(যে কোনো হেডিং-এ ক্লিক করুন
ঐ লেখাটা সামনে আসবে)
কর্তব্যে অবহেলার জন্য এলজি পলিমার ও সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে সিপিআইএমএল!
এই বিপর্যয়ে দায়িদের চিহ্নিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
মোদী সরকারকে অবশ্যই সুরক্ষা এবং পরিবেশগত নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। ‘পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্ম পরিবেশ সংক্রান্ত কোড বিল’ সহ প্রস্তাবিত ‘শ্রম কোড বিল’ প্রত্যাহার করতে হবে!
কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে আরো একটি বিপর্যয়ে ধাক্কা খেল দেশ। এই বিপর্যয়টি ম্যানমেড। আজ ৭ মে, ২০২০ ভোর ৩ টে নাগাদ অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমের এলজি পলিমার প্ল্যান্ট থেকে স্টাইরিন গ্যাস লিক হওয়ার ফলে শিশু সহ ১১ জনেরও বেশি লোকের মৃত্যু ও ২০০ জনের গুরুতর অসুস্থতার খবর জানা যায়। পরবর্তীতে ক্রমশ জানা গেছে যে, বিষাক্ত গ্যাস ২০০০-এর বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারখানার আশেপাশের গ্রামগুলিতে পড়ে আছে অচেতন মানব দেহ ও মৃত গবাদি পশু। এই দৃশ্য ১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতিকে উস্কে দিচ্ছে, যে মর্মান্তিক ঘটনায় ৩০০০-এরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
এলজি পলিমার ফ্যাক্টরিটি ১৯৬১ সালে পলি স্টাইরিন উৎপাদনের জন্য ‘হিন্দুস্তান পলিমার’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে এই সংস্থাটি দক্ষিণ কোরিয়া ভিত্তিক কর্পোরেট সংস্থা ‘এলজি কেমিক্যালস’ অধিগ্রহণ করে এবং এর নাম পরিবর্তন করে ‘এলজি পলিমার’ করে। প্ল্যান্টটি একটি জনবহুল অঞ্চলে অবস্থিত এবং লিক করে বেরিয়ে আসা গ্যাস এই কারখানার পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অনেকগুলো গ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ভোপাল গ্যাস বিপর্যয়ের পর ৩৬ বছর পেরিয়ে এসে এখনও সরকার মানুষের প্রাণ বিপন্ন করে চলেছে। ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের ‘ঈজ অফ ডুইং বিজনেস’ বা ‘সহজে ব্যবসা করার’ নীতি কারখানার নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলিকে অকেজো করে দিয়েছে। মানুষের জীবনেরও ঊর্ধ্বে মুনাফাকে প্রাধান্য দেয়ার বাস্তবতা এই বিপর্যয় আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
কোভিড-১৯ মহামারীর এই সময়ে, মোদী সরকারের অনুসরণে অনেক রাজ্য সরকার শ্রম আইনগুলিতে একাধিক পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে। প্রয়োজনীয় সুরক্ষানীতি বা স্বাস্থ্যরীতি অনুসরণ করার কোনও রকম দায়বদ্ধতা ছাড়াই কারখানা পরিচালনা করার এবং শ্রমিকদেরকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করার অবাধ ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে মালিকদের। উত্তরপ্রদেশ সরকার তো শ্রম আইন পুরোপুরি স্থগিত করে দেওয়ারই পরিকল্পনা করছে। শ্রমিকদের শ্রম ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর এ এক মারাত্মক হামলা। অবশ্যই এর বিরোধিতা করতে হবে। এই ধরনের পদক্ষেপ কলকারখানায় বিপর্যয় ডেকে আনার নামান্তর।
যারা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন তাঁদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। অন্ধ্রপ্রদেশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত গ্যাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এবং তাঁদের যথাযথ সহায়তা ও যত্নের ব্যবস্থা করা।
কর্তব্যে অবহেলার জন্য এলজি পলিমার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানাচ্ছি আমরা। সমস্ত কারখানাই পুনরায় চালু করতে হবে যথাযথ নজরদারির অধীনে। ‘ঈজ অফ ডুয়িং বিজনেস’-এর নামে নিরাপত্তা, শ্রম ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধকে ও তদারকির নিয়মকে অকেজো করে দেওয়ার বিপর্যয়কর সরকারী নীতির অবসান ঘটাতে হবে।
ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মতো আরেকটি ট্র্যাজেডিকে ঠেকাতে শিল্প সুরক্ষা সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ এবং কারখানা পরিদর্শন আইন চালু করতেই হবে।
– কেন্দ্রীয় কমিটি
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
করোনা সংক্রমণের মতো নজিরবিহীন সংকটময় পরিস্থিতিতেও উন্মোচিত হয়ে চলেছে কেন্দ্রের মোদী সরকারের আচরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। মুখে যাইই বলুক মোদী জমানা ন্যূনতম যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ধার মাড়ায় না। তার বদলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, কর্তৃত্বকরণ, একচেটিয়াকরণই তার গন্তব্য। কোনো রাজনৈতিক ধারা যে প্রকৃতপক্ষে কী তার সবচেয়ে পরিস্কার প্রমাণ মেলে সংকটের পরিস্থিতিতে। এখন বিশ্বময় পরিস্থিতি কোবিড-১৯ কবলিত সর্বাত্বক সংকটের। এই সংকটে কাঁপছে ভারতও। প্রচণ্ড নড়বড়ে করে দেওয়া এই সংকটের সময়ে ঘরে-বাইরে সমস্ত বিপদকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রীয় অবস্থান মেনে চলার ব্যাপারে মোদী সরকারের ভূমিকা জঘন্য, ন্যক্কারজনক।
মোদীকে সামনে রেখে বিজেপি ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের ইস্তেহারে ‘সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রবাদে’র প্রতি আনুগত্য রেখে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যদিও এই বিষয়ে শাসনের প্রথম পাঁচটি বছরে কেমন কথা রেখেছিল তা জনগণ হাড়েহাড়ে টের পায়। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নিয়ে আসা হয় অন্য মাত্রা – মোদীর নেতৃত্বে চাই ‘এক দেশ, এক আইন, এক পার্টির শাসন’ ইত্যাদি! সমস্ত ক্ষমতা চাই ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিওয়ালা এক সর্বেসর্বার হাতে! তার বছরদুয়েক আগে ছড়িয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিবাদী মোদী হটাও দেশ বাঁচাও আন্দোলন। একের পর এক আন্দোলনের জেরে মোদী-কেন্দ্র পর্যবসিত হয় প্রায় পতনোন্মুখ খাদের কিনারায়। সেখান থেকে ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে কিভাবে বিজেপির কেন্দ্রের কুর্সিতে প্রত্যাবর্তন ঘটে, তা যে ‘পুলুওয়ামা’ ও ‘বালাকোট কান্ডে’র ডানায় ভর করে ‘সন্ত্রাসবাদে’র হাত থেকে ‘দেশ রক্ষা’র জিগির তুলে, সেও মানুষ পরে বুঝতে পেরেছে। সেই থেকেই মোদী সরকার আরও ঔদ্ধত্যের সাথে গণতন্ত্র, যাবতীয় বিরোধী মতামত ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে মানতে অস্বীকার করে আসছে। আর, এই প্রবণতা এখন চরম উৎকটভাবে প্রকাশ হচ্ছে কোবিড-১৯ সঞ্জাত সংকট সৃষ্টির পরিস্থিতিতে। কেন্দ্রে মোদীর দ্বিতীয় পর্বের শাসন সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসার উদাসীনতা, অবহেলা, গাফিলতি, ক্ষমাহীন অপরাধ করেই চলেছে।
বিজেপির কেন্দ্রের মন্ত্রীরা ও বাংলার রাজ্য নেতারা অনেক গলা ফাটাচ্ছেন। কেন্দ্র নাকি রাজ্যকে করোনা বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল ২০২০-র ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু কেন্দ্রের শাসকরা তখন নিজেরা কী করছিল? কোনও সতর্ক পরিকলল্পনা-প্রস্তুতি নিয়েছিল কি? নেয়নি। কেন্দ্র তখন ব্যগ্র ছিল অন্য অন্য বিষয়ে। একদিকে ‘বেনাগরিককরণে’র বেলাগাম বিতর্কে-পদক্ষেপে, অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্বর্ধনায় ভাসতে-ভাসাতে। অনতিবিলম্বে করোনার হানা অতিমারীতে পরিণত হওয়ার বিপদবার্তা জানান দিতে শুরু করে। আর তখন কেন্দ্রের আগে তৎপর হয় কয়েকটি অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য। কেন্দ্র কসরত দেখাতে শুরু করে কেবল তারপর থেকে।
প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলায় ভারতের সাফল্য অর্জনের গরিমা বোঝাতে ইতিমধ্যে দফায় দফায় অনেক খেল তামাশা দেখিয়েছেন। তালি দেওয়া, থালি বাজানো, প্রদীপ জ্বালানো এবং বায়ুসেনার বিমান থেকে পুস্পবৃষ্টি, বহু কিছু প্রদর্শিত হল। যারা দেড় মাস জেগে ঘুমিয়ে ছিলেন তারা মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে মধ্যরাত থেকে গোটা দেশকে লক ডাউনে গৃহবন্দী করে ফেললেন। এতে কোটি কোটি দেশবাসীর দ্রুত কি দুরবস্থা ঘনিয়ে আসবে তা নিয়ে একবারও ভাবা হল না, কোনো জনমত যাচাই করা হল না। বিজেপির কেন্দ্র-ভজা রাজ্য সরকারগুলো আশ্চর্যের কিছু নেই চুপ মেরে গেল। কিন্তু বিরোধী দলের রাজ্য সরকারগুলো একগুচ্ছ দাবি তুলেছিল, সেই দাবিগুলো যে সব সর্বাঙ্গীণ ছিল তা নয়, দাবিগুচ্ছের মধ্যে অনেক অসম্পূর্ণতা ছিল, হয়ত কিছু কিছু ফাঁক-ফাঁকিও ছিল, তবু তো প্রাথমিক পর্যায়ে কেন্দ্রের কাছে কম-বেশি যুক্তিসঙ্গত যুক্তরাষ্ট্রীয় আবেদন পেশ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ঘটা করে মুখ্যমন্ত্রীদের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করলেন। কিন্তু দাবি মেটানোর ব্যাপারে ছিটেফোঁটা বরাদ্দ ঘোষণা করেই দায় এড়ানোর কায়দা নিলেন। সেই থেকে ব্যাপক জনতাকে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। এর সবচেয়ে অমানবিক শিকার হয়েছেন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকরা। একইসাথে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কারখানা শ্রমিকের, ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুর মেহনতিদের মায় গ্রামীণ গরিব শ্রেণীর জীবন-জীবিকা। মোদী সরকার বিপদের শুধুমাত্র একটি দিক ‘করোনা’ দেখিয়ে সকলের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে, বিপদের অন্য দিকগুলি অর্থাৎ মানুষের নিদারুণ খাদ্য ও অর্থের অভাব, বেতন ও মজুরি বকেয়া থাকা, ঘরে ফেরার সমস্যা, শরীর-স্বাস্থ্যের পরীক্ষা ইত্যাদি প্রশ্নে মূলত মুখ বন্ধ রেখে চলছে। ‘লক ডাউন হয়েছে বলেই ভারত বেঁচে গেছে’ গলাবাজিটা মোদী করছেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির সাথে তুলনা টেনে। পক্ষান্তরে, করোনা মোকাবিলায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাফল্যের তুলনায় ভারত এখনও কত ব্যর্থতা ও অজানা বিপদের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে, সেই পর্যালোচনার নাম নেই। বিজেপির ঘোড়েল বুদ্ধিজীবীরা তুবড়ি ছোটাচ্ছেন এই বিশ্বাস গেলাতে যেন ‘মোদী অবিসম্বাদী, ভারতকে টেনে তুলতে পারেন একমাত্র মোদী’। অক্সফোর্ড অতীত থাকা অধুনা রাজ্যসভায় বিজেপির সদস্যপদের পুরস্কার পাওয়া এক ঝানু সাংবাদিক দেদার কলমবাজি করছেন। বলেছেন, মোদীর কড়া লক ডাউনের ব্যবস্থাগ্রহণ ‘ভারতের জনজীবন সস্তা’ – বাইরের দুনিয়ায় পোষণ করা এই বিশ্বাসটা উল্টে দিয়েছে। ভাবলেন তুড়ি মেরে সব অভিযাগ উড়িয়ে দেওয়া গেল। কিন্তু না, মিথ্যাচার করে করোনার মোকাবিলায় কেন্দ্রের ভূমিকা যে কত যন্ত্রণার সেটা মানুষ দুর্দশার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝছেন, যুঝছেন।
ভারতের জনজীবনের শোচনীয় অবস্থা বুঝতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্য নেওয়াই শ্রেয়। ‘হু’-র রিপোর্ট অনুসারে ভারতে একদিকে যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বছরে গড়ে ২ কোটি ৫০ লক্ষ, অন্যদিকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষের মতো; আর যক্ষায় ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় বছরে যথাক্রমে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ও ২০ হাজার। যক্ষায় মৃত্যুর পেছনে কারণ প্রথমত অনাহার-অর্ধাহার-অপুষ্টি, আর এই রোগভোগের পরিণামে মৃত্যুমিছিলের পেছনে অভিন্ন কারণ হল, সুলভ পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব বা বিনা চিকিৎসা। তার পেছনে আরও কারণ হল, জনস্বাস্থ্য ও দরকারী চিকিৎসার প্রশ্নে ক্রমবর্দ্ধমান সরকারি অবহেলা, সরকারি ব্যবস্থাপনার শম্বুকগতি, বেসরকারীকরণ, বাজারিকরণ। করোনার মোকাবিলায় সরকারি ব্যয়বরাদ্দের তুলনামূলক নমুনাও ভারত সরকারের অবস্থান ও মনোভাব যে বেদরদী জনবিরোধী তার প্রমাণ দেয়। যখন জাপান বরাদ্দ করেছে জিডিপি-র ২০ শতাংশ, আমেরিকা করেছে দুদফায় মোট ১৬ শতাংশ, তখন ভারতে মোদী সরকার জিডিপি-র ১ শতাংশেরও কম বরাদ্দ করে সাফল্য জাহির করছে! অথচ জাপান-আমেরিকার তুলনায় ভারতের জনসংখ্যা যেখানে বহুগুণ বেশি। ভারত রাষ্ট্রের পরিচালকদের কাছে জনগণের জীবনের দাম কতটুকু! লক ডাউন পর্বের জন্য শ্রমিকদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ মজুরি মিটিয়ে দেবেন নির্দেশ দিয়েই নিষ্ক্রিয় হয়ে থেকেছে। অবশ্য এ দোষে যেমন কেন্দ্রের মোদী সরকার দুষ্ট, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রীয় দাবি কণ্ঠ তোলা রাজ্যের তৃণমূল সরকারও দোষী। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো হল বহু দিন ফেলে রেখে। কেন্দ্র প্রথমত কখনই ফেরানোর দায়দায়িত্ব নিতে চায়নি। তার জন্য জুজু দেখায় সংক্রমণ ছড়ানোর। রাজ্য সরকারগুলোও প্রথম দিকে দায় এড়ানোর সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে কেন্দ্রের ছড়ানো জুজুকে অজুহাত বানায়, গাজোয়ারী অনড় মনোভাবকে ঘাঁটাতে চায়নি, বিরল ব্যাতিক্রম তৎপর হয় কেবলমাত্র কেরল। তারপর যখন দেশজুড়ে ঘরে ফেরানোর দাবি-ঝড় উঠল সেই ধাক্কায় বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলো বাধ্য হল কেন্দ্রের ওপর চাপ তৈরি করতে। আর কেন্দ্র বাধ্য হল একগুয়েমী ছাড়তে। নিমরাজি হল রেল কর্তৃপক্ষ। তাও আবার বেঁকে বসেছিল ভাড়ার টাকা বহন করবে না বলে। রেল প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ১৫০ কোটি টাকা দান করতে পারে, আর তার এক-তৃতীয়াংশ টাকা ছাড় দিয়ে শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে পারে না! ভাড়ার পুরো দায়টা চাপাতে চেয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর, তারা না পারলে তাদের যে রাজ্য থেকে যে রাজ্যে পাঠানো হচ্ছে সেই রাজ্যগুলোর ওপর। শ্রমিকরা যখন ভাড়া গুণতে অস্বীকার করল, রাজ্যগুলো যখন তা মানতে অস্বীকার করল, এই দড়ি টানাটানির মাঝে কংগ্রেস যখন বিশেষ ‘সাহায্যদানে’র তাস খেলে বসল, এইসমস্ত চাপের ফলে মোদীর কেন্দ্র সেই ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করল, ভাড়ার ৮৫ শতাংশ বহন করার অবস্থান গ্রহণ করল। তবে সোজা কথায় নয়, গণতান্ত্রিক অধিকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় দাবির প্রতি বদান্যতা প্রদর্শনবশতও নয়, অবনত হল লাগাতার দেশজোড়া প্রতিবাদ আর বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের রুখে দাঁড়ানোর চাপের সামনে।
মাননীয়া,
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,
মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
মহাশয়া,
করোনা লকডাউনের পরিস্থিতিতে রাজ্যের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের চরম অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর অন্তত ১২-১৫ দিন কৃষি পণ্যের কোনোরকম পরিবহন ব্যবস্থা ছিলো না। বিকল্প ব্যবস্থা না করেই গ্রামীণ হাটগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষকরা নামমাত্র দামে বিপুল লোকসানে ফসল বিক্রি করেছে। অথচ শহর ও গঞ্জে সেই ফসলই বিক্রি হয়েছে ৪-৬ গুণ বেশি দামে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে চাষিরা রাস্তায় ফসল ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা একান্ত জরুরি। সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টির কারণে বোরো ধান, সব্জি, ফল, ফুল, ভুট্টা, গম, পানচাষ, দুধ সরবরাহ, উদ্যান পালন প্রভৃতি ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত কৃষিজীবী মানুষেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শস্যবীমার আওতায় থাকুক বা না থাকুক এই সমস্ত কৃষি উৎপাদকদের, বিশেষত ভাগ-চুক্তি চাষিদের উপযুক্ত ক্ষতিপুরণের দাবি আজ গ্রাম বাংলা থেকে উঠে আসছে। বর্তমানে বোরো ধান কাটার কাজ শুরু হয়েছে বা কিছু জায়গায় শুরু হতে চলেছে। এই ধান কাটার সাথে ১০০ দিনের কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের কাজকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ইতিমধ্যে আপনি বলেছেন। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা জারি করা একান্ত প্রয়োজন। লকডাউনে কর্মহীন গ্রামীণ শ্রমজীবীরা রেশনে স্বল্প পরিমান খাদ্যদ্রব্য পেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এদের স্বার্থে অবিলম্বে কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প চালু করতে পঞ্চায়েত দপ্তরের যুদ্ধকালীন তৎপর ভূমিকা গ্রহণ করা জরুরি। ভিন্ন রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা অনেকেই গ্রামে ফিরে আসছে। আমাদেরই ভাই-বন্ধু-স্বজন এই মেহনতি মানুষদের আমরা স্বাগত জানাই। এদের শ্রমে গ্রামাঞ্চলের কৃষি পরিকাঠামোর প্রভূত উন্নয়ন করা সম্ভব। গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিনির্ভর ব্যাপক মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে আশাকরি এই পদক্ষেপগুলি আপনি গ্রহণ করবেন। অন্নদাতা কৃৃষক ও গ্রামীণ শ্রমজীবীরা যাতে নতুন করে ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য না হন সেই লক্ষ্যে আপনি যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন, এই আবেদন জানাচ্ছি। করোনাকে কাজে লাগিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। এর বিরুদ্ধে আমরা কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। আমাদের আবেদন আপনি এই বিষয়গুলি নিয়ে আমাদের কৃষক সংগঠনগুলির সাথে আলোচনার জন্য সাক্ষাতের সময় দেবেন অথবা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনার ব্যবস্থা করবেন।
১) করোনা লকডাউনের ফলে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধান, সব্জি, ফল, ফুল, ভুট্টা, গম, পানচাষ, দুধ উৎপাদন ও সরবরাহ, উদ্যান পালন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত কৃষিজীবী মানুষদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভাগ-চুক্তি চাষিরাও যাতে এই ক্ষতিপূরণ পায় তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।
২) কৃষকদের ভর্তুকি দিয়ে সার, বীজ, বিদ্যুৎ ও ডিজেল সরবরাহ করতে হবে।
৩) গ্রামে ক্যাম্প করে সরকারী দরে সমস্ত রকম ফসল কিনতে হবে, ধান কেনায় রাজ্য সরকারকে অতিরিক্ত বোনাস দিতে হবে।
৪) কাজ না পাওয়ার কারণে ভর্তুকি বাবদ প্রতিটি জবকার্ডে ১০ হাজার টাকা জমা করতে হবে। অবিলম্বে কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পর কাজ চালু করতে হবে। ধান কাটা সহ কৃষিকাজকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, জেসিপি ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে।
৫) রেশনে সমস্ত গ্রামীণ গরিব মানুষদের মাথাপিছু ১৫ কেজি চাল/গম, ডাল, ভোজ্য তেল, আলু ও মশলা সরবরাহ করতে হবে।
৬) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনে করে এরাজ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি পরিযায়ী শ্রমিককে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭) করোনা মোকাবিলা ও গ্রামীণ চিকিৎসার উন্নতির জন্য জেলা ও ব্লকস্তরে উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি জেলায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে।
ধন্যবাদান্তে,
সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি (এআইকেএসসিসি)
পশ্চিমবঙ্গ শাখার অন্তর্ভুক্ত ২১টি কৃষক সংগঠনের পক্ষে
সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ স্বাস্থ্য সংকট, কোভিড-১৯ অতিমারীর মধ্যেও সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী থাবা বিস্তার করে চলেছে। লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা থেকে এশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক পরিবর্তন, অমানবিক নিষেধাজ্ঞা, সরাসরি এবং গোপন আক্রমণের নীতি ধ্বংসাত্মক ফলাফল এবং জনগণের দুঃখ দুর্দশার কারণ হিশেবে কাজ করছে।
ভেনেজুয়েলাতে গত ৩ মে ইউএস মদতপুষ্ট ভাড়াটে বাহিনীর সাম্প্রতিক আক্রমণ, যা বলিভিয়ান সৈন্য বাহিনী ব্যর্থ করেছে, এবং ১ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিউবার দূতাবাসে সশস্ত্র আক্রমণ নিশ্চিতভাবেই ইউএস রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মারমুখি নীতির প্রতিফলন।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোকে অপসারনের জন্য ইউএস-এর সহায়তার কথা ইউএস পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও পুনরায় ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যেই ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ হয়। সাম্প্রতিক কালে ইউএস ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদি আক্রমণকে তীব্রতর করেছে দানবিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, এবং দেশে অচলাবস্থা তৈরি ও সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে আগ্রহী ভেনেজুয়েলার অভিজাতদের সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণপন্থী বিরোধী গোষ্ঠীদের সমর্থন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে এই সংকর যুদ্ধ অত্যাবশ্যক পণ্যের যোগান ও সরকারি রাজস্বকে খর্ব করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার পাশাপাশি সরকারকে উৎখাত করতে সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করাকে সাহায্য করছে।
ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ইউএস সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য হল পূর্বতন রাষ্ট্রপতি হুগো স্যাভেজের নেতৃত্বে ঘটা বলিভিয়ান বিপ্লবকে বিপর্যস্ত করা। ওই বিপ্লব দেশের শ্রমিক ও পরিশ্রমী জনতার হাতে ক্ষমতা দিয়েছে এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুবিধে, আবাসন ও শিক্ষার নীতির সূচনা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার তৈল সম্পদের জাতীয়করণ জনতার উপর নিপীড়নকারী ইউএস বহুজাতিক ও ভেনজুয়েলিয় অভিজাত ধনীদের লুঠের সমাপ্তি ঘটায়। স্যাভেজের কাঙ্খিত বলিভিরিয়ান বিপ্লবের স্তম্ভগুলিকে শক্তিশালী করার মধ্যেই ভেনেজুয়েলায় ইউএস সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর শক্তি নিহিত আছে।
গত মাসে ইউএস সরকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কিউবা কর্তৃক প্রদেয় সাহায্য হিশেবে ১ লক্ষ মাস্ক, কোভিড-১৯ নিরুপণ দ্রব্য, ভেন্টিলেটর ও গ্লাভসের পরিবহণকে বন্ধ করতে কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করেছিল। ২০১৯ সালে ইউএস সরকার কিউবার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার অংশ হিশেবে হেমস-বার্টন আইনের ৩নং বিধিকে ব্যবহার করেছিল, যা কিউবার রাষ্ট্রায়ত্ব সম্পত্তির থেকে মুনাফাকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ইউএস নাগরিকদের মামলা করার অধিকার দিয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীরা ইউএস মদতপুষ্ট ফালজেনসিও বাতিস্তার অমানবিক একনায়কতন্ত্রকে পরাস্ত করার সময়কাল ১৯৬০-এর দশক থেকেই কিউবার বিরুদ্ধে এই অর্থনৈতিক জবরদস্তি শুরু হয়েছে।
ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণের পরেও ইউএস সাম্রাজ্যবাদকে অগ্রাহ্য করে কিউবা তার স্বাধীনতাকে ঊর্ধে তুলে ধরে চলছে। ওবামা প্রশাসন কিউবার উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তোলার পদক্ষেপ নিয়েছিল, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেগুলিকে বাতিল করছে। কাস্ত্রোর মৃত্যুর পরে কিউবার জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার হরণকারী অকল্পনীয় দারিদ্র ও দুঃখ কষ্ট প্রদানকারী একজন একনায়ক হিশেবে কাস্ত্রোকে চিহ্নিত করে কিউবাতে শাসক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে টুইট করে ট্রাম্প ঘোষণা করে যে ইউএস তার সর্বশক্তি দিয়ে কিউবাবাসীদের সাহায্য করবে “উন্নতি ও স্বাধীনতার দিকে তাদের অগ্রগতিকে”। কিউবার জনগণ ওই ঘোষণার প্রত্যুত্তরে কাস্ত্রোর শেষকৃত্যের মিছিলে বিপুল অংশগ্রহণ করে কিউবার বিপ্লবকে সমর্থন ও বিপ্লবের উপর ভরসা ব্যক্ত করে।
ইউএস অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্বেও সর্বাধিক বিপর্যস্ত দেশগুলিতে চিকিৎসাবাহিনী ও ৬০টিরও বেশি দরিদ্র ও প্রান্তিক দেশে চিকিৎসা সাহায্য পাঠিয়ে কিউবা কোভিড-১৯ বিপর্যয়ে সাড়া দেওযার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ইউএস সাম্রাজ্যবাদ এবং দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই-এর ক্ষেত্রে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ভেনেজুয়েলা ও কিউবার জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
ইউএস সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক
দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাস নিপাত যাক
কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল), ৬ মে, ২০২০
মার্ক্স ছিলেন আপাদমস্তক একজন বিপ্লবী বাস্তববাদী। তাঁর এই বাস্তববাদের মূলে রয়েছে বস্তু, এবং গতিময়তা হল বস্তুর অস্তিত্বের রূপ। সামাজিক বাস্তবতার উপর দৃঢ় ভিত্তি করে মার্ক্স দাঁড়িয়ে, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতাকে স্বীকার করা মানে যথাস্থিতিকে মেনে নেওয়া নয়, বরং সেই বাস্তবতাকে বদলে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সবরকমের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের সংগ্রাম। তাঁর ২০২তম জন্মবার্ষিকীর সময়কালে, চারিদিক যখন থমকে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়, যখন প্রায় গোটা দুনিয়া লকডাউন মোডে চলে গেছে, যখন দূরত্ব বজায় রাখাই আচার হয়ে উঠেছে আর অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাভাবিক রূপ হয়ে উঠেছে ডিজিটাল, তখন মার্ক্সকে আমরা কীভাবে স্মরণ করতে পারি?
মার্ক্সের কাছ থেকেই ইঙ্গিত নিয়ে আসুন আমরা জীবনের বাস্তব অবস্থার উপর, পরিবর্তনশীল বাস্তব পরিস্থিতির উপর নজর কেন্দ্রীভূত করি। এই বাস্তবতা মোটেই একপেশে নয় বরং বহুমাত্রিক, সোজা-সাপটা নয় বরং জটিল। আপাত স্তব্ধতার বাহ্যিক আবরণ ভেদ করে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে পরস্থিতির অন্তর্নিহিত গতিধারার উপর। আর এই গতি সরলরৈখিক নয়, বরং বহুমুখী টানাপোড়েন ও ঘাত প্রতিঘাতের নীট যোগ।
বিশ্বব্যাপী মহামারীর চিকিৎসা সংক্রান্ত দিকটির চর্চা আমরা জীবানুবিদ ও মহামারী বিশারদদের জন্য ছেড়ে রাখছি। আমরা মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করব সামাজিক বাস্তবতার দিকটিতে। যেহেতু এই মড়ক সারা বিশ্বে ব্যাপ্ত তাই আমরা বরং মহামারীর এই প্রাদুর্ভাবকালে বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদী বাস্তবতাকেই নজরে রাখি। প্রথমেই যা আমাদের সামনে প্রকট চেহারায় হাজির হয় তা হল বিশ্বায়নের সঞ্চারপথের সাথে ভাইরাসের সংক্রমণপথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ভাইরাসটি বিশ্ব অর্থনীতির পাওয়ার হাউস চীন দেশে প্রথম দেখা দিল ও দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত বিশটি দেশের প্রায় সকলেই জি-২০ ভুক্ত দেশ। আর এই দেশগুলির মধ্যেও বিশেষভাবে বিপর্যস্ত এলাকাগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে কোনো স্থানের বৈশ্বিক সংযোগের মাত্রা তথা পুঁজির সঞ্চয়নের মাত্রার সাথে ঐ স্থানের বিপর্যয়ের গভীরতা প্রায় সমানুপাতিক। আমাদের অবশ্য স্পষ্ট ভাবে বুঝে নিতে হবে যে এই ধাক্কা ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ভেতরে এবং বিশ্বজুড়ে বর্তমানে বিদ্যমান অসাম্যকেই অবশেষে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
মানুষের জীবনের প্রয়োজন আর কর্পোরেটদের লালসার মধ্যে মৌলিক সংঘাতকে বর্তমান সংকট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। প্রায় সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবার মুনাফার স্বার্থে সুপরিকল্পিতভাবে বড় বড় ঔষধ কোম্পানি, বিপুলাকার বীমা সংস্থা ও বেসরকারী হাসপাতালের আঁতাতের অধীনস্থ করে ফেলা হয়েছে। কর্পোরেট উন্নয়ন মডেলে প্রকৃতি পরিবেশের অবনমন ও জলবায়ু পরিবর্তনও বিপদসীমা ছাপিয়ে অস্থির মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
জানুয়ারীর শেষ দিকে যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরি সতর্কতা জারি করল, যখন পর্যন্ত চীনের বাইরে আর কোথাও কোনও মৃত্যুর খবরও সামনে আসেনি, তখন পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ বাদে আর কোনও দেশ তেমন পাত্তাই দেয়নি। অনেক পরে তাদের ঘুম ভাঙল। আর অনেক দেরীতে তারা চীনের কায়দায় লকডাউনের পথ বেছে নিল। কিন্তু তা নেওয়া হল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ও অনেক কম দক্ষতার সাথে। এই প্রক্রিয়ায় অর্থনীতি ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে। এরকম ধাক্কা বোধহয় আমরা আগে কখনই দেখিনি, অন্ততপক্ষে এই মাত্রায় ও এতটা লম্বা সময় জুড়ে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বহুবিধ পণ্যের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ও বিক্রয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। লকডাউন এই বুনিয়াদী প্রক্রিয়াকেই ব্যাহত করেছে। পরিষেবা শিল্পের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষার মতো কিছু ক্ষেত্রের কাজকর্ম ‘বাড়িতে বসে কাজ’ হিসেবে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন বা বিমান চলাচল কার্যত স্তব্ধ। সর্বত্রই কর্মী ছাঁটাই ও মজুরি ছাঁটাই ইতিমধ্যেই ঘোষিত হতে শুরু করেছে। এখান থেকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাটা মোটেই সহজ হবে না এবং রীতিমতো এক উথাল-পাথাল বা আলোড়নের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে।
আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এক বহুস্তরীয় জটিল দানব যার মূলে রয়েছে তার নিপীড়নকারী কেন্দ্র, কিন্তু সেই নিপীড়নকারী যন্ত্রের উপর চাপানো থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রণালী এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের বহুমাত্রিক আন্তঃসম্পর্ক। কিন্তু এই মহামারী ও তার প্রশাসনিক পরিপূরক হিসেবে এই লকডাউন আবার একবার রাষ্ট্রের বুনিয়াদী চরিত্রকে প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। প্রশাসন, সুরক্ষা প্রদান ও সুশাসনের প্রশ্নে কোনো রকম তৎপরতা প্রদর্শনের বদলে কেবল নিপীড়ন ও নজরদারির হাতিয়ার হিসেবেই রাষ্ট্র আজ আমাদের সামনে উপস্থিত।
আজ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা চরম আকার নিয়েছে। এই মাত্রার সংকট ধর্মীয় বিশ্বাস এমনকি বিভিন্ন কুসংস্কার ও বুজরুকি চিন্তা অনেকটা বাড়িয়ে তুলেছে। যুক্তিব্যাখ্যা ও অনুসন্ধিৎসায় অভ্যস্ত আধুনিক মননের কাছে এই পরিস্থিতি বেদনাদায়ী, কিন্তু মার্ক্স ধর্ম সম্পর্কে আমাদের যা বলেছিলেন তা এখানে স্মরণে আনা দরকার : “ধর্মীয় কৃচ্ছসাধন হল একাধারে বাস্তব দুর্দশার প্রকাশ ও সেই দুর্দশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন দুনিয়ার হৃদয়, আত্মহীন অবস্থার আশ্রয়”। এত নৃশংসতা আর বিশৃঙ্খলার মাঝে এই হৃদয়হীন দুনিয়ায় সামান্য সান্তনার আশ্রয় খুঁজতে ধর্মকে আঁকড়ে ধরা দেখে আমাদের তো অবাক হওয়ার কিছু নেই।
মার্ক্স থেকে সাহায্য নিয়ে ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকা এই বিশ্ব-সংকটকে আমাদের বুঝতে হবে, আর অবশ্যই বিশেষ নজর দিতে হবে ভারতের বুকে আমাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার উপর। মোদী সরকার ও সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী তাদের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট এজেণ্ডা আগ্রাসীভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ফ্যাসিস্ট প্রকল্পকে ত্বরান্বিত করতে ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করতে এই সংকটকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। নাগরিকত্বের ধারণাকে নতুন করে নির্মাণ করতে শুরু করেছে তারা, যেখানে অধিকারসম্পন্ন নাগরিককে অনুগত প্রজায় পর্যবসিত করা হচ্ছে। ওদের জাতীয়তাবাদী ছক অনুযায়ী সমগ্র সমাজকে যূথবদ্ধ করার নয়া মওকা হিসেবে এই স্বাস্থ্য সংকটকে কাজে লাগাতে চাইছে ওরা।
করোনা ভাইরাসকে ওদের সাম্প্রদায়িক ছকের সাথে সেট করে দেওয়ার কোনও সুযোগ ওরা হাতছাড়া করছে না। স্যাঙাতি মিডিয়ার সহযোগিতায় তারা যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছে চীন আর তবলিগি জামাতের ঘাড়ে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাকে যখন সতর্কতার প্রধান রূপ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তখন ওরা তাকে বদলে দিয়েছে অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বহিষ্কার চাপিয়ে দেওয়ার হাতিয়ারে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুব্যবস্থিত সামাজিক ও আর্থিক বয়কটের সূচনা ঘটিয়েছে এবং এখন তো আমরা কোভিড-১৯ সংকটকে ঘিরে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক ভাইরাস, তীব্র ইসলাম-বিদ্বেষ ও সামাজিক অস্পৃশ্যতার রমরমা দেখতে পাচ্ছি।
লকডাউন তো সব স্বৈরাচারিরই স্বপ্নের পথ। এবং মোদি সরকার দুহাত দিয়ে সেই স্বপ্নকে লুফে নিয়েছে। লকডাউনের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে সরকার তাকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতা ও সমস্ত সংসাধন আরও বেশি কেন্দ্রীকরণ করতে (পিএম কেয়ার্স যার একটি নির্লজ্জ উদাহরণ), নজরদারি বাড়াতে (আরোগ্য সেতু অ্যাপকে ক্রমশ বাধ্যতামূলক করে), গণতন্ত্রকে সংকুচিত করতে (পুলিশ ও আমলাতন্ত্র সবকিছু নির্ধারণ করে দিচ্ছে, বিরোধী দল সমূহ, গণ সংগঠনগুলি, নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলি, বিশেষজ্ঞগণ বা বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি - সকলকেই একদম প্রান্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে এবং প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ বা আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে কদর্য দমন অভিযান চালান হচ্ছে) এবং মোদি-ভক্তিকে আরও বেশি ছড়িয়ে দিতে (মোদিকে সমস্ত দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে এক ত্রাতা হিসেবে স্থাপন করা হচ্ছে)।
কিন্তু ইতিহাস আমাদের বলে যে স্বৈরাচারী ও সম্রাটেরা চিরদিন রাজ করে না এবং জনগণই শেষ কথা বলে। মোদী জমানা কোভিড-১৯ মহামারি ও চলমান লকডাউনকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করার যতই চেষ্টা চালাক না কেন, সরকারের সমস্ত ব্যর্থতা, অবিচার, নৃশংসতা এবং রাষ্ট্র ও এই ব্যবস্থার নিপীড়ক শ্রেণী চরিত্র এখনকার মতো এত সুস্পষ্ট রূপে আগে বোধহয় কখনও উন্মোচিত হয়নি। লকডাউন সৃষ্ট সামাজিক সংকটের বিস্ফোরক চেহারা ভারতকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। পরিযায়ি শ্রমিক ও ক্ষুধার্ত মানুষ আজকের সংকটের সবচেয়ে মূর্ত সামাজিক প্রতিচ্ছবি। সরকার দাবি করছে জনতাকে বাঁচাতে নাকি সে অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করে নিয়েছে, অথচ আসল সত্য হল, করোনা ভাইরাস থেকে ছাড় পেলেও কর্মহীন নিঃসম্বল অসহায় ব্যাপক মানুষ আজ আর্থিক কারণেই চূড়ান্ত বিপদের মুখোমুখি।
মার্ক্স বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করতেন সেই বাস্তবতার সাথে আরও ভালোভাবে যুঝতে, তাকে বৈধতা দানের জন্য নয়, বরং সর্বদাই তার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। তিনি সব সময় বৈপ্লবিক ধ্যানধারণা ও বিপ্লবী উদ্যোগ ছড়িয়ে দেওয়ার এবং সম্মিলিত সক্রিয়তা শক্তিশালী করার পথ খুঁজেছেন। আজ বিশ্ব পুঁজিবাদ যখন অভূতপূর্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে এবং মোদী সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতা যখন উত্তরোত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠছে তখন আমাদের বিপ্লবী মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এই ঘনীভূত সংকট ও বিকাশমান বাস্তবতাকে যুঝতে হবে।
কোভিড-১৯ এক নিদারুণ ভাঙ্গনের মুহূর্ত। বিশ্ব পুঁজিবাদ আর পুরনো পথে চলতে পারবে না। ভারতেও পুরনো নীতিপদ্ধতিগুলি আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় বেশি উন্মোচিত। এখনই সময় গতিপথ পাল্টানোর লক্ষ্যে উদ্যোগ বাড়ানোর, জনস্বাস্থ্য, গণবন্টন ও গণপরিবহন ব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থেই গণ ও সার্বিক করতে লড়াই গড়ে তোলার। এই লকডাউনের মাঝেও আমরা ‘বাড়িতে থাকুন’-কে ‘বাড়িতে থেকে কাজ করুন, বাড়িতে থেকে প্রতিবাদ গড়ুন’-এ বদলে দিয়েছি। আমরা শারীরিক দূরত্বকে সংযুক্ত করেছি সামাজিক সহমর্মিতা ও সংহতির সাথে। সংকটের সুযোগে মোদি সরকার আমাদের যৌথ সম্পদ ও অধিকারগুলি কেড়ে নিতে চাইছে। আমরা তা করতে দেব না। ওদের ফ্যাসিবাদী ছককে রুখে দিতে পাল্টা লড়াই গড়ে তুলব, এগিয়ে যাব মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক পরিবর্তনের পথে।
– দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
সাধারণ সম্পাদক
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
১৯৪১ সালে তাঁর জীবনের শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই প্রবন্ধটি আমাদের সুপরিচিত সভ্যতার সংকট। এই লেখা এবং এর কাছাকাছি সময়ে রচিত আরো কিছু লেখায় সভ্যতার সংকটের, দেশের সংকটের দিকটিকে নানাভাবে দেখার চেষ্টা তিনি করেছেন। তবে এর কোনোটি কোনোটি নিয়ে তিনি ভাবছেন দীর্ঘদিন ধরেই। কয়েক দশক ধরে নানা জায়গায় নানা লেখায় তিনি সেগুলিকে ধরার চেষ্টা করেছেন।
বিশ্ব সভ্যতার সংকটকে রবীন্দ্রনাথ যে দুটি প্রধান জায়গা থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন তার একটি হল ফ্যাসিবাদ, যা তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর অন্যটি হল সাম্রাজ্যবাদ ও দেশে দেশে তার চাপিয়ে দেওয়া পরাধীনতার অন্ধকার। এই বৈশ্বিক সঙ্কটের পাশাপাশি আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজনের অভিশাপের মতো দুটি বিষয় নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন। এর প্রথমটি নিয়ে তাঁর চর্চা শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়কার কিছু পর্যবেক্ষণ ও তার কারণ অনুসন্ধান দিয়ে। দেশ ও বিশ্ব সভ্যতার সংকটগুলি নিয়ে কথাবার্তার পর কীভাবে, কোন পথে সভ্যতার এই সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব – তার অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশিকা নিয়েও রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তাভাবনা জানিয়েছেন।
মৃত্যুর কয়েকমাস আগে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ রচনার পাতা কয়েকের সীমিত আয়তনেই রবীন্দ্রনাথ খুব সংহতভাবে একবার ফিরে দেখেছেন তাঁর গোটা জীবন ও সমসাময়িক বিশ্বকে। এই লেখা যখন তিনি লিখছেন তখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদের মদমত্ত আস্ফালন কোটি কোটি মানুষের জীবনকে নরক করে দিচ্ছে। তারই উল্টোদিকে চলছে এর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো ভারতেও তৈরি হয়েছে ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সভাপতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ফ্যাসিবাদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্ষমতা দখল করে নেয় নানান নামে। প্রায় সর্বত্রই এই ভয়ংকর মতাদর্শের প্রভাব বাড়তে থাকে। বিভিন্ন দেশের ভেতরে যেমন জাত্যাভিমান কেন্দ্রিক উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তেমনি চলতে থাকে পররাজ্য গ্রাস ও সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রক্রিয়া।
ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের ঘটনাটির পর বিচলিত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত আফ্রিকা কবিতাটি। এই কবিতায় বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির উপনিবেশ দখলের প্রক্রিয়াকে তিনি দেখেছেন এক পরাধীন নিপীড়িত জাতির প্রতিনিধি হিসেবে। শাসক রাষ্ট্রের নিজেদের সুখ শান্তি সমৃদ্ধির সমাজ কীভাবে উপনিবেশের লুন্ঠন শোষণ দারিদ্রের বিনিময়ে তৈরি হয়েছে, তার স্পষ্ট উচ্চারণ রয়েছে কবিতাটিতে।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে;
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিণ্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।
সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পুজোর ঘণ্টা
সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
সুন্দরের আরাধনা।
আবিসিনিয়াতে যুদ্ধ চলাকালীনই জেনারেল ফ্ল্যাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে নেমে আসে ফ্যাসিস্ট অত্যাচার (জুলাই, ১৯৩৬)। স্পেনের ঘটনার পরপরই ‘লিগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার’–এর ভারতীয় শাখা তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সভাপতি হন। তারপরেই জাপান চিনকে আক্রমণ করে (জুলাই, ১৯৩৭)। জাপানের হাতে ১৫ ডিসেম্বর (১৯৩৮) নানকিং শহরের পতন হয়। প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে জাপানি সৈন্য। এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে তিনি লেখেন ২৫ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ লেখেন —
‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’ (প্রান্তিক, ১৮ সংখ্যক)
অমিয় চক্রবর্তীকে ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ এ লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি ফ্যাসিজমের পরাজয় কামনা করলেন। সেই লেখার মধ্যে তিনি বললেন — ‘এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি। কেননা মানব – ইতিহাস ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না।’ ১৯৪০ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি হিটলারের বাহিনীর হাতে ফ্রান্সের পতনের পর তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখে যুদ্ধে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।
রবীন্দ্রনাথ যে কোনও পরাশক্তির আগ্রাসন, দমন, শাসন, শোষণের উল্টোদিকে বরাবর দাঁড়িয়েছেন। তবু ফ্যাসিজম এমন একটা শক্তি যার তুলনায় ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের মত ঔপনিবেশিক শক্তির বিজয়কেও তিনি শ্রেয় মনে করেছেন। ইংরেজের হাতে ভারতবর্ষের পরাধীনতা সত্ত্বেও এই অবস্থান এক ধরনের লেসার ইভিলকে বেছে নেওয়ার চেষ্টা। ইংরেজের ঔপনিবেশিক শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে এবং সামগ্রিকভাবেই ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভগুলি বারবার ভাষা পেয়েছে।
সভ্যতার সংকট প্রবন্ধটিতে ইংরেজ শাসককে তিনি কীভাবে দেখেছেন তার পরিচয় আছে। বেড়ে ওঠার প্রথম পর্বে ইংরেজি শিক্ষা সংস্কৃতির প্রভাবে তিনি তাঁর সমসাময়িকদের অনেকের মতোই আবিষ্ট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “তখন ইংরেজি ভাষার ভিতর দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও উপভোগ করা ছিল মার্জিতমনা বৈদগ্ধ্যের পরিচয়। দিনরাত্রি মুখরিত ছিল বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে ; নিয়তই আলোচনা চলত সেক্স্পিয়ারের নাটক নিয়ে, বায়্রনের কাব্য নিয়ে এবং তখনকার পলিটিক্সে সর্বমানবের বিজয়ঘোষণায়। তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস। সে বিশ্বাস এত গভীর ছিল যে একসময় আমাদের সাধকেরা স্থির করেছিলেন যে, এই বিজিত জাতির স্বাধীনতার পথ বিজয়ী জাতির দাক্ষিণ্যের দ্বারাই প্রশস্ত হবে।” কিন্তু এই বিশ্বাসের জায়গাটা যে অচিরেই ধ্বস্ত হয়ে গেল ও ব্রিটিশ শাসন শোষণ অত্যাচারের কদর্য রূপগুলি তাঁর চোখে ধরা পড়ল, তা তিনি জানাচ্ছেন। “নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন হতে একদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হল তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা – কিছু অত্যাবশ্যক তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধ হয় পৃথিবীর আধুনিক - শাসনচালিত কোনো দেশেই ঘটে নি। অথচ এই দেশ ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে তার ঐশ্বর্য জুগিয়ে এসেছে। যখন সভ্যজগতের মহিমাধ্যানে একান্তমনে নিবিষ্ট ছিলেম তখন কোনোদিন সভ্যনামধারী মানব – আদর্শের এতবড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারিনি; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভিতর দিয়ে বহুকোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্যজাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য।
যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত।”
শুধু ভারতবর্ষ নয়, আফিম ব্যবসা থেকে লাভের নেশায় আরেক জনবহুল ও প্রাচীন ঐতিহ্যের দেশ চীনকেও ধ্বস্ত করার কথাগুলি জুড়ে নিচ্ছেন নিজ দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। “ভারতবর্ষ ইংরেজের সভ্যশাসনের জগদ্দল পাথর বুকে নিয়ে তলিয়ে পড়ে রইল নিরুপায় নিশ্চলতার মধ্যে। চৈনিকদের মতন এতবড়ো প্রাচীন সভ্য জাতিকে ইংরেজ স্বজাতির স্বার্থসাধনের জন্য বলপূর্বক অহিফেনবিষে জর্জরিত করে দিলে এবং তার পরিবর্তে চীনের এক অংশ আত্মসাৎ করলে”।
ঔপনিবেশিকতার সঙ্কটকে শুধু শারীরিক অত্যাচার বা শোষণের মাধ্যমে আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার ব্যাপার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ দেখেননি। ঔপনিবেশিক শাসক তাঁর শাসনকে নিষ্কন্টক রাখার আগ্রহ থেকে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটিতে ফ্যাসিবাদের চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করেননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ফ্যাসিবাদের একটি বৈশিষ্ট্য যে মানুষে মানুষে বিভাজন, এবং দেশের একাংশের মানুষকে অন্য অংশের মানুষের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিয়ে শাসনকে নিষ্কন্টক রাখার চেষ্টা – তার বিপদটিকে নিজের দেশের প্রেক্ষিতে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। হিটলারের ক্ষেত্রে এটা ইহুদি বিদ্বেষের মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে নক্কারজনকভাবে ফুটে উঠেছিল বিশ্ব ইতিহাসে। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের বুকে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করে কী বিরাট ক্ষতি করেছে তা দ্বর্থ্যহীন ভাষায় বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। “সভ্যশাসনের চালনায় ভারতবর্ষের সকলের চেয়ে যে দুর্গতি আজ মাথা তুলে উঠেছে সে কেবল অন্ন বস্ত্র শিক্ষা এবং আরোগ্যের শোকাবহ অভাব মাত্র নয়; সে হচ্ছে ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ, যার কোনো তুলনা দেখতে পাইনি ভারতবর্ষের বাইরে মুসলমান স্বায়ত্তশাসন – চালিত দেশে। আমাদের বিপদ এই যে এই দুর্গতির জন্যে আমাদেরই সমাজকে একমাত্র দায়ী করা হবে। কিন্তু এই দুর্গতির রূপ যে প্রত্যহই ক্রমশ উৎকট হয়ে উঠেছে, সে যদি ভারত – শাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বস্তরে কোনো – রাএক গোপন কেন্দ্রে প্রশ্রয়ের দ্বারা পোষিত না হত তা হলে কখনোই ভারত – ইতিহাসের এতবড়ো অপমানকর অসভ্য পরিণাম ঘটতে পারত না।”
আমাদের দেশের যে সাম্প্রদায়িক সংকট আজ পর্যন্ত আমাদের সমাজের প্রধান সংকট হিসেবে আছে, তা যে গোটা বিশ্বের চেহারা নয়, মুসলমান – অমুসলমান দ্বন্দ্বের স্বাভাবিকতা দিয়ে সেকাল থেকে একাল অবধি অনেকে যাকে ব্যাখ্যা করেন, একেবারেই তা যে সত্য নয়, বরং শাসকের দ্বারা সৃষ্ট ও পুষ্ট এক অভিশাপ – তা এখানে স্পষ্টভাবে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বস্তুতপক্ষে এই সমস্যাটি নিয়ে বিশ শতকের চারটি দশক জুড়েই নিরন্তর ভেবেছেন তিনি।
সামাজিক বিভাজনের সমস্যা ও বর্ণহিন্দুদের তরফ থেকে মুসলিমদের নানাভাবে দূরে ঠেলে রাখা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো ব্যাপারগুলি থেকেই যে দুই সম্প্রদায় পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে অনেক জায়গায়, সেটা রবীন্দ্রনাথ নানা লেখায় সে সময় সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরেন।
“আমাদের দেশে যখন স্বদেশী-আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলেম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয়নি, বিরুদ্ধ ছিল। জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক। জানি, ওরা যোগ দেয়নি। কিন্তু, কেন দেয়নি। তখন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য! কিন্তু এতবড়ো আবেগ শুধু হিন্দুসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমানসমাজকে স্পর্শ করল না! সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয়নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি। সেটাকে রক্ষা করেও লাফ দিয়ে সেটা পার হতে হবে, এমন আবদার চলে না। এমন কথা উঠতে পারে যে, ডোবা তো সনাতন ডোবা, কিন্তু আজ তার মধ্যে যে দুশ্চিকিৎস্য বিভ্রাট ঘটছে সেটা তো নূতন, অতএব হাল আমলের কোনো একটা ভূত আমাদের ঘাড় ভাঙবার গোপন ফন্দি করেছে, ডোবার কোনো দোষ নেই, ওটা ব্রহ্মার বুড়ো আঙুলের চাপে তৈরি। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ভাঙা গাড়িকে যখন গাড়িখানায় রাখা যায় তখন কোনো উপদ্রব হয় না। সেটার মধ্যে শিশুরা খেলা করতে পারে, চাই কি মধ্যাহ্নের বিশ্রামাবাসও হতে পারে। কিন্তু, যখনই তাকে টানতে যাই তখন তার জোড়ভাঙা অংশে অংশে সংঘাত উপস্থিত হয়। যখন চলিনি, রাষ্ট্রসাধনার পথে পাশাপাশি রয়েছি, গ্রামের কর্তব্য পালন করেছি, তখন তো নাড়া খাইনি। আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তাঁর বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম, এ কেন, তখন জবাব পেলেম, যে-সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসাতেও হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে; অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে। জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তার পর ওদের ডেকে একদিন বলেছি, আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে। তখন হঠাৎ দেখি অপর পক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ মাথায় দিয়ে বলে, আমরা পৃথক। আমরা বিস্মিত হয়ে বলি, রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়। বাধা ঐ জাজিম-তোলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোটো নয়। ওখানে অকূল অতল কালাপানি। বক্তৃতামঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না।” (কালান্তর বইয়ের স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রবন্ধ)।
কালান্তর গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি ছাড়াও গোরা বা ঘরে বাইরের মতো উপন্যাসে এবং বেশ কিছু কবিতা গানে এই সংকট ও তার সমাধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। গোরা উপন্যাসে ধর্মীয় আইডেনটিটির জায়গা থেকে শুরু করে এর নায়ককে শেষপর্যন্ত ভারতবাসীর বড় আইডেনটিটির জায়গায় পৌঁছে দেন রবীন্দ্রনাথ। তবে ন্যাশানালিটির ধারণাটিও রবীন্দ্রনাথে খুব সরল বা একরৈখিক নয়। এমনকী জাতীয়তাবাদের ধারণাটির ওপর অতিরিক্ত জোর দিতে গিয়ে তার অতিরেক থেকে কী কী সমস্যা হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ সেই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বলেছেন।
সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে ভারতবর্ষীয় সামাজিক সদাচারের প্রসঙ্গে মনুসংহিতার উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “সিভিলিজেশন’, যাকে আমরা সভ্যতা নাম দিয়ে তর্জমা করেছি, তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সহজ নয়। এই সভ্যতার যে রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল মনু তাকে বলেছেন সদাচার। অর্থাৎ, তা কতকগুলি সামাজিক নিয়মের বন্ধন। সেই নিয়মগুলির সম্বন্ধে প্রাচীনকালে যে ধারণা ছিল সেও একটি সংকীর্ণ ভূগোলখণ্ডের মধ্যে বদ্ধ। সরস্বতী ও দৃশদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী যে দেশ ব্রহ্মাবর্ত নামে বিখ্যাত ছিল সেই দেশে যে আচার পারম্পর্যক্রমে চলে এসেছে তাকেই বলে সদাচার। অর্থাৎ, এই আচারের ভিত্তি প্রথার উপরেই প্রতিষ্ঠিত — তার মধ্যে যত নিষ্ঠুরতা, যত অবিচারই থাক। এই কারণে প্রচলিত সংস্কার আমাদের আচারব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়ে চিত্তের স্বাধীনতা নির্বিচারে অপহরণ করেছিল। সদাচারের যে আদর্শ একদা মনু ব্রহ্মাবর্তে প্রতিষ্ঠিত দেখেছিলেন সেই আদর্শ ক্রমশ লোকাচারকে আশ্রয় করলে।”
রবীন্দ্রনাথের সমকালেই আম্বেদকর ও দলিত আন্দোলনের তরফে মনুস্মৃতি পোড়ানোর ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের জাত ব্যবস্থা ও দলিতদের ওপর বহুযুগ লালিত কাঠামোগত অত্যাচারকে উপড়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তা থেকে। প্রশ্ন হল ভারতের জাতিয়তাবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদের মহড়া নিচ্ছে, তখনও জাতিয়তাবাদ এর মধ্যে উগ্রতার দিকটির বিপদ সম্পর্কে বেশ কিছু সতর্কতা উচ্চারণ করছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের সমাজের ভেতরকার বিভাজনগুলির সমাধান না করে জোর করে একটা ঐক্যবদ্ধ ন্যাশানালইজম তৈরি করার সমস্যাটি নিয়ে আম্বেদকর থেকে একালের সমাজবিদেরা অনেকেই ভেবেছেন। প্রসঙ্গত আমরা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘নেশন অ্যান্ড ইটস ফ্রাগমেন্টস’ রচনাটির কথা ভাবতে পারি। রবীন্দ্রনাথ নেশন ও ন্যাশানালিজম নিয়ে কীভাবে ভেবেছিলেন সেই সংক্রান্ত আলোচনার জন্য আমরা দেখতে পারি তাঁর ‘রাবীন্দ্রিক নেশন কী?’ বা ‘রাবীন্দ্রিক নেশন প্রসঙ্গে আরো দু চার কথা’ র মতো প্রবন্ধগুলি।
পরিশেষে আসা যাক রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদে জর্জরিত পৃথিবীর সামনে মুক্তির সামনে কোনো ভাবনার কথা বলেছেন। সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে ইউরোপের পরাশক্তির তথাকথিত সিভিলাইজেশন মিশনের বাগাড়াম্বর ও মিথ্যাচারকে রবীন্দ্রনাথ শয়তানি মনে করেছেন ও এককথায় তাকে খারিজ করে লিখেছেন, “পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি।” তবু মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে না চেয়ে তিনি আশা করেছেন, “একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।” কিন্তু তার পথটা কী ?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাশিয়া ভ্রমণের পর থেকেই যে রাশিয়ার নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন, তার বহু প্রমাণ রয়েছে ‘রাশিয়ার চিঠি’ নামের বইটিতে। রাশিয়ায় বলশেভিকদের নেতৃত্বে গোটা দেশ ও প্রভাবাধীন অঞ্চলে যে বিরাট মন্থন চলছিল, তা যে রাশিয়া ভ্রমণের সাময়িক আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, তার প্রমাণ রয়েছে দশ বছর পর জীবন সায়াহ্নে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ এর এই অংশে – “রাশিয়ার মস্কাও নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের আরোগ্যবিস্তারের কী অসামান্য অকৃপণ অধ্যবসায়—সেই অধ্যবসায়ের প্রভাবে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের মূর্খতা ও দৈন্য ও আত্মাবমাননা অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। এই সভ্যতা জাতিবিচার করে নি, বিশুদ্ধ মানবসম্বন্ধের প্রভাব সর্বত্র বিস্তার করেছে। তার দ্রুত এবং আশ্চর্য পরিণতি দেখে একই কালে ঈর্ষা এবং আনন্দ অনুভব করেছি। মস্কাও শহরে গিয়ে রাশিয়ার শাসনকার্যের একটি অসাধারণতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল – দেখেছিলেম, সেখানকার মুসলমানদের সঙ্গে রাষ্ট্র – অধিকারের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে অমুসলমানদের কোনো বিরোধ ঘটে না; তাদের উভয়ের মিলিত স্বার্থসম্বন্ধের ভিতরে রয়েছে শাসনব্যবস্থার যথার্থ সত্য ভূমিকা। বহুসংখ্যক পরজাতির উপরে প্রভাব চালনা করে এমন রাষ্ট্রশক্তি আজ প্রধানত দুটি জাতির হাতে আছে — এক ইংরেজ, আর – এক সোভিয়েট রাশিয়া। ইংরেজ এই পরজাতীয়ের পৌরুষ দলিত করে দিয়ে তাকে চিরকালের মতো নির্জীব করে রেখেছে। সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রিক সম্বন্ধ আছে বহুসংখ্যক মরুচর মুসলমান জাতির — আমি নিজে সাক্ষ্য দিতে পারি, এই জাতিকে সকল দিকে শক্তিমান করে তোলবার জন্য তাদের অধ্যবসায় নিরন্তর। সকল বিষয়ে তাদের সহযোগী করে রাখবার জন্য সোভিয়েট গভর্নমেন্টের চেষ্টার প্রমাণ আমি দেখেছি এবং সে সম্বন্ধে কিছু পড়েছি। এইরকম গভর্নমেন্টের প্রভাব কোনো অংশে অসম্মানকর নয় এবং তাতে মনুষ্যত্বের হানি করে না। সেখানকার শাসন বিদেশীয় শক্তির নিদারুণ নিষ্পেষণী যন্ত্রের শাসন নয়।” এই কথাগুলি থেকে বোঝা যায় সভ্যতার যে মডেলটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের (এবং পরবর্তীকালের মার্কিনী নয়া ধাঁচের সাম্রাজ্যবাদের) মধ্যে দিয়ে ফেরি করা হয়েছিল, তা শোষণ, উপনিবেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া, ও সেখানকার মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার কাজটাই কেবল করেছিল। অল্পের জন্য অধিকাংশের মেহনতের ফসল চুরি হওয়ার বিপরীত এক সার্বজনিক উন্নতির মডেল সোভিয়েত ব্যবস্থায় দেখার পর রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে একেই ভারতের উন্নতির পথ বলে স্বাগত জানাতে অসুবিধে হয়নি। এর মধ্যেকার কিছু সমস্যার কথা রাশিয়ার চিঠিতে উল্লেখ করেও দুটো দিক থেকে তাকে অনেক শ্রেয় বলে মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এক – রাশিয়ার ভেতরে সমাজের সব ধরনের মানুষের জীবনের ব্যবহারিক দিকগুলির; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুযোগ সুবিধার বিকাশ এবং দুই – প্রভাবাধীন অঞ্চলগুলিতেও একই ধরনের সুযোগ সুবিধে তৈরি করা, সেগুলিকে শোষণ না করা, সেখানে শাসন করার পদ্ধতি হিসেবে বিভাজন নীতি চালু না করা। সাম্প্রদায়িকতার সংকট বিদ্ধ ভারতের মাটিতে বসে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করছেন, “সেখানকার মুসলমানদের সঙ্গে রাষ্ট্র – অধিকারের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে অমুসলমানদের কোনো বিরোধ ঘটে না; তাদের উভয়ের মিলিত স্বার্থসম্বন্ধের ভিতরে রয়েছে শাসনব্যবস্থার যথার্থ সত্য ভূমিকা।”
সেই সময়ের মতো আট দশক পরে আজও ভারত যখন এই সব সমস্যার মধ্যে পড়ে আছে, নানা ধরনের পুরনো সমস্যা নতুন নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করছে, তখন সভ্যতার সংকটের এই বর্তমান মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথকে ফিরে পড়বার বিশেষ দরকার আছে।
৫ মে বাঁকুড়া জেলার হিড়বাঁধ ব্লকের বনগোপালপুরে পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু-র জন্মদিন পালন করা হয়। গ্রামবাসীদের উপস্থিতিতে তাঁর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। তারপরে এক আলোচনা সভায় তার জীবনকাহিনী নিয়ে আলোচনা করেন আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের রাজ্য নেতা সুধীর মুর্মু ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জি।
রঘুনাথ মুর্মু ছোট বেলা থেকেই সকলকে প্রশ্ন করতেন সব জাতি নিজের ভাষায় লেখাপড়া করতে পারলেও আদিবাসীরা পারে না কেন? বড়ো হয়ে তিনি বুঝতে পারেন এর কারণ হল তাদের ভাষার কোনো লিপি নেই। তিনি বুঝেছিলেন সাহিত্যের বিকাশ ছাড়া কোনো জাতির বিকাশ অসম্ভব আর এই সাহিত্যের বিকাশের জন্য দরকার লিপি। আর তাই তিনি অনেক পরিশ্রম করে তৈরি করেন নিজস্ব লিপি অলচিকি। তিনি এই লিপিতে ছোটদের ছড়ার বই থেকে শুরু করে ধারাপাত, নাটক, কাব্যগ্রন্থ লেখেন। অলচিকির প্রচার-প্রসারের জন্য ১৯৬০ সালে এএসসিইএ নামে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেন। স্বাধীনতার পর ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের সময় সাঁওতালদের আলাদা রাজ্য গঠনের জন্য ১৯৪৮ সালে উড়িষ্যার ময়ুরভঞ্জে তিনি সাঁওতালদের এক জমায়েতের ডাক দেন। স্বাধীন ভারতের পুলিশ এই জমায়েতে গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা করে এবং তাদের নেতা রঘুনাথ মুর্মু-র নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। যদিও মানুষ তাঁকে লুকিয়ে রাখে, পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি। সারা জীবন তিনি আদিবাসীদের হাসা-ভাষা-লায় লাকচারের জন্য লড়াই করে গেছেন। আজ আবার নতুন করে আদিবাসীদের হাসা-ভাষা-লায় লাকচারের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা। জল-জঙল-জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং লেখাপড়ার জগৎ থেকে তাদের বের করে দেয়ার ফন্দী করছে। তাই আজ নতুন করে লড়াইয়ের শপথ নিতে হবে।
৫ মে বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক কার্ল মার্কসেরও জন্মদিন। তিনি সমাজটাকে শুধু ব্যাখা করেই থেমে যাননি, তিনি নিপীড়িত জনতার স্বার্থে সমাজব্যবস্থাটাকে বদলে দেওয়ার পথেরও সন্ধান দিয়েছিলেন। বিশ্ব সর্বহারার সেই কান্ডারী কার্ল মার্কসেরও স্মরণ করা হয়।
৪ মে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল রাজ্য প্রশাসনকে দেওয়া চিঠিতে জানিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত্যুর হার অর্থাৎ কেস ফ্যাটালিটি রেট (সিএফআর) দেশের মধ্যে সর্বাধিক। এই সিএফআর হল মোট আক্রান্তে মোট মৃত্যুর অনুপাত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ৪ মে পর্যন্ত রাজ্যে মোট আক্রান্ত ১২৫৯, কো-মর্বিডিটি সহ মোট মৃত্যু ১৩৩, অর্থাৎ সিএফআর ১০.৫%। ভারতের যে রাজ্যগুলিতে করোনা সংক্রমণ সব থেকে বেশি, সেই মহারাষ্ট্রে যখন সিএফআর ৪%, গুজরাটে ৫.৫%, মধ্যপ্রদেশে ৫.৬%, তখন পশ্চিমবঙ্গে ১০%-র বেশি কেন?
গোটা বিশ্বে গড় সিএফআর এখন পর্যন্ত ৭.১%। সব থেকে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫.৮%। ভারতের জাতীয় গড় ৩.২%। তাহলে কি পশ্চিমবঙ্গে করোনা মহামারীতে ব্রিটেন, ইতালি, স্পেনের মতন মড়ক লেগে গেছে? বাস্তব চিত্রটা কিন্তু আসলে এতটা ভয়াবহ নয়।
মৃত্যুহার বেশি হওয়ার প্রধান কারণ পশ্চিমবঙ্গ কোভিড-১৯ পরীক্ষা বা টেস্টিং-এর হিসেবে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। গতকাল অবধি গোটা দেশে স্যাম্পেল টেস্ট হয়েছে ১১ লক্ষ ৯১ হাজার। এর মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ ৪৬ হাজার ৪৩৩। অর্থাৎ প্রতি ১০০টি টেস্ট পিছু ৪ জন পজিটিভ বেরিয়েছে। মহারাষ্ট্রে এবং গুজরাটে এখন পর্যন্ত প্রতি ১০০টি টেস্ট পিছু ৭ জন পজিটিভ বেরিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে গতকাল অবধি টেস্ট হয়েছে মাত্র ২৫১১৬, করোনা পজিটিভ ১২৫৯। অর্থাৎ ১০০ টি টেস্ট পিছু ৫ জন পজিটিভ বেরিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে পশ্চিমবঙ্গে করোনা সংক্রমণের হার জাতীয় হারের থেকে একটু বেশি হলেও মহারাষ্ট্র বা গুজরাটের মতন সর্বাধিক আক্রান্ত রাজ্যগুলির তুলনায় কম।
আসলে পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় সমস্যা কোভিড-১৯ পরীক্ষা বা টেস্টিং-এর অত্যন্ত মন্থর হার। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭%। অথচ গোটা দেশের মোট কোভিড-১৯ পরীক্ষার তুলনায় এখন অবধি পশ্চিমবঙ্গে পরীক্ষার অনুপাত মাত্র ২%।
সারা দেশে যেখানে গত কয়েকদিনে গড়ে প্রতিদিন ৭০ হাজার কোভিড-১৯ পরীক্ষা হচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে মাত্র ২০০০ করে। এর ফলে সমস্ত করোনা আক্রান্তদের সময় মতন চিহ্নিত করা হচ্ছে না। অথচ রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে কোভিড-১৯-এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল বেডের মাত্র ১৩% গতকাল অবধি ভর্তি হয়েছে। তাহলে পরীক্ষার হার বাড়ানোয় বাধাটা কোথায়। পরীক্ষার মন্থর হার নিয়ে ১৭ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখাতে নির্দেশ দেয়। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি। রাজ্য প্রশাসন ‘কো-মর্বিডিটি’ মাপার জন্য অডিট কমিটি বসিয়ে সময় নষ্ট করেছে, প্রকৃত তথ্য গোপন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এই জন্যেই আজ কেন্দ্রীয় দলের কাছে রাজ্য প্রশাসনকে সিএফআর নিয়ে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে।
দেশের বেশ কয়েকটি বড় রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারও এই বিষয়ে যে আত্মশ্লাঘা দেখিয়ে চলেছে সেটা বিপজ্জনক। এখন পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশে তুরস্ক, ইরান এবং চীনের পরে করোনা সংক্রমণে সব থেকে বেশি আক্রান্ত দেশ ভারত। দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ইত্যাদি বেশ কিছু এশিয়ার দেশ ইতিমধ্যেই সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। এতদিনের লকডাউন সত্ত্বেও ভারত সেটা পারেনি, মূলত বড় রাজ্যগুলির জন্য (কয়েকটি রাজ্য অবশ্য পেরেছে, যেমন কেরালা বা ওড়িশা)। এখন সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যেই সর্বত্র লকডাউন শিথিল করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি কোভিড-১৯ পরীক্ষার হার বাড়িয়ে প্রতিদিন অন্তত ৫০০০ টেস্ট না করতে পারে, তাহলে আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ অনেক বাড়বে। মৃত্যুর হার বা সিএফআর-এরও কোনো উন্নতি হবে না। টেস্টিং-এর হার আরও বাড়ানো নিয়ে দলমত নির্বিশেষে সকলেরই সোচ্চার হওয়া উচিৎ। নাহলে পরিস্থিতির অবনতি অনিবার্য।
তথ্যসূত্রঃ https://ourworldindata.org/coronavirus; https://www.wbhealth.gov.in/pages/corona/bulletin; https://www.mohfw.gov.in/
পশ্চিমবঙ্গে করোনা রোগে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে হেলথ সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন, পশ্চিমবঙ্গের বক্তব্য
বিশ্বজুড়ে করোনা অতিমারিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে চলেছে। আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম নয়, আশঙ্কা এই অতিমারি দীর্ঘায়িত হবে। এই সঙ্কট মোকাবেলায় প্রয়োজন সঠিক বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা ও তার সার্থক প্রয়োগ। পরিকল্পনা ও প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও পরিসংখ্যান প্রস্তুতি। সেখানে ভুলভ্রান্তি থেকে গেলে কোনো মতেই সঠিক বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্য প্রকৌশল নির্মিত হতে পারে না। তথ্য ও পরিসংখ্যানের মধ্যে রয়েছে আক্রান্তের সংখ্যা, আক্রান্তের হার, মৃত্যুর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার, মোট কত জনের পরীক্ষা হল, কতজন রোগাক্রান্ত চিহ্নিত হল, কতজনের কি কি চিকিৎসার প্রয়োজন হল বা হল না, কতজন সুস্থ হল, সুস্থ হতে কতদিন সময় লাগল, রোগমুক্ত ঘোষণা করতে কতজনকে কতবার পরীক্ষা করতে হল, কতজন পুনরায় রোগাক্রান্ত হল ইত্যাদি প্রভৃতি। তথ্য সংগ্রহ ও পরিসংখ্যান প্রস্তুতি যত সঠিক হবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল নির্মাণ তত বাস্তবসম্মত ও প্রায়োগিক হবে। এর ব্যতয় সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর, একান্তই অবাঞ্ছিত।
সারা বিশ্বেই করোনা রোগে বয়স্ক মানুষ বিশেষ করে যাদের বয়সজনিত রোগ যেমন ডায়াবেটিস, কিডনী, লিভার, হৃদরোগ আছে পরিভাষায় যাকে কো-মর্বিডিটি বলা হয় তাদের রোগ গুরুতর ও জটিল হয়ে যায় ও বহুক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটে। এসব রোগ যাদের থাকে তারা বিভিন্ন চিকিৎসা ও পরিবর্তিত জীবন শৈলীর নিয়ম মেনে দীর্ঘকাল প্রায় স্বাভাবিক, সার্থক ও উপার্জনশীল জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু করোনার আকস্মিক আক্রমণ এদের শরীরের প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করে জীবনহানি ঘটায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এদের মৃত্যুকে করোনা সংক্রমণের কারণে মৃত্যু বলে চিহ্নিত করাটাই স্বাভাবিক রীতি ও পদ্ধতি। আ-বিশ্ব এটাই স্বীকৃত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ তাদের সাম্প্রতিক নথিতে করোনা রোগীর মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারিত করেছে। যে কোনো চিকিৎসাগত অসুখে মৃত্যু, যেক্ষেত্রে সম্ভাব্য অথবা নিশ্চিত রূপে করোনা ভাইরাসের প্রভাব রয়েছে, সে সব ক্ষেত্রেই করোনা রোগে মৃত্যু হিসাবে বিবেচিত হবে, যদি না কোনো স্পষ্ট বিকল্প কারণ (যেমন দুর্ঘটনা জনিত আঘাত ইত্যাদি) নিশ্চিত রূপে উপস্থিত থাকে। প্রতিটি মৃত্যুর শংসাপত্রেও আন্তর্জাতিক রোগ শ্রেণীবিভাগ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট ও সার্বজনীন কোডিং পদ্বতি (International Classification of Disease-10), অনুসরণ করা আবশ্যিক ও বাধ্যতামূলক। এই আন্তর্জাতিক নিয়মকে অস্বীকার করে অমান্য করে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অসত্য তথ্য পরিবেশিত হতে দেখতে পেলাম আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে। করোনা আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যায় অবমূল্যায়ন ঘটানোর উদ্দেশ্যে মৃত্যুর সংখ্যায় কো-মরবিটির তত্ত্ব আমদানি করে করোনা সংক্রান্ত মৃত্যুকে কো-মরবিডিটি বা সংশ্লিষ্ট রোগে মৃত্যু হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে।
এ কথা ঠিক যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো পুরানো ও ক্রনিক অসুখে (ক্যান্সার ইত্যাদি) মৃত মানুষের করোনা টেস্ট পসিটিভ এলে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ নির্ণয়নে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সে সব ক্ষেত্রেও মৃত্যুর কার্যকারণে করোনা ভাইরাসের কোনরূপ প্রভাব থাকলে তা করোনা রোগে মৃত্যু হিসাবে বিবেচিত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। আমরা মনে করি মহামারীর সময় সন্দেহসূচক ক্ষেত্রে, মৃত্যু হারের অবমূল্যায়নের থেকে কিছুটা সম্ভাব্য অতিমুল্যায়ন বরং বাঞ্ছনীয়। এবং এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
দুঃখের বিষয়, অতিমারীর এই চূড়ান্ত সংকটকালে, করোনা মৃত্যুর হারের অবমুল্যায়নের যে প্রবৃত্তি ও প্রবণতা প্রশাসনের তরফে দেখা যাচ্ছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিষয়টির সাথে আমাদের রাজ্য, দেশ তথা সমগ্র মানবসমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত; যা একই সঙ্গে প্রকাশ করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি ও সংস্কৃতির পরিচয়কে। এছাড়াও মৃত্যুর সঠিক ও যথাযথ কারণ নির্ধারণ ও তার প্রত্যায়িত পঞ্জিকরণ মৃতের পরিবারের পরবর্তী জীবনযাপনের বহু সংশ্লিষ্ট বিষয়কে প্রভাবিত করে।
১) রোগ মহামারীর যথাযোগ্য নিয়ন্ত্রণকল্পে উপযুক্ত পরিকল্পনায় সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও তার নিরপেক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। এর সাথে যুক্ত হয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন, জীবিকা এবং দেশ তথা সমগ্র মানব সমাজের ভবিষ্যৎ। মহামারীর তীব্রতা ও ভয়াবহতাকে কৃত্রিম ভাবে অবমূল্যায়ন করে সাময়িক স্বস্তি হতে পারে, কিন্তু তা সমাজের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করে।
২) মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে মৃতের পরিবার বীমার ক্ষতিপূরণে অসুবিধায় পড়তে পারেন, যা একেবারেই কাম্য নয়।
৩) করোনা চিকিৎসায় সামনের সারিতে যেসব চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী ও অন্যান্য কর্মচারিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন; তাদের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বীমার প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এদের মধ্যে চল্লিশ ঊর্ধ্ব প্রচুর ব্যক্তি রয়েছেন, যারা প্রকৃতই অত্যন্ত বিপদের সম্মুখীন। কর্তব্যরত অবস্থায় এদের অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক মৃত্যুতে, মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে বীমা রাশির থেকে এদের পরিবার বঞ্চিত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা অতীতেও দেখেছি মানুষের অকাল ও অনভিপ্রেত মৃত্যু নিয়ে সরকারী দায় ও দায়িত্ব অস্বীকার এবং প্রকৃত পরিস্থিতিকে লঘু করে দেখানোর অনেক উদাহরণ। দেশ ও রাজ্যে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাগুলি তার মধ্যে অন্যতম। আমরা আশা করবো, পশ্চিমবঙ্গ সরকার উপরিউক্ত বিষয়গুলি গুরুত্বের সাথে বিচার বিবেচনা করবেন এবং এই মহামারীর মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ও সহানুভূতির নিদর্শন রাখবেন।
কথায় বলে, যা ঘটবার, সেটা ঘটবেই। এই মুহূর্তে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা মহামারী, সেই আপ্ত বাক্যটিকে বার বার মনে করাচ্ছে। বেড়েই চলেছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা। মৃত্যু ইতোমধ্যে দুই লাখ আটান্ন হাজার অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। সকলের পাখির চোখ, বৃদ্ধির এই “সংখ্যার” উপর। মূলত আমেরিকা, ইতালি, ইংল্যান্ড ও স্পেন হয়ে ভারতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে। মিডিয়ার ফোকাসও ঐ দিকে। স্বাভাবিক। কারণ বিশ্বের ধনীতম দেশগুলিতে দ্রুত হারে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের “নেই রাজ্যের” দেশের রথী-মহারথীদের হৃদ কম্পন না ঘটিয়ে পারে? যাঁদের ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন সবই ইউরোপ, http://www.ba.cpiml.net/Deshabrati/2020/05/china-and-covidআমেরিকাকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তাঁরা তো বিচলিত, শঙ্কিত হবেনই। ধনতন্ত্রের স্বর্গ মার্কিন সাম্রাজ্যে মৃত্যুর তীক্ষ্ম ঊর্ধ্বমুখী প্রবনতায় বিশ্ব হতবাক। লকডাউনের ফলে কোটি কোটি মানুষের মর্মন্তুদ জীবন যন্ত্রনায় স্বপ্নাহত সেই মানুষগুলি কিন্তু নির্বাক। ভয়ার্ত পরিসংখ্যানের ঘূর্ণিপাকে আমাদের ভাবার সময় নেই, চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশ, এমনকি ছোট্ট রাজ্য কেরল কি ভাবে রুখে দিল কোবিড-১৯ এর গতি। তাদের থেকে শিক্ষা নিলে “করোনা ভীতি” যে প্রশমিত হয়ে যায়। আসুন, করোনার গতি-প্রকৃতি, আতঙ্ক ও তার প্রতিরোধে কিছু দেশের ব্যর্থতা আর কিছু দেশের সাফল্যকে বুঝে নেই বিজ্ঞানের আলোকে।
জীব ও তার পরিবর্তনশীলতার পথ ধরেই করোনা ভাইরাসের (কোভ) আগমন, প্রবাহ ও আক্রমণ। কোভের সাথে এক ধরনের বাদুড়ের সম্পর্ক প্রায় ৫৫ কোটি বছর (কো-ইভোল্যুশন) ধরে। যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে মেক্সিকো অঞ্চলের শুকরের সম্পর্ক। নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের, সুনির্দিষ্ট প্রাণীই ভাইরাসের পোষক। প্রাণহীন, চলচ্ছক্তিহীন, এই পারমাণবিক পদার্থটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় কোনো প্রাণীকোষে প্রবেশ করলে। একাধিক ভিন্ন জাতের প্রাণী এদের পোষক হতে পারে। ভাইরাস সংক্রমণে ভাইরাসের একটি গোষ্ঠীকে বিবেচনা করা হয়।
ভাইরাস প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর সে নিজেই স্বয়ম্ভূ। নিজেই নিজের স্রষ্টা হয়ে ওঠে। তৈরি করে একের পর এক আপন প্রতিলিপি (রেপ্লিকেশন)। কিছু ভাইরাস (আরএনএ ভাইরাস) রেপ্লিকেশনকালে নিজেদের গঠনে (জিন) পরিবর্তন(ড্রিফট) ঘটায়। এইভাবে ভাইরাসটি কোন প্রাণীর মধ্যে তার একাধিক ভিন্ন ধরণের প্রতিলিপি (স্ট্রেন) তৈরি করে। এই অনুলিপিগুলির সম্মিলিত রূপই গোষ্ঠী। এক বা একাধিক ভিন্ন অনুলিপি বহু মানুষকে একই সময় সংক্রমিত করতে পারে (এপিডেমিক)।
আবার ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর (ধরি ভাম) মধ্যে ঐ ভাইরাসের কোন অনুলিপির সাথে এক (ধরি বাদুড়) বা একাধিক (ধরি মানুষ) পোষক প্রাণী থেকে আসা সেই ভাইরাসের ভিন্ন স্ট্রেনের সংযুক্তিতে ভাইরাসটির গঠনের (জিনের) আমূল পরিবর্তন (শিফট) ঘটতে পারে। তৈরি হয় শক্তিশালী নূতন উপপ্রজাতির ভাইরাস। অনেকটা পৌরাণিক গল্পে বর্ণিত দুর্গার সৃষ্টির মত। একাধিক অনুলিপির টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে এই নূতন ধরণের (মহা) ভাইরাসটির উৎপত্তি।এরাই বিশ্বজুড়ে মহামারী (প্যানডেমিক) ঘটায়।
পোষক প্রাণীর নামেও ভাইরাসকে চেনা যেতে পারে। যেমন শুকর, ইঁদুর, বাদুড়, পাখি বা মানুষের ভাইরাস।পরিবেশের পরিবর্তন, বন নিধন, নগরায়ণ মানুষকে নানা ধরণের বুনো প্রাণী ও তাদের দেহে থাকা ভাইরাসের সংস্পর্শে নিয়ে এসেছে। এই পথেই কোভের সাথে মানুষের নিবিড়তা।
কোভের প্রথম আক্রমণ দক্ষিণ চীনে ২০০২ সালে (সার্স কোভ-১)। বাদুড়>ভাম>মানুষ>মানুষ হয়ে চীন থেকে আরও ২৬টি দেশে। দ্বিতীয় হানা ২০১২-তে। আরব সাম্রাজ্যে “মার্স কোভ” নামে। এখানে মধ্যবর্তী প্রাণী ভামের বদলে উট। উটের দুধ থেকে মানুষে। বিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুনলেন। ২০১৫-তে গবেষকরা আশঙ্কা করলেন কোভের ভয়ঙ্কর ভাবে ফেরার সম্ভাবনা (সূত্র : নেচার মেডিসিন, নভেম্বর, ২০১৫)। আশঙ্কা সত্যি হলো ২০১৯-এ, কোভ-১৯-এর হাজিরায়, চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে। বাদুড়>প্যাঙ্গোলীন>মানুষ>থেকে মানুষে। উহান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামজাদা বানিজ্যিক শহরে। এই সকল শহর থেকে শহরে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ নাগরিকের আসা যাওয়া, কোভ প্রবাহের গতি সূত্র।
করোনা কোনো নূতন ভাইরাস নয়। সাধারণ সর্দি-কাশির শতকরা ত্রিশ ভাগ করোনা ভাইরাসের জন্য ঘটে। সুদীর্ঘ সময় ধরে (কয়েক শত বছর) মানব দেহ এদের চেনে। ফলে মানুষের শরীর এদের প্রতিরোধ করতে পারে। কোভিড-১৯ সম্পূর্ণ নবাগত। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ার সময় মানব দেহ পায়নি। বিজ্ঞানীরাও সময় পাননি প্রতিষেধক তৈরি করার। তাই বিনা বাধায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
কোভ-১৯ প্রথম ছড়ায় উহান ও তার সংলগ্ন শহরে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রায় এক মাস ধরে ভাইরাসটির গতি প্রকৃতি, বিস্তার পদ্ধতি, সংক্রমন ও মারণ ক্ষমতার ভাষ্য চলেছে দুনিয়া জুড়ে। এইভাবে ভাইরাসটির বিপদ ও তাকে প্রতিরোধ করার প্রাথমিক ধারণা চীন থেকে বিশ্ববাসী জেনে যায়। ১১ মার্চ, ২০২০ হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন) করোনাকে প্যান্ডেমিক ঘোষণা করে। কিন্তু ভোগ বাণিজ্যে মত্ত দুনিয়া ভাইরাসটির বীভৎসতা জানার পরও নির্লিপ্ত রইলো। কিছুদিনের মধ্যেই ধনতন্ত্রের স্বর্গ রাজ্যগুলিতে কোভে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগলো।
প্রশ্ন হলো কেন এই নির্লিপ্ততা। জেনে বুঝে কেন মৃত্যুপুরীর বিলাসিতা? আসলে বাজার অর্থনীতির মাধ্যাকর্ষণে আবর্তিত দেশগুলির পক্ষে বিশাল মাত্রার ক্রেতার উপস্থিতিকে কয়েকটা মৃত্যুর জন্য (প্রাথমিক পর্যায়ে) উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যে বাজারের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পর্যটন শিল্প। যে শিল্পের বাজারে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করেন প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ক্রেতা।
মূলত আমেরিকা, চীন, ইংল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও ভারত এই তিনটি বাজারের কম বেশি দাবিদার। কয়েকটা তথ্য দিয়ে সংক্ষেপে আমরা বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করব। প্রসঙ্গত, বাণিজ্যের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে এই আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।
** আমেরিকা : ২০০৭-এ ৭.৫ লাখ, ২০০৮-এ প্রায় ১০ লাখ, ২০১৭-তে ১.৪ মিলিয়ন আমেরিকান বিদেশে যান (আউট বাউন্ড) চিকিৎসার জন্য। ২০১৭-তে ৫.৫ লক্ষ বিদেশি আমেরিকা আসেন (ইন বাউন্ড) চিকিৎসা করাতে। ঐ বছর আউট বাউন্ড খরচ বাদ দিয়ে মোট উদ্বৃত্ত ছিল ৪০৪.০ মিলিয়ন থেকে ০১ বিলিয়ন ডলার। প্রসঙ্গত, এদেশের বিভিন্ন কর্মী বিনিয়োগ সংস্থার কর্তাদের লক্ষ্য কর্মীদের জন্য আউট সোর্সড চিকিৎসার দিকে। স্পেকুলেশান ও লক্ষ্য এই আয়কে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ১৬০.৮ বিলিয়ান ডলারে পৌঁছানো। ২০১৭-তে স্বাস্থ্যের বিশ্ববাজারে মোট মেডিক্যাল টুরিস্ট সংখ্যা ছিল ১৪ থেকে ১৬ মিলিয়ান। (সূত্র : The American j. of medicine, January 01, 2019)
** স্বাস্থ্য বাজারে ভারত : ক্রম প্রসারমান অভ্যন্তরীণ বাজারের ২০২০-তে ভারতের লক্ষ্যমাত্রা ৩.৯ বিলিয়ন ডলার।গত তিন বছরের থেকে ২৭.০ পার্সেন্ট বেশি। ২০১৭-তে ভারতে বিদেশি রুগীর (ইন বাউন্ড) সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ। এছাড়া আছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। এপ্রিল ২০০০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৬ অব্দি যার পরিমাণ হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক কেন্দ্রে ৪.১ বিলিয়ন এবং ডাক্তারি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ১.৪ বিলিয়ন ডলার।
**চীনের অবস্থান : ২০১৮ : আউট বাউন্ড রুগী : ১৬০ মিলিয়ন। ইন বাউন্ড রুগী : ১০ লাখের বেশি।
স্বাস্থ্যের পর শিক্ষা সবচেয়ে বেশি বিক্রয় যোগ্য পণ্য। তাই বাজারও বেশ তেজি। ২০১৯-এ বিশ্ব বাজারে উচ্চ শিক্ষার মোট মূল্য ছিল ৬৫.৪০ বিলিয়ন ডলার। এই বাজারের পঞ্চাশ ভাগ আমেরিকার দখলে। বিগত তিন বছর ধরে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে ঐ দেশে পড়তে গেছেন ১০ লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রী। ২০১৭-তে মার্কিন জাতীয় আয়ে শিক্ষা বিক্রি থেকে আয় ছিল ৪২.৪ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে চিন ও ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি ছাত্র শিক্ষা কিনতে যান। ২০১৬-তে ভারতের যোগান ছিল তিন লাখের বেশি।
বিশ্ব বাণিজ্যের মোট আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ আসে পর্যটন শিল্প থেকে (২০১১)। ২০১২-তে আন্তর্জাতিক পর্যটক সংখ্যা ছিল ১.০৩৫ বিলিয়ন। ২০১৮-তে পর্যটন বানিজ্য থেকে ভারতের আয় ছিল জিডিপির শতকরা ৯.২ ভাগ। ২০১৯-এ প্রায় ৭০ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক যাত্রী ভারতে অবতরণ করেন। পর্যটন শিল্পে ফ্রান্স, স্পেন, ইউএস, চীন, ইতালি, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশগুলি সামনের সারিতে।
এই তিনটি বাজারে মানুষের বিপুল স্রোত যেমন করোনা ভাইরাসের আন্তর্জাতিক বাহক, অন্যদিকে বাজারের ভর কেন্দ্র অর্থাৎ বানিজ্য শহরগুলি ভাইরাসের গতিমুখ। আবার বাজার থেকে মুনাফার স্রোতকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আত্মস্থ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এক লহমায় একে রুখে দেওয়া কার সাধ্য? তাই আমরা বলতেই পারি, কোভিড-১৯ বাজার অর্থনীতির গর্ভজাত জারজ। অবাঞ্ছিত হলেও অনিবার্য।
(ক) ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যান্ডেমিক : আমরা কোন নূতন ঘটনাকে বিচার করি পুরোনো অভিজ্ঞতার নিরিখে। ভাইরাস জনিত মারী বা মহামারীর ধারণা ১৯১৮-১৯-এ ইনফ্লুয়েঞ্জা ঘটিত প্যান্ডামিক থেকেই। ডাকনাম “স্প্যানিশ ফ্লু”। এই অতিমারীতে সারা বিশ্বে মারা যান ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ। ভারতে ১৮ মিলিয়ন। সমুদ্রপথে গুজরাট হয়ে ভারতে এই ফ্লু প্রবেশ করে। এরপর ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ইনফ্লুয়েঞ্জা স্ট্রেন বিশ্ব মহামারী ঘটায়। ১৯৫৭-৫৮ এশিয়ান ফ্লু-র উৎপত্তি চীনে। মৃত্যু হয় গোটা বিশ্বে ১.১ মিলিয়ন মানুষের। আমেরিকায় ৭০ হাজার থেকে ১.১৬ লক্ষ। ১৯৬৮- ৬৯ হংকং ফ্লু। সারা বিশ্বে মৃত্যু হয় ১০ লক্ষের বেশি মানুষের। আমেরিকায় এক লক্ষ। ২০০৯-১০-এ সোয়াইন ফ্লু। ভয়ঙ্করতম এবং প্রথম আক্রান্ত দেশ ছিল আমেরিকা ২০০৯, এপ্রিলে। এক বছরে সেখানে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২,৪৬৯। গোটা বিশ্বে ২,৮৪,০০০।
(খ) সিজনাল ফ্লু : প্যান্ডেমিকের মধ্যবর্তী বছরগুলিতে ইন্ফ্লুয়েঞ্জাকে “সিজনাল ফ্লু” বলা হয়। সতত বিবর্তনীয় ভাইরাসটির বিভিন্ন ভাইরাল স্ট্রেন-এর ফলে উন্নত বিশ্বে প্রতি বছর “সিজনাল ফ্লু”-তে মৃত্যুর সংখ্যা ভয়াবহ। যদিও এর ভ্যাকসিন আছে। মানুষের দেহে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে নিজস্ব ইমিউনিটিও আছে। তবুও ২০১৭-১৮-তে এই ফ্লুতে গোটা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তিন থেকে ছয় লাখ। ২০১৯-এ প্রায় দুই লাখ। উন্নত দেশ গুলোর তথ্য কি?
আমেরিকা :
২০১৭-১৮ : আক্রান্ত ৪৫ মিলিয়ন ---- মৃত ৮০ হাজার
২০১৮-১৯ : আক্রান্ ৩৫ মিলিয়ন --- মৃত ৩৪ হাজার
প্রতি বছর শীতকালে গড়ে ১২ থেকে ৫৬ হাজার।
ইউরোপ ইউনিয়ন : মৃত – বছরে ৪০ হাজার।
ইতালিতে এই সংখ্যা সর্বাধিক।
২০১৪-১৫ : মৃত – ২০ হাজারের বেশি।
২০১৬-১৭ : মৃত – ২৫ হাজার।
পক্ষান্তরে, সাধারণ ফ্লুতে ভারতে মারা যান ২০১৭-তে ২২৬৬ জন। সিংহভাগ গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাধারণ ফ্লুতে এত মৃত্যুতেও সারা বিশ্ব চুপ কেন। বিষয়টা যেন মিডিয়ার গোচরেই নেই। কিন্তু ফ্লু ও কোভিড-১৯ দুজনেরই সংক্রমন পদ্ধতি, প্রবাহ একই রকম। দুজনেরই মারণ ক্ষমতা নজরকাড়া। কোথাও এ বেশি, তো কোথাও ও বেশি। সহজাত ইমিউনিটি, ভ্যাকসিন থাকা সত্বেও এত বছর ধরে ফ্লুতে এত মানুষ মারা গেলেন, তবু আমরা শুনিনি “সোশাল ডিসটেন্স”, “আইসোলেসন”, “কোয়ারিন্টিন” শব্দগুলি। যেগুলি “সিজনাল ফ্লু”র ক্ষেত্রেও সত্য। এই নিস্তব্ধতার নিখুঁত উত্তর হয়তো সময় বলবে। তবে বিস্রস্ত সমাজ আমতা আমতা করে বলতে পারে, “ফ্লু সয়ে গেছে। ওটাই স্বাভাবিক”। তবে সম্ভাব্য সঠিক যে উত্তর প্রথমেই আসে, ওসব করে পুঁজির গতিকে থামানোর চিন্তা? অসম্ভব। ধনতন্ত্র প্রেমীদের কাছে এই ভাবনা দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
মুনাফার স্রোত পুঁজিবাদের একমাত্র লক্ষ্য। সামাজিক নিষ্ঠুরতা যে তার চালিকা শক্তি। তবে সার্স-২ কোভিডের ক্ষেত্রে এরা সক্রিয় হলেন কেন? গেল গেল রব কেন? এটাও ঠিক। তবে অনেক দেরিতে। মাসাধিক কাল পর। ৩০ জানুয়ারী “হু” থেকে কোভিডকে “গ্লোবাল হেলথ ইমার্জেন্সি” ঘোষণা করা হয়। অনেক গড়িমসি ও টালবাহনার পর, পুঁজির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে পুঁজির প্রতিভুদের সরে আসতেই হলো। দ্রুতহারে উন্নত বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে নিজের মানুষরাও (শ্রেণী) যে বিপন্ন হতে পারে! ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নিজেই আক্রান্ত হলেন। ট্রাম্প সাহেব নিজেরই পরীক্ষা করতে ছুটলেন। তাঁরা শুনতে বাধ্য হলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত, ‘করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা মানুষের শরীরে নেই। ভ্যাকসিনও নেই। সংক্রমণের হার ও মারণ ক্ষমতা “সিজনাল ফ্লু” থেকে এই ভাইরাসের বেশি। আপাত দৃষ্টিতে সেরকম ধারনাই যে তৈরি হয়।’
**আমেরিকা : ট্রাম্প প্রশাসন বুঝলেন এই অজানা ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে, পাবলিক হেলথ এজেন্সির সাহায্য নিতেই হবে। আসলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমেরিকায় “ঠুঁটো জগন্নাথ”। প্রাইভেট স্বাস্থ্য ব্যবসার স্বর্গরাজ্য আমেরিকায় প্রতি বছর স্বাস্থ্যবীমার অভাবে মারা যান প্রায় ষাট হাজার আমেরিকান। মুনাফার কি কোন সামাজিক বা মানবিক মুখ থাকতে পারে? সরকারী দপ্তর সক্রিয় হতেই চিহ্নিত হতে লাগল একের পর এক করোনা আক্রান্ত রুগী। ইউরোপ, আমেরিকা জুড়ে মৃত্যুর মিছিলে সন্ত্রস্ত শাসকশ্রেণী অস্বাভাবিকভাবে স্ববিরোধিতায় টেনে ধরলেন বাজারের লাগাম!
**ইংল্যান্ড : চলুন ধনতন্ত্রের আরেক স্বর্গ রাজ্যে। এখানে সকলের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের। তবু দেশটা কিন্তু ধনবাদের স্বার্থে। ফল, মৃত্যু : ২১ হাজার। প্রথম আক্রান্ত ধরা পরে ৩১ জানুয়ারী। ২৩ মার্চ পর্যন্ত সরকার নির্বিকার। কোনো বিধিনিষেধ নেই। বরং দেখা যাচ্ছে ১১ মার্চ হু’র প্যাণ্ডেমিক ঘোষণার দিন, চাম্পিওন লীগের খেলায় পঞ্চাশ হাজারের জমায়েত। ১২ মার্চ কোন এক শহরে ঘোড় দৌড়ে দুই লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত। ফাটকা পুঁজির এটাই তো চরিত্র। ২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বরিস বলেই ফেললেন, “করোনাকে আটকাতে যাঁরা বাণিজ্য আটকাতে চাইছেন, তাঁদের রুখে দিয়েই আমরা ‘মুক্ত বাণিজ্যের’ সুপার হিরো হবো”। বিজ্ঞান মন্ত্রকের এক বরিষ্ঠ উপদেষ্টা সাধারণ নাগরিকদের গিনিপিগ ভেবে ঠেলে দিতে চাইলেন কোভের সংক্রমনে। এতে নাকি সকলের অনাক্রম্যতা (হার্ড ইমিউনিটি) তৈরি হবে! নিষ্ঠুরতার এই অনন্য নজির খুঁজতে হয়তো ফিরে যেতে হবে হিটলারের জার্মানিতে। এই দুটি দেশের নমুনা দিয়েই আমরা বোঝার চেষ্টা করব ভারতের কান্ডারিদের।
**চিত্র ভারত : ভারতে প্রথম আক্রান্তের খোঁজ মেলে ৩০ জানুয়ারী। দুদিন পরেই আরও দুজন। কেরলে। প্রত্যেকেই উহান ফেরত ছাত্র। সেদিন থেকেই কেরল প্রশাসন ‘হু’য়ের গাইড লাইন মেনে তৎপর হলেন করোনার মোকাবিলায়। তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন ২৩ জানুয়ারী থেকে উহান প্রদেশে লকডাউন শুরু হওয়াকে। তাঁরা মান্যতা দিয়েছেন ৩০ জানুয়ারী হুর “সমস্ত দেশকে করোনা প্রতিরোধে তৈরি থাকার” নির্দেশকে।
প্রশ্ন আসে, চীন থেকে বছর শেষের ছুটিতে কি মাত্র তিনজন ছাত্র ভারতে ফিরেছিলেন? যেখানে শুধু ২০ হাজারের বেশি ডাক্তারি ছাত্র আছেন? কেন্দ্রীয় সরকারের সেই ভাবনার সময় কোথায়। তাঁরা তখন ব্যস্ত সওদাগর ট্রাম্প সাহেবের আবাহন পরিকল্পনায়। শাসক শ্রেণীর চিন্তায় তখন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কূট কৌশল।
কেরল থেকে শিক্ষা নেওয়া দূরের কথা, ১৩ মার্চ ট্রাম্প সাহেবের নকলে প্রধানমন্ত্রী নির্দ্বিধায় বললেন, “করোনা নিয়ে কোনো ইমারজেন্সি নেই”। কিন্তু বাস্তব ছিল ৪ মার্চ ১৪ জন ইতালি ট্যুরিস্ট এবং ৯ থেকে ১৩ মার্চ মহারাষ্ট্রে ৩১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তখন চলছে নানা ধর্মের উৎসব ও জমায়েত। ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ছয় দিনের মধ্যেই ঘোষণা করলেন, “২২ মার্চ জনতা কার্ফু”। কেউ তখনো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি ১৪ ঘণ্টার মধ্যেই সবাইকে হতচকিত করে ঘোষণা হতে চলেছে “তালাবন্দী”। ১৩৮ কোটির দেশে সব রাজ্যে এক সাথে। বিপদে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ। অবিমৃষ্যকারিতা নাকি মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যাকর্ষণে সকলকে একই সময়ে থামার বাধ্যতা। লক্ষণীয় আমেরিকা ২১, ইংল্যান্ড ২৩ এবং ভারতে ২৪ মার্চ লকডাউন শুরু হয়।
(ক) কভিড-১৯ দেখিয়ে দিল
(১) পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা, দুর্যোগ মোকাবিলায় কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও সমগ্র মানব সমাজের নেতৃত্ব দেবার অক্ষমতা। তার নিজের শ্রেণীও উদ্বিগ্ন, মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত। দীর্ঘকাল ধরে লালিত আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক মানসিকতা তাদেরকে নিজের শ্রেণীরই ঘাতকে পরিণত করেছে।
(২) দেখালো এক অভূতপূর্ব সংকট। আমাদের জানা আছে পুঁজিবাদের অতি উৎপাদন জনিত সংকট। এবার দেখলাম সংকটে পুঁজির বাজার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিক্রির চাহিদা থাকা স্বত্বেও। যে বাজারে পুঁজিপতিদের পুঁজির বড় রকমের উৎস সাধারণ মানুষের সঞ্চয় পুঁজি এবং ধার নেওয়া অর্থ (লোন); স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভ্রমণ কেনার জন্য। হাজির হলো এমন একটা সময়, যখন এক দিকে এই সব বাজারে সঞ্চয় পুঁজির বহমান যোগান ও তৎজনিত মুনাফার হাতছানি, অন্য দিকে করোনা আতঙ্কে বাজার বন্ধের বাধ্যতা। পুঁজিপতি ও তাদের রাষ্ট্র হতচকিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এ যেন সোনার পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আহরণে অক্ষম কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ী! ভরা পেটে ব্যুফে টেবিলের সামনে অসহায় কোনো ভোজনবিলাসী। ঠিক যেন টান্টালাস কাপের গল্প। কোভিড রুগী এখন মুনফার উৎস নয়, মৃত্যুর পরোয়ানা!!
(** বাজারের ক্রমপ্রসার, প্রকৃতির অবলুপ্তি ঘটিয়ে মানবজাতির অস্তিত্বকে নানা পথে সংকটাপন্ন করছে। ভাইরাসকেও সান্নিধ্যে নিয়ে এসেছে। এই আলোচনায় এই বিষয়টাকে বাদ রাখা হয়েছে।)
(৩) সার্স-২ দেখাল সমাজের উপরতলার মানুষের আতঙ্ক কিভাবে গোটা সমাজটাকে দ্রুততার সাথে গিলে নেয়। আতঙ্ক থেকে অবিশ্বাস, দূরত্ব। মানুষই মানুষের কাছে ভয়ের উৎস। সন্দেহের বাতাবরণ। মানুষ মানুষকে নিয়ে শঙ্কিত। সহমর্মিতা নয়, মমত্ব শূন্যতা। আন্তরিকতার বদলে নিষ্ঠুরতা। বাঘা বাঘা সংবাদ মাধ্যমে একদিকে আমেরিকা ও ইউরোপের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা, অপরদিকে সরকার নির্ধারিত সতর্কতায় নজর না দেওয়া মানুষদের লাগাতার প্রচার, ভয় ও বিদ্বেষের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে চলেছে। মানসিকতার এই উর্বর পটভূমিই তো খুঁজে বেড়ায় ধর্মীয় মৌলবাদ বা উগ্রজাতিবাদের প্রতিভূরা। এদের কাছে এটাইতো “আচ্ছে দিন”!
(৪) ধনিক শ্রেণী বিজ্ঞানকে ততক্ষণই মান্যতা দেয় যতক্ষণ সেই বিজ্ঞান মুনাফা অর্জনে সহায়তা করে। বিজ্ঞান যদি মুনাফা অর্জনের প্রতিবন্ধক হয়, পুঁজিপতিরা তখন সাহায্য নেন অপবিজ্ঞান, কল্পবিজ্ঞান প্রভৃতির। প্রয়োজনে ধর্মান্ধতা, জাতি ঘৃণা প্রভৃতি। পুঁজিপতিরা তাদের প্রতিনিধি হিসাবে বেছে নেন খামখেয়ালী, স্বাভিলাসী, সতত মিথ্যাচারী, অতিআত্মম্মন্যতা দর্শী (মেগালোমেনিয়াক) প্রভৃতি অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতার রাজনীতিকদের।
(৫) এই ধরনের বিপদ প্রতিরোধের আবশ্যক ও প্রাথমিক শর্ত “একক ব্যক্তির সুরক্ষা”। আবার “ব্যক্তির সুরক্ষা”ই “সমাজ সুরক্ষার” প্রধান শর্ত। “ব্যক্তির সুরক্ষা” দাবি করে তাঁর দৈহিক সক্ষমতা (ইমিউনিটি), বিজ্ঞান মান্যতা ও সমাজ মনস্কতা।
(খ) করোনা ভাইরাস শিক্ষা দিল :
(১) প্রতিটি ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও গ্রামস্তরে স্বাস্থ্য সচেতনতা, সকলের অংশ গ্রহণ (কমিউনিটি পার্টিসিপেশন) ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার উন্নত সমাজের জরুরী শর্ত। মুনাফা নয়। মানবিকতাই হতে পারে তার চালিকা শক্তি।
(২) প্রতিটি দেশের জীব-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার গবেষকরা করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে সচেষ্ট। বিশ্বের সকল নাগরিকের স্বার্থে এই নিরলস প্রচেষ্টা দাবি করে বিজ্ঞানই হোক সকল নাগরিকের পথপ্রদর্শক।
(গ) কর্পোরেট জগৎ স্বপ্ন দেখতেই পারেন ভ্যাকসিন তৈরি করে মুনাফা লুঠের। এটাই তাঁদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাঁদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই (১) গঠনের সতত পরিবর্তন ঘটানো ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন সম্পূর্ণভাবে কার্যকরী নয়। সেই কারণেই ভ্যাকসিন থাকা সত্বেও “ফ্লু”তে ২০১৭-১৮-তে শুধু আমেরিকাতেই আশি হাজার মানুষ মারা গেছেন। (২) বিবর্তনের নিয়মেই, কোনো নূতন প্রজাতির কিংবা নূতন উপপ্রজাতির ভাইরাস আগামীদিনে আক্রমণ শানবেই। আজকের মতো সেদিনও সেই মুহূর্তে কোনো ভ্যাকসিন থাকবে না। সামাজিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে আবার মরণ ও আতঙ্কের পুনরাবৃত্তি। কোভিড ও ফ্লু থেকে মানুষ এই জ্ঞানটুকু ইতিমধ্যেই আয়ত্ত করেছেন।
শুরুতেই বলি, চীন ল্যাবরেটরিতে একটা জীবাণু যুদ্ধের অস্ত্র বানিয়ে তাদের নিজেদের দেশে বা বাকি বিশ্বে ছেড়ে দিয়েছে এরকম আজগুবি থিওরিতে আমি বিশ্বাস করি না। হোমিনিড-রা পৃথিবীতে আসার পর বার বার ভাইরাল প্যানডেমিকে তারা প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে হতে টিঁকে গেছে। মানুষের জিনোমের একটা বড় অংশ হল তার কোষে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আপাত ঘুমিয়ে পড়া রেট্রোট্রান্সপোজন যা আদতে এইচআইভি-র মতো ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণের জিন-ইতিহাস। তা ছাড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় ভাইরাসের অনন্যতা পোষকের ইমিউনিটিকে এড়িয়ে যাবার ক্ষমতায়। ছোটখাটো মিউটেশনের ফলে অ্যান্টিজেনিক বদল বা ড্রিফট ঘটিয়ে সে অহরহই মানুষের অ্যান্টিবডিভিত্তিক শারীরবৃত্তীয় ‘স্মৃতি’কে ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া, বেশ কিছুদিন অন্তর অন্তর দুই বা ততোধিক টাইপের ফ্লু-ভাইরাস মানুষ বা অন্য কোনও অন্তর্বর্তী বাহকে জিন আদানপ্রদান করে সম্পূর্ণ নতুন অ্যান্টিজেনিক ধর্ম অর্জন করে হয়ে উঠছে নভেল। যেমন হয়েছে কোভিড ১৯-র ক্ষেত্রে। একে বলে অ্যান্টিজেনিক শিফট। ড্রিফট সামলে নেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ কেন না সেটা হল প্রতারিত স্মৃতির গল্প। শিফট নিয়ে সমস্যা বেশি কেন না নভেল বলে মানুষের দেহে তার ‘স্মৃতি’ থাকার অবকাশটাই হয়নি। মানুষের কোষ যে বহুমাত্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবাণুদের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে ঘোড়ার আড়াল নেওয়া গ্রিক সৈন্যদের মত ঠকিয়ে নভেলরা আমাদের লিখিত ইতিহাসকালেই বার বার ঢুকে পড়ছে আমাদের দেহে এবং বহু মৃত্যুর কারণ হয়েছে। ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু কেবল একটিমাত্র উদাহরণ নয়।
এতদিনে আমরা সবাই জেনে ফেলেছি যে করোনাভাইরাস হল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অতি নিকট আত্মীয় এবং এটিও এর আগে দু-দুবার মহামারী ঘটিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে ২০০২-০৩ এর SARS (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) নিয়ে আমাদের একটু বিস্তৃতে আলোচনা করতে হবে কেন না সেটিরও এপিসেন্টার ছিল চীন। আমরা দেখতে চাই এবারের এই কোভিড-১৯ অতিমারীর উদ্ভব ও বিস্তারে চিনের ভূমিকাকে সত্যিই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় কি না!
২০০২-০৩ সালের চীন হল তিয়েন আনমেন সঙ্কটকালের পরবর্তী চীন। ইনফরমেশন শেয়ারিং নিয়ে বাকি দুনিয়া চীনকে বিশ্বাস করতে ভরসা পাচ্ছে না। SARS মহামারীতে সরকারী হিসাব অনুযায়ী চীনে আক্রান্ত হয় পাঁচ হাজারের বেশি লোক আর মারা যায় ৩৪৯। এর প্রভাবে চীন ঘরে ও বাইরে দুভাবেই অস্থিরতার সম্মুখীন হয়। এমন কি পার্টিও রেকর্ড করছে “the health and security of the people, overall state of reform, development, and stability, and China’s national interest and international image are at stake” [[১]]। SARS এর প্রথম রোগীর খবর পাওয়া যায় গুয়াংডং প্রদেশের ফরশান শহর থেকে ২০০২ এর নভেম্বর মাসে। কিছুদিনের মধ্যেই আশেপাশের আরও দু একটা শহর থেকে একটা “স্ট্রেঞ্জ ডিজিজ”-এর খবর আসতে শুরু করে। কিন্তু গুয়াংঝাউতে কেন্দ্রীয় কমিটি প্রথম এক্সপার্ট পাঠায় ২০ জানুয়ারী ২০০৩। সরকারীভাবে প্রেস করা হয় ১১ ফেব্রুয়ারী ২০০৩ এবং লোকে জানতে পারে যে রোগ একটা হয়েছে তবে সেটা ‘কম্প্রিহেনসিভলি আন্ডার কন্ট্রোল’। SARS-এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত হল SARS-CoV নামের একটি ভাইরাস যা করোনাভিরিডি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই দেরির ফলে যা হল তা হচ্ছে এই যে, রোগটিকে দেশের ও দেশের বাইরের মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হিসাবে ঘোষণা করার আগেই একাধিক দেশে SARS-জনিত মৃত্যুর খবর পাওয়া যেতে থাকল। ১১ এপ্রিল ২০০৩-এ WHO সর্বপ্রথম SARS-কে ‘গ্লোবাল হেলথ হ্যাজার্ড’ হিসাবে সতর্কীকরণ ইস্যু করে এবং বিমানযাত্রাই যে এটির ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ – এই মর্মে একটি অ্যাডভাইসরি ইস্যু করে। এপ্রিলের ২৬-২৭ তারিখে বেইজিং শহরে শুরু হয়ে যায় আংশিক লকডাউন কেন না ততদিনে রোগটির এপিসেন্টার সরে এসেছে সেখানে। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারান্টাইন, ট্রান্সমিশন চেইন অর্থাৎ সংক্রমণ শৃঙ্খলটির পথ ও গতি রুদ্ধ করার যে সমস্ত উপায়গুলি আজ সারা বিশ্ব জুড়ে অনুসৃত হচ্ছে তার সব কটিই চীন অতঃপর যে দ্রুততার সঙ্গে লাগু করে তাকে একটা ক্রুসেড বলাই সমীচীন। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুটোই অচিরেই নিয়ন্ত্রণে আসে। জুন ২০০৩-এর মধ্যে বিশ্বের ২৯টি দেশের প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ সংক্রামিত হন এবং তাদের মধ্যে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয় অর্থাৎ মৃত্যুহার দাঁড়ায় ৯.৪ শতাংশ। যদিও ২০০৪-এর মে মাস অবধি বেইজিং থেকে SARS আক্রান্তের খবর মিলেছে চিন সরকারের সূত্রে। যদি মনে হয় ২০০২ নভেম্বরে SARS-এর প্রথম হদিশ পাওয়া থেকে সেটার অস্তিত্ব ২০০৩-এর জানুয়ারি মাসে সরকারিভাবে স্বীকার করা এবং নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাগুলো নিতে তাদের দ্বিধা এপ্রিল পর্যন্ত বিলম্বিত হওয়ায় এই মহামারীতে এতগুলো প্রাণ গিয়েছিল, তা হলে এটাও মনে রাখতে হবে যে সেটাই ছিল করোনাভাইরাসঘটিত প্রথম মহামারী। এর মোকাবিলায় প্রাথমিক হতচকিত অবস্থা কাটিয়ে চীন সেটির নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল সেগুলোই পরবর্তীকালের এইরকম পরিস্থিতির মুখে পড়ে বাঁচবার গাইডলাইন হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
লক্ষ করার কথা এই যে, চীনের এবারের প্রতিক্রিয়াকাল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ডিসেম্বরের গোড়ায় প্রথম সংক্রমণের খবর পেয়ে WHO-কে জানাল তারা ৩১শে ডিসেম্বর। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা জীবাণুর সংক্রমণজনিত প্রতিক্রিয়াকাল হিসাবে এই মাসখানেক সময়কে অতি দীর্ঘ বলা ঠিক হবে না। সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষে হচ্ছে কিনা, এটি করোনা ভাইরাসের নতুন কোনও প্রকরণ কিনা, সেটির জিনোমের বিশ্লেষিত প্রকৃতি SARS-CoV-এর অনুরূপ না ভিন্নতর ইত্যাদি বুঝে উঠে সেটিকে নভেল হিসাবে চিহ্নিত করার পক্ষে সময়টা খুব বেশি এটা চীনের অতি বড় শত্রুও বলতে পারবেন না। ডিসেম্বর মাসেই উহান ফুড মার্কেটে সংক্রামিত মানুষের লালারস নিয়ে, মেটাজিনোমিক নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং টেকনিক ব্যবহার করে। তারাই সনাক্ত করে যে এটি নভেল বা সম্পূর্ন নতুন একটা করোনাভাইরাস SARS-Cov-2।
জানুয়ারীর মাঝামাঝি থেকে তারা রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে ব্যবস্থা নেয় তা অভূতপূর্ব বললেও কম বলা হবে। প্রাথমিক হিসেব বলছে যদি ২৩ জানুয়ারী তারিখের লকডাউন না হত তাহলে সে দেশের ৫০ কোটি মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হত। একজন কোভিড-১৯ সংক্রামিত মানুষ কোনও নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাবিহীন স্বাভাবিক পরিবেশে গড়ে আড়াই থেকে তিন জন সুস্থ লোককে সংক্রমিত করতে পারে। চীনের লকডাউন দেখাল জানুয়ারীর ৩০ তারিখেই সে হার ১.০৫-এ নেমে এসেছে, যেটাকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা এপিডেমোলজিস্ট অ্যাডাম কুচারস্কি বলছেন – অ্যামেজিং। মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এ সংখ্যায় জল আছে- আদতে তা অনেক বেশি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এপিডেমোলজিস্ট ক্রিস্টোফার ডাই বলছেন – কত বেশি? যদি ধরা যায় আসলে সংক্রামিতের সংখ্যা এ সময় সরকারী সংখ্যার তুলনায় ২০ থেকে ৪০ গুণও বেশি ছিল, তা হলেও মানতে হবে চীন তাদের দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। দেখে শুনে WHO বলছে – চীন ধন্যবাদার্হ।
সব ঠিক আছে, কিন্তু প্রায় সকলেই এ কথাও মেনে নেবেন যে লকডাউন যদি আরও আগে করা যেত তা হলে চিনে এবং চীনের বাইরে অবশ্যই এ হার অনেক কম হতে পারত। সাউদহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মডেল বলছে চীন মাত্র এক সপ্তাহ আগে তৎপর হলেই সে দেশে সংক্রমণ হার ৬৭ শতাংশ কমে যেত আর জানুয়ারীর প্রথম থেকেই তৎপর হলে তারা কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা তুলনায় ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারত [[২]]। ইতালি, চীন এবং আমেরিকার বৈজ্ঞানিকদের একটি মিলিত সমীক্ষা বলছে উহান থেকে ট্র্যাভেল ব্যান লাগু করতে চীন চারদিন দেরী করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বলছেন তাঁরা যে ট্র্যাভেল ব্যান চালু করে চীন থেকে সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাযুক্ত প্রতি পাঁচজন বাহকের মধ্যে চারজনকে তারা ওই দেশেই আটকে রাখতে পেরেছে [[৩]]।
একটু দেখে নেওয়া যাক, কী হত যদি চীন জানুয়ারির প্রথমদিন থেকেই অন্তঃদেশীয় ও আন্তর্জাতিক ট্র্যাভেল ব্যান লাগু করতে পারত? আমরা সবাই জেনে গেছি ইতিমধ্যেই যে করোনা-লিঙ্কের একদম কেন্দ্রে আছে হুবেই প্রদেশের প্রধান শহর উহান। গুগল করলে ২০১৮-র সেন্সাস ডেটা দেখতে পাওয়া যায় – অধিবাসীর সংখ্যা ১.১১ কোটি। প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার কারণে এবং শিল্প-বাণিজ্যের ক্রমপ্রসরমানতার জন্য চীনের বিভিন্ন প্রান্তের লোক রোজ উহানে আসেন, থাকেন, যাতায়াত করেন। দুটি নদী – ইয়াংজি এবং হান, অনেকগুলি লেক ও পার্ক এবং ফুড মার্কেট উহানকে ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবেও পূবের বিশ্বে উল্লেখযোগ্য জায়গা দিয়েছে। সম্ভবত ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই উহানের হাসপাতালগুলি এমন কিছু রোগী পেতে শুরু করে যাদের লক্ষণ ভাইরাল নিউমোনিয়া বা অজানা জ্বরের মতো এবং এও লক্ষ করা যায় যে প্রচলিত কোনও ওষুধেই এ জ্বর সারছে না। ডিসেম্বরের শেষাশেষি শনাক্তকৃত এমন রোগী ছিল ওদের হিসেবে ডজনখানেক, জনস হপকিন্স ইউনিভারসিটির হিসেবমতে তখনই তা হাজারের নীচে নয়। হয়ত তখনই কম্যুনিটি স্প্রেড হয়ে গেছে, কিন্তু চীনের প্রশাসকেরা নিজেদের জনতাকেই প্রথম অ্যালার্ট করে বছরের শেষে – ৩০শে ডিসেম্বর। সে দিনই তারা WHO-কে জানায় এমন একটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বটে তবে তা “প্রিভেন্টেবল অ্যান্ড কনট্রোলেবল”! এ কথাও মানতে হবে যে, করোনার বিশ্বপরিক্রমার জন্য এর চেয়ে সুসময় আর কিছু হতে পারত না। এটা চৈনিক ক্যালেন্ডারের নববর্ষ উদযাপনের সময়। মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে দেখা যাচ্ছে শুধু পয়লা জানুয়ারীতেই এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার লোক উহান থেকে বেরিয়ে দেশের এদিক ওদিক গেছে। জানুয়ারীর ২১ তারিখে চীন প্রথম খোলসা করে যে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হচ্ছে কিন্তু ততদিনে বেইজিং, সাংহাই সহ অন্যান্য বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর দু-দিনের মাথায় তারা উহান শহর লকডাউন করে এবং অচিরেই আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ততদিনে করোনার বীজ পৌঁছে গেছে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। নিউ ইয়ারের ছুটিতে হাজার হাজার মানুষ উহান থেকে উড়ে গেছে বিভিন্ন গন্তব্যে। ৯০০ জনের একটি দল গেছে নিউ ইয়র্কে, ২২০০ মানুষ গেছে সিডনিতে, ১৫০০০ গেছে ব্যাঙ্ককে এবং করোনার চীন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার খবর পাওয়া যেতে থাকে সিঙ্গাপুর, সিওল আর সিয়াটল থেকে। অনুমান করা যায়, এই ভ্রমণার্থীদের মধ্যে তখনও বহু লোক এমন ছিল যাদের মধ্যে রোগের লক্ষণ নেই বটে তবে রোগ তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দেশে দেশান্তরে। SARS-এর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কেন যে চীন ট্র্যাভেল ব্যান লাগু করতে এতটা দেরী করল আর কেন যে WHO তার পরেও একমাস বসে রইল বাকি বিশ্বকে সতর্ক করতে, তা ব্যাখ্যা করা কঠিন।
এখানেই আর একটা কথা চলে আসে প্রাসঙ্গিকভাবে। ২০০২-০৩ এর SARS মহামারীর পরে চীন দেশ জুড়ে একটা প্রযুক্তিনির্ভর অ্যালার্ম সিস্টেম চালু করেছিল যেটাকে অভ্রান্ত এবং সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে সক্ষম বলেই ওরা ভাবত এবং SARS পরবর্তী যে কোনও আউটব্রেকের ক্ষেত্রে এটাকেই তারা ফ্রন্টলাইন ইমিউনিটি বলে ভেবে নিয়েছিল বলে মনে হয়। অর্থাৎ মানুষের হাড়ে-মজ্জায়-রক্তে-মাংসে অনাক্রম্যতার যে অমোঘ সঙ্কেতগুলি মহামারির পূর্বাবস্থা ঘোষিত করে তার চেয়ে প্রযুক্তিগত সঙ্কেতের উপর তাদের ভরসা ছিল বেশি [[৪]]। দেখাই যাচ্ছে সিস্টেমটা প্রত্যাশামাফিক কাজ করতে পারেনি। অনুমান করা যায় স্থানীয়ভাবে যখন চিকিৎসকরা মনে করছিলেন নতুন একটি ভাইরাল সংক্রমণের হদিশ পাচ্ছেন তাঁরা, তখন তার প্রযুক্তিগত সমর্থন নেই সিস্টেম থেকে। ঠিকঠাক কাজ করলে এই সিস্টেম থেকে বেইজিং খুব দেরী হবার আগেই জানতে পারত কী আসতে চলেছে। চীনের ন্যাশানাল ডিজিজ রিপোর্টিং সিস্টেম (NDRS) হল এমন একটা নেটওয়ার্ক যা দেশের ১৪০ কোটি মানুষের প্রতিজনকে পঁয়ত্রিশটি সংক্রমণযোগ্য অসুখের পরিপ্রেক্ষিতে নজরে রাখতে পারে। এটাকে এক ধরনের মাস সার্ভেলেন্স নেটওয়ার্ক বলা যেতেই পারে কেন না প্রতিটি মানুষের রোগসংক্রান্ত তথ্য তার ন্যাশানাল আইডিভিত্তিক তথ্যের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া চীন সারা দেশে ১৪৫টি ডিজিজ সার্ভেলেন্স পয়েন্ট (DSP)-এর মাধ্যমে র্যান্ডম স্যামপ্লিং-এর সাহায্যে বয়স, লিঙ্গ, অন্য ধরনের অসুস্থতা, জীবিকা, রোজগার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে যে কোনও জায়গার মানুষের গড়পড়তা সংক্রমণ প্রবণতার একটা হদিশ দিতে পারে বলেই বিশ্বাস ছিল SARS পরবর্তীকালে। কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রে এই সিস্টেম ব্যর্থ হয়েছে আগত দুর্যোগের আগাম হদিশ ঠিক সময়ে দিতে, কিন্তু মানতেই হবে বহুলাংশে সফল হয়েছে ভাইরাসের ট্রান্সমিশন চেইনকে রুখে দিতে। এই নেটওয়ার্ককে তারা জুড়ে দিয়েছে একটি কনট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ-এর সঙ্গে যা কেন্দ্রীয় ডেটা ব্যাঙ্কে জমা হওয়া তথ্যের মাধ্যমে মানুষকে ভাগ করে দিচ্ছে সবুজ-হলুদ- লালে। আপনার হাতের স্মার্টফোনে থাকা অ্যাপটি আপনাকে জানিয়ে দেবে মেট্রোয় যার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সে আপনার পক্ষে নিরাপদ (সবুজ) না কি আপনার সরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয় (হলুদ) না সে ইতিমধ্যেই সংক্রামিত। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা যা চীন করেছে, সে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং-ই হোক বা কন্ট্যাক্ট ইনহিবিশন (সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং কথাটা ভালো লাগে না), লকডাউনই হোক বা চেইনব্রেকিং– সবকটাই আজ বাকি বিশ্বে অনুসৃত হচ্ছে। হার্ড ইমিউনিটির প্রবক্তা বরিস জনসন বা ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও শেষ পর্যন্ত তাদের দেখানো পথেই হাঁটতে হয়েছে। পথ হিসাবে সেটাই যে ষোল আনা গ্রহণযোগ্য সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। যদি তাও হয়, তাহলে তা মেনে নিয়েও বলতেই হচ্ছে চীন যদি আর কয়েকদিন মাত্র আগে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, তাদের নববর্ষের আগে উহান থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে পারত তা হলে SARS-Cov-2-এর বিশ্বভ্রমণ বহুলাংশে আটকানো যেত।
চীনের বিরুদ্ধে আর যে অভিযোগ সঙ্গতভাবেই তোলা যায় তা হল তাদের একাংশের খাদ্যরুচি যা নিশ্চিতভাবেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী। করোনা প্যান্ডেমিকের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবত এই প্রথমবার বেইজিং মেনেও নিয়েছে এই কথা। বেইজিং ইনস্টিটিউট অফ মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড এপিডেমোলজির প্রখ্যাত দুই বিজ্ঞানী নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁদের সাম্প্রতিকতম গবেষণাপত্রটিতে অন্তত প্রকৃতিবিরূপ খাদ্যরুচির কথা পরোক্ষে মেনে নিয়েছেন [[৫]]। তাঁরা বলছেন বাদুড় হল এই করোনাভাইরাসের একমাত্র স্বাভাবিক পোষক যার থেকে মানুষে এই সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং বাদুড় আর মানুষের মাঝে আরও দু-তিনটে ইন্টারমিডিয়েট বাহক থাকতেই পারে। এর পরেই তাঁরা যা বলেছেন তা খাদ্যরুচির নিরিখে চীনের প্রতি বাকি পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিযোগের নিরিখে প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা বলছেন “If wild animals are not treated well, humans may be punished by nature.” নেচার-এর মতো পত্রিকায়, কোনও বিজ্ঞান সন্দর্ভ পেশ করতে গিয়ে এরকম উপসংহার ব্যক্ত করাকে খাদ্যরুচির সঙ্গে অতিমারির সম্পর্ক স্বীকার করে নেওয়া বলেই মনে করি। আশা করাই যায় চীন এরপর থেকে তাদের মানুষের খাদ্যরুচিকে প্রকৃতি-বিরূপতার মানদণ্ডে যাচাই করে দেখবে এবং সেভাবেই তাদের দেশের মানুষকে প্রণোদিত করবে। এই লেখা যখন লিখছি তখন জানা যাচ্ছে ফেলাইন অর্থাৎ বাঘ-বিড়াল ফ্যামিলির প্রাণীও নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এহ বাহ্য, বিড়াল তো আইনসম্মতভাবে সে দেশে ভক্ষ্য আর বাঘের মাংসের যৌনক্ষমতা বিবর্ধক হিসাবে চীনে প্রবল চাহিদা আছে। বিজ্ঞানীদের হুইসল তারা শুনলে হয়!
কিন্তু ভাইরাল প্যানডেমিকের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এবং ফ্লু-জাতীয় ভাইরাসগুলির মিউটেবিলিটি বা জিনগত পরিবর্তনশীলতা অর্জনের ক্ষমতা মাথায় রাখলে বলে দেওয়া যায় – মানুষ বিপন্ন বটে তবে এই শেষবার নয়। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমাদের জন্য আরও অনেক বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করে আছে। SARS-CoV-2-এর টীকা অচিরেই বেরিয়ে যাবে কিন্তু তা দিয়ে অনাগত SARS-CoV-3 বা অন্য কোনও গোকুলে বাড়তে থাকা ভাইরাসকে দমিয়ে রাখা যাবে না যদি ঠিক সময়ে ঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া যায়। ঠিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে চিন উদাহরণ হতে পারে, কিন্তু সময় ও প্রাণীবাহিত সংক্রমণের নিরিখে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই গেল।
তথ্যসূত্র:
[[১]] https//www.ncbi.nim.nih.gov >books
[[২]] https://www.nature.com/articles/d41586-020-00741-x
[[৩]] https://doi.org/10.1126/science.aba9757
[[৪]] https://www.nytimes.com/by/steven-lee-myers
[[৫]] https://www.nature.com/articles/s41423-020-0407-x
(লেখাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম নামক ই প্ল্যাটফর্ম থেকে গৃহীত। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।)
দেশব্যাপী লকডাউনের দ্বিতীয় কিস্তি শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ আগে (১৫ এপ্রিল, ২০২০)। সকলেই চিন্তিত। দুশ্চিন্তায় সাধারণ মানুষের অনেকেরই ঘুম ছুটেছে, বহু মানুষের ঘরে বসে অতিরিক্ত বিশ্রামের ফলেও। অপরদিকে অনেক মধ্যবিত্তও আছেন যারা কাজ হারানোর ভয় পাচ্ছেন। সারা ভারত জুড়ে যে কুড়ি কোটি কৃষি বহির্ভুত অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে শ্রমিকরা রয়েছেন তাদের মধ্যে যারা ঘরে ফিরতে পেরেছেন তাঁরা চিন্তায় আছেন, লকডাউন উঠে গেলে আবার কাজ পাবেন কিনা, আর যারা বাইরে আটকে আছেন, এক ঘরে ৬-৮ জন বন্দী দশায়, তাঁরা ভাবছেন, কবে মুক্তি পেয়ে ঘরে ফিরবেন। কর্পোরেট কর্তারাও চিন্তিত, আপাতভাবে দেশের জন্য, আসলে মুনাফার জন্য। এখনকার কর্পোরেট জগতে কোম্পানির প্রত্যেকটি বিভাগই মুনাফা কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়, আর কর্পোরেট কর্তারা নিজ নিজ বিভাগের মুনাফার পরিমাণ দ্বারা মূল্যায়িত হন। তাই মুনাফাই সব, দেশপ্রেমে মুনাফা হলে তাই সই অথবা মুনাফা দ্বেষপ্রেমে হলেও কোনো ক্ষতি নেই। ফলে সকলেই চাইছেন কাজ শুরু করতে, মুখে বলছেন দেশের অর্থনীতির কথা, মনের কথা দেবা ন জানন্তি। আমাদের দন্ডমুন্ডের কর্তা সরকারও দুশ্চিন্তামগ্ন, ভান করছে কিনা বলতে পারব না। তবে দেশের সব প্রতিবাদ প্রতিরোধকে ঘরে ঢোকানোর সুযোগ পেলে দুশ্চিন্তার থেকে সুচিন্তার আধিক্যই স্বাভাবিক।
লকডাউনের বিস্তার, প্রসার ও সংকোচন একাদিক্রমে ঘোষণা হয়েছে। অর্থাৎ, ২১ দিনের লকডাউনকে আরো ১৯ দিন বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে ২০ এপ্রিল মানে ৫ দিন পর থেকে সেক্ষত্রে কিছু এলাকায় বেশ কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং অনেকগুলি কোভিড প্রবণ এলাকাকে স্পর্শকাতর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে লকডাউনকে অধিক কঠোর করা হয়েছে। দ্য ওয়্যারের তরফ থেকে করণ থাপারকে দেওয়া ভারতের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক শঙ্কর আচারিয়ার একটি ভিডিও সাক্ষাতকার থেকে জানা যাচ্ছে যে, যে সমস্ত স্থানগুলি হটস্পটের অন্তর্ভুক্ত সেইসব স্থানেই অর্থনৈতিক কাজকর্মের ৬০% কেন্দ্রীভূত আছে ও সেখানকার সংস্থাগুলি ব্যাঙ্ক ঋণের ৮০% এর খাতক। অর্থাৎ মূল অর্থনৈতিক কাজকর্মের স্থানগুলিই হটস্পটের অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষও ওই হটস্পটেই বাস করে। অপরদিকে, লকডাউনের যে শিথিলতা তা এতটাই জটিল ও বিমূর্ত যে সেব মেনে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। ফলত, ২১ দিনের লকডাউনে অনুমিত কাজকর্মের মাত্রা ৪০-৫০ শতাংশ ছিল, সঙ্কুচিত লকডাউনে সেই কাজের স্তর বেড়ে ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ হতে পারে। ফলে যে অর্থনৈতিক জটিলতার মধ্যে দেশের অর্থনীতি তলিয়ে যাচ্ছিল সেই জটিলতা কাটিয়ে ওঠার কোন রাস্তা নতুন লকডাউনের নিয়ম দেখাতে পারছে বলে মনে হয় না।
ভারতে যে এত বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক আছে, যাদের ছাড়া দেশটাই অচল হয়ে যাবে, এবং যারা এক মনুষ্যেতর জীবন যাপন করে সে ব্যাপারে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল ছিল না তা মার্চের শেষ সপ্তাহ জুড়েই বোঝা গিয়েছিল। ওই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকরা যে দেশের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল প্রধানমন্ত্রী ও মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট সরকার যখন ১৪ তারিখ পর্যন্ত ঘরে ফেরার জন্য অধীর প্রতিক্ষারত শ্রমিকদের কথা না ভেবেই মোদিজি লকডাউনের সময় বাড়িয়ে দিলেন, আর মুম্বাইএর বান্দ্রায় ঘরে ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের উপর লাঠি চালাল মুম্বাই পুলিশ। একই সময়ে অর্ধভুক্ত অভুক্ত শ্রমিকদের জোর করে আটকে রাখা হল সুরাটে। যখন এই নিবন্ধ লেখা হচ্ছে সেই সময়ে দেশে কোভিড ১৯ এ মৃত মানুষের সংখ্যা ৬৫০ ছাড়িয়েছে। তবে করোনাভাইরাস জনিত লকডাউনের কারণে মৃত শ্রমিকদের কোনো পরিসংখ্যান সরকার দেয় না। এ বিষয়ে ৩ জন গবেষক জি এন তেজেশ, কণিকা ও আমন একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেছেন। পূর্নাঙ্গ প্রতিবেদন সম্ভব নয়, কিন্তু লকডাউনের ফলে অন্তত ২০০ জনের মৃত্যুর তালিকা গবেষকরা তৈরি করেছে। মোদির নয়া ভারতবর্ষে কেবল ঘরে ফেরার আকাঙ্খায় শ্রমিক মরছে। ভারতীয় জনতা পার্টির রামরাজত্বে, ছত্তিশগড়ের বিজাপুরের ক্ষুধার্ত আদিবাসী পরিবারের ১২ বছরের একমাত্র কন্যা জামালো মাকদাম তেলেঙ্গানায় কাজ করতে যায়, আর লকডাউনের মধ্যে পড়ে ১৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ঘরে পৌঁছানোর ১২ কিলোমিটার আগে ক্ষুধা তৃষ্ণায় শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যের অভাবে মারা যায়। জামালো একই সাথে থাপ্পড় মারে সারা দেশের গালে, এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় মারে প্রধানমন্ত্রীর সযত্ন লালিত শ্রশ্রুশোভিত গালে, থাপ্পড় মারে আমার আপনার মতো সমস্ত ক্লীব বামপন্থীদের কপোলে। জামালো মাকদাম মরে দেখিয়ে দেয় এদেশের সব ভুয়ো; সর্বশিক্ষা অভিযান ভুয়ো, খাদ্য নিরাপত্তা আইন ভুয়ো, শিক্ষার অধিকার আইন ভুয়ো, শিশুশ্রম নিবারণ আইন ভুয়ো।
দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থেকে আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক যখন ব্যস্ত জিডিপি বা তার বৃদ্ধি কতটা কমবে তা নিয়ে ব্যস্ত তখন সিএমআইই জানাচ্ছে যে, একদিকে শ্রমশক্তিতে অংশ গ্রহণের হার কমেছে ৬%, অন্যদিকে তা সত্বেও বেকারির হার বেড়ে ২৬%-এ পৌঁছেছে। ফলে সব মিলিয়ে বেকার বেড়েছে ১০ কোটির থেকেও বেশি। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের সমীক্ষায় ৭২% সংস্থা তাদের কাজকর্ম ও উৎপাদনে ভয়ানক ঘাটতির কথা বলেছেন, ৭৫% সংস্থা কর্মী সংকোচনের রাস্তায় হাঁটতে হবে বলে মনে করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, পেট্রোল-ডিজেলের ব্যবহার এগুলিও বিপুল উৎপাদন-মন্দার দিকে দিক নির্দেশ করছে। যে পরিমাণ উৎপাদন হীনতার কথা বলা হচ্ছে তার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি ঋণাত্মক অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে চলে যেতে পারে।
যদিও সেকথা স্বীকার করতে নারাজ দেশের নেতারা। তারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্যাকেজের মধ্য দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা ভাবছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দুদফায় ঋণের ক্ষেত্রে সুবিধে প্রদান করেছে। এক দফায় রেপো রেট বা ব্যাঙ্ক রেটকে এক ধাক্কায় ০.৭৫% কমিয়ে দেওযা হয়, অন্যদিকে রিভার্স রেপো রেটকে দু দফায ০.২৫% করে মোট ৫% কমানো হয় (রেপো হার বলতে যে হারে ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ পেতে পারে, ও রিভার্স রেপো হার বলতে ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে যে হারে সুদ পেতে পারে।)। এছাড়াও শিল্প ক্ষেত্রের জন্য ঋণ পাওয়ার শর্তকে শিথিল করে বা শিল্পে ঋন দেওযার জন্য ব্যাঙ্কগুলির কাছে অর্থের যোগান বাড়িয়ে শিল্পকে চাঙা করার চেষ্টা করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। অপরদিকে অর্থমন্ত্রী রাজকোষ সংক্রান্ত কিছু বন্দোবস্ত করেছেন। প্রথমে তিনি কর প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু সময় সংক্রান্ত ছাড় দেন। পরবর্তিতে তিনি ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা ঘোষণা করেন। নামে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার হলেও তা সাকুল্যে ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি নয়। সেই টাকায় গরিবরা কেমন সুফল পেয়েছেন তা ওই দ্বিশতাধিক পরিযায়ী শ্রমিক ও উপরে বর্ণিত জামালো মাকদামের মৃত্যু থেকেই বোঝা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একজন ভারতীয়কেও না খেয়ে মরতে দেব না-র গালভরা ঘোষণা যে কতটাই ফাঁপা ও মেকি তা একদম পরিস্কার। এর পরেও সম্ভবত শিল্পের জন্য কর রাজস্ব ছাড়ের প্যাকেজ আসবে, হযতো আরেক দফা ৫০০-১০০০ টাকার মাসিক খয়রাতি বা অতিরিক্ত কয়েক মাসের চাল-গম দিয়ে ওই গরিব ঘরে না ফিরতে পারা পরিযায়ী শ্রমিক বা ঘরে ফেরা অভুক্তদের ক্ষতে প্রলেপ দেওযার চেষ্টা হবে। কর্পোরেট মালিকদের তাোয়াজ করতে শিল্প ক্ষেত্রকে ছাড় দেওযা হবে তার কয়েক গুণ।
এই কোরোনা অতিমারীর মধ্যেই তো ফেসবুকের জুকেরবার্গ আম্বানির জিওতে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করল। এই মহা দুর্যোগের সময়ই তো আম্বানির সম্পদ চিনের জ্যাক মার সম্পদকে ছাড়িয়ে গিয়ে তাকে এশিয়ার সর্বোচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত করল, যার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াল ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের ধনীদের উপরে সম্পদ কর বসিয়েই তো কয়েক লক্ষ কোটি টাকা তোলা সম্ভব। উত্তরাধিকার কর বা এস্টেট ডিউটি বসিয়ে তো রাজস্ব আদায় সম্ভব। ভারতে অতি ধনীদের আয়ের উপরে করের হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্টই কম। আমেরিকায সেই হার ৫০.৩%, চিনে ৪৫%, কানাডায় ৫৪%, ফ্রান্সে ৬৬%। ভারতে তা সর্বোচ্চ ৪২.৭%। বার্ষিক ৫০ লক্ষ টাকা আয় করা ব্যক্তির আয়ের উপরে সর্বোচ্চ কর হার ৩৪.৩%। অতি ধনীদের আয়ের উপরে কর বসিয়েই তো রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু সেই রাস্তায় না হেঁটে দুর্যোগের সুযোগে সরকার বেতনভোগী কর্মচারিদের বেতন কাটতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা বন্ধ করে দেওযা হয়েছে আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। বহু রাজ্য সরকার তাদের কর্মীদের বেতন কাটছেন। এই বেতন ছাঁটাই একদিকে সরকারগুলির খরচ কমালেও বাজারে চাহিদাও কমাবে। যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে সরকারের এই কাজ বেসরকারী ক্ষেত্রে বেতন হ্রাস করাকে ন্যায্যতা প্রদান করবে। আগেই বলেছি বেসরকারী সংস্থাগুলি কর্মী সংকোচনের কথা বলছে। কর্নাটক সরকার আইটি সংস্থাগুলিকে কর্মী লেঅফ-এর পরিবর্তে বেতন কাটতে বলেছে। কোভিড-১৯ এর সুযোগ নিয়ে গুজরাটে কারখানাগুলি ১২ ঘণ্টা কাজের দিন চালু করছে, ৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরিতে ওভারটাইমের পরিবর্তে নিয়মিত মজুরিতে কাজের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে সংস্থাগুলি কোভিড-১৯ পরবর্তী পর্যায়ে নিজেদের মুনাফা বাড়াতে পারবে, কমবে শ্রমিকদের আয়। সেটিকে নিরাপদ ও প্রতিবাদহীন করার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন কাজকর্মকে রদ করার দাবি তোলা হয়েছে মালিকদের পক্ষ থেকে। সুতরাং, কোভিড-১৯ এর সব দায় দাযিত্ব শ্রমিকদের ঘাড়ে, সে পরিযায়ী, সংগঠিত বা অসংগঠিত যাই হোক না কেন।
এরপরে যে বেকার মানুষের সারি চলবে, কাজ হারানো যুবকদের, চিকিৎসা না পাওযা বৃদ্ধদের মিছিল, তাদের কী হবে? কোরোনা যখন এসেই পড়েছে, ঘরে যখন বন্দীই করে ফেলা হয়েছে শত কোটি মানুষকে শ্রমিককে তখন কেন বুনিয়াদি প্রশ্ন গুলি করব না? সত্যিই নতুন ভারতের পরিকল্পনার কথা ভাবব না? কেন প্রত্যেক মানুষের জন্য সু-চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা হবে না? না চিকিৎসা মানে চিকিৎসা বীমা নয়, চিকি়ৎসা মানে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা। কেবল বীমার টাকা দিয়ে বেসরকারি পরিষেবায় গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা গোল্লায় যেতে পারে তার উদাহরণ এই কোভিড-১৯-এর অতিমারী দেখিয়ে দিয়েছে ইতালিতে। সেখানে বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসার পুরো অর্থ সরকার দিত চিকিৎসা বীমার সূত্রে। কিন্তু বেসরকারী হাসাপতাল মুনাফার জন্য যতটা প্রয়োজন ততটাই পরিকাঠামো তৈরি রেখেছে। ফলে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে বিপুল সংখ্যক রোগী। জার্মানি সরকারী চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেওয়ায় অনেকটাই ভালো অবস্থা বজায় রাখতে পেরেছে। ভারতে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপিরমাত্র ১.২-১.৩% খরচ করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি মিলে। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা হয় ৩.১%, অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের আড়াই গুণ। কেন্দ্রীয় সরকার স্বাস্থ্য খাতে যা খরচ করে সম পরিমাণ খরচ করে আধাসামরিক বাহিনির জন্য। বোঝাই যায়, সরকারের পেশী শক্তি অনেক বেশি প্রয়োজন দেশের সাধারণ মানুষের সুস্থ সবল জীবনের থেকে। কোরোনা উত্তর বা কোরোনা-সংযুক্ত ভারতে সরকারগুলিকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারি ভারতের কথা ভাবতে বাধ্য করতে হবে।
কোভিড-১৯ আক্রমণে যে ক্ষতির কথা আমরা আলোচনা করছি বা সরকার ও শিল্পপতিরা বিবেচনা করছেন তা অনেকটাই কর্পোরেট জগৎকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। দেশে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাপটাও ওই কর্পোরেটের ক্ষতির নিরিখেই মাপা হবে, হয়ও। কারণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাপ করা হয় কর্পোরেট জগতের উৎপাদনের উপর নির্ভর করে। ফলে বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষতির কোনো বাস্তব পরিমাণ জানাও যাবে না। বোঝাই যাচ্ছে, এই সরকার শিল্পোৎপাদনকে চাঙা করতে আরো কিছু বরাদ্দ রাজকোষ থেকে করবে, ছিটেফোটা অসংগঠিত ক্ষেত্রের ভাগেও জুটবে। ভারতে ২০১৮-১৯ সালে টাকার অঙ্কে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল মাসিক ১০,৫৩৪ টাকা। সেই পরিমাণ ২০১৯-২০ সালে বেড়ে ১১ হাজার টাকা অন্তত হবে বলে আসা করা যায়। প্রত্যেক দেশবাসীকে কেন নিশ্চিত ন্যুনতম আয়ের বন্দোবস্ত করবে না সরকার? কেন সরকার প্রত্যেক ভারতবাসীর জন্য সেই মাথাপিছু আয়ের অন্তত তিনভাগের একভাগ নিশ্চিত করতে পারবে না? যে রাষ্ট্র ডিজিটাল ভারতের কথা বলে, আধার, আরোগ্য সেতু, ভীম, ডিজিটাল রেশন কার্ড এত আধুনিকিকরণের মাধ্যমে দেশ চালায়, সেই রাষ্ট্র কেন অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য, খেত মজুরদের জন্য যথোপযুক্ত আয়তনের আশ্রয়ের সুবন্দোবস্ত করতে পারবে না? এরকম সমস্ত বুনিয়াদি নাগরিক সুবিধের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে দাবি তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে এই দেশ জোড়া দুর্যোগ।
বোধ হয়, সমস্ত কালো মেঘের সঙ্গে থাকা বিদ্যুতরেখা কথাটি এখানে বিশেষ প্রযোজ্য। প্রশ্নগুলি সহজ আর উত্তরটাও জানা থাকলেও, সেই উত্তরটাকে পাল্টাতেই হবে। সেই প্রশ্ন তোলা ও উত্তর পাল্টানোর দায় এড়ানো যাবে না, এড়াতে দেবে না জামালো মাকদাম।
পৃথিবী আজ এক অভূতপূর্ব সংকটে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক জীবাণু বিভিন্ন মহাদেশ পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় দু’শোটি দেশে। দুনিয়া জুড়ে বিছিয়ে দিয়েছে এক অজানা আতঙ্কের রহস্যময় চাদর।
কিন্তু আপাতত মানবদেহই বুঝি তার একমাত্র লক্ষ্য। এই মৃত্যুমিছিলের আবহে প্রকৃতি কিন্তু ক্রমশ নির্মলতর, উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। এত দুঃখেও কেউ পরিহাসছলে বলছেন, পৃথিবী নাকি তার অটো-ইমিউনাইজেশন সিস্টেমকে সক্রিয় করতেই এই জীবাণুর আমদানি করেছে! সত্যি, গতবছর যখন সেই ছোট্ট মেয়েটি, গ্রেটা থুনবার্গ রাষ্ট্রসঙ্ঘে লাঞ্ছিতা পৃথিবীর, ভয়াল সংকটে থাকা পরিবেশের কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভে দুঃখে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল, বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তার কণ্ঠ, ক’জন রাষ্ট্র প্রধান গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার কথায়? আবেগে? কিন্তু আজ জনাকীর্ণ ঘিঞ্জি মহল্লাতেও যখন কুণ্ঠিত অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা সবুজ হঠাৎ ফলে ফুলে প্রাণের হিল্লোলে ভরে উঠেছে – মানুষের মৃত্যু আতঙ্কের পরোয়া না করে, নিত্য নতুন পাখিদের জলসায় ভরে থাকছে সারাটা দিন – তখন মনে হচ্ছে পরিবেশপ্রেমী সেই বালিকার ইচ্ছে হয়তো আপাতত কিছুটা পূর্ণ হয়েছে! – কিন্তু তার জন্যে মানবসমাজকে গুণতে হয়েছে অভূতপূর্ব মাশুল, হারাতে হয়েছে আজ এইমুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় আড়াই লক্ষ প্রাণ!
কল্পবিজ্ঞানের কোনো লেখকও এমন ভয়ঙ্কর একটি পরিস্থিতির কথা ভাবতে পেরেছেন কিনা জানিনা, যা ওলট পালট করে দিয়েছে গোটা দুনিয়াকে। কিন্তু এমন অতলান্তিক বিপন্নতার মধ্যেও বেঁচে আছে, টিঁকে রয়েছে, অতি সক্রিয় হয়ে উঠছে পৃথিবীর আদিমতম এক ভাইরাস – গার্হস্থ্যহিংসা তথা লিঙ্গবিদ্বেষ। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গোটা পৃথিবী জুড়ে চলছে লকডাউন।আর তার মধ্যেই বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে বেড়ে চলেছে গৃহহিংসা অভাবনীয় হারে। যার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেসকে ট্যুইটারে লিখতে হয়েছে “I urge all governments to put women's safety first as they respond to the pandemic”। কেমন তার গতিধারা? সেই প্রসঙ্গে ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ববিদ মন্তব্য করেছেন “Domestic abuse is acting like an opportunistic infection flourishing in the conditions created by the pandemic”
১) নানুরের এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ শ্বশুরবাড়ির অশান্তির জেরে পালিয়ে বাপেরবাড়ি (বাঁকুড়ার পাত্রসায়র) যাওয়ার জন্য শনিবার সকাল থেকে রেললাইন ধরে ২৫ কিমি পথ একাকী হেঁটে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে স্থানীয়দের কাছে খবর পেয়ে গুসকরা ফাঁড়ির পুলিশ তাকে বনপাস স্টেশন থেকে উদ্ধার করে বাড়ি পাঠায়, কোর্টের নির্দেশে। স্বামী তার, মহারাষ্ট্রের কর্মস্থলে আটকে রয়েছেন। অভিযোগ, শনিবার সকালে বধূ একাই বোলপুর থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর সে নিরুপায় হয়ে হাঁটতে শুরু করে।
২) ১৮ এপ্রিল জামাই আতিয়ারের অনৈতিক কাজে বাধা দিতে গিয়ে খুন হয়েছেন ভাঙড় থানার কাশীপুর জামাইপাড়ার আমিনা বিবি। ৯ দিন পর গ্রেপ্তার হল আতিয়ার মোল্লা।
৩) অন লাইন লুডোয় হেরে বেধড়ক মার স্ত্রীকে, শিরদাঁড়ায় গুরুতর আঘাত। গুজরাতের ভদোদরার ঘটনা।
৪) নাগপুরের হুড়কেশ্বর এলাকায় বিক্রান্ত পিল্লেওয়ার নামে এক যুবক রাগের বশে শুধু বাবার ঘাড়ে কামড় বসিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, যৌনাঙ্গও কেটে নিয়েছে। প্রৌঢ়ের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। (এই সময়,২৮এপ্রিল) এক দিনেই এতগুলো খবর। তালিকা দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই। হয় স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির পরিজনদের দ্বারা বধূনির্যাতন, নয় ছেলে-বৌয়ের হাতে বৃদ্ধ বৃদ্ধার নিগ্রহ, শিশু নির্যাতন, বাবা কাকা জ্যাঠা দাদার দ্বারা শারীরিক ও মানসিক পীড়ন, হ্যাঁ যৌননির্যাতন ও পারিবারিক পরিসরের মধ্যেই আপাত দুর্বলের উপর আপাত সবলের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া, হিংসার আশ্রয় নিয়ে।
ভারতে এই মুহূর্তে, বিশেষ করে কর্ণাটক ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে চুরি ছিনতাই রাহাজানি খুন সহ অ্যালকোহল জনিত অপরাধ অবশ্য প্রায় ৫০% কমে গেছে। কিন্তু শিশুনির্যাতন সহ গার্হস্থ্যহিংসার বৃদ্ধি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। নির্যাতিতদের সুরক্ষা ও পৃথক আশ্রয়ের আবেদন জানিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ও দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জমা পড়েছে।
জাতীয় মহিলা কমিশন সূত্রে জানা গেছে,গত ২৪ মার্চ (লকডাউন ঘোষণার পর) থেকে ১ এপ্রিলের মধ্যে ২৫৭টি নারী নির্যাতনের অভিযোগ এসেছিল যার মধ্যে ৬৯টি গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত। এনসিডব্লুর চেয়ারপার্সন রেখা শর্মার মতে, সংখ্যাটা আসলে আরও বেশি।কারণ বহু নির্যাতিতা ভবিষ্যতে আরও অত্যাচারের ভয়ে, পুলিশে অভিযোগ জানাতে সাহস পায় নি। জাতীয় মহিলা কমিশন সূত্রে – ২৩ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৮৭ টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারী থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত সংখ্যাটা ছিল ৩৯৬। ভারতে লকডাউন পর্বে লিঙ্গ হিংসা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। চাইল্ডলাইন ইন্ডিয়া হেল্পলাইনে ২০-৩১ মার্চের মধ্যে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে কল এসেছে ৯২০০০এরও বেশি। রেখা শর্মা আগেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে লকডাউনে গার্হস্থ্য হিংসা বাড়তে পারে যেহেতু অত্যাচারিতা অত্যাচারীর সহাবস্থান বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পলিটব্যুরো সদস্য ও অ্যাপোয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক কবিতা কৃষ্ণাণ জানিয়েছেন, লকডাউনে গার্হস্থ্য হিংসার এত বাড়বাড়ন্তের কারণ সরকারের অপরিকল্পিত ও সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে লকডাউন ঘোষণা। তিনি বলেন, নির্যাতিতারা অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছেন
সরকারের আগাম ঘোষণা থাকলে তারা নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারতেন। তাঁর মতে, এখন একমাত্র করণীয় হল-অভিযোগ কারিণীদের সাহায্য ও উদ্ধার করা। তিনি এবং তার সংগঠন এআইপিডব্লুএ প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে প্রতিটি জেলায় ২৪×৭ হট লাইন চালু করার ও অভিযোগকারিণীদের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য একটি বিশেষ টিম গঠনের দাবি জানিয়েছেন। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে তিনি মহিলা সংগঠনগুলির সাহায্য নেওয়ার কথা বলেছেন। তারা পিসিপিএনডিটি আইনটি কঠোরভাবে বলবৎ করার দাবিও জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রক গত ৪ এপ্রিল এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ঐ আইনের কিছু বিধি শিথিল করেছে। এই আইনটি (প্রি-নাটাল অ্যান্ড প্রি-কনসেপশন ডায়াগনস্টিক টেকনিক অ্যাক্ট) লিঙ্গ নির্ণয় পরীক্ষা সংক্রান্ত। আইনটির কঠোরতা হ্রাসের মাধ্যমে কন্যাভ্রূণ হত্যাকে আইনি অনুমোদন দিতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর সাহায্য নিয়ে পারিবারিক হিংসা আরও ব্যাপক হবে বলে উদ্বেগ জানিয়েছে নারী সংগঠনগুলি।
নারী অধিকার কর্মীরা অনেকে গার্হস্থ্যহিংসাকে ‘শ্যাডো প্যানডেমিক’ আখ্যা দিয়েছেন। হিংসার আশ্রয় নিয়ে মহিলাদের কাজকর্ম ও গতিবিধির উপর এই নিয়ন্ত্রণ মেয়েদের মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা তথা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ভয়ঙ্করভাবে বিপর্যস্ত করছে।
জাতীয় মহিলা কমিশন অভিযোগ নেওয়ার জন্য একটি হোয়াটস্অ্যাপ নম্বর (7217735372) প্রকাশ করেছে। সারা দেশে মহিলাদের সাহায্যের জন্য ৫০টিরও বেশি হেল্প লাইন চালু আছে।
শুধু ভারতেই নয়, গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই লকডাউন পর্বে গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে। নতুন জনস্বাস্থ্যবিধি অত্যাচারের সুযোগ করে দিচ্ছে,সন্ত্রাস তৈরিতে সাহায্য করছে। লকডাউন অত্যাচারীদের কাছে "নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার" হয়ে উঠেছে। সরকার অনেকক্ষেত্রেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় এই গৃহহিংসাকে বিশেষজ্ঞরা ‘অন্তরঙ্গ সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করেছেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে এই পাশাপাশি থাকা তৈরি করছে সংঘাত। ক্রমশ তা শারীরিক ও মানসিক পীড়নের রূপ নিচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ নাও থাকতে পারে। কিন্তু স্ত্রী বা সঙ্গিনীকে কঠোর ও নিরবচ্ছিন্ন নজরদারিতে রাখা ও ‘প্রতারণা করছে’ এমন সন্দেহপ্রবণতায় ভোগা, বন্ধু, পরিবার, কর্মসংস্থান থেকে নির্বাসিত অবস্থায় তাকে দূরভাষ, মোবাইল ফোন বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে না দেওয়া (সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট নম্বর ডিলিট করে দেওয়া), কঠোর আচরণবিধি আরোপ করা, সন্তানসহ সঙ্গিনীকে খাদ্য, বস্ত্র, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত করা, এমনকি স্নানঘরের নিভৃতিটুকুও কেড়ে নেওয়া – এ সবই চলছে ঘরবন্দি থাকার সুযোগে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের ট্রমা বিশেষজ্ঞ জুডিথ ল্যুইস হারম্যান বলছেন: অত্যাচারীরা সঙ্গিনী ও সন্তানদের সঙ্গে এমন পদ্ধতিতে অত্যাচার করছে, যার সঙ্গে অপহরণকারীরা তাদের হেফাজতে থাকা পণবন্দিদের বা অত্যাচারী সৈন্যরা রাজনৈতিক বন্দিদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যা করে তার সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, “while perpetrators of organised political or sexual exploitation may instruct each other in coercive methods, perpetrators of domestic abuse appear to reinvent them.”
আইসোলেশনে থাকার জন্যে নির্যাতিতাদের সাহায্য পাওয়া বা নিরাপত্তার জন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার পথও খোলা থাকছে না। ফলে এক ভয়ঙ্কর বিপন্নতা তাদের গ্রাস করছে। প্রশাসন সময়মত হস্তক্ষেপ না করলে মারাত্মক বিপদ ঘটে যেতে পারে।
চীনের বেজিংভিত্তিক একটি এনজিও, ‘ইক্যুয়ালিটি’ জানাচ্ছে – হুবেই প্রদেশে লকডাউন শুরুর পর, ফেব্রুয়ারীর গোড়া থেকে হেল্প লাইনে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ জানিয়ে কলের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যায়। গতবছর ফেব্রুয়ারির তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারিতে তিনগুণ বেড়ে গেছে-৪৭ থেকে ১৬২। চীনের এক নির্যাতিতা তরুণী শিশুকন্যাকে কোলে নেওয়া অবস্থায় স্বামীর দীর্ঘক্ষণের নির্মম নির্দয় প্রহারে রক্তাক্ত আহত হওয়ার পর পুলিশকে ফোন করলে, ঘটনাটি নথিবদ্ধ করা হয়, কিন্তু পরবর্তী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে মেয়েটি আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানায়। কিন্তু তার জন্যেও তাকে অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করাও সম্ভব নয়। অগত্যা শিশুকন্যাকে নিয়ে তাকে সেই অত্যাচারী লোকটির সঙ্গেই সহাবস্থানে বাধ্য হয়ে কোর্টের রায়ের প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে। এরকমই চলছে সারা বিশ্ব জুড়ে।
ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি – ইওরোপের সর্বত্র একই অভিজ্ঞতা। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার যারা, তাদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা, পরিকল্পনা ছাড়াই সরকারের লকডাউন ঘোষণার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে অসহনীয় অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে নির্যাতিতাদের।
ইউরোপে প্রথম ইতালিতে,মার্চের শুরুতে লকডাউন ঘোষিত হয়। তারপর থেকে গার্হস্থ্য হিংসাও বাড়তে থাকে।নিরুপায় মেয়েদের পালানোর কোন উপায় ছিল না। সংক্রমণের ভয়ে কোথাও তাদের ঠাঁই হচ্ছিল না। তাই সরকার স্থানীয় প্রশাসনকে হোটেলগুলিতে অস্থায়ী আশ্রয় গড়ে তোলার নির্দেশ দেয় যেখানে মেয়েরা নিরাপদে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারে।
স্পেনে লকডাউন ঘোষণার (১৪ মার্চ) পর দু’সপ্তাহের মধ্যে জরুরি নম্বরে কলের সংখ্যা আগের মাসের থেকে ১৮% বেড়ে যায়। সেখানে মহিলা সংগঠনগুলির সাহায্য নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস হোয়াটস্অ্যাপে নির্যাতিতাদের সাক্ষাৎকার নেয়। স্পেন সরকারও হোটেলের খালি ঘরগুলোতে সন্তানসহ নির্যাতিতাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর ব্রিটেন। সংক্রমণ শুরুর অনেকেটা পরে ২৩ মার্চ সেখানে লকডাউন ঘোষিত হয়। লকডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের পূর্ব দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে, অ্যাভন ও সমারসেটে গার্হস্থ্য হিংসা ২০% বেড়ে যায়। চ্যারিটি 'রিফিউজ' জানিয়েছে লকডাউনের পর তাদের ‘ন্যাশনাল ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ হেল্পলাইনে’ কলের সংখ্যা ২৫% বেড়ে যায়। গোটা ইউ কে-তে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহের তুলনায় 'ন্যাশনাল ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ হেল্প ওয়েবসাইট'-এ তথ্যানুসন্ধান ১৫০% বেড়ে গেছে। এই সংস্থার এক প্রচারক (ক্যাম্পেনার) রাচেল উইলিয়ামস আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, লকডাউন ও সোশ্যাল ডিসস্ট্যান্সিং দীর্ঘায়িত হলে হিংসা তো বাড়বেই, খুনের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। এই সংস্থার মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক স্যানড্রা হার্লের মতে লকডাউন যত প্রলম্বিত হবে, শিশুসহ মহিলাদের স্বাধীনতা তত খর্ব হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, নিজের ১৮বছরের দাম্পত্যজীবন ছিল স্বামীর নির্যাতনে জর্জরিত। সেই দুর্বিষহ জীবন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত জানালে তাকে শট গান থেকে গুলি করা হয়। বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছেন, “Homicide rate is going to go through the roof –” আর বিশ্বমহামারীতে এটা এপিডেমিকে পৌঁছে গেছে বলে তিনি মনে করেন।
ব্রিটেনে গৃহহিংসা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নিউইয়র্ক টাইমস স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে,সেখান থেকে জানানো হয় – পরামর্শ ও সাহায্যের জন্য চালু ব্যবস্থাগুলোর সহায়তা মিলতে পারে। এরপর সরকার কয়েকটি হট লাইন ও অ্যাপের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র একটিই ছিল কোভিড-১৯ সংকট সংক্রান্ত! সংকট তীব্র হওয়ায়, কয়েক ডজন নাগরিক সংগঠন গণস্বাক্ষরিত খোলা চিঠি পাঠালে, স্বরাষ্ট্র দপ্তর জানায় সমস্যা সমাধানে তারা যথাসাধ্য সচেষ্ট। আরও জানায় নির্যাতনের শিকার যারা, নতুন আশ্রয় খোঁজার প্রয়োজনে ঘরবন্দিত্বের বিধি লঙ্ঘন করতে পারেন। সেখানেও স্থানীয় প্রশাসন একইভাবে খালি হোটেলগুলোকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা মেটাতে চেষ্টা করে।
ফ্রান্সে লকডাউন জারি হয় ১১ মার্চ। সেখানেও ফরাসী পুলিশ প্রশাসনের নজরে আসে, গোটা দেশে গার্হস্থ্য হিংসা ৩০% বেড়ে গেছে লকডাউনের পর।
লাতিন আমেরিকায় – এই গোটা অঞ্চলে সাধারণভাবেই প্রতিবছর প্রায় ২ কোটি মহিলা ও কিশোরী শারীরিক ও যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। আর ঘরবন্দি অবস্থায় তা কতটা বেড়েছে, বুয়েনস আয়ার্স, মেক্সিকো সিটি, সান্তিয়াগো, সাও পাওলো – সর্বত্র হটলাইনে কলের আকস্মিক বৃদ্ধিই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে ।
আর্জেন্টিনায় ২০ মার্চ লকডাউন ঘোষণার পর, নির্যাতিতদের জন্য নির্দিষ্ট ১৩৭টি জরুরী লাইনে কলের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৬৭% বেড়েছে। ‘ইউনাইটেড নেশনস উইমেন’ সম্প্রতি জানিয়েছে, কোয়ারেন্টইনে মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং কলাম্বিয়ায় নারীর প্রতি হিংসা বেড়েছে , আর্জেন্টিনায় নারীহত্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। (লকডাউনের আগে সেখানে প্রতি ২৩ ঘণ্টায় একজন নারী খুন হত।) চিত্রনির্মাতা লুসিয়েন ভাসেল্লো বলেছেন, “গৃহহিংসা আরেকটি প্যানডেমিক হতে চলেছে”।
লাতিন আমেরিকায় নারীদের উপর পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গত বছর তীব্র আন্দোলন চলেছে, বিশাল বিশাল মিছিল হয়েছে।
চিলিতে ঘরবন্দিত্বের প্রথম সপ্তাহেই জরুরী কলের সংখ্যা ৭০% বেড়েছে। সান্তিয়াগোর মেয়র রয়টারকে জানিয়েছেন, আইনি,
মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক সাহায্যের আবেদন জানানোর স্থানীয় দপ্তরে কলের সংখ্যা ৫০০% বেড়ে গেছে।
ব্রাজিলিয়ান ফোরাম অন পাবলিক সেফটি জানিয়েছে ব্রাজিলের সাও পাওলো স্টেট, যেখানে অতিমারীর আক্রমণ সব চেয়ে বেশি সেখানে গার্হস্থ্যহিংসা বেড়েছে ৪৫%।
মেক্সিকোর প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে – লকডাউনে গার্হস্থ্য হিংসা মার্চে গত বছরের তুলনায় এক চতুর্থাংশ বেড়েছে। মিউনিসিপ্যাল ইনস্টিটিউট ফর উইমেন অব ভেরাক্রুজ (যেখানে নারীহত্যার ঘটনা দেশের মধ্যে সর্বাধিক) জানিয়েছে-সেখানে গার্হস্থ্য হিংসায় মানসিক নির্যাতনের ঘটনাও অনেক। অনেক মহিলাই সন্তানসহ ঘর ছাড়ার এবং তার পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।
কলাম্বিয়ায় লকডাউনের প্রথম ১৮ দিনে জাতীয় মহিলা হটলাইনে সাহায্যের আর্তি জানিয়ে কলের সংখ্যা ১৩০% বেড়েছে ।
আর্জেন্টিনীয় সাংবাদিক এবং Ni Una Menos নারী আন্দোলনের সংগঠক Marta Dillon জানিয়েছেন গার্হস্থ্য হিংসার প্রতিরোধে সারা বিশ্বের মহিলারা একজোট হতে চাইছেন এবং গোটা পৃথিবীর সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে তারা একটি ইস্তাহার প্রকাশ করবেন।
আমেরিকার পাঁচটি বড় শহর-শিকাগো,কানসাস সিটি,লস এঙ্গেলস,মেম্ফিস এবং নিউ অর্লিয়েন্স-এর ১০০০০০ রিপোর্ট বিশ্লষণ করে ‘দি ইকোনমিস্ট’ জানিয়েছে – ১৯-২৪ মার্চের মধ্যে লকডাউন জারি হওয়া শহরগুলিতে অন্যান্য অপরাধ ২৫% কমে গেলেও গার্হস্থ্যহিংসা ৫% বেড়ে গেছে । এন বি সি নিউজ জানাচ্ছে--মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের আইনবলবৎকারী সংস্থাগুলির পর্যবেক্ষণ-সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে গার্হস্থ্যহিংসা ৩৫% বেড়ে গেছে ।
অস্ট্রেলিয়া প্রশাসন সূত্রে-সেখানে গার্হস্থ্য হিংসা ৫% বেড়েছে ।
বেলজিয়ামে লকডাউনের তৃতীয় সপ্তাহে হেল্প লাইনে কলের সংখ্যা ৭০% বেড়েছে ।
সিঙ্গাপুরে লকডাউনে হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা ৩০% বেড়েছে।
রাশিয়ায় ২০১৭ সাল থেকে গার্হস্থ্য হিংসা আর ফৌজদারি অপরাধ নয়।ফলে সরকারিভাবে পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। তবে ব্যক্তিগত গবেষণা বলছে-গার্হস্থ্য হিংসা হটলাইনে কলের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এক চতুর্থাংশ বেড়েছে ।
পাকিস্তানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন,তারা সেখানে গার্হস্থ্যহিংসা বৃদ্ধির জন্য আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার মন্ত্রক ন্যাশনাল ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ হেল্পলাইন চালু করেছে। গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তানের জাতীয় বিপর্যয় ব্যবস্থাপন কর্তৃপক্ষ, “জেন্ডার অ্যান্ড চাইল্ড সেল” গঠন করেছে।
টিউনিশিয়ার নারী বিষয়ক দপ্তরের মন্ত্রী আশমা শিরি গার্হস্থ্য হিংসা বাড়ার কথা স্বীকার করেছেন।
তুরস্কের লকডাউন ঘোষণা হয় ১১ মার্চ। মার্চের শেষে গৃহহিংসার জেরে অন্তত ১২ জন নারী প্রাণ হারিয়েছে। টার্কিশ ফেডারেশন অব উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর সেখানে হটলাইনে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগের বন্যা আছড়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস-এর ছায়া হয়ে প্রায় গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে এই হিংসা। যদিও নারী সংগঠনগুলি মনে করে, এইসব পরিসংখ্যানে হিমশৈলের চূড়ামাত্র দৃশ্যমান হয়েছে। ৫০% ঘটনা দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে।
গার্হস্থ্যহিংসা পৃথিবীর প্রাচীনতম হিংসা। সর্বত্রই আছে। তবে এই ঘরবন্দি অবস্থায় তার এত বাড়বাড়ন্ত কেন? এটাও আকস্মিক বা নতুন কিছু নয়। এর আগেও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা গভীর আর্থিক সংকটের সময় তার ভয়াল প্রকাশ ঘটেছে। উন্নয়নের মাপকাঠিতে বিভিন্ন দেশের সামাজ-আর্থনীতিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, জীবন ধারায় ফারাক রয়েছে। কিন্তু লকডাউনের প্রভাবে সারা দুনিয়ার অর্থনীতিই বিপর্যস্ত। বহু মানুষ ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছে। কেউ হারাবার আশঙ্কায় প্রহর গুণছে। ভয়ঙ্কর আর্থিক সংকট ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য ও সুস্থিতিকে নষ্ট করেছে। আর্থিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, জনসাধারণের প্রতি রাষ্ট্রের নির্দায় ও নির্দয় মনোভাব ব্যক্তিমানুষকে গভীর বিপন্নতা, অবসাদের খাদে ঠেলে দিচ্ছে । কর্মস্থলের চাপ, ঝড়ের গতির বৈচিত্র্যহীন প্রাত্যহিকতা সম্পর্কের মধ্যে চোরাফাটল তৈরি করছে। যেখানে আস্থা বিশ্বাস সহমর্মিতার অভাব ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সন্তানদের সময় না দিতে পারায় তাদের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি জীবনের নিরবচ্ছিন্ন নৈকট্য মতান্তরকে মনান্তরে পরিণত করছে। সেখান থেকে সংঘাত। ঘৃণা অবিশ্বাসের ফাটলটা চওড়া ও দুর্লঙ্ঘ্য হচ্ছে। স্ত্রী বা সঙ্গিনী ও সন্তানদের প্রতি হিংস্র অমানবিক বর্বর হয়ে উঠতে সাহায্য করছে তাদের অসহায়তা নিরুপায়তা, তাদের আক্ষরিক অর্থে বন্দিজীবন।আবার চরিত্রগতভাবে নির্দয়, রূঢ় মানুষ এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ক্রূরতর হয়ে উঠছে। পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসন ও নিপীড়ন তো সমাজে আছেই। ঘরবন্দিত্বে তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
গার্হস্থ্যহিংসার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে সংসার ভেঙে যাওয়ার ঘটনাও বিপুলহারে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন দেশেই বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার পাহাড় জমছে। অপমান লাঞ্ছনা নির্যাতনকে ছায়াসঙ্গী করে যে মেয়েরা সংসার করছিল, লকডাউন তাদের সেখান থেকে চিরতরে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন বুঝিয়ে দিয়েছে।
চীনে লকডাউন পর্বে বিবাহ বিচ্ছেদ ২৫% বেড়েছে। প্রতিবছর এই হারটা সেখানে অন্যান্য দেশের থেকে বেশিই থাকে। বিবাহ বিচ্ছেদ-আইনজীবী স্টিভ লি’র মতে – বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনে অবিশ্বাসই বিচ্ছেদ ডেকে আনছে। তার পর্যবেক্ষণ-তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি, বোঝাপড়া ও সহিষ্ণুতার অভাবে।
গার্হস্থ্য হিংসার অনুষঙ্গে আরেকটি বিপজ্জনক দিক সামনে আসছে। ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড-এর একজিকিউটিভ ডিরেক্টর নাতা লিয়া কানেম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন-লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে, কম ও মধ্য আয়ের ১৪৪টি দেশের ৪৪০ লক্ষ মহিলা আধুনিক গর্ভনিরোধক পাবেন না এবং ১০লক্ষ অনিচ্ছুক গর্ভধারণের ঘটনা ঘটবে। ঘটবে অনিরাপদ গর্ভপাত এবং গর্ভধারণ সংশ্লিষ্ট কারণে মৃত্যুর ঘটনা। বাল্যবিবাহও বেড়ে যাবে। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন যে, পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ও আরব দেশে লোকজন মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়া জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যখন পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশে প্রসবকালীন মৃত্যু হার তিনগুণ বেড়ে গেছে। সামনের দশকটি সারা পৃথিবীর মেয়েদের জন্যই এক গুরুতর সমস্যার দশক।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটেরেস বিভিন্ন দেশের কাছে মহিলাদের নিরাপত্তার বার্তার সঙ্গে একগুচ্ছ পরামর্শও দিয়েছেন। যেমন অনলাইন পরিষেবা ও নাগরিক এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জন্য সরকারকে ব্যয় বাড়াতে হবে, সুরক্ষা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা বলে গণ্য করতে হবে, অত্যাচারীদের বিচারসাপেক্ষে কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশের সরকার কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেও। কিন্তু এগুলো সবই স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ। মহিলাদের নির্ভয় স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা ও বিকশিত হয়ে ওঠার জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা পুষ্টি সামাজিক সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করতে হবে।তাদের স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায়নকে সম্ভব করার মতো সমাজকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখতে হবে। আর ভারতবর্ষের ভয়ঙ্কর মন্দাপরিস্থিতি থেকে অর্থনীতির মুক্তির জন্য দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজি,সামাজিক নিরাপত্তার দায় সরকারকে নিতে হবে-বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা একথা বারংবার সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এই সব প্রশ্নে মহিলা সংগঠনগুলির সামনে এখন নিরন্তর লড়াইয়ের বলিষ্ঠ চ্যালেঞ্জ।এবং সেটা তারা হিম্মতের সঙ্গে লড়ছে, লড়বেন – জোটবদ্ধ হয়ে, মানুষকে সাথে নিয়ে, ইতিহাসকে সঙ্গী করে।
সূত্র: Impact of the COVID-19 pandemic on domestic violence
LOCKDOWN wjth abusers:India sees surge in domestic violence
A new covid-19 crisis:domestic abuse rises worldwide: Amanda Taub
কবে, কোথায় আর আরও কতটা বিপর্যয় ঘটিয়ে যে এই অতিমারী টানবে তার শেষ যতি চিহ্ন, তা এখনও কেউ বলতে পারছেন না। নতুন নতুন সীমানা টপকে একের পর এক দেশকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে এই করোনা। দেখা যাচ্ছে এবার রাশিয়া মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। রাজধানী মস্কোয় বিদ্যুতগতিতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর হার।
এই বিশ্ব আগেও দেখেছে অনেক মহামারী। গভীর অর্থনৈতিক মন্দা। ১৯২৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে যে বিশ্বব্যাপী মহামন্দার জন্ম দিল, তার প্রভাব চলেছিল প্রায় ১০ বছর। তারপর, ২০০৮ সাল গোটা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করে ফিনান্সিয়াল মেল্টডাউন বা বিত্তীয় পুঁজির সংকট। কিন্তু এবারের সংকট আক্ষরিক অর্থেই নজিরবিহীন। যার তুলনা মেলা ভার। এর আগে একই সঙ্গে চাহিদা জোগানের শৃঙ্খল এমনভাবে আগে কখনও ছিন্নভিন্ন হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, ইন্টারনেট যুগে এই প্রথম অতিমারি ঘটল বিশ্বায়িত পুঁজির নিবিড় আঁটোসাটো বাঁধনের পৃষ্ঠভূমিতে, ৩০-এর দশকে মহা মন্দার সময়েও যে অর্থনীতি তার জাতীয় সীমানা ছাপিয়ে গুণগত ভাবে আজকের মতো এতটা একমাত্রিক গ্রন্থিতে নিজেকে বাঁধেনি। গ্লোবাল ভ্যালু চেন, যা আজ বিশ্বায়িত পুঁজির চরিত্রলক্ষণ, করোনার প্রবল ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন। উৎপাদন শিল্পের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র চীনে সাব-সাহারা আফ্রিকা মহাদেশ নানান কাঁচামাল সরবরাহ করে জায়গা করে নিয়েছে এই বিশ্বব্যাপী ভ্যালু চেন র মধ্যে। দেখা গেল, চিনের উহান, যা দুনিয়ার বুকে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অটোমোবাইল উৎপাদনের কেন্দ্র, যেখানে সিংহভাগ অপ্টিকাল ফাইবার তৈরি হয়, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিরাট গ্লোবালভ্যালু চেন, সেখানে প্রথম করোনা ভাইরাস হানা দেওয়ার পরই প্রবল ঝাঁকুনি অনুভূত হল গোটা অর্থনৈতিক গ্রন্থী জুড়ে। করোনা নির্মমভাবে সামনে আনলো এই বিশ্বায়িত আর্থিক মডেলের অন্তর্নিহিত চরম ভঁঙ্গুরতাকে, সংকটের সময় তার কার্যকারীতা সম্পর্কে তুলে দিল হাজারো প্রশ্ন।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান প্রচলিত মডেলের চূড়ান্ত দেউলিয়াপনা বে আব্রু করলো এই অতিমারী। কয়েকটা উদাহরণ উল্লেখ করা যাক। ইতালির অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী অঞ্চল হল লোম্বারডি। একসময় এই অঞ্চলে গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল নজর কাড়া। কিন্তু, ১৯৯৭-এর পর থেকে সেখানে দ্রুত গতিতে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলে যায় কর্পোরেটদের কব্জায়। করোনার নির্মম পরিহাস দেখালো, গোটা ইউরোপের মধ্যে লোম্বারডি সবচেয়ে বিধ্বস্ত। সমগ্র ইতালির সাপেক্ষে এই অঞ্চলের জনসংখ্যা মাত্র ১৬ শতাংশ। কিন্তু গোটা ইতালিতে মৃত্যুহারে এই অঞ্চল সর্বাধিক – ৬৬ শতাংশ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেল শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক্সদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। মার্কিন সমাজে এই দরিদ্র জনসংখ্যাটি ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য বিমার আওতার বাইরে। নিউইয়র্ক মহানগরে হিসপানিক্সদের জনসংখ্যা মাত্র ২৯ শতাংশ, কিন্তু মৃত্যুর হার হল ৩৪ শতাংশ। আবার, বৃহত্তর নিউইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গদের জনসংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ। কিন্তু মৃত্যু হার ১৮ শতাংশ। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্যকে কর্পোরেটদের কব্জায় তুলে দেওয়ার হিড়িকে ধ্বংস করা হয়েছে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ভারতের আর্থিক বরাদ্দ সবচেয়ে কম – জিডিপির মাত্র এক শতাংশ।
এই অতিমারী নয়া উদারবাদী অর্থনীতির গোড়া ধরে টান মেরেছে। উদ্ঘাটিত করেছে তার বিরোধাভাস, চরম ভঙ্গুরতা, নিকৃষ্টতম অন্তঃসারশূন্যতাকে। যে সংগঠিত উৎপাদন ব্যবস্থাকে তছনছ করে নয়া উদারবাদ বিপুল আয়তনের এক ইনফর্মাল অর্থনীতি, ইনফর্মাল শ্রমশক্তির জন্ম দিল, আজ সেটাই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২৯ এপ্রিল এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা জানিয়েছে যে, গোটা বিশ্বে ৩০০ কোটি ৩০ লক্ষ শ্রমশক্তির মধ্যে অর্ধেকের ও বেশি অর্থাৎ, ১০০ কোটি ৬০ লক্ষ ইনফর্মাল শ্রমিকের রুটিরুজি কেড়ে নেবে এই অতিমারী। করোনা হামলার প্রথম মাসেই ২০০ কোটি ইনফর্মাল শ্রমিকদের মজুরি বিশ্ব হারের ৬০ শতাংশ হ্রাস প্রাপ্ত হয়। যে ইনফর্মাল শ্রমিকদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে চোখ ধাঁধানো নগর সভ্যতা, মুষ্ঠিমেয় বিত্তবানদের বিপুল উৎকট ও কুৎসিত বৈভব যাদের উপর ভর করে এসেছে, সেই অযুত – নিযুত মানুষগুলোর না আছে নিশ্চিত, ভদ্রস্থ আয়ের গ্যারান্টি, না আছে সুলভে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ সুবিধা। না আছে ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচ। তাদের না আছে ভবিষ্যতের জন্য কোনো আর্থিক সঞ্চয়, বার্ধক্যকালীন পেনশন। তাদের নেই কোন ভবিষ্যৎ, আছে শুধু রুক্ষ প্রাণহীন বর্তমান। যা ঝুলে রয়েছে হাজারো অনিশ্চয়তার সূক্ষ সুতোর উপরে। করোনায় সব হারানো এই মানুষদের পাশে গোটা দুনিয়া যদি সামাজিক সংহতিবোধ থেকে পাশে না দাঁড়াতে পারে, আইএল ও সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, তবে তারা স্রেফ আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তেনিয়ো গুতেরেস গোটা বিশ্বের কাছে এক আবেদন জানিয়ে বলেছেন, “বর্তমানে আমরা এক অত্যন্ত নজীরবিহীন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি, যেখানে সাধারণ সময়ের নিয়মগুলো খাটে না।”
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “বছরের শেষে গোটা দুনিয়ায় শ্রমিকদের আয় ৩.৪ লক্ষ কোটি ডলার হ্রাস প্রাপ্ত হবে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন স্বল্প আয় সম্পন্ন শ্রমিক ও মহিলারা। এই সংকটের বোঝাকে সবচেয়ে আক্রান্ত দুঃস্থ মানুষদের উপর চালান করে দিলে আমরা জন্ম দেব হত দরিদ্র গরিব মানুষদের বিশাল এক বাহিনীকে।”
১৮ মার্চ আই এল ও প্রকাশ করেছে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট – কোভিড ১৯ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড পলিসি রেসপন্সেস। অতিমারীর প্রবল আঘাতে দুনিয়া জুড়ে বিপর্যস্ত সাপ্লাই চেন সমস্ত ধরনের ব্যবসা- বানিজ্যকে, ছোট মাঝারি অসংখ্য সংস্থাকে যে ধ্বংস করে দিয়েছে আর তার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকটা জরুরী পদক্ষেপের উল্লেখ করেছে। এই গভীর সংকটে আর্থিক বৃদ্ধি ও বিকাশের লক্ষ্যে “মানবিক মনোভাব সম্পন্ন (হিউম্যান সেন্ট্রিক) নীতি অনুসরণ করার উপর জোর দিয়েছে। তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় সর্বপ্রথম রয়েছে শ্রমিক কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কোভিড ১৯-এর ঝুঁকির হাত থেকে সুরক্ষিত করা, তাঁদের কর্মস্থল গুলোকে ঝুঁকিহীন-সুরক্ষিত করে তোলা, এবং তার জন্য বিপুল পরিমাণে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও সহায়তা প্রদান। দ্বিতীয়ত, রুটি রুজি হারানো মানুষদের কর্মসংস্থান, বিরাট মাত্রায় আর্থিক সহায়তা প্রদান, (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রঘুরাম রাজন এই সমস্ত গরিব মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধার্য করার প্রস্তাব দিয়েছেন)। সর্বস্তরের শ্রমিকদের সবেতন ছুটির সুযোগ দেওয়া (যা ইনফর্মাল শ্রমিকদের ক্ষেত্রে জোটে না)। তৃতীয়ত, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করতে অগ্রাধিকার দেওয়া, সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের নিরাপদ – স্বাস্থ্য সম্মত কর্মস্থল সুনিশ্চিত করা (এ প্রশ্ন ভারত সবচেয়ে পিছিয়ে)।
আইএলও আরেকটা বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দিয়েছে। তা হল, ত্রিপাক্ষিক স্তরে আলাপ আলোচনা। সরকার – শ্রমিক ইউনিয়ন – নিয়োগ কর্তার মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময়, ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাগুলোকে উন্নত ও মজবুত করে। এই অতিমারি বিরাজমান প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনসাধারণের চুড়ান্ত অনাস্থা তৈরি করে। আইএলও তাই বিভিন্ন দেশের শাসকবর্গের কাছে সতর্কবার্তা দিয়ে আশংকা করছে যে ভেঙে পড়া এই আস্থা আগামীদিনে বিরাট সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দেবে, যা এখন থেকে সামাল দিতে না পারলে পরে তা নাগালের বাইরে চলে যাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, কেইন্সের অর্থনৈতিক দর্শন সংকটগ্রস্থ পুঁজিবাদী দুনিয়াকে নতুন ভাবে উঠে দাঁড়াতে বিরাট ভূমিকা রাখে। পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে কল্যাণকামী রাষ্ট্র ও সরকারী বিনিয়োগে গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আত্মপ্রকাশ করে। কোভিড-১৯-এর দুনিয়া জোড়া সুনামির পর কী আবার নতুন করে জনস্বাস্থ্য, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কবচ, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ – যাকে নব্য উদার অর্থনীতি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অপচয় মনে করে বেসরকারিকরণকেই একমাত্র মোক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে, – আবার আসবে কেন্দ্রবিন্দুতে? তা অনাগত আগামী বলবে। ২০০৮ সালের ফিনান্সিয়াল মেল্টডাউনের পর বিভিন্ন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক মহল ডুবন্ত অর্থনীতিকে বাঁচাতে তখন বিপুল আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে কর্পোরেটদের স্বার্থে। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করলো, সেই বিরাট বহরের আর্থিক সাহায্য পাওয়ার পর ও বৃহৎ পুঁজি – কর্পোরেট ঘরানাগুলো বিন্দুমাত্র সামাজিক দায় দায়িত্ব পালন করেনি। ব্যাপক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস ঘটিয়ে দুনিয়া জুড়েই শ্রমজীবী মানুষের উপর নামানো হয়েছিল বিরাট হামলা। আইএলও-র হিসাব বলছে, ঐ সংকটের ফলে বিশ্ব ব্যাপি বেকারত্ব দু’কোটি দু লক্ষ্য বৃদ্ধি পায়। সেখান থেকে কি এবার শিক্ষা নেবে আন্তর্জাতিক মহল? বিভিন্ন অর্থশাস্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, এবার ও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করার আগে বেশ কিছু কঠিন শর্ত আরোপ করা হোক।
আমাদের দেশের শাসকেরা আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষা নিল না। সমস্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, অর্থশাস্ত্রী সমস্ত গরিব মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তাদের বেঁচে বর্তে থাকার মতো আর্থিক অনুদান, বুবুক্ষা ভারতবর্ষের অগণন ক্ষুধার্ত মানুষকে দু-বেলা বিনামূল্যে পর্যাপ্ত রেশন, সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা অবিলম্বে গড়ে তোলা প্রভৃতি প্রস্তাব রাখলেও কোন সরকারই তা কর্ণপাত করল না। এমনকি ২৯ মার্চ, ভারত সরকার জাতীয় বিপর্যয় আইনের ১০ (২)(১) ধারার ভিত্তিতে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে, লকডাউনের সময় কাউকে ছাঁটাই বা মজুরী কাটা চলবে না। কিন্তু, বহু সংস্থা আজ পর্যন্ত তার মান্যতা না দিয়ে কর্মী ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস করলেও না রাজ্য না কেন্দ্র, কেউই এর বিরুদ্ধে কোন বিধিব্যবস্থা নিল না। আইএলও-র রিপোর্ট উল্লেখ করেছে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে গরিব, ইনফর্মাল শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্য – আর্থিক নিরাপত্তা – কর্মস্থলে নিরাপত্তা প্রভৃতি নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। সেখানে মোদীর ভারতের কোন স্থান নেই।
এযাবৎ অনুসৃত নয়া উদারবাদী অর্থনীতির গতিমুখকে আমূল বদলে নতুন জনমুখী আর্থিক প্যারাডাইমের অভিমুখে সরকারকে বাধ্য করার উপরই আবর্তিত হবে আগামীর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভাষ্য। যেখানে মুনাফা নয়, মানুষের উন্নয়ন, স্বার্থ ই থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে।
এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে ইন্ডিয়া আর ভারত। ইন্ডিয়ার জনসাধারণ সবাইকে মুখ বেঁধে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর নিরন্ন ভারতের অনশনক্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়ে, সহায় সম্বল আশ্রয় হারিয়ে শতশত মাইল পদব্রজে অতিক্রম করতে পথে নেমেছেন নিজেদের ঘরে ফেরার আশায়। মরলে সেখানেই শান্তিতে মরবেন, স্বভূমিতে স্বজনের উপস্থিতিতে মরবেন। পথে তাঁরা তৃষ্ণার্ত হয়েছেন, ক্ষুধার্ত হয়েছেন। অবুঝ শিশুরা কাঁদছে ক্ষুধার তাড়নায়। কখনো পথে কেউ সহৃদয় হয়ে একটু জল দিয়েছন, খাবার দিয়েছেন। তারপর আবার তাঁদের পথচলা। এই পথেই বারবার জুটেছে পুলিশের মার। তাঁরা রক্তাক্ত হয়েছেন, যন্ত্রণাতুর হয়েছেন। তাঁদের সেই সকরুণ আর্তনাদে পুলিশের হৃদয় করুণার্দ্র হয়নি, রাষ্ট্রযন্ত্রের টনক নড়েনি। এমন দৃশ্য মাসকয়েক আগেও ছিল চিন্তাভাবনার অতীত। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর এই প্রথম মানুষ এইভাবে আশ্রয়চ্যুত হয়ে, কর্মচ্যুত হয়ে, ঘরে ফেরার জন্যে কাতর হয়ে পথে নেমেছেন। তাঁদের ছায়ায় আসন্ন দুর্ভিক্ষের গন্ধ। আসন্ন এক অসহায় ভারতের ছবি।
এই অসহায় মানুষগুলোই হচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবার, যাঁরা ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যেই অন্য রাজ্যে, বিদেশ বিভূঁইয়ে, গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। সেখানে যে যার মতো কাজে লিপ্ত হয়ে দিনাতিপাত করছিলেন। গত মার্চ মাসের চব্বিশ তারিখে সহসা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই সারাদেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় তাঁদের বর্তমান বিপন্ন, ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
সাড়ে আঠাশ কোটি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ভারতের সর্বত্র ব্যাপৃত এই লংমার্চের রাস্তা থেকে যদি পাড়ায়, এলাকায়, সন্নিহিত অঞ্চলে চোখ ফেরানো যায় তাহলে দেখা যাবে এই চিত্রই একটু অন্যরকমভাবে আমাদের আশপাশে সচল রয়েছে। বাড়ির কাজের মাসি-বোনেদের এই করোনাক্রান্ত সময়ে কাজে আসা নিষেধ। তাঁরা গালে হাত দিয়ে অসহায়ভাবে অশ্রুপাত করছেন। যাঁরা রাস্তার ভিখিরি, ভিক্ষে করে দিন গুজরান করে থাকেন, তাঁরা এখন অসহায়। ভিক্ষা মিলছে না। তাঁরা পথে বেরোতে পারছেন না। যাঁরা ট্রেনে-বাসে হকারি করে দিনযাপন করেন, তাঁদের এখন কাজ নেই। বাড়ির মিস্ত্রির এখন কাজ নেই। ছোট দোকানদার দোকান খুললেই পুলিশের মার জুটছে। বাজারে ভিড় এড়াবার একমাত্র সহজ পদ্ধতি হিসেবে বাজার সিল করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্যে বেরিয়ে পুলিশের লাঠির শিকার হচ্ছেন। একদিকে করোনাজনিত লকডাউনের সৃষ্ট সন্ত্রাস, অপরদিকে মূর্তিমান যমসদৃশ পুলিশি সন্ত্রাস।
মূলত এই ঘটমান বর্তমানের প্রেক্ষাপটেই শিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত তাঁর সংবেদনশীল মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁর বাহান্ন পৃষ্ঠার কৃশকায় গ্রন্থ নিরন্ন কর্মহীন –এর পৃষ্ঠায়। এই করোনাক্রান্ত, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি নিনাদিত তমসাকীর্ণ সময়ে শিল্পী তাঁর প্রথাগত দৃষ্টিনন্দিত ভুবন থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন এইসব আশপাশের কর্মহীন অসহায় মানুষগুলোর প্রতি। তাঁর হৃদয়ে এই চিত্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি এই সময়কে অবশ্য এক ‘অসুখ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, এখন মানুষের কর্মহীনতা এবং গৃহবন্দিত্ব আসলে একটা অসুখ। একে নিছক অসুখ বলে মান্যতা দিলে তো এর জন্যে কারও বিন্দুমাত্র দায়দায়িত্বের অস্বীকরণ প্রতিষ্ঠা পায়। সঠিক সময়ে বিপন্নের সঠিক সাহায্যপ্রাপ্তির অধিকারও অস্বীকৃত হয়ে যায়। রাষ্ট্রের নির্বিবেক ভূমিকা, নিয়োগকর্তার অমানবিকতা কোনও অপরাধ বলে আর গণ্য হয়না।
তবে শিল্পী কৃষ্ণজিৎ স্বীকার করেছেন : তিনি এতকাল ‘অনায়াস উপেক্ষায়’ এইসব মানুষজন থেকে তাঁর চোখ সরিয়ে রেখেছিলেন, ‘এইবার নিরন্ন কর্মহীন মানুষের মুখ’ তাঁর স্কেচের খাতায় এসে ভিড় করেছে, তবে তাঁদের মুখে কোনও ‘মাস্ক’ নেই। কারণ তিনি মনে করেন মাস্কের ‘শাক দিয়ে আতঙ্কের মাছ’ ঢেকে রাখা এক অসম্ভবের শিল্পচর্চা। এইখানেই শিল্পীর বিদ্রোহ, শিল্পীর নবজন্ম ।
এই গ্রন্থ জুড়ে তাঁর স্কেচের ভুবনে ভিড় করেছে রাজমিস্ত্রি, রিকশাঅলা, ভ্যানচালক, নাপিত, ছুতোর, বাড়ির কাজের মাসি, হকার প্রমুখের অসহায়, আতঙ্কগ্রস্ত মুখ। কবিবন্ধু বিপুল চক্রবর্তী একবার তাঁর এক ছোট্ট একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মুখোশের আড়ালে নয়, তোর মুখ দেখতে চাই পোড়ামুখী’। এখানে শিল্পী কৃষ্ণজিৎ-ও মুখোশের আড়াল থেকে নয়, সরাসরি সেইসব ক্লীন্ন, অসহায়, আতঙ্কগ্রস্ত মুখগুলো দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছেন। তিনি আরও একটি কথা অকপটে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ করা সেইসব বিপন্ন মানুষগুলোর মুখচ্ছবি ‘হুবহু’ আঁকেননি, তবে বোঝাই যাবে তিনি কাদের মুখ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। এই করোনাবিধ্বস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত, অসহায় কর্মহীন মানুষগুলোর অঙ্কিত মুখগুলর বলিরেখায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এই কালবেলার তাঁদের প্রকৃত মুখের আদল।
শিল্পীকে অভিনন্দন। এই প্রপীড়িত মানবাত্মার প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ নতচিত্ততার জন্যে তিনি অবশ্যই পাঠকের শ্রদ্ধা এবং সমীহ আদায় করে নেবেন।
কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত : নিরন্ন কর্মহীন। উদ্ভাস। বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। প্রথম ডিজিটাল সংস্করণ, এপ্রিল ২০২০। বিনিময় : আশি টাকা
- জয়তু দেশমুখ।
লকডাউনের একমাস দশ দিন পেরিয়ে গেলো। একটু খোঁজখবর করলেই দেখা যাবে দিন-আনি দিন-খাই অবস্থা যাদের সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে এ অবস্থাটা আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য আজ সবচেয়ে বড় সংকট রূপে তাঁদের কর্মহীন প্রাত্যহিক জীবনে একেবারে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে। ভয়াবহ এই সংকটের সময়কালে রেশনে যতটুকু পাওয়া যায় সেই চাল-গমই তাদের একমাত্র সম্বল! খড়কুটোর মতো সেটুকুই মানুষ আঁকড়ে ধরেছে। লকডাউনে ঘরে থাকার কথাই কেবল আউড়ে গেছে সরকার, গরিব মানুষের রুজি রুটির বিকল্প সংস্থানের জন্য কোনো কিছুই কোনো সরকার করেনি। স্বাভাবিক ভাবেই রেশনের সমগ্র ব্যাবস্থাটার গভীরে যে অপ্রাপ্তি – বঞ্চনা ও দুর্নীতি বাসা বেঁধে রয়েছে, গণবন্টনকে গুটিয়ে ফেলার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মূলত তার বিরুদ্ধেই দিকে দিকে শুরু হয়েছে প্রবল গণক্ষোভ! জেলায় জেলায় বহু জায়গায় রেশনে বরাদ্দ খাদ্যসামগ্রী পরিমাণে কম দেওয়া হচ্ছে। কোথাও বা নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা, রাইসমিলে বা শাসকদলের গ্রামীণ মাতব্বরদের ঘরে মালপত্র অদলবদল করা ইত্যাদি চলছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে শাসক দলের যে প্রবল আধিপত্য কায়েম রয়েছে তাতে ওদের মদত বা প্রশ্রয় ছাড়া রেশনে এ জাতীয় অনিয়ম-দুর্নীতি বাস্তবে চলতেই পারেনা। সঙ্গতভাবেই উঠে এসেছে ফুড সাপ্লাই তথা শাসক দলের রেশন সিন্ডিকেটের কথা। ওদিকে বহু সংখ্যক মানুষের ডিজিটাল রেশন কার্ড নেই। হাজার হাজার মানুষ নিয়ম বিধি অনুযায়ী ‘টোকেন’ও পায়নি,বহু যায়গায় ‘টোকেন’গুলি পঞ্চায়েতের কর্তারা ঘরে রেখে দিয়ে কারচুপি করে মাল তুলে নিচ্ছে। শাসকদলের নেতারা রেশনের মাল গোপনে তুলে নিয়ে সেটাকেই ‘ত্রাণ’ হিসাবে বিলি করে গরিব মানুষকে তাঁদের অনুগত করে রাখার ঘৃণ্য রাজনীতি করছে। দেখা যাচ্ছে বিডিও অফিসে কার্ড না থাকা মানুষের দীর্ঘ লাইন। সেখানে অনাহার অর্ধাহারে থাকা গ্রামীণ গরিবদের বলা হচ্ছে – পঞ্চায়েতে যাও। পঞ্চায়েত বলছে – বিডিও অফিসে যাও। সব মিলিয়ে চলছে এক চরম বিশৃঙ্খলা। উদাহরণ প্রচুর! বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে বর্ধমানের পূর্বস্থলী, নদীয়ার নাকাশীপাড়া থেকে মুর্শিদাবাদের সালার – বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া খবরে দেখা যাচ্ছে এই সব অনিয়ম বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। বাস্তবে রেশন কার্ড না থাকাটা ব্লক ও জেলার ফুড সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের দীর্ঘসূত্রিতা এবং অতিপরিচিত ঘুষের কারবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত! যেমন একটি পরিবারের মধ্যে অনেকেরই নতুন কার্ডের আবেদনের কাগজপত্র মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ঘুষের বিনিময়ে কার্ড তৈরি করার জন্য সক্রিয় দালাল চক্রর মাধ্যমে কারও কপালে শিকে ছেঁড়ে, অধিকাংশেরই জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যায়। মানুষ মাসের পর মাস বঞ্চিত থেকেই যায়।
এই রেশন দুর্নীতির বিষয়টা নিছক কতিপয় অসাধু ডিলারের রেশন চুরির প্রশ্ন নয়। সমগ্র গণবন্টন ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে দুর্নীতি। স্বভাবতই শাসক দলের গ্রামীণ মাতব্বর, ডিলার, খাদ্য দপ্তরের আমলার যোগসাজসে এই চক্র সক্রিয়। সম্প্রতি যেটা যুক্ত হয়েছে তা হলো বহুসংখ্যক গরীব মানুষকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকার রেশন ব্যাবস্থাকে ধাপে ধাপে তুলে দিতে চাইছে। খাদ্য সুরক্ষার গালভরা কথাটুকু শিকেয় তুলে নগদ ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তুতি জোরকদমে শুরু হয়েছে। রান্নার গ্যাসে যা চালু হয়েই গেছে। রেশনের দোকানে দোকানে চলছে ডিজিটাল কার্ড পাঞ্চ করার পকসো মেশিন চালু করার তোড়জোড়। এ বছর কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্য ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। খাদ্য মজুত ও সরবরাহের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ফুড কর্পোরেশনের অফ ইন্ডিয়া(এফসিআই)-র জন্য বরাদ্দ অর্থও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে খাদ্যদ্রব্যের অবাধ বানিজ্য চালু করার নীতিতে কেন্দ্র এগিয়ে চলেছে। গণবন্টনে কাটছাট করতে করতে যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটাকে তুলে দিলেই বৃহৎ খাদ্য ব্যবসায়ীদের লাভ। সরকার এখন ওদেরই স্বার্থরক্ষা করে চলেছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই এ রাজ্যের ৯ কোটি রেশন কার্ডের ৬ কোটির কিছু বেশি সংখ্যক মানুষকে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় (এনএফএসএ) তিন রকম কার্ডের মাধ্যমে যুক্ত করেছে, বাকি ৩ কোটিকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। আগে বিপিএল-রা ৮ কেজি মাল পেতো। সেটা কমিয়ে করা হয়েছে ৫ কেজি! অন্যদিকে রাজ্য সরকার প্রায় দেড় কোটি গ্রাহককে ২ টাকার খাদ্য প্রকল্পে যুক্ত করলো – বাকি দেড় কোটি হয়ে গেলো বাদ! তারা নাকি রেশন থেকে কিছুটা কমদামে কিনে খাবে! বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই ঐ খাদ্যদ্রব্য তোলে না। ওটা যায় ডিলার ও অসাধু চক্রের পকেটে। তাই দেখা যাচ্ছে গণবন্টন সংকোচন নীতিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একই পথের পথিক। কাগজে কলমে ধান কেনা ও চাল তৈরি করার ক্ষেত্রে এ রাজ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ – রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী এই ফাটা রেকর্ড শুনিয়েই চলেছেন। কিন্তু বাস্তবে রাইস মিলগুলি সরকারের ঘরে চালই পাঠায় না। ওরা ফড়ে দালালের মাধ্যমে চাষিদের থেকে ১০০০-১১০০ টাকায় ধান কিনে ১৮৫০ টাকা সরকারী দর আত্মসাৎ করে। লেভি হিসাবে যতটা চাল সরকারকে দেওয়ার কথা মিলগুলি আদৌ দেয় না। ফলে গণবন্টনের জন্য প্রয়োজনীয় চাল রাজ্য সরকারের কাছেও মজুত নেই। এই বিষয়গুলিই রেশনে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ কম হওয়ার নেপথ্যে বাস্তব কারণ হিসাবে থেকেছে। করোনা লকডাউনের নতুন পরিস্থিতিতে যা প্রকটভাবে একেবারে সামনে উঠে এসেছে।
লকডাউনের পরিস্থিতিতে বিনামূল্যে চাল-গম কারা পাবে, রাজ্যের কাছে প্রয়োজনীয় চাল-গম সরবরাহ হয়েছে কী হয়নি তা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে কেন্দ্র ও রাজ্য চাপান উতোর। রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি চালাচালি। ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ – মাঝখান থেকে বঞ্চিত হলো রাজ্যের ব্যাপক গরিব মানুষ। লকডাউনের ঠিক পরেই কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা ছিলো অতিরিক্ত ৫ কেজি চাল দেওয়া হবে। মার্চ মাসের এক সপ্তাহ এবং এপ্রিল মাসের চার সপ্তাহ মোট পাঁচ সপ্তাহ তরজা করতে করতেই কেটে গেলো। গ্রাহকরা সেই বর্ধিত চাল পেলোই না। সেটা দেওয়া শুরু হলো মে মাসে। তাও রাজ্যের ৩ কোটির কিছু বেশি সংখ্যক গ্রাহকরা সেই বর্ধিত চাল অর্থাৎ মাথা পিছু মাসিক ১০ কেজি পাবে না। আর যারা মে মাসে পেলো কিন্তু তাঁদের প্রাপ্য এপ্রিল মাসের মাথাপিছু ৫ কেজি মাল যে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো, এ দায় কার? কারা কেড়ে খেল মুখের গ্রাস? অবশ্যই কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারই এজন্য সমানভাবে দায়ী। রাজ্য সরকার তার দুই রকম গ্রাহকদের বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার দাবি লাগাতার একগুঁয়ে ভাবে অস্বীকার করে চলেছে। দেখা গেলো এপ্রিল মাসের চার সপ্তাহ আরকেএসওয়াই ২নং গ্রাহকরা ৫ কেজি চাল পায়নি। অসহায় বহু গরিব মানুষ ভুল ভাবে ঐ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছিলো। তাদেরকে লকডাউনের একমাস বঞ্চিত করা হলো। রেশনে পরিবারপিছু মাসিক মাত্র ১ কেজি ডাল কেন্দ্রীয় গ্রাহকদের দেওয়া হবে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য! তাই দাবি উঠছে, মাথা পিছু ১৫ কেজি খাদ্যদ্রব্য আগামী ৬ মাস দিতে হবে। এ দায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে মিলিতভাবে নিতে হবে। স্পেশাল রিলিফের যে খাদ্য দ্রব্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিলি করার কথা - সেটা শাাসকদলের দলীয় কার্যালয় থেকে বিলি করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য এই অবৈধ কাজ করা হচ্ছে স্বজন পোষণ ও দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এটাকে বন্ধ করে রেশনের মাধ্যমে কার্ড না থাকা মানুষদের মধ্যে বিলি করার দাবি সঙ্গত ভাবেই উঠে এসেছে।
রেশন দুর্নীতি বন্ধ করার একমাত্র উপায় গণতদারকি। তাই গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন স্তরের মানুষের ও সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই গণ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই একমাত্র সমাধান! গরিব মেহনতি মানুষের পাল্টা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সাথে এটা সম্পর্কযুক্ত! তাই সার্বজনীন গণবন্টনের অধিকারের দাবীতে, লকডাউনের পরিস্থিতিতে চাল-গম ছাড়াও ডাল, তেল, আলু, মশলা প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের দাবিতে দিকে দিকে গড়ে উঠছে বঞ্চিত ভূখা মানুষের লড়াই।
“পাহাড় ভেঙ্গে,
পাথর গুঁড়িয়ে,
রাস্তা তৈরি হয়,
ইঁট রক্ত মিশিয়ে,
পরিশ্রম কার? ধনরাশি কার?
জঙ্গল কেটে,
মাটি চষে,
ফসল জন্মায়,
ঘাম ঝড়িয়ে,
ভাত কার? ফ্যান কার?”
- চেরবণ্ডারাজু
সম্মান আর অধিকারের দাবিতে সংঘর্ষের ইতিহাসকে মনে রেখে পয়লা মে সারা পৃথিবী জুড়ে মজদুর দিবস পালন করা হয়।
মে দিবসের উত্তরাধিকার কী?
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের আটজন শহীদ মজদুর নেতাকে স্মরণ করে মে দিবস পালিত হয়। তাঁদের দাবি ছিল কাজের সময়ের ঊর্ধসীমা আট ঘণ্টা করা হোক। এই দাবিতে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এঁরা এবং এই কারণেই তাঁদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। সারা পৃথিবী আট ঘণ্টা কাজের দাবীতে কেঁপে ওঠে এরপর, এই দাবি মেনেও নেওয়া হয়। ১৯৪২ সালে, ভারতে এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন ডাক্তার ভীমরাও আম্বেদকর। এর পরেই কাজের সময় সর্বোচ্চ আট ঘণ্টায় বেঁধে দেওয়া হয়।
কিন্তু আজ এই করোনা মহামারীর সংকটাবস্থায় ভারত সরকার এই নিয়ম বাতিল করার জন্য আটঘাট বাঁধছে। মজদুরদের ওভারটাইমের মজুরি ছাড়াই দিনে বারো ঘণ্টা কাজ করানোর নতুন আইন আনতে চাইছে সরকার। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার পুঁজিবাদী শাসকবর্গ ন্যায্য দাবীর প্রেক্ষিতে লড়াইতে শামিল মজদুর নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল, তাদের ওপর রাষ্ট্রদ্রোহ ও হত্যার মিথ্যা দায় চাপিয়েছিল। শিকাগো হে-মার্কেটের সংঘর্ষের সময় আমেরিকান পত্রপত্রিকার ভয়ানক, মজদুর-বিরোধী রূপ সবার সামনে আসে। পুঁজিপতিদের পদলেহন করে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা হয়, “যে মজদুররা বেশী মাইনে আর তাদের ভুখা বাচ্চাদের পেটের ভাত চায় তাদের গুলি করা উচিত, বোমা মারা উচিত। এদের স্বাধীন থাকার অধিকার নেই, ভোটাধিকার তো কোনমতেই নয়।”
এই ২০২০ সালেও করোনার কবলে পড়া গরিব মজদুররা তাদের ভুখা বাচ্চাদের জন্য ভাত চাইছে। ফলত পুলিশের লাঠির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। গরিব, মজদুরদের সংঘর্ষের সাথী নেতাদের কোন না কোন কালা কানুনের আওতায় জেলে পোড়া হচ্ছে। সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মুখ খুললে ভারতের সংবাদমাধ্যম তাকে দেশদ্রোহীর অভিধা দিচ্ছে, প্রচার করছে এদের হত্যার সপক্ষে।
এমতাবস্থায় হে-মার্কেটের শহিদদের মধ্যে অন্যতম অগাস্ট স্পাইসের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়, “তোমরা যদি ভাব আমাদের ফাঁসিতে চড়িয়ে তোমরা এই লড়াইকে চুপ করিয়ে দেবে, তাহলে আমাদের ফাঁসিতে চড়িয়ে দাও। এখানে একটা স্ফুলিঙ্গ চাপা দেবে, ওখানে তোমাদের পিছনে আর তোমাদের সামনে আগুন গর্জিয়ে উঠবে। এই আগুন মনের মধ্যে জ্বলছে, তোমাদের পায়ের মাটির তলায় জ্বলছে, একে নেভাতে পারবে না তোমরা।”
একইসাথে ফৈযের একটি কবিতাও মনে পড়ে যায়,
“আমরা আমাদের ভাগ চাইবো,
একটা ক্ষেত নয়, একটা দেশ নয়,
আমরা এই গোটা পৃথিবী চাইব।”
এই পৃথিবী গোটাটাই চলে মজদুরদের খাটনির দৌলতে, এই বিপুল ধনরাশিও তৈরি করেছে শুধু তারাই। একদিন সবরকম দমন শোষণের চোখে চোখ রেখে এই পুরো দুনিয়ার ভাগ চাইবে এই মজদুররা।
আজ আমরা সবাই করোনা অতিমারীর সাথে লড়াই করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মোদী সরকার এর জবাবে দিয়েছে শুধুই ঠাট্টা, তামাশা আর অপরিকল্পিত লকডাউন। এর ফলে সাধারণ মানুষকে অপরিসীম মুশকিলের মুখে পড়তে হচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষকে মারা হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে, হেনস্থা করা হচ্ছে, তাদের ওপর রাসায়নিক কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে। ঘরে ফেরার তাগিদে বহু মজদুর মাইলের পর মাইল হেঁটে প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রথম পর্বের লকডাউনে, এসওএএন-এর এক সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ভিনরাজ্যে আটকে পড়া ৯৬ শতাংশ পরিযায়ী মজদুর সরকারের তরফ থেকে কোন রেশন পাননি, ৮৯ শতাংশ মজদুর কোনো বেতন পাননি, ৭৪ শতাংশ মানুষের কাছে লকডাইনের বাকি সময় কাটানোর জন্য তাঁদের দৈনিক বেতনের অর্ধেক পড়ে ছিল। এরকম মানুষের সংখ্যা লকডাউনের এক একদিন বাড়ার সাথে সাথে আরও বেড়ে চলেছে। মনে রাখবেন, লকডাউন বাড়িয়ে ৪০ দিনের করা সত্ত্বেও কোনো ত্রাণপ্রকল্পের ঘোষণা করা হয়নি। বেরোজগারী আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে, কিন্তু মোদী সরকার নিত্যনতুন মজদুরবিরোধী নীতি এনেই চলেছে। এসত্ত্বেও মজদুররা লড়াই থামাননি।
আমরা করোনা, সাম্প্রদায়িকতা আর মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লড়ব। সবার পেটে ভাত থাকবে, কারোর মাইনে কাটা চলবেনা, কারোর চাকরী কেড়ে নেওয়া চলবেনা।
আজকের এই সংঘর্ষে জার্মানীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পুরোধা রোজা লুক্সেমবার্গের উক্তি ধ্বনিত হয়, “যতদিন শাসকবর্গ এবং পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে মজদুরদের লড়াই চলবে, যতদিন তাদের প্রত্যেক দাবি মানা হবেনা ততদিন মে দিবস এই দাবিগুলির বার্ষিক অভিব্যক্তি রূপে পালিত হবে। আর যখন ভাল দিন আসবে, যখন এই পৃথিবীর সমগ্র মজদুরবর্গ নিজেদের দাবির লড়াই জিতে যাবে, হয়ত তখনো সমগ্র মানবসমাজ মে দিবস পালন করবে – বিগত দিনের সেই দারুণ সংগ্রাম আর দুঃখের স্মৃতির সম্মানে।”
এই প্রতিবেদন লেখা যখন চলছে, তখন পর্যন্ত (০৫/০৫/২০২০) আমেরিকায় নোভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১২১৩১৮৫ এবং কোভিড-১৯ প্রাণ নিয়েছে ৬৯৯২৯ মানুষের। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় এই সংখ্যাগুলো অনেক বেশি। এবং সে দেশের অর্থনীতিও বড় ধরনের সংকোচনের মুখে। কিন্তু আমেরিকাকে এত বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হল কেন? ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক জীবাণুর কাছে অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশটার এমন নাস্তানাবুদ অবস্থা আধুনিকতার সীমাবদ্ধতা এবং প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুরতার পরিণামকে যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সেরকমই গোড়ার দিকে এর ভয়াবহতার সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করার মাশুল গুনতে হওয়ার আখ্যানকেও সামনে নিয়ে আসছে। আমেরিকার এক বড় অংশ, গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রদেশই কোভিড-১৯-এর গ্ৰাসে চলে যাওয়ায় আমেরিকার জনগণ সহ অনেক ভাষ্যকারই আমেরিকার এই বিপর্যয়ে ট্রাম্প ও তাঁর পার্শ্বচরদের ভূমিকাকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। এবং কেন সে কথা বিচার করা যাক।
আমেরিকায় করোনা সংক্রমণের প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে জানুয়ারীর মাঝামাঝি, এবং করোনা ঘটিত মৃত্যুর প্রথম খবরটা পাওয়া যায় ২৯ ফেব্রুয়ারী। ইতিমধ্যে জানুয়ারির শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থার কথা ঘোষণা করেছে। তখনও কিন্তু এই ঘটনায় গুরুত্ব দেওয়া, চীনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোন তাগিদই ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের দিক থেকে দেখা গেল না। এই ভাইরাসের সংক্রমণকে গোড়ার দিকে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতন বলে ট্রাম্প মন্তব্য করলেন। যেমন, ২৬ ফেব্রুয়ারী সাংবাদিকদের কাছে নিত্যদিনের বিবৃতিতে বললেন, “এটা একটা ফ্লু। এটা একটা ফ্লুর মতন।” ফেব্রুয়ারীর ২৮ তারিখে আবার বললেন, “এটা মিলিয়ে যাবে। একদিন ভোজবাজির মতন – এটা উবে যাবে।” কখনও আবার, যেমন ফেব্রুয়ারীর ৭ ও ১৯ তারিখে, তাঁর কল্পনা ডানা মেলে এই অভিলাষের ওপর ভর করল যে – এপ্রিলের গরম হাওয়ায় ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা যখন বলছেন যে, নোভেল করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বার করতে কম করে এক থেকে দেড় বছর লাগবে, ট্রাম্প ২৫ ফেব্রুয়ারী বলে বসলেন, “দ্রুতই এক টিকার সন্ধান পাওয়া যাবে।” এই সমস্ত মন্তব্য এমন এক রাষ্ট্রপ্রধানকে দেখিয়ে দেয়, যিনি শুধু এই ভাইরাস থেকে বিপদের সম্ভাবনাকেই অবজ্ঞা করেননি, নোভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে যাঁর ধারণা ছিল একেবারেই ফাঁপা এবং এই বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থাকে বিপথে চালিত করার পক্ষে যা ছিল যথেষ্ট।
নোভেল করোনাভাইরাসের কাছে আমেরিকার চূড়ান্ত রূপে পর্যুদস্ত হওয়ার কারণ হিসাবে সেখানকার ভাষ্যকাররা ফেব্রুয়ারীর শেষের দিক থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ও প্রশাসনের করোনাভাইরাসের নিজেকে ব্যাপ্ত করার, বিশাল সংখ্যক মানুষকে সংক্রমণ কবলিত করার ভয়াল সম্ভাবনায় গুরুত্ব না দেওয়াকেই দায়ী করেছেন। এই সময়ে যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা হল না, পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিটও ছিল না। আর নমুনা পরীক্ষা না হওয়ায় সংক্রমিতদের যেমন খুঁজে বার করা গেল না, তেমনি তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদেরও খুঁজে বার করে কোয়ারান্টিনে পাঠানোর ব্যবস্থা হতে পারল না। বিভিন্ন প্রদেশের হাসপাতালগুলোতে মাস্ক, গ্লাভস, বর্মবস্ত্রর তীব্র অভাবও দেখা গেল। বর্মবস্ত্র না পাওয়ায় নার্সরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, এমন ছবিও সংবাদপত্রে ছেপে বেরোলো। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে বিদেশ থেকে যে নাগরিকদের ফেরানো হল, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিড়ে ঠাসা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হল। না জানা সংক্রমিতদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক অসংক্রমিত ব্যক্তিও সংক্রমণের শিকার হলেন। যখন ট্রাম্পের বোধদয় হল যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, বিপদ গুরুতর মাত্রা নিয়ে নিয়েছে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে, তার বিস্তারের জন্য নোভেল করোনাভাইরাসের পালে অনেক বাতাস ইতিমধ্যেই জোগানো হয়ে গেছে। ট্রাম্প অবশেষে ১৩ মার্চ যখন জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন, ততদিনে আমেরিকায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭০১ এবং কোভিড-১৯ থেকে মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। দ্য টেলিগ্ৰাফ পত্রিকার ১৩ এপ্রিলের সংস্করণে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমস নিউজ সার্ভিস-এর একটা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হল – “হোয়াইট হাউসে তাঁর শাসন পর্বের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ফেব্রুয়ারীর শেষের দিনগুলো সম্ভবত তাঁর কাছে আসা সতর্কবার্তাকে গ্ৰহণ করতে ট্রাম্পের অক্ষমতা অথবা অনাগ্ৰহকে সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরে। …”
লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ছেদ এবং শেয়ার বাজারের পতন তাঁকে যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে তোলে। অর্থনীতির ইঞ্জিন কত তাড়াতাড়ি সচল করা যাবে, এই তাড়না থেকে তিনি সম্ভবত কোভিড-১৯ মোকাবিলার উদ্ভট কিছু উপায় বাতলানোর পথে গেছেন। কখনও বলেছেন কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন (যে ওষুধটা সরবরাহের জন্য ভারতের ওপর চাপ দেওয়া হয় এবং ভারত না দিলে ‘প্রত্যাঘাতের’ হুমকিও দেওয়া হয়) ‘গেম চেঞ্জার’ বা মোক্ষম দাওয়াই হবে। ওই ওষুধ আমেরিকায় গিয়ে রোগীদের ওপর প্রয়োগ হওয়ার পর সেখানকার ডাক্তাররাই জানিয়েছেন – যাদের ওপর এই ওষুধ প্রয়োগ হয়েছে তাদের মৃত্যুর হার যারা ওই ওষুধ পায়নি তাদের তুলনায় বেশি। কখনও আবার করোনা সংক্রমণের নিরাময় হিসাবে জীবাণুনাশকের কথা ট্রাম্পের মাথায় ঢোকে। সাংবাদিকদের সামনেই তিনি প্রস্তাব রাখেন – শরীরে জীবাণুনাশক বা অতি বেগুনি রশ্মি ঢুকিয়ে ফুসফুস সাফ করা যায় না? এই প্রস্তাব শুনে ব্রিটেনের ইস্ট এংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক পল হান্টার বললেন – “কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা প্রকৃতই কিভাবে হবে সে ব্যাপারে এটা সবচেয়ে বিপজ্জনক ও নির্বোধ প্রস্তাবগুলোর অন্যতম।” ট্রাম্পের এই পথ বাতলানোর পর ডেটল ও লাইজলের মতো জীবাণুনাশক তৈরির সংস্থা রেকিট বেঙ্কাইজারকে বিবৃতি দিয়ে জনগণকে সতর্ক করতে হল – এই জীবাণুনাশকগুলো কেউ যেন গলাধঃকরণ না করেন বা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে না ঢোকান। বাজারকে সক্রিয় করার গরজে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রধান নিজেকে কি আহম্মক রূপে প্রতিপন্ন করলেন না!
আমেরিকায় মৃত্যু মিছিল যত বাড়ে, প্রথম দিকে বিপদকে লঘু করে দেখার জন্য, গ্রহণীয় অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য, পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে দেওয়ার জন্য ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের সমালোচনা ততই বেড়ে চলে। আর ট্রাম্পকেও তাই ক্রমেই বেশি করে নন্দ ঘোষ, দায় পাচারের জন্য ঘাড় খুঁজতে হয়েছে। বিশ্ব সংস্থার (হু) বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ আনলেন – তারা সংক্রমণের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে দিশা দেখাতে পারেনি, নির্দিষ্ট সময়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া ও সঠিক তথ্য জানানো দরকার তা তারা জানাতে পারেনি; আমেরিকা হুকে সবচেয়ে বেশি অর্থ দেয়, এ সত্বেও হু ‘চীন কেন্দ্রিক’ হয়ে চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে। ট্রাম্প অতএব হুকে অর্থ দেওয়া বন্ধ করলেন। হু প্রধান টেড্রস অ্যডানম গেব্রিয়েসাস অবশ্য কোভিড-১৯ অতিমারী নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে বললেন, “আপনারা যদি শবদেহ ভরা আরও ব্যাগ দেখতে চান – তবে এটা করুন, আর যদি শবদেহ ভরা আরও ব্যাগ দেখতে না চান তাহলে রাজনীতি করা থেকে বিরত থাকুন।”
তবে ট্রাম্প সবচেয়ে বড় নন্দ ঘোষ করে তুললেন চীনকে। ট্রাম্প নোভেল করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে, বিদেশ সচিব মাইক পম্পেও ‘উহান ভাইরাস’ বলে অভিহিত করলেন, যাতে পৃথিবী ব্যাপী বিপর্যয়ের দায়ের সঙ্গে চীনকে জড়ানো যায়। করোনা সংক্রমণ নিয়ে তথ্য গোপন করার, এক জনের থেকে অন্য মানব দেহে ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে সে কথা বিশ্বকে না জানানোর অভিযোগও তিনি চীনের বিরুদ্ধে আনলেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও একটা বিশেষ কাজে লাগানো হল – নোভেল করোনাভাইরাস উহানের পরীক্ষাগার থেকে বেরিয়েছে তার প্রমাণ তাদের খুঁজে বার করতে হবে। অর্থাৎ, এই ভাইরাসের উৎস রয়েছে চীনের জীবাণু অস্ত্র প্রকল্পের মধ্যে তা প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু তাদের তদন্তের ফল বলছে, এই ভাইরাস খুব সম্ভবত কোনোভাবে প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে, এর সঙ্গে পরীক্ষাগারের কোনো সম্পর্ক নেই, যেমনটা ঘটেছিল এইচআইভি, ইবোলা এবং সার্স সংক্রমণের ক্ষেত্রে। এ সত্বেও ট্রাম্প ও মাইক পম্পেও দাবি করে চলেছেন – নোভেল করোনাভাইরাসের উৎপত্তি উহানের পরীক্ষাগার থেকেই হয়েছে। আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে সাদ্দাম হুসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগে জর্জ বুশের ইরাক আক্রমণের কথা, যে অস্ত্রের কোনো সন্ধান আমেরিকা কোনোদিন পায়নি এবং সে কথা তাদের স্বীকার করতেও হয়। তবে, ট্রাম্পের চীন-বিরোধী হুঙ্কার, তাদের অর্থনীতির ক্ষতির জন্য চীনের থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের হুমকি কিন্তু তীব্রতর হয়ে চলে। ট্রাম্পের হম্বিতম্বি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মিসৌরি, মিসিসিপি, ফ্লোরিডার মতো আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশও চীনের থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা করেছে।
নিজের অবস্থানে দৃঢ় থাকার বদনাম কেউ ট্রাম্পকে দিতে পারবেন না। আজ যা বলেন কাল তাকে অবলীলায় পাল্টে ফেলেন। চীনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। চীনের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের প্রশংসায় প্রথম দিকে তিনি পঞ্চমুখ হয়েছেন। তথ্য সংকলকরা দেখিয়েছেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারী মাসে বিভিন্ন উপলক্ষে ট্রাম্প অন্তত পনের বার চীনের প্রশংসা করেন। তার মাত্র তিনটের উল্লেখ আমরা এখানে করছি। জানুয়ারী ২৪ : “করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চীন অত্যন্ত কঠোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রচেষ্টা ও স্বচ্ছতার বিশেষ প্রশংসা করছে।…” জানুয়ারী ৩০ : “দুর্ভাগ্যবশত, এই মুহূর্তে চীনের অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু ওরা প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় তা আমরা দেখব। তবে, আমরা চীন ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে কাজ করছি।” ফেব্রুয়ারী ৭ : “গত রাতেই আমি প্রেসিডেন্ট জি-র সঙ্গে কথা বলেছি, আর আপনারা জানেন, আমরা ওই সমস্যাটা, ভাইরাস নিয়ে কাজ করছি। এটা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি। তবে আমি মনে করি তিনি এটা সামলে নিতে পারবেন। আমি মনে করি তিনি অত্যন্ত ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। যেটুকু সাহায্য করতে পারি তা আমরা করছি।”
তাহলে ট্রাম্পের এই ভোলবদল কেন? এ বছর নভেম্বরের গোড়ায় আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়ার কথা এবং ট্রাম্প তাতে প্রার্থী। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে তাঁর সুবিশাল ব্যর্থতা (অনেকেই যেটাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বর্ণনা করছেন) দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সামনে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে। তিনি এখন আবার বলতে শুরু করেছেন যে, তাঁকে হারাতে চীন সমস্ত রকমের চেষ্টাই চালাচ্ছে। ট্রাম্পের এই চীন-বিরোধী তর্জন গর্জনের আসল লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচকমণ্ডলী যাঁরা এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন। মৃত্যুমিছিল নিয়ে আমেরিকার জনগণের যে ক্ষোভ, ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা নিয়ে তাদের যে অসন্তোষ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং ফলে কাজ হারানো লোকেদের সংখ্যা আকাশ ছুঁতে চলায় তাদের যে ক্রোধ, তাকে চীনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশলকেই ট্রাম্প তুরুপের তাস করতে চাইছেন বলে মনে হয়। নির্বাচনের এখনও বেশ কয়েক মাস দেরী। ট্রাম্পের ফেরি করা বর্ণবাদ, উগ্ৰ জাতীয়তাবাদের উদগীরণ তাঁকে ঈপ্সিত ফল এনে দিতে পারে কিনা তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ভোজপুর জেলার চারপোখরি ব্লকে সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে এক অপ্রাপ্তবয়স্ক দলিত বালিকা গণধর্ষিতা হওয়ার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম-এল), এআইপিডব্লিউএ, এআইএসএ, আরওয়াইএ এবং ইনসাফ মঞ্চ ২৯ এপ্রিল যৌথভাবে প্রতিবাদ জানায়। সিপিআই(এম-এল)-এর বিহার রাজ্য সম্পাদক মিডিয়ার কাছে ২৮ এপ্রিল দেওয়া এক বিবৃতিতে এই ঘৃণ্য অপরাধের কথা জানিয়ে বলেছেন, লকডাউনের সময় এই দুর্বৃত্তদের স্পর্ধা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, আর নীতীশ কুমার চোখ বুঝে থেকে কিছুই করছেন না। লকডাউন চলার সময় দলিত ও দরিদ্ররা অনাহারে মারা যাচ্ছে, এবং তাদের আবার এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই দুর্বৃত্তরা বিজেপি-জে ডি ইউ-র মদতে সুরক্ষা পেয়ে চলেছে।
ভোজপুর জেলার চারপোখরি থানার কাথারি গ্ৰামে অপ্রাপ্তবয়স্ক দলিত ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয় ২৫ এপ্রিল। এই পাশবিক ঘটনার খবর পেয়ে সিপিআই(এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং আরওয়াইএ-র জাতীয় সভাপতি মনোজ মঞ্জিল ওই গ্ৰামে যান এবং ঘটনাটি সম্পর্কে তদন্ত করেন। তিনি জানান, ২৫ এপ্রিল মেয়েটি যখন গ্ৰামেরই এক দরজির কাছে সেলাই করার জন্য মায়ের কাপড় দিয়ে এসে বাড়ি ফিরছিল তখন চার ব্যক্তি তাকে পথ আটকে গোপন জায়গায় নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে, এবং দুর্বৃত্তদের মধ্যে ছিল ওই গ্ৰামেরই গোলু পাণ্ডে, শিবশঙ্কর এবং কৃষ্ণ রাই।
মনোজ মঞ্জিলের নেতৃত্বে সিপিআই(এম-এল)-এর এক তদন্তকারী দল ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করে তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্ত তথ্য জানতে পারে। সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষে সার্বিক সহায়তা প্রদান এবং ন্যায় বিচারের জন্য লড়াইয়ের আশ্বাস ওই পরিবারকে দেওয়া হয়। ঘটনাটা ঘটে ২৫ এপ্রিল এবং সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর চাপে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দায়ের হয় না। ধর্ষিতার কোনো ডাক্তারি পরীক্ষাও হয় না। তদন্তকারী দলের সদস্যরা জেলার এসপি-র সঙ্গে দেখা করে অবিলম্বে অভিযোগ দায়ের এবং ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষার দাবি জানান। ডাক্তারি পরীক্ষা হওয়ার পর এসপি দ্রুত বিচার সম্পন্ন হওয়ার আশ্বাস দেন।
সিপিআই(এম-এল) এই দাবিগুলো প্রশাসনের কাছে জানিয়েছে : ধর্ষণকারীদের অবিলম্বে গ্ৰেপ্তার করতে হবে; মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে; ধর্ষিতা ও তার পরিবারের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দলের তরফে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে – ধর্ষকদের অবিলম্বে গ্ৰেপ্তার করা না হলে এবং ধর্ষিতা ন্যায় বিচার না পেলে জেলা স্তরে এবং রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করা হবে।
সিপিআই(এম-এল), এআইপিডব্লিউএ, এআইএসএ, আরওয়াইএ এবং ইনসাফ মঞ্চ এই ঘটনায় প্রতিবাদ জানাতে ২৯ এপ্রিল ভোজপুর জেলা জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন করে। লকডাউনের বিধি মেনে জনগণ এক দিনের ধর্ণা/অনশনে বসেন। নেতৃবৃন্দ এবং তার সাথে শতশত জনগণ ওই প্রতিবাদে অংশ নেন।
ভোজপুর জেলায় রাজপুত জাতের সামন্ততান্ত্রিক লোকজন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে লাগাতার ঘৃণা ও বিদ্বেষের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে চলেছে এবং তাদের ওপর আক্রমণও হানছে। কতৃত্ব চালানো এই শক্তিগুলো বিজেপি সাংসদ আর কে সিং-এর মদত ও সুরক্ষা পাচ্ছে।
জগদীশপুর ব্লকের কৌদা গ্ৰামে ২৭ এপ্রিল সমাজে আধিপত্য চালানো লোকজন মহম্মদ ইসারের ছেলে মহম্মদ জাকি আখতারকে প্রচণ্ড মারধর করে। মহম্মদ জাকি সে সময় পুলিশে নিয়োগের প্রস্তুতি হিসাবে দৌড় অনুশীলন করছিল। উচ্চ বর্ণের লোকেরা সেখানে এসে বলতে শুরু করল যে, এই লোকগুলোই করোনা ছড়াচ্ছে। উচ্চ বর্ণের যারা ওই সমস্ত সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর হলেও কাউকে গ্ৰেপ্তার করা হয়নি। মারধরে যুক্ত ব্যক্তিটি হল জয়প্রকাশ জিদ্দির ছেলে সমর প্রতাপ সিং ওরফে ভোলু।
ওই গ্ৰামেই আর একটা ঘটনা ঘটে ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায়। আফজল হুসেনের ছেলে আসান-উল-হক গ্ৰামে ডিম বিক্রি করছিল। তখন রাজপুত জাতের কিছু লোকজন এসে ওকে মারধর করতে শুরু করে এবং ও কানে প্রচণ্ড আঘাত পায়। এফ আই আর দায়ের হলেও কাউকে গ্ৰেপ্তার করা হয় না। আক্রমণকারীদের মধ্যে ছিল শিব কুমার সিং-এর ছেলে রোহিত কুমার; বীরেন্দ্র সিং ওরফে ভাগেলু সিং-এর ছেলে দীপক সিং; সুরেন্দ্র সিং-এর ছেলে রোহিত কুমার। ২৭ এপ্রিলের ঘটনার কিছুদিন আগেও এখানে মুসলিমদের মারধর করা হয়েছিল।
আর একটা ঘটনা ১২ এপ্রিল ঘটে সিয়ারুয়া গ্ৰামে। রাজপুত জাতের ছোটু সিং-এর বাড়িতে একটি মুসলিম পরিবার থাকে। পরিবারের গৃহকর্তা হলেন এক রং-মিস্ত্রি, তার সাথে আর থাকেন স্ত্রী ও দুই সন্তান। রাজপুত জাতের সামন্ততান্ত্রিক লোকজন মুসলিম পরিবারটিকে হুমকি দিয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে; মুসলিম পরিবারটিকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলার জন্য ওরা ছোটু সিং-এর ওপরও চাপ দেয়।
ভোজপুর জেলার অন্যান্য গ্রাম থেকেও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই ধরনের আক্রমণ ও হুমকির খবর পাওয়া গেছে।
পাটনা জেলার পালিগঞ্জের সিগোডি থানার নুরচকে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো দলিত ও মুসলিমদের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালায়। ভোজপুর জেলাতেও সামন্ততান্ত্রিক গুণ্ডারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে এবং অনেক গ্রাম থেকেই নিপীড়ন এবং আক্রমণের খবর এসে পৌঁছচ্ছে। অনেক স্থানেই আধিপত্যকারী অংশের এই সমস্ত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে এফ আই আর হলেও তাদের গ্ৰেপ্তার করা হচ্ছেনা।
সিপিআই(এম-এল)-এর দুই নেতা কুনাল ও অমর এক বিবৃতিতে করোনার নামে এই সমস্ত আক্রমণ ও ঘৃণা ছড়ানোর পিছনে বিজেপি-আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন। অতিমারি করোনাকেও ওরা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে কাজে লাগাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও মুখ বুজে থাকছেন এবং কিছুই করছেন না। আমাদের দাবি হল – আজকের এই সংকট কালেও যারা ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই নেতৃবৃন্দ জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন – তাঁরা যেন বিজেপি-আরএসএস-এর দ্বারা প্রতারিত না হন, সংখ্যালঘুদের অর্থনৈতিক-সামাজিক বয়কটের বিরোধিতা করে সেটাকে প্রতিহত করেন এবং একসাথে ও ঐক্যবদ্ধভাবে বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করেন; একমাত্র এভাবেই আমরা করোনাকে পরাস্ত করতে পারব।
নুরচক গ্রাম হল পাটনা জেলার সিগোডি থানায়। গ্ৰামের জনসংখ্যার বিন্যাস এই রকম : ভাট ব্রাহ্মণ ১০০ ঘর; রবিদাস ৩০ ঘর; পাশোয়ান ১০ ঘর; আর মুসলিম ৩০ ঘর। এই গ্ৰামে দলিত ও মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরেই মিলেমিশে রয়েছেন এবং এখনও তাঁদের মধ্যে সম্প্রীতি অটুট রয়েছে। ভাট ব্রাহ্মণরা ২৮ ও ২৯ এপ্রিল দলিত-মুসলিম টোলার ওপর বারবারই আক্রমণ চালায় এবং অনেকেই আহত হয়েছেন বলে বলে খবর পাওয়া যায়। সিপিআই(এম-এল)-এর এক তথ্যানুসন্ধানী দল ওই ঘটনার তদন্তে যায়, দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন – কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গোপাল রবিদাস, রাজ্য কমিটির সদস্য আনোয়ার হুসেন, সুধীর কুমার এবং স্থানীয় নেতা রাজেশ গুপ্তা। তাঁরা বলেছেন, গ্ৰামের আবহাওয়া এখনও উত্তেজনাপ্রবণ রয়েছে। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় যেকোনো দিনই এই উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে দাঙ্গা বাধিয়ে দিতে পারে।
গোলমালটা শুরু হয় ২৮ এপ্রিল যখন ভাট ব্রাহ্মণদের ৪-৫টা ছেলে ফেকু মিঁয়ার ছোট দোকানে হাজির হয়। ফেকু মিঁয়ার ছেলে পারভেজ আলম দলের সদস্যদের জানিয়েছেন, সেই সময় দোকানে বসেছিল তার বোন সোহরাত খাতুন। ছেলেগুলো দোকান থেকে চকোলেট নিয়ে খায় কিন্তু দাম দেয় না, যদিও সে সময় দোকানে তাদের অনেক বাকি ছিল। সোহরাত দাম চাইলে ওরা ওর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। কাছেপিঠেই থাকা ফেকু মিঁয়া ও তাঁর ছোট ছেলে তাবরেজ আলম দোকানে ছুটে আসে। ব্রাহ্মণ সন্তানরা এরপর বলতে থাকে যে, মুসলিমরা করোনা ছড়াচ্ছে এবং ওরা ফেকু মিঁয়াকে মারবে বলে হুমকিও দেয়। ফেকু মিঁয়ার স্ত্রী এর প্রতিবাদ করলে ছেলেগুলো তাঁর সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করে এবং মৌখিক বাদানুবাদ শুরু হয়। এরপর দলিত ও সংখ্যালঘুরা যৌথভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় দলিত ও মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকেদের মারতে শুরু করে। ফেকু মিঁয়া আহত হন এবং ঘটনাটা থানায় জানানো হলে থানা কিছুই করে না।
জারখা পঞ্চায়েতের মুখিয়া উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করেন, এবং একটা সময়ে মনে হল যে শান্তি বুঝি বজায় থাকবে। কিন্তু কতৃত্বকারী শক্তিগুলো চাইছিল না যে শান্তি আসুক, এবং কিছু পরে রঞ্জিত পাশোয়ানকে এমন মারে যে ও পেটে গুরুতর আঘাত পায়।
কতৃত্বকারী শক্তিগুলো ২৯ এপ্রিল আবারও দলিত-মুসলিম টোলায় আক্রমণ চালায় এবং তাদের আক্রমণে কমকরে ছ-জন আহত হয়: ফেকু মিঁয়ার স্ত্রী নূর জাহান; ফেকু মিঁয়ার মেয়ে সোহরাত খাতুন; রমেশ পাশোয়ানের স্ত্রী প্রতিমা দেবী; যিতন পাশোয়ানের ছেলে রমেশ পাশোয়ান; কইস মিঁয়ার বাবা মুন্না মিঁয়া; এবং দেবী প্রসাদ পালোয়ানের স্ত্রী অনুপা দেবী।
সিপিআই(এম-এল) প্রশাসনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছে যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই কর্তব্যে অবহেলা করেছে। যদি ২৮ এপ্রিলই এফআইআর দায়ের হয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হত তবে ২৯ এপ্রিলের ঘটনাকে এড়ানো যেত। বারবার আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে দলিত-মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা একাধিকবার আবেদন জানালেও কোনো এফআইআর নেওয়া হয়নি। এর পরিবর্তে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সিপিআই(এম-এল) নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেই এফআইআর করার হুমকি দিচ্ছেন।
সরকারের নির্দেশিকা ছিল লকডাউন চলা কালে বেতন কাটা যাবে না। এ সত্ত্বেও প্রিকল কারখানার পরিচালকমণ্ডলী একতরফা নির্দেশিকা জারি করে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩০ শতাংশ বেতন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এআইসিসিটিইউ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছে যে, কারখানা কর্তৃপক্ষ ‘কাজ না করলে বেতন নয়’ নীতির আশ্রয় নিতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা ২৯ মার্চের নির্দেশিকা সুস্পষ্টভাবেই জানিয়েছে যে লকডাউন পর্বে বেতন কাটা হলে তা আইনের চোখে অপরাধ বলেই গণ্য হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশিকা ২০০৫ সালের জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ধারা ১০(২)(১) অনুসারে জারি হয় এবং এই নির্দেশিকা লঙ্ঘন হলে তা ওই আইনের ৫১(বি) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ যাতে জরিমানা এবং জেল দুটোই হতে পারে।
সারা দেশেই শ্রমিকরা যখন চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে তখন সরকারি সংস্থাগুলোর মুখ বুজে থাকাটারও সমালোচনা এআইসিসিটিইউ করেছে। তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে যে তারা যেন ৩০ শতাংশ বেতন কাটার নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নিতে এবং শ্রমিকদের পুরো বেতন দিতে কারখানা কতৃপক্ষকে বাধ্য করে। অবৈধভাবে বেতন কাটার জন্য ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ (বি) ধারা অনুসারে কারখানা কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করার দাবিও সরকারগুলোর কাছে জানানো হয়েছে। অতিমারির নাম নিয়ে কোনো লেঅফ, ছাঁটাই এবং বেতন কাটা চলবে না।
বিজেপি নেতারা প্রয়োজন হলেই একবার করে শুনিয়ে দিচ্ছেন, করোনা সংক্রমণ এমন একটা ইস্যু যেটার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে হলে রাজনীতিকে দূরে রাখতে হবে, গোটা জাতিকে এক হয়ে লড়তে হবে। যেমন বিজেপির উত্তরপ্রদেশ মুখপাত্র মনোজ মিশ্র বললেন – “করোনাভাইরাস একটা মহামারী; এটা রাজনীতির কোনো ইস্যু হতে পারে না। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।” কিন্তু বিজেপি নেতারা, বিজেপি চালিত কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই কি লকডাউন পর্বে রাজনীতি পরিহারকে মান্যতা দিচ্ছে? বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রীয় টিম পাঠানোর কথাই ধরা যাক। লকডাউনের গোড়ার দিকে অমিত শাহকে তেমন চোখে না পড়া নিয়ে যখন জল্পনা চলছিল, তখন সহসাই তাঁর মন্ত্রককে প্রভূত সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গেল। লকডাউন বলবৎ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা তা সরেজমিনে তদন্ত করতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিভিন্ন রাজ্যে দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। প্রথম পর্বে কেন্দ্রীয় টিম পাঠানোর জন্য যে ছটা রাজ্যকে বেছে নেওয়া হল তার মধ্যে চারটে অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য : পশ্চিম বাংলা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা; এর সাথে বেছে নেওয়া বিজেপি শাসিত রাজ্য দুটো হল মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাট। কিন্তু কেন্দ্রীয় টিমগুলো যেভাবে পর্যবেক্ষণ করল ও রিপোর্ট দিল তার মধ্যে একটা ছক যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। পশ্চিমবাংলায় যে দুটো দল এল তাদের কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, এখানকার সরকারকে ভর্ৎসনা করতে, তার ছিদ্রান্বেষণ করতে, তাকে এক হাত নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের লম্বা হাত এখানে পৌঁছে গেছে। সংবাদে প্রকাশ কেন্দ্রীয় দল যে এখানে আসছে সে খবর রাজ্য সরকারকে দেওয়া হল দল এ রাজ্যে পৌঁছানোর পরই। সংবাদে আরও প্রকাশ, রাজ্যে লকডাউন বলবৎ নিয়ে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে রাজ্য সরকার সম্পর্কে কড়া রিপোর্টই এখানে আসা দুটো দল কেন্দ্রের কাছে জমা দিয়েছে। মমতা সরকারের করোনা সংক্রমিতদের সংখ্যা এবং কোভিড-১৯ থেকে মৃত্যু নিয়ে তথ্যের কিছু কারচুপি, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ত্রুটিবিচ্যুতি, রেশন নিয়ে কিছু দুর্নীতি যে কেন্দ্রীয় দলকে তাদের অভিপ্রেত রিপোর্ট তৈরির জন্য অনুকূল জমি যুগিয়েছে তা অবশ্য বাস্তব সত্য। কিন্তু যেভাবে কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে আসার সাথে-সাথে বিজেপি নেতারা গলা চড়াতে শুরু করলেন, যেভাবে রাজ্যপাল সাংবিধানিক গণ্ডি অতিক্রম করে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কামান দাগতে লাগলেন তাতে করোনা ইস্যু ছাপিয়ে অন্য একটা নকশার রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। এ রাজ্যে ২০২১-এর লড়াইয়ে বিজেপির পালে হাওয়া লাগানোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় দলের সফরের যোগ আর তেমন অস্পষ্ট রইল না।
এর সাথে বিজেপি শাসিত দুটো রাজ্যের করোনা পরিস্থিতির বিচার করুন – মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ। মধ্যপ্রদেশে করোনা সংক্রমণ ইস্যুতে রাজ্যের নাজেহাল অবস্থা নিয়ে চারদিক থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ হচ্ছিল। বিধায়ক ভাঙ্গিয়ে কংগ্ৰেস নেতৃত্বাধীন সরকার ফেলে দিয়ে লকডাউনের মধ্যেই মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার গঠন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ছাড়া মন্ত্রীসভায় আর কোনো মন্ত্রী নেই, বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অভাব (লকডাউনের মধ্যেই মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ হয় অনেক দেরিতে)। হিন্দুস্তান টাইমসের ১১ এপ্রিল সংখ্যার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হল, “শুক্রবার মধ্যপ্রদেশেই কোভিড-১৯ রোগীদের মৃত্যু হার ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলে দেখা গেল, যেখানে গোটা স্বাস্থ্য দপ্তর হয় কোয়ারান্টিনে আর না হয় হাসপাতালে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন মৃত্যুর বেশি হার এবং সংক্রমণের সংখ্যায় বৃদ্ধি ভয়াল ভাইরাসটার মোকাবিলায় রাজ্য গৃহীত ব্যবস্থার করুণ হালকেই দেখিয়ে দেয়।” তথ্যের কারচুপির অভিযোগ, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এবং প্রাপ্ত রিপোর্টের মধ্যে গরমিলের অভিযোগও রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠেছে। আর করোনা পরিস্থিতির বিচারে মধ্যপ্রদেশের স্থান এই মুহূর্তে দেশের মধ্যে ষষ্ঠ, সংক্রমিতর সংখ্যা ২৯৪২ এবং কোভিড-১৯ থেকে মৃত্যু হয়েছে ১৬৫ জনের। পশ্চিম বাংলা রয়েছে মধ্যপ্রদেশের অনেক পরে। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় দলের রিপোর্ট যেন আগে থেকেই তৈরি ছিল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব পুণ্য সলিলা শ্রীবাস্তব সাংবাদিকদের সামনে বললেন – “কেন্দ্রীয় দল দেখতে পেয়েছে বর্মবস্ত্র, কিটস, মাস্ক এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম যথেষ্ট সংখ্যায় রয়েছে, এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাও সুনিশ্চিত করা হচ্ছে।” একেবারে যেমনটি চাই তেমন রিপোর্ট, অমিত শাহর অসামান্য কীর্তিতে কংগ্ৰেস নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটানোর ফলে করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কোন ছায়া যেন রিপোর্টে না থাকে!
এবার উত্তরপ্রদেশের কথা ধরা যাক, বিশেষভাবে বিচার করা যাক ‘আগ্ৰা মডেল’-এর কথা, সারা বিশ্বেরই যে মডেল অনুসরণ করা উচিৎ বলে যোগী আদিত্যনাথ মন্তব্য করেছিলেন। এই মডেল নিয়ে প্রচারের বন্যা বওয়ানোর নির্দেশও নাকি তিনি দিয়েছিলেন। ইকনমিক টাইমসকে দেওয়া ১৬ এপ্রিলের সাক্ষাৎকারে যোগী বললেন, “আগ্ৰা দেশের মধ্যে একটা মডেল হয়ে উঠেছে। সর্বপ্রথম এক ঝাঁক করোনা সংক্রমণের খবর ওখানে পাওয়ার পর রাজ্য সরকার পুরোদস্তুর নজরদারি চালিয়ে ব্যবস্থা নেয় এবং উৎকৃষ্ট কৌশল গ্ৰহণ করে যার ফলে জেলার সমস্ত হটস্পটগুলোকে (বেশি সংক্রমণের জায়গা) চিহ্নিত করা হয়, দ্রুত ব্যবস্থা গ্ৰহণের দল গড়া হয়, গুচ্ছ-গুচ্ছ নমুনা পরীক্ষা করা হয়, কল সেন্টার স্থাপন করা হয়, ঘরে জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় এবং সমস্ত ঘর জীবাণুমুক্ত করা হয়।…” কেন্দ্রীয় যুগ্ম স্বাস্থ্য সচিব লব আগরওয়ালও ‘আগ্ৰা মডেল’-এর প্রশংসা করে তাকে অনুসরণ করার কথা বললেন। কিন্তু এই মডেলের পরিণতি কী দাঁড়াল তা আগ্ৰার বিজেপি মেয়র নবীন জৈন-এর কাছ থেকে শোনা যাক – “আগ্ৰা দেশের উহান হয়ে উঠতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন অযোগ্য রূপে দেখা দিচ্ছেন। হটস্পটগুলোর কোয়ারান্টিন কেন্দ্রগুলোতে অনেকদিন ধরে কোন নমুনা পরীক্ষা হয়নি। রোগীদের জন্য খাবার, জলের কোনো ব্যবস্থা নেই। ... পরিস্থিতি বিস্ফোরক।” যোগী আদিত্যনাথকে লেখা নবীন জৈনের যে চিঠি সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেছে, তাতেই এই কথাগুলো রয়েছে। ২৯ এপ্রিল আগ্ৰা জেলায় সংক্রমিতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০৪ আর কোভিড-১৯ প্রাণ নিয়েছে ১২ জন আগ্ৰাবাসীর। এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি রেড জোন, মোট ১৯টা। এই রাজ্যে কেন্দ্রীয় টিম পাঠানোর কথা অমিত শাহর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একবারও ভাবতে পারল না। গত ৩ মে কেন্দ্রের তরফে যে ২০টা জেলায় টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের আগ্ৰা এবং লক্ষ্ণৌও রয়েছে। কিন্তু এই দলগুলোতো যাচ্ছে করোনা নিয়ন্ত্রণে জেলাগুলোকে সাহায্য করতে। তবে, রাজ্য বিশেষে ‘সাহায্য’র ধরন পাল্টে যেতেই পারে। যোগী আদিত্যনাথ হিন্দুত্বের এক প্রতাপশালী মুখ, কম্যুনাল ভাইরাসের কারবারি হয়ে সংখ্যালঘু বিরোধী ঘৃণার উদগিরণে অকুণ্ঠ, করোনা নিয়ন্ত্রণে মোদীর প্রশংসায় অকৃপণ, মোদীর আরোগ্য সেতু অ্যপকে ডাউনলোড করা এবং ‘পিএম কেয়ারস’ তহবিলে অনুদান আদায়ে রাজ্যের আমলাদের ওপর চাপ সৃষ্টিতেও পিছিয়ে থাকেননি। প্রকাশিত সংবাদ থেকে এও জানা গেছে যে, করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য তিনি জামাতীদের দায়ী করেছেন এবং তাদের জেলে পোরার জন্য নাকি ৩৪টা অস্থায়ী জেল বানিয়েছেন। মোদী-শাহ ঘনিষ্ঠ, আরএসএস-এর মতাদর্শের ও ফ্যাসিস্ট এজেণ্ডার এই বাহক চূড়ামণির রাজ্যের পরিস্থিতি যাই হোক, তা কেন্দ্রের কাছে কখনোই ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হতে পারে না। বিজেপি এমন একটা দল যে কোনো পরিস্থিতিতেই ফ্যাসিস্ট এজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, করোনা মহামারীর মতো পরিস্থিতিতেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলে মেরুকরণের পথে এগিয়ে যেতে একটুও দ্বিধা দেখায় না। করোনা পরিস্থিতিতে কেউ রাজনীতি করবেন না, এই আহ্বান আসলে বিজেপিকে বাদ দিয়ে আর সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর দাবিতে দেশ আবার উত্তাল হওয়ার পরিস্থিতি। এই দিকে নজর রেখেই এরাজ্যের গ্রাম-গ্রামান্তর এখন আরো কী কী নিয়ে আলোড়িত তা নিয়ে কিছু কথা।
চলমান করোনা পরিস্থিতির বেশ কিছুটা আগে লোকসভা নির্বাচনের সময় এরাজ্যে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনমনে যে তীব্র অসন্তোষ জমা হয়েছিল, তাকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছিল বিজেপি। সরকারে থাকার সুবাদে ধীরে ধীরে কাজে লাগিয়ে বিশেষত ‘পিকে’-র পেশাদারিত্ব, মমতার উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, সর্বোপরি পুলিশকে কাজে লাগিয়ে (মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো,জেলে পাঠানো) পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে নিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। গ্রামেগঞ্জে মূলত বিজেপির পতাকার তলায় থাকা বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মীদের প্রায় আগের মতোই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল টিএমসি। কিন্তু এই লকডাউন পর্বে খাদ্য-রেশন অব্যবস্থা সহ রেশন দুর্নীতি, কাজ (মূলত ১০০ দিনের কাজ), নগদ অর্থের যোগান না থাকা ইত্যাদি কারণে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ তীব্র হয়ে উঠছে।
এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে আবারো দ্রুত পথে নেমেছে বিজেপি। বহু জায়গায়, বিশেষত দলটির কেন্দ্রীভূত কাজের গ্রামগুলি থেকে এই পর্যায়ে মূলত ত্রাণের খাদ্য নিয়ে আশপাশের এলাকায় গ্রামীণ দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে (মধ্যবর্তীতে কোণঠাসা অবস্হায় থাকা) বিজেপির কর্মীবাহিনী। এই কর্মীরা বেশিরভাগই নতুন, পশ্চাদপদ শ্রেণীর। ত্রাণের জন্য উপরিস্তর থেকে বুথ স্তরে প্রচুর অর্থ ও খাদ্য পাঠাচ্ছে বিজেপি ও তার শাখা সংগঠনগুলি। ত্রাণ যোগান দিয়ে বিতরণ করে রেশন-খাদ্য-কাজ নিয়ে জমে ওঠা মানুষের অসন্তোষকে প্রভবিত করছে।
এই পরিস্থিতিতে জনসাধারণের পাশে থাকতে যথাসাধ্য সমস্ত রকমের উদ্যোগ সক্রিয়তা চালাচ্ছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশান ও তার গ্রামীণ শাখা সংগঠনগুলি। অসহায় মানুষের পাশে থাকা হচ্ছে খাদ্য নিয়ে। স্থানীয়দের মাধ্যমে চিহ্নিত করে অনেক দূরবর্তী স্থানেও পাড়া ভিত্তিক সবচেয়ে অসহায় পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কখনো পার্টি অফিস ও পার্টির পরিচিত সেন্টারগুলি থেকে পার্টির সদস্য পরিবারগুলিকেও যুক্ত করে ত্রাণ শিবির করে জনগণের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী তুলে দেওয়া হচ্ছে।
গত ২৭ এপ্রিল, ২০২০ দিল্লি পুলিশ দিল্লির আইসা সভাপতি কাওয়ালপ্রীত কাউরের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করেছে। সরকারের কাছে যে ছাত্র-ছাত্রী এবং রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মীদের বিপজ্জনক বলে মনে হবে তাদের এবং আইসাকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়ার যে ষড়যন্ত্রের চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে এ তারই অঙ্গ।
একের পর এক ছাত্রকর্মীদের গ্রেফতারি ও ভীতি প্রদর্শন করার যে পুলিশি সক্রিয়তা চলছে তারই অংশ হিসাবে, দিল্লি পুলিশ ২৭ এপ্রিল কমরেড কাওয়ালপ্রীত কাউরের দিল্লির বাড়িতে যায়। দিল্লিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক গণহত্যার তদন্ত করার নামে তার মোবাইল ফোনটি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। তাকে দেওয়া রসিদে একটি এফআইআরের কথা রয়েছে, তাতে একগুচ্ছ ধারার সাথে ইউএপিএ-র মতো কালা-কানুনও রয়েছে যা আসলে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং সরকারের সমালোচনা করা ছাত্র-ছাত্রী, রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীদের আটক রাখার অজুহাত হিসেবে তা ব্যবহার করছে। বিরোধী কন্ঠকে বিনা বিচারে, বিনা জামিনে, সারাজীবন কয়েদ করে রাখার অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে।
এরকম ভয় দেখানো গ্রেপ্তারি দীর্ঘদিন চলছে। বিশেষত, দরিদ্র ও সংখ্যালঘু ভারতীয়দের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়ার জোড়া প্রকল্প এনআরসি ও সিএএ-র বিরুদ্ধে সংবিধান বাঁচাও আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মীদের আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
আসামে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মী অখিল গোগোই এখনও কারাগারে বন্দী। দিল্লিতে জামিয়া এবং জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রী সহ সিএএ-বিরোধী নেতাকর্মীদের এই কালা কানুনে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে রাখা হয়েছে। একইভাবে উত্তরপ্রদেশের ছাত্রকর্মীদেরও সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ১১ জন শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং আন্দোলন কর্মীরা এখন ইউএপিএ আইনে কারাগারের অন্তরালে। সম্প্রতি, কান্নন গোপিনাথন, যিনি আইএএস-এর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের এক বিশিষ্ট মুখ ও স্পষ্টবাক তরুণ কন্ঠ হয়ে উঠেছেন, আইএএস সার্ভিসে পুনরায় যোগদান করতে অস্বীকার করার অভিযোগে দমন ও দিউতে তার নামে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, অজুহাতগুলি আলাদা আলাদা হলেও লক্ষ্যটা অভিন্ন-ভিন্নমত পোষণকারীদের গ্রেফতারি, সংবিধান রক্ষার সমর্থনে কথা বলার সাহস দেখানোর জন্যে শায়েস্তা করা। ২৫ এপ্রিল, ২০২০ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর নজরে আসে যে দিল্লী আইসা সভাপতি কাওয়ালপ্রীত কাউরকে দিল্লী পুলিশ নিশানা বানিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে দিল্লী পুলিশ দাবি করে যে নয় জন ব্যক্তির হোয়াটস্যাপ কথোপকথন তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে তারা যা তথ্য প্রমাণ পেয়েছে তার ভিত্তিতেই বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও আন্দোলন কর্মীদের ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি পপুলার ফ্রন্ট অব ইণ্ডিয়া (পিএফআই), জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি(জেসিসি), পিঞ্জরা তোড়, অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)-এর কিছু সদস্য ও তৎসহ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ও জেএনইউ-এর কিছু প্রাক্তনীর বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।
আইসা কর্মী সহ অন্যান্য ছাত্র আন্দোলনকারীদের পশ্চাদ্ধাবন তাদের তদন্ত(?)’র উপর ভিত্তি করেই হচ্ছে – দিল্লী পুলিশের এই দাবি কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? আসুন দেখা যাক :
১) এক মাসেরও বেশি সময় আগে, ২০২০ সালের ৭ ও ৮ মার্চ এএনআই, রাজস্থান পত্রিকা এবং আরো কিছু সংবাদ সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর উদ্ধৃতি প্রকাশ করে যে “আইসা সহ আরো কিছু সংগঠন উত্তর পূর্ব দিল্লির দাঙ্গার মূল চক্রী”। ১২ মার্চ আইসা রাজস্থান পত্রিকায় একটি চিঠি পাঠিয়ে এই মিথ্যাগুলির নিন্দা করে ও এই সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করে। পরে এই চিঠিটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়।
২) ১১ মার্চ, ২০২০-তে, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের একটি দল এবিভিপি-র দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের প্রাক্তন সভাপতি, দিল্লী বিধানসভার প্রাক্তন বিজেপি প্রার্থী এবং বিজেপির পক্ষে বহু আইনি লড়াইতে আইনজীবীর ভূমিকা পালনকারী মনিকা অরোরার নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিষেন রেড্ডির সাথে দেখা করে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এই প্রতিবেদনের বিস্তৃত কাহিনী আরএসএসের দলীয় মুখপত্র “অর্গানাইজার” থেকে নেয়া হয়েছে। এই তথাকথিত “প্রতিবেদন”, যা আসলে এক মনগড়া কাহিনি, ঠারেঠোরে জানিয়েছে যে “সিএএ বিরোধী বিক্ষোভগুলিতে পিএফআই-আইসার হাত রয়েছে।” স্পষ্টতই এটি আইসার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যান তৈরির চেষ্টা।
সংক্ষিপ্তসার : ২৫ এপ্রিল, ২০২০ দিল্লী পুলিশ দাবি করে যে অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন তদন্ত এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই আইসা এবং অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে পুলিশ। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো দিল্লী পুলিশের তথাকথিত তদন্তের একমাসেরও বেশি সময় আগে আরএসএস-বিজেপি ব্রিগেডের তৈরি করা চিত্রনাট্যকে মনিকা অরোরার মতো সমর্থকদের সহায়তায় চড়া সুরে বাধার প্রক্রিয়ার পর দিল্লী পুলিশ সেই চিত্রনাট্য অনুযায়ী অভিনয় করছে মাত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশের, ডানপন্থী জালিয়াতিকে তাদের নিজস্ব “প্রমাণ” বলে দাখিল করার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। জেএনইউ-তে মুখোশধারী এবিভিপি দুষ্কৃতিদের দ্বারা সহিংসতার পরে দিল্লি পুলিশ একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিল। সেখানে বিজেপি-এবিভিপি অনুমোদিত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলিতে প্রচারিত ছবি এবং ভিডিওগুলিকে তারা “পুলিশি তদন্তের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য প্রমাণ” হিসেবে দাখিল করেছিল!
আমরা এখানে ভীমা কোরেগাঁও গ্রেফতারির বিষয়টি স্মরণ করতে পারি, সেক্ষেত্রেও একই ধরণের চিত্রনাট্য তৈরি করে রিপাবলিক টিভি স্টুডিওতে তা প্রথম অভিনীত হয় এবং তারপরে পুণে পুলিশ তা অনুসরণ করে এবং এখন জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) সেই চিত্রনাট্যকে অনুসরণ করছে। অন্যদিকে, আমরা স্মরণ করতে পারি, উত্তর-পূর্ব দিল্লির একটা বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে পড়া পরিকল্পিত হিংসা ও দাঙ্গাতে কপিল মিশ্রের মতো বিজেপি নেতাদের ইন্ধন জোগানোর স্পষ্ট প্রমান থাকা সত্বেও দিল্লী পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম আইনি ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করে। দিল্লী নির্বাচনের প্রচার করা কালীন অনুরাগ ঠাকুর এবং প্রবেশ ভার্মার উগ্র বিষাক্ত আহ্বান স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরিতে মদত জুগিয়েছিল, কিন্তু একইভাবে দিল্লী পুলিশ এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। দিল্লি পুলিশ এমন প্রমাণও এড়িয়ে গেছে যে, এবিভিপি নেত্রী কোমল শর্মা এবং এবিভিপির খুনে বাহিনী মুখোশ পরে জেএনইউ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছিল এবং ব্যাপক হিংসা চালিয়েছিল যা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রাণসংশয় ঘটিয়েছিল। একইভাবে জাতীয় তদন্ত সংস্থা ভীমা কোরেগাঁওয়ে সম্ভাজি ভীড়ে এবং মিলিন্দ একবোটের নেতৃত্বে দলিতদের ওপর হামলায় ডানপন্থী গুণ্ডাবাহিনীর জড়িত থাকার প্রমাণ উপেক্ষা করেছে। দিল্লি দাঙ্গা, পাশাপাশি ভীমা কোরেগাঁও ও জেএনইউ – এই সমস্ত ক্ষেত্রেই যারা হিংস্র হামলার শিকার তারা এবং তাদের সহযোগী এবং প্রতিবাদী স্বরের ব্যক্তিদেরই লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, আর সহিংসতাকারী প্রকৃত অপরাধীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কমরেড কাওয়ালপ্রীত সহ সমগ্র ভারতবর্ষের আইসা কর্মীদের সাথে সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করেছিলেন। যখন ক্ষমতাসীন শক্তি ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা করে চলেছে তখন আইসা কর্মীরা আমাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি রক্ষার জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিচ্ছে। উত্তরপূর্ব দিল্লির দাঙ্গার পরে আইসা কর্মীরা দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্যে ত্রাণ কর্মসূচীর আয়োজন করেছে। আর এখন, আরএসএস এবং বিজেপির নির্দেশে পুলিশ দেশের সংবিধান রক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এই শিক্ষার্থীদের পেছনে লেগেছে, তাদের হয়রান করছে!
আজ আমরা আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছি সরকার যাদের অনাহারে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখেছে। ক্ষুধার গ্রাস থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গরিব ও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলির হাতে হাত মিলিয়ে আমরা লড়াইয়ের আওয়াজ তুলছি। আমাদের আজকের প্রচেষ্টায় আমরা জানি, যে শ্রমিক ও দরিদ্ররা রেশন বা আধার কার্ডের অভাবে আজ অনাহারে, এনআরসি কার্যকরী হলে সেই তালিকা থেকে তাদের ছেঁটে ফেলা হবে।
ভারতের সংবিধান এবং গণতন্ত্রের রক্ষায় যারা লড়াই করছেন তাদের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ এবং ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মহামারী ছড়ানোর গল্প কাহিনি রচনা করে পরিবেশন করতে পারে। কিন্তু আমরা দেশের নাগরিকেরা অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে দরিদ্র ও দুর্বলদের পাশে দাঁড়িয়ে, ক্ষমতাসীন শক্তির শাসন পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জবাবদিহি চেয়ে আমাদের কর্তব্য পালনে অবিচল থাকবো। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবো, নির্ভীকভাবে লড়াই করবো। সরকার বাহাদুর যত আমাদের চুপ করানোর চেষ্টা করবে, শত শত স্বর ততই আরও জোরে প্রতিবাদী চিৎকারে ফুঁসে উঠবে।
৬ মে, ২০২০ কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর বৈঠক হয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর তরফ থেকে উত্থাপিত বিষয়গুলোর প্রতি শ্রম মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ও মনোভাবের তীব্র নিন্দা করছে এআইসিসিটিইউ। বিগত ৪৫ দিন ধরে লকডাউন চলাকালীন শ্রমিকরা যে সমস্ত সমস্যার মুখে পড়ে তা বৈঠকে সামনে আনা হয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে।
ইউনিয়নগুলো জানায় যে, লকডাউনের পর্যায়ে মজুরি প্রদান, ছাঁটাই বা মজুরি হ্রাস না করার যে নির্দেশিকা শ্রমমন্ত্রকের তরফ থেকে জারি করা হয়েছিল তাকে বিন্দুমাত্র আমল দিল না নিয়োগকর্তারা। লকডাউন পর্যায়ের মজুরি প্রদানের পাশাপাশি ঐ নির্দেশিকাকে পুরোপুরি কার্যকর করতে শ্রম মন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়। বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিক ও গরিব মানুষ রেশন সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র পাচ্ছেন না, তা মন্ত্রীর গোচরে আনা হয়। ইউনিয়নগুলো বিশেষ জোর দেয় আটকে পড়া লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের তীব্র দুর্দশার প্রতি, তাঁদের উপর নেমে আসা পুলিশী বর্বরতার ঘটনা এবং নিখরচায় ও নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনার বিষয় গুলোর উপর।
সম্প্রতি কোভিড-১৯-এর পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র সরকার ও বেশ কিছু রাজ্য শ্রমিকদের অধিকারকে ছিনিয়ে ১২ ঘণ্টার শ্রমদিবস চালু করছে, শ্রমকোড ও বেসরকারীকরণকে এগিয়ে নিয়ে বর্তমান আর্থিক সংকটের গোটা বোঝাটাই শ্রমিক কর্মচারিদের উপর চালান করে ডিএ ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ সুবিধাগুলো হ্রাস করছে, কেটে নিচ্ছে একদিনের মজুরি ও বেতন, নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের উপর বসাচ্ছে নতুন নতুন কর। শ্রমিকদের দুর্দশা ঘোচাতে ইউনিয়ন গুলো “পিএম কেয়ারস” তহবিল থেকে খরচ করার দাবি জানায়।
ইউনিয়নগুলো বিভিন্ন সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীদের, বিশেষ করে স্বাস্থ্য কর্মীদের ভূমিকার প্রশংসা করে, যারা নিজেদের স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করার ঝুঁকি নিয়ে কোভিড১৯-এর সংকটে দেশের কাজে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন।
কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, ইউনিয়নের তোলা এই সমস্ত নানা বিষয় ও দাবি সম্পর্কে শ্রমমন্ত্রী একটা শব্দও খরচ করলেন না। ফলে, গোটা বৈঠকটাই পর্যবসিত হল তামাশায়। সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হল, বিভিন্ন রাজ্যে গত ৪৫ দিন ধরে অভুক্ত ও দুর্বিষহ অবস্থায় আটকে থাকা অভাবগ্রস্থ পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই সমস্ত রাজ্যের আর্থিক পুনরুজ্জীবনের কাজে আবার ফেরত পাঠাতে শ্রম মন্ত্রীর সুপারিশ। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে, এ প্রশ্নে ইউনিয়নগুলোর সাহায্য চেয়েছেন যাতে ঘরে না ফিরে পরিযায়ী শ্রমিকরা ঐ কাজে নিজেদের যুক্ত করেন।
আরও লজ্জাজনক বিষয় হল, তিনি জানান, পরিযায়ী শ্রমিকরা যেন করোনা ভাইরাস নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত না হন। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে মৃত্যুর হার অনেক কম। যখন এই মুহূর্তের প্রয়োজন করোনাকে মোকাবিলা করে মানুষকে বাঁচানো ও সকলের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়া, তখন এই সমস্ত পরস্পর বিরোধী, ক্ষতিকারক যুক্তি হাজির করে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক শ্রমে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে কর্পোরেটদের মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতে। এই মনোভাব দেখিয়ে দেয়, লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় শ্রমিকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বদলে সরকার বরং নিজের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, “পিএম কোন আমলই” দিচ্ছেন না। সরকারের এই মনোভাবকে আমরা তীব্র নিন্দা করছি, যা সম্মিলিত প্রতিবাদের দাবি জানায়।
রাজিব ডিমরি
সাধারণ সম্পাদক। ৬ মে, ২০২০
জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে জবাব চাই!
সাফুরার গর্ভাবস্থা প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর অশ্লীল মন্তব্যে জাতীয় মহিলা কমিশন ও প্রধানমন্ত্রী চুপ কেন?
কোভিড-১৯-এর জন্য চিহ্নিত অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত স্থান যেমন, সবুজ বা কমলা অঞ্চলেও গর্ভবতী মহিলাদের বাড়িতে থাকার নির্দেশ রয়েছে সরকারের। এমতাবস্থায়, সাফুরা জারগার জেলে বন্দী কেনো?
দিল্লীর গণহত্যায় ইন্ধনকারী কপিল মিশ্র জেলের বাইরে, অপরদিকে সিএএ-বিরোধী নারী আন্দোলনের নেত্রী সাফুরা, ইসরাত, গুল্ফিসা জেলের ভেতরে। এই দ্বিচারিতা কীসের স্বার্থে?
এই অপবাদের লজ্জা জাফুরার নয় বরং লজ্জা কপিল মিশ্র এবং বিজেপি আই-টি সেলের।
নিজের বাড়িতে পোস্টার তুলে ধরুন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে। প্রশ্ন করুন জাতীয় মহিলা কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীকে।
চলুন সাফুরার অপবাদকে আমরা প্রতিহত করি ভালোবাসা ও সংহতির বার্তায়।
আমাদের দাবি হোক,
সকল সিএএ-বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর মুক্তি।
অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হোক কপিল মিশ্রকে।
- সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি
বানরসেনার নিষ্পত্তি আর
বায়ুসেনার উৎপত্তি –
দুই মেলালেই বেদ-পুরাণে
অসীম তোমার ব্যুৎপত্তি।
পুষ্পবৃষ্টি? সেও রামায়ণ,
রাম বিনে আর গতি নাই-
উল্টে পাতা, চুলকে মাথা,
নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াই!
পিপিই নাই, নিরাপত্তাও,
চাল-ডাল-তেল তাও জোটে না-
লকডাউনে আটক শ্রমিক –
আনচান প্রাণ, কেউ পোঁছে না।
অনটনের মিছিল চলে
দিকবিদিকে চাই চাই চাই...
এমন সময় পুষ্পবৃষ্টি!
প্রাসঙ্গিকে বাজেট নাই!!
সমরসজ্জা? – বাজেট আছে,
অক্ষৌহিনী প্রাক্কালিক!
স্বাস্থ্য-শিক্ষা-খিদের হিসেব?
ট্যাক্সের টাকা কার পৈতৃক?
রাজা এখন ভোট-সোহাগে
সবাইকেই মিত্রোঁ ডাকে,
কিন্তু কাউকে তোলে মাথায়,
কাউকে বা ফেলে পাঁকে।
মন-কি-বাত আর চাপান-উতোর-
কথামালা রাজনৈতিক,
ক্লিশিত যাপনে একা
করোনাই গণতান্ত্রিক।
শ্রমিকরা ৩ নম্বর গেট দিয় মিলে ঢুকছে এবং ছুটির সময় ১ নম্বর গেট দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। ঢোকার সময় শরীরে জীবাণুমুক্ত স্প্রে (কি রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে শ্রমিকদের কাছে অজানা) করছে, থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপ মাপা হচ্ছে, হাতে লিকুড সাবন এবং ১ টা মাস্ক দিয়েছে যা শ্রমিকরা প্রতিদিন বাড়িতে ধুয়ে পরের দিন মিলে ব্যবহার করবেন। জুটমিলে দুটো সাইট আছে মিলসাইট ও ফ্যাক্টরি সাইট। এখন ফ্যাক্টরি সাইট বন্ধ থাকছে, শুধুমাত্র মিল সাইট খুলছে। মিল সাইটে পর্যায় ক্রমে আছ সিলেকশন, বেচিং, প্রিপেয়ারিং, স্পিনিং এবং ওয়াইনডিং। এতো অল্প সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে অন্য বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না। এখন শুধুমাত্র সুতো উৎপাদন হবে। ফ্যাক্টরি সাইটে তাঁত আছে তা বন্ধ থাকছে। চটকলে তাঁতের শব্দ আপাতত শোনা যাবেনা, চটের কাপড় বোনা বন্ধ থাকছে। এবিসি (ভোর ৬টা – ২টো, ২টো – ১০টা এবং রাত ১০টা থেকে পরের দিন ভোর ৬ টা পর্যন্ত) তিন শিফটে কাজ হওয়ার কথা। টানা ৮ ঘণ্টা কাজ মাঝে কোন বিশ্রাম নেই।
চটকলের কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন বিসিএমএফ চিন্তিত মিল চালু হলে রীতি হচ্ছে সাইরেন বাজিয়ে মিল চালু করা। সাইরেন বাজেনি। যে প্রশ্ন উঠছে তা হলে এই কাজ কি অতিরিক্ত হচ্ছে। শ্রমিকরা কি সামাজিক সুরক্ষা থেকে (পিএফ, এসটিএল, গ্রাচ্যুইউটি ইত্যাদি) বঞ্চিত হবেন? সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো অতিমারিতে মিল খুললো কিন্তু সরকারের কোন নজরদারি বা তত্ত্বাবধান চোখে পড়ছে না। বিসিএমএফ উদ্বিগ্ন কামারহাটি লাল জোন হিসাবে চিহ্নিত, সরকারি দপ্তর যদি কঠোর ও মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে দিধা করেন তাহলে জন স্বাস্থের অধিকতর ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকছে।
৩০ এপ্রিল ২০২০, ক্রীড়া ইতিহাসের এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকল। করোনাগ্রাসের ভয়াবহতার মধ্যে এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক খবর এল চুনী (সুবিমল) গোস্বামীর মৃত্যুতে। প্রায় একমাস আগে এরকমই আরেক শোকবহ খবর এসেছিল ২০ মার্চ, প্রদীপ কুমার ব্যানার্জীর জীবনাবসানে। ভারতীয় ফুটবলের দুই মহাতারকা, যাঁরা দেশের জার্সি গায়ে একসময় পাশাপাশি খেলেছিলেন এবং ভারতীয় ফুটবলকে তুলেছিলেন খ্যাতির শিখরে সেই দু’জন আজ প্রয়াত, শুধু পড়ে থাকল তাঁদের সৃষ্টি করা গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
চুনী গোস্বামীর জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার সুবিখ্যাত কিশোরগঞ্জে (এখানেই ছিল বাংলার সুবিখ্যাত রায় বংশের আদি বাড়ি, যে বাড়ির কৃতি সন্তানরা ছিলেন সারদারঞ্জন রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ)। ১৯৩৮ সালের ১৫ই জানুয়ারী। বাঙাল পরিবারে জন্ম হলেও চুনী গোস্বামীর ফুটবল জীবন পুরোটাই অতিবাহিত হয় সবুজ-মেরুন জার্সিতে গঙ্গাপারের ক্লাবে। চুনী এবং তাঁর দাদা মানিক (সুনির্মল) গোস্বামী মোহনবাগানের জার্সিতে একসঙ্গে দীর্ঘদিন খেলেছেন। ১৯৪৬ সালে মাত্র আট বছর বয়সে মোহনবাগানের জুনিয়র টিমে চুনী গোস্বামীর ফুটবল কেরিয়ারের সূচনা। ১৯৫৪ সাল থেকে খেলতে শুরু করেন মোহনবাগানের সিনিয়র টিমে। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই একই জার্সিতে ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে বহু অনন্য নজির সৃষ্টি করেন তিনি। তবে চুনী গোস্বামীর কাছে একসময় টটেনহ্যাম হটস্পারের মত ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের দলের অফারও ছিল। কিন্তু তিনি কোনওদিন সবুজ-মেরুন জার্সিকে ত্যাগ করেননি। মোহনবাগানের জার্সি গায়ে পূর্ব আফ্রিকা ও দূর প্রাচ্য সফরেও যথেষ্ঠ কৃতিত্বের পরিচয় দেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফরোয়ার্ড। ভারতের ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ফুটবলেও মোহনাবাগানের বহু ট্রফি জয়ের কান্ডারী ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন চুনী গোস্বামী।
দেশের জার্সিতে ভারতীয় ফুটবল দলে চুনী গোস্বামীর আবির্ভাব ঘটে ১৯৫৬ সালে চিনের অলিম্পিক ফুটবল দলের বিরুদ্ধে। ১৯৫৮-র টোকিও এশিয়াডে তিনি ভারতীয় ফুটবল দলের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড হয়ে ওঠেন। ১৯৬০-র রোম অলিম্পিকেও তিনি ভারতীয় ফুটবল দলের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড ছিলেন। তবে তাঁর ফুটবল কেরিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় ছিল ১৯৬২ সাল। ঐবছর প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ফুটবলে রহিম সাহেবের প্রশিক্ষণে ও চুনী গোস্বামীর অধিনায়কত্বে দ্বিতীয়বার (প্রথমবার ১৯৫১ সালে শৈলেন মান্নার অধিনায়কত্বে দিল্লীর প্রথম এশিয়ান গেমসে) এবং এখনও পর্যন্ত শেষবারের মত সোনার পদক জয় করে ভারতীয় ফুটবল দল, ফাইনালে ফেভারিট দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে। (ভারত এশিয়ান গেমসের ফুটবলে এখন পর্যন্ত শেষ পদক পায় ১৯৭০ সালে ব্রোঞ্জ জয় করে।) সেমিফাইনালে ভারত কঠিন লড়াই করে দক্ষিণ ভিয়েতনামেকে ৩-২ গোলে হারিয়ে। এই ম্যাচে ভারতের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন চুনী গোস্বামী। ভারতের ৩টি গোলের মধ্যে ২টি গোলই করেন তিনি। এই সময় ভারতীয় ফুটবলের তিন প্রধান স্তম্ভ ছিলেন চুনী-পিকে-বলরাম। এই তিনটি নাম এইসময়ে প্রায় সম্মুচ্চারিত হত। ১৯৬২ সালে চুনী গোস্বামী এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ফরোয়ার্ডের সম্মান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে অর্জুন পুরস্কার চালু হওয়ার পর প্রথম বছর ফুটবলে অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রদীপ কুমার ব্যানার্জী। ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় বাঙালি ফুটবলার হিসাবে অর্জুন হলেন চুনী গোস্বামী। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৪৩টি ম্যাচে ভারতের জার্সি গায়ে অবতীর্ণ হয়ে মোট ১১টি গোল করেছিলেন তিনি। ১৯৬৪-র মারডেকা কাপের পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
চুনী গোস্বামী ছিলেন সত্যিকারের জিনিয়াস খেলোয়াড়। ফুটবলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর ভারতের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও বাংলার ও পূর্বাঞ্চলের হয়ে বিশেষ কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় রোহিংটন বারিয়া টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ১৯৬২-৬৩-র রঞ্জি মরশুমে বাংলার হয়ে ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেন ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাট এবং মিডিয়াম ফাস্ট বোলার চুনী গোস্বামী। ইডেনে রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালে হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে রয় গিলক্রিস্টের আগুনে ফাস্ট বোলিং সামলে প্রথম ইনিংসে করেছিলেন মূল্যবান ৪১ রান (এই ম্যাচে জয়সীমার নেতৃত্বাধীন হায়দ্রাবাদের দুর্ধর্ষ বোলিং-এর বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করে বাংলার জয় নিশ্চিত করেছিলেন বাংলার আরেক কৃতি ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ রায়, যিনি আবার স্পোর্টিং ইউনানের হয়ে ফুটবল খেলেছিলেন নিজের প্রথম যৌবনে এবং ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলায় তাজ মহম্মদের ট্যাকেলে ভয়ানক চোট পেয়ে ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটে চূড়ান্ত মনসংযোগ করে ১৯৫০-র দশকে হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের নির্ভরযোগ্য ওপেনার।)। এই ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে মোট তিনটি উইকেটও অর্জন করেছিলেন চুনী গোস্বামী।
১৯৬৬ সালের ২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর ইন্দোরে আয়োজিত প্রথম শ্রেণীর ট্যুর ম্যাচে সফররত কানহাই, লয়েড, হল, গ্রিফিথ, কলিমোর প্রমুখ সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে ইনিংসে হারিয়ে দিয়েছিল পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল-এর মিলিত একাদশ। এই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শেষ করে দিয়েছিলেন দুই বাঙালি ক্রিকেটার সুব্রত গুহ ও চুনী গোস্বামী। ব্যাটে ২৫ রান করার পাশাপাশি বলে এই ম্যাচে মোট আট উইকেট নিয়েছিলেন চুনী গোস্বামী (প্রথম ইনিংসে ৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩), সুব্রত গুহ নিয়েছিলেন ম্যাচে এগারো উইকেট। ১৯৭১-৭২-এর রঞ্জি মরশুমে চুনী গোস্বামীর অধিনায়কত্বেই বাংলা ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু বোম্বের কাছে হেরে সেবার রানার্স হয়েই বাংলাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৯৬২-৬৩ মরশুম থেকে ১৯৭২-৭৩ মরশুম পর্যন্ত খেলেছেন চুনী গোস্বামী। ৪৬টি প্রথম শ্রেণীর খেলায় ২৮.৪২ গড়ে ১টি শতরান ও ৭টি অর্ধশতরানসহ মোট করেছেন ১৫৯২ রান এবং মিডিয়াম পেস বলে ২৪.০৮ গড়ে অর্জন করেছেন মোট ৪৭টি উইকেট।
ফুটবল-ক্রিকেটের পাশাপাশি জাতীয় স্তরে টেনিসেও যথেষ্ঠ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন তিনি। সাউথ ক্লাবের অন্যতম নিয়মিত টেনিস তারকা ছিলেন তিনি। খেলা ছাড়ার পরও যুক্ত ছিলেন খেলার সঙ্গে। তিনি ও পিকে একইসঙ্গে ডেটমার ফেইফারের প্রশিক্ষণাধীনে কোচিং ডিগ্রি অর্জন করে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন টাটা ফুটবল একাডেমীর ডিরেক্টর। খেলার পাশাপাশি তাঁর লেখনীও ছিল ভীষণ সাবলীল। যা তাঁর লেখা বই ‘খেলতে খেলতে’ সহজেই প্রমাণ করে। ব্যবহারে অমায়িক হলেও নিজের ক্রীড়ারীতি ও প্রতিভা সম্পর্কে যথেষ্ঠ উচ্চ ধারণা ছিল তাঁর এবং সেকথা তিনি বহু সাংবাদিককে বহু সময়ে খোলাখুলি বলেছেন। ২০০৫ সাল তাঁর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বছর। এই বছর একদিকে তিনি কলকাতার শেরিফের সম্মানীয় পদ অলঙ্কৃত করেন আবার এই বছরই তাঁর প্রিয় ক্লাব মোহনবাগান তাঁকে ‘মোহনবাগানরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করে। ২০১০ সালের মোহনবাগান দিবসের অনুষ্ঠানে বহু বছর পর নিবিড় আলাপচারিতায় দেখা গিয়েছিল ভারতীয় ফুটবলের চারস্তম্ভ শৈলেন মান্না, পি কে ব্যানার্জী, চুনী গোস্বামী ও অমল দত্তকে। সারাজীবন ভীষণ কর্মদ্যোমী থাকার পর বিগত কিছু সময় শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল। অবশেষে ৩০ এপ্রিল বিকেল পাঁচটায় হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিল ভারতীয় ক্রীড়া জগতের হৃদয় জয় করা এই মানুষটির।
প্রয়াত বর্ষীয়ান থিয়েটার ব্যক্তিত্ব ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার ভোররাতে চলে গেলেন তিনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর প্রয়াণ কলকাতা থিয়েটার জগতের ইন্দ্রপতন। কলকাতায় হিন্দি থিয়েটারের স্তম্ভ ছিলেন ঊষা গাঙ্গুলি। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের থিয়েটার দল রঙ্গকর্মী।
মাতৃভাষা হিন্দি হওয়া সত্ত্বেও বাংলা থিয়েটারে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। রুদালি-নাটকের মাধ্যমেই থিয়েটার জগতে নিজের জায়গা পোক্ত করেছিলেন তিনি। মহাশ্বেতা দেবীর লেখা গল্পেই তৈরি করেছিলেন রুদালি। রঙ্গকর্মীর ছায়ায় তারপর একে একে হিম্মত মাঈ, কোর্ট মার্শাল, কাশিনামা-র মতো লোকপ্রিয় নাটক তৈরি করেছেন।
তবে নাটকের পাশাপাশি হিন্দি সাহিত্য নিয়ে প্রভূত পড়াশোনা ছিল তাঁর। ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন বহুদিন। ২০০৮ সালে শিক্ষকতা থেকে বিরতি নিয়ে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন নাটকে। পরিচালনার জন্য সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারেরও ভূষিত হয়েছিলেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারেের তকফেও তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পেয়েছেন তিনি। কিছুদিন আগেই ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ছিলেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। এদিন তাঁর বাড়ির পরিচারিকা এসে দেখেন মাটিতে পড়ে আছেন তিনি। তাঁর প্রয়াণে নাট্যজগতে শোকের ছায়া।
(লেখাটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া হয়েছে।)
দার্জিলিং জেলার রিপোর্ট
প্রতিবারের মতো এবারেও উত্তরবঙ্গ জুড়ে রক্ত পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মিছিলে শ্লোগানে শপথে শ্রমিকরা মে দিবস পালন করেছে।
দার্জিলিং জেলা পার্টি অফিস : শ্রমজীবী পরিবারের প্রতিনিধি কমরেড রীতা দাসের পতাকা উত্তোলনের পরে শহীদ স্মরণ করে শ্রমিক শ্রেনীর ঐক্যকে সুসংহত করে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার শপথে শ্লোগানে শ্লোগানে শেষ হয় মে দিবসের কর্মসূচী। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, অপু চতুর্বদী, মীরা চতুর্বদী, মোজাম্মেল হক, ময়না সূত্রধর, লক্ষ্মী দাস প্রমুখ।
শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটি: শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে মে দিবসের কর্মসূচিতে পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য এবং শ্রমিক নেতা পুলক গাঙ্গুলী। শহীদ স্মরণ শেষে পুলক গাঙ্গুলী উপস্থিত কমরেডদের কাছে মে দিবসের তাত্পর্য বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেন। যে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার অর্জন করেছিল, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার করেছিল, বর্তমান দেশের ফ্যাসিবাদী সরকার তা কেড়ে নিতে চাইছেন এর বিরুদ্ধেই আগামীর লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথে শেষ হয় মে দিনের কর্মসূচি। উপস্থিত ছিলেন রজত বর্মণ, রুবী সেনগুপ্ত, মিলি ভট্টাচার্য, শাশ্বতী সেনগুপ্ত, ছবি দত্ত, গঙ্গা রায়, কল্পনা সরকার, ভাগ্য মন্ডল, আরতি বর্মণ, মনি ভট্টাচার্য, রমা রায় প্রমুখ।
খড়িবাড়ি : চা বাগানের শ্রমিক মহল্লায় লকডাউন সঙ্কটেও ধ্বনিত হল মে দিবসের শ্লোগান। সোনা চাঁদি চা বাগান সংলগ্ন মাঠে কমরেড বন্ধু বেক পতাকা উত্তোলন করেন। ছাত্র কমরেড চা শ্রমিক সুমন্তির দুনিয়ার মজদুর এক হও শ্লোগানে ততক্ষণে গলা মিলিয়েকেন নকশালবাড়ির আন্দোলনের প্রবীন নেতৃত্ব কান্দরা মুর্মু থেকে এ প্রজন্মের চা শ্রমিক নেতা তাসিলাল জোসেফ থেকে সদ্য প্রয়াত লালু ওঁরাওয়ের স্ত্রী মনিয়ারা ওঁরাও রাজকুমার এক্কারা। কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে চা শ্রমিক দাবি দিবসের দাবির ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখে কান্দরা মুর্মুর নেতৃত্বে একটি মিছিলে চা বাগান এলাকায় সংঘটিত হয়।
ফাঁসিদেওয়া : রাঙাপাণি স্টেশন মুটিয়া মজদুর ইউনিয়ন অফিসে এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন দাবির সম্মিলিত প্ল্যাকার্ড দিয়ে সাজানো অফিসে কমরেডরা শ্লোগানে শ্লোগানে নেন মে দিবসের শপথ। উপস্থিত ছিলেন নেমু সিংহ, পবিত্র সিংহ, পৈষানজু সিংহ, পঞ্চা বর্মণ, শরত সিংহ প্রমুখ।
জলপাইগুড়ি
মে দিবসে জলপাইগুড়ি পার্টি অফিসে পতাকা উত্তোলন করেন শ্যামল ভৌমিক। শহীদ স্মরণ এবং শ্লোগানে শপথে আগামী দিনের লড়াইয়ে মেহনতি মানুষের ঐক্যকে সুদৃঢ় করার শপথে শেষ হয় মে দিবসের কর্মসূচি। উপস্থিত ছিলেন সুভাষ দত্ত, প্রদীপ গোস্বামী, গোপাল রায়, শিল্পী দত্তগুপ্ত প্রমুখ।
বেরুবাড়ি : বেরুবাড়িতে মে দিবসে রক্ত পতাকা পতাকা উত্তোলন করেন বাছিরুদ্দিন হক। উপস্থিত ছিলেন হিমাংসু মজুমদার, ফরিদুল হক সহ বেশ কিছু শ্রমজীবী মানুষ।
হেলাপাকরি: জলপাইগুড়ি হেলাপাকরিতেও মে দিবসের কর্মসূচী পালিত হয়। উপস্থিত ছিলেন রতন সরকার, হরেন বসাক, নারিয়া বাদক এবং সিপিআই(এম)-এর অজয় সরকার।
কোচবিহার
কোচবিহার পার্টি অফিসে মে দিবসে কর্মসূচী পালিত হয়। পতাকা উত্তোলন করেন সুজিত দে। উপস্থিত ছিলেন রাজা, প্রজাপতি, বীণা সিংহ এবং আরো কিছু শ্রমজীবী মানুষ। এছাড়া জলপাইগুড়ি জেলার রংধামালিতে মুকুল চক্রবর্তী এবং ময়নাগুড়ির রাজার হাটে রেবা অঞ্জনা প্রমুখর নেতৃত্বে মে দিবসের কর্মসূচী পালিত হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের মে দিবস উদযাপন
বহরমপুর শহরের জেলা পার্টি অফিসে ১ মে সকাল সাড়ে আটটার সময় মে দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমেই পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে মাল্যদান শ্লোগানের পর এক মিনিট নিরবতা পালন করা হল। আন্তর্জাতিক মে দিবস জিন্দাবাদ, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, মজদুর ঐক্যের শ্লোগান উঠে। পর্যাপ্ত রেশন দেওয়ার দাবি, রেশন নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পরিবার পিছু ১০হাজার টাকার করোনা ভাতার দাবি, পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারী ঘরে ফেরানোর দাবি ও অন্যান্য দাবিতে শ্লোগান তোলেন কমরেড অপুর্ব লাহিড়ী। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কমরেড রাজীব রায়। তারপর অফিস ঘরে বসে সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এর লেখাটার পাঠ করা হল। তারপর লেখাটার সংক্ষিপ্ত ব্যাখা রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড সজল পাল। বর্তমান পরিস্থিতির উপর জেলার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রচেষ্টার উপর জোর দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয়। রাজীব রায় জেলার বিভিন্ন ব্লকের উদ্যোগ গ্রহণ করার ব্যাপারে আলোচনা করেন।
রানীনগর ব্লকের গ্রামের মধ্যে মে দিবস উদযাপন করা হয়। এবং বেলডাঙা ২নং ব্লক-এর কাশীপুর গ্রামে মে দিবস পালন করা হয়।
নদীয়া
নদীয়া জেলা সদর কৃষ্ণনগর শহরে পার্টি কার্যালয়ে মে দিবসের লাল পতাকা উত্তোলন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। এর পর শহরের এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে কৃষ্ণনগর বাস ষ্ট্যান্ডেও অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। পরিবহন শ্রমিকরা লকডাউনের পরিস্থিতিতে চরম সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। মে দিবসের দাবীগুলি ছাড়াও পরিবহন শ্রমিকদের খাদ্য ও লকডাউন ভাতার দাবিও তুলে ধরা হয়। সেখানে কয়েকজন শ্রমিক এগিয়ে আসেন ও কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন।
ধুবুলিয়াতে পার্টি ও এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে পার্টি কার্যালয়ে পতাকা উত্তোলন করা হয়। মে দিবস উপলক্ষে পার্টিঋর সাধারণ সম্পাদকের লিখিত বার্তা উপস্থিত কমরেডরা পাঠ করেন। ধুবুলিয়ায় বিড়ি ইউনিয়ন, রেলহকার ও লোডিং আনলোডিং ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দও কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন। নাকাশীপাড়া ব্লকের গাছা বাজারে পার্টি অফিসেও লাল পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। চাপড়া পার্টি অফিসেও অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। নবদ্বীপে পার্টি, এআইসিসিটিইউ ও ব্যান্ডেল কাটোয়া রেল হকার ইউনিয়নের কর্মী ও নেতৃত্বের অংশগ্রহণে শহরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লালপতাকা,ব্যানার ও শ্রমজীবী মানুষের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড সহকারে প্রচার করা হয়। তাহেরপুরে মে দিবসে পার্টি ও এআইসিসিটিইউ কর্মীদের অংশগ্রহণে লালপতাকা উত্তোলন, শহীদবেদীতে মাল্যদান, জনবহুল স্থানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়। তারপর রেল স্টেশন নিকটবর্তী স্থানে বামপন্থী ট্রেডইউনিয়নগুলির সাথে যৌথ ভাবে মে দিবস উদযাপন করা হয়। চাকদা শহরের পৌরসভার সামনে যৌথ ভাবে মে দিবস পালন করা হয়। স্লোগান ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্যর মধ্যদিয়ে ৮ ঘণ্টার কাজের অধিকার খর্ব করে ১২ ঘণ্টা করার বিরুদ্ধে, লকডাউনে শ্রমিকদের খাদ্য ও অর্থ দেওয়া, শ্রমিকের কাজ ও মজুরীর গ্যারান্টি দেওয়া সহ বিভিন্ন দাবিগুলি তুলে ধরা হয়।
কোলকাতা
যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পালিত হল মে দিবস। ঐদিন মৌলালির রাজ্য পার্টি ও এআইসিসিটিইউ অফিসে শহিদ বেদিতে পতাকা উত্তোলন ও মাল্যদান করা হয়। এই সংক্ষিপ্ত কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে অতনু চক্রবর্তী ও বাসুদেব বোস, রাজ্য নেতা ও কলকাতা এআইসিসিটিইউ-র সভাপতি প্রবীর দাস।
এরপর বিরসুলহাটে মে দিবসের কর্মসূচী পালিত হয়। সেখানে হকার ইউনিয়নের কর্মী ও নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বাসুদেব বোস র সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। উপস্থিত ছিলেন অতনু চক্রবর্তী, প্রবীর দাস, মহঃ শামিম, আমিন, রুস্তম ও অন্যান্যরা।
যাদবপুর-ঢাকুরিয়া এলাকায় এআইসিসিটিইউ ও পার্টি লোকাল কমিটির উদ্যোগে একাধিক স্থানে পালিত হয় মে দিবস। গড়ফা রিক্সা স্ট্যান্ড-পালবাজার-৮বি-সিআইটি মার্কেট ও গাঙ্গুলিপুকুর রিক্সাস্ট্যান্ডে শহিদ বেদিতে মাল্যদান করা হয়। এই কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন জয়তু দেশমুখ, বাবুন চ্যাটার্জি, অমলেন্দু চৌধুরী, সুষান্ত দেবনাথ, মমতা ঘোষ এবং রিক্সা ইউনিয়নের কর্মীবৃন্দ।
বাঁশদ্রোণিতে বেলতলা রিক্সা স্ট্যান্ডে উদযাপিত হয় মে দিবস। রিক্সা চালক ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন সৌরভ, স্বপন রায় চৌধুরী, গণেশ পুষ্টি, রাজিব গুহ, মিলন হালদার, মিঠু জ্বালানি প্রমুখ।
টালিগঞ্জ কমিটির তরফ থেকে মে দিবস পালিত হয় শ্রীকলোনি মাঠের সামনে। শহিদ বেদির সামনে পতাকা, পোস্টার নিয়ে কমরেডরা দাঁড়ান। বক্তব্য রাখেন, মলয়, ছাত্র কর্মী রুদ্র, সৌরভ। শান্তনু ভট্টাচার্য সঙ্গীত পরিবেশন করেন। উপস্থিত ছিলেন সৌমিত্র, শীলা, শংকর, আইসার কর্মী বর্ষা, আকাশ প্রমুখ। রামগড়ে মিড ডে মিল কর্মীরা পোস্টার প্রদর্শন করে পালন করেন মে দিবস।
বেহালায় তিনটি ব্রাঞ্চের উদ্যোগে তিন জায়গায় মে দিবস পালিত হয়। কালিতলা ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে স্থানীয় পার্টি অফিসে মাল্যদান ও নীরবতা পালনের মাধ্যমে মে দিবস উদযাপিত হয়। পুলিশী হুমকিকে অগ্রাহ্য করেই, কমরেডদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতিতে কর্মসূচী সম্পন্ন হয়।
সরশুনা ব্রাঞ্চের তরফ থেকে সতীন সেন পার্কে এর সামনে কর্মসূচী পালিত হয়। নীরবতা পালন করে শহিদদের স্মরণ করার পর ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে ছাত্র নেতা শুভদীপ পার্টির সাধারণ সম্পাদকের প্রেরিত বার্তা পাঠ করেন ও অভিজিৎ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। রবীন্দ্রনগর ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে সেখানে অবস্থিত কমঃ চারু মজুমদার ও সরোজ দত্তের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করার পর মে দিবসে পার্টির আহ্বানকে সামনে রেখে বক্তব্য রাখেন ছাত্র নেতা অত্রি।
উত্তর ২৪ পরগণা
মে দিবস শ্রমিকদের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকরা শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে মজুরি সংকোচন করছে ও লকডাউনের সময়কার মজুরি থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করেছে। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ নেওয়া হয়। বেলঘরিয়া কার্যালয়ে আঞ্চলিক কমিটির সদস্য কমরেড বিষ্ণু রায়, কামারহাটি কার্যালয়ে চটকল ইউনিয়নের সম্পাদক কমরেড মাজাহার খান, জেলা কার্যালয় রাষ্ট্রীয় পরিবহন ইউনিয়ন সদস্য কমরেড পরিমল দাস, মিড ডে মিল ইউনিয়ন কামারহাটি শাখার সম্পাদিকা কমরেড শিখা গুহরায়, জেলা অফিস সম্পাদক কমরেড অশোক সাহা শহীদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন। শহীদ স্মৃতিতে নীরবতা পালন এবং শ্লোগানের মধ্য দিয়ে কর্মসূচী শেষ হয়।
অশোকনগরের শহর ও গ্রামের পার্টি অফিসে, বীজপুরের হালিশহর জেটিয়া বাজার ও দাসপাড়া অঞ্চলে, নৈহাটির শিবদাসপুর গ্রামে, ও নৈহাটি জুটের ইউনিয়ন অফিসে পতাকা উত্তোলন হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রায় তিরিশজন শ্রমিক এই কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন। হালিশহর জেঠিয়া অঞ্চলে, জগদ্দলের কাঁকিনাড়া জুটমিলে ও জেজে আইতেও শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মে দিবস পালনে সামিল হন। কাঁচরাপাড়া অঞ্চলে রেল শ্রমিকেরা মে দিবস পালন করেন। রাজারহাট, মধ্যমগ্রাম, বসিরহাট অঞ্চলে ও গাইঘাটার চাঁদপাড়া পার্টি অফিসে মে দিবস পালিত হয়।
জেলা সদর বারাসাতে বারাসাত লিডিং টিমের উদ্যোগে ঐতিহাসিক মে দিবস প্রতিপালিত হলো। সভায় বক্তব্য রাখেন আজকের দেশব্রতী পত্রিকার সম্পাদক কমরেড অনিমেষ চক্রবর্তী, শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন দিলীপ দত্ত, রনজিৎদা, সুশান্ত বিশ্বাস, সমীর চাটার্জি, পবন, মায়া মুখার্জি ও জয় মুখার্জি।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার রিপোর্ট
ঐতিহাসিক মে দিবসে দঃ ২৪ পরগণার জেলাজুড়ে কর্মসূচী পালিত হয়। করোনা ভাইরাস আক্রমনের সময় যখন মানুষ ক্ষুধা, অধিকার,সম্মান ও রোগের হাত থেকে বাঁচতে মরনপণ লড়াই চালাচ্ছে তখন সরকারী হামলাও নেমে এসেছে। একদিকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসকে ১২ ঘণ্টায় পরিণত করার জন্য গুজরাট সরকার ফতোয়া জারি করেছে। কেন্দ্র সরকার গোপনে এই মতলবে আছে। চিকিৎসা/নগদ অর্থ প্রদানে/বিনামূল্যে রেশন সরবরাহে টালবাহানা ও দুর্নীতি অব্যহত রয়েছে। এর প্রতিবাদে আজ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জেলা কার্যালয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকার। রক্ত পতাকা তোলেন সিটু হকার্স ইউনিয়ন থেকে আগত কমরেড শশাঙ্ক ব্যানার্জী, বজবজ শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক অঞ্জন ঘোষ, দেবাশিষ মিত্র, স্বপন নস্কর, সুকান্ত দাস , সেখ সাবির, নন্দন মন্ডল সহ অন্যান্যরা। বজবজের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে রক্ত পতাকা তোলেন আয়ারলা-র জেলা নেত্রী কমরেড দেবযানি গোস্বামী, যুব নেতা আশুতোষ মালিক, আইসা নেত্রী সঞ্জনা ধাড়া, নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের নেত্রী অঞ্জনা মাল সহ আরো অনেকে।
বাখরাহাট স্কুল মোড়ে রক্ত পতাকা উত্তোলন পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের দঃ ২৪ পরগণা জেলা সভাপতি কমরেড ইন্নাস সেখ, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন সারাভারত কিষাণ মহাসভার জেলা সম্পাদক কমরেড দিলীপ পাল, পার্টির লোকাল সম্পাদক কমরেড নিখিলেশ পাল, বিপ্লবী যুব অ্যাসোশিয়েশনের পক্ষে কমরেড শুভদীপ পাল, কমরেড অর্ঘজ্যোতি পাল, সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি বিষ্ণুপুর-২ ব্লক কমিটির সম্পাদিকা কমরেড পূর্ণিমা হালদার, সারাভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পক্ষে কমরেড অনুপ সরদার ও অন্যান্য সংগ্রামী সাথীরা। পরিচালনা করেন কমরেড শুভদীপ পাল। সভায় পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের মে দিবস উপলক্ষে লেখা পাঠ করেন কমরেড শুভদীপ পাল। সভা শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন কমরেড দিলীপ পাল। উস্থি বাজারে রক্ত পতাকা তোলেন নির্মাণ ইউনিয়নের জেলা নেতা জয়দেব নস্কর, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন এআইকেএম-এর জেলা নেতা কমরেড জগদীশ মন্ডল, কমরেড ভবোতোষ মন্ডল সহ আরো অনেকে। বজবজের জামালপুরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ও সভা পরিচালনা পার্টির জেলা সম্পাদক। রক্ত পতাকা তোলেন আয়রলা-র জেলা নেতা কমরেড শ্যাম সুন্দর গোস্বামী, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন কমরেড মমতাজ বেগম সহ আরো অনেকে। বারুইপুর এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত হরিহরপুর-লাঙ্গলবেড়িয়া রিক্সাচালক ইউনিয়ন ১ মে উদযাপন করে। রক্ত পতাকা উত্তোলন ও শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন সম্পাদক কমরেড স্বপন ব্যানার্জী ও অন্যান্য ইউনিয়ন নেতৃত্ব।
বাখরাহাট অঞ্চলে নিজস্ব কর্মসূচী ছাড়াও সিপিআই(এম)-র কার্যালয়ে যৌথভাবে কর্মসূচী পালিত হয়। বাখরাহাটে যৌথ কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা নেতা কমরেড দিলীপ পাল। বাটা অঞ্চলে সিপিআই(এম) কার্যালয়ে যৌথ কর্মসূচীতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন জেলা নেতা কমরেড শিবন ধর।
রিপোর্ট- শুভদীপ।
হুগলি
ওরা কাজ করে মাঠে, বন্দরে, ওরা কাজ করে পথে প্রান্তরে। মে দিবস ওদের কথা বলে, ওদের কথা ভাবায় তাই স্বাভাবিক ভাবেই ওদের নিরাপদে ঘরে ফেরানোর দাবিতে, প্রত্যেকের রেশনের দাবিতে, লকডাউনকালে মজুরি বন্ধ না করা ও বিশেষ ভাতা দেওয়ার দাবিতে এবং লকডাউনের ক্ষতি পোষাতে ওদের ঘাড়ে দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজের বোঝা না চাপানোর দাবিতে গ্রাম, শহর সোচ্চার হল ১ মে ২০২০।
হুগলী জেলার গ্রামীণ এলাকায় পাণ্ডুয়া ব্লকের
ইলছোবায় সকালে শহীদ স্মরণ হয়, পতাকা উত্তোলন করেন লোকাল কমিটির সদস্য রাম হাঁসদা, সাঁচিতারায় পার্টি ব্রাঞ্চ সম্পাদক দিবস মালিক পতাকা উত্তোলন করেন, বৈঁচির মুরলী কোল্ডস্টোরের কর্মসূচীতে রক্তপতাকা তোলেন বিনোদ আহির এবং কোঁচমালির রায়পাড়ায় পার্টির সঙ্গে প্রায় চল্লিশ বছর যুক্ত থাকা গরিব কৃষক নেত্রী লক্ষী রায়ের নেতৃত্বে শহীদ স্মরণ হয়। বৈঁচি পার্টি অফিসে মে দিবস শপথে পতাকা তোলেন ব্লক কমিটি সদস্য সরস্বতী তুড়ি ও হালদারদীঘিতে বর্ষীয়ান গরিব কৃষক নেতা মেঘনাথ সর্দার। বিকালে দ্বারবাসিনীতে শহীদ স্মরণে রক্তপতাকা তোলেন জেলা কমিটি সদস্যা শিপ্রা চ্যাটার্জী। বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়া ব্রাঞ্চ, ইছাপুর ও ইটাগড়েও মে দিবস উদযাপন করেন ক্ষেতমজুর ও গ্রামীণ শ্রমজীবি মানুষরা। সায়রা গ্রামে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চে সামিল নতুন সদস্যরা আন্তরিকতার সাথে শহীদ স্মরণ ও রক্তপতাকা উত্তোলন করেন। পোলবা-দাদপুর ব্লকের বালিটানায় আয়ারলা ও আদিবাসী মঞ্চের কমরেডরা পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ করেন।
ধনিয়াখালিতে আয়াররা, আর ওয়াই এ ও আদিবাসী মঞ্চের তরফ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কমরেডরা লাল পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ করেন। হুগলী শিল্পাঞ্চলে ভদ্রেশ্বরে অ্যাঙ্গাস জুট মিলের গির্জা গেটের সামনে এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে রক্তপতাকা উত্তোলন ও শহীদবেদীতে মাল্যদান হয়। চাঁপদানির কমরেডরাও নিজ নিজ বাড়িতে শহীদ স্মরণ করেন পরিবারের সদস্যদের সাথে। কোন্নগরের ১, ২ ও ৩ নং শাখা ও জয়ন্তনগর-বিধানপল্লী শাখায় এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্বে নির্মাণ শ্রমিকরা লাল ঝাণ্ডা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণের সাথে করোনা আতঙ্ককে সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ হিসাবে কাজে লাগানোর বিজেপির বিভিন্ন ধরনের অপচেষ্টাকে সরাসরি রাস্তাতেই মোকাবিলার হুঁশিয়ারি দেন। হিন্দমোটর ৪নং শাখার উদ্যোগে বিপিন ভিলা মোড়ে শহীদ বেদীতে রক্তপতাকা উত্তোলন ও মাল্যদান হয়। জেলার সমস্ত অঞ্চলেই মে দিবস স্মরণে সাধারণ সম্পাদকের লেখাটি পাঠ ও আলোচনা হয়।
রিপোর্ট - সৌরভ
পূর্ব বর্ধমান –
বর্তমান লকডাউন-এর পরিস্থিতির মধ্যেই শাসক কুল করোনার অজুহাত দেখিয়ে শ্রমিক এবং মেহনতি জনগণের জীবন-জীবিকার এবং শ্রমের উপর নামিয়ে এনেছেন আক্রমন তখন এবারের মে দিবস উদযাপনের ও গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।নতুন নতুন দাবি ও সামনে চলে আসছে। শাসক কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অপরিকল্পিত হঠাৎই গরিব মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্তমুলক ভাবে লকডাউন ঘোষণার ফলে ব্যাপক গরিব মেহনতি মানুষ অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে। খাদ্য মজুরি চিকিৎসার অভাবের ফলে চরম বিপদের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে যারা দৈনিক মজুরি বা আয়ের উপর নির্ভর করেই সংসার চালান ।লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।কাজ বন্ধ মজুরি নেই খাদ্য নেই থাকার জন্য আস্তানা নেই। রাস্তায় থাকতে চাইলেও পুলিশী অত্যাচার মোট কথায় মরনোন্মুখ অবস্থার পথে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। আর রাষ্ট্র নায়করা ঘন ঘন টিভির সামনে দাঁড়িয়ে জাতির উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করার বাণী বর্ষণ করতে থাকছেন। জয়ের গল্প শোনাচ্ছেন। হাত তালি বাজাচ্ছেন, বাজি ফাটাচ্ছেন, বাতি জ্বালাচ্ছে, গোমুত্র সেবনের অনুষ্ঠান করাচ্ছেন। এই পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে পুর্ব বর্ধমান জেলায় গত ১২ এপ্রিল সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ডাকা বিক্ষোভ কর্মসূচী, ১৮-১৯ এপ্রিল এআইসিসিটিইউ-র ডাকা অনশন বিক্ষোভ, ২৩ এপ্রিল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ডাকা অনশন আন্দোলন, ২২ এপ্রিল সিপিআই(এম-এল)-এর ৫১তম প্রতিষ্ঠা দিবসও কমরেড লেনিনের ১৫০তম জন্মদিবস, ২৭ এপ্রিল এআইকেএম ওআয়ারলা ডাকা বিক্ষোভ অবস্থান কর্মসূচী সমস্ত ক্ষেত্রেই ভাল সাড়া পাওয়া যায়।
এই সমস্ত কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যে দাবি গুলো উঠে আসছে তাহল –
১৷ রেশন কার্ড নেই এমন পরিবার সহ সমস্ত গরিব পরিবারের জন্য বিনামুল্যে পর্যাপ্ত রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ।
২৷ প্রতিটি গরিব পরিবার পিছু ১০হাজার টাকার করোনা ভাতা দিতে হবে ।
৩৷ সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারী খরচে ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে ।
৪৷ আট ঘণ্টার শ্রম দিবস আইন সুরক্ষিত রাখতে হবে ।
৫৷ ব্লকে ব্লকে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ।
৬৷ সাম্প্রদায়িক হিংসা, বিভেদ ও ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ।
৭৷ সমস্ত গ্রামীণ শ্রমিকদের সামাজিক কল্যাণ পরিষদে নথিভুক্ত করতে হবে ।
শেষ বিচারে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই এবং করোনার বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলুন। তাই এবারের মে দিবস উদযাপনের মধ্যে দিয়েও এই সমস্ত দাবিগুলো সমদান করার আওয়াজ ধ্বনিত হয়। জেলার ১০টা জায়গায় মে দিবস উদযাপনের করা হয়। বর্ধমান সদর ২নং ব্লক-এর করন্দা গ্রামের কমরেড সুকুমার সোমের নেতৃত্বে গ্রামের কমরেডরা অংশ গ্রহণ করেন। শক্তিগড়ে কমরেড ঠাকুর-দার নেতৃত্বে মে দিবস উদযাপন করা হয়।
বর্ধমান সদর ১নং ব্লকের কামারকিতা গ্রামের কমরেড সমীর হাজরার নেতৃত্বে মে দিবস পালিত হয়। বর্ধমান শহরে কমরেড শ্রীকান্ত রানা ও কমরেড কুনাল বক্সীর নেতৃত্বে মে দিবস উদযাপিত হয়। মেমারী ১নং ব্লকের নিমো অফিসে কমরেড সাধন কর্মকারের নেতৃত্বে মে দিবস উদযাপন করার ব্যবস্থা করা হয়। কালনা ২নং ব্লক এর অকালপোষ অঞ্চলের আগ্রাদহ গ্রামে কমরেড রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে মে দিবস উদযাপন সংগঠিত করা হয়। মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামের অফিসে কমরেড আনসারুল আমন মন্ডলের নেতৃত্বে মে দিবস পালন করা হয়। নাদনঘাট থানার ইসলাম পুর গ্রামে কমরেড জিয়াদুল সেখের নেতৃত্বে মে দিবস পালিত হল।
পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে কমরেড শিবু সাঁতরা ও কমরেড সমীর বসাকের নেতৃত্বে মে দিবস উদযাপন করা হয়। কাটোয়া থানার সাহাপুর গ্রামে কমরেড স্বপন মণ্ডল-এর নেতৃত্বে মে দিবস পালিত হয়।প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই পতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও নিরবতা পালন করা হয়। উপরোক্ত দাবি তুলে শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক মে দিবস জিন্দাবাদ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান উঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য-এর লেখা পড়া হয়। আয়ারলা-র ঘোষণা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই মাথায় লাল পেট্টি বাঁধা হয়।
গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরী ওয়ার্কার্স ইউনিয়নর মে দিবস উদযাপন
১ মে, আন্তর্যাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী এবারের মে দিবস এক সংকটময় পরিস্থিতিতে অভিনব ভাবে পালিত হল। সাধারণ শ্রমিকের জমায়েতের মাধ্যমে চিরচরীত মে দিবস উদযাপনের বিপরীতে গিয়ে কোথাও বাড়িতে থেকে, কোথাও খুব ছোট্ট জমায়েতের মধ্য দিয়ে লকডাউনের নিয়ম বিধি মেনে এবারের মে দিবস পালিত হল। সাধরণ শ্রমিকদের এক বড় অংশ এবারের উদযাপনে শামিল হতে পারল না। শ্রমিকদের সবথে বড় অংশই আজ গভীর সংকটে নিম্মজিত। মে দিবসের দিশাই এই শংকট মুক্তির একমাত্র পথ। গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন নিজ নিজ বাড়িতে থেকে আন্তর্যতিক শ্রমিক দিবস পালন করল। ঘটমান বর্তমানের পাতা ওলটালে তার পাতায় পাতায় দেখা যায় মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা আজও অমলিন ।
নতুন মারণ অস্ত্র করোনা কোভিদ-১৯ বিশ্ববাসীকে আতঙ্কগ্রত করে তুলেছে। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। কাজ হারানো, বেতন হ্রাস, কাজের সময় বৃদ্ধি এসবের থেকেও বড় সংকট অস্তিত্বের। কর্পোরেট নিজের সংকটা থেকে রেহাই পেতে সরকারের থেকে আয়কর ছাড়, ঋণ মুকুব ইত্যাদির সুযোগ গ্রহণ করছে। এই সুযোগে কর্মী ছাঁটাই করে কাজের সময় বৃদ্ধি মাধ্যমে উৎপাদন ঠিক রেখে মুনাফা বাড়িয়ে নিচ্ছে। সরকার ও শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে কাজের সময় ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা করতে চাইছে। ইতিমধ্যে গুজরাট, রাজস্থান সহ কয়েকটি সরকার শ্রম আইন পরিবর্তন করে দৈনিক কাজের সময় ১২ ঘণ্টা করে নিয়েছে। সংবিধানের ৫নং ধারা প্রয়োগ করে এটা করা হয়েছে বলা হচ্ছে। যদিও ঐ ধারায় আজকের মতো অবস্থার কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে দেশ বিপন্ন, সেটা বহিঃশত্রুর আক্রমন, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি পরিস্থতির কথা বলা হয়েছে।
গান এন্ড শেল ফ্যক্টরি সহ প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিকরাও এই সংকটের থেকে বাইরে নয়। প্রতিরক্ষা শিল্পকে করপোরেটদের কাছে বেচে দেওয়ার সরকারি চক্রান্তের বিরুদ্ধে এখানকার শ্রমিকরা কয়েক বছর ধরে লাগতার লড়াই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। দু-দফায় প্রতিরক্ষা শিল্পে আটদিনের ধর্মঘট সফল করেছে। ২২০ বছর ধরে দেশের সামরিক প্রয়োজনে দক্ষতার সঙ্গে উন্নতমানের সমরাস্ত্র সরবরাহ করার পরেও সরকার প্রতিরক্ষা কারখানায় উৎপন্ন পণ্যের মান ও দামের দোহাই দিয়ে এই ক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চায় ।
করোনা কোভিদ-১৯ ভাইরাস আক্রমনের ফলে বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেরও যখন টাল মাটাল অবস্থা প্রতিরক্ষা শ্রমিকরা কিন্তু বসে নেই। লকডাউনে অস্ত্রের উৎপাদন যখন বন্ধ, কলকারখানা, অফিস কাচারি বন্ধ, সবাই যখন নিভৃতবাসে, প্রতিরক্ষা শ্রমিকরা তখন ব্যাস্ত করোনা যুদ্ধের সৈনিকদের জন্য সরঞ্জাম তৈরিতে । প্রতিরক্ষা কারখানায় আপাতকালীন পরিস্থিতিতে তৈরি হচ্ছে এই চিকিতসায় উপযোগী ভেন্টিলেটর, পিপিই , ফেসশিল, ওটি ড্রেস, ডিপোজেবল গাউন, বিভিন্ন ধরনের মাস্ক, স্যনিটাইজার ইত্যাদি। সারাদেশে দশটি প্রতিরক্ষা হাসপাতাল কে কোভিদ আসোলেশন হাসপাতাল হিসাবে চিহ্নত করা হয়েছে ।
গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরি হাসপাতাল কাশীপুর ওএমএসএফ হাসপাতাল ইছাপুর-এর মধ্যে পড়ে। প্রতিরক্ষা কারখানায় তৈরি এই সব চিকিৎসা সামগ্রী দেশীয় ও বিশ্বমান অনুযায়ী স্বীকৃত। আর দাম যে কোনো ব্র্যান্ডের থেকে অনেক কম ।
সরকারীভাবে ও বিভন্ন মিডিয়াতে কর্পোরেটের লেজুড় বৃত্তিকারী ব্যাক্তি বর্গের দ্বারা যখন সরকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরির নিরন্তর প্রয়াস চলছিল। করোনার আক্রমণে সাধারণ মানুষের চোখের সামনে থেকে কালো পর্দাটা সরে গেল। এমন কি যারা এতদিন সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটা কথা না বলে সারাদিনে এক গ্লাস জলও খেত না তারাও এখন সরকারী প্রতিষ্ঠানের গুণগান করছে কেউ আড়ালে, কেউ একটু অন্য ভাবে।
লড়াইটা সব সময় শ্রমিকরাই করে। এই প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন নেতৃত্ব বাড়িতে থেকে এবারের আন্তর্যাতিক শ্রমিক দিবস পালন করল। শ্রমিক সহ সমস্ত সাধারণ মানুষের ওপর করোন ও কর্পোরেটের দ্বারা নেমে আসা আক্রমণ গুলোকে প্রতিহত করার জন্য প্লাকার্ড-এর মাধ্যমে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়।
ক) ক্ষুধার্ত মানুষের খাবারের ব্যাবস্থা, করোনা ও দারিদ্রকে পরাস্ত করা
খ) লকডাউন পর্যায়ে অসংগঠিত, কৃষি ও গ্রামীণ শ্রমিকদের আগামী ছ-মাস প্রতি মাসে ১০০০০ টাকা করে দিতে হবে ।
গ) কাজের সময় বৃদ্ধি করে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা করা চলবে না।
ঘ) শ্রমিক বিরোধী কোড বাতিল কর।
ঙ) করোনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাকে মেশানো চলবে না।
চ) সকলের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা দিতে হবে।
মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা আগে যেমন ছিল এখনও আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে। দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ এক হও।
সাধারণ মানুষের স্বার্থে এর আগেও বিভিন্ন পদক্ষেপ করতে দেখা গেছে ‘আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’-কে। ৫ বছর ধরে রেশন না পাওয়া গ্রামবাসীরাও সুরাহা পেয়েছেন। এবার রেশন কার্ড দুর্নীতি ও ১০০ দিনের কাজ চালুর দাবিতে হুগলীর জয়হরিপুর গ্রাম থেকে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেছে তারা। সংগঠনের নেতা সজল দে বলেন, ‘১০০ দিনের কাজ অবিলম্বে চালু করতে হবে। রেশন কার্ড নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও সমস্ত মানুষের রেশন সুনিশ্চিত করতে গ্রামভিত্তিক কার্ডের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। নির্বাচন পরিচয় পত্রের তালিকা যেমন গ্রাম ও বুথভিত্তিক থাকে, তেমনই রেশন কার্ডের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন দুর্নীতি বন্ধ হবে, পাশাপাশি সমস্ত মানুষের রেশনের ব্যবস্থাও সুনিশ্চিত করা যাবে। এই দুটি দাবিকে সামনে রেখে ১০০ ঘণ্টার অবস্থান আন্দোলন চলছে।’
তাঁদের এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন আশেপাশের গ্রামের মানুষও। স্বেচ্ছায় যোগ দিচ্ছেন অবস্থানে। মঙ্গলবার থেকে হুগলীর বিভিন্ন ব্লকে ৫-৭টি গ্রামেও ১০০ ঘণ্টার অবস্থানে যোগ দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এই অবস্থান কর্মসূচীতে যোগ দেবেন রাজ্যের বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশন (আরওয়াই)-এর নেতারা, এমনটাই জানিয়েছেন সজল দে। তিনি আরও বলেন, ‘১০০ ঘণ্টার প্রতিবাদী অবস্থান শুরু হয়েছে হুগলীর জয়হরিপুর গ্রাম থেকে। আজ একই দাবিতে অবস্থানে বসেছে আরও কয়েকটি গ্রাম। সেগুলির মধ্যে মুড়িগড়িয়া, পুঁটিগড়িয়া, বোড়োনানপাড়া, মহেশ্বরবাটি, আখিলপুরেও চলছে এই অবস্থান। সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ ও আরওয়াই-এর পক্ষ থেকে এই অবস্থান কর্মসূচি চলছে।’
বিষ্ণুপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প সহ শাঁখ, লন্ঠন ও অন্যান্য পোড়ামাটি, বেল-নারকেলের খোলা দিয়ে রকমারি সম্ভার বানানোর শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের লকডাউনের দরুন অনর্থনৈতিক ক্ষতি ও সঙ্কটময় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের দাবি নিয়ে বিষ্ণুপুর মহকুমাশাসকের কাছে ডেপুটেশন দিলেন শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ-র নেতৃত্ব।
শহরে বসবাসকারী কয়েক হাজার ভ্যানচালক, রিক্সাচালক ও নির্মাণ শ্রমিক সহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের ১০০০০/- টাকা ভাতা প্রদানের দাবি করে এআইসিসিটিইউ।
এই লকডাউন চলাকালীন যাঁরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখলেন সেইসব পৌরসভার সাফাইকর্মীদের ন্যায্য ১৮,০০০/- নুন্যতম মজুরি ও এক বছরের ওপর কর্মে নিযুক্ত সমস্ত অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণের দাবিও জানানো হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে।
আগামীদিনে এই সকল দাবি পূরণ না হলে রাস্তার আন্দোলন তীব্র করার কথা বলেন এআইসিসিটিইউ ভুক্ত ইউনিয়নের শ্রমিকরা।