সকালের আলো গায়ে মেখে সে বেরিয়ে পড়েছিল। রোজের থেকে সে দিনটা ছিল একটু অন্যরকম। সঙ্গে ছিল তার সাথীরা, আন্দোলনের সহযোদ্ধারা। উঠোনে খড়গাদার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো তার আরেক বন্ধু — তার রুজি-রুটির সঙ্গী প্রিয় অটোটি — সেদিন ছিল তার বিশ্রাম।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সে ঘুণাক্ষরেও জানতো না-বাংলার ছাত্র যুব আন্দোলনের ইতিহাসে শহীদের তালিকায় তার নামটাও যুক্ত হতে চলেছে। জানতো না মা তহমিনা বিবি, স্ত্রী আলেয়া বিবি, দুই কন্যা আর কন্যাসমা পিতৃহারা ভাগ্নীকে নিয়ে ছ’জনের (এখন পাঁচ জন) সংসারে ঘনিয়ে আসতে চলেছে নীরন্ধ্র এক আঁধার। জানতো না পশ্চিমবঙ্গের ভোটের আবহে সে এতটা প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান হয়ে উঠবে!
না, এসব কিছু জানা সম্ভব ছিল না বাঁকুড়ার কোতুলপুরের চোরকোলা গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত পেশায় অটোচালক বছর ৩১-এর যুবকটির পক্ষে।
হয়তো সে বুঝতে পারেনি, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান যিনি ‘ছাত্র যৌবন’-এর প্রশংসায় মুখর, তাদের জন্যে অনেক গান-কবিতাও লিখেছেন, যিনি গত বছর এনআরসি-বিরোধী বড় বড় মিছিলের পুরোভাগে থেকে অভয়দাত্রীর ভূমিকা নিয়েছিলেন, যিনি কিছুদিন ধরে মানুষের ‘দুয়ারে সরকার’ পাঠিয়ে ডেকে ডেকে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দিচ্ছেন, যিনি আজকাল অনেক সভায় বলেন, ‘আমি কারও মা, কারও বোন, কারও মেয়ে’ — সেই ‘মাতৃস্বরূপা’র পুলিশ ছাত্র যুবকদের শিক্ষা ও কাজের দাবির মিছিলে এমন নির্মম লাঠি চালাতে পারে!
হয়তো ভাবতে পারেনি, যে পুলিশ আম্ফান সামলাতে, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে, সেই পুলিশই ছাত্রদের প্রতি এমন হিংস্র মারমুখী হয়ে উঠবে! হ্যাঁ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, সর্বাঙ্গে এলোপাথাড়ি লাঠির আঘাত তাকে বুঝিয়ে দিল। এমন আঘাত যে তখনই বুঝেছিল, সে আর বাঁচবে না! যন্ত্রণায় সেই সাজোয়ান শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ১১ ফেব্রুয়ারী লাইভ টেলিকাস্টে রাজ্যের মানুষ তা দেখে শিউরে উঠেছে।
নেত্রী অনেক সময়ই বলেন, ‘দুষ্টু মিষ্টি’ ছেলেরা অনেক সময় ‘দুষ্টুমি’ করে, সেটা তাদের বয়সের ধর্ম। কিন্তু সেদিন তো কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি! তারা শুধু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাদের দাবি জানানোর অনমনীয় জেদে ব্যারিকেড ভেঙেছিল। তবুও কেন তাদের আটকাতে জলকামান, টিয়ার গ্যাস চলল? বেধড়ক লাঠিচার্জ হল?
মুখ্যমন্ত্রী নিয়ম মাফিক দুঃখ প্রকাশ করলেন, তার পরিবারের পাশে থাকার, চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিলেন, কিন্তু তার সাথে এটাও বললেন, হয়তো মৃত্যুর কারণ তার কোনো পুরোনো রোগ। কিন্তু ভুলেও একবারও বললেন না পুলিশ বাড়াবাড়ি করে অন্যায় করেছে বা পুলিশ অপরাধী সাব্যস্ত হলে কঠোর শাস্তি পাবে।
হ্যাঁ, লাঠিও হিংস্র ঘাতক হতে পারে। ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল কলকাতায় ৮০টি প্রাণ খাদ্য চাইতে এসে লুটিয়ে পড়েছিল এই লাঠির আঘাতেই। তাদের দাবি অসঙ্গত — এমনটা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও বলতে পারবেন না। রাজ্যে চা-চট-বস্ত্র-ইঞ্জিনিয়ারিং — সব শিল্পই ধুঁকছে। সরকারি ক্ষেত্রেও নিয়োগ প্রায় বন্ধ। এ রাজ্যে শিক্ষকদের বিভিন্ন অংশকে কোনো না কোনো দাবিতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস রোদজল-ঝড়ে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হয়েছে অনশনে, অবরোধে, ধর্ণায়। এখনও কাটাতে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাদের আদিগঙ্গার কোমর সমান পচা জলে পর্যন্ত নামতে হল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
আসলে মেলা খেলা উৎসবে দেদার অর্থ ছড়ানো শাসকের কাছে, নাগরিক-ছাত্র-যুব-মহিলাদের সংবিধানসম্মত ‘দাবি’ ও ‘অধিকার’-এর প্রশ্ন তুললেই তাদের গাত্রদাহ হয়, ভ্রূকুটি কঠিন হয়, চোয়াল শক্ত হয়। হাতের অস্ত্র আক্রমণোদ্যত হয়। সহৃদয় অভিভাবকের খোলশটুকু খসে পড়ে। শাসকেরা ভুলে যান, এই গণতন্ত্রকে ভর করে, সংবিধান ছুঁয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার শপথ নিয়েই তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন! আর সেই ক্ষমতা থেকে চলে যেতেও হয় এই গণতন্ত্রের ঘাড়ধাক্কায়! অতীতের কাছ থেকে এই গণতন্ত্রের পাঠ নিতে কেন এত অনীহা শাসকের!
‘নবান্ন অভিযানের’ শহীদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যা জীবন দিয়ে শাসককে স্মরণ করিয়ে দিলেন — দয়া দাক্ষিণ্যের ভিক্ষা-অনুদান নয়, ছাত্র-যুবরা চায় যোগ্য হাতে যোগ্য কাজ আর সেই দাবি অর্জনের জন্য তারা অনেক দূর যেতে প্রস্তুত! দিল্লী সীমানায় আন্দোলনে থাকা লাখো কৃষকের বজ্রকঠিন সংকল্প তাদের অনুপ্রেরণা!
আর হ্যাঁ, আমরা এক নিঃশ্বাসেই উচ্চারণ করব আনন্দ-নুরুল-মইদুলের নাম! আগেও করেছি, ভবিষ্যতেও করব! ওরা বাংলার বড় আদরের, বড় গর্বের দুলাল। লাখো মানুষের অশ্রু আর ক্রোধে ওরা থাকবে বাংলার আকাশ বাতাস জুড়ে।
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
পশ্চিমবাংলায় অতিমারী পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন বর্গের স্কুল শিক্ষকদের নানা বিক্ষোভ আন্দোলন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এইসব আন্দোলন চলে আসছে বিগত সাত-আট বছর যাবত। বলতে গেলে আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল লকডাউন পূর্ববর্তী সময়ে, লকডাউনকালীন উপায় ছিল না রাস্তায় নামার, আনলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেই বিক্ষুব্ধ শিক্ষককুল নাছোড়, আবার নামতে শুরু করেছেন রাস্তায়। কারণ রাস্তায় নামা ছাড়া ‘রাস্তা’ নেই। জীবন-জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা থেকে তৈরি হওয়া সংকট রাস্তায় নামতে বাধ্য করছে। কারণ রাজ্য সরকার কথা রাখছে না। সমানে চলছে বঞ্চনা, অবহেলা, উপেক্ষা আর উৎপীড়ন। সরকারের আচরণে মানবিকতার লেশমাত্র থাকছে না। সরকার কৌশল নিয়ে চলছে কেবল নানা অজুহাত, অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরস্ত করে রাখার। অপযুক্তিগুলোর প্রতি অবাধ্য হলে দেওয়া হচ্ছে নানা ‘চক্রান্তে’র লেবেল আর পুলিশী দাওয়াই। কথায় চালু আছে, শিক্ষকসমাজ হল প্রজন্ম তৈরির কারিগর ও সমাজ গঠনের অন্যতম মেরুদন্ড। অথচ সেই শিক্ষকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ লাগাতার পীড়িত হচ্ছেন সরকারপক্ষের পীড়নে।
গন্ডগোলের জের চলছে ২০১১ সালে রাজ্যে শাসকের পট পরিবর্তনের সময়কাল থেকেই। শিক্ষক নিয়োগ নীতি প্রণয়নের প্রশ্নে পরিবর্তিত সরকার গোড়াপত্তনেই শুনিয়ে রেখেছিল পূর্বতন বাম আমলের রেখে যাওয়া অস্বচ্ছতা ও জটজটিলতা অজস্র। নতুন সমাধান দেওয়ার পথে এক কঠিন সমস্যা। তাই সমাধানের উপায় নির্ধারণে সময় লাগবে। মমতা সরকার তখন বলেছিল সবকিছু ধাপে ধাপে শুরু করবে। বহুরকম সমস্যা আছে। শিক্ষকদের স্থায়ীকরণ, বেতন কাঠামো নির্ধারণ, শিক্ষক রয়েছেন বিভিন্ন বর্গের। তারপরে নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন ‘টেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুরানোরা, পাশাপাশি লাইনে থাকা আশায় আশায় নতুনরা, সব ধরনের প্রত্যাশীদের দাবির প্রতি সুবিচার করতে হবে ধাপে ধাপে, তার জন্য সময় লাগবে ছ’মাস থেকে তিন বছর। তারপর সময় গড়িয়েছে, কিন্তু সরকার সুড়ঙ্গের শেষে সুরাহার আলো দেখায়নি। বরং সরকারের মনোভাবে, অবস্থান গ্রহণে, আচরণে ক্রমশ অসংবেদী, অস্বচ্ছ, প্রতিশ্রুতি খেলাপী, বেদরদী, স্বজনপোষণ ও দমনকারী ভূমিকা প্রকাশ হতে থাকে। ২০১১ থেকে প্রথম পর্বে সরকারের স্বরূপ তত প্রকট না হলেও ২০১৬-র দ্বিতীয় পর্বে উৎকট আকার ধারণ করে। সরকারের দিক থেকে আলোচনার দরজা যে খোলা হয়নি তা নয়, কখনও কখনও হয়েছে; কিন্তু হয়েছে প্রথমত খুব কমই, দ্বিতীয়ত চালাকির আশ্রয় নিয়ে, তৃতীয়ত সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে দেওয়ার তথ্য-পরিসংখ্যান সহযোগে। তাছাড়া যত না উৎসাহ দেখানো, তার চেয়ে অনেক বেশি নিরাশ বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। শিক্ষকরা বারেবারে নিজেদের তাগিদে লাগাতার সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করে, সরকারের নীতি-পলিসির ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আইন-আদালতের দ্বারস্থ হয়ে, সমস্তরকমভাবে দাবির সপক্ষে জনমত অর্জন করেছেন। একমাত্র রাজ্যের শাসকদল এই ফয়সালা না করা সমস্যা সমূহকে ‘ভূতের বোঝা’ বলে বোঝাতে চায়। বিগত দশ বছরে প্রতিবিধান না পাওয়ার পরিণামে আত্মহত্যা সহ অনাহার-অর্ধাহারে-অপুষ্টিতে-রোগভোগে-বিনা চিকিৎসায় সবরকম মিলে শতাধিক সাথীর মর্মান্তিক অকালপ্রয়াণ ঘটেছে। আন্দোলন চালিয়ে আসছেন পার্শ্বশিক্ষক, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক, শিক্ষা সহায়ক, শিক্ষামিত্ররা, সোচ্চার অনুমোদন বিহীন মাদ্রাসা শিক্ষকরা। রয়েছেন আরও অনেক অংশ। কোনও অংশকেই সরকার সন্তোষজনক সমাধান দিতে পারছে না।
বহু টালবাহানার পর মুখ্যমন্ত্রী সদ্য জানালেন, পার্শ্ব ও চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক এবং শিক্ষা সহায়ক ও শিক্ষাবন্ধু — এই চার বিশেষ অংশ ফি-বছর তিন শতাংশ হারে বেতনবৃদ্ধির সুবিধা ও অবসরকালে তিন লক্ষ টাকা পাবেন। কিন্তু তাছাড়া অন্যান্য দাবির বিষয়ে অর্থাৎ স্থায়ীকরণ ও স্থায়ী বেতন কাঠামো, সম কাজে সম বেতন সহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার প্রশ্নে সরকার এখনও মুখ খুলছে না। অন্যদিকে, নতুন নিয়োগের দাবিও অতি বাস্তব ও যুক্তিসম্মত। অভাবের নমুনাগুলো নজর করলেই চোখ কপালে ওঠে। স্কুলগুলিতে শিক্ষক ঘাটতি থাকছে যথেষ্ট সংখ্যায়। সাধারণ স্কুলগুলিতে তবু পূর্ণ সময়ের শিক্ষকসংখ্যার ভারসাম্য সামলে নেওয়ার মতো। কিন্তু জনজাতি ভাষা মাধ্যমের স্কুলগুলিতে পূর্ণ সময়ের শিক্ষকের আকাল। পাশাপাশি লক্ষ্যণীয়, ২০১৪ সালে প্রাথমিকে টেট পরীক্ষা দেওয়া উত্তীর্ণদের প্রথম মেধা তালিকা প্রকাশ হল ২০২১-এ। ২০১৭-তে বিজ্ঞপ্তি জারি করা টেট পরীক্ষা নেওয়াও হল একমাস হয়নি। দীর্ঘসূত্রিতা চলছে কি মাত্রায়! এসব নিয়ে এখনও হয়ত তেমন প্রশ্ন ওঠেনি, তবে উঠবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। চলত হয়ত আরও অনাচার। কিন্তু নিকটে নির্বাচন পরিস্থিতি। শিক্ষক আন্দোলনও হচ্ছে বেগবান, ধেয়ে যাচ্ছে ‘বিকাশভবন’, ‘নবান্ন’ বা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে। আন্দোলন সরকারকে বাধ্য করছে কিছু পদক্ষেপ করতে। এই অভিজ্ঞতা শেখাচ্ছে আরও জোরদার ও ব্যাপক করে তুলতে হবে আন্দোলন। শিক্ষকদের আন্দোলনের অধিকার ও দাবি খুবই ন্যায়সঙ্গত।
সুযোগ বুঝে নির্বাচনী দাঁও মারতে শিক্ষক আন্দোলনের প্রতি ‘সমর্থনের’ ভন্ডামী দেখাতে শুরু করেছে বিজেপি। যে দল কেন্দ্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করছে শিক্ষা সংকোচন, শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়া, শিক্ষার গৈরিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণে; এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিল ৬.১৩ শতাংশ, যারা দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের প্রতি নিয়েছে ঔপনিবেশিক শাসকের অনুরূপ বৈর অবস্থান, তারা আবার এরাজ্যে সাজতে চাইছে ‘শিক্ষক দরদী’! এহেন ধূর্তামী থেকে রাজ্যের শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষক আন্দোলনকে থাকতে হবে সম্পূর্ণ সংস্রব মুক্ত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যসভার ভাষণটি ফ্যাসিবাদী প্রচারাভিযানের এক উৎকৃষ্ট ব্যাকরণসম্মত নিদর্শন। উপলক্ষ্যটি ছিল বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির উদ্বোধনী বক্তৃতায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন নিয়ে বিতর্কে প্রধানমন্ত্রীর জবাবী ভাষণ প্রদান। রাষ্ট্রপতির প্রথাগত উদ্বোধনী ভাষণটি অবশ্য আগাগোড়াই ছিল সরকারের সমস্ত স্বঘোষিত সাফল্যের জন্য অভিনন্দন আর প্রশস্তিতে ভরা। প্রধানমন্ত্রীর জবাবি ভাষণটি সাধারণভাবে বিতর্ক চলাকালীন সাংসদদের তোলা প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু মোদীর ভাষণে সাংসদদের তোলা বিতর্কের সমস্ত প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে সরকারের স্বঘোষিত সাফল্যের দাবিগুলোরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং সমস্ত বিরোধী বক্তব্যকে আবর্জনাস্তূপে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। দেশ যখন ২০৪৭-এ স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করবে তখন নাকি সারা দেশের সঙ্গে তাঁর বিরোধীরাও তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলোর জন্যে ধন্য ধন্য করবে! একমাত্র মোদীই জানেন,ভারতের জন্য মহত্তম কী! যিনি নিজেকে দেশের এক বিচক্ষণ সহৃদয় পিতৃপুরুষ হিসাবে বিজ্ঞাপিত করতে ভালোবাসেন, সেই স্বৈরশাসকের এক নির্লজ্জ আত্মপ্রশস্তি!
মোদী তাঁর বক্তৃতায় অনেকটা সময় খরচ করেছেন তাঁর তিনটি সর্বনাশা কৃষি আইন ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য কতটা উপকারী তার সাফাই গাইতে। এ নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই যে গড় কৃষিজোত ক্রমশ কমছে আর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা ও অনুপাত ক্রমশ বাড়ছ। কথাটা হল, পরের পর সরকারগুলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের সাহায্যের জন্য প্রগতিশীল ভূমিসংস্কার ও সমবায়-চাষের প্রসঙ্গটাকে এড়িয়েই গেছে। কৃষি এবং গোটা অর্থনীতির উপর ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ — এটাই হল তিনটি কৃষি আইনের মর্মবস্তু। এগুলো এই ছোট চাষিদের — কৃষিতে তাদের আয় বাড়িয়ে বা কৃষি-নির্ভর জনসাধারণের একটা অংশকে ম্যানুফ্যাকচারিং বা পরিষেবা ক্ষেত্রে নিয়োগের মাধ্যমে কৃষির উপর চাপ কমিয়ে — কোনোভাবেই উপকার করবে না। কৃষিতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ শুধু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের দারিদ্র্য আরও বাড়িয়ে তুলবে।
প্রধানমন্ত্রী যখন তার ভাষণে ছোট চাষিদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করেছেন, তার সরকার কিন্তু তখন কৃষি এবং তার সম্পর্কিত অন্যান্য খাতে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি বিপুল ঢক্কানিনাদিত ‘প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি’ (পি এম-কিষাণ), যার মাধ্যমে, নিজের নামে পর্চা আছে এমন ক্ষুদ্র জোতের মালিক কৃষকদের বছরে তিনটি কিস্তিতে ৬০০০ টাকা দেওয়া হয়, সেই খাতেও এ বছরের বাজেটে ১০,০০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভূমিহীন চাষি, ক্ষুদ্র কৃষক যারা পারিবারিক জমি চাষ করে বা ভাগ-চাষি যারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করে, তারা সকলেই ‘কিষাণ সম্মান’-এর নামে এই অতি নগণ্য ‘ভিক্ষার দান’ থেকেও বঞ্চিত!
প্রধানমন্ত্রী ঋণ মকুবের বিষয়টিকে উপহাস করে বলেছেন, ‘নির্বাচনী ইস্যু’, ‘কৃষকের অ্যাজেণ্ডা’ নয়! তিনি আরও বিলাপ করেছেন, ক্ষুদ্র চাষিরা ব্যাঙ্ক-ঋণ পাননি। ক্ষুদ্র চাষীরা ব্যাঙ্ক-ঋণ না পেয়ে থাকলে, তাদের জন্য সরকারের বহুল বিজ্ঞাপিত ‘উদ্বেগের’ আসল চেহারাটাই উন্মোচিত হয়েছে!
ভারতে, ঋণগ্রস্ততা এবং তার অনুষঙ্গে ঋণ পরিশোধের প্রশ্নে জুলুমই হচ্ছে হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ। এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি থেকেই ঋণ মকুবের দাবি উঠে এসেছে। কোন নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসকই পারে এই জীবন-বাঁচানোর দাবিকে ‘নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা’ বলে উপহাস করতে! আর ঋণ মকুবের প্রশ্ন যদি ‘নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা’ হয়, তাহলে ‘পি এম-কিষাণ’ তো তার চেয়েও বেশি মাত্রায় তাই! নির্বাচন মুখী পশ্চিমবঙ্গে, মোদী নগ্নভাবেই এই রাজ্যে বিজেপি’র ক্ষমতায় আসার সঙ্গে এটিকে যুক্ত করেছেন, ঠিক যেমনভাবে তার দল, বিহার নির্বাচনে জিতে এলে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কষক-আন্দোলন কখনও মাসিক সামান্য ৫০০ টাকার একটা নামকাওয়াস্তে/ প্রতীকী সাহায্য দাবি করেনি: তার মূল দাবি ছিল স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ন্যায্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ ও তার গ্যারান্টি।
‘এমএসপি থা, হ্যায় আউর রহেগা’ (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ছিল, আছে এবং থাকবে) — প্রধানমন্ত্রীর এই শূন্যগর্ভ আশ্বাসটি শোনাচ্ছে ঠিক সেই ভারত-চীন এলএসি সংঘর্ষের পর তার সাফাই গাওয়া বিবৃতির মতো — ‘না কোই ঘুসা থা, না ঘুসা হুয়া হ্যায় (আমাদের ভূখণ্ডে কোন অনুপ্রবেশ ঘটেনি)’। কৃষকরা যা দাবি করেছেন তা হল, তারা যাতে তাদের উৎপন্ন ফসল ন্যায্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করতে পারেন তার আইনি প্রতিশ্রুতি। সরকার জানে যে বেশির ভাগ রাজ্যেই কৃষকরা, বিশেষ করে ছোট চাষিরা, যাদের নাম করে মোদী তার সর্বনাশা কৃষি আইনগুলো চালাতে চাইছেন, তারা অভাবী বিক্রয়ে বাধ্য হন। বহুক্ষেত্রেই চালু বাজার দাম সরকার ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে অনেক কম, আর ছোট ও বঞ্চিত কৃষক, যারা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্ট মার্কেট কমিটি) কাঠামোর অনুমিত ‘উপকারভোগী’, তাদের এর বিরোধিতায় দাঁড় করিয়ে, সরকার আসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও এপিএমসি কাঠামোটাকেই ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় করে তোলার চেষ্টা করছে। আর এটাই হচ্ছে আরেকটি ক্ষেত্র যেখান থেকে সরকার নিজের দায়িত্ব প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং কর্পোরেট মুনাফা ও শক্তির যূপকাষ্ঠে জনসাধারণের স্বার্থকে বলি দিচ্ছে।
সমস্ত মতবিরোধকে কুমতলবপ্রসূত, সমস্ত প্রতিবাদীদের ‘পরজীবী’ এবং ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বলে দেগে দেওয়া, ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য সমস্ত সংগ্রামকে ‘বিদেশি ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ’ চালিত ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামগুলির বিরুদ্ধে ‘ডাইনি-খোঁজ’কে প্ররোচনা দেওয়া — এটা অবশ্যই রাজ্যসভায় মোদীর জবাবী ভাষণের সবচেয়ে শয়তানিপূর্ণ বিষয়। এটাই একটা বাক্যবাগীশ সরকারের বাক্যবিন্যাস, যে সরকার তার আইন দিয়ে কৃষকদের প্রতারণা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যাদের কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে একযোগে ফন্দি এঁটে আসরে নেমে প্রচারাভিযান ও মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, আর যাদের কৃষকদের এবং কৃষক আন্দোলন ঘিরে গণতান্ত্রিক সংহতির প্রতি ভয় একেবারে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে গেছে বিশ্বের চোখে। একটা সরকার যাকে, কংক্রিটের অবরোধ আর কাঁটাতারের বেষ্টনি খাড়া করে, রাস্তা খুঁড়ে অথবা সেখানে গজাল পুঁতে, ইন্টারনেট পরিষেবা বিদ্যুৎ আর জল বন্ধ করে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না গায়িকা ও সমাজকর্মীর শুধু কয়েকটি টুইটের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য মন্ত্রী, চিত্রতারকা, ক্রিকেটার এবং অন্যান্য বিশিষ্টজনের বিরাট বাহিনীকে নামিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষার ঢাল খুঁজতে হয়, সেই সরকারটা আসলে প্রবল ভয়ের মধ্যে আছে। সে তার ভয় এবং সংকটকে কৃষক ও বৃহত্তর জনসাধারণের উপর পাচার করতে চাইছে। আমাদের, ভারতের জনগণকে অবশ্যই এই বাকসর্বস্ব সরকারকে বলতে হবে — তোমার গোপন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে!
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১)
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে কার্তিক পাল এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, ১১ ফেব্রুয়ারী কয়েকটি বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনের ডাকে যে ‘নবান্ন অভিযান’ ছিল সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জ ও দমনকে আমাদের পার্টি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। বর্তমান সময়ে মোদী সরকার যেভাবে কৃষক আন্দোলন সহ বিভিন্ন আন্দোলনে হীন কায়দায় দমন নামানোর বাতাবরণ তৈরি করেছে সেই পরিস্থিতিতে বিরোধী দল শাসিত একটি রাজ্যে এই পুলিশি দমন বিশেষভাবে অনভিপ্রেত। আহত ছাত্রযুবদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত সরকারকে করতে হবে।
এছাড়া বিবৃতিতে আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা সহ ১২ ফেব্রুয়ারী আহুত ১২ ঘন্টার হরতালকে নৈতিক সমর্থন জানানো হয়।
কাজের দাবিতে পথে নামা এসএফআই-ডিওয়াইএফ ছাত্র-যুবদের উপর ন্যক্কারজনক পুলিশি বর্বরতা ঘটিয়ে বিজেপিকে মোকাবিলার কোন মডেল তৈরি হবে? রাজ্যের তৃণমূল সরকারের কাছে সরাসরি এই প্রশ্ন তুলে সোচ্চার হয় ছাত্র-যুব সংগঠন এআইএসএ-আরওয়াইএ। ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযানে পুলিশের নিন্দনীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে ঘটনার দিনেই তীব্র প্রতিবাদ জানায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, আইসা-আরওয়াইএ। ইতিমধ্যে হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে পুলিশী নিপীড়নে গুরুতর জখম বাম যুব কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার। এই ঘটনায় তীব্র ধিক্কার জানিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারী গোটা রাজ্য জুড়েই প্রতিবাদ দিবসের ডাক দিয়েছিল আইসা-আরওয়াইএ। তারা অবিলম্বে এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত করে দোষী পুলিশকর্তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করেছে।
সকলের জন্য শিক্ষা ও কাজের দাবিতে দশটি ছাত্র যুব সংগঠনের নবান্ন অভিযানে পুলিশের নৃশংস লাঠিচার্জে ডিওয়াইএফ কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার রাষ্ট্রীয় হত্যার প্রতিবাদে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে এক বিক্ষোভ মিছিল সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের শিলিগুড়ি অফিস থেকে শুরু হয়ে হিলকার্ট রোড ঘুরে হাশমিচকে এসে শেষ হয়, সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন অন্যতম রাজ্য নেতা বাসুদেব বোস। মিছিলে নেতৃত্ব দেন দলের জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য কমিটির, পবিত্র সিংহ প্রমুখ। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত হয় ব্যাণ্ডেল, বেলঘরিয়া, বারাসাত ইত্যাদি অনেক আরোও অনেক জায়গায়।
সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার অন্তর্ভুক্ত ২১টি কৃষক সংগঠনের পক্ষে অমল হালদার (আহ্বায়ক), কার্তিক পাল (সম্পাদক) এক প্রেস বিবৃতিতে জানান ১৮ ফেব্রুয়ারী সারা দেশের সাথে সাথে বাংলায় পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, মালদা, দার্জিলিং, বীরভূম, মেদিনীপুর সহ প্রভৃতি জেলায় বিভিন্ন স্টেশনে রেল অবরোধে কৃষক জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ হয়। বাঁকুড়া শহর, বোলপুর, বারাসাত, মালদার একলক্ষী স্টেশন, যাদবপুরের মতো শহরেও অবরোধ হয়। আজকের এই কর্মসূচীতে জনগণের মধ্যে উৎসাহ সহকারে অংশ গ্রহণ দেখা যায়। এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছাত্রযুব সংগঠনগুলিও শামিল হয়। কাজের দাবিতে বিক্ষোভ সংগঠিত করার সময় শহীদ হন বাম যুব সংগঠনের কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্দা। সংগঠনের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। আদানি-আম্বানির স্বার্থবাহী “কর্পোরেটজীবি’ মোদি সরকারকে অবিলম্বে তিন কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। যতদিন না তা হচ্ছে কৃষকদের আন্দোলন জারি থাকবে।
এআইসিসিটিইউ-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ১৫ ফেব্রুয়ারী এক আহ্বান পত্রে বলে, “যতই রাজ্যে নির্বাচন এগিয়ে আসছে,ততই বাড়ছে দলবদল, নোংরা রাজনৈতিক প্রচার। রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের হাজারো সমস্যা, জীবন্ত দাবি নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। যে বিজেপি এ রাজ্যে শিল্প স্থাপনের নানা গালগল্প শোনাচ্ছে, সেই মোদি সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোকে বেচে দিচ্ছে আদানি-আম্বানিদের হাতে। এদের হাত ধরে আবার ফিরে আসছে কোম্পানিরাজ। আর “দুয়ারে সরকারের” কান ফাটানো বিজ্ঞাপন এখনো লকডাউন পর্যায়ে সব খোয়ানো নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ করতে পারলো না এক কানাকড়িও। শ্রমিক শ্রেণীকেই বুঝে নিতে হবে তার আপন অধিকার। নির্বাচনী হট্টগোলের মধ্যে যখন শ্রেণীর দাবিগুলোকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে,তখন জোরালো কন্ঠে উচ্চারণ করতে হবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দাবিগুলোকে, যা রাষ্ট্রের কানে ঢুকেও ঢোকে না। তাই এই দাবিগুলো নিয়ে আসুন, আমরা সোচ্চার হই —
১) রেল, বীমা, ব্যাংক, প্রতিরক্ষা, বিএসএনএল, তেল ও কয়লা খনি সহ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারীকরণ চলবে না।
২) লকডাউন পর্যায়ে চা-চটকল সহ অন্য ক্ষেত্রে মজুরি/বেতন দিতে মালিকপক্ষকে বাধ্য করাতে রাজ্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩) এসএসওয়াই প্রকল্প চালু রাখতে হবে। নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল থেকে নথিভুক্ত সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের ন্যূনতম ৫০০০ টাকা দিতে হবে। নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ বোর্ডকে কার্যকরী করতে হবে।
৪) রাজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে সমস্ত ক্যাজুয়াল, ফ্র্যাঞ্চাইজি, কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ করতে হবে ও সমকাজে সমবেতন দিতে হবে।
৫) “ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্টে” এ রাজ্যে কোনো শ্রমিককে নিয়োগ করানো চলবে না। কেন্দ্রীয় শ্রম কোডে রাজ্যে কার্যকর না করতে রাজ্য সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
৬) স্কীম কর্মীদের ভাতা নয়, মজুরি ও সরকারী কর্মীর স্বীকৃতি ও উৎসব ভাতা দিতে হবে।
৭) লকডাউন পর্বে ছাঁটাই হওয়া সমস্ত শ্রমিকদের পুনর্বহাল করতে হবে।
৮) চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি লাগু করতে হবে।
৯) সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা রাজ্য সরকারকে নির্দিষ্ট এক সময়সীমার মধ্যে করতে হবে।
এই সমস্ত দাবি নিয়ে আসুন, আমরা রাজ্য জুড়ে এক প্রচার অভিযান সংগঠিত করি, জেলায় জেলায় ও রাজ্য স্তরে পেশ করি শ্রমিকশ্রেণীর এই সমস্ত জীবন্ত দাবিসমূহ।”
১২ ফেব্রুয়ারী শিলিগুড়ি সংলগ্ন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি অঞ্চলের মেহনতী মানুষের দাবিসনদ নিয়ে রাজগঞ্জ ব্লকের বিডিও অফিসে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ফাটাপুকুর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বিডিও দপ্তরে আসে। বিডিও দপ্তরের সামনে বিক্ষোভসভায় বক্তব্য রাখেন দার্জিলিং জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, বাসুদেব বসু। এছাড়া বক্তব্য রাখেন ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন জেলা সদস্যা মীরা চতুর্বেদী। মিছিল ও সভায় নেতৃত্ব দেন জেলা কমিটির সদস্য ও ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক অপু চতুর্বেদী, ময়না সূত্রধর, দীনবন্ধু দাস প্রমুখ। বিক্ষোভসভা থেকে ৬ জনের প্রতিনিধি দল আধিকারীকের সাথে সাক্ষাত করে স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপির দাবি সনদঃ
১) সাহু নদীতে বাঁধের বন্দোবস্ত করতে হবে। কারণ বর্ষাকালে নদীর জলে ১০-১২টি গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
২) সাহু নদীর রেঞ্জার অফিসের নিকট থেকে অনুমোদিত ব্রীজ দ্রুত নির্মাণ করতে হবে।
৩) তপশিলি জাতির সার্টিফিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজলভ্য করতে হবে।
৪) অবিলম্বে জমা দেওয়া ৩৯ জনকে জমির পাট্টা প্রদান করতে হবে।
ইতিমধ্যেই এই দাবি নিয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে জলপাইগুড়ি জেলা শাসকের দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছিল। বিডিও দপ্তরে দাবি সনদের সমাধানের জন্য আলোচনা ফলপ্রসু হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারী দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ি ব্লকে কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মীসভায় ১৮-২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১ তরাই অঞ্চলে শ্রমজীবী অধিকার অভিযানকে সফল করে তোলা, ফাঁসিদেওয়া বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন দার্জিলিং জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, বাসুদেব বসু, পবিত্র সিংহ, কান্দ্রা মুর্মু, লাল সিং প্রমুখ। বৈঠকে ফাঁসিদেওয়া বিধান সভা কেন্দ্রের প্রার্থী সুমন্তি এক্কা উপস্থিত ছিলেন।
গত বছর করোনা, লকডাউনের জন্য শিবদাসপুর ইটভাটায় মজুরি চুক্তি হতে পারেনি। এই বছর অনেক টালবাহানা ও ভাটায় শ্রমিক ধর্মঘটের পর ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ মালিক পক্ষ ও ইউনিয়নের সাথে দ্বিপাক্ষিক মজুরি চুক্তি হয়।
চুক্তির বিবরণ
শিবদাসপুর ইটভাটা মজদুর ইউনিয়ন ও শিবদাসপুর ব্রীক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ তারিখে দু’বছরের জন্য দ্বিপাক্ষিক মজুরি চুক্তি সম্পন্ন হল। এই চুক্তিতে দু’বছরে ১৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রথম বছর ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। যেমন ২০১৯-২০২০ অর্থবর্ষে বোঝাই-মিস্তিরি পেত মাসে ১২,৩৪০ টাকা। বৃদ্ধি হয়েছে ১,২৩৪ টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষে মজুরি হবে মোট ১৩,৫৭৪ টাকা।
দ্বিতীয় বছর ২০২১-২০২২ অর্থবর্ষে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি হবে। যেমন চুক্তির পর ২০২০-২০২১ বোঝাই-মিস্তিরি পাবে ১৩,৫৭৪ টাকা, বৃদ্ধি হবে ৮১৪.৪৪ টাকা। ২০২১-২০২২ মজুরি হবে ১৪,৩৮৮.৪৪ টাকা।
অন্য সব বিভাগেও শতকরা এই হারে মজুরি বৃদ্ধি হবে।
ইউনিয়ন ও মালিক পক্ষ উভয়ই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ঠিক হয়েছে দোলের অনুদান, জ্বালানি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
- শিবদাসপুর ইটভাটা মজদুর ইউনিয়ন (এআইসিসিটিইউ)
গত ১৫ ফেব্রুয়ারী বর্ধমান শহরের লায়ন্স ক্লাব হলে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এর পুর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির উদ্যোগে গণকনভেনশন সংগঠিত হয়। এই কনভেনশনের বিষয় ছিল “একুশের ডাক — ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক “গনতন্ত্র রক্ষা ও জীবন জীবিকার নিরাপত্তার সংগ্রামকে শক্তিশালী করা সম্পর্কে। এই কনভেনশনের প্রধান বক্তা ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। কনভেনশনের শুরুতেই গত ১১ ফেব্রুয়ারী চাকরির দাবিতে নবান্ন অভিযানে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত ডিওয়াইএফআই কর্মী কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হল। এবং ধিক্কার জানানো হল। তাছাড়া দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রয়াত কৃষক শহীদদের ও সাম্প্রতিক প্রয়াত সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নদীয়া জেলা সম্পাদক কমরেড সুবিমল সেনগুপ্ত সহ সমস্ত শহীদের স্মরণ করা হয়। কনভেনশনে জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে সাড়ে তিন শত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ঋণগ্রস্ত মহিলাদের ভালোসংখ্যক উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী মহিলারাও। শহরের কিছু বুদ্ধিজীবি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। কনভেনশনে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণশিল্পী পরিষদের বাবুনী মজুমদার। সঞ্চালক ছিলেন এআইকেএম-এর রাজ্য সভাপতি অন্নদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। প্রথমে বক্তব্য রাখেন এআইএসএ-র রাজ্য সভাপতি নিলাশিষ বসু তারপর বর্ধমান মিউনিসিপাল হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক অরুণাভ চক্রবর্তী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানস ঘোষ, নো ভোট ফর বিজেপি মঞ্চের মোজাম্মেল হক ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিট বুরোর সদস্য কার্তিক পাল বক্তব্য রাখেন।
সর্বশেষ বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি খাদ্য আন্দোলনের শহীদ নুরুল ইসলাম সাথে আজকের চাকরির দাবিতে আন্দোলনে শহীদ মইদুল ইসলাম মিদ্যার হত্যার প্রতিবাদে নামার আহ্বান জানান। ঋণগ্রস্ত মহিলাদের তথা গ্রামীণ গরিব মানুষের ঋণ মকুব করার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপর জোর দেন। দেশ জুড়ে কৃষক আন্দোলনের উপর দমন-পীড়ন ও আন্দোলনকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আন্দোলনজীবী ও পরজীবী বলে কটুক্তি ও কটাক্ষ করার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার উপর জোর দেন। বিজেপির ফ্যাসিস্ট হামলার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতায় আসার চেষ্টা রুখে দেওয়ার আহ্বান রাখেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ১২টি আসন এবং পুর্ব বর্ধমান জেলায় দুটি আসন মন্তেশ্বর ও জামালপুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বাকি কিছু আসনে বামপন্থীদের সমর্থন করবেন এবং বিজেপিকে হারানোর জন্য ভোট দিতে। বিজেপিকে রোখার জন্য সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এত কম কেন্দ্রে প্রার্থী দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। এই নির্বাচনে বিজেপির অগ্রগতি আটকানো সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রধান লক্ষ্য এবং বামপন্থীদের অগ্রগতির চেষ্টা করা। বামপন্থী আন্দোলনের ঐতিহ্যসম্পন্ন বর্ধমান জেলার মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন এই নির্বাচনে বামপন্থীদের দ্বিতীয় শক্তিতে পরিণত করুন।
১৩ ফেব্রুয়ারী সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে হুগলীর উত্তরপাড়ায় গণভবনে অনুষ্ঠিত হল ‘একুশের ডাক — ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক’ শিরোনামে এক গণকনভেনশন। এই কনভেনশনের প্রধান বক্তা ছিলেন পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি নিলাশিস বসু। সভাপতিমণ্ডলীতে ছিলেন সংগঠনের বর্ষীয়ান সদস্য স্বপন মজুমদার ও ছাত্র নেতা অঙ্কিত মজুমদার। সূচনায় প্রতিরোধের গান পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের নীতীশ রায় ও অসীম সরকার, তবলা সঙ্গতে ছিলেন প্রদীপ সরকার। কবিতা পাঠ করেন কবি সুজন ভট্টাচার্য। সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন পার্টির হুগলী জেলা কমিটির সদস্য তথা ছাত্র সংগঠক সৌরভ রায়। এই কর্মসূচীতে লিবারেশনের কর্মী, সমর্থকরা ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন ধারার গণ আন্দোলনের কর্মী, সংগঠক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক প্রমুখ ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য উত্তরপাড়া বিধানসভা আসন সেই ১২টি কেন্দ্রের অন্যতম যেগুলিতে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে কিছুদিন আগেই সংগঠনের তরফে সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়েছে।
চিকিৎসকের পরামর্শ মানতে হচ্ছে বলে আজকের নাগরিক কনভেনশনে আমার আসা হল না। সেজন্য আপনাদের মার্জনা চাইছি।
পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পরিস্থাতিতে আজকের দাবিসনদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবিষয়ে সভায় উপস্থিত বক্তারা বিশদভাবে বলবেন। আমি শুধু একটি বিষয় তুলে ধরতে চাই।
নির্বাচনী রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজেপি দল আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মতো নয়। মতাদর্স অত্যন্ত দৃঢ়, সুচিন্তিত এবং ভয়ানক রকমের বিপজ্জনক। একথা ভুললে চলবে না।
২০১৯-এ দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জেতার পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের কাজকর্মে দুটি প্রধান নীতি প্রতিফলিত হচ্ছে। এক, হিন্দুত্ব আর দুই, বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির মুনাফার রাস্তা প্রশস্ত করা। এই দুই নীতির যোগফল হিসেবে আমরা এক এক করে দেখলাম সংবিদানের ৩৭০ ধারা লোপ, জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নামিয়ে আনা, অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, কোভিড মহামারী মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের হরেক রকম তুঘলকি নির্দেশ, শ্রম আইন সংশোধন, কৃষিপণ্য আইন সংশোধন।
বিজেপি তথা আরএসএস-এর মতাদর্শের কেন্দ্রবিন্দু হল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা। এই হিন্দুরাষ্ট্রে হিন্দুরাই হবে প্রকৃত নাগরিক। অন্যদের হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে। যারা তাতে রাজি হবে না, হিন্দুিদের দয়ায় তাদের এদেশে থাকতে হবে। আরএসএস-এর গোলওযালকর বলতেন, হিন্দু পরাক্রমবাদ, অর্থাৎ বারতে হিন্দুজাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। ইদানীং ‘পরাক্রম’ শব্দটা বিজেপি নেতাদের মুখে মাঝেমাঝেই শোনা যাচ্ছে। নাগরিকত্বের এই দারণা আমরা স্পষ্ট রূপায়িত হতে দেখলাম নাগরিকত্ব আইন সংশোধনে।
ভারতের সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থাৎ ফেডেরাল কাঠামো আরএসএস কখনো মানেনি। তাদের মতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেয়। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এই মতবাদের ছাপ আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজেপি সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার নানা চেষ্টায়। সংবিদান যেসব বিষয়ে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়কেই আইন তৈরি করার ক্ষমতা দিয়েছে, সেখানে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা না করেই কেন্দ্র আইন পাশ করে চলেছে। এমনকি কৃষির মতো বিষয় যা কেবল রাজ্যের ক্ষমতার মধ্যে পড়ে, তাতেও কেন্দ্র আইন তৈরি করে সারা দেশের উপর চাপিয়ে দিল। ভারতে যে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা আছে, সে কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রতিটি নির্বাচনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো ‘মোদি বনাম কে?’ নাটকে পর্যবসিত করা হচ্ছে। এমনকি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনেও যেন দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের একমাত্র প্রার্থী। বেশ কয়বার তিনি বলেছেন, লোকসভা আর রাজ্য বিদানসভার নির্বাচন একসাথে হওয়া উচিত। এমন কথাও শুনছি যে, কেন্দ্রে আর রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে বাংলার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। একথা সত্যি হলে তো ফেডেরাল ব্যবস্থাটাই তুলে দিতে হয়। তবে আগেই বলেছি, বিজেপি আরএসএস ফেডেরাল ব্যবস্থার প্রয়োজন স্বীকার করে না।
কর্পোরেট পুঁজির সুবিধা করে দেওয়া ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলেছে। বৃহৎ পুঁজির উৎপাদন ক্ষেত্র, বাজার, সারা দেশ জুড়ে ছেয়ে আছে। তারা চায় কেন্দ্রীয় সরকার সর্বত্র তাদের গতিবিধি আরও সহজ করে দিক। কিন্তু বৃহৎ পুঁজি যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাজ্যে রাজ্যে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে অসাম্য তত বাড়ছে। শুধু উপার্জনের দিক দিয়েই নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবনধারণের মান, সব দিক দিয়েই ভারতে অসাম্যের ছবিটা ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। একদিকে মহামারীর কোপে সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগার চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত, অথচ অন্যদিকে শেয়ার বাজারে দৈনিক রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে বলতে চাই, বিজেপির উত্থানে সাংঘাতিক বিপদের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। অনেকে বলেছেন, ত্রিপুরায় দেখুন কী হয়েছে, বিজেপি এলে বাংলাতেও তাই হবে। আমার মনে হয়, ত্রিপুরা নয়, চোখ ফেরানো উচিত উত্তরপ্রদেশের দিকে। হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণায় বাংলা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। বাংলার সংস্কৃতি বেশ কিছুকাল বামপন্থী মতাদর্শে প্রভাবিত হয়েছে। অনেকদিন হল, এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় আছে। বিজেপি এখন পুরোনো দেশভাগের স্মৃতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি উসকে দিতে চাইছে। তারা বলে, বাংলায় দেশভাগের অসম্পূর্ণ কাজ তারা সম্পূর্ণ করবে। অথচ বাংলায় তাদের সংগঠন নেই, সর্বগ্রাহ্য কোনো নেতা নেই। তাই ভিন রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে অবধারিতভাবে এখানে এসে পড়েছে উত্তর ভারতের হিন্দু উচ্চজাতির সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্মাচার, স্লোগান, যার সঙ্গে বাংলার মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। এও এক পরাক্রমবাদ। বাংলায় ক্ষমতা পেলে নিশ্চিতভাবে এখানে আসবে, গোরক্ষা অভিযান, ‘লাভ জেহাদ’ ঠেকানোর ছুতোয় মানুষের স্বাধীন মেলামেশায় হস্তক্ষেপ এবং নিরীহ স্ত্রী-পুরুষের ওপর অত্যাচার, সরকার সম্বন্ধে যে কোনো সমালোচনার জন্য দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার, বিরোধী মিটিং-মিছিলে যোগ দিলে শুধু চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, সরকারী চাকরিতে আবেদন করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া। এসবই সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে ঘটে চলেছে।
আমি তাই বলব, আগামী নির্বাচনে আমাদের কর্তর্ব্য বিজেপি প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত করা। এর জন্য কোনো সাধারণ পন্থা নেই। কারণ বিভন্ন দলের পারস্পরিক শক্তি এক এক নির্বাচনে এক এক রকম। দশ বছর সরকার চালানোর পরে তৃণমূল কংগ্রেস সম্বন্ধে অনেকের মনে ক্ষোভ তৈরি হওযা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আবার বলি, বিল্প হিসেবে বিজেপি কিন্তু অন্য যে কোনো দলের মতো নয়। তাদের স্থির উদ্দেশ্য, ভারতের শাসন ব্যবস্থার খোলনলচে বদল করা। সে যাত্রাপথে বাংলা তাদের কাছে একটি প্রধান সোপান। সুতরাং আমি বলব, নিজের কেন্দ্রে দলগুলির পারস্পরিক শক্তি বিচার করে বিজেপি প্রার্থীর পরাজয় যাতে নিশ্চিত করা যায়, সেইভাবেই ভোট দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
আজকের সভার আলোচনায় অংশ নিতে পারলাম না বলে আবার আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেচে দিচ্ছে সরকার। সাম্প্রতিক বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বেসরকারীকরণের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা উন্মুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের সামান্য, যতটুকু না হলেই নয়, উপস্থিতি থাকবে। এই চারটি ক্ষেত্র হল -- নিরাপত্তা ও আণবিক শক্তি; যানবাহন ও টেলিকম; বিভিন্ন জ্বালানি যেমন তেল, কয়লা, ইত্যাদি; বিমা, ব্যাঙ্কিং এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিষেবা। এর বাইরে সমস্ত সরকারি সংস্থা বেসরকারী করে দেওয়া হবে, আর যদি সেগুলির কোনো ক্রেতা না পাওয়া যায় তো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর অর্থ ২৬৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, লাখো কর্মচারির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আরও অনেক কিছু তারা ধনকুবেরদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে -- যে সব রাস্তা, হাইওয়েতে টোল তোলা হয়, মালবাহী রেলের করিডর, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন, বিমানবন্দর, আড়ত বা গুদাম, স্টেডিয়াম, সরকারী জমি -- সব!
আমরা এই লেখাটিকে ব্যাংক বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব। অর্থমন্ত্রী বলেছেন দু’টি সরকারী ব্যাংক বেসরকারী করা হবে। কোন দু’টি? বাজারে এই নিয়ে নানা উড়ো খবর। কেউ বলছেন যে ব্যাংকগুলির সংযুক্তিকরণ (মার্জার) হয়নি সেগুলিকেই ঝাড়পোঁচ করে বেচে দেওয়া হবে। কেউ বলছেন না সদ্য মার্জার হওয়া পাঁচটি ব্যাংকের থেকে যে দু’টির অনুৎপাদক সম্পদ (এনপিএ) কম, যাদের আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্কৃতি, পরিষেবা তুলনামূলকভাবে ভালো এবং যে দু’টি অধিক লাভজনক সেগুলিই বেচা হবে। ছ’টি ব্যাংকের এখনো সংযুক্তিকরণ হয়নি -- সেন্ট্রাল ব্যাংক, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংক, ইউকো ব্যাংক, ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, ব্যাংক অফ মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাব এন্ড সিন্ধ ব্যাংক। এরমধ্যে প্রথম তিনটিতে PCA (প্রমট কারেক্টিভ অ্যাকশন) চলছে, অর্থাৎ এই ব্যাংকগুলি এতোই রুগ্ন যে রিজার্ভ ব্যাংক তাদের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বলাই বাহুল্য কোনও শিল্পপতি রুগ্ন সংস্থার দায় নিতে আগ্রহী হবেন না, ঝুঁকি আছে এমন কোনও কিছুর দায়িত্ব নিতে তাঁরা চিরকালই অপারগ। রক্ষণশীল মতামত হচ্ছে ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’র মতো বড় ব্যাংকের পরিবর্তে ছোট দু’টি সংস্থা পাঞ্জাব এন্ড সিন্ধ এবং ব্যাংক অফ মহারাষ্ট্র দিয়ে বেসরকারীকরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে। সম্প্রতি এই দু’টি ব্যাংকে পুঁজি ঢেলে কেন্দ্রীয় সরকার এগুলির অনুৎপাদক সম্পদ সাফ করে দিয়েছে যাতে এগুলি ক্রেতাদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে বিওএম ও পিএসবি যথাক্রমে ৭,৮০০ এবং ৫,৫০০ কোটি টাকা সরকারের থেকে পেয়েছে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল যে পাঁচটি শক্তিশালী ব্যাংক সংযুক্তিকরণের পর তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান দু’টি, ব্যাংক অফ বরোদা এবং পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাংককে দিয়ে বেসরকারীকরণ পর্ব শুরু করা। পিএনবি’র প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার ঘোটালা সম্পর্কে আমরা অবহিত এবং সেই টাকা পুনরুদ্ধারের আর যে বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই তাও আমরা জানি। তা সরকার নিজেই ঐ ব্যাংকে ১৬,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেটিকে লাভজনক করেছে। একইভাবে বিওবি’তে ৭,০০০ কোটি টাকা দিয়ে সেটির অনুৎপাদক সম্পদ অনেকটা সাফ করা হয়েছে (পুঁজি বিনিয়োগের সূত্রঃ wishfin.com)। এছাড়া বাজেটে একটি ‘ঋণ পূনর্গঠন সংস্থা’ তৈরি করার প্রস্তাব আছে যাতে অনুৎপাদক সম্পদ এই সংস্থায় সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকবে এবং ব্যালান্সশীট পরিষ্কার রাখা যাবে। অনুৎপাদক সম্পদ সাফ রাখার ব্যাপারে সরকার মুক্তহস্ত, কারণ তার অন্তরঙ্গ ভুইফোঁড় ব্যক্তিরাই, যেমন নীরব মোদী, এনপিএ সৃষ্টি করার প্রধান কারিগর। এরজন্য তারা ব্যাংকে পুঁজি ঢালবে, অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে আরও গুরুত্বপূর্ণ এনপিএ মুছে ফেলবে (Write-off)। অনাদায়ী ঋণ কী হারে মকুব হচ্ছে জানলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। ২০১৯-২০’র প্রথম ত্রৈমাসিকে ১০টি ব্যাংকের ১৯,০০০ কোটি টাকা মকুব করা হয়েছে। মোদী জমানায় অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০১৫’র ৩১ মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে মোট অনাদায়ী ঋণ ছিল ২.৭৯ লক্ষ কোটি টাকা যা ২০১৯-এ হয়ে দাঁড়ায় ১০.৩৬ কোটি টাকা। বলাই বাহুল্য একই সাথে অনাদায়ী ঋণ মকুব, যার প্রায় পুরোটাই কর্পোরেট ঋণ তাও তাল মিলিয়ে বেড়েছে -- ২০১৫ সালে সেটা ছিল ৪৬,১৭৯ কোটি টাকা, ২০১৯-এ সেটা উল্লম্ফন ঘটে হয়েছে ২৫৪,০০০ কোটি টাকা (সূত্রঃ আইসিআরএ-ইনভেস্টমেন্ট ইনফরমেশন এন্ড ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি)।
পিএনবি ও বিওবি বিক্রিতে সরকার বেশি উৎসাহিত হবে কারণ এতে দাম বেশি পাওয়া যাবে। ক্রেতারাও বড় ব্যাংক কিনতে বেশি আগ্রহী হবে কারণ দেশজুড়ে এদের শাখার সংখ্যা, গ্রাহক, মোট আমানত ছোট ব্যাংকের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিনবেটা কে? এখানে ক্রনোলজি বোঝার দরকার আছে। প্রথমে সরকার বলল মার্জার প্রয়োজন কারণ এতোগুলো ছোট ব্যাংকের পরিবর্তে আমাদের বড় এবং টেকসই ব্যাংক দরকার যা আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। খুব ভালো ১৩টি ব্যাংক সংযুক্ত হয়ে ৫টি হয়ে গেল। এবার রিজার্ভ ব্যাংক হালকা করে কর্পোরেট ব্যাংকের প্রস্তাব বাজারে ভাসিয়ে দিল। রঘুরাম রাজন যিনি গভর্নর থাকার সময়ে এই প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন, তিনি এবং সমমনস্ক অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন। শীর্ষ ব্যাংক ব্যাপারটা চেপে গেল। এবার বাজেটে বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এখন যুক্তি দেখানো হচ্ছে শুধু বড় ব্যাংক হলেই হবে না, সংস্থা পরিচালনায় পেশাদারিত্ব দরকার নাহলে আন্তর্জাতিক স্তরে পাল্লা দেওয়া যাবে না। তাহলে বেসরকারী হলেই কি পেশাদারিত্ব এসে যাবে? কর্পোরেট ব্যাংকের ওপর ইদানিং এই পত্রিকায় একটি লেখায় দেখানো হয়েছে কতগুলি প্রাইভেট ব্যাংক হয় উঠে গেছে কিংবা কোনও সরকারী ব্যাংককে বাধ্য করা হয়েছে সেগুলিকে উদ্ধার করতে। রিজার্ভ ব্যাংক বলছে ২০২০-তে বেসরকারী ব্যাংকের এনপিএ বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিগত অর্থনৈতিক বছরে প্রাইভেট ব্যাংকে ৫৩,৯৪৯ কোটি টাকার ঋণ রাইট অফ করা হয়েছে (সূত্রঃ আরবিআই-বিজনেস ইনসাইডার ইন্ডিয়া)। বেসরকারী ব্যাংক দক্ষ, এনপিএ হয় না এসব স্রেফ সরকারি প্রচার। সুতারাং এটা পরিষ্কার বেসরকারী ব্যাংকগুলি নিজেরাই টলোমলো, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কেনার অবস্থায় তারা নেই।
তাহলে কে কিনবে এই দুটি ব্যাংক? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সম্ভাব্য ক্রেতা হিসাবে সেই কর্পোরেট সংস্থাগুলির নামই উঠে আসবে। আবারও বলতে হয় কোনো কর্পোরেট সংস্থা ব্যাংক চালানোর অর্থ দাতা ও গ্রহীতা এক হয়ে যাবে, বাণিজ্যিক পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি হবে একাকার। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং, অর্থাৎ যে ঋণ দিচ্ছে এবং যে ঋণ নিচ্ছে দুজনে সম্পর্কের অথবা ব্যবসার সূত্রে পরস্পরের অন্তরঙ্গ বা ঘনিষ্ঠ। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং বাস্তবে ‘ক্রোনি’ লেন্ডিং। ঋণগ্রহীতার ব্যবসার ঠিক মতো যাচাই হয় না, তাঁর লেনদেনের মূল্যায়ন করা হয়না, শুধুমাত্র মালিক/পরিচালকের সাথে সম্বন্ধ বা যোগসাজশের কারণে তাকে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত অর্থ পাইয়ে দেওয়া হয়। বিজেপি সরকারের গোঁড়া সমর্থক, দুঁদে অর্থনীতিবিদরাও বলছেন কর্পোরেট যদি ক্রেতা হয় তাহলে ব্যাংক শিল্পে বিপর্যয় অবধারিত। তাহলে আর কে ক্রেতা হতে পারে? বিদেশী ব্যাংক? ছোট করে এই পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে, লক্ষ্মী বিলাস ব্যাংককে উদ্ধার করতে সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংক এগিয়ে এসেছে। আত্মনির্ভরের নাম করে নিখাদ দেশীয় শিল্পে বিদেশী হানার সূত্রপাত। মিনমিন করে কিছু প্রতিবাদ হয়েছে, আরও অনেক কিছুর মতো সরকার এটাকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।
সাধারণ মানুষের কি কিছু যায় আসে যদি ব্যাংক বেসরকারী হয়ে যায়? সরকার দীর্ঘদিন ধরে সুকৌশলে মানুষকে এটা বুঝিয়েছে যে ব্যাংক কর্মচারিরা সুবিধাভোগী, বেশি মাইনে পায়, ফাঁকিবাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাংক ধর্মঘট হলে অনেকেই বিরক্ত হন। বৃহৎ সংবাদপত্র উস্কে দেয় -- সর্বনাশা ধর্মঘট। এতে কর্মচারিদেরও দায় আছে। মানুষের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়ার পক্ষে তাঁদের খুব কমই সরব হতে দেখা গেছে। এই সম্পর্ক মেরামত করা অতীব প্রয়োজন। বিভিন্ন কারণে গ্রাহকরা নাজেহাল -- আমানতের ওপর সুদ কমছে, উল্টোপাল্টা চার্জ কাটা হচ্ছে, নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। গত বাজেটে ব্যাংকে জমা টাকার ওপর বিমা এক থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ করা হয়েছিল। এবারের বাজেটে বলা হল যে সেই টাকা পেতে বিলম্ব যাতে না হয় সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে। হঠাৎ কেন এই কথা উঠে এলো? তবে কি অতীতের মতো ব্যাংক ফেইল হওয়ার সম্ভাবনা আছে? গ্রাহকদের বোঝাতে হবে শিয়রে সমন! ব্যাংক ধর্মঘটে গ্রাহকদের শামিল করতে হবে, লাগাতার প্রচারের জন্য কর্মচারি-গ্রাহক যৌথ কমিটি করতে হবে। ব্যাংকের আন্দোলন যদি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় তাহলেই একমাত্র এই সরকারকে সবক শেখানো যেতে পারে, বেসরকারীকরণের ভূত তাদের ঘাড় থেকে নামতে পারে।
- সোমনাথ গুহ
সারা ভারতের অর্থনীতি যখন নিম্নগামী সেই সময়ে রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন বেড়েছে। ২০১৮-১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী তা বেড়ে ছিল ১২.৫৮% হারে। গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় সে হার কমিয়ে ১০.৪%-তে আসার কথা বলা হয়েছিল, তবে ২০২০-২১এর ইকোনোমিক রিভিউ অনুযায়ী তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭.২৬%। ২০২০-২১ সালের অনুমান অনুযায়ী বৃদ্ধির হার কমে ১.২% হবে, তা গত কয়েক বছরের তুলনায় কম হলেও, সারা দেশের ক্ষেত্রে অনুমান যখন -৭.৭%, তখন মমতাদেবী বলতেই পারেন, আমরাই সেরা। কেবল সামগ্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রেই নয়, শিল্পোৎপাদন সূচকের নিরীখেও পশ্চিমবঙ্গ ভারতকে পিছনে ফেলেছে। রাজ্য কর্তৃক প্রদত্ত পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাচ্ছে যে, জিএসডিপি বৃদ্ধি সত্যিই চমকপ্রদ; গত ৫ বছরে যথাক্রমে ৬.১৩%, ৭.২০%, ৮.৮৮%, ১২.৫৮% ও ৭.২৬% ও ১.২%। এই হারে বৃদ্ধি ঘটলে রাজ্যের আয় বৃদ্ধিও অতি দ্রুত ঘটা উচিৎ। কর রাজস্ব বাড়া উচিৎ। কিন্তু ২০২০-২১ সালের রাজস্ব আদায়ে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ইকোনোমিক রিভিউর তথ্য অনুসারে ২০২০-২১ সালে বাজার চলতি মূল্যে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপন্ন বাড়বে ৮% (২০১৯-২০র তুলনায়), কিন্তু ২০১৯-২০ সালের তুলনায় কর রাজস্ব আদায় কমবে, ৪%-এর বেশি। কর বহির্ভুত রাজস্বের ক্ষেত্রে সেই পতন আরো ভয়াবহ, ৩৩%। তাই বাজেট বা ইকোনোমিক রিভিউতে প্রকাশিত রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তথ্যকে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত ধরনের যুক্তরাষ্ট্রিয়বাদকে আত্মসাৎ করে নেওয়া জিএসটি নামক অতি কেন্দ্রিকৃত কর ব্যবস্থা চালু হয়ে যাওয়ার পরে সরকারি বাজেটে সম্পদ সংগ্রহের কোনো অভিনব বন্দোবস্ত করার কোনো রাস্তা রাজ্য সরকারের অর্থমন্ত্রীর থাকে না। তিনি কেবলমাত্র খরচের ক্ষেত্রেই উদ্ভাবনী চিন্তার পরিচয় দিতে পারেন। যার মধ্য দিয়ে রাজ্যে কর্মসংস্থান, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য পরিষেবার সহজ প্রাপ্যতা ও গুণমান বৃদ্ধি প্রভৃতি ঘটানো যেতে পারে। তেমন কোনো নতুন ভাবনা চোখে পড়বে না। ২০২০-২১ সালের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় অর্থমন্ত্রীর পেশ করা বাজেটে উল্লেখিত সংশোধিত বরাদ্দ প্রায় সব খাতেই কম দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ সম্পদ সংগ্রহের ব্যর্থতা রাজ্য সরকারকে ব্যয় ছাঁটাই করতে বাধ্য করেছে। স্বাস্থ্য-পরিবার কল্যাণ ও পুষ্টি-সামাজিক কল্যাণ ব্যতিরেকে সমস্ত খাতেই আনুমানিক সংশোধিত ব্যয়ের পরিমাণ প্রাথমিক বাজেটের তুলনায় কম, কিছু কিছু কাতে তা অর্ধেকেরও কম। কৃষি খাতেই ওই আনুমানিক সংশোধিত ব্যয়ের পরিমাণ, ৪৮৭১ কোটি টাকা প্রাথমিক বাজেট বরাদ্দ, ১০৬৪৮ কোটি টাকার তুলনায় মাত্র ৪৬%। শিল্প ও খনিজ খাতেও ওই সংশোধিত আনুমানিক ব্যয় মাত্র ৬৪৪ কোটি টাকা, প্রকৃত বাজেট বরাদ্দ ২১৮৬ কোটি টাকার ৩০% এর ও কম।
একদিকে ২০২০-২১ এর বাজেট বরাদ্দ্দের তুলনায় সংশোধিত অনুমানে সর্বত্র ব্যয় কমেছে, স্বাস্থ্য-পরিবার কল্যাণ, পুষ্টি-জনকল্যাণ ও ঋণ ও সুদ প্রদান ব্যতিরেকে; অন্যদিকে ২০২১-২২-এর বাজেট বরাদ্দ বিপুল পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। ঋণ ও সুদ প্রদান বাদ দিলে গত বছরের বাজেটের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২০%; আর সংশোধিত ব্যয়ের তুলনায় তা বাড়ানো হয়েছে ৩২%-এর বেশি। যেহেতু নির্বাচনী বছরের বাজেট, তাই বিবিধ প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে বাজেটে। বাজেটের অব্যবহিত আগেই সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমার ঘোষণা করা হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পকে সমস্ত রাজ্যবাসী নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে। এর পরেই বাজেটে সমস্ত বয়স্ক (৬০ বছরের উপর) ও সমস্ত বিধবাদের (১৮ বছরের উপর) জন্য মাসিক ১০০০ টাকা পেনশনের ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে এই অর্থ সংস্থান করা হবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কর ও করবহির্ভুত রাজস্ব (কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওযা গ্রান্ট-ইন এইড বাদ দিয়ে) আদায় হয়েছিল ১১২ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবর্ষেসেই আদায়ের আনুমানিক পরিমাণ (সংশোধিত) ১০৬ হাজার কোটি টাকা (যদিও ওই বছরের বাজেটে ধরা হয়েছিল আয় হবে ১৪১ হাজার কোটি টাকা)। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কর ও কর বহির্ভুত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৫১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির পরিমাণ ৪২% এর বেশি। এই বিপুল পরিমাণ আয়বৃদ্ধি এই আর্থিক মন্দার সময়ে প্রায় অসম্ভব। বাজেট যেহেতু এই কল্পনার উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাই পুরো বাজেটটাই এক প্রকার ভাওতা।
নির্বাচনী বছরে ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশ করতে গিয়ে বিভিন্ন জনমোহিনী প্রকল্পের ঘোষণা করাটা ভারতীয় ‘গণতন্ত্রে’ নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশের নামে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করার অসদাচার নরেন্দ্র মোদির সরকার শুরু করেছিল ২০১৯-২০ সালের ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশ করার সময়ে। তাকে ট্রাডিশনে পরিণত করতে মমতা ব্যানার্জী-অমিত মিত্র এগিয়ে এসেছেন। গত ১০ বছরে যেসব কাজ মনে পড়েনি তা এই নির্বাচনী বছরে কাজে লাগানো হল। ঠিক যেমন ২০১৯-এর ভোট অন এ্যাকাউন্ট পেশের সময়ে সব রীতিনীতি ভেঙে পিএমকিষান প্রকল্পকে অতীত দিন থেকে কার্যকরী করেছিল মোদি-গোয়েল জুটি, প্রায় তেমনই বাজেটে বয়স্ক ও ১৮ বছরের বেশি বিধবাদের জন্য ১০০০ টাকার পেনশন ঘোষণা করা হল। কোনো নিয়মকানুন কিন্তু তৈরি হল না, কারা তা পাবে কারা তা পাবে না জানানো হল না। বাজেট পেশের মাস দুয়েক আগেই যেমন সকলের জন্য পরিবারপিছু বার্ষিক ৫ লাখ টাকা অবধি হাসপাতাল খরচ প্রদানকারী স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, কেবল ভোট পাওয়ার জন্যই তো। ঘোষণা অনুযায়ী এই বাজেটে নতুন প্রকল্পের পেনশনের জন্য ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলেছেন মমতা ব্যানার্জী। যেহেতু বিভিন্ন পেনশন প্রকল্প আগে থেকেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য চালু আছে, তাই কতজন মানুষ এই প্রকল্পে আসবেন তা বলা যাচ্ছে না। তবে ১০০০ কোটি টাকায় সাকুল্যে ৮.৩৩ লাখ মানুষকেই ওই পেনশন দেওয়া যেতে পারে। ফলে বাজেট বরাদ্দ পেনশন দেওযার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না।
এই বাজেট কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশ দেখাতে পারেনি। গত ১০ বছরে ১১২.৫ লক্ষ কাজ সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে। যদি তেমনটা হত তাহলে এরাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে লক্ষ লক্স শ্রমিক কাজ করতে যেত না। যে চিত্র লকডাউনের সময় ফুটে উঠেছে। আগামী ৫ বছরে ১৫০ লক্ষ কর্মসংস্থানের স্বপ্ন ফেরি করেছে সরকার, যার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে ১২ হাজার কোটি টাকার সংস্থান নাকি রাখা হয়েছে এই বাজেটে। যদি ৫ বছরে তার ৫ গুণ অর্থাৎ ৬০ হাজার কোটি টাকার সংস্থানও ধরা হয় তাহলেও জন পিছু ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগে কর্মসংস্থানের ভাবনা সুপ্ত রয়েছে। একজনকে কাজ দিতে ৪০ হাজার টাকা অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে এই কর্মসংস্থানের ঘোষণাটিও আরেকটি ভাওতা। রাজ্য জুড়ে সরকারী দফতরে শূন্যপদ, কেবল অস্থায়ী ক্যাজুয়াল বা চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ, নিয়োগে অকাতর দুর্নীতি; আর অপরদিকে গত ১০ বছরে ১.১২৫ কোটি কর্মসংস্থানের ভাষণ, এবং ভবিষ্যতে ৫ বছরে ১.৫ কোটি কর্মসংস্থানের ভাওতা, পশ্চিমবঙ্গের ২০২১-২২ সালের বাজেটে এটাই ‘প্রাপ্তি’।
- অমিত দাশগুপ্ত
বিজেপি কি সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে? এতদিন আমরা জানতাম, প্রবল-প্রখর এক আইটি সেলের অস্তিত্বের কথা, যার এক পোস্ট বা ট্যুইটে সারা দেশের জনতা নাকি উদ্বেলিত হয়ে উঠতেন। সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত সে বাচনে নাকি দেশ জুড়ে এমন এক ঐকমত্য নির্মাণ হয়েছিল, যার তুমুল প্রতাপের কাছে আর সব তর্ক, ভাবনা বানের জলে ভেসে গিয়েছিল। যে বা যারা ওইসব বয়ানের বিরুদ্ধে কিছু বলতেন বা লিখতেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের জবাই করা হত। শুধু তাই নয়, আইটি আইনের নানান ধারায় তাঁদের জেলে পোরাও ছিল এক সহজ-সরল নিদান। সে সব সুখের দিন কি অবশেষে সমাগত প্রায়?
নয়তো, পপস্টার রিহানের এক প্রশ্নসূচক বা গ্রেটা থুনবার্গের কিছু অতি-নিরীহ ট্যুইটে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র দফতর অমন রে রে করে মাঠে নেমে পড়বে কেন? শুধু তাই নয়, স্বয়ং বিদেশ মন্ত্রী মহাশয় পর্যন্ত এ বিষয়ে মুখ খুলে একচোট বীরত্ব দেখিয়েছেন। এরপর আইটি আইনের নানান ধারা দেখিয়ে সরকার ঘাড় ধরে ট্যুইটারের ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে কিছু কসরত শেখাবারও চেষ্টা করেছে। প্রথম রাউন্ডে তারা ট্যুইটার কর্তৃপক্ষকে প্রায় ২৫০ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেবার নির্দেশ পাঠায়, যদিচ সে নির্দেশ পেয়ে সেইসব অ্যাকাউন্ট বন্ধও করে দেয় ট্যুইটার, কিন্তু ঘন্টা ছয়েক পরে তা আবার প্রত্যাহার করে। ট্যুইটারের সিইও জ্যাক ডর্সি জানান, ট্যুইটার মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বীকার করে। এইসব বাক্য বিনিময়ে দিল্লীর অধিপতিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং হুমকি দেন যে ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ যদি তাঁদের নির্দেশানুযায়ী হাজারের ওপর ট্যুইটার অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আইটি আইন মোতাবেক সরকার ট্যুইটারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সেই ব্যবস্থায় ট্যুইটারের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাত বছর অবধি জেল হতে পারে। ট্যুইটারের পক্ষ থেকে আইটি মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রী সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তাদের তাঁর দফতরের আমলাদের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন। একটি নড়বড়ে আলোচনা হয় এবং সরকারের নির্দেশে ট্যুইটার অ্যাকাউন্টের ৯৭ শতাংশ সরকার কর্তৃক চিহ্নিত ট্যুইটার ভারতীয় ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
কিন্তু কী এমন ঘটল যে এতদিনের সাধের সৌধ সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে বিজেপি-আরএসএস এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল? বলাই বাহুল্য, আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আইটি সেলের আধিপত্য আজ ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে। এক সময়ে যেখানে এই কুখ্যাত সেল সংগঠিতভাবে একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারত, যে কোনও ঘটনায় তাদের নিজেদের বয়ান পেশ করে সেগুলিকে জনপ্রিয় করে নিজেদের অনুকূলে চলমান ঘটনাবলীকে মোড় ঘোরাতে পারত, আজ তাদের সে দাপট ম্রিয়মান। মানুষের এক বড় অংশ তাদের জুমলাবাজি ধরে ফেলেছে এবং সক্রিয় ভাবে তাদের বিরুদ্ধে স্বর তুলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই স্বর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার অন্দরেও ঝড় তুলেছে। পাশাপাশি, দিল্লীর সীমান্তে কৃষক জমায়েত ও গত ৭০ দিনেরও বেশি সময় ধরে তাদের বলিষ্ঠ আন্দোলন ও বিজেপি সম্পর্কে মোহভঙ্গ চারিদিকে এক নতুন সোরগোল তৈরি করেছে। উত্তর ভারত জুড়ে লাখে লাখে কৃষকের মহাপঞ্চায়েত সমস্ত বিভাজনের বাতাবরণকে নস্যাৎ করে মানুষের এক নতুন ঐক্যযাত্রার সূচনা করেছে। সেই দৃপ্ত অভিযান সোশ্যাল মিডিয়ার অন্দরেও আলোড়ন তুলেছে ও বড় জায়গা জুড়ে বিস্তৃতি পেয়েছে। খুব স্বাভাবিক, এই লহরের সামনে উগ্র ধর্মীয় রক্ষণশীল শক্তি আরও বিচ্ছিন্ন হবে ও ফলত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। তাই, সোশ্যাল মিডিয়ায় এক সময়ে তাদের রাজ আজ বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত।
আপনাদের সকলের মনে আছে, ফেসবুককে হাতিয়ার করে ও তাদের প্রায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কীভাবে ২০১৪ সাল থেকে মোদী ও তাঁর দলবল জনমতকে বিভ্রান্ত ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। তা নিয়ে কম হৈচৈ হয়নি। ভারতীয় ফেসবুকের অন্যতম কর্তাব্যক্তি আঁখি দাসের বয়ানে তা স্পষ্টও হয়েছে। তখন এইসব সোশ্যাল মিডিয়ার হাতিয়ারগুলি ছিল তাদের বন্ধু ও সহযোগী। কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে।
সাম্প্রতিককালের ট্যুইটার ট্রেন্ডগুলি দেখলে বোঝা যাবে যে মোদী ও বিজেপি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগগুলি একদম ওপরের সারিতে জায়গা পাচ্ছে। এবারের গণ্ডগোলের সূত্রপাত #ModiPlanningGenocideofFarmers হ্যাশট্যাগটি। কৃষক আন্দোলনের নেতা রাকেশ টিকায়েতের সেই মর্মস্পর্শী আবেদনের পর যখন লাখে লাখে কৃষক আবার গাজীপুর, সিঙ্ঘু ও টিকরি সীমান্তে এসে আন্দোলনে নব জোয়ার তৈরি করলেন, ঠিক তার পরপরই এই হ্যাশট্যাগটি ট্যুইটারে কোনও আন্দোলনকারীর পক্ষ থেকে তৈরি করা হয় এবং তা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়। এই হ্যাশট্যাগের জনপ্রিয়তা দেখেই বিজেপি নেতাদের মাথা ঘুরে যায় ও তারা পালটা প্রচারে পাঙ্গা নিতে না পেরে ট্যুইটার কর্তৃপক্ষকে ভয় দেখিয়ে একে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এরপরেই আসে পপস্টার রিহানার খুব সাধারণ প্রশ্নসূচক একটি ট্যুইট যেখানে তিনি সরলভাবে জানতে চান: কৃষকদের এই প্রতিবাদ নিয়ে কি আমরা আলোচনা করতে পারি না? ব্যস, এই সামান্য প্রশ্নবাণেই অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন বিজেপি নেতারা। তারপর এলো গ্রেটা থুনবার্গ ও মীনা হ্যারিসের সমর্থনসূচক বক্তব্য। কাণ্ডজ্ঞান হারালেন বিজেপি নেতারা। বলতে শুরু করলেন যে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা নাক গলাচ্ছেন। অথচ, তাদেরই সর্বময় নেতা ও দেশের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গিয়ে যখন সমস্ত কূটনৈতিক রীতিনীতি ভেঙে শ্লোগান দিলেন “অব কি বার, ট্রাম্প সরকার”, তখন তা অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর বিষয় নাকি ছিলনা। কিম আশ্চর্যম!
কিন্তু এইভাবে মিথ্যার ছলনায় কি সত্যকে আড়াল করা যাবে? উত্তাল কৃষক আন্দোলন মানুষের মোহমুক্তি ঘটিয়েছে ও সমস্ত জড়তার অবসান হয়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে বিজেপি’র বাহিনী সোচ্চার ঘোষণা দিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে ট্যুইটার অনুরূপ ‘কু’ নামক একটি ‘দিশি’ সোশ্যাল মিডিয়ায়। বালিতে মুখ গুঁজলে কি ঝড়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়? ট্যুইটার ব্যবহারকারীরা বরং বিজেপি নেতাদের এই প্রয়াসে আমোদ পেয়েছেন ও তাঁরা #RecycleBin হ্যাশট্যাগ করে ট্যুইটারের সমস্ত জঞ্জালকে কু’তে চলে যাওয়ার আবেদন করেছেন। পাশাপাশি, #AmitShahGoBack, #GoBack Modi ইত্যাদি বিবিধ হ্যাশট্যাগ তৈরি হয়ে ট্যুইটারে এক নতুন ঝড়ের সূত্রপাত হয়েছে যা অচিরেই ট্রেন্ডিং’এ একেবারে প্রথম সারিতে উঠে আসছে।
এর পাশাপাশি সংবাদ-ভিত্তিক ইউটিউব ভিডিও এখন খবর সম্প্রচারের মূল গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে যা গোদি মিডিয়ার বিকল্প হিসেবে ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গেছে। ‘ন্যাশনাল দস্তক’, ‘দ্য লাইভ টিভি’ ইত্যাদি ইউটিউব ভিত্তিক সংবাদ চ্যানেলের গ্রাহকের সংখ্যা ৪৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার এদের এক্তিয়ার এতদূর যে আপলোডিং’এর ৫ মিনিটের মধ্যেই ভিউয়িং ছাড়িয়ে যাচ্ছে ১০ হাজারের ওপর। সবটা মিলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন জনমতের ঘুরে যাওয়ার উজ্জ্বল ছবি। বলাই বাহুল্য, আগামী স্বল্প দিনেই আইটি সেলের দাপটের অন্ত বেশ স্পষ্ট। তারা নিজেরাও এখন সে দেওয়াল লিখন পড়তে পারছে।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় (ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক, ১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০২১)
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের কাছে প্রার্থনা, ধর্মান্ধ লোভী মিথ্যাচারী ফ্যাসিস্টরা যেন না আসে। আর যেই আসুক, হিটলারপূজক, গান্ধী হত্যাকারীরা যেন না আসে।
যাকে খুশি ভোট দিন। কিন্তু ফ্যাসিস্টদের দেবেন না। বেছে বেছে প্রার্থী দেখে ভোট দিন। দল দেখে নয়।
২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আমি কতগুলো “ভবিষ্যৎবাণী” করেছিলাম, যার অনেকগুলোই এখনো পর্যন্ত মিলে গেছে, এবং বাকিগুলোও মিলে যাবে। আমি যদিও কোনো বরাহমিহির বা আর্যভট্ট নই (অবশ্য বাম ও দক্ষিণ দুদিক থেকেই আমাকে বরাহ সম্ভাষণ মাঝে মাঝেই করা হয়ে থাকে), কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা ও রাস্তায় নেমে দুই দেশে দীর্ঘকাল রাজনীতি করার সুবাদে কতগুলো সিক্সথ সেন্স বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তৈরি হয়েছে। যার ভিত্তিতে এই প্রেডিকশনগুলো আমি করি। কে কী ভাবলো, বা আমাকে কোনো পার্টির গুপ্তচর মনে করলো, তাতে আমার গ্রীন প্ল্যানটেন।
“ভবিষ্যৎবাণী” কথাটা উক্তি চিহ্নের মধ্যে দিলাম, কারণ নাহলে মনে হতে পারে আমি কোনো জ্যোতিষী, পীর, দরবেশ, বা গুরুদেব। আমার আবার ঝাড়ফুঁক, হস্তরেখা, কুষ্ঠীবিচারে, গ্রহরত্নে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। সেনকো পিসিরা আমাকে একেবারেই পছন্দ করবেন না।
যা হতে পারে, তা খুব সংক্ষেপে লিখলাম। সম্ভাবনা। অর্থাৎ, এগুলো হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। কোনো জিপসি ক্রিস্টাল বল আমার সামনে নেই। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু নাও হতে পারে। কিছু হবে পরের দিন থেকেই। বাকিগুলো হবে একটু একটু করে। হবেই — বলতে পারি না। ওই যে বললাম, হবার সম্ভাবনা।
(১) হিন্দি বাধ্যতামূলক হবে স্কুল স্তর থেকে। বাংলা ঐচ্ছিক -- অপশনাল -- বিষয় হিসেবে পড়ানো হবে।
(২) সমস্ত স্টেশন এবং সরকারী অফিসে হিন্দিতে সাইনবোর্ড থাকবে। বাংলা হয় একেবারেই থাকবে না, অথবা খুব গৌণভাবে থাকবে।
(৩) দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো বা সরস্বতী পুজোর বাঙালি পদ্ধতিকে ক্রমশ বিসর্জন দেওয়া হবে। তার জায়গায় গুজরাটি, মারাঠি বা পাঞ্জাবি স্টাইলে শাস্ত্রাচার চাপিয়ে দেওয়া হবে। গণেশ চতুর্থী, ধনতেরাস, নবরাত্রি, ছট জাতীয় উৎসব জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে।
(৪) বাউল, সুফী, লালন, রাস, সংকীর্ত্তন এবং হাজার লোকায়ত সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিল্প ইত্যাদি রাষ্ট্রের নিষ্পেষণের শিকার হবে। আকাশবাণী রেডিওতে বাংলা প্রোগ্রাম আরো সঙ্কুচিত করা হবে, এবং হিন্দি মাধ্যমের অনুষ্ঠান আরো বেশি প্রসারিত হবে।
(৫) বলিউডের স্টাইলে টলিউড সিনেমা তৈরি হবে (ধরে নিন আজকের গেরুয়া সিন্নি বাংলা টিভি সিরিয়ালের নবকলেবর), যেখানে বাংলার বুদ্ধিজীবিতার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। মৌলবাদী হিন্দু ধর্মভিত্তিক সিনেমা অনেক বেশি জাঁকিয়ে বসবে, এবং যে কোনো সৃষ্টি -- সিনেমা থিয়েটার ছবি থেকে যাত্রাপালা -- যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বা ঈশ্বর-অবিশ্বাসের কোনোরকম ইঙ্গিত আছে, তা নির্দয়ভাবে বন্ধ করা হবে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক বা তপন সিংহকে আস্তে আস্তে মুছে দেওয়া হবে চেতনা থেকে।
(৬) বাংলাদেশকে শত্রুদেশ হিসেবে ক্রমশ আরো বেশি করে চিহ্নিত করা হবে, ঠিক যেমন এখন পাকিস্তানকে করা হয়েছে। মুসলমানদের ওপর নতুন নতুন নিষ্পেষণ ও নির্যাতন বাড়বে, এবং বাংলায় নতুন করে জাতের রাজনীতি শুরু হবে। উঁচু জাত, নীচু জাত। মুসলমান নিপীড়ণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে ধর্মান্ধ হিন্দুবিদ্বেষী ও ভারতবিদ্বেষী চরমপন্থী ইসলামীরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, এবং “শত্রুদেশ ভারতের চর” হিন্দুদের ওপর নতুন করে নির্যাতন শুরু হবে।
(৭) বাংলার ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, যে কটা কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের জমানার সর্বনাশের হাত থেকে এখনো বেঁচে আছে। হয় আম্বানি আদানি জাতীয় বিলিয়নেয়ার কর্পোরেট হাউসের হাতে তুলে দেওয়া হবে, আর নয়তো কৌশল করে শুকিয়ে মারা হবে। যেমন, বেঙ্গল কেমিক্যাল, চায়ের বাগান, বস্ত্র ও পাট, গঙ্গার দুই তীরের কলকারখানাগুলো, অথবা পরিবহন ও ট্যুরিজম।
(৮) জিনিষপত্রের দাম এখন যা দেখছেন, তার তিনগুণ হয়ে যাবে। এখন যদি একশো টাকায় এক লিটার তেল পান এবং কেন সারা পৃথিবীতে তেলের দাম কমে গেছে কিন্তু আমাদের দেশে তা এতো বেশি -- তার উত্তর না পান, তখন তিনশো টাকায় কিনলেও কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। সেইরকম আর সব জিনিসপত্রের দামও তিনগুণ হয়ে যাবে, কারণ অর্থনীতিটাই বিলিয়নেয়ার কর্পোরেট হাউস এবং কালো টাকার হাতে তুলে দেওয়া হবে।
(৯) সরকারী চাকরি ক্রমে সম্পূর্ণবিলুপ্ত হবে। সরকারী সমস্ত কাজকর্মপ্রাইভেট হাউস চালাবে -- কয়েক বছরের মধ্যেই।
(১০) সারা ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গেও রাজনৈতিক বিরোধিতা আইন করে নিষিদ্ধ হবে, এবং সংবিধান বদলে ফেলে ধর্মনিরপেক্ষ বা অ-হিন্দু ধর্মের সংগঠন সব নিষিদ্ধ হবে।
(১১) রবীন্দ্রনাথকে সমস্ত পাঠ্যক্রম থেকে তুলে নেওয়া হবে, এবং জাতীয় সঙ্গীত বদলে দেওয়া হবে। বিশ্বভারতীকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা থেকে বাতিল করা হবে। বিশ্বভারতী বা এই জাতীয় ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানকে ছলে বলে কৌশলে নিষ্পেষিত করা হবে।
(১২) বাঙালির ইতিহাস সমস্ত ভুলিয়ে দেওয়া হবে। বিশেষ করে নারীর অধিকার, গরিবের অধিকার, এবং অন্যান্য যেসব সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলন গত দুশো বছর ধরে হয়ে এসেছে -- যেমন বেঙ্গল রেনেসাঁস বা নবজাগরণ -- তার সম্পূর্ণ বিকৃতকরণ করা হবে। রবীন্দ্রনাথের মতোই নজরুল, লালন মুছে যাবেন। স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে কোনো আলোচনা আর পাঠ্যবইতে থাকবে না, কারণ আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শতহস্ত দূরে ছিল। শ্যামাপ্রসাদ, বা এই জাতীয় হিন্দু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বকে বাংলার প্রধান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থাপিত করা হবে।
সবাই বিন্দাস থাকুন। আচ্ছে দিন আসছে।
আবার বলছি, সম্ভাবনা। “ভবিষ্যৎবাণী” সে অর্থে নয়। এসব কিছু না হলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবো।
সময়ের চাকাকে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জান্তব প্রচেষ্টায় রত ফ্যাসিবাদী শাসকেরা প্রশ্ন তোলার অধিকার কেড়ে নিয়ে সারা দেশে নামিয়ে এনেছে এক অদ্ভুত আঁধার। অন্ধকারে আলোর ঠিকানা দেখানোর কাজে যাঁদের পথে নামার কথা তাঁদেরও আনেকে বিভ্রান্ত, দিশাহারা। কিন্ত প্রাণপণ শক্তিতে এখনও বহু পদাতিক লন্ঠন হাতে দুর্গম পথে হেঁটে চলেছে। ফ্যাসিবাদের দুশ্চিন্তা সেখানেই। কোন ‘অমাপ্রসাদে’র ৩০০ ফুট উঁচু মূর্তি স্থাপন কিম্বা কোন অবতারের সুউচ্চ মন্দির নির্মাণ-এসব প্রকল্পকে তুচ্ছ করে দিয়ে এইসব পদাতিকরা যে শোনাচ্ছে ‘একুশের ডাক, মানুষের দাবি!’ বিলাসবহুল বিশাল বিশাল রথযাত্রায় ‘একুশের ডাক’কে চাপা দিতে অন্ধকারজীবী, কর্পোরেটজীবীরা এজন্য এত ভীষণ মরিয়া। দেশের পশ্চিম সীমান্তে অন্নদাতাদের মহাজাগরণের সংবাদ যেন পূর্ব সীমান্তে ঢেউ তুলতে না পারে, ভগৎ সিং আর ক্ষুদিরাম যেন একাকার না হয় -- সেজন্য ফ্যাসিবাদ ‘পিএম কিষানে’র সমস্ত কালো টাকা এ’রাজ্যেই ঢেলে দিতে প্রস্তুত। কিন্ত জোনাকিরা একদিন যে তারা হয়ে জ্বলবেই তা জানান দিতে হুগলী জেলার ব্যান্ডেলে ‘দুর্গা লজে’ ১২ ফেব্রুয়ারী কবিতা-গান-কথায় অনুষ্ঠিত হল এক সাংস্কৃতিক অপরাহ্ণ। উপলক্ষ্য ছিল ভিয়েৎ ব্যানার্জীর কাব্যগ্রন্থ ‘স্বগতোক্তি’র আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। ভিয়েৎ পার্টির হুগলী জেলা কমিটির সদস্য। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে সর্বদা সামিল থেকেই নিঃশব্দে তিনি কবিতা লিখে গেছেন কয়েক বছর ধরে। সমকালীন যুগের কথা, প্রবাসী শ্রমিকের যন্ত্রণা, হাথরাসের ঘটনা -- সব কিছুই তাঁর কবিতার উপজীব্য। আর সেজন্য পার্টির সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের হাত দিয়েই এই কাব্যগ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলির প্রথম উন্মোচন হল।
‘রাম রাজত্বে’র নামে যে আসলে মোদী-অমিত শাহ কোম্পানিরাজ কায়েম করতে চায় তা যাঁদের কাছে স্পষ্ট এমন বহু বিশিষ্ট মানুষ, কবি, ‘আন্দোলনজীবী’ -- বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা সভাগৃহ ভরিয়ে তোলেন। এই সাংস্কৃতিক অপরাহ্ণে সংগীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার, পৃথা মুখার্জী, সঙ্গীতা দাস, গীতালি ব্যানার্জী ও সতী সেন। কবিতা পাঠ করেন সুজন ভট্টাচার্য, কিশোর চক্রবর্তী, কল্যাণ সেন, শায়েরি ব্যানার্জী, সম্পন্না ব্যানার্জী, রিয়াংসিকা চক্রবর্তী, দেবাশিস রায় ও রীতা ব্যানার্জী (রীতা ভিয়েতের স্ত্রী এবং বস্তুত তাদের দাম্পত্যজীবনের রজত জয়ন্তী উপলক্ষ্যেই রীতা ভিয়েতের এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন)। বলা বাহুল্য, সকলেই দীপঙ্করের বক্তব্য শোনার জন্য উন্মুখ ছিলেন। দীপঙ্কর তাঁর নাতিদীর্ঘ ভাষণে বলেন, মানুষ কী খাবে, কী পরবে, ‘লাভ জিহাদের’ নামে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মাঝেও দেয়াল তুলে দেওয়া – সঙ্ঘ পরিবার এসব নিয়ে এতদিন ফতোয়া দিচ্ছিল। এখন তারা “কৃষকরা শুধু কৃষি নিয়ে বলুক, বন্দিমুক্তি নিয়ে যেন মুখ না খোলে আর প্রতিবাদীরা যেন অন্য ব্যাপারে কথা বললেও কৃষকদের নিয়ে সরব না হয়” -- এমন ফতোয়া দিচ্ছে। দীপঙ্কর বলেন, এই ফতোয়া পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশ মানতে অস্বীকার করেছে।
সুন্দর এই সাংস্কৃতিক অপরাহ্ণের সভামঞ্চে ছিলেন সনৎ রায়চৌধুরী, প্রণব দাশগুপ্ত, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্তিক পাল ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন দেবাশিস মুখার্জী। এই অনুষ্ঠানে কাব্যগ্রন্থটির বিক্রয়লব্ধ অর্থ পার্টির নির্বাচনী তহবিলে প্রদান করা হয়।
কিছু কিছু মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী। ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়াণ ঝা’র চলে যাওয়া যেন আরেকবার তা প্রমাণ করে দিল। ফেব্রুয়ারী ২০২১’র প্রথম সপ্তাহে একাশি বছর বয়েসে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন এই খ্যাতনামা ঐতিহাসিক। শুধু নামকরা ঐতিহাসিক বা ইতিহাসের অধ্যাপক নন, তিনি ছিলেন এমন ইতিহাসবিদদের অন্যতম, যাঁরা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আপোস করেননি। গোয়েন্দার মতো সত্যের অনুসন্ধান করাই যে ঐতিহাসিকের কাজ, এবং একমাত্র তথ্য প্রমাণের সাহায্যেই যে ইতিহাস রচনা সম্ভব, তা তিনি কখনোই ভোলেননি। যদিও সবকিছুর মূল্যে ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য বারে বারে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁর লেখা বই তুলে নিতে বাধ্য করা হয়েছে প্রকাশককে, এমনকি মৃত্যুর হুমকিও দেওয়া হয়েছে বর্ষীয়ান এই ঐতিহাসিককে। কিন্তু কোনো প্রতিরোধই তাঁকে নিজের কাজ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বারবার লিখেছেন এমন ইতিহাস, যা পড়তে ভারতেরই এক নব্য শ্রেণির পাঠকের অস্বস্তি হয়েছে। কারণ তাঁর ইতিহাস সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক এজেন্ডার বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা’র সাথে কলকাতারও একটা যোগাযোগ রয়েছে। কলকাতার তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক পর্যায়ের পড়া শেষ করে তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মার কাছে নিজের গবেষণা শেষ করেন। এরপর ঐতিহাসিক হিসাবে তাঁর জীবন প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি চলেছে, কিন্তু তাঁর লেখায় কখনো ইতিহাসের অপলাপ করেননি এই সাহসী ইতিহাসবিদ। শক্ত শিরদাঁড়া নিয়ে বারে বারেই লিখেছেন ইতিহাস, যা সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে তাঁকে অপ্রিয় করে তোলে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসে তাঁর পারদর্শিতা অতুলনীয়। তিনি অবশ্য মনে করতেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সাম্প্রতিক সময়ের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লেখা পড়লে বোঝা যায় এই মতামতের কারণ। ২০০১ সালে তাঁর লেখা বই “দ্য মিথ অফ দ্য হোলি কাউ” প্রকাশিত হয়েই শোরগোল ফেলে দেয়। এই বইতে ঝা তথ্যপ্রমাণসহ দেখিয়েছিলেন যে, গরু খাওয়ার চল মুসলমানদের হাত ধরে ভারতে শুরু হয়নি, বরং তা প্রাচীন যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রাচীন যুগে গরু খাওয়া যে ট্যাবু ছিল না, তা নানা রকম উপাদান ঘেঁটে প্রমাণ করেন অধ্যাপক ঝা। স্বভাবতই ভারতের সমকালীন রাজনীতির ময়দানে এই বই শোরগোল ফেলে দেয়। গোমাংস নিয়ে মিথ্যা প্রচারের বেলুন ফুটো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় সাম্প্রদায়িক শক্তি পেশীশক্তির প্রদর্শন শুরু করে, ফলে প্রকাশক বইটি বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু অধ্যাপক ঝা’কে থামানো যায়নি। কয়েক বছর বাদে বইটি আবার অন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রকাশিত হয় এবং একই রকম সাড়া ফেলে। মুশকিল হল অধ্যাপক ঝা’র লেখাকে মিথ্যা বলে দাগিয়ে দেওয়া অন্তত ঐতিহাসিকভাবে সম্ভব নয়। তাই তাঁর বিরুদ্ধে বারবার পেশীশক্তির প্রয়োগ ছাড়া উপায় থাকে না।
অবশ্য শুধু গোমাংস খাওয়া নিয়ে ইতিহাস লেখা দিয়ে অধ্যাপক ঝা’র মতো শক্তিশালী ঐতিহাসিকের মূল্যায়ন করা একেবারেই সঠিক নয়। কিন্তু একথা বলাই যায় যে তিনি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের “হোলি কাউ” বা পবিত্র বেশ কিছু ধারণা বদলে দিতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। যেমন গুপ্তযুগকে স্বর্ণযুগ হিসাবে চিহ্নিত করাকে প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন এই প্রথিতযশা ঐতিহাসিক। ভারতমাতা বা অখন্ড ভারতের কল্পনা যে খুব বেশি হলে একশো বছরের পুরনো এবং প্রাচীন ভারতে ভারতমাতা বা বিশাল ভারতবর্ষের চিত্র পাওয়া যায় না, তা তিনি দেখিয়েছিলেন নিজের লেখায়। এছাড়াও ১৯৯১ সালে বাবরি মসজিদ নিয়ে বিতর্কের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি ও অন্য দুই ঐতিহাসিক এম আতহার আলি ও সুরজ ভান একটি লেখা লেখেন, যার শিরোনাম ছিল “বাবরি মস্ক অর রাম’স বার্থপ্লেস: হিস্টোরিয়ান্সেস রিপোর্ট টু দি ইন্ডিয়ান নেশন”। এই লেখাটিতে লিখিত ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতে দেখানো হয়েছিল যে বাবরি মসজিদের নীচে কোনো হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব কখনোই পাওয়া যায়নি। স্বভাবতই, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রোপাগান্ডার মূল ধরে নাড়া দিয়েছিল এই লেখা (২০১৯ সালে প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে অবশ্য, এই লেখা “ঐতিহাসিকদের মতামত মাত্র”!!!)। প্রকৃতপক্ষে ১৯৮৬ সালে যখন অধ্যাপক ঝা ছিলেন ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের সচিব পদে, তখন থেকেই এই রামজন্মভূমি বিতর্কমাথা চাড়া দিয়েছিল, এবং ঝা’র মতামতের জন্য তাঁকে অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন এমন এক প্রজন্মের ঐতিহাসিক, যাঁদের কাছে তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। তাই ‘হিন্দুবিরোধী’ বা ‘ব্রাহ্মণ বিরোধী’ তকমা দিয়েও তাঁকে পোষ মানানো যায়নি। এরপরেও তিনি লিখেছেন যে দক্ষিণপন্থী ঐতিহাসিকদের ঋকবেদ নিয়ে অবসেশনের আসল কারণ হল তাঁদের নিজেদের সাম্প্রদায়িক বা মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব। এত সরাসরি এরকম কঠিন সত্যি বলা বোধহয় একমাত্র অধ্যাপক ঝা’র পক্ষেই সম্ভব ছিল। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্তও তিনি ইতিহাস চর্চা চালিয়ে গেছেন। কোনো বিরোধ, কোনো ভয় তাঁকে এক চুলও সরাতে পারেনি নিজের বিশ্বাস এবং কাজের প্রতি সততা থেকে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু দক্ষিণপন্থী শক্তি বারবার তাঁর লেখার বিরোধিতা করেছে।
আজ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নতুন এক কাল্পনিক ইতিহাস রচনা করে সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতিবিদ্বেষের বিষ ছড়াতে, সেই সময় অধ্যাপক ঝা’র মতো শক্ত মেরুদণ্ডের ঐতিহাসিকের চলে যাওয়া ইতিহাসের ছাত্র এবং সাধারণ পাঠকের পক্ষে অপূরণীয় ক্ষতি। তাই আরো বেশি করে এই সময় তাঁকে স্মরণ করা প্রয়োজন। তাঁর লেখা ইতিহাস পড়া এবং সেই ইতিহাসের ধারাকে অনুসরণ করে তথ্যপ্রমাণসহ ইতিহাস রচনার পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই বোধহয় তাঁকে সঠিক অর্থে স্মরণ করা।
- সায়ন্তনী অধিকারী (সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা)
nagorik.net এ লেখাটি পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল
- সমাপ্ত -