পাঁচটা রাজ্যে যখন নির্ধারিত নির্ঘন্ট মেনে বিধানসভা নির্বাচন চলছে, তখন এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যার মধ্যে বর্তমানের শঙ্কাজনক জরুরি রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে।
২০২১-এর ৩১ মার্চ অর্থমন্ত্রক ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে সুদের হারকে যথেষ্ট মাত্রায় হ্রাস করে, যে হ্রাসের পরিমাণ ছিল ৪০ থেকে ১১০ বেসিস পয়েন্ট। পরদিন ১ এপ্রিল সকালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন টুইট করে জানালেন, সুদের হার একই থাকবে এবং “নজর এড়িয়ে যে নির্দেশিকা জারি হয়েছিল তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে”। সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি পাল্টানোর এই ঘোষণা এপ্রিল ফুল-এর দিন করা হলেও মোদী সরকার কিন্তু তড়িঘড়ি সুদ হ্রাসের সিদ্ধান্ত বাতিল করার মধ্যে দিয়ে তাদের প্রকৃত অভিপ্রায় সম্পর্কে কাউকেই বোকা বানাতে পারল না। স্পষ্টতই, অর্থমন্ত্রককে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুদ হ্রাসের সিদ্ধান্তকে মুলতুবি রাখতে হবে — কেননা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে যাঁরা টাকা রেখেছেন নির্বাচন চলাকালে তাদের বড় ধরনের আঘাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিজেপি’র কাছে রাজনৈতিকভাবে সর্বনাশা হয়েই দেখা দেবে। মোদী সরকারের মানব বিদ্বেষ, অসততা এবং অপদার্থতা এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে এতটা প্রকট হয়ে পড়ছে যে অন্য কোনো ঘটনায় তা আর হয়নি।
ইতিমধ্যে, আসামে বিজেপি’র এক প্রার্থীর গাড়িতে ভোট গ্ৰহণে ব্যবহৃত একটা এক ইভিএম নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে দেখা গেল, নির্বাচনের সময় যেটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে! নির্বাচন কমিশন এই আষাঢ়ে গল্প ফাঁদল যে, ভোট গ্ৰহণে নিযুক্ত কর্মীদের গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল আর তাই পিছনে আসা গাড়িটা যে প্রার্থীর গাড়ি তা না জেনেই তারা সেই গাড়িতে চেপে পড়েছিল। নির্বাচন কমিশনের এই কৈফিয়তে কেউই বিশ্বাস করবে না। ইভিএম চুরির এই ঘটনা আগেকার কাগজের ব্যালটে ভোট হওয়ার সময়ের বুথ দখলের ঘটনার সঙ্গেই তুলনীয়। আসামের অন্য একটা ঘটনায় একটা বুথে মোট ভোটদাতার সংখ্যা ৯০ হলেও সেখানে ভোট পড়তে দেখা গেল ১৭১টা। কাগজের ব্যালটের চেয়ে ইভিএম মেশিনগুলোকে দখল করা বা রিগিং করার সম্ভাবনা যদি এত অনায়াসই হয় তবে সেগুলোকে আদৌ ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?
ত্রুটিপূর্ণ, ঠিকভাবে কাজ করতে না পারা এবং চুরি হয়ে যাওয়া ইভিএম-এর দীর্ঘ ধারার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ধরন দেখা যায়। এই ধরনের যে সমস্ত নিদর্শন সামনে এসেছে, সেই সমস্ত ‘ত্রুটি’ থেকে ব্যাপক সংখ্যাধিক ক্ষেত্রেই লাভবান হয়েছে বিজেপি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নির্বাচন কমিশন এই বক্তব্যকে খণ্ডন করে যে ইভিএম এবং ভিভি প্যাট মেশিনগুলোতে কারচুপি করা সম্ভব, এবং তাও আবার এই ঘটনা সত্ত্বেও যে, এই সম্ভাবনাকে স্বীকার করেই বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ব্যালট মেশিনগুলোকে বাতিল করেছে। এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই যে, নির্বাচনী ফলাফল যাই হোক না কেন, নিজেদের ভোটকে সুরক্ষিত করতে ভারতের নির্বাচকমণ্ডলীকে কাগজের ব্যালটে ফিরে যাওয়ার দাবি তুলতে হবে।
বিজেপি এই ব্যাপারে অবহিত যে, নির্বাচন চলা রাজ্যগুলো সহ সারা ভারতেই তারা এমন দল হিসাবে পরিচিত যারা “সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিয়েছে, আমাদের সব সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছে”। রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের সম্পদের বেসরকারীকরণ, লব্ধ ঋণ শোধ না করে সরকারের বন্ধু কর্পোরেট সংস্থাগুলোর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো থেকে জনগণের সঞ্চয়ের লুট এবং যে অপরিশোধিত ঋণকে অবশেষে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সুদের হার কমানোর চেষ্টা, এমন কৃষি আইন তৈরি করা যা কৃষিকে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেয়, শ্রম আইনগুলোকে লঘু করে তুলে মালিকদের সুবিধা করে দেওয়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বেসরকারীকরণ এবং তারসাথে বেকারির হার ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হওয়া — এই সমস্ত পদক্ষেপ যতই কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় চালিত হচ্ছে, সেগুলো ততই জনবিরোধী হয়ে উঠছে; জনগণ এর পরিণাম ভোগ করছেন ও তার প্রতিরোধ করছেন।
এই সমস্ত ক্ষেত্রে জনগণের তোলা প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে না পেরে বিজেপি তাদের নির্বাচনী প্রচারে সেই পুরনো প্রিয় বিষয়েরই শরণ নিচ্ছে — তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ মুসলিম-বিরোধী ঘৃণাবর্ষী বুলি। অমিত শাহ আসামের ভোটারদের “আত্মনির্ভর আসাম ও মৌলানা-নির্ভর আসামের” মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলেছেন। এরমধ্যে দিয়ে তিনি বদরুদ্দিন আজমল পরিচালিত এআইইউডিএফ-কেই বুঝিয়েছেন, যে সংগঠন বিরোধী জোটের শরিক। পশ্চিমবাংলায় প্রধানমন্ত্রী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে চূড়ান্ত অবমাননাকর ও নারী বিদ্বেষী ভঙ্গিতে সম্বোধন করেছেন। পশ্চিমবাংলার বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, তিনি যেভাবে শাড়ি পরে প্লাস্টার করা ভাঙ্গা পা দেখাচ্ছেন তা ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র বিরোধী, এবং তার পরিবর্তে তাঁকে বারমুডা পরার পরামর্শ দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের প্রতি বিজেপি’র মার্কামারা বিদ্বেষের সাক্ষর রেখে দিলীপ ঘোষ ঘোষণা করেছেন যে বুদ্ধিজীবীরা হলেন সমাজের বোঝা। চলচ্চিত্র, থিয়েটার ও সঙ্গীত জগতের যে শিল্পীরা বিজেপি’র বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, “ওরা যদি রাজনীতির কথা না ছাড়ে আমি ওদের দেখে নেবো। আর আমি যে সেটা কেমনভাবে করতে পারি তা শিল্পীরা জানেন”। পশ্চিম বাংলার মতো রাজ্যে এই ধরনের হুমকিবাজি বিশেষভাবে উদ্বেগের, যে রাজ্য তার প্রাণোচ্ছল ও তর্কপ্রিয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের জন্য দীর্ঘকাল ধরে সুপরিচিত।
তবে বিজেপি প্রচারের সবচেয়ে বিষময় অংশ হয়ে থেকেছে বিদ্বেষময় ভাষণ যার লক্ষ্য হল মুসলিম-বিরোধী ঘৃণার ওপর ভর করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক সৃষ্টি করা, যেটা আজ পর্যন্ত কখনই বাংলার রাজনীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল না। নন্দীগ্রাম আসনে বিজেপি প্রার্থী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে এমন ভাষায় আক্রমণ করেছেন যা বোঝায় যে তিনি হলেন এক মুসলিম মহিলা যিনি ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘রোহিঙ্গাদের’ কাছে ‘ফুপু’। পশ্চিমবাংলায় নির্বাচনী প্রচারে আসা এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন যে মুখ্যমন্ত্রী ‘রোহিঙ্গা গোত্রের’ (নিকৃষ্ট জাতের) মানুষ। এই প্রচারে পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত শরণার্থীদের অন্যতমদের পরিচিতিকে কুকথা হিসাবে ব্যবহার করা হল, এবং তা দিয়ে বোঝানো হল যে, যে প্রার্থী মুসলিম বা মুসলিমদের ঘৃণা না করা হিন্দু, তিনি হিন্দুদের ভোট পাওয়ার যোগ্য নন। এই খোলাখুলি, জলজ্যান্ত ঘৃণাবর্ষী ভাষণের প্রতি নির্বাচন কমিশন নীরবই থেকেছে, আর এটাই তাদের স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।*
তবে, বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবুলি তাদের দেউলিয়াপনা এবং মরিয়াভাবকেই প্রকাশ করে দিচ্ছে। মোদীর বশংবদ গণমাধ্যমগুলো বিজেপি’র অপরাজেয়তা সম্পর্কে এক বিভ্রম সৃষ্টি করতে চেষ্টার কোনো কসুর করছে না। ঐ সমস্ত গণমাধ্যমের সহায়তায় বিজেপি নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে তর্জনগর্জন করছে এবং ভোট পড়ার আগেই নিজেকে অনিবার্য বিজয়ী বলে ঘোষণা করছে! তবে নির্বাচন যত এগিয়ে চলেছে, পাঁচ রাজ্যের ভোটাররা ওদের দাবির যথার্থতাকে প্রতিপন্ন করার চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। বিজেপির বিপুল অর্থ শক্তির (যা অর্জিত হয়েছে সন্দেহজনক ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে) এবং প্রচার যন্ত্রের মোকাবিলা করে শ্রমিক ও কৃষক, নারী ও তরুণ-তরুণীরা জনগণের ইস্যুগুলোকে সফলভাবে সামনে আনছেন এবং বিদ্বেষময় বুলির দ্বারা চালিত হতে অস্বীকার করছেন।
* (বেশকিছু নির্দিষ্ট অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে পেশ হওয়ার পর কমিশন বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষ ও শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।)
***
সেই পাঁচ যুবকের রক্ত এখনও তাজা। শীতলকুচির বাতাসে এখনও বারুদের গন্ধ। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ফরমান অনুযায়ী সেখানে কেউ যেতে পারবেন না।
এদিকে দিলীপ বাবুরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। রগড়ে দেবার ধমকের পর এখন নতুন ধমক — শীতলকুচি করে দেব। অন্য এক বিজেপি নেতার লোকসভা নির্বাচনের ভিডিও মনে পড়ে যাচ্ছে - সোজা বুকে গুলি করা হবে।
লাশ বেছানো রাস্তায় ওরা ভাবছে ওদের বাংলা জয়ের রথ টগবগিয়ে ছুটে চলবে লক্ষ্যের দিকে।
যোগীর এনকাউন্টার রাজ ও এ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড আর অসমের এনআরসি ও ডিটেনশন ক্যাম্প অপেক্ষা করে রয়েছে বাংলা কবে সোনার হবে।
আপনার ভোট যদি হয়ে না গিয়ে থাকে তাহলে এখনও সময় আছে। এক একটা ভোট দিয়ে বলে দিন বাংলাকে জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ হতে দিচ্ছি না।
বিজেপির ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপত্র ‘সোনার বাংলা সংকল্প পত্রে’ পরিবেশিত হয়েছে ১১টি উপশিরোনামে ১৩৪ দফা প্রতিশ্রুতি! সব নেতারাই বলে আসছেন, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ পাঁচ বছরের মধ্যেই ‘সোনার বাংলা’ তৈরি করে দেখিয়ে দেবে! এসব যে ভোটবাজারে হাওয়া তুলতে ভূয়ো কথা দেওয়া তার প্রমাণ ইতিমধ্যে দলের হোতারা বারবার নিজেরাই দিয়েছেন। ভোলাবে কি করে মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর ‘মুখ’ করে কেন্দ্রে প্রথমবার ক্ষমতায় আসতে বছরে দু’কোটি বেকারের হাত চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল! ক্ষমতায় আসার পর ওই প্রসঙ্গ বেমালুম চেপে যাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল! এমনকি তা ‘জুমলা’ অর্থাৎ নির্বাচনী পরিস্থিতিতে ওরকম অনেক কথা দিতে হয় বলে চাপ এড়ানোর অপকৌশল নেওয়া হয়েছিল! দেশের মানুষ দেখছে মোদী সরকারের হাতযশে কেমন ‘সোনার ভারত’ গড়ে উঠছে! বিজেপি শাসনের রাজ্যগুলোকে কেমন ‘স্বর্ণময়’ করে তোলা হচ্ছে! তবু বিরূপতা-বিদ্রূপকে আমল না দিয়ে পুনরায় নির্বাচনী পরিস্থিতিতে দাঁও মারতে নানা ছদ্ম প্রতিশ্রুতির কৌশল নিচ্ছে। প্রতারণার ওস্তাদিকে কিন্তু ঘুরে ফিরে ধরা পড়ে যাওয়া ও অবিশ্বাসের মাশুল গোনার মুখে পড়তে হচ্ছে। সেই মতোই বাংলার নির্বাচনের পরিস্থিতিতে বিজেপির ফেরী করা যাবতীয় প্রতিশ্রুতি মানুষের অবিশ্বাস ও কাঁটাছেড়ার মুখে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। ‘সংকল্প পত্রে’ অসঙ্গতি রয়েছে ছত্রে ছত্রে। বলা হয়েছে, ‘পিডিএস-কে সর্বজনীন করে সমস্ত নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ কিন্তু কেন্দ্রের মোদী সরকারের প্রবণতা হল গণবন্টণ ব্যবস্থার ক্রমাগত সংকোচন করে চলা। খাদ্যশস্যের বিষয়টিকে ক্রমেই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাজারের হাতে তুলে দেওয়া। অতিমারী পরিস্থিতিতে বিনা মূল্যে খাদ্য সরবরাহের প্রশ্নে চরম অমানবিক নির্দয় নিষ্ঠুর নির্বিকার অবস্থান নিয়েছিল কেন্দ্র। এই অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন কি কেবল একটি রাজ্যের? তাতো নয়। প্রয়োজনটি সারা দেশের সমস্ত রাজ্যের। তাহলে গোটা দেশের জন্য চালু করা হয়নি কেন? উল্টে চালু হচ্ছে গণবন্টণ সংকোচনের পলিসি। তাই কেন্দ্রের ক্ষমতায় থেকে ‘কি করছে’র ভিত্তিতেই উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে এ রাজ্যে এলে ‘কি করবে’ প্রচারিত ছদ্মকথা। ‘সংকল্প পত্রে’ ঘোষিত প্রায় প্রতিটি প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। বিস্তারিত পরিসরে সেই তুলোধোনা করা যেতে পারে। আপাতত কয়েকটি বিষয় নিয়ে দু’কথা হতে পারে।
প্রথমত লক্ষণীয়, অদ্ভুতভাবে কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে কিছু মনীষীদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা স্রেফ ভোট সংস্থানের জন্য যথেষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেমন, বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য বিদ্যাসাগর তহবিল স্থাপন, নতুন কলেজ ও পলিটেকনিক কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তহবিল গঠন, গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ‘গুরুদেব রুরাল মিশন’ নির্মাণ, বিচার ব্যবস্থার পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তহবিল স্থাপনের কথা দেওয়া হয়েছে! ইতিহাসে কাদের কি বিশেষত্ব ছিল, আর তাদের স্মৃতিকল্পকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে কেমনতর সব বিষয়ের সাথে! শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা রূপায়ণে উপরোক্ত মনীষীদের স্মৃতিনাম থাকলে তবু সম্মান দেখানো হচ্ছে মনে করা যেত। ইতিমধ্যে অবশ্য বাংলার স্বপ্ননায়কদের নামাঙ্কিত ব্যবসা সংস্থা খুলতে শুরু করেছে। যেমন, ‘নেতাজী সুভাষ ইনস্টিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্ট’! এইসব ব্যাপার স্যাপার জমি তৈরি করে দিচ্ছে। আর বানিয়াদের দ্বারা চালানো পার্টি বিজেপি মনীষীদের স্মৃতি ব্যবহারের প্রকরণে তদনুরূপ নমুনা মিলছে। ‘সংকল্প পত্রে’ বলা হয়েছে, নির্মাণ করা হবে নাকি ‘ক্রিড়া বিশ্ববিদ্যালয়’!
বিজেপির ‘সংকল্প পত্রে’ বলা হয়েছে, ‘বাংলাকে ভারতের সাস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে গড়ে তুলতে সোনার বাংলা তহবিল স্থাপন’ করা হবে। তার মানে বিজেপি ক্ষমতা পেলে বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে ভেঙেচুরে তাদের ছাঁচে ঢেলে গড়বে। বাংলা তো ইতিহাসগতভাবে সুদূর অতীতকাল থেকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হয়েই রয়েছে। তা অন্তত কয়েকশ বছর যাবত তো বটেই। বিশেষত কিছু অতিকথার কথা বাদ দিলে ঐতিহাসিক নবজাগরণের সময়কাল থেকে শুরু করে একদিকে সামন্তবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী এবং অন্যদিকে উপনিবেশবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক সৃজন ও সংগ্রামের পরম্পরা বাংলার আছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন, শ্রেণীসংগ্রাম ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা থেকে শুরু করে গণনাট্য, নবনাট্য, নতুন ধারার চলচ্চিত্রায়ণ, প্রগতি শিল্পসাহিত্য-সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা, লালন থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত, বইমেলা, পছন্দের অনুশীলন ও প্রেম ভালোবাসা, খাওয়া-পরা, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের, ঔদার্যের পরম্পরা। এই সবকিছুর দৌলতে বাংলা সারা দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীর ঐতিহ্য বহন করে আসছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিশেষ অর্জন করেছে। এতে কোনোকালেই সংঘবাদী ধারার কোনও জায়গা ছিল না, বরং বহু ক্ষেত্রে সংঘবাদী ধারার বিরুদ্ধে সংঘাতের মধ্যে দিয়ে এই পরম্পরা বিকশিত হয়েছে। এই ঐতিহ্যকে দিগভ্রান্ত করতে নিচের থেকে আরএসএস সুচতুর প্রয়াস চালিয়ে আসছে। তার কিছু কিছু বিষফলও লক্ষ্যণীয়। এবার বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতা দখলের গন্ধ পেয়ে বাংলার প্রতিষ্ঠিত পরম্পরাকে নিজের ছাঁচে পাল্টে দিতে ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিস্পর্ধার চ্যালেঞ্জ জানানো এবং সংঘবাদী শাসকদের ক্ষমতায় আসতে না দেওয়াই আজ সময়ের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক দাবি।
১২ এপ্রিল ভোটের দিন, সিআইএসএফ জওয়ানরা কোচবিহারের শীতলকুচিতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ৪ জন ভোটারকে হত্যা করে।
এই ৪ জনই গরিব শ্রমিক পরিবারের মানুষ। এরমধ্যে নুর আলম মিয়াঁ এবং মনিরুজ্জামান মিয়াঁ পরিযায়ী শ্রমিক, শমিউল হক প্রথমবারের ভোটার এবং হামিদুল মিয়াঁ মিস্ত্রীর কাজ করতেন। এছাড়াও একটি অন্য ঘটনায় ১৮ বছরের আনন্দ বর্মনকে দুষ্কৃতি গুলি করে হত্যা করে।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর দ্বারা এই গুলিচালনার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তাদের ভূমিকা সম্বন্ধে কিছু গুরুতর প্রশ্ন সকলের মনে জাগিয়েছে। শান্তি বজায় রাখা এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করানোর বদলে, কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালাচ্ছে এবং ভোটারদের মনে ভীতি তৈরি করছে। বিজেপি নেতাদের বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে যে সিআইএসএফ যেন বিজেপি’র পক্ষ নিয়ে ভোটারদের ভয় দেখাতেই এসেছে। নীচে কয়েকটি ঘটনার কথা বলা হল যেখানে বিজেপি নেতারা তাদের ভাষণে শীতলকুচি গণহত্যা উল্লেখ করে সাম্প্রদায়িক হুমকি দিয়েছে এবং ভোটারদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে।
সত্যিটা হল যে বিজেপি নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তাদের নিজেদের পার্টির সেনাবাহিনী হিসেবে প্রচার করছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি কিভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীদের অপব্যবহার করছে।
বিজেপি নেতাদের এই হুমকিগুলো সমাজে সাম্প্রদায়িক বার্তাও দিচ্ছে কারণ সিআইএসএফের গুলিতে মৃত্যু হওয়া সকলেই মুসলমান।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে প্রভাত কুমার
সিপিআই(এম) প্রার্থী সায়নদীপ মিত্রের সমর্থনে কামারহাটি বিধানসভা কেন্দ্রের দেশপ্রিয়নগর কলোনি বাজার এলাকায় সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে। ভিড়ে ঠাসা এই জনসভায় প্রচুর সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। গান ও কবিতা পরিবেশন করেন নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার এবং শোভনা নাথ। সভা পরিচালনা করেন সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য কমিটির সদস্য নবেন্দু দাশগুপ্ত। তিনি প্রারম্ভিক উপস্থাপণায় বিজেপি’র বিপদের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। মনে করিয়ে দেন কামারহাটি এলাকায় নানা বিতর্ক নিয়েও সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-এর যৌথ লড়াই আন্দোলনের কথা। আগামীদিনে কঠিন পরিস্থিতিতে তা আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বানও তিনি রাখেন। সিপিআই(এম)-এর প্রার্থী সায়নদীপ ছিলেন সভার শেষ বক্তা। তিনি এই সভা আয়োজনের জন্য ও সেখানে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতির জন্য আয়োজকের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। সিপিআই(এমএল)-এর ১২ আসনে প্রার্থী দেওয়াকে উল্লেখ করে বলেন বিভিন্ন বাম দলের শক্তি যত বাড়বে আমাদের লড়াই আরও শক্তিশালী হবে। তাঁর বক্তব্যে তিনিও বিজেপি’র বিপদের নানা দিককে তুলে ধরেন এবং বামপন্থীদের যৌথ লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি সংসদ বা বিধানসভায় প্রতিনিধিত্বের গুরুত্বের কথা মনে রেখেও বেশি জোর দিতে চান মানুষের পাশে থেকে গণসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের দিকে এবং মনে করিয়ে দেন এই লড়াইয়ে বামপন্থীরাই মানুষের সবচেয়ে ভরসার শক্তি। সভার প্রথম বক্তা ছিলেন আইসার ছাত্রনেতা সৌমেন্দু মিত্র। তিনি বলেন যে বাংলার নির্বাচনে ধর্ম নিয়ে, নাগরিকত্ব নিয়ে নানা ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে প্রচুর কথা বলছেন বিজেপির নেতারা। কিন্তু ছাত্রদের কথা, শিক্ষার অধিকারের কথা, কর্মসংস্থানের কথা তারা কিছু বলছেন না। মূলত ছাত্র ও যুবদের আশা আকাঙ্খার নিরিখ থেকে কেন বিজেপি’র বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম দাঁড়াতে চান, সেটাই সৌমেন্দু তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন। এরপর এই নির্বাচন, তার বিশেষ গুরুত্ব ও তাতে সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচন অত্যন্ত বিশেষ একটা নির্বাচন। আরএসএস ১৯২৫ সালে তৈরি হওয়ার পর থেকেই একটা স্বপ্ন দেখে এসেছে। এই দেশটাকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। একশো বছর পরে আজ সর্বস্তরে বিজেপি’র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে মরীয়া চেষ্টা, তার লক্ষ্য এটাই। একটা নির্বাচনে স্থানীয় প্রশ্ন সহ অনেক প্রশ্ন থাকে। কিন্তু এই নির্বাচনে বাংলা জয়ের জন্য বিজেপি সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি’র তাবড় নেতারা এখানে ঘাঁটি গেঁড়ে বসে রয়েছেন বা ঘনঘন যাতায়াত করছেন। এই নির্বাচন তাই স্বাধীনতার পরে, সংবিধান তৈরি হবার পর দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়ে উঠেছে। গোটা দেশের চোখ এখন এই নির্বাচনের দিকে।
বিজেপি এখনো অবধি ক্ষমতা দখল করেছে মূলত হিন্দি বলয়ে। কিন্তু সেখানেও মানুষ বিজেপি’র বিরুদ্ধে যেতে শুরু করেছে। চলমান কৃষক আন্দোলন আমাদের একটা অদ্ভুত জিনিস এর মধ্যেই দেখিয়েছে। ২০১৩-তে উত্তরপ্রদেশে যে দাঙ্গা হয়েছিল, যাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করেছিল, যোগী আদিত্যনাথ তারপর উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই দাঙ্গার ষড়যন্ত্রে যাদের কাজে লাগানো হয়েছিল, তারা কৃষকের সম্মানের জন্য রুখে দাঁড়ালেন। উত্তরপ্রদেশ পালটে যাচ্ছে। বিহারের নির্বাচনে অল্পের জন্য বিজেপি’কে আটকে দেওয়া যায়নি, নানা কারচুপি করে তারা জিতেছে, কিন্তু বামপন্থীরা সেখানে শক্তি অর্জন করে নিতে পেরেছে। ঝাড়খণ্ডে বিজেপি হেরেছে। মহারাষ্ট্র তাদের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। হিন্দি বলয়ের বাইরে বিজেপিকে আজ তাই নতুন দিকে তাকাতে হচ্ছে। তাদের নজর দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের দিকে। বিশেষভাবে বাংলার দিকে।
বাংলার নির্বাচন জেতার জন্য বিজেপি নানা কৌশল নিচ্ছে। একটা স্নায়ুযুদ্ধ তারা শুরু করেছে। প্রথম থেকেই জিতে গেছি, জিতে গেছি এই রব তুলে তারা সুবিধে নিতে চাইছে। বাংলা এত সহজে বিজেপিকে জিততে দেবে না। বাংলা দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থীদের শক্তিশালী ঘাঁটি। কিন্তু যারা বামপন্থী নন, সেই বাঙালিও বিজেপিকে রুখবেন। বাংলার যে হিন্দু মানুষ তারা অন্য ধরনের। এই মাটি রামকৃষ্ণদেবের মাটি, যিনি ‘যত মত তত পথ’ এর কথা বলেন। বাংলার বিবেকানন্দ তাঁর চিকাগো বক্তৃতায় গর্ব করে বলেন, তিনি তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছেন যারা সারা দুনিয়ার নিপীড়িতদের, শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। এই উত্তরাধিকারের জন্য তিনি গর্বিত। আর আজকে যারা সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত ও শরণার্থী – সেই মায়ান্মার থেকে তাড়া খেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আজকে ভারতবর্ষ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সদ্য বিজেপি হওয়া শুভেন্দু অধিকারী মমতা ব্যানার্জীকে আক্রমণ শানানোর সময় বলছেন যে তিনি নাকি রোহিঙ্গাদের পিসি।
বিজেপি উদার হিন্দু সংস্কৃতির জায়গায় এক অন্য ধরনের হিন্দুত্বের আমদানি করছে। এটা সাভারকরের দেওয়া হিন্দুত্বের ধারণা। যে সাভারকর বলেছিলেন যে এদেশে কেউ জন্মালেই, দেশের জন্য শ্রম করলেই, দেশের জন্য আত্মত্যাগ করলেই তাকে এদেশের প্রকৃত নাগরিক বলা যাবেনা। এদেশের বুকে জন্ম নেওয়া ধর্ম যদি কেউ মানে, তবেই তাকে এদেশের নাগরিক বলতে হবে। তাই খ্রিষ্টান বা মুসলিমরা এদেশের প্রকৃত নাগরিক নন। তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই থাকতে হবে।
বাবুল সুপ্রিয়রা একটা গান তৈরি করেছেন যেখানে তারা বলছেন যে তুমি খেজুর বেচতে এসেছ, তুমি এদেশের মাটি চেনো না। তারা খাবার থেকে, পোষাক আশাক থেকে সমস্ত কিছুর সূত্রেই মানুষকে এইভাবে ভাগ করতে চায়। তারা বামপন্থীদের বলে টুকরে টুকরে গ্যাং, আসলে তারাই এদেশের সংস্কৃতি মানুষ সবকিছুকে টুকরো টুকরো করতে চায়।
বাংলার বুকে চৈতন্যদেব থেকে শুরু লালন ফকিরের যে উদার মতবাদ আমরা দেখেছি, রামমোহন বিদ্যাসাগরের আমল থেকে যে সংস্কার হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল হয়ে যে সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে উঠেছে – বিজেপি’র এই উগ্র হিন্দুত্ব তার সঙ্গে কোনওভাবেই মেলে না।
মোদী সরকার সবকিছুকে বেচে দিতে চাইছে। রেল-ব্যাংক-খনি সবকিছুই তারা কয়েকটা বেসরকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে চাইছে। একটা নতুন কথা বলা হচ্ছে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জায়গায় এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সবকিছুই আদানি-আম্বানি-গুজরাটিদের কাছে বেচে দেওয়া হচ্ছে।
লাভ জেহাদের নামে শুধু মুসলিম যুবকদের ভালোবাসার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না। হিন্দু মহিলাদের স্বাধীন পছন্দের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আজ বলা হচ্ছে তুমি মুসলিমদের বিয়ে করতে পারবে না। কাল বলা হবে তুমি জাতের বাইরে বিয়ে করতে পারবে না। পরের দিন বলা হবে বাবা মা পরিবারের পছন্দ করে দেওয়া কারোর বাইরে বিয়ে করতে পারবে না। রামমোহন বিদ্যাসাগরের সময় থেকে নারী স্বাধীনতার যে লড়াই চলেছে, তাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
কাগজ দেখাতে পারেননি বলে আসামে কুড়ি লক্ষ মানুষকে বে-নাগরিক করে দেওয়া হচ্ছে। গরিব মানুষের কাগজ থাকেনা অনেক সময়েই। তার মানেই তারা নাগরিক নন? ডাউটফুল ভোটারকে ডিটেনশান ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে। এক একটা পরিবারকে আসামে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। বাবা মা বাড়িতে তো ছেলেমেয়েরা ক্যাম্পে। আগামীদিনে যদি এনআরসি গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তবে সবচেয়ে বড় বিপদ হবে বাঙালিদের। পশ্চিমবাংলার প্রবাসী শ্রমিকদের বলা হবে বাংলাদেশী। এরকম ঘটনা এরমধ্যেই নানা জায়গায় ঘটতে শুরু করেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে, এনআরসি আটকাতে বিজেপিকে হারাতেই হবে।
অনবরত মিথ্যে প্রচার চালানো হচ্ছে বিজ্ঞাপণের মধ্যে দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় এমন একজনের ছবি দিয়ে বাড়ি পাওয়ার বিজ্ঞাপণ দেওয়া হচ্ছে যে তিনি বাড়ি পাননি। তিনি জানেনই না তাঁর ছবি দিয়ে আবাস যোজনার বিজ্ঞাপণ হচ্ছে।
কংগ্রেস জমানায় অনেক খারাপ কাজ হয়েছে। বাম জমানায় ভালো কাজের পাশাপাশি শেষদিকে কিছু ক্ষতিকর কাজও হয়েছে। তৃণমূল জমানাতেও দশ বছরে অনেক খারাপ কিছু হয়েছে। কিন্তু সব দলের সব খারাপ কাজকে মেলালেও তা বিজেপি’র মতো খারাপ হবে না। এই দল এতটাই আলাদা অন্যদের থেকে, এতটাই ভয়ানক। বাংলাকে যদি বিজেপি’র হাত থেকে বাঁচানো না যায়, তা শুধু তৃণমূলের পরাজয় হবে না, তা বামপন্থীদেরও পরাজয় হবে। সমগ্র বাংলার পরাজয় হবে। তৃণমূল কংগ্রেসি ঘরানা থেকে তৈরি হওয়া একটা দল। তারা দশ বছর শাসন করেছে। আগামীদিনে তারা নাও থাকতে পারে। কিন্তু বিজেপি বাংলা দখল করলে সেটা বামপন্থীদের জন্য হবে সবচেয়ে ভয়ানক। সে কথাটাই ত্রিপুরা থেকে এসে বারবার বলার চেষ্টা করছেন সেখানকার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার।
আমরা ঠিক করেছি এই নির্বাচনে বিজেপি যাতে বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে না পারে তার জন্য আমরা এখানে সর্বাত্মকভাবে প্রচার করব। আমরা নিজেরা এবারে পশ্চিমবঙ্গে খুব কম, বারোটা আসনে লড়ছি। মূলত যে সব জায়গায় বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম চলছে, সেই লড়াইয়ের প্রতিনিধিরাই আমাদের হয়ে এখানে নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করছেন। যেমন চা বাগান আন্দোলনের প্রতিনিধি ২৬ বছরের সুমন্তি এক্কা লড়ছেন ফাঁসিদেওয়া থেকে। মালদার মোথাবাড়ি থেকে লড়ছেন বিড়ি শ্রমিকের অধিকার নিয়ে লড়াই করা এব্রাহিম শেখ। হুগলির ধনেখালি থেকে লড়ছেন মাইক্রো ফিনান্স-এর মহাজনী ঋণে জর্জরিত মানুষের ঋণমুক্তি আন্দোলনের সামনের সারির সৈনিক সজল দে।
এর বাইরে সিপিআই(এম) সহ সমস্ত বিজিত বামপন্থী বিধায়কদের আমরা সমর্থন করছি। এর বাইরেও অনেক জায়গায় বিভিন্ন আন্দোলনের মানুষদের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকছে। যেমন নাগরিকত্ব আন্দোলনের নেতা সিপিআই-এর কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে আমরা সমর্থন করছি। এর বাইরে অন্যান্য আসনে আমরা বলেছি বিজেপিকে হারাতে ভোট দিতে। এটা আমরা নির্দিষ্ট করে দিতে চাইনি। আসনভিত্তিক ভাবে মানুষের বিচারের ওপরে ছেড়ে দিয়েছি। এজন্য বামপন্থীরা অনেকে আমাদের গালমন্দ করছেন। বলছেন তৃণমূলের দালাল ইত্যাদি। তা যদি কেউ বলতে চান বলুন। কিন্তু মনে রাখা ভালো পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের নেতারাও বাংলায় এসে একই কথা বলছেন। বিজেপিকে ভোট দেবেন না।
আমেরিকা চার বছরের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারতকে যদি মোদী, অমিত শাহদের হাত থেকে ২০২৪ সালে মুক্তি পেতে হয় তাহলে অতি অবশ্যই ২০২১-এর নির্বাচনে বাংলায় বিজেপিকে হারাতে হবে। ২০২২-এর নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে হারাতে হবে।
অনেক তরুণ বামপন্থীরা লড়ছেন এই নির্বাচনে এটা খুবই ভালো ব্যাপার। আমাদের সুমন্তি এক্কা, সৌরভ, এব্রাহিম, সজলদের মতোই সিপিআই(এম)-এর মীনাক্ষি, দীপ্সিতা, সায়নদীপ-এর মতো অনেক তরুণরা লড়ছেন। তাদের সাফল্য কামনা করি। এই কেন্দ্রের প্রার্থী সায়নদীপ শুধু সিপিএই(এম) প্রার্থী নন, তিনি এখানে সিপিআই(এমএল)-এরও প্রার্থী। আপনারা তাকে বিজয়ী করুন। বিজেপিকে পরাস্ত করুন।
শীতলকুচিতে আধা সামরিক বাহিনীর গুলিচালনায় চারজন ভোটার নিহত হওয়ার পর গোটা রাজ্য জুড়ে এক উথাল-পাথাল পরিস্থিতি শুরু হয়। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সংগঠিত করার বাহানায় নজীরবিহীন সংখ্যায় আধা সামরিক বাহিনীর মোতায়ন, প্রয়োজনে গুলি চালাবার ক্ষমতা তাদের হাতে তুলে নির্বাচন কমিশন গোটা প্রক্রিয়ায় বিজেপি’র হয়ে যেভাবে পক্ষপাতিত্ব শুরু করে তা রাজ্যের গণতান্ত্রিক বিবেককে রীতিমতো ক্ষুব্ধ করে তোলে। দেখা গেল, শীতলকুচির গুলিকান্ডের পর প্রয়োজনে সর্বত্র তা রাজ্যে প্রয়োগ করা, চারের বদলে আটজনকে হত্যা করা প্রভৃতি নানা উস্কানিমূলক বিবৃতি দেওয়া শুরু করলো রাজ্যের বিজেপি নেতারা।
এর বিরুদ্ধে, যাদবপুরের পাল বাজারে ঘটনার পরদিন, ১১ এপ্রিল যাদবপুর ঢাকুরিয়া এলাকা পার্টির পক্ষ থেকে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন, মানস ঘোষ, মিতালি বিশ্বাস, তরুণ সরকার, অতনু চক্রবর্তী ও আকাশ দেশমুখ। সভা পরিচালনা করেন সুশান্ত দেবনাথ। এলাকার মানুষেরা আগ্রহের সাথে সভায় বক্তাদের বক্তব্য শোনেন।
১২ তারিখ মৌলালী মোড়ে একই ইস্যুতে এক বিক্ষোভসভা হয়। সেখানেও সভার শুরুতে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালিত হয়। আইসা’র সাথে পার্টির পক্ষ থেকে এই সভায় বৃহত্তর কলকাতার কর্মীরা অংশ নেন। সভায় বক্তব্য রাখেন অতনু চক্রবর্তী, নীলাশীষ বসু, মন্সুর আলি, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, কিশোর সরকার, নির্মল ঘোষ, ও কার্তিক পাল। গোটা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন দিবাকর ভট্টাচার্য।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে শীতলকুচিতে গণহত্যার প্রতিবাদে হুগলি জেলার বিভিন্ন জায়গায় সিপিআই(এমএল) এবং এআইপিএফ এবং এপিডিআরের পক্ষ থেকে ধিক্কার কর্মসূচী পালিত হয়। কোন্নগরে পার্টির পক্ষে দলীয় অফিসের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়ে হিন্দমোটর বাজার ঘুরে বিপিন ভিলা মোড়ে এসে শেষ হয়। চারজন শহিদের নামাঙ্কিত বেদীর সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ছাত্র নেতা সৌরভ। পান্ডুয়া ব্লকের কোঁচমালি রায়পাড়ায় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এই মিছিলে গ্রামের মহিলারা বেশি সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন। মিছিলের শেষে শিশু সহ সকলেই মোমবাতি প্রজ্বলন করে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে এআইপিএফ এবং এপিডিআর-এর পক্ষ থেকে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়, সভায় বক্তব্য রাখেন সনৎ রায়চৌধুরী, কমল দত্ত, বটকৃষ্ণ দাস, কল্যাণ সেন, সুদর্শন বসু, শ্যামল ঘোষ ও অমল। কর্মসূচী চলাকালীন উপস্থিত সদস্যরা ধিক্কার পোস্টার হাতে নিয়ে প্রদর্শন করেন।
চতুর্থ দফার নির্বাচনে কোচবিহারের শীতলকুচিতে বিনা প্ররোচনায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চারজন যুবকের প্রাণহানির ঘটনায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নির্বচন কমিশনকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তৈরি করার পরিকল্পিত চেষ্টার প্রতিবাদে এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও মৃতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের দাবিতে, শিলিগুড়িতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে ১২ এপ্রিল বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত হয় এবং নিহতদের স্মরণ করা হয়। কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন উদ্যোক্তা সংগঠনের দার্জিলিং জেলা কমিটি সদস্য পুলক গাঙ্গুলী এবং মোজাম্মেল হক। কর্মসূচী পরিচালনা করেন শাশ্বতী সেনগুপ্ত। এছাড়াও ফাঁসিদেওয়া বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী প্রচারে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়।
সংযুক্ত কিসান মোর্চা ‘এফসিআই বাঁচাও’ ডাক দিয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে সিপিআই(এমএল) ও সারা ভারত কিসান মহাসভা ৫ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্ণা প্রতিবাদ কর্মসূচী সংগঠিত করে। মৌ, গাজিপুর, চন্দৌলি, জালাউঁ ও অন্যান্য জেলায় কর্মসূচী সফলভাবে পালিত হয়। প্রতিবাদ কর্মসূচী স্থলে অনুষ্ঠিত জনসভাগুলিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, মোদী সরকার যে তিনটে কালা কৃষি আইন জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তার একটাতে বলা হয়েছে কৃষকরা খোলা বাজারে তাদের উৎপন্ন ফসল বিক্রির ‘স্বাধীনতা’ পাবে। এই স্বাধীনতা একটা ভ্রান্তি ছাড়া অন্য কিছু নয়। কেননা, বাস্তবে এটা মাণ্ডি সমিতিগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করছে, যে মাণ্ডি সমিতিগুলো সরকারের হয়ে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহ করে। আরও প্রশস্ত করছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথ। মাণ্ডি সমিতিগুলো যে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহ করে সেগুলোই এফসিআই-এর গুদামে জমা হয়, সেখান থেকে যায় রেশন দোকানগুলোতে, যেখান থেকে দরিদ্ররা কম দামে খাদ্যদ্রব্য পান। সরকার যদি মাণ্ডি সমিতিগুলোর মাধ্যমে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহ বন্ধ করে দেয় তবে এফসিআই-এর আর অস্তিত্ব থাকবে না এবং দরিদ্রদের ভর্তুকিতে রেশন পাওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। আর তাই দরিদ্রদের এবং সারা দেশের স্বার্থেই এফসিআই-কে বাঁচানো এবং তিনটে কৃষি আইনকে বাতিল করাটা জরুরি বলে বক্তারা তাঁদের বক্তব্যে তুলে ধরেন।
একটা কুৎসিত মিম যেখানে মেয়েদের কাজের বাধ্যতা-স্বাধীনতা, তাদের রূপ রঙ নিয়ে চরম নারীবিদ্বেষী মনোভাব প্রচারিত হলো। মনুবাদীদের কাছ থেকে এরচেয়ে ভালো কি আর আশা করা যায়!
মনুবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সেনাপতি ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকরের জন্মজয়ন্তীতে গোঁদলপাড়া আইসা পরিচালিত বিশ্বজিত দে স্মৃতি কোচিং সেন্টারের ছাত্র ছাত্রীরা সমবেত হয়ে আম্বেদকারের মূর্তিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। উপস্থিত রানী (মা হাসপাতালে কাজ করেন), রিংকু-খুশি (মা জুট মিলের শ্রমিক), মাধুরী (দিদার কাছে থাকে, মামার বাড়ির রান্না, বাসন মাজার কাজ করে তারপর স্কুলে যেতে হয়), নেহা (বাবা নাইট গার্ডের কাজ করতেন, কিছুদিন আগে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান, তিন মেয়েকে নিয়ে মা কাজ করে সংসার চালান), জবা (মা কাজ করেন), গুলশান (মা মেহনতি) কষ্ট করেই পড়াশোনা করছে।
ওদের শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার সহ সমস্ত যখন কেড়ে নিতে উদ্যত ফ্যাসিস্ট শক্তি তখন বাবাসাহেবের জন্মদিনে, “শিক্ষিত হও, ঐক্যবদ্ধ হও, লড়াই করো” তাঁর এই শিক্ষাকে স্মরণ করে, সংবিধান বাঁচানো, দেশ বাঁচানোর শপথ নেওয়া হয়। এলাকার শ্রমিক সংগঠকরা এই কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন।
আইনের সন্ত্রাস এমনই যে মৃত্যুর কারণ কি তা খোলসা করে বলা যাবে না। বিষাক্ত মদ খেয়েই মানুষগুলো যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সে কথা প্রকাশ করে অসুস্থতার যথাযথ চিকিৎসা হতে পারল না ঐ আইনের সন্ত্রাসের জন্য। না হলে অসুস্থদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর হাসপাতালের কর্মীরা বলতে পারে — এদের ফিরিয়ে নিয়ে যাও, নইলে মদ খাওয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের হবে! রাজ্যে আইন করে মদ নিষিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু যারা মদ খেতে চায় তাদের মদের নাগাল পেতে অসুবিধা হয় না, চাইলে ঘরেই পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট মার্কার কারণসুধা!
বিষাক্ত মদ খেয়ে বিহারের নওদায় মৃত্যু হল ১৭ জনের, গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আরো ৮ জন। গোটা ঘটনার পিছনে আসল সত্যিটা কি তা জানতে সিপিআই(এমএল)-এর একটা তদন্তকারী দল ৫ এপ্রিল নওয়াদা গিয়ে নিহত এবং আহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। সেই দলে ছিলেন ঘোষির সিপিআই(এমএল) বিধায়ক রামবলি সিং যাদব, রাজ্য স্থায়ী কমিটির সদস্য ও এআইকেএম নেতা রামাধর সিং, জেলা সম্পাদক নরেন্দ্র সিং, ভোলা রাম এবং সিপিআই(এমএল) নেত্রী সুদামা দেবী।
তদন্তকারী দল যা জানতে পারে তা হল — প্রশাসনিক অবহেলা এবং দানবীয় মদ নিরোধক আইনের সন্ত্রাসের জন্যই মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলে। প্রশাসনের পক্ষে যথাসময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হলে বেশ কয়েকজনের জীবনই বাঁচানো যেত। যে স্থলে ঘটনাটা ঘটে তা জেলাশাসকের অফিসের ঠিক পিছনেই। এই ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে নীচু তলার পুলিশ কর্মীদের নিশানা করা হচ্ছে। মদ নিরোধক আইন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং বিহার এখন অবৈধ মদের কবজায়। আর, এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা যে, রাজনীতিবিদ-প্রশাসন-মদ মাফিয়ার গাঁটছড়া ছাড়া অবৈধ মদের ব্যবসা চলতে পারে না। এই গাঁটছড়াকে আড়াল করতে পুলিশ মায়া দেবী নামে এক দরিদ্র মহিলা কর্ণ বিক্রেতাকে গ্ৰেপ্তার করে জেলে পুরেছে এবং বিকাশ মিশ্র নামে এক চৌকিদারকে বিষাক্ত মদ তৈরির অভিযোগে সাসপেন্ড করেছে।
নিহতদের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ বিষাক্ত মদ বলে উল্লেখ করা হলেও পুলিশ মৃতদের পরিবারের সদস্যদের লিখতে বাধ্য করে যে, মৃত্যু হয়েছে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে বা মৃগি রোগে। তদন্তকারী দলের সদস্যরা বিষাক্ত মদ পানে মৃত ভূষণ রাজবংশির বাড়ি গেলে সেখানে দু’জন পুলিশ কর্মীকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখেন। প্রশাসনের চাপে নিহত ব্যক্তির মেয়ে আমাদের বলেন, তাঁর বাবার মৃত্যু বিষাক্ত মদ খেয়ে হয়নি, হয়েছে মানসিক উত্তেজনার কারণে, ময়না তদন্তের রিপোর্ট যদিও অন্য কথা বলছে। প্রশাসনের দিক থেকে চরম ন্যক্কারজনক ঘটনাটা ঘটল জেণ্ডা বিগাহা গ্ৰামে। তদন্তকারী দল সেই গ্ৰাম থেকে ফেরার পর পুলিশ গ্ৰামবাসীদের ওপর আক্রমণ চালায়, তাঁদের অপরাধ হল, তাঁরা সিপিআই(এমএল)-এর তদন্তকারী দলের সদস্যদের কাছে বিষাক্ত মদ খেয়ে মৃত্যুর কথা ফাঁস করেছেন!
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন ২০২১-এর শুরুতে আমেরিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে তখন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বলা হয়েছিল ভারত করোনা মোকাবিলায় অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু এই প্রগলভতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দ্রুতই ভারতে আছড়ে পড়েছে। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, দিল্লী, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য কয়েকটি প্রদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগে রেখেছে। বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, গবেষকরা সতর্ক করছেন। পশ্চিমবঙ্গে আট দফা নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচনী মিটিং-মিছিল-সমাবেশের ভিড় তো লেগেই আছে, একইসঙ্গে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ভিড়ও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ভোট কেন্দ্রে থার্মাল স্ক্যানার, স্যানিটাইজার, বোতাম টেপার হাতের জন্য গ্লাভস্ —সবকিছুই রাখা হচ্ছে। কিন্তু ব্যবহারে ভুল তো হয়ে যেতেই পারে। প্রতিটি বুথ পিছু ভোটার সংখ্যা হাজারে বেঁধে দিলেও দুই ভোটারের মধ্যে তিন ফুট দূরত্বের ব্যবধান থাকছে না। ভেতরে পোলিং এজেন্টদের বসার জায়গাও যথেষ্ট দূরত্ব মেনে থাকছে না। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সমূহ সম্ভাবনা থাকছেই। রোগ লক্ষণ ছাড়া যাঁরা জীবাণু বহন করছেন তাদের সংস্পর্শে যারা আসছেন তারাও সংক্রমিত হতে পারেন। এসব নিয়ে আদৌ দুর্ভাবনা থাকছে না।
রাজনৈতিক দলগুলির কর্তাব্যক্তিদের, কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, পুলিশ-প্রশাসন, কেন্দ্রীয় বাহিনী কারও কি কোনো হুঁশ আছে? এরই মধ্যে উপরন্তু রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চারজন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গেলেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুও ঘটছে। মারা গেলেন অধ্যাপক ও কবি পবিত্র কুমার মুখোপাধ্যায়। প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক।
করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে প্রশ্ন উঠছে, আবারও কি লক ডাউন করা হবে? এই রাজ্যে, এই দেশে? এই প্রশ্নে সাধারণ নাগরিকরা শঙ্কিত, কেন্দ্রের মোদী সরকারকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। আম জনতার সার কথা হল, যেটুকু কর্মসংস্থান রয়েছে তা বন্ধ করে দিতে যেন আর লক ডাউন ঘোষণা করা না হয়। হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকরা ২০২০-র মার্চ নাগাদ লকডাউন জারি হওয়ার পর টের পেয়েছিলেন কাজ হারানো, এতটুকু অর্থের সংস্থান না থাকা, দিনের পর দিন ভুখা পেটে থাকা, কেবলই পথ হাঁটা আর ঘরবাড়িতে ফেরা অনিশ্চয়তার শিকার হয়ে জীবন-জীবিকার পরিণতি কি নিদারুণ হতে পারে! প্রাণে বাঁচতে তারা নিজের নিজের গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সহযোগিতা না করে কেন্দ্রীয় সরকার ফেরার পথ রুদ্ধ করে দেয়। এক অ-সরকারী সংস্থার হিসাব অনুসারে পায়ে পায়ে পথ হেঁটে ফিরে আসতে গিয়ে প্রায় চার শতাধিক পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণ নাশ হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এইসব হৃদয় বিদারক তথ্য পরিসংখ্যান স্বীকার করে না, কোনও খবরই রাখে না। নাগরিক জনতার কত কত অংশ দেশের কোনো কোনো রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত? পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা কোথায় কত?
করোনায় আমাদের দেশে এপর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ১ লক্ষ ৬৯ হাজারের কিছু বেশি। পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজারের ওপর। দেশে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক। পশ্চিমবঙ্গে টেস্ট বাড়ালে দিনপ্রতি পজিটিভের সংখ্যা ১০ হাজার হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মিউট্যান্ট ভাইরাস ভীষণ পরিবর্তনশীল। টিকাকরণ চলছে ১০ কোটি ছুঁই ছুঁই। এখন শোনা যাচ্ছে টিকা সরবরাহে ঘাটতি থাকছে, হাসপাতালে শয্যা সংখ্যার ঘাটতি রয়েছে। এখনও অনুর্দ্ধ ৪৫ বয়সীদের টিকা শুরু হয়নি। তাতেই ঘাটতি! খবরে প্রকাশ, কিছু কিছু রাজ্যে যেমন, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, পাঞ্জাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব থাকছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে অ্যাকটিভ রোগীর সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। মহারাষ্ট্রে ৫,৩৮০০০, ছত্তিশগড়ে ৮৫,০০০, কর্ণাটকে ৫১,৭০০, উত্তরপ্রদেশে ৫৮,৮০০, কেরালায় ৪০,০০০। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের খবর হল, অ্যাক্টিভ পেশেন্টদের ০.৪৬ শতাংশ ভেন্টিলেটরে, ২.৩১ শতাংশ আইসিসিইউ, ৪.৫১ শতাংশ অক্সিজেনের সাহায্যে চিকিৎসাধীন। টিকা নিলেই কি প্রতিরোধ নিশ্চিত? এপ্রসঙ্গে বেলেঘাটা নাইসেডের বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী জানালেন, টিকা নেওয়ার পর করোনা হলে ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হবে। খবরে প্রকাশ, এইমস-এর টিকা নেওয়া জনা ত্রিশ ডাক্তারের করোনা পজিটিভ হয়েছিল। তাঁরা চিকিৎসাধীন। সুতরাং টিকা নিলেই করোনা হবে না এই ধারণা ভুল। তাই মুখাবরণ পরা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা উচিত। করোনা মোকাবিলায় প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর গুরুত্ব বিরাট। সেটা করতে হলে দারিদ্র থেকে মুক্তি আবশ্যিক প্রয়োজন। তাই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন দারিদ্র কমাতে সরকারী হস্তক্ষেপ খুবই জরুরী।
সুতরাং করোনার মোকাবিলায় লকডাউন কোনো পন্থা হতে পারে না। মানুষকে সচেতন করা, মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, মানুষের আর্থিক উপায় অব্যাহত রাখা, দ্রুত গতিতে টেস্ট ও টিকা অভিযান চালানো, হাসপাতাল ব্যবস্থাকে তৈরি রাখা — এসব করে চলতে পারলে মানুষ নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে।
- নিত্যানন্দ ঘোষ
একুশে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন লিঙ্গবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এক নজিরবিহীন নজির হয়ে রইলো। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে রইলো এই বিদ্বেষ। সৌজন্যে, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল — বিজেপি। করোনার এই সুনামি-ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে প্রায় করোনামুক্ত এই রাজ্যে আট দফায় নির্বাচনের পিছনে এক গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। এবং সেখান থেকেই দলটির মানববিদ্বেষী ক্রূর চেহারাটা আরেকবার স্পষ্ট হয়ে গেল।
প্রচারপর্বে রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর মোকাবিলায় বিজেপি’র এক ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সর্বভারতীয় নেতা, ভিন রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করলেন, নারী বিদ্বেষের গরল ছড়ালেন ভাষায়, শরীরী ভঙ্গিমায়। রাজ্যনেতারা তাতে যোগ্যতর সঙ্গত করলেন, বলাই বাহুল্য!
তৃতীয় এবং বিশেষ করে চতুর্থ দফার নির্বাচন গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকলো। সেই কলঙ্ক সামনের দফাগুলোকে গ্রাস করবে কিনা সেই আশঙ্কা সবার মনেই।
কিন্তু এইরকম একটি আবহে নির্বাচনে ‘নারী’ একটি বিশেষ প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে উঠল কেন? পাঁচটি রাজ্যের প্রায় সব দলের কাছে? সেটা কি এই জন্যে যে, রাজ্যগুলিতে মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি, এমনকি চারটিতে পুরুষের সমান বা তার চেয়েও বেশি? কেরালা, তামিলনাড়ু, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে মহিলা ভোটারের অনুপাত যথাক্রমে ৫১.৪%, ৫০.৫%, ৪৯.৩৫% এবং ৪৯.০১%। না কি, মহিলারা না এগোলে সমাজ এক পা-ও এগোবে না — এই চূড়ান্ত সত্যটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে রাজনৈতিক দলগুলো?
কিন্তু এখানে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। সাধারণভাবে বলা যায় মহিলাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি সবার ঝুলিতেই। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি একধাপ এগিয়ে কর্মসংস্থানে ৩৩% সংরক্ষণের কথাও বলেছে। নিখরচায় যাতায়াতের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
তামিলনাড়ুতেও উপহারের ছড়াছড়ি। বিনামূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার, ওয়াশিং মেশিন পর্যন্ত আছে! এটা অবশ্য ওখানে নতুন কিছু নয়। নতুন যেটা সেটা হল মেয়েদের গার্হস্থ্য শ্রমের মজুরির কথা বলেছে কামাল হাসানের পার্টি। আর বিভিন্ন দল, কেউ মাসে ১৫০০, কেউ ১০০০ টাকা করে মেয়েদের হাতে দেওয়ার কথা বলেছে। আমাদের পশ্চিমবাংলার শাসক দলও কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, রূপশ্রী এই সব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সাথে মহিলাদের হাতখরচ বাবদ মাসে ৫০০ টাকা (এসসি, এসটি-দের জন্য ১০০০ টাকা) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মোদ্দা কথা, যে গার্হস্থ্য শ্রমের স্বীকৃতি ও মর্যাদার জন্য মহিলা সংগঠনগুলো লড়াই করছে-সেটা অন্তত নৈতিকভাবে রাজনৈতিক বৃত্তে উঠে এল। শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রমজীবী মহিলা থেকে গ্রামের চাষি, কুমোর, তাঁতী, জেলে, বিড়ি শ্রমিক পরিবারের মহিলাদের অনেকটা সময় ঘর গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসা বা পেশাতেও শ্রম দিতে হয় যা পুরুষশাসিত সমাজের চোখের আড়ালে থেকে যায়।
বিজেপি’র ইস্তাহারের সঙ্গে নেতাদের ভাষণের কোনো সাযুজ্য নেই। তারা তথাকথিত নারীসুরক্ষার নামে যেসব আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে নারীর স্বাধীনতা, সায়ত্ততা, স্বাধিকার প্রবলভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং পরোক্ষ ভাবে তাদের ঘরবন্দি করারই চক্রান্ত এটা। বাংলার শিক্ষিত উদার পরিমণ্ডলের (বামপন্থীদের ভূমিকাও যেখানে অগ্রগণ্য) পরিচর্যায় সমাজে মেয়েরা অনেক খোলামেলা পরিসরে বেড়ে উঠতে পেরেছে, আর্থিক অবস্থা যা-ই হোক। কিন্তু বিজেপি নেতাদের অভয়বাণীতে সেই পরিসর কেড়ে নেওয়ার অশনি সংকেত!
বিজ্ঞাপনেও বিজেপি’র মহিলা — কেন্দ্রিকতা লক্ষণীয়। মেয়েদের বাসস্থান, জ্বালানি, গ্রামীণ কর্মসংস্থান স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদিতে বিজেপি কত অবদান রেখেছে -- তারই পাতাজোড়া বাহারি বিজ্ঞাপন। কিন্তু হায়! সেখানেও নির্লজ্জ শুধু নয়, নির্মম প্রতারণা! গ্যাস সিলিন্ডার ৮৫০ টাকা, তাই সেই ‘চোখ-জ্বালা করা’ ঘুঁটে কয়লা কাঠই আবার লক্ষ লক্ষ মা-বোনেদের ভরসা। গ্রামীণ কর্মসংস্থান তথা প্রকল্পে এবারের বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরপিএম আবাস যোজনায় প্রধানমন্ত্রীর সহাস্য উপস্থিতির সঙ্গে ঘর-পাওয়া যে মহিলার ছবি ছাপা হয়েছে, বউবাজারের সেই লক্ষ্মীদেবী থাকেন ঘুপচি এক ভাড়া করা ঘরে। কস্মিনকালেও তিনি যোজনার ঘর পাননি! গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে বাবু ঘাটে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তখন তার ছবি তুলে তার অজান্তে দিব্যি তা বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে! এ ঘটনায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত।
আরেকটি লজ্জাজনক ঘটনা বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারগীতি ঘিরে। সেখানে বাংলাদেশে ২০০১ সালে ধর্ষিতা এক হিন্দু বালিকার (এখন যিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ড্যাফোডিল বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি পাওয়া ৩২ বছরের তরুণী এবং দায়িত্বশীল পদে কর্মরত) নাম ও ছবি তার অনুমতি না নিয়েই ব্যবহার করা হয়েছে। স্বভাবতই তরুণী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, “বাস্তবে একবার ধর্ষিতা হয়েছিলাম। এখন রাজনীতির স্বার্থে বার বার ধর্ষিতা হতে হচ্ছে।” বিজেপি মহিলাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকারকে কানাকড়িও দাম দেয় না -- বিদেশি তরুণীর এই ক্ষোভই তা আবার প্রমাণ করল! এই গানে ইসলাম বিদ্বেষকে উস্কানোই মূল উদ্দেশ্য আর সেটা এমন জঘন্য ও নির্লজ্জ ভাবে করা হল! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঐ তরুণীর পাশে বাংলাদেশ সরকার সর্বতোভাবে থেকে তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে, অপরাধীদের কঠোর সাজা দিয়েছে (সূত্র: আনন্দবাজার)। আর এখানে প্রত্যেকদিন কাঠুয়া, উন্নাও, হাথরাস ঘটছে এবং তারপর কী ঘটছে, সবাই জানেন।
এবার আসি সামাজিক মাধ্যমে মহিলা প্রার্থীদের নিয়ে ‘মিম’-এর প্রসঙ্গে। সেখানে অভিনেত্রীদের যেমন ‘সেক্সি’ ‘স্টাইলিশ’ অভিধায় তাদের পরশ্রমজীবী অকর্মণ্য বলে পেশাগত দক্ষতাকে নস্যাৎ করা হয়েছে, অন্যদিকে আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী দীপ্সিতার তথাকথিত জৌলুষহীন চেহারাকে কটাক্ষ করে ‘কাজের মাসি’ বলে, সমাজের মেহনতি মহিলা, পরিচারিকা সমাজকে অপমান করা হয়েছে। পরিচারিকা সমিতির নেত্রী সক্ষোভে জানিয়েছেন, দলীয় ইশতেহারে যেমন তাদের ব্যাপারে নীরব দলগুলি, তেমনই মধ্যবিত্ত সমাজের খুব ছোট একটা অংশই লকডাউনে তাদের পাশে থেকেছে। নেটিজেনদের মহিলা প্রশ্নে এই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার কুৎসিত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আমোদ বন্ধ হোক!
এবার চলে আসব শেষ প্রশ্নে। নারী ভোটার প্রধান রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক দলগুলো নারীর ক্ষমতায়নে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে? প্রার্থী নির্বাচনে কতটা গুরুত্ব পেয়েছেন মহিলারা?
আসামে ১২৬ আসনে তিন দফা নির্বাচনে মহিলা প্রার্থীর অনুপাত মাত্র ৭.৮২%, কেরালা, যেখানে মহিলা ভোটারের সংখ্যা পুরুষ ভোটার থেকে ৮.২৭ লক্ষ বেশি সেখানে ১৪০ আসনের জন্য মহিলা প্রার্থীর অনুপাত মাত্র ৯%!
তামিলনাড়ুতে মহিলা প্রার্থীর অনুপাত: এআইএডিএমকে-৮%, ডিএমকে-৬%, একমাত্র নাম তামিলার কাচি-৫০%;
পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের মহিলা প্রার্থী সংখ্যার অনুপাত: ১৭%;
(লিঙ্গ অনুপাত ২০২০-তে ছিল — ৯৫৬/১০০০, ২০২১-তে ৯৬১/১০০০)
সুতরাং ইস্তেহারে বিজ্ঞাপনে অনেক গালভরা আশ্বাস থাকলেও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও চিত্রটি বড়ই করুণ! সেটা যতদিন উজ্জ্বল না হচ্ছে, নারীর নির্ভয় স্বাধীনতা কি সম্ভব!
ফ্যাসিবাদী মানসিকতার পরিচয় বোধকরি এই যে, জনগণের মধ্যে অনাচার চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যেই তা প্রশাসনিক উৎকর্ষ খুঁজে পায়। আর আত্মানুসন্ধানের পথে না যাওয়াটাও তার এক মার্কামারা বৈশিষ্ট্য। পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যখন বলেন যে, তাঁরা এই রাজ্যে ক্ষমতায় এলে ‘নারীর সুরক্ষায়’ অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড বানাবেন, তখন এই কথাগুলোই মনে আসে। ‘নারী সুরক্ষাকে’ অছিলা করে যে বাহিনী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে বানিয়েছিলেন তা যে তরুণ-তরুণীদের কাছে, সাধারণ জনগণের কাছে উৎপীড়নের এক যন্ত্র হয়ে উঠেছিল তা আজ এক প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং সেই কারণেই গঠনের এক বছেরেরও কম সময় পর বাহিনীকে যে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হল তাও কোনো গোপন ব্যাপার নয়। এছাড়া, নারী নিগ্ৰহ, নারীর অসম্মান-অমর্যাদার বিচারে উত্তরপ্রদেশ আজ দেশের শীর্ষে। নিজের রাজ্যেই যিনি নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না, নারী নির্যাতন যেখানে প্রতিদিনই খবর হচ্ছে, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অন্য রাজ্যের নারীদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে কতটা দু’কান কাটা হতে হয় তা যে কেউই অনুমান করতে পারবেন।
উত্তরপ্রদেশের যে মডেলকে আদিত্যনাথরা বাংলায় প্রয়োগ করার কথা বলছেন তা সেই রাজ্যে কোন পরিণতি ডেকে এনেছিল তার দিকে তাকানো যাক। এক-একটা অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডে সাধারণত থাকত চারজন কনস্টেবল — দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। তারা যেমন উর্দি পরত, আবার সাদা পোশাকেও থাকত। তাদের দেওয়া হয়েছিল অবাধ ক্ষমতা। শুধু স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টারই নয়, পার্ক, সিনেমা হল, মল-এর মতো যে কোনো প্রকাশ্য স্থানে — লোক জড়ো হওয়ার সম্ভাবনাময় জায়গায় — তারা ঘুরে বেড়াত। নারী-পুরুষকে একসাথে বসে থাকতে বা যেতে দেখলেই তাদের ডেকে জেরা করত, তাদের সম্পর্ক বৈধ না অবৈধ তা নিজেরা বিচার করত এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুসারে তাদের শাস্তিও দিত। প্রেমিক যুগলের একসাথে ঘুরে বেড়ানোটা স্কোয়াডের কাছে অপরাধ বলেই বিবেচিত হত। লক্ষ্ণৌর এক মলে অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডের হাতে বাবা ও মেয়ের হেনস্থা হওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এই বাহিনী গঠন হওয়ার এক বছরের মধ্যে রাজ্যে ৩৪,৪৯,৬৪৬ জনকে সন্দেহজনক ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, ২,৪৮১টি এফআইআর করা হয়, ৪,৩৯২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং ১৫,৬৯,১৪৫ জনকে সতর্ক করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সাধারণ জনগণকে কি অপার হেনস্থা ভোগ করতে হয়েছিল তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। যে সমস্ত শাস্তি দেওয়া হয় তারমধ্যে ছিল কান ধরে উঠবোস করানো, মাথা কামিয়ে দেওয়া, মুখে কালি মাখানো, থানায় নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি। এছাড়া, মেয়েদের শ্লীলতাহানি করা এবং তোলাবাজিও ঐ বাহিনীর কীর্তিকলাপের অন্যতম অঙ্গ ছিল। স্কোয়াড ধরলে টাকার বিনিময়ে রোমিও হিসাবে চিহ্নিত হওয়াকে এড়ানোর রাস্তাই অনেকের কাছে ঈপ্সিত হত। একটি ঘটনায় স্কোয়াডের সদস্যদের হাতে এক ব্যক্তির খুন হওয়ার কথাও জানা যায় — “২০১৮-র অক্টোবরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া স্কোয়াডের দুই সদস্য প্রশান্ত চৌধুরী ও সন্দীপ কুমার রাণা রাত দুটোর সময় অ্যাপল কোম্পানির পদস্থ কর্মচারি বিবেক তিওয়ারিকে গুলি করে মেরে ফেলার জন্য গ্ৰেপ্তার হয়। একটা নতুন মোবাইল ফোন বাজারে চালু করার দিন পার্টি দেওয়া হয়েছিল, সেই পার্টি থেকে ফেরার সময় তিওয়ারি এক মহিলা সহকর্মীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে নিজের গড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে গুলি করা হয়”। (দ্য টেলিগ্ৰাফ, ৯ এপ্রিল ২০২১) স্কোয়াডের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা হতে থাকায় ঐ বাহিনী আর সক্রিয় থাকে না। অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড গড়ার ঘোষিত উদ্দেশ্য ‘নারীর সুরক্ষা’ হলেও তা আসলে চালিত হয়েছিল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, পারস্পরিক মেলামেশা করার সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে, নারী স্বাধীনতায় লাগাম পরানোর লক্ষ্যে, নিজের জীবনসঙ্গীকে বেছে নেওয়ার নারীর অধিকারকে শৃঙ্খলিত করতে।
আরএসএস ও বিজেপি নারীর স্বাধীনতাকে কি চোখে দেখে, এই প্রশ্নটাও আলোচ্য প্রসঙ্গের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। সংঘীয় মতাদর্শে নারী কখনই পুরুষের সম-অধিকারী নয়। আদিত্যনাথ নিজে এক বড় হিন্দুত্ববাদী নেতা এবং তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে লেখা এক রচনায় বলেছেন, “নারীদের গুরুত্ব ও সম্মানের কথা বিবেচনা করে… আমাদের শাস্ত্র সর্বদাই নারীকে সুরক্ষা জোগানোর কথা বলেছে। … কর্মশক্তিকে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত করে রাখলে তার যেমন অপচয় হতে পারে ও তা ক্ষতি করতে পারে, সেরকমভাবে নারীর ক্ষমতার স্বাধীনতার চেয়ে সুরক্ষারই প্রয়োজন। …” স্বাধীনতা বর্জিত নারীকে সুরক্ষা জোগাতে হবে — নারী সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হয়ে নারীকে শুধু পুরুষের অধীনস্থ রূপে দেখা হয়না, তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারলে সে পরিবারের কাছে সমস্যা হয়ে দেখা দেবে বলেও মনে করা হয়। রান্নাবান্না করা, ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা, শিশু লালনপালন সহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে লেগে থাকা — এইভাবে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করাটাকে তার বিপথগামিতা রোধের পথ বলে বিবেচিত হয় পিতৃতন্ত্রের কাছে। অ্যান্টি-রোমিও বাহিনী গঠনের পিছনে এই লক্ষ্যই কাজ করেছে। পছন্দের সাথীকে বেছে নেওয়ার ও তার সঙ্গে ঘোরাফেরার স্বাধীনতা নারী যেন ভোগ করতে না পারে, অবাঞ্ছিত হাতের স্পর্শে নারী যেন অপবিত্র হয়ে না যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করে নারীবাদীরা বলে থাকেন, নারীরা পুরুষের মালিকানাধীন কোনো ‘মাল’ নয় যাকে চুরি হয়ে যাওয়া বা যার ক্ষতি হওয়া থেকে তাকে ‘স’রক্ষিত করতে হবে’। নারীর সমানাধিকারের, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সম-অংশিদারীর দাবিকে দাবিয়ে রাখতে না পেরে ‘সুরক্ষার’ নামে নারীকে শৃঙ্খলিত করতে উদ্যোগী হচ্ছে সংঘ পরিবারের শক্তিগুলো। অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড যে উত্তরপ্রদেশের নারীদের কাছে হয়রানির এক বাহিনী হয়ে উঠেছিল তা তাঁরা হাড়ে-হাড়ে বুঝেছেন। উত্তরপ্রদেশের সমাজ আন্দোলনের নারী কর্মীরা ২০১৭-র এপ্রিলে এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, “অনেক ক্ষেত্রেই অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডগুলো নারী ও পুরুষের কাছে হেনস্থার বৃহত্তর কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলও যেটা স্বীকার করেছেন। …” কিছুদিন আগে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান নির্দেশিকা জারি করে বলেছেন, মেয়েরা বাইরে বেরোলে স্থানীয় থানায় জানাতে হবে যাতে পুলিশ তার ‘নিরাপত্তার’ জন্য তার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারে! এমনকি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও প্রশ্ন তুলেছেন, মহিলা কৃষকরা কেন কৃষি আইন বাতিলের প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন! দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির কণ্ঠেও সংবিধান প্রদত্ত নারীর সমানাধিকার নিয়ে প্রশ্ন! কাজেই, সংখ্যাগুরুবাদী নৈতিকতা, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ দিয়ে সমাজকে পরিচালনার যে আয়োজন চলছে, তাকে প্রত্যাখ্যান করেই নারীদের এবং জনসমাজকে এগিয়ে যেতে হবে। সংবিধানের দেওয়া অধিকারকে কিছুতেই ছিনিয়ে নিতে দেওয়া যাবে না। ভারতের ক্রমেই এক পুলিশ রাজের অভিমুখে যাত্রার সঙ্গে এই বাহিনীর ধারণার সংযোগ থাকতে পারে, সেই অভিমতও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বিজেপি পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় আসুক আর না আসুক, এই রাজ্যের উদারবাদী জীবনধারাকে অব্যাহত রাখতে অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডের মতো নারী-বিদ্বেষী, সাধারণ জনগণের নিপীড়ক বাহিনীকে কখনই দিনের আলো দেখতে দেওয়া যাবে না। রোমিও আমাদের কাছে শেকসপীয়রের কালজয়ী নাটকের নায়ক, পবিত্র প্রেমের প্রতিমূর্তি, এক নির্মল হৃদয়ানুভূতি। লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসা, সংঘ পরিবারের চিন্তাধারার অনুগামী হয়ে নীতি পুলিশের কাজ করা নিপীড়ক কোনো বাহিনীর সঙ্গে জুড়ে এই নামকে কখনই কলুষিত হতে দেওয়া যাবে না।
আবার কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে বিভিন্ন রাজ্য থেকে শুরু হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপরীতমুখী অভিবাসন, বা রিভার্স মাইগ্রেশন। গতবছর অপরিকল্পিত, আচমকা দেশজুড়ে ডেকে দেওয়া পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নির্দয় লকডাউনের বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি। আর, কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিপোর্টে প্রকাশিত, ২০০৬-০৭ সালে মনরেগা প্রকল্প প্রথম চালু হওয়ার পর এই প্রথম, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করার সংখ্যা ১১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যে একশো দিনের কাজের প্রকল্পকে মোদী কটাক্ষ করে বলেছিলেন, এটা ভবিষ্যতে ব্যর্থ প্রকল্পের এক স্মারক হয়ে থাকবে, সেই প্রকল্পটাই অসহায়, কর্মচ্যুত, কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে বেঁচে থাকার শেষ খড়কুটো হয়ে উঠলো।
কেন্দ্রীয় সরকারের ১ এপ্রিলে প্রকাশিত শেষ তথ্য অনুযায়ী, মাত্র এক বছরের মধ্যে এই প্রকল্পে নথিভুক্তির সংখ্যা এক লাফে বেড়েছে ৪১.৭৫ শতাংশ — গত অর্থবর্ষে যা ছিল ৭.৮৮ কোটি, তা ২০২০-২১ অর্থবর্ষে হয়েছে ১১.১৭ কোটি! ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ পর্যায়ে নথিভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ৬.২১ কোটি থেকে ৭.৮৮ কোটিতে উঠা নামা করতো।
পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপুল বাহিনী নিজ নিজ এলাকায় ফিরে আসার পর গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক তেমনি বেড়েছে পরিবার পিছু এই প্রকল্পে অংশ নেওয়ার মাত্রা। ২০১৯-২০-তে ১০০ দিন কাজ সম্পন্ন করা পরিবারের সংখ্যা ছিল ৪০.৬০ লক্ষ, যা ২০২০-২১ এ বেড়ে হয়েছে ৬৮.৫৮ লক্ষ — এটাও আরেকটা রেকর্ড। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কর্মদিবসের সংখ্যা ৩৮৫.৮৯ কোটি, গত অর্থবর্ষের তুলনায় এবার কর্মদিবসও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে, আর এই বৃদ্ধির হার ৪৫.৪৩ শতাংশ।
এবারের বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী তাঁর আড়াই ঘন্টার ভাষণে তিনবার ‘কাজ’ ও ছ’বার ‘কর্মসংস্থানের’ কথা আওড়েছেন। কিভাবে নতুন নতুন গড়ে ওঠা টেক্সটাইল হাব, গণপরিবহন ব্যবস্থা, তামিলনাড়ুতে কিছু নতুন শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক নতুন কাজ সৃষ্টি করবে, এই সব বলে তাঁর কল্পকথার ফানুস উড়িয়েছিলেন। এবং, এই নতুন নতুন ‘কাজ’ সৃষ্টির স্বার্থেই সম্পদ সৃষ্টিকারী নিয়োগকর্তাদের (পড়ুন, কর্পোরেটদের) আরও উৎসাহ জোগাতে তিনি এই বাজেটে হ্রাস করলেন বেশ কিছু পণ্যের উপর কাস্টমস ডিউটি, শিল্পকে দরাজ হাতে দিলেন উৎপাদন ভিত্তিক ইনসেন্টিভ (পাঠক, মনে রাখবেন, আম জনতার জন্য যা ভর্তুকি, কর্পোরেটদের জন্য তা হয়ে যায় ইনসেন্টিভ)। আর, বারংবার কর্পোরেট ঘরানাগুলোকে ভূয়সী প্রশংসা করলেন দেশের ‘সম্পদসৃষ্টিকারী’ ও ‘কাজ সৃষ্টিকারী’ হিসাবে। এই কথাগুলো যখন অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, তার ঠিক কিছুদিন আগে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি এক রিপোর্টে জানায়, ভারতের ৫০ কোটি আনুমানিক শ্রমশক্তির মধ্যে প্রায় ৪০.১ কোটি মানুষ প্রকৃত অর্থে কর্মরত। আর, প্রায় ১০ কোটি মানুষ, যাদের মধ্যে সিংহভাগই হলেন তরুণ, তারা হন্যে হয়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজছেন। অর্থমন্ত্রী কর্পোরেটদের হয়ে যতই সার্টিফিকেট দিন না কেন, নির্মম বাস্তব এটাই, বিপুল সংখ্যক কর্মঠ তরুণ কাজের সন্ধানে দাঁড়িয়ে আছেন উপান্তে, আর, বিগত দু’বছর ধরে এই ৪০ কোটি সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়, যা দেখিয়ে দেয় যে শ্রমবাজার স্থিতাবস্থার মুখে। আর, বিরাট সংখ্যক এই বেকার বাহিনী, অর্থনীতির নিয়মেই, প্রকৃত মজুরির হারকে ঠেলে নামিয়েছে নীচের দিকে। গতবছর অতিমারীর ছোবল কেড়ে নেয় লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের কাজ। শহরাঞ্চল থেকে উৎখাত হওয়া কাজ খোয়ানো কাতারে কাতারে মানুষ গ্রামে ফিরে যায়, আর কৃষি বা গ্রামের অকৃষি ক্ষেত্র সেই কর্মচ্যুত এক বিরাট অংশকে তার অর্থনীতির মধ্যে ঠাঁই দেওয়ার চেষ্টা চালায়। আর, এরফলে গ্রামীণ মজুরীও নেমে যাচ্ছে ক্রমেই নীচের দিকে। কেন্দ্রীয় লেবার বুরো কর্তৃক প্রকাশিত মজুরি সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, উত্তর প্রদেশে কৃষি মজুরদের মজুরি ২০১৫ সালে ছিল দু’শো টাকা, যা ২০২০তে বেড়ে দাঁড়ায় ২৭২ টাকা। পাঁচ বছরে ৭২ টাকা বৃদ্ধি অর্থাৎ ফি বছর ১৫ টাকা বা প্রতি বছর ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি। কিন্তু প্রতি বছর গড়ে ৪.৪ শতাংশ মুল্য বৃদ্ধির সাপেক্ষে প্রকৃত বৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ২.৫ শতাংশ। লেবার ব্যুরোর চার্ট থেকেই দেখা যায়, কৃষিক্ষেত্রের বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথে যুক্ত কৃষি মজুরদের (পুরুষ) মজুরি বিগত কয়েক বছর ১২ থেকে ১৬ টাকায় আর মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৪ টাকা বৃদ্ধিতে আটকে রয়েছে। প্রতি বছরের মূল্যবৃদ্ধি নাম-কা-ওয়াস্তে প্রকৃত মজুরিবৃদ্ধিকে মুছে দিচ্ছে। সিএমইআই জানিয়েছে, যে কাজগুলো আগে ছিল সেগুলোও লোপাট হয়ে যাচ্ছে, আর দেশের যে কাজগুলো অবশিষ্ট রয়েছে, তা দু’টো মারাত্বক অভিশাপে দুষ্ট — অত্যন্ত কম মজুরী ও কর্মক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। তাই, বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী কর্পোরেটদের যতই পিঠ চাপড়াক না কেন, আতঙ্কজনক বেকারত্ব, কোনো নতুন কর্মসংস্থানের আশাপ্রদ ক্ষেত্র খুঁজে না পাওয়ায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তরুণ প্রজন্মের কর্মপ্রত্যাশীর দেশ ভারতবর্ষ গভীর অর্থনৈতিক সংকটের ফাঁসে জর্জরিত ।
যে ১০০ দিনের প্রকল্পটি অতিমারীর গভীর দুঃসময়ে কাজ খোয়ানো পরিযায়ী শ্রমিকদের কিছুটা সুরাহা দিতে পেরেছিল, সেই প্রকল্পে ও গতবছর জুন মাসে ৯০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কাজের জন্য আবেদন করেও কাজ পাননি। আবার, মোদী সরকার ধারাবাহিকভাবে এই প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ অনেক কাটছাঁট করেছে। অতিমারীর পর ২০২১-২২ অর্থবর্ষের জন্য ৭৩ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বরাদ্দ ২০২০-২১ সংশোধিত বরাদ্দের থেকে ৩৫ শতাংশ কম।
যে কর্পোরেটদের ‘সম্পদ সৃষ্টিকারী’, নতুন ‘কাজ সৃষ্টিকারী’ বলে সংসদে তারিফ করলেন অর্থমন্ত্রী, তিনি একটা তথ্য সযত্নে গোপন রাখলেন। আর তা হোল, ১৯৯১ সালে উদারিকরণ চালু হওয়ার পর যে কাজ ভারতীয় অর্থনীতি তৈরি করেছে তার ৯২ শতাংশই ইনফর্মাল। আর, অতিমারী এই ইনফর্মাল শ্রমিকদের উপরই সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৭৫ শতাংশ ইনফর্মাল শ্রমিকই কর্মচ্যুত হয়েছেন। আর, বিশ্বব্যাঙ্ক গতবছরই এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে নতুন করে ১.২ কোটি মানুষ চরম দারিদ্রের কবলে পড়বে।
শিল্পক্ষেত্রকে নিত্য নতুন নানা করছাড় থেকে শুরু করে আর্থিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও এই ফেব্রুয়ারী মাসে শিল্প উৎপাদন হ্রাস প্রাপ্ত হলো ৩.৬ শতাংশ হারে। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন ক্ষেত্রগুলোতে এখনও ঘুরে দাঁড়াবার কোনো ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, ১৩ এপ্রিল ভারতীয় টাকা মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে গত তিন সপ্তাহের মধ্যে তার মূল্যের ৪.২ শতাংশ খুইয়েছে, যা বিগত ন’মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন! আর কোনো উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রার এতো গভীর অবনমন ঘটেনি। এই সময়ে একমাত্র তুরস্কের মুদ্রা নতুন লিরা ভারতের থেকে বেশি অবনমিত হয়েছে।
অধ্যাপক কৌশিক বসু তাঁর একটি লেখায় দেখিয়েছেন, ২০১৮-র পর থেকেই ভারতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে তা ২৩.৭৫ শতাংশ। ১৯৯১র পর ভারতে বেকারত্বের হার কোনদিন এতো বেশি ছিল না। অপুষ্টি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও রীতিমতো উদ্বেগজনক। এনএফএইচএস-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রে ১৬টিতে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। আর, এভাবে অপুষ্টি বেড়ে যাওয়া অতি বিরল ঘটনা।
ফি দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নতুন করে কোভিড সংক্রমণের ঘটনা। গতবছরের লকডাউন আতঙ্ক এখনও পরিযায়ী শ্রমিকদের স্মৃতিতে মারাত্মক এক অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, ফের লকডাউন আতঙ্কে মহারাষ্ট্র, দিল্লীতে কর্মরত অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক আবার ফিরে আসছেন দলে দলে। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিদারুণ অভিজ্ঞতা, যা গোটা দুনিয়ার কাছে ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল, তা মোকাবিলা করতে বিগত এক বছর আমাদের নীতিকারেরা কোনো শিক্ষা নিলেন কি না, আবার তাঁদের সুষ্ঠুভাবে নিজ নিজ এলাকার সন্নিকটে কোনো কাজের সাথে যুক্ত করা যাবে কিনা, এই কঠিন পরীক্ষার সামনে গোটা দেশ, তার শাসক বর্গ, বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচিত সরকার।
আবার কোন মানবিকতার অগ্নিপরীক্ষা আমাদের দিতে হবে, কে জানে।
- অতনু চক্রবর্তী
ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকারের একমেবাদ্বিতীয়ম নেতা নরেন্দ্র মোদী ও সেই সরকারের অযোগ্যতম অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের মুখে প্রায়শই একটি মন্ত্র উচ্চারিত হয়, ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট ম্যাক্সিমাম গভার্নেন্স’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ন্যুনতম সরকার অধিক নিয়ন্ত্রণ। যদিও এই বাক্য বন্ধটির অর্থ সম্ভবত নরেন্দ্র মোদীও জানেন না, অন্যরা তো কোন ছাড়। কিন্তু অধিকতর নিয়ন্ত্রণটি অন্তত মন্ত্রী শান্ত্রীদের উপরে এতটাই জোরালো যে, কেউ রাজাকে জিগ্যেস করতে রাজি নয়, রাজা তোর কাপড় কোথায়?
বাক্য বন্ধটিকে ভাঙলে দুটি অংশ পাওয়া যায়, (১) ন্যুনতম সরকার, (২) অধিকতর নিয়ন্ত্রণ। পরবর্তীটি অবশ্যই মোদী সরকার চালু করেছে, তবে ধনী ও পুঁজির মালিকদের জন্য বিপরীতমুখে। বৃহৎ পুঁজির উপরে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণকেই আর রাখছে না সরকার। জল-জঙ্গল-জমি-আকাশ-বাতাস, কৃষি-শিল্প-পরিষেবা সমস্ত ক্ষেত্রেই পুঁজিকে অবাধ বিচরণের মধ্য দিয়ে ন্যুনতম নিয়ন্ত্রণকেও লোপাট করে দিচ্ছে। অন্য কথায় ভারতের অর্থনীতি তথা সমাজকে নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হচ্ছে বড় পুঁজির মালিকদের। অন্য দিকে কঠোরতম নিয়ন্ত্রণ বা সর্বোচ্চ শাসনের আওতায় আনা হচ্ছে শ্রমিক-কৃষক-গরিব-মেহনতি জনতাকে ও তাদের পক্ষে দাঁড়ানো মানবাধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকারের কর্মীদের বিভিন্ন ভুয়ো মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ভরে।
প্রথম অংশটিকেও অবশ্য মন্ত্রীসভার মাপের দিক থেকে ভাবলে অসফল বলে মনে হবে। কারণ, প্রথম এনডিএ মন্ত্রীসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৮, যা ইউপিএ-র ৭১ জন মন্ত্রীর তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। দ্বিতীয়টির মাপ বাড়ানোর সুযোগ এখনো আসেনি, কোভিড বাদ সেধেছে। কিন্তু সরকারি কর্মচারির সংখ্যা ক্রমাগত কমছে, নিয়োগ মোটামুটি বন্ধ। তাছাড়া, সরকারের মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রনাধীন শিল্প সংস্থাগুলিকে ক্রমাগত বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ওই ন্যুনতম সরকারের শ্লোগানটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোভিডের সময়ে মহামারী নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৮৯৭-কে ব্যবহার করে সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলিকে নিস্ক্রিয় করে রেখে, কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়া, শ্রম আইন ও কৃষি আইনকে পুঁজির স্বার্থে সংশোধন করা হল এবং ২০২১-২২ সালেরে বাজেট বক্তৃতায় প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলিকে বিক্রি করে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা করা হল।
অর্থাৎ, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, সিবিআই, এনআইএ, আধা সামরিক বাহিনীর জনজীবনে প্রবল উপস্থিতির মধ্য দিয়ে ন্যুনতম সরকারের শ্লোগানকে হাস্যকর করে তোলা হচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে সমস্ত উৎপাদন ও পরিষেবা মায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবের ক্ষেত্রে সরকারের সবরকমের অনুপস্থিতিকে নিশ্চিত করার দিকে পদক্ষেপ নিয়ে ন্যুনতম সরকার কথাটির তাৎপর্য রক্ষা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলিকে তুলে দেওয়ার জন্য মোদীজির ছটফটানি দেখবার মতো। এমনভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপিত করা হয় যেন, সমস্ত সরকারী সংস্থা লোকসানে চলছে। কিন্তু সরকারি তথ্য তেমন কথা বলে না। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, নিতি আয়োগের কর্তারা, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সকলে মিলে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকে অপদস্থ করার যে কর্মসূচি নিয়েছে তার উপরে দাঁড়িয়ে বেসরকারীকরণের পথকে প্রশস্ত করা হয়েছে। গত অতিমারীর সময়ে সুযোগ বুঝে প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাকেই (ব্যাঙ্ক, বীমা, কয়লা, জ্বালানী তেল সমেত) বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এইভাবেই নাকি আত্মনির্ভর ভারত গড়ে উঠবে।
রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকে বেসরকারী মালিকানায় তুলে দেওযার মোদী সরকারের যে চক্রান্ত তা এরাজ্যের শিল্প-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের জটিল পরিস্থিতিকে আরো সংকটগ্রস্ত করে তুলবে। আত্মনির্ভর ভারতের আগেই ২৬টি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাকে বেসরকারীকরণের কথা ঘোষনা করা হয়েছিল। তার মধ্যে এরাজ্যের দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট, এ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, ব্রিজ এন্ড রুফ ও বেঙ্গল কেমিক্যাল রয়েছে। অসত্য ভাষণে পটু চতুর বিজেপির নেতারা, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে সেগুলিকে বেসরকারিকরণের কথা একবারও মুখে আনছে না। বাবুল সুপ্রিয়র হিন্দুস্তান কেবলের পুনরুজ্জীবনের কথা বলে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন জেতার কথা সকলেরই হয়তো মনে আছে। প্রতিশ্রুতি রাখার দস্তুর যে বিজেপির সাংসদদের নেই, নরেন্দ্র মোদী নিজের আচরণ দ্বারা বহুবার জানিয়ে দিয়েছেন। বাবুল ২০১৪ সালের মে মাসে সাংসদ হলেন, মন্ত্রী হলেন। তার বাড় বাড়ন্ত হল। ওদিকে হিন্দুস্তান কেবল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এতদিনে সকল শ্রমিক কর্মচারীর ছুটি হয়ে গেছে, মানে এক্কেবারে ছুটি।
ভারতীয় অর্থ ব্যবস্থাকে তাদের সাঙাতদের হাতে তুলে দেওযার জন্য বহুদিনকার রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলিকে ধ্বংস করতে বিজেপি বদ্ধ পরিকর। সরকারি তথ্য অনুসারে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলির কাছ থেকে আয়কর ও উৎপাদন শুল্ক বা পণ্য-সেবা কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ২০১৮-১৯ সালে ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। উক্ত সংস্থাগুলি সামগ্রিকে লভ্যাংশ প্রদান করেছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। তা সত্বেও লাভজনক সংস্থাগুলিকে ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে মোদী- সীতারামনরা। কেবল তাই নয়, কেন্দ্রীয় রাস্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলিতে ১০ লক্ষ ৩১ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কাজ করত ২০১৮-১৯ সালে, তার মধ্যে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও পশ্চাতপদ শ্রেণির সংখ্যা যথাক্রমে ১ লক্ষ ৮১ হাজার, ১ লক্ষ ২ হাজার ও ১ লক্ষ ৯৭ হাজার। ফলে সংরক্ষিত পদে রয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ কর্মী। বেসরকারীকরণ করা হলে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও পশ্চাতপদ শ্রেণির সংরক্ষণ লুপ্ত হবে।
হিন্দুস্তান কেবলকে নরকে পাঠানোর পরে মোদী সরকার আসানসোলের নিকটবর্তী দুর্গাপুরে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট ও এ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট দুটিকেও বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে শ্রমিক কর্মচারী তথা দুর্গাপুরের সর্বনাশ করার জন্য পরিকল্পনা করছে। দুর্গাপুর ইস্পাত কিন্তু লোকসানে চলছে না, লাভ করছে। ২০১৯-২০ সালে ১০৮ কোটি টাকা লোকসানের পরে ২০২০-২১-তে এই অতিমারির মধ্যেও সেটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে ও ২০২০-২১ অর্থবর্ষের ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত ৯ মাসে ৪৭৩ কোটি টাকা ও ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে ৪৫২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে দুর্গাপুর ইস্পাত। এ্যালয় ইস্পাতের ক্ষেত্রে সামান্য লোকসান হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে ১২ কোটি টাকা। বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে বাঙালীর সেন্টিমেন্ট ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত লোকসানে চললেও তার পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ও পরপর ৪ বছর মুনাফা করেছে। ২০১৯-২০ অর্থ বর্ষে কর দেওযার পরে মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি টাকা, অতিমারীতে উৎপাদন শেষ দিকে ব্যাহত হওযা সত্বেও। তার আগের বছরে ২০১৮-১৯ সালে মুনাফার পরিমাণ ছিল ২৫ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ সালে ব্রিজ এন্ড রুফ সংস্থার মুনাফা হয়েছে ৩৩ কোটি টাকা, তার আগের বছরে হয়েছিল ১৭ কোটি টাকা। ওই সমস্ত সংস্থাগুলি এছাড়াও কোম্পানি আয় কর ও জিএসটি বাবদ আরো অনেক টাকা সরকারের রাজকোষে ঢুকিয়েছে। ফলে এই কারখানাগুলিকে বেচে দেওযার কোনো যুক্তি সরকারের কাছে নেই।
পশ্চিমবঙ্গের যে ৪টি সংস্থাকে বেসরকারী হাতে তুলে দেবে মোদী সরকার সেগুলি কর মারফত সরকারী রাজকোষে অর্থ সরবরাহ করে চলেছে। দুর্গাপুর ইস্পাত ও এ্যালয় ইস্পাতের দেয় আয়কর ও পণ্য-সেবা কর স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিযার (সেইল) হিসেবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সেইল সরকারী কোষাগারে ওই সব বাবদ ১০, ৯১৬ কোটি টাকা দিয়েছে (২০১৮-১৯ সালে), ব্রিজ এন্ড রুফ দিয়েছে আয়কর ও পণ্য-সেবা কর বাবদ ১৩৩ কোটি টাকা ও লভ্যাংশ বাবদ ৫ কোটি টাকা; বেঙ্গল কেমিক্যালের থেকে সরকার পেয়েছে কর বাবদ ৪ কোটি টাকা। এতদসত্বেও মোদী-সীতারামনের সন্তুষ্টি হচ্ছে না। তারা সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে বধ করে সব ডিম এক সাথে নিতে উন্মুখ। তাতে পশ্চিমবঙ্গের সর্বনাশ হোক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলি তুলনামূলকভ ভাবে শ্রম নিবিড় হওয়ায় সেগুলি বন্ধ হয়ে গেলে রাজ্যের কর্মসংস্থান ধাক্কা খাবে। একই সঙ্গে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও পশ্চাতপদ শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ অর্থহীন হয়ে যাবে। নির্বাচনের আগে শাসক দল এই বেসরকারীকরণের কাজকে নির্বাচক মণ্ডলীর কাছে আড়াল করে রাখবে, কারণ ভারতীয় জনতা পার্টির ভোট ব্যাঙ্কের এক বিরাট অংশ তফশিলি জাতি ও উপজাতি। বিজেপি তাদের সংকল্প পত্রে লাখো লাখো যুবককে কাজ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা যে নিয়োগের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয় না সেটা রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টাতেই প্রকট। একদিকে লাখো লাখো যুবকের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি অপরদিকে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার অবলুপ্তি এই দ্বিচারিতার নামই হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি।
- অমিত দাশগুপ্ত
ভারতের পূর্বদেশে, এই অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবাংলায় আট পর্বের ভোটের মধ্যে তিন পর্ব ইতিমধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে। বাংলায় এবারের ভোটপর্ব অভূতপূর্ব। কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপি পরিচালিত তথাকথিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন(!) কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে এই নির্বাচন পরিচালনা করছে। অনেকদিন পর বাংলার মসনদ দখল করার জন্য গো-বলয়ের ফ্যাসিষ্ট বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’ ধরনের আক্রমণাত্মক শ্লোগান তুলে সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা যেভাবে হোক এবার বাংলাকে তাদের ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ প্রকল্পর অংশীদার করে, হিন্দি বলয়ের এক উপনিবেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্বভাবতই অলীক কুনাট্য রঙ্গের কোনো কমতি নেই। এমনকি গণতন্ত্রের উৎসবে রাষ্ট্রীয় রাইফেলের দ্বারা বাঙালির রক্ত ঝরানোরও খামতি নেই। কুচবিহারের শিতলকুচিতে সিআরপি’র গুলিতে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো চারজন বাঙালি মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকের শহীদ হয়ে যাওয়া, এর অনন্য উদাহরণ।
যাই হোক, এবারের নির্বাচনে ঐতিহাসিক কাল হতে নির্মিত বাংলা ও বাঙালির যে বিশেষ সামাজিক আচরণবিধি সেটাই আক্রান্ত। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের পর্যায়ে রামমোহন, ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহ, সন্যাসবিদ্রোহ, বিদ্যাসাগর, ইয়ংবেঙ্গল, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদিদের হাত ধরে এবং পরবর্তীতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও বাংলার বামপন্থী কম্যুনিস্ট আন্দোলনের পথ বেয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল যে ধর্ম নির্বিশেষে সংহতি ও সম্পৃতির ইমারত সেটাকেই আজ ভূলুণ্ঠিত করার চক্রান্তে নেমেছে ফ্যাসিষ্ট বিজেপি-আরএসএস। স্বভাবতই এর বিপরীত সামাজিক-সাংস্কৃতিক চলনও পরিদৃশ্যমান। এমনিই “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা”। এতো নির্বাচন, ভোট! কবে সেই দাদঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত গান লিখেছিলেন “ভোট দিয়ে যা আয় ভোটাররা/ যদুর কপালে আয় ভোট দিয়ে যা”। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। অজস্র গান ও সৃষ্টির প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে বাংলার সামাজিক প্রচার মাধ্যম। কারণ বাংলায় ভোট জনগণের উৎসব। একদম নীচুতলা থেকে উপরতলার অংশগ্রহণে বাংলার ভোট জমজমাট। ভূভারতে এই অভিজ্ঞতা অনুপস্থিত। বাংলায় ভোট দেয় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। স্বাভাবিক কারণেই কিছু বিশৃঙ্খলা যেমন থাকে, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলা একোমোদ্বীতিয়ম। যাই হোক ভোটে সৃষ্ট গানের সবটা আলোচনা করা একটা লেখার কম্ম নয়। কয়েকটি ‘আসল কম্ম’কে দেখে নেয়া যাক। ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’ এই টাইটেল দিয়ে বাংলার লব্ধপ্রতিষ্ঠ কলাকুশলীরা একটি গান বেঁধেছেন এই ভোটে। লিরিকটা একটু তুলে দিলে অন্যায্য হবে না। “তুমি পুরাণকে বলো ইতিহাস/ ইতিহাসকে বলো পুরানো/ তোমার কাজ শিক্ষাকে লাঠিপেটা করে মূর্খের জ্বালা জুড়ানো/ তোমার ভক্তিতে দাগ রক্তের/ তুমি কাউকেই ভালোবাস না/ তুমি দেশাথি করতে এসেছ/ দেশপ্রেমের কিছুই জানোনা/ তোমার কোনো কথা শুনবো না আর/ … যথেষ্ট বুঝি কীসে ভালো হবে/ নিজেদের মতো ভাববো/ আমি অন্য কোথাও যাব না/আমি ভারতবর্ষেই থাকবো…”। এই হোলো পার্টি বা দলতন্ত্র বহির্ভূত বাংলার উদার গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর। এই উচ্চারণের মাধ্যমেই তাঁরা বিজেপি-আরএসএসের বিপদকে রুখতে চায়। এর বাইরে যে গানটার উল্লেখ না করলেই নয় সেটার স্রষ্টা সিপিএম। সিপিএমের পক্ষ থেকে আর কোনো গান যে লেখা হয়নি তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেগুলো অভিনব কিছু নয় বলেই উল্লেখ করা হলনা। এই প্রথম সিপিএমের পক্ষ থেকে ব্রিগেড সমাবেশের প্রাক্কালে ডিজে বাজিয়ে ‘টুম্পা সোনা হাম্পি দে না’র সুরে এক গান বাঁধা হয়েছে যা কিনা বাংলার বাম-গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বাংলায় ‘লা মার্সাই’এর সুরে গান হয়েছে, চটুল আঙ্গিকে নিবারণ পণ্ডিতের ‘মূর্খ গিদাল’ কিংবা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘মাউন্ট ব্যাটন মঙ্গলকাব্য’ও আমরা শুনেছি। কিন্তু একটি চটুল অবক্ষয়ী সংস্কৃতি থেকে ধার করা গণজাগরণের প্যারডি আমরা কখনোই শুনিনি। সেদিক দিয়ে দেখলে গণসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ এক অনন্য উদাহরণ। আগামি বাংলার বামপন্থী আন্দোলনই এর স্থান নির্ধারণ করবে। এবার আমরা উল্লেখ করব এই ভোটে সৃষ্ঠ বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় পরিচালিত একটি গানকে। ‘দিদি তুমি আমাদের ভালোবাস না’ এই টাইটেলে ছাড়া হয়েছে গানটিকে। লিরিকের অংশ দেখলেই বোঝা যায় - গানটা এরা সৃষ্টি করছেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাগিদে; সাথে যুক্ত হয়েছে এনআরসি-সিএএ চাই শ্লোগান। ‘বড় যত্ন করে মিথ্যে বলে বিকৃত করি ইতিহাস/ বৃথা স্বপ্ন দেখাও বাঙালি আবার পড়বে তোমার সিলেবাস/ না না না না/ তা হছে না, হবেনা/ … তোমার সিলেবাসে নেই/ কখনো ছিল না দলিত মেয়ে পূর্ণিমা/ মনে পড়ে সেই সিরাজগঞ্জে/ অষ্টমশ্রেণি শরীরে বালিকাবেলা/ তোমার কাজ সত্যিকে মেরে ধরে মিথ্যার ছলাকলা’। গানের প্রতিপাদ্য এতটাই অস্বাভাবিক যে অন্য দেশ বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জও ওদের দাঙ্গা সৃষ্টিকারী সৃজনের বিষয়।
লেখাটির উপক্রমণিকায় একটি কথাই বলতে হয় বাংলার জনগণ যেন - খাল কেটে কেউ নিজের ঘরে কুমির এনো না/ কুমির দেবে মারণ কামড় (ঐ কামড়ে) তুমিও শেষে বাঁচবে না/ খাল কেটে কেউ নিজের ঘরে কুমির এনো না/ কুমিরের দু’চোখেতে জল তোমায় করে যে দুর্বল/ গণতন্ত্রের মায়াকান্না (ওদের) শিকার ধরার ছল/ কুমির থাকে ঘোলা জলে, স্বরুপে দেখা না তার মেলে/ দাঙ্গা বিভেদ ঘৃণা দিয়ে (ওরা) জলটা ঘোলা করে/ ওদের ‘সোনার বাংলা’ ধাপ্পাবাজি ঐ ফাঁদেতে পড়বো না/ (ভায়ে ভায়ে দাঙ্গা করে মরবো না)/ খাল কেটে কেউ নিজের ঘরে কুমির এনো না/ তাই আগামী নির্বাচনে শ্লোগান একটাই - “বিজেপিকে কোনো ভোট নয়”।
- সিতাংশু চক্রবর্ত্তী
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ খড়দহে নিজের বাড়িতে বাবলু দাস (বিডি) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি বয়সজনিত কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন।
কমরেড বাবলু দাস ছিলেন নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন সহায়ক কমিটির সময়কার রাজনৈতিক কর্মী। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন সিপিএমের ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফ-এর কর্মী। ১৯৬৬/৬৭ সালে বেলঘরিয়া যতীন দাস নগরে কংগ্রেসের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বিডি’ও সেই লড়াইয়ে অন্যতম সৈনিক ছিলেন। এরপর নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন, ডাক্তারির ছাত্র বিডি পড়াশোনা ছেড়ে দেশের মুক্তির জন্য আরও বহু কমরেডকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্লবের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বহু রাজনৈতিক ঘটনার তিনি সাক্ষী ছিলেন। বাবলুদা আমাদের কাছে ছিলেন রাজনৈতিক ‘হিরো’। সেই সময়ে সিপিএম বা কংগ্রেসের সাথে সংঘর্ষ আমরা জড়িয়ে পড়েছি। এগিয়ে যাওয়া বা পিছু হটা চলছে। আশ্রয় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে অঞ্চলে ফিরে আসার পরিকল্পনা প্রস্তুতি সবকিছুতেই বাবলু দাস।
১৯৭৪ সালে পার্টি ধাক্কায় পড়েছে। টিঁকে আছে যতীন দাস নগরে, নেতৃত্বে বিডি। প্রতিদিন কংগ্রেস ও পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন ২০ বছরের যুবক কমরেড তপন শুর, এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটে গেল। এই সময়ে বাবলুদা ছোট বড়, মহিলা-পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী সবার প্রিয়, আশা ভরসার স্থল। বাবলুদার জন্যে প্রতিটি বাড়ির দরজা ছিল খোলা, যখন তখন যে কোন সময় তিনি সেখানে এসে থেকে গেলে; বাড়ির মানুষ নিজেকে ধন্য মনে করতেন। সেই সময় কলোনির কাঁচা রাস্তা, গলি তস্যগলি, বেড়ার বাড়ি, হারিকেনের আলোতে ছিল বিডি’র বিচরণ। বিডি নিজে নয়, বিডি’র সাথে আসা যেকোন কমরেডের থাকা খাওয়ার জন্যে কোনো চিন্তা ছিল না। বাবলুদার তত্বাবধানে কেন্দ্রীয় কমিটি, রাজ্য কমিটির বহু মিটিং সেই সময় যতীন দাস নগর, উদয়পুরে হয়েছে।
যখন পার্টির মধ্যে স্কোয়াড রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, তখন বাবলুদা গুন্ডা, দালাল ও পুলিশের নজর এড়িয়ে জননেতা হয়ে উঠেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতা থেকে খুন, জখম গণ্ডাগণ্ডা মামলা পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে বেরাচ্ছে, বাবলুদা ধরাছোঁয়ার বাইরে। জনগণের নিরাপদ আশ্রয়ে তিনি নিশ্চিন্তে আছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুলিশ তাঁর হদিস পায়নি।
বিডি গোপন পার্টির রাজনীতির মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। পার্টির কাজে দার্জিলিং ও নদীয়া জেলায় সংগঠক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। এরপর পার্টি প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করলে বিডি তা মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। বাবলুদার মনের মধ্যে গেঁড়ে বসেছিল যে কোনো সময় তার অতীতের মামলাগুলো চালু হবে এবং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করবে। যতীন দাস নগরে যাতায়াত করতেন, কিন্তু নিজের বাসস্থান গোপন রেখেছিলেন। যার ফলে ওনার মৃত্যু সংবাদও আমাদের কাছে গোপন ছিল। এখন প্রয়াত কমরেড রামুর স্ত্রী মায়াদির কাছে বাবলুদার মৃত্যু সংবাদ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনেক স্মৃতি ভেসে ভেসে আসছিল। বিডি আমাকে চিরকাল লং বলেই ডাকতো। মনে পড়ে যায় যতীন দাস নগরে কমরেড পানুদার ‘মাও’ গুহার কথা। কমরেড বাবলু দাস লাল সেলাম।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত