তৃতীয় দফার ভোট অতিক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের আটদফা ভোটের চতুর্থ দফায় যে ভোট হতে চলেছে তাতে হুগলি জেলার উত্তরপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন তরুণ অধ্যাপক সৌরভ রায়। সৌরভ রায়ের সমর্থনে চলছে জোর কদমে প্রচার – বাড়ি বাড়ি যাওয়া, ছোট বড় মিছিল, ঝান্ডা টাঙিয়ে এলাকাকে সুসজ্জিত করে তোলা, মাইক প্রচারের মতো বহুবিধ কর্মকান্ডে উৎসাহের সঙ্গে যুক্ত আছেন ছাত্র যুব মহিলা সহ পার্টি কর্মীরা। গত ৩ এবং ৫ এপ্রিল দুটি নির্বাচনী সভায় বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, একটি সভায় বিহারের ডুমরাও বিধানসভা কেন্দ্রের পার্টির বিধায়ক অশোক কুশওয়া বক্তব্য রাখেন, তিনি প্রার্থীর সাথে বিহারী মেহনতি মানুষ অধ্যুষিত এলাকাতেও যান, প্রার্থী নিজেও সামগ্রিক রাজনীতির সাথে সাথে এলাকার জীবন্ত সমস্যাগুলিকে তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন।
এই দুটি সভাতেই কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বর্তমান পরিস্থিতি ও বিজেপির ভয়াবহতা ও তাকে রোখার দায়িত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন, সম্পূর্ণ বক্তব্যকে লিপিবদ্ধ না করে বরং সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে এই জন্য প্রতিবেদক ক্ষমাপ্রার্থী, তিনি বলেন এবার আমরা দুটো কথা বলছি, এক বাংলাকে দখল করার বিজেপির উঠে পড়ে লাগাকে, বিজেপির চক্রান্তকে প্রতিহত করা দরকার, দ্বিতীয়ত বামপন্থাকে প্রতিষ্টিত করার জন্য, মানুষের রুটি রুজির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন রাজনীতি, নতুন নেতৃত্ব, নতুন ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবি। তিনি করোনা কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা ও দেশের আর্থিক বিপর্যয়ের কথা বলেন, তিনি বলেন দেশের সামগ্রিক উৎপাদন (জিডিপি) – ২৫ শতাংশে নেমে গেছে উল্টো দিকে আরেক জিডিপি – গ্যাস, পেট্রল ডিজেল-এর দাম ঊর্ধমুখী, ভোজ্য তেল দেড়'শ টাকা, রেলে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে এক্সপ্রেসের ভাড়া দিতে হচ্ছে, প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে, অথচ এই কথাগুলো নির্বাচনে আলোচিত হচ্ছে না। পরিবর্তনের কথা, সোনার বাংলা গড়ার কথা হচ্ছে, পরিবর্তন মানে দাঁড়াচ্ছে অন্য দলের পাঁচ বছরের বিধায়ককে নিজের দলের প্রার্থী করা, টাকা দিয়ে নেতা কেন হচ্ছে, ভোটার কেনা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, একজন মহিলার নাম লছমি দেবী ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে তিনি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি পেয়েছেন যেটা সাংবাদিকরা দেখিয়েছেন সেটা ডাহা মিথ্যা, বিহারে আমরা দেখলাম সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো বিশেষ পুলিশ আইন আনা হচ্ছে যেখানে সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা খানা তল্লাশি ও গ্রেপ্তার করা যাবে, এই নিয়ে বিধায়করা প্রতিবাদ করলে রাপিড একশন ফোর্স দিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালালো। এই রকম এক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলায় ভোট হতে চলেছে, যে পশ্চিমবাংলায় বামপন্থী সরকার ছিল, সেই সরকার কেন গেলো সেটা আমরা জানি, সিঙ্গুরে শিল্প না হওয়ায় হাহুতাশ শোনা যাচ্ছে, সিঙ্গুরে শিল্প হলে কত মানুষের কাজ হতো সেটা একটা প্রশ্ন, সেটা একটা ধাঁধা, কিন্তু এই হুগলিতেই হিন্দমোটর কারখানা বন্ধ হয়ে গেলো, রবার কারখানা, সুতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেলো, লোকের কাজ চলে গেলো, কারখানার জমি জমি হাঙরদের কাছে চলে গেলো। আমরা শুনেছিলাম এখনও আবার শুনছি কৃষি আমাদের সেই ভিত্তিকে সারা দেশে নাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই ভিত্তির মানুষরা সারা দেশে লড়াই করছেন, সুতরাং সেই অতীত এবং ভবিষ্যৎ বললে হবে না, বর্তমানে আমাদের রাজনীতি করতে হবে, বর্তমানকে নিয়ে। যে হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা ভোট দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছিল তারা আজ সারা দেশে বিজেপিকে পরাজিত করানোর কথা বলছেন, কারণ তারা ভুক্তভোগী, বিহারের হাজার হাজার যুবক কাজের দাবিতে আমাদের সমর্থন করেছেন যারা একসময় মোদির জয়গান গেয়েছিল, তারা ভুক্তভোগী। আজকে শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে, আজকে স্বাস্থ্য বীমা হচ্ছে কিন্তু হাতের কাছে ডাক্তার, হাসপাতাল না থাকলে পাঁচ লাখ টাকার বীমার কার্ড থাকলেও কিছু হবে না, আমাদের দাবি তাই সবার জন্য শিক্ষা সবার জন্য স্বাস্থ্য। বিজেপি আর আরএসএস এসসব কিছু উল্টে দিচ্ছে। যেটা ছিল সরকারী সেই স্বাস্থ্য শিক্ষা, চাকরি সেটা চলে যাচ্ছে আদানি আম্বানির হাতে আর মানুষ কি পড়বে, কি খাবে কাকে ভালোবাসবে, কি ধর্ম পালন করবে এইসব ব্যক্তিগত বিষয় ঠিক করে দিচ্ছে সরকার, বিজেপি-আরএসএস।
এনআরসি নিয়েও পশ্চিমবাংলায় ভয় দেখানো শুরু হয়েছে, বাংলার শ্রমিকদের বাইরে কাজ করতে গেলে বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়, বিপদটা তাই বাংলায় আরও বেশি। অমিত শাহের তত্বাবধানে স্বরাষ্ট্রদপ্তর দিল্লিতে নির্বাচিত সরকারের অধিকার খর্ব করে গভর্নরের ক্ষমতা বাড়িয়েছে, তেলেঙ্গানায় মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁদের ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করে বিভিন্ন ডাটা ঢুকিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে জেলে পোরা হচ্ছে! তাই আমরা বলছি বিজেপিকে প্রতিহত করতে হবে, বামপন্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, গণতন্ত্রের জন্য, রুটি রুজির সংগ্রামের জন্য বামপন্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। পশ্চিমবাংলায় নতুন করে বামপন্থী জাগরণ দরকার। এই জাগরণের প্রেক্ষাপটটা অন্য। চল্লিশের দশক, ষাটের দশক, সত্তরের দশকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে বামপন্থা জেগে উঠেছিল, সেখান থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, আজকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করে বামপন্থাকে নতুন করে জায়গা তৈরি করতে হবে, নতুন করে আস্থা অর্জন করতে হবে, গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে হবে, মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে, এটা একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। এই নতুন চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীরা নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়াবেন।
রাজ্যের আট দফা নির্বাচন মধ্যম পর্বে প্রবেশ করছে। এপর্যন্ত অভিজ্ঞতা হল, ভোটদানের ইচ্ছাশক্তির ভালোমাত্রায় প্রকাশ ঘটতে চাইলেও ভোটপর্ব পুরোদস্তুর অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হতে পারেনি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন পুলিশ ও প্রশাসনিক অফিসারদের বহু রদবদল করেছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যায়, তবু তাদের ভূমিকা নিয়ে অনেক অভিযোগ উঠেছে। যেখানে দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সেখানে অথচ দেখানো হয়েছে শিথিলতা, আবার অনেক ক্ষেত্রে এতটুকু নিরপেক্ষতা বজায় রাখেনি, প্রচ্ছন্নভাবে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বিজেপির প্রতি। বিজেপির তরফে খোলাখুলি চালানো হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজনের ভিত্তিতে ভোট মেরুকরণের ঘৃণ্য প্রচার। এটা শুরু করে দেওয়া হয়েছে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকেই। অবাধে দেগে দেওয়া হয় ‘পাকিস্তান পন্থী’! চক্রান্ত ষড়যন্ত্র চলছে নাকি ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর! সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে কোণঠাসা করতে ঐ ধংসাত্মক প্রচারকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সর্বত্র। রোড শো-সমাবেশে-মিডিয়া সাক্ষাতকারে এতে মদত দেন মোদী-যোগী-শাহ-নাড্ডা’রা। বিপজ্জনক প্রচার সেখানেই থেমে থাকেনি। সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সীমান্ত জেলাগুলোতে ভোট করানোর জন্য ঢোকানো হচ্ছে নাকি সীমান্তবর্তী ‘বাংলাদেশীদের’! এই ধরনের সাজানো তথ্যচিত্র ও খবর পরিবেশন করছে নির্বাচন পরিস্থিতিতে নতুন খোলা কিছু বাংলা চ্যানেল। বোঝাই যায় পেছনে রয়েছে শাসকশ্রেণীর কোন দলের হাত। এসব বিধিভঙ্গের প্রবণতা নির্বাচন কমিশন দেখেও দেখছে না। ফলে আরও বেপরোয়া হচ্ছে গেরুয়া দলটি, বিধিনিয়ম না মানতে আর পরিবেশকে বিষিয়ে দিতে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায়। রাতের অন্ধকারে গ্রামে পাড়ায় ঘরে ঘরে গিয়ে বা বুথের ভিতরে পদ্ম চিহ্নে ভোট দিতে প্রভাবিত করছে। সময়মতো মহল্লার মানুষের নিরাপত্তার প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মেলেনি। ঘটেছে বেশ কিছু সংঘর্ষ, রক্তপাত, প্রাণহানির ঘটনা। কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রার্থীরও নিরাপত্তা মেলেনি। আক্রান্ত হয়েছেন বিভিন্ন দলের একাধিক প্রার্থী। তৃণমূলের হাতে মানসিক-শারীরিক হেনস্থা হয়েছেন সিপিএম থেকে বিজেপিতে যাওয়া মহিলা প্রার্থী। তেমনি অন্য এক কেন্দ্রে বিজেপির ভাষায় ‘জনরোষে’র মার থেকে জীবন বাঁচাতে পালাতে হয়েছে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া মহিলা প্রার্থীকে। বিজেপির এক জেলা সভাপতি প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন, প্রয়োজনে ‘এনকাউন্টার’ করে শেষ করে দেওয়া হবে! নির্বাচন কমিশন ও তার নিয়োজিত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ও বিশেষ পর্যবেক্ষকরা তবু কোনও ব্যর্থতা স্বীকার করেননি, উল্টে উড়িয়ে দিয়েছেন প্রায় সমস্ত অভিযোগ, পিটিয়েছেন স্ব-স্ব ভূমিকার ঢাক! এই সেই উপলক্ষে ‘ধর ধর’ রব তুলে বাড়িয়ে দেওয়া হয় এনআইএ, ইডি, সিবিআই হানা। জঙ্গলমহলে ভোট শেষ হতেই ‘নিয়া’ লাগিয়ে ফের গ্রেপ্তার করা হল বারটি বছর কারাজীবনের ভুক্তভোগী হয়ে সদ্য বাইরে আসা বহুল পরিচিত এক জনজাতি নেতাকে, অজুহাত দেখানো হল পুরানো মামলায় জেরা ও তদন্তের জন্য হেফাজতে নেওয়া প্রয়োজন। আসল কারণটি অন্য। ঐ জননেতা বাইরে থাকলে বিজেপি বিরোধী প্রচারে নামা বন্ধ করা যাবে না, প্রচারে থাকলে বিজেপির বিপদ। মুখ বন্ধ করতেই তাই আবার গ্রেপ্তার। কয়লার চোরা কারবার ধরতে সিবিআই-ইডিকে লেলিয়ে দেওয়ার পেছনে চোর ধরাটা গুরুতর উদ্দেশ্য নয়, তা যদি থাকত তাহলে বিজেপির ঠগ বাছতে দল উজার হয়ে যেত। আসল মতলব হল তৃণমূল-পুলিশ-আমলা চক্রের একটা চোরা যোগসাজশ যদি এই নির্বাচনী বাজারে খাইয়ে দেওয়া যায়। অর্থাৎ তার নির্বাচনী খাস স্বার্থের খাঁই মেটাতেই বিজেপির গোপনে গোপনে এত কলকাঠি নাড়া, এত তৎপরতা। এরই সাথে জনমানসকে দিগভ্রান্ত করতে চিৎকার জুড়ে দিচ্ছে— ‘বিজেপি নন্দীগ্রামে জিতে গেছে’! শুধু তাই নয়, সত্তর শতাংশ আসনে হৈহৈ করে বিশাল ব্যবধানে ‘জিতছে, জিতবে’!! এর উদ্দেশ্য হল, একটা হাওয়া তৈরি করা। হাওয়া তুলতে প্রচার করছে যথেচ্ছ মিথ্যাচার। মিথ্যাচারের সাথে উন্মত্ততা ছড়ানো, গুজব ছড়ানো — সবই তার মেরুকরণের কৌশল প্রয়োগের অঙ্গ। নির্বাচন কমিশনের দ্বিচারিতার নির্দিষ্ট প্রকাশ ধরা পড়ল তৃণমূল-বিজেপির দুই সর্বোচ্চ নেত্রী ও নেতার আচরণকে কেন্দ্র করেও। নন্দীগ্রামে বুথে ভোটারদের বাধা দেওয়া হচ্ছে খবর পেয়ে প্রার্থী হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন তৃণমূল দলনেত্রী। সেখানে বহুক্ষণ অবস্থানও করেন। এতে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে অভিযোগে নির্বাচন কমিশন কৈফিয়ৎ তলব করেছে। অন্যদিকে বিজেপির নির্বাচনী সভামঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিধিবহির্ভূত ব্যবহার করে রাজ্যের আধিকারিকদের খোলাখুলি প্রশাসনিক দিলেন নরেন্দ্র মোদী! সরকারের বদল হবে ‘নিশ্চিত’ ধূয়ো তুলে ‘ডবল ইঞ্জিন সরকারে’র কাজ এখন থেকেই শুরু করে দিতে বললেন! এটা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার কাঠামোকে অমান্য করার সাংবিধানিক অমান্যতা তো বটেই। নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনেরও নিকৃষ্ট প্রকাশ। তবু হায়! নির্বাচন কমিশন থাকে মূক ও বধির হয়ে!
বেশ কিছুদিন যাবত সরব হচ্ছেন বাজপেয়ী আমলের এক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, গুচ্ছের অভিযোগের তীর ছুঁড়ছেন মোদীরাজ ও বর্তমান বিজেপির বিরুদ্ধে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা করোনা অতিমারীর আগে থাকতেই অধোগতির শিকার হচ্ছিল। জড়িয়ে যাচ্ছিল মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির আবর্তে। নোটবন্দীর জের অনুভূত হয় আজও। ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্রের অস্তিত্ব আধমরা হয়ে যায় তখন থেকেই। তারপরে অতিমারী কবলিত অবস্থায় হয়েছে আরও মৃত্যুমুখী। জিডিপি হ্রাস হয়ে চলেছে লাগাতার।
অর্থনীতি, গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও সংবিধানের বারটা বাজিয়ে ‘আত্মনির্ভর ভারত নির্মাণ’-এর নামে নয়া প্রতারণা শুরু করেছেন মোদী। অমিত শাহ তো প্রতিশ্রুতি দিয়ে তামাশায় পরিণত করেন হেসে খেলে। উত্তরবঙ্গের নির্বাচনী সফরে শাহ বলে দিলেন গোর্খা সম্প্রদায়ের এগারোটি গোষ্ঠীকে বিশেষ মর্যাদা মঞ্জুর করা হবে, চা শ্রমিকদের মজুরি বর্তমান স্তর থেকে দ্বিগুণ করা হবে, জমির পাট্টা দেওয়া হবে। আরও কত কি বলে দিলেন! যে দল ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণকেই পাখীর চোখ করেছে, আদিবাসী-জনজাতি সম্প্রদায়গুলোকে জীবন-জীবিকার প্রশ্নে পীড়িত করে চলছে, শ্রমিকের এযাবত সমস্ত অধিকারকে চারটি লেবার কোডে আবদ্ধ করার পলিসি বানিয়েছে, তারা আবার ভোট পেতে প্রতিশ্রুতির ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে।
এই সবকিছুকে মোকাবিলার চ্যালেঞ্জটা নতুন করে জোরদার করা দরকার। দেশজুড়ে বিজেপি জমানার শেষের শুরুর অভিযানটা ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব এসে পড়েছে বাংলার জনগণের ওপর।
৫ এপ্রিল ২০২১
ছত্তিশগড়ের বস্তার অঞ্চলের বিজাপুর জেলার সুকমাতে কথিত মাওবাদী আক্রমণে বাইশ জন আধাসেনা জওয়ানের হত্যার ঘটনাকে আমরা তীব্র ভর্ৎসনা করি। মৃত জওয়ানদের পরিবার ও প্রিয়জনদের উদ্দেশে গভীর সমবেদনা জানাই। খবরে প্রকাশ, হামলায় সামিল ১৫ জন মাওবাদীরও এই ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছে।
বর্তমানে গোটা দেশ জুড়ে ঐতিহাসিক এক কৃষক জাগরণ চলছে, বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে ও কাজের দাবিতে ব্যাপক শ্রমিক-কর্মচারী যুব-ছাত্র তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছেন এবং পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। এই পরিস্থিতিতে এই ধরণের মাওবাদী সশস্ত্র কার্যকলাপ গণ আন্দোলনকে এবং চলতি নির্বাচনে জনগণের স্বার্থকে সামনে নিয়ে আসার কাজকে বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে নোটবাতিল থেকে শুরু করে বস্তারের আদিবাসীদের মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের উপর নির্বিচারে নামিয়ে আনা দমন পীড়নের ফলে ছত্তিশগড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবী বার বারই ভ্রান্ত প্রমাণিত হচ্ছে। কেন্দ্র সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরং আমাদের জানান তাঁদের কোন ব্যর্থতার জন্য পুলওয়ামা ও সুকমার মতো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন
ক্রন্দনরত এক ষোড়শীকে কোমরে দড়ি বেঁধে হাঁটানো হচ্ছে। উন্মত্ত জনতা ‘ভারত মাতা কী জয়’ ধ্বনি দিতে দিতে চলেছে। কিশোরীর অপরাধ – সে ধর্ষিতা হয়েছে এবং পরিবারকে সেটা জানিয়েছে! অর্থাৎ সে কেন ধর্ষকের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলনা, আর কেনই বা সেই ‘ভীষণ কলঙ্কের’ কথা প্রকাশ করে ফেলল! কেন সে ‘পরিবারের অসম্মানের’ কথা ভাবলো না! এত বড় অন্যায়! হাঁটানোর আগে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল। তারসঙ্গে অবশ্য ধর্ষককেও মারধর করার পর একই ভাবে গ্রামে ঘোরানো হয়। নাবালিকার এই নিগ্রহে গ্রামবাসীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল তার পরিবারের লোকজনও। ‘ভারত মাতা’র অন্তরাত্মা ‘পৌরুষদৃপ্ত সন্তানদের’ জয়ধ্বনি শুনে পুলকিত হয়েছিল, না গোপনে চোখের জল ফেলেছিল তা জানার উপায় নেই। কিন্তু বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের আলিরাজপুরের এই ঘটনা নারী নির্যাতনে (নাবালিকা নির্যাতনে) এক নতুন মাত্রা যোগ করল। বিজেপি শাসনে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের হাতে আরও কতভাবে নারী নিগৃহীত, অপমানিত হতে পারে তার সম্ভাব্য নিদর্শনের কথা ভেবে নাগরিক সমাজ নিশ্চয়ই শিউরে উঠবে!
গত সোমবার যোগীরাজ্য উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় বাইক আরোহী এক তরুণ দম্পতিকে তিন দুষ্কৃতী মারধর করে দশ হাজার টাকা লুঠ করে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে তার ভিডিও-ও করেছে।
বিজেপি শাসিত কর্ণাটকের প্রাক্তন জলসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গতকাল এক মহিলা আদালতে চাকরি দেওয়ার নাম করে তাঁকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেন।
গত রবিবারের আরেকটি ঘটনা। বছর চোদ্দ-পনেরোর দুই আদিবাসী কিশোরী বিকেলে রোজকার মতো গ্রামের প্রান্তে ইউক্যালিপ্টাস-এর জঙ্গলে শুকনো গাছের ডালে দোল খেতে খেতে গল্প করছিল। এমন সময়ে গ্রামেরই পাঁচ যুবক, যাদের ওরা ‘দাদা’ ‘কাকা’ বলে ডাকে, ওদের বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে সাইকেলে তুলে নেয় এবং নির্জন পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে। ধর্ষকরা শিক্ষিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়েরই। এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার শুখাডাঙ্গা গ্রামের। আদিবাসী কন্যা গণধর্ষণের এবং অপমানে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হওয়ার আরও ঘটনা কয়েক মাস আগে এই রাজ্যে ঘটেছে।
এ রাজ্যে ক্ষমতায় না থাকলেও বিজেপি এমন একটা সামাজিক আবহ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে -- যেখানে জাতি, ধর্ম বর্ণ এবং লিঙ্গভেদের বিষবাষ্প বায়ুকণায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের নির্বাচনী প্রচারে সেটা উৎকটভাবে প্রকট হয়ে উঠছে।
আলিরাজপুরের ঘটনায় ধর্ষিতা কিশোরীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়, এর আগেও আরএসএস-বিজেপি’র নেতা নেত্রীরা ধর্ষিতা, তার বাবা মা, তার পারিবারিক সংস্কারকেই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন এবং ধর্ষককে আড়াল করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু কেন? কেন নারীর প্রতি আরএসএস-বিজেপি’র এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ?
হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেপি সনাতন হিন্দুধর্মে নয়, মনুবাদে বিশ্বাসী যে মনুবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদের সমার্থক এবং পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। মনুসংহিতা অনুসারে শূদ্র ও নারী অপূর্ণ মানব। নারীর কোনো শিক্ষার ও স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার নেই। নারী হীনজন্মা। শাস্ত্রমতে স্ত্রীজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ। স্বামীসেবা, গৃহকর্ম ও সন্তানের জন্ম দেওয়াই তার একমাত্র কাজ। ব্রাহ্মণ ও পতিসেবায় ত্রুটি ঘটলে তাকে পরজন্মে আরও হীন পশুযোনিতে জন্ম নিতে হবে।
“ইহলোকে পুরুষদের দূষিত করাই নারীর স্বভাব। তাই পণ্ডিতগণ স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে অসাবধান হন না।”
“স্ত্রীগণ সৌন্দর্য বা বয়স বিচার করে না। যুবা বা বৃদ্ধ, সুরূপ বা কুরূপ, যাই হোক না কেন, পুরুষ পেলেই তারা সম্ভোগে লিপ্ত হয়।”
“শয়ন, আসন, ভূষণ, কাম, ক্রোধ, পুরহিংসা, কুটিলতা ও কুৎসিত ব্যবহার – এই সকল প্রবৃত্তি স্ত্রীলোকের জন্যই মনু সৃষ্টির সময় কল্পনা করেছেন। অর্থাৎ এই সকল প্রবৃত্তি নারীদের স্বভাবগত ব্যাপার।”
“ইহ সংসারে দেহধর্মবশত সব মানুষই কাম ক্রোধে বশীভূত। তাই মূর্খই হোক, আর বিদ্বানই হোক, কাম ক্রোধে বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থন হয়।”
“স্ত্রীলোকের এই স্বভাবের জন্যই সব সময় তাদের বশে রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই তারা স্বাধীন থাকতে পারবে না।”
“সর্বদাই গৃহকর্মে, পতি ও পরিজনের সেবায়, গৃহ দ্রব্যাদি পর্যবক্ষেণে তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে।”
এইসব হচ্ছে মনুর নির্দেশ ও বিধান। আর আরএসএস নেতারা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এই ফরমান আজকের ভারতীয় নারীদের জন্য চালু করতে চাইছেন। তাই তারা শুধু যে নিজেরা ধর্ষিতা নারীকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করছেন, তাই-ই নয়, আদালতকেও প্রভাবিত করছেন। নারীকে ঘৃণা, বিদ্বেষ, তাচ্ছিল্যের চোখে দেখার এই বিষাক্ত মনোভাব যেটা যুগপরম্পরায় খানিকটা প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও, আধুনিক শিক্ষা ও বিজ্ঞান মনস্কতায়, নারী আন্দোলনের ঢেউয়ে ক্রমশ ক্ষীয়মান হয়ে আসছিল, তাকেই চাঙ্গা করে তুলছে ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদীরা। তাই কেবল কঠোর থেকে কঠোরতম সাজা ঘোষণা করে ধর্ষণ রোখা যায়নি, যাবে না। দলিত নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী বিদ্বেষকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণা ও বিদ্বেষের মতাদর্শকে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের নারীরা, ছাত্রীরা চান নির্ভয় স্বাধীনতা।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এগিয়ে আসছে যত, বাঙালী ব্রাহ্মণ্যবাদী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী কাম শিক্ষাবিদদের মুখোশ ততই খসে পড়ছে। কোনো না কোনো ক্ষমতার বৃত্তে থাকা কারুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে (দুর্জনের কথায় তেল দিয়ে) বিশ্ববিদ্যালয়ের কিউবিকলে মৌরসিপাট্টা গাড়ার পরে এখন বৃহত্তর ক্ষমতা দখলের অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকেই। তেমনই একজন মাঝে মাঝে লেখার বরাত পান একটি আনন্দদায়ক বাজারে, লেখার জন্য। খোলাখুলি ভারতীয় জনতা পার্টিকে ভোট দেওয়ার কথা না বলে সোনার বাংলা গড়তে গেলে মানুষেরর মধ্যে উচ্চাকাঙ্খা তৈরি করার দায়িত্ব রাজনীতিকদের উপর অর্পণ করেছেন তিনি। সোনার বাংলা বলতে কী বোঝায় এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলেও পরিমাপের জন্য তিনি যে মাথাপিছু আয় আর ইজ অফ ডুইং বিজনেসেকেই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছেন তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। অর্থাৎ যে সূচকগুলিকে ব্যবহার করে বিজেপি গুজরাট মডেলকে পশ্চিমবঙ্গে গুজে দিতে চাইছে সেই নিরীখেই শিক্ষাবিদ মহাশয় সোনা লোহায় পার্থক্য করতে উন্মুখ। তাছাড়া উনি জানেন যে আর্থিক উদারীকরণ অত্যন্ত সুন্দর প্রকল্প, যার উপর নির্ভর করে দেশের অন্যান্য প্রান্তের মানুষ দ্রুত এগিয়ে গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গকে পিছিয়ে ফেলে। যে কথাটাকে উনি বলতে চেয়েছেন কিন্তু বলতে পারেননি সেটি হল যে, সোনার বাংলা গড়তে বিজেপিকে ভোট দিন।
এটা অনস্বীকার্য পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। তথাপি বহু বিজেপি শাসিত বা কিয়দ্দিন পূর্বে বিজেপির শাসনাধীন থাকা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিচারে বহুলাংশে পিছিয়ে আছে। উক্ত অর্থনীতি শিক্ষক স্বপ্নের চাঁদ আলো ফেলেছেন এরাজ্যের নিম্ন স্তরের মাথাপিছু আয়ের উপরে, যা ২০১৮-১৯ সালে ছিল মাত্র ১,০১,১৩৮ টাকা বার্ষিক, সারা ভারতের গড় ১,২৬,৫২১ টাকার তুলনায় বেশ খানিকটা কম, প্রায় ২০শতাংশ কম। ওই সময়ে বা তার বছর খানেক আগে দীর্ঘকাল ধরে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির দিকে চোখ ফেরালে বোঝা যাবে ওই সমস্ত রাজ্যগুলিকে মোদি-শাহেরা কী রকম স্বর্ণরাজ্যে রূপান্তরিত করেছে। যেমন ধরা যাক বিহার। প্রায় ১৩ বছর বিজেপি-জেডিইউ-র সঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ওই রাজ্যটির ২০১৮-১৯ এর মাথাপিছু আয় ৪০,৯৮২ টাকা, সারা ভারতের গড় আয়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম। আসাম, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় যথাক্রমে ৭৩১৫৫ টাকা, ৮২৮৩৭ টাকা, ৯০১৬৫ টাকা ও ৯২৪১৩ টাকা। ওই সমস্ত রাজ্যগুলির ভোটারদের জন্য সোনার রাজ্য গড়তে বোধহয় বিজেপির সোনা কম পড়েছিল বা তা সোনার বাংলা গড়ার জন্য সেফ ডিপোজিট ভল্টে রেখে দিয়েছেন মোদি-শাহ-চাড্ডা।
যেহেতু মাথাপিছু আয়কে উল্লেখ করেই মূলত স্বপ্নের চাঁদ সোনার স্বপ্ন বেঁচতে বেরিয়েছেন, তাই ডাবল ইঞ্জিনে টানলেও যে কখনো কখনো গাড়ির দুদিকে দুমুখো ইঞ্জিন লাগানোয় তা ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় জড় হয়ে যেতে পারে সেটা মাথাপিছু আয়কে ধরেই দেখানো সম্ভব, তবুও সোনার ভারতের ভবিষ্যৎ বিজেপির হাতে কেমন পিতলে পালিস করে ঝকঝকে হয়েছে তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ২০১৫-১৬ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে (এনএফএইচএস ৪), এখন অবধি প্রকাশিত শেষ পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে এনডিএ শাসিত বিহারে ৫৯ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌছেছিল (পশ্চিমবঙ্গে ৯৪ শতাংশ, কেরালায় ৯৯ শতাংশ)।
যথাযোগ্য পানীয় জল ছিল এনডিএ শাসিত ঝাড়খন্ডে ৭৮ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৮৫ শতাংশ, গুজরাটে ৯১ শতাংশ বাড়িতে (পশ্চিবঙ্গ ৯৫ শতাংশ, কেরালা ৯৯ শতাংশ)।
শৌচালয়ের সুবিধে ছিল এনডিএ শাসিত ছত্তিশগড়ে ৪১ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৪৩ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৭১ শতাংশ, গুজরাটে ৭১ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গ ৭৫ শতাংশ, কেরালা ৯৯ শতাংশ) বাড়িতে।
পাকা বাড়িতে বাস ছিল বিহারে ২৬ শতাংশ, ছত্তিশগড়ে ৩৬ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৩৬ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৭৩ শতাংশ ও গুজরাটে ৭৭ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গে ৪৭ শতাংশ ও কেরালায় ৮৯ শতাংশ) নাগরিকের।
কোনোদিন বিদ্যালয়ে যায়নি (৬ বছরের অধিক বয়স্ক) এমন ব্যক্তিদের অনুপাত এনডিএ শাসিত বিহারে ৪৩ শতাংশ, ঝাড়খন্ডে ৩৯ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৩৬ শতাংশ, ছত্তিশগড়ে ৩২ শতাংশ, হরিযানায় ৩০ শতাংশ, গুজরাটে ২৮ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গ ২৬ শতাংশ, কেরালা ৪ শতাংশ)।
শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রেও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির পরিস্থিতি তথৈবচ। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে) মধ্যপ্রদেশে ৬৫, ছত্তিশগড়ে ৬৪, বিহারে ৫৮, ঝাড়খন্ডে ৫৪, রাজস্তানে ৫১, গুজরাটে ৪৪ (পশ্চিমবঙ্গ ৩২, কেরালা ৭)।
প্রতিষেধক প্রদানের ক্ষেত্রেও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির অনেকগুলিই পিছিয়ে আছে; গুজরাটে ৫০ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৫৪ শতাংশ, রাজস্থানে ৫৫ শতাংশ, বিহারে ৬২ শতাংশ ঝাড়খন্ডে ৬২ শতাংশ, হরিযানায় ৬২ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গ ৮৪ শতাংশ, কেরালা ৮২ শতাংশ) শিশুকে প্রতিষেধক দেওয়া হযেছে। শিশুদের বামনাকৃতি বা খর্বাকৃতি হওয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটাই দেখা যায়; বিহার, ঝাড়খন্ড, গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পিছিয়ে আছে, এবং কেরালা এক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে।
নীতি আয়োগ কর্তৃক প্রকাশিত সাসটেইনেবেল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বা টেঁকসই উন্নয়ন লক্ষ্য সংক্রান্ত সূচকের (২০১৯-২০) নিরিখে এনডিএ শাসিত বহু রাজ্যের অবস্থান নীচের দিকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের নিরিখে গোয়া ২৮তম, ত্রিপুরা ২৬তম, উত্তর প্রদেশ ২৫তম, হরিয়ানা ২৩তম, গুজরাট ২১তম।
উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণের সূচকের নিরিখে বিহার ২৮তম, ঝাড়খন্ড ২৫তম, উত্তর প্রদেশ ২৩তম, হরিয়ানা ১৮তম, ত্রিপুরা ১৫তম, মধ্যপ্রদেশ ১৫তম, গুজরাট ৯ম (পশ্চিমবঙ্গ ১৩তম, কেরালা ১ম)।
দারিদ্র নিরসনের নিরিখে ঝাড়খন্ড ২৮তম, বিহার ২৭তম, উত্তর প্রদেশ ২৪ তম, মধ্যপ্রদেশ ২৪তম, হরিয়ানা ১৯তম, গুজরাট ১৯তম, আসাম ১৭ তম, ত্রিপুরা ২য় (পশ্চিমবঙ্গ ১৪তম, কেরালা ৭ম, তামিলনাড়ু ১ম)।
সুস্বাস্থ্য সুস্থ জীবনযাপনের নিরিখে উত্তর প্রদেশ ২৭তম, বিহার ২৫তম, মধ্যপ্রদেশ ২৩তম, ঝাড়খন্ড ১৯তম, হরিয়ানা ১১তম, গুজরাট ৮ম, (পশ্চিমবঙ্গ ৭ম, কেরালা ১ম)।
উচ্চমানের শিক্ষাপ্রদানে অগ্রগতির ভিত্তিতে বিহার ২৮তম, ঝাড়খন্ড ২৬তম, আসাম ২৫তম, গুজরাট ২৩তম, উত্তরপ্রদেশ ২২তম, মধ্যপ্রদেশ ১৭তম (পশ্চিমবঙ্গ ২১তম, কেরালা ১ম)।
লিঙ্গসাম্যের অগ্রগতির সূচকের ভিত্তিতে আসাম ২৫তম, ঝাড়খন্ড ২২তম, গুরাট ১৯তম, বিহার ১২তম, উত্তরপ্রদেশ ১০ম, মধ্যপ্রদেশ ৮ম (পশ্চিমবঙ্গ ১৫তম, কেরালা ২য়)।
তাহলে কী দাঁড়াল? এনডিএ অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টি বিভিন্ন রাজ্যে মানুষের মধ্যে বিপুল উচ্চাকাঙ্খা তৈরি করে হীরের গুজরাট, প্লাটিনামের হরিয়ানা, মণিমুক্তার মধ্যপ্রদেশ, জহরতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড প্রভৃতি তৈরি করার পরে সোনার বাংলা গড়তে পচনশীল তৃণমূলের উচ্চাকাঙ্খী তোলাবাজদের বেছে নিয়েছে। আর স্বপ্নের চাঁদবাবু সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন ফেরি করার দয়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন! অসত্য ভাষণ ভারতীয় জনতা পার্টি বা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বের, এমনকি উচ্চতম নেতৃত্বের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। তাদের নেকনজরে থাকতে তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী কাম শিক্ষাবিদরা অর্ধসত্য বলতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এমনটা নয় যে, এনডিএ বা বিজেপি শাসিত সমস্ত রাজ্যগুলিই উন্নতির সমস্ত সূচকের নিরিখে পিছিয়ে আছে, এমনটাও নয় যে সমস্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে সেগুলি অনন্য হয়ে উঠেছে। বরং সমস্ত সামাজিক উন্নয়নের সূচকের নিরিখেই কেরালা সামনের সারিতে আছে, সেদিক দিয়ে কেরালা অনন্য, তাই উদাহরণ দিতে হলে সেই রাজ্যকেই সামনে আনা প্রয়োজন, যেখানে না ডাবল ইঞ্জিনের সরকার আছে না বিজেপি কোনদিন শাসন করেছে।
তাই বিজেপির নেতারা যখন সোনার বাংলা (‘সুনার বাঙ্গালা’!) তৈরি করতে হুঙ্কার ছাড়েন তখন যেকোনো প্রকৃত অর্থনীতির শিক্ষকের দায়িত্ব সেই ফাঁকা আওযাজকে বাস্তবের জমিতে এনে দাঁড় করানো, চাটুকারিতা করা নয়। তা না হলে বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-বিদ্যাজীবীর এহেন আচরণ বিজেপির দাঙ্গাবাজদের সাহস যোগাবে পশ্চিমবঙ্গকে ‘মিডাস টাচ’এর রাজ্যে রূপান্তরিত করতে, যেখানে হাত দিলেই সোনা হয়ে যাওয়ায় বহু দরিদ্রের ভাত জুটবে না কারণ সোনার লোভের হাতছানিতে ভাতও সোনা হয়ে যাবে। মনে রাখা দরকার নিতি আয়োগের এসডিজি (২০১৯-২০)-র সূচকের নিরীখে ক্ষুধা নিরসনের ভিত্তিতে ঝাড়খন্ড ২৮তম, মধ্যপ্রদেশ ২৭তম বিহার ২৬তম, উত্তর প্রদেশ ২৪তম, কর্নাটক ১৭তম, গুজরাট ১৫তম, আসাম ১৫তম (পশ্চিমবঙ্গ ১৪তম, কেরালা ২য়)।
- অমিত দাশগুপ্ত
বাংলায় তৃতীয় দফার ভোটে কী হয়েছে সবাই জানেন। ‘না দেখলে পিছিয়ে পড়তে হয়’ চ্যানেলের সান্ধ্য চণ্ডীমণ্ডপে সঞ্চালক দুই মহিলা প্রার্থীকেই (সুজাতা মণ্ডল ও পাপিয়া অধিকারী) ডেকেছিলেন, দর্শক শ্রোতাদের তাদের বক্তব্য শুনিয়ে চ্যানেলের ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রেখে ব্যথিত বিস্ময়ে বার বার প্রশ্ন রেখেছেন — কেন বাংলার এই অবস্থা যখন প্রতিবেশি রাজ্যগুলোতে নিরুপদ্রবে ভোট হয়! কিন্তু ভুলেও বললেন না – কেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় পদ্মনেতারা এই বাংলায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। কেন এক মহিলার বিরুদ্ধে বিরামহীন বিষোদগার করে চলেছেন যে বিষ নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চ থেকে সমাজ আবহে ছড়িয়ে পড়ছে, গরল হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে! কেন প্রধানমন্ত্রী সমস্ত শিষ্টাচার সৌজন্য জলাঞ্জলি দিয়ে, নির্বাচনী বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, দেশের যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধূলিসাৎ করে রাজ্যের সরকারি আধিকারিকদের কৃষকপঞ্জী বানানোর নির্দেশ দেন? মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা বলে কি এই অসৌজন্য এত অবলীলায় প্রকাশ করা গেল!
এক কথায়, ‘ঠগেন্দ্রনাথ’ তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে বাংলার বাতাসে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ভেদের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন গত কয়েক মাস ধরে। এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা বাংলার মাটিতে ঠাঁই পাবে না, কিন্তু বাংলার সমাজ জীবনের অনেকটাই ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছেন দূষণ ছড়িয়ে। কেউ বলতেই পারেন, বাংলার বাতাস কি নারীবিদ্বেষ মুক্ত ছিল! তাহলে কয়েক বছর আগে অভিনেতা-সাংসদ যখন বিরোধী দলের কর্মীদের বাড়ির মেয়েদের ‘রেপ’ করিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তখন প্রবল হর্ষধ্বনিতে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল কেন তার দলীয় কর্মীরা? ঠিক। কিন্তু এই কুমন্তব্যের জেরে সেই ‘ভালোমানুষ’ ইমেজের নায়কটি পরিণত হয়েছিলেন ‘কলঙ্কিত নায়কে’ এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন সমাজে। অকাল প্রয়াণের পরও সে কলঙ্ক মোছেনি! পুরুষপ্রধান সমাজে পিতৃতন্ত্র ছিল, আছে – মেয়েদের কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখার, মেয়েদের দক্ষতা, যোগ্যতাকে সন্দিহান চোখে দেখার চোরা প্রবণতা – ছিল, আছে। কিন্তু সেটা সমাজের উপরিকাঠামোয় তত উচ্চকিত ছিল না। নানা সংস্কার-প্রয়াস, নারী শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলন, যুক্তিবাদ, সমাজমনস্ক প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং অবশ্যই রাজনৈতিক চেতনার আলোকে নারী বিদ্বেষের অন্ধকার থেকে সমাজ ক্রমমুক্তির পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। মেয়েদের সমানাধিকার, স্বায়ত্ততা, মর্যাদার দাবি উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু কোথায় গেল সেই পরিবেশ? সেই পরিসর? যখন পনেরো ফুট লম্বা বাঁশ, চ্যালাকাঠ, হাঁসুয়া নিয়ে এক মহিলাকে তাড়া করা হয় এবং শরীরে তার ঘা পড়ে, যখন কোনো মহিলাকে সপাটে চড় কষানো হয় – তখন আর তাকে ‘মহিলা’ ভাবা হয় না – তখন সে ‘মেয়েমানুষ’! জনপরিসরে নেমেছো পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে, পাঞ্জা কষতে — তাহলে আবার ‘মহিলা কার্ড খেলা’ কেন? (এই শব্দবন্ধটি বাংলাকে ‘উপহার’ দিয়েছেন স্বনামধন্য দিলীপ ঘোষ – বিজেপির রাজ্য সভাপতি!) – ভাবটা এইরকম।
ঐদিন মহিলা সাংবাদিকদেরও একাধিক জায়গায় নিগৃহীত ও হেনস্থা হতে দেখা গেছে শাসকদল সহ বিভিন্ন দলীয় নেতা কর্মীদের হাতে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিষ্ণুপুরের পানাকূয়া পঞ্চায়েতের বাসিন্দা রীতা পাঁজা দীর্ঘ দশ বছর ভোট দিতে পারেননি। এবারও গ্রামবাসী যুবক গৌরাঙ্গ মাকালের বাধা ও হুমকি অগ্রাহ্য করে ভোট দেন। নির্বাচন কমিশন মাকালকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেও লিখিত অভিযোগ না থাকায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়া সেই মাকালকে দলীয় সহকর্মীরা গলায় মালা পরিয়ে ‘বীরের’ সম্বর্ধনা দিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করে! কী বলবেন?
নির্বাচনের আগের রাতে গোঘাটে শাসকদলের বাইকবাহিনীর তাণ্ডবে এক বিজেপি কর্মীর মা মালতী আদক মারা যান। তার প্রতিক্রিয়ায় এক তৃণমূলের পোলিং এজেন্টের বাবাকে নিগ্রহ করলে তিনিও মারা যান। সন্তানদের ভিন্নদল করার ‘অপরাধের’ বলি হলেন দুই দরিদ্র পরিবারের দুই অসহায় বর্ষীয়ান মানুষ! নির্বাচন মিটে যাবার পর, গ্রামে ঢুকে সন্ত্রাস, বাড়ি ঘর ভাঙচুরের তাণ্ডবে কোনো দলই পিছিয়ে থাকেনি। টিভির পর্দায় সেই এক ছবি-হদ্দ গরিব পরিবারের সামান্য মাথা গোঁজার আস্তানাটুকু আধ-ভাঙা, জিনিসপত্র ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে। কত কষ্ট করে, তিল তিল করে গড়ে তোলা গৃহস্থালির এই পরিণতি! মেয়েদের কান্না-হাহাকার। এসব দেখে মনে হয়-এদের কী অপরাধ যে কোলের শিশু নিয়ে রাস্তায় অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটাতে হবে?
আসানসোলের তৃণমূলপ্রার্থী অভিনেত্রী সায়নী ঘোষকে তার বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বী অগ্নিমিত্রা পাল হারার পর কন্ডোমের দোকান খোলার পরামর্শ দিয়েছেন। কতটা বিকৃতির শিকার হলে, বুকে কতটা ঘৃণা পুষে রাখলে-একজন মাঝবয়সী মহিলা এক তরুণীকে এমন কথা বলতে পারেন? এই বিকৃতি, বিদ্বেষ নিয়ে ‘জনপ্রতিনিধি’ হয়ে উনি মানুষের কাছে কী বার্তা দেবেন, কী মহদুপকার করবেন তাদের জন্যে? দেখুন, উনি কতটা সংক্রমিত হিংসায়! এমন নিদর্শন আছে ভূরি ভূরি যেখানে শালীনতার শেষ সীমাও লঙ্ঘিত হয়ে গেছে। তালিকা বাড়িয়ে শিরঃপীড়া বাড়ানোর দরকার নেই!
এবার রাজনীতির জগৎ ছেড়ে একটু সমাজের কথায় আসি, যদিও সেটাও রাজনীতিমুক্ত নয়।সেদিন কথা হচ্ছিল এক সরকারি সংস্থার প্রযুক্তিবিদ আধিকারিকের সঙ্গে। বললেন, “কয়েক দশক আগে বি টেক করে যখন শিক্ষানবিশীতে ঢুকেছিলাম, তখন এক মহিলা হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় নিজের পেশাগত ও প্রশাসনিক দক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিতও করতে পেরেছি। মহিলা হিসেবে বাড়তি সুযোগ তো নিই-ই নি, বরং অতিরিক্তটাই দিয়েছি। আমার জুনিয়র প্রতিটি মহিলা সহকর্মীকেও সেটাই বুঝিয়েছি।
এখন প্রতিটি সংস্থাকে নিজের সম্পদ নিজে যোগাড় করে নিতে হচ্ছে। সংস্থাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে সবল পায়ে চলাটাকেও আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। সবাই একযোগে এই সামগ্রিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার সাথে সাথে যখনই প্রোডাকশনের কোন সমস্যা বা ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়েছে, রাত দুপুরে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে, দৌড়েছি। সবাই মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে বিপদ সামলেছি। তখন সিনিয়র-জুনিয়র, নারী-পুরুষ এসব অবান্তর প্রশ্নই আসেনি। কোনো পদক্ষেপ বেঠিক মনে হলে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছি। সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে গেছি। তাতে সাময়িক মনোমালিন্য হলেও কখনও অসম্মানিত হইনি। জুনিয়র কোলিগদের কাছ থেকেও, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভালোবাসা ও সম্মান দুটোই পেয়েছি। অন্তত এতদিন পর্যন্ত তাই-ই জানতাম। হঠাৎ মাত্র কিছু দিনের মধ্যে অবাক হয়ে দেখছি, পরিস্থিতিটা কেমন পাল্টে যাচ্ছে। প্রতি পদে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে – তুমি একজন মহিলা! তোমার কথা শুনবো কেন? চোখের সামনে দেখলাম আমার যে পদে প্রমোশন প্রাপ্য ছিল, সেটি দেওয়া হল একজন জুনিয়রকে যিনি ভুল করেও কখনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো সংঘাতে যাননি। সে যাক। কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে আর চাকরিটা করা যাচ্ছে না। রাতের ঘুম চলে গেছে। অবসরের এখনও দেরি আছে। কিন্তু আমি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।” তার আক্ষেপ – “যখন একজন সিএম-কে যা খুশি বলা যায়, তখন আমরা আর সম্মান আশা করব কী করে!”
একজন মহিলা ইট ভাটা বা কয়লা খাদানের শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা, চাকরির সুরক্ষা তাহলে কোথায়? বিশেষ করে যখন নতুন শ্রম কোডে তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে?
গত সপ্তাহে আউশগ্রাম দুটি আদিবাসী বালিকাকে গণধর্ষণ করা হয়। সেই আউশগ্রামেই এক জনমজুর মহিলাকে তার জামাই দুই সঙ্গীকে নিয়ে গণধর্ষণ করে গত সোমবার। মহিলাদের ‘মেয়েমানুষ’ হিসেবে, পুরুষের অধীনত হিসেবে, মনুষ্যেতর হিসেবে দেখার এই ‘চোখটা’ প্রতিদিন ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা গোলওয়ালকরের শিষ্যরা এই বাংলায় নতুন করে ফুটিয়ে চলেছেন। এই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের প্রতিটি মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের কষ্টার্জিত সমাজভাবনাকে, সংস্কৃতিকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।
দেশের বিচার ব্যবস্থা আরো একবার প্রহসনের সাক্ষর রাখল গত ২৫ মার্চ, যেদিন উত্তরপ্রদেশের মুজাফ্ফরনগরের বিশেষ আদালতের বিচারপতি রাম সুধ সিং ২০১৩ সালে সংঘটিত মুজাফ্ফরনগর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের আবেদনে সায় দিলেন। মোদী সরকার ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারে বসার পর বারবারই দেখা গেছে -- অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো বিচার বিভাগও বিজেপি ঘেঁষা হয়ে বিজেপি যেমন চায় সেরকম রায় দেওয়াতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আদালতের এই ধরনের রায়দানের ফলে দাঙ্গা সংঘটনে, পুলিশের সঙ্গে ভুয়ো সংঘর্ষে নাগরিক হত্যার চক্রান্তে অভিযুক্ত বিজেপি নেতারা যেমন রেহাই পেয়েছেন, তারই সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মামলায় আদালতের দিক থেকে ন্যায়বিচারের তোয়াক্কা না করার প্রবণতাও প্রকট হয়ে সামনে এসেছে। মুজাফ্ফরনগর দাঙ্গা সংঘটিত হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে, যখন নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই বিজেপি’র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী রূপে ঘোষিত হয়েছেন। মুজাফ্ফরনগরের নাগলা মাণ্ডোরে গ্ৰামে অনুষ্ঠিত মহাপঞ্চায়েত থেকে (যা অনুষ্ঠিত হয় ৭ সেপ্টেম্বর) সলতে পাকানো শুরু হয় দাঙ্গার। ‘বেটি বহু ইজ্জত বাঁচাও’ নাম দিয়ে সেই মহাপঞ্চায়েতে ‘লাভ জেহাদ’কে ইস্যু করে বিজেপি নেতারা মুসলিম ছেলেদের হাতে হিন্দু মেয়েদের ইজ্জত বিপন্ন হওয়ার আষাড়ে গল্প ফেঁদে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে পরিস্থিতিকে উত্তেজনাময় করে তুললেন। একটি মুসলমান ছেলের হিন্দু মেয়ের পিছু নেওয়ার আজগুবি অভিযোগকে কেন্দ্র করে এবং মুসলিম ছেলেটিকে হত্যা করা বীরত্বপূর্ণ কাজ বলে জাহির করার মধ্যে দিয়ে যে দ্বন্দ্বর শুরু তা অবশেষে ভয়াবহ দাঙ্গায় পরিণতি লাভ করল। একটা ভিডিও ইউ টিউব এবং ফেসবুকের মত সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে লাগল। সেই ভিডিও দেখাল – দুই হিন্দু যুবককে মুসলিমরা পিটিয়ে মারছে। এই দুই ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা ও ন্যায়বিচারের জিগির তুলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষকে তীব্র করে তোলা হল। পরে পুলিশ তদন্ত করে জানাল যে ভিডিওতে দেখানো ঘটনা আদৌ উত্তরপ্রদেশের কাওয়াল গ্ৰামের নয় এবং ভিডিওটা দু’বছরের পুরনো। ঐ ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে তুলেছেন বলে অভিযুক্ত হলেন বিজেপি বিধায়ক সঙ্গীত সোম। সুপরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু মহল্লাগুলোতে ও পরিবারগুলোর ওপর চালানো হল পৈশাচিক আক্রমণ, ৬০-এর বেশি মানুষ নিহত হলেন, ৫০,০০০-এরও বেশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন সরকারের বানানো বিভিন্ন শিবিরে। এই দাঙ্গার পিছনে মূল মাথা হিসাবে অমিত শাহ কাজ করেছিলেন বলেই জনশ্রুতি। দাঙ্গা থেকে বিজেপি বিপুল লাভ তুলল, সমাজবাদী পার্টি ও বিএসপি’কে ধরাশায়ী করে উত্তরপ্রদেশে ৮০টা সংসদীয় আসনের মধ্যে বিজেপি একাই দখল করল ৭১টা আসন। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসা এবং নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে মুজাফ্ফরনগর দাঙ্গার ভূমিকা এইভাবে বড় হয়ে দেখা দিল। সেদিন যারা মুজাফ্ফরনগরে দাঙ্গা বাধানোয় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, যোগী সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে সেই নেতারা বেকসুর খালাস পাবেন। সেই নেতাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান যোগী মন্ত্রীসভার মন্ত্রী সুরেশ রাণা, বিধায়ক সঙ্গীত সোম, পূর্বতন বিজেপি সাংসদ ভরতেন্দু সিং, বর্তমান মন্ত্রিসভার রাষ্ট্রমন্ত্রী কপিল দেব আগরওয়াল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেত্রী সাধ্বী প্রাচী, প্রমুখ। এদের জাতীয় সুরক্ষা আইনে গ্ৰেপ্তার করা হয় এবং পরে জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিলে তাদের জামিন পেতে অসুবিধা হয় না।
শুরুতে আদালতের রায়ে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের রেহাই পাওয়ার যে উল্লেখ করা হয়েছে তার দু’একটার দিকে তাকানো যাক। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আট মাস পরই গুজরাটের সোহরাবুদ্দিন সেখ সংঘর্ষ হত্যা মামলা থেকে খালাস পেলেন অমিত শাহ – অত্যন্ত বিতর্কিত পরিস্থিতিতে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলা গুজরাটের বাইরে নিয়ে এসে চালানো হচ্ছিল মুম্বাইয়ে সিবিআই-এর বিশেষ আদালতে। যে বিচারপতি আদালতে শাহর উপস্থিতি নিয়ে কড়া মনোভাব নিয়েছিলেন তাঁকে বদলি করা হল, আর বদলি করা হল সিবিআই-এর সেই অফিসারদের যারা সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলার তদন্ত করছিলেন। বিচারপতি বদলি হওয়ার পর যিনি বিচারপতি হয়ে এলেন, সেই বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিসান লোয়ার মৃত্যু হল রহস্যজনক পরিস্থিতিতে। তাঁকে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়েছিল বলে অভিযোগ এবং আরো অভিযোগ বোম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং তাঁকে ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর যিনি অমিত শাহ মামলার বিচারপতি হয়ে এলেন, সেই এম ভি গোসাভি কোনো বিচার না করেই এক মাসেরও কম সময়ে অমিত শাহকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দিলেন। এই মামলায় অমিত শাহর রেহাইয়ের সঙ্গেই অভিযোগ মুক্ত হয়ে খালাস পেলেন রাজস্থানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গুলাব চাঁদ কাটারিয়া ও ভুয়ো সংঘর্ষ হত্যায় অভিযুক্ত গুজরাটের পুলিশ অফিসাররা।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় চূড়ান্ত উদ্ভট যুক্তিতে বিশেষ আদালতের বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার যাদব যে বিজেপি নেতা-নেত্রীদের রেহাই পাওয়ার পথ প্রশস্ত করলেন তাদের মধ্যে ছিলেন এল কে আদবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতি ও আরো অনেকে। সর্বসমক্ষে যা সংঘটিত হয়েছিল, টিভিতে যা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল, তা জানিয়েছিল যে বিজেপি’র সর্বোচ্চ নেতাদের উপস্থিতিতেই ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করা হয়েছিল। মসজিদ যখন চূর্ণ করা হচ্ছিল তখন কিছু নেতার উল্লাস প্রকাশের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। আরো ধরা পড়েছিল বিজেপি নেতা-নেত্রীদের দেওয়া ‘এক ধাক্কা আউর দো’র মতো শ্লোগান। লিবারহান কমিশন তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল যে, বাবরি মসজিদ ‘নিখুঁতভাবে ছকা পরিকল্পনা’র মধ্যে দিয়েই ধ্বংস করা হয়েছিল, আর সেই পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সংঘ ও বিজেপি নেতৃবৃন্দের। এগুলো বিশেষ আদালতের বিচারপতির কাছে কোনো গুরুত্বই পেল না। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার যাদব রায়ে অবলীলায় বললেন, “সমাজবিরোধী লোকজন কাঠামোটাকে ভেঙ্গেছে। অভিযুক্ত নেতারা তাদের থামানোর চেষ্টা করেছিলেন”। এরচেয়ে আজগুবি যুক্তি আর কি হতে পারে!
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর আদিত্যনাথ নিজেরই বিরুদ্ধে চলা বেশ কিছু মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশের বড় হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে আদিত্যনাথ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা, অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থান নিয়ে অশালীন মন্তব্য করা, শান্তি বিঘ্নিত করা ও আরো নানান অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যত গুরুতরই হোক, ন্যায়বিচারকে বানচাল করতেই তারা সিদ্ধহস্ত।
অযোধ্যা জমি মালিকানা মামলার রায়ের উল্লেখও এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না এই জন্য যে, উপরে উল্লেখিত রায়গুলোর মতো এই রায়ও বিচারের বিপথগামিতাকে নির্দেশিত করে নরেন্দ্র মোদী জমানার আর একটা বিচারবিভাগীয় ‘বিজয়’এর নজির হয়ে রয়েছে। ১৯৪৯ সালে চুপিসারে বাবরি মসজিদের ভিতর রামলালার মূর্তি ঢুকিয়ে শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্রের একটা প্রক্রিয়া। ২০১৯এর নভেম্বরে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ সহ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের রায়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সেই বৃত্তের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটল। এই ধরনের রায় যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী সামাজিক বুনটকে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতবিক্ষত করতে পারে, বিচারপতিদের বিবেচনা তাকে একটুও স্পর্শ করতে পারল না।
বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে চলা মামলা তুলে নেওয়ার সুপারিশ করতে গিয়ে আদিত্যনাথের সরকার বলছে, এটা করা হচ্ছে ‘জনস্বার্থে’। জনস্বার্থ বলতে তো জনগণের স্বার্থকেই বোঝায়। যে নেতারা জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে, জাল ভিডিও দেখিয়ে দাঙ্গা সংঘটিত করলেন, তাদের রেহাই দেওয়া কোন ধরনের জনস্বার্থ? দাঙ্গায় যে বহু সংখ্যক মানুষ নিহত হলেন আর যে হাজার-হাজার মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে শিবিরে আশ্রয় নিতে হল, তাদের ন্যায়বিচারের বঞ্চনাটা কোন্ জনস্বার্থকে নির্দেশিত করে? আদিত্যনাথ সরকারের এই পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে এই বার্তাই বেরিয়ে আসছে যে -- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ও তার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিরা ঘৃণ্য অপরাধ করলেও শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবে, যে উদ্দেশ্যে দাঙ্গা সৃষ্টির মতো ন্যক্কারজনক কাজ, তার রাজনৈতিক ফসল তাদের কুড়োতে দেওয়া হবে।
সিপিআই(এমএল)-এর উত্তরপ্রদেশ শাখা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার রাজ্য সরকারের প্রস্তাবে মুজাফ্ফরনগরের জেলা আদালতের সায় দেওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। বিবৃতিতে দাবি জানানো হয়েছে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে উচ্চতর আদালতকে স্বীয় উদ্যোগে মামলাগুলি বিচারযোগ্য বলে গণ্য করতে হবে, মামলাগুলোকে পুনরায় শুরু করতে হবে, দাঙ্গায় নিহত ও ক্ষতিগ্ৰস্তদের ন্যায়বিচার দিতে হবে। উল্লেখ্য, কর্ণাটকে বিজেপি সরকারও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ২১টা মামলা তুলে নেওয়ার আবেদন জানায়। সেই প্রসঙ্গে কর্ণাটক হাইকোর্ট বলে, “কোনো আদালতই সরকারের করা মামলা তুলে নেওয়ার সুপারিশে সায় দিতে বাধ্য নয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২১ ধারায় আবেদন করা হলেও আদালত প্রাথমিকভাবে এই মূল্যায়ন করতে বাধ্য যে মামলা প্রত্যাহারের যুক্তিগ্ৰাহ্যতা ঠিক আছে কি নেই, এবং সরকারের সুপারিশকে খারিজ করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে।” অতএব, মুজাফ্ফরনগর দাঙ্গায় অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও মামলা পুনরায় শুরু করার ক্ষমতা উচ্চতর আদালতের আছে, এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে তা করাও উচিৎ।
সেনা শাসনের নির্মমতা ভোগ করাই যেন মায়ানমারের জনগণের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ফলাফলকে অগ্ৰাহ্য করে সেনারা ১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেওয়ায় মায়ানমারে সেনা শাসনের ধারাবাহিকতাই আবার ফিরে এল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৮ সালে মুক্তির মাত্র ১৪ বছর পর ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করে মায়ানমারকে সেনা শাসনের কবজায় নিয়ে আসেন। এরপর টানা পাঁচ দশক মায়ানমার থেকেছে সেনা শাসনের নিষ্পেষণে। একের পর এক সামরিক একনায়ক ক্ষমতায় বসে কায়েম করেছেন সন্ত্রাসের রাজ, সাক্ষর রেখেছেন নির্মম পৈশাচিকতার। এরই পাশাপাশি গণতন্ত্র কায়েমের জন্য আন্দোলনের এক ধারাও চলতে থাকে, যার নেতৃত্বে থাকেন ১৯৯১ সালে শান্তি নোবেল পুরস্কার প্রাপক আউং সান সু কি। প্রধান সেনা অফিসাররা ২০১১ সালে গণতন্ত্রের কিছুটা অনুশীলন চলতে দিতে রাজি হন ২০০৮ সালে তাদের তৈরি এক সংবিধানের ভিত্তিতে। এই গণতান্ত্রিক অনুশীলন চরিত্রের দিক দিয়ে ছিল একেবারেই আংশিক, অনেকেই যেটাকে অভিহিত করেছেন ‘আধা গণতন্ত্র’ রূপে। এর ভিত্তিতে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ প্রশস্ত হলেও রাষ্ট্র কাঠামোর ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রইল যথেষ্ট মাত্রায়, ২০০৮এর সংবিধান অনুসারেই। সংবিধানের ধারা অনুসারে সংসদের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্রর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকও সেনারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আউং সান সু কি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। এনএলডি পাঁচ বছর শাসন চালানোর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এনএলডি ৮৩ শতাংশ আসন পেয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। কিন্তু সেনা কর্তারা নির্বাচনে জালিয়াতি হওয়ার অভিযোগ এনে নির্বাচনী ফলাফলকে না মানার পথে যায়। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন রায় দিলেও সেনারা জালিয়াতির অভিযোগে অনড় থেকে নির্বাচনে নিজেদের প্রত্যাখ্যাত হওয়াকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। সেনা অভ্যুত্থানের প্রধান উদ্যোক্তা হলেন সেনা প্রধান মিন আউং হাইয়াং। সেনাদের সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এণ্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়। সেনাপ্রধান মনে করেছিলেন তাঁদের সমর্থিত দল নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন, গণতান্ত্রিক পথে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা অধরা থাকায় তাঁর মাথায় সামরিক অভ্যুত্থান চেপে বসে। সু কি ও তাঁর দলের অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীদের গ্ৰেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তাঁরা ঘুষ নিয়েছেন, অনুমতি ছাড়াই বিদেশ থেকে ওয়াকিটকি এনেছেন, করোনার নিয়মাবলী লঙ্ঘন করেছেন, যদিও এই অভিযোগগুলোর কোনোটাই প্রমাণিত নয় এবং কিছু অভিযোগ একেবারেই তুচ্ছ। আগের অভিযোগের সঙ্গে নতুন-নতুন অভিযোগ দিন-দিন যোগ হতে থাকে।
মায়ানমারের জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লক্ষ এবং সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৪ লক্ষ। জনসংখ্যার তুলনায় সেনাবাহিনীর বহরকে বড়ই বলতে হবে। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে এক শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থ গড়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীর আর্থিক প্রতিপত্তি বিস্মিত না করে পারেনা। সেনাবাহিনীর রয়েছে বিপুল ব্যবসায়ী সাম্রাজ্য -- নিজস্ব ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল, স্কুল, বীমা সংস্থা, মোবাইল নেটওয়ার্ক, আনাজপাতির সংস্থা। তাদের আরো রয়েছে চুনি ও অন্যান্য দামি পাথরের খনন ব্যবসা, তামাক-বিয়ার-পণ্যদ্রব্য উৎপাদন-পর্যটন-এর মতো বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা। সেনারা টিভি স্টেশন, প্রকাশনা সংস্থা এবং এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণের শিল্পও চালায়। মায়ানমার হোল্ডিংস লিমিটেড নামে বহু বাণিজ্য সংস্থার যে কংলোমারেট বা সমন্বয় সেনাবাহিনী চালায়, তাতে প্রতিটি সেনা ইউনিটের শেয়ার আছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের কিছু কর্পোরেট সংস্থাও এর অংশীদার। রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০১৯ সালের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মায়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের দমনমূলক কার্যকলাপের জন্য আন্তর্জাতিকস্তরে সমর্থন পেতে তাদের ব্যবসায়ী ও অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তিগুলোকে কাজে লাগায়। প্রসঙ্গত, মায়ানমারে ভারতীয় পুঁজিপতি আদানিদের একটা বন্দর প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য আদানি পোর্টস এণ্ড সেজ লিমিটেড এবং মায়ানমার ইকনমিক কোঅপারেশন-এর মধ্যে চুক্তির পরিমাণ হল ৩০ মিলিয়ন ডলার। এই মায়ানমার ইকনমিক কোঅপারেশন হল সেনাবাহিনী চালিত অন্যতম বাণিজ্যিক কংলোমারেট। আদানিদের ব্যবসা এইভাবে মায়ানমারের সেনাদের সঙ্গে গাঁটছড়ায় আবদ্ধ। যে সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এত বিস্তৃত, আর্থিক স্বার্থের ডালপালা এত প্রসারিত, তারা যে নিজেদের ব্যবসায়ী সাম্রাজ্যকে অটুট রাখতে অসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সঁপে দেবেনা তা সহজেই বোধগম্য। মাথিয়েসন নামে জনৈক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতেই এই সামরিক অভ্যুত্থান। (ওরা মনে করল) উনি (সু কি) এবার এমন রায় পেয়েছেন যাতে আমাদের অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষমতাকে, অভিযুক্ত হয়ে মামলার মুখোমুখি হওয়া থেকে অব্যাহতির অধিকারকে খর্ব করা যাবে। কোনোভাবেই নিজেদের এমন অসহায় করে তুলতে আমরা পারি না”।
মায়ানমার সেনার চরিত্র সম্পর্কে মাথিয়েসন আরো বলেছেন, “এটা সম্পূর্ণরূপে অসংশোধিত ও পুনর্গঠিত না হওয়া স্বৈরাচারী, পৈশাচিক প্রতিষ্ঠান যার ডিএনএ’তে রয়েছে হিংসা ও নৃশংসতা”। মায়ানমারের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, দেশের আপামর নাগরিকদের বিরুদ্ধে সেনারা চালায় ধর্ষণ ও অন্যান্য রূপের যৌন হিংসা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, তীব্র নিপীড়ন; তারা বলপূর্বক শ্রমদানে এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানেও বাধ্য করে। মায়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে এবং সেনা প্রধান মিন আউং হাইয়াং নিজে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে হেগ-এর আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে একটি মামলাও চলছে।
যে সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য এই ধরনের, দেশের প্রতিবাদী নাগরিকদের যারা শত্রু জ্ঞান করে, সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নামা জনগণের রক্ত ঝড়াতে তারা যে অকুণ্ঠিতচিত্ত হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। বন্দুকবাজ সেনাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামা নিহত মানুষের সংখ্যা ৫৫০ ছাড়িয়ে গেছে, যাদের মধ্যে ২৭ মার্চ, সেনা দিবসের দিন রক্তঝড়া শনিবারেই নিহত হয়েছেন ১৪২ জন। নিহতেদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৫০-এর কাছাকাছি। এরই সাথে আহত হয়েছেন বহু সংখ্যক জনগণ এবং গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। রাতের বেলায় সেনারা পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, যথেচ্ছ গুলি চালিয়ে নাগরিকদের ভয় দেখায় এবং তাদের তালিকায় থাকা নির্দিষ্ট নাগরিকদের গ্ৰেপ্তার করে। সেনাদের আতঙ্কে সাংবাদিকরাও নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন না। তাঁরা সব সময়েই আশঙ্কা করেন, তাঁদের গ্ৰেপ্তার করা হবে (ইতিমধ্যে ১০ জন সাংবাদিককে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানা গেছে) এবং তাঁদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে।
সেনাদের এই নির্মমতা কিন্তু প্রতিরোধের ঢেউকে রুখতে পারছে না। নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে হাজার-হাজার যুবক, কারখানা শ্রমিক, শিক্ষক, সাধারণ জনগণ, কলেজ পড়ুয়ারা সেনা দখলদারির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র পুনর্বহালের দাবিতে গড়ে তুলছেন প্রতিরোধ। প্রতিরোধে নামা নেতৃত্ব বলছেন, “আসুন, আমরা দলে-দলে এগিয়ে যাই। আসুন, সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখল করা সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষমতা দেখাই, যে সরকার যুবকদের ভবিষ্যত, দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে”। তাঁরা আরো বলছেন, “আমরা কোনো এক নেত্রীর জন্য লড়ছি না, আমরা দেশের জন্য লড়ছি, আমরা লড়ছি ভবিষ্যতের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য”। কারেন, কাচিন, রাখাইন, রোহিঙ্গাদের মতো সশস্ত্র জনজাতি গোষ্ঠীগুলোও প্রতিরোধ বাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সেনার যে বর্বরতা মায়ানমারের জনগণকে দলন করছে, রক্তের রূপে প্রতিরোধের যে মাশুল সেনারা আদায় করে নিচ্ছে, সেই রক্ত বন্যার শেষ কি কোথাও নেই? আন্তর্জাতিক মহল কি দু’একটা সেনা-বিরোধী বুলির মধ্যেই তাদের মানবিক কর্তব্যকে সীমিত রাখবে? মায়ানমারের পরিস্থিতিতে ‘উদ্বিগ্ন’ হওয়ার মধ্যেই কি রাষ্ট্রপুঞ্জ তার ‘রক্ষা করার দায়িত্ব’ সমাধা করবে?
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের একটা অংশের অভিমত হল, রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমোদনের ভিত্তিতে মার্কিন-গ্ৰেট ব্রিটেন-ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট হয়ে মায়ানমারে কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটলে তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে, দেখা দিতে পারে বকলমে মার্কিন ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ। এই অভিমতকে যুক্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়না। বিশ্বের বড়-বড় শক্তিগুলো আজ তাদের জাতীয় স্বার্থকে, বড়-বড় কর্পোরেটদের স্বার্থকে অগ্ৰাধিকারে রেখে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান নেয়। আর তাই মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা করে কোনো প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, “আমরা বিপর্যয়কর সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অথবা বলপ্রয়োগ করে স্বৈরতান্ত্রিক জমানাকে উৎখাতের চেষ্টা করব না। অতীতে আমরা এই কৌশলগুলোর প্রয়োগ করেছি। সেগুলোর পিছনে যত সদিচ্ছাই থাক, সেগুলো কাজে দেয়নি”। এই মন্তব্যের মধ্যে কেউ মার্কিনের বিদেশ নীতিতে আমূল দিগপরিবর্তন দেখতে চাইলে ভুল হবে। প্রয়োজন হলে তারা ইরান বা ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ করবে; ‘জমানা বদলের’ নীতিকে কখনই বিলকুল বাতিল করবে না। দরকারে আরো একটা ইরাক, আর একটা লিবিয়া তারা ঘটাবে। আর চীনও এখন জাতীয় স্বার্থ, নির্ভেজাল পুঁজিবাদী অনুশীলনের স্বার্থকে অগ্ৰাধিকারে রেখেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের চালিত করে। তাই তারা আউন সান সু কি জমানার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে, সু কি’র মুক্তির কথা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে, আবার সেনা শাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্ৰহণেও বাধা দেয়। সেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মায়ানমারে রক্তপাত বন্ধ করাই যখন বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রকৃত কর্তব্য হত, জনগণের ওপর দমন রদ করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্যোগে সক্রিয়তা দেখানোটাই যথার্থ মানবিক কাজ হত, তখন মুখে ‘উদ্বেগ’ দেখিয়ে সেনা শাসন ও তাদের নির্মমতাকে অব্যাহতভাবে চলতে দেওয়ার পথই তাদের কাছে অভিপ্রেত হল। সেনা প্রধান বলেছেন নির্বাচনে জালিয়াতির তদন্ত শেষ হলে, এক বছর পর জরুরি অবস্থা উঠে গেলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিজেদের প্রতারিত করে দুনিয়া কি মায়ানমার সেনার ঝড়ানো রক্ত স্রোতকেই অনিবার্য বাস্তবতা বলে মেনে নিয়ে হাত গুটিয়ে থাকবে? নিজ-নিজ স্বার্থ তাড়িত ও নীতি-নৈতিকতা বর্জিত বিশ্বে পাশবিকতার অরাজকতা চললেও, মানবাধিকারের বিপুল বিপর্যয় ঘটলেও তার প্রতি নিস্পৃহ থাকাটাই কি রীতি হবে? মায়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে যেমন আওয়াজ উঠে আসছে, “আর কত লাশ পড়লে তবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ব্যবস্থা নেবে?”
(মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় সিপিআই(এমএল)-এর বিবৃতি)
মায়ানমারের সেনা শাসকরা একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে অসামরিক সরকারকে উৎখাত করেছে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানো জনগণের ওপর নামিয়ে এনেছে পৈশাচিক দমন। মায়ানমারের সেনাবাহিনী ৫০০রও বেশি প্রতিবাদকারী অসামরিক জনগণকে গুলি করে হত্যা করেছে।
সিপিআই(এমএল) সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছে ও তাদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছে। মায়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকৃত প্রতিবাদকারী জনগণ এবং মায়ানমারে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা চলছে, আমরা তাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানাচ্ছি।
এটা অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার যে, মায়ানমারের সেনা শাসকরা যখন সে দেশের জনগণের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, ভারত সরকার তখন ২৭ মার্চ মায়ানমারের সেনা দিবসের কুচকাওয়াজে যোগদানের জন্য তার সেনা প্রতিনিধিকে পাঠায়। আমরা এই বিষয়টারও উল্লেখ করতে চাই যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ দোস্ত আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন একটা কোম্পানির সুদৃঢ় ব্যবসায়িক গাঁটছড়া রয়েছে। আদানি পোর্টস সংস্থার সর্বোচ্চ কর্তা ২০১৯ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সিদ্ধান্তকে এড়ানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব হচ্ছে যে মোদী সরকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্যবোধের চেয়ে আদানির স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে বলে আমরা ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের যেন খাবার ও আশ্রয় দেওয়া না হয় বলে মনিপুরের রাজ্য সরকার যে নির্দেশিকা দিয়েছিল (পরে যা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়) আমরা তাকে ধিক্কার জানাচ্ছি; মায়ানমারে ফিরে গেলে মায়ানমারের সেনাদের হাতে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মৃত্যু অবধারিত, সেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে নির্বাসিত করার ভারত সরকারের প্রচেষ্টাকেও আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি। যে দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নাগরিকের স্বীকৃতি পায়না এবং যেখানে তাদের গণহত্যার মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন (নিপীড়নের মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকা দেশে শরণার্থীদের বলপূর্বক ফেরত পাঠানোর বিরুদ্ধে অধিকার)। এই ইস্যুতে একটা শুনানি গ্ৰহণের সময় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যেরও আমরা নিন্দা করছি: “আশঙ্কাটা হল এই যে ওদের ফেরত পাঠানো হলে ওদের হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু আমরা এটাকে আটকাতে পারি না”।
আমরা দাবি জানাচ্ছি, ভারত আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলুক এবং মায়ানমারের সেনাদের হাতে গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী সহ সমস্ত শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার দায়কে মান্যতা দিক।
গত ৩১ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয় যে ১ এপ্রিল থেকে স্বল্প সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুহূর্তেই তোলপাড় হল দেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠল। পরদিন সাত সকালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ট্যুইট করে জানিয়ে দিলেন যে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে; যা প্রকাশ পেয়েছে তা ‘অসাবধানতা’ বশত। কী কাণ্ড! তাহলে কি একজন সরকারী আধিকারিকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি অত্যন্ত জরুরি বিজ্ঞপ্তি, মন্ত্রী, সচিব ও ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের এড়িয়ে গিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ফাইল, নোট ও অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অনুমোদন ব্যতীতই জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়ে গেল? আর এই কথাটা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আমাদের বিশ্বাস করতে বলছেন?
ডাল মে অবশ্যই কুছ কালা হ্যায়! তাহলে রহস্যটা বোঝা যাক।
শুধু স্বল্প সঞ্চয়েই নয়, সাধারণ মানুষের গচ্ছিত ব্যাঙ্ক আমানতে সুদ হ্রাস থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ডিএ স্থগিত, রেল-ব্যাঙ্ক সহ লাভজনক রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রকে বেচে দেওয়া, কৃষিক্ষেত্রের সক্ষমতা ও কৃষকের স্বাধীন রোজগারকে নির্মূল করা, শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকাকে তছনছ করে দেওয়া, ছোট শিল্প ও স্থানীয় বাণিজ্যকে পঙ্গু করে অথর্ব করে ফেলা -- কোন কাজটি করতে এই সরকার বাকি রেখেছে? তাই, স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ হ্রাসের পরিকল্পনাটা এদের পক্ষে মোটেও অকরণীয় কিছু ছিল না। গণ্ডগোলটা হয়েছে অর্থমন্ত্রীর খানিক রাজনৈতিক বালখিল্যতার জন্য। আসলে তিনি এটুকুই জানেন, তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কোনও ধর্তব্যযোগ্য শক্তিই নয়। কিন্তু অসম ও বাংলাতেও যে তাঁর দলকে নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে, বিশেষ করে বাংলায় তাদের দলের অস্তিত্ব রয়েছে তীব্র ও ব্যাপক বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হওয়া নিদারুণ সংকটে -- সেই কাণ্ডজ্ঞানটি তাঁর মাথায় কাজ করেনি। যেমন, আরও বহু সাধারণ অর্থনৈতিক বোধ তাঁরমধ্যে একেবারেই কাজ করে না (বুঝে হোক কি না বুঝে)। অতএব, সক্কাল সক্কাল তাঁর দলের শীর্ষ জুটির ধমকধামক খেয়ে সাত-তাড়াতাড়ি তাঁকে আপাতত সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়েছে। তিনি জানেন, ১ জুলাই থেকে সেই বিজ্ঞপ্তি আবারও কার্যকর হবে।
এ তো গেল ভোটের বাজারে তিন মাস আগে বা পরে সিদ্ধান্ত স্থগিত বা চালু করার কথা। কিন্তু কেন লাগাতার এই সুদ হ্রাসের প্রয়াস? কেন সর্বতোভাবে চেপে ধরা হচ্ছে আমজনতার বেঁচে থাকার সমস্ত উপায় ও রসদকে? তা বুঝতে হলে শুধু আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতিকে অনুধাবন করলেই হবে না, এদেশে বিজেপি দলটি যে নির্দিষ্ট এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কায়েম করতে চাইছে তার ভিতরের গতিশীলতাকেও বুঝতে হবে। অর্থাৎ, উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে তারা যাত্রা করতে চাইছে এক ফ্যাসিবাদী-পুঁজিবাদের দিকে (অনেকে বলেন ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) যা তাদের ‘এক দেশ এক পার্টি’ ব্যবস্থা পত্তনের মূল ভিত্তি। তাদের সেই অভিলাষকে একটু সাজিয়ে ফেলা যাক।
১) তাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল আদানি-আম্বানি নির্ভর এমন এক নিরেট আধার গড়ে তোলা যেখানে দেশের যাবতীয় অর্থনীতির সম্পদ এসে কেন্দ্রীভূত হবে গুটিকয়েক কর্পোরেট হাউজের হাতে। এই হাউজের সঙ্গেই থাকবে তাদের গভীর রাজনৈতিক-অর্থনীতিগত সখ্য। তা এই অর্থে যে, সেই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তারা এমন এক বানিয়াতন্ত্র গড়ে তুলবে যেখানে ব্যক্তিগতস্তরে প্রয়োজন মতো অর্থ বিলিয়ে নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক আধিপত্যকে নিশ্চিত করতে পারা যাবে। এইজন্যই কিছুদিন আগে এরাজ্যে এক জনসভায় অমিত শাহ খুব জোরের সঙ্গে বলেছেন যে তিনি বানিয়া এবং তাই অর্থের জন্য তার ওপর যেন সকলের বিশ্বাস থাকে। অর্থাৎ, সারা দেশ জুড়ে রাজনীতিকদের কেনাবেচা করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বা থাকার যে কার্যসূচীটি তারা একবগ্গা ভাবে ঠেলে নিয়ে চলেছে তারজন্য অর্থের কোথাও কোনও কার্পণ্য হবেনা। ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’ (পড়ুন আদানি-আম্বানি)। শুধু রাজনীতিক কেন, এই বিপুল অর্থের অংশ দিয়ে তারা বিচারব্যবস্থা, মিডিয়া ও গণতন্ত্রের সমস্ত কলামগুলিকে দখলে নিয়ে নেবে। তাদের ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের এই হল সার কথা। যারা টাকার কাছে বিকোতে চাইবেন না, তাদের জন্য থাকবে কেন্দ্র থেকে ছোঁড়া বাকী ব্রহ্মাস্ত্রগুলি -- এনআইএ, সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি।
২) অতএব, এই উদ্দিষ্ট সাধনের জন্য প্রাথমিকভাবে দরকার, দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে আদানি-আম্বানিদের বেচে দেওয়া, যাতে তারা মহীরূহের মতো ‘এক-হাতে থাকা অর্থভাণ্ডার’ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এই এক-হাতে অর্থভাণ্ডারকে কুক্ষিগত করাটাই তাদের প্রাথমিক এজেন্ডা। করোনার সুযোগ নিয়ে এই কাজটি অনেকাংশেই কেন্দ্রীয় সরকার সম্পন্ন করে ফেলেছে। সারা বিশ্বে গত এক বছরে সব থেকে বেশি সম্পদ বেড়েছে আদানি গোষ্ঠীর।
৩) পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ধূলিসাৎ করে দিতে হবে। এই প্রক্রিয়া দু’ভাবে চলতে পারে। এক, ব্যাঙ্ক বা স্বল্প সঞ্চয়ের প্রকল্পে বিনিয়োগ করে মানুষের হাতে যাতে খুব সামান্য অর্থ ফেরত আসে তার ব্যবস্থা পাকা করা। তার জন্যই নিয়ম করে সুদের হার কমিয়ে যেতে হবে। এইভাবে সুরক্ষিত প্রকল্পগুলি থেকে মানুষের আয় কমে গেলে তারা অধিক আয়ের জন্য শেয়ার বাজারে যেতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ, আমজনতাকে একপ্রকার বাধ্য করা কর্পোরেট শেয়ার কিনে বা ইক্যুইটি ফান্ডে বিনিয়োগ করিয়ে বড় বড় কর্পোরেটদের হাতে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ তুলে দেওয়া। দুই, স্থায়ী চাকরি বা শ্রম বাজারকে পঙ্গু করে শ্রমিক ও কর্মচারীদের এমন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া যেখানে তারা মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়বে। মোদ্দা কথায় তাদের আকাঙ্ক্ষিত চিত্রটি হল -- কর্মের কোনও সুনিশ্চিতি থাকবে না, কর্মজগতে সুরক্ষা থাকবে না, ন্যূনতম আয়েরও কোনও ব্যবস্থা থাকবে না। এই সার্বিক দ্বিমুখি কৌশলের অভীষ্ট লক্ষ্য একটিই -- এক অক্ষম জনসমাজ নির্মাণ করা যেখানে মানুষ বাধ্যত এক বিশালাকায় দৈত্যকুলের নিছক করুণার ওপর বেঁচে থাকবে।
৪) নিঃস্ব, রিক্ত ও দীর্ণ এমন এক জনসমাজ গড়ে উঠলেই তো সম্ভব ‘এক দেশ এক দল’এর স্বপ্নপূরণ। একদিকে থাকবে এক-কেন্দ্র শাসিত দেশ ও এক-দল কর্তৃক অনুশাসিত মানুষ, অপরদিকে এক অক্ষম জনসমাজ, চূড়ান্ত গণতন্ত্রহীনতা ও বিদ্বেষভরা যাপন; আড়ালে সক্রিয় মুষ্টিমেয় কর্পোরেট চালিত এক নৃশংস আর্থিক ব্যবস্থা।
এই অভিমুখেই চলেছে দেশের অর্থনীতি। চলেছে মানে, সেই পানেই তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্বল্প সঞ্চয় বা ব্যাঙ্কের আমানতে সুদের হার কমানো এর থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও প্রবণতা নয়। অস্থির ও অসুস্থ এক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে বিজেপি আজ যেভাবে উন্মাদের মতো অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে শুধু রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যই যথেষ্ট নয়, অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম ও নির্ভরশীল জনসমাজ গঠনও তার স্থির অভীষ্ট, নচেৎ, তার ফ্যাসিবাদ পূর্ণতা পাবে না।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
ভারতের সংবিধানের অন্যতম রূপকার বাবাসাহেব আম্বেদকার চেয়েছিলেন জাতিভেদ প্রথার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ। বিজেপি’র ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ তাকেই আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। ব্রাহ্মণ্যবাদের আকর গ্রন্থ মনুস্মৃতিকে তারা ভারতের আইন বানাতে চায়। বাংলায় রয়েছে জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস। চৈতন্যদেব তাঁর বৈষ্ণব আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জাতপাতের বেড়াজালকে ভাঙতে চেয়েছিলেন এবং অনেকদূর পর্যন্ত সফল হয়েছিলেন। সে যুগে দাঁড়িয়ে তিনি বলতে পেরেছিলেন হরিভক্তি থাকলে চণ্ডালও ব্রাহ্মণের চেয়ে উৎকৃষ্ট হতে পারেন।
বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান দিক জাতিবর্ণভেদকে উচ্ছেদের লড়াই। সেই লড়াইয়ের জন্য জেনে নেওয়া দরকার ভারতে বর্ণভেদ প্রথার ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই লেখাটিতে সেই চেষ্টাই রইলো।
খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর লেখক দিওদেরাস তাঁর একটি লেখায় আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়কার (খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দ) জনৈক লেখকের একটি অংশ উদ্ধৃত করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে আলেকজান্ডারকে রাজা পুরু জানাচ্ছেন যে গঙ্গারিডাই-এর রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের অনেক ক্ষোভ এবং প্রজারা তাঁকে সম্মানও করে না, কারণ তিনি ‘চামারের সন্তান’। এই উল্লেখটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সে সময় চামারবৃত্তিকে যথেষ্ট নীচু চোখে দেখা শুরু হয়েছিল। এই উদ্ধৃতির সঙ্গে ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্তের ৩৮নং ঋকটির যদি তুলনা করে দেখি, তাহলে দেখব সেখানে মুচির পেশাটিকে মর্যাদার চোখেই দেখা হচ্ছে। ঋগ্বৈদিক পরিস্থিতি থেকে সরে এসে আলেকজান্ডারের সময়কালের মাঝের হাজার বছরের মধ্যে এই পরিবর্তন কবে কীভাবে হতে থাকল, সেটি একটি জরুরী অনুসন্ধানের বিষয়।
অথর্ববেদ পর্বের শেষ দিক থেকেই কর্ম বিভাজন ক্রমে সামাজিক স্তর বিভাজন হয়ে উঠতে থাকল, জনগোষ্ঠী ও পরিবারগোষ্ঠী ক্রমশ সামাজিক শ্রেণিতে বিভাজিত হয়ে গেল, এমন অনুমানের সঙ্গত কারণ রয়েছে। অথর্ববেদের উনিশতম কাণ্ডের ৬নং সূক্তের ৬নং ঋকটি সেই পুরুষসূক্ত, যা সম্ভবত পরে ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত হয়। অথর্ববেদের ঊনিশ সংখ্যক কাণ্ডেই আরো দু’জায়গায় চতুর্বণের উল্লেখ রয়েছে। ৩২নং সূক্তের ৮নং ঋক’এ ঘাসের কাছে প্রার্থণা জানানো হয়েছে যে তিনি যেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, আর্য (বৈশ্য?) ও শূদ্রদের কাছে প্রিয় করে তোলেন। যদি মনে রাখি যে অথর্ববেদের উনিশ ও বিশ কাণ্ড দুটি মূল অথর্ববেদে পরে প্রক্ষিপ্ত, তবে এটিকে বৈদিক সংহিতা যুগের শেষতম পর্বর, খ্রীষ্টপূর্ব দশম থেকে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী সময়কালের রচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।
অধ্যাপক রামশরণ শর্মা তাঁর ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ বইতে বিভিন্ন প্রমাণ সহযোগে অনুমান করেছেন সামাজিক শ্রেণি হিসেবে অথর্ববেদের আদি পর্বটিতেও শূদ্রদের উপস্থিতি ছিল না। যেমন অথর্ববেদের পঞ্চম কাণ্ডের ১৭নং সূক্তের ৯নং ঋক’এ ব্রাহ্মণ, রাজন্য ও বৈশ্যের কথা আছে কিন্তু শূদ্রের উল্লেখ নেই।
শূদ্ররা কি আর্যভাষী সমাজের ভেতর থেকে উদ্ভূত না তারা এই সমাজের বাইরের কোনও গোষ্ঠী? খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে শূদ্র নামে যে একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। দিওদেরাস লিখেছেন আলেকজান্ডার সোদ্রাই নামের এক জনগোষ্ঠীকে আক্রমণ করেছিলেন। মহাভারতেও আভীরদের সঙ্গে যুক্তভাবে শূদ্রদের এক জনগোষ্ঠী হিসেবে বারবার অভিহিত করা হয়েছে। এতে শূদ্রকুল ও শূদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যও করা হয়েছে। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের কুলের সঙ্গে শূদ্রকুলের উল্লেখ করা হয়েছে আবার আভীর, দরদ, তুখার, পল্লব এইসব জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি শূদ্র জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। ভেবার তাঁর বইতে মনে করেছিলেন যে শূদ্ররা আর্যভাষীদেরই বেদবাহী তরঙ্গের আগেকার এক তরঙ্গ। পরবর্তীকালে এই মতটি পরিত্যক্ত হয়েছে। ফিক, কিথ, লাসেন, প্রমুখের গবেষণা (দ্রষ্টব্য রামশরণ শর্মার ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’, পৃষ্ঠা–৩৫) প্রমাণ করেছে শূদ্ররা প্রাক-আর্য জনগষ্ঠীরই এক শাখা। তবে শূদ্ররা প্রায় সর্বত্র আভীরীদের সঙ্গে একযোগে উল্লিখিত হয়েছেন, যে আভীরীরা একটি আর্য উপভাষাতে কথা বলতেন। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আভীরোক্তির উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণের যুগের বিভিন্ন সাহিত্য থেকে অনুমান করা যায় শূদ্ররা আর্যদের ভাষা বুঝতে পারতেন। সম্ভবত ভারতে শূদ্ররা আসেন খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের শেষদিকে। পরবর্তীকালে বৈদিক আর্যভাষীদের কাছে তারা পরাজিত হয়ে বর্ণে বিভক্ত বৈদিক সমাজের নিম্নতম অংশ হিসেবে আর্যভাষী সমাজে অন্তর্ভুক্ত হন। (দ্রষ্টব্য রামশরণ শর্মার ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’, পৃষ্ঠা–৩৭)
ডক্টর বি আর আম্বেদকর অবশ্য এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে দীর্ঘকাল ধরে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংঘাতের ফলে ক্ষত্রিয়দের অবনমিত করা হয় শূদ্রদের পর্যায়ে। এমনকি ব্রাহ্মণেরা তাঁদের প্রতিপক্ষদের উপনয়নের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেন। আম্বেদকর এক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত করেছেন মহাভারতের শান্তিপর্বে উল্লিখিত রাজা পৈজিবনের কাহিনী। সেখানে তাঁকে শূদ্ররাজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে ভারত জনগোষ্ঠীর প্রধান সুদাসের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ঋগ্বেদে উল্লিখিত দশরাজার যুদ্ধের এই বিখ্যাত নায়ক ছিলেন শূদ্র। (দ্রষ্টব্য আম্বেদকরের ‘হু ওয়্যার দ্য শূদ্রস’) রামশরণ শর্মা অবশ্য মনে করেছেন বিভিন্ন আর্য জনগোষ্ঠীর মতো সূর্য জনগোষ্ঠীর অনেকে সামরিক ভূমিকা পালন করতেন। মহাভারতে অম্বষ্ঠ, শিবি, সূরসেন ইত্যাদিদের সঙ্গে শূদ্র সেনাবাহিনীরও উল্লেখ আছে। (মহাভারত ৭/৬/৬) শূদ্ররা উৎসগতভাবে বৈদিক সমাজের ভেতরের মানুষই হোন বা বাইরের, রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই থেকেই যে ভারতীয় সমাজের ভেতরের বর্ণবাদের উদ্ভব ও তাদের নিম্নতম বর্ণে রূপান্তরিত হওয়া, সেকথা আমরা বলতে পারি।
ঋগ্বেদীয় সমাজে পরিচয়ভিত্তিক কোনও শূদ্র বর্গ ছিল না। এই সমাজ ছিল মুখ্যত পশুপালক ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক। বৈদিক সমাজের পুরোহিত ও সমরনায়কদের পক্ষে একারণেই নিজেদের সমাজের ভেতর থেকে এত বেশি সম্ভব উদ্বৃত্ত উৎপন্ন ও শ্রম আদায় সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না, যাতে কোনও অংশের অবস্থান্তর ঘটিয়ে দাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। অবৈদিক জনগোষ্ঠীদের থেকে যুদ্ধ ও লুন্ঠনের মধ্যে দিয়ে যা কিছু সম্পদ আদায় করা হতো, বৈদিক সমাজের জ্ঞাতিদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হতো। সমাজপতিরা যে অশ্ব, রথ এবং দাসদের অধিকারী হতেন, তা তাঁদের পদমর্যাদার সঙ্গে যুক্ত ছিল, সামাজিক শ্রেণির সঙ্গে নয়। পরবর্তী বৈদিক যুগে, খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী পর্বে, পশুপালন থেকে যখন চাষবাসের ও আধা যাযাবর বৃত্তির জায়গায় স্থায়ী বসতি স্থাপণের পর্ব এল, তখনই বৈদিক সমাজের ভেতরে সামাজিক শ্রেণি ভিত্তিক বর্ণ ব্যবস্থার আবির্ভাব হল।
বেদোত্তর কালে শূদ্র জাতিকে মূলত সেবক হিসেবেই দেখা যায়। কিন্তু ঋগ্বেদ পরবর্তী বৈদিক যুগে শূদ্রেরা যে স্বাধীনভাবে গো-ধনের অধিকারী ছিলেন, তেমন অনেক উল্লেখ আছে। মৈত্রয়ণী সংহিতাতে বলা হয়েছে (৪/২/৭ ও ৪/২/১০) শূদ্রদের গবাদি পশু ছিল এবং উচ্চবর্ণের লোকেরা যজ্ঞের জন্য সেগুলো নিয়ে যেতে পারতেন। পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে শূদ্ররা কোনও দেবতা বা যজ্ঞ ছাড়াই জন্মেছেন, কিন্তু তাঁদের অনেক পশু সম্পত্তি আছে (৬/১১/১১)। কিন্তু সম্পত্তি থাকলেও তাদের অধস্থন ভূমিকা ও অবমানিত অবস্থানটি বেশ স্পষ্ট। জৈমিনি ব্রাহ্মণে বলা হচ্ছে (১/৬৮) কোনওরকম দেবতা ছাড়াই শূদ্রদের উৎপত্তি হয়েছিল প্রজাপতির পা থেকে, তাই গৃহস্বামীই তাদের দেবতা ও তাঁর পা ধুয়েই তাঁদের জীবিকা অর্জন করতে হবে। শ্রৌতসূত্রে বলা হয়েছে (২৬/১-৭) উচ্চবর্ণের শুশ্রূষা করেই তাঁদের বাঁচতে হবে। জৈমিনি ব্রাহ্মণ আমাদের জানিয়েছে অশ্বমেধের মধ্যে দিয়ে বৈশ্যদের ধনী হয়ে ওঠার কথা।
শূদ্ররা প্রভুর জমিতে ভূমিদাস হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা প্রভুর খেতে কাজ করে দিতেন। তবে তার নিজের জন্যও একটুকরো জমি থাকত। যতদিন তিনি ভূস্বামীর জমিতে কাজ করে দিতেন, ততদিন তিনি সেই জমি রাখতে পারতেন। পরবর্তী বৈদিক যুগ পর্যন্ত করযোগ্য ছোট ভূমি সম্পত্তি শূদ্রদের ছিল কিন্তু বেদোত্তর কালে তারা করপ্রদান ও সম্পত্তির আওতার বাইরে চলে যান।
শূদ্রদের সেবক ভূমিকার পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্র শূদ্রদের শ্রমজীবী শক্তি হিসেবেও উল্লেখ করেছে। বাজসনেয়ি সংহিতা (৩০/৬/২১) ও তৈত্তরীয় ব্রাহ্মণে (৩/৪/২/১৭) নানারকম বৃত্তির উল্লেখ আছে, যেমন – রথকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, কর্মকার, মণিকার, পশুপালক, পশুচারক, শৌণ্ডিক, ধীবর ও ব্যাধ। কৃষিতে কাজের কথাও রয়েছে। মনে করা হতো শূদ্ররা হলেন কঠোর শ্রমের প্রতিভূ। নিষাদ, কিরাত, পর্ণক, পৌল্কস, বৈন্দ ইত্যাদি অবৈদিক অন আর্য মানবগোষ্ঠীর কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। বেদিক ইনডেক্স নামক বিখ্যাত আকরগ্রন্থ ইঙ্গিৎ করেছে যে শূদ্র গোত্রের মধ্যে এরাও অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন। হস্তশিল্পের সংখ্যা পরবর্তী বৈদিক যুগে অনেক বাড়ে কিন্তু বৈদিক সমাজের বিশ্-এর সদস্যরা সেইসব শ্রমসাধ্য কাজ যে আর করতেন না, তেমন ইঙ্গিৎ এখানে রয়েছে। সেই কাজ শূদ্ররা করতেন।
বর্ণ ব্যবস্থা থেকে জীবিকানির্ভর হাজারো বিভাজনভিত্তিক জটিল ভারতীয় জাত ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ আরো পরের ঘটনা, যে জাত ব্যবস্থার কাঠামো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে আবার অনেকখানি স্থানীয় পরিচিতি ও চরিত্র লাভ করল। সেই সংক্রান্ত কথাবার্তা এক পৃথক পর্যালোচনা দাবি করে। কিন্তু এই আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি ভারত ইতিহাসের প্রথম দিকে মেহেরগড় বা হরপ্পা সভ্যতার আমলে তো বটেই, এমনকি বৈদিক সভ্যতার প্রথম দিকে ঋক বৈদিক যুগেও বর্ণভেদের অস্তিত্ব ছিল না। তা ভারতীয় সংস্কৃতি ইতিহাসের কোনও মৌলিক দিকই নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিস্বার্থ ও বর্ণস্বার্থ জাতপাতের জন্ম দিয়েছে এবং তাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালন করেছে। আজকের ভারতের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এর মূলোচ্ছেদ না করে এগোতে পারবে না।
- সৌভিক ঘোষাল
১) বিজয় মালিয়া
২) মেহুল চক্সি
৩) নীরব মোদী
৪) নিসান মোদী
৫) পুস্পেস বৈদ্য
৬) আশীষ জবানপুত্রা
৭) সানি কালারা
৮) আরতি কালারা
৯) সঞ্জয় কালারা
১০) বর্ষা কালারা
১১) সুধীর কালারা
১২) যতীন মেহতা
১৩) উমেস পারেখ
১৪) কমলেশ পারেখ
১৫) বিনয় মিত্তল
১৫) নিলেস পারেখ
১৬) একলব্য গর্খ
১৮) চেতন জয়ন্তী লাল
১৯) নিতিন জয়ন্তী লাল
২০) দীপ্তি বেইন চেতন
২১) সাভিয়া শেঠ
২২) রাজিব গোয়েল
২৩) অলকা গোয়েল
২৪) ললিত মোদী
২৫) রীতেশ জৈন
২৬) হিতেশ নগেন্দ্রভাই প্যাটেল
২৭) ময়ূরীবেন প্যাটেল
২৮) আশীষ সুরেশভাই
এই ২৮ জন মিলে ব্যাঙ্ক লুঠ করেছে সর্বমোট ১০,০০০,০০০,০০০,০০০ টাকা। প্রায় দশ ট্রিলিয়ন টাকা। চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা। এই ২৮ জনের মধ্যে শুধুমাত্র বিজয় মালিয়া ছাড়া বাকি সবাই গুজরাটি। এদেরই লুঠ করা সম্পদে দেশ সর্বস্বান্ত। তখনই নজর পড়ল লাভজনক রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থার উপর, সবশুদ্ধু বেচে দেওয়ার জন্য। দিনের পর দিন পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। এই মুনাফালোভী কুচক্রী দেশের শত্রুদের লোকসান সামলাতে এলআইসি, বিএসএনএল, বিমান পরিবহণ, রেল ইত্যাদি সরকারি সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। উপরন্তু নজর পড়েছে দেশের কৃষিজমি ও কৃষিজাত পণ্যের দিকে, কর্পোরেট হস্তান্তর ঘটাতে। এই লুটেরার দল বিজেপি যদি বাংলা শাসনের দখল পায়, যদি আবার আসামের মসনদে ফিরে আসে তাহলে মহা সর্বনাশ হতে আর বাকী কিছু থাকবে না।
শস্যভান্ডার তুলে দেওয়া হচ্ছে আম্বানি, আদানি, কর্পোরেটের হতে। চাষির কাছ থেকে জলের দরে ফসল কিনে গুদামজাত করা হবে, বাজারে দাম বাড়িয়ে বেচা হবে। মোদী সরকারের তৈরি তিনটি কৃষি আইন পুরোদস্তুর কৃষি ও কৃষক বিরোধী।
তাই বিজেপি’কে একেবারেই ভোট দেওয়া নয়, বিজেপি’কে হারাও, হটাও আর বাংলাকে বাঁচাও হোক আজকের নির্বাচনী রণধ্বনি।
কমরেড হিমাংশু বিশ্বাস (৭১), পার্টিতে ‘রামু’ বলে পরিচিত ছিলেন। বাবা ছিলেন মোহিনী মিলের সূতাকল শ্রমিক, মা অনেক পরিশ্রম করে সংসার টেনে নিয়ে চলতেন। তিন ভাই ও তিন বোন, হিমাংশু ছিল সবার বড়। কৈশোরেই জীবিকার জন্য বেরিয়ে পড়তে হয়। এই অঞ্চলে তখন বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সহযোগী ছোট ছোট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ছিল। সেখানেই রামুর কাজ শেখা ও দক্ষ শ্রমিক হয়ে ওঠা। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও মাইক্রোমিটার, ভার্নিয়ার স্কেলের মাপ বুঝতেন এবং যে কোনো ড্রইং দেখে বস্তুটির আকৃতি লেদ মেশিনে অপারেট করে স্যাম্পল বানিয়ে দিতে পারতেন। এই শিল্পীয় দক্ষতার জন্যে ২০ বছর বাদে যখন আবার কর্মক্ষেত্রে ঢুকছেন, তখন কাজের নিরীখে সহজেই সেই প্রতিষ্ঠানের নির্ভরযোগ্য দক্ষ শ্রমিকের মর্যাদা পেয়েছেন। এরপর শিল্প পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে, কারখানার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকল এবং নিজের শরীরও আর টেনে নিয়ে চলতে পারছিলেন না। মজুরি অনিয়মিত হয়ে গেল, ধীরে ধীরে কাজে যাওয়া বন্ধ হল। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়েছে। যা এখনো চলছে। শ্রমিকদের সমস্যাগুলো নিয়ে শোনা ও বিচার করার মতো অবস্থা রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তরের ছিল না, এখনো নেই।
রামু ৭০ দশকে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিল। কিছুদিন জেল জীবন এবং পরে মুক্তি। আবার ৭৭ সালে পার্টির সাথে যোগাযোগ। এই সময় সিপিআই(এমএল) বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গেছে, নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নির্বাচন করা কমরেডদের কাছে কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল। নিজের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী পছন্দের গোষ্ঠীতে কমরেডরা শামিল হয়েছেন। বহু কাছের কমরেডের সাথে দূরত্বও তৈরি হয়েছে। এই সন্ধিক্ষণে হিমাংশু বিশ্বাস সিপিআই(এমএল) ‘২৮শে জুলাই কমিটি’র সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। বর্তমানে যা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নামে খ্যাত।
রামু তখন কারখানায় কাজ ও রাজনীতি করছে এবং তাদের বাড়ি পার্টির আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে। অনেক অভাব অনটন থাকা সত্বেও ওদের পরিবারের সবাই পার্টি কমরেডদের পছন্দ করতেন।
পার্টির ভিতর শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু হয়েছে, রামু প্রতিটি দস্তাবেজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন, মিটিংগুলোতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ঠিক সময় উপস্থিত হতেন। ১৯৭৮ সালে পার্টি শ্রমিকদের গ্রামে যাওয়ার জন্যে আহ্বান রাখে। পার্টির ডাকে সারা দিয়ে রামু কাজ, বাড়ি ঘর ছেড়ে গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে চলে গেলেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, নদীয়ায় সহ বিভিন্ন জেলায় পার্টি সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। এই পর্যায় স্থানীয় পার্টি কর্মী মায়া বিশ্বাসের সাথে প্রেম ও বিবাহ হয়। তারপর তাদের দু’টি কন্যা সন্তান জন্মায়। এই মেয়েরা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৯২ সালে পার্টির প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়। এই পর্যায়ে পার্টিতে বেশ কিছু সাংগঠনিক রদবদল হয়। হিমাংশু এবার উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সদস্য হয়ে বেলঘরিয়া পার্টি কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব সামলান। এই সময় তিনি পার্টি গঠন ও কামারহাটিতে ট্রেড ইউনিয়নের কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি সব সময় আন্দোলন, লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকতেন। রামু বরাবর’ই সাহসী ও একরোখা ছিলেন। পার্টির রাজনৈতিক লাইন তখন কতগুলো বাঁক অতিক্রম করছিল। সেই সময় সমগ্র পার্টি খোলস ছেড়ে গণআন্দোলনের নতুন রাস্তা ধরছে, এই সময় রামু নতুন চিন্তা এবং প্রয়োগে পিছিয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু পার্টির দেওয়া কাজ আন্তরিকতার সাথে করতেন। একটা সময় রাজ্য কমিটি রামুকে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ায় পরামর্শ দিল। অনেক বিতর্ক, দুঃখ ও অভিমানে পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নেন রামু। কঠোর উৎপাদন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুনরায় নিজে দক্ষ শ্রমিক হয়ে উঠলেন। এতোসবের পরেও কোনদিন পার্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। এটাই বোধহয় একজন শ্রমিকের পার্টি বোধ।
কমরেড হিমাংশু ১ এপ্রিল ২০২১ সাগর দত্ত হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রামুকে অন্তিম বিদায় জানাতে জেলা কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল সহ জেলা ও আঞ্চলিক কমিটির সদস্য এবং স্থানীয় পার্টি সদস্যবৃন্দ। কমরেড রামুকে আর মিছিল মিটিংয়ে দেখা যাবে না। কমরেড হিমাংশু বিশ্বাস (রামু) লাল সেলাম।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত