২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবার বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের কারণে। ১৯৫২-র একুশের লড়াই ছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ২০২১ এর লড়াই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই। কুমার রানা, কৌশিক সেন, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, মৌসুমী ভৌমিক, কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, পুণ্যব্রত গুণ, নব দত্ত, শামিম আহমেদ, অলিক চক্রবর্তী, আশিস কুসুম ঘোষ, সুজাত ভদ্র, মেরুনা মুর্মু, অশোক বিশ্বনাথান, অনুরাধা দেব, পল্লব কীর্তনিয়া, অভিজিৎ বসু, শরদিন্দু বিশ্বাস প্রমুখ আহ্বায়কদের পক্ষ থেকে এই কার্যক্রম আয়োজিত হয়। বস্তুতপক্ষে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারী পালন যতটা সাংস্কৃতিক, ততটাই রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কারণে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও গণআন্দোলনের ব্যক্তির উদ্যোগে এই দুটি দিককে মিলিয়েই পালিত হল একুশের মিছিল ও গণ সমাবেশ।
একুশের দুটি বর্ণাঢ্য মিছিল যথাক্রমে সুবোধ মল্লিক স্কয়ার ও হাওড়া থেকে ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে আসে। সেখানে গণসমাবেশে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার ও অভিনেতা কৌশিক সেন, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, নাগরিক মঞ্চের নব দত্ত, অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু, দলিত আন্দোলনের নেতা শরদিন্দু উদ্দীপন, চিত্র পরিচালক অর্জুন গৌরিসারিয়া, বামপন্থী আন্দোলনের নেতা হাফিজ আলি সইরানি ও অলিক চক্রবর্তী, ছাত্র নেতা মৃন্ময় সরকার, শ্রমিক আন্দোলনের আশিস নেতা কুসুম ঘোষ প্রমুখ। বক্তব্য রাখেন চা-বাগান শ্রমিকদের আন্দোলনের নেত্রী সিমন্তি এক্কা, ঋণ মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী রুমা আহিরি। মিছিলে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা সুজাত ভদ্র ও দলিত আন্দলের নেতা কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর।
অনুষ্ঠানের শুরু, শেষ ও মাঝের পর্বছিল নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পূর্ণ। সঙ্গীত পরিবেশন করেন অগ্নিবীণা গানের দল, জনগণমন গানের দল, বাবুনি ও মেঘনা মজুমদার, নীতীশ রায়, মেরুনা মুর্মু। আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটক পরিবেশন করেন ঋদ্ধি আবৃত্তি গোষ্ঠী, অভিজিৎ, মহাশ্বেতা সমাজদার। থ নাট্যগোষ্ঠীর একটি নাটক পরিবেশিত হয় বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে, সমন্বয়ের সংস্কৃতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরে।
সভায় উপস্থিত বক্তাদের বক্তব্যে মূলত উঠে আসে ফ্যাসিবাদকে রোখার সংকল্প। সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “যারা পরিবর্তনের নাম করে বাংলাকে ধ্বংস করতে চাইবে, আজ এই একুশের ডাক থেকে আমরা সংকল্প নিয়ে যাচ্ছি ওদের ধ্বংস করতে দেবো না। ধ্বংসের বিরুদ্ধে সৃষ্টির গান গেয়ে আমরা এই বিপর্যয় রুখবো। এই বাংলা সকলের বাংলা। এই বাংলা যারা বাংলায় কথা বলেন তাদের বাংলা। এই বাংলার বুকে যারা আদিবাসী ভাষা সে সাঁওতালি হতে পারে বা মুন্ডারি হতে পারে, বিভিন্ন আদিবাসী ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য যারা লড়াই করছেন সেই আদিবাসীদের বাংলা, এই বাংলা যারা নেপালিতে কথা বলেন তাদের বাংলা। এই বাংলায় যারা ভিন রাজ্য থেকে ভিন্নসময় ধরে এসেছেন, যারা দু-তিন প্রজন্ম ধরে এসে ঘাম ঝড়িয়ে পরিশ্রম করে আসছেন ওই সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিক, হিন্দিভাষী শ্রমিক তাদেরও বাংলা।
একুশের ডাক আমাদের জেগে থাকতে হবে। আমরা যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে সব লুট হয়ে যাবে। বিরাট বড় বিপর্যয় বিরাট বড় চক্রান্ত চলছে। আসুন আমরা সবাই জেগে থাকি, একে অপরকে জাগিয়ে রাখি, সবাই মিলে যদি জেগে থাকি, সবাই মিলে যদি জোরে কথা বলি, সবাই মিলে যদি প্রতিবাদ করি, সবাই মিলে যদি হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে লড়াই করতে পারি তাহলে অবশ্যই এই বাংলার বুকে রুখে দিতে পারবো এই ফ্যাসিবাদকে।”
অভিনেতা কৌশিক সেন বলেন, “... আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি কাকে চাই না। আমি এই রাজ্যে, আমার দেশে ভারতীয় জনতা পার্টির মতো এরকম একটা বীভৎস শক্তিকে চাই না। এইটা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। এইটা একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে আমি বলবো, এবং বলবো আমার সাংস্কৃতিক বন্ধুদের, কখনো কখনো ক্ষমতা এসে আমার গা-হাত-পা জড়িয়ে ধরে, লতানো গাছের মতো আমার সারা শরীর বেয়ে উঠে পরে, আমার কানের ভিতরে, আমার নাকের ভিতরে আমার মস্তিষ্কের ভিতরে ঢুকে পরে সেই ক্ষমতার চারা গাছ। সেই ক্ষমতা আমার কানের ভিতরে ফিসফিস করে অনেক কিছু করতে বলে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শব্দটিকে আমরা শুধুমাত্র অভিনয় নাচ গান এইসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি সামগ্রিকভাবে আমার বেঁচে থাকা বলে বিশ্বাস করি, তাহলে সেই বেঁচে থাকার দোহাই কোনোভাবে কোনো ক্ষমতার সাথে আপোষ করবেন না...।”
নাগরিক আন্দোলনের কর্মী নব দত্ত বলেন বিভিন্ন আইন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কৃষক শ্রমিক বনবাসী মানুষের নানা অধিকার, পরিবেশ রক্ষার নানা রক্ষাকবচ কীভাবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এজন্য কেন্দ্রের সরকার আর রাজ্যগুলির অনুমতিরও তোয়াক্কা করছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সচিব পর্যায়ের মানুষদের দেওয়া সার্কুলারের মাধ্যমে আইনের ইচ্ছামতো ব্যখ্যা দিয়ে মূল আইনকেই পাল্টে দেওয়া হচ্ছে, এজন্য সংসদের অনুমতিও লাগছে না।
চিত্র পরিচালক অর্জুন গৌরিসারিয়া বলেন, “..... ভাষা আমাদের একে অন্যের সাথে বার্তালাপ করায়, একে অন্যের সাথে পরিচয় করায়, ভালোবাসতে শেখায়, একই সাথে ভাষা প্রতিবাদের অস্ত্র। ... যে ভাষা যেদিন প্রতিবাদ করবে সে ভাষাই হবে আমার ভাষা।”
বিশেষ কারণে সভায় উপস্থিত হতে পারেননি গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক। একটি গান ও লিখিত বার্তা পাঠান তিনি। সেই বার্তায় মৌসুমী বলেন, “এত যে ভয় আর ক্ষয়, তার ভিতরে কিছু কিছু দিন নতুন করে আঁকড়ে ধরছি আমরা বাঁচার আর বাঁচাবার তাগিদে। কাল সাত্যকির আর আমার গান ছিল হেই সামালোর উদযাপনে, বরাবরের মতন আমাদের গান মাঠ বা হলে শেষ হয় না, ঘর থেকে যাই, ঘরে ফিরে আসি, রেশ কাটে না। কাল তারপর এই গানটা গাইলাম আবার আমরা। আমি আজ যেতে পারবো না, আমার শরীরে আর দিচ্ছে না, কিন্তু আমি এইটুকু তোমাদের, আমাদের সবার জন্য এখানে রেখে দিলাম। শরীর নরম, গলা ভেঙে যাচ্ছে, গলাও শরীরেরই অংশ ভুলে যাই অনেক সময়। ক্লান্তি সারা দেহে মনে। তবু আজ একুশে সাত্যকির সঙ্গে আমার গান আর লাবণী গান ...।
দার্জিলিং চা বাগানের আন্দোলনের লড়াকু নেত্রী সুমন্তি এক্কা বলেন, “মোদি আমাদের তাঁর মন কি বাত শুনতে বলেন। আমি আমার মন কি বাত বলতে চাই। আমরা করোনা মহামারীর সঙ্গে লড়াই করার সময় নানা কোম্পানির স্যানিটাইজার ব্যবহার করি। তেমনি মোদি মহামারী থেকে বাঁচতে গেলে আমাদের নানারঙের ঝান্ডা নিয়ে একসাথে লড়ে মোদিকে হারাতে হবে।”
শরদিন্দু উদ্দীপনের বক্তব্যে উঠে আসে এনআরসি, সিএএ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সমান নাগরিকত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করা ও মানুষকে বে-নাগরিক করার চক্রান্তের কথা।
একুশের ডাক – ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলা রুখে দাঁড়াক। একুশের ডাক – মাতৃভাষা, গণতন্ত্র, মানবতা জিন্দাবাদ। বাংলার উদার ঐতিহ্য জিন্দাবাদ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন দ্বিগুণ শক্তিতে জ্বলে উঠুক – এই সমস্ত আহ্বানের মধ্যে দিয়ে সভার কাজ শেষ হয়।
প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলায় মিড-ডে-মিল কর্মীদের আয় কিভাবে বাড়ানো যায়? সে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু, রাজ্যের অন্যান্য প্রকল্প কর্মীদের জন্য ছিটে ফোটা ভাবলেও মিড-ডে-মিল কর্মীদের জন্যই টাকার অভাব পরে গেল। ক্লাব,উৎসব, দান-খয়রাতির শত কোটি টাকা ব্যয় হয়, কিন্তু বাংলার আড়াই লক্ষ মিড-ডে-মিল কর্মীর ভাগ্যে কিছু জোটে না।
সোনার বাংলা গড়ে তুলবে বলে যারা বাংলায় শোরগোল তুলছে, তাদের তো আরো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা। বছর বছর বরাদ্দ তো কমাচ্ছেই, এখন প্রকল্পটিই বেসরকারী ব্যবসায়ী, এন জি ও দের হাতে তুলে দেবার মতলব করছে।
স্বাভাবিকভাবেই, আজ কর্মীদের লড়াই আরো বৃহৎ ও শক্তিশালী করে তুলতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারী কলকাতার পথে থালা মিছিলে হাজার হাজার কর্মী সামিল হয়ে আওয়াজ তুললেন — শ্রমিকের স্বীকৃতি চাই, ন্যূনতম মজুরি চাই, ভবিষ্যৎ সুরক্ষা চাই।
দক্ষিণবঙ্গের ৭টি জেলার কর্মীরা সকাল থেকে শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত হয়ে এক দৃপ্ত মিছিল কলকাতা কর্পোরেশন পাশে জমায়েত হয় এক মহতী সমাবেশে। এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধন কর্মী ইউনিয়ন এবং নদীয়া জেলা সংগ্রামী রন্ধন কর্মী ইউনিয়ন যৌথ আহ্বানে এই সমাবেশে অন্যতম নেত্রী জয়শ্রী দাস বলেন, “আমরা আজ দাবি জানাতে আসিনি, আমরা এসেছি কৈফিয়ত চাইতে। কিভাবে রাজ্য সরকার এই দরিদ্র মহিলাদের কথা ভুলে গেলেন। বর্তমান বা নতুন সব সরকারের জন্য আমাদের হুঁশিয়ারি, মজুরি না বাড়লে লড়াই আরো তীব্র হবে। সম্প্রতি (২০/১২/২০২০) এলাহাবাদ হাইকোর্ট মিড-ডে-মিল কর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও ন্যুনতম মজুরি দেওয়ার রায় দিয়েছে, তাকে এ রাজ্যেও অবিলম্বে কার্যকরী করতে হবে। আমরা শুধু রাস্তার লড়াই না, এবার মহামান্য হাইকোর্টের ও দ্বারস্থ হব।”
আন্দোলনের অন্যতম নেতা কৃষ্ণ গোপাল দাস বলেন, আমরা অনেক আশা নিয়ে দুবছর আগে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এসেছিলাম। তিনি ভেবে দেখবেন বলেছিলেন। কিন্তু দেখলাম সবটাই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। আজ আমরা যদি কোনো সদুত্তর না পাই, তবে এ লড়াই আরো বৃহত্তর হবে।
বিভিন্ন জেলার রন্ধনকর্মীরা কিভাবে এই করোনা কালেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে এমনকি বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। তার বিনিময়ে কেবলই পেয়েছেন বঞ্চনা। এ বছর ১২ মাসের মজুরি শুধু তারা মেনে নেবেন না। আগামী বছর থেকে প্রতিবছরই ১২ মাসের মজুরি দিতে হবে।
সভা থেকে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল শিক্ষামন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বিকাশ ভবনে স্মারকলিপি দেন। মন্ত্রীর পক্ষে তার সচিব স্মারকলিপি গ্রহণ করেন।
প্রতিনিধি দলের পক্ষে এআইসিসিটিইউ রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু বলেন, “আসন্ন নির্বাচনে এই দাবি আমাদের সর্বত্র তুলতে হবে। নতুন সরকারের সূচনায় আমাদের আরো জোরদার আন্দোলনে দাবি আদায়ে নামতে হবে। পথেই আমাদের মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে হবে।” এই সভাকে সম্বোধিত করে ভাষণ দেন আইসা নেত্রী অন্বেষা রায়, প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেত্রী চন্দ্রাষ্মিতা চৌধুরী। লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে গণসংগীত পরিবেশন করেন গণশিল্পী অনুপ মজুমদার (বাবুনি)। আসন্ন নির্বাচনে এলাকায় এলাকায় কর্মীদের সমাবেশিত করে তীব্র প্রচার জারি রাখার আবেদন জানিয়ে সভা শেষ হয়।
সদ্য সদ্য পরপর দুদিন দুটি উল্লেখযাগ্য জামিন পাওয়ার খবর নজর কেড়েছে। প্রথমজন বিশিষ্ট বিপ্লবী কবি, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের পুরোধা ভারভারা রাও, দ্বিতীয় জন উদীয়মান পরিবেশ কর্মী দিশা রবি। রাও অশক্ত হয়ে পড়া প্রবীণ, রবি একেবারে তরতাজা নবীনা।
বৃদ্ধ ভারভারা রাওকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল গত দু’বছর। তথাকথিত ভীমা-কোরেগাঁও মামলায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের আচরণ এতই নিপীড়নমূলক যে, অসুস্থ রাওকে বিগত দু’বছরে মোট প্রায় পাঁচ মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়। জীবনভর এই মানুষটি আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে বহুবার কারান্তরিত হয়েছেন। বলাবাহুল্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মিথ্যা অভিযোগে। ভীমা কোরেগাঁও কেসটিও কেন্দ্রে মোদীরাজ কায়েম হওয়ার পর একটি সাজানো মামলা। মানবাধিকার আন্দোলনকে দমনের এক নজির তৈরির জন্যই এনআইএ-কে দিয়ে ‘ষড়যন্ত্র মামলা’টি দায়ের করা হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে। এতে ফাঁসানো হয়েছে আরও বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজকর্মীকে, যারা আজও ভোগ করছেন দুঃসহ কারাজীবন। ভারভারা রাও জামিন পেলেন, কিন্তু কঠোর শর্তে, মাত্র ছয় মাসের জন্য, তিনি ফিরতে পারবেন না হায়দ্রাবাদে নিজগৃহে, তাঁকে থাকতে হবে মুম্বইয়ে পুলিশের নাকের ডগায়। পরের পর কারাজীবনের যাতনায় ভেঙেছে স্বাস্থ্য, তবু রাষ্ট্রের ঠিকেদাররা শোনে কার কথা! নিঃশর্তে মুক্তির জন্য থাকতে হবে নিরন্তর লড়াইয়ের পথে, যেতে হবে বহু দূর।
পুলিশী ভাষায় দিশা রবির ‘অপরাধ’ হল দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিদেশী টুইট শেয়ার করা। মোদী সরকারের প্রতি সরব সমালোচনা শেয়ার করা। ব্যস্! রুষ্ঠ হলেন রাষ্ট্রের শাসকপক্ষ। দাগিয়ে দিলেন ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত হওয়ার তকমা। শিকারী পুলিশ দিশাকে তুলে নিয়ে আসে বেঙ্গালুরু থেকে, চালান করে দিল্লীর হেফাজতে, আদালতে। দিশার এই প্রথম হেফাজত অভিজ্ঞতা। উপরোক্ত অভিযোগের অজুহাতে পুলিশ আরও দুজনকে হেফাজতে নিয়েছে, দাঁড় করিয়েছে মামলায়। নিম্ন আদালত কিন্তু পুলিশী কারণ দর্শানোকে বিশেষ গ্রাহ্য করেনি, বরং মন্তব্য করেছে, সরকারের সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা মানেই ‘ষড়যন্ত্র’-‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ নয়, তার জন্য হাজতবাস করানো যায় না। অর্থাৎ, গ্রেপ্তার করে পক্ষান্তরে অন্যায়-অবিচার করেছে পুলিশ, মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যূনতম শর্ত হল, থাকতে হবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মান্যতা দিতে হবে শাসকের—শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা, বিরোধিতা ও পরিবর্তন করার অধিকারকে। নাহলে সেই পরিবেশটা গণতন্ত্রের থাকে না, তার বদলে তাকে গণ্য করা যেতে পারে রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ।
মোদীজীরা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করছেন নিজেদের তৈরি কিছু ‘যুক্তি-তর্ক’। বলছেন, ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বিচার করতে হবে ‘আইনের শাসনকে সুরক্ষিত করা’ ও ‘জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া’র অধীনে। আরও বলছেন, ‘আইনসভা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার কেন্দ্রীয় ভাবনায় থাকতে হবে ‘আইনের শাসন’ তথা ‘সুশাসন’। বড়গলায় আরও দাবি করছেন, এসব হল ‘উদ্ভাবনী রূপায়ণের’ বিষয়। এইসব কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে মোদী জমানা হয়ে দাঁড়িয়েছে কালা কানুন আর পুলিশী উৎপীড়ন চালানো নজিরবিহীন এক কুশাসন। ইউএপিএ ইত্যাদি অগণতান্ত্রিক আইনকানুন প্রয়োগ করার সাথে সাথে রাজ্যে রাজ্যে শাসনক্ষমতার জোরে লাগু করছে আরও জঘন্য সব কানুন, যেমন ব্যক্তির নিজের পছন্দের অধিকার বিরোধী ‘লাভ জেহাদ’ আইন। ঝাঁপিতে রেখেছে নাগরিকত্ব কোতল করার সংশোধনী আইন সিএএ। বিজেপি এভাবে স্বমূর্তি ধারণ করছে ফ্যাসিবাদেরই।
ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস্ ব্যুরোর তথ্যে জানা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর সত্য। ২০১৬-১৯ পর্বে ইউপিএ আইনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল ৫৯২২, তার মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত সংখ্যা ১৩২; কেবলমাত্র ২০১৯ সালে সিডিশান আইনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল ৯৬, সাজা হয় ২ জনের, ছাড়া পান ২৯ জন। ধৃতদের লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও শ্রেণী পরিচিতি এনসিআরবি-র উপরোক্ত রিপোর্টে এখনও নেই। যাই হোক, ঐ রিপোর্ট থেকেই পরিষ্কার মোদীতন্ত্রে চলছে কেমন সাংবিধানিক গণতন্ত্র! ‘দেশ রক্ষা’র ধূয়ো তুলে চলছে কেমন ‘আইনের শাসনের’ যথেচ্ছ কেন্দ্রীকরণ! রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখন প্রতিটি রাতদিনের ঘটনা। তার জেরে বিধ্বস্ত হচ্ছে মানুষের দাবিসনদ, জনগণের রাজনৈতিক গণতন্ত্র।
ভারত শাসনের এই ‘মহিমা’র প্রেক্ষাপট যাদের, সেই বিজেপি ঝাঁপাচ্ছে বাংলায়। আসন্ন নির্বাচনকে পাখির চোখ করে। ফেরি করছে ক্ষমতায় আনলে সব দাবি পুষিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। আবেদন করছে ক্ষমতায় আসার সুযোগ দেওয়ার জন্য। বলছে প্রতিষ্ঠা করবে ‘আইনের শাসন’! গড়বে নাকি ‘দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা’! ফেরাবে ‘সন্ত্রাসমুক্ত গণতন্ত্র! এটাই ফ্যাসিবাদের স্বরূপ। মগজে হানা দেয়, হাতছানি দেয়। ছলচাতুরিতে ওস্তাদি দেখায়। কিন্তু ভুললে চলবে না গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশে, আসাম থেকে ত্রিপুরায় মানুষের কি হাল করছে বিজেপি! সব মনে রাখতে হবে।
পরিবেশ এবং সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের কর্মী একুশ বছরের তরুণী দিশা রবির গ্রেফতার প্রমাণ করে দিল, মোদী সরকার আপাত গণতান্ত্রিক ছদ্ম আবরণটুকুও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একেবারে প্রকাশ্যে স্বৈরতন্ত্রের কণ্ঠলগ্ন হয়েছে। দিশা এবং অন্য তরুণীরা দিল্লি পুলিশের ‘ডাইনি-খোঁজ’-এর শিকার; কারণ তারা মোদীর তিনটে কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষকদের প্রতিবাদের সপক্ষে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে জনমত সংগঠিত করছিলেন।
কৃষক আন্দোলন-পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম গণআন্দোলন- আন্তর্জাতিক মহলের বহু সমর্থন পেয়েছে। দিল্লী পুলিশের হিংস্র হামলার ছুতো হল একটি গুগল তথ্য – জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের কর্মী আঠেরো বছরের সুইডিশ তরুণী গ্রেটা থুনবার্গের একটি টুইট। বিতর্কিত তথ্যটি হল একটি “টুলকিট”— সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদ জানানোর একটি অতি পরিচিত হাতিয়ার — সেখানে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং বিশ্ব জনমত কীভাবে আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারে তার পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। খুব সাধারণভাবে রাখা হয়েছে : প্রতিবাদ জানানো কোনো অপরাধ নয়, আর হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ ও তথ্যের মাধ্যমে প্রচার সংগঠিত করাও অপরাধ নয়। যে সরকার প্রতিবাদ গড়ে তোলার সঙ্গে ‘দেশদ্রোহকে’ এক করে ফেলে, সেটি গণতন্ত্র নয়, একনায়কতন্ত্র।
যেভাবে দিশা রবিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাতে দিল্লী পুলিশ নাগরিকদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখার প্রত্যেকটি বিধি লঙ্ঘন করেছে। সাদা পোশাকের লোকজন দিশাকে তার বেঙ্গালুরুর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, লোকদেখানো তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদের নামে; তারপর তাকে দিল্লী নিয়ে এসে তার পরিবার বা আইনজীবীকে না জানিয়েই তাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। তার পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট তার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেননি, দিশাকে সরকার-নিযুক্ত কোনো কৌঁসুলী দেওয়া তো হয়ইনি, উল্টে তাকে পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠানো হয়।
দিশা রবির গ্রেফতার যে শুধু অসাংবিধানিক এবং লজ্জাজনক, তা-ই নয়-দিল্লী পুলিশ টুলকিটএর ভিত্তিতে যে এফ আই আর করেছে, সেটাও অসাংবিধানিক এবং লজ্জাজনক। সংবিধানের রক্ষাকবচ হিসাবে আদালতগুলি যদি তাদের কর্তব্য পালন করে, তাহলে এই এফআইআর-কে বাতিল করে দিশা রবিকে ক্ষমা চেয়ে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া উচিত।
এই আদালতকে স্বীকার করতে হবে মোদী সরকারের সর্বগ্রাসী একাধিপত্যকামী ‘টুলকিট’-এর অস্তিত্ব এবং তাকে লাগাম পরাতে হবে — সরকার যেটা যে কোনো মতবিরোধ এবং গণআন্দোলনকে দমনের জন্য বারংবার ব্যবহার করে থাকে। জেএনইউ-তে ছাত্র আন্দোলনে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায়, সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদে, এবং এখন কৃষক আন্দোলনে, মোদী সরকার তার সর্বগ্রাসী টুলকিট’-এর থেকে একই হাতিয়ারগুলো কাজে লাগিয়েছে। এই হাতিয়ারগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রতিবাদীদের ‘জন-বিচ্ছিন্ন’ হিসাবে কালিমালিপ্ত করার এবং ‘দেশদ্রোহী’র তকমা দেওয়ার জন্য নিজের পোষা ‘গোদী’ মিডিয়া সংস্থা এগুলোকে কাজে লাগানো; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের তাক-লাগানো গল্প ফেঁদে সেগুলো ছড়ানোর জন্য, হয় সযত্নরচিত প্রতারণামূলক তথ্য আর নয়তো প্রতিবাদ সংগঠিত করার নিরীহ মাধ্যমগুলো (যেমন হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ, ই-মেল, এবং প্রতিবাদী টুলকিট’-এর তথ্য) ব্যবহার করা — (অবশ্য এসব নড়বড়ে খুঁটি এই গল্পের ভার কতটা বইতে পারে!) আর শেষমেশ চলে জিজ্ঞাসাবাদ, গ্রেফতার এবং দীর্ঘদিন কারাবাসে ঠেলে দেওয়ার অভিযান-সে বহু সংগ্রামের পোড়-খাওয়া বর্ষীয়ান নেতাই হোন আর তরুণ ছাত্র প্রতিবাদীরাই হোক; আর আদালতের কর্তব্যচ্যুতির সাহায্য নিয়ে ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনগুলোর শরণ নেওয়া, যার মাধ্যমে জামিন এবং বিচার ছাড়াই জেলে পচানো সম্ভব হয়।
মোদী সরকারের টুলকিট-য়ে আছে আরও কয়েকটি হাতিয়ার – তথ্যকে চেপে দেওয়া এবং জনপরিসরে কল্পকাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য। প্রথমত তারা প্রচারক মিডিয়ার ‘অভিনেতা’ যারা “সাংবাদিকের” ছদ্মবেশে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট নিউজ মিডিয়ার বিরাট অংশ দখল করে আছে, তাদের বিশাল, ইচ্ছুক বাহিনীকে সযত্ন লালনে বিকশিত করে তোলা। তারপর তারা সেই সব সাংবাদিক যারা হয় সরকার, নয় তাদের কর্পোরেট প্রভুদের কীর্তিকলাপ নিয়ে তদন্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা অথবা মানহানির মামলা খাড়া করা (ওয়্যার-এর সম্পাদক এবং অন্যান্য সাংবাদিক যারা প্রজাতন্ত্র দিবসে এক প্রতিবাদী কৃষক, যিনি পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তার মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করছিলেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা এবং সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার বিরুদ্ধে আদানি কর্পোরেশনের দায়ের করা মানহানির মামলা সাম্প্রতিক নিদর্শন)। মোদী সরকারের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি এবং আক্রমণের সর্বশেষ নিদর্শন হল নিউজক্লিক পোর্টাল ও তার অফিসগুলিতে এবং তার সম্পাদকদের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের হানা। নিউজক্লিক-এর সম্পাদক একজন মার্কসবাদী; তিনি ছাত্রজীবনে ইন্দিরা গান্ধীর চাপানো জরুরি অবস্থার সময় জেল খেটেছেন। নিউজক্লিক এমন একটি পোর্টাল যা জনগণের আন্দোলনের অসামান্য সংবাদ পরিবেশনায় অনন্য স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার।
দিল্লীর পুলিশ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ সমাবেশের সংগঠকদের সঙ্গে যে আচরণ করে, আর সেইসব রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংগঠিত হিন্দু-আধিপত্যকামী গোষ্ঠী, যারা মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মোদী সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হিংসাকে প্ররোচনা যোগায় এবং ছড়িয়ে দেয়, তাদের প্রতি পুলিশের যে ব্যবহার – তার মধ্যে আকশপাতাল ফারাক! এবিভিপি নেতা কোমল শর্মা, গত বছর যে দলবল নিয়ে জেএনইউ ক্যাম্পাসে চড়াও হয়েছিল এবং ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মাথা ফাটিয়েছিল, দিল্লী পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও দায়ের করেনি। বিজেপি নেতা কপিল শর্মা, যিনি গত বছর “বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করো” শ্লোগান দিয়ে দিল্লী দাঙ্গায় ইন্ধন যোগানোর জন্য কুখ্যাত, দিল্লীর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করা দূরে থাক, কখনও জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। নিউজলন্ড্রির সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিশ্র “হিন্দু-ইকোসিস্টেম” গোষ্ঠীর প্রধান, যেটি ধারাবাহিকভাবে হিন্দুদের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ ও নানা মনগড়া তথ্যসহ সংকীর্ণতাবাদী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই গোষ্ঠীটিও বিভিন্ন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব প্রচার এবং তার অনুগামীদের বিদ্বেষমূলক ও মিথ্যা প্রচার বহুগুণ বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দিতে, গুগল তথ্য (ডকুমেন্ট) ব্যবহার করে থাকে। যদি একটি নিউজ পোর্টাল হিন্দু-আধিপত্যকামী সন্ত্রাসের দেশজোড়া ‘ইকোসিস্টেম’-এ ঢুকতে ও অনুসন্ধান চালাতে পারে, দিল্লী পুলিশও নিশ্চয়ই এটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? তাহলে দিল্লি পুলিশ কেন কপিল মিশ্র এবং তার ঘৃণা-উদ্গীরণের হাতিয়ার যা সরাসরি মিথ্যা সংবাদ এবং বিদ্বেষ প্রচারে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে? যখন এই পুলিশই সেইসব মানুষ যারা মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের সমর্থনে হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ চালাচ্ছেন বা গুগল ডকুমেন্ট সম্পাদনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এত সক্রিয়?
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীন পুলিশ বাহিনী বিশ্বাস করে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস মতবিরোধ ও প্রতিবাদ হচ্ছে বেআইনি এবং দেশদ্রোহিতামূলক, আর সহিংস ইসলাম বিদ্বেষ ও হিন্দু-আধিপত্যকামী ঠগী দৌরাত্ম্য হল আইনসম্মত এবং দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা! তার মানে-মোদী সরকার নিজেকে আর কোনোভাবেই ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবি করতে পারে না; এই সরকারটাকে বিশ্বের সংকীর্ণতাবাদী ফ্যাসিবাদী একাধিপত্যকামী সরকারগুলোরই একটা বলে গণ্য করতে হবে। এর বিরুদ্ধে সরব হওয়া এবং সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের শুধু অধিকার নয়, কর্তব্যও !
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১)
(১৭ ফেব্রুয়ারী জারি করা এই বিবৃতিটিতে দিল্লী পুলিশের হাতে পরিবেশ কর্মী দিশা রবির অবৈধ গ্ৰেপ্তারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং অবিলম্বে তাঁর ও গ্ৰেপ্তার হওয়া অন্যান্যদের মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিটির ভাষান্তর করে ছাপানোর উদ্যোগ যখন চলছে, প্রাপ্ত শেষ খবরে তখন জানা গেল, দিল্লীর একটি আদালত দিশা রবির জামিন মঞ্জুর করে তাকে মুক্তি দিয়েছে।)
দিল্লী পুলিশের “টুলকিট এফআইআর” মোদী সরকারের চালানো টুলকিট-এরই অংশ, যার উদ্দেশ্য হল বিরোধী মতকে দমন করা ও শাস্তি দেওয়া এবং ভারতে গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করা। “টুলকিট” বস্তুত কোন বিষয়ে সমর্থনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক নথি, যাতে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত না থাকা মানুষদের জন্য কৃষক আন্দোলনের মূল বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা থাকে এবং হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা, ভিডিও তৈরি করা এবং প্রতিবাদ সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে আন্দোলনে সমর্থন জানাতে উৎসাহিত করা হয়। এগুলো সবই গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের অপরিহার্য কার্যকলাপ। এই সমস্ত সক্রিয়তাকে ফৌজদারি অপরাধ বলে দাগিয়ে দেওয়াটা মোদী সরকারের স্বৈরাচারী চরিত্রকেই প্রকটিত করে।
দিল্লী পুলিশ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন। তারা চরম বেআইনিভাবে বেঙ্গালুরুতে পরিবেশ কর্মী দিশা রবির বাড়িতে জোরজবরদস্তি ঢুকে তাকে কর্নাটক থেকে দিল্লীতে নিয়ে আসে, এবং এই পথে একগুচ্ছ বৈধ ও সাংবিধানিক সুরক্ষাবিধির লঙ্ঘন ঘটায়। দিল্লীতে করা তুচ্ছ কোনো এফআইআর-এর অছিলাকে মোদীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যদি ভারতের যে কোনো প্রান্তের যে কোনো নাগরিকের গ্ৰেপ্তারির অস্ত্র করে তোলে তবে তা যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও গণতন্ত্রের ওপর এক কদর্য আঘাত হয়েই দেখা দেয়। কর্নাটকের বিজেপি সরকার যে কর্নাটকের জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে এই ঘটনায় দিল্লী পুলিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি মদত যোগায়, তা গোটা বিষয়টাতে আরো কলঙ্ক লেপন করেছে।
আমরা দাবি জানাচ্ছি — দিশা রবি, নিকিতা জেকব ও অন্যান্য পরিবেশ কর্মীদের বিরুদ্ধে এবং কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়ের করা সমস্ত মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে, এবং এই ব্যাপারে গ্ৰেপ্তার হওয়া সমস্ত ব্যক্তিকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
মোদী সরকার এই যুবা পরিবেশ কর্মীদের শত্রু বলে গণ্য করে, কেননা, তাঁরা আদানি ও আম্বানির মালিকানাধীন স্যাঙাতি কোম্পানিগুলোর সুবিধা করে দিতে পরিবেশ বিধিসমূহকে লঘু করে তোলার মোদী সরকারের নীতিকে ধারাবাহিক ও সফলভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।
অহিংস প্রতিবাদ এবং আইন অমান্যকে ফৌজদারি অপরাধ বলে দাগানো চলবে না। বিপরীতে, ঘৃণা ও হিংসার পক্ষে চালানো প্রণালীবদ্ধ প্রচারের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ দায়ের করতে হবে। আমরা দাবি জানাচ্ছি — দিল্লী পুলিশকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে যে, হিংসায় যুক্ত থাকা ভিড়কে উস্কিয়ে তুলেছিলেন ও পরিচালিত করেছিলেন যাঁরা সেই কপিল মিশ্র ও কোমোল শর্মার মতো বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এখনও অভিযোগ দায়ের করা বা তাদের গ্ৰেপ্তার করা হচ্ছে না কেন? কপিল মিশ্র সোশ্যাল মিডিয়ায় কারখানা খুলে ঘৃণার যে কারবার চালাচ্ছেন, তার বিরুদ্ধে দিল্লী পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? দিল্লী পুলিশ ভারতের সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ এবং “আমরা, ভারতের জনগণ”-এর কাছে জবাবদিহি করতে তারা বাধ্য।
- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি
১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারী, নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়া বিধানসভা ও কৃষ্ণনগর দক্ষিণ বিধানসভা এলাকায় গণকনভেনশন, শহীদ স্মরণে জনসভা করলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
একুশের ডাক “ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক” এই উপলক্ষে কনভেনশন হল বেথুয়াডহরি অভিনন্দন লজে। বুধবারের হাটে কৃষকের সমাবেশ, গঞ্জের ক্রেতাদের সমাবেশের মধ্যে কনভেনশন হলঘর ভর্তি হয়ে গেল কর্মীদের সমাবেশে। শুরুতে প্রায়ত কমরেড সুবিমল সেনগুপ্তের স্মরণে নীরবতা পালন করা, তারপর কনভেনশনের কথা, কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য হলঘর ছেড়ে পৌঁছে গেল হাটে উপস্থিত জনতার মধ্যে। একসময়ের ডাকছিল “লাঙ্গল যার, জমি তার” এখন ডাক এসেছে, আন্দোলন চলছে “ফসল যার, কৃষি তার” এই অধিকারের দাবি নিয়ে দিল্লীর সীমানা পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গ্রামে-গঞ্জে, বাংলার মানুষ তাতে সামিল। বিজেপিকে রুখতে বাংলার মানুষের অন্যান্য দাবির আন্দোলনের সাথে কৃষি ও কৃষক স্বার্থবিরোধী ৩ কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
কনভেনশনে মিরাইপুর, তেঘড়ি, পাটপুকুর, বড়গাছি, শিবপুর, শালিগ্রাম, মুড়াগাছা, জগন্নাথপুর, সুলতানপুর, সুধাকরপুর, সাপজোলা, দলুইপূর, বনপলাশী, দেবগ্রাম সহ বেথুয়াডহরির যুব কমরেডরা অংশগ্রহণ করেন, ছিলেন মহিলা কমরেডরাও। কাজল দত্ত গুপ্তের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কার্তিক পাল ও রাজ্য কমিটির সদস্য কৃষ্ণপদ প্রামানিক।
কনভেনশন শেষ করে গাছা বাজারে পার্টি অফিসে কমরেড সুবিমল সেনগুপ্তের স্মরণ সভার আয়োজন করেন মুড়াগাছা লোকাল কমিটি। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, কার্তিক পাল সহ এলাকার নেতৃবৃন্দ, বাজার কমিটির সম্পাদক ও অন্যান্য কমরেডরা মাল্যদান করেন। এখানে সুবিমল সেনগুপ্তকে স্মরণে রেখে আজকের পরিস্থিতিতে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সফল উদ্যোগও সংকল্প হতে পারে সুবিমলের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রকৃত পথ।
তারপর বাইক মিছিল রওনা দেয় শালীগ্রামের জনসভার দিকে। জনসভায় অংশগ্রহণকারী কৃষক জনতার বেশিরভাগ অতীতের কৃষক আন্দোলনের বয়স্ক কর্মী সহ কিছু নতুন যুবক। নামাজ পড়ার ফাঁকে জনসভা শুরু হলো। চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে স্মরণ করে নেওয়া হলো কমরেড সুবিমল সেনগুপ্ত সহ অতীতের কৃষক আন্দোলনের শহীদ কমরেড জালালউদ্দিন শেখ ও অন্যান্য কৃষক নেতাদের। কৃষ্ণপদ প্রামাণিকের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখলেন মহিলা নেত্রী চন্দনা সেনগুপ্ত। ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী কৃষক আন্দোলন, শক্তিশালী বাম ঐক্যই পারে বিজেপি’র মতো এক ভয়ঙ্কর শক্তিকে পরাজিত করতে, নীতিহীন ক্ষয়িষ্ণু তৃণমূলের পক্ষে একাজ সম্ভব নয়, বললেন প্রধান বক্তা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারী সোনাতলা গ্রামে জনসভা হল। উপস্থিত ছিল কালিনগর, সোনাতলা চরমহতপুর, পাত্রদহ সহ আশেপাশের বেশকিছু কৃষক জনগণ। জীবন কবিরাজের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন ঠান্ডু শেখ, কলম বিশ্বাস, সন্তু ভট্টাচার্য, কার্তিক পাল, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারী সোনাতলা গ্রামে জনসভা হল। উপস্থিত ছিল কালিনগর, সোনাতলা চরমহতপুর, পাত্রদহ সহ আশেপাশের বেশকিছু কৃষক জনগণ। জীবন কবিরাজের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন ঠান্ডু শেখ, কলম বিশ্বাস, সন্তু ভট্টাচার্য, কার্তিক পাল, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
সভা শেষ করে বাইক মিছিল করে যাওয়া হল শোনডাঙ্গা গ্রামের সভায়। পুরনো কাজের এলাকায় দেখা গেল নতুনভাবে শুনবার জন্য আগ্রহী জনতার ভিড়। এখানে বক্তব্য রাখেন কাজল দত্ত গুপ্ত, সন্ত ভট্টাচার্য ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। ডবল ইঞ্জিনের সরকার গড়ার লক্ষ্যে বিজেপি’র বাংলা দখল করার ফ্যাসিবাদী চক্রান্ত রুখতে জনগণকে শামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানালেন প্রধান বক্তা।
উত্তরের ডুয়ার্সের সঙ্কোশ নদীর কাছে কুলকুলি বনবস্তির থেকে ৬ ফেব্রুয়ারী শ্রমজীবী অধিকার অভিযানের যাত্রা শুরু হয়। উত্তরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত বনবস্তির মানুষদের উদ্দীপনা, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার অদম্য লড়াইকে সম্বল করে বর্তমানে উদ্ভুত ফাসিস্ত পরিস্তিতিতে যখন ক্রমশ গণতান্ত্রিক পরিসর কমে আসছে, সেই অবস্থায় উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জনপদের মানুষেরা, চা বাগানের শ্রমিকেরা যারাই মূলত উত্তরের অর্থনৈতিক কাঠামোর ধারক, বাহক তাদেরকে নিয়েই শুরু হয় অভিযানের প্রথম পর্যায়। কুলকুলি বনবস্তি, আলিপুরদুয়ার শহর, চৌপাথি, হলদিবাড়ি মোড়, রাজাভাতখাওয়া, মেন্দাবাড়ি চা বাগান, মাদারিহাট, হাসিমারা বাজার যেখানেই অভিযাত্রিরা থেকেছেন, বক্তব্য রেখেছেন শমীক চক্রবর্তী, অভিজিৎ রায়, মুকুল চক্রবর্তী, সুন্দর রাভা মানবাধিকার কর্মী সুমন থেকে শ্রমজীবী মঞ্চের সহযোদ্ধা লাল সিং ভুজেলরা মানুষ দাঁড়িয়ে শুনেছেন, গানের দল লালিগুরাসের ‘গাও ছোড়াব, নেহি জঙ্গল ছোড়াব’ গানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গলা ছেড়েছেন অধিকারের প্রখর দাবিতে। আদিবাসী নাচ গান সংস্কৃতিতেও বারংবার উঠে এসেছে বিকল্প দিনের ভাবনা। একইসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় চলেছে অভিযানের সমর্থনে লিফলেট বিলি, পোস্টারিং।
বাগরাকোট চা বাগানে প্রথম ধাপের অভিযান শেষ হয়। অভিযাত্রিদের রাত কেটেছে এদের আতিথেয়তায়।
দ্বিতীয় দফায় অভিযান শুরু হয় শিলিগুড়ির অদূরে তরাইয়ের গজোলডোবা বনবস্তি থেকে। একইরকম উত্সাহ উদ্দীপনাকে সঙ্গি করে কিছু নতুন সফরসঙ্গী সহযোদ্ধাদের সাথে।
লালিগুরাস, মীরা চতুর্বেদী, রনজিত মুখার্জি, নগর কবিয়াল গৌতম চক্রবর্তীদের গানে, কবিতায় যেমন ছিলো চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন সংহতি। মেহনতি মানুষের ঐক্যে শৃঙ্খল ভাঙার তীব্র আকাঙ্খা। তেমনই দেশবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জেদ। গাজলডোবা, রাঙাপাণি, খড়িবাড়ির বিকেলের হাট, নকশালবাড়ির চা বাগান থেকে বামনপকরি বনবস্তি, কাটারিয়া বনবস্তি, শুকনা বনবস্তি থেকে এনজেপি রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের অফিস। শমীক চক্রবর্তী, অভিজিৎ মজুমদার, অভিজিৎ রায়, বনজন শ্রমজীবী মঞ্চের রাজকুমার, অধ্যাপক অজিত রায় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব গৌতম ঘোষ, চা বাগানের শ্রমিক বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতৃত্ব ললিতা পুরিয়া, রাজু সরকাররা বারংবার সরব হয়েছেন প্রান্তিক মানুষদের অধিকারের সপক্ষে, বনের অধিকার, জমির অধিকারের পক্ষে। ফাসিস্ত বিজেপির তার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক, প্রান্তিক বনবস্তির মানুষদের সার্বিক ঐক্যের মাধ্যমে এই দীর্ঘকিন্তু অক্লান্ত লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। যে কোনোভাবেই প্রতিহত করতে হবে এই সর্বনাশা শক্তিকে। সমস্ত বন্ধন,শৃঙ্খল ছিন্ন করে আমরা এগিয়ে যাবোই আগামীর দিকে যে আগামী নিশ্চিত স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তাকে নামিয়ে আনবেই পৃথিবীতে। এই রিপোর্টলেখা পর্যন্ত অধিকার অভিযান তৃতীয় দফায় অধিকারের দাবিতে তরাই থেকে পাহাড়ের দিকে তাদের যাত্রা চলছে। শেষ হবে আগামী ১ মার্চ।
২০১৪ সালের মে মাসের আগে পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন এসবের দাম বাড়লে দেশের খুব ক্ষতি হত, বিশেষত অমিতাভ বচ্চন, অক্ষয়কুমার, রামদেব ও নরেন মোদির। আমজনতার দুঃখে কাতর হয়েতারা টুইট করতেন, অথবা বক্তৃতায় গলা ফাটাতেন। এখন পেট্রল ও পেট্রলজাত দ্রব্যের দাম বাড়লে তারা আনন্দিত হয়, দেশের সরকার উন্নয়নের জন্য অর্থ সংস্থানে পারঙ্গম হবে বলে। যারা পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ার জন্য ক্ষুব্ধ হন, মিছিল করেন, আন্দোলন করেন তাঁদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতভাবেই আন্দোলনজীবী বলবে। আগে জানা ছিল যে, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়লে তা উৎপাদন ও পরিবহণ খরচকে বাড়িয়ে তুলে পণ্য মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। তবে মোদিজির রাজত্বে পরিসংখ্যান জবরদস্ত তাই জানুয়ারী জুড়ে পেট্রোপণ্যের দাম দ্রুত বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতির হার কমেছে, গত ১৭ মাসের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার সর্বনিম্ন হয়েছে। এখন মনে হয আমরা শিবঠাকুরের আপন দেশেই বাস করছি, যেখানে সরকারের আকাঙ্খা অনুযায়ী জিডিপি বাড়ে কমে, সামগ্রিক উৎপাদন ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছয়, কৃষকদের আয় ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়, মুদ্রাস্ফীতির হারে তারতম্য ঘটে, কর্মসংস্থানের তথ্য গোপন করা হয। সেই একুশে আইনের রাজত্বে পেট্রল-ডিজেলের দাম যে সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ীই বাড়বে কমবে তাতে আর আশ্চর্য কী!
গত দুবছর ধরে পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে। গত ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ সালে যখন পেট্রলের দাম বাড়ছিল, বিজেপি ও এনডিএ তখন নিয়মিত রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করত। ২০১২ সালের ৩১ মে ভারতজোড়া বামেদের ডাকা ধর্মঘটের দিন আলাদাভাবে ধর্মঘট ডেকেছিল তারাও। অবশ্য মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস সেই ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছিল। ২০১২ সালের ধর্মঘটের প্রাক্কালে, ২৩ মে গুজরাটের তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি ও এনডিএ-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন মোদি টুইট করেছিলেন, “পেট্রলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি কংগ্রসে নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা”। আজ গত দুবছরে যখন পেট্রলের দাম বেড়েছে লিটারে ২০ টাকা, শতাংশের হিসেবে ৩০%, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে ২১ টাকার বেশি, ৩৩%, তখন তিনি পূবর্বর্তী সরকারের পেট্রলের জন্য আমদানী নির্ভরশীলতাকে দোষ দিয়েছেন। মনে রাখা দরকার, ভারতের নির্বাচিত সরকারগুলির সর্বমোট ৬৯ বছরের শাসনের মধ্যে ১৩ বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতায় ছিল, এবং ৪ বছর বিজেপি বা তার পূর্বাবতাররা সরকারের শরিক ছিল বা সমর্থক ছিল। ওই সময়কালে আমদানীর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে কী করা হযেছিল তা জানতে পারলে হত। অবান্তর ও অসত্য ভাষণে পারদর্শী নরেন মোদি যেকথা বলেননি তাহল যে, ২০১৩-১৪ সালে পরিমাণগতভাবে ভারত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য নীট আমদানি করেছিল ওই ধরনের পণ্যভোগের ৮৭%, নরেন মোদির ৭ বছরের শাসনে আমদানির অংশ বেড়ে হয়েছে ৯৬%। ফলে পেট্রলের জন্য আমদানি নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের (ইন্ডিযান বাস্কেটের) সর্বোচ্চ দাম দেখা গিয়েছিল এপ্রিল, ২০১১-তে, ১১৯ ডলার প্রতি ব্যারেল; ওই বছরেই অপরিশোধিত তেলের গড় মূল্য ছিল ১১২ ডলার প্রতি ব্যারেল। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে গড় মূল্য ছিল ১১৮ ডলার প্রতি ব্যারেল ও ওই বছরে, ২০১২-১৩ সালে গড় মূল্য ছিল ১০৮ ডলার প্রতি ব্যারেল। ২০১৪ সালের মে মাসে দাম ছিল ১০৭ ডলার। এর পরে তা ক্রমাগত কমে ২০১৫-১৬ সালে ৪৬ ডলারে নেমে আসে। তারপরে বাড়তে থাকে ও ২০১৮-১৯-এ ৭০ ডলার প্রতি ব্যারেলে দাঁড়ায়। ২০১৯-২০-তে তা কমে ৬০ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছয়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল প্রতি দাম কমে দাঁড়ায় ২০ ডলার। এরপরে দাম বাড়তে তাকে ও জানুয়ারিতে তা ৫৫ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছেছিল। বর্তমানে তা বেড়ে ৬৩ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছেছে। অপরদিকে ডলারের দাম বেড়ে ৫৯ টাকা থেকে ৭২ টাকায় গিয়েছে। ফলে টাকার অঙ্কে ব্যারেল প্রতি দাম ২০১৪ সালের মে মাসের ৬৩১৩ টাকা থেকে কমে বর্তমানে ৪৫৩৬ টাকায় নেমেছে। যদি আনুপাতিক অঙ্ককে পেট্রলের দাম নির্ধারণে গ্রহণ করা যায় তাহলে ওই সময়ের ৭২ টাকা প্রতি লিটারের তুলনায় পেট্রলের দাম হওয়া উচিৎ ৫১ টাকা প্রতি লিটার। নরেন্দ্র মোদি সরকারের ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে পেট্রলের উপর প্রভূত কর চাপিয়ে তার দাম ৫১ টাকার তুলনায় ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, দাম দাঁড়িয়েছে ৯১ টাকার বেশি।
যখন মোদিজি ক্ষমতায় আসেন তখন পেট্রলের উপর এক্সাউজ ডিউটি ছিল লিটার প্রতি ৯.৪৮ টাকা ও ডিজেলের উপর ৩.৫৬ টাকা। ২০১৪র জুন মাসের পর থেকে যখন দাম কমতে থাকে ও ২০১৬র জানুয়ারীতে দাম কমে ২৮ ডলার প্রতি ব্যারেলে নেমে আসে, সেই সময়ে ২০১৪র নভেম্বর থেকে ২০১৬র জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৫ মাসে মোদি সরকার পেট্রলের উপর ৯ দফায় এক্সাইজ ডিউটি বাড়িয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ওই ১৫ মাসে পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি বাড়ে ১১.৭৭ টাকা এবং ডিজেলের উপর ১৩.৭৭ টাকা। অক্টোবর, ২০১৭ তে এক্সাইজ ডিউটি ২ টাকা কমানো হয়, ১ বছর বাদে আবার নরেন মোদি দয়াপরবশ হয়ে ১.৫০ টাকা ডিউটি কমান। জুলাই, ২১০৯এ ডিউটি বাড়ানো হয় ২ টাকা করে প্রতি লিটারে, মার্চ, ২০২০-তে ৩ টাকা করে প্রতি লিটারে। কোভিড অতিমারিতে যখন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম তলানিতে ঠেকছে তখন পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হয় ১০ টাকা প্রতি লিটার ও ডিজেলের উপর ১৩ টাকা প্রতি লিটার। ফলে পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি দাঁড়িয়েছে ৩২.৯৮ টাকা প্রতি লিটার যা মোদি সরকারের ক্ষমতায় আসার সময়কালের থেকে ২৩.৫০ টাকা বা ২৫০% বেশি। ডিজেলের ক্ষেত্রেতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৮৩ টাকা প্রতি লিটার অর্থাৎ বেড়েছে ২৮.২৭ টাকা বা ৭৯৪%।
২০১০ সালে যখন পেট্রল-ডিজেলের দামকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে যুক্ত করে বাজার কর্তৃক নির্ধারিত করার ঘোষণা করা হয় তখন বিরোধিতা করেছিল বামপন্থীরা। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে ডিজেলকেও বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে তার ফল ভুগতে হচ্ছে জনসাধারণকে, যেমন এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে তাই দেশে তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দাম কমলে সরকার এক্সাইজ ডিউটি বসিয়ে দাম কমতে দিচ্ছে না। ফলে তেলের দামের ঊর্ধগামিতা নিশ্চিত করার দায় নিয়েছে মোদি সরকার। কেবল তাই নয়, এক্সাইজ ডিউটি বসানো হলে তার ৪২% ভাগ পেয়ে তাকে রাজ্য সরকারগুলি। কিন্তু সেস বসালে তার ভাগ রাজ্য সরকারগুলি পায় না। এবছরের বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার ডিজেল ও পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি যথাক্রমে ৪ টাকা ২.৫০ টাকা প্রতি লিটারে কমিয়েছে কিন্তু সেস বসিয়েছে সম পরিমাণ। ফলে রাজ্য সরকারগুলির আয় কমবে।
পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা গৃহস্থালীর জ্বালানিকে প্রায় ভুলতে বসেছি। ইতিমধ্যেই কেরোসিন তেলের উপর থেকে ভর্তুকি তুলে নিয়েছে সরকার। যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্য উজ্বলা প্রকল্পে বিনা পয়সায় গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কৃতিত্বকে ঢাক পিটিয়ে জানান দেওয়া হচ্ছে। উজ্জ্বলা প্রকল্পে গ্যাস দেওয়া হলেও পরবর্তীতে প্রাপককে গ্যাস কিনতে হবে। এদিকে গ্যাসের দাম ক্রমাগত বাড়ছে কিন্তু ভর্তুকির পরিমাণ কমতে কমতে ১৯ টাকায় ঠেকেছে যখন গ্যাসের দাম দাঁড়িয়েছে সিলিন্ডার পিছু ৮২০ টাকা। সব মিলিয়ে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের উপভোক্তাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে মোদি সরকার।
- অমিত দাশগুপ্ত
“রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব; হাসে অন্তর্যামী”। গত ৬ ফেব্রুয়ারী; নবদ্বীপ থেকে শুরু হয়েছে আসন্ন নির্বাচনে বঙ্গবিজয়ের লক্ষ্যে বিজেপির হাইভোল্টেজ ‘পরিবর্তন যাত্রা’। রাজ্যের ২৯৪ আসন ছুঁয়ে হাইটেক রথে চড়ে দফায় দফায় পরিক্রমা করবেন বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। সেই আশির দশক থেকে চলা আদবানীর রথযাত্রার মডেল এখনও বিজেপির কাছে নির্বিঘ্ন শহর-নগর-গ্রামে মানুষের মাঝে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা- সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার একমাত্র হাতিয়ার। সেকারণেই রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশটি মনে এসে গেল। তবে এক্ষেত্রে দেবতাটি কে তা একমাত্র বলতে পারবে জনগণের ‘মন কি বাত’! যাই হোক, এই ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় ইতিমধ্যে দুবার এসে গেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। অমিত শাহ ঘুরে গেছেন। আবার আসবেন। মায় আমাদের ‘আন্দোলনভোগী’ প্রধানমন্ত্রীও জেলায় ঘুরে গেলেন। ব্রিগেড ছাড়াও আরো আসবেন নাকি পশ্চিমবাংলার অন্দরমহলে! আসলকথা পুরো হিন্দি বলয় জুড়ে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকদের ‘মহাপঞ্চায়েত’ বিজেপি-আরএসএস-কে আক্ষরিক অর্থে তাড়া করছে। সেই তাড়া হজম না করতে পেরে ওরা এসে তল্পী গাড়তে চাইছে এই বারভূঁইয়ার দেশে। ওনারা নাকি পরিবর্তন এনে এই প্রদেশকে ‘সোনার বঙ্গাল’ করে দেবেন। বাংলাকে জানে না, চেনে না। বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালি জীবনচর্যা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাহীন বিজাতীয় এই শক্তি শুধুমাত্র সংগঠিত ধর্মকে হাতিয়ার করে, ‘জয় শ্রীরাম’ এই হন্তারক শ্লোগানের জিগির তুলে পশ্চিমবঙ্গকে ওদের একমাত্রিক ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ওদের সুবিধা হয়ে গেছে একটা জায়গায়-বাংলার এখনকার শাসকদল মূলত মতাদর্শহীন; দলের সম্বল একমাত্র নেতৃর অনুপ্রেরণা। আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও তৃণমূলস্তরে দুর্নীতি প্রশ্নে শাসক তৃণমূলের অবস্থানও প্রশ্নের ঊর্ধে নয়। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়ে, অঢেল অনৈতিক অর্থ ও পেশিশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কৃষক আন্দোলনের ফলে নিজের গড় হিন্দি-বলয়ে কোণঠাসা, মরিয়া বিজেপি। দলবদল, ঘোড়া কেনবেচা এখন বাংলায় নিত্যদিনের ঘটনা। ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী ভূমিকা জনগণ দেখছে। আপাদমস্তক এক অপদার্থ কেন্দ্রীয় সরকার যে কিনা মাত্র ৬ বছরে দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারে — সেই চোরের মায়ের বড় গলা।ওরা নাকি ডবল ইঞ্জিন দিয়ে অর্থাৎ কেন্দ্র-রাজ্য যুগপৎ সহযোগিতা দিয়ে বাংলায় উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দেবে? ত্রিপুরার মানুষকেও এই একই কথায় ভুল বুঝিয়ে ওরা ক্ষমতায় এসেছিল। আজ ত্রিপুরার মানুষ বুঝছে – ফ্যাসিবাদ কি ও কেমন? জনগণ সব দেখেছে কিভাবে মোদী- অমিত শাহ-মোহন ভাগবতের আরএসএস-বিজেপি বিমুদ্রাকরণ; জিএসটি, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, উচ্চতম ন্যায়ালয়কে কাজে লাগিয়ে রামমন্দির নির্মাণ; দাভোলকর, পানশারে, কালবুর্গী, গৌরীয় লঙ্কেশ হত্যা; ভীমা কোরেগাঁও মামলা; গো-রক্ষক বাহিনী; জয় শ্রীরামের নামে মব লিঞ্চিং; দলিত হত্যা; ধর্ষণ সংস্কৃতি; তাৎক্ষণিক তিন তালাক আইন; লাভ জিহাদ আইন, করোনা কালে অপরিকল্পিত লকডাউন; পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে অমানবিক আচরণ; ব্যাঙ্কে জনগণের সম্পত্তি লুট হতে দেওয়া; বিলগ্নীকরণের নামে জলের দরে দেশের সম্পত্তি বেঁচে দেওয়া; কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নির্বিচারে দমনপীড়ন; এনপিআর-সিএএ-এনআরসি; ইত্যাদি ইত্যাদি চরম নেতিবাচক যা কিছু আজকের এই ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট ভারতে কার্যকর হচ্ছে সবই করছে এই সরকারের প্রতিনিধিরা। এসব করেও বাংলার নির্বাচনে ওরা পরিবর্তনের আওয়াজ তুলছে। কি পরিবর্তন আনবে ওরা? কোন মডেলকে প্রতিষ্ঠা করবে? গুজরাট মডেল? নাকি উত্তরপ্রদেশ মডেল! নরেন্দ্র মোদীর সাধের গুজরাট মডেলের অন্তঃসার আগেই উন্মোচিত হয়েছে। যোগী রাজ্য তো অত্যাচারী দুষ্কৃতিদের রাজ্য-এ ভীষণই প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর আমাদের পশ্চিমবাংলা?
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু “‘ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো’ দু’বছর (২০১৮ ও ২০১৯) কলকাতাকে দেশের ‘সেফ সিটি’র তকমা দিয়েছে। অন্য শহরের তুলনায় এই শহরের নারী নিরাপত্তা যে অনেকটাই ভালো, তা বারবারই উঠে এসেছে ‘ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো’র পরিসংখ্যানেও। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশেরসঙ্গে কলকাতার তুলনা করে ওই পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে এই শহরের ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। আর দিল্লিতে ১২৩১টি। [সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০.০২.২১] উপরি লিখিত অংশটি অনুধাবন করলেই বোঝা যায় সত্যি অর্থে ইতিবাচক পরিবর্তন বিজেপির সিলেবাসের বিষয় নয়। ওরা মূলত পরিবর্তন করতে চায় বাঙালি জীবনে বহু ঝরঝাপটা সত্ত্বেও আজও টিকে থাকা বাংলার নবজাগরণের উদার মানবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।ওরা বাংলার অতীতে, ঝেটিয়ে বিদায় করা বাবু কালচার আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। বিজেপির প্রকল্প অনুযায়ী বাংলা কেমন দেখতে হবে? খোদ প্যারিচাদ মিত্রর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে সেই উদাহরণকে দেখে নেওয়া যাক। বাবু “মতিলাল ধূমধামে সর্বদাই ব্যস্ত – বাটিতে তিলার্ধ থাকে না। কখন বনভোজনে মত্ত কখন যাত্রার দলে আকাড়া দিতে আসক্ত কখন পাঁচালির দল করিতেছে কখন সকের কবিওয়ালদিগের সঙ্গে দেওরা দেওরা করিয়া চেঁচাইতেছে কখন বারোয়ারী পূজার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছে কখন খেমটার নাচ দেখিতে বসিয়া গিয়াছে কখন অনর্থক মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামে উন্মত্ত আছে। নিকটে সিদ্ধি, চরস, গাঁজাগুলি মদ অনবরত চলিতেছে গুড়ুক পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। বাবুরা সকলেই সর্বদা ফিটফাট মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দাঁতে মিসি, সিপাই পেড়ে ঢাকাই ধুতি পরা বুটোদার একলাই ও গাজের মেরজাই গায়ে, মাথায় জরির তাজ, হাতে আতরে ভুরভুরে রেশমের হাত রুমাল ও এক এক ছড়ি, পায়ে রুপার বগলসওয়ালা ইংরাজি জুতা। ভাত খাইবার অবকাশ নাই কিন্তু খাস্তার কচুরি, খাসা গোল্লা,বরফি, নিখুঁতি, মনোহরা ও গোলাবি খিলি সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে। — সন্ধ্যার পর বাবুরা দঙ্গল বাঁধিয়া বাহির হন হয় তো কাহার বাড়িতে পরিয়া লুঠতরাজ করেন নয় তো কাহার কানাচে আগুন লাগাইয়া দেন হয়তো কোনো বেশ্যার বাটীতে গিয়া শোর সরাবত করিয়া তাহার কেশ ধরিয়া টানেন বামশারি পোড়ান কিংবা কাপড় বা গহনা চুরি করিয়া আনেন নয় তো কোন কুলকামিনীর ধর্ম্মনষ্ট করিতে চেষ্টা পান”। বাংলা এই সংস্কৃতিকে সবলে তার কক্ষচ্যুত করেছে বিগত শতকের নবজাগরণের কালে। আজবিজেপি তাকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছে নব আঙ্গিকে। পরিবর্তন করতে চাইছে উদার বাঙালির সহজিয়া মুখকে। একবিংশ শতাব্দীতে নতুন করে ফিরে আনতে চাইছে কৌলিন্য প্রথা অধ্যুষিত বাহ্মন্যবাদী বাংলাকে।
বাংলাকে করতে চাইছে মুসলমান-দলিত বিরোধী এক নব উত্তরপ্রদেশ।
কথা শেষ — কিন্তু পরিবর্তনের জন্য বিজেপির এই মরিয়া প্রচেষ্টা এতো সহজে হবে না। বিজেপিকে লড়তে হবে — “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে — এই বাংলায়” এই অনুভূতির সঙ্গে। বিজেপিকে লড়তে হবে -- “একসাথে চল গড়বো মোরা রঙ্গা দুনিয়া” এই তীব্র অনুভবের সঙ্গে। দেখা যাক সময় কি বলে?
- সিতাংশু চক্রবর্তী
আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের অগাস্ট মাসে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার ‘অপরাধে’ সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদহিন্দ ফৌজের সেনাবাহিনীর বন্দিদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া জারি রাখার কথা ঘোষণা করেছিল বিদেশি ঔপনিবেশিক সরকার। তাদের ‘বিচারে’ তিনজন আজাদহিন্দ ফৌজের তিনজন অফিসারের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের আদেশ জারি হয়। এঁরা ছিলেন হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ সম্প্রদায়ের তিনজন প্রতিনিধি। এই বিচারা এবং কারাদণ্ডের প্রতিবাদে সেইসময় কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। নভেম্বর মাসের ২১ থেকে ২৩ এই তিনদিন কলকাতার রাস্তা প্রকম্পিত করেছিল ছাত্ররা। সুভাষচন্দ্রের ছবি ছাড়াও তাদের হাতে ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এবং ফরওআর্ড ব্লকের নিশান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী মিছিল সমসময়ে এক ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই মিছিলের ওপর পুলিশের হামলায় হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের দুই ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। এটা ছিল প্রথম দিনের ঘটনা। পরের দু’দিন কলকাতার জনজীবন স্তব্ধ করে দিয়েছিল এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকারীরা। এই আন্দোলনের মোকাবিলা করতে গিয়ে পুলিশ আবার গুলি চালিয়েছিল এবং তার পরিণতিতে ছাত্রজনতার তেত্রিশ জন শহিদ হন, আহত হন দুই শতাধিক আন্দোলনকারী। সেদিনের সেই আন্দোলনে আরএসএস বা হিন্দু মহাসভার কেউ ছিলেন না। আজ বিজেপির অজ্ঞ এবং মতান্ধ নেতৃবর্গ সুভাষচন্দ্রের ‘অপমান’ তথা সম্মানহানি নিয়ে বাজার গরম করে তারা কতটা নেতাজি-ভক্ত তার প্রচারে বাজার গরম করতে চাইছেন, অথচ তারা সেদিন আজাদহিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের এই অনৈতিক বিচার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসেনি, প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হয়নি। সেদিন সুভাষচন্দ্রের প্রতি সম্মান জানানোর কথা তাদের মনেই হয়নি। এখন আসন্ন নির্বাচনের মুখে তারা বাঙালির মন জয় করার লক্ষ্যে সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাদের অনুরাগ নিয়ে তা বাজারে সওদা করতে নেমে পড়েছে! এর চাইতে ন্যক্কারজনক আর কী হতে পারে?
আসলে ফ্যাসিস্তরা এভাবেই মিথ্যার বেসাতি করে জনসাধারণকে প্রতারিত করে চলে তাদের হীন উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে। একটা মিথ্যেকে তারা বারবার প্রচার করার মধ্যে সত্যি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে থাকে। এখনও তারা তাই-ই করে চলেছে। এখন তাদের মুখে কথায় কথায় ভুল উচ্চারণে, ভুল তথ্যে উচ্চারিত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ প্রভৃতির নাম এবং অবশ্যই তা আসন্ন নির্বাচনে বাঙালি মনজয়ের হীন উদ্দেশ্যেই। তাদের আসল লক্ষ্যই তো ‘জয় শ্রীরাম’-এর প্রচার। জাতীয়তাবাদী প্রচার হিসেবে ‘ভারতমাতা’ নাম নিয়ে দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন।
মনে রাখা দরকার যে রামচন্দ্রের জয়গাথা থেকেই জয় শ্রীরাম-এর উৎপত্তি। এই উচ্চারণ বাংলাদেশে তেমন আমলও কোনওদিন পায়নি। আরএসএস-বিজেপি তথা গোটা সঙ্ঘপরিবার এই উচ্চারণটিকে তাদের ফ্যাসিস্ত অ্যাজেন্ডায় রূপায়িত করেছে। এখন লিঞ্চিং-এর সময় ‘জয় শ্রীরাম’ উচ্চারিত হয়, ধর্ষণ-খুন-অগ্নিসংযোগের ঘটনার সময়ও এই ‘জয় শ্রীরাম’ উচ্চারিত হয়! এই উচ্চারণ আসলে এখন হয়ে উঠেছে সঙ্ঘপরিবারের একটি পরিকল্পিত ফ্যাসিস্ত শ্লোগান এবং রণধ্বনি।
প্রখ্যাত ফোটোজর্নালিস্ট প্রশান্ত পাঞ্জিয়ার জানিয়েছেন যে অযোধ্যা মহিলা তীর্থযাত্রিরা বলে থাকেন ‘সীতারাম সীতারাম’, আর বয়স্কারা বলে তো রামনাম উচ্চারণই করেন না! প্রচলিত অর্থে ‘জয়’ বলতে ‘সিয়াভার রামচন্দ্রজি কি জয়’ অর্থাৎ সীতাপতি রামচন্দ্রের জয়। আজ থেকে শতবর্ষ আগে অযোধ্যায় আন্দোলনকারী কৃষকরা ‘বাবা রামচন্দ্র’-এর কথা বলতেন। সে সময় আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের শ্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ‘সীতারাম’ বা ‘সিয়ারাম’। এই অধুনা প্রচারিত ‘জয় শ্রীরাম’ একান্তভাবেই ফ্যাসিস্ত হিন্দুতবাদীদের রাজনৈতিক এবং তাদের মতাদর্শিক উপস্থাপনা, যে শ্লোগানে নারীদ্বেষী হিসেবেই তারা সীতার নাম অনুক্ত রেখেছে। ‘জয় সীতারাম’ কিম্বা ‘জয় সিয়ারাম’-এর স্থলে এই ফ্যাসিস্তরা পরিকল্পিতভাবেই সীতার নাম বাদ দিয়েছেন। তাদের নারীদ্বেষী মনোভাব এই শ্লোগানে পরিস্ফূটিত হয়েছে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে গত শতকের আশির দশকে রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’-এই এই ‘জয় শ্রীরাম’ জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াস পাওয়া হয়েছিল। আর তার বারো বছর পর বিরানব্বুই-এর ৬ ডিসেম্বরের কালো দিনটিকে এই ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান তার বিধ্বংসী এবং বিদ্বিষ্ট মনের প্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
সঙ্ঘপরিবারের চিন্তক জনৈক কলমচি ফ্যাসিস্ত হিন্দুত্ববাদীদের এই ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগানটিকে বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবাংলায় অত্যন্ত ‘জনপ্রিয়’ বলে অভিহিত করেছেন! কবে থেকে এবং ঠিক কীভাবে তা জনপ্রিয় হয়েছে তা তিনি বলেননি। তবে তিনি একথা স্বীকার করেছেন যে এই শ্লোগানটি প্রকৃতপক্ষে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকাল থেকেই জনপ্রিয়কৃত করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য : ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগানদুটি বাংলাদেশে প্রাধান্য পেয়েছিল, সেখানে ‘জয় শ্রীরাম’-এর কোনও স্থান ছিল না। অন্যদিকে গোবলয়ে এই ‘জয় শ্রীরাম’ প্রাধান্যলাভ করে ছিল। — স্বভাবতই তাঁর এই বক্তব্যের নির্যাসেই প্রকাশ পায় যে বাংলায় ‘জয় শ্রীরাম’ আদতে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মাধ্যমেই সঙ্ঘপরিবার তাদের ফ্যাসিস্ত অ্যাজেন্ডাকে কার্যকরী করার পরিকল্পনা করেছে। তাঁর ক্ষোভ এই যে পশ্চিমবাংলার কেউ কেউ প্রতিবেশী দেশ থেকে ধার করে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছেন! বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এই জনপ্রিয় শ্লোগানটিকে গ্রহণে তাঁর ভীষণরকম আপত্তি! ব্রিটিশ আমলে বন্দেমাতরম যেমন জনমনপ্লাবী শ্লোগান হয়ে উঠেছিল, এখন তেমনই ‘জয় শ্রীরাম’ হচ্ছে ‘ক্রোধ প্রকাশের’ উচ্চারিত কণ্ঠস্বর! এভাবেই তিনি সম্ভবত অসতর্কভাবেই স্বীকার করে ফেলেছেন যে ‘জয় শ্রীরাম’ প্রকৃতপক্ষে সঙ্ঘপরিবারের ‘ক্রোধ প্রকাশের’ অর্থাৎ খুনহত্যা-ধর্ষণ-দহন-ধ্বংসের প্রোগ্রাম কার্যকরী করার উত্তেজিত শ্লোগান!
তিনি আরও বলেছেন যে বন্দেমাতরম তো বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেই পাওয়া যায় যেখানে দেবী দুর্গার পুজো উপলক্ষে এই বন্দেমাতরম অর্চিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম-গানে ‘ত্বং হি দুর্গা’ ইত্যাদি আছে, যা নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম শ্লোগানকে গ্রহণ কেন গ্রহণ করেনি, এপ্রশ্ন সঙ্গত। বন্দেমাতরম-এর অর্থ ‘মা, তোমাকে বন্দনা করি’। স্বঘোষিত ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে তারা এই বন্দেমাতরমকে গ্রহণ না করে ‘জয় শ্রীরাম’ গ্রহণ করলো কেন? এর জবাব কলমচি দেবেন কি? আসলে দুর্গা তো মহিলা দেবী। সীতা তো রামচন্দ্রের স্ত্রী। সঙ্ঘপরিবার তাদের নারীদ্বেষিতার কারণেই মহিলাদের গুরুত্ব দিতে নারাজ। মহিলাদের কাজ হচ্ছে পুরুষদের দাসী হিসেবে সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং নির্বিকার চিত্তে ঘরের কাজ করে যাওয়া! দুর্গা ছিলেন যোদ্ধা। স্বভাবতই তিনি তো বিজেপির কাছে গ্রহণযোগ্যা হতে পারেন না! আর রামের সহধর্মিনী হিসেবে সীতা রামের সঙ্গে বনবাসে গিয়েছিলেন, প্রচুর দুঃখকষ্ট ভোগ করার পর তিনি যুদ্ধশেষে রামচন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে রানি হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্তা হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সংঘপরিবারের এই আরাধ্য দেবতা রাম তো নিজের স্ত্রীকেই মর্যাদা দেননি, তাঁর সম্মানহানি করেছেন, আর সেই স্ত্রীর প্রতি অবিচারকারী রামচন্দ্রই সংঘপরিবারের কাছে অপ্রশ্নেয় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। ফলে তাদের শ্লোগানে সিয়ারাম কিম্বা সীতারামের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ত্রাসসঞ্চারক শ্লোগান হিসেবেই গৃহীত হয়েছে।
অন্যদিকে এই সংঘপারিবারিকেরা আবার ভারতমাতা-র কথা বলে! তারা ‘ভারতমাতা কি জয়’ শ্লোগান দিয়ে থাকে! যারা নারীদ্বেষী তারা কীভাবে ভারতমাতার নামে শ্লোগান দেয়? ভারতমাতা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ভারতাম্বা’ শব্দ থেকে। অম্বা শব্দের অর্থ মা। এইভাবে ভারতাম্বা-ই ভারতমাতা হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতমাতার কনসেপ্টটি এসেছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময়। উত্তরকালে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভারতমাতা’ নামে একটি নাটক লেখেন এবং তা অভিনয়ও হয়। এর সাতবছর পর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এই ভারতমাতা দেশমাতৃকা রূপে চিত্রিত হন। তারও আড়াই দশক পরে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতমাতার চিত্রাঙ্কন করেন। তবে এইসব ভারতমাতার কনসেপ্ট এবং চিত্রাঙ্কন সবই ছিল কল্পিত। স্বয়ং নিবেদতাও এইসব ভারতমাতার চিন্ত্রাঙ্কনের প্রশংসা করলেও স্বীকার করেছিলেন যে এসবই কল্পনাপ্রসূত।
হিন্দুত্ববাদীরা এই ভারতমাতার কল্পচিত্রকেই তাদের দেশপ্রেমের স্মারক হিসেবে সওদা করে থাকে। এই নারীমূর্তি নিছক কল্পিত, বাস্তবের সঙ্গে যার কোনও সংশ্রব নেই। একসময় দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকরা বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। আর সেইসময় সেই বিদেশি ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে দূরে থাকা দেশ্রদ্রোহিরা আজ দেশপ্রেমের পাঠ শেখাচ্ছেন! নিজেদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে গণ্য করে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত সব আইনে অভিযোগ এনে তাদের কারারুদ্ধ করে চলেছেন আর অন্যদিকে আসন্ন নির্বাচনে বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে বাংলার মন জয় করতে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে।
এই নারীদ্বেষী, কৃষকস্বার্থ বিরোধী, শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী এবং সর্বোপরি দেশের আপামর জনস্বার্থ বিপন্নকারী এই ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলাই আজ সময়ে এবং ইতিহাসের দাবি।
- অশোক চট্টোপাধ্যায়
২৫ জানুয়ারীর রাত। সেদিনের রাতটা একটু বেশিই ঠান্ডা ছিল। কিন্তু সিঙ্ঘু , টিকরি এবং গাজীপুর বর্ডারের কৃষকরা সারা রাত জেগে পরের দিনের ট্র্যাক্টার ৠালির জন্য তাদের ট্র্যাক্টার আর ট্রলি সাজাতে এবং পরের দিনের প্রস্তুতি নিতে মেতে ছিল।
২৬ জানুয়ারী টিকরী বর্ডার থেকে শুরু হওয়া ট্র্যাক্টর মিছিলের একদম সামনে ছিলেন সর্বভারতীয় কিষাণ মহাসভার সভাপতি কমরেড রুলদু সিং এবং সঙ্গে ছিলেন এআইকেএমএর কমরেড গুরনাম সিং এবং যশবীর কৌর নত। গাজীপুরে মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন সম্পাদক কমরেড রাজারাম সিং এবং উত্তরাখণ্ডের নেতা কমরেড পুরুষোত্তম শর্মা এবং উত্তর প্রদেশের কমরেড ঈশ্বরী প্রসাদ কুশওয়াহা।
তিনটি মিছিলকেই দিল্লীর জনতা স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যর্থনা জানায় এবং পুরো রাস্তা ধরে মিছিলে যোগদানকারী মানুষদের আতিথেয়তা করে। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় দিল্লীর এআইসিসিটিইউ এবং এআইএসএ শাখা মিছিলকে অভ্যর্থনা জানায় তাদের ব্যানার এবং শ্লোগানের মাধ্যমে এবং খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থাও তারা করেছিল। টিকরী বর্ডারের মিছিলকে এআইসিসিটিইউএআইএসএ-আরওয়াইএ নজফগড়ে স্বাগত জানায়। সিঙ্ঘু বর্ডারের মিছিলকে তারা স্বাগত জানায় স্বরূপনগরে এবং সিংঘৌলায় আর গাজীপুরের মিছিলকে অপ্সরা চৌকে। কমরেডরা জানান যে মানুষ তাদের বাড়ির ছাদে জড়ো হয়েছিল কৃষক মিছিলের ওপর পুষ্পবৃষ্টি করার জন্য।
কমরেড সঞ্জয় শর্মা, ভি অরুণ কুমার এবং আমি ২৫ জানুয়ারী সিঙ্ঘু বর্ডারে রাত কাটাই লিবারেশানের তরফে এই কৃষক মার্চকে কভার করার জন্য। আমি আমার কিছু অতুলনীয় অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব।
আমরা রাত কাটাই সিঙ্ঘু বর্ডারে শহীদ ভগত সিং গ্রন্থাগারের তাঁবুতে যেখানে এআইএসএ এবং এআইসিসিটিইউ-র কমরেডরা সারা রাত জেগে কৃষকদের ট্র্যাক্টার এবং ট্রলি সাজাচ্ছিল। এআইএসএ-র কমরেড নেহা তিওয়ারী একটি ব্যানার বানিয়েছি, তাতে মোদীকে আদানী-আম্বানীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি পুতুল হিসেবে দেখানো হয়েছিল। সেই ব্যানারটির কৃষকদের মধ্যে ভাল চাহিদা হয়েছিল। অনেকেই সেই ব্যানারটি নিয়ে যাচ্ছিল তাদের ট্র্যাক্টারে লাগানোর জন্যে। আমাদের কমরেডরা এআইকেএম-এর ট্রলীতে ভগৎ সিং, আশফাকুল্লা খান, চন্দ্রশেখর আজাদ, ডক্টর আম্বেদকার, চে গেভারা, শহীদ উধম সিং এবং কার্তার সিং সারাভা-র বড় বড় কাট আউট লাগিয়েছিল যা পুরো মিছিলে এবং সিঙ্ঘু বর্ডারে উৎসাহের সঞ্চার করেছিল।
কমরেড সঞ্জয় এবং আমি, সঙ্গে চন্ডীগড়ের কমরেড সৌম্যা, কয়েক কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছলাম আমাদের গুরুদাসপুর কমরেডদের ক্যাম্পে। সেখানে আমরা ৪ জনের এক পরিবারের দেখা পেলাম — বাবা, মা এবং তাদের দুই মেয়ে —একজন ন’বছরের আরেকজন তেরো। তারা বাইকে চেপে গুরুদাসপুর থেকে সিঙ্ঘুতে এসেছেন এই মিছিলে যোগদান করার জন্য। দুটি মেয়ে, তাদের এই জনসমাগমের প্রতি তীব্র আকর্ষণের বশে, সৌম্যা এবং গুরুদাসপুরের কমরেডদের কাছে বায়না ধরে তাদেরকে ট্র্যাক্টারে জায়গা দিতে হবে!
আমরা তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক থেকে আসা কৃষকদের একটি দল দেখলাম যারা মিছিলের সামনে থাকার জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
পরের দিন সকালে, যখন ঘুম চোখে আমি বাথরুমের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, লক্ষ্য করলাম এক ভদ্রলোক এক যুবতীকে খোঁচা দিচ্ছেন এবং আমার দিকে তাকাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর, তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে বলেন, “ইনি সেই লেখিকা যার বই আমি তোমাকে পড়তে দিয়েছি — ‘‘ফিয়ারলেস ফ্রীডম’’। সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু যুবতী আমাকে উৎসাহের সাথে অভিবাদন জানায় এবং আমার বইয়ের প্রশংসা করে। নারী স্বাধীনতার ওপর বইটি যুবতী মেয়েরা পড়ছে জেনে এবং তাদের এই ঐতিহাসিক প্রতিবাদী সমাবেশে দেখতে পেয়ে আমার বড় আনন্দ হল। তারা জানায় তারা পাটিয়ালা, গুরুদাসপুর, চন্ডীগড় থেকে এসেছে এই প্রতিবাদে সামিল হতে এবং তারা প্রজাতন্ত্র দিবসের কৃষক প্যারেডের দিকে মুখিয়ে আছে।
অনেক লঙ্গরের মধ্যে একটিতে একটু চা এবং সকালের জলখাবার খেয়ে, কমরেড সঞ্জয় এবং আমি বর্ডারের দিকে চলতে শুরু করলাম যেখান থেকে প্যারেড শুরু হবে। অরুণ ততক্ষণে তার ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে গেছে একদম সামনে। একটি চায়ের দোকানে অপেক্ষা করতে করতে আমাদের সাক্ষাৎ হল গুরুদাসপুরের যশবীর সিং-এর সাথে। তার হয়তো ফকোমেলিয়া নামে একটি জন্মগত অসুস্থতা থাকার কারণে পা দুটি ছোট এবং তিনি হুইলচেয়ারেই যাতায়াত করেন। তিনি বললেন, ২৫ দিন ধরে এখানেই আছেন — “আমরা তো এখানে বাংলো তৈরি করে ফেলেছি” — মজা করে বলেন। তিনি আমাকে তার হুইলচেয়ারে বাঁধা কিষাণ ইউনিয়ানের পতাকা গর্বের সাথে দেখান। তিনি বলেন “এই ট্র্যাক্টারের লাইন সোনিপত পর্যন্ত চলে গেছে। এখানে মাত্র ২ শতাংশই দেখা যাচ্ছে। এই আইন লাগু হয়ে গেলে সবাইকে খুব খারাপ ভাবে প্রভাবিত করবে। মানুষ খেতে পাবে না, রেশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাবে। মোদীকে আমাদের দাবি মানতেই হবে।”
সময়ের সাথে সাথে যখন সেই অন্তহীন ট্র্যাক্টারের কুচকাওয়াজ শুরু হল, তখন তার পাশে একই রকম বিশাল সংখ্যায় মানুষের মিছিলে আমরা পায়ে হেঁটে যোগ দিলাম। এর সঙ্গে সামরিক মার্চের কোনো মিল ছিল না। এই মিছিল উচ্ছ্বাসে ভরা, স্লোগান উঠছে চারিদিকে, বিভিন্ন ধারার গান গাওয়া এবং বাজানো হচ্ছে — দেশাত্মবোধক থেকে বিপ্লবী গান, কৃষকদের গান থেকে এই প্যারেডের জন্য বাঁধা গান। তারই সঙ্গে যুবক যুবতী বৃদ্ধ বৃদ্ধারা তালে পা মিলিয়ে নাচছে।
সঞ্জয় আর আমি মিছিলের সাথে পা মিলিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার হাঁটলাম। আমরা টিভি মিডিয়ার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি দেখে বিস্মিত হলাম। মনে হল যে ইন্টারনেট বোধহয় ইচ্ছে করেই কমজোরী করে রাখা হয়েছে কারণ আমরা কোনো ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ সম্প্রচার করতে পারছিলাম না।
প্যারেডের পথে যেখানেই বসতি ছিল সেখানেই মানুষ বেরিয়ে এসে হাততালি এবং উল্লাস উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছিল। আমি কিছু যুবক শ্রমিকের সাথে কথা বললাম। একজন বলল, তার মুখ আনন্দোজ্বল, “প্রত্যেকে কৃষকদের প্রশংসা করে তাদের তেজ এবং সাহসিকতা — দুটোকেই! আমরা তাদের দেখতে পেয়ে খুবই আনন্দিত এবং তাদের দাবিকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করি। আমরা শ্রমিকরাও কৃষকই — আমরা সবাই গ্রামের কৃষি সমাজ থেকেই এসেছি।”
আমরা একটি ট্র্যাক্টার দেখতে পেলাম যেখানে সবাই মহিলা, চালাচ্ছে একজন যুবতী। ট্র্যাক্টার এবং ট্রলি ভর্তি মহিলারা ছাড়াও, আমাদের সঙ্গে অগণিত মহিলা হাঁটছিল, শ্লোগান দিচ্ছিল, পতাকা ধরে ছিল।
খামপুরে (দিল্লীর একটি গ্রাম), আমরা দেখলাম সেখানকার বাসিন্দারা — পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা সবাই – বালতিতে জল ভরে এবং গ্লাসে করে ক্লান্তদের পানীয় জল দিতে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে দুজন আমাদের বলল “আমরা কৃষকদের সম্পূর্ণ সমর্থন করি এবং তারা অসাধারণ কাজ করছে।”
একজন ভদ্রলোক যিনি খামপুরে একটি ছোট্ট দোকান চালান তিনি উৎসুক হয়ে বলে গেলেন,” আমি আমার ছেলেকে কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছি। কিন্তু সব ব্যর্থ। এখন কোনো চাকরি নেই। আমার ছেলে জমি বাড়ি কেনা বেচার সাথে যুক্ত কিন্তু এখন তার বাজারও খারাপ। মোদী আচ্ছে দিনের কথা বলে কিন্তু আমরা কিচ্ছু পেলাম না। শুধু মনে হচ্ছে আদানী আম্বানীরাই লাভ করল। এই কারণেই কৃষকরা লড়ছে।”
খামপুরে সঞ্জয় আর আমি একটি ট্রলিতে চড়লাম। আমার উঠতে অসুবিধে হচ্ছে দেখে আমার হাত ধরে একজন যুবক আমাকে তুলে দিল। ভেতরে আমরা এক গোটা পরিবারের দেখা পেলাম। সেই পরিবারের মহিলারাও সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা চন্ডীগড়ে একটি কসমেটিকসের দোকান চালায়। তারা সিঙ্ঘুতে এসেছে এই আন্দোলন এবং প্যারেডে অংশগ্রহণ করতে। ট্রলি থেকে রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য দেখতে পেলাম। যতদূর চোখে দেখা যায় ট্র্যাক্টারের সারিবদ্ধ লাইন। ট্র্যাক্টারের লাইন সীমাহীন।
অবশেষে, আমরা যখন অরুণের কাছ থেকে জানতে শুরু করলাম যে কৃষকদের ওপর পুলিশী নির্যাতন হচ্ছে আইটিও-তে, বুঝতে পারলাম যে প্যারেড সম্পূর্ণ থেমে গেছে কারণ দিল্লী পুলিশ এই আইটিও-র ঘটনা দেখিয়ে পুরো মার্চকে মুকতরবা চকের পরে আর যেতে দিচ্ছে না। বুঝতে পেরে আমরা ট্রলি থেকে নেমে পড়লাম এবং বুঝতে পারলাম যে আমরা এখন সঞ্জয় গান্ধী ট্রান্সপোর্টনগর ফ্লাই ওভারে আছি এবং আমাদের নীচে লিবাসপুর গ্রাম। আমরা অগত্যা ঝোপঝাড় ধরে নীচের রাস্তায় নেমে এলাম। আমরা আমাদের শাকারপুরে অফিসের দিকে প্রায় ছুট লাগালাম এবং অনেক বাধা অতিক্রম করতে হল কারণ দিল্লী পুলিশ মেট্রো বন্ধ করে দিয়েছে এবং চারিদিকে জ্যাম কারণ পুলিশ প্যারেড এগোতে দিচ্ছে না এবং দিল্লীতে যাতায়াত করা প্রায় দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল।
ভালো ব্যাপারটি হল যে আমরা যখন ফিরছিলাম, প্রত্যেক দিল্লী বাসিন্দা — বেশির ভাগ অটো-রিক্সা চালক এবং দিল্লীর বিভিন্ন শ্রেণী থেকে আসা তাদের যাত্রীরা — কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং মোদী সরকারের ও পুলিশের বিরুদ্ধাচারণ করছিল।
এক ভদ্রলোক বিস্তারিতভাবে মোদী সরকারের সমালোচনা করলেন, “কি করে এটা হয়! যে সরকার এত সমর্থনের সাথে ৬ বছর আগে নির্বাচিত হল, সেই একই সরকার প্রায় প্রত্যেক বছর সারা দেশকে অশান্ত করে তুলছে, নোটবন্দী, সিএএ, লকডাউন আর এখন কৃষি আইন? আমাদের দেশের বর্ডারে চীন দাঁড়িয়ে আছে আর সরকার নিজের নাগরিকদেরকেই তার শত্রু বানাচ্ছে। শেষ শীতে সিএএ বিরোধী আন্দোলন চলছিল আর এই শীতে কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন দুই মাস ধরে চলছে। এত মানুষ যদি এর বিরোধিতাই করে তো সেই আইন ফেরত নিয়ে কেন নেওয়া হচ্ছে না? সমস্যা হচ্ছে মোদীকে নিয়ে, সে খুবই দাম্ভিক। সে ভাবে সে দেশের রাজা যে তার সম্মান হারাবে যদি সে পিছু হটে। এই কৃষকদের দেখো। তারা একজন মানুষের গায়েও হাত দেয়নি যদিও তারা এতদিন ধরে এতজন মিলে এখানে আছে।”
একজন অটোচালক বললেন, “কৃষকরা এতো কম টাকা কামায় এবং প্রত্যেক বছর তারা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তায় থাকে। এখন সরকার তাদের এই কম আয়টুকুও ছিনিয়ে নিতে চাইছে। এই সরকারকে নিয়ে সমস্যা কি জান? তারা তাদের সমস্ত সমালোচককেই দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে দেয়। এটা কি করে হয় যে সরকার সবসময় ঠিক আর সবাই যারা তাকে সমালোচনা করছে তারা দেশদ্রোহী এবং তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে?”
ই-রিক্সাতে লিবাসপুরের একটি মেয়ে বলল,” আমি শুনলাম কৃষকরা পুলিশকে মারছে”। আমরা তাকে একজন কৃষক পুলিশী হামলায় মারা গেছে বলায়, সে ট্র্যাক্টারের লম্বা লাইন দেখে বলল “এখানে তো তারা শান্তিপূর্ণই আছে। যদি পুলিশ তাদেরকে মারে এবং খুন করে, তাহলে কৃষকরাও তাদেরকে দুই ঘা দেবে এটা কি আশ্চর্যের?”
আমরা যাদের সাথে কথা বললাম তাদের একজনও যাতায়াতের অসুবিধের ব্যাপারে অভিযোগ করল না এবং সবাই কৃষকদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং তাদের জন্য চিন্তিত ছিল।
এই প্রজাতন্ত্র দিবসে, কৃষকরা তাদের এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের আরেকটা ফলক পার করল। আমাদের তাদের সাথে শেষ অবধি এই পথ চলতে হবে এবং সেটা তখনই শেষ হবে যখন এই তিন কৃষি আইন ফেরত নেওয়া হবে।
- কবিতা কৃষ্ণান
ভাষান্তর : প্রত্যূষ নন্দী
(লিবারেশান, ফেব্রুয়ারী, ২০২১ সংখ্যা থেকে)
মাঝে মাঝে তিনি মনকে অর্গলমুক্ত করেন! আম জনতার উদ্দেশে অর্ধনিমীলিত নেত্রে, সুনিয়ন্ত্রিত স্বরক্ষেপনে, প্রগাঢ় বাচনে ‘অমৃত’বর্ষণ করেন! কিন্তু সব উপদেশ কি আর ফলে! তিনি যখন থালি বাজাইয়া দীপ জ্বালাইয়া করোনা নির্মূলের নিদান দিলেন, অতীব দুষ্ট সেই জীবাণু প্রায় সার্ধলক্ষ প্রাণ কাড়িয়া ছাড়িল!
ইদানীং তাহার সযত্ন লালিত শ্মশ্রু গুম্ফ শোভিত মুখে খানিকটা ‘ঋষিতুল্য’ ভাবের উদয় হইয়াছে। মন্দ লোকেরা অবশ্য এই রাবীন্দ্রিক শ্মশ্রুর পশ্চাতে কূট উদ্দেশ্য দেখিতেছে। এই নূতন ‘ঋষিতুল্য লুক’-এর আড়ালে অতি পরিচিত ক্রূর মুখটি গোপন করিয়া, নূতন ‘ইমেজ’-এ বঙ্গবাসীকে মোহাবিষ্ট করাই নাকি উদ্দেশ্য!
আপামর জনতার জাগতিক সুখ-দুঃখআনন্দ-বেদনায় তিনি নির্বিকার! গত বৎসর দেশের রাজধানীতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাতাণ্ডবে তাহার স্নেহভাজনেরা ‘দেশকে গদ্দারোঁকো’ ইত্যাদি শ্লোগানসহ প্ররোচনা দিয়াছিলেন (যাহাদের একজন ‘অতি বিশিষ্ট’ – গত দই বৎসর ধরিয়া ‘দেশের বিলগ্নীকরণ বাজেট’ ভাষণের নৃত্যপর উপস্থাপনায় যাহার অতি শিষ্ট উপস্থিতি লক্ষণীয়)। সেই হত্যালীলায় উস্কানিদাতাদের পরিবর্তে প্রশাসন নিগৃহীতদের, সমান নাগরিকত্বের আন্দোলনকারীদের গারদে পুরিল। তিনি নীরব! লকডাউন ঘোষণা হইতে, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের হাজার মাইল পদব্রজের অসহায়তা, পথিমধ্যে অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যুর বেদনা, কোটি কোটি কর্মচ্যুত মানুষের হাহাকার, দেশের আর্থিক বিকাশরেখার ক্রমপতন ও ঋণাত্মক হওয়া-এ সকল বিষয় তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই আনিলেন না। তথাকথিত ভীমা কোরেগাঁও মামলায় মিথ্যা অভিযোগে দুই বৎসর যাবৎ বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সমাজকর্মী, কবি (যাহাদের মধ্যে দুইজন অশীতিপর চলচ্ছক্তিহীন মানুষ কারাযন্ত্রণার পীড়নে মুমূর্ষুপ্রায়) বিনা বিচারে আটক রহিয়াছেন, জামিন পর্যন্ত হয় নাই (অতি সম্প্রতি অবশ্য কবির চিকিৎসার্থে শর্তাধীন সীমিত সময়ের জামিন মিলিয়াছে বটে!) দেশের ‘প্রধান অভিভাবক’ তাহাতে বিস্ময়করভাবে অবিচলিত!
দেশের কৃষক সমাজ, তাহার অতি সাধের কর্পোরেটরাজ কায়েমের বাসনায় জল ঢালিয়াছেন! তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তিন মাসব্যাপী সত্যাগ্রহে অনড় থাকিয়া তাহার শিরঃপীড়ার কারণ হইয়াছেন। এই অনমনীয় দৃঢ়পণ লড়াইয়ে দেশের সকল মানুষ যাহারা গত প্রায় সাত বৎসর ধরিয়া কেন্দ্রের হিন্দুত্ববাদীদের গণতান্ত্রিক রীতি প্রকরণকে পদদলিত করিয়া সমস্ত জুলুম, বেনিয়মের বেত্রাঘাত সহিতেছেন, যাহাদের হাজার প্রতিবাদ শাসকের আকাশচুম্বী ঔদ্ধত্যে প্রতিনিয়ত প্রতিহত হইতেছে, তাহারা যেন এই আন্দোলনে এক সমস্বর প্রতিবাদের ভাষা পাইয়াছেন! গত ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে আম জনতা গর্বিত বিস্ময়ে, আত্মহারা আনন্দে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, ধূলিধূসর লাখো কৃষকের হিম্মতের ‘ট্রাক্টর প্যারেড’ কীভাবে মন্ত্রী সান্ত্রী আমলা রাজনীতিকদের ঔদ্ধত্য, আভিজাত্য প্রদর্শনের একচেটিয়া অধিকারকে ম্লান করিয়া দিয়াছিল! সেই হিম্মতের প্যারেড প্রধান ‘অভিভাবকের’ হৈমালিক উপেক্ষায় অবশেষে আঁচড় কাটিতে সক্ষম হইয়াছে!
সেই দিন লাল কিলায় এক বিক্ষিপ্ত ঘটনার উল্লেখ করিয়া, তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় আবেগ থরথর কণ্ঠে বলিয়াছিলেন, জাতীয় পতাকার অবমাননায় বিশ্বের কাছে নাকি ভারতের মুখ পুড়িয়াছে!
বটে! ইতোপূর্বে তাহার কারণে বহুবার ভারতের মাথা হেঁট হয় নাই? যখন তাহার মুখ্যমন্ত্রিত্বে একটি রাজ্যে রাষ্ট্রপোষিত সাম্প্রদায়িক হিংসায় প্রায় দুই সহস্র প্রাণ বলি হইয়াছিল? হাজার হাজার নারীর সম্ভ্রম লুঠ হইয়াছিল? যখন সমস্ত রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচারের মুখে কালি লেপিয়া বিদেশে এক রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচনী প্রচার করিয়াছিলেন (‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’), সেই রাষ্ট্রপ্রধান যখন তাহার দেশের মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হইলেন – তখন আরেকবার? ৩৭০ ধারা বিলোপের পর হইতে কাশ্মীরী জনগণের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ, শিশুদের পর্যন্ত পেলেটে চোখ অন্ধ করিয়া দেওয়া? দীর্ঘ প্রায় দেড় বৎসর ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখিয়া (অতি সম্প্রতি ইন্টারনেট চালু হইয়াছে) কাশ্মীরী জনগণকে বিপর্যয়ে ঠেলিয়া দেওয়া, অর্থনীতির কোমর ভাঙিয়া দেওয়া? একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধান হইয়া ‘রামমন্দিরের’ শিলান্যাস করা এবং সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ রঞ্জিত স্বাধীনতা দিবসের গরিমাকে ধূলায় লুটাইয়া শিলান্যাসের দিনটিকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ আখ্যা দেওয়া? অপরিকল্পিত লকডাউনে মানুষকে, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্দশায় ঠেলিয়া দেওয়া? দিল্লী সীমানায় ভয়াবহ ঠাণ্ডার হিংস্র কামড়ের মধ্যেও অবিচল কৃষকদের উপর প্রশাসনিক মদতে হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাবাহিনীকে তাণ্ডব চালাইতে দেওয়া? কর্পোরেটের কোম্পানি রাজ কায়েমের জন্য কৃষক ও জনতার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া? কৃষকদের অনড় সংকল্পে ব্যর্থকাম হইয়া তাহাদের পানীয় জল,বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট বন্ধ করিয়া কংক্রিট-গজাল-কাঁটাতারে দেশের মধ্যেই অবরুদ্ধ রাখা? বিশ্ববাসী কি এই সব জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় চক্ষু মুদিয়াছিলেন? আসলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামী প্রতিস্পর্ধা তাহাকে প্রতিহিংসা পরায়ণ করিয়া তুলিয়াছে!
এ হেন ব্যক্তিটি যে আদৌ সত্য ও ন্যায়ের পথিক নহেন এবং জনগণের পক্ষেও নহেন—এ বিষয়ে রাজনৈতিক মহলে অন্তত কিঞ্চিন্মাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না, যতই ‘ভোল’ পরিবর্তন করুন!
সম্প্রতি বঙ্গের শাসকদলের নেতা কর্মীদের মধ্যে এক অদ্ভুত রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়াছে। ‘পদ্মরোগ’! কিছুকাল টানাপোড়েনের পর – কোনো এক সুপ্রভাতে পদ্মবনে প্রস্ফুটিত হওয়া! ‘হেভিওয়েট’ মন্ত্রী হইতে পঞ্চায়েতের চুনোপুঁটি নেতা-সবারই এক ‘অভিযোগ’—একই সঙ্গে!’দলের মধ্যে দম বন্ধ হইয়া আসিতেছে’! এই ‘গণতান্ত্রিক অধিকারবোধ’ এখনই হঠাৎ কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভাঙিয়া প্রবল বিক্রমে জাগিয়া উঠিল? রহস্যটি কী? কিছু দিন ধরিয়া পদ্মদলের রাজ্য সভাপতিকে অবশ্য এক রহস্যময় ‘পলিটিক্যাল ভ্যাকসিন’-এর কথা বলিতে শুনা যাইতেছে! তিনি কতজনকে, কী মাত্রায় তাহা প্রয়োগ করিয়াছেন, তিনিই জানেন।ইহা কতটা ‘পলিটিক্যাল’ তাহা লইয়া সন্দেহ থাকিলেও, ইহার কার্যকারিতা অমোঘ! যেন হ্যামলিনের বংশীবাদকের সম্মোহনে ইন্দূরের পাল পিল পিল করিয়া চলিয়াছে! টলি পাড়াতেও সংক্রমণ ভয়ানক আকার নিয়াছে। এই এই খানেই আমাদের বিস্ময়। এই জুমলা দলটিকে সততা, ন্যায়, আদর্শবোধের ‘পরাকাষ্ঠা’ ঠাওরাইবার কারণটি কী?
এই আবহেই তিনি বঙ্গে আসিলেন — জুমলা দলের কর্ণধার! দিল্লীর বাকি পদ্মনেতারা তো ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করিতেছেনই। তিনি আসিয়াই রাবীন্দ্রিক শ্মশ্রু-গুম্ফের আড়ালে রহস্যঘন কণ্ঠে ‘আসল পরিবর্তন’-এর কথা শুনাইলেন! ‘আসল পরিবর্তন’!! সেটি কি তোলাবাজির পরিবর্তে জুমলাবাজি! বঙ্গবাসীর এখন ‘ছাড়িয়া দে মা, কাঁপিয়া বাঁচি’ অবস্থা! উদরান্নের সংস্থান কঠিন হইয়াছে ঠিকই। কিন্তু একেবারে ‘তৃণভোজী’ ভাবিয়া ফেলা কি ঠিক হইতেছে?
১) ভারত সরকারের কাছে আমাদের দাবি করে পাওয়া গাঁয়ের মানুষের গাঁয়েই কাজ। যার নাম ‘১০০ দিনের কাজ’।
এবারের বাজেটে এই কাজে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার টাকা কমিয়ে দিয়েছে।
২০২০-২১ সালে সরকার খরচের জন্য রেখেছিল ১,১১,৫০০ কোটি টাকা।
২০২১-২২ সালের বাজেটে কমিয়ে রেখেছে ৭৩,০০০ কোটি টাকা।
তার মানে ৩ ভাগের ১ ভাগ টাকা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে গাঁয়ের লোক কম কাজ পাবে, গাঁয়ের লোকের রোজগার কমে যাবে। এখন এমনিতেই অনেকে কাজ-হারা হয়ে গেছে। বাজেটে টাকা কমিয়ে দেওয়ায় আরও গরিব হয়ে যাবে।
কোথা থেকে জানা : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
২) দেশের কাজ করার লোকজনের ১০০ জনের ভিতর ৬০ জন থাকে গাঁয়ে। এরা চাষ করে, জিনিস বানায়। এর জন্য লাগে পথ, আলো, জল, বাড়ি -- এমন এমন সব। এসবকে বলে পরিকাঠামো। এসবের যোগান যদি সরকার বাড়িয়ে দিত, গাঁয়ের লোকেরা গাঁয়ে কাজ করতে পারত। এবারের বাজেটে গাঁয়ের পরিকাঠামো খাতে ভারত সরকার কোনো টাকা দেয় নি। ফলে গাঁয়ের লোকের গাঁয়ে কাজ বাড়লো না।
অথচ আগে গাঁয়ের যত লোক কাজ পেতে চাইত এখন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি লোক কাজ পেতে চাইছে।
কোথা থেকে জানা : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
৩) গাঁয়ের আর শহরের গরিবরা যতটা খাবার দরকার পায় না। দেশের লোককে খাবার দেবার দায় ভারত সরকারের। তার জন্য আছে খাদ্য সুরক্ষা আইন। সেই আইন মেনে সরকারের টাকা খরচ করার কথা। এই খাতে ২০২০-২১ সালের বাজেটে ছিল ৩,৪৪,০০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালের বাজেটে কমিয়ে রাখা হল ২,০০,০০০ কোটি টাকা।
তার মানে গাঁয়ের আর শহরের গরীবরা আরও কম খাবার খেতে পাবে। আরও কমজোরী হয়ে যাবে।
কোথা থেকে জানা : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
৪) এখনকার এই আকালের সময়ে সরকারি কম্পানিরা জরুরি কাজ করে, করতে পারে। অনেকের চাকরি বানায় বানাতে পারে। অনেক জিনিস আর পরিষেবা কম দামে যোগায়, যোগাতে পারে।
এই বাজেটে বলা হল অনেক ক’টি সরকারী কম্পানি বেচে দেওয়া হবে টাকাওয়ালা মালিকের কাছে।
ভারত সরকার নিজের রোজগার বাতিল করে টাকাওয়ালা কম্পানিদের রোজগার বাড়িয়ে দিল। এরা এবার লোক ছাঁটাই করে কম লোককে কাজে রেখে বেশি দাম বসিয়ে তাদের মুনাফা বাড়াবে।
আর দেশের মানুষজনের অসুবিধা বাড়াবে।
কোথা থেকে জানা : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
৫) নিয়ম হওয়ার কথা ছিল, যারা যতো বেশি মুনাফা বানাবে তারা ততো বেশি কর দেবে। আর সরকার সেই করের টাকা দিয়ে সাধারণ মানুষের উপকার হয় এমন কাজ করবে।
২০২১-২২ এর বাজেটে বলা হলো, যে কম্পানিরা বেশি মুনাফা করবে তারা কম কর দেবে।
যে কম্পানিদের মুনাফা ৫০০ কোটি টাকার ওপরে তারা খুবই কম হারে কর দেবে। যাদের মুনাফা ১০০ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা, তারা একটু বেশি হারে কর দেবে।
পুঁজির মালিকরা মুনাফা বানায় আমাদের শোষণ করে। ভারত সরকার বলছে, কর কমিয়ে দিয়ে বলছে পুঁজির মালিকরা আমাদের শোষণ করে যতো বেশি মুনাফা বানাবে, সরকার ততো বেশি মদত দেবে কম কর বসিয়ে।
কোথা থেকে জানা : দি হিন্দু, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
৬) যে দেশবাসী খাবার যোগাড় করতে পারছে না, তাদের খাবার যোগান দেবার দায় দেশের সরকারের।
ভারত সরকার ২০২১-২২ এর বাজেটে খাদ্যে ভরতুকি কমিয়ে দিয়েছে।
২০২০-২১ এর বাজেটে যা ছিল ৪,২২,৬১৮ কোটি টাকা, ২০২১-২২ এর বাজেটে তা কমিয়ে দিয়ে হলো ২,৪২,৮৩৬ কোটি টাকা।
ভারত সরকার দেশবাসীকে খাবার যোগানের দায় মানলো না। ভারত সরকার যারা খাবার পাচ্ছে না তাদের সাথে থাকলো না।
কোথা থেকে জানা : দি হিন্দু, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
৭) সরকারের কাজ, ভারত সরকারের কাজ হলো যাদের হাতে কাজ নেই, কাজ নেই বলে খাবার নেই, তাদের কাজ দেওয়া।
ভারত সরকারের কাজ হলো, যাদের কাজ করার জায়গা বন্ধ করে দিয়ে কাজ আর রোজগার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তাদের কাজ ফিরিয়ে দেওয়া, কাজ দেওয়া। যাদের কাজের যায়গা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের কাজ ফিরিয়ে দেওয়া ভারত সরকারের কাজ, সরকারের দায়।
ভারত সরকার মজদুরদের জন্য ভাবেনি।
কোথা থেকে জানা : দি হিন্দু, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
৮) দেশের কাদের হাতে কতটা সম্পদ রয়েছে তা দিয়ে বোঝা যায় দেশের সরকার কাদের জন্য কাজ করছে, আর কাদের জন্য করছে না।
১৯৯১ সালে উপরের দিকে ১০ শতাংশ লোকের হাতে ছিল ৩৪.১ শতাংশ সম্পদ। আর নীচের দিকে ৫০ শতাংশ লোকের হাতে ছিল ২২.২ শতাংশ সম্পদ।
২০১৯ সালে উপরের দিকে ১০ শতাংশ লোকের হাতে সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ৫৬ শতাংশ সম্পদ আর নীচের দিকে ৫০ শতাংশ লোকের হাতে সম্পদ কমে গিয়ে ১৪.৭ শতাংশ সম্পদ।
এই সরকারের শাসনকালে উপরের দিকের লোকেদের হাতে সম্পদ বাড়ছে আর নীচের দিকের লোকের হাতে সম্পদ কমছে।
কোথা থেকে জানা : টাইমস অফ ইণ্ডিয়া, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
- শুভেন্দু দাশগুপ্ত
বেশ কিছুদিন যাবত একটি নতুন চিন্তার বাস্তব রূপায়ণের কথা ভাবা হচ্ছিল। সেটাই অবশেষে সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হল। সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি গত ৯ ফেব্রুয়ারী বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার মুখপত্র “আজকের দেশব্রতী” আগামী ৪ মার্চ থেকে কিছু রঙীন সাজে প্রকাশ হতে থাকবে। নব সাজে পত্রিকার দাম হবে ৫ টাকা এবং বছরে গ্রাহক মূল্য হবে ২০০ টাকা। এই পরিকল্পনাকে সফল রূপ দিতে প্রিয় পাঠক জনতা এগিয়ে আসুন, আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন, পত্রিকা সংগ্রহ করুন, গ্রাহক হোন, প্রচার সংখ্যা বাড়িয়ে চলুন। “আজকের দেশব্রতী” একদিকে যেমন পার্টির মুখপত্র, অন্যদিকে তেমনি সংগ্রামের — সংগ্রামী জনতার মুখপত্র। তাই এই পত্রিকা হাতে হাতে ছড়িয়ে দিন।
- সমাপ্ত -