আজকের দেশব্রতী : ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
11 Februarymoulaliconvention

“একুশের ডাক, মানুষের দাবি – নাগরিক কনভেনশন” শীর্ষক এক মঞ্চ ৮ ফেব্রুয়ারী মৌলালী যুবকেন্দ্রে এক কনভেনশন আয়োজন করে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা কৌশিক সেন, রাজনৈতিক নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সংগীতশিল্পী মৌসুমী ভৌমিক, শিক্ষাবিদ কুমার রানা, দলিত সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী, অধ্যাপক মেরুনা মুর্মু, নাট্যকার-পরিচালক তীর্থঙ্কর চন্দ, সমর বাগচী সহ বিভিন্ন বিশিষ্টজন। কনভেনশন শুরু হয় অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্বোধনী সঙ্গীতের মাধ্যমে। কৃষক আন্দোলনের শহীদ, লকডাউনে মৃত শ্রমিক ও উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে মৃতদের স্মরণ করে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সনৎ রায় চৌধুরী। কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্য সংক্ষেপে তুলে ধরে দাবিসনদ পেশ করেন কুমার রাণা। কনভেনশনের মূল প্রস্তাব পাঠ করেন শামিম আহমেদ।

সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর আলোচনায় বলেন, “২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি’র অমিত শাহ্‌ বলেছিলেন আমরা ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকব, এই ভাবনা ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বিপদজ্জনক। বর্তমানে সারা দেশে কাজের অভাব, খাদ্যের অভাবের মধ্যে সরকার প্রতিনিয়ত বেসরকারীকরণ করে যাচ্ছে, এর ফলে সারা দেশে পুনরায় কোম্পানি রাজ শুরু হচ্ছে। আম্বানি-আদানিরা হচ্ছে স্বাধীন ভারতের নতুন কোম্পানি।” তিনি বলেন, “সংবিধানে সাধারণ মানুষের ভোট দেয়ার অধিকার রয়েছে, কিন্তু সেই ভোট দানের অধিকারকেও বারবার ক্ষুণ্ণ করে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে মানুষের দাবি, মানুষের কথা, মানুষের অধিকার বাদ দিয়ে শুধুমাত্র টাকা ও ক্ষমতার জোর দেখিয়ে সেই ক্ষমতাতেই টিকে থাকার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমরা লক্ষ করেছি আমেরিকায় ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পরেও ক্রমাগত নানারকমের বিদ্বেষমূলক কাজকর্ম করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি সেখানকার মানুষ, মিডিয়া’র সম্মিলিত প্রতিবাদের জন্য। আমাদের দেশেও সেইরকমভাবে প্রতিবাদ করে ফ্যাসিস্তদের হটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”

কৃষক আন্দোলন ও বিহারের নির্বাচন প্রসঙ্গে দীপঙ্কর বলেন, “বিহারে আমরা অল্পের জন্য বিজেপিকে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু বর্তমানে বিহারে একটি দুর্বল সরকার এবং একটি শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। বিহারে আমাদের আন্দোলন বা নির্বাচনে সাফল্য একদিনে হয়নি, আমরা ক্রমাগত মার খেয়েছি, আমাদের কমরেডরা শহিদ হয়েছেন, কিন্তু আমরা কখনও-ই লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাইনি, তাই আজ আমাদের এই সামান্য সাফল্য। বিজেপি সরকার নানা জায়গায় সাংসদ-বিধায়ক কিনে বেড়ালেও কৃষকদের এখনও কেনার সাহস দেখাতে পারেননি। সুতরাং বুঝতে হবে কৃষকদের এই আন্দোলন-ই আমাদের এই মুহূর্তে পথ দেখাতে পারে!”

কনভেনশন মঞ্চ থেকে ১০টি দাবি সনদ প্রস্তাব করা হয় এদিন। তার সপক্ষে আলোচনা করেন মেরুনা মুর্মু। তিনি বলেন, “ভোট এলেই একগুচ্ছ ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করা হয়, তারপর সেসবের কোনও খবর থাকে না। একজন আদিবাসী হিসেবে এই কথাগুলি বলা খুব প্রয়োজন যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের উপর যে আঘাত নামিয়ে আনছে এতে করে আগামী দিনে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিই নষ্ট হয়ে যাবে। উন্নয়নের নামে ক্রমাগত বন ধ্বংস করে সেখানকার মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিরও বিশাল ক্ষতিসাধন চলছে। এই আগ্রাসন বন্ধ হওয়া উচিৎ।”

convention

 

কনভেনশনে গৃহীত ১০টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, বিজেপি সরকারের তৈরি তিনটি কৃষি আইন বাতিল, বিদ্যুৎ বিল ২০২০ প্রত্যাহার, শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া শ্রম আইন বাতিল, ন্যূনতম মজুরি ৭০০টাকা করা, বিরোধী মতের উপরে আক্রমণ বন্ধ করা, এনআরসি রদ করা, মানুষের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি প্রদান, সরকারী সংস্থা বিক্রি বন্ধ করা, নতুন শিক্ষানীতি আইন ২০২০ বাতিল করা ইত্যাদি। এছাড়া আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দল যেভাবে বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চাইছে, সেই প্রয়াসকে বয়কট করে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আবেদন জানানো হয় সকলকে।

এদিনের সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষে সামিরুল ইসলাম বলেন, “আরএসএস যেভাবে গ্রামে কাজ করছে, আমাদের আর-ও জোরদারভাবে কাজ করতে হবে। না হলে বাংলার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের গ্রাম থেকে শহরে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ক্রমাগত লড়াই করে যেতে হবে।”

ভাষণ পর্ব শেষে সংগীত পরিবেশন করেন মৌসুমী ভৌমিক, অভিজিৎ বসু ও পল্লব কীর্তনিয়া। কনভেনশনের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠান সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

আগামী ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা ভাষা রক্ষা, গণতন্ত্র রক্ষা, আসন্ন নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া গ্রহণসহ বাংলার সংস্কৃতিকে যেভাবে বিষাক্ত করে দেওয়া হচ্ছে তার প্রতিবাদে শহর কলকাতার বুকে এক মিছিলের আহ্বান জানানো হয়েছে মঞ্চের তরফ থেকে।

রাজনৈতিক দলগুলির দৈনন্দিন প্রচারের বাইরে সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধিদের আহূত এই কনভেনশনের বৈশিষ্ট্য ছিল, এঁদের আহ্বায়কবৃন্দের পরিচিতি, যাঁদের অধিকাংশই রাজনীতির মানুষ হিসেবে পরিচিত নন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে সকলে যে যাক মতো করে এককাট্টা হচ্ছেন, এ এক বড় ঘটনা বৈকি! পাওনাও বটে!

- রিপোর্টঃ সৌরব চক্রবর্ত্তী, গুরুচণ্ডালী

resulationDemand

কনভেনশনের মূল প্রস্তাব পাঠ করেন শামিম আহমেদ। ধ্বনিভোটে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই প্রস্তাবে বলা হয় –

১) বিজেপি সরকারের তৈরি সাম্প্রতিক তিনটি কৃষি আইনকে এই কনভেনশন কৃষিজীবী মানুষ ও জনগণের ওপর হামলা বলে মনে করছে। এই আইনগুলি কৃষিজাত উৎপাদনের দাম ঠিক করা থেকে শুরু করে তা যথেচ্ছ জমিয়ে রাখার অধিকার – সবকিছুকেই সরকারের দায় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আনছে এবং তাকে কোম্পানির অধিকারে পরিণত করছে। এর মধ্যে দিয়ে কৃষক হয়ে যাবে কোম্পানির ভাড়াটে এবং রেশন ব্যবস্থা লাটে উঠবে। সর্বনাশা এই কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে যে কৃষক আন্দোলন চলছে, এই কনভেনশন তার প্রতি সংহতি জানিয়ে মনে করছে বাজেট অধিবেশনের মধ্যেই সংসদে এই কৃষি আইনগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যাহার করে নেওয়া দরকার। সেইসঙ্গে এই কনভেনশন বিদ্যুৎ বিল ২০২০ প্রত্যাহারের পক্ষে মত প্রকাশ করছে।

২) এই কনভেনশন শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়া শ্রম আইনগুলি বাতিল করার পক্ষে মত প্রকাশ করছে। যে কোনও কাজে ন্যূনতম দৈনিক ৭০০ টাকা (মাসে ২১০০০ টাকা) মজুরি হওয়া প্রয়োজন বলে এই কনভেনশন মনে করছে।

৩) দেশজুড়ে কৃষক, শ্রমিক, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, গণ আন্দোলনের শক্তি, সাংবাদিক সহ যে কোনও বিরোধী মতের ওপর যেভাবে আক্রমণ নামছে – এই কনভেনশন তার তীব্র নিন্দা করছে। এই কনভেনশন ভীমা কোরেগাঁও ঘটনা, এনআরসি, এনপিআর, সিএএ বিরোধী আন্দোলন, নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ বিরোধী আন্দোলন সহ বিভিন্ন ঘটনায় বন্দী সহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির পক্ষে মত প্রকাশ করছে।

৪) এই কনভেনশন বিভাজন ও ধর্ম জিগিরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইতে জনগণের রুটি রুজি গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিগুলিকে সামনে আনার প্রয়োজন অনুভব করছে। সাংবিধানিক অধিকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইতে নাগরিক সমাজকে সক্রিয় হওয়ার আবেদন জানাচ্ছে।

৫) কনভেনশন সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বাতিলের পক্ষে মত প্রকাশ করছে। দাবি জানাচ্ছে কোনও দেশবাসীর নাগরিকত্ব বা নাগরিক অধিকার নিয়ে প্রশাসনিক হয়রানি চলবে না। সমান নাগরিকত্বের ধারণাকে বদলানোর চেষ্টাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার জন্য কনভেনশন সমস্ত নাগরিকের কাছে আহ্বান রাখছে।

৬) বাজেটে সরকারী কোম্পানি বেচে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে দেশবিক্রির যে নকশা সামনে এসেছে, এই কনভেনশন তার বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হবার আবেদন জানাচ্ছে। ডিজেল, পেট্রোল, রান্নার গ্যাসের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং কেরোসিন তেলের রেশনিং ব্যবস্থাকে তুলে দেবার প্রতিবাদ করছে এই কনভেনশন।

৭) কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, বেসরকারীকরণ ও পণ্যায়নের দিকে একটা বড় ধাপ। এই কনভেনশন জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ বাতিলের পক্ষে মত প্রকাশ করছে।

৮) পরিবেশের সঙ্কট সভ্যতার সঙ্কট এই কথা মাথায় রেখে EIA ড্রাফট নোটিফিকেশন 2020 বাতিল করার পক্ষে এই কনভেনশন মত প্রকাশ করছে।

৯) গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করার ও বিরোধী কন্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখার বিপজ্জনক প্রবণতার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের সচেতন গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিককে ধারাবাহিকভাবে লড়তে হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দলের রাজ্যে ক্ষমতা দখলের মরিয়া প্রচেষ্টা রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক বাতাবরণকে আরও বিপন্ন করে তুলছে। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনে ও বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ও অধিকার অর্জনের আন্দোলনকে জোরালো করে তুলতে এই কনভেনশন ব্যাপক গণ সংযোগ ও গণ অংশগ্রহণের আবেদন জানাচ্ছে।

১০) ২১ ফেব্রুয়ারী শুধুমাত্র ভাষার অধিকার রক্ষার দিক থেকেই নয়, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বস্ত করার স্বৈরতান্ত্রিক চেষ্টার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ লড়াইয়েরও এক উজ্জ্বল অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বহুস্বরিক গণতান্ত্রিক বাতাবরণকে যেভাবে নষ্ট করার চেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারী কলকাতার বুকে এক শক্তিশালী প্রতিবাদ সভায় সামিল হবার জন্য সমস্ত গণ আন্দোলনের শক্তি ও বিবেকী জনগণের কাছে এই কনভেনশন আবেদন জানাচ্ছে।

দাবিসনদকে সমর্থন করে আজকের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন নির্বাচনে মানুষের দাবিকে সামনে তুলে আনার প্রয়োজনীয়তাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। প্রস্তাবের পক্ষে পরপর আলোচনা করেন সামিরুল ইসলাম, মেরুনা মূর্মূ, অলিক চক্রবর্তী, নব দত্ত, হাফিজ আলম সইরানি, পল্লব কীর্তনিয়া, কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, অভিজিত বসু, স্বপন গাঙ্গুলি, ডাঃ পুন্যব্রত গুণ, মৌসুমি ভৌমিক, অনুরাধা দেব, সুজাত ভদ্র, শরদিন্দু উদ্দীপন ও অশোক বিশ্বনাথন। মৌসুমি অভিজিৎ ও পল্লব তাঁদের গানে সভাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেন। কনভেনশনের সংহতিতে বার্তা পাঠান বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কনভেনশন থেকে আগামী একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবসের দিনে কলকাতায় এক গণ সমাবেশের আহ্বান করা হয়েছে। জনগণের মধ্যে থেকে উঠে আসা দাবিসনদ নিয়ে জনতার মাঝে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে একুশের সমাবেশ সংগঠিত হবে।

যে সমস্ত বিষয়ের ওপর দাবিসনদ তার আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করে, তা এরকম -
১। সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা
২। সকলের জন্য শিক্ষা
৩। সব হাতে কাজ
৪। শ্রমিকের অধিকার
৫। কৃষিব্যবস্থা ও গ্রামের রক্ষা
৬। বন ও বনবসতির বাসিন্দাদের সুরক্ষা
৭। সমান নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা
৮। মানবাধিকারের সুরক্ষা
৯। জনসাধারণের ক্ষমতায়ন ও বিভিন্ন স্তরের স্বায়ত্ত শাসন
১০। সামাজিক ন্যায়, সংহতি ও সমানাধিকার
১১। পরিবেশ ও জীবনের সুরক্ষা
১২। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও বহুভাষিক কৃষ্টিসৃষ্টি

21 FebEkush

১৩ ফেব্রুয়ারী উত্তরপাড়া “গণভবন” সভাঘরে বিকাল ৫ টায় শুরু হবে নাগরিক কনভেনশন। পরদিন সকাল ৯.৩০এ চূঁচুড়া থেকে প্রচারাভিযান শুরু। সকাল ১০.৩০-এ ধনেখালি বিধানসভা কেন্দ্রের বাবনান মোড়ে ও দুপুর ২.৩০-এ ধনেখালি বাসস্ট্যান্ডে জনসভা। এই দুটি সভায় ঋণমুক্তি আন্দোলন এবং আদিবাসী জনগণ ও কৃষক জনগণ অংশ নেবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারী বর্ধমান শহরে ‘সাংস্কৃতিক হল’-এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন পৃষ্ঠভূমির মানুষ ও শহরের বিশিষ্টজন সামিল হয়ে এই সভাকে সফল করে তুলবেন বলে প্রত্যাশা। ১৬ ফেব্রুয়ারী কোনো প্রকাশ্য সভা সংগঠিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ১৭ ফেব্রুয়ারী সকালে সদ্য প্রয়াত কমরেড সুবিমল সেনগুপ্তের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সাথে পার্টি নেতৃত্ব দেখা করতে যাবেন। তারপর বেথুয়াডহরি গঞ্জে দুপুর ১টায় অভিনন্দন লজে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। ঐদিন বিকাল ৫টায় শালীগ্রামের টাওয়ার মোড়ে জনসভা। ১৮ ফেব্রুয়ারী নপাড়া ২ নং অঞ্চলে সোনাতলা মোড়ে বিকাল ৪টায় জনসভা, সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলবে। এই সমস্ত সভাসমিতির প্রধান বক্তা হিসেবে পার্টির সাধারন সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য উপস্থিত থাকবেন। প্রচারাভিযানের দায়িত্বে আছে পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড কার্তিক পাল। জেলাগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক পৃষ্ঠভূমির সংগ্রামী মানুষের অংশ গ্রহণ সুনিশ্চিত করার জন্য আন্তরিক ও উদার মানসিকতায় প্রচেষ্টা চালাতে হবে। “একুশের ডাকঃ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলা রুখে দাঁড়াক” কর্মসূচীতে ২১ ফেব্রুয়ারী কলকাতায় গণ জমায়েত সংগঠিত করার পূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করার আবেদন জানাচ্ছে পার্টির রাজ্য কমিটি। সাথে সাথে বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ জোরদারভাবে শুরু করতে হবে।

February 21Call

ঊনসত্তর বছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষার জন্য ঢাকায় প্রাণ দিয়েছিলেন রফিউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিকুর রহমানরা। মাত্র সাড়ে চার বছর আগে দেশ ভাগ হয়েছে। দেশভাগে ভাগ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলা, ভগৎ সিং-এর পাঞ্জাব। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে আলাদা দেশ পাকিস্তান – তার এক প্রান্ত ভারতের পূর্বে, অন্য প্রান্ত হাজার মাইল পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমে। এক দেশের দুই প্রান্তের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিল ভাষা, সংস্কৃতি, আবেগ ও চেতনার দূরত্ব। পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের দাদাগিরি, বাংলা ভাষার উপর সরকারী উর্দু ভাষার আরোপিত আধিপত্য। বাংলা ভাষার সম্মান ও অধিকারের জন্য বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে ঝরা সেই রক্ত থেকেই ভাষা দিবস। আর দু-দশক পরে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। সেই ভাষা দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারীর অমোঘ শিক্ষা – বহু ভাষাভাষী সমাজে ধর্ম দিয়ে দেশ হয় না, জোর করে বানিয়ে দিলেও ধরে রাখা যায় না। এক দেশ বলে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক দল, এক নেতা কখনোই চলে না, চলতে পারে না। মানুষের জীবন, অস্তিত্ব, পরিচিতি বহুমাত্রিক। অনেকের জীবনেই ধর্ম একটা মাত্রা। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, সার্না, বাহাই। সে মাত্রা পরিবর্তনশীল। নিজের ধর্ম বেছে নেওয়ার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। কোনো ধর্ম না মানার অধিকারও মানুষের মৌলিক অধিকার। আবার একই ধর্মকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন ধরণে অনুসরণ করে। যত মত তত পথ। নিজের মত নিজের পথ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। তা স্বাধীনতাকে খর্ব করে, মানবতাকে কলুষিত করে। একুশের জন্ম ভূগোলের দিক থেকে আজকের বাংলাদেশে। কিন্তু একুশ বেড়ে উঠেছে বাংলা ভাষার কোলে। একুশ তাই ও বাংলার মতো এ বাংলারও। আজ তো একুশ আন্তর্জাতিক। সার্বজনীন। গোটা পৃথিবীকে বাংলার উপহার। ধর্মের বন্ধনকে ভাষা বারবার ভেঙে দিয়েছে। বঙ্গভঙ্গের প্রথম প্রচেষ্টাকে রুখে দিয়েছিল ভাষার বন্ধন। পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে ভাষার ভিত্তিতে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলা ভাষার ঐক্যকে ধর্ম দিয়ে ভাঙা যাবে না। বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে বেড়ে উঠেছে বাংলার উদার সংস্কৃতি। ধর্মান্ধতা নয়, সংকীর্ণতা নয়, জাতের নামে বজ্জাতি নয়, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’ এই আমরা-ওরা ভাগাভাগি নয়, চাই খোলা মন ও মুক্ত চিন্তা, একে অপরকে গ্রহণ করার, বিবিধের মাঝে মহামিলনের সমন্বয়, মৈত্রীবন্ধন।

বাংলা ভাষা যতটা স্বাধীন বাংলাদেশের, ততটাই বহুভাষিক ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের। অসম, ত্রিপুরা থেকে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার বহু মানুষের। আজ এই ভাষার উপর বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাভাষী মানুষ নির্যাতিত হচ্ছেন বাংলাদেশী সন্দেহে। এ বিদ্বেষ বন্ধ হোক, এ নির্যাতনের হোক অবসান। এনআরসি-এনপিআর-সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের নামে মানুষকে রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত করার চক্রান্ত ধ্বংস হোক। পরাজিত হোক অসহায় মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে দিয়ে অধিকারহীন বন্দীজীবনে ঠেলে দেবার নোংরা ছক। ধর্ম, ভাষা সবই মানুষের পরিচয়ের সূত্র। পরিচিতি থেকে গড়ে ওঠে যোগাযোগ। সংঘাত নয়, সংযোগ। ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা নয়, মৈত্রীর বন্ধন। বিভেদ নয়, সমন্বয়। মনে রাখতে হবে ধর্মের উপর ভাষা, মাতৃভাষা, কিন্তু ভাষার উপর মানুষ। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। আজ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনেকেই তথাকথিত বহিরাগত। কেউ কাজের সূত্রে কিছুদিনের জন্য পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে, কেউ সেখানকারই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। কেউ কিছুদিন হলো ভিনরাজ্যের বাসিন্দা, কেউ কয়েক প্রজন্ম ধরে। প্রত্যেকের কাছে রয়েছে নিজের নিজের মাতৃভাষার পরিচয়, আবেগ, গর্ববোধ। কেউ ছোট কেউ বড় নয়, সবাই সমান। পারস্পরিক পার্থক্য মানে বৈষম্য ও সংঘাত নয়, পার্থক্যকে স্বীকার ও সম্মান করা। এটাই গণতন্ত্রের সূত্র, সভ্যতার শিক্ষা। সবার উপরে মানুষ সত্য। কিন্তু আজ একুশ শতকে জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড অতিমারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবশ্যই এ কথাও মনে রাখতে হবে যে মানুষ যেন নিজেকে মহাশক্তিধর মনে করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নামে। মানুষ সবার উপরে, কিন্তু প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে নয়। প্রকৃতিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে বাঁধ বানালে, কারখানা বসালে তার পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে উত্তরাখন্ডের যোশীমঠের ভূস্খলন ও হিমবাহের মারণস্রোত আবার সেই সতর্কবাণী আমাদের শুনিয়ে গেল। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করার ভয়ানক ফলশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিল আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়। মানুষ আর প্রকৃতির সমন্বয়েই মানুষের সভ্যতা। সেই সভ্যতা সংকট মুক্ত হোক, সুস্থ ভাবে এগিয়ে চলুক।

এ বছর একুশে মানে নির্বাচনের প্রাকমুহূর্ত। নির্বাচনে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের আওয়াজ তুলে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলকে রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা। এক দেশ এক দল এক সরকার চাপিয়ে দিতে দল ভাঙানোর, দলবদলের হিড়িক। বাংলার মনীষীদের আত্মসাৎ করার নোংরা ছেলেখেলা। অন্যদিকে দিল্লীতে সংসদে রাজ্যসভা ও লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল আন্দোলনকারী বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে ‘আন্দোলনজীবী, পরজীবী’ রব তুলে বিরোধী কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার হুঙ্কার। আন্দোলন থেকেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা, দেশের সংবিধান, সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন। আজ সেই নির্বাচনের ভিত্তিতে ক্ষমতা দখল করে নিয়ে ক্ষমতার বলে দেশকে ‘আন্দোলনমুক্ত, বিরোধিতামুক্ত’ করার অভিযান শুরু হয়েছে। এ হল ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি, গণতন্ত্র হত্যার ফরমান। এ চক্রান্তকে রুখতেই হবে। তাই এবারের একুশের ডাক – ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক। বাংলার উদার ঐতিহ্য জিন্দাবাদ। প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন দ্বিগুণ শক্তিতে জ্বলে উঠুক।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য,    
sahomon.com এ প্রকাশিত   
 

corruption

বোধহয় এই প্রথমবার এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে এক দুর্নীতির ‘তদন্ত হবে’ শোনা গেল। তাও আবার মন্ত্রী পর্যায়ে দুর্নীতির। রাজ্য সরকারের বন দপ্তরে সহায়ক পদে নিয়োগ নিয়েই দুর্নীতির অভিযোগ। যে দপ্তরের মন্ত্রী সম্প্রতি মন্ত্রীপদ ও দল ছেড়ে বিজেপিতে গেছেন। প্রশ্ন হল, এই দুর্নীতির অভিযোগ যখন অনেক আগের, তখনই কেন তদন্তের পদক্ষেপ করা হয়নি, উপরন্তু মন্ত্রীপদে রেখে দেওয়া হয়েছিল কেন? দুর্নীতির খবর বাইরে চাউর হয়ে যাওয়ার ভয়ে! ইতিপূর্বে ফাঁস হয়ে যাওয়া সারদা চিটফান্ড ও নারদ ঘুষ খাওয়া নিয়ে তৃণমূল জেরবার বলে! আবার স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়ে গেলে বেসামাল অবস্থায় পড়তে হবে আরও, চেপে বসেছিল কি সেই আতঙ্ক! দলে যতদিন সমঝোতায় সহাবস্থানের ভারসাম্য থাকছে, ভাঙছে না, ততদিন সব চেপে থাকো, সম্পর্ক ভেঙে গেলে মুখ ছোটাও! এভাবেই কি ‘রাজনৈতিক দিক থেকে সঠিক থাকা’র ঘুঁটির চাল আজ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে না!

পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলছুট বনমন্ত্রী। ‘বড়গলা’য় তাঁর দাবি, তিনি ‘নির্দোষ’ এবং কোথা কোথা থেকে আসা কোন্ কোন্ সুপারিশের কারণে তিনি নিয়োগে দলীয় স্বজনপোষণ কার্যকরি করণে বাধ্য হয়েছিলেন, গুছিয়ে রেখেছেন সেসব তথ্য। তিনি মুখ খুললে নাকি তৃণমূলী ‘বটগাছ’ নড়ে যাবে! মুখ্যমন্ত্রী ‘কেচোঁ খুড়তে গেলে নাকি কেউটে বেরোবে’! প্রশ্ন উঠেছে, এতই যদি নৈতিকতার বালাই, বুকের পাটা, তাহলে যখন ‘সুপারিশ’ এসেছিল তখন কেন বিরোধিতায় সরব হননি? মন্ত্রীর স্বীকারোক্তি – মন্ত্রগুপ্তি নিয়েছিলেন বলেই দলে যতদিন ছিলেন মুখ খোলেননি। কি চমৎকার! মন্ত্রগুপ্তির মর্মার্থকে ক্ষমতার ভাগীদারির স্বার্থে কি অবলীলায় দুর্নীতির তথ্য গোপনের আঁতাতের সংস্কৃতিতে পরিণত করা যায়! কিন্তু পরিহসের ঘটনা হল, তারপরেও ভাগ্যের চাকা সশব্দে ফেটে যাওয়া ঠেকানো যায়নি। ক্ষমতার খাস স্বার্থকে কেন্দ্র করে সংঘাতে যখন ভাঙন অনিবার্য হয়েছে, পাশাপাশি কথা পাকা হয়েছে বিজেপিতে ভিড়ে যাওয়ার, আর নির্বাচনের পরিস্থিতি আসন্ন, তখন দল ছাড়া বা বহিস্কৃত হওয়া নেতারা আর অপেক্ষায় থাকেননি তৃণমূলকে কামড়াকামড়িতে লিপ্ত হতে। তাদের কাছে কোনো অসঙ্গত নয় এই খেয়োখেয়ির রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

অন্যদিকে, দলত্যাগী তৃণমূলী নেতাদের বিজেপি যত দলে ঢোকাচ্ছে, তত লেলিয়ে দিচ্ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ব্যবহার করছে কত কি করতে হবে সেই প্রমাণ দিতে। তাছাড়া বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কাউকে পুরছে গারদে, কাউকে পাইয়ে দিচ্ছে জামিন। নয়া তৎপরতায় নামাচ্ছে নানা ইডি-সিবিআই তল্লাশী। তৃণমূলের উত্তরপ্রদেশীয় এক প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্যকে আচমকা গারদে পোরা হল, নারদ কান্ডের তথ্য বার করার হাবভাব দেখাতে। তার পরপরই রোজভ্যালি চিটফান্ড কেলেঙ্কারীতে ভুবনেশ্বর জেলে বন্দী করে রাখা একদা তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এক টলিউড প্রযোজককে পাইয়ে দেওয়া হল জামিন। কিছুদিনের মধ্যেই গ্রেপ্তার করা হল একদা টলি-অভিনেত্রী তথা রোজভ্যালি মালিকের স্ত্রীকে, যাঁর সাথে তথ্য লোপাটে সাহায্যকারী এক ইডি অফিসারের যোগসাজশ থাকার তথ্য আছে দাবি করেছিল সিবিআই। প্রযোজক সাহেবকে ফাটক থেকে বার করার পেছনে বিজেপির রয়েছে অন্য সমীকরণ, তাকে টলিউডে গেরুয়া শিবির বানাতে ব্যবহার করা। মেদিনীপুরের ‘অধিকারী জমিদারীর’ মেজো যুবরাজ এক টেলি-মিডিয়ায় ‘ঘন্টাখানেক’ সাক্ষাতে বুক বাজিয়ে দাবি করলেন ২০১১-র নির্বাচনে ঢালা হয়েছিল সারদার টাকা। প্রার্থী পিছু দেওয়া হয়েছিল সত্তর লাখ করে। ঐ পদত্যাগী পরিবহনমন্ত্রী তথা ‘বিদ্রোহী’ নেতার কথা হল, সেই তদন্ত ঠিকঠাক করতে হলে ক্ষমতায় পরিবর্তন আনা চাই! প্রাক্তন বনমন্ত্রী থেকে শুরু করে গেরুয়া ঘরে ঢোকা আধা নাম ফাটানো নেতা-ফেতা সবারই মুখে এক বুলি! তৃণমূল আমলে সমস্ত দুর্নীতির তদন্ত করতে হলে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা দরকার। পাশাপাশি শুরু হয়েছে একের পর এক গোয়েন্দা হানা। গরু পাচার, কয়লা পাচার, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী ঘটানো কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের কারবারের তালাশের কারণ দেখিয়ে। তার সাথে গোপনে জড়িত সন্দেহে শাসকদলের নেতাগুচ্ছ সমেত পুলিশ অফিসার ও সরকারী আমলাদের খোঁজে। বিজেপিতে যোগ দেওয়া কালনার তৃণমূল ছুট এক চাঁই প্রকাশ্যে কবুল করলেন, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘটেছে ‘টেট’ কেলেঙ্কারী। দুর্নীতি হয়েছে দু’ভাবে – কিছু স্বজনপোষণের কোটায়, কিছু কাটমানির বিনিময়ে। দল দুষছে দলত্যাগীকে, দলত্যাগী দুষছে দলতন্ত্রকে। যত হচ্ছে পর্দা ফাঁস, তত চড়ছে চাপান উতোর। সিবিআই নাকি আবার সারদা তদন্তের ফয়সালা করতে তৃণমূল ভাঙার পয়লা নম্বরের মূল পান্ডাকে ‘রাজসাক্ষী’ করতে চায়! এই সবের লক্ষ্য বিজেপির সপক্ষে ‘সাধুতা’র মোহ বিস্তার করা। তবে সিবিআইয়ের উপরোক্ত দাবি মানা বিজেপির পক্ষে এই নির্বাচনী বাজারে কিছুতেই সম্ভব নয়। যে রাজনৈতিক জুয়াখেলায় বিজেপি নেমেছে, তার জেরে পড়ছে উভয় সংকটে। নিজের বৃদ্ধির স্বার্থে তৃণমূলের ঘর ভাঙানো ডাকাবুকো নেতাদের নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই, অথচ বহিস্কৃত সেইসব তৃণমূল নেতাদের কেউই দুর্নীতির দূর্গন্ধমুক্ত নন। এইসব নেতা-আধা নেতাদের অন্তর্ভুক্তির সাফাই দিতে তিলক কাটা নেতারা চালবাজীর ধরণ-ধারণেও পাল্টি খাচ্ছেন। প্রথম প্রথম বলতেন, ‘আইন আইনের পথে চলবে’। আর এখন বলছেন, ‘বিজেপিতে এসেছে বলেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে যত দোষ’। স্বাভাবিক ভাবেই এটা একরকম সংকটদীর্ণ অবস্থা।তৃণমূল আমলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাঁকে জড়ানোর অভিযোগের যথেষ্ট বাস্তবতা আছে। তবে এ প্রসঙ্গে  বিজেপির তুলনা একমাত্র বিজেপি। একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল ডুবেছে দুর্নীতির পুকুরে। অন্যদিকে, কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি ডুবেছে দুর্নীতির সাগরে। মধ্যপ্রদেশে ‘ভ্যাপম’ (মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত) কেলেঙ্কারী, তার তদন্ত চাপা দিতে প্রায় অর্ধশত হবু সাক্ষীদের গুম করে দেওয়া, কর্ণাটকে খনি বন্টণ কেলেঙ্কারী, ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা ‘ঋণ নেওয়ার’ নামে বিদেশে পাচার হতে দেওয়া, পাচারকারী কুবেরদের প্রশ্নে রহস্যপূর্ণ ‘মোদী-মোদী’ সম্পর্ক থাকা, রাফাল কেলেঙ্কারী, মোদীর ‘পি এম কেয়ারস্’ ফান্ডকে ক্ষমতার জোরে হিসাব বহির্ভূত করে রাখা ইত্যাদি আরও নমুনা রয়েছে। বিশেষ করে এই যে এত ঘটা করে আম্বানী-আদানি-কোম্পানিরাজ ডেকে নিয়ে আসা, এর পিছনেও ‘কাটমানি-কমিশন’-এর গোপন লেনাদেনার আঁতাত না থেকে পারে! তাই বিজেপি ‘বাংলায় ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির প্রকৃত তদন্ত হবে’ – এটা একটা ছদ্মবেশী প্রচার মাত্র। এরাজ্যের ছোটবড় যে কোনো দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারীর তদন্ত ও বিচার নিশ্চয় চাই, নতুন করে দুর্নীতি যাতে মাথা তুলতে না পারে সেই চ্যালেঞ্জও রাখতে হবে, থাকতে হবে লড়ে বিহিত আাদায় করার সংকল্প। কিন্তু কোনোভাবেই  বিজেপিকে তার সুযোগ নিতে দেওয়া যায় না। কারণ, বিজেপি সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত।

strong movementstrong

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে, কৃষকদের ট্রাক্টর প্যারেডে লাখো কৃষক দিল্লীর রাস্তায় শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কৃষি-বিরোধী তিনটি আইন বাতিলের দাবি তুলে ধরেছিলেন, আর দিল্লিবাসীরাও বিপুলভাবে তাদের আবেগউষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে, মোদী সরকার লাল কেল্লার একটি বিচ্ছিন্ন, অনভিপ্রেত ঘটনাকে ব্যবহার করে (যে ঘটনার সংঘটনে স্বয়ং সরকারের সুপরিকল্পিত হস্তক্ষেপের সমস্ত লক্ষণ রয়েছে) আন্দোলনের উপর একটা সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়েছে।

ঠিক শাহিনবাগের ধাঁচের এই আক্রমণে পাঁচটি ধরণ রয়েছে : মিথ্যা অভিযোগ; ভারতীয় পতাকার অবমাননার জন্য কৃষকদের “দেশদ্রোহী” বলে দাগিয়ে দেওয়া; কৃষকদের উপর পুলিশী ও হিন্দু-আধিপত্যকামী সংগঠনের আক্রমণ; কৃষক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ; যে সাংবাদিকরা, কূষক আন্দোলন ও তার উপর আক্রমণের খবর করছিলেন,তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ; কৃষকদের বিক্ষোভ সমাবেশের স্থলটি দুর্ভেদ্যভাবে ঘিরে ফেলা এবং ওখানে অন্যান্য কৃষক ও তার সঙ্গে দিল্লীবাসীদেরও যাওয়া আটকানোর জন্য রেলপথ নিয়ন্ত্রণ করা।

২৬ জানুয়ারীতেই, পুলিশ কৃষকদের উপর বর্বরভাবে কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ করেছিল। নভরীত সিং নামে এক কৃষক প্রাণ হারান; তার পরিবারের অভিযোগ পুলিশের গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ, বিরোধী দলের রাজনীতিকদের জল আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আন্দোলন স্থলে পৌঁছাতে দিচ্ছে না, কিন্তু হিন্দু-আধিপত্যবাদীদের “স্থানীয়” সেজে দলবল নিয়ে ওখানে ঢুকে পড়ে কৃষকদের উপর আক্রমণ চালাতে দেওয়া হয়েছে।

এ পর্যন্ত, ন’জন সাংবাদিক যারা নভরীতের পরিবারের পুলিশি গুলিচালনার অভিযোগ নিয়ে তদন্ত ও খবর করছিলেন, তাদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ এবং অন্যান্য ‘অপরাধে’ অভিযুক্ত করা হয়েছে। কৃষকদের আন্দোলন স্থলে দুষ্কৃতি এবং পুলিশের হিংস্র আক্রমণ নিয়ে যে সাংবাদিকরা খবর করেছিলেন, তাদের মারধর করে, হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কৃষক সংগঠনগুলি জানিয়েছে, গত ২৬ জানুয়ারীর প্যারেডের পর থেকে শতাধিক কৃষকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

সরকারের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যারা সেই গোটা প্রতিনিধিদল সহ, কৃষক আন্দোলনের বিরাট সংখ্যক সামনের সারির নেতাদের নাম এমন সব ফৌজদারি মামলায় জড়ানো হয়েছে যা রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইন তাদের উপর চাপিয়ে দেবে। অন্তত ১২০ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। আন্দোলনস্থলে বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে সব অ্যাকাউন্ট থেকে কৃষক আন্দোলন নিয়ে খবর টুইট করা হত,  তার অনেকগুলিকে মোদী সরকারের “অনুরোধে” অত্যন্ত জঘন্যভাবে বন্ধ করে দিয়েছে টুইটার কর্তৃপক্ষ।

দিল্লীর সীমানায় কৃষকদের প্রতিবাদ স্থলের বাইরে ব্যারিকেড করে, গভীর গর্ত খুঁড়ে, লোহার গজাল পুঁতে ট্রাক ও ট্রাক্টরের ঢোকা-বেরোনো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে, শক্তপোক্ত ক্যাম্পও তৈরি করে ফেলেছে। পাঞ্জাব থেকে আসা ট্রেনগুলোকে  দিল্লীর স্টেশনগুলোতে থামতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে, এই সব অত্যাচার শুধু আন্দোলনকে ঘআরও শক্তিশালী ও সংকল্পবদ্ধই করে তুলছে।

গাজীপুর সীমানায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিধ্বংসী আক্রমণ এবং উত্তরপ্রদেশের বিশিষ্ট কৃষকনেতা রাকেশ টিকাইতের চোখে জল, মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃষক আন্দোলনের পরাজয়ের প্রমাণ হিসাবে সোল্লাসে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু তার ফল হয়েছে উল্টো, সেই রাতেই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কৃষক গাজীপুর সীমানায় চলে এসেছেন। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ব্যাপকভাবে কৃষক পঞ্চায়েতগুলি তিনটি কৃষ-বিরোধী আইন বাতিল এবং প্রতিবাদী কৃষকদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।

আন্দোলন যখন তীব্রতর হচ্ছে, মোদী সরকারের পেশ করা বাজেটে প্রধানমন্ত্রী-কিষাণ, এমএনআরইজিএ, তৈলবীজ এবং ডালের জন্য মূল্য সহায়ক প্রকল্প, স্বল্প মেয়াদি শস্য ঋণের উপর সুদে ভর্তুকি সহ কৃষিএবং গ্রামীণ কল্যাণ প্রকল্পগুলিতে ব্যাপক হারে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। তার সঙ্গে, অঙ্গনওয়াড়ি এবং প্রসূতিদের সুযোগ সুবিধা; স্বাস্থ্য পরিচর্যা; এবং শিক্ষাতেও সরকারী ব্যয় প্রচুর কমানো হয়েছে। “স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ”, এবং “পানীয় জল ও পরিচ্ছন্নতা”-য় ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য উভয় ‘হেড’-এই “কেন্দ্রীয় সড়ক পরিকাঠামো তহবিল” গণনা করা হয়েছে-আদতে যা একটি সন্দেহজনক গণনা পদ্ধতি।

মোদী সরকারের চালু কৌশল – মিথ্যা সংবাদ, সাম্প্রদায়িক বিভাজন, অত্যাচার, সাংবাদিক এবং আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার – কোনোকিছুই কাজে আসছে না। এবার, সরকারের প্রত্যেকটি আঘাত শুধু আন্দোলনের শক্তি ও সংকল্পকেই বাড়িয়ে তুলছে।

এম এল আপডেট, খণ্ড ২৪, সংখ্যা-৬, ২-৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ 

citizenindian

মোদী শাসনের শেষ ছয় বছর নাগরিক স্বাধীনতা, ভারতের সংবিধান এবং গণতন্ত্রের উপর নিরন্তর আক্রমণ চলেছে। ৮ ফেব্রুয়ারী সংসদে বক্তৃতা করে প্রধানমন্ত্রী মোদী সমস্ত ভণ্ডামির মুখোশ খুলে ফেললেন এবং কোনো রাখঢাক না রেখেই প্রতিবাদকারী ও বিরোধী স্বরকে “পরজীবী” অভিধায় অভিহিত করলেন। এই শব্দচয়ন সমগ্র পৃথিবী জুড়েই স্বৈরাচারী শাসকের প্রতিবাদী মানুষকে অবমাননা এবং অশুভ শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করার ভাষা। এই ভাষা শাসকের গণহত্যার পথে অগ্রসর হওয়ার ভাষা। মোদী “আন্দোলনজীবী” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মহিলা এবং আরও কিছু মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করতে যারা বিভিন্ন প্রতিবাদ প্রতিরোধের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তিনি বললেন যে এই জাতীয় লোকেরা, যারা বিভিন্ন গণআন্দোলনের সমর্থক, তারা আসলে “ষড়যন্ত্রকারী”, দেশকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে।

বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক ইউনিয়ন, মহিলা আন্দোলন, দলিত আন্দোলন, নাগরিক স্বাধীনতা এবং পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীরা সকলেই গর্বিত “আন্দোলনজীবী” যাদের বাঁচা মরার অর্থই নিপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের প্রতিবাদের পক্ষে থেকে সংগ্রাম করা — মিছিলে তাই শ্লোগান ওঠে, “লড়াই করে বাঁচতে চাই”। প্রতিটি দেশে তারা দরিদ্র ও নিপীড়িতদের সংগ্রামে যোগ দেয় এবং এই সংগ্রামগুলিকে তাদের নিজের সংগ্রাম হিসেবেই আঁকড়ে ধরে, এরা দেশের গর্ব, এমনকি সে দেশের সরকার তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও।

আমরা আন্দোলনজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের গর্বিত উত্তরাধিকারের পক্ষে দাঁড়াই। স্বাভাবিকভাবেই মিঃ মোদী আন্দোলনের প্রশংসা করতে পারেন না – কারণ তাঁর নিজস্ব দল আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণই করেনি। আরএসএস তত্কালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং তার কোম্পানি রাজের সেবাদাস ছিল। এখন মোদীরাজ কোম্পানিরাজের সেবাদাস এবং তার সংঘকে টিকিয়ে রাখতে ‘নির্বাচনী বণ্ড’-এর মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্থ কর্পোরেট তহবিলের উপর নির্ভরশীল। বিপরীতে আমরা আন্দোলনজীবীরা একমাত্র ভারতের “উই দ্য পিপল” জনগণের উপর নির্ভরশীল।

যেসব আন্তর্জাতিক অধিকার কর্মী এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, মোদী তাদের “বিদেশী ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ” হিসাবে অভিহিত করেছেন। তবে মোদী নিজেই ট্রাম্প এবং বলসেনরোর মতো বিভিন্ন স্বৈরাচারীদের এবং বিল গেটসের মতো বিগ কর্পোরেট প্রধানদের প্রশংসাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি কেবল তখনই আপত্তি করেন, যখন নিজেদের দেশে বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরোধী কণ্ঠস্বরগুলি ভারতের জনগণের আন্দোলনকে সমর্থন করে। আমরা সমস্ত প্রগতিশীল স্বাধীনতা-প্রেমী ন্যায়বিচার-সন্ধানী ভারতীয়দের কাছে আবেদন করছি “আন্দোলনজীবী” উপাধিটিকে গর্বের সঙ্গে সানন্দে আপন করে গ্রহণ করুন। ভারত এবং বিশ্বের আন্দোলনজীবীরা যথার্থই অন্য একটি বিশ্ব গড়ে তুলবে, যে বিশ্ব হবে বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক, এবং এটা অবশ্যই সম্ভব।

– দীপঙ্কর ভট্টাচার্য,সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল )   

tablusubimal

সকলকে হতচকিত করে দিয়ে দুঃসংবাদটা এলো, যেন এক নির্মম আঘাত হয়ে। কমরেড সুবিমল সেনগুপ্ত আর নেই। মুহূর্তের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। নদীয়া জেলা তথা ধুবুলিয়ার পার্টি সংগঠনের সমগ্র কর্মীবাহিনী, সমর্থক দরদী, এলাকার সর্বস্তরের মানুষ সকলেই বাকরুদ্ধ! সবার প্রিয় কমরেড - একান্ত আপনজন টাবলুকে হারানোর বেদনায় ধুবুলিয়ায় পার্টি অফিস সন্নিহিত এলাকায় কেবলই হাহাকারের রোল, বুক চাপড়ে কান্না আর বাঁধ না মানা চোখের জল! ৫ ফেব্রুয়ারী রাত ৯টা নাগাদ তাঁর প্রয়াণের শেষ খবরটা এলো। এলাকার অসংখ্য মানুষ ততক্ষণে জড়ো হয়ে গেছেন ঘটনাস্থল ধুবুলিয়ার কাঁঠালবাগান ইউথ সোসাইটি ক্লাবের মাঠ সংলগ্ন এলাকায়। এই ক্লাবের সভাপতি তথা কর্ণধার ছিলেন, এলাকার আপামর জনগণের সব ধরনের কাজের ভরসার মানুষ সুবিমল সেনগুপ্ত বা টাবলু। অনতিদূরেই তাঁর বাড়ী। রাত ৮টার কিছু পড়ে এই মাঠেই গুরুতর আহত-রক্তাক্ত অবস্থায় সুবিমলকে চিনতে পেরে লাগোয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায় পার্টির স্থানীয় কর্মীরা ও এলাকার মানুষেরা। পার্টি অফিস থেকে মোটর সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় জাতীয় সড়কের এক পাশে কোনো এক জরুরি দরকারে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে সময় বিপরীত দিক থেকে তীব্র গতিতে আসা এক মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা মারে। নিজের মোটর সাইকেল সহ তিনি ছিটকে পড়ে যান। ধাক্কা মারা মোটর সাইকেলের আরোহী কমবয়সী তিনজন যুবকও ছিটকে পড়ে যায়। প্রচন্ড আঘাতে সুবিমলের বাঁ পায়ের উরু চুরমার হয়ে গিয়ে প্রবল রক্তক্ষরণ হতে থাকে। দ্রুতই তাঁকে নিকটবর্তী ধুবুলিয়া গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তাররা জিজ্ঞাসা করলে তিনি অস্ফুট স্বরে জানান তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওটাই তাঁর জীবনের শেষ কথা!

জরুরি তৎপরতায় স্যালাইন অক্সিজেন সহ তাঁকে এ্যাম্বুলেন্সে করে কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। অচৈতন্য অবস্থায় শক্তিনগর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জানা গেলো সব শেষ! চিকিৎসার কোনো সুযোগই আর পাওয়া গেলো না। ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন। সে সময় কাঁঠালবাগান ক্লাবের মাঠের ঘাসে লেগে রয়েছে চাপ চাপ রক্তচিহ্ন, শোকস্তব্ধ পরিবার ও এলাকার মানুষের ভীড়। কিছু সময় পর বেশি রাতে হাসপাতাল থেকে তাঁর সহযোদ্ধারা, পার্টির স্থানীয় নেতৃত্ব ও কর্মীরা, আত্মীয় পরিজনেরা ভগ্নহৃদয়ে ফিরে এলেন। অর্ধনমিত হলো লাল পতাকা। সুবিমল সেনগুপ্তের জীবনাবসান নদীয়া জেলার বুকে তাঁর নেতৃত্বে এক গৌরবময় সংগ্রামী পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটালো। এই অকাল প্রয়াণ কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না – এটাই যেন হয়ে উঠলো সুবিমলের কর্মক্ষেত্রের বিস্তির্ণ এলাকার ব্যাপক মানুষের অনুভব। নদীয়া জেলায়’ ৯০-এর দশক থেকে শুরু করে আজকের সময়ের বিপ্লবী কমিউনিষ্ট আন্দোলনের অগ্রণী নেতা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ও নদীয়া জেলা সম্পাদক চির বিদায় নিলেন।

তাঁর মরদেহ শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে আসা হলো পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারী বেলা ২টায়। তখন সেখানে পৌঁছে গেছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পার্টির নেতৃত্ব ও কর্মীরা। নদীয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তের অগ্রণী কর্মীদের প্রায় সকলেই। অর্ধনমিত লালপতাকা সহকারে শতাধিক মানুষের মিছিল পৌঁছালো কৃষ্ণনগর চৌধুরী পাড়ায় জেলা অফিসে। সেখানে  তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানান পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা কার্তিক পাল, রাজ্য নেতা বাসুদেব বসু, নবেন্দু দাশগুপ্ত, কাজল দত্তগুপ্ত, জয়তু দেশমুখ, সলিল দত্ত, প্রবীর হালদার, কৃষ্ণ প্রামানিক প্রমূখ। জেলা কমিটির নেতা স্বপন দাস, বিজয় সাহা, অমল তরফদার, আলতাফ হোসেন, সন্তু ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, অপু কবিরাজ, দিলীপ বিশ্বাস সহ অন্যান্যরা। এছাড়াও মাল্যদান করেন সিপিআই(এম) দলের নদীয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে, শ্রমিক নেতা এসএম সাদি প্রমূখ। এর পর লাল পতাকায় সুসজ্জিত মোটর সাইকেল সহ চলমান শেষযাত্রা প্রথমে তার নিজ বাসভবন পৌঁছয়। সেখানে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাঁর স্ত্রী রুনু সেনগুপ্ত সহ ভাই বোন আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা। সেখানে শ্রদ্ধা জানান স্থানীয় বিধায়ক কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। এরপর তাঁকে নিয়ে আসা হয় তাঁর নিজ হাতে গড়া এলাকার ক্লাবে। ক্লাবের পতাকা দিয়ে সকলে শ্রদ্ধা জানায়। তারপর তাঁকে আনা হয় তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের মূল কেন্দ্র ধুবুলিয়া পার্টি অফিসে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানায় ধুবুলিয়া এরিয়া কমিটির নেতা জয়কৃষ্ণ পোদ্দার, সুব্রত রায়, শহীদুল মোল্লা, হবিবুর রহমান, ঠান্ডু সেখ, কলম বিশ্বাস, ছবি বিশ্বাস, দয়াল মন্ডল, ফরোজ সেখ প্রমূখ। সেখানে তখন ধুবুলিয়া এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের কর্মীদের এবং অসংখ্য মানুষের ব্যাপক সমাবেশ। পার্টি কর্মী সমর্থক ছাড়াও স্থানীয় ক্লাবের কর্মকর্তারা, দলমত নির্বিশেষে এলাকার সর্বস্তরের মানুষেরা, বিভিন্ন বামপন্থী দল এমনকি স্থানীয় সরকারী ও বিরোধীদলের বিভিন্ন নেতারা। যথাযোগ্য মর্যাদায় শায়িত তাঁর মরদেহে সুশৃঙ্খল ভাবে সকলে শ্রদ্ধা জানায়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ৬২ বছর।

সুবিমলের সংগ্রামী ও বিস্তৃত কর্মময় জীবন, সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পরিধি যে কতদুর ব্যাপ্ত ছিলো শেষ যাত্রায় যেন সেই ছবিটাই পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। তাঁকে নিয়ে নেতাজী পার্ক অভিমুখে মিছিলে বিপুল সংখ্যক মানুষ পথ হাঁটেন যাতে জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে স্থানীয় শ্মশানে তাঁর অন্তিম কাজ করা হয়। অগণিত মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন তাঁর বিপ্লবী কর্মজীবন, গ্রামে গঞ্জে মানুষের নানাবিধ সংগ্রামে নেতৃত্বকারী ভুমিকার কথা। ৭০ দশকে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নকশালবাড়ী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। তার দাদা ছিলেন নদীয়া তথা ধুবুলিয়ায় পার্টি প্রতিষ্ঠার অন্যতম এক রাজনৈতিক সংগঠক। এটাও তাকে প্রভাবিত করেছিলো। প্রয়াত কমরেড সুবোধ মজুমদারের সাথে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে কলেজ জীবনে তৃতীয় ধারার ছাত্র সংগঠন পিএসইউ গড়ে তোলেন। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে ধুবুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে কৃষক সংগ্রামে বিশেষত খাস বেনামী জমিদখল তথা ভূমিসংস্কারের আন্দোলনে তিনি অগ্রণী নেতৃত্বের ভুমিকা নেন। গ্রামাঞ্চলে শত শত একর জমি দখল করার পাশাপাশি ধুবুলিয়ার বুকেও জমি ও বাস্তুর অধিকারের দাবিতে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। স্থানীয় ধুবুলিয়া বাজারে দোকান বসানোর মাধ্যমে বেকারদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার্টি অফিস নির্মাণ করা হয়। নপাড়া অঞ্চলের বিস্তির্ণ গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে ধর্মদা মুড়াগাছা শালিগ্রাম লাগোয়া দুটি ব্লকের বিরাট এলাকা জুড়ে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে তিনি ছুটে যেতেন, কৃষকদের বিভিন্ন আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়চেতা মানসিকতায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন গরিব শ্রমজীবী মানুষের আশা ভরসাস্থল।

কলেজ জীবন শেষ করে কিছু দিন একটা অডিট ফার্মে তারপর ব্যাংকে চাকরি করেন। তারপর ৯০ দশকের শেষে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যান। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়কালে তিনি পার্টির নদীয়া জেলা কমিটির সদস্য হন, পরবর্তীতে জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। এই সময়কালে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটি ও তারপর রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হন। ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে ধুবুলিয়ার বুকে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। বলা যায় এ জাতীয় কর্মকান্ডে, তা সে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শুরু করে স্পোর্টস এ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন দায়ভার কাঁধে নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য এক ব্যাক্তিত্ব। তাঁর গুণাবলী ছিলো এমনই যে ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের সাথে মতান্তর হলেও তাঁর কোনো মনান্তর হতো না। রাজনৈতিক আদর্শগত দৃঢ় অবস্থান অটুট রেখেও নানাজনকে সামাজিক কাজে সমন্বিত করার গুণাবলী তাকে বিপুল জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজ, মানুষের ছোটখাটো সমস্যায় বিপদে আপদে পাশে থাকা – গণনেতা হিসাবে এই সমস্ত কিছুকে মেলানোর অদ্ভুত দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ধুবুলিয়ার বুকে বিড়ি শ্রমিক, লোডিং আনলোডিং মজদুর, রেল হকার, টোটো চালক এই সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে ইউনিয়ন গড়ে তোলা এই মেহনতী মানুষদের ন্যায্য মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা, পাশাপাশি যুবকদের সংগঠিত করা এই সমস্ত কর্মকান্ডে অগ্রণী নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে গেছেন। ধুবুলিয়া এলাকার নানা জায়গায় পৃথক ভাবে তাঁর স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। লোডিং আনলোডিং ইউনিয়ন টিবি গেটে স্মরণ সভা করে৷ ১৬-১৭ নং ব্রাঞ্চ স্থানীয় দুর্গামন্দির চত্তরে এলাকার বহু মানুষকে সমাবেশিত করে স্মরণ সভা করে। টোটো ইউনিয়ন ধুবুলিয়া বাজারের স্ট্যাণ্ডে অনুরূপ সভা করে। তার আদর্শকে পাথেয় করে, বিভিন্ন গুণাবলী থেকে শিক্ষা নিয়ে স্থানীয় কমরেডরা নিজেদের মনকে দৃঢ় করে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রকৃতই এক সংগ্রামী গণনেতা, ক্লান্তিহীন এক অনুভবী মানুষ কমরেড সুবিমল সেনগুপ্তকে জানাই লাল সেলাম।

Modibengal

কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা পাওয়ার শর্ত হিসেবে বাংলার নির্বাচনে বিজেপির জয়কে যুক্ত করার হীন প্রচেষ্টা চালালেন প্রধানমন্ত্রী। কিছুদিন আগে হলদিয়ায় একটি নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই কিষাণ স্কিমে বাংলার কৃষকের বকেয়া অর্থ মিটিয়ে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধিক্কার জানিয়ে অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি (এআইকেএসসিসি)র পশ্চিমবঙ্গ শাখা ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১ একটি প্রেস বিবৃতিতে দাবি জানিয়েছে যে, কেন্দ্রের কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পে বাংলার প্রতিটি কৃষক পরিবারের পাওনা ১৪০০০ টাকা রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের সমন্বয়ে অবিলম্বে ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে। পাওনা টাকা আদায়ের দাবিতে এআইকেএসসিসি’র শরিক সংগঠনেরা কৃষক অধিকার যাত্রা শুরু করছে, পঞ্চায়েত, ব্লক ও জেলা স্তরে কৃষকদের নিয়ে গণ-বিক্ষোভ সংগঠিত করবে এবং প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সহ বাংলার সব সাংসদ ও বিধায়কদের দাবিপত্র পাঠাবে।

প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, কিষাণ নিধি স্কিম জনগনের অর্থে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্প যা ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯ তারিখে ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু এটা প্রযোজ্য করা হয় ১ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখ থেকে, অর্থাৎ ঘোষণার তারিখের আগের থেকে। এই স্কিমের আওতায় ভারতের সমস্ত কৃষক প্রতি বছর ৬০০০ টাকা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার যোগ্য। ২০০০ টাকার ৩ কিস্তিতে এই সহায়তা দেওয়া হবে, যার নির্দিষ্ট তারিখ ১ এপ্রিল, ১ আগস্ট  এবং ১ ডিসেম্বর। দুর্ভাগ্যক্রমে, শুরু থেকেই বাংলার কৃষকরা এই স্কিমের অর্থ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কারণ রাজ্য সরকার আবেদনকারী কৃষকদের তথ্য যাচাই করে দেয়নি। কেন্দ্র সরকারও তার নিজস্ব তথ্যভাণ্ডার এবং ব্যবস্থার সাহায্যে বাংলার কৃষকরা যাতে এই অর্থ পান তা নিশ্চিত করার জন্য কোন চেষ্টা করেনি। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য বিধানসভায় বলেছেন যে রাজ্য সরকার কেন্দ্র সরকারকে চিঠি লিখে জানিয়েছে যে রাজ্য সরকার তথ্য যাচাই প্রক্রিয়া দ্রুততার সাথে করে দিতে সম্মত হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন যে রাজ্য সরকার ৬ লাখ কৃষকের তথ্য কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন যাচাইয়ের জন্য এবং ইতিমধ্যে ২.৫ লাখ কৃষকের দাবি যথাযথ বলে রাজ্য সরকার কেন্দ্র সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। তবু টাকা আসছে না কেন। কিষাণ স্কিমে বাংলার কৃষকের আবেদনের সংখ্যা এবং তথ্য এবং কৃষকদের তথ্য যাচাইয়ের সঠিক পরিসংখ্যান ইত্যাদির সঠিক চিত্র প্রকাশ করার দাবি এআইকেএসসিসি রাজ্য এবং কেন্দ্র, উভয় সরকারের কাছেই জানাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতি সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে এখনও অবধি বাংলার কোনো কৃষক কেন্দ্র সরকারের থেকে কিষাণ স্কিমের এক পয়সাও আর্থিক সাহায্য পায়নি। এআইকেএসসিসি’র দাবি যে রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকার অবিলম্বে এবং যুদ্ধকালীন তৎপরতায় একে অপরের সাথে সমন্বয় সাধন করুন এবং : (১) রাজ্য সরকার ১৫ দিনের মধ্যে সমস্ত যোগ্য কৃষকদের নিবন্ধনের জন্য পঞ্চায়েত স্তরে শিবির স্থাপন করুন (২) নিবন্ধনের ৭ দিনের মধ্যে রাজ্য সরকার যোগ্য কৃষকদের সমস্ত নথি যাচাই সম্পূর্ণ করুন (৩) কেন্দ্র সরকার বাংলার কৃষকদের বকেয়া দেবার জন্য কিষাণ প্রকল্পে যথাযথ পরিবর্তন করুন (৪) কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকারের তথ্য যাচাই সম্পূর্ণ হওয়ার ৭ দিনের মধ্যে সমস্ত নিবন্ধিত ও যোগ্য কৃষকদের ১২০০০ টাকার পুরো বকেয়া অর্থ প্রদান করুন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনৈতিক, অবৈধ, অসাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের জঘন্য নিদর্শন। এর আগে বিহার নির্বাচনের সময় কোভিড ভ্যাক্সিন ফ্রি পাওয়া না পাওয়া প্রসঙ্গেও একই কথা বিজেপি বলেছিল। সারা ভারতের সব কৃষক যাকে খুশি ভোট দিয়ে কিষাণ স্কীমের অর্থ পাওয়ার যোগ্য হয়েছেন ও পেয়েছেন, তাহলে প্রশ্ন উঠছে বাংলার কৃষকরা শুধুমাত্র বিজেপির পক্ষে ভোট দিলে তবেই এই স্কীমে অর্থ পাওয়ার যোগ্য হবেন, এটা কি করে হতে পারে? কেন্দ্র সরকারের একটি যোজনার বকেয়ার টাকা পাওয়ার বিষয়টা রাজ্যে বিজেপি’র নির্বাচনী সাফল্যের সাথে কিভাবে জুড়ে দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী? বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কোনো ভুমিকা বা করণীয় নেই – একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র সরকারই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন বাংলার ২২ লক্ষ কৃষক কিষাণ স্কিমে নিবন্ধন করিয়েছেন – প্রধানমন্ত্রী তাদের কীভাবে বঞ্চিত করার অধিকারি হলেন?

budgetwork

অর্থনীতির বিপজ্জনক নিম্নগতিকে রোধ করতে ও তাকে বিপরীতমুখে ঘুরিয়ে দিতে, এবং জনগণের সব থেকে বেশি বিপর্যস্ত সেই অংশ, যারা কাজ হারিয়েছেন বা যাদের আয় ও জীবিকায় যারপরনাই ধ্বস নেমেছে তাদের জরুরি ত্রাণের বন্দোবস্ত করতে মোদি সরকারের প্রথম কোভিড-পরবর্তি বাজেট কোনো প্রচেষ্টাই গ্রহণ করেনি। তার বদলে, বাজেটটি সঙ্কটের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে ভারতের বৃহৎ কোম্পানিদের সম্পদ কুক্ষিগত করার বাড়তি সুযোগ প্রদানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। যখন অর্থনীতির প্রয়োজন বর্ধিত সরকারী ব্যয় ও বিনিয়োগ, তখন বাজেট পাইকারি হারে বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারীকরণের দিকে ধাবিত হয়েছে।

এই বাজেটে দরকার ছিল কর্মসংস্থান, এবং সাধারণ মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরাসরি অর্থ হস্তান্তরের দিকে দৃষ্টি প্রদান। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবেই অনুপস্থিত। ভারতের ধনীতম ১০০ অর্বুদপতির সম্পদ অতিমারী ও লকডাউনের সময়ে বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি (প্রায় ১৩ লক্ষ কোটি টাকা) পেয়েছে। ওই বিপুল সম্পদকে ব্যবহারের জন্য সম্পদ কর বা লেনদেন কর আরোপ করতে বাজেটে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। অতি ধনীদের কাছ থেকে বর্ধিত হারে রাজস্ব সংগ্রহ ও জিএসটি ও আয়করে হ্রাস ঘটিয়ে মধ্যবিত্তদের সুরাহা করার উদ্দেশ্যে দেশের রাজস্ব নীতিকে সংস্কার করার বদলে বাজেটটি এক চরম পশ্চাদগামী রাজস্ব নীতিকেই অনুসরণ করেছে।

যথোচিৎ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তার জন্য কৃষকদের দীর্ঘ দিনের দাবিকে সরকার পুনরায় অগ্রাহ্য করেছে। ভারতের ক্ষুদ্র চাষি ও অতিক্ষুদ্র ঋণগ্রহিতাদের ঋণের বোঝা এক ভয়ানক সমস্যা। সমস্ত ক্ষুদ্র ঋণ মকুব করার প্রয়োজন সারা দেশ জুড়েই তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে এবং বাজেট এই গুরুত্বপূর্ণ দাবিকে অবহেলা করেছে।

অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের বুনিয়াদি চাহিদাকে সমাধানে এই বাজেট ব্যর্থ হয়েছে। আমরা তাই বাজেটের সম্পূর্ণ সংশোধনের দাবি করছি এবং ভারতের সমস্ত ধরনের শ্রমজীবী জনগণের কাছে প্রতিবাদে সরব হওযার আহ্বান জানাচ্ছি।

– দীপঙ্কর ভট্টাচার্য,সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল)

hooghlyFarmer Portest

পূর্ব বর্ধমান
গত ২৬ জানুয়ারী কৃষক প্রজাতন্ত্র দিবস পালনে দিল্লীর টাক্টর প্যারেডের বিরুদ্ধে বিজেপি’র অপপ্রচার এবং পুলিশ ও বিজেপি-আরএসএস’র গুন্ডাবাহিনী হামলার মাধ্যমে দিল্লী সীমান্ত গাজীপুর ও সিঙ্ঘু বর্ডার এলাকার আন্দোলনকারীদের হঠিয়ে দেওয়ার নৃশংস ব্যর্থ অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষক নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করছে। এমনকি ইউএপিএ মামলার মাধ্যমে কৃষক নেতাদের জেলে আটক করার চেষ্টা করছেন। এর বিরুদ্ধে এআইকেএসসিসি’র আহ্বানে দেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে পুর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া স্টেশন সংলগ্ন বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পূর্বস্থলী-কাটোয়া এরিয়া কমিটির উদ্যোগে মিছিল পরিক্রমা করাহয়। তারপর কৃষক-বিরোধী ফ্যাসিস্ট ও কোম্পানির দালাল নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। দাবি ওঠে কেন্দ্রের কৃষক-বিরোধী নয়া কৃষিআইন বাতিল করতে হবে। কৃষক নেতাদের উপর আরোপ করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। কৃষক আন্দোলনের উপর বিজেপি-আরএসএস গুন্ডাবাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সমস্ত মানুষ এক হোন। এই কর্মসূচীর নেতৃত্ব দেন পুর্বস্থলী-কাটোয়া এরিয়া কমিটির সম্পাদক শিবু সাঁতরা। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য কমিটির সদস্য সজল পাল, জেলা কমিটির সদস্য সমীর বসাক, অশোক চৌধুরীও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ।

purbasthali

 

কালনা ২নং ব্লকের অকালপোষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কালনা লোকাল কমিটির উদ্যোগে ৩১ জানুয়ারী মশাল মিছিল সংগঠিত করা হয়। মিছিল শেষে জন বিরোধী দাঙ্গাবাজ বিভাজনের রাজনীতি সৃষ্টিকারী কৃষক হত্যার নায়ক নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। এই মিছিলে আদিবাসী মহিলাদের উপস্থিতিছিল উল্লেখযোগ্য। উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা সুমি মজুমদার। আয়ারলার জেলা সভাপতি হরেকৃষ্ণ ঘোষ, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কালনা লোকাল কমিটির সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, জেলা কমিটির সদস্য প্রদ্যুত ঘোষ, হাফিজুর রহমান সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।মেমারী ১নং ব্লকের নিমো বটতলা বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও সিপিআই(এম)-এর যৌথ উদ্যোগে মিছিল সংগঠিত করা হয়। মিছিল শেষে পথসভা করা হয় এবং নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের কুশপুতুল দাহ করা হয়। এআইকেএম, আয়ারলা ও এআইকেএস’র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

দার্জিলিং
কৃষক-বিরোধী কৃষিআইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষক নেতৃত্বের উপর থেকে অবিলম্বে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এআই কেএম ও আয়ারলার পক্ষ থেকে ৩১ জানুয়ারী একটি মিছিল দার্জিলিং জেলার রাঙাপাণি পার্টি অফিসের সামনে থেকে শুরু হয়ে রাঙাপাণি বাজার সহ সন্নিহিত অঞ্চল পরিক্রমা করে। নেতৃত্ব দেন এআইকেএম’র জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, বর্ষীয়ন নেতা নেমু সিংহ, আয়ারলার শরত সিংহ, তাপস বর্মণ, পঞ্চা বর্মণ, দীপক ঘোষ প্রমুখ।

হাওড়া জেলার রিপোর্ট
৩০ জানুয়ারী বালি বাজার হরিসভায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে, কৃষি-আইন বাতিলের দাবি এবং কৃষক নেতৃত্বের ওপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সভা সংগঠিত হয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন AIKM রাজ্য সম্পাদক এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য জয়তু দেশমুখ, AIKM নেতা এবং পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য তপন বটব্যাল, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বালি-বেলুড় লোকাল কমিটি সম্পাদক এবং পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য নীলাশিস বসু, পার্টির লোকাল কমিটি সদস্য কার্তিক পান্ডে, পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য পার্থ ব্যানার্জী। গণসংগীত পরিবেশন করেন অমিতাভ ব্যানার্জী। সভা সঞ্চালনা করেন লোকাল কমিটি সদস্য অঙ্কিত মজুমদার। দীর্ঘদিন অসুস্থতায় থাকার পর আজকের সভায় উপস্থিত ছিলেন কল্যাণ গোস্বামী।

হুগলির রিপোর্ট
দিল্লী সীমান্তে দীর্ঘ দু’মাস ধরে অবস্থানরত কৃষকদের ওপর মোদী সরকার ও সঙ্ঘ পরিবারের নির্লজ্জ হামলার প্রতিবাদে বৈঁচিতে জিটি রোড চৌমাথায় এক বর্ণময় পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। পথসভায় মুখ্য বক্তা ছিলেন এআইকেএম’র অন্যতম রাজ্যনেতা তপন বটব্যাল। তিনি তাঁর তথ্যসমৃদ্ধ ভাষণে মোদী সরকারের তিন কৃষি-আইনের কৃষক তথা জনবিরোধী চরিত্রকে উন্মোচন করেন এবং এই মারাত্মক আইনগুলি কার্যকর হলে কৃষিক্ষেত্রে যে কোম্পানিরাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তার আগাম চিত্রনাট্য তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি ২৬ জানুয়ারী দিল্লীতে সামরিক বাহিনীর প্যারেডের সমান্তরালে লক্ষ লক্ষ কৃষকের ঐতিহাসিক ট্রাক্টর প্যারেডের এক প্রতিতুলনাকে তুলে ধরেন। সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের মাঝে স্যুট-বুট পরা মোদীই যেখানে একমাত্র হিরো আর বাকিরা নীরব দর্শক, সেখানে লক্ষ লক্ষ কৃষকের দৃপ্ত শপথে সমস্ত নাগরিকই হয়ে ওঠেন সম্মিলিত নায়ক। তিনি বলেন, কৃষকদের ঐতিহাসিক ট্রাক্টর প্যারেডের মাধ্যমে ব্যক্তিপূজার পরিবর্তে সাধারণতন্ত্র দিবসের সঙ্গে গণতন্ত্রের সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর এই মন্তব্যে পরিপার্শ্বস্থ শ্রোতারা উল্লাস প্রকাশ করেন। পথসভাটিতে আয়ারলা নেতা নিরঞ্জন বাগ ও পার্টির পান্ডুয়া ব্লক সম্পাদক মুকুল কুমারও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন বিনোদ আহির।

bankura

 

বাঁকুড়ার রিপোর্ট
ওন্দা বিধানসভার অন্তর্গত চারটি অঞ্চলে দেশজুড়ে চলা কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বাড়ি বাড়ি প্রচার সংগঠিত করে, ৩১ জানুয়ারী নিকুঞ্জপুরে গ্রামীণ মজুর, ক্ষেতমজুর ও কৃষক জনগণের একটি আলোচনা সভা ডাকা হয় সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলার তরফ থেকে।

উক্ত সভায় এই আন্দোলনগুলিকে আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্তরে জল-জঙ্গল-জমি বাঁচানোর লড়াইকে আরো বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করা হয়। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সারা দেশে মারণ থাবা বসানো সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী-কোম্পানির দালাল বিজেপি’র বিরুদ্ধে কীভাবে গ্রাম বাংলার মানুষকে সচেতন করা যায় সেই প্রশ্নেও দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলে। আসন্ন পশ্চিমবাংলা বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ওন্দা বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে যে ঘোষণা করেছে, সেখানে সর্বোতভাবে সাহায্য করার জন্য উপস্থিত জনতার মধ্যে থেকেই একটি কমিটি গঠন করা হয় ১৫ জনকে নিয়ে। যার নেতৃত্বে আছেন অজিত দাস, অশোক বাউরী, রবিদাস মুর্ম্মু প্রমুখ কমরেডরা। এইদিন বিকেল নাগাদ দিল্লীতে অবস্থানরত কৃষকদের ওপোর মোদী সরকার ও অমিত শাহের পেটোয়া দিল্লী পুলিশ কর্তৃক তীব্র দমন পীড়ন চালানোর বিরুদ্ধে, নয়া কৃষিআইন বাতিলের জন্য এবং কৃষক নেতাদের ওপর মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে নিকুঞ্জপুর স্কুলমোড় বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে। মিছিলে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জয়তু দেশমুখ এবং ওন্দা কেন্দ্রের প্রার্থী বাবলু ব্যানার্জী।

pargana

 

দক্ষিণ ২৪ পরগণার রিপোর্ট
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহের ডাকে দেশব্যাপী ৪টি লেবার কোড জ্বালানোর কর্মসূচীতে গত ৩ ফেব্রুয়ারী দঃ ২৪ পরগণার বজবজ ও বাখরাহাটে সর্বনাশা ৪টি শ্রমকোডের প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। বজবজের কালীপুর-বিড়লাপুর মোড়ে কোডের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। সমগ্র কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন AICCTU-জেলা সভাপতি কিশোর সরকার, সম্পাদক শিবন ধর, কাজল দত্ত, সুব্রত বিশ্বাস, অঞ্জনা মাল সহ অন্যান্যরা। কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন AICCTU জেলা সভাপতি কিশোর সরকার। বাখরাহাটে বুড়িরপোল নতুন রাস্তা মোড়ে কোডের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। সমগ্র কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন AICCTU-জেলা সভাপতি কিশোর সরকার, নিখিলেশ পাল, মোমিন সেখ, পূর্ণিমা হালদার, কৃষক নেতা দিলীপ পাল সহ অন্যান্যরা। কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন AICCTU জেলা সভাপতি কিশোর সরকার এবং AIKM জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল।

মুর্শিদাবাদ জেলার রিপোর্ট
গত ২৭ জানুয়ারী সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সহ অন্যান্য বাম দলগুলোর নেতৃত্বে নয়া কৃষি-আইন বাতিলের দাবিতে ও ২৬ জানুয়ারীর দিল্লীর কৃষক প্রজাতন্ত্র দিবস পালনে ঐতিহাসিক টাক্টর মিছিল সম্পর্কে বিজেপি-আরএসএস’র অপপ্রচার এবং পুলিশ ও বিজেপি-আরএসএস’র গুন্ডাবাহিনীর হামলার প্রতিবাদে বহরমপুর শহরে বিশাল মিছিল সংগঠিত হয়। এই মিছিল সংগঠিত করার জন্য জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে মানুষ মিছিল করে শহরের ওয়াইএমএ মাঠে জমায়েত হয়। বেলা আড়াইটার সময় ওয়াইএমএ মাঠ থেকে মিছিল বের হয়ে শহর পরিক্রমা করে টেক্সটাইল মোড়ে আসলে পুলিশ মিছিল আটকে দেয়। সেখানেই মেটাডোরের মধ্যেই মাইক লাগানো মঞ্চে বাম দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখা হয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে মানস মুকুল বক্তব্য রাখেন। জমায়েত থেকে বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল জেলাশাসক এর কাছে ডেপুটেশন দেয়। ডেপুটেশনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে জেলা সম্পাদক রাজীব রায় ডেপুটেশনে অংশগ্রহণ করেন।

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার রিপোর্ট
গত ৩১ জানুয়ারী অশোক নগরে কৃষক সংগ্রাম সংহতি মঞ্চের নামে স্টেডিয়াম বাজার, ৮নং স্কীম, গোলবাজার এই তিন জায়গায় পথসভা হয়। বিভিন্ন বন্ধু সংগঠনের মানুষজন উপস্থিত ছিলো। বক্তব্য রাখেন পবন সিংহ রায়, অজয় বসাক, সৌভিক। সঙ্গীত পরিবেশন করেন অঙ্কিতা।

siligurifarmer

দিল্লীর বুকে কাঁটাতার ব্যারিকেড দিয়ে কৃষক আন্দোলনকে দমন করা, কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, ২৬ তারিখ পরিকল্পিত ভাবে এক ধরনের “ফাঁদ” সৃষ্টি করে কৃষক আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ৬ ফেব্রুয়ারী বেলা ১২টা - ৩টা সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও এআইকেএসসিসি দেশব্যাপী চাক্কা জাম কর্মসূচীর আহ্বান জানিয়েছিল। উল্লেখ্য কেন্দ্রীয় সরকারের নজিরবিহীন দমন স্বত্বেও কৃষক আন্দোলন বিন্দুমাত্র স্তিমিত হয়নি, বরং দিল্লীর পার্শ্ববর্তী “বর্ডার”গুলিতে এবং সারা দেশ জুড়ে কৃষক জনগণের জমায়েত ও বিক্ষোভ তীব্রতর হয়ে উঠেছে। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দুই মাসের অধিককাল ধরে চলা এই নজিরবিহীন আন্দোলন মোদী সরকার বনাম দেশের কৃষক জনগণের এক গভীর দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যার মূল্য অপরিসীম। সমাজের ব্যাপকতর নাগরিক সমাজ সহ সর্বস্তরের মানুষ কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।

৪ ফেব্রুয়ারী দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় হামলা ও জনবিরোধী কেন্দ্রীয় বাজেটের বিরুদ্ধে জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, জেলা সদস্য অপু চতুর্বেদী, মোজাম্মেল হক, শরত সিংহ, পবিত্র সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে শিলিগুড়ির হাসমিচকে ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। অবিলম্বে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর থেকে সমস্ত মামলা  প্রত্যাহার এবং কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি করা হয়।

February

 

পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২নং ব্লকের কালনা-বৈচি রোডে শিরিষ তলা বাস স্ট্যাণ্ডে ৬ ফেব্রুয়ারী বেলা ১২টার সময় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কালনা লোকাল কমিটির উদ্যোগে এআইকেএম ও আয়ারলার কর্মীদের সমাবেশের মাধ্যমে বিক্ষোভ অবরোধ সংগঠিত করা হয়। দীর্ঘ সময় অবরোধের পর পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধ ওঠে। এই অবরোধের নেতৃত্ব দেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এর কালনা লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রফিকুল ইসলাম ও এআইকেএম নেতা কমরেড প্রদ্যুত ঘোষ এবং আয়ারলার জেলা সভাপতি কমরেড হরেকৃষ্ণ ঘোষ।

পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান শহরের নবাব হাট বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয় এআইকেএসসিসির পূর্ব বর্ধমান শাখার উদ্যোগে। এই অবরোধে এআইকেএম, আয়ারলাও এআইকেএসসিসির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ সময় অবরোধের পর নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। অবরোধ কর্মসূচীতে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখা হয়।

belghoriastay

গান্ধীজীর প্রয়াণ দিবসে হিসাব বহির্ভূত সিইএসসি’র অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের বিরুদ্ধে সিপিআই, সিপিআই(এম), সিপিআই (এমএল) এবং জাতীয় কংগ্রেসের যৌথ ধর্ণা, অবস্থান, বিক্ষোভ এবং ডেপুটেশন কর্মসূচী পালিত হয়। বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ।

conferencerangapani

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন, ঋণমুক্তি আন্দোলন সহ বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্টির লক্ষ্য নিয়ে রাঙাপাণি ভতনজোতে ৭ ফেব্রুয়ারী দার্জিলিং জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একটি কর্মীসভা আয়োজিত হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, সভাপতিত্ব করেন জেলা কমিটির বর্ষীয়ান নেতৃত্ব নেমু সিংহ এবং পবিত্র সিংহ। ফাঁসিদেওয়া কেন্দ্রে নির্বাচনে প্রচার কৌশল নিয়ে আলোচোনা হয়। বক্তব্য রাখেন শরত সিংহ, পৈষানজু সিংহ, পঞ্চা বর্মণ প্রমুখ।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন শক্তিগড়ের শাখা কমিটির ৯ম বার্ষিক সাধারণ সভা (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হল ৭ ফেব্রুয়ারী। কমরেড বাধনা ওঁরাও মঞ্চ নামাঙ্কিত ছোট্ট পরিসরে ১৪ জন ব্রাঞ্চ সদস্যের উপস্থিতিতে সভার শুরুতেই সদ্য প্রয়াত নদীয়া জেলা সম্পাদক, পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড সুবিমল সেনগুপ্ত এবং কমরেড চারু মজুমদারের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন বর্ষীয়ান জেলা নেতৃত্ব পুলক গাঙ্গুলী। শহীদ স্মরণের পর বিদায়ী কমিটির পক্ষে খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন শাশ্বতী সেনগুপ্ত। প্রতিবেদনের ওপর বক্তব্য রাখেন উপস্থিত ব্রাঞ্চ সদস্যা মিলি ভট্টাচার্য, ভাগ্য মন্ডল রুমা রায়। মূলত বন্ধনের ঋণ সংক্রান্ত সমস্যার কথাই তারা বলেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে স্হানীয় স্তরে কর্মসূচী নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।রজত বর্মণ, মিলি ভট্টাচার্য, ভাগ্য মন্ডল, রুবী সেনগুপ্ত এবং শাশ্বতী সেনগুপ্তকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের লিডিং টিম গঠিত হয়। জেলা নেতৃত্ব পুলক গাঙ্গুলী এবং শিলিগুড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক মোজাম্মেল হক নতুন কমিটিকে অভিনন্দিত করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্টির লক্ষ্য, উদ্দেশ্যর কথা তুলে ধরেন। শাশ্বতী সেনগুপ্ত পুনর্বার ব্রাঞ্চ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

corporaterich

মাসের ১ তারিখে যখন বাজেট পেশ করা শেষ করলেন অর্থমন্ত্রী ঘড়ির কাটা তখন বেলা ১টা ছুঁতে যাচ্ছে। টিভির পর্দায় অর্থনীতিবিদ ব্যবসায়ীরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময়ে রাস্তায় ফেরিওয়ালার হাঁক শুনতে পেলাম, “মাছ চাই মাছ, কাতলা, চিংড়ি, পার্সে মাছ”। যেহেতু অবসর নিয়েছি বেশ কয়েক বছর হল তাই দুপুরবেলায় অনেকদিনই বাড়িতে থাকি; কিন্তু দুপুর দেড়টার সময় অবিক্রিত মাছ বিক্রির জন্য হাঁক সচরাচর শোনা যায় না। অতিমারীর গোড়া থেকেই ঘরের দোরে সব্জি মাছ মশলা আসছে; ওই মাছ মিষ্টি আর মোরের মতো। তবে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে বলে গত কয়েক মাস ধরে শুনলেও অতিমারীজনিত লকডাউনের কারণে সব্জি-মাছ বিক্রির পেশায় আসা ফেরিওয়ালাদের সংখ্যা ও অসময়ের হাঁক কমছেই না। তাহলে নির্মলাজি কি নির্মল রসিকতা করে মিথ্যে বলছেন? ওঁরা ‘পবিত্র’ সংসদে দাঁড়িয়ে অসত্য বলবেন এমনটাতো হতেই পারেনা, তাছাড়া যেখানে ‘সর্বজনপ্রিয়’ মোদীজিও টেবিল চাপড়ে সাবাশ জানাচ্ছেন। ফলে সীতারামন সত্য, বাজেট বক্তৃতা সত্য, শেয়ার বাজার সত্য; মাছ সব্জির ফেরিওয়ালারা মিথ্যে। ওঁদের অবস্থা স্বাভাবিক হওয়া সত্বেও অতিমারীতে অতি লাভের লোভ তৈরি হয়েছে তাই এখনো সারাদিন মাছ বেচে চলেছে। বছর ঘুরতে চলল সেই ঘোষণার যেদিন মাননীয় প্রধান সেবক ৪ ঘন্টার নোটিশে ভারত বন্ধ ডেকে দিয়ে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে লাখো লাখো ঘর ছেড়ে কাজের খোঁজে যাওয়া শ্রমিকদের না খাইয়ে মারার বন্দোবস্ত করেছিলেন; বলেছিলেন, মাত্র ২১ দিনে করোনাসুরকে পরাস্ত করবেন তিনি। ১১ মাস কেটে যেতে চলল সেই শ্রমিকরা কাজ হারালেন, আবার কাজের খোঁজে ভিন দেশে পাড়ি দিলেন, করোনায় ভারতে লক্ষাধিক মানুষ সরকারী হিসেবেই মারা গেলেন, আক্রান্ত হলেন তার শতগুণ। তবু করোনার এখনো সুরাহা হলো না। মধ্য এশিয়া বাদে সারা মহাদেশে এদেশে কোভিডের প্রকোপ সর্বাধিক, জনসংখ্যা পিছু মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। তবু নির্মলারা আমরা করোনা মোকাবিলায় সব থেকে এগিয়ে বলে নির্মম রসিকতা করতে পারেন। অন্যদিকে করোনাজনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের অবস্থা বৃহৎ অর্থনীতিগুলির মধ্যে বেশ করুণ। ততোধিক দূরবস্থা দেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের, যারা রুজি হারিয়েছেন, কোনোমতে রুটির জোগাড়ে প্রাণপাত করছেন। বেলা দেড়টা দুটোর সময়েও মাথায় মাছের ঝুড়ি নিয়ে মাছ চাই মাছ বলতে বলতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

এই সরকারের নেতা মন্ত্রীরা রামের থেকে নাথুরামকেই বেশি আপন করে রেখেছেন হৃদয়ে, প্রধানমন্ত্রীও। যদিও বাইরে তারা রাম ভক্ত, অন্তরে নাথুরাম। প্রধানমন্ত্রী গান্ধীকে ব্যবহার করেন ভোটের জন্য, গডসেকেও বাদ দেননা। এমন দ্বিচারিতায় পান্ডিত্য অন্য কোনো শাসকের আয়ত্বে ছিল বলে মনে পড়ছে না। যে প্রধানমন্ত্রী মহাত্মা গান্ধীকে মেনে চলার ভান করেন তাকে যদি প্রশ্ন করা যায় যে, গান্ধীজি বলেছিলেন, কোন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে ভেবে দেখতে যে তা সমাজের সবথেকে পিছিয়ে পড়া দরিদ্রতম মানুষের কী উপকারে আসবে, তাই এই বাজেট, গত ৬ বছরের বাজেট অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশল দেশের হতদরিদ্র গরিব মানুষগুলির ঠিক কী কী উপকার করেছে? উত্তরে তিনি অনন্ত মিথ্যে বলতে পারবেন, মিথ্যে পরিসংখ্যান হাজির করবেন তার পারিষদরা। কিন্তু বোধহয় কোন ফুটপাথবাসি দরিদ্র নাগরিককে খুঁজে পাবেন না যিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গৃহের সংস্থান করেছেন। যদিও গত কয়েক বছরের অর্থনীতির গরিমা কীর্তনে আগের ৬টি বাজেটের মত এ বাজেটও দরাজ।

বাজেটের মূল সুর অতি ধনী পুঁজিপতিদের কাছে দেশের অর্থনীতিকে তুলে দেওয়ার, সেই পুঁজিপতিরা বিদেশি পুঁজির তাঁবেদারিও করবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত কিছু টাকা বরাদ্দের কথায় বাজেট বক্তৃতাকে ভরিয়ে দিয়ে গরিব জনগণের জন্য সামাজিক দায়িত্ব পালনের কাজটি শেষ করা হয়েছে। সারা বছর শাসক দল ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে, সমাজকে পশ্চাদমুখি করার ভাবনাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা বজায় রাখার সমস্ত কদর্যতাকে প্রকট করে তোলে। কিন্তু বাজেট অথবা অন্য কোন অর্থনৈতিক নীতি বা আইন প্রণয়নের সময় খেয়াল করিয়ে দেয় যে দেশে আসলে দু’ধরণের মানুষ আছে, ধনী ও গরিব; পুঁজির মালিক শাসক নাগরিক হিসেবে ও শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষ প্রজা হিসেবে। বরাবর এ’কথাকে স্পষ্ট করে দেয় যে, দেশের উৎপাদন, আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ বিষয়ে চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেবল শাসক দলের, আর সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ধনী অর্বুদপতি (বিলিওনেয়ার) পুঁজির মালিকদের কথা মাথায় রেখে। বিশ্বজোড়া অতিমারী, দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ভয়ানক ভাবে ঋণাত্মক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শিল্প ধুঁকছে, ফুটপাথের হকার, চা-দোকানি, রেলওয়ে হকার, স্টল, পরিবহণ কর্মী, ছোট রেস্তোরার মালিক-শ্রমিক, ভ্রমণ ব্যবসায়ে নিযুক্ত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, সংগঠিত ক্ষেত্রের কাজ হারানো শ্রমিক কর্মচারি গত এক বছর ধরে কোনো রকমে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের আয় খুইয়েছে। কিন্তু দেশের অর্বুদপতিদের সম্পদ বেড়েছে ১৩ লক্ষ কোটি টাকার। তাদের হাতে অঢেল অর্থ। জনমুখি সরকারের দায়িত্ব সেই অতিরিক্ত সম্পদ ও আয়ের একটি অংশকে সরকারী কোষাগারে নিয়ে তাকে পুনর্বন্টনের মাধ্যমে অতিমারীর ফলে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের কাছে পৌঁছে দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার। এই ধনী অর্বুদপতিদের তাঁবেদার সরকার তা করতে নারাজ। ফলে কর না বসিয়ে সেই ধনীদের কাছে সরকারী সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার ভাবনায় মশগুল মোদী, নির্মলারা। বিপদে পড়ে গৃহকর্তা অসহায় জমিদার যেমন পূর্বপুরুষের সঞ্চিত সম্পদকে নিলামে তোলে, আর তার অপেক্ষায় থাকে নিলামের দোকানি ও নিলামের ক্রেতারা, ঠিক সেভাবেই দেশের সঞ্চিত রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানিগুলিকে নিলামে তোলার ঘোষণা করেছে সরকারি অছিরা। সেই নিলামে দেশকে বেচা হবে, বিক্রি করা হবে সেই সব অর্বুদপতিদের কাছে যারা এই অতিমারিতে অতি ধনী থেকে অতি অতি ধনী হয়েছে। যে অর্থ অর্বুদপতিদের কাছ থেকে কর বসিয়ে আদায় করা যেত, সরকারের করার হক ছিল, সেই অতিরিক্ত সম্পদকেই সেই অতি অতি ধনীরা ব্যবহার করবে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক, বীমা, বিমান কোম্পানিকে নিজেদের কুক্ষিগত করার জন্য। কর্পোরেট পুঁজির কাছে মাথা বিক্রি করে দেওয়া এই শাসকদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আদানি আম্বানিরা যে চাইবেই তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই।

দেশের অর্থনীতিকে জনমুখি করে তোলার কোন আন্তরিক বাসনা যে সরকারের নেই তা রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকারের প্রতিটি বাজেটেই প্রকট। ইচ্ছেমতো পরিসংখ্যান ব্যবহার করা তার মধ্যে অন্যতম, অবশ্য ফরমায়েশি পরিসংখ্যান প্রস্তুত করানোও আরেক বড় চালাকি। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে জটিলতার মধ্যে পড়েছে তা অস্বীকার করার মধ্যে নিজস্ব বীরত্ব ঘোষণার মোদী সুলভ আত্মম্ভরিতা থাকলেও আমজনতার যা প্রয়োজন, কর্মসংস্থান, খাদ্য সুরক্ষা, শিক্ষা সেসবের প্রতি দৃষ্টি নেই। মনে রাখা দরকার গত ২০১৮ সালের গোড়া থেকেই ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধি ক্ষয় পেতে শুরু করেছে। কোভিড আক্রান্ত হওয়ার আগের ৭টি ত্রৈমাসিকের প্রত্যেকটিতেই বৃদ্ধির হার তার আগেরটির তুলনায় কম ছিল। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছিল। কিন্তু যেহেতু পুলওয়ামা-বালাকোটকে হাতিয়ার করে মেকি দেশপ্রেমের জোয়ারে দেশকে ভাসিয়ে মোদী পুনরায় ক্ষমতায় বসতে পেরেছেন তাই অর্থনীতির বেহাল অবস্থাকে থোড়াই কেয়ার করে এই সরকার। দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষের হাতে যখন কাজ নেই বা থাকলেও যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি তৈরি করতে তা অপারগ তখন চাহিদা তৈরির জন্য শ্রমজীবীদের আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা গ্রহণে সরকারের দায় ছিল। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রের দু’টি চাহিদা বৃদ্ধি করার মতো প্রকল্পেই ব্যয় বরাদ্দ কমানো হল। ১০০ দিনের কাজে সংশোধিত বাজেট অনুমান অনুসারে ১১১ হাজার কোটি টাকাকে কমিয়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে আসা হল যা আদতে ২০১৯-২০ সালের বাজেট বরাদ্দের অনুরূপ। ফলে দু’বছরে যে মুদ্রাস্ফীতি-জনিত মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে তাকে ধরলে কাজের পরিমাণ ২০১৯-২০র তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ কমবে ধরা যেতে পারে। অন্যদিকে সারা দেশ জুড়ে যখন কিষাণ আন্দোলন চলছে সেই সময়ে পিএম কিষান প্রকল্পে বরাদ্দ ৭৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা করা হল। বাজেট বক্তৃতায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পরিমাণকে ১৩৭% বাড়ানোর কথা বলা হলেও, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বা সরাসরি স্বাস্থ্যখাতে তেমন বৃদ্ধি তো হয়ইনি বরং সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ, ৮২,৪৪৫ কোটি থেকে কমে তা ৭৪,৬০৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যদিও পানীয় জল ও নিকাশি ব্যবস্থার জন্য বরাদ্দ বর্ধিত অর্থ ও কোভিড প্রতিষেধক টিকার জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকাকে ধরে অর্থমন্ত্রী ওই ১৩৭% বৃদ্ধির গল্পটি ফেঁদেছেন। পরিকাঠামোক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার কথা বারবার উচ্চারিত হলেও যে সমস্ত ঘোষণা করা হচ্ছে তা অনেকটাই কল্পিত ও আগামী কয়েক বছর ধরে চলবে, হযতো নাও রূপায়িত হতে পারে। যেসমস্ত রাজ্য নির্বাচনের মুখোমুখি যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, তামিলনাড়ু সেই সমস্ত রাজ্যে বিজেপি যাতে এই করেছি সেই করেছি বলে ভোট চাইতে পারে তাই সেই সমস্ত রাজ্যে রাস্তা বা অন্য পরিকাঠামোর প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, যেগুলি যদি রূপায়িতও হয় তাহলেও তা চলবে ৫-১০ বছর ধরে।

অনেক ক্ষেত্রে নির্মলাজি একই কুমিরছানাকে বার বার দেখালেন। আগেই ঘোষিত হওয়া প্রকল্পকে আবার ঘোষণা করলেন। কৃষকদের আন্দোলনকে অযৌক্তিক প্রমাণের জন্য সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার জন্য ব্যয় কত বাড়িয়েছে তা দেখানোর জন্য বাজেট বক্তৃতায় সংযোজনীও জুড়লেন। কিন্তু কেন পিএম-কিষাণ যোজনায় বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হলনা বা বরাদ্দ কেন কমানো হল সেব্যাপারে একটি কথাও বললেন না। জানালেন না কীভাবে ওই প্রকল্পের ১,৩০০ কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নতি নিয়ে প্রতিনিয়ত বক্তৃতা শোনা যায় এই সরকারের নেতা মন্ত্রীদের মুখে। এই অতিমারীর সময়ে সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ অনুসারে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মন্ত্রকের ২০২০-২১ সালের বাজেট বরাদ্দ ৭,৫৭২ কোটি টাকা থেকে কমে ৫,৬৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে যা ২০১৯-২০ সালের প্রকৃত ব্যয়ের থেকে ২,০০০ কোটি টাকা বা প্রায় ১৫% কম। ওই শিল্পকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের তত্ব যে কতটাই কল্পকথা তা এই পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দিচ্ছে। মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট প্রকল্প, ‘বেটি ,বাঁচাও বেটি পড়াও’, ‘প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনা’কে ‘সামর্থ্য’ নামের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। সামগ্রিকে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট যে বাজেট বরাদ্দ তা গত বছরের বাজেট বরাদ্দ, ২৮,৫৬২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৫,২৬০ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা ২০১৯-২০ সালের প্রকৃত ব্যয় ২৬,৭৩১ কোটি টাকার থেকে কম, আর ২০২০-২১’র সংশোধিত অনুমান ৬৬,০১৪ কোটি টাকার ৫ ভাগের ২ ভাগ মাত্র। মহিলাদের সামর্থ্য বাড়াতে সরকারের আন্তরিকতা বোঝাই যাচ্ছে। অনুরূপে শিশুকল্যাণের জন্য সামগ্রিক বরাদ্দ ২০২০-২১’র বাজেটের ৯৬,০৪২ কোটি থেকে কমিয়ে ৮৫,৭১২ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। এক্ষেত্রেও সুসংহত শিশু উন্নতি প্রকল্প (আইসিডিএস)কে ‘সক্ষম’ নামকরণ করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছে সরকার। কিন্তু গত ২০২০-২১ সালে আইসিডিএস ও সহযোগী খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮,৫৫৭ কোটি টাকা; তাকে ২০,১০৫ কোটি টাকায় কমিয়ে সক্ষমে রূপান্তর করা হয়েছে। ২০২০-২১ বাজেটে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৬,৪০০ কোটি টাকা। অতিমারি সত্বেও সংশোধিত অনুমানে খরচ হবে ৩,১০০ কোটি টাকা (২০১৯-২০তে প্রকৃত ব্যয় ৩,২০০ কোটি টাকা); এবার বাজেটেও বরাদ্দ করা হয়েছে ৬,৪০০ কোটি টাকা। জনসংখ্যা বাড়লেও বরাদ্দ বাড়ছেনা, ব্যয়ও কমছ,। গুরুত্বপূর্ণ যে খরচের খাতগুলি রয়েছে তার দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় সবক্ষেত্রেই ২০২০-২১’র বাজেট বরাদ্দ বা আনুমানিক সংশোধিত খরচের তুলনায় ২০২১-২২’র বাজেট বরাদ্দ কমেছে। সার, খাদ্য বা পেটোলিয়াম পণ্যের ভরতুকিতে হ্রাস ঘটেছে। কেরোসিন তেলে ভরতুকি তুলে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ গত বাজেটের ৯৯,৩১২ কোটি টাকা থেকে ৬,০৮৪ কোটি টাকা কমিয়ে ৯৩,২২৪ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। এমন এক সময়ে শিক্ষায় বরাদ্দ কমানো হচ্ছে যখন গরিব শিশু-কিশোররা গত এক বছর ধরে শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের হিসেব অনুযায়ী শিশুদের পড়াশোনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ ভারতবর্ষে ২৯ লক্ষ কোটি টাকা। সমাজ কল্যাণে গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা (৫৩,৮৭৬ কোটি থেকে ৪৮,৫৬০ কোটি)। গ্রামোন্নয়নে আনুমানিক সংশোধিত খরচের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে ২২ হাজার কোটি টাকা। আগেই বলেছি পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই সরকারের অনীহা প্রবল। তা তাদের ব্যয় বরাদ্দেও প্রকট হচ্ছে। ২০১৯-২০ সালে প্রকৃত ব্যয় ছিল ৫,৪৭৯ কোটি টাকা, ২০২০-২১এ বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬,০৯৪ কোটি টাকা, ২০২০-২১’র আনুমানিক সংশোধিত খরচ মাত্র ২,১৬৪ কোটি টাকা; আর ২০২১-২২এ বাজেট বরাদ্দ ২,৪৭২ কোটি টাকা যা ২০২০-২১এ বাজেট বরাদ্দের ৪০%।

অন্যদিকে পেট্রলের উপর অন্তঃশুল্ক কমিয়ে সেস বসানো হল। ফলে পেট্রল-ডিজেলের দাম হয়তো তেমন বাড়ল না, কিন্তু সরকার ঘুরপথে রাজ্যের আয়ে হস্তক্ষেপ করল। অন্তঃশুল্ক থেকে পাওয়া অর্থের ৪১% রাজ্যগুলির কাছে যেত, সেসের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের একচ্ছত্র অধিকার। ফলে অন্ত:শুল্ক কমিয়ে পেট্রল-ডিজেলে সেস বসিয়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোকে আঘাত করল এই বাজেট।  

তদর্থে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকেই নিজেকে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিচ্ছে। কর্পোরেট চালিত শাসনকে গ্রহণযোগ্য করাই মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪টি ক্ষেত্রকে স্ট্রাটেজিক ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১) পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা; ২) পরিবহণ ও টেলিযোগাযোগ; ৩) বিদ্যুত, পেট্রোলিয়াম, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ; ৪) ব্যাঙ্ক, বীমা ও অর্থলগ্নি পরিষেবা। এই ৪টি ক্ষেত্রে সরকারের উপস্থিতিকে ন্যূনতম করে তুলে বাদবাকি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হবে। তাছড়া যে কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা আছে তাদের হয় বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হবে নইলে বন্ধ করে দেওয়া হবে। শুরুতেই বলেছিলাম যে, এই বাজেটে ও পূর্বতন বাজেটের মূল সুর প্রকৃত অর্থে দেশের সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়ার চরম নয়া উদারনীতিবাদ। ২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটে আমাদের দেশ তেমন সমস্যায় পড়েনি কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ছিল একটি বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারও ২০০৮ পরবর্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছে। কিন্তু এই অতিমারির সময়ে স্যাঙাত পুঁজির তাঁবেদাররা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকেই তুলে দিতে চাইছে। নেহরু-ইন্দিরাকে গালাগালি দিতে দিতে তাদের জমানো সম্পদেই রাজ্যপাট চালানোকে দস্তুর করে ফেলেছে সরকার। এ’বছরের বাজেটে সরকারি সম্পদকে বেচে ১৭৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে সরকারের। কিন্তু সব সম্পদ ফুরিয়ে গেলে কী হবে তা ভেবে দেখা দরকার।

সবশেষে বলি, বাজেট নিয়ে এই চর্চার কি কোনো মানে আছে, অন্ততপক্ষে বাজেটের আয়-ব্যয়ের দিক থেকে। বেসরকারীকরণের নীতি বা শ্রমকোড মোতাবেক শ্রমিকদের অধিকার হরণের বিষয়গুলি বাজেটের মধ্য দিয়ে উচ্চড়ারিত হয় ও পরবর্তিতে কার্যকরিও করা হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারীর গোড়ায় এপ্রিল থেকে মার্চ পর্যন্ত বাজেট হয়। পরের বছর ফেব্রুয়ারীর গোড়ায় আবার চলতি বছরের জন্য সংশোধিত আনুমানিক আয়-ব্যয়ের হিসেব হয়। সর্বশেষে প্রকৃত আয়-ব্যয়ের হিসেব পাওয়া যায়। একটির সঙ্গে অন্যটির তফাৎ বাড়তেই থাকে। ধরা যাক গত ২০১৯-২০কে। বাজেটে আয় ছিল ২০.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা, ব্যয় ছিল ২৭.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা। পরের বছর বাজেটের সময় সংশোধিত অনুমানে ব্যয় কমে দাঁড়াল ২৬.৯৯ লক্ষ কোটি টাকা; অনুমান করা হল আয় কমে দাঁড়াবে ১৯.৩২ লক্ষ কোটিতে। বছর শেষ হলে প্রকৃত আয় হয়েছিল ১৭.৫১ লক্ষ কোটি টাকা (বাজেটের থেকে ৩.৩২ লক্ষ কোটি টাকা বা ১৬% কম, সংশোধিত অনুমানের থেকে ১.৮১ লক্ষ কোটি টাকা বা ৯.৪% কম)। ব্যয়ের দিক থেকে প্রকৃত ব্যয় হয়েছিল ২৬.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা (বাজেটের থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকা কম)। এই বাজেটেও সংশোধিত অনুমানে ২০২০-২১ সালে মোট ব্যয় হবে ৩৪.৫০ লক্ষ কোটি টাকা, কম্পট্রোলার জেনারেল অফ একাউন্টস (সিজিএ)’র হিসেব অনুযায়ী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২২.৯০ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ জানুয়ারী-মার্চ এই ৩ মাসে ব্যয় করা হবে ১১.৬০ লক্ষ কোটি টাকা, যা গত ৯ মাসে যতটা ব্যয় করা হয়েছে তার ৫০%। ২০১৯-২০ সালে অনুরূপ ৩ মাসে ব্যয় করা হয়েছিল সাকুল্যে ৫.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা যা পূর্বতন ৯ মাসের মোট ব্যয়ের ২৭% ছিল। তাই সরকারের আয় ব্যয়ের অনুমানের ক্ষেত্রে যে খামখেয়ালিপনা দেখা যাচ্ছে তা অনুমেয়।

– অমিত দাশগুপ্ত   

digitaldigital

মহারাষ্ট্রের ভীমা কোড়েগাঁওতে ২০১৮ সালে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি দলিতদের জমায়েতে হামলা করে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী করে। একজনের মৃত্যু হয় সেই ঘটনায়। সবাইকে অবাক করে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশান এজেন্সি সেই সময় ভীমা কোরেগাঁও ঘটনাকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের একটি অংশ বলে দাবি করে। এরকম প্রচার করা হয় যে মাওবাদীরা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। প্রায় সাথেই সাথেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মীকে গ্রেপ্তার করা শুরু হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন রোনা উইলসন, শুধা ভারাদ্বয়াজ, ভারভারা রাও, স্ট্যান স্বামী এবং আরো অনেকে। এরা প্রায় প্রত্যেকেই মোদী সরকারের প্রকাশ্য সমালোচক ছিল। কোন হিন্দুত্ববাদী কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় না। এনআইএ দাবি করে যে এঁদের কাছ থেকে বাজেয়প্ত করা ল্যাপটপগুলি থেকে এমন অনেক চিঠি কাগজ পাওয়া গেছে যা এই ষড়যন্ত্রকে প্রমাণিত করে। অভিযুক্তরা বারবার বলেন যে উক্ত চিঠিগুলি কোথা থেকে তাঁদের ল্যাপটপে এল তা তাঁরা জানেন না।

সম্প্রতি আর্সেনাল কন্সাল্টিং নামে এক বেসরকারী ডিজিটাল ফরেন্সিক সংস্থা উক্ত ল্যাপটপগুলির ওপর একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা রোনা উইলসানের ল্যাপটপের বৈদ্যুতিক কপি বিশ্লেষণ করেছে রোনার উকিলের অনুরোধে। এনআইএ-র দাবি মতো রোনার ল্যাপটপেই সব থেকে জোরালো প্রমাণ স্বরূপ চিঠিটি পাওয়া গিয়েছে। সেই চিঠিতে রোনা একজন মাওবাদী কমান্ডারের কাছে অস্ত্র চাইছে মোদীকে খুন করার জন্যে। কিন্তু ফরেন্সিক তদন্ত রিপোর্ট দিখিয়ে দিয়েছে যে এনএইএ যেইসব প্রমাণের কথা বলছে সেই সব প্রমাণ রোনার ল্যাপটপে বাইরে থেকে ঢোকানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য প্রায় ২০১৬ থেকে এই চিঠিগুলো ল্যাপটপে ঢোকানো শুরু হয়। ২০১৮ অবধি এই চিঠি গুলো ধীরে ধীরে রোনার ল্যাপটপে একটি হিডেন ফোল্ডারে রাখা হয়। রোনার ল্যাপটপে এই জিনিসটি করা হয় ‘নেট ওয়্যার’ নামে একটি ম্যালওয়্যার সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ২০১৬-তে রোনারই এক পরিচিত তাকে একটি ইমেল পাঠায়। সেই ইমেলে একটি লিঙ্ক ক্লিক করতে বলে তাকে কিছু সিভিল গ্রুপের স্টেটমেন্ট ডাউনলোড করার জন্যে। ক্লিক করতেই নেট ওয়্যার নামে এই সফট ওয়্যার তার ল্যাপটপে ঢুকে যায়। নেট ওয়্যার ব্যবহার করে হ্যাকার ল্যাপটপটিকে ইন্টারনেটের মধ্যে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং কীবোর্ডে যা টাইপ করে হচ্ছে রেকর্ড করতে পারে। এর মাধ্যমে যেকোন ফাইল ল্যাপটপে ঢোকানো যায় এবং বার করা যায় এবং সমস্ত পাসওয়ার্ড ও পেয়ে যায় সে। আর্সেনাল বলেছে যে এত লম্বা সময় ধরে হ্যাকিং এর ঘটনাও তারা খুব একটা দেখেনি। তারা এই ল্যাপটপটা প্রায় ৩০০ ঘন্টা ব্যয় করে বিশ্লেষণ করেছে। এই সংস্থা বোসটন বম্বিংএর ডিজিটাল ফরেন্সিক বিশ্লেষণ করেছিল। এটাও দেখা যাচ্ছে যে যেই ইন্টারনেট প্রোভাইডার এড্রেস এবং সাইট থেকে রোনার ল্যাপটপে এই আক্রমণটা হয়েছে অন্য অভিযুক্তদেরও সেই একই জায়গা থেকে আক্রমণ করা হয়েছে।

রোনার আইনজীবী জানিয়েছেন, এই রিপোর্টের পর বোঝা যাচ্ছে যে তার ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। সে বম্বে হাইকোর্টে এই রিপোর্ট জমা দিয়ে পিটিশান করেছে তার ক্লায়েন্টকে এখুনি অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে। এনএইএ জানিয়েছে যে তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী রোনার ল্যাপটপ ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। এর আগে টার্কিতে এক সাংবাদিকেকে সন্ত্রাসবাদী মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আর্সেনাল দেখায় যে প্রমাণগুলি তার কম্পিউটারে হ্যাক করে ঢোকানো হয়েছে। তাকে টার্কির কোর্ট মুক্তি দেয়।

এই কেস নিয়ে ‘সংযুক্ত জাতিরাষ্ট্র’ নিজেদের গভীর চিন্তা ব্যক্ত করেছে আগেই এবং সরকারকে অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বলেছিল। ২০১৯ সালে অভিযুক্তদের যারা সাহায্য করছিল তাদের তিন জনের মোবাইল ল্যাপটপ পেগাসাস স্পাইওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই সফটওয়্যারটির জনক কোম্পানি এই ধরণের সফটওয়্যার কেবলমাত্র কোনও দেশের জাতীয় সরকারকেই বিক্রি করে থাকে। মোদী সরকার এই পেগাসাস কান্ডকে সরাসরি অস্বীকার করেনি, উত্তরে কেবল বলেছিল যে, অনুমতি ছাড়া কোনও কাজ তার সরকারের কোনো কর্মচারি করেনি।

এই পুরো ঘটনাক্রম থেকে বোঝা যাচ্ছে এক দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এই সামাজিক কর্মীরা। এরা প্রায় অনেকেই সমাজের অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করতেন এবং কঠিন পরিস্থিতিতে জীবন কাটিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে এরকম ষড়যন্ত্র ভারতীয় গণতন্ত্রেরর জন্য ঘনিয়ে আসা ভয়ানক বিপদ ও দলিত সমাজের প্রতি বিজেপির কুটিল হিংসাকে প্রকটভাবে দেখিয়ে দেয়।

- প্রত্যূষ নন্দি

dilip

জগদ্দল লোকাল কমিটির সদস্য কমঃ দিলীপ রাউথ গত ২৪ জানুয়ারী ফুসফুস সংক্রমণে মাত্র ৫২ বছর বয়সে প্রয়াত হন। ৪ ফেব্রুয়ারী তাঁর পরিবারবর্গ ও বন্ধুদের উদ্যোগে তাঁর স্মরণ সভা আয়োজিত হয়। স্মরণসভায় গণসংস্কৃতি পরিষদের তরফ থেকে কমঃ সরিৎ চক্রবর্তী  ও মেহুলি সংগীত পরিবেশন করেন। শিল্পী ও কবি দিলীপের শিল্পী জগতের বন্ধুরা স্মৃতিচারণ করেন। তাছাড়া তাঁর ভাগ্নেরা ও মেজদি বক্তব্য রাখেন। সিপিআই(এম‌এল) পার্টি থেকে বক্তব্য রাখেন বারাকপুর এরিয়া সম্পাদক নারায়ণ দে ও আইসার নেতা শুভ্রদীপ। উপস্থিত ছিলেন পার্টির স্থানীয় সদস্য সহ কমরেড দিলীপের প্রিয়জনরা। শোকসভা পরিচালনা করেন দিলীপের বন্ধু কমরেড ধীরেন মন্ডল।

End

খণ্ড-28
সংখ্যা-5