করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনীতির কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই। গ্রাস করছে উত্তরোত্তর মন্দা। কর্মসংস্থান উধাও হয়েছে ব্যাপক হারে। যে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকরা রাতারাতি কাজ হারা হয়েছিলেন তাদের কত শতাংশ আবার কাজ ফিরে পেয়েছেন, অন্য পেশায় ছিটকে গেছেন, শূন্য হাতে রয়ে গেছেন, তার কোনও তথ্য সংগ্রহের কাজে কেন্দ্রের মোদী সরকার হাত লাগিয়েছে কি? যদিও এদের বিকল্প কর্মসংস্থান করার নামে এক অতি সীমিত মাত্রার ‘গরিব কল্যাণ যোজনা প্রকল্প’ নামিয়েছে, তবু সমস্ত রাজ্য সরকারগুলোকে একাজে নামাতে বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে কি? না। মোদী সরকার সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে উপরন্তু আরও অসৎ আচরণ করে চলছে। অতিমারী আর লক ডাউনের সুযোগ নিয়ে সরকারি সম্পদ বেচার রাস্তা নিয়েছে। বিশেষ করে কয়লা খনি, বিমান বন্দর, রেল ও প্রতিরক্ষার মতো সরকার নিয়ন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর বেসরকারিকরণ ঘটিয়েছে। লোকসানের অবসান ঘটিয়ে লাভজনক পুনরুজ্জীবনের নামে আর সরকারি কোষাগারকে ঘাটতি মুক্ত করে তোলার অছিলায় উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোর বাজারী হস্তান্তরের পদক্ষেপ করেছে। যা কর্মসংকোচনের মাত্রাকে আরও অনিবার্য করে তুলবে। বাড়বে আরও বেকারি।
কেবলমাত্র প্রথম দুটি পরপর লক ডাউনের পরিণামে মেহনতি অংশগুলোর কাজ খুইয়ে মজুরি ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম লক ডাউন পর্বে কাজ চলে যাওয়া সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৬০ লক্ষ, তারপর ১৪ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত দ্বিতীয় লক ডাউন পর্বে কাজ হারা হয়েছিলেন ৭ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ। এই ছিল যেখানে লক ডাউনের গোড়ার দিকের বেকারির চিত্র, লক ডাউন পূর্ববর্তী বেকারির গোদের ওপর লক ডাউন শুরুর সময়কার বিষফোঁড়ার রেখাচিত্র এবং যার ৯০ শতাংশই অপ্রচলিত ক্ষেত্রের, তাহলে তার পরের চারমাসের ধাক্কায় কাজ ছাঁটাইয়ের পরিণাম কী বিভীষিকাময় দাঁড়িয়েছে ভেবে ওঠা যায়! রাজ্যভিত্তিক এবং গ্রাম ও শহর ভিত্তিক তারতম্য রয়েছে বটে, কিন্তু বেকারি বাড়ছে সর্বত্র। মোদী সরকার এ প্রসঙ্গে নিয়েছে নীরবতার কৌশল।
সিএমআইই-র সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ১৬ আগস্ট পর্যন্ত বেকারি পৌঁছেছে ৯ শতাংশে। লক ডাউন শুরু হওয়ার আগে বেকারি ছিল ৮.৪১ শতাংশ। তারপর প্রাক পাঁচ মাসে বেকারি পৌঁছেছে ৯.১ শতাংশে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই বৃদ্ধির পরিমাণ ১.৬০ শতাংশ। ৯ আগস্ট পর্যন্ত বেকারি ছিল ৮.৬৭ শতাংশ। তার মাত্র সাত দিনের মধ্যে তা উঠে গেল ৯.১ শতাংশে! বৃদ্ধির ভাগ সাতদিনে ০.৩৪ শতাংশ! লক ডাউন শুরুর দ্বিতীয় পর্বের মধ্যেই সিএমআইই অশনি সংকেত দিয়েছিল। পয়লা দফায় শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ চলে যাবে ১৪ কোটি মানুষের। এখন কেবল পর্যটন শিল্পে লক্ষ্যণীয়, কাজ চলে গেছে ৫.৫ কোটি মানুষের। এর সাথে বিমান পরিষেবা, রেল ইত্যাদি ক্ষেত্রে বড় সংখ্যায় কাজ চলে যাওয়ার পাকচক্র রয়েছে। এরপর মন্দা যত স্থায়ী হবে, সরকারি বিনিয়োগ যত কমতে থাকবে, বিমুখ থাকবে, বেসরকারিকরণ যত বাড়তে থাকবে, ততই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ আরও ছাঁটাই হবে, সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের আরও সংকোচন ঘটবে। সব মিলে কাজের বাজারে সৃষ্টি হবে হাহাকার অবস্থা।
পশ্চিমবাংলার বেকারির সর্বশেষ হিসাব সিএমআইই যা দিয়েছে তা গত জুন মাসের। তখন রাজ্যের বেকারির হার ছিল ৬.৫ শতাংশ। যা উল্লেখ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন এখানে বেকারি জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। একথা বলে মুখ্যমন্ত্রী আত্মপ্রচার করতে পারেন, কিন্তু তাতে বেকারি বৃদ্ধির প্রবণতা কমার নয়।
মোদী সরকার কাজের বাজার তৈরি হওয়ার দিকনির্দেশ করছে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য ঋণ প্রকল্প সুলভ করার কথা শুনিয়ে। কিন্তু সাধারণভাবে কোথাও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ঋণ নেওয়ার বিশেষ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হচ্ছে না। এই অনাগ্রহের মূল কারণ রয়েছে বাজারে সাধারণ ক্রেতাসমাজের চাহিদার অভাব লক্ষ্য করার মধ্যে। কারণ, কেনার ক্ষমতা প্রচুর কমে গেছে, কাজ নেই তাই। এই দুরাবস্থা ঘোরানোর একমাত্র উপায় হল পর্যাপ্ত সরকারী বিনিয়োগের জন্য বড় মাত্রায় উদ্যোগ গ্রহণ। কিন্তু মোদী সরকার সে কথা কানে তুলছে না, দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে অবতারণা করছে নানা চমকে মোড়া চালাকির। যেমন, নয়া শিক্ষানীতি উপলক্ষে বলতে শুরু করেছে, শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য কর্মপ্রার্থী তৈরি করা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা শেষে নিজেদেরই সক্ষম হয়ে উঠতে হবে কর্মক্ষেত্র তৈরির!
দুটি টু্ইটের জন্য অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণকে সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে আদালত অবমাননার দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে তাতে আমরা মর্মাহত। এই রায় কার্যত বাকস্বাধীনতা ও সমালোচনার গলা টিপে ধরার সামিল এবং আদালতের কর্মধারা ও বিচার বিভাগ পরিচালনা সম্পর্কে উঠে আসা সত্যিকারের প্রশ্নগুলিকে ঝেড়ে ফেলার প্রচেষ্টা।
সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, আন্দোলনকর্মী, আইনজীবি, বুদ্ধিজীবি সহ বিভিন্ন মহল থেকে এরকম সমালোচনা উঠে আসতে দেখেছি আমরা, এবং আমাদের মনে হয় এইসব মূল্যবান সমালোচনাগুলি যথার্থ মর্যাদার সাথে গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের জরুরী কর্তব্য হওয়া উচিৎ ছিল। আমাদের মনে হয় জনগণের অটুট আস্থা অর্জন করতে চাইলে আদালত-অবমাননার চাবুক না চালিয়ে বিচার বিভাগকে বরং নিজের স্বাধীনতা বজায় রেখে, নির্ভীক ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে জনতার নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরতে হবে।
এই রায় এমন এক সময়ে এল যখন দেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে অপরাধ হিসেবে দেগে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সংবিধান আক্রমণের মুখে আছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি সংখ্যাগুরুবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে, আর ধারাবাহিকভাবে মোদী সরকার দ্বারা আইনের শাসনকে খর্ব করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধিতা অপরিহার্য। ইউএপিএ বা সিডিশনের মতো উৎপীড়ন আইন ব্যবহার করে বিরোধিতাকে স্তব্ধ করা হচ্ছে। সংখ্যাগুরুবাদের বিরোধী যে কোনও মতামতকেই অ্যান্টি-ন্যাশনাল বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ গুরুত্ব সম্পন্ন বহুবিধ প্রতিষ্ঠানকে দেখা যাচ্ছে ভারতের সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতার বদলে শাসক গোষ্ঠির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে। সাংবিধানিক কর্তব্য পালনে নিঃশঙ্ক চিত্তে পক্ষপাতহীনভাবে নিজেদের বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগের বদলে কার্যনির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তকে বৈধতার শীলমোহর দেওয়াই এই প্রতিষ্ঠানগুলির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরকম প্রবণতা যে কোনও গণতন্ত্রের পক্ষেই মারাত্মক। আইন প্রণয়ন বিভাগ, কার্যনির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ বা অন্য যে কোনও ধরণের রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রতিই হোক না কেন - সমালোচনার কন্ঠ রুদ্ধ করে দিলে তা আর গণতন্ত্র থাকে না, পুলিশ-রাষ্ট্রে পর্যবসিত হতে শুরু করে। আমরা প্রশান্ত ভূষণের পাশে আছি।
সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে
সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
২০২০ সালের প্রায় আট মাস অতিক্রান্ত হতে চলল। বছরের প্রায় গোড়ার দিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন (WHO) আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল যে চীনে যে নতুন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তা এক আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সংকট। এগারোই মার্চ কোভিড-২০১৯কে অতিমারী বা Pandemic হিসেবে চিহ্নিত করা হল। তারপর থেকে গোটা পৃথিবী জুড়ে সারা বছর ধরে শুধুই এই অতিমারীর চর্চা।
অতিমারী হিসেবে কোভিড-২০১৯ কতটা মারাত্মক তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। একশ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লু-র তুলনায় অবশ্যই কোভিডের মারণক্ষমতা অনেক কম। কিন্তু এই তুলনাটাই কেমন অবাস্তব এবং অনৈতিহাসিক মনে হয় না? গত একশ বছরে পৃথিবীতে অনেক সংকট, যুদ্ধ ও বিপর্যয় সত্ত্বেও চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতে অবশ্যই বিরাট উন্নতি হয়েছে, দেশে দেশে মানুষের গড় আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে বিচার না করে কোভিড অতিমারীকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই সময়ের এক মহাবিপর্যয় হিসেবে দেখাই বোধকরি যুক্তিসঙ্গত।
আগস্ট মাসের প্রথম দুসপ্তাহের শেষে আজ অবধি পৃথিবী জুড়ে প্রায় দু’কোটি দশ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন সাড়ে সাত লক্ষের কিছু বেশি মানুষ। দুশোর বেশি দেশ এই তালিকায় রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হল অর্ধেকের বেশি রোগীর সংখ্যা মাত্র তিনটি দেশ থেকে – আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারত। মৃত্যুর দিক থেকে দেখলে প্রায় সোয়া তিন লক্ষ রোগীর মৃত্যু ঘটেছে এই তিন দেশে। এর সাথে মেক্সিকো আর যুক্তরাজ্যকে যুক্ত করলে পাঁচটি দেশে কোভিড রোগে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে আরও এক লক্ষ বেশি অর্থাৎ সোয়া চার লক্ষ। ভারতের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে অবশ্যই এই সরকারী পরিসংখ্যানকে বাস্তব অবস্থার এক সীমিত অনুমান হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। তবু একুশ শতকের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিরিখে সরকারী পরিসংখ্যানে উঠে আসা এই আনুমানিক ছবিটিও অতিমারীর বিভীষিকাকে ভালোই তুলে ধরে।
এই অতিমারীর যাত্রাবৃত্তান্তও বেশ অদ্ভুত। চীন থেকে মূলত আকাশপথে এর বিশ্বসফর শুরু। ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানের মতো যে সব দেশ শুরু থেকেই এই যাত্রাপথকে অনুধাবন করে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে তারা অনেক দ্রুত এবং অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করে এর ধাক্কা সামলে উঠেছে। এশিয়ার এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ শিক্ষাও যথেষ্ট কাজে এসেছে। তুলনামূলকভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার যে সব দেশ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেরী করেছে তাদের আজও অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। চীনের পর ইউরোপ কাঁপিয়ে আজ কিন্তু করোনা সবচেয়ে বেশি দাপট দেখাচ্ছে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মেক্সিকো ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে।
সবচেয়ে বেশি সময় পাওয়া সত্ত্বেও সবচেয়ে কম শিক্ষা ও প্রস্তুতি নেওয়া দেশ হিসেবে আজ এই পর্যায়ে এক নম্বর ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে ভারতকেই চিহ্নিত করা যায়। আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশে করোনার এই তীব্র তাণ্ডবের মধ্যে কোনো সাধারণ যোগসূত্র চোখে পড়ে কি? মৃত্যু হারের দিক থেকে ভারত অবশ্যই আমেরিকা ও ব্রাজিলের থেকে সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছে। তার কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ভাইরোলজি সঙ্গত কারণ অবশ্যই রয়েছে, সে চর্চায় আমরা এখানে যাব না। যে সাধারণ যোগসূত্র খুব সহজেই চোখে পড়ে তা হল এই তিনটি দেশেই উগ্র দক্ষিণপন্থার রাজত্ব চলছে। আর্থিকনীতি ও স্বাস্থ্যনীতির দিক থেকে ইউরোপের অনেক দেশ সম্পর্কেই আজ একথা বলা যায়। স্বাস্থ্য নিয়ে যে দেশে যত মুনাফার কারবার চলে সে দেশ করোনার আক্রমণে তত বেশি বিপর্যস্ত। বিপরীতে কিউবা বা ভিয়েতনাম বা এমনকি বাজারবাদের যুগেও চীনের মতো দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এ ধরনের অতিমারী মোকাবিলায় স্পষ্টতই অনেক বেশি দক্ষ।
তবে আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারতের ক্ষেত্রে শুধু উগ্র দক্ষিণপন্থী নীতি দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। এই তিন দেশেই এই মুহূর্তে যে নেতারা শাসনক্ষমতায় রয়েছে তাদেরও একটা বিশেষ চরিত্র রয়েছে। এই চরিত্রকে বুঝতে আমরা হিটলার ও তুঘলকের একটা যৌগকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দম্ভ, বিজ্ঞান বিরোধী মানসিকতা ও খামখেয়ালিপনার এক মারাত্মক সমাহার। ভারতে ১৮ মার্চের আগে পর্যন্ত সরকার ক্রমাগত বলে গেছে করোনা নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। সরকারীভাবে নরেন্দ্র মোদীর ১৮ মার্চের ভাষণ থেকে প্রথম করোনা মহামারী ‘সরকারী স্বীকৃতি’ পায়। বাইশে মার্চ জনতা কারফিউ-এর নামে সারাদিন লকডাউনের মহড়ার পর বিকেল পাঁচটায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে গোটা দেশজুড়ে তালি-থালি কাঁসর-ঘণ্টা সহযোগে ‘গো করোনা গো’ মিছিল সংগঠিত হয়। আর তারপর হঠাৎ চার ঘণ্টার নোটিশে ২৪ মার্চ রাত থেকে শুরু হয়ে যায় লকডাউন, আর নিরন্ন, কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ফেরার মহামিছিল।
আজ দেশজুড়ে করোনার বিলম্বিত তাণ্ডবের পেছনে এই উদ্ভট লকডাউনের বিরাট অবদান। আর তারই সাথে তাল দিয়ে আমাদের ভাঙ্গাচোরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও করোনা সম্প্রসারণে বিরাট ভূমিকা পালন করে চলেছে। একদিকে সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সরকারী উপেক্ষায় জর্জরিত, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সর্বনাশের সময়কেই বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুনাফা লুটের পৌষমাস হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে ভারতে করোনা মহামারীর থেকেও বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলতে থাকা লকডাউন। দিনআনা-দিনখাওয়া ব্যাপক জনগণ তো স্পষ্টতই গভীর সংকটে। ছাঁটাই ও বেতন সংকোচনের কবলে পড়েছেন এমন শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যাও বিরাট। সব মিলিয়ে সমাজের বিরাট বড় অংশের মানুষের আয়ের ব্যাপক অবনমন ঘটেছে এই পাঁচ মাসে। করোনা মহামারীতে মৃত্যুর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে তাই বেড়ে চলেছে লকডাউনজনিত মৃত্যুর মিছিল – অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষ থেকে শুরু করে লকডাউনের ফলে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়া মানুষ আর সামাজিক-আর্থিক সংকটে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হওয়া মানুষ, লকডাউনের ফলে বিরাট এক বিভীষিকা নেমে এসেছে বহু মানুষের জীবনে।
করোনা অতিমারী ও লকডাউনজনিত সংকটের সাথেই যুক্ত হয়ে পড়েছে তৃতীয় একটি বিষয়। লকডাউনের ফলে স্বাভাবিক সংসদীয় প্রণালী ও জনগণের প্রতিবাদ-আন্দোলন, এমনকি স্বাভাবিক জনজীবনে যে গতিরোধ নেমে এসেছে তার সুযোগ নিয়ে মোদী সরকার একের পর এক বড় বড় নীতিগত পরিবর্তন করে চলেছে। তথাকথিত আর্থিক প্যাকেজ ও ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্লোগানের আড়ালে একদিকে সরকার তার যাবতীয় দায়দায়িত্ব জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে আর অন্যদিকে কয়লা, রেল, প্রতিরক্ষা, ব্যাঙ্ক শিল্পের মতো রণনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে চলছে বেসরকারীকরণের আগ্রাসী অভিযান। এই বিপর্যয়েই বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার বিভিন্ন শ্রম আইন বাতিল, নিষ্ক্রিয় বা শিথিল করে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করার নির্দেশ জারী করেছে, তিন তিনটি কৃষিসংক্রান্ত অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কৃষি-উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের কেনাবেচার প্রশ্নে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণকে সম্প্রসারিত করেছে আর নতুন শিক্ষানীতি জারী করে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়কে আমন্ত্রণ জানানোর সাথে সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যিকীকরণের পথ খুলে দিয়েছে।
বেসরকারীকরণ ও বাজারিকরণের দিশায় এই আক্রমণাত্মক অভিযানের পাশাপাশি চলছে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত হামলা, সংবিধানিক মূল্য ও আইনভিত্তিক শাসন কাঠামোর ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় বন্দীদের কোভিড পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জামিনে মুক্তি দেওয়ার পরিবর্তে উল্টে আরও তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই কায়দায় দিল্লী দাঙ্গার মামলাকেও সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। যাদের প্রকাশ্য উস্কানি ও নেতৃত্বে এই দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, প্রবেশ বর্মা ও রাগিনী তেওয়ারির মতো সেই সব দাঙ্গাকারী বিজেপি নেতৃত্বকে খোলাখুলিভাবে ছাড় দিয়ে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক এবং বামপন্থী ও প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের অগ্রবাহিনীকে দাঙ্গার অভিযুক্ত হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে ইতিমধ্যে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আর অন্য অনেকের বিরুদ্ধে চলছে অভিযোগ গঠন ও পুলিশী জেরার প্রক্রিয়া।
কৃষক ও ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নাগরিকতা সংশোধন বিরোধী আন্দোলন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় গণজাগরণ হিসেবে উঠে এসেছে। কোভিড পরিস্থিতি ও লকডাউনের ফলে আন্দোলন পুরনো গতিতে ও ধরনে এই পর্যায়ে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, আর এই সুযোগে সরকার এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ও জাতীয় নিরাপত্তা আইনের মতো দানবীয় আইনকে কাজে লাগিয়ে এই গণজাগরণকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। এই দমন অভিযান গোটা দেশ জুড়েই চলছে, তবে দিল্লী ও মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ ও অসম এই অভিযানের বিশেষ ল্যাবরেটরি হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার সাথে সাথেই মোদী সরকার সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়। ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলকে রাজ্যে পরিণত করার বিপরীতে (যেমন গোয়া) এক পূর্ণ রাজ্যকে দুটি কেন্দ্র শাসিত এলাকায় বিভক্ত করে দেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ, সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কারুর সাথে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা না করেই একতরফাভাবে কেন্দ্র সরকার এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় আর কাশ্মীরের মানুষ যাতে প্রতিবাদ না করতে পারে সেজন্য রাজ্যজুড়ে নামিয়ে আনা হয় এক অভূতপূর্ব লকডাউন। যে টেলিফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা আজ জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের মতোই নিত্যপ্রয়োজনীয় তা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সহ প্রায় সমগ্র বিরোধীপক্ষকে জেলে বা নিজ ঘরে আটক করে রাখা হয়।
গত একবছরে কাশ্মীরের এই বন্দীদশার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। লকডাউন পর্যায়ে বরং একের পর এক নিয়ম পরিবর্তন করে বহিরাগত নাগরিকদের কাশ্মীরের বাসিন্দা (domicile) প্রমাণপত্র দেওয়া হচ্ছে যাতে কাশ্মীরের জনসংখ্যার কাঠামো ও ভারসাম্য বদলে দেওয়া যায়। এবছর ৫ আগস্ট কাশ্মীরের সম্ভাব্য প্রতিবাদের কথা ভেবে সরকার প্রথমে ৪ ও ৫ দুদিনের জন্য কারফিউ জারী করেছিল, পরে ৪ তারিখ সন্ধ্যায় সেই কারফিউ প্রত্যাহার করা হয় যাতে সম্ভবত ৫ আগস্ট বার্ষিকী পালনে প্রশাসন ও মুষ্টিমেয় বিজেপি সমর্থকদের কোনো অসুবিধে না হয়।
৫ আগস্ট বার্ষিকী বিজেপি এবার পালন করল অযোধ্যায়। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় এবং বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এখনও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা রয়েছে – অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকবে না এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসন ধার্মিক অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে আলাদা রাখবে। সেই সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সরকারী ক্ষমতায় আসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যপাল অনাদিবেন প্যাটেল এবার আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে একযোগে রাম মন্দিরের ভূমিপূজন করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ছেঁড়া কাগজের প্রহসনে পরিণত করার এর চেয়ে নির্লজ্জ উদাহরণ কমই দেখা গেছে।
১৯৯২ সালের ৬ জিসেম্বর বাবরি মসজিদ বিধ্বংস করে সংঘ পরিবার সংবিধানের উপর যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল তখন রাষ্ট্র তাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯৯৪ সালে সুপ্রীম কোর্ট তাকে ‘জাতির লজ্জা’ হিসেবে ধিক্কার জানিয়েছিল। এমনকি গত ৯ নভেম্বর ২০১৯ সুপ্রীম কোর্টের যে রায়ের ভিত্তিতে অযোধ্যার বাবরি মসজিদের জমিকে মন্দির নির্মাণের জন্য আইনি অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাতেও ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ বিধ্বংসের ঘটনাকে অপরাধ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেই অপরাধের মামলাটি এখনও শুনানি স্তরে আছে। শুধু ১৯৯২ নয়, সুপ্রীম কোর্ট ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদে রামলালার মূর্তি রেখে দেওয়ার ঘটনাটিকেও মসজিদকে অপবিত্র করে মুসলিম সমাজের ধার্মিক অধিকারে হস্তক্ষেপ ও প্রার্থনার অধিকার হরণের এক দৃষ্টান্ত হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। যারা আজ কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে মন্দির নির্মাণকেই সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন তাদের ভাবা উচিত ১৯৪৯ ও ১৯৯২ সালের এই দুটি অপরাধ যদি না ঘটত তাহলে কি অযোধ্যা জমি বিবাদে সুপ্রীম কোর্ট এভাবেই মন্দিরের পক্ষে জমির মালিকানার রায় দিত?
মন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সাংকেতিক তাৎপর্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল তার পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রদত্ত ভাষণ, যাতে রামকে ভারতের ঐক্যের মূল সূত্র হিসেবে এবং রামমন্দির নির্মাণকে কয়েক শতাব্দীর অপেক্ষা ও আকাঙ্খার বাস্তবায়ন হিসেবে তুলে ধরা হয়। এভাবে ৫ আগস্টকে ১৫ আগস্টের সঙ্গে একই আসনে বসিয়ে দেওয়াটা এক মারাত্মক মিথ্যা ও বিপজ্জনক ইঙ্গিত। রামভক্তদের অনেকের জন্য অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ এক আন্দোলনের ও আকাঙ্খার বিষয় অবশ্যই ছিল কিন্তু তাকে গোটা দেশের কয়েক শতাব্দীর অপূর্ণ স্বপ্ন হিসেবে ঘোষণা করাটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা ভাষণ।
ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সংগ্রামটা ছিল সমগ্র দেশ ও জাতির, আর সেই সংগ্রামে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির গড়ার কোনো প্রশ্নই কখনও ওঠেনি। ১৯৪৯ সালে আরএসএস-এর এক কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা হিসেবে বাবরি মসজিদকে বিতর্কিত করে তোলা হয়েছিল, আর আশির দশকে আর একবার কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাম জন্মভূমি আন্দোলনের নামে গোটা দেশজুড়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে মসজিদকে শেষপর্যন্ত ষড়যন্ত্রমূলক কায়দায় ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাক্রমকে গোটা দেশের কয়েকশো বছরের স্বপ্নপূরণ হিসেবে তুলে ধরাটা ভারতের ইতিহাসকে চূড়ান্তভাবে বিকৃত ও অপমানিত করা, এবং এই মিথ্যা আর ধর্মের নামে সংকীর্ণতা ও দম্ভের ভিত্তিতে ভারতের জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচিতিকে পরিভাষিত করার এক জঘন্য চক্রান্ত। রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আড়ালে এ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে হিন্দু আধিপত্যবাদের ভিত্তিতে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে উপড়ে ফেলার ষড়যন্ত্র।
অর্থনীতি থেকে জাতীয়করণকে নির্বাসিত করে তার সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ করার পাশাপাশি ধর্মের মতো একান্ত ব্যক্তিগত আস্থার বিষয়কে সরকারীকরণ করে তোলার এই বিরাট ওলটপালট এই করোনাকালে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লকডাউনের বাধা সত্ত্বেও মানুষ কিন্তু প্রতিবাদে নেমেছে। কয়লা শিল্পে তিন দিনের অভূতপূর্ব ধর্মঘট আমরা দেখলাম। পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে কৃষক রাস্তায় নেমেছে কৃষির কর্পোরেটীকরণের অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবিতে। গোটা দেশজুড়ে মাইক্রোফিনান্সের নতুন মহাজনী প্রথার বিরুদ্ধে ঋণমুক্তির দাবিতে সোচ্চার শ্রমজীবী নারীসমাজ এবং ঋণগ্রস্ত কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত জনগণ।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই ফ্যাসিবাদী ওলটপালটের বিরুদ্ধে আজ দরকার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, এক দুর্বার গণপ্রতিরোধ। অধিকাংশ বিরোধী দলই এই প্রশ্নে এখনও চরম উদাসীন বা রীতিমতো দেউলিয়া। কাশ্মীরের প্রশ্নে কিছুটা বিরোধিতা করলেও অযোধ্যা প্রশ্নে আমরা কংগ্রেসকে বিজেপির কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে দেখলাম। রামমন্দির নির্মাণের শ্রেয়লাভের মিথ্যা নিষ্ফল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজেপিকে পরাস্ত করতে চায় কংগ্রেস। বামপন্থীদের কাছে তাই আজ বড় চ্যালেঞ্জ, বড় দায়িত্ব। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের পতাকা নিয়ে আজ বামপন্থীদের এগিয়ে আসতে হবে সামনের সারিতে।
১৯৪৯ সালে সংবিধান গ্রহণের সময় সংবিধান সভায় শেষ ভাষণে আম্বেদকর বলেছিলেন, ভারতে যদি হিন্দুরাজ চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা হবে এক বিরাট বড় বিপর্যয়। সেই সতর্কবাণী আজ বিরাটভাবে প্রাসঙ্গিক। হিন্দুরাজ মানে মনুস্মৃতির রাজ, সমাজকে আবার বর্ণাশ্রমের রাস্তায়, অন্ধবিশ্বাস ও সামাজিক সংকীর্ণতার কানাগলিতে ঠেলে দেওয়া। আজ সময় এসেছে বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের আন্দোলন, কর্পোরেটীকরণের বিরুদ্ধে কৃষকের মুক্তির আন্দোলন; শিক্ষার অধিকার ও মুক্তচিন্তার জন্য ছাত্র-শিক্ষক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ; পরিবেশ, মানবাধিকার ও নাগরিকতা বাঁচানোর লড়াই সব কিছুকে একসূত্রে গেঁথে এক বিরাট গণজাগরণ সৃষ্টি করার। সরকার করোনাকাল ও লকডাউনকে দীর্ঘায়িত করে গণতন্ত্র ও মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু জনগণ এর মধ্যেও প্রতিবাদের পথ খুঁজে নিচ্ছেন, প্রতিবাদের নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই গণউদ্যোগ ও সংগ্রামী প্রাণচাঞ্চল্য, গতি ও স্পর্ধাকে পুঁজি করেই বামপন্থীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আসুন জোট বাঁধি, তৈরি হই। এ লড়াই গণতন্ত্রের বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে।
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
(শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ আগস্ট, ২০২০ ডিজিটাল সংখ্যায় প্রকাশিত।
অনুমতিক্রমে দেশব্রতীতে পুনরায় প্রকাশিত হল।)
বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে ন্যায় বিচারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করেন বলে যিনি সুবিদিত সেই আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের সম্প্রতি করা দুটো টুইটে স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্র, বি আর গাভাই ও কৃষ্ণ মুরারির বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশান্ত ভূষণের কাছে নোটিস পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন--কেন তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে না। প্রশান্ত ভূষণের জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে গত ১৪ আগস্ট তাঁদের রায়ে তাঁরা জানিয়েছেন ভূষণ তাঁর টুইটের মধ্যে দিয়ে আদালতের অবমাননা ঘটিয়েছেন, ফলে দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন। শাস্তি কী হবে তা আদালত ২০ আগস্ট জানাবে। আদালতের রায় নিয়ে আলোচনার আগে ভূষণের টুইটগুলোতে কি অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তার দিকে তাকানো যাক।
প্রথম টুইটে ভূষণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে – “গত ছ-বছরে জরুরি অবস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই গণতন্ত্রকে কিভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তার দিকে ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকরা যখন ফিরে তাকাবেন তখন তাঁরা এই ধ্বংসকাণ্ডে বিশেষভাবে সুপ্রিম কোর্টের এবং আরও বিশেষভাবে ভারতের শেষ চার প্রধান বিচারপতির ভূমিকাকে লক্ষ্য করবেন।” আর, দ্বিতীয় টুইটে ভূষণ একটা অতীব ব্যয়বহুল ‘হারলে ডেভিডসন’ মোটরবাইকে প্রধান বিচারপতি শারদ অরবিন্দ বোবদের বসে থাকার ছবি পোস্ট করে বলেন, “বিজেপি নেতার ছেলের ৫০ লক্ষ টাকা দামের মোটরবাইকে চেপে রয়েছেন প্রধান বিচারপতি বোবদে, মুখে মাস্ক ও হেলমেট নেই, সুপ্রিম কোর্টে শুনানি বন্ধ রেখে তিনি অবকাশ যাপন করছেন আর বিনা বিচারে আটক এবং গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিরা সুরাহা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।” মোটরবাইকটার মালিক যে কোনো এক বিজেপি নেতার ছেলে তা বাইকটার রেজিস্ট্রেশন নম্বর থেকে জানা যায়।
নাগপুরের রাজভবনে বিজেপি নেতার ছেলের হারলে ডেভিডসন মোটরবাইকে বসা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বোবদে জানিয়েছেন যে, ওই মোটরবাইকের মালিক কে তা তিনি জানতেন না, এবং মোটরবাইকটা তাঁর কাছে নিয়ে আসে হারলে ডেভিডসন কোম্পানির কোনো এক পদস্থ কর্মচারি। তিনি যেহেতু মোটরবাইকটাতে চেপে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা চালাচ্ছিলেন না, তাই হেলমেট বা মাস্ক পরার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এটি প্রধান বিচারপতির মন্তব্য আর তাই এর সত্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তা সত্যের অপলাপ হবে। ভূষণ বাইক চাপা এবং হেলমেট ও মাস্ক না পরা বিষয়টি প্রসঙ্গে মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও অন্যান্য বিষয়ে নিজের অবস্থানে অবিচল থাকেন।
তাঁকে পাঠানো নোটিসের পরিপ্রেক্ষিতে জমা দেওয়া হলফনামায় প্রশান্ত ভূষণ বলেছেন, দেশের গণতন্ত্রের সুরক্ষার দায়িত্ব সংবিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করেছে। প্রশাসনিক শাখার বাড়াবাড়িতে রাশ টানতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক শাখাগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করছে কিনা তার নজরদারির ভারও সুপ্রিম কোর্টের ওপর রয়েছে। কিন্তু গত ছ-বছরে শেষ চার প্রধান বিচারপতি যেভাবে নিজেদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে “স্বৈরাচার, সংখ্যাগুরুবাদের প্রসার ঘটতে দিয়েছেন, বিরোধী কন্ঠস্বরের দমন ও ব্যাপক হারে রাজনৈতিক কর্মীদের বন্দীত্ব ঘটতে দিয়েছেন”, তাঁর করা টুইটে তিনি সে সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশই করেছেন। এটা প্রধান বিচারপতিদের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর আন্তরিক অভিমত। এটা অতএব কখনই আদালত অবমাননার শামিল হতে পারে না। তাঁর হলফনামায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “প্রশাসন এবং আইনসভা বুনিয়াদি অধিকারগুলির শ্বাসরোধ করে এবং নির্ধারিত ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘনের মধ্যে দিয়ে ও আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করার মধ্যে দিয়ে এই দেশে গণতন্ত্রের মর্মবস্তুকে যখন নির্বাপিত করা হচ্ছিল তখন এই সমস্ত কিছুকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করতে সুপ্রিম কোর্ট প্রধানত অসমর্থ হয়েছে এবং এইভাবে আমাদের গণতন্ত্রের ধ্বংসকে প্রতিহত করতেও ব্যর্থ হয়েছে।…”
শেষ চার প্রধান বিচারপতির ভূমিকা প্রসঙ্গে তাঁদের জমানায় দেওয়া কিছু রায়, নির্দেশ ও পদক্ষেপকেই যে বোঝানো হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। এগুলোর মধ্যে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী সহ শাসকদের স্বস্তি ও সুরক্ষাই শুধু জোগানো হয়নি, ভবিষ্যৎ ভারতের গণতন্ত্রের পথকেও কন্টকাকীর্ণ করা হয়েছে। উঠেছে সাহারা-বিড়লা মামলায় রায়ের কথা। আয়কর দপ্তরের বাজেয়াপ্ত করা নথিতে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি নেতাদের কোটি-কোটি টাকা দেওয়ার উল্লেখ থাকলেও বিচাপতি অরুণ মিশ্র ও অমিতাভ রায়ের বেঞ্চ রায় দেয় ওই সমস্ত নথি “এমন কোনো অপরাধকে নির্দেশিত করে না যার ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের করার নির্দেশ দেওয়া যায়।” আরও উঠেছে ভীমা কোরেগাঁও মামলার কথা যাতে হিংসার প্রকৃত সংগঠকদের অপরাধকে আড়াল করে মানবাধিকার কর্মীদের কারান্তরীণ করা হয়, এবং মানবাধিকার কর্মীদের সুরাহা করতে সুপ্রিম কোর্টের অনীহা প্রকট হয়ে ওঠে। চর্চায় এসেছে রাফাল যুদ্ধবিমান ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় তদন্তের নির্দেশ দিতে সুপ্রিম কোর্টের অস্বীকার করার কথা যার ফলে মোদী সরকার স্বস্তি পায়, আর আধার মামলায় ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তাকে গুরত্ব না দেওয়ার ব্যাপারটাও আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। বিমুদ্রাকরণ, ইলেক্টোরাল বণ্ড-এর মতো ইস্যুতে শুনানিকে ক্রমেই পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণকে এড়িয়ে যাওয়ায় সরকার সুবিধা পেয়েছে, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলকে আইনসম্মত বলা যায় কিনা তার ফয়সালা এখনও না করায় সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপই বৈধতা পেয়ে চলেছে। আর সর্বোপরি তো রয়েছে অযোধ্যার বিতর্কিত জমি মামলার রায়, যে রায়ে বিচার বিভাগের হাতে বাবরি মসজিদের আরও একবার ধ্বংসসাধনই শুধু হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেও হিন্দু রাষ্ট্রের উত্থানে উৎসাহ জোগানো হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী যেমন সিবিআই, আরবিআই, নির্বাচন কমিশন, ক্যাগ থেকে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতার বিপর্যয় ঘটিয়ে সেগুলোকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করেছেন, তাঁর সেই অভিযান থেকে বিচার বিভাগও রেহাই পায়নি। আদালতগুলোকে এনডিএ সরকারের প্রতি নমনীয় করে তুলতে, যে কোনো বিষয়েই বিচারপতিরা যাতে সরকারী ভাষ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তার জন্য তিনি প্রথম থেকেই কসরত চালাতে তৎপর হয়েছেন। একেবারে শুরুতেই, সেই ২০১৪ সালেই বিচারপতি গোপাল সুব্রমনিয়মের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া আটকাতে মোদী মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং সেই পরিস্থিতিতে সুব্রমনিয়ম সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার জন্য নিজের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। কলেজিয়ামের মধ্যে দিয়ে বিচারপতি নিয়োগের ওপর সুপ্রিম কোর্টের অধিকারকে খর্ব করতে চাপ সৃষ্টি করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশে অনুমোদন দিতে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব ঘটিয়েছেন। মোদী মন্ত্রীসভার প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের অধিকারকে, কলেজিয়াম প্রথাকে “অনির্বাচিতদের স্বৈরাচার” বলে অভিহিত করেছিলেন। আর আজ গোটা দেশ “নির্বাচিতদের স্বৈরাচারে” হাঁসফাঁস করছে। জনৈক ভাষ্যকারের মতে মোদী শাসনের বছরগুলোতে সুপ্রিম কোর্ট “ত্রস্ত, দ্বিধান্বিত, খণ্ডিত ও দুর্বল” রূপে দেখা দিয়েছে।
বিচারপতি অরুণ মিশ্রর বেঞ্চ প্রশান্ত ভূষণের টুইটগুলোকে “বিদ্বেষপ্রসূত”, “কদর্য” এবং সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা হানিকর বলে মনে করেছেন। বিচারপতিরা এই অভিমতই ব্যক্ত করেছেন যে, আদালত হল গণতন্ত্রের রক্ষক এবং তার ও বিচারপতিদের সমালোচনা প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের ওপরই আক্রমণ। আর তাই “একেবারে কঠোর হস্তে” এই আক্রমণের মোকাবিলা করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট ও তার প্রধান বিচারপতিদের সমালোচনা করায় যে অরুণ মিশ্র এমন খড়্গহস্ত হলেন, সেই তিনিই মাত্র অল্প কয়েকদিন আগেই গত ২৩ জুলাই এক মামলায় বিরোধী মত প্রকাশের অধিকারকে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি বলেছিলেন। রাজস্থানে সচিন পাইলটের নেতৃত্বে কংগ্ৰেস বিধায়কদের একাংশের মুখ্যমন্ত্রী গহলৌতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজস্থান বিধানসভার স্পিকার সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হলে এই অরুণ মিশ্রই মন্তব্য করেছিলেন — “গণতন্ত্রে নির্বাচিত কোনো ব্যক্তি কি তাঁর ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারবেন না? ভিন্ন মত প্রকাশকে দমন করা উচিত নয়। গণতন্ত্রে কারুর ভিন্ন মত প্রকাশের কণ্ঠকে কি এইভাবে রোধ করা যায়?” তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন, “বৃহত্তর প্রশ্ন হল গণতন্ত্র এবং সেটা কী করে বাঁচবে, তা নিয়ে।” আর এখন ৭৪তম স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের দিন অরুণ মিশ্রর অভিমত হল, সুপ্রিম কোর্ট ও তার বিচারপতিদের ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশকে “কঠোর হস্তে” দমন করেই, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বুনিয়াদি অধিকারকে নস্যাৎ করেই, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে! ভিন্ন মত প্রকাশের প্রতি, বিরোধিতা জানানোর অধিকারের প্রতি অরুণ মিশ্রদের স্বীকৃতি যে সর্বাঙ্গীণ নয়, তা যে বৈষম্যমূলক এবং বেছে নেওয়া কিছু ক্ষেত্রেই অনুমোদনযোগ্য, তা অতএব প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রসঙ্গত, অরুণ মিশ্র হলেন সেই বিচারপতি যাঁর অবস্থান “নিরপেক্ষ” হলেও যিনি নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে কোনো কুন্ঠা দেখাননি। অরুণ মিশ্র হলেন সেই বিচারপতি যাঁর বেঞ্চে বিচারপতি লোয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তের দাবির মামলা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র ফেলায় সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতি ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারী ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল মামলাগুলো নির্দিষ্ট কিছু বেঞ্চেই ন্যস্ত করা হচ্ছে কেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করতেই হয়েছিল ওই চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলন। সেই ট্র্যাডিশন কি এখনও চলছে? ভারতে মোদী জমানায় সুপ্রিম কোর্টের হাতে গণতন্ত্র ধ্বংসের অভিযোগের মতো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল মামলাও গেল অরুণ মিশ্রর মতো বিতর্কিত বিচারপতির বেঞ্চে। ভূষণের হয়ে সওয়াল করতে উঠে আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভেও প্রশ্ন তুললেন — “উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট কয়েকজন বিচারপতির কাছে কেন রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল মামলাগুলো যায়? দৃষ্টান্তস্বরূপ বিচারপতি নরিম্যানের কথা বলা যায় – এই ধরনের কোনো মামলা তাঁকে দেওয়া হয় না।” তবে কি ভূষণের কাছে নোটিস পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই রায়ও নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল? আর তা হয়েছিল বলেই কি গ্ৰাহ্য করা গেল না সেই সমস্ত মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টেরই বেশ কিছু প্রাক্তন বিচারপতির অভিমত ও যুক্তিকে, যাঁরা ভূষণের সমর্থনে আদালত অবমাননার মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের কাছে? আমাদের মনে এই প্রশ্ন জাগলেও এ বিষয়ে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে, একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। ভূষণের টুইটের আয়নায় নিজেদের অনাচারের উন্মোচনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই টুইটগুলোর প্রতি দেখানো সুপ্রিম কোর্টের অতি-সংবেদী প্রতিক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টের নৈতিক কর্তৃত্বকেই কলঙ্কিতই করেছে। সুপ্রিম কোর্টের এই গ্লানিময় অস্তিত্বের কাছে ভারতীয় সংবিধান কতটা সুরক্ষিত থাকবে তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। সংবিধান রক্ষার লড়াইটা, সুপ্রিম কোর্টকে যথার্থ ন্যায়ালয়ে পরিণত করার লড়াইটা ভারতের জনগণকেই চালাতে হবে, প্রধানত আদালতের বাইরে, মাঠেঘাটে, রাজপথে ও অলিত-গলিতে।
-- জয়দীপ মিত্র
সারা দেশে ১৩ আগস্ট ঋণমুক্তি দিবস হিসেবে বহুস্তরে কর্মসুচী গৃহীত হয়। বিশেষত পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে তা খানিকটা ব্যাপক চেহারা নেয়। এখানে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলা ও ব্লকের রিপোর্ট প্রকাশ করা হল।
পূর্ব বর্ধমান
১৩ আগস্ট দেশ জুড়ে ঋণমুক্তি দিবস পালনের অংশ হিসেবে পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে ১৫ দিন আগে থেকে ঋণ মুক্তি কমিটির নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে বৈঠক, মিছিল ও প্রচার শুরু হয়। জেলার ৪টি ব্লকে ৬০টির মতো গ্রামে বৈঠক হয়। মোদী সরকার দেশ জুড়ে আনলক-টু ঘোষণা করলেও গ্রামীণ গরিব জনগণের জীবন-জীবিকায় লকডাউন কাটছে না। মানুষের কাজ নেই, খাদ্যের অভাব বেড়েই চলছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে কাজের অভাবে চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। গ্রামীণ মজুর, হকার, তাঁত শ্রমিক ও গ্রামীণ মেহনতি মহিলাদের কাজ নেই। ১০০ দিনের কাজ পর্যাপ্ত দেওয়া হচ্ছে না। চলছে দলবাজি, দুর্নীতি। তার উপর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া গরিব মানুষের জীবনধারণ অসহনীয় হয়ে উঠছে। তার মধ্যেই মহাজনী সংস্থাগুলোর এজেন্টরা ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপর ঋণ আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে চাপ সৃষ্টি করে চলছে। তাই ঋণ-ফাঁদে জর্জরিত গ্রামীণ গরিব জনগণ বিশেষত মহিলারা দলে দলে ঋণ মুক্তি কমিটিতে সামিল হতে শুরু করেছে।
জামালপুর ব্লকে ১৩ আগস্ট বিক্ষোভ, ডেপুটেশন সংগটিত করা হয়। ৩৭টি গ্রামের দুই হাজারের বেশি মানুষ বিশেষ করে মহিলারা নিজস্ব উদ্যোগে বিডিও অফিসে জমায়েত হয়। ব্যাপক পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারী মহিলাদের জঙ্গী প্রতিরোধের সামনে পুলিশ পিছু হঠতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ চলার পর বিডিও তিন জন প্রতিনিধির ম্যাধমে ডেপুটেশন গ্রহণ করতে রাজি হয়। কুনাল বক্সীর নেতৃত্বে ঋণ-মুক্তি কমিটির ব্লক সভাপতি অর্চনা মল ও সম্পাদক নিতাই ক্ষেত্রপাল ডেপুটেশনে প্রতিনিধিত্ব করেন। দাবিগুলি ছিল – (ক) প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থ বর্ষের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সমস্ত ইএমআই আদায় স্থগিত রাখতে হবে। (খ) লকডাউন বিপর্যস্ত মানুষের উপর বন্ধন, উজ্জীবনের মতো সংস্থাগুলির চড়া সুদ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিস্তি আদায়ের নামে জুলুমবাজি বন্ধ করতে জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (গ) রাজ্য সরকারকে সমস্ত ধরনের কৃষি ঋণ মুকুব করতে হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের স্বনির্ভরতা সুনিশ্চিত করুন। (ঘ) দরিদ্রদের সমস্ত ধরনের ঋণমকুবে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। (ঙ) মনরেগা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।
এই দাবিগুলো নিয়ে বিডিও আলোচনা করে সাত দিন সময় নেয়। দাবিগুলো উপরে পাঠাবে। সাত দিন পরে কি করতে পারবে জানাবে। এই ডেপুটেশন এলাকায় ভালো প্রভাব ফেলেছে। উপস্থিত জনগণ ভালো উৎসাহিত হয়েছে। এই ডেপুটেশনে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড সলীল দত্ত সহ ছয় জন জেলা কমিটির সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
বর্ধমান সদর ১নং ব্লকের বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ডেপুটেশনে দুই শতর কাছাকাছি ঋণগ্রস্ত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জেলা কমিটির সদস্য শ্রীকান্ত রানা ও সমীর হাজরা, চাপা হাজরা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ডেপুটেশনের পরেও বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ যোগাযোগ করছে। জমায়েতে বেশিরভাগ গ্রামীণ মহিলারা উপস্থিত ছিলেন।
কালনা ২নং ব্লকে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে ঋণ মুক্তির দাবিতে বিডিও অফিসে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। দুই শতাধিক গরিব তথা ঋণ-ফাঁদে জর্জরিত মানুষ বিক্ষোভে সামিল হয়। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মহিলারা ভালো মাত্রায় উপস্থিত ছিলেন। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা কমরেড সুমি মজুমদার (ঘোষ) ও অনান্য মহিলা নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন আয়ারলা ও সিপিআই(এমএল)-এর নেতা কর্মীরা।
হুগলি
১৩ আগস্ট ঋণ মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠল গোটা হুগলি জেলা। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, জেলা জুড়ে পথে নামলেন হাজার হাজার মানুষ। কোথাও পথ অবরোধ, জাতীয় পতাকা হাতে তুলে ধরে কোথাও ঋণপত্রের প্রতিলিপি পোড়ানো, কোথাও মিছিল, কোথাও বা বিডিও ডেপুটেশন, স্টেট ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ডেপুটেশন ইত্যাদি নানান কর্মসূচী সংগঠিত হল ঋণ-মুক্তির দাবিতে।
দিনের প্রথম কর্মসূচীটির সূচনা ধনেখালির ফিডার রোডে। ব্লকের প্রত্যন্ত অসংখ্য গ্রাম থেকে বেলা ১১টার মধ্যে এখানে উপস্থিত হলেন শয়ে, শয়ে মানুষ, যাদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র মহিলা। স্বাধীনতার ঠিক আগে জাতীয় পতাকা হাতে, করোনা সতর্কতা মেনেই তে-মাথার সবদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীরা তুলে ধরলেন ঋণ মুক্তির দাবি – “শিল্পপতিদের বারবার ঋণমকুব হলে, আমাদের গরিবদের ঋণ সরকার এই প্যানডেমিকের সময় মকুব করবে না কেন?”
আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণ ঘটালো বহ্নি-উতসবে, তেমাথার মোড় আটকে শত, শত ঋণগ্রস্ত মহিলা নিজের হাতে পোড়ালেন ঋণপত্রের প্রতিলিপি! রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে বাসযাত্রী থেকে সাধারণ মানুষ, আওয়াজ উঠল, মুখ্যমন্ত্রী এখনো চুপ কেন? মন্দির গড়ায় সময় না দিয়ে, প্রধানমন্ত্রী মোদী বরং ভাবুন মাইক্রো ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলির জুলুমবাজি কিভাবে বন্ধ করা যায়, সেসব নিয়ে! আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন সম্রাট মাহেলী, প্রতিমা মুর্মুদের পাশাপাশি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সজল দে, সোমা রায়, শৈলেন মাজি প্রমুখ।
ইতিমধ্যে চুঁচুড়া খাদিনা মোড়ের স্টেট ব্যাংক শাখার সামনে মিছিল শেষে শুরু হয় ধর্ণা ও ডেপুটেশন কর্মসূচী। নেতৃত্বে ছিলেন আইপোয়া নেত্রী চৈতালী সেন, সাবিনা খাতুন, ঋণ মুক্তি কমিটির শেলী রায়, এআইপিএফের ভিয়েত ব্যানার্জী, সুদর্শন বসুরা।
বেলা ২টা নাগাদ পোলবা দাদপুরের সেঁইয়া থেকে শুরু হল মিছিল। মিছিল হারীট গঞ্জে পৌঁছালে সেনেট থেকেও যোগ দিলেন আন্দোলনকারীরা। জাতীয় পতাকা হাতে পথ অবরোধে নামলেন শয়ে, শয়ে মহিলা; মাইক্রো ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলির জুলুমবাজির বন্ধ করার দাবিতে। এখানেও পোড়ানো হলো ঋণপত্রের প্রতিলিপি। রাস্তার দুদিকে দাঁড়িয়ে আগুনের উত্তাপ গায়ে নিলেন অসংখ্য মানুষ। নেতৃত্ব দিলেন গোপাল রায়, পাগান মুর্মু, পদ্মা কর্মকার, রীনা পাশোয়ান সহ অন্যেরা। আয়ারলা অন্তর্ভুক্ত ‘ঋণ মুক্তি কমিটি’র বলাগড় বিডিও ডেপুটেশন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিলেন সেখ আনারুল, শোভা ব্যানার্জী। এখানেও হাজির ছিলেন অসংখ্য ঋণগ্রস্ত মানুষ, অধিকাংশই মহিলা।
এদিন হুগলির অন্যতম এক ঋণমুক্তি আন্দোলন দেখলেন পান্ডুয়াবাসী। বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ তিনদিক থেকে তিনটি মিছিল নিয়ে এসে পাণ্ডুয়া জিটি রোডের সদা ব্যস্ত কালনা মোড়ে ঋণমুক্তির দাবিতে পথের উপর বসে পরলেন শত, শত আন্দোলনকারী। ঋণ মুক্তি কমিটির এই আন্দোলনের সামনে রইলেন বিনয় দাস, নিরঞ্জন বাগ, চন্দনা মণ্ডল, মুকুল কুমার, ময়না কিস্কুর মতো নেতৃবৃন্দ।
আন্দোলন সংগঠিত হল তারকেশ্বরের মোচপুর মোড়, হরিপালের আঁটপুর, জাঙ্গিপাড়ার দ্বারহাটাতেও। গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষের মিছিল এসে মোড়ে, মোড়ে ঋণপত্রের প্রতিলিপি পুড়িয়ে নষ্ট করলো সর্বত্র। সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ উঠল, ‘ব্যাংক এজেন্টদের জুলুমবাজি বন্ধ করো’। নেতৃত্বে ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন, রুমা আহেরি, সজল দে প্রমুখ। এইদিন সন্ধ্যায় কোন্নগর ধারসা পেট্রোল পাম্প বাস স্ট্যাণ্ড এলাকায় নবগঠিত ‘ঋণ-মুক্তি কমিটি’ পথসভার মাধ্যমে প্রতিবাদ তুলে ধরলো।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাটে বারাসাত টাকি রোডের উপর দণ্ডিরহাট সোলাদানার মোড়ে রাস্তার উপর জড়ো হয়ে প্রতিবাদ দেখালেন অসংখ্য মহিলা, ঋণ মুক্তি কমিটির নেতা বাবু বিশ্বাসের নেতৃত্বে। ওইদিনই আয়ারলার ব্যানারে অজয় বসাকের উদ্যোগে প্রতিবাদ সংগঠিত হল অশোকনগর শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামেও। শিবদাসপুরে আদিবাসী মানুষের উপস্থিতিতে চলে গ্রামীণ আলোচনা সভা। উদ্যোগে ছিলেন আয়ারলার স্নেহাশিষ চক্রবর্তীরা।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার নিশ্চিন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মালিকপাড়াতে ঋণমুক্তির দাবিতে হল আলোচনাসভা, আয়ারলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামীর উদ্যোগে। ঋণ-মুক্তির দাবিতে পোস্টারিং হল উস্হি বাজারে।
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর চকবাজার ইন্দিরা মার্কেট মোড়ে আইপোয়া ও এআইসিসিটিইউ নেতৃত্বের উদ্যোগে চলে প্রতিবাদ কর্মসূচী। বক্তব্য রাখেন আইপোয়া নেত্রী তিতাস গুপ্ত, সিপিআই(এমএল) নেতা ফারহান হোসেইন খান ও আইসার বিল্টু ক্ষেত্রপাল। কর্মসূচীটি পথচলতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও অনেক মহিলা এই কর্মসূচীতে যোগ দেন।
দার্জিলিং জেলার শক্তিগড়ে ঋণ-মুক্তি প্রস্তুতি কমিটির ব্যানারে প্রতিবাদ সংগঠিত করলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা নেতা পুলক গাঙ্গুলি, মোজাম্মেল হক, আইপোয়া নেত্রী রুবি সেনগুপ্ত, শ্বাশ্বতী সেনগুপ্ত প্রমুখ। ফাঁসিদেওয়ার রাঙ্গাপানি কালারাম পাইকারি বাজারে পথসভায় ঋণ-মুক্তির দাবি তুলে ধরলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্য পবিত্র সিংহ, যুবনেতা কৃষ্ণ সিংহ সহ অন্যরা।
ছাত্র সংগঠন আইসা ঋণ মুক্তি দিবসে এডুকেশন লোন মকুবের দাবিতে সোচ্চার হয়। এই দাবিতে ১৩ অগষ্ট সরশুনার পথসভায় বক্তব্য তুলে ধরেন ছাত্রনেতা অভিজিৎ, আর ওয়াইএ রাজ্যনেতা রণজয় সেনগুপ্তরা। এই দিন আইসা, আইপোয়া, আরওয়াইএ’র যৌথ উদ্যোগে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যাণ্ডে দীর্ঘ সময় ধরে কর্মসূচী চলে। দরিদ্র নারীদের ঋণ-মুক্তির দাবি তোলার পাশাপাশি প্যানডেমিকের এই সময়ে এক বছরের জন্য এডুকেশন লোন মকুবের দাবী ওঠে।
ঋণ-মুক্তি কমিটির উদ্যোগে হাওড়া জেলায় আন্দোলন শুরুর ইতিহাস একেবারেই সাম্প্রতিককালের। এখানে অল্প দিনেই বিভিন্ন ব্লকে আন্দোলন ছড়িয়েছে। ১৩ অগষ্ট এই জেলার বাগনান ১ নম্বর ব্লকের বাঙ্গালপুর অঞ্চলে এবং হাটুরিয়া অঞ্চলে পথসভায় বক্তব্য রাখেন ঋণ-মুক্তি কমিটির নবীন সামন্ত, দিলীপ দে। আড়ুপাড়ায় নেতৃত্বে ছিলেন প্রণব মণ্ডল। কামারডাঙ্গায় কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দান করেন দেবব্রত ভক্ত। এছাড়াও ঋণ-মুক্তি দিবস পালিত হয় পিপুল্যান পূর্ব-পশ্চিমে। আমতা রইদাস এলাকায় কর্মসূচীর নেতৃত্বে ছিলেন আইপোয়া নেত্রী কল্যাণী গোস্বামী, অঞ্জনা মণ্ডলরা। আমতা ১ নম্বর ব্লকে ঋণমুক্তি কমিটি বিডিওকে ডেপুটেশন দিয়ে প্রতিবাদ প্রকাশ করে।
সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ শ্রমিক সমিতি (আয়ারলা) জাতীয় কার্যকরী কমিটির বৈঠক থেকে এক মাসব্যাপী লাগাতার আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, তামিলনাড়ু, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িষা ও উত্তরপ্রদেশের বিস্তারিত রিপোর্টের ভিত্তিতে এই কর্মসূচী ঘোশিত হয়েছে। জাতীয় কার্যকরী কমিটির প্রেরিত সার্কুলারে বলা হয়েছে, এক মাসব্যাপী এই প্রচার-আন্দোলন-অভিযানে মূল জোর থাকবে ‘গ্রাম থেকে গ্রামে, ঘর ঘর চলো’। গ্রামের প্রত্যেক পাড়ার প্রতিটি ঘরের সাথে দেখা করতে হবে। এই গণসংযোগ অভিযানই হবে সূচনাবিন্দু। ৩১ আগস্ট ব্লক-সদরে ব্লক স্তরের বিক্ষোভ সংগঠিত হবে। আর ১৫ সেপ্টেম্বর জেলাস্তরে সংগঠিত হয়ে জেলা-সদরে বিক্ষোভ সংগঠিত হবে। এই বিক্ষোভ প্রদর্শনগুলিরে নির্দিষ্ট রূপ বা ধরন কী হবে তা আয়ারলার রাজ্য কমিটিগুলি নিজ নিজ পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ করবেন। সবরকম করোনা সতর্কতা বিধি সহ জমায়েতগুলি করতে হবে এবং অতি অবশ্যই সমস্ত বিক্ষোভের সময় আন্দোলনের শ্লোগান ও দাবিগুলিকে পোস্টার-প্ল্যাকার্ডে সুস্পষ্টভাবে তুলে-মেলে ধরতে হবে। নিম্নলিখিত পাঁচটি প্রশ্নে নজর কেন্দ্রীভূত করা হবে :
১) সমস্ত পরিযায়ি শ্রমিক ও জবকার্ড (মনরেগা) শ্রমিক সহ সব ধরনের গ্রামীণ শ্রমিকদের ১০,০০০ টাকা করোনা লকডাউন ভাতা দিতে হবে।
২) কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প(মনরেগা)-কে সব সীজনের প্রকল্প হিসেবে বিকাশ ঘটাতে হবে। প্রত্যেক পরিবারের প্রত্যেককে বছরে অন্তত ২০০ দিন কাজ ও ৫০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিতে হবে। এই প্রকল্পকে শহর পঞ্চায়েত অবধি প্রসারিত করতে হবে এবং কৃষিকাজের সাথেও একে যুক্ত করতে হবে।
৩) সকলের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রেশন সরবরাহ করতে হবে, রেশনে যুক্ত করতে হবে বিভিন্ন ডাল, তেল, মসলা, সাবান ও মাস্ক।
৪) ‘স্বনির্ভর গোষ্ঠি’, ‘জীবিকা মিশন গ্রুপ’ ও কৃষকের সমস্ত ঋণ মকুব কর। কৃষকদের কিষান ক্রেডিট কার্ড ও অন্যান্য ঋণ মকুব করতে হবে।
৫) ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শ্রেণী ঐক্যকে জোরালো কর। নয়া শিক্ষানীতির বিরোধিতা কর, এই নীতি গরিব প্রান্তিকদের প্রবঞ্চনার উদ্দেশ্যে প্রণয়ন হয়েছে। রেল, ব্যাঙ্ক, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি সরকারি সংস্থা ও দেশের সম্পদ উৎস বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াও। কৃষক-বিরোধী কৃষি-বিরোধী অধ্যাদেশগুলি এবং পরিবেশ-বিরোধী ‘ইআইএ ২০২০’ প্রতিরোধ কর।
পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যেই আয়ারলার নেতৃত্বে ঋণমুক্তির প্রশ্ন সহ গ্রামীণ শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে আন্দোলন গতি পেতে শুরু করেছে। এই মাসব্যাপী অভিযান সেই লড়াইকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। জাতীয় কার্যকরী কমিটির বৈঠকের পর আয়ারলার রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারী জানিয়েছেন, প্যানডেমিক পর্যায়ে ভারত জুড়ে বেশ কিছু রাজ্যে আয়ারলার জোরালো উদ্যোগের ক্ষেত্রগুলি ছিল খাদ্য-নিরাপত্তা সংক্রান্ত (রিলিফ ও রেশন), করোনা সচেতনতায় উদ্যোগ, প্রবাসী মজুরদের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের সংগঠিত করা, এনআরইজিএ-তে জবকার্ড ও কাজ আদায়, সামন্তী অত্যাচার ও উচ্ছেদ বিরোধী এবং বনভূমি থেকে আদিবাসী উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলন ও প্রতিরোধ, সর্বোপরি ঋণ-মুক্তির আন্দোলন। এসত্ত্বেও প্যানডেমিকের এই সময়ে যে মাত্রায় ও বিস্তৃতিতে মানুষ বিপর্যস্ত, বিপন্ন এবং বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারগুলোর চরম ব্যর্থতার পাশাপাশি সরকার গৃহীত একের পর এক পদক্ষেপে শ্রেণীবৈষম্য দিনের আলোর স্পষ্টতা নিয়ে সামনে আসছে, সেসময় গ্রামীণ মেহনতিদের অগ্রণী সংগঠন হিসাবে দেশজুড়ে আয়ারলার উদ্যোগ আরও ব্যাপক হওয়া প্রত্যাশিত। গ্রাম ও আধাশহুরে এলাকার বিপন্ন মানুষ, মেহনতিদের সংগঠিত করতে, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে আমাদের দিক থেকে আরো অনেক বেশি উদ্যোগ প্রয়োজন।
রাজ্যে নিত্যদিন বেড়ে চলা স্বাস্থ্য সংকটকে ঘিরে রাজ্যবাসীর অশেষ দুর্গতি ও ভেঙে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৪ আগস্ট কলকাতা জেলা পার্টি কমিটির তরফ থেকে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম-এর সামনে এক বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হয়। পূর্ব ঘোষণা মতো পিজি কর্তৃপক্ষকে এক স্মারকলিপি দেওয়া হবে তা পুলিশ প্রশাসনকেও জানানো হয়। শ্লোগান, বিভিন্ন বক্তাদের বক্তব্য চলাকালীন ডেপুটি সুপার বিক্ষোভ স্থলে আসেন স্মারকলিপি গ্রহণ করতে। সেখানে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা কোভিড-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় নন-কোভিড রোগীরা প্রকৃত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, হাসপাতাল থেকে গুরুতর রোগাক্রান্ত রোগীদের ফেরানো হচ্ছে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
বিক্ষোভ চলাকালীন বক্তব্য রাখেন চন্দ্রাস্মিতা, আইসার কলকাতা জেলা সভাপতি অভিজিত, বাসুদেব বোস ও অন্যান্যরা।
এরপর এক্সাইড মোড় থেকে একটা গাঁজা পার্ক অবধি মিছিল হয়। বলিন্দ্র সাইকিয়ার বিরুদ্ধে সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, দেশব্যাপী যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী, প্রতিবাদী ছাত্র-কৃষক নেতা-অধ্যাপকদের মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের নিঃশর্তে মুক্তির দাবি তোলা হয় মিছিল থেকে।
বর্তমানে কেন্দ্রের মোদি সরকার দেশের স্বাধীনতা, সংবিধান ও নাগরিকের রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিপন্ন করে তুলেছে। দেশের সম্পদের উৎসগুলোকে বিদেশি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই স্বাধীনতা দিবসে আওয়াজ তোলা হয় দেশের সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, কর্পোরেট হটাও। মোদি-অমিত শাহ চক্র থেকে ভারতকে মুক্ত করো। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অসংখ্য শহীদদের শ্রদ্ধা জানান হয়।
বেলঘরিয়ার কর্মসূচীতে অংশ নেন রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ। জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণের পর তিনি সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
বর্ধমান জেলায় পূর্বস্থলীর মেড়তলা কালনা ২নং ব্লক, মেমারী ১নং ব্লক, মন্তেশ্বর, কাটেয়া ২নং ব্লক, রায়না ব্লক, পূর্বস্থলী ১নং ব্লক ও জামালপুর, শিলিগুড়ি, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘরিয়া, অশোকনগর এবং কলকাতার কয়েকটি স্পট সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কোথায় পার্টির নেতৃত্বে এককভাবে কোথাও অন্যান্য বামদলগুলির সাথে যৌথভাবে স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচী পালিত হয়। সর্বত্রই বর্তমান সময়ে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএসের হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্তর্বস্তু ও অর্জনকে পুনরুদ্ধারের আহ্বান রাখা হয়।
গত ১২ আগষ্ট উচ্চ বর্ণের প্রাধান্যকারী বন কমিটি বাঁকুড়া ব্লক২-এর কোষ্ঠিয়া অঞ্চলের খেমুয়া গ্রামের কাটাপেশিয়া মৌজার দীর্ঘদিন ধরে দখলিকৃত বনের জমিতে আদিবাসীদের চাষ করা ধান নষ্ট করে দেয়। এর বিরুদ্ধে লোকপুর রেঞ্জার অফিসে ডেপুটেশন সংঘটিত করা হয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের উদ্যোগে গড়ে তোলা গণ সংগঠন ‘আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’ এবং ‘সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি’-র ব্যানারে। দাবি (১) দীর্ঘদিন ধরে দখলিকৃত বনের জমিতে আদিবাসীদের বনপাট্টা নতুন করে দিতে হবে, (২) নষ্ট করা ফসলের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, (৩) বারমেসিয়া মৌজার বনের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারি বাউরি সম্প্রদায়ের মানুষদের বাস্তু পাট্টা দিতে হবে। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী।
ডেপুটেশন প্রতিনিধিদের রেঞ্জার বলেন, আগামী ২৩ আগস্ট উপরোক্ত সংগঠন, বন কমিটি, রেঞ্জার, বাঁকুড়া ব্লক-২ বিডিও, বেলিয়াতোড় থানা এবং আদিবাসী ও বনবাসীদের উপস্থিতিতে সমস্যার সমাধান করা হবে।
১৮ আগস্ট, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া : বিষ্ণুপুর মিউনিসিপালিটির সাফাইকর্মী ও জল বিভাগের কর্মীরা গত তিন-চার মাস কোনো বেতন পাননি। কিন্তু করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে তাঁরা অবিরত তাঁদের কাজ চালিয়ে গেছেন। গত ৭ আগস্ট তাঁরা নিজেদের কাজ বন্ধ রাখেন এবং এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলেন। মিউনিসিপালিটির কর্মীরা ওইদিন তাঁদের বকেয়া মজুরি মেটানোর দাবিতে প্রথমে মহকুমাশাসককে ডেপুটেশন দেন। মহকুমাশাসক তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পরদিন অর্থাৎ ৮ তারিখ থেকেই কাজে যোগ দেওয়ার কথা বলেন এবং কর্মীদের অসুবিধার প্রসঙ্গে তিনি জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দেন। এসডিও ডেপুটেশনের পর মিউনিসিপালিটির স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মীরা মিলিতভাবে এসডিও অফিস থেকে মিছিল করে আইসবাজার, চকবাজারের মোড় হয়ে মিউনিসিপালিটিতে গিয়ে শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে মিছিল শেষ করে। পরের দিন সকালে তাঁরা কাজে যোগ দিতে গিয়ে দেখে জরুরি-বিভাগগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কর্মীরা সেখানেই ধর্ণায় বসে পড়েন। এর ফলে পৌর কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। মিউনিসিপালিটির কর্মীরা বকেয়া মজুরি মেটানোর প্রশ্ন তুললেই উল্টো দিক থেকে কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়ার হুমকি আসে এবং কিছু বিদায়ী কাউন্সিলার কর্মীদের দিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, ফলত সুষ্ঠভাবে চলতে থাকা আলোচনা ব্যাহত হয়।
এই ঘটনার পর মহকুমাশাসককে ফোন করে সমস্ত ঘটনা জানানো হয়। এসডিও পৌর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন এবং তাঁদের যাতে কাউকেই কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া না হয়, আগামী দুসপ্তাহের মধ্যে তাঁদের বকেয়া মজুরি মিটিয়ে দেওয়া হবে এরকম আশ্বাসও দেন। এইসকল আশ্বাস পাওয়ার পর ৯ তারিখ থেকে কর্মীরা কাজে যোগ দেন।
ইতিমধ্যেই মিউনিসিপালিটির কর্মীরা এক মাসের বেতন পেয়েছেন এবং আগামী ১৮-১৯ তারিখের মধ্যে বাকি দু-তিন মাসের বেতন মিটিয়ে দেবার আশ্বাস দেন পৌর কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া মাসের বেতন মাসে মিটিয়ে দেওয়া, মজুরি বৃদ্ধি করা ও অস্থায়ী কর্মীদের কাজের স্থায়ীকরণ, এবং সমস্ত কর্মীদের পিএফ চালু করা ও পেনশন সংক্রান্ত অন্যান্য সুবিধাগুলি পাওয়ার লক্ষ্যে আগামীতে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে সাফাইকর্মীরা বৃহত্তর লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করবে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
– তিতাস গুপ্ত
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন সারা পৃথিবী উত্তাল, অর্থাৎ এই করোনা অতিমারি যখন নিজের থাবা বসাচ্ছে মানুষের জীবনে, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, সারা দেশ জুড়ে ঘটে চলছে দুর্নীতি। যেখানে দেশের সাধারণ মানুষের রুজিরুটি প্রশ্নের মুখে, সেখানে দেশের শাসক দল ব্যস্ত কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাম মন্দির বানাতে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, রাজ্যের নেতামন্ত্রীরা তখন ব্যস্ত সাধারণ মানুষের অধিকারের রেশনটুকু আত্মসাতের খেলায়। এমতাবস্থায় বালির বুকে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলছে ছাত্রছাত্রীদের লড়াকু সংগঠন আইসা। বালির ৫৪নং ওয়ার্ডের নগর এলাকায় একটি বাড়িতে গত পরশু কোভিড আক্রান্ত হন এক ব্যক্তি। আইসার সাথে যোগাযোগ করার পরে আইসার ‘বালি কোভিড ভলেন্টিয়ার টীম’-এর পক্ষ থেকে এলাকা স্যানিটাইজেশনের কাজ করা হয় ও আশ্বাস দেওয়া হয় যে কোনো প্রয়োজনে পাশে থাকার।
-- অঙ্কিত মজুমদার
পশ্চিমবঙ্গ মিড-ডে-মিল (রন্ধনকর্মী) ইউনিয়ন দক্ষিণ কলকাতার রামগড়ে সংগঠিত করল এক প্রতিবাদী সভা। রামগড় কমিউনিটি হলে আয়োজিত এই সভায় মিডডেমিল কর্মীরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন তাদের ঘরের পরিজনেরা, যারা পরিবেশন করলেন সঙ্গীত-আবৃত্তি-নৃত্য। বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন অতনু চক্রবর্তী, ইন্দ্রাণী দত্ত, নিত্যানন্দ ঘোষ। শোভনা নাথ আবৃত্তি পরিবেশনার সাথে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। নীতীশ রায়ের পরিচালনায় পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে গণসংগীত পরিবেশন করা হয়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও শারীরিক দূরত্ব মেনে সামাজিক দায়িত্ব পালনের কথা মাথায় রেখে সভায় সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উদ্যোক্তারা উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান।
রাজনাথ সিং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকার সময় ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মীদের জন্য চালু করেন তদন্তে নৈপুণ্য দেখানোর পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রবর্তনের উদ্দেশ্য রূপে বলা হয় “অপরাধের তদন্তে পেশাদারিত্বের উচ্চ মানকে উৎসাহিত করা।” এবারের, অর্থাৎ ২০২০ সালের জন্য এই পুরস্কারের প্রাপক রূপে গত ১২ আগস্ট ঘোষণা করা হয় ১২১ জন পুলিশ কর্মীর নাম। এঁরা হলেন বিভিন্ন রাজ্যের এবং সিবিআই, এনআইএ-র মত অপরাধের তদন্তে নিয়োজিত সংস্থার কর্মী। এই ১২১ জনের মধ্যে এমন কয়েক জনের নাম রয়েছে যাঁদের তদন্তের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং অভিযোগ, তদন্তে উৎকর্ষের স্বাক্ষর রাখার চেয়ে তদন্তকে বিপথগামী করতেই তাঁরা সচেষ্ট থেকেছেন।
এঁদের একজন হলেন দিল্লী পুলিশের ডেপুটি কমিশনার রাজেশ দেও যিনি কয়েক মাস আগে ঘটা দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তদন্তে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) প্রধান। উল্লেখ্য, দিল্লীর দাঙ্গায় কম করে ৫৩ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন যাঁদের ব্যাপক সংখ্যাধিকই হলেন মুসলিম। দিল্লী দাঙ্গার তদন্ত নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। যাঁরা প্রকৃতই দিল্লীর দাঙ্গাকে উস্কিয়ে তুললেন, উত্তেজনাকর ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভরা ভাষণ দিয়ে দাঙ্গার আগুন জ্বালালেন, সিট-এর তদন্তে তাদের আড়াল করে বেছে-বেছে মুসলিমদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-র মত দানবীয় আইন প্রয়োগ করে জেলে পোরা হচ্ছে। এই চক্রান্তকে সম্প্রসারিত করে আরো অনেক নিরপরাধ মানুষকে দাঙ্গায় জড়িত বলে ফাঁসানোর অভিসন্ধি সচল রয়েছে।
অনেকেই বলেছেন যে, দিল্লী দাঙ্গা নিয়ে সংখ্যালঘু কমিশনের রিপোর্টে যেখানে দাঙ্গার মূল প্ররোচনাকারী হিসাবে অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, কপিল মিশ্রর মতো বিজেপি নেতাদের নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেখানে সিট-এর তদন্ত দাঙ্গার সংঘটনে এদের কোনো ভূমিকাই দেখতে পায়নি। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকে পুলিশবাহিনী গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ছাত্র-ছাত্রীদের যে নির্মম প্রহার করে তার তদন্তের ভারও দেওয়া হয় রাজেশ দেওকে। লাঠিধারি পুলিশরা ছাত্রদের বেধড়ক পেটাচ্ছে, ছাত্রীরাও তাদের নির্মমতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না, এই ছবি সংবাদ মাধ্যমে ভাইরাল হলেও রাজেশ দেওর তদন্তে একজন পুলিশ কর্মীও দোষী সাব্যস্ত হয়নি।
রাজেশ দেও আর এক কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন ফেব্রুয়ারী মাসের দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের সময়। শাহিন বাগে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। একদিন জনৈক ব্যক্তি সেখানে শূন্যে গুলি চালান। দেও ভিত্তিহীনভাবে বলে দেন যে ওই ব্যক্তি আপ দলের সঙ্গে যুক্ত। দেওর এই মন্তব্যের জন্য নির্বাচন কমিশন তাঁকে দিল্লী নির্বাচনের কাজ থেকে সরিয়ে দেয়। নির্বাচন কমিশন বলে--দেওর এই মন্তব্য “পরিচ্ছন্ন ও অবাধ” নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করবে। দেও নির্বাচনে বিজেপির হয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ তখন উঠেছিল।
এই পুরস্কারের আর এক প্রাপক হলেন বিক্রম মুকুন্দ খালাতে। ইনি তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট যাঁর ওপর রয়েছে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারীর ভীমা-কোরেগাঁওয়ের হিংসাশ্রয়ী ঘটনার তদন্তের ভার। প্রসঙ্গত, ভীমা কোরেগাঁও ঘটনার তদন্ত পুনে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয়। সে সময় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফ্রন্ট লাইন ডিফেণ্ডারস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল – এই হস্তান্তরের উদ্দেশ্য হল ঘটনার স্বাধীন তদন্তকে ব্যাহত করা, ঘটনার রাজনৈতিক আখ্যানকে নিয়ন্ত্রিত করা। আর তা হতে গেলে কোনো বশংবাদ পুলিশ অফিসারই অভিপ্রেত ভূমিকায় অবদান রাখতে পারেন। ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনায় হিংসার মূল সংঘটক রূপে, দলিতদের ওপর হামলার প্রধান চক্রীরূপে সামনে এসেছিল হিন্দুত্ববাদী সম্ভাজি ভিদে ও মিলিন্দ একবোটের নাম। বিক্রম মুকুন্দ খালাতের তদন্তে কিন্তু এই দুজন হিন্দুত্ববাদীর হিংসার ঘটনায় জড়িত থাকার কোনো উল্লেখ নেই, ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়েরও হয়নি। বিপরীতে, বেছে-বেছে অভিযুক্ত করে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে জেলে পোরা হয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মীকে, যে ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আর এনআইএ গ্ৰেপ্তার হওয়া মানবাধিকার কর্মীদের জামিনের লাগাতার বিরোধিতা করে চলেছে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলা বিরোধী কন্ঠস্বরকে দমন করা এবং সরকারের সমালোচক ব্যক্তিত্বদের আক্রমণের নিশানা বানানোর বিজেপির দুরভিসন্ধিরূপেই অভিহিত হয়ে থাকে।
তদন্তে উৎকর্ষের নিদর্শন রাখার জন্য পুরস্কারের আর এক প্রাপক হলেন মহারাষ্ট্রের পুলিশ অফিসার শিবাজি পাওয়ার। ইনি ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বরের এলগার পরিষদের সভা নিয়ে (বিজেপি ও পুলিশের মতে এই সভাই নাকি ভীমা-কোরেগাঁও-এর হিংসাত্মক ঘটনার জন্য দায়ী) তদন্ত করেন। ভীমা-কোরেগাঁওয়ের ঘটনার তদন্ত সে সময় পুনে পুলিশই করেছিল, আর তখন মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। শিবাজি পাওয়ার যে চার্জশিট দেন তাতে অভিযোগ করা হয় – সমাজ আন্দোলনের বামঝোঁকা কর্মীরা মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিংসা উস্কিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই তদন্ত চলার সময়ই “শহুরে নকশাল” অভিধা চালু হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর মন্ত্রকই এই পুরস্কার প্রাপকদের চিহ্নিত করেছে। তাদের নাম ঘোষণার পর অমিত শাহ পুলিশ কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়ে একটি টুইট করে বলেন — “ন্যায় বিচার প্রদানে এক পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। … এটা আমাদের পুলিশ কর্মীদের অসাধারণ সেবা ও অঙ্গীকারের স্বীকৃতি। ভারত তাদের জন্য গর্বিত!”
যে ১২১ জন পুরস্কার প্রাপককে বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বোধকরি এমন কেউ-কেউ রয়েছেন যাঁরা কর্মক্ষেত্রে সত্যিই কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু যে তিন জনের কথা ওপরে উল্লেখ করা হল তাঁরা এক ভিন্ন গোত্রের। নিজেদের কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ার চেয়ে (যেটার মধ্যে দিয়েই দেশের সেবা সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায়) বিজেপির দুরভিসন্ধিকে চরিতার্থ করতেই তাঁরা সচেষ্ট থেকেছেন বলে সুস্পষ্ট হয়েছে। সঠিক বিচারে এঁদের কাজ দেশের ও জনগণের স্বার্থের সহায়ক হওয়ার বিপরীতে চরম অনিষ্টেরই পরিচায়ক। আজ দেশজুড়ে স্বৈরাচার কায়েমের যে আয়োজন পুরোদমে চলছে, এঁদের কাজ সেই প্রক্রিয়ায় ইন্ধনই জোগাচ্ছে। এই পুরস্কার প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য যে বিজেপি অনুগত পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা তা একেবারেই স্বচ্ছ। এই ধরনের পুলিশ কর্মীদের পুরস্কৃত করে অন্যান্য পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের কাছে এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে যে – প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, বিজেপি যেমন চায় তদন্তের ফলাফল তেমন হলে তাদের বিজেপি-সেবা স্বীকৃতি পাবে এবং পুরস্কার থেকেও তারা বঞ্চিত হবে না!
-- জয়দীপ মিত্র
ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল নামে এক মার্কিনী পত্রিকায় নিউলি পার্নেল এবং জেফ হরউইতজ নামক দুই সাংবাদিক ফেসবুক-বিজেপি আঁতাত নিয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে।
ফেসবুক একটি ইন্টারনেট গণমাধ্যম যেখানে আপনি বৃহত্তর সমাজের সাথে আলাপচারিতা করতে পারেন বা বন্ধু বান্ধবদের সাথে খোশগল্পও করতে পারেন। শুনে খুব নিরীহ একটি জিনিস মনে হলেও এটি সারা বিশ্বের গণতন্ত্রগুলির বিরুদ্ধে একটি বিপজ্জনক সংস্থা হয়ে উঠেছে। ওয়াটসঅ্যাপ আর ইন্সটাগ্রামও এই সংস্থার দ্বারা পরিচালিত।
ফেসবুকে আমি-আপনি যেসব নিজস্ব ফটো বা লেখা “শেয়ার” করি বা মেসেজ অথবা অন্যের ছবি বা লেখায় লাইক কমেন্টগুলো করি সেই তথ্যগুলো ফেসবুকের বাণিজ্যের কাঁচামাল। ফেসবুক এই কাঁচামাল সংগ্রহ করার জন্য মানুষকে নিজেদের পরিষেবা বিনামূল্যে ব্যবহার করতে দেয়। যখন একজন মানুষের সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে তথ্য জোগাড় হয়ে যায়, তখন সে সেটিকে ব্যবহার করে।
কিভাবে ব্যবহার করে? ভাবুন ফেসবুক একটা সমাজ। সেই সমাজের নিয়মকানুন ফেসবুক কোম্পানির মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। তারা আমাদের দেওয়া তথ্য যাচাই করে বুঝে ফেলছে যে জনতা কী ভাবছে, কি করছে, কী চাইছে। এবার একটি কোম্পানি আসছে ফেসবুকের কাছে। তারা জানতে চায় যে ঠিক কারা কারা তার পণ্য কিনতে পারে এবং তাদেরকেই সে তার বিজ্ঞাপন দেখাতে চায়। ফেসবুক সেই কোম্পানির কাছ থেকে পয়সা নিয়ে তাদেরকে জনতার তথ্য দেখায়। যে যত বেশি টাকা দেবে ফেসবুক তাদেরকে তত বেশি জনতার কাছে পৌঁছে দেবে।
ফেসবুকের নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন আছে যেগুলো কেউ অমান্য করলে তাকে ফেসবুক থেকে বিতাড়িত করা হবে। তার মধ্যে একটি হল কেউ যদি হিংসা, উসকানিমূলক কথা বলে তাহলে তা সহ্য করা হবে না।
অসুবিধে তখন শুরু হয় যখন কোম্পানির বদলে রাজনৈতিক পার্টিগুলি ফেসবুকের প্রধান ক্রেতা হয়ে উঠল। তারা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এবং আরো বিভিন্ন ধরনের সাংঠনিক আর আর্থিক শক্তি লাগিয়ে ভোটারদের ভাবনাচিন্তার দখল নিতে শুরু করল।
ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের খবরে উঠে এসেছে যে টি রাজা সিং বলে তেলেঙ্গানার বিজেপি এমপি বার বার ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কথা বলেছে। ফেসবুকের কর্মচারিরা টি রাজা সিং কে বিপজ্জনক ঘোষণা করলেও ফেসবুকের ভারতের একজন উচ্চপদস্থ ম্যানেজার, আঁখি দাস অভ্যন্তরীণ মিটিংএ বলছেন যে বিজেপির রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে ভারতে ফেসবুকের বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। এই মিটিঙের পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি টি রাজা সিং এর ওপর। এই দুই রিপোর্টার খোঁজ খবর করা শুরু করার পর পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এই খবর প্রকাশ পাওয়ার পর পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বিজেপির সাথে বানিজ্যিক সম্পর্কের কারণে ফেসবুক সমাজের সুরক্ষাকেও অগ্রাধিকার দিতে রাজি নয়। ফেসবুক বিজেপিকে তার তৈরি করা এই গণমাধ্যমে আধিপত্য স্থাপন করতে সাহায্য করছে। তার বদলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ভাবে ফেসবুককে সুবিধা দিয়েছে, যেমন “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” প্রচারে মোদী সমস্ত সরকারী সংস্থা, মন্ত্রী, আমলাদের বলেন ফেসবুকে প্রোফাইল খুলতে। এই সরকারি মদত ফেসবুককে ভারতে আলাদাই জায়গা দিয়েছে।
বিজেপির সঙ্গে ফেসবুকের সম্পর্কের একটু ইতিহাস ঘাটা যাক।
ভারতের ৩২ কোটি মানুষ আজকের দিনে ফেসবুকের সদস্য। ভোটে প্রচারে ফেসবুক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। তার ওপর ওয়াটস অ্যাপ আর ইন্সটাগ্রামও আছে। প্রথম খটকা লাগা শুরু হয় যখন ফেসবুকে বিভিন্ন বিজেপি বিরোধী খবর প্রকাশ করতে অসুবিধেয় পড়তে শুরু করে। ফেসবুককে টাকা দেওয়া সত্ত্বেও তারা সেই সব খবর বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে দেরী করে। বিজেপি-বিরোধী কথা লেখার জন্য এরমনকি রিপোর্টারদের প্রোফাইল বন্ধ হয়ে যায়।
সিরিল স্যাম আর পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার তদন্তের পর জানা যায় যে শিবনাথ ঠুকরাল নামে ফেসবুকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারি, তিনি ২০১৪’র আগে মোদীর ভোটের প্রচারে কাজ করতেন। তিনি যেসব ওয়েবসাইটের সাথে যুক্ত ছিলেন তা ২০১৪-র আগে বিভিন্ন ভুল খবর বাজারে ছড়াত মানুষের কাছে মোদীর ইমেজ ভাল করার জন্যে। আঁখি দাশের বোনও আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপির সদস্য। তিনি নিজেও যে বিজেপির অত্যন্ত ঘনিষ্ট তা সাংবাদিক মহলে অজানা নয়।
এও জানা গেছে যে বিজেপি আইটি সেলকে ফেসবুকের কর্মচারীরা নিজেরা প্রশিক্ষণ দিয়েছে কিভাবে ফেসবুককে তারা আরো ভাল ভাবে ব্যবহার করতে পারে। এর আগে এই তথ্য সামনে এসেছে যে ফেসবুকে জনতার তথ্য ব্যবহার করে বুথ লেভেল পর্যন্ত ভোটারের মানসিকতা বুঝে ফেলা সম্ভব এবং তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তার প্রচার চালায়। জনতার ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুক যে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছে না এটা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে।
ভুল ও উসকানিমূলক খবর ওয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুকের মাধ্যমে তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে দিয়ে কিভাবে সমাজের মানসিকতাকে বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা আজ অনেকের কাছেই পরিষ্কার। মায়ানমারে এই সব মাধ্যম ব্যবহার করে রোহিঙ্গা-গণহত্যা সংগঠিত হয়। শ্রীলঙ্কায় দাঙ্গা হওয়ার পরে সেখানকার সরকার ফেসবুক ব্যান করতে বাধ্য হয়। ভারতে এর বীজ বপন শুরু হয় ২০১৪-র আগে মোদীর ভোটের প্রচারের সময়। ২০১৯’এ আরো কার্যকর হয় বিজেপি-ফেসবুক-বড়পুঁজি আঁতাত।
আজকের ভারতে বিজেপি-আরএসএস-বড় পুঁজি জোট ভারতের গণতন্ত্রকে গভীর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুধু ভারতে নয় পুরো বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে ফ্যাসিবাদ-পুঁজিবাদ-সোশাল মিডিয়ার মারক মিশ্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
-- প্রত্যুষ নন্দী
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ একটি প্রেস বিবৃতিতে ভারতের ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের সঙ্কট এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্রমাগত অবনতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায় যে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ভারত ২০১৯ সালের অবস্থান থেকে ২ ধাপ পিছিয়ে ২০২০ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২তম স্থানে নেমে গেছে। আরও অন্যান্য কারণের সাথে জম্মু ও কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা রদ করার পর সেখানে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, অধিকারকর্মীদের উপর দমন-পীড়ন এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ভারতের বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ক্রমাবনতি হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট সম্প্রতি কাশ্মীরকে গণমাধ্যমের জন্য ‘বিশ্বের সবচেয়ে দমনকারী জায়গা’ বলে অভিহিত করেছে।
বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন: ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো একটি গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি। নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯ (সিএএ) ভারতের সংবিধানের মূলভিত্তি ও চেতনার পরিপন্থী। ভারতীয় সংবিধানের ৫ থেকে ১১ অনুচ্ছেদে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি ও সংস্কৃতির ভিন্নতা নির্বিশেষে সাধারণ নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু, সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “রাষ্ট্র সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার অস্বীকার করবে না। এতে জোর দেওয়া হয়েছে যে ১৪ অনুচ্ছেদ কেবল নাগরিকদের জন্যই নয়, ‘ভারতের ভূখণ্ডের সমস্ত ব্যক্তির জন্য’ প্রযোজ্য”।
ফারুখ ফয়সল আরও বলেন, “ভারতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। প্রতিবাদ সমাবেশ আন্দোলনের খবর প্রকাশ অথবা প্রচার করার জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপি সমর্থক এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা সাংবাদিকদের উপর হামলা করছে। ভিন্নমত পোষণকারীদের দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে দমন করা হচ্ছে। আইনের শাসনের অভাব, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, বাক-স্বাধীনতার চর্চাকারীদের উপর আঘাত, ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে”।
সাংবাদিকদের হত্যা, তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং হয়রানির প্রতিবিধান না করা বা দোষীদের বিচারের আওতায় না আনার উপর নির্ভর করে তৈরি সূচক অনুযায়ী ভারত বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে ১৩তম স্থানে চলে এসেছে। নারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় ভারত হল তৃতীয় সর্বোচ্চ দেশ। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা, কর্মপরিকল্পনায় অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে সাংবাদিকসহ যারাই কথা বলছেন তারাই হামলা-মামলা এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সিএএ এবং নাগরিক নিবন্ধন পঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের প্রবণতা দেখা গেছে। বিশেষত জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হামলা, গুলি, যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এই বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মুসলিম পাড়া-মহল্লায় হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত এবং শত শত আহত হয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতায় গর্বিত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া (জেএমআই) বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সফুরা জারগারকে সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী আন্দোলন করার কারণে সন্ত্রাস-বিরোধী আইন এবং বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ আইন ২০১৯-এর (ইউএপিএ) অধীনে মামলা দিয়ে গর্ভাবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং বারবার তার জামিন নাকচ হয়ে যায়। মানবাধিকার সংস্থা, সুশীল সমাজ এবং অধিকারকর্মীদের কয়েক মাসের আন্দোলনের পর অবশেষে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত যেখানে ভারতে প্রতিবাদ এবং মতপ্রকাশের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সেখানে একজন সন্তান সম্ভবা মাকে করোনার মধ্যে গ্রেপ্তার এবং আটক করা হয়েছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কঠোর এবং বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞাগুলি আরোপ অব্যাহত রেখেছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদে প্রদেশটিকে আধা-স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিলো। আইন করে এই অধিকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে। এরপর অঞ্চলটিতে ব্যাপক সামরিকীকরণ, ল্যান্ডলাইন, ব্রডব্যান্ড, মোবাইল ফোন, রোড ব্লক এবং পরিবহন পরিষেবা স্থগিতের ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ পুরো পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জম্মু ও কাশ্মীরে সাংবাদিকদের হয়রানি এবং হুমকি অব্যাহত রয়েছে এবং নতুন মিডিয়া নীতিমালা ২০২০-এর মাধ্যমে সেখানে সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয়েছে।
বিবৃতিটিতে ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ ভারত সরকারকে ধর্মনিরপেক্ষতা, আইনের শাসন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যে কোনো লঙ্ঘনের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
আলো আঁধারিতে সময়ের এক অদ্ভুত সুড়ঙ্গ পেরোচ্ছি আমরা। কোভিড সংক্রমণের বলি একান্ত প্রিয়জনকে শেষ দেখার উপায়টুকুও হয়তো থাকছে না। যাঁর প্রাণরসে পুষ্ট হওয়া কিংবা যার হাতে হাত রেখে জীবনের বহু চড়াই উতরাই পেরোনো, বা ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনে যার সঙ্গে মিছিলে পা মেলানো, উদ্দাম বিতর্কে জড়িয়ে পড়া — সেই সব প্রিয়জন! এটা আজ এক বেদনাদায়ক অনিবার্যতা।
কিন্তু স্বঘোষিত এক ‘সেরা’ হাসপাতালে এসে অ্যাম্বুল্যান্সে শায়িতা গর্ভধারিণীকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যেতে দেখা? ৮০,০০০ টাকা দিয়ে কয়েক ঘন্টা আগে বেড বুক করার পরেও? এটাও কি অনিবার্যতা?
হ্যাঁ, তমলুকের নাজিম খানের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তাই-ই। ভর্তির মুহূর্তেই তিন লক্ষ টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না — এটা জানিয়ে পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলেন। তাতেও অনড় কর্তৃপক্ষের নির্বিকার জবাব ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’! অনন্যোপায় নাজিম আবু ধাবিতে কর্মরত দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও দু'লক্ষ টাকা জমা করেন হাসপাতালের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। তাতেও হয়নি। হোয়াটস অ্যাপে সেই লেনদেনের ছবি দেখাতে বলা হয়। এরপর চিকিৎসক এসে অ্যাম্বুল্যান্সে শোয়ানো লায়লা বিবিকে যখন সিপিআর দেন — তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ। কল্লোলিনী তিলোত্তমা সাক্ষী রইলো এক জঘন্য অপরাধের। শুধু তাই নয় — এক নির্মম বাস্তবতার!
স্বাস্থ্য দপ্তরের কড়া হুঁশিয়ারি ছিল — কোভিড রোগীকে ফেরানো যাবে না। স্বাস্থ্য কমিশনের নির্দেশ রয়েছে — কোভিড-রোগী ভর্তির সময় ৫০,০০০ টাকার (চিকিৎসার আনুমানিক খরচের ২০%) বেশি নেওয়া যাবেনা। ভর্তির সময় টাকা না থাকলে, অন্তত ১২ঘন্টা রোগীকে পরিষেবা দিতে হবে। রোগীকে চিকিৎসার মাধ্যমে স্থিতিশীল করে তবে অন্যত্র পাঠানো যাবে। এসব নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলেছে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসা, যেখানে চিকিৎসা একটা মহার্ঘ পণ্য মাত্র।
নাজিম খান এসেছিলেন অনেক আশা নিয়ে — কোভিড আক্রান্ত মা-কে সেরা চিকিৎসায় বাঁচিয়ে তুলতে। ফিরে গেলেন মাকে হারিয়ে লাঞ্ছিত, অপমানিত, বিপর্যস্ত হয়ে। টাকা তো গেছেই। কিছুই জানা ছিল না তার। সরকারি হেল্পলাইনও নয়। শুভানুধ্যায়ীদের কথায় এসেছিলেন, ‘পূর্ব ভারতের সেরা দশটি হাসপাতালের অন্যতম’ একটিতে। ডিসান হসপিটাল অ্যান্ড হার্ট ইন্সটিটিউট-এ। ২০০৮-এ যাত্রা শুরুর তিন বছরের মধ্যে যার মিলেছে এনএবিএইচ এবং তারপর এনএবিএল স্বীকৃতি। দশ তলা সুউচ্চ সৌধের দম্ভও অভ্রংলিহ! অত্যাধুনিক পরিকাঠামো, ‘বিশ্বমানের পরিষেবা’, শুধু নাকি ধনীদের জন্যই নয়, ‘গরিব এবং সাধারণ মধ্যবিত্তের’ জন্যও! এই কথাগুলো বোধ হয় সরকারি স্বীকৃতি শংসাপত্রগুলো হাতিয়ে নেওয়ার জন্যেই বলতে হয় — আসলে শুধুই কথার কথা! নাজিম অন্তত তাই-ই জেনে গেলেন! নিশ্চয়ই আরো অনেক ভুক্তভোগীই ইতিমধ্যে জেনেছেন।
শুধু তো ডিসান নয়, কলকাতায় বেসরকারি ২৬টি কোভিড হাসপাতালের মধ্যে আরও কয়েকটির নামও উঠে এসেছে। কোভিড আক্রান্তের চিকিৎসায় অস্বাভাবিক বিল করা, টাকা আদায়ের জন্য রোগীর পরিজনদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহারের অভিযোগে। দিনকয়েক আগে শহরের আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে (মেডিকা) শ্যামনগরের দরদী এক কোভিড আক্রান্ত চিকিৎসক প্রদীপকুমার ভট্টাচার্য প্রয়াত হয়েছেন। চিকিৎসার বিল হয়েছিল ১৮ লক্ষের বেশি। স্থানীয় অনেক সংগঠন বিল কমানোর অনুরোধ জানায়। ব্যতিক্রমী এই চিকিৎসকের পরিবারের পাশে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন বহু মানুষ তাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর চিকিৎসাধন্য হতদরিদ্র মানুষজন। অবশেষে স্বাস্থ্য কমিশনের হস্তক্ষেপে বিল কিছুটা কমে। তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। বেসরকারী এই স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা এতটা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পায় কেন? সরকারের নির্দেশগুলোও কি নেহাতই কথার কথা? কেন উপযুক্ত নজরদারি নেই? অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেই? ‘কেন নেই’ সকলেই জানেন। আইন প্রশাসন বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী সকলের আনুকূল্যেই ব্যবসা এমন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণের হাওয়ায় বাইপাসের ধারে গজিয়ে উঠেছিল বেসরকারী চিকিৎসা ‘হাব’। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে উঠে আজ তা মহীরূহ — নাগালের বাইরে চলে গেছে।
নাজিম ডিসান হাসপাতালের বিরুদ্ধে আনন্দপুর থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য কমিশনও মামলা রুজু করেছে। আমরা চাই এই খুনীদের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি হোক। মুখরক্ষার জন্য শুধু দু’একজন কর্মচারিকে বরখাস্ত বা হাজতবাস করিয়ে কর্তৃপক্ষ যেন পার না পায়! কর্মচারিরা তাদের আজ্ঞাবহ মাত্র। সমস্ত সরকারী স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হোক। এবার অন্তত সরকার সতর্ক হোক যাতে লায়লা বিবির মতো আর কাউকে এইভাবে হারাতে না হয়!
কিন্তু তারপরেও কথা থাকে। গরিব এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য সুলভ চিকিৎসা মিলতে পারে একমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরকারি হাসপাতালে, যদি সত্যিই সরকারের সেই সদিচ্ছা থাকে। সেই সদিচ্ছাটুকু আছে কিনা এটাও একটা প্রশ্ন!
– জয়ন্তী দাশগুপ্ত
জি নিউজ চ্যানেল সম্পর্কে কম-বেশি ধারণা আমাদের সবারই আছে। এসেল গোষ্ঠীর নামে পঞ্জীকৃত একটি সংস্থা জি চ্যানেলের মালিক। এসেল গোষ্ঠীর কর্ণধার হল সুভাষ চন্দ্র। এই সুভাষ চন্দ্র বিজেপির সদস্য, এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এসব হলো পোশাকি পরিচয়। আজ সারা দেশে জি নিউজ চ্যানেল বিজেপির মুখপত্র বলেই পরিচিত। সরকারের তাবেদারী করতে যাবতীয় ভুয়ো খবর, অপ্রাণিত তথ্য, এমনকি মনগড়া গল্পকেও খবরের নামে চালায় জি নিউজ। এক কথায় জি হলো তথাকথিত ‘গোদি মিডিয়ার’ পোস্টার বয়।
আজকাল, জি গোষ্ঠী, সেই একই এসেল গোষ্ঠির মালিকানায় নতুন ওয়েবস্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম (OTT) শুরু করেছে। তার নাম জি-ফাইভ। এই প্লাটফর্মে ‘অভয়’ নামে একটি সিরিজ চলছে কিছুদিন ধরে। এটা একটা ক্রাইম ড্রামা। সিরিজের গুণমান নিয়ে না হয় অন্য কোথাও মন্তব্য করা যাবে। কয়েকদিন আগে, এই সিরিজের দ্বিতীয় সিজন শুরু হয়। এই নতুন সিজনের দ্বিতীয় এপিসোডের একটি দৃশ্যে দেখা যায় যে সিরিজের প্রোটাগোনিস্ট পুলিশ অফিসার থানায় এক সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। দৃশ্যের এক কোণে সেই থানার ক্রিমিনাল ডিসপ্লে বোর্ড। সেই বোর্ডে সেই থানার আয়ত্তাধীন এলাকার নানাবিধ পলাতক অপরাধীদের ছবি। সেই ছবিগুলির মধ্যে একটি ছবি হলো শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরাম বসুর। মানে, একজন শহীদকে ঠাঁই দেওয়া হল দাগি আসামিদের সাথে! এই দৃশ্য নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আপত্তি উঠতে শুরু করে। নেটনাগরিকরা জোরালো ভাষায় এর প্রতিবাদ জানান। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এক, একটা সিরিজ যখন তৈরি হয়, তখন কোনো একক ব্যক্তি সেটা করেন না। একটা বড়-সড় দল লাগে একটা প্রোডাকশন সামলাতে! সেই দলের কারুরই কি চোখে পলড়লো না বা মনে দাগ কাটলো না এই কাণ্ডটা!
বিক্ষোভ প্রবল হলে, চ্যানেলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। নিজের বয়ানে চ্যানেলের তরফ থেকে বলা হয় যে ‘কোনো ব্যক্তি ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের ভাবাবেগ কে আহত করার উদ্দেশ্য তার ছিল না দর্শকদের অভিমতকে মাথায় রেখে ওই বিশেষ দৃশ্যকে ঝাপসা করে দেওয়া হবে।’
ধৃষ্টতার মাত্রাটা ভেবে দেখুন। জি ফাইভ মনে করে যে ক্ষুদিরামের দৃশ্য ব্যবহার তা কোনো এক বিশেষ সম্প্রদায়ের (পড়ুন বাঙালি) ভাবাবেগ কে আহত করেছে। ক্ষুদিরাম কি কোনো সম্প্রদায় বিশেষের স্বাধীনতার জন্যে আত্মত্যাগ করেছিলেন! কতটা ইতিহাস বিদ্বেষী হলে কেউ এই কথাটা বলতে পারে। আসলে সমস্যাটা মানসিকতার। সম্প্রদায় আর সাম্রদায়িকতার বাইরে আমাদের দেশের কিছু লোক কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। আর জি চ্যানেল সেরকম লোকেই ভরা।
এবার আসা যাক ‘ভাবাবেগের’ প্রশ্নে। এটা আরো সমস্যাজনক। ক্ষুদিরাম তথা সকল শহীদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী আমাদের ইতিহাসের অংশ। কোনো পৌরাণিক কাহিনীর অলীক চরিত্র নন তাঁরা। তাঁদের সাথে আমাদের সম্পর্ক অন্ধ ভক্তির নয়, শ্রদ্ধার, ভালোবাসার। আমরা তাদের কাছ থেকে শিখি, তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করি, অনেক সময়ে বিতর্কও করি। আর এটাই বোধ হয় ইতিহাস বোধ আর পৌরাণিক আস্থার মধ্যে সবচেয়ে বড় ফারাক। তাই বিজেপির চেলা আরএসএস এর টেনিয়া জি ফাইভ যেটা করেছে সেটা ইতিহাস বিকৃতি, ভাবাবেগে আঘাত নয়! আর ইতিহাস বিকৃতিতে ওদের যে জুড়ি নেই! আসলে কি বলুন তো? আরএসএস হলো এদেশের একমাত্র রাজনৈতিক ঘরানা, যাদের কোনো শহীদ নেই। এহেন লোকজনের দেশপ্রেমী শহীদকে চিনতে ভুল হওয়ার কারণটা অজানা নয়।
-- বিস্ময় বসু
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭ আগস্টকে ‘ন্যাশনাল হ্যান্ডলুম ডে (জাতীয় হস্তচালিত তাঁত দিবস)’ ঘোষণা করেন। স্বদেশী আন্দোলনের স্মরণে হ্যান্ডলুমের ঐতিহ্য এবং বৈশিষ্ট্য ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখার জন্যেই নাকি এই দিনটির ঘোষণা। বাস্তবে তাঁত শিল্পকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ‘স্পেশাল’ করার ফলে তাঁতিদের কী উপকার হল সে কথায় পরে আসছি, তবে প্রত্যেক বছর এই দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড হয় হ্যান্ডলুম শাড়ি পরে ছবিসহ “আমাদের ঐতিহ্যকে টিঁকিয়ে রাখতে হবে” লিখে স্ট্যাটাস মেসেজ। না, কারোর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করায় কোনও আপত্তি নেই! কিন্তু হ্যান্ডলুম কি শুধুই ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ হয়ে থেকে যাবে?
অনেকেই হয়তো জানেন না, ২৭ জুলাই এবং ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্সের’ যুক্তি দেখিয়ে অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড, এবং অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্রাফট বোর্ড দুটোকেই বাতিল ঘোষণা করেছে! এর ফলে থমকে গেল এই দুটি বোর্ডকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের ভবিষ্যৎ। ৭ই আগস্ট ‘হ্যান্ডলুম ডে’ উপলক্ষ্যে টেক্সটাইল মিনিস্টার স্মৃতি ইরানি হ্যান্ডলুমের শাড়ি এবং কাপড়ের তৈরি মাস্ক পরে নিজের দুটি ছবি টুইট করে মোদীর সুরেই ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর ডাক দিয়ে বলেছেন “হ্যান্ডলুম আমাদের প্রতিদিনের জীবন ও আশপাশের পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। পোশাক থেকে ফার্নিশিং কিংবা মুখোশ... বাড়িতে নিয়ে আসুন একটুকরো হাতে তৈরি ভারত”৷ আর তার এই ‘দরদী’ পোস্ট দেখে সেলিব্রিটিরাও সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যান্ডলুমের শাড়ি পরে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট দিতে শুরু করলেন। কেউ টেক্সটাইল মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন না “আচ্ছা তাহলে এই বোর্ডগুলিকে বাতিল করলেন কেন?”
তাই আসুন, বাস্তবটাকে একটু জানি ...
হ্যান্ডলুম এবং হস্তশিল্প প্রায় ৩২ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহের একটি উৎস, তাদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র পশ্চাৎপদ, তফসিলি উপজাতি, তপশিলী জাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এবং বেশিরভাগই মহিলা। এই ব্যবসার ফলে সরকার লাভের মুখ দেখে না এমনও নয় যে ‘খাজনার থেকে বাজনা বেশি’ (মিনিমাম গভর্মেন্ট ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্সের বাংলা করলে যা হয়) বলে সরকার বোর্ডগুলি বন্ধ করে দেবে। হস্তশিল্প, বস্ত্রশিল্প উৎপাদন ভারতের সেরা অর্থনৈতিক উপার্জনের মাধ্যম (কৃষিকার্যের পরে)। এই দুটি শিল্পই অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। আগের অর্থ-বছরে সরকার হস্তশিল্প রপ্তানির মাধ্যমে ৩৬,৭৮৯৮৮ কোটি টাকা এবং দেশীয় বাজারে ১২,৬৭৮ কোটি টাকা আয় করেছে, হ্যান্ডলুম রপ্তানির মাধ্যমেও ২,২৮০.১৮ কোটি টাকা, এবং দেশীয় ব্যবসায় ২,৭৫,০০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। পলিসি এক্সপার্ট ও সমাজকর্মী ডঃ নরসিমা রেড্ডি ‘সিয়াসত ডেলি’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এই বোর্ড চালাতে সরকারের তেমন কোন খরচা ছিল না, অথচ এই বোর্ড থাকার কারণে লাভ হতো বহু মানুষের।
১৯৯২ সালে তৈরি হ্যান্ডলুম বোর্ড তাঁত, তাঁতশিল্পী ও কারিগরদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছে এবং নানা অসুবিধাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা চালিয়েছে। ঠিক তেমনি ভাবেই ১৯৫২ সালে দেশের হাজার হাজার মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য হস্তশিল্প বোর্ড তৈরি করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনের নেত্রী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় এবং পুতুল জয়াকার। কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই বোর্ডের প্রথম চেয়ারপার্সন। মহিলাদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে আসছিল এই বোর্ড। এই দুটি বোর্ডের মুল কাজ ছিল সরকারের সাথে আলোচনা করে এই শিল্প এবং শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষের জীবনের মান উন্নত করা।
এই বাংলার তাঁত শিল্প সারা বিশ্বে বিখ্যাত। এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় শত শত তাঁতির আঙুল কেটে দিয়েছিল যাতে ভারতবর্ষের দেশীয় তাঁতশিল্প শেষ করে দেওয়া যায়। নিজের দেশে সূতীবস্ত্র শিল্পে বিপ্লব আনার জন্য ভারতের বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে কোম্পানির মূল নীতি ছিল ‘যথাসম্ভব কম দামে মাল কিনে তা ইউরোপীয় বাজারে চড়া দামে বিক্রয় করা’। কোম্পানির এই নীতির ফলে ভারতীয় তাঁতিদের লোকসানের সীমা ছিল না। কিন্তু গান্ধীজীর নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে তাঁত বস্ত্র শিল্পের উন্নতি ঘটতে থাকে।
বহু বছর ধরেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁত শিল্পের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে পাওয়ারলুম। রাণাঘাট, ধনেখালি, ফুলিয়া, শান্তিপুরের তাঁতশিল্পগুলি ধুঁকছে। যে কোনো শিল্পকে লাভজনক অবস্থায় চালানোর ক্ষেত্রে দরকার যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার উন্নতি ঘটানো, তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। সরকার যখন ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের কথা বলছে তখন তো দেশের হ্যান্ডলুম ব্যবসাকে আরও উৎসাহ জোগানো উচিত ছিল, তাই না? কিন্তু এই সরকার ঠিক তার উল্টোটা করছে।
এই মোদি সরকার হল সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক নয়া রূপ। দেশের সম্পদকে বিক্রি করে চলেছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে। আমরা আগেই বলেছি দেশীয় ও রপ্তানি বাজারগুলিতে হ্যান্ডলুম এবং হস্তশিল্পের বিক্রি বাড়ছে। তাহলে কেন সরকার এই বোর্ডগুলি বন্ধ করে দিচ্ছে? তার একটাই কারণ এই বাজারগুলি কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেবে। রিলায়েন্সের মত কোম্পানিগুলি ওঁত পেতে রয়েছে এই বাজারগুলি দখল করার জন্য। হ্যান্ডলুম-এর জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দও অনেক কম করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কয়েকদিন আগে এই সরকারের চাপানো জিএসটি-র প্রভাবে তাঁত ব্যবসায় আরও মন্দা শুরু হয়। তারপর এই লকডাউনের মধ্যে মানুষের জীবন-জীবিকা যখন চরম সংকটে তখন এই সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও সরকারী সম্পত্তি বিক্রি করে, শ্রম আইন, পরিবেশ আইনের জনবিরোধী পরিবর্তন এনে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের আসল উদ্দেশ্য আসলে দেশীয় উৎপাদনের বিকাশ ঘটানো নয়, এই দেশের সম্পদকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মারা। এইসব বোর্ডগুলি বাতিল করে দেবার ফলে শিল্পের সাথে জড়িত মানুষের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা সরকারের আর থাকলো না। দেশী, বিদেশী পুঁজিপতিরা এসে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নেবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে, প্রচুর মানুষ এবং বিশেষ করে বহু মহিলা কাজ হারাবেন। ইতিমধ্যেই সিএমআইই রিপোর্ট অনুযায়ী সংগঠিত এবং অসংগঠিত দুটি ক্ষেত্রেই লকডাউনের পর্যায়ে মার্চ এবং এপ্রিলের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন ১৭ লক্ষ মহিলা। এখন মোদি সরকার কুটির শিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে আরও বহু কোটি মানুষকে কর্মহীন করার রাস্তা পাকা করল।
- মিতালি বিশ্বাস
সূত্র- livemint.com, firstpost.com, thewire.com
দেশের ১৩৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৫.৮৭ কোটি মানুষ আয়কর দফতরের কাছে নিজেদের আয় সংক্রান্ত বিবরণ দাখিল করে, যাকে পরিভাষায় রিটার্ন দাখিল করা বলা হয়। আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ এই সময়কালকে রাজকোষ বর্ষ ও বিত্ত বর্ষ হিশেবে ধরা হয়, সাধারণভাবে সেটি অর্থ বর্ষ হিশেবেও পরিগণিত হয়। যদিও ব্যবসায়ীদের অন্যরকম অর্থ বর্ষ বা হিসেব বর্ষ ধরার অধিকার আছে। ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলা সময়ের মধ্যে শেষ হওয়া কোনো অর্থ বর্ষ বা হিশেব বর্ষের জন্য পরবর্তি ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ সময়কালকে আয়কর দফতরের পরিভাষায় এ্যাসেসমেন্ট বর্ষ বলা হয়। অর্থাৎ ১ এপ্রিল ২০১৮ থেকে ৩১ মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে বেতনভোগীরা যে আয় করবেন তার জন্য বা ওই সময়ের মধ্যে শেষ হওয়া (যেমন ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) কোনো ব্যবসায়ীর হিসেব বর্ষের মুনাফার জন্য ১ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ৩১ মার্চ ২০২০-কে এ্যাসেসমেন্ট বর্ষ বলা হবে। বিভিন্ন বিধি নিষেধ সাপেক্ষে ২০১৯-২০ এ্যাসেসমেন্ট বর্ষের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে হয়। বর্তমানে সমস্ত রিটার্নকেই অনলাইনে বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে দাখিল করতে হয়। দাখিলিকৃত রিটার্নগুলির মধ্যে কিছু রিটার্নকে বেছে নিয়ে তাকে খুঁটিয়ে দেখা হয়। যদি সেই খুঁটিয়ে দেখার সময়ে রিটার্নগুলিতে কোনো ত্রুটি দেখা যায় তাহলে সেই রিটার্ন দাখিল করা ব্যক্তির উপরে অর্থদন্ড আরোপ করা হয়। সেই আদেশের বিরুদ্ধে আয়করদাতা আবেদন করতে পারেন। সেই আবেদনকে বিচার করেন আয়কর দফতরের কোনো আধিকারিক, তিনি যে অঞ্চলে আয়করদাতা অবস্থান করেন সেই শহর বা ক্ষেত্রের আধিকারিক হন। বর্তমানে খুঁটিয়ে দেখার জন্য রিটার্ন বাছাই পর্যন্ত আয়করের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে রিটার্নদাতার কোনো মুখোমুখি পরিচয় হওয়ার কথা নয়। ফলে ওই পর্যন্ত মূলত আয়কর রিটার্ন দাতা ফেসলেস বা অবয়বহীন। অতিসম্প্রতি, গত ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পরবর্তি দুটি স্তর, খুঁটিয়ে দেখা ও আবেদনকেও অবয়বহীন অর্থাৎ আয়কর আধিকারিকের সঙ্গে আয়করদাতার কোনো সাক্ষাত ব্যতিরেকেই করার কথা ঘোষণা করেছেন। এছাড়া ‘করদাতার সনদ’ হিশেবে করদাতার দায়িত্ব ও অধিকারও সরকারের তরফে ঘোষিত হয়েছে। এই ধরনের প্রায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঢাক পেটানোর তেমন প্রয়োজন থাকার কথা নয়। যখন প্যান বা বৈদ্যুতিন রিটার্ন দাখিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগত পরিবর্তন প্রবর্তিত হয়েছিল তখন কোনো প্রধানমন্ত্রী তা ঘোষণার নাটক করেননি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশটি এমন এক স্তুতি বন্দনার হীরক-রাজ্যে পরিণত হয়েছে যে সব ঘোষণাই রাজাকে করতে হয়, আর চাটুকার তাঁবেদাররা আহা, বেশ বেশ বলে সমস্বরে গলা মেলায়।
যদিও ৫.৭৮ কোটি রিটার্ন দাখিল করা হয়েছে ২০১৮-১৯ এ্যাসেসমেন্ট বর্ষে, তারা সবাই কিন্তু কর দেননি; দিয়েছেন ১.৪৬ কোটি করদাতা, যা রিটার্ন দাখিলকারীদের ৪ ভাগের ১ ভাগ। করদাতাদের সংখ্যা এত কম কেন তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সাধারণত, বেতনভোগী কর্মচারিদের পক্ষে আয়কর থেকে ছুট পাওয়া দুস্কর। ২০১৮-১৯ এ্যাসেসমেন্ট বছরের আযকর বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে বেতনের থেকে প্রাপ্ত আয় ৫ লক্ষ টাকার বেশি দেখিয়ে রিটার্ন দিয়েছেন এমন করদাতার সংখ্যা ১.৩৩ কোটির মতো। ফলে অনুরূপ সংখ্যক বেতনভোগী আয়করদাতা অবশ্যই কর দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায় থেকে প্রাপ্ত আয়ের ক্ষেত্রে ওই ৫ লক্ষ টাকার সীমা অতিক্রম করেছেন মাত্র ২০ লক্ষের মতো ব্যক্তি যার মধ্যে কোম্পানিগুলিও রয়েছে। ফলে আয় লুকোনো ও কর না দেওয়ার ক্ষেত্রে কারা অগ্রণী তা বোঝাই যাচ্ছে। বেতন থেকে মোট যে আয়ের পরিমাণ ওই বছরে দেখানো হয়েছে তা হল ২০ লক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশি, অপরদিকে ব্যবসায় থেকে মোট আয়ের পরিমাণ ২২.৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো, যার মধ্যে কোম্পানিগুলির আয় ১২ লক্ষ কোটি টাকা, ও ব্যক্তি বা অংশীদারি ব্যবসায় বা পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যবসায় থেকে প্রাপ্ত মোট ঘোষিত আয় ১০.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই সব তথ্য থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে এত বড় দেশে এত ব্যবসায়ীদের অত্যন্ত কম একটি অংশ আয়কর দিয়ে থাকে। যদিও এই সরকার প্রতিদিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা করে, আর সেই ঘোষণার সব থেকে বড় সমর্থক দেশের বৃ্হৎ ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।
আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় ২.৫ লক্ষ ব্যক্তি ব্যবসায় থেকে আয় আছে বলে জানিয়েছে, কিন্তু মাত্র ২০ লক্ষের বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ টাকার বেশি। সুতরাং আয়কর আধিকারিকদের খুঁটিয়ে দেখার জন্য বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে। ‘ফেসলেস স্বচ্ছ’ বন্দোবস্তের মাধ্যমে সেটা দেখা যাবে এমন ভাবার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। এই ফেসলেস স্বচ্ছ আয়করের মঞ্চ তৈরি ও তা নিয়ে ঢাক পেটানোর অন্য কারণ আছে। এই সরকার আয়কর দফতর, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, সিবিআই, এনআইএ-র মতো এজেন্সিগুলিকে ভয়াবহভাবে ব্যবহার করেছে ও করছে। রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে তা করা যাবে, তা নিয়ে মোদিজির তেমন বলার কিছুই নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অফিসে বা বাড়িতে ছাপা মারার অভিযোগকেতো সামলাতে হবে, সে দোষ তো আয়কর দফতরের আধিকারিকদের ঘাড়েই দিতে হবে। গত বছরে কাফে কফি ডে-র মালিক সিদ্ধার্থের উপর আয়করের অত্যাচারের ফলেই নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ঘরেও রেইড করা হযেছে। ফলে যে প্রশ্নগুলি মোদিজির ঘরের লোকেদের ভিতর থেকে উঠছে, যারা বিজেপির অর্থ সরবরাহ করে থাকে, তাদের জন্যই এত স্বচ্ছ কর বন্দোবস্তের দরকার। এর আগে আদালতের বাইরে কর সংক্রান্ত বোঝাপড়ার জন্য বিবাদ থেকে বিশ্বাস প্রকল্প, এখন ফেসলেস কর নিস্পত্তি বন্দোবস্ত। তবে এর আগেও করের ক্ষেত্রে নাগরিক সনদ ছিল, তাতে কাজে কাজ কিছু হয়নি। এবার নতুন জামা গায়ে তা করদাতাদের সনদে রূপ বদলাল। কিন্তু সেটিতো আইন নয়, ইচ্ছা, সদিচ্ছা মাত্র। যদি সেই সনদ লঙ্ঘিত হয় তাহলে করদাতা কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে না, কেবল ওই করদাতা সনদের বিভাগে অভিযোগ জানাতে পারবেন। সে বন্দোবস্ত মোটামুটি আগেও ছিল, ওমবুডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা। তেমন কাজে লেগেছে বলে জানা যায়নি।
একদিকে যখন মোদিজি করের ক্ষেত্রে সব ‘যুগান্তকারী’ ঘোষণা করছেন, অন্যদিকে দেশে কর আদায় তলানিতে ঠেকছে। কর বনাম জিডিপি (মোট অভ্যন্তরিণ উৎপন্ন) অনুপাত ২০১৯-২০ বিত্ত-বর্ষে ১০ বছরের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে, ৯.৮৮%; যা ২০১৮-১৯-এ ১০.৯৭% এ দাঁড়িয়েছিল, ২০১৭-১৮-তে ১১.২২% থেকে কমে। প্রত্যক্ষ কর বনাম জিডিপি অনুপাত ২০১০-১১ সালে ছিল ৫.৮২%, ২০১৫-১৬ সালে কমে হযেছিল ৫.৪৭%; ২০১৯-২০ বিত্ত-বর্ষে তা কমে হয়েছে ৫.১%। কোম্পানি করের পরিমাণও ১৬% কমেছে। উন্নত দেশগুলির কর-জিডিপি অনুপাত ৩৪% এর তুলনায় ভারতবর্ষ বহু দূর পিছিয়ে রয়েছে। এর একাধিক কারণ রয়েছে। ধনীদের উপর কর না বসিয়ে তাদের উদ্যম বাড়িয়ে আয়ের বৃদ্ধি ঘটিয়ে কম হারে কর বসানো সত্বেও মোট কর রাজস্বকে বাড়ানোর তথাকথিত ল্যাফারের সূত্র প্রয়োগের ভাবনা বিজেপি শাসকদের পছন্দের দর্শন। তাই গত ১০ বছরে প্রত্যক্ষ করের মধ্যে কোম্পানি করের অংশ কমেছে। ২০১০-১১ সালে মোট প্রত্যক্ষ করের মধ্যে কোম্পানি করের পরিমাণ ছিল ৬৭%, ২০১৮-১৯ সালে সেই অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮%; ২০১৩-১৪ সালে, ইউপিএ সরকারের আমলের শেষ বর্ষে তা ছিল ৬২%। ভারতের সর্বোচ্চ ধনী কোম্পানি, সকল সরকারের নেক নজরে থাকা রিলাযেন্সের দিকে তাকানো যাক। ২০১৬-১৭ সালের পর থেকে রিলায়েন্স প্রদত্ত আয়করের সঙ্গে কোম্পানির নগদ মুনাফার অনুপাত কমেছে। ২০১৬-১৭ সালে তা ছিল ১৯.৭৪%, ২০১৯-২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.৫৬%। অন্যান্য তাবেদার কোম্পানিগুলির হিসেবে চোখ রাখলে হয়তো এমনটাই পাওয়া যাবে।
মোদিজির সাম্প্রতিক ঘোষনায় তাই যতটা নাটক আছে ততটা অন্তর্বস্তু নেই। তবে অন্য শঙ্কার দিক রয়েছে। আয়কর দফতরের আধিকারিক ও কর্মীদের যত্রতত্র বদলি ও শেষ পর্যন্ত কর্মী-সঙ্কোচনের ষড়যন্ত্র থাকতেই পারে। এক অঞ্চলের আধিকারিক অন্য অঞ্চলের করদাতার রিটার্ন খুঁটিয়ে দেখবে, আবার অন্য কোনো অঞ্চলের কেউ আবেদনের নিস্পত্তি করবে, তাতে কর্মচারিদের বদলি হোয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে যেহেতু পুরো খুঁটিয়ে দেখার জন্য রিটার্ন বাছা থেকে শুরু করে আবেদনের নিস্পত্তি পর্যন্ত সব কাজটাই কম্পুটারে হবে, ফলে কর্মচারিদের প্রয়োজন কমবে। ফলে কর্মী-সঙ্কোচনের জোরালো আশঙ্কা আছে।
-- অমিত দাশগুপ্ত
১৬ আগস্ট দমদমের কমরেড ‘মাসিমা’ রানু দাশগুপ্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘ দিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তাঁর মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং পার্টি শোকাহত। মাসিমা গোপন পার্টি জীবনের সময় থেকে পার্টির একজন দরদী এবং সহযোগী ছিলেন। তাঁর ছেলেরা, বিকাশ ও বিমান, তখন থেকেই পার্টি কর্মী। তাঁদের বাড়ি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয় হিসাবে কমরেডরা নিয়মিত ব্যবহার করতেন। এব্যাপারে মাসিমা এবং পরিবারের সকলের সহযোগিতা না থাকলে তা সম্ভব হোত না। আমি যখন উত্তর ২৪ পরগণায় কাজ করতাম তখন কমরেড মাসিমার বাড়ি পার্টির মিটিং এবং আশ্রয়স্থল হিসাবে নিয়মিত ব্যবহার হোত। মাসীমা ঘরোয়া কথা থেকে পার্টির কাজ সবকিছুই আলোচনা করতেন। নিজে স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মী ছিলেন। এই বাড়িতে কমরেড নাগভূষন পট্টনায়ক অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন ছিলেন, পার্টির অনেক নেতৃস্থানীয় কমরেডরা, এমনকি বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথিরা এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। মাসীমা পার্টির এবং কমরেডদের প্রতি তাঁর ভূমিকা পালন করে গেছেন। পরিবারের সকলের মাথার ছাতা ছিলেন। এই মাসীমা’দের অবদান অনেক সময় আড়ালে থেকে যায়। মাসীমার পরিবারের শোকের সাথে আমি ও পার্টি সহমর্মী ও সমব্যথী। মাসীমাকে মনে রেখে আমার এবং পার্টির পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও লাল সেলাম।
- মীনা পাল