিং গ্রেওয়াওলের বেঞ্চ বলেছে, এমনকি যদি মায়ের অন্য সম্পর্কও থাকে, তাহলেও তিনি খারাপ মা হয়ে যান না। এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল দু-তিন বছর আগে৷ দম্পতি অস্ট্রেলিয়ার থাকতেন। মা স্বাবলম্বী। তিনি ২০১৯ সালে থেকেই ডিভোর্স চাইছেন। বাবা জোর করে বাচ্চাকে নিয়ে যান। এখন বাবার বক্তব্য, মায়ের অন্য সম্পর্ক আছে। তিনি বাচ্চাকে সময় দেবেন কী করে? আদালত বলেছে – ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর নৈতিক চরিত্রের প্রতি আঙুল তোলা সোজা। অনেক ক্ষেত্রেই সেই দোষারোপ ভিত্তিহীন। আর যদি সত্যিই কারও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক থাকে, তাহলেও এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে তাঁকে সন্তানের কাস্টডি দেওয়া যাবে না।’
ভারতীয় প্রেক্ষিতে এমন পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যুগ যুগ ধরে এখানে আদালতে মায়ের অন্য সম্পর্ক সন্তানের কাস্টডি হারানোর অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ আমাদের সুযোগ দেয় মাতৃত্ব নিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারণাটি ফিরে দেখার।
রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় শিশুপুত্রের কল্পনায় মা হল অসহায় নারী, যাকে শিশু হয়েও পুত্রটি উদ্ধার করতে চায়। ‘মনে পড়া’ কবিতায় মায়ের সঙ্গে পবিত্রতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। পুজোর গন্ধে, আশ্বিনের শিউলি বনে, ভোরের শিশিরে মায়ের উপস্থিতি। নজরুল ‘মা’ কবিতায় বলেন, ‘হেরিলে মায়ের মুখ, দূরে যায় সব দুখ/ মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরাণ।’ মায়ের ডাকে বিদ্যাসাগরের জীবন বাজি রেখে ভরা দামোদার সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার অতিরঞ্জিত গাল-গল্প তৈরি হয়ে যায় সহজেই।
অর্থাৎ সমাজ-সংস্কৃতিই শেখায়, মা হবেন নিঃস্বার্থ, পবিত্র, ছায়াদায়ী, কিন্তু অসহায়। মহত্ত্বের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে নীরব নির্যাতন। অথচ বাস্তবে তাঁরও আছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, জৈবিক চাহিদা। অনেক বিধবা এবং ডিভোর্সী নারী আজও দ্বিতীয় বিয়ে করেন না সন্তানের মুখ চেয়ে। আবার অনেকে সন্তানের কারণে আজীবন গৃহহিংসা সহ্য করেন। নিজের আলাদা সত্তার ডাক মা এড়িয়ে যান লোকনিন্দার ভয়ে।
এই সামাজিক পাঠ নিতে নিতে আপামর নারী শেখে, ‘ভালো মা’ হয়ে ওঠাই মোক্ষ৷ এই দীক্ষা কি পিতৃতন্ত্রের সুবিধার্থে নয়? আড্রিয়ান রিচ ‘অফ উওম্যান বর্ন’-এ ‘ভালো মা’ নামক সামাজিক নির্মাণটির কাটাছেঁড়া করেন। বলেন, ধনী মা ও দরিদ্র মা, বিবাহিত মা ও একাকী মা — এদের পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতা সমান নয়। তাদের থেকে একই সামাজিক প্রত্যাশা কেন?
ষাটের দশকেই বেটি ফ্রিড্যান ‘ফেমিনাইন মিস্টিক’-এ বলেছিলেন, ‘ভালো মা-র সংজ্ঞার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মাতৃত্বের বাইরে অন্য সব পরিচিতি হারিয়ে ফেলেন নারী। যেন তাঁর অন্য কোনো লক্ষ্য, ইচ্ছা বা চাহিদা নেই।’ পরিবার টিকিয়ে রাখতে এই মাতৃত্বের ধারণা জরুরি। এঙ্গেলস ‘অন অরিজিন অফ ফ্যামিলি, প্রাইভেট, প্রপার্টি অ্যান্ড স্টেট’-এ বলেছেন, বংশ পরম্পরায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা নিশ্চিত করতেই সন্তানের মাতৃপরিচয়ের বদলে পিতৃপরিচয়কে আবশ্যিক করা হয়। একগামিতা চালু হয়। নারীর স্বাধীনতা খর্ব হয়।
‘ভালো মা’— অর্থাৎ নম্র, সহনশীল, সর্বগুণসম্পন্না, বিষমকামী কিন্তু প্রায় অযৌন এক মূর্তি-র আদর্শে পৌঁছতে গিয়ে নারীদের মধ্যে সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে। নারীরাই মা হিসেবে অন্য নারীর ব্যর্থতা বিচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বুকে যথেষ্ট দুধ আসছে কিনা, ঠিক মতো সন্তানকে খাওয়ানো-নাওয়ানো হচ্ছে কিনা, সে বিচারে মেয়েদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন মেয়েরাই। পরবর্তী কালে সে দায়িত্ব নেয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি — যেমন, বাচ্চার স্কুল, আদালত বা সংবাদ মাধ্যম। পার্ক স্ট্রীটে সুজেট জর্ডন যখন ধর্ষিতা হয়েছিলেন, তখন গণমাধ্যম আলোচনা করেছিল, দুই সন্তানের মায়ের বার-এ যাওয়া উচিত কিনা। ডিভোর্সী নারী বিবাহ নামক ‘পবিত্র’ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে একেই সমাজের বিরাগভাজন। সেই নারীর শুদ্ধিকরণের শেষ উপায় ‘আদর্শ মা’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা। সেই মা যখন বার-এ যান, তখন তিনি ধর্ষিতা হলেও সমাজ সহমর্মিতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। একই মানসিকতা কাজ করে ডিভোর্সের কাস্টডির মামলায়। আদালত মেপে দেখে, মায়ের জীবনযাত্রা শৃঙখলাবদ্ধ তো? সর্বোপরি তাঁর কোনো ছেলে বন্ধু বা স্বতন্ত্র যৌন জীবন নেই তো?
পাশ্চাত্যে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আইন নারীর পক্ষেই থাকে। রাষ্ট্রের দায় থাকে সিঙ্গল মায়ের সন্তানের প্রতি। গৃহহিংসার আইনেও নারীর স্বার্থকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, উক্ত পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টের কেসে আলোচ্য মা যেহেতু অস্ট্রেলিয়াবাসী, তাই পাঞ্জাব হাইকোর্ট উল্লেখ করেছে যে, অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুসারে রাষ্ট্র বাচ্চার জন্য একলা মাকে অনুদান দেবে। তদুপরি মা চাকুরিরতা, তাই সন্তানের ভরণপোষণে সমস্যা হবে না। অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে, আইন কেন নারীবান্ধব হবে? এ কি পক্ষপাত? নারী ও পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনও। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন রাষ্ট্র ও আইন নারীদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব নেবে, এটাই স্বাভাবিক৷ আমাদের দেশে আইন যতটা নারীবান্ধব হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। অথচ ৪৯৮ক-এর একটি দুটি অপব্যবহারের নিদর্শন দেখিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজবোদ্ধারা ‘হায় হায়’ রব তোলেন।
মাতৃত্বের ধারণায় আছে লিঙ্গভিত্তিক শ্রমের বাধ্যবাধকতা। ধরে নেওয়া হয়, মায়ের কাজ প্রতিপালন, আর বাবার কাজ সেই প্রতিপালনে আর্থিক সহায়তা। নতুন সময়ে মা ‘বাইরের কাজ’-এ অংশ নিয়েছেন, অর্থাৎ উপার্জনশীল হয়েছেন৷ কিন্তু ‘বাড়ির কাজ’, অর্থাৎ প্রতিপালনের দায়িত্ব ভাগ হয়নি সব ক্ষেত্রে। যেহেতু আদালতের মাথাতেও লিঙ্গনির্ধারিত শ্রমের ধারণা গাঁথা, তাই মা চাইলে তাঁকে ‘অপেক্ষাকৃত যোগ্যতর পালিকা’ ভেবে আদালত সচরাচর তাঁর হাতেই বাচ্চাদের সমর্পণ করে। আবার ওই একই কারণে আদালত আশা করে যে সেই মা হবেন হিন্দি সিনেমার নিরূপা রায়ের মতো। উপার্জনশীল হলেও তাঁর ‘ব্যস্ত’ হওয়া চলবে না। ‘মা খুব ব্যস্ত’ — এটাকেও বিপক্ষের উকিল ‘যুক্তি’ হিসেবে খাড়া করেন অনেক ক্ষেত্রে৷ আর মায়ের অন্য সম্পর্ক অবশ্যই থাকা চলবে না। পিতৃতন্ত্রে সন্তানহীন নারী নিন্দার্হ, কিন্তু ‘খারাপ মা’ আরও নিন্দনীয়।
ডিভোর্সকামী অনেক মেয়েকে তাই এখনও ট্রমার মধ্যে দেখি যে, হয়ত প্রতিশোধস্পৃহাতেই বর ‘বাচ্চাকে কেড়ে নেবে’ এরকম নানা সত্য-মিথ্যা যুক্তি সাজিয়ে। এ কারণেই বিচারব্যবস্থার অনেক হতাশাজনক রায়ের মধ্যে কোনো বিচারকের এহেন পর্যবেক্ষণ এক টুকরো আশার আলো। ক্রমশ হয়ত এই ধারণাও স্পষ্ট হবে যে মাতৃত্ব একটা চয়েস, মোক্ষ নয়। যারা সন্তান চাইছে, যারা চাইছে না, যারা এই মুহূর্তে চাইছে না, যারা শারীরিক কারণে পেরে উঠছে না, যারা নিজস্বতা বজায় রেখেই একলা মা হতে চাইছে — তাদের সকলের পাশে দাঁড়াক রাষ্ট্র।
-- শতাব্দী দাশ