১৫ মার্চ ২০২১। বিকেল ৫:০০-৫:৩০ টা। হটাৎ করেই গেরুয়া টি-শার্ট পরিহিত কিছু মানুষ এক এক করে ঢুকে পরলেন বই পাড়ার কফি হাউজের দু’তলা, তিন তলায়। কয়েকজন আবার ভিতরে ঢুকে গায়ে গলিয়ে নিলেন গেরুয়া জামা, যার বুকে লেখা ‘মোদী পাড়া’। কফি হাউজ জুড়ে বিভিন্ন টেবিলগুলো ধীরে ধীরে তাদের দখলে চলে এলো। এদের মাঝেই দেখা গেল একটি চেনা মুখ। সামাজিক মাধ্যমে বিজেপি’র ট্রোল আর্মির অন্যতম চেহারা ও মোদীর ডিজিটাল প্রচারের সামনের সারিতে থাকা ‘কুখ্যাত’ তেজিন্দর বগগা, যিনি প্রথম প্রচারের আলোয় আসেন আদালত চত্বরে ঢুকে আইনজীবী প্রশান্তভূষণের উপর হামলা করে। তারপর নানান সময়ে সামাজিক মাধ্যমে বিরোধী যে কোনো স্বরকে তীব্র আক্রমণ করে কুৎসিত পোস্ট, ফেক নিউজ, হুমকি, শাসানি দেওয়ার পুরস্কার স্বরূপ ২০২০ সালে দিল্লি থেকে বিজেপির হয়ে নির্বাচনে লড়েন ও আপ-এর কাছে হেরে যান। এই তেজিন্দর বগগা-র নেতৃত্বেই ‘মোদী পাড়া’ ডিজিটাল ক্যাম্পেন চলে ফেসবুক সহ নানান মাধ্যমে। ১৫ মার্চ বগগা ও তার অনুগামীদের দলবল প্রথমে কফি হাউজে ঢোকেন, বিভিন্ন টেবিলে বসেন, কথা বার্তা বলেন, প্রচার চালান, ছবি তোলেন। তাদের শারীরিক ভাষা ও প্রচারের ধরন ছিল কফি হাউজের চেনা ছবির একেবারেই পরিপন্থী। এর পরেই তাদের কয়েকজন সটান চলে যান নীচে সিঁড়ির কাছে যেখানে বিভিন্ন পোস্টারের মাঝেই লাগানো ছিল ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র পোস্টার। কালি দিয়ে সেই পোস্টার নষ্ট করতে ও পোস্টার ছিঁড়তে শুরু করেন তারা। সেই সময়ে কফি হাউজে উপস্থিত কয়েকজন এর প্রতিবাদ করতেই ভিতরে বসে থাকা বাহিনী এসে শুরু করে তাণ্ডব। যখন বলা হয় যে ‘আপনারা কেন পোস্টার নষ্ট করছেন, আপনাদের পোস্টার আপনারা পাশের খালি জায়গায় লাগান’, তখন তাদের তরফ থেকে জবাব আসে ‘বেশ করছি ছিঁড়ছি, যা পারিস করে নে’। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে, উচ্চগ্রামে ৩০-৪০ জন মিলে শুরু হয় ‘মোদী মোদী’, ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান। কফি হাউজ তখন হতচকিত। চিরকাল নানা রাজনৈতিক আলোচনা, মত বিনিময়, তর্ক বিতর্ক দেখে অভ্যস্ত মুক্ত চিন্তার পরিপোষক কফি হাউজ এই ধরনের উদ্ধত- উগ্র শরীরী ভাষার সাথে একেবারেই পরিচিত নয়। এর পরেই প্রতিবাদীদের মধ্যে থেকে পাল্টা আওয়াজ ওঠে ‘ক্ষুদিরামের মাটিতে নাথুরামের ঠাই নেই’, ‘রবি ঠাকুরের মাটিতে দাঙ্গাবাজদের ঠাই নেই’। লেজ গুটিয়ে পালায় নেতা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ঘটনার প্রতিবাদে পরের দিন ১৬ মার্চ ওই জায়গাতেই বিক্ষোভ সভার ডাক দেওয়া হয়, যোগ দেন কয়েকশো মানুষ। সভা ও মিছিল থেকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয় বহু লড়াইয়ের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করবো। বাঙলার বুকে থেকে এই ফ্যাসিস্ত শক্তির কোনো জায়গা নেই। গেরুয়া বাহিনী যে যে জায়গায় পোস্টার নষ্ট করে, দিগুণ পোস্টারে ভরিয়ে দেওয়া হয় সেই সমস্ত দেওয়াল।
বস্তুত কলকাতার কলেজ পাড়ায় খোদ কফি হাউজে এই ধরনের আক্রমণ একেবারেই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা দেশজুড়েই মুক্ত চিন্তা, খোলামেলা পরিবেশ যেখানে বহু মতের আদান-প্রদান হয়ে এসেছে সুস্থ-গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়; ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেগুলোই হয়েছে বিজেপি সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম নিশানা। দেশের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই হোক বা শিল্প সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র; বারবার নানা কুৎসা, মিথ্যা প্রচার, ফান্ড কাট, আরএসএস-এর পেটোয়াদের নিযুক্ত করে, সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের হেনস্থা করে সবক সেখানোর চেষ্টা চলছে। পরিকল্পিতভাবে সিস্টেম্যাটিক আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। আর এতেও না হলে হয়েছে সরাসরি হামলা, মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তারি। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া, আলীগড়, বেনারস, যাদবপুর, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, এফটিআইআই উদাহরণ ভুরি ভুরি। বিজেপি-আরএসএস-র আক্রমণের ধরন বহুমুখী, যার পরিকল্পনা চলছে বহু বছর ধরে। ক্ষমতায় এসে একদিকে কৃষি আইন, শ্রম কোড, নয়া শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে কৃষক শ্রমিক ছাত্রদের অধিকার কেড়ে নেওয়া, সিএএ–এনআরসি লাগু করে নাগরিকতার অধিকার কেড়ে নেওয়া, যেকোনো বিরোধী মত প্রকাশের অধিকারের উপরে আঘাত, সংবিধানকে নস্যাৎ করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্র এগুলো হচ্ছে সরাসরি দিনের আলোয়; প্রয়োজনে আইন বা সাংবিধানিক ধারা বদলে ফেলে। সংখ্যালঘু, দলিত ও মহিলাদের উপর নিপীড়নকে ‘নিউ নরমাল’ বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক হামলার পাশাপাশি নিরন্তর চলছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দখলদারি। দেশের বহু ভাষার-বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের’ ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়ার ছক চলছে। আর এখানেই বিজেপি দেশের আর পাঁচটা শাসক দলের থেকে আলাদা। এই ফ্যাসিস্ত বিজেপিকে ভারতবর্ষের সমস্ত পরিসর থেকে ছুঁড়ে ফেলা তাই আজ দেশকে রক্ষা করার প্রাথমিক শর্ত।
কলকাতার কলেজপাড়া বইপাড়া স্বাধীনতার আগের সময় থেকে বহু গণআন্দোলনের সাক্ষী। শিক্ষা সংস্কৃতি মননের জগতেও বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে এই অঞ্চল। শ্রমজীবী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, শিল্পী বিভিন্ন মানুষকে দুই বাহু প্রসারিত করে গ্রহণ করেছে এই এলাকা। বিবিধ রাজনৈতিক মতের আদান-প্রদান চলেছে একই টেবিলে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে। নিজের মত প্রকাশ করতে দুবার ভাবতে হয়নি কাউকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলেছে নির্মাণ ও বিনির্মাণ। মগজে কার্ফু নামানো হিন্দুত্ববাদি গেরুয়া বাহিনী এখানে কোনো দিনই কল্কে পায়নি। আর তাই এবার তাদের নিশানায় এসেছে কফি হাউজ। তাদের নিশানার আসবে রাজ্যের সমস্ত গণতান্ত্রিক মুক্ত চিন্তার পরিসর। যারা বাংলার বহুত্ববাদী সংস্কৃতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, যারা মিছিল করে গিয়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গে, যারা সিলেবাস থেকে রবি ঠাকুরের লেখা বাদ দেয়, বিশ্বাসঘাতকতা আর ব্রিটিশদের দালালি করা ছাড়া যাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো ভূমিকা নেই; তাদের কোনো জায়গা এই প্রীতিলতা-সূর্য সেন-সুভাস বোস-ক্ষুদিরাম-এর মাটিতে নেই। আক্রমণ নয়, শেষ কথা বলে প্রতিবাদ প্রতিরোধ। আগামী নির্বাচনে তাই ফ্যাসিস্ত বিজেপিকে একটিও ভোট নয়।
মানুষের মতামত শোনা হবে বলে রাজ্যের সমস্ত বিধানসভা কেন্দ্রে রথ ঘোরানোর কর্মসূচী নিয়েছিল বিজেপি। প্রতিটি রথে থাকার কথা ছিল একশটি করে ড্রপ বক্স! মোট প্রায় ত্রিশ হাজার বাক্স। লক্ষ্যমাত্রা নাকি দু’কোটি লোকের মত নেওয়া! নির্বাচনী ইস্তাহার তৈরির নামে। শুনে অবাক লাগারই কথা! কারণ কর্পোরেটমুখী সাম্প্রায়িক মুখের বিজেপি কবে আর মানুষের অভাব, অভিযোগ, দাবি বা মনের কথা শুনতে চেয়েছে! বরং পরিহাসের ব্যাপার হল, উল্টোটাই সত্য। শোনানো হয় কেবল প্রধানমন্ত্রী মোদী’র ‘মন কী বাত’। প্রশ্ন হল, মত শোনার রথ পরিক্রমা কি সারা হয়েছে? বাক্স কি আদৌ ছিল? সংখ্যায় কত? কি কি বিষয়ে জিজ্ঞাসা, অভিমত জমা পড়েছে? কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ কি উত্থাপিত হয়েছ?। কারণ, প্রশ্নটা একদিকে ভীষণ জ্বলন্ত, অন্যদিকে তার প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রশ্নে রাজ্যের মমতা সরকারের যাইই ব্যর্থতা থাক, কেন্দ্রের মোদী সরকারের ভূমিকা ভয়ঙ্কর প্রতারণামূলক। কারণ, ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার পরপরেই বছরে দু’কোটি হাতে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ধরা পড়ে গিয়েছিল। অমিত শাহ নিজেই পরে প্রশ্নের চাপের মুখে বলেছিলেন, ওটা ছিল ‘জুমলা’, মানে নির্বাচনী ইস্তাহারে নিছক বলার জন্য বলা। মোদী উপরন্তু করেছিলেন আরও ঠাট্টাতামাশা, বলেছিলেন — নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে পকোড়া ভাজার দোকান খোলায়! ২০১৯-এ ফের ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদী সরকার এ নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। বরং বলতে শুরু করে, এমন ‘নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করা হচ্ছে, যাতে কর্মসংস্থানের জন্য যুবশক্তি নিজেদের কাজের ব্যবস্থা নিজেরা করে নেবে, সরকারের ওপর নির্ভর হয়ে থাকতে হবে না। এভাবে কর্মসংস্থানের রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্ব অস্বীকারের বজ্জাতি চালিয়ে আসা হচ্ছে।
এখন পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী পরিস্থিতির মুখে বিজেপি পড়েছে খুব মুশকিলে। মোদী সরকার খুব কয়লা চোর ধরার ধূয়ো তুলে সিবিআই হানা চালাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হয়না স্রেফ বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে। অন্যদিকে খোদ কোল ইন্ডিয়াকে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় একশটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার মতলব এঁটেছে। বেচে দেওয়া হবে ‘সেল’-রেল-ব্যাঙ্ক-বীমা-বিএসএনএল-এর হেফাজতে থাকা জমিজমা। কেন্দ্র কর্মসংস্থান করার ভাবনার ধারে-কাছে নেই। উল্টে ফন্দি আঁটছে উপরোক্ত সংস্থাগুলোর মোট প্রায় দু’হাজার একর জমি বেচে দেওয়ার। সরকারের লক্ষ্য কোষাগারে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা তোলা। সব কর্পোরেট পুঁজির কাছে দেওয়া।
গত বছরে অতিমারী পরিস্থিতিতে পর্যায় ভিত্তিক শ্রম সমীক্ষায় ধরা পড়ে লক ডাউনের পরিণামে যথেষ্ট বেড়ে যায় শহরাঞ্চলের বেকারির তীব্রতা। ২০১৯-র অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেকারি ছিল ৭.৯ শতাংশ। ২০২০-র জানুয়ারি-মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯.১ শতাংশ। আর তার পরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে বেকারি পৌঁছে যায় ২০.৯ শতাংশে! মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ছেয়ে যায় প্রায় তিনগুণ বেকারি বৃদ্ধিতে। সব বয়সী বেকাররাই এর শিকার হন। বিশেষ করে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী বেকারির হার ছিল ৩৪.৭ শতাংশ। এপ্রিল-জুন পর্যায়ে বেকারি বৃদ্ধির প্রথম তিন স্থানে ছিল মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড ও মধ্যপ্রদেশ; যথাক্রমে ৩৫.৬, ৩২ ও ২৮.৯ শতাংশ। কোনও রাজ্য ১০ শতাংশের নীচে থাকেনি। পশ্চিমবঙ্গেও এই সমস্যা পৌঁছায় বেশ চড়া মাত্রায়। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ রাজ্যে ফিরে আসে, কাজ হারিয়ে, মজুরি না পেয়ে, বিপর্যস্ত হয়ে; ঘরে ফিরেও সেই একই দূর্ভোগ, পোহাতে হয় জীবিকার উপায় না মেলা জীবন। লক-ডাউন উঠে যাওয়ার পরেও অবস্থার কোনও গুণগত পুনরুজ্জীবন হয়নি। সঙ্গত অধিকার, সুরক্ষা ও মর্যাদা সম্পন্ন কাজের সুযোগ বা পরিবেশ ফিরে পাওয়ার প্রবাহ শতাংশের বিচারে এখনও হতাশাব্যঞ্জক। এই পরিণতির দায় অস্বীকার করতে পারেনা রাজ্য সরকার। তবে সবচেয়ে দায়ী কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। লক ডাউন পর্বে কেন্দ্র বিমুখ ছিল কাজ হারানো শ্রমজীবীদের প্রতি, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি।
সেই বিজেপি এখন এরাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য মরীয়া, তাই যা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাও বলছে। মিথ্যাচার ও ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে। বলছে ক্ষমতায় আনলে সবার হাতে কাজের ব্যবস্থা করবে! কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খোলার জন্য ডবল ইঞ্জিনের সরকার চাই! কৈ বন্ধ হয়ে থাকা একটিও নির্দিষ্ট সংস্থা নিয়ে, যেমন ডানলপ খোলার ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট কথা তো দিচ্ছে না। কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বন্ধ কলকারখানা, যেমন বন্ধ চা বাগান খোলার তো নির্দিষ্ট কোনও প্রতিশ্রুতি নেই। একদিকে কারখানা বন্ধের জন্য কেবল শ্রমিক আন্দোলনকে কাঠগড়ায় তোলা, অন্যদিকে বিজেপিকে ‘ক্ষমতায় আনলে সব মুশকিল আসান হবে’ — এহেন মোহ বিস্তারের জন্য কতই না অপচেষ্টা। বিজেপি এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনে ‘চাকরির প্রতিশ্রুতি’ দেওয়া কার্ড প্রকাশ করেছে, বাড়ি বাড়ি বেশ কিছু বিলি করেছে, এমনকি ‘আবেদনপত্র’ও পূরণ করিয়েছে! এভাবে কর্মসংস্থানের জ্বলন্ত দাবি নিয়ে ধোঁকাবাজি ও বশীকরণের অবৈধ কারবার চালাচ্ছে, এই হচ্ছে বিজেপি। এই বিজেপিকে তাই বুঝে নিতে হবে, বুঝিয়েও দিতে হবে — ভোট নয়, ভোট নয়।
ভারতে ২০২১-এর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হল বিষণ্ণ ও ভয়াল পরিস্থিতিতে। ভারতের বর্তমান শাসকরা “নারীর ক্ষমতা”, “নারীর ক্ষমতায়ন” এবং “নারীর কীর্তি”র মতো ছেঁদো বুলি তুলে ধরেন, তার সাথেই নারীর সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে এমন মনোভাব ব্যক্ত করেন যা একেবারেই মার্কামারা ফ্যাসিস্ট ধ্যানধারণারই শামিল। কিন্তু সারা ভারতে নারী আন্দোলনের কাছে নারী দিবস ছিল তাদের ঐক্যকে জোরদার করা এবং একেবারে তাদের অস্তিত্বের ওপরই নামিয়ে আনা অভূতপূর্ব মাত্রার আক্রমণকে প্রতিরোধ করার এক উপলক্ষ। কেন্দ্রে মোদী সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় নারী আন্দোলন এমন আক্রমণের মুখে পড়েছে যার নজির অভূতপূর্ব।
নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রী টুইট করে তাঁর ভাষায় যা “অজেয় নারী শক্তি” এবং “আমাদের দেশের নারীদের বহু কীর্তি দেশের গর্ব” তাকে অভিবাদন জানান। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বার্তা একেবারে নাজি ও মনুবাদীদের নির্দেশ-পুস্তিকা থেকে তুলে আনা। প্রশংসার ছদ্ম আবরণে ব্যক্ত হলেও ঐ বার্তা ছিল নারীদের প্রতি এক নৈতিক উপদেশ, যাতে নারীদের জন্য হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সামাজিক ভূমিকা ও কর্তব্যমালাকেই মনে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নারীদের অবশ্যই “পরিবার ও গৃহকে নির্মাণ করতে হবে, শিশুদের লালন-পালন করতে হবে এবং তাদের সু-নাগরিকে পরিণত করতে হবে”, যাতে তারা “এক আদর্শ পরিবার, আদর্শ সমাজ এবং আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে” অবদান রাখতে পারে। এই বার্তার মধ্যে রয়েছে সেই নাজি শ্লোগানেরই প্রতিধ্বনি যাতে নারীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে জাতির সেবায় তারা যেন “শিশু, রন্ধনশালা, চার্চ”-এর মধ্যে নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ করে রাখে। তাঁর এই বার্তায় রয়েছে ২০০৯ সালে লেখা তাঁর এক নিবন্ধেরই নির্যাস, যাতে তিনি এই যুক্তিতে বিধানসভা ও সংসদে নারীদের সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিলেন যে, পুরুষরা রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনতাকে অবাধ করে তুললে তাতে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং নারীরাও দানবে পরিণত হবে।
যোগী শাসিত উত্তরপ্রদেশকে বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্রের এক পরীক্ষাগার রূপেই জাহির করে। এই রাজ্যে কিন্তু বারবারই ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে, আর ধর্ষকদের রক্ষা করতে এবং ধর্ষণের পর বেঁচে যাওয়া নারীদের, ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যদের এবং ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলনকে হুমকি দিতে ও দমিয়ে রাখতে পুলিশ ও বিজেপি নেতারা পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলায়। উত্তরপ্রদেশ আবার হল সেই রাজ্য যা ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মের নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রতিহত করতে আইন প্রবর্তনে পথ দেখায়, যে আইন নাজি জার্মানি এবং বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ নিরোধক কুখ্যাত আইনকে মনে পড়িয়ে দেয়।
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনেই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ধর্ষণে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির উদ্দেশ্যে করা তাঁরা এই মন্তব্যের ন্যায্যতা প্রতিপাদনে উঠেপড়ে লাগলেন —”তুমি কি ওকে বিয়ে করবে (ধর্ষিতাকে)? যদি রাজি হও আমরা সাহায্য করতে পারি। অন্যথায় চাকরি খুইয়ে তোমাকে জেলে যেতে হবে।” প্রধান বিচারপতির সমর্থনে এগিয়ে এসে ভারত সরকারের প্রতিনিধি সলিসিটর জেনারেল ঘোষণা করলেন, ধর্ষিতাকে বিয়ে করবে কিনা সে কথা ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিগ্যেস করাটা প্রধান বিচারপতির পক্ষে “পুরোপুরি বৈধ” ছিল। প্রায় ১০০০০ স্বাক্ষরকারী এক খোলা চিঠিতে দাবি জানিয়েছিলেন, বোবডে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করুন, কেননা, ঐ পদে থেকে ধর্ষণ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য সমস্ত নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে ও তাদের বিপন্নতা বাড়িয়েছে। ঐ চিঠি প্রকাশের পরও প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের সমর্থনে এই যুক্তিগুলো নামানো হল যা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হয়ে দেখা দিল। তাঁদের মন্তব্যের জন্য প্রধান বিচারপতি এবং সলিসিটর জেনারেল কোনো ধরনের অনুশোচনা প্রকাশ তো করলেনই না, বিপরীতে, যেটাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না তাকে সমর্থন করতে দুজনে একজোট হলেন। ভারতে বিচার বিভাগের দিক থেকে যে সমস্ত আইনগ্রাহ্য নজির রয়েছে এবং যে সমস্ত প্রথা চলে এসেছে, সেগুলোর কোনো তোয়াক্কা না করে ভারতের বর্তমান প্রশাসন ও বিচার বিভাগের এই দুই প্রতিনিধি এই অভিমতের প্রতিই অনড় রইলেন যে, ধর্ষণে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির জামিনের আবেদনের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে অভিযুক্ত ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে রাজি আছে কিনা সে সম্বন্ধে তাকে জিগ্যেস করাটা প্রাসঙ্গিক।
প্রধান বিচারপতির এই আখ্যানটাই আমাদের বলে দিচ্ছে যে, নারীদের বুনিয়াদি অধিকার ও মর্যাদা কিভাবে বিপজ্জনক মতাদর্শের কবলগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে মতাদর্শই আজ ভারতীয় রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলোকে গ্রাস করেছে এবং সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কুৎসিত ও উৎকট নারী বিদ্বেষের স্বাক্ষর রেখেও পার পেয়ে যাবার সামর্থ্য বোবডের মতো ব্যক্তিদের রয়েছে। এই ধরনের ব্যক্তিরা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষে আসীন হলে নারীদের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করতে পারবে বলে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা রাখা যাবে কিভাবে, যে স্বাধীনতা প্রতিদিনই বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকার এবং বিজেপি নিয়ন্ত্রিত আইনসভার হাতে আক্রান্ত হচ্ছে?
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঐতিহ্য শুরু হয় এক শতকেরও বেশি সময়কাল আগে যখন নারী শ্রমিক এবং কমিউনিস্ট মতাদর্শের নারীরা তাঁদের অধিকার ও সমতার আত্মঘোষণা করেছিলেন। আজ সারা ভারতে নারী শ্রমিকরা, সরকারি প্রকল্পগুলোতে নিয়োজিত, কারখানাগুলোতে ও মাঠেঘাটে, পুরসভাগুলোতে কাজ করা নারীরা আইনি সুরক্ষাগুলোর বিলুপ্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। যে দুঃসহ পরিস্থিতিতে তাঁদের কাজ করতে হয় তা ঊনবিংশ শতকের পুঁজিবাদকেই মনে পড়িয়ে দেয়। আদানি ও আম্বানীর মতো মোদীর যে স্যাঙাতরা “কোম্পানিরাজ”-এর প্রতিনিধি হয়ে রয়েছেন, তার হানাদারির হাত থেকে কৃষির রক্ষায় কৃষকদের যে আন্দোলন চলছে তার সম্মুখ সারিতে রয়েছে নারী কৃষকরা। নারীরা সিএএ আইন বিরোধী লড়াইয়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে আইন নাগরিকত্ব সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষ-বিরোধী এবং গণতন্ত্র-বিরোধী এক ধারণার প্রবর্তন ঘটিয়ে ভারতীয় সংবিধানকেই ওলটপালট করে দিচ্ছে। এই উল্লেখযোগ্য আন্দোলনগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, সফুরা ইসরত, গুলফিসা, নাতাশা, দেবাঙ্গনা, দিশা রবি, নিকিতা জেকব ও নোদীপ কউর-এর মতো মেয়েরা; মোদী সরকার ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনে তাদের জেলে পুরছে।
জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের কর্মী তরুণী গ্ৰেটা থুনবার্গের কথাগুলো সহজ করে বললে দাঁড়ায়, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এবং অন্য প্রতিটা দিবসে নারীরা যা চায় তা অভিবাদন বা উদযাপন নয় — বরং তা হল সমানাধিকার ও স্বাধীনতা, এবং সমানাধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদ ও নারীবাদী-বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ে সমর্থন প্রদান।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৯ মার্চ ২০২১)
মন্তেশ্বর বিধানসভা ১৭টি গ্রামপঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে মন্তেশ্বর ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও মেমারী ২নং ব্লকের ৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত। এই বিধানসভা এলাকায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের শক্তিশালী সংগঠন আছে বলা যায় না। মন্তেশ্বর ব্লকের ৪টা গ্রাম পঞ্চায়েত ও মেমারী ২নং ব্লকের ৩টা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার কিছু গ্রামে কম-বেশী সংগঠন আছে। বিগত লকডাউন সময়ে ব্যাপক পরিযায়ী শ্রমিক এই বিধানসভার গ্রামাঞ্চলের মেহনতি মানুষ বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়েন এবং চরম অর্থনৈতিক ও খাদ্য সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তখন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কর্মীরা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির সদস্য ও এলাকার নেতা কমরেড আনসারুল আমান মন্ডলের নেতৃত্বে উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সংগঠন মারফত এবং সরাসরি সেই সব রাজ্যের প্রশাসনকে জানিয়ে ঐ সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। এবং এলাকার গরিব মানুষের দুরবস্থার মোকাবিলার জন্য এক দিকে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা অন্যদিকে নিজেরা ত্রাণ সংগ্রহ করে গরিব মানুষের বন্টনের ব্যবস্থা করা হয়। এই সমস্ত কার্যক্রম এলাকার মানুষের মধ্যে ভালো প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার মধ্যেই ঘরে ফেরার পর ব্যাপক পরিযায়ী শ্রমিক সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাদের এলাকায় ১০০ দিনের কাজ দেওয়ার দাবি, জবকার্ড পাওয়ার দাবি ও লকডাউন ভাতা বা অনুদানের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। রেশনকার্ড খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন চলছিল এই সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর একটি সমীক্ষার ফর্ম পূরণ করার জন্য দেওয়া হলে ৫টা গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে ১৫ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক তাদের ফর্ম পূরণ করে সংগঠনের কাছে জমা দেন। প্রায় ২৫০০ পরিযায়ী শ্রমিকদের ফোন নম্বর ও হোয়াটসপ নম্বর সংগঠনের কাছে আছে। যাদেরকে নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ার গ্রুপ চালানোর চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যেই গ্রামীণ মহিলাদের ঋণের কিস্তি আদায়ের জন্য মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের জুলুম নির্যাতন বেড়ে চলছিল। তাই ঋণ মকুব এবং কিস্তি আদায় স্থগিত রাখাও এজেন্টদের জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঋণগ্রস্ত মহিলাদের নিয়ে ঋণ মুক্তিকমিটির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিছু কিছু গ্রামে এই আন্দোলনের ভাল উৎসাহ তৈরি করে।
তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই ব্লকে কোনো বিরোধী দল জনগণের কোনো দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার শাহস বা উদ্যোগ নিতে পারছিলনা। তাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগগুলো এক দিকে জনগণের মধ্যে আশা সঞ্চার করেছিল অন্য দিকে শাসক তৃণমূলের গাত্রদাহের কারণ হয়ে ওঠে। তৃণমূলের তোলাবাজির স্বীকার ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষের কেউ কেউ সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকেন। সিপিএমের সমর্থনে থাকা গরিব মেহনতীদের মধ্যে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল বিভিন্ন ভাবেই সিপিআই(এমএল)-কে মোকাবিলার চেষ্টাও শুরু করে। সন্ত্রাস দেখিয়ে সাধারণ কর্মীদের দমিয়ে দেওয়া মিথ্যা মামলার মাধ্যমে পুলিশ দিয়ে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে দমন করতে চেষ্টা করে।
এই সব মোকাবিলা করারমধ্য দিয়েই আন্দোলন চালিয়ে যেতে। কেন্দ্রের কৃষক বিরোধী তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুত বিল ২০২০ বাতিলের দাবিতে বার বার সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও তাঁর গণ সংগঠন এআইকেএম, আয়ারলা, আরওয়াইএ এবং এআইএসএ-র উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করা হয়। এআইকেএসসিসি-র নেতৃত্বে যৌথ উদ্যোগে বহু আন্দোলন সংগঠিত হয়। বিদ্যুতের অতিরিক্ত বিল চাপানোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ গ্রামের কৃষকদের নিয়ে ব্যানার ছাড়াই সংগঠিত করা হয়। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সংহতিমূলক টাক্টর মিছিল ও শহীদের স্মরণে অনুষ্ঠান ও প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। আর এইসব জনগণের জীবন-জীবিকার দাবির আন্দোলনকে শক্তিশালী ও এগিয়ে নেওয়ার জন্যই বিধানসভার নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রধান প্রচারের এজেন্ডা হিসেবেই থাকছে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রার্থী আনসারুল আমান মন্ডলের নামে পতাকার মধ্যে তিন তারা চিহ্ন নিয়ে ক্যালেন্ডার করা হয়েছে। ব্লক নির্বাচনী টিম তৈরি হয়েছে। ভাল সংখ্যক দেওয়াল লিখন হয়েছে। প্রচারের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
১৪ মার্চ হুগলির ধনিয়াখালি বিধান সভা কেন্দ্রের সিপিআই(এমএল) প্রার্থী কমরেড সজল কুমার দে-র সমর্থনে ধনিয়াখালি বাজার ও সংলগ্ন এলাকায় এক প্রচার পরিক্রমা হয়। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে স্থানীয় সংগঠক অর্পিতা রায় ও ঋণ মুক্তি আন্দোলনের অগ্রনী কর্মী রুমা আহিরি-র নেতৃত্বে ভালো সংখ্যক মহিলা এই পরিক্রমায় সামিল হয়েছিলেন। কমরেড সজল দে-র সঙ্গে যুবক কমরেডরাও ছিলেন। ধনিয়াখালির কলেজ মোড় থেকে বিকেল ৪টেয় প্রচার শুরু হয়। পাড়ার ভিতর দিয়ে বাজার চত্বর ঘুরে মদনমোহন তলায় সন্ধ্যা ৭টায় প্রচার শেষ হয়।
তিন তারা পতাকায় সুসজ্জিত টোটো থেকে মাইকে স্থানীয় ও রাজ্য ইস্যুতে, বিশেষতঃ বিজেপির জনবিরোধী নীতি ও কার্য কলাপের বিরুদ্ধে জীবন্ত বক্তব্য রাখতে থাকেন কমরেড শ্রাবণী মালিক। এলাকার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তা শোনেন। জনবহুল মোড়ে মোড়ে বক্তব্য রাখা হচ্ছিল, প্রার্থী পরিচিতি চলছিল। প্রচার চলাকালীন আমাদের প্রার্থী যেভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন, হাত মেলাচ্ছিলেন তা থেকে বোঝা যাচ্ছিল তিনি এলাকায় আন্দোলনের মুখ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত। পথ চলতি মানুষ ও দোকানীরা আগ্রহের সাথে সমিতির ও পার্টির প্রচারপএ নেন এবং বক্তব্যও শোনেন। বক্তব্য রাখেন, অর্পিতা, রুমা, রাজ্য নেত্রী চন্দ্রাসমিতা চৌধুরী ও চৈতালি সেন এবং সৌমি জানা।
দিল্লী সীমান্তে কৃষকদের ঐতিহাসিক অবস্থান আন্দোলন ১০০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার (এআইকেএসসিসি) সর্বভারতীয় নেতৃত্ব আন্দোলনের বার্তাকে সরাসরি পশ্চিমবাংলা সহ পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এই লক্ষ্যে সর্বপ্রথম কলকাতার রামলীলা পার্কে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গ কৃষক-মজুর মহাপঞ্চায়েত। মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে সর্বভারতীয় কৃষক নেতারা কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন করার পর সেখান থেকে রামলীলা পার্ক পর্যন্ত এক মহামিছিলের আয়োজন করেন। এই মিছিলের পুরোভাগে ছিল একাধিক ট্রাক্টর-যেগুলির সওয়ার হয়েছিলেন সুদূর পাঞ্জাবের লায়ালপুর থেকে আগত কৃষক নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও। এ ছিল মহানগরী কলকাতায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আর এই মিছিলে দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন ছাত্র-যুব, নাগরিক সমাজ। লাল ঝান্ডার পাশাপাশি হলুদ ও সবুজ ঝান্ডার এই বর্ণময় মিছিলের আর এক অবিষ্মরণীয় দিক ছিল কলকাতার স্থানীয় পাঞ্জাবী জনগণের বিশেষত শিখদের বড় আকারে অংশ গ্রহণ। বলতে কি, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা ১৯৮৪ সালের পর এইদিন আরও একবার কলকাতার জনজীবনে নজর টানলেন। ১৯৮৪-তে নজরে এসেছিল তাঁদের অশ্রুসজল, ভয়ার্ত মুখ আর এবার নজরে এসেছিল তাঁদের খুশীতে উজ্জ্বল মুখগুলি — যা বলছিল, ‘আমরাই পারি। অন্নদাতা কৃষকদের সামনে থেকে আমরাই পেরেছি মোদি সরকারকে হেলিয়ে দিতে।’
কৃষক-মজুর মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বলবীর সিং রাজওয়াল, যোগেন্দ্র যাদব, গুরনাম সিং চাডুনি, মেধা পাটকর, রাজারাম সিং, অতুল অঞ্জন, ডঃ সুনীলম, সত্যবান, হিমাংশু তেওয়ারি, হান্নান মোল্লা প্রমুখ সুখ্যাত কৃষক নেতারা। সভার শুরুতেই বাবুনি মজুমদারের উদাত্ত কণ্ঠে গান, ‘মরা গাঙে তোলরে তুফান কিষাণ জোয়ারে’ — মহাপঞ্চায়েতের চমৎকার আবহ গড়ে দেয়। সভা পরিচালনা করেন কার্তিক পাল, অমল হালদার ও অভিক সাহা। সভার প্রারম্ভিক বক্তা ছিলেন বলবীর সিং রাজওয়াল। তিনি তাঁর দীর্ঘ ভাষণে তিন কৃষি আইনের সর্বনাশা দিকগুলি বিস্তারে ব্যাখ্যা করার সাথে সাথে দিল্লী সীমান্তে লাগাতার অবস্থানের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন এবং মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। শ্রী রাজওয়ালের সাথে সাথে প্রত্যেক বক্তাই জানিয়ে দেন, তাঁরা শুধু সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের বার্তা শোনাতেই এরাজ্যে আসেননি, তাঁরা এসেছেন এরাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষক বিরোধী বিজেপিকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করার আহ্বান জানাতে। মেধা পাটকর তাঁর সাবলীল কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন, ‘খেতি বাঁচাও, দেশ বাঁচাও।’ হান্নান মোল্লা বলেন, ‘মোদি-অমিত শাহেরা বলছেন, এই আন্দোলন নাকি শুধু পাঞ্জাবীদের আন্দোলন। তাহলে দেশের ৬০০টি স্থানে ‘রেল রোকো’ হল কীভাবে?” তিনি উল্লেখ করেন, এ রাজ্যেও কৃষকরা ফসলের সরকার ঘোষিত দাম পান না। রাজারাম সিং বলেন, ‘চুক্তি চাষ ব্যাপক হারে চালু হলে কার্যত কোম্পানিরাজ কায়েম হবে যেখানে বর্গাদাররাও চাষের অধিকার হারাবেন। এমএসপি-র গ্যারান্টি না থাকায় ভবিষ্যতে সরকার ফসল না কিনলে খেতমজুর ও দরিদ্র মানুষরা আর রেশন পাবেন না।’
মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চ থেকে নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরেও এই ধরনের মহাপঞ্চায়েত সংগঠিত করার ঘোষণা করা হয়েছে। স্পষ্টতই কৃষক-মজুদের এই মহাপঞ্চায়েত বিজেপির বঙ্গ বিজয়ের পথে এক রাশ কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৃষক নেতারা এরপর আসাম, উরিষ্যা, কর্নাটক প্রভৃতি রাজ্যগুলিতেও সফর করবেন এবং অন্নদাতা কৃষকদের স্বার্থে বিজেপিকে সর্বতোভাবে রুখে দেওয়ার বার্তা দেবেন।
এবারের বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২টি সরকারি ব্যাঙ্ক প্রাইভেট মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা করেন। ঠিক কোন দুটি ব্যাঙ্ক সে বিষয়ে নির্দিষ্ট উল্লেখ না হলেও সাম্প্রতিক কালে ব্যাঙ্ক সংযুক্তি (মার্জার) প্রক্রিয়ার বাহিরে থাকা ব্যাঙ্ক গুলির মধ্য থেকে কোন দুটি কে বেঁচে দেওয়া হবে। এই তালিকায় যে ব্যাঙ্ক গুলি আছে তা হল ইউকো ব্যাঙ্ক, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাব এন্ড সিন্ধ ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কগুলির সদর দফতর দেশের উত্তর, দক্ষিণ, পুর্ব, পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এবং ৫১ বছর আগে সরকারের মাধ্যমে জনসাধারণের মালিকানায় এসেছিল। অর্থমন্ত্রী আরো জানান যে সরকার আইডিবিআই ব্যাঙ্ক বিক্রি করে দিতে চায় এবং সাধারন বীমা (জিআইসি) বেসরকারি হাতে তুলে দেবে।রাষ্ট্রায়ত্ত জীবনবীমা (এলআইসি) নিগমেও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বর্তমান ৪৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। যার অর্থ হল এল আই সি শুধু বেসরকারি হচ্ছে না এখন থেকে সেটি একটি বিদেশি সংস্থায় পরিণত হবে।
সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরেই বিজেপি সরকার এই সব পদক্ষেপ নিতে পারছে সে কথা বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশে আধুনিক ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠার এক ইতিহাস আছে। কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বম্বে প্রেসিডেন্সিতে যে তিনটি ব্রিটিশ ব্যাঙ্কগুলি ছিল সেগুলি একত্রিত হয়ে ১৯২১ সালে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আইবিআই) গঠিত হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তারমধ্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দর্শনই ১৯৫৫ সালে পন্ডিত নেহেরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ককে ভারতের স্টেট ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত করে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ১৯৬৯ সালে ১৪টি এবং ১৯৮০ সালে আরও ৬টি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসেন। এখানে উল্যেখ করাই যায় যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহ দেশের প্রগতির জন্য সরকারি ক্ষেত্র নির্মানের আবশ্যকতা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই কংগ্রেসের মঞ্চে উচ্চারিত হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান বিজেপি এবং পুর্বসুরী জন সংঘ শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করেছে। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম ২২ বছরে ৫৫৯টি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক ডুবেছে। বিগত পঞ্চাশ বছরে ৩৬টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক সরকারি ব্যাঙ্ককে বিলীন করে দিয়ে সাধারণ গ্রাহকের আমানত এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয় রক্ষা পেয়েছে।
মোট ৩০টি সরকারি ব্যাঙ্কের যায়গায় এখন ১২টি ব্যাঙ্ক কাজ করছে। সরকার ৪/৫টি হাতে রেখে সবই বেঁচে দিতে চায়। কারণ ‘সরকারে কাজ ব্যাবসা করা নয়’। অন্য একটি কারণ হল ভারত সরকার এই সব বিক্রি বাট্টার অর্থ দিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে চায়।ব্যাঙ্ক সরকারের জন্য আয় করতে পারছে না বা লোকসানে চলছে এমন নয়। ২০২০ মার্চ সরকারি ব্যানকের মোট মুনাফা ১ লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। কর্মচারীদের বেতন সহ সমস্ত খরচ মেটানোর পরই এই লাভের অঙ্ক। কিন্তু ২ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের হিসাব মিটিয়ে ব্যাঙ্ক গুলির খাতায় ২৬০০০ কোটি টাকা লোকসান লেখা হল। নরেন্দ্র মোদী সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত ১৮ লক্ষ কোটি টাকা এনপিএ হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা আদায় হয়েছে অন্যদিকে আনুমানিক সাত লক্ষ কোটি টাকা সরাসরি খাতা থেকে বাদ (রাইট অফ) দেওয়া হয়েছে।
এবারের ধর্মঘটে সারাদেশে দশ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মচারী প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নেন। পশ্চিমবাংলায় আট হাজারের অধিক ব্যাঙ্ক শাখা, দশ হাজার এটিএম এবং প্রায় ৩০ হাজার ব্যাঙ্ক মিত্র, যারা গ্রামে বাস গ্রামে কিয়ক্স পয়েন্টের মাধ্যমে পরিষেবা দেয় দুদিন কাজ বন্ধ রাখেন। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরাও ধর্মঘটী কর্মচারিদের সঙ্গে থেকেছেন। সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সাথে সাথে কৃশান আন্দোলনের নেতারাও এই ধর্মঘটের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন। সরকার কৃষি কে করপোরেট দের হাতে দিতে চায়। ভারতীয় করপোরেট রা তাদের কৃষি ব্যাবসার জন্য টাকার যোগান পাবে সরকারি ব্যাঙ্ক গুলি কমদামে কিনে নিয়ে। সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে আজকের দিন পর্যন্ত দেশের মানুষ জমা রেখেছেন ১৫৬ লক্ষ কোটি টাকা। লোভী করপোরেট দের লক্ষ্য হল টাকাটা হাতিয়ে নেওয়া। বিজেপি সরকার তাই প্রভুর স্বার্থ রক্ষায় পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে।
ত্রিপুরা ও বিহার
বাংলার দুই প্রতিবেশী রাজ্যের দিকে চোখ ফেরানো যাক। দু’টোই বিজেপি শাসিত। চলছে ডবল ইঞ্জিনের সরকার। বিহারে এনডিএ ক্ষমতায় আসলে নাছোড় বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল নীতিশ-বিজেপি জোটের। এদিকে, সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত বিহারে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের ও বেশি — এতো দীর্ঘ সময় ধরে বিহার রাজ্য এর আগে কোনোদিন এরকম সুউচ্চ বেকারত্বের হার আগে কখনও দেখেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হলো এক মর্মান্তিক ঘটনা। লকডাউন পরবর্তী সময়ে তীব্র আর্থিক সংকটে বেসামাল ও জর্জরিত ৫ জনের একটা গোটা পরিবার একসাথে আত্মহত্যা করলো বিহারের সাপৌল জেলার এক গ্রামে। আর, এই ঘটনা সামনে আসতেই আবার নতুন করে লকডাউন পরবর্তী চূড়ান্ত দুর্দশার একের পর উদাহরণগুলো সামনে চলে আসছে।
পাশ্ববর্তী রাজ্য ত্রিপুরা। বিরোধী দলগুলোর উপর স্টিমরোলার চালিয়ে যে কোনো প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার পাশাপাশি এবার সেখানে শুরু হয়েছে সরকারি স্থায়ী চাকরি লোপাটের রাষ্ট্রীয় অভিযান। ত্রিপুরার রাজ্য সরকার এবার সরকারি ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব তুলে দিল বেসরকারি সংস্থার হাতে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের ডাইরেক্টরেট অফ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস অ্যান্ড ম্যানপাওয়ার প্ল্যানিং এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নানা ধরনের কাজে কর্মী নিয়োগের জন্য বেসরকারি সংস্থার কাছে আবেদন করেছে। পাঁচটি বেসরকারি সংস্থার সাথে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী একটা চুক্তি করেছেন, যারা গ্রুপ-ডি থেকে শুরু করে উচ্চতর স্তরে আধিকারিক পর্যায়ে ও সমস্ত ধরনের কর্মী নিয়োগ করবে। এমনকি, ত্রিপুরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় যারা যারা সফল হয়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা ও ওই বেসরকারি সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উল্লিখিত সরকারি দপ্তরের ডিরেক্টর জানিয়েছেন, ওই বেসরকারি এজেন্সিগুলো যতজনকে নিয়োগ করবে, সেই সংখ্যা ও বেতনের উপর রাজ্য সরকার তাদের মাসিক কমিশন দেবে।
এর আগে জানুয়ারি মাসে, রাজ্য শিক্ষামন্ত্রী রতন লাল নাথ বলেছিলেন, তাঁদের সরকার মোট ৬,৯৩৯ জনকে সরকারি চাকরি দিয়েছে, যার মধ্যে ২,৭৩৩ জন পান স্থায়ী চাকরি, ২,২৫০ জনকে নিয়োগ করা হয় ঠিকা কর্মী হিসাবে আর ১,৯৫৬টি সরকারি কাজ বাইরে আউট সোর্স করে দেওয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রীর এই ঘোষণা নসাৎ করে দেয় খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি — তিনি তার ঠিক একমাস আগে, ২০২০-র ডিসেম্বরে বলেন যে তাঁর ৩২ মাসের সরকার ২৩ হাজার জনকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করে। ত্রিপুরার মতো এক শিল্পহীন রাজ্যে যুবসমাজ নির্ভর করে রয়েছেন সরকারি চাকরির উপর। শেষ সম্বলটাও এবার তুলে দিয়ে যুব সমাজের ভবিষ্যৎকে গভীর অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করলো ত্রিপুরার বিজেপির সরকার।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব “ডিজিটাল বিদ্রোহ” আছড়ে পড়তে দেখা গেল। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কর্মী নিয়োগের জন্য যে স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষা হয়, তার ফলাফল বেরোনোর পর পরই একটা টুইটার ঝড় কাঁপিয়ে তোলে সামাজিক মাধ্যমকে। যুব সমাজকে কাজের সুযোগ দিতে অক্ষম কেন্দ্রীয় সরকার #মোদী জব দো বা #মোদী রোজগার দো এই মর্মে এক ঝড় বয়ে যায় যা কার্যত ছিল এক বিদ্রোহ।
স্টাফ সিলেকশন কমিশন হচ্ছে দেশের মধ্যে অন্যতম খুবই প্রতিযোগিতা মূলক এক পরীক্ষা, যা দেবার জন্য ফি বছর লক্ষ লক্ষ আবেদন পত্র জমা পড়ে, কিন্তু দিনের পর দিন এই সরকারি ক্ষেত্রেও চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে মারাত্মক হারে। ২০১৪ সালে যে সরকারি শূন্য পদের সংখ্যা ছিল ১৫,৫০০ মোদী আসার পর তা সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৫০০-তে। পাশাপাশি বেড়েছে এই পরীক্ষাকে ঘিরে নানা কেলেঙ্কারি, সময়মতো পরীক্ষার ফল না প্রকাশ করা, ভুলভাল গ্রেডিং ইত্যাদির মতো নানা ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ।
এ প্রশ্নে এখন আর কোনো বিতর্ক নেই যে মোদীর জমানায় ভারতে আজ কর্মহীনতা পৌঁছেছে আতঙ্কজনক এক অবস্থায়। সিএমআইই-র রিপোর্ট অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তা ৭ শতাংশ হারকেও টপকে গেছে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলো সাকুল্যে ১৪ শতাংশ কর্মসংস্থান জুগিয়েছে। বাদ বাকি জোগায় রাজ্য সরকারগুলো। মূলত গণনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত কাজগুলোর সঙ্গেই তা যুক্ত রয়েছে। রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষেত্রে মোট শূন্যপদের সংখ্যা হচ্ছে ৩৮.৮ লক্ষ, তাও এটা ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান। তারপর থেকে লাগাতারভাবে শূন্যপদের সংখ্যা বেড়েছে, অবলুপ্ত হয়েছে বিপুল পরিমানে সরকারি পদ। এখনো পর্যন্ত সরকার (তা রাজ্যই হোক বা কেন্দ্র) শূন্য পদগুলো পূরণ করার পদক্ষেপ নিলে বেশ কিছু যুব চাকরি পেতো। “ওয়াই পাব্লিক এমপ্লয়মেন্ট ইজ ক্রুসিয়াল ফর অ্যা হেলথি ইকিউটিবল সোসাইটি’’ প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ উল্লিখিত তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন ভারতে সরকারি কর্মসংস্থানের কাঠামোটাই ভারসাম্যহীন ও গলদে ভরা। ২০১৭-১৮-র মধ্যে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোতে কর্মসংস্থান ২.২ লক্ষ হ্রাস প্রাপ্ত হয়, আর এই কর্মী হ্রাসের সবচেয়ে বড় কোপ পড়েছে সাধারণ কর্মীদের উপর, উপরতলার ম্যানেজার বা সুপারভাইজার পদের সাথে যুক্ত কর্মীরা নন। এটাও দেখা যাচ্ছে, সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কন্ট্রাক্ট/ক্যাজুয়াল, দিন মজুরের সংখ্যা বেড়েছে হুহু করে। ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে এই অনেক কম মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত অ সুরক্ষিত, অনিশ্চিত ধরনের কর্মীর সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোট কর্মীবাহিনীর এক তৃতীয়াংশের ও বেশি। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। আইসিডিএস-র অধীনে কর্মরত মোট ১২.৯ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও ১১.৬ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি হেল্পার কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প ও সংস্থায় কর্মরত মোট কর্মীর তুলনায় ৬০ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক অসুরক্ষিত অনিয়মিত কর্মীরাই সরকারি সংস্থার সিংহভাগ অংশ। যারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সরকারি কর্মীদের সমান সুযোগ সুবিধা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়ে পরিষেবা দিয়ে চলেছেন কোনো রকম সরকারি স্বীকৃতি ছাড়াই।
সিএমআইই আরেকটা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছে, বর্তমান ভারতে ৪৮ শতাংশ শহুরে যুবক, যাদের বয়স ২০ থেকে ২৪-র মধ্যে, তারা কর্মহীন। আর, ২৫ শতাংশ স্নাতক কাজ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ মোদীর ভারতে যে যতবেশি শিক্ষিত, সে ঠিক ততটাই বেকার হয়ে পড়ছেন।
কাজ, রোজগার দেওয়া তো দূরে থাক, ডবল ইঞ্জিনের সরকার, মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার কেড়ে নিচ্ছে কাজ, চাকুরির সমস্ত সুযোগ, যা এতোদিন কোনক্রমে বেঁচে বর্তে ছিল। আগামী চার বছরের মধ্যে আরও ১০০ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে তুলে দিয়ে, গোটা দেশকেই হাতে গোনা কয়েকজন সাঙ্গ্যাতের কাছে সঁপে দেওয়ার অভিযানে নেমেছে মোদী সরকার। আর, এই নির্লজ্জ বেহায়া বিজেপি সোনার বাংলা বানানোর আষাঢ়ে গপ্পো ও বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার কথা বলে রাজ্য দখল করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। এর বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।
- অতনু চক্রবর্তী
১০ মার্চ ত্রিপুরায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশান রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, আসন্ন ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদ (টিটিএডিসি) নির্বাচনে গণতন্ত্র প্রিয় নির্বাচক মন্ডলীর কাছে আহ্বান — ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে যে কোনও মূল্যে পরাস্ত করুন। কোনও বিভেদমূলক শক্তিকে ভোট নয়। গণতন্ত্র, ঐক্য ও উন্নয়নের জন্য বিরোধী বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন।
এখন করোনা মহামারী প্রকোপ কমেছে। এমন সময়ে এক বছর পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আমাদের রাজ্যে এডিসিতে নির্বাচন হচ্ছে এবং দেশে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সারা দেশে ও রাজ্যে যে কোন নির্বাচনে গণতন্ত্র প্রিয় ভোটারদের কাছে ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে পরাস্ত করা আজ সাধারণ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। কারণ দ্বিতীয় বার ক্ষমতাসীন হয়ে মোদি সরকার উন্নয়নের নাম করে দেশের সমস্ত সরকারি ও জাতীয় সম্পদকে একে একে দেশী বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে এবং তার জন্য ক্ষমতার কেন্দ্রীকরন বাড়িয়ে তুলেছে। সংসদের ভিতরে বা বাইরে যে কোন বিরোধীতাকে অবদমিত করে চলেছে। এর বিরুদ্ধে জনগণের স্বত:স্ফূর্ত ক্রোধকে ও গণতান্ত্রিক পথে যে কোনও প্রতিবাদ আন্দোলনকে রাষ্ট্র বিরোধী বলে ক্ষমতার বুলডোজার চালিয়ে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। অন্যদিকে আরএসএস দেশের সংবিধান ও প্রজাতন্ত্র কে ধ্বংস করে একটি ফ্যাসিবাদী মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য আধুনিক ভারতের ভিত্তি মূলে আঘাত করে চলেছে। একটি বেসরকারি সংগঠিত শক্তি হিসাবে আরএসএস বেআইনিভাবে সরকারি ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যার ফলে দেশে ও রাজ্যে আজ গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার বিপন্ন। আইনের শাসন নেই। জঙ্গলরাজ কায়েম হয়েছে। আরএসএস-বিজেপির রাজত্বে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুব, নারী ও সব অংশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসী ও জনজাতি জনগণের অধিকার আজ আক্রান্ত ও বিপন্ন। জনগণ আজ বিজেপির শাসন থেকে মুক্তি চাইছেন। তাই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের শত্রু ফ্যসিবাদী বিজেপিকে যে কোন মূল্যে আজ পরাস্ত করা সময়ের দাবি।
তাছাড়া, গত তিন বছরে বিজেপি জোট শাসনে ভিশন ডকুমেন্টে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। এডিসির হাতে আরো বেশি অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করা তো দূরের কথা রাজ্য বাজেটে ফি-বছর বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা এডিসি পায়নি। এডিসির নাম বদল করে ত্রিপুরা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল করা এবং আসন সংখ্যা আটাশ থেকে পঞ্চাশ করা কোথায় হারিয়ে গেল? মানুষ জবাব চাইছে। এডিসি এলাকায় একশটি মডেল ভিলেজ, মিনি সেজ্ গঠন করা, সবার জন্য খাদ্য, বিশুদ্ধ পানীয় জল, আবাসন, স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত করা বাস্তবে মিথ্যাচার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিহারের পরেই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব, ৪২ শতাংশ ত্রিপুরাতে। অথচ সরকারি শূণ্যপদ পূরণ করতে, ব্যাকলগ বজায় রাখতে, বেকার এসটি যুবকদের জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু করতে বিজেপি জোট সরকার ব্যর্থ প্রমানিত হয়েছে। অপরিকল্পিত ও নিষ্ঠুর লকডাউনের ফলে মানুষ কাজ ও রোজগার হারিয়েছে। এই তিন বছরে এডিসি এলাকায় জনজাতিরা সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে এবং বিশেষভাবে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়েছে। বিদ্যালয়ে ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। অথচ সব শিক্ষার্থীদের কাছে পঠন পাঠনের বই নেই। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্য বই নগদ অর্থ দিয়ে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। নোট বই গরীবরা কিনতে পারেনি। সরকারি ও সরকারি অনুদান প্রাপ্ত বেসরকারী বিদ্যালয়ে স্টাইপেন্ড বন্ধ। রেগা প্রকল্পে গড়ে ৬০-৭০ দিনের কাজ হয়েছে। ১৫০ দিনের কাজ তো দূরের কথা। অন্যায়ভাবে অনেকের সামাজিক ভাতা বন্ধ বা কেটে দেওয়া হয়েছে। পাট্টা প্রাপ্ত জমিতে কেন্দ্রীয় প্রকল্প সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ কককরা হয়নি। রোজগার কমেছে। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাদ্যসামগ্রী ও ঔষধপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। তাই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সর্বনাশা নয়া কৃষি আইনের ফলে দেশে কোম্পানিরাজ কায়েম হবে। উপজাতিরা সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে জমি থেকে উচ্ছেদ হবেন। তাঁরা খাদ্যের অধিকার হারাবেন। জনজাতিদের জন্য এডিসি একটি সংবিধান সম্মত রক্ষাকবচ হিসাবে বাস্তবে আর এর কোন অর্থ থাকবে না। তাছাড়া ঘরে বাইরে শাসক বিজেপি দলের ভিতরে ও জোটের মধ্যে সংকট বেড়েই চলেছে। তাই এই নির্বাচনে বিজেপিকে পরাস্ত করতে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
পাশাপাশি রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি প্রথমে তিপ্রাল্যান্ড ও এখন গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড গড়ার দাবি তুলেছে। তারা বলছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তারা এই দাবি আদায় করবেন। যার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। বরং এই দাবিগুলি তাদের মধ্যেকার রাজনৈতিক সংকটকে প্রতিফলিত করেছে। কেননা কেন্দ্রীয় সরকার তার হাতে ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত করার ফলে যেখানে দেশে আজ যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক কাঠামো আক্রান্ত। রাজ্যগুলির অধিকার ও অস্তিত্ব বিপন্ন। সেখানে আঞ্চলিক স্বশাসিত সংস্থাগুলির ক্ষমতাবৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন নেই। তাই বিজেপি কোনো প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। অথচ এই প্রশ্নে এই দলগুলোর কোন বক্তব্য নেই। আর সংবিধান অক্ষত থাকলে পরে আমরা ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদকে সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে আরো বেশী ক্ষমতাসম্পন্ন করে তুলতে পারব। তাছাড়া তাদের এই দাবিগুলি স্বাভাবিকভাবেই জাতি উপজাতিদের মধ্যে বিভেদ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করেছে। অতীতে অনেক বাঁধা বিপত্তি থাকলেও ত্রিপুরায় আজকের এডিসি জাতি-উপজাতি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল। আবারো এক সাধারণ ঐক্যের মধ্য দিয়েই রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে এডিসিকে সময়ের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই যারা বিভেদ তৈরি করে তাদের ভোট দেবেন না।
দেশ ও রাজ্যে এই সংকটকালীন সময়ে আমরা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। যাতে বিজেপি বিরোধী অভিমুখে বিশেষত বিরোধী বাম ভোট ভাগ না হয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যপক বামপন্হী ঐক্য শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাই জনগণের গণতন্ত্র, ঐক্য ও উন্নয়নের দাবিতে বিরোধী বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করছি এবং বামপন্থী প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য নির্বাচক মন্ডলীর কাছে আহ্বান করছি।
ত্রিপুরায় আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে সরকারি দপ্তরে কর্মী নিয়োগে বেসরকারি এজেন্সি নিযুক্ত করে সরকারি চাকরির দরজা বন্ধ করে দিল রাজ্যের বিজেপি সরকার। এই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত প্রত্যহারের দাবিতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবে সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি। ত্রিপুরায় বিজেপি-র নেতৃত্বে পরিচালিত রাজ্য সরকার গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক আদেশমূলে সরকারি দপ্তরে নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য দিল্লী সহ রাজ্যের পাঁচটি বেসরকারী এজেন্সিকে নিযুক্ত করেছে। এখন থেকে এই এজেন্সির মাধ্যমে সরকারি দপ্তরে কর্মী নিয়োগ হবে। সরকার সরাসরি আর কাউকে চাকরি দেবে না। এর ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া হবে অস্বচ্ছ। যারা চাকরি পাবেন বেতন মিলবে কম। যে কোনো মুহূর্তে চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকবে। অর্থাৎ রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীদের কাছে সরকারিভাবে চাকুরি পাওয়ার দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সরকারি দপ্তরে আর কোনোদিন স্থায়ী চাকুরি হবে না। বেসরকারী কোম্পানির মতো করে চাকরি হবে। এর মাধ্যমে বেকারদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিল সরকার। বছরে পঞ্চাশ হাজার চাকরি, মিসড্ কলে চাকরি, ঘরে ঘরে রোজগার দিতে ভিশন ডকুমেন্টে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। ইতিমধ্যে কৃষি দপ্তরে ৯২ জন চুক্তিবদ্ধ কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এছাড়া ছাঁটাই করা হয় তথ্য দপ্তর ও সচিবালয়ে কর্মরত চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের। এর আগে জাইকা, ক্ষুদ্র সেচ দপ্তরে কর্মরত চুক্তিবদ্ধ পাম্প অপারেটর, পৌর সংস্থাতে সাফাই কর্মী, শিক্ষায় মিড ডে মিল কর্মী, সরকারি অতিথিশালাতে অনিয়মিত চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের অমানবিকভাবে ছাঁটাই করা হয়। এই আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে নিয়োগ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বেসরকারিকরন নীতির অঙ্গ। সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার বেসরকারীকরণ। তাই এই লড়াই আসলে সরকারের বেসরকারীকরণ নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। এই কর্পোরেটমুখী আগ্রাসী বেসরকারিকরণ নীতির বিরুদ্ধে পথে নেমে প্রতিরোধে সামিল হতে আহ্বান জানান সিপিআই(এমএল) এর রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার।
সংবাদপত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত একটা সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে – খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে যারা রেশন থেকে সস্তায় চাল-গম পান, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সংখ্যাটা কমিয়ে আনার কথা ভাবছে। প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কেন্দ্রীয় খাদ্য সচিব এবং পরিসংখ্যান ও কর্মসূচী রূপায়ণ মন্ত্রকের সচিবের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করার পর নীতি আয়োগ সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে যে, গ্রাম ও শহরে যত শতাংশ মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা আইনে ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়, সেই হারটাকে কমিয়ে আনা দরকার। এর পক্ষে নীতি আয়োগের যুক্তি হল — গত এক দশকে দেশে অর্থনীতির যে বৃদ্ধি ও উন্নতি ঘটেছে তাকে বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে দরিদ্র জনগণের একটা অংশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে, ফলে খাদ্য সুরক্ষা আইনের সুবিধা পাওয়ার দরকার তাদের আর নেই। রেশনে সস্তায় চাল-গম দেওয়ার জন্য বর্তমানে প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণ ৪২২৬১৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১-এর অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়, খাদ্য সুরক্ষায় ভর্তুকির এই পরিমাণ “এতটাই বড় যে তা নিয়ন্ত্রণের অতীত”। নীতি আয়োগ সরকারের অভিপ্রায়ে সায় দিতে সুপারিশ করে যে ভর্তুকির এই পরিমাণটাকে কমিয়ে আনা দরকার, আর কম করা গেলে যে অর্থের সাশ্রয় হবে তাকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যর মতো খাতে ব্যয় করা যাবে।
উল্লেখ্য, খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে সস্তায় চাল-গম পায় অন্ত্যোদয় আন্না পরিবারগুলো যারা দেশের দরিদ্রতম জনগণ। পরিবার পিছু এদের জন্য মাসে বরাদ্দ ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য। এই আইনের আর সুবিধা প্রাপকরা হল “প্রায়োরিটি হাউসহোল্ড” বা অগ্রাধিকার বলে গণ্য পরিবারগুলো, যে সমস্ত পরিবারের সদস্যদের মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়। মনমোহন সিং-এর সরকার ২০১৩ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, গ্রামের ৭৫ শতাংশ জনগণ এবং শহরের ৫০ শতাংশ জনগণকে খাদ্য সুরক্ষা আইনে ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। এই হারে সুবিধা প্রাপকদের সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৮১ কোটি ৩৫ লক্ষ বা মোট জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ। এর সাপেক্ষে নীতি আয়োগের সুপারিশ হল সুবিধা প্রাপকদের হার কমিয়ে গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ করা হোক। তাদের আরো হিসেবে, হার অপরিবর্তিত থাকলে ২০১৩-র পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সস্তায় রেশন দিতে হবে ৮৯.৫২ কোটি মানুষকে যা খাদ্যশস্যে ভর্তুকির পরিমাণকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। আর তাদের সুপারিশ করা হারে সস্তায় রেশন প্রাপকদের সংখ্যাটা নেমে আসবে ৭১.৬২ কোটিতে। ফলে, খাদ্যশস্যে ভর্তুকির পরিমাণ বেশ কিছুটা কমানো যাবে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে দরিদ্র জনগণের একটা অংশের দারিদ্র সীমার বাইরে এসে রেশন-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার নীতি আয়োগের অভিমত কি আদৌ বাস্তব সম্মত? কোনো একটা নীতি বা কর্মসূচীর প্রবর্তনে সরকার যেমন তাদের পছন্দ মতো কমিটি গঠন করে সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে এগিয়ে যায়, খাদ্য সুরক্ষায় ভর্তুকি ছাঁটতে মরিয়া সরকারের কাছে নীতি আয়োগের সুপারিশ কি সেরকমই একটা অবলম্বন হচ্ছে? অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি কখনই এমন সন্তোজনক ছবি তুলে ধরে না যার ভিত্তিতে বলা যায় যে তা দরিদ্র জনগণের দুরবস্থা ঘুচিয়ে তাদের অবস্থাকে উন্নত করেছে। নোটবন্দি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান এবং আয়ে এমন ধাক্কা দেয় যে তার প্রভাব এখনও কাটানো যায়নি বলেই অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে সরকার প্রথমে চেপে গেলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, বেকারির হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করে পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ৪.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের বছরেই। এরপর এল কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং চূড়ান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন লকডাউন। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি দূরে থাক, কাজ খোয়ালেন ২ কোটিরও বেশি মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিক। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গিয়ে তাদের জীবনে নেমে এল চরম বিপর্যয়। ২০২০-র এপ্রিল থেকে জুন ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির সংকোচন ঘটল অভাবনীয় মাত্রায়, বৃদ্ধি নেমে গেল শূন্যের ২৩.৯ শতাংশ নীচে, পরের ত্রৈমাসিকেও অর্থনীতির সংকোচন ৭.৫ শতাংশ ঘটায় অর্থনীতি মন্দার গ্রাসে বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হল। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে অর্থনীতির সংকোচন হবে ৮ শতাংশ। অর্থনীতির এই পরিস্থিতি দরিদ্র জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে তাদের রেশন-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিয়েছে বা দিতে পারবে, এমন কথা কোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই বলতে পারবেন না।
অনেকে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন — এবং তা আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গেও মিলে যায় – রেশনের সুবিধা পেয়েছেন বলে কোভিড কালে বহু মানুষ অনাহারে মৃত্যুকে এড়াতে পেরেছেন। ভারতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব বলছে, পৃথিবীর সমস্ত ক্ষুধার্ত মানুষের এক চতুর্থাংশই রয়েছে ভারতে। এখানে কোটি-কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। খাদ্য সুরক্ষা আইনে সুবিধা প্রাপক পরিবারগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনলে তা খাদ্য নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করে তুলবে। রেশনের ওপর নির্ভর করে যে মানুষগুলো কোনো রকমে টিকে থাকেন, তাদের অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।
রেশনে সুবিধা প্রাপক পরিবারের সংখ্যাকে কমিয়ে আনার বিষয়টা এখনও সিদ্ধান্ত নয়, সুপারিশের পর্যায়েই রয়েছে। তবে, আমাদের নজরদারি জারি রাখতে হবে এবং এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার গ্ৰহণ করলে তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলাটাই হবে যথার্থ প্রত্যুত্তর।
একুশ শতকের দু’ দুটি দশক পার করে এখন স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিসরে এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়ে চলেছে। যে পরিবর্তনের নাগাল না পাওয়া গেলে শেষাবধি বামপন্থীদের পক্ষে সদর্থক কিছু করে ওঠা মুশকিল। এই পরিবর্তনের নানান রকমফের ও প্রযুক্তিগত বিন্যাস আছে। তবে সে সব কথা ছাপিয়ে উঠে এ কথা এই মুহূর্তে অনস্বীকার্য যে, শ্রমজীবী মানুষের জগতে ও আঙ্গিকে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এসেছে। উত্তরোত্তর সংখ্যাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এক নতুন ধরনের শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি আজ আর অধরা বা অদৃশ্য নয়। এদের কেউ কেউ নামকরণ করেছেন ‘গিগ শ্রমিক’ বলে। ‘গিগ’ কথাটির অর্থ, বৃহত্তর অর্থে, স্বল্পকালীন। ‘গিগ শ্রমিক’ অর্থে তাই বোঝানো হচ্ছে এমন এক ধরনের শ্রমজীবী মানুষকে যাদের কাজের ধরন ও নিয়োগ স্বল্পকালীন ভিত্তিতে। আরও বিশদে বললে, এঁরা কাজ করবেন বা নিয়োজিত হবেন খুব অল্প সময়ের জন্য (ধরা যাক তিন কি ছ’মাস অথবা এক বছর), অনেক সময়েই পার্টনার-ভিত্তিক চুক্তির মাধ্যমে অথবা খুব সামান্য এক ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে কাজের ভিত্তিতে ইনসেন্টিভ মডেলে।
এই ধরনের কাজের আঙ্গিক কেন, কীভাবে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে? এ নিয়ে বিশদে পরে আলোচনা করা যাবে কিন্তু এই লেখার পরিপ্রেক্ষিতে এটুকুই আপাতত বলা যে, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ডিজিটালাইজেশন ও অনলাইন-করণের ফলে এবং সর্বোপরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এমন এক নতুন ধরনের শ্রমজীবী মানুষের নির্মাণ হয়েছে যাদের আজকের আধুনিকতম অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির একটি অবশ্যম্ভাবী সুবিশাল লেজ হিসেবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। সোজা কথায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চালনায় এমন এক নতুন ধরনের পরিপূরক শ্রমজীবী মানুষের উত্থান, যারা এই পরিবর্তিত অর্থনীতির জোয়ালকে নিজ কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছেন। এঁরা কারা?
এঁদের একটা বড় অংশ অনলাইন ডেলিভারি বয়; যাদের সংখ্যা দেশ জুড়ে কয়েক লক্ষ- জোমাটো, স্যুইগি, ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন এই অযূত ধরনের সংস্থায় দিনাতিপাত করা শ্রমজীবী মানুষ, প্রাপ্ত অর্ডারের ভিত্তিতে বাড়ি বাড়ি বা অফিস-কারখানায় নিত্য হরেক কিসিমের পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। এঁদের কোনও ন্যূনতম মজুরি নেই, শ্রমিকের মর্যাদা নেই, সামাজিক সুরক্ষা বলেও কিছু নেই। এঁদের দেখানো হয় পার্টনার বা শরিক হিসেবে, যারা কোম্পানির প্রাপ্ত অর্ডারের ওপর কমিশন ভিত্তিতে স্বনিয়োজিত শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এদের নিজস্ব বাইক বা অন্য যান থাকতে হবে যাতে করে মাল পৌঁছে দেওয়া যায়। তেল খরচা অথবা সামান্য টিফিন খরচা বাবদ এদের হয়তো কোনও কোনও কোম্পানি স্বল্প কিছু অর্থ অনুদান দিয়ে থাকে। বাকি সবটা রোজগার হয় কমিশন ভিত্তিতে (কোনও কোনও ক্ষেত্রে সঙ্গে একটা বেসিক স্যালারি দেওয়া হয় যার থেকে তেলের খরচাও মেটাতে হয়) যা বেশি রাতের দিকে বাড়তে থাকে। এদের কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময় বা সীমা নেই, যখনই এবং যতক্ষণ সম্ভব এঁরা শ্রম দিয়ে চলেন আরও কমিশনের আশায়। মনের মধ্যেও গেঁথে যায় এই ধারণা যে, তাঁর নিজ কাজের বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই তাঁর আয়েরও বৃদ্ধি হবে। কিন্তু সে এক গোলকধাঁধা।
শুধুমাত্র অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিককুলই নয়, গিগ শ্রমিকদের মধ্যে পড়ে ওলা-উবের’এর ড্রাইভার, আর্বান ক্ল্যাপ’এর মতো বিভিন্ন পরিষেবা-প্রদানকারী দক্ষ শ্রমিকেরা ও অনলাইনে কর্মরত আরও নানা ধরনের শ্রমিক ও কর্মীরা। সবটা জুড়ে এই ধরনের কর্মী বা শ্রমিকদের সংখ্যাই এখন শ্রমিকশ্রেণির সর্ববৃহৎ অংশ। কিন্তু এঁরা কি সাবেকি অর্থে শ্রমিক? নাকি যে কোনও শিল্প-বাণিজ্য উদ্যোগের শরিক মাত্র। এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে অতি সম্প্রতি উবের’এর ক্ষেত্রে ব্রিটেনের শীর্ষ আদালত এক রায়ে জানিয়েছে, এঁদের ‘শ্রমিক’ হিসেবেই গণ্য করতে হবে। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, যান পরিবহনের যে পরিষেবা উবের ড্রাইভাররা দেন, তা খুব পাকাপোক্ত ভাবে উবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও লিখিত-পড়িত। এই পরিষেবা এমনভাবেই দেওয়া হয় যে সেখানে কোম্পানির ইচ্ছানুযায়ী ড্রাইভারদের নিয়োগ বা বাতিল করা যায় এবং দিনের শেষে খদ্দেরদের আনুগত্য ও শুভ কামনা ড্রাইভাররা নয়, উবের কোম্পানিই পায়। নিঃসন্দেহে এই যুগান্তকারী রায় গিগ শ্রমিকদের জন্য এক বিরাট জয়। এই রায়ের ফলাফল উবেরের সীমানা ছাড়িয়ে এবার নিশ্চয়ই প্রসারিত হবে অন্যান্য সংস্থার গিগ শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও।
পশ্চিমবঙ্গে আগামী নির্বাচনে ‘একুশের ডাক: মানুষের দাবিতে গিগ শ্রমিকদের সমস্যার কথা খুব গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে। এ রাজ্যে এই ধরনের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষা তো নেইই, উপরন্তু, এদের নিজস্ব কোনও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনও নেই। যতক্ষণ না এঁরা শ্রমিকের মর্যাদা পাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তোলাও এঁদের পক্ষে সমস্যাসঙ্কুল। দিনরাত পরিশ্রম করে এঁদের হাতে দৈনিক যে নেট আয়টা আসে তা অতি সামান্য। মনে রাখতে হবে, এই শ্রমিকেরাই কিন্তু ক্রমেই সমগ্র শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়ে উঠছেন। অধিক মুনাফার লোভে কর্পোরেট কোম্পানিগুলি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যাতে এই ধরনের শ্রমিকদের শরিক হিসেবে দেখিয়ে, তাঁদের প্রাপ্য শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সুউচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা যায়। অবস্থাটা কীরকম?
প্রথমত, এই গিগ শ্রমিকদের ‘শ্রমিক’ মর্যাদাই দেওয়া হয় না। এঁদের দেখানো হয় স্বাধীন স্ব-উদ্যোগী হিসেবে যাদের সঙ্গে কোম্পানিগুলি চুক্তি মোতাবেক কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করে। ব্রিটেনের শীর্ষ আদালতের রায় এই ধারণাকে নস্যাৎ করেছে। এখানেও তাই একই দাবিতে এই শ্রমিকদের সংগঠিত করা, আন্দোলনে নামা ও পাশাপাশি আইনি সুরাহা পেতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, শ্রম সুরক্ষা বিধির যে সুযোগ-সুবিধাগুলি আছে এঁরা সেগুলো পান না। পিএফ, ইএসআই, সবেতন ছুটি, পাঁচ বছর চাকরি হলে গ্র্যাচুইটি — এইসব নানাবিধ শ্রমিক অধিকার তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। এই সামাজিক সুরক্ষার বিধিগুলি তাঁদের ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
তৃতীয়ত, এঁদের কাজের দৈনিক নির্ঘন্ট বলে কিছু নেই। কিছুটা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এঁরা বেশি কমিশনের আশায় অসময়ে বা রাতবিরেতে কাজ করেন। এঁদের ক্ষেত্রে শ্রমিক বিধি অনুযায়ী আট ঘন্টার বেশি বাড়তি সময়ে কাজ করাকে ওভারটাইম হিসেবে গণ্য করতে হবে। তার সঙ্গে নির্দিষ্ট ও বেশি হারে কমিশনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।
চতুর্থত, সবচেয়ে বড় কথা, এই গিগ শ্রমিকদের আঙ্গিকগত পরিবর্তনের ফলে এদের শ্রমিক হিসেবে না দেখানোর যে কৌশল, তার সুযোগে এঁদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকেই খর্ব করা হয়েছে। এটা এক ভয়ঙ্কর দিক। অবিলম্বে এঁদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য সম্প্রতি, উবের ক্যাব চালকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে ও তাঁরা তাঁদের নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের পথেও আছেন।
পঞ্চমত, এই গিগ শ্রমিকদের কাজ ও কাজের নিরাপত্তার কোনও গ্যারান্টি নেই। যে কোনও অজুহাতে তাঁদের কাজ চলে যেতে পারে অথবা তাঁদের বেসিক স্যালারি (যাদের ক্ষেত্রে আছে) ও কমিশনের হার নিয়েও টানাটানি হতে পারে। সোজা কথায়, এঁরা এক নিরালম্ব বায়ুভূতের মতো সমাজ-অর্থনীতির গায়ে আলগা ভাবে লেপ্টে আছে, যাদের ভূত-ভবিষ্যতের কোনও কূলকিনারা নেই। কেউ কেউ এঁদের কর্ম-অবস্থাকে দাস ব্যবস্থার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। অবিলম্বে এই দাস ব্যবস্থার অবসান চাই।
এ হেন পরিস্থিতি গিগ শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আজ এক মুখ্য লড়াই গড়ে ওঠার অবকাশই শুধুমাত্র নির্মাণ করছে না, তা সমাজ পরিবর্তনেরও গুরুত্বপূর্ণ দিশারী হিসেবে দেখা দিচ্ছে। একদিকে চরম কর্মহীনতা, অন্যদিকে কর্মরত শ্রমিকদের এক বড় অংশের দুঃসহ যাপন — সমাজ পরিবর্তনের সার্বিক লড়াইয়ে এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। একুশের দাবি সেই লক্ষ্যপূরণে কতটা অগ্রসর হতে পারে, তা লড়তে লড়তেই দেখার।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
জন্ম সাবেক জম্মু ও কাশ্মীরের কিস্তওয়ারে। কিন্তু নিজেকে ‘কাশ্মীরী’ বলাটা খুব স্বচ্ছন্দের নয় — ’কাশ্মীরী’ শুনলেই লোকজনের দৃষ্টি, আলাপের ধরনটা কেমন পাল্টে যায়।
দিল্লিতেই শিক্ষা, বড় হয়ে ওঠা। এখন প্রায় পাঁচ মাসের এক সন্তানের মা। সাতাশ বছরের তরুণী র জীবনের যে সময়টায় পরিবারের সান্নিধ্য সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল সেই সময়টা কেটেছে জেলের নির্জন কুঠুরিতে – আইসোলেশন সেলে। কোভিড পরিস্থিতিতে। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায়, আশঙ্কায়। শুধু তাই নয়। গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য সহযোগে অকথ্য কুৎসা ছড়ানো হয়েছে। চলেছে চরিত্র হনন। একাকী সেলে সেই মানসিক উৎপীড়ন সইতে হয়েছে। মুসলিম বলে বিজেপি’র আই টি সেল হয়তো দ্বিগুণ উৎসাহে এ কাজটা করেছে। মহিলা প্রতিবাদীদের অবশ্য এসব বাড়তি ‘পাওনা’। যেমন অনেক সময়েই ‘ধর্ষণ’ রাষ্ট্রের হাতিয়ার হয়ে ওঠে – দানবীয় আইন প্রয়োগ, বিনা বিচারে আটক ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে।
প্রতিবাদ করেছিলেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের গবেষক সাফুরা জারগর। তিনি বিশ্ব বিদ্যালয়ের মিডিয়া কোঅর্ডিনেটরও বটে। প্রতিবাদ করেছিলেন রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে। সিএএ-নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে। দিল্লীর এবং গোটা ভারতের ছাত্রসমাজই তখন গর্জে উঠেছিল। আন্দোলনের এক নতুন পথ দেখিয়েছিল শাহীনবাগের মুসলিম নারীসমাজ।
প্রতিহিংসাপরায়ণ রাষ্ট্র তাই ভরা লকডাউনে ১০ এপ্রিল, ২০২০ গ্রেফতার করে অন্তঃসত্ত্বা সাফুরাকে, জাফরাবাদ পথ অবরোধ মামলায় দায়ের করা এফ আই আর ৪৮/২০২০-র ভিত্তিতে। ১৩ এপ্রিল জামিন হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি পুলিশ সাফুরাকে আবার গ্রেফতার করে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে দায়ের করা এফআইআর-৫৯/২০২০-এ তার নাম জড়িয়ে। অভিযোগ, তিনি ছিলেন ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে ঘটে যাওয়া ‘দিল্লি দাঙ্গার অন্যতম মূল চক্রী ও উস্কানিদাতা’। সঙ্গে ছিল জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আরও কয়েকটি নাম।
তথাকথিত দিল্লী দাঙ্গা, যা আসলে ছিল হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-আরএসএস-এর এক সুপরিকল্পিত হত্যাভিযান, তার প্রকৃত উস্কানিদাতাদের যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দিল্লি পুলিশ আজও (বছর পেরিয়ে গেছে) গ্রেফতার দূরে থাক, তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। কিন্তু জেএনইউ, জামিয়া-র ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডাইনি-খোঁজ চলল। গ্রেফতার ও করা হল।
সাফুরার জামিনের আবেদন বার বার নাকচ হয়েছে। সরকারি আইনজীবী যুক্তি দেখিয়েছেন, তিহার জেলে গত দশ বছরে ৩৯টি সন্তান প্রসবের ঘটনা রয়েছে। সুতরাং সাফুরার অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক টানা পোড়েনের পর, চতুর্থ আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন দিনের টানা শুনানির পর ২৩ জুন দিল্লি হাইকোর্ট সাফুরাকে মানবিক কারণে জামিন মঞ্জুর করে। ২৪ জুন তিনি বাইরের মুক্ত আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালেন।
সাফুরা জারগরের এই গ্রেফতার ও আটককে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল-এর ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন’ অযৌক্তিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ঘোষণা করেছে। কারণ তা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণা (ইউডিএইচআর) এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিমামা, ভারত যার স্বাক্ষরকারী — তাকেও লঙ্ঘন করেছে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে-মানবাধিকার রক্ষা কর্মী হওয়ার জন্যই সাফুরা স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সংস্থার পর্যবেক্ষণ – মানবাধিকার কর্মী হওয়ার জন্যই তাকে বৈষম্যের নিশানা করা হয়েছে এবং চুক্তিনামার ২৬নং ধারার অধীনে আইনের চোখে সমানাধিকার ও আইনী সুরক্ষার সমানাধিকার তাঁর ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হয়েছে। সরকারের নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক অভিমত ও বিশ্বাসের কারণেই ঘটেছে এই অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা-এও পরিষ্কারভাবে জানানো হয়েছে সংস্থার তরফে।
গোটা পরিস্থিতি সাপেক্ষে সংস্থার সুপারিশ — এই অন্যায়ের উপযুক্ত প্রতিবিধান হিসেবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য আর্থিক খেসারত মেটানোর দাবি করার জন্য সাফুরাকে কার্যকরী অধিকার দিতে হবে। সংস্থাটি সরকারকে বলেছিল সাফুরাকে স্বাধীনতা-বঞ্চিত করার পুরো বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে এবং যারা এই অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ওয়ার্কিং গ্রুপ এই অভিমত গ্রহণ করেছিল ২৭ নভেম্বর, ২০২০; কিন্তু তা প্রকাশিত হল এ বছর ১১ মার্চ। সংস্থার দাবি-তারা সরকারকে অভিযোগগুলো জানিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০-র মধ্যে বিস্তারিত তথ্য পাঠানোর অনুরোধ জানায়। কিন্তু সরকার তথ্য তো পাঠায়ইনি, এমনকি উত্তর দেবার সময়সীমা বাড়ানোর আবেদনও করেনি।
এই সরকার ‘যথাযথ ক্ষতিপৃরণের’ কোনো পদক্ষেপ নেবে? মানসিক যন্ত্রণার কোনো ক্ষতিপূরণ কি সম্ভব? সে সব প্রশ্ন ব্যতিরেকেই বলা যায়, বিশ্বের দরবারে সরকার নিজেই নিজের মুখ পুড়িয়েছে।
সূত্র: দি লিফলেট ; মার্চ ১৪, ২০২১
একথা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না, কি দেশজুড়ে, কি এই রাজ্যে নারী সমাজের অবস্থা কি করুণ! শরীর-মনের অপুষ্টি, অভাব, অযত্ন যেন ঝলসে দিচ্ছে। নিত্যসঙ্গী হাড়ভাঙা খাটুনি। পরিবারের অন্যদের দেখভাল করার জেরে নিজের দিকে তাকানোর ফুরসতই মেলে না। বিশ্রাম মেলা ভার। তার ওপর ঘরে-বাইরে লেগেই থাকে লিঙ্গজাত বৈষম্য-পীড়ন-নিপীড়ন। অধিকার চাইলে পাওয়া যায় না, অন্তত সহজে তো নয়ই। প্রতিটা প্রশ্নে প্রয়োজন হয় পুরুষের তুলনায় বেশি লড়ে যাওয়ার। এইসব নিয়েই চলছে নারীজীবন।
সুপ্রীম কোর্টে ক্ষতিপূরণ পাওয়া না পাওয়া সংক্রান্ত এক মামলা চলাকালীন গত ৫ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদ্বয় মন্তব্য করেন, গৃহকর্তার অফিসে শ্রম দেওয়ার যা মূল্য গৃহকত্রীর গৃহশ্রমের মূল্য তার থেকে কিছু কম গণ্য হতে পারে না, দুটিই সম মূল্যের। বিচারপতিদের একজন আরও বলেন, ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্টে প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল ভারতে ১৫৯.৮৫ মিলিয়ন মহিলার কাছে গৃহশ্রমই মুখ্য জীবিকা, যেখানে তুলনায় পুরুষদের মুখ্য শ্রম হিসাবে গৃহশ্রমে থাকার সংখ্যাটি বহু পিছনে, ৫.৭৯ মিলিয়ন। ‘টাইম ইউজ ইন ইন্ডিয়া-২০১৯’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক তথ্য পরিসংখ্যান রিপোর্টে আরও জানা যায়, গড়ে একজন মহিলা গোটা দিনে গৃহস্থালী কাজের জন্য বিনা মূল্যে পরিষেবা দিয়ে থাকেন ২৯৯ মিনিট, আর গড়ে একজন পুরুষ সারা দিনের মধ্যে একই কাজে সময় দেন ৯৭ মিনিট মাত্র। একইরকমভাবে পরিবারের মহিলারা অন্যান্য সদস্যদের দেখভাল করতেই বিনা মূল্যে সময় ব্যয় করেন যেখানে দিনে ১৩৪ মিনিট, সেখানে তুলনায় পুরুষেরা সময় দিয়ে থাকেন গড়ে ৭৬ মিনিট। শতাংশের বিচারে মহিলাদের দিনপ্রতি উপরোক্ত দু’ধরনের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমসময় দেওয়ার চিত্রটি যেখানে যথাক্রমে ১৬.৯ ও ২.৬, সেখানে পুরুষ প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট শ্রম সময়ের ভাগটি হল যথাক্রমে ১.৭ ও ০.৮ মাত্র। এই তথ্য পরিসংখ্যানই দেখিয়ে দেয় গৃহশ্রমে ও বিশেষ করে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমসময় ব্যয় করার ক্ষেত্রে লিঙ্গজাত প্রভেদ কত প্রকট ও ব্যাপক।
অন্যদিকে ঘরের বাইরের জগতে কর্মক্ষেত্রের ক্ষেত্রে? কর্মসংস্থানের প্রশ্নে? বলাবাহুল্য সেখানেও লিঙ্গগত বৈষম্যই প্রধান প্রবণতা। আর, ২০২০-র অতিমারী ও লকডাউনজাত কাজ উধাও হয়ে যাওয়া বা কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাও হয়েছে একইরকম। পুরুষ কর্মীদের তুলনায় মহিলা কর্মীদের কাজ থেকে ছেঁটে দেওয়া হয় ৫ গুণ বেশি! লক ডাউনে কর্মহীন হয়ে যাওয়া মহিলারা স্বনিযুক্তি শ্রমের উপায়ও বিশেষ কিছু পাননি। স্বনিযুক্তির বন্দোবস্ত করে উঠতে পেরেছিলেন স্থায়ী বেতনের কর্মীদের মাত্র ২ শতাংশ, অস্থায়ী বেতন কর্মীদের মাত্র ১০ শতাংশ, আর দিনমজুর মহিলাদের মাত্র ২১ শতাংশ। এমনকি অতিমারী অবস্থায় চলে যাওয়া কাজ ফেরত পাওয়ার প্রশ্নেও মহিলা কর্মীদের “না” করে দেওয়া হয়েছে পুরুষ কর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি, ১১ গুণ! কর্মক্ষম মাত্র যে ১০ শতাংশ মহিলা কাজ পেয়েছিলেন প্রাক অতিমারীপর্বে, লক ডাউন উঠে গেলে কাজ ফিরে পেয়েছেন তার মাত্র ৫৩ শতাংশ, প্রায় অর্ধেকাংশই কাজ ফিরে পাননি। এই কাজ হারাদের মধ্যে রয়েছেন দিন মজুর, ঠিকা চুক্তির, অস্থায়ী, স্থায়ী, বেতনভোগী, বড় অঙ্কের বেতনপ্রাপ্ত, নিরক্ষর, সাক্ষর, সাধারণ শিক্ষিত, মধ্যমেধার ও উচ্চ শিক্ষিত তথা সব বর্গের মহিলা শ্রমজীবী। এত ব্যাপক অংশেরও বেশি গুণ কাজ ছাঁটাইয়ের অর্থ হল, তাদের আবার পরিবারে বিনা পারিশ্রমিকে আরও বেশি শ্রমসময় দিতে ঘরে ঢুকে থাকতে বাধ্য করা। শ্রমের বাজার থেকে উৎখাত হয়ে বিজেপির ভাষায় শ্রমসেবা দানে ‘সুশীলা গৃহলক্ষী’ হয়ে থাকতে বাধ্য হওয়া।
উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করেছেন আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী-পুরুষ সমন্বয়ে তিন সদস্যের এক গবেষক টিম। ভারতে শ্রমের বাজারে অতিমারী উত্তর পরিস্থিতিতে লিঙ্গগত কি পড়ছে সেটাই ছিল তাঁদের গবেষণাপত্রের বিষয়। তাঁরা কাজ করেছেন সিএমআইই-সিপিএইচএস-এর প্রাক লকডাউন (ডিসেম্বর ২০১৯-জানুয়ারি ২০২০), লক ডাউন (এপ্রিল-মে ২০২০) ও লক ডাউন উত্তর (অগাস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২০) — এই তিনটি পর্বের তথ্য নিয়ে। এই গবেষণা ফলচিত্রের অনুরূপ পরিণাম পশ্চিমবঙ্গের পটভূমিতেও মেলে।
সামনে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে রাজ্যের কাজ হারানো মহিলাদের কাজে ফেরানো ও নতুন মহিলা কর্মপ্রার্থীদের কর্মসংস্থানের অধিকার বা দাবি এক জ্বলন্ত বিষয়। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রের ও রাজ্যের শাসকপক্ষ কে কি এপর্যন্ত করেছে তার হিসাব মাথায় রাখতে হবে। সেইমতো উচিত শিক্ষা দিতে সমানাধিকারের চেতনায় জোট বাঁধতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে ৭ কোটি ২০ লক্ষ নির্বাচক জনতার ৪৯ শতাংশ মহিলা। কিন্তু মহিলাদের কাজের ও তথা সমকাজে সমমজুরির অধিকার কেবল মাত্র মহিলাদের ইস্যু নয়, এটা সমাজের সমস্ত সংবেদনশীল জনমানুষেরই সোচ্চার হওয়ার বিষয়। তাই ব্যাপকতম নির্বাচকমন্ডলীকেও তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিস্কার বুঝে নিতে হবে। কোন সরকার — কোন রাজনৈতিক দলের নীতিগুচ্ছ নারী কর্মশক্তির কর্মসংস্থানের বিষয়ে সবচেয়ে ব্যর্থ, অপদার্থ, নিস্পৃহ, উদাসীন, বিরোধী? সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত সত্য, কর্পোরেট পুঁজি এবং আরএসএস দোসর বিজেপি হচ্ছে সমস্ত দিক থেকে নারী বিরোধী। তাই আসন্ন নির্বাচনে বিজেপিকেই সবচেয়ে উচিত শিক্ষা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মালদহে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে এসে বলে গিয়েছিলেন যে — যে সরকার নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, একদিনও ক্ষমতায় থাকার অধিকার তার নেই। কিন্তু তাঁর রাজ্যে নারীরা কেমন আছেন? যোগী শাসনে তাঁরা কি নিরাপদ বোধ করেন? পুলিশ কি নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে দুষ্কৃতী দমনে তৎপরতা দেখায়? ঐ রাজ্যেরই উন্নাও, বদায়ুন, হাথরসে ঘটে নারী-বিরোধী হিংসার হাড় হিম করা ঘটনা আর সেই সমস্ত ঘটনার অপরাধীদের, পৈশাচিক দুষ্কৃতীদের রক্ষায় পুলিশ ও প্রশাসনের মদত দান কোনো গোপন ব্যাপার নয়। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার ১৫ মার্চ সংস্করণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে যাতে দেখানো হয়েছে উত্তরপ্রদেশে কি অবাধে নারী-বিরোধী হি্ংসার ঘটনা ঘটে চলে এবং রাজ্যটা নারীদের কাছে কি রকম আতঙ্কের হয়ে উঠেছ। ঐ প্রতিবেদনে শুধু এ বছরেরই ১ থেকে ৮ মার্চ ঘটা নারীর ওপর হামলার একের পর এক ঘটনা বিধৃত হয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তাতে জানানো হয়েছে যে, শুধু ২০১৯ সালেই নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৫৯৮৫৩, যা সারা দেশে ঘটা নারী-বিরোধী অপরাধের ১৪ শতাংশ। মুখে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও বিজেপি শাসন যে নারীর কাছে ভীতিজনক এবং তার আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক তাকে তুলে ধরতে ঐ প্রতিবেদনে বিবৃত ঘটনাগুলো এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হচ্ছে।
তারিখ ১ মার্চ : এক পেশাদার নর্তকীকে অপহরণ করে গোরখপুর জেলার শাহাপুরের একটা বাড়িতে আটকে রেখে তিন ব্যক্তি তাকে গণধর্ষণ করে। অভিযুক্তরা ধর্ষণ কাণ্ডের একটা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে তুলে দিয়েছিল বলেও জানা যায়। অভিযোগ নথিবদ্ধ না করায় এক পুলিশ ইন্সপেক্টর ও এক কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করা এবং তিন অভিযুক্তকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে।
তারিখ ৪ মার্চ : বদায়ুনের সিভিল লাইন এলাকায় এক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কর্মরত এক মহিলা অভিযোগ করেন, ২ মার্চ সেই কেন্দ্রে চার পুলিশ কর্মী হানা দেয়। তারা মহিলাকে মারধর করে, সেই কেন্দ্রের খরচের হিসেবের খাতা নিয়ে চলে যায় এবং অন্য একদিন তাকে তাদের কাছে যেতে বলে। তাদের কথামতো তিনি তাদের কাছে অন্য একদিন গেলে এক সাব-ইন্সপেক্টর ও দুই কনস্টেবল তাঁকে একটা ঘরে আটকে গণধর্ষণ করে।
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে হামলা, হিসেবের খাতা চুরি করা বা মহিলার ওপর গণধর্ষণের জন্য কোনো অভিযোগ নথিবদ্ধ করা হয়নি। তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা বা বিবৃতি নথিবদ্ধ করতেও পুলিশ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এসপি জানিয়েছেন, “মহিলার স্বামী শ্লীলতাহানির একটি ঘটনায় অভিযুক্ত। পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ সত্ত্বেও আমরা ঘটনাটার তদন্ত করছি।”
প্রতিবেদনে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মহিলার স্বামীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে মহিলার ওপর গণধর্ষণ চালানোর কোনো সম্পর্ক কি আদৌ থাকতে পারে।
তারিখ ৭ মার্চ, ঘটনা ১ : ১৯ বছরের এক যুবক আগ্ৰার হাভেলি মহল্লায় ৪৫ বছর বয়স্ক এক মহিলার বাড়িতে জোরজবরদস্তি ঢুকে ঐ মহিলা ও তাঁর ১৫ বছরের মেয়েকে ছুরি মেরে খুন করে। অভিযুক্ত পাড়ারই যুবককে ১০ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঘটনা ২ : আজমগড় জেলার ফুলপুরে চাষের মাঠে ১১ বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণ করা হয়। বালিকার গ্রামেরই একটি ছেলে ধর্ষণ করেছে বলে জানা যায়। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারিখ ৮ মার্চ, ঘটনা ১ : কানপুর গ্রামীণ অঞ্চলে ঘটমপুর এলাকায় ১৩ বছরের এক বালিকাকে গণধর্ষণ করা হয়। মূল অভিযুক্ত এক পুলিশ অফিসারের ছেলে, এবং তার সাথে তার বন্ধুও ছিল। পরদিন ধর্ষিতার দাদা যখন অভিযোগ দায়ের করার জন্য সাজেতি থানায় যাচ্ছিল, অভিযুক্তর দাদা তখন ধর্ষিতার দাদাকে মারধর করে এবং হুমকি দেয়—ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করলে তাকে এবং তার বাবাকে মেরে ফেলা হবে। ধর্ষিতার দাদা কোনোরকমে থানায় পৌঁছলেও পুলিশ অভিযোগ নেয় না এবং এই কথাও নাকি বলে যে, মেয়েটার চরিত্র ভালো নয়। পরদিনই, অর্থাৎ ১০ মার্চ পুলিশের সামনেই একটা লরি ধর্ষিতার বাবাকে চাকার তলায় পিষে দিয়ে মেরে ফেলে। ধর্ষিতার দাদার অভিযোগ, এক পুলিশ কর্মী তার বাবাকে লরির নীচে ঠেলে দেয়।
সাংবাদিকরা থানায় যাওয়ার পরই থানায় ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। পুলিশের এক ইন্সপেক্টর, এক সাব-ইন্সপেক্টর ও এক কনস্টেবলকে কর্তব্যে অবহেলার জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। মূল অভিযুক্তর বাবা, পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের হয়েছে।
ঘটনা ২ : এলাহাবাদের সিভিল লাইন এলাকায় এক পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর সর্বসমক্ষে এক মহিলা ইন্সপেক্টরের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ও তাকে ধাক্কা দেয়। মহিলা ইন্সপেক্টর ঐ সাব-ইন্সপেক্টরের চেয়ে উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হলেও পুরুষ সাব-ইন্সপেক্টর তার হেনস্থায় কোন দ্বিধা দেখায় না। পুরুষ সাব-ইন্সপেক্টর চাইছিলেন – মহিলা ইন্সপেক্টর কোতোয়ালি অঞ্চলে যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেটা তিনি ছেড়ে দিন। ঘটনার একটা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে সচল হয়েছে।
স্থানীয় সার্কেল ইন্সপেক্টর বলেছেন, এরকম কোন ঘটনার কথা তিনি জানেন না। মহিলা ইন্সপেক্টর জানিয়েছেন, তাঁর নিজের থানা তাঁর অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছে।
এলাহাবাদের ডিআইজি জানিয়েছেন, তিনি উভয় পুলিশ কর্মীকেই সতর্ক করে বলেছেন, এই ধরনের ঘটনা আবার ঘটলে উভয় পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধেই তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। মহিলা ইন্সপেক্টর কোনো খারাপ ব্যবহার করেছেন বলে ভিডিওতে দেখা যায়নি।
ঘটনা ৩ : বুলন্দশহরের শিকারপুরের এক রাস্তায় এক যুবক এক মহিলাকে ছুরি মেরে খুন করে। অভিযুক্ত ঐ মহিলার দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, যুবকের সঙ্গে মহিলার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল।
উত্তরপ্রদেশ মহিলাদের কাছে যে আতঙ্কের রাজ্য হয়ে উঠেছে তার সঙ্গে কি নারী সম্পর্কে বিজেপির ধারণার কোনো সংযোগ রয়েছে? রাজ্যে নারী-বিরোধী হিংসার বাড়বাড়ন্তের পিছনে নারীদের সম্পর্কে বিজেপি-আরএসএস-এর পোষণ করা ধারণা, রাজ্যে রাজনীতি-দুর্বৃত্ত গাঁটছড়ার অতি শক্তিশালী হয়ে ওঠার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। বিজেপি মনে করে গৃহকোণই নারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান, রান্নাবান্না, ছেলে-মেয়েদের লালন-পালন এবং গৃহস্থালির অন্যান্য কাজের জন্যই তারা নিয়তি-নির্দিষ্ট। যোগী আদিত্যনাথের মত হিন্দুত্ববাদী নেতা কখনই চাইবেন না যে, নারীরা পুরুষের সমানাধিকার অর্জন করুক, সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখুক, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের আত্মঘোষণায় এগিয়ে যাক। যে রাজ্যে প্রশাসনের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিটির মধ্যে নারী-বিদ্বেষী মনোভাব চরম মাত্রায় মূর্ত হয়, সেই রাজ্যে নারী নিগ্ৰহ ও তাদের দমনের এক পরিমণ্ডল যে বিরাজ করবে সেটাই স্বাভাবিক।
(যোগী আদিত্যনাথ নারীদের সম্পর্কে কি মনোভাব পোষণ করেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীদের সম্পর্কে তাঁর কি বার্তা ছিল, সে সম্পর্কে অবহিত হতে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় দেখুন।)
শিরোনামে গত ১৩ মার্চ বজবজ মহেশতলা সাংকৃতিক, সামাজিক কর্মীদের যৌথ সাংস্কৃতিক কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হলো। বিষাক্ত কোবরা উদ্যত ফনা তুলে ফ্যাসিবাদীর কায়দায় যখন সংবিধান, গণতন্ত্র, অন্নদাতা, সংখ্যালঘু, মহিলা সহ সমাজের বেশিরভাগ মানুষকে স্যাঙ্গাত পুঁজিবাদের দাসানুদাসে পরিণত করে মনুবাদী সমাজ তৈরি করতে উদ্যত তার বিপরীতে চোখে চোখ রেখে দেশের অন্নদাতারা দেশ বাঁচাতে মরণপণ লড়াই করছে সেই সময় অন্নদাতাদের সমর্থনে ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের কাছে বার্তা দিতে চলার পথে গণসাংস্কৃতিক সংস্থার সভাপতি বজবজ মহেশতলার সমস্ত সাংস্কৃতিক, সমাজিক কর্মীদের পথে নামার আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে সামিল হয়ে গত ১৩ মার্চ শনিবার বজবজের প্যালেসস্টার মোড়ে কবিতায়, গানে, বক্তব্য রাখার মাধ্যমে এক প্রতিবাদী কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র সভাটি পরিচালনা করেন অঞ্জন ঘোষ ও দেবাশিস মিত্র। সভার শুরুতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক গণশিল্পী নীতিশ রায়। বক্তব্য রাখেন সমাজ কর্মী কিশোর সরকার, সুদেষ্ণা দত্ত, মহিলা আন্দোলনের কর্মী কাজল দত্ত, সময় উপযোগী কবিতা আবৃতি করেন বাচিক শিল্পী অভিজিৎ চক্রবর্তী, শ্রাবণী নাথ, কর্মচ্যুত শ্রমিক বিপ্লব দে নাথ স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন, সঙ্গীত পরিবেশন করেন কান্ডীব সাংস্কৃতিক সংস্থা, চলার পথে গণ সাংস্কৃতিক সংস্থা ও গায়ক অভিজিৎ মন্ডল, সেখ সাবির। সভায় উপস্থিত ছিলেন দৃষ্টিপথ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী। আমন্ত্রিত শ্রোতা এবং চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শ্রোতারা সমগ্র কর্মসূচী উৎসাহের সাথে গ্রহণ করেন, তাই দেখা গেল দুরে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রোতারা তাদের অঞ্চলে এরকম একটি কর্মসূচী অনুষ্ঠিত করতে চান, তাই আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। সমগ্র কর্মসূচীর এটা একটা বড় প্রাপ্তি।
১৬ মার্চ রাতে প্রয়াত হলেন কলকাতায় কালীঘাট অঞ্চলের পার্টির সকলের শ্রদ্ধেয় মাসিমা যূথিকা চ্যাটার্জী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তিনি রেখে গেছেন পরিবারের বাকী সব সদস্য সহ বহু পরিজনদের। ‘৮০-র দশক থেকে দীর্ঘকাল ধরে পার্টির নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত আশ্রয়স্থল — মিটিং স্থল ছিল কালীঘাটে সকলের প্রিয় মাসিমার বাড়ি। বাড়ি বদল হয়েছে এলাকার একদিক থেকে অন্যদিকে, পার্টি একটা সময়ে এসে গণকাজ করতে শুরু করে, কাজের ধারার এই পরিবর্তনের কারণে মাসীমার বাড়িতে যাতায়াত ক্রমশ কমে গেলেও তাঁর স্নেহশীল সংস্পর্শ, পার্টি বোধ ও ব্যাক্তিত্বের ছোঁয়া পেয়েছেন বহু কমরেড। তাঁর দুই পুত্রই পাটির কর্মী। ইতিমধ্যে ছোটজন অরূপের (রূপা) আকস্মিক অকাল প্রয়াণ মাসীমাকে প্রবল যন্ত্রণাবিদ্ধ করে তোলে। তবে ভাবপ্রকাশে কখনও বুঝতে দিতেন না। পার্টির প্রতি ও মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অসম্ভব ভালোবাসা। চর্চায় থাকতো পার্টির রাজনীতি। মাসীমা চলে যাওয়ায় পার্টি কমরেডরা গভীর শোকাহত। মাসীমার স্মৃতিকথা বেঁচে থাকবে উত্তর প্রজন্মের চলার পথে, লড়াইয়ের মাঝে। লাল সেলাম।
১৮ মার্চ সকালে পাওয়া এই খবরটা আমাদের অনেককেই খুব কষ্ট দিয়েছে, অবাক করেছে, শোকস্তব্ধ করেছে। আমরা মানতেই পারছি না যে অকালে প্রয়াত হয়েছেন মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনার বর্তমান কর্ণধার ইন্দ্রাণী রায়। একদা গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও তাঁর বন্ধু সুমথনাথ ঘোষ মিলে যে প্রকাশনা শুরু করেছিলেন ও বিখ্যাত করেছিলেন, যাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ভানুবাবু বা সবিতেন্দ্রনাথ রায়, একালে তার হাল ধরেছিলেন আমাদের প্রজন্মের ইন্দ্রাণী। ভানুবাবুর কলেজ স্ট্রিটের সত্তর বছর বইপাড়ার এক অনবদ্য ইতিহাস। ইন্দ্রাণী সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে আরো অনেকদূর অবধি বয়ে নিয়ে যাবেন — এরকমটাই তো কথা ছিল। কিন্তু এই আকস্মিক প্রয়াণ সব হিসাব নিকেশ উলটে দিল। আমাদের শোকস্তব্ধ করে দিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিজের দেশে ঢুকতে দিতে চায় না বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম।
আগামী ২৬ মার্চের মোদি সফরের বিরুদ্ধে লাগাতার রাস্তায় নামছে বাংলাদেশের ছাত্রীছাত্ররা।
সমাপ্ত