আর নয় অন্যায়! এই মুহূর্তে দেশে সব চেয়ে বড় অন্যায় কাদের ওপর হচ্ছে? আসামের ২০ লক্ষ মানুষের ওপর, যাদের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সব ভাষা, সব ধর্মের মানুষই আছেন এই বাদ পড়া ২০ লক্ষের মধ্যে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছেন বাঙালি, হিন্দু। ওদের আটক রাখার জন্য বিশাল বিশাল খোঁয়ার বানিয়েছে মোদি সরকার, সরকারী ভাষায় এই খোঁয়ারগুলির নাম “ডিটেনশন সেন্টার”। এই মুহূর্তে দেশে কাদের ওপর ওই একই সর্বনাশের খাঁড়া ঝুলছে? পশ্চিমবাংলার জনতার ওপর। এনআরসি-র খাঁড়া। রাজ্যে ক্ষমতায় এলে প্রথমেই এনআরসি শুরু করবে বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে বিজেপি। বারবার বিজেপি নেতারা বলছে, পশ্চিমবঙ্গে দুই কোটি পঁচিশ লক্ষের ওপর মানুষ নাকি অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু তারা কারা? আপনিও তো তাদের মধ্যে একজন হতে পারেন, আমিও হতে পারি। এনআরসি মানে – আপনি বা আমি যে অনুপ্রবেশকারী নই তা আমাদের প্রমাণ করতে হবে কাগজপত্র দেখিয়ে। ১৯৪৮ সালের আগে থেকেই আমার আপনার পরিবার যে বংশ পরম্পরায় এই পারে বসবাস করত তার সরকারী নথি হাজির করে আপনাকে আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি আমি অনুপ্রবেশকারী নই। বাংলার কোটি কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কারিগর সমাজ, আদিবাসী ও মহিলারা কোথায় পাবে এইসব কাগজপত্র? নাগরিকত্ব প্রমাণের ফাঁদে পড়তে যদি আমরা না চাই, খোঁয়ারে চালান হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক থেকে যদি আমরা বাঁচতে চাই তাহলে বিজেপির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে, আপনাকেও বলতে হবে “বিজেপি হারাও, বাংলা বাঁচাও”, বলতে হবে “বিজেপিকে একটিও ভোট নয়”।
দেশভাগের বলি হয়ে এই রাজ্যে একদা আসা উদ্বাস্তুদের বিপুল অংশ নমশুদ্র সমাজের। বাংলাকে ভাগ করার প্রধান চক্রী ছিল বিজেপির সেই সময়কার প্রতিনিধিরা। এখনও বিজেপি গর্বভরে বলে যে তারাই বাংলা ভাগ করেছিল। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে প্রায় একশ বছর ধরে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন চলার ফলে অখণ্ড বাংলার পূর্ব অংশের ‘চণ্ডাল’-রা নমশুদ্র জাতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বাংলাভাগ ছিল এই ক্রমবর্ধমান শুদ্র-ঐক্যের ওপর পরিকল্পিত আঘাত। হিন্দুত্ববাদী নেতাদের কুটিল ছক টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল নমশুদ্র সমাজের পায়ের তলার মাটি। সেই কুটিল ছকের সেকেণ্ড এপিসোড বিজেপি সামনে আনে ২০০৩ সালে। আইন বানিয়ে বলে দেয় যে ১৯৪৮ সালের পর আসা উদ্বাস্তুরা সকলেই “অনুপ্রবেশকারী”, আর তাদের সন্তানসন্ততি, নাতিপুতিরা সকলেই “বেআইনি অভিবাসী”। এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কী হতে পারে? ২০১৯ নির্বাচনে নাগরিকত্ব দেওয়ার টোপ দিয়ে মতুয়াদের ভোট কব্জা করেছিল। বিধানসভা নির্বাচনে এসে বিজেপি মতুয়াদের জন্য “শরণার্থি কল্যাণ প্রকল্প” গঠন করার কথা বলেছে। ২০০৩-এ বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বানালো, ২০১৯-এ এসে নাগরিকত্বর টোপ দিয়ে ভোট নিল, এখন বলছে “শরণার্থী” হিসেবে গণ্য করে আপাতত কিছু টাকাপয়সা সাহায্য দেবে। ধীরে ধীরে ডিটেনশন ক্যাম্পের দিকে নমশুদ্রদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে বিজেপি, আসামে যা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে। আসন্ন এই বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা বিজেপিকে সমস্ত ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেওয়া, বাংলার নির্বাচনে বিজেপিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা, বিজেপি যাতে আপনার বন্ধুবান্ধবদের একটিও ভোট না পায় তার জন্য সক্রিয় হওয়া।
বাংলায় এখনও এনআরসি হয়নি, তাতেই বাংলাভাষী মানেই সন্দেহজনক বাংলাদেশী “ঘুসপেটিয়া” হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে প্রতিটি বিজেপি শাসিত রাজ্যে। বিভিন্ন শহরে কর্মরত লক্ষ লক্ষ বাঙালী কারিগর ও তাঁদের পরিবার আজ বিজেপি সরকারগুলির পুলিশ প্রশাসন ও আরএসএস বাহিনীর দ্বারা নির্মম হামলার শিকার। বাংলার কারিগরদের কাজ করতে যাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার বাঁচাতে চাইলে বিজেপিকে না সরিয়ে উপায় নাই। বাংলার কারিগর সমাজের কেউ বিজেপিকে একটিও ভোট দেবেন না। পরিযায়ি শ্রমিক হিসেবে আপনারা নিশ্চয় ভুলে যাননি হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া লকডাউন আর সেই লকডাউনের দিনগুলিতে আপনাদের সাথে বিজেপি সরকারের নির্মম আচরণ।
আপনি কি আপনার মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে স্বাধীন মানুষ করতে চান? তাহলে আপনি বিজেপিকে ভোট দেবেন না। বিজেপি নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। ঘরের কাজেই মেয়েদের ঘরে বন্দী থাকা ও বাচ্চা বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ওকালতি করে বিজেপি নেতারা। কোনও মেয়েই বিজেপিকে ভোট দেবে না, কারণ এদেশে বিজেপি একমাত্র দল যারা সরাসরি ধর্ষকের পক্ষে মিছিল করে এবং যাদের এমএলএ-এমপিদের ৫৫ শতাংশের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ আছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কে এবং বাংলার মেয়েদের সম্পর্কে এরাজ্যের বিজেপি নেতাদের কুৎসিত মন্তব্য সকলেই শুনেছেন। বিজেপিকে একটিও ভোট নয়।
বাংলার মননজগৎ প্রেম প্রীতি ভালোবাসার রসে স্নিগ্ধশুদ্ধ হয়েছিল শ্রী চৈতন্যের ভাবান্দোলনে। জাত-ধর্ম-বর্ণ এমনকি লিঙ্গভেদ নস্যাৎ করে দেওয়া প্রেমে গৌর-নিতাই বাংলার মানুষের বড় প্রিয়। সমস্ত গণ্ডি ভেঙ্গে ভালোবাসার যুগলমূর্তী রাধাকৃষ্ণ বাঙ্গালির হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। রাজস্থানের মীরা বাইও তাই সহজেই বাংলার আপনজন হয়ে যায়। লালন ফকির হোক বা ভবা পাগলা – এই ভালোবাসারই আরাধনা করেছেন গানে গানে। বাঙ্গালির মননজগতের এই সৃষ্টিশীল আবাদভূমিকে ধ্বংস করতে এসেছে বিজেপি। “লাভ জিহাদ”-এর ধূয়ো তুলে ওরা আমাদের সাথি নির্বাচনের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারটাও কেড়ে নিতে চায়। বিজেপিকে তাই একটিও ভোট নয়।
মোদি ক্ষমতায় আসার পর যত মানুষ কাজ হারিয়েছে, যত মানুষ চরম দারিদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তা আগে কখনও হয়নি। সমীক্ষা বলছে শুধুমাত্র গত বছরে মধ্যবিত্ত অংশের অন্তত ৩ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে গেছে। গত পাঁচ দশকের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে গেছে বিজেপি সরকারের আমলে এসে। “সোনার আসাম” গড়ব বলে ক্ষমতায় এসে গত পাঁচ বছরে আসামে ৩ লক্ষ সরকারী পদ হাপিস করে দিয়েছে, কাজ হারিয়েছে ৫ লক্ষের বেশি মানুষ; কাগজকল, চা বাগান, তেলের কূপ বন্ধ অথবা বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কাজ কেড়ে নিয়েছে। ত্রিপুরায় সরকারী চাকরিই তুলে দেবে বলে নোটিশ জারি করেছে। আপনি যদি শিক্ষিত কর্মপ্রত্যাশী হন তাহলে আর যাকেই হোক বিজেপিকে ভোট দিতে পারেন না।
এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে গ্রামীণ পরিকাঠামো খাতে মোদি সরকার এক টাকাও দেয়নি, খাদ্য সুরক্ষা খাত থেকে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি টাকা কেটে নিয়েছে, খাদ্য সামগ্রিতে দেওয়া ভর্তুকি থেকে ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা কেটে নিয়েছে, নতুন কর্মসংস্থান খাতে ৩৫% কাটতি করেছে, শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য রাখা টাকা ৩.৪ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে, মেয়েদের শিক্ষার খাতে রাখা টাকা কেটে নিয়েছে, মাতৃত্ব খাতে টাকা কমিয়েছে আর মিড-ডে-মিল খাতে ১,৪০০ কোটি টাকা কম করে দিয়েছে। এদিকে এরাজ্যের নির্বাচনে এই ফাণ্ডে এত হাজার কোটি ওই ফাণ্ডে অত হাজার কোটি টাকার গল্প দিচ্ছে বিজেপি। সবার একাউন্টে ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার জুমলা তো কেউ ভোলেননি, এই জুমলাবাজদের কে ভোট দেবে?
ব্যাঙ্ক বীমা রেল জল খনি আকাশ জঙ্গল সবই বেচে দিয়ে কোম্পানিরাজ কায়েম করছে বিজেপি। শ্রমিকের এতদিনের অর্জন কেড়ে নিতে শ্রম কোড এনেছে। যত ঘণ্টা খুশি কাজ করাতে পারবে, যখন খুশি তাড়িয়ে দিতে পারবে মালিক। কর্মরত মানুষের সিংহভাগই তো এখন অসংঠিত শ্রমিক, ক্যাজুয়াল। মালিক ও তার ফড়েদের দাপটে নিত্য অপমানে ঘার গুঁজে কাজ করে যেতে হয় শুধু সপরিবারে বেঁচে থাকার জৈবিক দায়ে। কোথায় সরকার দেশের শ্রমজীহী জনতার সম্মানজনক কাজের পরিবেশ তৈরি করবে তা না, আইন এনে মালিকপক্ষকে ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের মতো ক্ষমতা দিচ্ছে, সাধারণ মানুষকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ দাসে পর্যবসিত করছে। তদুপরি যদি পশ্চাতে সর্বক্ষণ নাগরিকত্ব প্রমাণের চাবুক পড়তে থাকে তাহলে আমরা যাই কোথা! ঘুরে দাঁড়িয়ে এই বিপর্যয়কর বিজেপি শাসনকে খতম করা ছাড়া আর কোন পথ
খোলা থাকে?
কৃষকদের সাথে কত বড়ো অন্যায় করছে দেখুন। কর্পোরেট-দাসে পরিণত করতে চাইছে কৃষকদেরও। শুধু কৃষকের বিষয়ও নয়, আমাদের দেশের সমগ্র খাদ্য উৎপাদনকেই আদানি আম্বানিদের কব্জায় তুলে দিতে নতুন কৃষি আইনগুলি এনেছে বিজেপি। আদানিরা কয়েক বছর আগে থেকেই বিশাল বিশাল গোলা বানিয়ে রেখেছে। একেকটা গোলায় কয়েক হাজার টন শস্য স্টোর করে রাখা যায়। এই আধুনিক গোলা/মড়াইগুলিকে বলে ‘সাইলো’। শস্য বস্তাবন্দি না করেই সাইলোতে রেখে দেওয়া যায়। আদানিরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম সাইলো-গুচ্ছ বানিয়ে রেখেছে। ভেবে দেখুন ছোটখাটো আড়তের মজুদদারদের দাপটেই দ্রব্যমূল্য লাফালাফি করে কোথায় পৌঁছেছে। এখন বিজেপির আইন আদানি আম্বানির মতো সুপার আড়ৎদারদের হাতে দেশের সমস্ত কৃষি উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিচ্ছে। ভেবে দেখুন, দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষকে কোন আকালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিজেপি। রুখে দাঁড়ান, এবং সকলকে বলুন, বিজেপিকে একটিও ভোট নয়।
বাংলা ভাষাকেও ওরা ধ্বংস করে দিতে চায়। হিন্দি চাপিয়ে দিতে চায় আমাদের ওপর। তথাকথিত হিন্দিভাষী যে মানুষেরা বাংলায় আছেন তাঁদেরও মাতৃভাষা হয়তো মৈথিলি, ভোজপুরি বা অওধি, এবং এই ভাষাগুলিও হিন্দি আগ্রাসনে লুপ্তপ্রায়, ওইসব ভাষা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে। বাংলা বরাবর বহু ভাষা, নানা মতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির জায়গা। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানির স্টিম রোলার চালিয়ে বাংলাকে লুট করতে আসছে নব্য বর্গিরা। মাতৃভাষার প্রতি আপনার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকলে আপনি বিজেপিকে ভোট দিতে পারবেন না।
এসসি-এসটি-ওবিসিদের সংরক্ষণের অধিকার নাকচ করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি। নয়া শিক্ষানীতি একদিকে যেমন সমস্ত সাধারণ পরিবারের জন্যই শিক্ষাকে দুর্মূল্য পণ্যে পরিণত করবে, অন্যদিকে তেমনই এসএসি-এসটি-ওবিসিদের সংরক্ষণের সুযোগকেও সম্পূর্ণ অকেজো করে দেবে। হরিয়ানায় সমস্ত সরকারী স্কুলই তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানকার বিজেপি সরকার। ব্রাহ্মণ্য শাসনের যুগে শিক্ষা যেমন অব্রাহ্মণদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল তেমনই ব্যবস্থা ঘুরপথে আবার কায়েম হতে চলেছে। এসসি-এসটিদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে আইন ছিল তাকেও লঘু করে দিয়েছে বিজেপি। আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার নাকচ করতে একের পর এক সার্কুলার এনেছে। আদিবাসীদের ধর্মপরিচিতিকেও জনগণনায় নথিভুক্ত করতে দিতে নারাজ বিজেপি-আরএসএস। বিজেপি শাসন ভারতে সামাজিক বিপর্যয় তৈরি করছে। বিজেপিকে একটিও ভোট নয়।
সংবিধানের অন্তর্বস্তু — ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও বিবিধতা — যারা রক্ষা করতে চান, যারা সামাজিক ন্যায়ে বিশ্বাস করেন, আদিবাসীদের জমি, ভাষা ও সংস্কৃতির সুরক্ষা যারা চান, বিদ্যাসাগর-হরিচাঁদ-মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-রোকেয়া-রঘুনাথ মুর্মু-নেতাজী সুভাষের মতো বহু মনীষিদের অবদানে অর্জিত প্রগতিশীল ও উদার মৈত্রীর সংস্কৃতিকে যারা রক্ষা করতে চান, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ দেশ যারা গড়তে চান তাঁরা আর যাই করুন বিজেপিকে একটিও ভোট দেবেন না।
শুরু হতে চলেছে দু’মাস ব্যাপী আট দফায় রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। এক কথায় দীর্ঘতম নির্বাচন প্রক্রিয়া। স্বাধীনতার পরে এমন দুর্যোগপূর্ণ নির্বাচনের পরিস্থিতি বোধহয় আর আসেনি। সরকার পরিবর্তনের আভাস থাকা নির্বাচনের কতিপয় নজির এ রাজ্যের ইতিহাসে আছে। যেমন, ১৯৬৭, ১৯৭৭ ও ২০১১-র নির্বাচন; যে নির্বাচনগুলোতে ফলাফল প্রকাশের আগে থাকতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল মানুষ কি চাইছে, গণরায় কি হতে যাচ্ছে। বিপরীতে, ১৯৭২-এর নির্বাচনেও পরিণাম প্রকট ভাবে উন্মোচিত হয়েছিল ফলাফল প্রকাশের অনেক আগে থাকতেই, যদিও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তা চায়নি। তেমনি এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার দখল নিতে আগ্রাসী হয়েছে এমন এক রাজনৈতিক দল যাকে সুগভীর বিবেচনাবোধে কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। হ্যাঁ, বিজেপি হচ্ছে সেই শক্তি যার পেছনে রয়েছে আরএসএস, যার জনমোহিনী মায়া বিস্তারের জন্য গুচ্ছ গুচ্ছ বিজ্ঞাপনী প্রতিশ্রুতি থাকতে পারে, কিন্তু তার অবলম্বন হল বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি, চূড়ান্ত লক্ষ্য হল কর্পোরেট রাজ ও হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করা। বিজেপি বলছে, পশ্চিমবাংলার মানুষজন একবার সুযোগ দিক, পাঁচবছরে ‘সোনার বাংলা’ বানিয়ে দেবে। বিপরীতে বুঝতে হবে, মানুষকে বোকা বানানোর সুযোগ ওদের দেওয়া যায় না।
১৯৯১ সালে কেন্দ্রের নরসীমা রাও সরকারের আমলে নয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের সময় আদবানি বলেছিলেন, আমাদের পছন্দের নয়া উদারবাদী নীতি কংগ্রেস চালু করে দিল। তারপর গত তিন দশকে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে একাধিক রাজ্যে। তার প্রতিটি শাসিত রাজ্যকে কেমন ‘সোনা’য় মুড়ে দিয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না। সর্বোপরি, সাত বছর চলছে কেন্দ্রে মোদী শাসনের দুর্ভোগ। সরকারী দায়-দায়িত্ব সব ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। রাজস্বের সিংহভাগ কেন্দ্রের কব্জায়, অথচ তার বিনিয়োগের ব্যাপারে ক্রমশ হাত গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে, নয়ত আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে মিথ্যাচারের। গোটা অর্থনীতিতে এখন কর্পোরেট ক্ষমতার দাপট। ক্রমশ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-কর্মসংস্থানের অধিকার এবং তার সাথে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। একদিকে ক্ষুধার বিশ্বসূচকে ভারতের স্থান নেমেই চলেছে, অন্যদিকে অতিমারী পরিস্থিতিতেও ধনকুবের বৃদ্ধির হারে বিশ্বকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ভারত। প্রশ্ন হল, এহেন উৎকট ‘উন্নয়ন’-এ জনস্বার্থের স্থান কোথায়? সবই তো কর্পোরেট সর্বস্ব। তাহলে, এই পরিণতির জন্য দায়ি যে বিজেপি তাদের আবার বাংলার দখল পেতে সুযোগ দেওয়া হবে কেন?
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার বনিয়াদ ধূলিসাৎ করার সূচনা করেছিল বিজেপি। এই অপরাধকে খোলাখুলি মদত জুগিয়েছিল বিজেপির তদানীন্তন উত্তরপ্রদেশ সরকার। তারপর থেকে তার রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখল, কেন্দ্র দখলের জোরে তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে একদিকে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী রাজনৈতিক-সামাজিক সন্ত্রাস-হিংসা; অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। গুজরাটে এই শতকের গোড়ায় মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছিল দু’সহস্রাধিক সংখ্যালঘু জনতার গণহত্যার পথ বেয়ে। টানা বিজেপি শাসিত গুজরাটে মুসলিম ও দলিতদের দিন কাটে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। উত্তরপ্রদেশের যোগীরাজ সরকার হল এক কথায় সব দিক থেকে সবচেয়ে নৃশংসতার নজির। যে রাজ্যে মুসলিম-দলিত ও নারী সমাজের কোন স্বাধীনতা কার্যত স্বীকার করা হয় না, চালু হচ্ছে একের পর এক ফতোয়ার ‘অনুশাসন’। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি শাসন কলঙ্কিত হয় একবার মেডিক্যাল কলেজে দুর্নীতিতে, এমনকি তার সমস্ত সাক্ষী লোপাটে কাশ্মীর-কায়দায় গণ নিখোঁজ (গুম) করণের অভিযান চালিয়ে; পরের বার কংগ্রেসী বিধায়ক ভাঙিয়ে ক্ষমতা দখল করে। আসামে আবার এসেছে নির্বাচন, বিগত বিজেপি শাসন এনআরসি-র নামে ঊনিশ লক্ষাধিক নাগরিককে বেনাগরিক করে ফেলে রেখেছে বন্দীশিবিরে। ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার উঠিয়ে দিচ্ছে সরকারী চাকরি, পেনশন। আর, কেন্দ্রের মোদী শাসন তো সর্দারিতে ‘সেরার সেরা’। শ্রমিক-কৃষক বিরোধী, পরিযায়ী শ্রমিক বিমুখ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিমুখ, গণতন্ত্র ও সংবিধান বিরোধী নানা কৃতকর্মের অপরাধে অপরাধী।
এতকিছু দেখার পর ঠেকে শেখার কোনো মানে হয় না। মতাদর্শ ও রাজনীতির বিচারে প্রধান এই আগ্রাসী প্রতিপক্ষকে কোনোভাবেই গৌণ বা লঘু করে দেখার দুর্বলতা দেখানো যায় না। সেটা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা, কান্ডজ্ঞান লোপ পাওয়ার মতই। শাসকশ্রেণীর বাকি কোনও অংশের সঙ্গে বিজেপির কোনো তুলনা হয় না। কোনও শাসনের বিকল্প ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে হতে দেওয়া যায় না। বরং বাংলার নির্বাচনে বিজেপিকে রুখে দিতে হবে। তার মধ্য দিয়ে বাকি ভারতেও এক নতুন বার্তা দেওয়া যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও গণতন্ত্রের ওপর নামানো তাদের সাম্প্রতিকতম হামলায় মোদী সরকার লোকসভায় একটা বিল পেশ করেছে। ঐ বিলের উদ্দেশ্য হল দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাকে চূড়ান্ত মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত করা এবং সমস্ত কার্যকরী ক্ষমতাকে দিল্লীর লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের হাতে সমর্পিত করা। দিল্লীর জাতীয় রাজধানী অঞ্চল সরকার (সংশোধনী) বিল ২০২১ “সরকারকে” সংজ্ঞায়িত করেছে দিল্লীর লেফটেন্যান্ট গভর্ণর রূপে, এবং বিলে বলা হয়েছে, রাজ্য আইনসভা যে সমস্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেবে ও আইন প্রণয়ন করবে তার জন্য লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের অনুমোদন প্রয়োজন। এই বিল দিল্লীর নির্বাচিত সরকারকে এক তুচ্ছ সত্তায় পরিণত করতে চায় এবং সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করতে চায় লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের হাতে যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। এই বিলটা তাই সংবিধান নির্দেশিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আক্রমণ মাত্র নয়, তা নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক নীতির ওপর হামলা।
সুপ্রিম কোর্টের ২০১৮ ও ২০১৯ সালের রায়কে নাকচ করার উদ্দেশ্যেই বিলটি আনা হয়েছে বলে মনে হয়। ঐ দুই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রিত করে বলেছিল যে, তিনি পুলিশ, আইন ও শৃঙ্খলা এবং জমির এক্তিয়ারের বাইরে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কংগ্ৰেস ও বিজেপি উভয়েই দিল্লীকে পরিপূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল — যদিও কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকার সময় কোনো দলই তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। প্রধানমন্ত্রী মুখে “সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার” উপদেশ দিতে পারেন — কিন্তু তিনি দিল্লীকে পরিপূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে যেমন নারাজ, তেমনই এই যুক্তিতে দিল্লীর নির্বাচকমণ্ডলীর ইচ্ছাকে খারিজ করতে চান যে, তারা এর আগে পরপর দুটো বিধানসভা নির্বাচনেই বিজেপিকে পরাস্ত করার পথে গিয়েছিল।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫ চাপিয়ে দিতে চাইলে স্বাধীনতা আন্দোলন সফলভাবে তাদের সেই প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করেছিল, কেননা, ঐ আইন গভর্ণর জেনারেল ও ভাইসরয়-এর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার কথা বলেছিল। মোদী সরকার আরো একবার ব্রিটিশ সরকারের মতোই আচরণ করছে, শুধু নির্বাচিত আইনসভার ওপর ভাইসরয়-এর স্থানে গভর্ণরকে বসানোর কথা বলছে।
দিল্লী বিলই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর মোদী সরকারের আক্রমণের একমাত্র নজির নয়। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নজিরের মধ্যে রয়েছে জিএসটি আইন; যে সমস্ত রাজ্যে ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে বিরোধী দলগুলোর সরকার রয়েছে, সেগুলোর পতন ঘটাতে রাজ্যপাল পদটির অপব্যবহারের চেষ্টা; পশ্চিম বাংলার মতো রাজ্যে রাজ্যপালের কার্যত বিরোধী দলের নেতার মতো আচরণ করা, নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে হেয় করার কোনো সুযোগকেই হাতছাড়া না করা; কলকাতা পুলিশ কমিশনারের অফিসে সিবিআই-এর হানাদারি চালানো; পাঞ্জাবের রাজ্য আইনসভা তিনটে কর্পোরেটপন্থী কৃষি আইনের বিরোধিতা করলে পাঞ্জাবে মালগাড়ি যাওয়া বন্ধ করা; এবং দিল্লী পুলিশের কর্ণাটক গিয়ে দিশা রবিকে আটক করে কর্ণাটকের পুলিশ ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে তাকে কর্ণাটক থেকে দিল্লী নিয়ে আসা, তাদের সম্মতি নেওয়ার কথা না হয় ছেড়ে দেওয়াই হল।
যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর মোদী সরকারের প্রথম দিককার আক্রমণের একটা প্রকট নজির ছিল ৩৭০ ধারাকে বাতিল করা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা হরণ করে তাকে একাধিক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভাগ করার পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, সংবিধান অনুসারে ৩৭০ ধারা বাতিলের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান সভার সম্মতির প্রয়োজন ছিল। একটু বাড়িয়ে বলে এই যুক্তিও দেওয়া যেত যে, জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত বিধানসভাই হল সংবিধান সভা। কিন্তু ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভাকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং রাজ্যে কোন নির্বাচিত সরকার ছিল না। মোদী সরকার ঘোষণা করল, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি রাজ্যপালই জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং ৩৭০ ধারা বিলোপের জন্য তাঁর সম্মতিই কেন্দ্রের কাছে যথেষ্ট। রাজ্যের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারগুলোর ভিত্তিতে তারা ক্ষমতা ভোগ করতে বা ভোগ করার আশা করতে পারে, সেগুলোকেই আপ, টিডিপি, বিএসপি, এআইডিএমকে, বিজেডি এবং ওয়াইএসআর কংগ্ৰেস-এর মতো দলগুলো প্রাণপণে সমর্থন করে; এরাই কিন্তু মোদী সরকারের অসাংবিধানিক, গণতন্ত্র-বিরোধী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তা-বিরোধী ৩৭০ ধারা বিলোপের পদক্ষেপকে উৎসাহিত করেছিল। গুরুত্বপূর্ণ এই আঞ্চলিক দলগুলোর যোগানো বৈধতাকে ঢাল করে ৩৭০ ধারা বাতিলের পদক্ষেপ বিজেপির যুক্তরাষ্ট্রীয় বিরোধী তাড়নাকে উদ্দীপিত করে এবং আজ আমরা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর একের পর এক যে আক্রমণগুলো দেখতে পাচ্ছি তার পথ প্রশস্ত করে।
দিল্লী বিল যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বিমূর্ত কোনো তাত্ত্বিক বিতর্কের বিষয় নয়। এই বিল দিল্লীর নির্বাচকমণ্ডলীর অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত হানছে। এই বিল সুনিশ্চিত ভাবেই জানান দিচ্ছে যে, কোনো রাজ্যের ভোটাররা অ-বিজেপি সরকার নির্বাচিত করার স্পর্ধা দেখালে তাদের শাস্তি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগে তারা দ্বিধা দেখাবে না। এই ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ কি আছে যে, ভোটারদের নিয়ন্ত্রিত করতে ও শাস্তি দিতেও বিজেপি এনআরসি-এনপিআর-সিএএ-র মতো আইনগুচ্ছকে ব্যবহার করতে চায়, এবং তা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ব্যবহার করে শাসক বিজেপির দৃষ্টিতে তাদের স্বার্থের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন ভোটারদের ভোটাধিকার হরণ করা এবং ভোটারদের সম্পর্কে “সন্দেহ” জাগিয়ে তোলার মধ্যে দিয়ে?
আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি, মোদী-শাহর শাসনাধীনে বিজেপি কিভাবে সরকারের বিরোধিতাকারী ও প্রতিবাদী প্রতিটি নাগরিকের পিছনে ছুটে তাদের “দেশদ্রোহী” বলে ছাপ মেরে জেলে পুরছে, তা তারা ছাত্র, লেখক, কৃষক, সাংবাদিক যাই হোন না কেন। বিজেপি এখন আবার তার রাজনৈতিক স্বার্থকে জাতির রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে একাকার করে তুলে গোটা নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাকেই খর্ব করছে। শাসক শ্রেণীর বিরোধী দলগুলো গণতন্ত্রের রক্ষায় অদৃঢ় হতে পারে —তাদের নিজেদের সরকার বিপন্ন হলে তারা প্রতিবাদ করে, কিন্তু দানবীয় ও সংবিধান-বিরোধী আইনগুলোর ক্ষেত্রে, বেআইনি গ্ৰেপ্তারি এবং সংবিধানের ধারাগুলি স্বেচ্ছাচারীভাবে বাতিল করার ক্ষেত্রে তারা মুখ বুজে থাকে। ভারতের জনগণকে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক নীতিমালাকে প্রতিটি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। দিল্লীর যুক্তরাষ্ট্রীয়তা রক্ষার আন্দোলন ভারতে গণতান্ত্রিক অধিকারের সমগ্ৰ বিন্যাসের রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলে তবেই তা ফলদায়ী হতে পারে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬ মার্চ ২০২১)
সিপিআই(এম)-এর সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’র(পিডি) ১৪ মার্চ ২০২১ সংখ্যায় একটি রাজনৈতিক ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে যেখানে সিপিআই(এমএল)-কে পশ্চিমবঙ্গে “ভুল দিকে” যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর ১১মার্চ ২০২১ তারিখের অনলাইন বৈঠকের সিদ্ধান্ত ‘পিবি বিজ্ঞপ্তি’ হিসেবে পত্রিকাটির ওই একই সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে। কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, আসাম ও পুদুচেরির আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন প্রসঙ্গে এই ‘পিবি বিজ্ঞপ্তি’-তে বলা হয়েছে, ‘সিপিআইএম মূলত বিজেপিকে হারানোর কাজেই উদ্যম কেন্দ্রীভূত করবে’। তাহলে কেন এবং কীভাবে সিপিআই(এম) মনে করছে যে সিপিআই(এমএল) পশ্চিমবঙ্গে ‘ভুল দিকে’ যাচ্ছে?
এই নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) কী অবস্থান নিয়েছে তা প্রথমে পাঠক-পাঠিকাদের অবগত করা দরকার। কেরালা ও ত্রিপুরাতে সিপিআই(এমএল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না, কেরালায় এলডিএফ-কে এবং ত্রিপুরা স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে বামফ্রন্টকে সমর্থন করছে। তামিলনাড়ু ও পুদুচেরিতে অল্প কয়েকটি আসনে (যথাক্রমে ১২ ও ১) সিপিআই(এমএল) স্বাধীনভাবে লড়ছে এবং বাকি আসনগুলিতে বিজেপি ও তার শরিকদের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া মূল জোটকে সমর্থন দিচ্ছে। আসামে সিপিআই(এমএল) ও সিপিআই(এম) একই বিরোধী জোটের অংশীদার (অবশ্য কার্বি আংলং জেলায় কংগ্রেস আসন সমঝোতা থেকে পিছিয়ে আসায় সিপিআই(এমএল) এই পাহাড়ি জেলায় স্বাধীনভাবেই লড়বে)।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল) ১২টি আসনে স্বাধীনভাবে লড়ছে। কেউ যদি মনে করেন যে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল) সিপিআই(এম)-এর সাথে জোট ভেঙ্গে দিল তাহলে আমরা তাঁদের স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখতে চাই যে বাংলায় কোনোদিনই সিপিআই(এমএল) ‘বামফ্রন্ট’-এর অংশীদার ছিল না এবং সিপিআই(এম)-এর সাথে কোনও দিনই কোনও নির্বাচনী বোঝাপড়া হয়নি, যদিও অনেক নির্বাচনেই সিপিআই(এমএল) বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছে, বিশেষত ২০১১ সালের পর থেকে যখন বামফ্রন্ট আর ক্ষমতায় নেই। যে ১২টি আসনে সিপিআই(এমএল) লড়ছে তার বাইরে সেই সমস্ত আসনেই আমরা বামফ্রন্ট প্রার্থীদের খোলাখুলি সমর্থন দিয়েছি যেগুলোতে বামফ্রন্ট ২০১৬’র নির্বাচনে জিতেছে কিন্তু দলত্যাগ করে টিএমসি বা বিজেপিতে চলে যায়নি (বামফ্রন্টের বিজয়ী ৩২ জনের মধ্যে ৮ জন এরকম দলত্যাগ করেছেন)। আমাদের এই অবস্থানে তো সিপিএমের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়!
এর বাইরে বাকি আসনগুলিতে সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থান নিয়ে তাহলে তাদের সমস্যা। এই আসনগুলিতে দল বা প্রার্থী নির্দিষ্ট না করে বিজেপিকে পরাজিত করতে সক্ষমতম বা সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অবিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিতে আবেদন জানিয়েছে সিপিআই(এমএল)। অবাক কাণ্ড হলো, পিডি ভাষ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে এই অবস্থান “ইঙ্গিত করছে” যে “২০০’র বেশি আসনে তাদের (সিপিআইএমএলের) সমর্থন টিএমসি-র দিকে”। এরকম ব্যাখ্যার অর্থ কী? এর অর্থ কি এই যে, সিপিএমের নিজস্ব হিসেবে ২০০-র বেশি আসনে মূল লড়াইটা বিজেপি আর টিএমসির মধ্যেই? সবশেষে পিডি ভাষ্য উপসংহার টেনেছে: “এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে সিপিআই(এমএল) আশ্চর্যজনকভাবে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ে টিএমসি-কে বেটার বিজেপি-বিরোধী শক্তি মনে করছে”।
সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থান থেকে এমন আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্তে কীভাবে পৌঁছনো সম্ভব! বামফ্রন্ট বা বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও নবগঠিত ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (যারা এখন শোনা যাচ্ছে এক অন্য পার্টির নামে প্রার্থী দিচ্ছে) বৃহত্তর নির্বাচনী জোটে না থাকা সত্বেও সিপিআই(এমএল) অন্তত দুই ডজন আসনে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থন করছে, কিন্তু সিপিআই(এম) তো তার বিনিময়ে একটি আসনেও সিপিআই(এমএল)-কে সমর্থন দেয়নি। বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে কংগ্রেস বা আইএসএফ-কে সিপিআই(এমএল)-এর থেকে ‘বেটার’ ফোর্স সিপিএম মনে করে কি না সে প্রশ্নও তাহলে উঠতে পারে। পশ্চিমবাংলায় বিজেপির ক্ষমতায় আসার বাস্তব বিপদ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন শক্তিগুলির সিংহভাগের কাছে নির্বাচনী সংগ্রামে কার কতটা সাধ্য রয়েছে তা মূল প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। একদিকে বেশ কিছু বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে টিএমসি-কে সমর্থন দিয়েছে, অন্যদিকে বিজেপিকে বাদ দিয়ে কাকে ভোট দিতে হবে তা “নো-ভোট-টু-বিজেপি” অভিযান ও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার বিজেপি-বিরোধী প্রচারাভিযান নির্বাচকমণ্ডলীর বিবেচনা ও পছন্দের ওপর ছেড়ে রেখেছে।
ভারতীয় গণতন্ত্রের এই সঙ্কটকালে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর কৌশলগত লাইন ও রাজনৈতিক ভূমিকার নিদারুণ সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতাকে সিপিআই(এমএল) প্রশ্নবিদ্ধ ও উন্মোচিত করেছে – এটাই বোধকরি সিপিআই(এম)-এর আসল মাথাব্যাথার জায়গা। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে সংঘ-বিজেপির ফ্যাসিস্ট হামলা কী মাত্রায় বেড়ে যাবে তা অনুধাবন করা তো তেমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় (এখানে এটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভালো যে আমরা এই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে কখনই ফ্যাসিস্ট শব্দটিকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখছি না, পিডি ভাষ্যটিতে বারবার যেরকম করা হয়েছে, কেন করেছেন তা লেখক বা সম্পাদকই ভালো বলতে পারবেন)। মাত্র এক দশক আগেও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকা একটি দল, ইতিহাসের গতিতে রাজ্যে স্বাধীনতাপূর্বকাল থেকে দশকের পর দশক ধরে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট গণভিত্তি ও প্রভাবের সবচেয়ে বড়ো ধারক সিপিআই(এম)-এর মতো একটি দল রাজ্যে বিজেপির এই বিপজ্জনক বৃদ্ধির ব্যাখ্যা কেবলমাত্র টিএমসি-র ঘাড়ে দায় চাপিয়েই সেরে ফেলতে পারে না। টিএমসি-র ক্ষমতায় থাকাকেই যদি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের একমাত্র কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে একই যুক্তিতে ত্রিপুরায় বিজেপির উত্থানের জন্য তো সিপিআই(এম)-কেই দায়ী করতে হয়।
পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি-র রাজত্ব নিশ্চিতভাবেই একদিকে সন্ত্রাস, হিংসা ও দুর্নীতি আর অন্যদিকে পপুলিস্ট শ্লোগান ও কল্যাণমূলক বিভিন্ন প্রকল্পের মিশ্রণ। সিপিআই(এম)-এর কর্মী-সমর্থক এমনকি বিধায়কদেরও বিজেপিতে যোগদানের পরিঘটনাকে প্রথমে দেখা হয়েছিল টিএমসি-র সন্ত্রাসের ফল হিসেবে – টিএমসির বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর প্রতিরোধ খাড়া করার অবস্থায় সিপিআই(এম) আছে বলে যেহেতু কেউ মনে করছিল না তাই বাম সমর্থকরা বিজেপিতে যাচ্ছে এমনটাই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৬র পর থেকে সিপিআই(এম)-এর ক্ষয় বিপজ্জনক মাত্রায় বৃদ্ধি পায় এবং ২০১৯-এর নির্বাচনে এসে মাত্র একজন সিপিআই(এম) প্রার্থীরই জামানত রক্ষা পায়, আর সিপিআই(এম)-এর ভোট শতাংশ নেমে আসে এক অঙ্কে (৭%)। ত্রিপুরার অভিজ্ঞতা অন্তত পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম)-কে শিক্ষা দিতে পারত। কিন্তু না। দলের এক বিপুল অংশ “আগে রাম, পরে বাম”-এর ফাঁদে ধরা দেয়। এমনকি ২০১৯ নির্বাচনে ধাক্কার পরেও আত্মঘাতী “একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম” ফর্মুলা নাকচ করার কোনও গম্ভীর প্রচেষ্টা সিপিআই(এম)-এর তরফ থেকে চোখে পড়ছে না।
পিডি ভাষ্য আমাদের বলছে যে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হলে সবার আগে আপনাকে আপনার টিএমসি-বিরোধী বিশ্বাসযোগ্যতা তুলে ধরতে হবে। নিশ্চিতভাবেই এই দিকটায় সিপিআই(এম)-এর এক বিন্দু খামতি নেই! তথাপি সিপিআই(এম) ভোটাররা ক্রমাগত টিএমসি-র সম্ভাব্য শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে বিজেপির দিকেই সরে যাচ্ছে। এখনও কি সময় হয়নি সিপিআই(এম)-এর, পুনর্বিবেচনা করে নিজেদের অভিমুখ সংশোধন করে নেওয়ার? টিএমসি-বিরোধী পরিচয়পত্র নয়, প্রশ্ন হলো বিজেপি বিরোধিতার ধার কতটা থাকছে। পিডি ভাষ্য আমাদের বলছে যে সিপিআই(এম) বিজেপির বিপদকে খাটো করে দেখছে না বা বিজেপি ও টিএমসি-কে সমানও বলছে না। তবু বাস্তব জীবনে সিপিআই(এম)-এর বাচন লক্ষ্য করে যেকোনও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই সিপিআই(এম) নেতাদের অজস্র উক্তি, বিবৃতি বা মিছিলের শ্লোগান সামনে এনে হাজির করতে পারবেন যেখানে বিজেপি ও টিএমসি-কেই প্রধান বিপদ হিসেবে দেখা হচ্ছে বা তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়া যায় এই বক্তব্য সমানে তুলে ধরা হচ্ছে।
বাজপেয়ীর জমানায় যেহেতু কিছুদিনের জন্য টিএমসি এনডিএ-তে যোগ দিয়েছিল তাই সিপিআই(এম) টিএমসি-কে এখনও কার্যত এনডিএ-র শরিক হিসেবেই ধরতে চায়। বাস্তব বিষয়টা হল টিএমসি-বিজেপি জোট কোনোদিনই বাংলায় পায়ের তলায় মাটি পায়নি। প্রকৃতপক্ষে ২০০৪ লোকসভা নির্বাচন ও ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচন বিজেপি ও টিএমসি উভয়ের জন্য সবচেয়ে খারাপ ছিল আর সিপিআই(এম) ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনেই অদ্যাবধি সর্বোচ্চ ফল করেছিল। পিডি ভাষ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে এমনকি ২০১৪ সালেও মোদি টিএমসি-কে সম্ভাব্য জোটসঙ্গী হিসেবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কথাটা সত্যি। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা অন্যভাবে এগিয়েছে। প্রতিবেশী বিহার রাজ্যে নীতীশ কুমার যখন এনডিএ-তে ফিরে গেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকার কিন্তু সে পথে চলতে অস্বীকার করেছে। আজকের পরিস্থিতি যখন আকালি দল বা শিবসেনার মতো পূর্বতন এনডিএ শরিকদের বিজেপি থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য করছে তখন টিএমসি-কে বিজেপির সাথে এক বন্ধনীভুক্ত দেখিয়ে কার কোন উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে?
বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে দোদুল্যমান শক্তি হিসেবে টিএমসিকে উন্মোচিত করা এবং বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের অবিচল অগ্রণী শক্তি হিসেবে বামপন্থীদের প্রতিষ্ঠা করা এক জিনিস, কিন্তু টিএমসি ও বিজেপিকে একাসনে বসিয়ে এমনকি ‘বিজেমূল’ হিসেবে দলা পাকিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ২০১৯-এ বিজেপির পুলোয়ামা-পরবর্তী উগ্র প্রচারাভিযানের মাঝেও টিএমসি ৪৩%-এর বেশি ভোট টেনেছিল। এই ভোটাররা কারা? বাংলার গ্রাম ও শহরের দরিদ্র জনতার বৃহৎ অংশ, লক্ষ লক্ষ মহিলা ও রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটারদের বিপুল অংশ। এঁদের একটা বড় অংশ অতীতে বামপন্থীদের সমর্থক ও ভোটার ছিলেন, এবং বর্তমান সময়েও তাঁরা বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি মেনে নিতে রাজি নয়। জনতার যে অংশ ইতিমধ্যেই বিজেপির বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে প্রভাবিত ও বিবশ হয়ে পড়েছে তাদের সাথে এই বিজেপি বিরোধী গণভিত্তিকে একাকার করে কেন দেখব?
পিডি ভাষ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে এটা পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে। অবশ্যই তাই। রাজ্য বিধানসভারই নির্বাচন, এবং রাজ্য সরকারকে অবশ্যই দায়বদ্ধ করতে হবে। কিন্তু আমাদের এ কথাও তো স্মরণে রাখতে হবে যে এই বিধানসভা নির্বাচনটি হচ্ছে ২০২১ সালে, যখন মোদি সরকার দ্রুতই সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছে আর সংবিধানকে ও সংবিধানের অন্তর্বস্তু — ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও বিবিধতা — কে সমানে পদদলিত করে চলেছে। বর্তমানে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল পশ্চিমবঙ্গ এবং বিজেপি তা দখল করতে মরিয়া। পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল ঐতিহ্য ও মৈত্রীর ভাবধারা আজ বিপন্ন, আর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করলে গোটা দেশে বিরোধী পরিসর আরও সংকুচিত হবে এবং দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই কারণেই গোটা দেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের দিকে আকুলভাবে তাকিয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের এই অভূতপূর্ব সর্বভারতীয় গুরুত্বকে খাটো করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন ছাড়া আর কীই বা বলা যায়!
বস্তুত আজ বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে শুধুমাত্র রাজ্যের প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখতে মরিয়া। ওরা জানে যে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে পরিবর্তনের ডাক সর্বাগ্রে বিজেপি-কেই লাভবান করবে। গভীর হতে থাকা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং একটা নতুন পার্টিকে চান্স দেওয়ার আহ্বান উভয়ই বিজেপির অনুকুলে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে জাতীয় প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার এবং মোদি সরকার ও বিজেপিকে আড়ালে রাখার এই বিজেপি প্রণোদিত কমন সেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই বামেদের নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিত হওয়া দরকার। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারী বামফ্রন্ট-জাতীয় কংগ্রেস-আইএসএফ-এর ব্রিগেড সমাবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন বার্তা ছড়াল। এমনকি চলমান ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের বিশেষ প্রেক্ষাপটে এবং মূল্যবৃদ্ধি, কর্পোরেট আগ্রাসন ও বেকারত্বের তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে দাঁড়িয়ে ব্রিগেড সমাবেশ বার্তা দেয় যে পশ্চিমবঙ্গকে বিজেপির হাতে পড়া থেকে বাঁচানোর চেয়েও টিএমসি সরকারকে অপসারণ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর ব্রিগেড সমাবেশ কার্যত যে দলটির লঞ্চিং প্যাড হয়ে উঠল সেই আইএসএফ-এর রাজনৈতিক ঘোষণার মূল অভিমুখ তো প্রায় পুরোপুরি রাজ্য সরকারের বিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
পিডি ভাষ্য আমাদের আরও স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছে যে টিএমসি কোনো আরজেডি নয়। একটি কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে স্বাধীন বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে আমাদের সবক’টি প্রধান রাজ্যেই অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছে, তা সে আরজেডি শাসিত বিহার, কংগ্রেস শাসিত আসাম, বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ড হোক বা বামফ্রন্ট শাসিত পশ্চিমবঙ্গ। বিহারে আমরা অনেকগুলি গণহত্যার শিকার হয়েছি। কিন্তু বাম-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় যথাক্রমে ১৯৯৩-এ বর্ধমানের করন্দা গণহত্যা ও ১৯৮০-র হুরুয়ার গণহত্যাও কম নৃশংস ছিল না। বিহারে সামন্তী শক্তি ও আমাদের বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক দলের জিঘাংসায় আমরা বেশ কিছু নেতাকে হারিয়েছি, এবং আসাম, ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গেও। আরজেডি শাসিত বিহারে মনি সিং, চন্দ্রশেখর ও মঞ্জু দেবীর মতো কমরেড, বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ডে কমরেড মহেন্দ্র সিং, কংগ্রেস শাসিত আসামে কমরেড অনিল বরুয়া আর গঙ্গারাম কোল এবং বাম শাসিত পশ্চিমবঙ্গে আব্দুল হালিম — রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারা খুন হওয়া অগ্রণী কমরেডদের কয়েকজন। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের বনিয়াদ ও বাম আন্দোলনের সামনে প্রধান বিপদ হিসেবে বিজেপিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এই হত্যাকাণ্ডগুলি কখনই আমাদের অন্ধ করে রাখতে পারেনি। পৃথিবি জুড়ে সব ফ্যাসিস্ট শক্তির মূল নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-বহির্ভূত শক্তির দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মতাদর্শগত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, বৈষম্য ও হিংসা ছড়ানোর রাজনীতি। ভারতকে হিন্দু প্রভুত্ববাদী জাতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে বিজেপির উদ্ধত আগ্রাসী অভিযানই আজ গণতন্ত্রের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ।
একটি স্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আমরা বিহারে ১৫ বছর ধরে চলা আরজেডি রাজত্বে ধারাবাহিকভাবে বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করেছি, ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসিত বাংলাতেও করেছি। আরজেডি শাসনের বিরোধিতা করলেও নীতীশ কুমার বিজেপির সাথে হাত মেলানোর পর কখনোই আমরা তাঁর দিকে সহযোগিতার কোনো হাত বাড়িয়ে দিইনি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বাইরে আমরাই একমাত্র বাম দল যাদের বাম জমানায় টিএমসি’র সাথে রাজনৈতিক সহযোগিতার কোনও ইতিহাস নেই। সিপিআই(এম)-কে সরিয়ে ক্ষমতায় আসার পর মমতা ব্যানার্জী আমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন এমন কোনও উদাহরণ স্মরণ করতে পারবেন না। আজ তিনি যদি আমাদের বিজেপি-বিরোধী সুদৃঢ় অবস্থানের জন্য ধন্যবাদ জানান তাহলে তা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যাওয়াকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। বামফ্রন্টকে সরিয়ে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা আর আজ তৃণমূলকে সরিয়ে বিজেপির ক্ষমতায় আসার বিপদ – এই দুই পরিস্থিতির গুণগত পার্থক্য কি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে?
আর এটাও অদ্ভুত যে সিপিআই(এমএল)-কে মমতা ব্যানার্জির ধন্যবাদ জানানোর কথা পিডি উল্লেখ করলেও বিজেপি নেতারা যে ২০১৯-এ বিজেপিকে সহযোগিতা করার জন্য সিপিআই(এম)-এর নেতা-কর্মীদেরদের প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন এবং ২০২১-এ আরও বেশি সহযোগিতার আবেদন জানিয়ে চলেছে সে বিষয়ে পিডি কোনও মন্তব্য করেনি। আজ যখন পশ্চিমবঙ্গ ফ্যাসিস্ট কব্জায় চলে যাওয়ার ভয়ানক বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তখন একটি কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আমাদের প্রধান কাজই হল এই আসন্ন বিপদ থেকে বাংলাকে বাঁচানো।
আমরা আশা করেছিলাম যে ২০১১-পরবর্তী এবং আরও বেশি করে ২০১৪-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিন্যাস বৃহত্তর বাম ঐক্য বিকশিত ও সংহত করার অনুকুল পরিবেশের জন্ম দেবে। কিন্তু হায়! প্রথমে কংগ্রেস ও তারপর নবগঠিত আইএসএফ-এর সাথে জুড়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ছক কষতে গিয়ে বামপন্থার পুনর্জাগরণের অভিঘাতকেই সিপিআই(এম) লঘু করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামেরা আবার উঠে দাঁড়াতে পারে কেবলমাত্র লড়াইয়ের ময়দানে এক জোরালো বিজেপি-বিরোধী ভূমিকা পালনের মাধ্যমেই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ তার ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করুক — এই প্রত্যাশা নিয়ে সারা দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি যখন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের দিকে তাকিয়ে আছে তখন দুর্ভাগ্যবশত সিপিআই(এম) তার টিএমসি-বিরোধী পরিচিতি নিয়ে আচ্ছন্ন। আমরা তবু আশা রাখব যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিজেপির এই ডাবল ইঞ্জিন অভিযানকে রুখে দেবে, আর ফ্যাসিস্ট হামলার জবাব দিয়ে গণতন্ত্রের সুদৃঢ় ও অবিচল চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বাংলার বামপন্থীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা আবার সামনে আসবে।
ভগৎ সিং এর জন্ম এক জাতিয়তাবাদী পরিবারে। তাঁর জন্মের সময় তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবা কিষাণ সিং ও কাকা শরণ সিং দুজনেই জেলে ছিলেন। তাঁর জন্মের আগেই তাঁর আর এক কাকা স্বাধীনতা সংগ্রামী অজিত সিং-কে ব্রিটিশরা দেশান্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাঁর বড় হয়ে ওঠাটা ছিল এক ঝড়ো আবহাওয়ায়। ভগৎ সিং স্কুলের ছাত্র, সেই সময়েই এল অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ, সরকারী স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠান ছাড়ার আহ্বান। ভগৎ সিং সরকার পরিচালিত স্কুল ছেড়ে ভর্তি হলেন অ-সরকারী নবগঠিত জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায় এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরে ভগৎ সিং জলন্ধর থেকে সেখানে যান এবং শহীদের রক্তভেজা মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এটা সারাজীবনই তিনি সঙ্গে রেখেছিলেন।
১৯২২ সালে চৌরিচৌরার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে গান্ধীজী যখন আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন, তখন বাংলা ও পাঞ্জাবের একদল তরুণের জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের কংগ্রেসী ধারাটির প্রতি মোহভঙ্গ হল। একদা গান্ধীজীর ‘এক বছরের মধ্যে স্বরাজ’ এর প্রতিশ্রুতি তাঁদের আশান্বিত করেছিল। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতি তাঁদের হতাশ করল। নারাজীদের আইনসভার বাইরে থেকে অসহযোগ বা স্বরাজীদের আইনসভার মধ্যে ঢুকে ভেতর থেকে প্রতিবাদ – কোনোটিই তাঁদের বিশেষ পছন্দ হয়নি। চরমপন্থী বিপ্লবী হিসেবে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ভগৎ সিং ছাড়াও ছিলেন সূর্য সেন, যতীন দাস, চন্দ্রশেখর আজাদ, শুখদেব সিং প্রমুখ বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও বাংলার অনেক উজ্জ্বল তরুণ মুখ। ভগৎ সিং-কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল গদর আন্দোলনের ঐতিহ্য। গদর পার্টি রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যোগী হয়েছিল, সেই সঙ্গে চোখ রেখেছিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর। গদর পার্টির বিপ্লবী তরুণ কর্তার সিং সরাভার মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদান ভগৎ সিং-কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
১৯২৩ সালে পাঞ্জাব থেকে কিছুদিনের জন্য ভগৎ সিং চলে আসেন কানপুরে এবং সমমনোভাবাপন্ন এক ঝাঁক তরুণের সঙ্গে সেখানে তাঁর যোগাযোগ হয়। এদের মধ্যে ছিলেন গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী, বটুকেশ্বর দত্ত, বিজয় কুমার সিংহ, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ। ১৯২৩ সালে সচ্চিদানন্দ সান্যাল তৈরি করেছিলেন হিন্দুস্থান রিভোলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশন, ভগৎ সিং কানপুরবাস পর্বে এতে যোগ দেন। সচ্চিদানন্দের লেখা ‘বন্দী জীবন’ বইটি তিনি পাঞ্জাবীতে অনুবাদও করেন। ১৯২৪ সালের অক্টোবরে কানপুরে ভগৎ সিং ও অন্যান্য তরুণ বিপ্লবীরা মিলে গড়ে তুললেন হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (মতান্তরে আর্মি) (এইচ আর এ)। এর লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে তার জায়গায় ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব ইউনাইটেড স্টেটস’ প্রতিষ্ঠা। এই নামটির দিকে খেয়াল করলেই আমরা বুঝতে পারব অতিরিক্ত কেন্দ্রিকতার বদলে গণতন্ত্রের স্বার্থে ফেডারেল ধরনের এক স্বাধীন ভারতবর্ষর প্রতিষ্ঠাই তাঁরা চেয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে ভগৎ সিং পাঞ্জাবে ফিরে যান। সেখানে তখন গদর আন্দোলন নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভগৎ সিং এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে যান।
কাকোরি ডাকাতি মামলায় হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর অনেক বিপ্লবী নেতা গ্রেপ্তার হন। আশফাকুল্লা খাঁ, রামপ্রসাদ বিসমিল, রোশন সিং ও রাজেন্দ্র লাহিড়ীকে বিচারের পর ফাঁসি দেওয়া হয়। অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আন্দামানে দীপান্তর ও দীর্ঘমেয়াদি কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয়। এই ধাক্কার পর ভগৎ সিং ও তাঁর অবশিষ্ট সাথীরা একটি আইনি, প্রকাশ্য সংগঠন তৈরি করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই প্রয়োজন মেটাতেই ১৯২৬ সালে তৈরি হয় ‘নওজোয়ান ভারত সভা’। ১৯২৮ সালে ভগৎ সিং ও সুখদেব তৈরি করেন এর ছাত্র শাখা লাহোর স্টুডেন্ট’স ইউনিয়ন।
১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন এলো ভারতে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস একে বয়কটের ডাক দিল। ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরাও সক্রিয় প্রতিবাদে জোর দিলেন। লাহোর শহরে লাজপত রায়ের নেতৃত্বে যে বিরাট মিছিল বেরোয় তাতেও তাঁরা সামিল ছিলেন। মিছিলের ওপর পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালায়। লালা লাজপত রায় মারাত্মক আঘাত পান ও কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর মারা যেন। এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদরা দৃঢ়সংকল্প হন। তাঁরা পুলিশ অফিসার স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যদিও ভুলবশত আরেক পুলিশ অফিসার জে পি স্যান্ডার্স বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন।
১৯২৯ সালে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত আইনসভার মধ্যে ফাঁকা জায়গায় একটি বোম নিক্ষেপ করেন ও তাঁদের বক্তব্য সকলকে জানিয়ে দেন। এই ঘটনা শুধু দেশের কোণে কোণেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেই চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে।
ভগৎ সিং এর রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ গঠনে রুশ বিপ্লবের প্রভাব ছিল ব্যাপক। সেই সময় লাহোরে লাজপত রায় তৈরি করেছিলেন দ্বারকাদাস লাইব্রেরি। এখানে রুশ বিপ্লবের ইতিহাস, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন এর লেখালেখি, ইতালি, আয়ার্লাণ্ড প্রভৃতির জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের ওপর বইপত্রের খুব ভালো সংগ্রহ ছিল। ভগৎ সিং ছিলেন এই গ্রন্থাগারের প্রধান পাঠক। তিনি শুধু নিজেই প্রচুর পড়তেন তা নয়, তাঁর কমরেডদেরও এইসব পড়াশুনোয় নিরন্তর উৎসাহ দিতেন। এই সব বইপত্রের ভিত্তিতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকেই ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডরা তাঁদের নতুন আদর্শ করে তোলেন। বিপ্লবী তরুণদের প্রকাশ্য সংগঠন নওজোয়ান ভারত সভা ১৯২৮ সালের অগস্ট মাসে সাত দিন ব্যাপী ‘রুশ বান্ধব সপ্তাহ’ পালন করেছিল। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডরা লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বিচারাধীন বন্দী ছিলেন, সেই সময়ে তাঁরা জেলের মধ্যেই পালন করেন ‘লেনিন দিবস’। সোভিয়েত রাশিয়ার জনগণকে জেলের ভেতর থেকেই তাঁরা শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে সোভিয়েত সমাজবাদের প্রভাবেই এই সময় তাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগঠিত বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জায়গা থেকে সরে এসে বৃহৎ জনসমাজকে সমন্বিত করে বিপ্লবী গণ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শুরু করেন। ১৯২৭ সালের পর থেকেই ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডদের দৃষ্টিকোণের এই পরিবর্তনের স্পষ্ট সাক্ষ্য আছে ১৯৩১ সালের এক বয়ানে। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে এখন আমি যেভাবে ভাবছি, আমার বিপ্লবী জীবনের শুরুতে সেভাবে ভাবিনি। আমি ঘোষণা করতে চাই যে আমি আর সন্ত্রাসবাদী পথে বিশ্বাসী নই। আমি মনে করি না এই পথে হেঁটে আমাদের কোনও লাভ হবে। সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন যে তিনি একদমই মনে করেন না তাঁর বোম ছোঁড়ার ঘটনাটি অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকারক ছিল।
ভগৎ সিং-এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা বুঝতে তাঁর বিভিন্ন উক্তি আমাদের সহায়ক হতে পারে। তরুণদের উদ্দেশে একটি ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, এরই অবিচ্ছেদ্য প্রাথমিক কাজ হল রাজনৈতিক বিপ্লব সফল করা। তাই-ই আমরা করতে চাই। রাজনৈতিক বিপ্লব মানে শুধুমাত্র ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে রাষ্ট্র হস্তান্তর করা বোঝায় না। আমাদের সুনির্দিষ্ট বিপ্লবী লক্ষ্য আছে, জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে বিপ্লবী দলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা আমরা চাই। তারপর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে গোটা সমাজকে পুনর্গঠিত করার পথে সংগঠিতভাবে আমাদের এগোতে হবে। বিপ্লবের এই সঠিক ধারণা যদি আপনার না থাকে তবে দয়া করে থামুন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান তুলবেন না। বিপ্লব শব্দটির তাৎপর্য অন্তত আমাদের কাছে সুমহান। এ শব্দটিকে যেমন তেমন করে ব্যবহার করতে বা অপব্যবহার করতে আমরা দিতে পারি না।”
ভগৎ সিং বলেছিলেন, ‘‘রাষ্ট্র এবং সরকারী প্রশাসন শাসক শ্রেণির একটা হাতিয়ার – যা দিয়ে সে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে, নিজের স্বার্থকে রক্ষা করে। আমরা এই ক্ষমতা ছিনিয়ে এনে সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মার্কসবাদের চিন্তা অনুযায়ী নতুন সমাজ গড়ে তুলতে চাই। এ কারণেই সরকারী ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য আমরা লড়ছি। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনগণকে সচেতন ও প্রস্তুত করে গড়ে তোলা যায়। বিপ্লবের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এজন্য বিপ্লবী কর্মীদের অপরিসীম আত্মত্যাগ প্রয়োজন। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আপনি যদি ব্যবসায়ী হন কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং পারিবারিক পিছুটান যদি আপনার থাকে তবে এ পথ আপনার জন্য নয়। বিপ্লবী দলের নেতা হওয়ার যোগ্যতা আপনার নেই। সান্ধ্য অবকাশে কিছু ভাষণ দেবার মতো নেতা আমাদের অনেক আছে, এসব নেতাদের কোনও মূল্যই নেই। লেনিন যাকে বলছেন জাতবিপ্লবী, তেমন ধরনের নেতা আমাদের চাই। আমাদের চাই এমন সব সর্বক্ষণের বিপ্লবী কর্মী, বিপ্লব ছাড়া আর কোনও আকাঙক্ষা, বিপ্লবের জন্য কাজ ছাড়া আর কোনও কাজ যাদের নেই। সুপরিকল্পিত অগ্রগতির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল জাত বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত একটি দল – আদর্শ সম্পর্কে যাঁদের ধারণা সুস্পষ্ট, যাঁদের পর্যবেক্ষণ নিখুঁত, উদ্যোগ গ্রহণ করার এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যাঁদের আছে।”
ভারত স্বাধীন হয়েছে দেশভাগের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। ধর্ম ও রাজনীতিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে কথা ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডরা ভেবেছিলেন, আজকের ভারত তাঁর বিপরীত দিকে প্রবল গতিতে এগোচ্ছে। তার বিষময় ফল আমরা প্রত্যক্ষ করছি। ভগৎ সিং-এর কথাগুলি এই প্রসঙ্গে আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখার। তিনি বলছেন, ‘‘ধর্ম আমাদের অগ্রগতির পথে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। যেমন ধরুন আমরা চাই সমস্ত মানুষ সমান হোক, মানুষে মানুষে উঁচু-নীচু বা অস্পৃশ্যতার ভেদাভেদ যেন না থাকে। কিন্তু সনাতন ধর্ম তো এই ভেদাভেদের পক্ষে। এই বিংশ শতাব্দীতে পণ্ডিত মৌলবীরা আজও মেথরের ছেলের কাছ থেকে গলায় মালা নেন তারপর কাপড়-চোপড় সহ স্নান করে শুদ্ধ হন। অচ্ছুৎদের তাঁরা পৈতা পরার অধিকার দেন না। এমন যে ধর্ম তার বিরুদ্ধে কিছু না বলে নীরবতাই যদি শ্রেয় মনে করি, তবে তো সব কিছুতে জলাঞ্জলি দিয়ে মরে বসে থাকতে হয়। চোখের উপর আমরা দেখছি ধর্ম আমাদের সামনে পর্বত প্রমাণ বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একের ধর্ম বলছে গরু কাটা চলবে, অন্যের ধর্মে লেখা আছে গরুকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করতে হবে। তাহলে এখন কী হবে? যদি অশ্বত্থ গাছের ডাল ভাঙলেই ধর্ম ভেঙে পড়ে তাহলে কী-ই বা করা যায়। এইসব ধর্মীয় দর্শন, সংস্কার ও ধর্মীয় আচার-আচরণকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভেদ শেষ পর্যন্ত জাতীয় ধর্ম হয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে ভিত্তি করে পৃথক পৃথক সংগঠন গড়ে ওঠে। এর অশুভ পরিণাম যে কী তা আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। যতদিন পারস্পরিক বিদ্বেষ মন থেকে মুছে ফেলে আমরা এক না হব, ততদিন বাস্তবে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে না। কেবলমাত্র ব্রিটিশ সিংহের থাবা থেকে মুক্তি পাওয়ার নাম স্বাধীনতা নয়। পূর্ণ স্বাধীনতার অর্থ হল সমস্ত মানুষের মিলেমিশে থাকবার ক্ষমতা অর্জন এবং সর্বপ্রকার মানসিক দাসত্ব ও দুর্বলতা থেকে মুক্তি।” বাবাসাহেব আম্বেদকরের জাতিপ্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন তখন আলোড়িত করছে ভারতীয় রাজনীতিকে, সেই সময়কালেই ‘অচ্ছুৎ সমস্যা’ সংক্রান্ত লেখাটিতে ভগৎ সিং শুধু কারখানার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণিকে খুঁজছেন না, দলিত মেহনতি মানুষের জাগরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন শ্রমিক জাগরণকে। এর মধ্যে দিয়ে মার্কসবাদের ভারতীয়করণের একটি কাজ সেই তরুণ বয়সেই তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। ২৩ মার্চ ফাঁসির মঞ্চে অকালে তাঁর পথচলা শেষ না হয়ে গেলে শুধু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনই নয়, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনও নিঃসন্দেহে বিশেষভাবে লাভবান হত।
ভগৎ সিং ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম উজ্জ্বল বিপ্লবী। তবে শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের মধ্যেই নয়, আজকের ভারতের নতুন সঙ্কটগুলির সমাধানের ক্ষেত্রেও তাঁর চিন্তাভাবনা ও কাজের গুরুত্ব অপরিসীম।
- সৌভিক ঘোষাল
খোয়াই বনের হাটের পার্শ্ববর্তী গ্রামের অধিবাসীবৃন্দের ডাকা এক অভূতপূর্ব সভায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বহু কিছু শিখলাম। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের অন্যতম সদস্য সোনা মুর্মু এই সভার খবর দিয়েছিলেন।
সেই কবে শুরু হয়েছিল এই হাট সোনাঝুরি জঙ্গলের একধারে, উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় মানুষ তাদের নিজের হাতে তৈরি পসরা নিয়ে বসবেন শনিবারের বিকালে, নিজেরাই কেনাবেচা করবেন এবং সন্ধ্যা লাগলে সব গুটিয়ে ফিরে যাবেন। কোনো স্থায়ী আস্তানা এখানে হবে না। কিছু হস্তশিল্পের পাশাপাশি সেখানে ঘরে তৈরি পিঠে পুলি পেয়েছি। আমাদের প্রিয় শ্যামলীদিকে দেখেছি কাগজের তৈরি শান্তির পাখি নিয়ে বসেছেন। স্থানীয় গ্রামের বাচ্চারা নুড়িপাথরের বিনিময়ে সেই পাখি পেয়েছে।
কালক্রমে সেই খোয়াইবনের অন্য হাট গুরুতর বাণ্যিজিক বাজারে পরিণত হয়েছে। শনিবার ছাপিয়ে রবি সোম মঙ্গল সব দিনেই হাট বসছে। একটা ছেড়ে কত কটা হাট। সেখানে একই কোম্পানির একই উৎপাদন পাঁচ জায়গায় পাঁচ জনা বেচছেন। প্রয়োজনের অনেক উপরে চেপেছে সৌখিন চটক। যা বিক্রি হয়, তা কেনার সাধ বা সাধ্য কোনোটাই স্থানীয় মানুষের নেই।
স্থায়ী হোটেল বসেছে, চারিদিকে রমরমা রিসোর্ট। কলকাতা থেকে সোজা ঢাউস গাড়িতে হাটের মাঝে। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথ কোনো কিছু নয়, লক্ষ্য শুধু হাট। অরণ্যের দিনরাত্রি এখন এই বিপণনে মুখর। পথ ঢেকেছে বিচিত্র সব যানে, আশেপাশের গ্রামের মানুষের বেরোনোর পথ নেই। অসুস্থ হলে কোন পথে হাসপাতাল পৌঁছবেন কেউ জানেন না। আদিবাসী মেয়েদের গ্রুপ ড্যান্স আর বাউল সং দিয়ে সংস্কৃতির দারুণ চর্চা চলছে। আমোদের অন্যান্য আয়োজন সহযোগে।
পাশের কয়েকটি সাঁওতাল গ্রামের ক্ষুব্ধ মানুষ আজ স্পষ্ট ভাষায় জানালেন এই হাট তাদের সংস্কৃতি ও যাপনের উপর বিরাট আঘাত হানছে। চিরকাল যা হয়ে আসছে, শহুরে বাবুদের ফূর্তির জন্য তাদের জমি গিলছে জমিহাঙর। সরতে সরতে তারা কোণঠাসা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়ন নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। তাদের ছেলেরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাবুদের কীর্তি দেখে বেড়াচ্ছে। দেখাই যাচ্ছে পর্যটনে যারা আসেন, তাদের কাছে স্থানীয় মানুষ একেবারেই তুচ্ছ। ওরা বলছিলেন, যে ধরনের কুরুচিকর আচরণ তারা প্রকাশ্যে করেন, এ কি তারা নিজেদের এলাকায় পারবেন! গভীর ক্ষোভে একজন বললেন, কেন এই বনভূমিতেই তাদের হাট করতে হবে? আর কি কোনো জায়গা নেই। আদিবাসী মেয়েদের বিশেষ উৎসবের সাথে যুক্ত যে নাচ, কটা পয়সা ফেলে এরা যখন তখন এই নাচ দেখছেন, এ সব কী হচ্ছে? একজন বয়স্ক মানুষ বাবু বিবিদের উল্লাসের যেটুকু বর্ণনা দিতে পারলেন তাতে বিবমিষা জাগছিল।
সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে এই হাট বন্ধ করতে হবে। নিঃসন্দেহে এক আলোড়ন জাগানো দাবি যার পক্ষে তারা তাদের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন।
জল জঙ্গল জমির উপর যাদের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ আজ তাদের উপর চলতে থাকা এই আগ্রাসনের কথা শুনতে শুনতে অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করেছি। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের তরফে তাদের আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছি।
- মনীষা ব্যানার্জী
হাট তখন শেষের দিকে; রোজের কেনাবেচা সেরে আমবাড়ি হাট ফিরতি মানুষ তখন জটলা করেছে চা দোকানে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশছোঁয়া দাম চিন্তার ভাঁজ যেমন বাড়িয়েছে, পাশাপাশি আসন্ন ভোটের উত্তাপের আঁচও এসে পড়েছে চা বাগান সংলগ্ন এই জনপদে। আলোচনা চলছিল এসব নিয়েই, এর মধ্যেই ফাঁসিদেওয়া বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রার্থী সদ্য ছাব্বিশে পা দেওয়া ছিপছিপে মেয়েটির নেতৃত্বে লাল পতাকার দৃপ্ত মিছিল এগিয়ে আসছিল। সঙ্গে শ্লোগান, ভোট দেবেন কোনখানে পতাকায় তিনতারার মাঝখানে। ফ্যাসিস্ট বিজেপি দেশবেচা বিজেপি দূর হটো। বিজেপি হটাও বাংলা বাঁচাও। আলোচনা খানিক্ষণের জন্য থমেকে গেলো! ঐ চায়ের দোকানে হাটের এদিকে ওদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন যে আলোচনা করছিলেন এরাও তো সে কথাই বলছে। সেসবের বিরুদ্ধেই মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছে। মিছিল শেষে হাটে সভা যখন শুরু হয়। সূর্য তখন প্রান্ত সীমায়। কিন্তু মিছিলের দৃপ্ত মেজাজ তখন সভাতেও অক্ষুণ্ণ। একে একে বক্তব্য রাখলেন বর্ষীয়ান চা শ্রমিক নেতৃত্ব বন্ধু বেক, মুক্তি সরকার, বাসুদেব বোস, শরৎ সিংহ এবং প্রার্থী সুমন্তি এক্কা। কেউ বললেন দীর্ঘদিন চা বাগানের মজুরি বৃদ্ধির লড়াইয়ে থেকে কিভাবে সরকার তাদেরকে নায্য পাওনা, জমির পাট্টা, রেশন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত করে চলছে দিনের পর দিন। তবে তারা এ লড়াই লড়ে যাবে শেষ পর্যন্ত। কৃষক-বিরোধী কৃষি আইন, শ্রমিক-বিরোধী শ্রম-কোড পরিবর্তন করার দাবিতেও সরব হলেন বক্তরা। উঠে এসেছে বিজেপির আমলে নারী নিরাপত্তার পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হওয়ার প্রশ্নটিও। বছর ছাব্বিশের সুমন্তি যখন চা বাগানের মজুরি বৃদ্ধির লড়াইয়ের কথা বলছিলেন, বলছিলেন এই মোদী সরকারই আস্ত একটা মহামারী। আমাদের কাছে ভোট তাই জনগনের উৎসব। যে উৎসবে সামিল হয়ে আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার যুদ্ধ করবো ব্যালটের মধ্যে দিয়ে। এক ইঞ্চি জমিও আমরা ছাড়বো না ফ্যাসিস্ট সরকারকে। আসুন আমরা একসাথে বিজেপি মুক্ত বাংলা গড়ে তুলতে আগামী ১৭ এপ্রিল ভোট দিই পতাকায় তিন তারার মাঝখানে। সভার আশেপাশের মানুষদের ছুঁয়ে যাচ্ছিল সেই প্রত্যয়। ভগত সিং এর ৯১তম শহীদ দিবসে জনগণের ভারত গড়ে তুলতে সঙ্গের সহোযোদ্ধারাও তখন সুমন্তির ঋজু আলোয় উদ্ভাসিত।
কেন্দ্রের তিনটে কর্পোরেটপন্থী ও কৃষকের স্বার্থ বিরোধী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যে রাজ্যগুলোতে কৃষক আন্দোলন প্রবল আকার নিয়েছে হরিয়ানা তার অন্যতম। প্রসঙ্গত, হরিয়ানার শাসন ক্ষমতায় এখন বিজেপি ও জননায়ক জনতা পার্টির (জে জে পি) জোট সরকার। জেজেপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী অবস্থান থেকে লড়লেও নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর তারা বিজেপির সঙ্গে জোট সরকারে শামিল হয়। শাসক জোটের অঙ্গ হওয়ায় বিজেপির সঙ্গে তাদের নেতা-বিধায়করাও কৃষকদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে পড়ছেন, সরকার সমর্থক নির্দল বিধায়করাও কৃষক রোষ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। কৃষকরা বিধায়ক, নেতা ও মন্ত্রীদের বাড়ির বাইরে অবস্থান করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করছেন। কৃষকদের ক্রোধ এমন মাত্রা নেয় যে তাঁরা কার্নালের পারহা গ্ৰামের এবং জিন্দের উচানা গ্ৰামের হেলিপ্যাড দুটো ক্ষতিগ্রস্ত করেন, যে হেলিপ্যাড দুটোতে মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী দুশ্যন্ত চৌটালার হেলিকপ্টার থেকে নামার কথা ছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, রাজ্যের এক জাট নেতা কিছুদিন আগে জানান, “মন্ত্রীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, আগামী দু-মাস তাঁরা যেন হরিয়ানা ভ্রমণ না করেন।”
গত ১০ মার্চ তিনটে কৃষি আইনের ইস্যুতে কংগ্ৰেসের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে হরিয়ানা বিধানসভায় ভোটাভুটি হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে বেশি ভোট পড়ায় খট্টর সরকার অনাস্থা ভোটে জয়ী হলেও কৃষক নেতারা দাবি করেছেন, সরকার “জনগণের আস্থা হারিয়েছে।” অনাস্থা ভোটের পর সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতা গুরনাম সিং চারুনি বলেন, “গতকাল আমরা হরিয়ানার সমস্ত বিধায়কদের অনুরোধ করেছিলাম … শুধু এই একবারের জন্য আপনাদের ভোট চেয়েছিলাম। (বলেছিলাম) আমরা সবসময় আপনাদের ভোট দিয়েছি, এবার চাই আপনারা আমাদের ভোট দিন, আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু ওঁরা পুঁজিবাদকে ভোট দিলেন। ভবিষ্যতে … ওরা যদি আমাদের গ্ৰামে আসে, আমরা ওদের বিরোধিতা করব, সামাজিকভাবে বয়কট করব, আর আমাদের সামাজিক জমায়েতে এই বিধায়কদের আমন্ত্রণ জানানো হবে না। ওরা যদি আসার চেষ্টা করে, আমরা ওদের ঢুকতে দোবো না।”
কৃষকরা এই অবস্থান নেওয়ায় সারা রাজ্যেই বিজেপি-জেজেপি বিধায়ক ও সরকার সমর্থক নির্দল বিধায়কদের অভূতপূর্ব সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জিন্দ জেলার নারওয়ানাতে বিজেপির জেলা স্তরের প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে। গত ১৪ মার্চ কৃষকরা সেখানে পৌঁছে বিক্ষোভ দেখালে পুলিশের সহায়তা নিয়ে বিজেপি কর্মীদের স্থান ত্যাগ করতে হয়। ১৫ মার্চ উপ-মুখ্যমন্ত্রী চৌটালার জিন্দের উছানা অফিসে পৌঁছে কৃষকরা বিজেপি ও সরকার বিরোধী শ্লোগান দিতে থাকেন। অফিসের সবাইকে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। বিধায়ক অসীম গোয়েল ও গোপাল গয়াল কাণ্ডার বাড়ির বাইরেও বিক্ষোভ প্রদর্শনের খবর পাওয়া গেছে। কৃষক প্রতিবাদের জেরে মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরও তাঁর গ্ৰামের বাড়িতে ঢুকতে পারেননি বলে সংবাদ বেরিয়েছে।
এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসা পাঞ্জাবের আকালি দলের নয় বিধায়ক বিধানসভার বাইরে মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরকে ঘেরাও করলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে। মন্ত্রী-বিধায়কদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সামাজিক বয়কট আন্দোলন তীব্র মাত্রা অর্জন করায় হরিয়ানা সরকার বিধানসভায় বয়কট বিরোধী প্রস্তাব পাশ করানোর পথে যায়। হরিয়ানা বিধানসভার নির্বাচনের দেরি আছে, এবং শাসন ক্ষমতায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সামনে আশু কোনো বিপদও নেই। তবে, জনসমর্থনের দিক থেকে বিচার করলে এই মুহূর্তে জনসমর্থন যে সরকারের পাশ থেকে সরে গেছে তা হলপ করে বলা যায়।
সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট (ইডি) ও আয়কর বিভাগের জন্য অনেকে এখন ত্রিশূল অভিধাটি ব্যবহার করে থাকেন। বিরোধী কোনো দল বা নেতাকে দমিয়ে রাখতে, ভয় দেখাতে, তাদের সক্রিয়তা বন্ধ করতে মোদী সরকার তাদের ত্রিশূল দিয়ে বিদ্ধ করছে, দুর্নীতি দমনে যুক্ত কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে তাদের পিছনে লেলিয়ে দিচ্ছে। অখিলেশ যাদবের এসপি, মায়াবতীর বিএসপি থেকে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস, চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপি, কমল হাসানের এমএনএম-এর মত বিরোধী পক্ষের দলগুলো এই তিন কেন্দ্রীয় সংস্থার হানাদারির মুখে পড়েছে। এই অভিযোগও এমনকি উঠেছে যে, কেরলে সোনা পাচার কাণ্ডে ইডি এক অভিযুক্তকে চাপ দেয় যে তিনি যেন কেরলের সিপিআই(এম) মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের নাম নিয়ে তাঁকে এই দুর্নীতিতে জড়ান। বিরোধী পক্ষের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমনের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর অভিযান যে পুরোদস্তুর মোদী সরকার তথা বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ প্রসূত তা নিয়ে আজ আর প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই।
এরই পাশাপাশি তাদের সঙ্গে দুর্নীতির কোনো যোগ না থাকাটাকেও বিজেপি জাহির করতে চায়। কিন্তু নিজেদের নিষ্কলুষ বলে প্রদর্শিত করতে চাইলেই কি আর কলঙ্ক চাপা থাকে। আগেও বিজেপির বিরুদ্ধে, তার নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল (পাঠক, রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে, এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বাজেয়াপ্ত হওয়া খাতাপত্রে নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁকে ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার উল্লেখ, নোটবন্দীর মাত্র কয়েক দিন আগে অমিত শাহর পরিচালনাধীন গুজরাটের কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে বেশ কয়েকশো কোটি টাকা জমা হয়ে কালো টাকাকে সাদা করার মতো দুর্নীতির অভিযোগ স্মরণ করুন)। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া থেকে অব্যাহতি ঘটে। সম্প্রতি আবারও বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যাতে নাম জড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপি নেতৃবৃন্দের ও তাদের চালিত প্রশাসনের। অভিযোগগুলোকে বিচার করা যাক।
সুইডেনের বাস-ট্রাক প্রস্তুতকারী সংস্থা স্ক্যানিয়া নিজেরাই তদন্ত করে জানিয়েছে যে, ২০১৩ থেকে ২০১৬-র মধ্যে ভারতের সাতটা রাজ্যে বাস সরবরাহের বরাত পেতে তারা সরকারী কর্তাদের ঘুষ দিয়েছিল। তাদের তদন্ত রিপোর্ট জানিয়েছে – “এই অশিষ্ট আচরণের মধ্যে রয়েছে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ, ব্যবসার অংশীদারের এবং মিথ্যা উপস্থাপনার মাধ্যমে ঘুষ প্রদান।” ভারতে স্ক্যানিয়ার এজেন্ট এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে দু-দফায় কালো প্ল্যাস্টিক ব্যাগে ২৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছিল বলেও জানানো হয়েছে।
স্ক্যানিয়ার সঙ্গে বাস সরবরাহের চুক্তি হয় গুজরাতের সিদ্ধি বিনায়ক লজিস্টিকস লিমিটেড-এর। স্ক্যানিয়ার থেকে কেনা বাস ২০১৪ সালে মোদীর নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার কর হয়েছিল বলেও প্রকাশ পেয়েছে। এই বাস কেনা ও অন্যান্য প্রকল্পের জন্য সিদ্ধি বিনায়ক ব্যাঙ্ক অব মহারাষ্ট্র থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নিয়েছিল, এবং অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৮৩৬ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ সিদ্ধি বিনায়ককে চিঠি দিলে কোম্পানির প্রধান কর্তা রূপ চাঁদ বইদ উত্তরে জানান – “নিম্ন স্বাক্ষরকারী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দলের লোকজনের ৩ডি প্রচারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি বাসের যোগারযন্ত্রের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এর জন্য প্রায় দু-মাস সময় লাগে (ফেব্রুয়ারি ও মার্চ)। এই সময় কালে আমি ব্যবসার কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারিনি।” ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধ করার কোনো আগ্ৰহ এই উত্তরের মধ্যে ধরা পড়ছে না। বিপরীতে রূপচাঁদ বইদের এই মনোভাবই সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, নরেন্দ্র মোদীর নাম নিলে, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জাহির করতে পারলে ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধ করার কোনো দায় থাকবে না, এবং ঋণ পরিশোধের জন্য ভবিষ্যতে কেউ আর তাগাদাও দেবে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছাকাছি থাকা এই ধরনের ব্যক্তিরাই যে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর অনুৎপাদক সম্পদকে পাহাড় প্রমাণ করে তুলেছে তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য।
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত গত ৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বলা ভালো, তাঁর দল বিজেপিই তাঁকে অপসারিত করে। তাঁর প্রতি দলের বিধায়কদের অনাস্থা, ক্ষোভই তাঁর অপসারণের কারণ বলে বলা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে প্রকাশ পেয়েছে। অভিযোগ, ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত যখন ঝাড়খণ্ডে বিজেপির দায়িত্বশীল ছিলেন, সেই সময়, অর্থাৎ ২০১৬ সালে জনৈক অমৃতেশ সিং চৌহান হরেন্দ্র রাওয়াত ও তাঁর স্ত্রী সবিতা রাওয়াতের অ্যাকাউন্টে ২৫ লক্ষ টাকা জমা করেন। এই সবিতা রাওয়াত হলেন ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতের শ্যালিকা। অমৃতেশ সিং চৌহানকে ঝাড়খণ্ডের গৌ-সেবা আয়োগের প্রধান করা হবে, এই সুবিধা পাওয়ার আশ্বাসেই চৌহান ঐ দুই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করেন।
মেশ কুমার শর্মা নামে এক সাংবাদিক ফেসবুকে একটি ভিডিও তুলে দিলে দুর্নীতির এই অভিযোগ সামনে আসে। টাকা জমা করার প্রমাণ হিসেবে উমেশ শর্মা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, কথোপকথনের রেকর্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমার রসিদের প্রতিলিপি দাখিল করেন।
সাংবাদিক উমেশ শর্মা এই অভিযোগ আনলে অমৃতেশ সিং চৌহানের জমা করা টাকায় যাঁরা লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ, তাদের অন্যতম হরেন্দ্র রাওয়াত পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করে বলেন, উমেশ শর্মার অভিযোগ মিথ্যা এবং মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতের সঙ্গে তাঁর কোনো আত্মীয়তা নেই।
মামলাটি উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে যায়। হাইকোর্ট উমেশ শর্মার বিরুদ্ধে এফআইআর খারিজ করে দিয়ে অভিযোগের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। বিচারপতি তাঁর রায়ে বলেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রকৃতি বিচার করে এই আদালত মনে করে যে সত্যের উদঘাটনই যথাযথ হবে।” রায়ে আরো বলা হয়, “রাজ্যের স্বার্থেই সংশয় পরিষ্কার হওয়া দরকার।”
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, লক্ষ্মৌয় তৈরি হচ্ছিল সুপার স্পেশালিটি ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গত বছরের ২০ অক্টোবর হাসপাতালের উদ্বোধন হয়। হাসপাতাল তৈরি হতে গেলে তো বেড থেকে আরম্ভ করে প্রচুর সামগ্ৰী কেনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সমস্ত সামগ্ৰী কেনায় স্বচ্ছতা যদি না থাকে? সামগ্ৰীর দাম যদি প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়? গত ১৭ ফেব্রুয়ারি যোগী সরকারের কাছে প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের দেওয়া রিপোর্টে এরকমটাই প্রকাশ পেয়েছে। অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের রিপোর্টে প্রতিফলিত প্রকৃত দাম আর দেখানো দামের মধ্যে ফারাকের দিকে চোখ বোলানো যাক:
হাসপাতালে ১০০টা ৪২ ইঞ্চি রঙিন টিভি কেনা হয়েছে; এক একটা টিভির আসল দাম যেখানে ৫২০৯৬ টাকা, সেখানে প্রতিটি টিভির দাম দেখানো হয়েছে ১.২ লক্ষ টাকা। বেড কেনা হয়েছে ১০০টা; বেডের প্রকৃত দাম ৪০৪১৫ টাকা করে হলেও এক একটা বেডের দাম দেখানো হয়েছে ২ লক্ষ টাকা করে। কেনা হয়েছে বেশ কিছু ইনডোর-আউটডোর লাইট ফিক্সচারস; অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের রিপোর্টে ঐ লাইট ফিক্সচারসগুলোর প্রকৃত দাম ১৮.৪ কোটি বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেগুলোর দাম দেখানো হয়েছে ৩৮.৩০ কোটি টাকা।
এই সমস্ত সামগ্ৰী কেনার দায়িত্বে ছিল পিডব্লিউডি দপ্তর। সরকার সেই দপ্তরকেই অভিযোগের তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলে। এই প্রতিবেদন লেখা যখন চলছে, তখনও রিপোর্ট জমা হওয়ার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। এটাকে কর দাতাদের, অর্থাৎ জনগণের টাকার নির্ভেজাল লুট ছাড়া আর কি বা বলা যেতে পারে !
নরেন্দ্র মোদী পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে বলে গেলেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস ও স্ক্যাম একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে বিজেপিরও কি কোনো ছুঁৎমার্গ আছে? পশ্চিম বাংলায় আমরা কি এর ভুরি-ভুরি নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি না? দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্ৰেসের যে নেতাদের বিরুদ্ধে বিজেপি একদিন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখিয়েছিল, আজ তো বিজেপি তাদের দুহাতে বরণ করছে! এখানে দুর্নীতির যে অভিযোগগুলো উল্লিখিত হল, মোদী সরকার সেগুলোর পিছনে সত্যের উন্মোচনে আগ্ৰহ দেখিয়ে তদন্তের নির্দেশ কি দেবে? সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বলে এই অভিযোগগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলে জোরের সাথে তদন্তের দাবি তোলার পথেই আমাদের যেতে হবে। নরেন্দ্র মোদীর থ্রি-ডি প্রচারে বাস যোগান দেওয়ার বিনিময়ে সিদ্ধি বিনায়ক লজিস্টিকস লিমিটেড বিপুল পরিমাণ ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধকে এড়িয়ে গেল কেন, তার জবাবদিহিও নরেন্দ্র মোদীর কাছে দাবি করতে হবে। নরেন্দ্র মোদী সরকারই ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্প চালু করে কর্পোরেটদের কাছ থেকে, বিদেশী সংস্থা থেকে অস্বচ্ছ পথে বড়-বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কালো টাকা গ্ৰহণকে আইনি সুরক্ষা যুগিয়েছে। এর মধ্যে কর্পোরেটদের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার একটা ব্যবস্থা কেউ যদি খুঁজে পান তাকে বোধহয় খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না।
২০১৮ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত ১৫ দফায় ৬৫৩৫ কোটি টাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঁড়ারে জমা পড়েছে, যার সিংহ ভাগ, ৬০ শতাংশেরও বেশি গেছে বিজেপির কাছে। শাসকদের দুর্নীতি আগেও ছিল। কিন্তু নয়া উদারবাদী অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রটাকে ধরে লুটপাটের যে সংস্কৃতি ফুলেফেঁপে উঠেছে, শাসক শ্রেণীর কোনো দলই তার ছোঁয়াচ থেকে মুক্ত নয়। ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্প সাক্ষ্য দিচ্ছে, বিজেপি ঐ লুটের সবচেয়ে বড় অংশীদার।
যোগীরাজ্যে আবার কিশোরী হত্যা। পিলভিটে ইট-ভাটা শ্রমিকের দুই কন্যা সন্ধ্যায় গিয়েছিল কাছের একটি মাঠে। আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাদের। ফিরেছে তাদের মৃতদেহ। দু’জনেরই গলায় রয়েছে ক্ষতচিহ্ন। পুলিশ যথারীতি জানিয়েছে, ধর্ষণ কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। যতটা বিলম্ব করে ধর্ষকদের বাঁচিয়ে দেওয়া যায়!
যিনি নিজের রাজ্যকে ধর্ষকদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলেছেন যেখানে প্রতিদিন নারীমেধ যজ্ঞে তার প্রশাসন আহুতি দিয়ে চলেছে, সেই তিনি যখন বাংলায় এসে নারীসুরক্ষা নিয়ে কথা বলেন তখন তার চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে!
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর, দায়িত্বভার নেওয়ার পরই নজর গেল মেয়েদের ফাটা জিনস-এর দিকে! তার প্রশ্নের যাথার্থ্য থাকতেই পারে না, যতক্ষণ নাগপুরের খাকীওলাদের উরু ও হাঁটু প্রদর্শন অব্যাহত থাকছে। কই, তারা তো ভুলেও প্রশ্ন করেন না, হতদরিদ্র নারীকে কেন শতচ্ছিন্ন বস্ত্রে আব্রু রক্ষা করতে হবে আজও, স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরেও? কেন তাকে প্রাকৃতিক কাজ সারতে মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গলে যেতে হবে? যেখানে নরপিশাচরা তার দেহটা ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে ওঁত পেতে থাকে? কেন সে জলের বন্দোবস্ত সহ পাকা শৌচাগার পাবে না? কেন তার বাছা অপুষ্টি অনাহারে পাঁচটা বছরও পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না? কেন অপুষ্টির শিকার প্রসূতি মাকে গর্ভস্থ সন্তানের মুখ না দেখেই মরতে হবে? কেন নাবালিকা মেয়েটিকে পুতুলখেলার বয়েসে বিয়ে দিতে বাধ্য হবে তার গরিব মা-বাপ? কেন স্কুল-ছুট নাবালক তার অপটু কচি শরীরটা নিয়ে কাজ খুঁজে ফিরবে এখানে ওখানে?
এই সব প্রশ্ন আপনাদের মনে কখনও জাগবে না! এগুলো আপনারা শুনতেও নারাজ। কিন্তু কোভিড-উত্তর পৃথিবী আজ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই বেহাল দশা দেখে হতবাক। ২০২০তে কোভিড কালে দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ বছরের নীচে শিশুমৃত্যু বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ভারতে, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুসংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এ দেশে। যেহেতু কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য পরিষেবা চূড়ান্ত ব্যাহত হয়েছে। রাষ্ট্র সঙ্ঘের রিপোর্ট বলছে।
‘দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক রিপোর্ট তৈরি করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড। সেখানে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১২০ লক্ষেরও বেশি যার মধ্যে ভারতেই সর্বাধিক, ১০৯ লক্ষ ছাড়িয়েছে। রিপোর্টে ৬টি জনবহুল দেশ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল আফগানিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার শিশু ও প্রসূতি-স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে অতিমারির ভয়াবহ প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।
এ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড-১৯ -এর পরীক্ষা ও কোভিড-মৃতদের অন্তিম সৎকার ইত্যাদি বাবদ ২.৪ বিলিয়ন ইউএসডি-র বেশি খরচ হয়েছে যার সিংহভাগই ভারতের। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, কোভিড পরীক্ষা, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের চালু ব্যবস্থা সত্ত্বেও অক্টোবর, ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর, ২০২১’র মধ্যে কোভিড-আক্রান্ত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আরও পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হতে পারে যার বেশির ভাগটাই ঘটতে পারে ভারতে (অনুমিত সংখ্যা, ৪৯১,১১৭)। সংক্রমণ প্রশমণের সমস্ত ব্যবস্থা, যেমন সময়োপযোগী সঠিক মাত্রার লকডাউন, হাতের পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক ব্যবহার - কঠোরভাবে কার্যকর থাকলে ভারতে কোভিড-মৃত্যুর এই সংখ্যা ৮৩% কমানো যেত এবং তখন সংখ্যাটা নেমে আসতো ৮৫,৮২১-এ।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর জন্য যৌন, প্রজননগত, মাতৃত্ব ও নবজাতকের পরিচর্যা ভীষণভাবে ব্যাহত হওয়ায় প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর উপর তা বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। ২০২০-তে দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ বছর ও তার কম বয়সী শিশুমৃত্যু আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে মোট ২২৮,৬৪১টি; ভারতে সর্বোচ্চ-১৫৪,০২০ (১৫%); পাকিস্তান-৫৯,২৫১ (১৪%)। দক্ষিণ এশিয়ায় মৃত শিশু প্রসবের ঘটনাও বাড়বে বলেই আশঙ্কা, মোট অনুমিত বৃদ্ধি-৮৯,৪৩৪; এর মধ্যে ভারতে অনুমিত বৃদ্ধি-৬০,১৭৯ (১০%)-সর্বোচ্চ; পাকিস্তান-১১%; বাংলাদেশ-৩%; অতিমারির ২০২০তে ভারতে প্রসূতি মৃত্যুর অনুমিত বৃদ্ধিও সর্বোচ্চ-৭,৭৫০ (১৮%); পাকিস্তান-২০৬৯ (২১%); অতিমারি পর্যায়ে আধুনিক গর্ভনিরোধক ব্যবস্থার সুযোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় অতিরিক্ত ৩৫ লক্ষ অনিচ্ছুক গর্ভধারণের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ভারতেই অনুমিত বৃদ্ধির সংখ্যা প্রায় ৩০লক্ষ (সর্বোচ্চ); ২০২০তে দক্ষিণ এশিয়ায় ১৫-১৯ বছর বয়সী প্রসূতিমৃত্যুর অনুমিত বৃদ্ধি সংখ্যা-১১৯১; ভারতে-৬৪৩ (সর্বোচ্চ); অতিমারিতে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডস-এর মতো সংক্রামক রোগগুলির চিকিৎসা পরিষেবা অপ্রতুল থাকায়, এসব অসুখে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মৃত্যুও বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বৃদ্ধি-৫৯৪৩ (অনুমিত); ভারতে-৩৪১২; অতিমারিতে পথ-দুর্ঘটনায় বয়ঃসন্ধিকালীন মৃত্যুর সংখ্যা অবশ্য আগের বছরের তুলনায় কমেছে। ভারতে হ্রাসের সংখ্যা সর্বোচ্চ-৪১৪৫; অতিমারি পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায়, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৯০ লক্ষ ছেলে মেয়ে স্থায়ীভাব স্কুল-ছুট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা; ভারতে সংখ্যাটা প্রায় ৭০ লক্ষ।
রিপোর্ট বলছে এই ব্যাপক সংখ্যক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা থেকে চির-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতেও। এইসব ছেলে মেয়েদের নিম্ন মানের শিক্ষার জন্য তাদের ভবিষ্যৎ জীবিকায় আয় কমবে ১৫-২৩%; দক্ষিণ এশিয়ায় আগামী ৪৫ বছরে যে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; ভারতে সেই ক্ষতির পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ- ৫২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বাংলাদেশ-৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; শ্রীলঙ্কা-১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু’র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা পুনম ক্ষেত্রেপাল সিং বলেছেন, হু-র কোভিড মোকাবিলা প্রচেষ্টার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল-অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে অব্যাহত অক্ষুণ্ণ রাখা। যেসব জাতীয় স্তরের নেতারা, কোভিড-এর আসন্ন দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সচেতন করার পরিবর্তে নির্বাচনী সভায় কুৎসিততম ভাষায় পরস্পরকে কাদা ছুঁড়তে ব্যস্ত তারা কি চূড়ান্ত অবহেলিত ক্ষতিগ্রস্ত এই শৈশব কৈশোরে কথা একটু ভাববেন!
না, সে সময় তাদের নেই! তাহলে কি আর প্রত্যেক দিন বোমা গুলি ছুরিতে ‘খেলা’র বলি হতে হয় শিশু-কিশোর-যুবকদের!
(সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ১৮ মার্চ, ২০২১ )
ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকাকালীন ১০২ বছরের বৃদ্ধ চন্দ্রধর দাস কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেছিলেন, বাথরুমে যাওয়ার জন্য, কিছু খাওয়ার জন্য তার সাহায্যের দরকার হত। কিন্তু ক্যাম্পে তাকে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতো না। বারবার তিনি বলতেন, ‘কোনো বৃদ্ধলোককে যেন ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো না হয়!’ ১০২ বছরের বৃদ্ধকে যারা ডিটেনশন ক্যাম্পে ছুঁড়ে ফেলতে পারে, ‘তারাই এই মানব সভ্যতার কলঙ্ক!’....
তবে তিনি ছিলেন দৃঢ় বিশ্বাসী – তিনি জাতিতে হিন্দু ও ভারতবর্ষ তাঁর দেশ। একদিন প্রমাণ হবেই তিনি ভারতীয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিনি বাবা বলে সম্বোধন করতেন। ক্যাম্পে অসহনীয় যাপনের পরও তিনি বলতেন মোদি আছেন বলেই আমি খাবার পাচ্ছি। জীবনে এতো দুঃখ কষ্টের মুহূর্ত কাটানোর পরও তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল যে একদিন তাঁর মহাপুরুষসম মোদিজির ক্যারিশমায় তিনি ভারতীয় প্রমাণিত হবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল সেরকম কিছুই ঘটেনি। চন্দ্রধর দাস অবচেতন মনে একটি কথা বারবার বলতেন, ‘আমার কাছে ৩০টি ভোট আছে। আমি মোদিকে সব ভোট দেবো’। গেল ১৪ই ডিসেম্বর ২০২০ সালে চন্দ্রধর দাস বিদেশি তকমা নিয়েই ইহ-সংসার ত্যাগ করেন।
[কমল চক্রবর্তীর লেখা “আসামে নাগরিকত্ব হরণের দহনলিপি” বই থেকে উদ্ধৃত একটি অংশ। এই অংশটি অনেক কথা বলে যায়।]
যে কোনও রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইস্তাহারে পরিবেশ একটি ফুটনোট ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ বেলাগাম উন্নয়নের ফলে এবং এলাকার পরিবেশ উপেক্ষা করার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। হিমালয়ের ভঙ্গুর এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর পরিবেশে এলাকার বাসিন্দা এবং পরিবেশবিদদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ হয়েছে। ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এর পরিণামে সম্প্রতি উত্তরাখন্ডের চামেলি জেলায় হিমবাহ ভেঙে বিশাল প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। লকডাউনের সময় বিশাখাপত্তনমে স্টাইরিন গ্যাস লিক করে মানুষ মারা গেলেন। পরে জানা গেল যে কারখানাটি থেকে গ্যাস লিক হয়েছে সেটির পরিবেশের কোনও ছাড়পত্রই নেই। একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি রাজ্যে ৪১টি কয়লা ব্লক নিলাম করলেন যার মধ্যে ১৪টি ব্লক গভীর অরণ্য এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যর কারণে নো-গো অঞ্চল(অর্থাৎ যে এলাকাগুলিতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এমন কিছু করা যাবে না)। এর মধ্যে দু’টি অঞ্চল ভার্জিন ফরেস্ট, অর্থাৎ বিশুদ্ধ অরণ্য হিসাবে গণ্য করা হয়। অতীতে জোনগুলিতে খননের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও তা বাতিল হয়ে গেছে। তবুও খোদ প্রধানমন্ত্রী একই অঞ্চলে নতুন প্রকল্পের অনুমতি দিয়েছেন। এর থেকে বোঝা যায় পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলি পুরো উদাসীন।
নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত বিভিন্ন পার্টির ইস্তাহারে পরিবেশের নামমাত্র উল্লেখ রয়েছে, কিংবা কোনও উল্লেখই নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারের সূচীপত্রে ১০টি বিষয়ের উল্লেখ আছে – অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায় ও সুরক্ষা, যুব, খাদ্য, কৃষিকাজ ও কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, বিদ্যুৎ রাস্তা ও জল – পরিবেশের কোনো নামগন্ধ নেই। অথচ নদীগুলি থেকে নির্বিচারে বালি খনন, রাণিগঞ্জ অঞ্চলে কয়লা খনন, বেলাগাম জলাভূমি ভরাট করা এবং বায়ু ও শব্দ দূষণের কারণে মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, পরিবেশ প্রবল ভাবে বিপন্ন।
বিজেপি’র ইস্তাহারে ঘাটাল, কান্দি এবং উত্তরবঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণের তথাকথিত মাস্টারপ্ল্যানের উল্লেখ আছে। আর ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে বরানগর, বালি এবং হাওড়ার কাজের উল্লেখ আছে। ‘নমামি গঙ্গে’ একটা বিরাট ধাপ্পা! গঙ্গাকে পরিষ্কার ও অবিরল রাখা যদি সত্যি অগ্রাধিকার পেতো, তাহলে হিমালয় জুড়ে যত্রতত্র বাঁধ, পাকা রাস্তা বানানো বন্ধ হতো। বিজেপি ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের কথা আওড়ায়, ওদিকে গঙ্গাকে রক্ষা করার জন্য হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমে একের পর এক সর্বত্যাগি সাধু বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করার জন্য অনশন করে আত্মত্যাগ করছেন – স্বামী নিগমানন্দ, অধ্যাপক জিডি আগরওয়াল, যিনি সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের প্রথম মেম্বার-সেক্রেটারি ছিলেন। স্বামী আত্মবোধনন্দজীর অনশন চলাকালীন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে আশ্রম প্রধান স্বামী শিবানন্দজী ১৪ মার্চ থেকে অনশন করছেন।
বামফ্রন্টের ইস্তাহারে পরিবেশ অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পনেরো পাতার এই ছোট পুস্তিকাটিতে দশ নম্বর পাতায় পরিবেশের ওপর একটি অনুচ্ছেদ আছে। এতে জীববৈচিত্র্য, জলাশয় জলাভূমি, ইকোলজি রক্ষা ও অরণ্যভূমি রক্ষা ও বিস্তারের কথা বলা হয়েছে। নিষ্কাশিত বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে এবং যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্লাস্টিক ব্যবহারে জনচেতনা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, সৌর শক্তির ব্যবহার এবং জল সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সামাজিক বনসৃজনে উৎসাহ দেওয়ার কথা আছে। সব ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং মানুষকে পরিবেশ রক্ষায় যুক্ত করার সংকল্প আছে। এটা অনস্বীকার্য যে অন্য দলগুলির তুলনায় অন্তত খাতায় কলমে পরিবেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বেশি।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ইদানিংকালে পরিবেশ সংক্রান্ত সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়, ইআইএ (এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট), খসড়া বিজ্ঞপ্তি, ২০২০ সম্পর্কে তাঁরা কোনও মন্তব্য করেননি। ‘একুশের ডাক মানুষের দাবি’ যা একটি নাগরিক কনভেনশনে আলোচনার মাধ্যমে নির্মিত তাতে এই বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। একুশের ডাক মানুষের দাবিতে পরিবেশ নিয়ে এক পাতা জুড়ে আলোচনা রয়েছে যার সর্বাগ্রে রয়েছে ইআইএ খসড়া বিজ্ঞপ্তি বাতিল করার ডাক। কনভেনশনে এই খসড়া বিজ্ঞপ্তি বাতিল করার দাবি জানানো হয় কারণ এটা “পরিবেশের প্রশ্নকেই তামাদি করে দিতে চায়”। যদিও কীভাবে তামাদি হচ্ছে সেটার কোনও ব্যাখ্যা নেই।
ইআইএ ২০০৬তে কোনও অঞ্চলে প্রকল্প নির্মাণের আগে সেখানকার মানুষদের সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এরজন্য গ্রাম সংসদ ডেকে মতামত নেওয়া হতো। নিয়মগিরিতে বারোটি গ্রাম সভা সম্মতি না দেওয়াতে বেদান্তর প্রজেক্ট খারিজ হয়ে গেছিল। ২০২০-র খসড়াতে এই নিয়ম লঘু করে দেওয়া হয়েছে। আগে গ্রামসভার শুনানির জন্য ৩০ দিন দেওয়া হতো, সেটা কমিয়ে ২০ দিন করে দেওয়া হয়েছে। এইসব প্রজেক্ট প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। এই কারণে সময় কমিয়ে দেওয়ার অর্থ, কম মানুষের শুনানিতে অংশগ্রহণ করা। এটা কোম্পানির মালিকের পক্ষে সম্মতি আদায় করা সুবিধাজনক করে দিয়েছে। একটি বিস্ময়কর শর্ত হচ্ছে কোনো কারখানা দূষণ ছড়ালে এলাকার মানুষ সেটার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারবে না! নাগরিক সমাজ, এনজিও, পরিবেশবিদরাও অভিযোগ জানাতে পারবে না। একমাত্র মালিক বা কোনও সরকারী সংস্থা যারা সমীক্ষা বা মূল্যায়ন করে তারা যদি নিজেরা সরকারকে জানায় যে দূষণ হচ্ছে, গ্যাস লিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বর্জ্য জমিতে পড়ে উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি, তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে! মালিক, বা তার তাঁবেদার সরকারী সংস্থা, কখনো নিজেদের গাফিলতির কথা আগ বাড়িয়ে সরকারকে জানাবে? এর অর্থ কোনও এলাকায় দূষণ ঘটলে বাসিন্দাদের মালিক বা নির্দিষ্ট সরকারী সংস্থার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। তারা সমস্যার সুরাহার ব্যবস্থা না করলে তাঁদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে।
এছাড়া বহু দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পকে পরিবেশ মন্ত্রক বা পর্ষদের অনুমতি নেওয়ার আর কোনও প্রয়োজনই নেই। যেমন- ছোট, মাঝারি সিমেন্টের কারখানা, খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন, ওষুধের বড় কারখানা, হাইওয়ে চওড়া বা দীর্ঘায়িত করা (২৫-১০০ কিমি), কয়লা এবং অন্য জ্বালানির তল্লাশ ইত্যাদি। আমরা জানি যে বীরভুমের দেউচা-পাঁচামিতে কয়লার খোঁজ পাওয়া গেছে। নতুন ইআইএ অনুযায়ী এই প্রকল্প শুরু করার জন্য এলাকার বাসিন্দাদের সাথে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। কোন প্রকল্প শুরু করার আগে ইআইএ করতে হবে বা পরিবেশ সংক্রান্ত অনুমতি নিতে হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা আর নতুন খসড়া অনুযায়ী থাকবে না। যুক্তি হল কাজে গতি আনতে হবে, কবে অনুমতি মিলবে তার জন্য কি শিল্প বসে থাকবে? ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস!’ চটজলদি যাতে কাজ হয় তার জন্য শিল্পপতিদের সর্বাত্মক ভাবে সাহায্য করতে হবে। চুলোয় যাক পরিবেশ!
কোনো প্রকল্প সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। ২৫%-এর অধিক করতে হলে ইআইএ করতে হবে, ৫০%-এর অধিক হলে জনতার শুনানির ব্যবস্থা করতে হবে। এই ক্ষেত্রেও জনতার সম্মতির গুরুত্বকে লঘু করা হয়েছে। কমপ্লায়েন্স অর্থাৎ কাজ সন্তোষজনক হচ্ছে কি না সেটার ওপর নজরদারিও শিথিল করা হয়েছে। আগে বছরে দুটো রিপোর্ট দিতে হতো, এখন সেটা একবার দিলেই হবে।
সরকারের মোদ্দা কথা পরিবেশ রক্ষার এতো সব আইন করার ফলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষতি হচ্ছে। ইদানিং কালের আরও অনেক আইনের মতো শিল্পপতিদের লাগামছাড়া সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই এই ইআইএ খসড়া রচিত হয়েছে। এতে জল-জঙ্গল-জমীন উজাড় হয়ে যাবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে আদিবাসীরা, জমিহীন, বাস্তুহীন, নিঃস্ব হয়ে পড়বে। এই ইআইএ বর্জন করার ডাক তোলা আবশ্যিক। এটা আশ্চর্যজনক যে পরিবেশের ওপর প্রভাব যাচাই করার জনবিরোধি এই প্রস্তাবিত খসড়া সম্পর্কে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির কোনো হেলদোল নেই।
- সোমনাথ গুহ
মানুষের মধ্যে কাজ করে মানুষের মন জয় করে জননেতা হয়ে উঠেছিলেন মধ্য কলকাতা নিবাসী মুকুর সর্বাধিকারী। এবছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। তাঁর জন্ম ১৯২১ সালে। তিনি প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯০ সালে। তাঁর শুভানুধ্যায়ী কজন মিলে তাঁর জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের শুভসূচনা করলেন গত ২২ মার্চ কলকতা কফি হাউসের ওপর তলায় “বই-চিত্র” সভাঘরে। ভাবগম্ভীর পরিবেশে অনেকেই স্মৃতিচারণ করলেন নানা দিক থেকে। উদ্যোক্তাদের পক্ষে আলোচনার মুখ খোলেন পবিত্র কুমার সরকার। বিদ্যাসাগর চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি বলেন বিদ্যাসাগর ও সর্বাধিকারী পরিবারের আন্তসম্বন্ধ বিষয়ে। স্মৃতিচারণ করেন কালান্তর সহ সম্পাদক ও শ্রমিক নেত্রী সোনালী বিশ্বাস, প্রখ্যাত ক্যান্সার চিকিৎসক ডাঃ শংকর নাথ, মুকুর সর্বাধিকারী প্রতিষ্ঠিত ডিরোজিও স্মরণ সমিতির স্বর্ণময় মুখোপাধ্যায়, “প্রচেষ্টা” সংস্থার পবন মুখোপাধ্যায়, প্রতিবেশী জয়শ্রী সরকার, বাসুদেব লাহিড়ী এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষে অনিমেষ চক্রবর্তী। বক্তাদের বক্তব্য থেকে মুকুর সর্বাধিকারীর জীবন ইতিহাসের বহু শিক্ষামূলক দিক উঠে আসে, বিশেষত আজকের পশ্চিমবাংলায় ফ্যাসিবাদী শক্তি যখন দখল নিতে আগ্রাসী হচ্ছে তখন তাঁর জীবন থেকে পাওয়া মূল্যবোধকে মানবসমাজে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা সামনে আসে। সঙ্গীত পরিবেশন করেন অরণি খ্যাত অমিতেশ সরকার। কর্মসূচীগত প্রস্তাব রাখেন বিজন মৈত্র। জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখেন পবিত্র কুমার সরকার এবং সেই ভিত্তিতে গঠন হয়েছে কমিটি, স্থির হয়েছে পরবর্তীতে নানা জায়গায় নানাভাবে শতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচী নেওয়া হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্নিগ্ধা সেন।
আজকের প্রজন্মের কাছে বিপ্লবী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠক মুকুর সর্বাধিকারীকে পরিচিত করাতে হবে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। এক শিক্ষিত ও সম্পন্ন পরিবারের সুসন্তান। তাঁর পিতা নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের জনক। পিতামহ ছিলেন ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনের ডীন। তুতো এক দাদা বেরী সর্বাধিকারী ছিলেন ষাটের দশকে খেলার ইংরাজিতে ধারাবিবরণীর প্রখ্যাত ভাষ্যকার। কিন্তু মুকুর সর্বাধিকারী কোনোদিন বংশকৌলীন্য প্রকাশ করতেন না। তাঁর জীবন বয়েছে অন্য খাতে। ১৯৫৫ সাল থেকে গোয়ার মুক্তি আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। তারপরে ১৯৫৬ সালে বাংলা-বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬০-এর দশক থেকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিন উদযাপন, কবিকে সম্বর্ধনা দেওয়ার রীতি প্রচলন করা, ১৯৬৯ সালে পার্ক সার্কাসে সমাধিস্থলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিফলক স্থাপন, বিনয়-বাদল-দিনেশ বাগ নামকরণের প্রস্তাব উত্থাপন করা, ডিরোজিও স্মরণ সমিতি গঠন, প্রেসিডেন্সী কলেজের বেকার হলের ডিরোজিও নামকরণ; এরকম বহু কাজে বিরামহীন বলিষ্ঠ উদ্যোগী কর্মযোগী পুরুষ ছিলেন মুকুর সর্বাধিকারী। সমঝদার ছিলেন শিল্পকলা-সাহিত্য ও ধ্রুপদী সঙ্গীতের, প্রবল উৎসাহী ছিলেন খেলাধূলোর। সখ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ক্রিকেটার মুস্তাক আলির সঙ্গে।
মধ্য কলকাতার ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের মোট ১৩ বছর যাবত কাউন্সিলর ছিলেন তিনি। প্রাচী সিনেমা হলের অদূরে ১৩-সি ফরডাইস লেনে একটা চৌকি পাতা এক কামরা ঘরে থাকতেন একা, এবং আহার সারতেন নিজের হাতে তৈরী খাবারে, হাত পাখা ছিল সম্বল। স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাতা গ্রহণ করেননি। এমন কষ্টকর জীবন কাটানোর বিরল জনপ্রতিনিধির দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
১৯৬৯ সালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আসে বিপ্লবী পরিবর্তন। যতদিন কাউন্সিলর ছিলেন সেই পদের ভূমিকাকে বরাবর ব্যবহার করেছেন জনমুখী সংগ্রাম ও সংস্কারের স্বার্থে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাবে তিনি কাউন্সিলরের পদ ত্যাগ করে বিপ্লবী অন্বেষণে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবী যুবছাত্রদের সংযোগ সেতু। তাঁর ঘর ছিল যুব কর্মীদের গোপন ডেরা। সেই সন্দেহে পুলিশ তাঁকে ১৯৭২ সালে গ্রেপ্তার করে, লালবাজার লক আপে প্রচন্ড অত্যাচার করে, কারাবন্দী করে রাখে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭।
১৯৭৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে তিনি যে কোনো কারণে হোক রাজনৈতিক জীবনে আর ফিরতে পারেননি, তবে নানা প্রগতিশীল উদ্যোগে আগের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপরে আরও তেরটি বছর বেঁচে ছিলেন। যতদিন বেঁচেছেন মানুষের পাশে থেকেছেন। আজীবন নিরহঙ্কারী থাকা ও পরার্থে নিরলস কাজ করে যাওয়া মুকুর সর্বাধিকারীর কথাকাহিনী অবশ্যই জনারণ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দাবি রাখে।