আজকের দেশব্রতী : ১২ নভেম্বর ২০২০ (অনলাইন সংখ্যা)
issuecccrar

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলফল প্রকাশিত হওয়ার পর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য একটি ভিডিও বার্তায় বাংলায় এই বার্তাটি দেন :

করোনাকালের মতো একটা কঠিন সময়ে এবং বিহারের মত একটা সংকটগ্রস্ত রাজ্যে বিপন্ন মানুষ কীভাবে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্নগুলো কীভাবে একটা নির্বাচনে অ্যাজেণ্ডা হয়ে উঠতে পারে সেটা বিহারের নির্বাচন এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বিহারের নির্বাচন বস্তুত একটা গণ আন্দোলন হয়ে উঠেছিল। একটা যুবশক্তির আন্দোলন এবং পরিযায়ি শ্রমিকদের আন্দোলন, এবং সেই আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল বলেই বামপন্থীদের ফলাফলটা তুলনামূলকভাবে বিহারে ভালো। কারণ লকডাউনের সময় মানুষের অভিজ্ঞতা হল, কোনও সরকার মানুষের পাশে ছিল না, সেখানে বামপন্থী কর্মীবাহিনীই ছিল, তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সেটা বামপন্থার যে ঐতিহ্য — দীর্ঘদিন ধরে — মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার, থেকে রাজনীতি করার, সেটা আবার মানুষ দেখলেন।

বিহারের নির্বাচন এটাও দেখালো যে আজকের এই যে বিজেপির দাপট, যে বিজেপি মানেই সে নির্বাচনে অপরাজেয়, এবং কেন্দ্রের সরকার এবং বিভিন্নভাবে যে পুরো ভারতবর্ষের যে পলিটিকাল সিস্টেম – সেখানে আর কোনও গণতন্ত্রের জন্য জায়গা নেই, সাধারণ মানুষের জন্য আর কোনও জায়গা নেই। এই যে একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে – সেখানে এখনও মানুষের মূল্য আছে এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়া যায়, সেই লড়াই করে উঠে দাঁড়ানো যায়, বিহার সেটা দেখিয়ে দিল। অবশ্যই শেষরক্ষা হয়নি, সরকারটা বদলে যাওয়া উচিৎ ছিল, সেটা হতে পারেনি, কিছু সিট কম পড়ল। কিন্তু আমার মনে হয় যে বিহার যে একটা বার্তা দিল সেটা গোটা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনগুলোতে, আগামী বছরের শুরুতে, বিহারের পরে, পশ্চিমবাংলার নির্বাচন, আসামের নির্বাচন, তামিলনাড়ুর, কেরালার নির্বাচন। তো সমস্ত জায়গাতেই, আমার মনে হয়, বিজেপি একটা বিরাট বড় বিপদ এই মুহূর্তে, গণতন্ত্রের জন্য সংবিধানের জন্য, আইনের শাসনের বিরুদ্ধে। পশ্চিমবাংলাতেও একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে, তাদের যে গণতন্ত্র-বিরোধী আচরণ সেই রাজ্যে, পশ্চিমবাংলাতেও যে দুর্নীতি, সেই প্রশ্নগুলো আমাদের কাছে আছে। কিন্তু তবুও আমি বলব যে, পশ্চিমবাংলাতেও বিজেপিকেই এক নম্বর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বামপন্থীদের অবশ্যই নিতে হবে। কারণ ত্রিপুরা বিজেপির হাতে চলে গেছে, আসাম বিজেপির হাতে চলে গেছে, বিহারে বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফিরে এল। ঝাড়খণ্ড কোনোমতে বিজেপি থেকে কিছুটা অব্যাহতি পেয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবাংলায় বিজেপির যেভাবে দাপট বেড়ে উঠছে লোকসভা নির্বাচনের পরে, সেটা বাংলার মানুষ দেখছে। পশ্চিমবাংলার বুকে বামপন্থীরা বিহার থেকে উৎসাহ নিয়ে আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হয়ে তারা লড়াই করুক এবং গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বামপন্থীরা উঠে দাঁড়ান। এটা বিহারের মানুষও দেখতে চায়। তো, যেরকম বিহার থেকে ... বিহারকে বামপন্থীরা উৎসাহ দিয়েছেন গোটা দেশের, তেমনই বিহারও চায় পশ্চিমবাংলা রুখে দাঁড়াক।

এবং, আরেকটা কথা হচ্ছে, গোটা দেশে যেভাবে কেন্দ্র সরকার একটা বুলডোজার চালাচ্ছে — ভারতবর্ষের ফেডেরাল স্ট্রাকচার বিপন্ন, রাজ্যে রাজ্যে রাজ্য সরকারগুলো তাদের ক্ষমতা হারাচ্ছে। সেখানে পশ্চিমবাংলা, বিহার — আমাদের যে পূর্ব ভারত সেই পূর্বভারতের যে ফেডেরাল রাইটস, আমার মনে হয় এটা একটা বড় প্রশ্ন — সেখানে বাংলার মানুষ, পশ্চিমবাংলা, বিহার, আসাম — এই সমস্ত রাজ্যের মানুষ একসাথে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করুন গণতন্ত্রের প্রশ্নে, সংবিধান রক্ষার প্রশ্নে, ভারতবর্ষের ফেডেরালিজমের প্রশ্নে এবং খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের প্রশ্নে। এটা সময়ের দাবি। আমার মনে হয় বিহারের আন্দোলন বিহারের নির্বাচন সেই বার্তা দিয়েছে। আমরা সেই বার্তা নিয়ে গোটা দেশে বামপন্থীরা এগিয়ে যাব। এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। বামপন্থী আন্দোলন গণতন্ত্র রক্ষার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কাজ করবে।

bhred

মোট ১৯টি বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিআই(এমএল) প্রার্থিরা সর্বমোট তের লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার দুশো বাহাত্তর (১৩,৪৫,২৭২) ভোট পেয়েছে যা সর্বমোট ভ্যালিড ভোটের ৩.৯%; ১২টি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে এবং বাকি ৭টি আসনে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকেছে। সিপিআই ৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২টি আসনে জয়ী হয়েছে এবং বাকি আসনগুলির তিনটিতে দ্বিতীয় ও একটিতে তৃতীয় অবস্থানে থেকেছে। সিপিআই(এম) ৪টি আসনে লড়ে ২টিতে জয়ী হয়েছে এবং বাকি একটিতে দ্বিতীয় ও অন্যটিতে তৃতীয় অবস্থানে থেকেছে। যে সাতটি আসনে সিপিআই(এমএল) দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তার মধ্যে তিনটি আসনে গণনায় কারচুপির সম্ভাবনা সামনে আসায় সেগুলিতে পুনর্গণনার দাবি জানিয়ে আবেদন জানানো হয়েছে যা বিচারাধীন আছে।

বিজয়ী সিপিআই(এমএল) প্রার্থিদের প্রাপ্ত ভোট ও জয়ের ব্যবধান

tab

 

মোট ১২টি আসনে বামেরা বিজেপির মুখোমুখি হয় [ সিপিআই(এমএল) ৮টিতে – দরৌলি, তরারি, কারাকাট, আরওয়াল, আরা, দরৌন্দা, দিঘা, ওউরাই;  সিপিআই ৩টিতে – বখরি, বাছওয়ারা, ঝঞ্ঝারপুর; সিপিআই(এম) ১টিতে – পিপরা ]। এর মধ্যে বাম দলগুলি ৫টিতে জিতেছে সিপিআই(এমএল) ৪টিতে ও সিপিআই ১টিতে)]। ১৬টি আসনে জেডিইউ’র মুখোমুখি হয় বামেরা, যার মধ্যে সিপিআই(এমএল) ১০-এ ৭টিতে জিতেছে, সিপিআই ৩টির মধ্যে ১টিতে জয়ী, সিপিআই(এম) ৩টির ২টি জিতেছে। বাকি একটিতে ভিআইপির মুখোমুখি সিপিআই(এমএল) জিতেছে (বলরামপুর)।

আরজেডি ৭৫ আসন পেয়ে সর্বোচ্চ দল হিসেবে সামনে আছে, বিজেপি ৭৪টি আসন জিতে দ্বিতীয়। বিজেপি জোট (এনডিএ) সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজনীয় সংখ্যা (১২২ আসন) অতিক্রম করেছে।

deeearded

তৃণমূল কংগ্রেস আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার গোষ্ঠী সংঘাতের পরিণামে প্রায় নিশ্চিত এক ভাঙ্গনের মুখে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! সেই তোপ শোনা যাচ্ছে নন্দীগ্রামে প্রতাপশালী ‘অধিকারী পরিবার’ থেকে আসা দাপুটে দল নেতা-মন্ত্রীর মুখে। যে নন্দীগ্রামের ভূমি উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন তৃণমূলকে রাজ্যের মসনদে পৌঁছে দিয়েছিল, সেখানে এখন দল দুভাগ হওয়ার অবস্থা। তৃণমূলের ক্ষমতায় আরোহণের পথ সুগম হয়েছিল আরেক কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের সুবাদে যে সিঙ্গুর থেকে, সেখানেও দলে দুর্নীতি ও ক্ষমতার সংঘাতকে কেন্দ্র করে অশান্তি বাসা বেঁধেছে বেশ ক’বছর। দল দীর্ণ হচ্ছে স্থানীয় জনগণের বিভিন্ন অংশের সাথেও সংঘাতে জড়িয়ে। অন্দরে প্রবীণ মাস্টার মশাই আর উঠতি দাদা-নেতার মধ্যেকার গোষ্ঠিদ্বন্দ্ব, বাইরে ‘জমি ফেরত দেওয়া’ ও কৃষিকে পুনরুদ্ধার করার প্রশ্নে সদিচ্ছা ও গুরুত্ব প্রদানকে কেন্দ্র করে দল আর জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব — এই দুই সংঘাতে সিঙ্গুরে তৃণমূলের পায়ের তলা থেকে মাটি ক্রমেই সরে সরে যাচ্ছে। না, সিপিএমের দিকে তার কোনো প্রত্যাবর্তন ঘটেনি, ঘটছে না, বরং ঘোর বিপদজনক বিপথগামী হয়েছে বিজেপির প্রভাবে। গত লোকসভা নির্বাচনে ওখানে বিজেপির দিকে সিপিএমের প্রতি হতাশগ্রস্ত অংশ শুধু নয়, টিএমসি-র প্রতিও বীতরাগবশত একাংশ চলে গিয়েছিল। অবশিষ্ট বিক্ষুব্ধ টিএমসি গোষ্ঠী এখন পরোক্ষে আসন্ন ভাঙ্গনের সংকেত দিতে শুরু করেছে নন্দীগ্রামের ‘দাদার কীর্তি’র সপক্ষে থাকার জানান দিয়ে। নন্দীগ্রামে তৃণমূলের শিবিরে যা ঘটছে সেটা দলনেত্রী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতৃত্বচক্র স্বীকার না করলেও রাজ্যের শাসক দলের অভ্যন্তরে অনেকটা বজ্রপাতের মতো, ধ্বস নামার মতো। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর এতবড় ভাঙ্গনের মুখে পড়েনি। এর আগে দলের প্রাক্তন দু’নম্বর নেতা ও তার একান্ত আপন গোষ্ঠী বেরিয়ে গিয়ে বিজেপিতে ঢুকেছে, বিজেপি শর্ত দিয়েছে তৃণমূল ভেঙ্গে ফায়দা তোলার প্রমাণ দিয়ে চলার, গোষ্ঠীচক্রগুলো লুফেও নিয়েছে সেই কারবার। তমলুকের ‘অধিকারী সাম্রাজ্যের’ অধীশ্বরের নয়া হৈ হল্লা তোলার রাজনৈতিক মতিগতি যদিও এখনও খুব স্পষ্ট নয়, তবে তাঁর ওপর যে বিজেপির বেশ কিছুকাল যাবত নজর রয়েছে তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না। আঞ্চলিক শাসক দল তৃণমূলে যে ভাঙ্গনের প্রবণতা চলছে তার প্রধান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ গন্তব্য বিজেপি। এভাবে বাংলার ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে বেড়ে চলেছে বিজেপি বিপদ। এই বিপদ ওরা যে বাড়াতে পারছে তার পেছনে অবশ্যই তৃণমূলী অপশাসনের জনপ্রতিক্রিয়া এবং তার নেতৃত্বের ভেতরকার নানা ক্ষমতার সংঘাত বেশ বড় কারণ। অন্য ভাষায় বললে খাল কেটে বিজেপির ধেয়ে আসার সুবিধা করে দেওয়ার জন্য তৃণমূল অবশ্যই দায়ী।

তবে বিজেপি-ই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় বিপদ এবং তার সবথেকে বড় বড় কারণগুলো রয়েছে বিজেপির মধ্যেই। তার ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ও রাজনীতি, কর্পোরেটমুখী সংস্কার কর্মসূচী, দেশব্যাপী হামলা নামানো ও দখল অভিযান চালানোর মধ্যে। বিজেপি মানেই সংবিধান ও গণতন্ত্রের সমূহ বিপদ, বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মেরুকরণে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিষিয়ে যাওয়া। বিহারে কোনোক্রমে গরিষ্ঠতা জুটে যাওয়া জোট সরকারের চালকের আসনের দখল হাসিল করে বিজেপি হুমকি দিচ্ছে ২০২১-এর নির্বাচনে বাংলা দখলের।

বিপরীতে, বিজেপিকে মোকাবিলার কার্যকরী নতুন আশা-ভরসাও জাগিয়েছে বিহারে বাম শক্তিসমূহের আত্মঘোষণা। তাই বিহারে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বামপন্থীরা তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলার বুকে আরও দৃঢ়তার সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে থাকতে হবে রণাঙ্গনে। বামপন্থার নির্ণয়ে বিজেপিকেই গণ্য করতে হবে প্রতিরোধের প্রধান লক্ষ্যবস্তু, সেই ধারায় তৃণমূলকেও বুঝিয়ে দেওয়া যাবে কাকে বলে জবাব।

masshir

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এবং এনডিএ গোটা দেশে এবং বিহারে চমকপ্রদ ফল করে। এই জয় এবং প্রধান বিরোধী দল আরজেডির মুখ্য নেতা লালু প্রসাদ যাদবের কারাবাস জনিত বিহারের রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে অনেকেই একসময় ভেবেছিলেন ২০২০-র বিহার বিধানসভা নির্বাচন হবে একপেশে। কোভিড-১৯ ও লকডাউনকেও এনডিএ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। ক্ষমতায় ফিরলে বিহারের জনগণকে বিনামূল্যে কোভিড টীকা দানের প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের সব মানুষের ন্যায্য অধিকারকে একটি রাজ্য নির্বাচন জয়ের তাস হিসেবে ব্যবহার করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা।

কিন্তু একতরফা নির্বাচন সম্পর্কে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতামতের বিপরীত বাস্তবতা সামনে আসতে শুরু করে মহাজোটের ঐক্যবদ্ধ চেহারাটি সামনে আসার সময় থেকেই। বিশেষ করে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সহ বাম দলগুলির উপস্থিতি ও নিজস্ব অ্যাজেন্ডা গোটা পরিস্থিতিকে দ্রুত পালটে দিতে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে এনডিএ সরকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের হামলা ও দমন পীড়নের বিরুদ্ধে লিবারেশন সহ বামেদের নাছোড় মাটি কামড়ানো কঠিন রাস্তার লড়াইগুলি নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে ঝড় তোলে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের জন্য জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করে। লকডাউনের ফলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা সহ বিহারের যে গরিব জনগণ সীমাহীন যন্ত্রণা ও অবমাননার মুখোমুখি হন, সিপিআই(এমএল)-এর কর্মীরা প্রাণপণে তাদের পাশে দাঁড়ান ও নানা ধরনের সাহায্য, সহযোগিতা ও আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাদের ভরসার জায়গা ও কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন।

পরিস্থিতির এই দ্রুত পরিবর্তন বিজেপি ও এনডিএ-কে সন্ত্রস্ত করে তোলে। বিজেপি সভাপতি থেকে শুরু করে তাদের তাবড় নেতারা সিপিআই(এমএল)-কে সুনির্দিষ্টভাবে আক্রমণের বর্শামুখ করে তোলেন। লিবারেশন সম্পর্কে অলীক মিথ্যা নানা প্রচার বিহারের বুকে সিপিআই(এমএল) রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে চর্চাকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে।

১৯৮০-র শেষদিকে সিপিআই(এমএল) প্রথমে আইপিএফ-এর মঞ্চ থেকে ও তারপর নব্বই এর দশকের শুরুতে পার্টি পরিচিতি নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে। বুথ-দখল রুখে দেওয়া এবং ভূমিহীন দরিদ্র ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত দলিতদের তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সিপিআই(এমএল)-এর রাজনীতি তাদের ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ ও দলিতদের ক্ষমতায়নের দল হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। ভোজপুরে সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষে ভোট দেবার জন্য দলিতদের গণহত্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু তারা ১৯৮৯ সালে প্রথম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাংসদ হিসাবে কমরেড রামেশ্বর প্রসাদকে সংসদে পাঠাতে সফল হয়।

পরবর্তীকালে সাহার থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জয়ী হন ভোজপুরের প্রবাদ প্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রাম নরেশ রাম। বিহারের রাজ্য সরকারী কর্মচারি আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কমরেড যোগেশ্বর গোপকে জনগণ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিধানসভায় পাঠান। প্রথমে বিহারে ও তারপর রাজ্য ভাগের পর ঝাড়খণ্ডের জনগণের সবচেয়ে দুঃসাহসী কণ্ঠ, কমরেড মহেন্দ্র সিং একাধিকবার নির্বাচনে বিজয়ী হন। রাজনীতির ময়দান থেকে সরানোর জন্য ২০০৫ সালের নির্বাচনের মনোনয়ন পেশের ঠিক পরেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও বিহারের মানুষ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন চন্দ্রদীপ সিং, অমরনাথ যাদব, অরুণ সিং, সুদামা প্রসাদ ও রাজরাম সিংয়ের মতো প্রখ্যাত কৃষক নেতাদের। কৃষিমজুর নেতা সত্যদেব রাম, সীমাঞ্চলের জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা মেহেবুব আলম, বিনোদ সিং ও রাজকুমার যাদবের মতো ঝাড়খণ্ডের জনপ্রিয় নেতারা বিহার ও ঝাড়খন্ড বিধানসভায় সিপিআই(এমএল) বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

mass

 

এই লড়াই আন্দোলনের ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বিত হয় শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র ক্ষোভের সমকালীন বাস্তব। সুশাসন ও উন্নয়নের রেটরিকগুলির আড়ালে নীতীশ সরকারের আমলে বিহারের বাস্তব অবস্থাটি নির্বাচনী প্রচারে প্রবলভাবে সামনে আসে।

নীতীশ কুমারের প্রশাসনিক মডেলে প্রথম থেকেই ছড়ি ঘুরিয়েছে আমলাতন্ত্র এবং তাতে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তেমন কোনো ভূমিকাই থাকেনি। জনগণের নানান অংশের বৈধ দাবি ও আন্দোলনগুলোর প্রতি কোনো সম্মানও দেখানো হয়নি। বছর-বছর ধরে চলা এই আমলাতন্ত্র-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা ক্রমেই আরও বেশি স্বেচ্ছাচারী ও অনির্ভরযোগ্য হয়ে দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন বিভাগ ও অঞ্চলে চক্রগুলোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে; যে সমস্ত অফিসার নির্দেশ মতো চলেননি, প্রধান্যকারী নেতা ও স্বার্থের প্রতি অনুগত না হওয়ায় তাদের হেনস্থা ঘটানো ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নীতীশ কুমারের ‘সুশাসন’-এর আষাঢ়ে কাহিনী সৃজন-এর মতো দুর্নীতিতে কালিমা লিপ্ত, মুজাফফরপুরের নারী আবাসে ধর্ষণ ও মেয়েদের হত্যা এবং ছাপরা থেকে মাধেপুরা, ঔরগঙ্গাবাদ থেকে জাহানাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে দাঙ্গার মতো রাষ্ট্র চালিত ভয়াবহ অপরাধগুলোর কলঙ্কে কলঙ্কিত। শিক্ষার বিকাশের ক্ষেত্রে নীতীশ সরকারের ব্যর্থতা বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে সামনে আসে এবং এই প্রেক্ষাপটেই সাম্প্রতিক সময়ে বিহারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অভিনব ধারার সৃজনশীল আন্দোলন ‘সড়ক পর স্কুল’। বিহারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের দাবিতে নতুন ধারার আন্দোলনগুলির কাণ্ডারি তরুণেরা নির্বাচনে প্রার্থী হবার ফলে সমাজে এক নতুন ধরনের উৎসাহের সঞ্চার হয়।

বিজেপি নীতীশ কুমারকে তাদের মুখ হিসাবে কাজে লাগিয়ে বিহারে নিজেদের অনুপ্রবেশকে গভীরতর এবং নিয়ন্ত্রণকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তুলেছে। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে সে সমস্ত ক্ষমতাকে আত্মসাৎ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষমতার এই সংহতকরণ ও কেন্দ্রীভবন মোদী সরকারের বৈশিষ্ট্য রূপে দেশের নানা জায়গাতেই আত্মপ্রকাশ করেছে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের জোট ক্ষমতার সমীকরণের এই নতুন বিন্যাস সৃষ্টির চেষ্টার মুখেই ভেঙে গেছে। বিহারেও লোক জনশক্তি পার্টিকে তারা নীতীশকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হিসেবে আড়াল থেকে মদত দিয়েছে, এমনটা অনেকেই মনে করেছেন।

বিজেপি যে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে রাশিকৃত করছে, ভারতের কৃষক ও শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে তার সমস্তটাকেই তারা কাজে লাগাচ্ছে আদানি-আম্বানী সাম্রাজ্যের সুবিধার স্বার্থে। বিভিন্ন আইন ও নীতির মধ্যে দিয়ে এটা এত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কোথাও কোথাও এর পরিপ্রেক্ষিতে এনডিএ শরিকেরা জনগণ ও কৃষক শ্রমিকদের আন্দোলনের স্বার্থে এনডিএ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। সাম্প্রতিক কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাঞ্জাবের আকালী দলের মোদি সরকার থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনায় যা আত্মপ্রকাশ করেছে।

এবারের বিহারের নির্বাচনের যে জনরায় সামনে এল, তাতে এনডিএ কানঘেঁষে সরকার গঠন করতে সমর্থ হলেও জনগণের ক্ষোভ অস্পষ্ট থাকেনি। বিহারের সীমান্ত অঞ্চলে বিরোধী ভোটের অনভিপ্রেত বিভাজন আটকানো গেলে বা মহাজোটে বামেদের অংশভাগের ন্যায়সঙ্গত অধিক প্রতিনিধিত্ব থাকলে বিহারের মানুষের মেজাজটি সরকার গঠনে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হতে পারত। তা সত্ত্বেও ১২ জন সিপিআই(এমএল) প্রার্থী সহ ১৬ টি আসনে বামেদের জয় যথেষ্ট সম্ভাবনাপূর্ণ বিষয় হিসেবে গোটা দেশেই চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনে বামেদের হতাশাজনক ফলের বিপরীতে বিহারে লিবারেশন সহ বামেদের এই সাফল্য গোটা দেশের বাম গণতান্ত্রিক মহলের কাছে উৎসাহব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে।

বিহার ১৯৭০-এর দশকে গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন হয়ে দেখা দিয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের পথপ্রদর্শনে ১৯৭৪-এর ছাত্র আন্দোলন গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে এবং জরুরি অবস্থার অবসানে প্রবল ভূমিকা পালন করেছিল। বিহার আরও একবার ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সংঘ বাহিনীর সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল। নির্বাচনী ফলাফল থেকে ইতিবাচক শক্তি সংগ্রহ করে বিহারকে আজ আবার তার সমস্ত শক্তি, উদ্যম ও অঙ্গীকারের সম্মিলন ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদী বুলডোজারকে রুখে দিতে হবে, সংবিধানকে বাঁচাতে, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে এবং জনগণের জন্য অধিকার অর্জন করতে হবে।  বিহারের রাজনীতি যে বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের নতুন দিনকালে প্রবেশ করল এবং তাতে যে সিপিআই(এমএল) সহ বামেদের এক বিরাট ভূমিকা থাকবে, ২০২০-র বিহার বিধানসভা নির্বাচনের রায় থেকে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

dip

 

পশ্চিমবঙ্গ সহ যে সব জায়গায় আগামীদিনে যে সব নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেগুলির জন্য বিহার নির্বাচন কোনও বার্তা দিচ্ছে কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশেষভাবে মনে হয় বিজেপিকে বিভিন্ন সময়ে যতটা অপরাজেয় মনে হয়, আসলে সে যে তা নয়, এটাই বিরোধী শক্তির জন্য এই নির্বাচনের প্রধান ইতিবাচক বার্তা। বিজেপি জোটের পক্ষে যথেষ্ট একপেশে হবার সম্ভাবনা হিসেবে যে নির্বাচনকে দেখা হচ্ছিল, সেটাই ক্রমশ এক গণ আন্দোলনের চেহারা গ্রহণ করে বিজেপি জোটকে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিল। ফ্যাসিবাদী জমানার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের প্রমাণ মিলেছে বিহার নির্বাচন থেকে। মোদি সরকারের বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক নীতিমালার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক গণ আন্দোলনের গুরুত্বকেও বিহার নির্বাচন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। সিপিআই(এমএল) সহ বামেদের বিধানসভার ভেতরে উপস্থিতি ছিল সামান্যই। গত লোকসভা ভোটের বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলেও বিজেপি বিরোধীরা খুবই কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। কিন্তু গণ আন্দোলনের ময়দানে ও মানুষের রোজকার সমস্যায় তাদের সক্রিয় উপস্থিতি বিধানসভার ভেতরের বিন্যাসকে এবার অনেকটাই বদলে দিয়েছে। সিপিআই(এমএল) সহ বামেরা তিন থেকে আসনসংখ্যাকে ষোলতে নিয়ে যেতে পেরেছে, সিপিআই ও সিপিএম বিহার বিধানসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব ফিরে পেয়েছে। প্রথমবারের জন্য সিপিআই(এমএল)-এর একডজন প্রার্থী বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে গোটা দেশেই বামেদের আবার আলোচনার মধ্যে ফিরিয়ে এনেছেন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বামেরা আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে। বিহার নির্বাচনের এইসমস্ত ইতিবাচক বার্তা থেকে পশ্চিমবঙ্গ সহ নানা রাজ্যের বাম গণতান্ত্রিক শক্তিই উৎসাহের রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারেন।

- সৌভিক ঘোষাল    

birddar

১৫ নভেম্বর ১৮৭৫ - ৯ জুন ১৯০০, মাত্র পঁচিশ বছরের জীবন। ভারতের আদিবাসী জনতার কাছে তিনি কেবল উলগুলান বা মহাবিদ্রোহের নেতা নন, তিনি ভগবান বিরসা, তিনি ধরতি আবা। দিকুদের শোষণ বিদ্বেষ ও অবজ্ঞার বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজকে মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। আমাদের দেশের দশ কোটি আদিবাসী জনতার ওপর সুব্যবস্থিত শোষণ ও অত্যাচার চলছে দীর্ঘদিন। সিআরপিএফ ও পুলিশের দ্বারা খুন ধর্ষণ ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে আদিবাসী জনতার ওপর যে পুলিশী নৃশংসতা চলে, যেভাবে প্রান্তিক করে রাখা হয় সামাজিক ক্ষেত্রে, উচ্ছেদ করা হয় জমি ও অরণ্যের অধিকার থেকে – সেই বাস্তবতাকে স্বীকার করে সেই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

ddber

পুরুলিয়ায় এসে রাস্তার মোড়ের একটি শিকারের ভাস্কর্যে বিজেপি নেতা অমিত শাহ খুব ঘটা করে মালা পরালেন বিরসা মুণ্ডার গলায় মালা পরাচ্ছি বলে। অতপর বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতির পক্ষ থেকে বলা হল, “যদি ওটা বিরসার মুর্তি নাও হয় তবু যেহেতু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালা পরিয়েছেন তাই এখন থেকে ওটাই বিরসার মুর্তি, সকলকে তাই মেনে নিতে হবে”। এতটাই দম্ভ ওদের! আমাদের ইতিহাসের বীরদের ইচ্ছে মতো অপমান করতে পারে ওরা। সরকারে আছে বলেই ওরা ইতিহাস পাল্টে ফেলতে পারে নিজের ইচ্ছে মতো! যে কোনও মুর্তিতে মালা দিয়ে বলতে পারে তাকেই বিরসা মুণ্ডা বলে মেনে নিতে হবে সকলকে!

আদিবাসীদের জন্মজন্মান্তরের আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, অরণ্য ধ্বংস করে আদিবাসীদের জমি লুটেরা পুঁজিপতিদের কাছে বিকিয়ে দেয়; ইউপিতে ভোটে জিতেই সাহারানপুরের দলিত গ্রাম জ্বালিয়ে শেষ করে দেয় আর দলিত কর্মীদের বিরুদ্ধেই ‘সংঘর্ষের’ মামলা আনে; হাতরাসে দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর ধর্ষিতার পরিবারকেই নির্যাতন করে; ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিত সমাবেশে সংগঠিত হামলা চালিয়ে দলিত আন্দোলনকর্মীদের বিরুদ্ধেই ইউএপিএ মামলা চাপিয়ে এনআইএ লেলিয়ে দেয়; সরকারী চাকুরির সংরক্ষণ খতম করে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী সরকারি সংস্থাগুলিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেয় যাতে আদিবাসী আর দলিতেরা বরাবরের জন্য সম্মানজনক জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়; নর্দমায় নামিয়ে দলিতদের হত্যা করে ওরা, এবং, এইসবের পর ওদের হোতা অমিত শাহ আদিবাসী বাড়িতে খাবার খায় ফটো তোলার জন্য!

hgghg

অমিত শাহ বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখছেন, বাংলার তপশিলি, আদিবাসী, মতুয়া জনগোষ্ঠীর ভোট বিজেপি মুখি করতে পারবেন, মুখ্যত এই প্রত্যাশা থেকে। বিগত লোকসভা ভোটে বিজেপির অগ্রগতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল টিএমসি থেকে মুখ ফেরানো গ্রামীণ ক্ষেত্রে নির্ধারক এসসি/এসটি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত ভোট বিজেপির ভোট বাক্সে যাওয়া।

এবার বাংলায় এসে একদিকে নেতাদের কাছে ২০০ আসনে বিজয় দাবি করলেন, বুথ সংগঠনের পরামর্শ দিলেন অন্যদিকে আদিবাসী বাড়িতে ভোজ সেরে অমিতজী তৃণমূল স্তরে বার্তা ছড়াতে চাইছেন, “আমি তোমাদেরই লোক”!

২০২১-এর বাংলার ভোট যত এগিয়ে আসবে, ততই ভণ্ডামি বাড়তে থাকবে। বিগত লোকসভা ভোটের সময়ও লকেট চ্যাটার্জীরা বারবার ছুটে যান আদিবাসী গ্রামে। আদিবাসী নাচে পা মেলাচ্ছেন, মিডিয়া এই ছবি কভার করে। হুগলি লোকসভায় বিজেপি জেতেও। কিন্তু তারপর লকেট চ্যাটার্জীর দেখা মেলেনি, আদিবাসী পল্লীতে। তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন চন্দননগরের উর্দিবাজারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির কাজে! হুগলি নদীর ওপারের অর্জুন সিং-এর সাথে যৌথভাবে! এমনকি আদিবাসী জনগণ প্যানডেমিক পরিস্থিতিতেও হুগলির বিজেপি এমপিকে পাশে পায়নি। ভোট এলে লকেট চ্যাটার্জীরা তবেই আদিবাসীদের সাথে নাচ করেন! বাকি সময় ভুলে যান। একারণেই, লকডাউনের সময় করোনার বিপদের ঝুঁকি নিয়ে রিলিফের কাজে লকেট চ্যাটার্জীরা থাকেন না।

বিপরীতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং বিশেষত আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ নিজেদের অর্থনৈতিক সীমিত সাধ্যকে ছাড়িয়ে ওই দুঃসময়ে আদিবাসী গ্রামগুলিতে রিলিফের কাজ চালিয়েছে, বিপন্ন আদিবাসীদের পাশে থাকার চেষ্টা চালিয়েছে।

রিলিফ ছাড়াও রেশন আদায়, জবকার্ড আদায়, রেশন কার্ড আদায়, ১০০ দিনের কাজ আদায়ে লাগাতার সক্রিয় থেকেছে সংগঠন।

লকডাউনে হঠাৎ কাজ হারিয়ে দিশেহারা ছিলেন মেহনতিরা। বিশেষত যে সকল পরিবারের ঋণগ্রস্থতা ছিল, তাদের বিপন্নতা ছিল বহু গুণ।

সিপিআই(এমএল) সংগঠকদের নেতৃত্বে পরিচালিত ঋণমুক্তি কমিটি এসময় লাগাতার গরিব ঋণগ্রস্ত, অসহায় পরিবারগুলির পাশে থেকেছে; ভরসা দিয়েছে। এখনো ভরসা দিচ্ছে।

হুগলি জেলার আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ছিলেন কমরেড বিশ্বনাথ সরেন।

প্রয়াত কমরেডকে লকডাউনের মধ্যেও যথাযোগ্য শেষ বিদায় জানানো, প্রয়াত কমরেডের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সংগঠনের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল। জেলা আদিবাসী নেতৃত্বের ভালো অংশের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল।

এই পরিস্থিতিতে অমিত শাহের বাংলা অভিযানের প্রেক্ষাপটে মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে আদিবাসী, মেহনতিদের রুটি, রুজির প্রশ্ন নিয়ে ৬ নভেম্বর জেলার চারটি ব্লকে বিডিও সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।

মূলত আদিবাসী ও আয়ারলা নেতৃত্বের তৃণমূল স্তরের উদ্যোগে এই কর্মসূচী। ভোট সর্বস্বতা নয়, গিমিক নয়; দাবি আদায়ে লাগাতার গণ আন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করে চলেছে সংগঠন।

গ্রাম বাংলা দীর্ঘ লকডাউনে কর্মহীন থেকে এখন চাষের মরশুমে, মেহনতিরা কর্মহীন থেকে কাজের মরশুমে ঢুকছেন। চলবে অন্তত দেড় মাস। হালকা হতে ডিসেম্বর শেষ। ঠিক ধান কাটা ও আলু চাষের শুরুর মুখে এই কর্মসূচী। ৬ নভেম্বরের কর্মসূচীতে কয়েকটি ব্লকে বুনিয়াদী আদিবাসী জনগণের অংশগ্রহণ ছিল উৎসাহজনক।

আদিবাসী মঞ্চের নভেম্বর কর্মসূচীর দাবি ছিল –
১) লোকপ্রসারে স্বজনপোষণ চলবে না।
২) প্রতি হাতে জবকার্ড, ২০০ দিনের কাজ
৩) গ্রামীণ মেহনতিদের মর্যাদা সহ (আরপিএফ জুলুম), করোনা সুরক্ষিত রেল যাত্রা
৪) গ্রামীণ কারখানাগুলিতে ন্যূনতম মজুরি, ৮ ঘণ্টার শিফট সহ শ্রম আইন কার্যকর করা, খেতমজুরদের সরকার নির্ধারিত মজুরি নিয়ে বিডিও-র হস্তক্ষেপ
৫) লিজ/ভাগচাষি সহ প্রকৃত উৎপাদকদের রবি চাষাবাদে ঋণ, ভর্তুকিতে আলুবীজ, সার সরবরাহ, অভাবী বিক্রি রুখতে অবিলম্বে সহায়ক মূল্যে ধান ক্রয়।

- সজল অধিকারী   

aeeadee

২৬ নভেম্বর ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের আহ্বানে দেশব্যাপী যে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান করেছে, তার সমর্থনে এআইসিসিটিইউ বেলঘরিয়ায় কমিটি এক প্রকাশ্য সভা সংগঠিত করে ৯ নভেম্বর বেলঘরিয়ায়। সভা শুরু হয় নীতিশ রায়ের গণসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। এই সভায় বেলঘরিয়ায় কর্মরত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সভায় উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখেন অমল সেন এআইইউটিইউসি, ঝন্টু মজুমদার সিআইটিইউ, শৈবাল ঘোষ এআইটিইউসি এবং দিব্যেন্দু মিত্র আইএনটিইউসি। বক্তব্য রাখেন সৌমেন্দু মিত্র এআইএসএ, অর্চনা ঘটক এআইপিডাব্লুউএ, সুজিত ঘোষ এআইসিসিটিইউ এবং শিবশঙ্কর গুহরায় পঃবঃ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড ডে মিল) ইউনিয়ন। উপস্থিত ছিল এআইআরইএফ, বিসিএমএফ এবং রন্ধনকর্মী ও নির্মাণকর্মী ইউনিয়ন এবং সিপিআই(এমএল) সমর্থক, কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। সভা পরিচালনা করেন নবেন্দু দাশগুপ্ত।

জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির রাজারহাটে এআইসিসিটিইউ, এআইকেএম, আয়ারলার উদ্যোগে প্রচার সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন পার্টি নেতা অভিজিৎ মজুমদার ও কৃষক নেতা শ্যামল ভৌমিক। জলপাইগুড়ি শহরের সমাজপাড়ায় বাম দলের যৌথ সভা হয়। বক্তব্য রাখেন জলপাইগুড়ি জেলা পার্টি সদস্য সুভাষ দত্ত।

শিলিগুড়িতে ১১ নভেম্বর নকশালবাড়ি ও শিলিগুড়িতে ট্রেড ইউনিয়ন গুলির যৌথ প্রচার সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন দার্জিলিং জেলা পার্টি সদস্য মোজাম্মেল হক ও অভিজিৎ মজুমদার।

নদীয়া জেলায় গত ৩ নভেম্বর প্রচার সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বসু, জীবন কবিরাজ, সুবিমল সেনগুপ্ত।

৮ নভেম্বর চিত্তরঞ্জনের আমলাদহি বাজারে সভা আইসিসিটিইউ’র সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন রেল আন্দোলনের নেতা প্রদীপ ব্যানার্জি, সুভাষ চ্যাটার্জি, কৃশানু ভট্টাচার্য, স্বদেশ চ্যাটার্জি, আইসিসিটিইউ’র পক্ষে বাসুদেব বসু, সুরিন্দর সিং।৯ নভেম্বর আসানসোলে প্রচারসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন রেল শ্রমিক নেতা প্রদীপ ব্যানার্জি, স্বদেশ চ্যাটার্জি, আইসিসিটিইউ’র পক্ষে বাসুদেব বসু, সুরিন্দর সিং।

১১ নভেম্বর হুগলি জেলার হিন্দমোটরের নন্দন কাননে আইসিসিটিইউ ও পার্টির ডাকে যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বসু, প্রদীপ সরকার, অপূর্ব ঘোষ ও ছাত্র নেতা সৌরভ রায়।

aeebdn

পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের কুসুমগ্রাম বাজারে ৬ নভেম্বর যৌথ গণ কনভেনশন সংগঠিত হয়। এই কনভেনশনে ৩০০-র বেশি লোক উপস্থিত ছিলেন। কনভেনশনে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পক্ষ থেকে জেলা সম্পাদক কমরেড আনসারুল আমন মন্ডল বক্তব্য রাখেন।

৭ নভেম্বর ভাতার ব্লকের কামারপাড়া গঞ্জে গণ কনভেনশন সংগঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের গণসংগঠনের পক্ষে কমরেড কুনাল বক্সী। কয়েক শত মানুষের উপস্থিতি ছিল।

৯ নভেম্বর পুর্বস্থলী-১ ব্লকের নিমতলা বাজারে ও কাটোয়া থানার কুরচি গ্রামে গন কনভেনশন সংগঠিত হয়। জমায়েতে উপস্থিতি যথাক্রমে শতাধিক ও চার শতাধিক। বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে কুনাল বক্সী ও অশোক চৌধুরী। ১১ নভেম্বর পুর্বস্থলী-২ ব্লকের পুর্বস্থলী বাজারে ও ভাতার ব্লকের ভাতার বাজারে গণ কনভেনশন সংগঠিত করা হল। জমায়েতে হাজির ছিলেন পুর্বস্থলীতে শতাধিক ও ভাতারে দুই শতাধিক। বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে কুনাল বক্সী ও অশোক চৌধুরী।

সমস্ত জায়গায় সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের গণসংগঠনের নেতারাও বক্তব্য রাখেন। নেতারা মুলত ২৬ নভেম্বর সাধারণ ধর্মঘট ও গ্রামীণ ধর্মঘটের তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ব্যাখ্যা করেন। শ্রমিক বিরোধী শ্রম কোড ও জন-বিরোধী কৃষক বিরোধী কৃষি আইন বাতিলের গুরুত্ব এবং আইনের ভবিষ্যত কুফল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং দেশজুড়ে আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মাধ্যমে ধর্মঘট সফল করার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরেন। দেশজুড়ে শ্রমিক কৃষক ও গ্রামীণ গরিবদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার উপর জোর দেন।                              

- সজল পাল   

cobk

কলেজের অস্থায়ী কর্মচারিরা তাদের কাজের স্থায়িত্বের দাবিতে বাঁকুড়ার সম্মিলনী কলেজ থেকে মিছিল করে এসে শহরের মাচানতলায় ১২ নভেম্বর সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত অবস্থান বিক্ষোভ করে এবং জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। অবস্থান বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন ‘অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সমিতি’-র প্রতীপ মুখার্জি, এআইসিসিটিইউ-এর পক্ষে বাবলু ব্যানার্জি এবং সিআইটিইউর প্রতিনিধি। বাবলু ব্যানার্জি বলেন, আন্দোলনের পাশে এআইসিসিটিইউ প্রথম থেকেই ছিল, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় চলা অবস্থান অনশনে প্রতিনিধিরা গেছেন, পরেও থাকবে। বস্তুত এদিনের অবস্থানও সেভাবেই হয়েছে। তিনি প্রস্তাও দেন যে, জেলাশাসক যদি সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তবে আগামী দিনে রাস্তা অবরোধ করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে সংগঠন সর্বতভাবে পাশে থাকবে। তিনি সমরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, মনে রাখবেন সারা দেশে আগামী ২৬ নভেম্বর ধর্মঘট আপনাদের সমস্ত অস্থায়ী কর্মচারিদের স্থায়ীকরণ ও নুন্যতম ১৮০০০ টাকা মাসিক বেতনের দাবিও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি হিসেবে আছে।

vvvddaree

মনোজ মঞ্জিল গরিব দলিত পরিবার থেকে আসা লড়াকু যুব নেতা, রেভলিউশনারি ইয়ুথ অয়াসোসিয়েশনের ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট, বাবা মা ইঁটভাঁটার শ্রমিক। কম বয়স থেকেই ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক। গরিব দলিত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার আন্দোলনে এগিয়ে নিয়ে আসেন। বিহারের দলিত ছাত্রছাত্রীদের হস্টেলগুলির আস্বাস্থ্যকর অসুরক্ষিত অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই দিয়ে পথ চলা শুরু। আইসার জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে পার্টির দশম কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। গরিব শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আমলাতন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছেন। জেল খেটেছেন। ২০১৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে ‘সড়ক পর স্কুল’ আন্দোলন বিশেষ সাড়া ফেলে। শত শত ছাত্রছাত্রী নিয়ে সড়কের ওপরই স্কুল বসতো, ক্লাস চলতো। এমন বহু সংখ্যক ‘সড়ক পর স্কুল’ সংগঠিত করেন। এই আন্দোলনের ফলে নীতিশ সরকার বিহারের প্রাথমিক স্কুলগুলির জন্য একগুচ্ছ সংস্কার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। গুজরাটে ‘উনা থেকে উন্নাও দলিত পদযাত্রায় পার্টির অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, জামিনে মুক্ত হন।

সন্দীপ সৌরভ আইসার বর্তমান ন্যাশনাল সেক্রেটরি, দলিত ও পিছড়ে বর্গের ছাত্রছাত্রীদের সংগ্রামের নেতা, জওহরলাল নেহরু স্টুডেন্টস ইউনিয়িনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে বিহারের খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

মেহেবুব আলম দীর্ঘদিনের বিধায়ক, আন্তরিক কমিউনিস্ট গুণাবলীর নেতা হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়। গরিব, ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষের তাঁদের আন্দোলন পরিচালনা করার নেতা হিসেবে তাঁর ওপর গভীর অটুট বিশ্বাস আরোপ করেছেন।

সুদামা প্রসাদ তারারি বিধানসভা ক্ষেত্রের বিধায়ক ছিলেন। বর্তমানে শাসক জনপ্রতিনিধিদের জনতার কাছে কোনওরকম দায়বদ্ধতা যখন মেলা ভার তখন সুদামা প্রসাদ উদাহরণ তৈরি করেন নিজের পাঁচ বছরের কাজের পূর্ণাঙ্গ ও অনুপুঙ্খ ‘রিপোর্ট কার্ড’ জনতার সামনে পেশ করে যেখানে এমএলএ ফাণ্ডের প্রতিটি পাইপয়সার হিসেব দেওয়া হয়।

2

 

সত্যদেও রাম দারাউলির বিধায়ক। বিহার আয়ারলার সাম্মানিক সভাপতি। গত নির্বাচনে কমরেড অমরজীত কুশোয়াহার সাথে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং জেল থেকে নির্বাচন লড়ে জতেছিলেন। পরবর্তীতে জামিনে মুক্তি পান।

বীরেন্দ্র প্রসাদ গুপ্তা সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির বিহার রাজ্য সভাপতি। পশ্চিম চম্পারণের সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ পরিচালনাকারী নেতা হিসেবে বিশেষ পরিচিত। অনেকবার শরীরীক হামলার সম্মুখীন হয়েছেন এবং মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে দীর্ঘ দিন জেল খেটেছেন।

গোপাল রবিদাস সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির বিহার রাজ্য সম্পাদক। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। গ্রামীণ গরিব, দলিত, মহিলা আন্দোলনের সংগঠক। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ আদায়ের নামে মাইক্রোফাইনান্স এজেন্সির অত্যাচার ও হয়রানির বিরুদ্ধে বিহারের গ্রামীণ গরিব, বিশেষত মহিলাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

অরুণ সিং অল ইণ্ডিয়া কিসান মহাসভার ন্যাশনাল ভাইস প্রেসিডেন্ট। বিহারে কৃষক আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা। কারাকাটে  জিতে থাকা এমএলএ। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য।

3

 

মহানন্দ প্রসাদ পার্টির রাজ্য নেতা। তাঁর জেলার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও সাফাই কর্মচারিদের আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। নব্বইয়ের দশকে আইসা আন্দোলনে যোগ দেন, জনসংস্কৃতি মঞ্চের কর্মী হিসেবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন।

রামবলি সিং যাদব অল ইণ্ডয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়ন (এআইসসিটিইউ)-এর বিহার রাজ্য সহ-সভাপতি। রাজ্যের সরকারি কর্মচারি ও শ্রমিকদের আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা। চুক্তি-শিক্ষকদের সম কাজে সম মজুরির অধিকার ও স্থায়িকরণের দাবিতে জনপ্রিয় অভিযান সংগঠিত করেন।

অজিত কুমার সিং রেভলিউশনারি ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের বিহার রাজ্য সভাপতি, দলিত যুব আন্দোলনের নেতা। কোভিড লকডাউনের সমগ্র পর্বে বিপন্ন মানুষের পাশে ধারাবাহিক ত্রাণকার্য চালান।

অমরজিত কুশওয়াহা রেভলিউশনারী ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের সাম্মানিক সভাপতি। গত পাঁচ বছর যাবত জেলবন্দী। জুলাই ২০১৩ তে তাঁকে ও সত্যদেও রামকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। দারাউলি বিধানসভার অন্তর্গত ঘুটনি ব্লকের চিল্মারভা গ্রামের ভূমিহীন দলিতদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায় সামন্তী শক্তি। সারা বিহারের মত এখানেও ২০১২ সালে ব্লক প্রশাসন দ্বারা খাস জমিতে ভূমিহীনদের গৃহ নির্মাণের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু তবু সেই জমি বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণ জমিদারদ্র দখলেই থেকে যায়। সিপিআই(এমএল)-এর ব্যানারে সেই জমি দখল করে দলিত ভূমিহীন মানুষেরা। সেখানে বাড়ি বানায়। ২০১৩’র ৫ জুলাই লোকাল বিজেপি এমএলএ রামায়ন মাঝি, স্থানীয় ব্রাহ্মণ জমিদার ও পার্শ্ববর্তী ইউপি থেকে আসা গুণ্ডাদের একটি নৃশ্নগস বাহিনী চিল্মারভা গ্রামের সীমানায় জমায়েত হয় এবং দলিত পরিবারগুলিকে হঠিয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দিতে থাকে। সিপিআই(এমএল) নেতা কমরেড সত্যদেও রাম ও অমরজিত কুশওয়াহা গ্রামে উপস্থিত ছিলেন। জেলাশাসক আসেন, দলিতদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সিপিআই(এমএল) নেতাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। এসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশের অফিসিয়াল রেকর্ড বলছে যে ডিএমের প্রতিশ্রুতি মেনে নিয়ে সিপিআই(এমএল) নেতারা সেই জায়গা ছেড়ে চলে যান।

কিন্তু পরদিনের ঘটানাবলী দেখিয়ে দেয় যে জেলা প্রশাসন আসলে ভয়ানক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে যেতে পারত। একটি টিভি চ্যানেলের ভিডিও ক্লিপ্স থেকে দেখে যায় যে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল আর জমিদারদের গুণ্ডা বাহিনী দলিত গ্রামে গুলি চালাচ্ছিল। গ্রামবাসীদের ছেড়ে রাখা হয়েছিল সামন্তী গুণ্ডাবাহিনীর হাতে, গ্রামবাসীরা নিজেরাই আত্মরক্ষা করে। এই প্রক্রিয়ায় দু’জন হামলাকারি গুণ্ডা, যারা দুজনেই এলাকার বাইরে থেকে আসা, প্রাণ হারায় এবং সিপিআই(এমএল) কর্মী কমরেড শ্রিনিবাস রাম আহত হন।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হল উক্ত ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে বিজেপি এমএলএ রামায়ন মাঝি এবং ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ সাংসদ ওম প্রকাশ যাদব যিনি পরে বিজেপি থেকে আবার সাংসদ হন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরিস্কার দেখা যাচ্ছে যে গুলির মুখে গরিব গ্রামবাসীরা প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ছুটোছুটি করছে। দিনকে রাত করে বিজেপির এমএলএ এমপিরা হামলাকারিদের ‘আম লোগ’ বলে অভিহিত করে যারা নাকি সিপিআই(এমএল) সমর্থকদের হামলার ‘ভিক্টিম’!

কমরেড সত্যদেও রাম পরবর্তীতে জামিনে মুক্ত হলেও কমরেড অমরজিতকে জেলবন্দী করেই রাখা হয়েছে।

elegaga


মাননীয় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার
ভারতের নির্বাচন কমিশন
সি সি: সিইও বিহার

বিষয় : সন্দেহজনক গণনা পদ্ধতির জন্য ভোরে, আরা, দারাউন্ধা বিধানসভা আসনগুলিতে ভোট পুনর্গণনার দাবি

মহাশয় আমরা বিহারের ভোরে, আরা এবং দারাউন্ধা বিধানসভা নির্বাচনকেন্দ্রগুলিতে এই মুহূর্তে ভোটের পুনর্গণনা দাবি করছি। এই তিনটি কেন্দ্রেই গণনা পদ্ধতির উদ্বেগজনক লঙ্ঘনের পর, সিপিআই(এমএল) প্রার্থীদের অত্যন্ত নগণ্য ব্যবধানে পরাজিত হতে দেখা গেছে।

ভোরে (১০৩)-এ জেডিইউ প্রার্থী সুনীল কুমার একজন প্রাক্তন অতিরিক্ত ডিজিপি এবং সেই কারণে প্রশাসনে তার ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। স্থানীয় জেডিইউ সাংসদ অলোক কুমার সুমনকে গণনা হলে ঢুকতে দেখা গেছে – যা অবৈধ ও নিষিদ্ধ। এটা ভোটের স্বচ্ছ গণনাকে প্রভাবিত করার এক চেষ্টা যা অত্যন্ত পরিষ্কার। এখন, ইসিআই সাইটে সুনীল কুমারকে ৭৩৫৫০ এবং সিপিআই(এমএল)-এর জীতেন্দ্র পাসোয়ানকে ৭২৫২৪ ভোট পেতে দেখা যাচ্ছে। এই নির্বাচন কেন্দ্রগুলিতে ভোট-পুনর্গণনাকে নিশ্চিত করার জন্য আপনার দ্রুত হস্তক্ষেপ চাইছি।

ঠিক একইভাবে, আমরা আরা (১৯৪) এবং দারাউন্ধা (১০৯) নির্বাচন কেন্দ্রগুলিতেও ভোটের পুনর্গণনা চাইছি যেখানে ভিভিপ্যাট এবং ইভিএম-এর গণনার মধ্যে গরমিল সহ অন্যান্য বেনিয়মের তথ্যও পাওয়া গেছে ।

- কবিতা কৃষ্ণাণ   
সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য   

ddaree

সিপিআই(এমএল) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার ৮ নভেম্বর ২০২০ একটি প্রেস বিবৃতিতে বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের মূল উস্কানিদাতা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী। তাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ কর্তৃক লঘু ধারায় মামলা গ্রহণ ও তাদের গ্রেপ্তার করা লোক দেখানো নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়। মুখ্যমন্ত্রীকে এর জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

গতকাল ৭ নভেম্বর ২০২০ শনিবার উদয়পুর রাজারবাগ বাসস্ট্যান্ডে ‘প্রতিবাদী কলম’ পত্রিকার বান্ডিল ছিনিয়ে নিয়ে নষ্ট করে দেয় একদল বিজেপি আশ্রিত সমাজবিরোধী। করোনা অতিমারীতে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ায় গত ১১ সেপ্টেম্বর সাব্রুমে মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক কার্যত রাজ্যের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি এর পিছনে পরোক্ষভাবে  দায়ী। তার হুমকির চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই সাংবাদিক পরাশর বিশ্বাসরা দৈহিকভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আজও তার অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি। সম্প্রতি কৃষিদপ্তর ও তার মন্ত্রীকে জড়িয়ে দেড়শো কোটি টাকার দুর্নীতির খবর প্রতিবাদী কলমে প্রকাশিত হয়। একে কেন্দ্র করেই এই হামলা। কারণ প্রকাশিত খবর অসত্য বা অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্যে হলে প্রচলিত আইনের বিধান রয়েছে প্রতিকার চাওয়ার ও পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের। কিন্তু সেইপথে না গিয়ে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ও বিরোধী দলের বিরুদ্ধে  উস্কানিমূলক শ্লোগান দিয়ে আগের দিন উদয়পুর শহরে শাসক দল যুবকদের মিছিল সংগঠিত করে। ঠিক পরদিন সকালে এই হামলা সংগঠিত হয়। আর এখন প্রমাণিত এই হামলাকারী সবাই শাসক দলের নেতা ও কর্মী। এদিকে ৮ নভেম্বর  রাজ্য প্রেস ক্লাবের নির্বাচন। তাই সরকার চাপে পড়ে যায়। আরকেপুর থানার পুলিশ অত্যন্ত লঘু ধারায় লোক দেখানো মামলায় অভিযুক্তদের অনেক দেরীতে গ্রেপ্তার করে একপ্রস্থ নাটক মঞ্চস্থ করে। যাতে করে সমাজবিরোধীরাই উৎসাহিত হবে, তাদের মনোবল বাড়বে। আর মুখ্যমন্ত্রীই সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের উপর এই হামলা ও প্রতিটি হামলার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। তাই মুখ্যমন্ত্রীকে এর জন্য রাজ্যবাসীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ক্ষমা চাইতে হবে। আজ রাজ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিপন্ন। সংবিধান, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। রাজ্যে সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান করছে সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি।

rretara

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে ১০৩তম নভেম্বর বিপ্লব দিবসে উদ্বোধন হল “শহীদ কমরেড মৃত্যুঞ্জয় তরণী স্মৃতি গ্রন্থাগার”।

কমরেড তরণী সামন্ত ও কমরেড মৃত্যুঞ্জয় নস্কর সত্তর দশকে দক্ষিণ ২৪ পরগণার পার্টি কাজে যুক্ত ছিলেন। সে সময়ের পুলিশ বাহিনীর হাতে শহীদ হন তাঁরা। তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত গ্রন্থাগার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পার্টির পলিটব্যুরো নেতা কার্তিক পাল, সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা নেতা সুফল পাল, ‘সেরিবান’ প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা সুদর্শন দলুই, ‘পূবের আকাশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’র অভিজিৎ চক্রবর্তী, ‘প্রস্তুতি নাট্য সংস্থা’র পক্ষে রাকেশ বনু, কবি স্বর্ণলতা মন্ডল, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা নেতা নবকুমার বিশ্বাস, দিলীপ পাল সহ আরো অনেকে। বক্তব্য রাখেন কার্তিক পাল, দিলীপ পাল, অভিজিৎ চক্রবর্তী, রাকেশ বনু, স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন যুব নেতা আশুতোষ মালিক, কবি স্বর্ণলতা মন্ডল, সঙ্গীত পরিবেশন করেন সোমা চক্রবর্তী। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন পার্টির জেলা নেতা শুভদীপ পাল।

rqqqnov

গত ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লব দিবসে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে (বজবজ) ১০৩তম নভেম্বর বিপ্লব দিবস পালিত হয়। সমগ্র কর্মসূচী পরিচালনা করেন অঞ্জন ঘোষ, পতাকা উত্তোলন, মাল্যদান, শহীদ স্মরণে নীরবতা পালন করেন দেবযানি গোস্বামী, দেবশিস মিত্র, পঞ্চু ঘোষ, সেখ সাবির, দ্বীপ মালিক, শ্যাম গোস্বামী, অতনু মালাকার। বাখরাহাটে বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির অফিসে ১০৩তম নভেম্বর বিপ্লব দিবস পালিত হয়। সমগ্র কর্মসূচী পরিচালনা করেন লোকাল কমিটির সম্পাদক নিখিলেশ পাল। পতাকা উত্তোলন, মাল্যদান, শহীদ স্মরণে নীরবতা পালন করেন দিলীপ পাল, মোমিন সেখ, সন্দীপ ধাড়া সহ আরো অনেকে।

daredar

ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের ১০৩তম বর্ষপূর্তিতে শিলিগুড়ির শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে ৭ নভেম্বর এক সংক্ষিপ্ত কর্মসূচীর শুরুতে লেনিনের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন উপস্থিত জেলা এবং ব্রাঞ্চ সদস্যরা। নভেম্বর বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং আজকের সময় নিয়ে বক্তব্য রাখেন শাশ্বতী সেনগুপ্ত ও রজত বর্মণ। ২৬ নভেম্বর সাধারণ ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে প্রচার অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়। উপস্থিত ছিলেন ব্রাঞ্চের পক্ষে রুবী সেনগুপ্ত, মিলি ভট্টাচার্য, মনি ভট্টাচার্য, গঙ্গা রায়, রমা সাহা, ছবি দত্ত, টুলু সাহা প্রমুখ। কর্মসূচীটি পরিচালনা করেন শাশ্বতী সেনগুপ্ত।

varddareee

লকডাউন পরিস্থিতিতে এমন আবেদন রাখা হয়েছিল সর্বসাধারণের কাছে। আপাতত সংক্রমণ তুঙ্গে থাকলেও লকডাউন নেই। যথাযথ নিরাপত্তা নিয়ে বেরোতে বাধা নেই। কিন্তু এই আবেদন, থুড়ি, নির্দেশটা মেয়েদের জন্যে একটা ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’, সে করোনা থাক বা না থাক! মেয়েরা কাজে বেরিয়ে বা স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথে ধর্ষিতা হলে, চরম অত্যাচারের পর তাদের ছিন্নভিন্ন লাশ এখানে ওখানে পড়ে থাকলে, নীতি-পুলিশ বিজেপি তথা আরএসএস নেতা-মন্ত্রীরা তিরস্কারের সঙ্গ সেই নির্দেশ মনে করিয়ে দেন একান্ত উপযাচক হয়ে। সরাসরিই বলেন ‘প্রশাসন নয়, পারিবারিক সংস্কারই ধর্ষণ রুখতে পারে’ কিংবা ‘ধর্ষিতার মৃত্যুই কাম্য’ ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রশাসন মেয়েদের সুরক্ষার দায় নেবে না। তাই বাড়িতে থাকাই নিরাপদ! কিন্তু, মেয়েদের কাছে এর থেকে ব্যঙ্গাত্মক কি আর কিছু আছে?

অতিমারীর ভয়ে, করোনার ভয়ে আমরা বাধ্য হয়েছি বাড়িতে থাকতে। কিন্তু সেই বাড়িতেই অন্য এক অতিমারী থাবা বসিয়েছে মহিলাদের ও কন্যা শিশুদের উপর। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গার্হস্থ্য হিংসা এবং পারিবারিক নির্যাতন। শুধু কলকাতা নয়, ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে, প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে অতিমারীর আকার ধারণ করেছে পারিবারিক নির্যাতন। সেজন্য এই অতিমারীকে ‘শ্যাডো প্যান্ডেমিক’ আখ্যা দিয়েছে ‘ইউএন উমেন’।

অতিমারীর আগেও, ভারতে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়েছেন প্রায় ২৯ শতাংশ মহিলা (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে, ৪), আট থেকে আশি, সমস্ত ধরনের মহিলা থেকে শুরু করে শিশু কন্যা কেউই বাদ নেই এই পরিসংখ্যানে। ২০১৮ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে প্রতিদিন ভারতে ২৮ জন মহিলা এই গার্হস্থ্য হিংসার জেরে প্রাণ হারান।

কিন্তু এসব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটির উপরেই বর্তায় সমস্ত দোষ – ‘মেয়েটি মানিয়ে নিতে পারেনি’, ‘স্বামী সংসার ছেড়ে অত বন্ধুবান্ধব কিসের?’ বা, ‘অল্প বয়সে পাকলে বাবা মা মারবে না তো কি পুজো করবে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। গা সওয়া হয়ে যায় আমাদেরও যতক্ষণ না আরও বীভৎস, আরও শোচনীয় হয় অত্যাচার। অর্থাৎ ঘরে-বাইরে ধর্ষিতা নির্যাতিতা হলে, এমনকি প্রাণ হারালেও দায় মেয়েটিরই!

প্রশ্ন আগেও ছিল কিন্তু লকডাউন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে ‘মেয়েরা বাড়িতেই নিরাপদ’ কথাটা কতটা ভুল। লকডাউনের পর সারা বিশ্বে পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ২০-৭০ শতাংশ। জাতীয় মহিলা কমিশন জানাচ্ছে মার্চ-এপ্রিলের তুলনায় এপ্রিল-মে মাসে অর্থাৎ লকডাউন শুরুর পর গার্হস্থ্য হিংসার মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ।

লকডাউন শুরুর পর থেকেই ঘরবন্দী মেয়েরা। আর সেই বাড়িতেই নির্যাতনকারী থেকে শুরু করে শিশু সহ পরিবারের সকলে। ফল? মেয়েদের উপর বেড়েছে গৃহকর্ম তথা সেবাযত্নের বোঝা। যেহেতু মেয়েদের ছোট থেকেই বাড়ি সামলানো, সেবা যত্ন এগুলোকেই তার মূল ভূমিকা হিসেবে শেখানো হয়। তথাকথিত ভালো মেয়ের ধাঁচা। পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে নির্যাতন ও হিংসা। আর নির্যাতনকারী যেহেতু ২৪ ঘণ্টা বাড়িতেই উপস্থিত সেহেতু অভিযোগ জানানো, সাহায্য চাওয়া – এসব দুরস্ত হয়ে উঠেছে মেয়েদের জন্য। আর অভিযোগ জানালেও আরও করুণ হচ্ছে পরিস্থিতি। উল্টে বাড়ছে নির্যাতন। ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি যেমন – রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড ইত্যাদি। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া বা সেই সংক্রান্ত হুমকি, সন্তানদের কেড়ে নেওয়া – এসব তো আছেই। অনেকেই বলবেন বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে বাপের বাড়ি চলে এলেই তো সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা অন্য। প্রথমত এই মানিয়ে নেওয়ার গল্প, স্বামীর ঘরই ঘর – এগুলো মেয়েরা পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান থেকেই শেখে। বাবা-মাও অংশ সেটার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা মা-ই বাধ্য করছেন আবার মেয়েদের ফিরে যেতে নির্যাতনকারীদের কাছে। আর লকডাউনে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করেছে কাজ চলে যাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে বাবা মা চেয়েও হয়ত রাখতে পারছেন না মেয়েদের কারণ খাওয়ানোর সঙ্গতি নেই। আবার মেয়েরা যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেরটুকু উপার্জন করত সেই সংস্থানও হারিয়েছে এই লকডাউনে। সরকারি তরফ থেকে চালু করা হয়েছিল হেল্পলাইন। কিন্তু উপার্জনই যেখানে নেই, পেটের খাবার জোটানোই দায় যেখানে সেখানে ফোনে রিচার্জ করে কি করে অভিযোগ জানাবেন মহিলারা? তাহলে কি সরকারি পরিষেবা, পুলিশ প্রশাসন এগুলো শুধুমাত্র সমাজের সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জন্য? ‘শারীরিক দূরত্ববিধি’ না বলে প্রচার করা হয়েছিল ‘সামাজিক দূরত্ববিধি’। মানুষের মনে তৈরি করা হয়েছিল ভীতি। এমনিতেই পারিবারিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘ছোটোখাটো’ পারিবারিক বিষয়, ‘মানিয়ে নিতে হয়’ বলে এড়িয়ে যায় চারপাশের সমাজ, প্রতিবেশীরা। মানতেই চাওয়া হয় না এটা ‘পারিবারিক’ নয় ‘সামাজিক’ সমস্যা। সেখানে এই ‘দূরত্ববিধি’ সংক্রান্ত ভীতির ফলে যেটুকু সাহায্য প্রতিবেশীদের থেকে পাওয়া যেত সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে লকডাউন। ফলে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক নির্যাতন এক বীভৎস আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এই লকডাউনে। যেসমস্ত মহিলারা বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন তাদের কাছে সুরক্ষিত আশ্রয় পাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার সামাজিকভাবে কোনোকালেই স্বীকৃত নয় আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে। তারা জানে তারা বেরিয়ে গেলেও বাবা মা আবার ফেরত পাঠাবেন। এমনিতেই  দেশে শেলটার হোমের সংখ্যা অপ্রতুল। তার উপর করোনা ভীতি ও সংক্রমনের ভয়ে হোমগুলি লকডাউন পরিস্থিতিতে নতুন কোনও আবাসিক নিতে চায়নি। একই অবস্থা পুলিশ, প্রশাসনের। একেই যানবাহন বন্ধ, ২৪ ঘণ্টা নির্যাতনকারীও উপস্থিত বাড়িতে। এই সমস্ত বাধা পেরিয়ে যেসব মহিলারা অভিযোগ জানাতেও গেছে তাদেরও অনেকক্ষেত্রে সংক্রমণের ভয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে থানা থেকে, পরামর্শ দেওয়া হয়েছে নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেওয়ার জন্য।

বর্তমানে কিছুদিন হল আনলক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কর্মরত মহিলাদের ক্ষেত্রে এমনিতেই লকডাউন দ্বিগুণ বোঝার কাজ করেছে। উপরের সমস্তকিছু সামলেও তাদের অফিস বা কর্মজীবন সামলাতে হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ মহিলাদেরই বাড়িতে নিজের মতো করে সময় কাটানো বা ‘নিজের জায়গা’ বলে কিছু থাকে না। পিতৃতান্ত্রিক অধিকারবোধ সেই স্পেস মেয়েদের দেয়না। ফলত ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে হলে যে স্পেসের প্রয়োজন সেটা মহিলাদের ক্ষেত্রে নেই। অর্থাৎ একদিকে পারিবারিক নির্যাতন বা সেই সংক্রান্ত মানসিক চাপ, অন্যদিকে কর্মজীবন! আনলক শুরু হওয়ার পরও সেই পর্বের পুরোপুরি অবসান হয়নি। বরং লকডাউনে এক অদ্ভুত প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে মহিলাদের প্রতি যা আনলক হওয়ার পরও অব্যাহত। যে যাই করুক, যেখানেই যাক পরিবারের দ্বিগুণ চাপ সামলেই করতে হবে। সঙ্গে দৃঢ় হয়েছে ‘ঘরটাই মেয়েদের জন্য’ এই ধারণা। ফলত আরও কঠিন হয়েছে অধিকারের, স্বাধীনভাবে বাঁচার লড়াই। গার্হস্থ্য হিংসা আগেও ছিল কিন্তু লকডাউনের ফলে আরও প্রকাশ্যে এসেছে অবাধ গার্হস্থ্য হিংসার চিত্র। সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত ‘সাপোর্ট সার্ভিস’গুলোর নগ্ন রূপ। ‘কন্যাশ্রী’ যে মেয়েদের বাঁচাতে পারে না, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ যে আদপে ধাপ্পা ছাড়া কিছুই নয় এবং ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ যে আদপে সেই তলানিতেই রয়েছে আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে লকডাউন।

- সৌমি জানা   

radare

দীর্ঘ টালবাহানার পর বঙ্গে লোকাল ট্রেন চলার ছাড়পত্র মিলেছে একটা অংশের মানুষকে বাদ দিয়েই। কিছু নীতিমালা সাজিয়ে। ভাবখানা এমন যে – দিলাম। দেশের জাতীয় সম্পদ রেলের দখলদারি যাদের হাতে, সেই কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দাম্ভিক সরকারটির নাম বিজেপি। যারা ক্ষমতায় এসে বাংলার মানুষকে ‘সোনার বাংলা’ উপহার দিতে চায়। যার নমুনা আমরা দেখি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির দিকে তাকালেই।

প্রথমত, ট্রেন যাত্রায় অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারি সহ আর্থিক নির্ভরশীলতায় এগিয়ে থাকার ভিত্তিতে এবং বাদের তালিকায় সরাসরি ঘোষণা করা হয়েছে হকার ও ভেন্ডারদের, যাদের লোকাল ট্রেনের উপর নির্ভর করে জীবন বাহিত হয় দিনের পরদিন। ইহা তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ নয়, হকার উচ্ছেদের পরিকল্পনা বহুদিনের। যা এই পেন্ডামিক সময়কালকে এক সুবর্ন সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়েছে। অতিমারীর সুযোগ নিয়ে, অপরিকল্পিত লকডাউন মানুষকে ঘরবন্দী করে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষকে আরও ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছে এই মুনাফা লোভী সরকার। মানুষের প্রয়োজনকে অস্বীকার করে যে এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কেন্দ্র, তাতে কিছু হলেও তাল মিলিয়েছেন বঙ্গ।

ট্রেন চালানোর দীর্ঘদিনের প্রয়োজনীয় দাবিকে ধর্তব্যে না রেখে লাভ ক্ষতির ব্যবসায়ী হিসাবে বিচার করে নিজেদের এজেন্ডা রুপায়নে ব্যস্ত থেকেছে এই নরেন্দ্র মোদির সরকার। আর দিনের পর দিন শুনিয়ে যাচ্ছে আতঙ্কের বাণী। সরকারি নির্দেশ কার্যকরী করতে রেলমন্ত্রী সমগ্র রেলটাকে এক বড়ো ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে পরিনত করতে চায় কর্পোরেট সহযোগে। দেশিয় সম্পদ ভারতীয় রেলকে বিকিয়ে দিতে তারা বদ্ধপরিকর।

কিন্তু, কীভাবে? আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া একদম নিচের মানুষটিও যে রেলযাত্রী হিসেবে নিজের অধিকার বোধ রাখে। নুন্যতম ভাড়ায় অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার হিম্মত রাখে। এ অভ্যাস বহুদিনের। মুনাফাবাজের যা না-পছন্দ। কর্পোরেট-রাজেই যাদের বিশ্বাস, লুঠেরাদের কাছে একটার পর একটা সরকারী সম্পদ বিকিয়ে দিয়েই যারা উন্নয়নের ধ্বজা উড়ায়, উল্লাসে মেতে থাকে, তাদের দায়িত্বও থাকে মালিকের পছন্দসই ব্যবস্থায় সাজিয়ে দেবার। সেই প্রয়াস চলছে। একটা অংশের মানুষকে রেলের উপর নির্ভরতা কমাতে চায় এবং এই কাজে মধ্য-ভোগী একটা অংশের মানুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দাঁড় করাতে পারছে। এই গরিব মানুষই যেন সব সমস্যার কারণ। যেমনটা ভাবানো হয়, সরকারি কর্মচারিদের অ-কর্মন্যতা, ফাঁকিবাজিই বেসরকারীকরণের কারণ। গরিব মানুষের উপস্থিতি সবসময়ই পরিপাটি ব্যবস্থার বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ‘সাচ্ছন্দ্য’ কমিয়ে দেয়। তাইতো উন্নয়নে বস্তি উচ্ছেদ হয়, আবার কোথাও গরিবি ঢাকতে সাদা বা কালো কাপড় মুড়ে দেওয়া হয়। রেলও আজ পরিপাটি ব্যবস্থার শরিক। যা আজ সাময়িক বলে মনে হলেও তা আগামীর মহরা। রেল বেসরকারীকরণ শুধুই যাত্রী পরিবহনেই নয়, ইহা সমগ্র রেল-যাত্রীর প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিকিকিনির কর্পোরেট দখলদারিও। যেমন মেল এক্সপ্রেস ট্রেন-যাত্রায় খাদ্যসামগ্রীর যোগানদাতা আইআরসিটিসি সহ কয়েকটি সংস্থা। এই ব্যাবস্থার প্রাথমিক কার্যকরী পদক্ষেপই হল হকার হটাও, যে পদক্ষেপ সরকার নিতে চলেছে।

ভাড়া বাড়তে চলেছে কয়েক গুণ। ইতিমধ্যেই দূরপাল্লার ট্রেনের ক্ষেত্রে তা কার্যকর হচ্ছে। মেল-এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না হলেও স্পেশাল নামে কিছু ট্রেন ইতিমধ্যেই চলছে। সমস্ত কিছু একই আছে, কেবল ট্রেন নাম্বারের আগে একটা শূন্য বসিয়েই তা স্পেশাল করা হয়েছে। মজা হলো এই শূন্য বসানোর মধ্যে দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভাড়ার বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। আর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না করে, যাত্রী চাহিদা বাড়িয়ে এই বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভ্যাসটা স্বাভাবিক করে নেওয়া হচ্ছে। এটাও মহরা। নাম্বারের আগের শুন্য উঠে যাবে, ট্রেন বাড়বে চাহিদা মতো (কর্পোরেট চাহিদা) কিন্তু বাড়তি ভাড়া দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকেই যাবে। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট নেই। অতি কষ্ট হলেও একটা অংশের গরিব মানুষের আপৎকালীন কম পয়সার ট্রেনযাত্রা ছিলো এই জেনারেল কম্পার্টমেন্ট। এই অতিমারীর সুজোগ নিয়ে তা সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সিট ভাড়া, পরিসেবা ভাড়া জুড়ে বাড়তি ভাড়া দিয়ে টিকিট কনফার্ম হলে তবেই যাত্রার অনুমতি মেলে। উচ্চ শ্রেণির যাত্রীর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট টাকার টিকিটের সাথে যে সুবিধা থাকতো তা বাদ দিয়ে আলাদা বাড়তি টাকার বিনিময়েই তা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, চাদর, জল, চা থেকে স্বাস্থ্য পরিসেবা সংক্রান্ত সমস্তই। ধীরে ধীরে তা নীচে নামানো হবে। একদিকে ঝাঁ-চকচকে পরিপাটি রেল যাত্রার স্বপ্ন অন্য দিকে নির্ভরতার সংকট মুখোমুখি। নির্ভরতার প্রশ্নে মানুষের আঙ্গুল যথাযথ মুনাফালোভী সরকারের দিকে থাকলেও ভিন্ন পক্ষকে সুচতুরভাবে কাজে লাগাতে চায় সরকার। কাজে লাগাতে চায় জীবন যাপনে রেল-নির্ভর মানুষগুলির বিরুদ্ধেই। আমরা একবার যদি ভাবতে পারি, রেল আমাদের, আমাদেরই দেশীয় সম্পদ, ইহা কারো ব্যক্তি মালিকানার অধিনে নয়, এ পরিসেবা কারও দয়া দাক্ষিণ্য নয়, অধিকার। রেল পরিপাটি হোক এবং সাচ্ছন্দ্য বাড়ুক। তা তখনই সুন্দর হয় যখন এই ব্যবস্থার শরিক হতে পারি আমরা সবাই। সব্বাই।

- শঙ্কর রায়    

taatar

কালান্তক ফুসফুসের ক্যান্সারে গত ২৮ অক্টোবর জীবনাবসান হ’ল তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মার্ক্স-স্কলার পরেশ চট্টোপাধ্যায় এবং আরেক বিরল পন্ডিত ও মার্ক্স-চর্চাবিদ প্রদীপ বকশিকে ঘিরে যে পার্টিতন্ত্র-কলুষ মুক্ত মার্ক্স-চর্চার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল কলকাতা মার্ক্স সার্কলকে কেন্দ্র করে তার অন্যতম ছিলেন তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। পরেশদা শেষবার যখন কলকাতায় এসেছিলেন ২০১১ সালে, ফ্রন্টিয়ার সাপ্তাহিকে তাঁর এক উল্লেখযোগ্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তপন। মার্চ ২০১২-র মাঝামাঝি প্রকাশিত হয়েছিল। তার কিছু আগে ‘একদিন’ দৈনিকে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নিত্যানন্দ ঘোষ। পরেশ চট্টোপাধ্যায় সেবার আড়াই মাস কলকাতায় ছিলেন। অথচ কোনো দৈনিকের কোনো তথাকথিত বাম রাজনীতি বিশেষজ্ঞ কলমচি তাঁর সাথে যোগাযোগ বা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেননি। তিনি ১৯৯০ দশকের প্রথম দিক অব্দি সিপিআই-এর সদস্য (প্রায় সিকি দশক) ছিলেন। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের পুনর্গঠন কর্মকান্ডের (মধ্য ১৯৮০র দশকে) সঙ্গে ও তার পশ্চিমবঙ্গ শাখা ভারতীয় গণসংস্কৃতি সঙ্ঘ (আইপিসিএ) পুনর্সংগঠনে রতন বসু মজুমদারের সহযোগী ছিলেন। তিনি ১৯৬০ দশকের শেষ দিক থেকে প্রায় দুই দশক ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকার (দ্বিমাসিক) সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ নরহরি কবিরাজ, প্রাথমিক শিক্ষক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক নির্মাল্য বাগচি ও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল আন্দোলন ও যুব বিদ্রোহের বীর রণধীর দাশগুপ্ত ও সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মহাপ্রাজ্ঞ সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার (রণধীরদা ও সত্যেনদা আন্দামানে সেলুলার জেলে অনেক বছর বন্দী ছিলেন, সেখানে কমিউনিস্ট কনসলিডেশন ও অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান) তার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। নরহরিদা ও সত্যেনদা ছিলেন সম্পাদক। সেই সময় মার্ক্সবাদী সাময়িকী হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত কতিপয় পত্রিকার অন্যতম ছিল ‘মূল্যায়ন’। তার সাথে যুক্ত ছিলেন ডঃ অসিত রায়, সুদীপ্ত কবিরাজ, শোভনলাল দত্তগুপ্ত, দীপিকা বসু, নন্দিনী সেন, ভানুদেব দত্ত, সত্য রায় প্রভৃতি। এই অভাজনও। ভানুদেববাবু স্মরিয়ে দিয়েছেন তপনের দুটি স্মরণীয় প্রবন্ধ – ‘অক্টোবর বিপ্লব ও রূশ বুদ্ধিজীবিরা’ ও অ্যাঞ্জেলা ডেভিসকে নিয়ে লেখা ‘বারুদের উজ্জ্বল পাখী’। আমার মনে পড়ছে স্পেনের রিপাব্লিক্যান সংগ্রামের প্রসিদ্ধ নেত্রী দলরেস ইবারুরি-কে (লা পাসিওনারিয়া) নিয়ে লেখা ‘সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।’

তপনের সাথে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সুসম্পর্ক ছিল। বলতেন, পার্টিটার নেতৃত্বের মুক্তমতিত্ব পার্টিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অনুসরণযোগ্য। আমাকে ও নিত্যানন্দ ঘোষকেও বলেছিলেন।

- শঙ্কর রায়    

deeeadip

এইতো কয়েকদিন আগে বইটা হাতে পেলাম। লেখক লোরেঞ্জো মিলানি, ‘আপনাকে বলছি স্যার’ পুস্তকের প্রধান উদগাতা। বইটির বিষয় আজকের দুনিয়াতে ন্যায় যুদ্ধ বলে কিছু হয় না। সেই বইতে মিলানি মূলত জোর করে মানুষকে সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করার বিরোধিতা করেছেন। যে মানুষ বিচারহীন আনুগত্য, যুদ্ধ করা এবং নরহত্যাকে বিবেক বিরোধী মনে করে তাকে জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা যাবে না। তাছাড়া কোনো যুদ্ধকে কি আজকের দিনে ন্যায় যুদ্ধ বলে মনে করা যায়? মিলানি বলছেন, যায় না। এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেরই হয়তো অমত হবে,  কিন্তু খানিকটা ভেবে দেখলে এই কথাকে মেনে নিতেই হয়। সেই আলোচনা এখন থাক। আমাদের কথায় ফিরে আসা  যাক। এই বইটি অনেকদিন ধরে আমি আর দীপাঞ্জন খুঁজছিলাম। আমার মনে হল আর কটা দিন আগে যদি বইটা পাওয়া যেত তাহলে পড়ে শেষ করার সুযোগ পাক বা না পাক, বইটা  দেখলে কি অসম্ভব খুশি হত দীপাঞ্জন। আমার মনে হয় এ বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ও দ্বিমত হতো না। কিছুদিন আগে চে গেভার’র একটি জীবনীতে এই বক্তব্যের উপস্থাপনা ছিল অন্য চেহারায়। আমার সঙ্গে আলোচনায় এই মতের সঙ্গে দীপাঞ্জন অনেকটাই একমত ছিল।

কিন্তু কথাটা তা নয়। এখানে আমি যে কথাটা বলতে চাইছি সেটা হলো যে কোনো ধরনের পুস্তকের প্রতি দীপাঞ্জনের কৌতুহল এবং অদম্য আগ্রহের কথা। যদিও আমার সঙ্গে টেলিফোনে নিয়মিত কথা হতো, এমনকি মৃত্যুর আগের দিন সন্ধ্যাবেলাতেও ও আমাকে ফোন করেছিল। ওর জড়িয়ে যাওয়া কথাতেই আমাদের কিছু আলোচনা হয়েছিল। আর যেদিন শেষ বার দেখা হয়েছিল, সেই দেখা হওয়াটাও ছিল পুস্তককেন্দ্রিক।

আবার আমি একথা বলতে চাইছি না যে ওর  বর্তমান জীবনটা পুস্তককেন্দ্রিক ছিল। এই সময়টা ওর চিন্তা ভাবনা জুড়ে ছিল মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উপায়, শিক্ষাব্যবসা ছেড়ে মানুষকে শিক্ষাব্রতী হিসেবে গড়ে তোলার উপায়। আর বারেবারে ভাবছিলেন, কেমন করে আমরা শ্রমিক-বুদ্ধিজীবী গড়ার দিকে পা বাড়াতে পারি। তারই পথ খুঁজে পাবার চেষ্টায় ও আবার বারে বারে পড়ছিল আন্তোনিও গ্রামশির লেখা। তেমন মানুষ আমরাই গড়ে তুলতে পারব এত বড় স্পর্ধা ও রাখত না আমি জানি। কিন্তু ভাবনার জায়গায় এমন সৃষ্টি নিয়ে দীপাঞ্জন সচেষ্ট ছিল। একটা ধাপ হিসেবে হয়তো ও শ্রমজীবী বিদ্যালয়ের গঠনকে বর্তমান লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে চেয়েছিল। শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে যে ছেলেমেয়েরা পড়তো আমরা চেয়েছিলাম আগামী দিনে তারাই যেন শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে উঠতে পারে। অন্যরকম উদ্দেশ্য গড়ে ওঠায় সেই ইচ্ছা আমরা সফল করে তোলার দিকে এগোতে পারিনি। সচল থাকার শেষ দিন অবধি দীপাঞ্জন শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানে ব্রতী ছিল।

আমার কথাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মনে হয়। আমি এখানে দীপাঞ্জনের তথাকথিত অবিচুয়ারি লিখতে বসিনি। আমি লিখছি অল্প কয়েকটা কথায় আমার চেনা দীপাঞ্জনের পরিচয় দিতে।

আমার চাইতে বছর দুয়েকের বড় ছিল দীপাঞ্জন। নানান সূত্রে ওকে আমি জানতাম। ওর কাজকর্ম নিয়ে আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম সামনাসামনি পরিচয় না থাকলেও। দুজনের পথ কোথাও মিলেছিল, কোথাও ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। ওর সর্ম্পকে নানান গল্প শোনা যেত। কোনটা বাড়িয়ে বলা, কোনটা সম্যক মিথ্যা। তবে প্রথম দিকে যখন ও লোকজনকে দলে টানার চেষ্টা করছিল তখন শুনেছি ও বড় বেশি ডগমেটিক ছিল। এমন কথা ও নাকি বলেছে সেসময়, চারু মজুমদারের সব কথা যদি না মানো তাহলে তুমি প্রতিবিপ্লবী। যার কাছে শুনেছি তাকে আমি বিশ্বাস করতাম, কিন্তু যে দীপাঞ্জনকে আমি পরবর্তীকালে চিনেছি সেই লোক এইরকম কথা বলবে, এমন মনে হতো না। অবশ্য মানুষ তো পাল্টায়। আজকে খুব স্পষ্ট করে ওর সেই সময়কার জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবে এমন মানুষ খুব একটা বেশি নেই। ওর সেই সময়কার বন্ধুদের মধ্যে খুব একটা কেউ আমার পরিচিত নেই। আর সেই সময়কার জীবন নিয়ে আমার সঙ্গেও ওর বিশেষ কথাবার্তা হয়নি।

সত্তরের গোড়ায়, কোন একটা সময় দীপাঞ্জনের তথাকথিত – কবির ভাষায় – বনবাসের শুরু। ১৯৭১-এর শেষে দেওঘরে গ্রেফতার হয়ে ওকে যেতে হয় কারাগারে। ১৯৭২ সালে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়ে ওকে দেশ ছাড়তে হয়। তখন সস্ত্রীক ও চলে যায় ইংল্যান্ড পিএইচডি করতে। ঠিকমতো জানা নেই, কিন্তু শুনেছি বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়াটা জেল থেকে ছাড়া পাবার একটা শর্ত ছিল। আমি অবশ্য এই ইংল্যান্ড যাওয়াটাকেই বনবাস বলে মনে করি। পিএইচডি করাটা দীপাঞ্জনের পক্ষে বিরাট কিছু কঠিন কাজ ছিল না। ফলে কাজ সম্পূর্ণ হয় সময়ের আগেই। তখন ওরা দুজনে ভারতে ফিরে আসে। জনশ্রুতি, এই তাড়াতাড়ি ফিরে আসাটা পুলিশ খুব ভালো চোখে দেখেনি। কলকাতায় ফিরে শিক্ষক হিসেবে দীপাঞ্জন যোগ দেয় তৎকালীন বিড়লা কলেজে। অল্পদিনের মধ্যেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীপাঞ্জনের বিরোধ শুরু হয় এবং দীপাঞ্জনকে সাসপেন্ড করে তারা। ওকে শেষ অবধি চাকুরিচ্যুত করার পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের। সাসপেনশন তুলে নিতে হবে এই দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় আর সেই সময় থেকেই দীপাঞ্জনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট যোগাযোগের শুরু। তখন পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (ওয়েবকুটা)র  মধ্যে কাজ করত ‘ফোরাম ফর এডুকেশন’। দীপাঞ্জন স্বভাবতই তার সদস্য হয়। সেই আন্দোলনের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে দীপাঞ্জনের ‘বিচার’ করার জন্য গঠিত কমিটি এবং তার পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফোরাম ফর এডুকেশন আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলন এবং আরও অন্যান্য চাপের ফলে দীপাঞ্জন তার চাকরি ফিরে পায়। যতদূর মনে পড়ে ওয়েবকুটা যথারীতি প্রায় কিছুই করেনি। এই আন্দোলন যখন শুরু হচ্ছে তখন কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িয়ে  দীপাঞ্জন আমাকে বলেছিল – কেবলমাত্র আমার চাকরি ফিরিয়ে দেবার জন্য আন্দোলন করার কোন মানে হবে না যদি না বৃহত্তর কোনো উদ্দেশ্য তার মধ্যে থাকে।

আমার যতদূর মনে পড়ে, বিড়লা কলেজে পড়াবার সময় নানা কারণে দীপাঞ্জন একেবারেই খুশি ছিল না। তার কিছুদিন পরে দীপাঞ্জন প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগের যোগ দেয়। সেই সময়কার ছাত্ররা আজও ‘ডিআরসি’র কথা সসম্মানে স্মরণ করে। অবসর গ্রহণের পরেও দীপাঞ্জন শিক্ষক হিসাবে গভীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিল।

তখন থেকে দীপাঞ্জনের কর্মকান্ডের এক নতুন দিকের সূত্রপাত ঘটে। এবং আমার সঙ্গে গভীর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পারিবারিক স্তরেও সেই বন্ধুত্ব বিশেষ রকম ঘনিষ্ঠ ছিল। আমরা প্রায়শই পরস্পরের বাড়ি যেতাম।

সেই বন্ধুত্বর সঙ্গে সঙ্গে নানান রকম কাজ আমরা করতাম তার মধ্যে মূল কাজ যেটা ছিল সেটা হল শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি। ওই সময়ই আমাদের হাতে এসেছিল ‘লেটার টু এ টিচার : বাই দি স্কুল অফ বারবিয়ানা’। বইটা পড়ে আমাদের সকলেরই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় এবং তখন থেকেই বলতে গেলে শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা শুরু করি। বইটা আমি অনুবাদ করে ফেলি। দীপাঞ্জন আর আমি দুজনে মিলে নানান চেষ্টার পরে অনুবাদটি প্রকাশ করেন বাউল মন। প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে বইটা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই  সঙ্গে পাউলো ফ্রেইরি-র বইগুলো আমরা পড়ি। পুরো শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে যায়। যা খুব সামান্য জানতাম তা আমাদের কাছে নতুন চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়। বলাই বাহুল্য পাউলো-র কাজের জটিলতা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে দীপাঞ্জন।

এর পাশাপাশি দীপাঞ্জন বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করছিল। খুব একটা সাফল্য পেয়েছিল বলে আমার মনে হয় না। বিফল হবার কারণ দীপাঞ্জনের কাজের খামতি নয়, কারণ সমস্ত শক্তির মধ্যে বিভেদ এবং একপেশেমী।

আমার সঙ্গে দীপাঞ্জনের মূল কাজের জায়গা ছিল শিক্ষা। ২৪ বছর আমরা সুইনহো স্ট্রীটে শিক্ষা কেন্দ্র চালিয়েছিলাম। শেষের দিকে আমরা নানান কারণে মূল কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। সেই সময়ে দীপাঞ্জন একাই শিক্ষা কেন্দ্রটি চালু রেখেছিল। কারণ সঙ্গে খুব একটা বেশি কেউ ছিলনা। এই সময় দিয়ে আমরা আরো কয়েকটি জায়গায় শিক্ষা কেন্দ্র বানাবার চেষ্টা করেছিলাম, সক্ষম হইনি। তারপর দীর্ঘ দিন অন্যান্য কাজে আমরা সবাই জড়িয়ে পড়েছিলাম। দীপাঞ্জনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অনেকটাই ছিন্ন হয়ে যায়। ব্যক্তিগত স্তরে অবশ্য আমাদের যোগাযোগ ছিল।

এর দীর্ঘদিন পরে দু’হাজার দশ সালের শেষে এবং এগারো সালের প্রথমে আমরা কয়েকজন মিলে বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রামাঞ্চলে কি ধরনের কাজ করা যেতে পারে, কিভাবে সরকারকে কিছু পথনির্দেশ আমরা করতে পারি, তাই নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাই। মার্কসের মৌলিক ভাবনাগুলো, মাও সেতুং এর চিন্তা, ফ্রেইরি-র চিন্তা, ভেনেজুয়েলার তথা দক্ষিণ আমেরিকার অভিজ্ঞতা, মারতা হারনেকারের লেখা ইত্যাদি এবং বামফ্রন্ট আমলের কিছু ইতিবাচক দিক নিয়ে আমরা একটি লেখা তৈরি করার চেষ্টা চালাই। লেখাটি ২০১২ সালের ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার শারদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য লেখাটি কেউ পড়েনি। অথবা পড়লেও কেউ আমল দেয়নি। সত্যি কথা বলতে গেলে এখানে আমরা যেসব কথা বলেছিলাম তার সঙ্গে প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা অনেকটাই অমিল ছিল।

২০১২ সালে নতুন একটি ঘটনা ঘটে। শ্রমজীবী হাসপাতাল থেকে আমাদের কাছে প্রস্তাব আসে একটি শ্রমজীবী বিদ্যালয় গড়ে তোলার। দীপাঞ্জন ও আমি সেই স্কুলে যোগ দিয়েছিলাম। দীর্ঘ পাঁচ বছর সেই স্কুল দীপাঞ্জনের নেতৃত্বে চলেছিল। অসম্ভব অসুস্থ শরীর নিয়ে দীপাঞ্জন আমাদের নিয়ে কাজে লেগেছিল। শেষ অবধি যে উদ্দেশ্য ছিল তা হল একটি এমন শিক্ষার কাঠামো তৈরি করব যেখান থেকে প্রকৃত অর্থে শ্রমজীবী শিক্ষা রূপায়িত হতে পারে। যে শিক্ষা জন্ম দেবে শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীর।

নানান কারণে সেই প্রচেষ্টা ছয় বছর পরে বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে দীপাঞ্জন ক্রমশ চলাফেরার ক্ষমতা হারাচ্ছিল, অনেকগুলো অসুস্থতা একসঙ্গে ওকে গ্রাস করেছিল। একসময় ওকে পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে যেতে হয়। কথা বলার ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে গেছিল, ও নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলো মস্তিষ্কের স্নায়বিক অসুস্থতায়।

কিন্তু তার মধ্যেও শয্যাশায়ী থেকেও ওর ভাবনা থেমে যায়নি। যখনই ওর সঙ্গে কথা হয়েছে তখনি দেখেছি মাথা একেবারে পরিষ্কার। ওর যে মেধার প্রকাশ তার কোনো খামতি চোখে পড়েনি। লিখতে পারতো না, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভাবনা চিন্তাগুলো ছোট ছোট সহজ সরল লেখায় প্রকাশ করতো। আপাত সরল সেই সব চিন্তার মধ্যে অনেক গভীর ভাবনা লুকিয়ে থাকত। সারা জীবন প্রবন্ধ ইংরেজি বাংলা গল্প কবিতা স্মৃতিচারণ সবমিলিয়ে অগুনতি লেখা যে লিখেছিল তাকে যখন দেখতাম কেউ তার কথা শুনে লিখে দিলে তবু কিছু রচনা সে তৈরি করতে পারে – বড্ড মন খারাপ হয়ে যেত। সেই কাজ করে দিত আমাদের একজন তরুণ বন্ধু। তাঁর উপন্যাসের তৃতীয় খন্ড ওই ভাবেই লেখা হয়েছিল।

তার সারা জীবনের সঙ্গী আরতির মৃত্যু ওকে এক গভীর একাকিত্বের মধ্যে নিয়ে যায়। যখন তার অনেক তথাকথিত সঙ্গীই ওকে আর কোনোরকম সাহায্য দিচ্ছিল না। আমার সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল। দেবাশিস সরকার নিয়মিত সাহচর্য দিত এই বিরাট ব্যক্তিত্বকে। মন সতেজ ছিল, কিন্তু শরীর আর চলছিল না। ও নাকি একজনকে বলেছিল, আমার যদি মস্তিষ্ক-মৃত্যু হত তাহলে বোধহয় নিষ্কৃতি পেতাম। আমি সাধ্যমত ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, ওর কাছে যেতাম। যতটুকু পারতাম।

সেই নিষ্কৃতি এল ২৪ অক্টোবর ভোররাত্রে।

শুনছি কয়েকজন বন্ধু এবং গুণগ্রাহী মিলে একটি সংগ্রহ প্রকাশ করতে চলেছেন। এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে বলছি, দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বকে খানিকটাও ধরে রাখতে হলে অনেক বড় লেখায় অনেক মানুষের স্মৃতি একত্র করতে হয়। সে কাজ কেউ কি করবে আদৌ!

- সলিল বিশ্বাস   

খণ্ড-27
সংখ্যা-40