(নির্দিষ্ট কোনো লেখা পড়তে সেই হেডিং-এ ক্লিক করুন)
বাংলার ২১টি কৃষক সংগঠন নিয়ে গঠিত সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির রাজ্য শাখার নেতৃত্বে আজ ১১ মে রাজ্যের ব্লকে ব্লকে লকডাউনের নিয়ম মেনে প্রতিনিধিত্ব ডেপুটেশন সংগঠিত হয়েছে। লিখিত ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরিয়ে আনা এবং কৃষক, গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষদের অবস্থা ও দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো ইতিবাচক উত্তর আসেনি। আমাদের পক্ষ থেকে ব্লকে ব্লকে -- জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলী, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা প্রভৃতি জেলায় – লকডাউনের নিয়ম মেনে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ধান, পাট, ভুট্টা, পান, পলু চাষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ব্লক আধিকারিকরা মেনে নিয়েছে। সব জায়গায় রাজ্যের ও জেলার নেতৃত্ব ডেপুটেশনে উপস্থিত ছিলেন। যে সব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে তার কোনো জবাব সরকারের পক্ষ থেকে নেই ফলে ব্লক আধিকারিকরা কিছু বলতে পারেননি, দু-তিন জনের রেশনের সমস্যা হলে তাঁরা কিছু করতে পারবেন বলে জানান। রেশন নিয়ে অনিয়মের কথাও তাঁরা মেনে নেন। কিন্তু সব কিছুরই জবাবে বলেন সরকারের কাছে আপনাদের ডেপুটেশনের কপি পাঠিয়ে দেব। একদিকে কেন্দ্রের সরকার চাইছে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নস্যাৎ করতে আর অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখতে। যার ফলস্বরূপ রাজ্যের সমগ্র প্রশাসন পরিণত হয়েছে নীরব দর্শকে। প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা মনেকির এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। আগামীদিনে আন্দোলন জোরদার করা ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা আমাদের সামনে নেই।
দাবিসমূহ
ধন্যবাদান্তে,
সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি (এআইকেএসসিসি)
পশ্চিবঙ্গ শাখার অন্তর্ভুক্ত ২১টি কৃষক সংগঠনের পক্ষে
অমল হালদার (আহ্বায়ক)
কার্তিক পাল (সাংগঠনিক সম্পাদক)
অনেককিছুই অপেক্ষা করতে পারে -- কিন্তু কৃষিকাজ নয়! একদা এ কথা বলেছিলেন এক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনেতা। আজ করোনা লকডাউনের অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে সেটা যেন প্রকটভাবে সামনে উঠে এসেছে। কৃষিকাজ থেমে নেই। লকডাউনের সংকটের বোঝা ঘারে নিয়ে, প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে অসম্ভব শ্রমে ঘামে কৃষক ফসল ফলিয়ে চলেছে। বৈশাখের প্রখর তাপে কখনও বা বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টির ক্ষয় ক্ষতি মাথায় নিয়ে অন্নদাতারা চালিয়ে যাচ্ছে কৃষিকাজ। কিন্তু লকডাউনের বাজারে তাদের উৎপাদিত ফসলের দাম নেই। ফসল বাজারে নিয়ে যাবে কে? এ দায়িত্ব তো ছিলো সরকারের। কিন্তু এ কাজে সরকারের কোনো প্রচেষ্টাই দেখা গেলো না। এভাবে কৃষকদের বিশেষত গ্রামের ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের আবারও নতুন করে ঋণফাঁদে জড়িয়ে পড়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। কাগজে কলমে সরকারের পরামর্শদাতা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশগুলি কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার ঘোষণা করলো। যেমন, সরকারীভাবে ফসল ক্রয় করো, বাজারের সংযোগ রক্ষা করো, চাষিদের আর্থিক সহায়তা দাও – ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু বাস্তবে প্রতিশ্রুতিগুলি পরিণত হয়েছে প্রতারণা আর চরম শঠতায়। যেমন প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সহায়তা প্রকল্পর টাকা বাংলার একজন চাষিও পেলো না। লকডাউনে ফসলের চূড়ান্ত অভাবী বিক্রির জন্য এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ নেই, কৃষিতে উদ্বৃত্ত ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন। তাদের জন্য কোনো আর্থিক সহায়তা এলো না। দেখা গেলো রাজ্য কেন্দ্র যেন একই পথের পথিক। কৃষি ও কৃষকদের প্রতি কেবলই মিথ্যার বেসাতি-নির্লজ্জ ধোঁকাবাজি! এর বিরুদ্ধে গ্রাম বাংলার দিকে দিকে চলছে কৃষক ও মজুরদের বিক্ষোভ। সরকারী প্রতারণা বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফু্ঁসছে গ্রামের কৃষিজীবী শ্রমজীবী মানুষ। লকডাউন বিধির মধ্যেও একে সংগঠিত রূপ দিতে, বধির সরকারের কানে কৃষকের বাঁচার দাবি পৌছে দিতে গত ১১ মে রাজ্য জুড়ে ব্লকে ব্লকে অনুষ্ঠিত হলো বিক্ষোভ ডেপুটেশন। সারা ভারত কৃষক সমন্বয় কমিটির আহ্বানে সমস্ত বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলির অংশগ্রহণে এই কর্মসূচী সংগঠিত হয়। দেখা গেলো ডেপুটেশন দেওয়ার পর ব্লকের আধিকারিকরা “উপরে পাঠিয়ে দেবো”, “দেখছি দেখবো” বলে দাবিগুলি উপেক্ষা করে কার্যত সরকারী উদাসীনতার মনোভাবকেই তুলে ধরলো। কিন্তু লকডাউনের মধ্যেও এই কর্মসূচী আমাদের কাজের এলাকায় গ্রামের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের বার্তা পৌছে দিয়েছে। আগামীদিনে যে প্রবল সংকট নেমে আসতে চলেছে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যপক মানুষকে সজাগ করে তুলতে সহায়ক হয়েছে। এলাকায় গরিব মানুষদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে উৎসাহ।
নদীয়া
ব্লক ডেপুটেশনের কর্মসূচীতে সবচেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে খাদ্য সংকট তথা রেশনে বঞ্চনার বিষয়গুলি। দেখা গেলো বহু সংখ্যক মানুষের রেশন কার্ড নেই। যারা মাঠে চাল গম উৎপাদন করে,তারাই এখন রেশনের চালের জন্য সরকারী দপ্তরের দোরগোড়ায়! নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া ব্লকের বিডিও বঞ্চনার কথা কিছুটা মেনে নিলেন। কিন্তু তিনি খাদ্য সংকট আছে বলে স্বীকারই করলেন না। বললেন “আসলে কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না, শুধু এ জন্যই হাজার খানেক মানুষ ব্লক অফিসে ভীড় করেছিলো। যারা রেশন কার্ডের দরখাস্ত জমা করেছে,অথচ কার্ড না পাওয়ার ফলে মাল পাচ্ছে না।” কার্যত এভাবে তিনি সরকার বা শাসকদের প্রচারকেই তুলে ধরলেন। মাসে মাত্র ৫/৭ কেজি মাল দিয়ে লাগাতার প্রচার করা চলছে যে -- রেশনে নাকি প্রচুর মাল দেওয়া হচ্ছে! ঐ স্বল্প পরিমান চাল গম পেলেই ব্যাস! গরিবের যেন আর অন্য কিছুর দরকার নেই!! এ যেন ফোঁটা ফোঁটা জল দাও, কোনোরকম ভাবে যেন বেঁচে থাকে! বিডিওর এই কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রতিনিধিরা বলেন, খাদ্য সংকট এবং বঞ্চনা দুটোই আছে। ডেপুটেশনে উপস্থিত কিষান মহাসভা, কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি ও কিষাণসভার নেতারা বলেন, ক্ষুধা-দারিদ্র আপনি বা সরকার কিংবা শাসক দল কী ভাবে বুঝবেন? মোদ্দা বিষয় হলো রেশনকার্ড মানুষের অধিকার। সেটা খাদ্যদপ্তর দেবে, নাকি ব্লক প্রশাসন দেবে আমরা জানি না। আপনার এক্তিয়ারে থাকা ব্লক খাদ্য দপ্তরের মাধ্যমে আপনি দ্রুত কার্ড বিলি করুন। বছরের পর বছর মানুষকে হয়রানি করা চলছে কেন? তাহলে কি লকডাউন উঠে গেলে মানুষকে কার্ড দেবেন?
প্রচুর বিতর্কের পর অবশেষে বিডিও প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, স্পেশাল জিআর-এর খাদ্য একেবারেই হতদরিদ্র মানুষদের দেওয়া হবে।
এরপর গ্রামে ক্যাম্প করে সরকারী দরে কৃষকের ধান কেনা, বৃষ্টি-শিলাবৃষ্টিতে মাঠের ফসলের ব্যাপক লোকসানের ক্ষতিপূরণ, ১০০ দিনের কাজ চালু করা,লকডাউনে জবকার্ডে ক্ষতিপূরণ – ইত্যাদি ৮ দফা দাবি নেতৃবৃন্দ তুলে ধরেন। দিনমজুরদের জন্য এককালীন ১০০০ টাকা রাজ্য সরকারের অনুদানের “প্রচেষ্টা” প্রকল্প সম্পর্কে বিডিও বলেন “ব্লকে দুই আড়াই হাজার দরখাস্ত জমা পড়েছে। তবে সেগুলি ডাস্টবিনে যাবে! নাকি কোথায় যাবে! উপরতলার নির্দেশ না এলে বলা যাবে না।” যদিও এই প্রকল্পের জন্য অনলাইনে “নিস্ফল প্রচেষ্টার” কথা তার কাছে শোনা গেলো!
শুরুতে বিভিন্ন দাবি সম্বলিত পোষ্টার বুকে নিয়ে ভালো সংখ্যক কর্মীরা বিডিও অফিস চত্বরে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বক্তব্য রাখা ও স্মারক লিপি পাঠ করা হয়,যা ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নদীয়ার ধুবুলিয়ার (কৃষ্ণনগর ব্লক ২ নং) কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন এআইকেএম নেতা সুবিমল সেনগুপ্ত, খোদাবক্স সেখ প্রমূখ ৷ জাতীয় সড়কের উপর থাকা ব্লক অফিসের সামনে পোষ্টার সহ স্লোগানের মাধ্যমে এই কর্মসূচী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মালিকরা নয়, ভাগ-চুক্তি চাষিরাই যাতে ফসলের ক্ষতিপূরণ পায়, এ বিষয়ে বিডিও কে জোড়ালো দাবি জানানো হয়। বিডিও বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে জানান। এছাড়া ডেপুটেশন কর্মসূচী সংগঠিত হয় নদীয়া জেলার কালীগঞ্জ ব্লকে।
বাঁকুড়া জেলার ১ নং ব্লকে নজরকাড়া মিছিল করে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। আয়ালার রাজ্য নেতা বাবলু ব্যানার্জী সহ বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। রেশনে খাদ্য না পাওয়া বহুসংখ্যক গরীব মানুষের কার্ডের দাবি তুলে ধরলে বিডিও জানায় যে ব্লকের জনসংখ্যা অনুযায়ী রেশন কার্ডের সংখ্যা প্রায় সমপরিমাণ। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে -- এই যে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক মানুষের কার্ড নেই – তার পেছনে কারণটা কি? তাহলে কি প্রচুর সংখ্যায় ভূয়া কার্ড রয়েছে? এ বিষয়ে তদন্তের দাবি জানানো হয়। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে ফারহান খান সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ডেপুটেশন দেন। এখানে দিনমজুর ও অন্যান্য শ্রমজীবীদের পিএফ-এর জমা টাকা ফেরতের দাবিটা গুরুত্ব পায়। পুরসভা এলাকায় ১০০ দিনের প্রকল্প চালু নেই বলে জানা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে শহর এলাকায় কর্মহীন গরিব শ্রমজীবী মানুষের কাজের উপযোগী প্রকল্প চালু করার দাবি প্রাধান্য পায়। এছাড়া বাঁকুড়ার ওন্দা, ছাতনা ও ২নং ব্লকে অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়।
উঃ ২৪ পরগণার হাবড়া ২ নং ব্লকে আয়ারলার রাজ্য কমিটি সদস্য অজয় বসাক সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ডেপুটেশন দেয়। এখানে ৩৯ জন গরিব মানুষ যাদের রেশন কার্ড নেই তাদের তালিকা স্পেশাল রিলিফের জন্য জমা দেওয়া হয়েছিলো, অথচ তারা মাল পায়নি। সেই বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে ব্লক দপ্তরে অবস্থান শুরু করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। তখন দুই দিনের মধ্যে তাদের খাদ্য দেওয়া হবে বলে বিডিও প্রতিশ্রুতি দেন। এই জেলার গাইঘাটা ব্লকে এআইকেএম রাজ্য কমিটি সদস্য কৃষ্ণ প্রামানিক সহ বামপন্থী কৃষক সংগঠনের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। নতুন রেশন কার্ড দেওয়ার দাবি জানানো হলে ব্লক আধিকারিক বলেন, সেটা নাকি তাঁর দায়িত্ব নয়। এছাড়া ১০০ দিনের প্রকল্পে কৃষিকাজকে যুক্ত করা, শাসক দলের এক নেতার রেশনের মাল আত্মসাৎ করা সংক্রান্ত দুর্নীতির একটি ঘটনা তুলে ধরে তার উপযুক্ত তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
বর্ধমান
সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার অন্তর্ভুক্ত ২১টি কৃষক, কৃষি মজুর ও আদিবাসীদের সংগঠনের যৌথভাবে রাজ্যব্যাপী ১১ মে ব্লকে ব্লকে ডেপুটেশন কর্মসূচীর অংশ হিসেবে পুর্ব বর্ধমান জেলার ব্লক ভিত্তিক ডেপুটেশন ।
জেলার আটটি ব্লকে যৌথ ভাবে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হয়। লকডাউন এর পর এই সমস্ত এলাকার কৃষকদের দুরবস্থার সীমা থাকেনি। বিশেষ করে সব্জির চাষিদের। প্রথমে বলা হল জনতা কার্ফু। মানুষ মনে করল এক দিনের ব্যাপার ট্রেন বন্ধ থাকবে। তারপরই সব্জি তোলা যাবে। কিন্ত পর দিনই সমস্ত লকডাউন ঘোষণার পর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। এখানকার সব্জির বেশিরভাগ ট্রেনের মাধ্যমে বিভিন্ন বাজারে যেত। সব্জির পাইকারী ব্যবসায়ীরা মুলত ট্রেনেই যাতায়াত করত। হঠাৎই বন্ধ করার ফলেই চাষিদের সব্জি জমিতেই নষ্ট হতে লাগল। জমি থেকে তোলা হলে ও তুলে আনার খরচাও উসুল হচ্ছিল না। ফলে চাষিদের চরম ক্ষতি হয়ে গেল। সরকার বহু বড় বড় ভাষণ দিলেও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কোনও সহায়তা এই কৃষকরা পেলেন না । তার উপর বর্তমান ঝড় ও শিলাবৃষ্টি ধান-পাট ও সব্জির চরম ক্ষতি করেছে। তাই পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ডেপুটেশনে ফসলের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবির উপর জোর দেওয়া হল। বিডিও সাহেব বললেন ফসলের ক্ষতিপূরণ ব্যাপারে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। এডিওর সাথে কথা বলার পরামর্শ দিলেন। অন্যান্য দাবিগুলো উপরে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন। পুর্বস্থলী ১নং ব্লকের ডেপুটেশন ও ফসলের ক্ষতিপূরণ এর উপর জোর দেওয়া হয়। ১০০দিনের কাজ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর জন্য আলোচনা করেন।
মন্তেশ্বর ব্লকে ১০০ দিনের কাজ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারি খরচে দ্রুত ঘরে ফেরানোর দাবি নিয়ে আলোচনা করা হয়। কালনা ২নং ব্লক-এর ডেপুটেশন ও ১০০ দিনের কাজের উপর জোর দেওয়া হল। এবং ৭ দিনের কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তাছাড়া ভাতার ব্লকে ডেপুটেশন দেওয়া হল। সদর ২নং ব্লক, রায়না ও জামালপুর ব্লকে ডেপুটেশন দেওয়া হল। সব ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে দেওয়া চিঠির বয়ান ভিডিও মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সব ক্ষেত্রেই মুলত সিপিএম-এর কৃষক সংগঠন কৃষিমজুর সংগঠন ও সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন-এর এআইকেএম ও আয়ারলা প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
হুগলী জেলা
হুগলী জেলার ৩টি ব্লক – বলাগড়, পোলবা ও পান্ডুয়ায় ব্লক প্রশাসনের নিকট করোনা উদ্ভূত সঙ্কটকালে কৃষক ও কৃষিমজুরদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলি উত্থাপন করে এআইকেএসসিসির পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। বলাগড়ে ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন আয়ারলার পক্ষে সেখ আনারুল। এখানে বামপন্থী ধারার অপর সংগঠন সারা ভারত কিষাণ সভার প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।
পোলবায় আয়ারলা, হুগলী জেলা কমিটি সদস্য গোপাল রায় ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন। পান্ডুয়ায় ব্লক ডেপুটেশনে আয়ারলার পক্ষে নিরঞ্জন বাগ ও এআইকেএম-এর পক্ষে মহঃ সিরজুদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। এখানে এআইকেএস-এর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সৌরেন বসু ও গোপাল হেমরম। এআইকেএসসিসি-র এই কর্মসূচীর সমর্থনে বৈঁচি জিটি রোড চৌমাথায় এআইকেএম ও এআইকেএস-এর যৌথ উদ্যোগে এক অবস্থান কর্মসূচী পালিত হয়। এআইকেএম ও এআইকেএস-এর পক্ষে এই অবস্থান কর্মসূচীতে যথাক্রমে মুকুল কুমার ও প্রদীপ সাহাও উপস্থিত ছিলেন।
দঃ ২৪ পরগণা
বিষ্ণুপুর ১নং ব্লকে অংশ নেন এআইকেএম রাজ্য কমিটি সদস্য দিলীপ পাল। স্মারকলিপি ও ৮ দফা দাবি তুলে ধরার পাশাপাশি এলাকায় গ্রামাঞ্চলে জল নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে পড়ছে,তাই নিকাশীবহালের দাবি,লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যানপালন, মৎসচাষিদের ক্ষতিপূরণ ও জমি মাফিয়াদের শাসকদল ও ভূমি দপ্তরের যোগসাজসে কৃষিজমি গ্রাসের বেআইনি কারবার বন্ধ করার দাবি প্রচারে তুলে ধরা হয়। মালদা জেলার কালিয়াচকে ইব্রাহিম সেখের নেতৃত্বে ডেপুটেশন কর্মসূচী সংগঠিত হয়।
উত্তরবঙ্গ
লকডাউন চলাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া -- ভতুর্কি দিয়ে সার বীজ প্রভৃতি সরবারহ করা, রেশনের মাধ্যমে প্রতিটি দরীদ্র গ্রামীণ মানুষদের ১৫ কেজি চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেল প্রভৃতি দেওয়া, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের উপযুক্ত সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনা, কোরোনা মোকাবিলায় গ্রামীণ ব্লক-জেলা স্তরে উপযুক্ত চিকিৎসার পরিকাঠামো তৈরি করার দাবিতে এআইকেএম-এর পবিত্র সিং আয়ারলার শরৎ সিং প্রমূখ। এই এলাকার গ্রামাঞ্চলে সব্জি চাষিরা লকডাউনের সময়কালে ২ টাকা ৩ টাকায় সব্জি বিক্রি করেছে। কখনও বা নিরুপায় চাষিরা স্রেফ বিনাপয়সায় সব্জি বিলি করে দিয়েছে। ডেপুটেশনে সরকারী উদ্যোগে সব্জি কেনার দাবি বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্পেশাল রিলিফ বিলিবণ্টনের কাজে পঞ্চায়েতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে বিডিও জানায়। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত গরিবদের নাম বাদ দেওয়া হলে বা দলবাজি হলে আমরা তার বিরোধিতা করবো বলে জানানো হয়। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে গরিব মানুষদের নাম সুপারিশ করা হলে সেগুলি বিবেচনা করা হবে বলে বিডিও প্রতিশ্রুতি দেয়।
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে এআইকেএম নেতা ভাস্কর দত্তের নেতৃত্বে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ব্লক দপ্তরে অনুষ্ঠিত একটি সর্বদলীয় বৈঠকে স্মারকলিপি ও দাবিসনদ পেশ করা হয়। আয়ারলার রাজ্য কমিটি সদস্য শ্যামল ভৌমিক ও বিল্টু চক্রবর্তী জলপাইগুড়ি ব্লকে অনুরূপ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন।
উঃ দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ ব্লকে ডেপুটেশনে ছিলেন এআইকেএম রাজ্য কমিটি সদস্য তসলিম আলি। এখানেও রেশন কার্ড না থাকা গরিবদেরকে খাদ্য দেওয়া ও দ্রুত কার্ড প্রদানেরর দাবি তুলে ধরা হয়।
মুর্শিদাবাদ জেলার মুর্শিদাবাদ ব্লকে এআইকেএম নেতা ও পার্টির জেলা সম্পাদক রাজীব রায় সহ অন্যান্য কৃষক সংগঠনের নেতাদের অংশগ্রহণে বিক্ষোভ ডেপুটেশন কর্মসূচী সংগঠিত হয়। বিডিও হাতে হাতে ডেপুটেশন নিতে না চাইলে স্মারকলিপি হোয়াটসএ্যাপে পাঠানো হয়। ব্লক দপ্তরের সামনে শ্লোগান সহকারে প্রচার করা হয়।
লকডাউনে জনজীবনের সংকটজনক পরিস্থিতিকেও বিজেপি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির সুযোগ হিসাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। গত ১০ মে ভদ্রেশ্বরে যে হিংসা ও সমাজবিরোধী দ্বারা বোমাবাজির ঘটনা ঘটে সেই ঘটনাকে ধরে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে বিজেপি উঠে পড়ে লাগে। বিজেপির যে সাংসদকে মিল বন্ধের এই দীর্ঘ সময়ে বা করোনা অতিমারিতে জনগণের দুর্দশায় একদিনের জন্যও খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেই সাংসদই সংঘর্ষের উত্তেজনা ছড়াতে তড়িঘড়ি ছুটে আসে পরের দিনই । ১২ মে হুগলি নদীর ওপারের ও এপারের কাছাকাছি এলাকার বিজেপির স্থানীয় লুম্পেনদের নিয়ে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিকল্পিত হামলা নামানো হয়। ঘটনাক্রম ওপারের কুখ্যাত বিজেপি নেতা ও সাংসদ অর্জুন সিং ও এপারের বিজেপি সাংসদ লকেট চ্যাটার্জির ঘৃণ্য ভূমিকাকে সামনে নিয়ে আসছে। এই সংকটে গত পরশু রাতের ঘটনার পরেও এই লকডাউনে হুগলী নদী পেরিয়ে বহিরাগত লুম্পেনদের জড়ো হওয়া ও এই সংগঠিত হিংসার প্রস্তুতি কিভাবে জেলা প্রশাসনের অগোচরে থেকে গেলো, তা সত্যিই বিস্ময়কর! এর সদুত্তরও জনসাধারণ দাবি করছেন।
১২ মে সকাল থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনের বাড়িতে ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়, আহত ও রক্তাক্ত হন অনেকে। আমাদের সংলগ্ন অঞ্চলের শ্রমিক ও পার্টি কর্মীরা খোঁজ খবর নিতে থাকেন। ১৩ তারিখ সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে হুগলির শহর শিল্পাঞ্চলে বিজেপির দাঙ্গা লাগানোর বিরুদ্ধে ধিক্কার দিবসের ডাক দেওয়া হয়। উত্তরপাড়া-কোন্নগর, চুঁচুড়া, ভদ্রেশ্বরে পার্টির পক্ষ থেকে ধিক্কার দিবস পালন করা হয়, কর্মীরা পোস্টার হাতে খালি গলায় স্লোগানে ও বক্তব্যে সাংসদ লকেট চ্যাটার্জির গ্রেপ্তারের দাবি তোলেন ও বিজেপির দাঙ্গার রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান রাখে। পার্টির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে চন্দননগর পুলিশ কমিশনারের কাছে তিন দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয় –
১) সাংসদ শ্রীমতী লকেট লকেট চ্যাটার্জিকে দাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী ও উস্কানিদানের জন্য গ্রেপ্তার করতে হবে, দাঙ্গায় অভিযুক্ত বিজেপির নেতা ও সমাজবিরোধীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।
২) দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩) এলাকার গণতান্ত্রিক জনগণকে সামিল করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
স্মারকলিপির প্রতিলিপি কপি স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছেও পাঠানো হয়।
জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাফুরার গ্রেপ্তার, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের বিরুদ্ধে এবং সোশাল মিডিয়ায় ক্রমাগত সাফুরাকে হেনস্থার বিরুদ্ধে কপিল মিশ্র-র গ্রেফতারের দাবিতে, এনআরসি-এনপিআর-সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবিতে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ির ফকদই বাড়ি এবং শক্তিগড়ে মীরা চতুর্বেদী ও রুবী সেনগুপ্তর নেতৃত্বে প্রতিবাদ অবস্থান কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির কমরেডরা। ফকদইবাড়ি নীচপাড়াতে ময়না সূত্রধর, রীতা দাস, লক্ষ্মী দাসদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আরো অনেক শ্রমজীবী মহিলা। শক্তিগড়ে রুবী সেনগুপ্ত ছাড়াও ছিলেন গঙ্গা রায়, ভাগ্য মন্ডল, কল্পনা সরকার, মিলি ভট্টাচার্য, আরতি দাস, আরতি ভট্টাচার্য প্রমুখ। এছাড়াও সাফুরার সাথে সংহতিতে দার্জিলিং জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এবং আইসার পক্ষ থেকে শাশ্বতী সেনগুপ্ত কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন ।
পূর্ব বর্ধমান
৭ মে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির দেশজুড়ে অবস্থান বিক্ষোভ-এর কর্মসূচীর অংশ হিসেবে পুর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়। দাবি ছিল সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর থেকে সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। চার মাসের গর্ভবতী সাফুরা জারগার কে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গ্রেফতার করে তিহার জেলে রাখা হল কেন নরেন্দ্র মোদি জবাব দাও । নারীবিদ্বেষী কপিল শর্মা কে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা কমরেড সুমি মজুমদার-এর নেতৃত্বে কালনা ২নং ব্লক-এর তেহাটা গ্রামে বিক্ষোভ ও শপথ অনুষ্ঠান সংগঠিত হয়। ৫০ জনের বেশি গ্রামের মহিলা বিশেষ করে আদিবাসীদের পরিবারের ভাল সংখ্যক মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। জেলার সভানেত্রী কমরেড মলিনা ভট্টাচার্য বর্ধমান শহরের নিজের ঘরেই প্রতিবাদে অংশ গ্রহণ করেন । আর একজন জেলা সদস্যা কমরেড ময়না চাটার্জী শক্তিগড়ে নিজের বাড়ির মহিলাদের সাথে নিয়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। সদর ২নং ব্লক-এর খাড়গ্রামে কমরেড অশোকা ঘড়ুই এর নেতৃত্বে বিক্ষোভ করেন ।
করন্দা গ্রামের পুর্ব পাড়ার কমরেড মানু সাঁতরার নেতৃত্বে বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত হয়। করন্দা পশ্চিম পাড়ায় কমরেড রাখী হাজরার উদ্যোগে প্রতিবাদ সংগঠিত হয় । সদর ১নং ব্লকের কামারকিতা গ্রামের কমরেড চাপা হাজরার নেতৃত্বে অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত হয় ।
পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের সিমলা গ্রামের জেলা কমিটির সদস্যা কমরেড তরী সাঁতরা ও বৈশাখী সাঁতরা সহ গ্রামের গরিব পরিবারের ২৫ জন মহিলা বিক্ষোভে সামিল হন ।
কাটোয়া থানার সাহাপুর গ্রামের সুমিত্রা মন্ডলের পরিচালনায় গ্রামের মহিলাদের প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। নাদনঘাট থানার ইসলামপুর গ্রামের জুলি সেখ পরিবারের লোকজন নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হন।
হুগলী
এআইপিডব্লিউএ-র ডাকে ও আইসা-র সমর্থনে ৭ মে সাফুরা, ইশরত, গুলফিশারার গ্রেফতারির প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ দিবসে সামিল হন কোন্নগর-হিন্দমোটরের মহিলা সমিতির মহিলারা এবং ছাত্ররা।
বলাগড গুপ্তিপাড়ায় কমঃ শোভা ব্যানার্জির নেতৃত্বে এই প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়। হুগলির পোলবাতেও মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে এই প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়।
নদীয়া জেলায় তাহেরপুরে মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা অপু কবিরাজের নেতৃত্বে এই পোস্টারে প্রতিবাদ কর্মসূচী সংঘটিত হয়। এছাড়া নদিয়ায় নাকাশীপাড়া অঞ্চলে গাছা গ্রামের মহিলারা এই বিক্ষোভে অংশ নেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
বজবজ গ্রামীণ অঞ্চলে এই কর্মসূচী পালন করা হয়। জেলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামীর উদ্যোগে ২৫ জনের উপস্থিতিতে এআইপিডব্লিউএ এবং আইসা রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ছাত্রী সঞ্জনা কপিল মিশ্র কেন জেলের বাইরে আছে সেই শ্লোগান তোলে ও গ্রেফতারের দাবি তোলে।
উত্তর ২৪ পরগণা
এই জেলায় অশোকনগরে দুই প্রান্তে দেশব্যাপী এই বিক্ষোভ প্রতিবাদে সাড়া দিয়ে দুটি প্রতিবাদ কর্মসূচী হয়।নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে জেলা সভানেত্রী কমঃ জয়শ্রী দাস ও ব্লক সম্পাদিকা কমঃ রীনা মজুমদার।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির বেলঘরিয়া শাখা সিএএ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী সফুরা, ইশরত, গুলফিশারা সহ সকলের অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভ অবস্থান করেন। অবস্থানের শুরুতে বিশাখাপত্তনমে গ্যাস লিকে নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় এবং কোম্পানি মালিক ও কর্তপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানান হয়। এই জেলায় বসিরহাটে মহিলা নেত্রী তপতি বিশ্বাস নিজ গৃহে এই কর্মসূচীতে অংশ নেন।
হাওড়া
৭ মে সাফুরা জারগারের প্রতি চূড়ান্ত নারীবিদ্ধেষী মন্তব্যকারী বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর শাস্তির দাবিতে হাওড়া জেলায় তিনটি এলাকায় মহিলারা প্রতি বাদ কর্মসূচী পালন করা হয় – বালি, আমতা ও বাগানানে । বালিতে পুরুষ কমরেড সহ মহিলারা পোস্টার নিয়ে অংশ নেন। আমতাতে ও বাগনানে শ্রমজীবী মহিলারা পোস্টার প্রদর্শন করে প্রতিবাদ জানান। জেলা সম্পাদিকা কল্যাণী গোস্বামী নিজ গৃহেই পোস্টার প্রদর্শন করেন।
কলকাতা
মহিলা সমিতির বেশ কিছু নেত্রী ও কর্মী নিজ গৃহে পোস্টার প্রদর্শন করে এই বিক্ষোভে সামিল হন। এদের মধ্যে ছিলেন চ্ন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, মিতালী বিশ্বাস, স্বপ্না চক্রবর্তী, রত্না মন্ডল, সম্প্রীতি মুখার্জী প্রমূখ।
যাদবপুর অঞ্চলে বারো ঘরে জেলা সম্পাদিকা মমতা ঘোষের নেতৃত্বে শ্রমজীবী মহিলারা পোস্টার সহ এই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে সামিল হন।
সফুরা জারগার সহ বিভিন্ন এনআরসি এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার, ও ইউএপিএ আনার বিরুদ্ধে ও কপিল মিশ্রর নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের বিরুদ্ধে যাদবপুর ঢাকুরিয়ায় এআইপিডব্লিউএ-র উদ্যোগে ও আরওয়াইএ ও আইসা-র সহযোগিতায় এই বিক্ষোভ প্রদর্শন কর্মসূচী পালিত হয়। অংশ নেন মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত ও মধুরিমা বক্সি, কল্পনা দেশমুখ এবং আরওয়াইএ-র রাজ্য নেতা রনজয় সেনগুপ্ত ও আইসা-র ঋতম মাঝি সহ অন্যান্য সাথীরা।
বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরে কমরেড তিতাস সহ একজন সাথী এই কর্মসূচীতে অংশ নেন।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির আহবানে সাড়া দিয়ে এবং দাবিগুলো তে সহমত হয়ে নিখিল বঙ্গ মহিলা সংঘ সাফুরা, ইশরাত, গুলফিসারা সহ সমস্ত এনআরসি বিরোধীদের মুক্তির দাবিতে পোস্টার প্রতিবাদ করে। এতে অংশ নেন এনবিএমএস-এর রাজ্য নেত্রী সর্বানী ভট্টাচার্য্য সহ অন্যরা।
প্রতি
বার্তা সম্পাদক
মহাশয়,
জামিয়া মিলিয়ার গবেষক ছাত্রী সাফরা জারদারের মুক্তির দাবিতে এবং তাঁর প্রতি জঘন্য অশালীন উক্তি করেন যে কপিল মিশ্র (দিল্লী গণহত্যার উস্কানিদাতা) তার শাস্তির দাবিতে আজ আমাদের সমিতির উদ্যোগে দেশব্যাপী পোস্টার প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হলো।
যখন দীর্ঘদিন এই লকডাউনের ফলে এক ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, খাদ্যের জন্য মানুষ হাহাকার করছে তখন সংকীর্ণ স্বার্থে কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছে। নিরন্নের মুখে খাদ্যের বদলে সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। তাই সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে দেশব্যাপীএই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে সামিল হন এরাজ্যের বিভিন্ন জেলার গ্রাম ও শহরের মহিলারা।
জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে জবাব চেয়েছ সমিতির পক্ষ থেকে জবাব চাওয়া হয় --
নিজের বাড়িতে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড ধরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মহিলারা প্রশ্ন তুলেছেন মহিলা কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। সাফুরার প্রতি ছুড়ে দেওয়া অপবাদকে প্রতিহত করার জন্য দেশব্যাপী নারীরা সংহত হন ভালোবাসা ও সংহতির বার্তা নিয়ে। ঘরে বসেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পোস্টার প্রতিবাদ জানিয়ে হলো এরাজ্যের বিভিন্ন জেলা সহ সারা দেশেই। আজ দাবি তোলা হয়েছিলো --
• সন্তানসম্ভবা সাফুরাকে করোনা সংক্রমণের বিপদের সময়ে কেন তিহার জেলে রাখা হল?
• মহিলা আন্দোলনের সঙ্গে প্রতারণাকারী বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে,
• দিল্লি দাঙ্গার মূলচক্রী কপিল মিশ্রকে গ্রেফতার করো,
• কুমন্তব্য আর ফেক নিউজের কারখানা বিজেপি আই টি সেল বন্ধ করো,
• সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় মহিলাদের জেলে পাঠানো বন্ধ করো,
• সন্তানসম্ভবা সাফুরা সম্পর্কে মিথ্যা ও অশ্লীল মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে মহিলা কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ধন্যবাদান্তে,
ইন্দ্রাণী দত্ত
সম্পাদিকা, পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য কমিটি
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর জনবিরোধী নীতির ফলশ্রুতিতে যে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিবিহীন করোনা লকডাউন চলছে তা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যার আরো নিত্যনতুন দিক খুলছে প্রতিদিন। মানুষ চোখের জল ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না, একটার পর একটা লকডাউনজনিত মৃত্যুসংবাদ আসছে রোজ আর মোদী সরকার কেবল আর্থিক ‘ক্ষতিপূরণ’ ঘোষণা করে দায় সারছে! যে সরকার লকডাউনে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে বিনামূল্যে ট্রেন দিতে পারে না, সেই সরকারের অপদার্থতা মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকা শ্রমিকদেরকে ট্রেনে চাপা দিতে পারে! অন্ধের ভাইজ্যাগে জনবহুল এলাকায় বহুজাতিক সংস্থা এলজি-র কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস লিক করে গণমৃত্যুর পরের ভোরেই ঔরঙ্গাবাদে মালগাড়ি চাপা পড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যু! এগুলো কি পরোক্ষে রাষ্ট্রের দ্বারা হত্যা নয়? এ'বিষয়ে এখনও সন্দেহ থাকতে পারে? এই দুটি ঘটনায় গণহারে মানুষ মারা গেলো, এছাড়াও বিচ্ছিন্ন ভাবে ইতিমধ্যেই দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তি কিম্বা পথ দুর্ঘটনার বলি হয়েছেন শিশু, মহিলা সহ আরো বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিক। এঁদের জন্য শোক প্রকাশের কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয় আর নিছক শোকপ্রকাশে আটকে থেকেও দায় সারা বা এই মৃত্যুমিছিল বন্ধ কোনোটাই করা যায় না। তাই সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের আহ্বানে এআইসিসিটিইউ, এআইএসএ, আরওয়াইএ সহ বিভিন্ন গণসংগঠনগুলির অংশগ্রহণে দেশ জুড়ে সংবেদনশীল প্রচুর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ৯ মে সামিল হলেন সর্বভারতীয় শোক ও প্রতিবাদ দিবসে। কালো পতাকা, ব্যাজ, ফিতে পরে হাতে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে জায়গায় জায়গায় কোথাও পথে কোথাও বা বাড়ি থেকেই শারীরিক দূরত্ব যথাসম্ভব বজায় রেখে সরকারী ইচ্ছাকৃত উদাসীনতাকে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানালো সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ।
হুগলী জেলা: শিল্পাঞ্চল হুগলিতে চুঁচুড়া ও কোন্নগরে সিপিআই(এম-এল) ও এআইসিসিটিইউ-র উদ্যোগে কর্মীরা কালো ব্যাজ পরে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড সহ পথে নেমে স্লোগান ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য সহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, পথচলতি মানুষকেও কালো ব্যাজ পরান নির্মাণ শ্রমিক কমরেডরা। চুঁচুড়ার প্রতিবাদে এআইপিএফ ও চেতনা মঞ্চের সদস্যরাও মিলিত হন বিক্ষোভ প্রদর্শনে। ভদ্রেশ্বর অ্যাঙ্গাস ইউনিটের জুটমিল শ্রমিক সদস্যরাও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে শ্রমিক মহল্লায় অবস্থান করেন। চন্দননগরে কমরেড চৈতালি সেন বাড়ি থেকেই কালো পতাকা ও পোস্টার সহ বিক্ষোভে সামিল হন।
গ্রামাঞ্চলে পাণ্ডুয়া ব্লকের বৈঁচির কোঁচমালিতে যুব কমরেড পাভেলের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্ল্যাকার্ড সহ শ্রমিক হত্যাকারী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়। বৈঁচি বাজারে পার্টি সদস্যরা প্রতিবাদী পোস্টার নিয়ে হেঁটে বেশ কিছুটা পথ পরিক্রমা করেন। সাঁচিতাড়ায় ক্ষেতমজুর কমরেডরা শ্রমিক হত্যাকারী মোদী সরকারকে ধিক্কার জানাতে ও সকলের রেশনের দাবিতে অবস্থান করেন। পোলবা-দাদপুরে ছাত্রী কমরেড অর্পিতা বাড়ি থেকেই পোস্টার সহ বিক্ষোভ দেখান। ধনিয়াখালির মল্লিকপুরে ক্ষেতমজুর, আদিবাসী ও যুব কমরেডরা রাস্তায় প্ল্যাকার্ড সহ বেশ খানিকক্ষণ অবস্থান করেন।
বলাগড় ব্লকের বরাল গ্রামে কৃষিজীবি গ্রামবাসী সাথীরা প্ল্যাকার্ড সহ শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জেলার সর্বত্রই শারীরিক দূরত্ব যথাসম্ভব বজায় রেখেই প্রতিবাদ কর্মসূচীগুলো সংগঠিত হয়।
উত্তরবঙ্গ
কোভিড-১৯-এ একদিকে অপরিকল্পিত লকডাউন, ভেঙে পড়া আর্থিক ব্যবস্থা --! অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে, হেঁটে চলেছেন নিজের নিজের জায়গায় পৌঁছাতে চাইছেন, সেসময় লকডাউনে চলছে একের পর এক গণহত্যা! বিশাখাপত্তনমের কারখানায় গ্যাস লিক-ঔরঙ্গাবাদে ট্রেনে পিষে শ্রমিকের মৃত্য কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা দুর্ঘটনা না --! ধারাবাহিক গণহত্যা।
এরই প্রতিবাদে পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে দেশের অন্যান্য জায়গার সাথে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি এবং রাঙাপাণিতে প্রতিবাদে সামিল হন পার্টি নেতৃত্ব ও কর্মীরা।
শিলিগুড়ি : দার্জিলিং জেলা অফিসের সামনে প্ল্যাকার্ড ব্যানার কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভে সামিল হন জেলা নেতৃত্ব এবং কর্মীরা। ঘটনার প্রতিবাদে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলে সোচ্চার শ্লোগান। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, পুলক গাঙ্গুলী, মোজাম্মেল হক, অপু চতুর্বেদী, মীরা চতুর্বেদী, দীনবন্ধু দাস, লক্ষ্মী দাস, শাশ্বতী সেনগুপ্ত, রুবী সেনগুপ্ত, ময়না সূত্রধর প্রমুখ।
ফাঁসিদেওয়া: ফাঁসিদেওয়া রাঙাপাণি স্টেশনের পাশে পবিত্র সিংহের নেতৃত্বে কালা দিবস পালিত হয়। উপস্থিত ছিলেন শরত সিংহ, পঞ্চা বর্মণ, পৈষানজু সিংহ প্রমুখ।
নদীয়া
মহারাষ্ট্রে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া ও অন্ধ্রপ্রদেশে গ্যাসকান্ডে মৃত্যুর প্রতিবাদে নদীয়া জেলায় গত ৯ মে বিভিন্ন কর্মসূচী সংগঠিত হয়।
জেলা সদর কৃষ্ণনগর বাস স্ট্যান্ডে পোস্টার পতাকা নিয়ে প্রচার করা, বক্তব্য রাখা হয়। এআইসিসিটিইউ জেলা সভাপতি অমল তরফদার, নীহার ব্যানার্জী সহ শহরের অন্যান্য কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। ধুবুলিয়া পার্টি অফিসের সামনে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়। উপস্থিত ছিলেন পার্টির জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, কাজল দত্তগুপ্ত সহ অন্যান্যরা। নপাড়া ২নং অঞ্চলের সোনাতলায় আয়ারলার পক্ষ থেকে অবস্থান কর্মসূচী সংগঠিত হয়। এতে স্থানীয় গ্রামীণ কর্মীরাও অংশগ্রহণ করেন।
গাছাবাজারে দাবি সম্মলিত প্ল্যাকার্ড-স্লোগান সহকারে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন জয়তু দেশমুখ, এলাকার পার্টি নেতা হবিবুর রহমান প্রমূখ। তাহেরপুরে প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন জীবন কবিরাজ, যোগেশ শিকদার সহ অন্যান্যরা। নবদ্বীপ শহরে এআইসিসিটিইউ ও রেল হকার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শহরের জনবহুল স্থানে স্লোগান ও বক্তব্যর মাধ্যমে প্রচার সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন পরিক্ষিৎ পাল, নারায়ন দেবনাথ, দেবাশীষ সিংহ প্রমূখ।
পূর্ব বর্ধমান
দেশজুড়ে ৯ মে বিক্ষোভ ও শোক দিবস পালন করার কর্মসূচীর অংশ হিসেবেই পুর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন ব্লকে কর্মসূচী পালন করা হয় ।
কাটোয়া থানার সাহাপুর গ্রামে কমরেড স্বপন মণ্ডল এর উদ্যোগে শোক দিবস ও বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়। পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে এবং সিমলা গ্রামে কমরেড শিবু সাঁতরাও কমরেড সমীর বসাকের নেতৃত্বে শোক দিবস ও বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয় ।
মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামেকমরেড আনসারুল আমন মন্ডলের উদ্যোগে শোক দিবস পালন ও বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়।বর্ধমান সদর ১নং ব্লকের কামারকিতা গ্রামের কমরেড সমীর হাজরার উদ্যোগে প্রতিবাদ ও শোক দিবস পালন করা হয়। বর্ধমান সদর ২নং ব্লক এর করন্দা গ্রামের সুকুমার সোমের নেতৃত্বে শোক দিবস পালন ও বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। বর্ধমান শহরের কমরেড রা কমরেড শ্রীকান্ত রানা ও কমরেড কুনাল বক্সীর উদ্যোগে শোক দিবস ও বিক্ষোভ সংগঠিত করেন।
শক্তিগড়ে কমরেড ময়না চাটার্জী নিজের বাড়ির মধ্যেই কালো পতাকা উত্তোলন করেন। কালনা ২নং ব্লক-এর অকালপোষ অঞ্চলের কমরেড রফিকুল ইসলাম-এর নেতৃত্বে বিক্ষোভ অবস্থান ও শোক দিবস পালন করা হয়। জেলা কমিটির সদস্য কমরেড প্রদ্যুত ঘোষ নিজের বাড়ির ছাদে কালো পতাকা উত্তোলন করেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
৯ মে বিশাখাপত্তনম গ্যাসলিক কান্ড ও ১৭ জন পরিযায়ী শ্রমিকের গণহত্যার বিরুদ্ধে বজবজের জামালপুরে বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। জামালপুর গ্রামে কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন পার্টির দঃ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকার, কমরেড দেবযানী গোস্বামী, যুব নেতা কমরেড আশুতোষ মালিক, কমরেড রঞ্জন ঘোষ ও অন্যান্য সাথীরা। গ্যাসলিক কাণ্ডের দোষীদের অবিলম্বে শাস্তি দিতে হবে, মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এই দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে।
এদিন বিকালে বজবজে দঃ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে বিক্ষোভ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়।উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকার, বজবজ শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড অঞ্জন ঘোষ,কমরেড পঞ্চু মন্ডল,যুব নেতা কমরেড সেখ সাবির, কমরেড নন্দন সহ অন্যান্যরা।
১০ মে বাখরাহাটে সিপিআই(এম)-এর সাথে যৌথভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচী হয়। বাখরাহাট বাজার থেকে সংক্ষিপ্ত মিছিল করে বাখরাহাট স্কুল মোড়ে এসে আধঘণ্টা বিক্ষোভ দেখানো হয়। বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা নেতা কমরেড দিলীপ পাল। উপস্থিত ছিলেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য কমরেড শুভদীপ পাল, লোকাল কমিটির সদস্য কমরেড সুনীত ধাড়া, কমরেড সন্দীপ ধাড়া, কমরেড মোমিন সেখ সহ আরো অনেকে।
কলকাতা
বিশাখাপত্তনমে গ্যাস লিকের ফলে বহু সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং ঔরাঙ্গাবাদে ট্রেনের তলায় পরিযায়ী শ্রমিকদের পিষে মারার বিরুদ্ধে গোটা দেশ স্তম্ভিত, শোকাহত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। এর বিরুদ্ধে পার্টি ও এআইসিসিটিইউ সারা দেশে শোক ও প্রতিবাদ দিবস পালন করে।
কলকাতায় বিভিন্ন স্থানে এই কর্মসূচী পালিত হয়। যাদবপুরে পাল বাজারে এই কর্মসূচীর শুরুতে এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। শ্লোগান ও শোক পালনের মধ্যে দিয়ে কর্মসূচী শেষ হয়।
বাঁশদ্রোণীর বেলতলায় এই কর্মসূচী পালিত হয়। এখানে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিকও সামিল হন। বেহালার কালিতলায় পোস্টার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে শ্লোগান ধ্বনির মাধ্যমে পালিত হয় এই কর্মসূচী। টালিগঞ্জের পার্টি কমরেডরা শোক ও প্রতিবাদ দিবস পালন করেন আই ব্লকে। ভবানীপুরের কমরেডরা চেতলা ব্রীজের সন্নিকটে এই কর্মসূচী পালন করেন। এখানেও কয়েক জন নির্মাণ শ্রমিক সামিল হন।
এছাড়া, জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ঔরঙ্গাবাদে রেলের চাকায় পৃষ্ট ১৬ জন, গ্যাস লিকের জন্য মৃত ১১ জন ও লকডাউন পর্যায়ে মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও ঘটনা গুলোর প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার দিবস পালন।
অতিমারীকে কাজে লাগিয়ে মোদী সরকার দেশব্যাপী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিজেপি শাসিত রাজ্য গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ৮ ঘণ্টা কাজের সময়কে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করেছে। স্বল্পকালের চুক্তি ভিত্তিক মেয়াদি শ্রমিক নিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছে। তিন বছর সব সামাজিক সুরক্ষা (পিএফ, গ্রাচুইটি ইত্যাদি) স্থগিত থাকবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার চলছে। শ্রমিকদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউ ১২-১৩ মে বিক্ষোভের ডাক দেয়।
এআইসিসিটিইউ-এর ডাকে সারা ভারত প্রতিবাদ দিবসের প্রথম দিনে জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের (কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিজ) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পথে নেমে দুরত্ব বজায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
উত্তর ২৪ পরগণার চটকল শ্রমিকরা আগরপাড়া জুটমিল গেটে বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম-এর নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। জেলার বিভিন্ন অংশে প্রতিবাদের খণ্ড চিত্র বেলঘরিয়া, বারাসাত, কামারহাটি চটকল ইউনিয়ন, অশোকনগর, নৈহাটি, শিবদাসপুর ইটভাটা ইউনিয়ন, বসিরহাট নির্মাণ শ্রমিক ও গাইঘাটা।
শ্রম আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউ ১২-১৩ মার্চ সারা ভারত প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচীর অঙ্গ হিসাবে কলকাতায় বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সংগঠিত হয়।
কলকাতা
ক্রীক রো-র সামনে পালিত হয় এই কর্মসূচী। বিরসুলহাটের হকার কমরেড দের সাথে এই কর্মসূচীতে অংশ নেন বাসুদেব বোস, প্রবীর দাস, অতনু চক্রবর্তী। এদিন বেহালার কালিতলায় শ্রম আইনের সংশোধনের বিরুদ্ধে, প্রচেষ্টা প্রকল্পে সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে, ও অন্যান্য দাবিতে বিক্ষোভ হয়।
যাদবপুর ঢাকুরিয়ার গাঙ্গুলিপুকুরে এই কর্মসূচী পালিত হয়। যাদবপুর লোকাল কমিটির সম্পাদকের উপর তৃণমূলী হামলার সাথে উক্ত বিষয়টি যুক্ত হয়। এলাকার অনেক কমরেড লকডাউনের মধ্যে ও এই কর্মসূচীতে সামিল হয়ে খুব সফলতার সাথে তা সম্পন্ন করেন। বর্ষীয়ান নেতা এ বি চৌধুরী, বাবুন চ্যাটার্জি সহ এলাকার অনেকেই এই বিক্ষোভে অংশ নেন।
বাঁশদ্রোণীতে নির্মাণ শ্রমিকদের সাথে অন্য কমরেডরা এখানে যুক্ত হন। রামগড়ে স্কীম কর্মীদের নিয়ে এই কর্মসূচী সম্পন্ন হয়।
হুগলি জেলা
শহর ও শিল্পাঞ্চলের সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকেরা সেই কর্মসূচীতে সামিল হন। কোন্নগরে নির্মাণ শ্রমিকেরা রাস্তার ধারে পোস্টার ও ঝান্ডা হাতে স্লোগান তোলেন নির্মাণ শ্রমিকসহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের দশ হাজার টাকা লক ডাউন ভাতা দিতে হবে, ভদ্রেশ্বর এঙ্গাস জুট মিলের শ্রমিকেরা মিল গেটে শ্রম আইন বদলে ৮ ঘন্টার জায়গায় ১২ ঘণ্টা কাজ চালু করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হন, প্রতিবাদে সামিল হন চুঁঁচুড়ার অসংগঠিত শ্রমিকেরা। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়া, বিনা পয়সায় সমস্ত শ্রমিককে রেশন দেওয়ার দাবি জানিয়ে খালি গলায় বক্তব্য রাখা হয়।
১৩ মে এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের সাথে সাক্ষাত করে ১৪ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী, রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু, রাজ্য সদস্য প্রবীর দাস। শ্রম দপ্তরের সব কাজ কর্ম বন্ধ। রোটেশনে ২ জন করে অফিসার দপ্তরে আসেন। প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিভিন্ন রাজ্য সরকার কোভিড ১৯ র অছিলায় একের পর এক যেভাবে শ্রম আইন সংশোধন করছে, রাজ্য সরকার যেন সেখান থেকে নিজেকে বিরত রাখে। লকডাউন পর্যায়ে মজুরী দেওয়ার যে বিজ্ঞপ্তি রাজ্য সরকার দিয়েছিল তা যে অনেকেই অমান্য করেছে তা তুলে ধরা হয়। “প্রচেষ্টা” প্রকল্পের ত্রুটি যুক্ত অ্যাপ, তা নিয়ে নানা জটিলতার বিষয়টি ও সামনে আনা হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা, নির্মাণ শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান প্রভৃতি বিষয় গুলো ও সামনে আনা হয়। মন্ত্রী জানান, অত্যন্ত কম সংখ্যক কর্মী ও হাতে গোনা আধিকারিকদের নিয়ে এখন কাজ চলছে। তাই, সরকারি সিদ্ধান্তগুলোকে কার্যকর করতে প্রশাসনিক সমস্যা হচ্ছে। তিনি নিজেও কয়েকটা দিন অল্প সময়ের জন্য অফিসে আসেন। সময়ের অভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা যায়নি। তিনি সরকারি কতগুলো সিদ্ধান্তের কথা প্রতিনিধিদলকে জানান –
১। এই রাজ্যে শ্রম আইন সংশোধন হবে না।
২। লক ডাউন পর্যায়ের মজুরি যারা দেননি তাদের দিতে হবে। ১৭ মে-র পর লকডাউনের পরবর্তী অবস্থা বুঝে এব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৩। প্রচেষ্টা প্রকল্প নিয়ে তিনি বলেন, অ্যাপের জটিলতা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত ১৫ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছে। অর্থ প্রদান ও শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন এটা একটা লিমিটেড ফান্ড। টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এই প্রকল্প নিয়ে আমাদের অবস্থান ও উদ্বিগ্নতার কথা জানানো হয়।
৪। তিনি জানান নির্মাণ শ্রমিকরা সবাই ১০০০ টাকা করে পাবেন। অফিস বন্ধ তাই জটিলতা হচ্ছে। নির্মাণ শ্রমিকদের নিয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্য স্মারকলিপিতে আছে।
৫। পরিযায়ী শ্রমিকদের ১০০ ট্রেনে সবাই কে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে বলে প্রতিনিধিদলকে তিনি অবহিত করেন। তবে, কবে কোন ট্রেন আসবে তা রেল মন্ত্রকই সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবে বলে তিনি প্রতিনিধিদলকে বলেন। মন্ত্রী কেন্দ্রের অসহযোগিতার কথা তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কোভিড-১৯ সরকারী দপ্তর হাতে গোনা কর্মীদের নিয়ে চলছে। সরকারী বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণা হচ্ছে, কিন্তু দপ্তরগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এমন কি স্মারকলিপি জমা নেওয়ার কেউ নেই। দপ্তর বন্ধ। স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্পগুলো সুবিধা অল্পদিনে মানুষের কাছে পৌঁছবে না।
আগামীদিনে লকডাউনের পরিস্থিতি বুঝে আবার পরবর্তী কর্মসূচীর রূপ ও পদ্ধতি ঠিক করতে হবে।
করোনা মহামারীর যুগেও আমাদের দেশের শাসকরা এই বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চাইছে যে -- আইন হাতে তুলে নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ না করলে কোনো দাবিই মানা হবে না।
আমাদের দেশে ৩০ জানুয়ারী প্রথম করোনা আক্রান্ত রুগী দেখা দিলেও (যদিও তার আগেই চিনের মাধ্যমে সারা বিশ্ব জেনে গেছে করোনা রোগের ভয়ঙ্করতা) ২৫ মার্চ অপরিকল্পিতভাবে প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে দিলেন (এই দীর্ঘ সময় দেশে কী কী খেলা কেন্দ্র সরকার চালিয়েছে তা দেশবাসীর জানা হয়ে গেছে)।
দেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে উপেক্ষা করে উচ্ছেদ, কর্মচ্যুত, অপমানিত হওয়া ও প্রতিবাদরত লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকরা লকডাউনের সমস্ত বিধিনিষেধকে অগ্রাহ্য করেই নিজেদের হাতে গড়া জাতীয় সড়ক ধরে নিজ গ্রামের পথে হন্টন শুরু করলো। শত শত মাইল পদযাত্রায় মরলো, রক্তাক্ত হলো, পড়ে গেল আবার উঠে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করলো। তাদের এই একরোখা মনোভাবের কাছে শেষমেশ সরকার ঘোষণা করলো পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ গ্রামে ফিরতে পারবে। কেন্দ্র সরকার ট্রেনে ব্যবস্থা করে দেবে (ট্রেনের ভাড়া নিয়ে কেন্দ্র সরকার সামন্ত রাজাদের মতো ব্যবহার করেছে তাও দেশবাসী দেখেছে)।
করোনা রোগের বিরুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে যারা জীবনপন করে লড়ছেন তাদের জন্য পিপিই, মাস্ক, স্যানিটাইজার, কিট ও রোগীদের পরীক্ষা নিয়ে সর্বত্র ছেলেখেলা চলছে। যেন জীবনের কোনো মূল্য নেই।
দেশের ৮০ কোটি মানুষ যাদের কাছে করোনা মহামারীর চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রনা আরো ভয়ঙ্কর, তাদের রেশনের প্রাপ্তি নিয়ে কেন্দ্র -রাজ্যের সংখ্যা তত্বের লড়াইর মধ্যে পড়ে কতশত মানুষ ক্ষুধায় দিনযাপন করতে বাধ্য হলো।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশকে বাঁচাতে বিশেষজ্ঞ মহল, বিরোধী রাজনৈতিক দল, কেন্দ্রীয় ট্রেড-ইউনিয়নগুলি লাগাতারভাবে দাবি তুলছে ৮০ কোটি শ্রমজীবী পরিবারকে ১০০০০ টাকা করে ৬ মাস লকডাউন ভাতা দিতে হবে। দেশের সরকার (রাজা) মোদী কেয়ার ফান্ড ও প্রধান মন্ত্রী জাতীয় রিলিফ ফান্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত থাকা সত্বেও সে দাবি পূরণ করেনি।
আমাদের রাজ্যেও তৎপর মুখ্যমন্ত্রীর এ প্রশ্নে কোনো জবাব নেই। বিশেষ করে বাংলার লাখ লাখ নির্মাণ শ্রমিকদের রক্তঘামে পশ্চিমবঙ্গ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদে শত শত কোটি টাকা জমা আছে। সেই গচ্ছিত তহবিল থেকে নির্মাণ শ্রমিক পরিবারকে সম্মান নিয়ে জীবন যাপন করতে লকডাউন ভাতা হিসাবে ১০০০০ টাকা ৬ মাস প্রদান করা হোক এই দাবি বারংবার উঠলেও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কোন সদুত্তোর নেই। ফলে নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর শ্রমজীবি মানুষকে মানুষ হিসাবে গ্রাহ্য করেননা তাই দেশব্যাপী অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষণার পর লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক শত শত মাইল পথ পদযাত্রা করেই নিজেদের গ্রামে ফেরার অধিকার আদায় করে নিয়েছে। রাজ্য সরকারও কি তাই চাইছে? বাংলার লাখ লাখ নথিভূক্ত নির্মাণ শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার আদায় করতে লকডাউনের সমস্ত বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে একরোখা মনোভাব নিয়ে সরকারী দপ্তরের দিকে অভিযান করুক।
আশাকরি রাজ্য সরকার বাংলাকে এই অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবেন না। কেন্দ্রের মতো শ্রমজীবি মানুষকে অগ্রাহ্য না করে রাজ্য সরকার নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য ১০০০০ টাকা করে ৬ মাস লকডাউন ভাতার দাবি প্রসঙ্গে দ্রুতই সরকারী কোনো ঘোষণা করে ক্ষুব্ধ, বিধ্বস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের সঠিক পথে চলার দিশা প্রদান করবেন।
ধন্যবাদান্তে,
কিশোর সরকার
সাধারণ সম্পাদক
পশ্চিমবঙ্গ গৃহ অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়ন (এআইসিসিটিউ অনুমোদিত)।
মোদী সরকার চতুর্থ দফা লক ডাউন ঘোষণার ইঙ্গিত দিল। লক ডাউনের মধ্যেই কিভাবে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ক্রমে ক্রমে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায় এবং তার জন্য কী কী ছাড় দেওয়া সম্ভব, শুরু হচ্ছে সেই ভাব বিনিময়। শাসকদের এই চৈতন্য প্রদর্শনের পেছনে মুখ্য কারণ দেশের অগণিত কোটি কোটি কোবিড-দূর্গত মানুষের বর্ণণাতীত বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-যন্ত্রণার কথা ভাবা নয়, সেই মনোভাব থাকলে সদিচ্ছার অভাব হোত না; শাসকশ্রেণী বিপর্যয়কর ত্রুটির অকপট স্বীকারোক্তি, সংশোধন ও দুরাবস্থা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি, দায়-দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে এতো অমানবিক প্রতারণা চালিয়ে আসত না।
ভারতবর্ষে দারিদ্রসীমা মাপার মানদণ্ড কত লোককে রেশন কার্ড দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে বিচার হতে পারে না। ওটা হচ্ছে সরকারী বরাদ্দের মতিগতি অনুযায়ী নিছক ‘কোটা’য় গরিবী স্বীকারের ধূর্তামি। প্রকৃত বাস্তবে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা জনসংখ্যার অস্তিত্ব প্রায় ৮৭ কোটি। দিনরাত সরকারি হুঁশিয়ারির ফোয়ারা ছোটানো হয়ে আসছে, করোনার বিপদ থেকে বাঁচতে ‘ঘরে থাকুন’, ‘নিভৃতবাসে থাকুন’; কিন্তু কত ব্যাপক শতাংশ মানুষের ‘ঘরের মতো ঘর’ বা ‘ঘরের মধ্যে ঘর’ নেই!! সমীক্ষা করলে দেশ উজার হয়ে যাবে। ‘নিভৃতবাসে’ থাকবে কি! ‘হা-ঘর’ অবস্থা ৮৪ কোটি মানুষের! মানুষের জীবন-জীবিকাকে ক্রমাগত কি নিদারুণ পরিণতিতে এনে ফেলা হচ্ছে তার পরিচয় মিলছে দেশজুড়েই। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গাইতে চাওয়াটা হবে নির্দয় রসিকতা। দিল্লীশ্বরদের শাসনের দৌলতে রাষ্ট্রের ভান্ডারে যুদ্ধাস্ত্রের মজুদ অঢেল, তবু কোবিড জর্জরিত অবস্থায়ও মোদী সরকার যুদ্ধবিমান কেনার বরাত থেকে সরে আসেনি। সরকারি গুদামে উপচে পড়ছে খাদ্যশস্য, সরকারি প্রচার মোতাবেক অন্তত ছয়মাস খাওয়ানোর সংস্থান রয়েছ। অথচ অন্যদিকে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে করে দেওয়া হয়েছে সাতকাহনযুক্ত ঝাঁঝড়া, বলি দেওয়া হয়েছে বেসরকারিকরণ-বাজারিকরণের হাঁড়িকাঠে। আর গণবণ্টন ব্যবস্থার নমুনা! গরিব জনতাকে মাসে পরিবারপিছু প্রয়োজন পঞ্চাশ কেজি পরিমাণ খাদ্যশস্য দেওয়া, বাস্তবে দেওয়া হচ্ছে তার পাঁচ-দশ শতাংশ মাত্র! তাই নিয়ে আবার তার ওপর চলে মিথ্যাচার, দুর্নীতি, কেন্দ্র-রাজ্য কামড়া-কামড়ি। কেন্দ্র বলছে রাজ্যকে সহযোগিতা করছি, রাজ্যগুলো বলছে কেন্দ্রের সহযোগিতা মিলছে না। এই সংঘাতে পিষ্ট হচ্ছে জনগণের জ্বলন্ত দাবিগুলো। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ভাড়ায় রেলের ৮৫ শতাংশ ভারবহন করার বুক বাজানো যে কতবড় মিথ্যাচার তা ধরা পড়ল পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসতে ভাড়া দিতে বাধ্য হওয়া টিকিট হাতে ধরা শ্রমিকদের থেকে।
মোদী সরকার চাইছে লকডাউনের যথাস্থিতি ধাপে ধাপে তুলে অর্থব্যবস্থার চাকা ঘোরাতে। কারণ চাপ বাড়ছে প্রধানত পুঁজির রাঘব-বোয়াল মায় অ-একচেটিয়া ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি -- সব ধরনের শিল্প মালিকদের দিক থেকে। পিএম কেয়ারস ফান্ডে কর্পোরেট ‘অনুদান’ ঢুকেছে শুধুমুুদু নয়। মুকেশ আম্বানী শুনিয়ে রেখেছেন লক ডাউনে তাদের শিল্পগোষ্ঠীর ক্ষতি হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণক্ষেত্র ও উৎপাদনক্ষেত্রের পুঁজি গোষ্ঠীগুলো যে ছলে-বলে-কৌশলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরতে দিতে চাইছিল না, তার পেছনে বরাবরকার উদ্দেশ্য হল দাস ব্যবস্থার মতো ব্যবহার করে আদিম প্রকৃতির পুঁজির পাহাড় বানানোর সস্তা শ্রমের বাজারকে ধরে রাখা। কোবিড সংকটের পরিস্থিতিকে বিশেষ ছুতো বানিয়ে বিজেপির গুজরাট-উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকারগুলো শ্রমিক বিরোধী শ্রম আইন সংস্কারের যাবতীয় আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। মোদী সরকারের লক্ষ্য হল এই উদ্দেশ্যে নির্বিশেষে রাজ্য সরকারগুলোর ওপরে চাপ তৈরি করা। রাজ্য সরকারগুলোও কায়েমী স্বার্থকে কেন্দ্রে রেখে, পুঁজির শক্তিগুলোকে প্রাধান্যে রেখে চলার সহাবস্থানপন্থী। এই ঐকমত্যের ভিত্তির কারণেই যোগসাজশ করে অর্থনীতির চাকা আবার ঘোরানোয় একমত হচ্ছে পুঁজি আর শাসক শক্তি। সিএমআইই সমীক্ষা রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত চিত্রটা ছিল প্রতি ৪ জন কর্মরত পিছু কাজ গেছে ১ জনের। এরপরও যদি লক ডাউনের অবস্থা একইভাবে চাপানো থাকে, আর ন্যূনতম আর্থিক উপশমের জ্বলন্ত দাবি সহ জনজীবনের সর্বস্তরে অচলাবস্থার অবসান যদি সমানে উপেক্ষিত হতে থাকে, তবে পরিস্থিতি বিস্ফোরণ ঘটার দিকে চলে যেতে পারে। এইসব চিন্তাই এখন শাসকশ্রেণী করছে এবং ব্যবস্থা-অবস্থার সংকট থেকে নিষ্কৃতি পেতে উপায় খুঁজছে।
দেড় মাসেরও বেশি সময় যাবত তিন দফা লকডাউন পর্বেও চলেছে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু দেখানো আর নানারূপে নিপীড়ন। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সময়কালে ছিলেন বোধহয় গ্রীষ্মাবকাশে আর তলে তলে ফন্দি আঁটার তালে। তারপর হঠাৎই দিলেন দর্শন। একদিকে শুরু করলেন বাংলাকে তাক করে অভিযোগের পত্রবোমা মারা, অন্যদিকে গুজরাট কেন করোনা আক্রান্ত হওয়ার ক্রমতালিকায় দু-নম্বরে থেকে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে পাঠালেন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল। শাহজীর গোয়েবেলসীয় চাতুরির গুণপনা কে না জানে।
প্রধানমন্ত্রীজী চতুর্থ দফা লক ডাউন ঘোষণার প্রাক বাণীতে শোনালেন ২০ লক্ষ কোটি টাকার অর্থব্যবস্থার কথা। তার পরিপ্রেক্ষিতগত গৌরচন্দ্রিকায় দাবি করলেন, ভারত হয়ে উঠছে ‘আত্মনির্ভর’, এবং এই তথাকথিত আত্মনির্ভরতার লাইন আঁকড়ে থাকতে প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন পাঁচটি স্তম্ভ নির্মাণের যথা -- অর্থনীতি, পরিকাঠামো, ব্যবস্থা, জনবিন্যাস ও চাহিদার। এভাবে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বলে চালানোর নয়া অপচেষ্টা শুরু করা হচ্ছে। অর্থনীতির স্তম্ভ নির্মীত হওয়ার দাবি স্রেফ ভূয়ো। খাল কেটে নয়া উদারবাদ ডেকে নিয়ে আসার তিন দশকের ধারায়, বিশেষত মোদী জমানায় তার অবাধ ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ চর্চায় জাতীয় অর্থনীতির সার্বভৌমত্ব ও বনিয়াদ কর্পোরেট ও বহুজাতিক পুঁজিমুখীতায় পরিণত হয়েছে পুরোপুরি ভঙ্গুর ও টলমল অবস্থায়। পরিকাঠামো নির্মাণের পরিণতিও তথৈবচ। আর্থ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে বৈষম্য, দীর্ঘসূত্রিতা ও দুর্নীতির অব্যবস্থা। বিপর্যস্ত করা হচ্ছে সামাজিক ব্যবস্থাকে জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে, এমনকি কোবিড ছড়ানোর জন্য মুসলিমদের সম্প্রদায় হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে, তাদেরকে উৎপাদন ও পরিষেবা এবং সব ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য থেকে কোণঠাসা, বিচ্ছিন্ন, উৎখাত করার উদ্দেশ্যে; আর রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হচ্ছে সর্বোপরি ফ্যাসিস্ত গেরুয়া শক্তির হাতে ক্রমবর্দ্ধমান গণতন্ত্র নিধনের প্রক্রিয়ায়। দেশের বহুবিচিত্র জনবিন্যাসগত সহাবস্থানের অস্ত্বিত্বও আক্রান্ত হচ্ছে ধর্মাশ্রয়ী নাগরিকত্ব সংশোধনীর সাঁড়াসি আক্রমণে। আর ‘চাহিদা’ তৈরির প্রশ্ন! ‘বৃদ্ধি’ যেমন কল্পনাতীত মাত্রায় ঠেকেছে একেবারে তলানিতে, তেমনি চার দশকের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া বেকারি, কর্মসংস্থানের আকাল ও ব্যাপক জনতার অর্থনৈতিক দুর্দশায় চাহিদার বাজার মহামন্দাগ্রস্ত।
এই পটভূমিতে জিডিপির ১০ শতাংশ দাবি করা ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করলেন মোদী। চাপ ছিল লকডাউনের গোড়া থেকেই। তথাপি প্যাকেজ ঘোষণায় লাগিয়ে দেওয়া হল লক ডাউনের তিনটি পর্ব। এখন এর মধ্যে সার কত গাদ কত, পরিণতি কি দাঁড়াবে, সবই বোঝা যাবে সময় বেড়ে চলার নিয়মে।
নাম শম্পা নস্কর। পেশা আয়া-র কাজ। বাড়ি ১০৬নং ওয়ার্ডের সাঁপুইপাড়া এলাকায়। সিপিআইএমএল-এর যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল অফিসে এসেছিলেন লকডাউনের সময় কিছু সাহায্যের আশায়। তার হাতে খাদ্য-সমগ্রীর প্যাকেট তুনে দেওয়ার পরে বললেন তার এলাকায় আরো মানুষ রয়েছেন, যাদের এই সাহায্যের প্রয়োজন। তারপর নিজেই এলাকার সমস্ত বাড়ি ঘুরে ৪০/৫০ জনের তালিকা তৈরি করে, খাদ্যসামগ্রীর কুপন তুলে দিলেন পার্টি কর্মীদের সাহায্যে, তাঁর এলাকার গরিব মানুষের হাতে। স্থানীয় একজন ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী নিজে পার্টি-অফিসে এসে কয়েক হাজার টাকা দিলেন গরিব মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এই রকম বহু মানুষ এগিয়ে এসে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
এই ভাবেই পার্টির বাইরের অসংখ্য মানুষের সহযোগিতায় ও পার্টি কর্মীদের মাধ্যমে যাদবপুর-ঢাকুরিয়া এলাকায় লকডাউনের মাঝে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৮০০-র বেশি পরিবারের হাতে সাধ্যমত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।এই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন পার্টি অফিস সংলগ্ন বেশ কিছু দোকানদার, রিক্সা চালক, সহ-নাগরিক, লকডাউনে গরিব মানুষের দূর্দশা, যাদের ব্যাথিত করেছিল, অনুভব করেছিলেন তাদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। খাবার প্যাকেট করা, লাইন ঠিক করা, কুপন পৌঁছে দেওয়া, খাবার হাতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজই করেছেন, পার্টি কর্মীদের সাথে তাল মিলিয়ে।
গাঙ্গুলিপুকুরে লোকাল কমিটির অফিস থেকেই সমস্ত কাজ পরিচালনা হয়েছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ১০৫নং ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর এই কাজ বন্ধ করার জন্য চাপ তৈরি করেছিলেন, থানার মাধ্যমে। কিন্তু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এখনও এই উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। ১০৪, ১০৫, ১০৬, ৯২ নম্বর ওয়ার্ডের মানুষের কাছে এই সাহায্য পৌঁছে দিতে পেরে, কার্যত আপ্লুত পার্টি-কর্মীরাও। গড়িয়া, সন্তোষপুর ও বাঘাযতীনে আটকে পড়া বেশ কিছু কাশ্মীরী মানুষের কাছেও সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয়। এলাকার ছাত্র কমরেডদের উদ্যোগে গান্ধী কলোনী, বিজয়গড়, নেতাজি নগরেও ১০০-র বেশি মানুষের বাড়িতে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয়, পৃথকভাবে।
স্থানীয় মানুষ, পার্টি কর্মী-সমর্থক, পার্টি কর্মীদের বন্ধুদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়া গেছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ২ লক্ষ টাকার কাছাকাছি অর্থ সংগ্রহ করে, এই কাজ চলছে। পার্টি কর্মী তমাল, রানা, স্বপন বিশ্বাস, রনজয়, ঋতম, মানস ঘোষ, নান্টু হোড়, অমলেন্দু চৌধুরী, সুশান্ত দেবনাথ, শুভ, অভিজ্ঞান, ঋত্বিক, অরিত্রা, বাপি, বাদল, সঞ্জয়, বাবুন চ্যাটার্জী ও আরও অনেকের যৌথ প্রচেষ্টায় এই কাজ সম্ভব হয়েছে। এই কাজের অভিজ্ঞতা স্থানীয় পার্টি-কর্মীদের অবশ্যই অনেকটা নতুন অনুপ্রেরণা দেবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক-সামাজিক কাজে।
গত ১২ মে সন্ধ্যায় কমরেড বাবুন চ্যাটার্জির ওপর হামলা হয়। তিনি যাদবপুর এরিয়া পার্টি কমিটির সেক্রেটরি। গত দেড়মাস যাবৎ শহীদনগর পার্টি অফিসকে কেন্দ্র করে তাঁর নেতৃত্বে আসপাশের চারটি ওয়ার্ডে লকডাউন-বিপন্ন মানুষের মাঝে খাবার প্যাকেট বিতরণের কাজ চলছে। প্রায় দুহাজার পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে এই পর্বে। এই উদ্যোগে সামিল হন এলাকার অনেক সাধারণ মানুষ। যাদের কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আছে তাঁদের অনেকেই এগিয়ে এসে অর্থ সাহায্য করেন। অন্যদিকে যাদের নেওয়ার দরকার আছে তাঁরা নিজেরা ফুডপ্যাকেট নেওয়ার সাথে সাথে একই অবস্থায় থাকা অন্য মানুষদের যোগাযোগ করে লিস্ট বানিয়ে এনে উদ্যোগে সামিল হন। এইভাবে এক সামাজিক সংহতি ও সহমর্মিতার পরিবেশ গড়ে উঠছিল। রাজ্যের শাসক দলের তা পছন্দ নয়। আসলে মুখ্যমন্ত্রী অনেক ভালো ভালো কথা বললেও সার্বজনীন ও পর্যাপ্ত রেশনের অভাবে খাদ্য সংকট গভীর হয়েছে। আর, নিরন্ন বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তেমন উদ্যোগ নিতেও টিএমসির স্থানীয় নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। বরং বিভিন্ন মাত্রার দূর্ণীতির কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে। সিপিআই(এমএল)-এর ধারাবাহিক ও আন্তরিক সামাজিক সংহতি কর্মসূচী সরকার ও শাসকদলের কথা ও কাজের মধ্যে বিরাট ফারাককে সাধারণ মানুষের সামনে নীরবে প্রকট করে তুলছিল। টিএমসি এই উদ্যোগ বন্ধ করার বিভিন্ন চেষ্টা করে। হুমকি দেয়। পুলিশি অসহযোগিতা শুরু হয়। শেষে শারীরিক হামলার আশ্রয় নিল।
কলকাতার বাইরেও বেশ কিছু ত্রাণকার্যের ওপর শাসকদলের বিভিন্ন মাত্রার আক্রমণ ও বাধা দানের খবর আছে। কমরেড বাবুন চ্যাটার্জির ওপর হামলার রাতেই গড়ফা থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু পরদিন সকাল পর্যন্ত পুলিশকে কোনো উদ্যোগ নিতে না দেখা যাওয়ায় পার্টি কর্মী ও সমর্থকেরা থানার সামনে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ দেখান। ডেপুটেশন দেওয়া হয়। স্থানীয় সিপিআই(এম) ও আরএসপি দলের পক্ষ থেকেও প্রতিনিধিরা ডেপুটেশন দেন। পুলিশের কাছে দাবি করা হয় অবিলম্বে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার। জানিয়ে দেওয়া হয় যে ত্রাণকার্য যেমন চলছিল সেরকমই চালিয়ে যাওয়া হবে, আত্মরক্ষার অধিকার সকলেরই আছে। এলাকায় আরও অশান্তি আটকাতে পুলিশের উচিৎ দুস্কৃতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এই হামলা নিছক এক ব্যক্তির ওপর নয়, বরং এলাকায় পারস্পরিক সহযোগিতার ত্রাণ কর্মসূচীতে অংশ নেওয়া সমস্ত মানুষ তথা তালাবন্দিতে বিপর্যস্ত মানুষের ওপর হামলা।
গত ৫ মে মহান চিন্তানায়ক বিপ্লবী কমরেড মার্কস এর ২০২তম জন্মদিবস শ্রদ্ধার সাথে পুর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন ব্লকে পালন করা হয় ।
পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া এরিয়া কমিটির অফিসে মার্কস-এর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করা হয়। বর্ধমান শহরের কমরেডরা মিলিত হয়ে কমরেড মার্কস-এর স্মরণ ও মাল্যদান করেন কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য-এর লেখাটার পাঠ ও আলোচনা করা হয়। বর্ধমান সদর ২নং ব্লক-এর করন্দা গ্রামের কমরেড রা কমরেড মার্কস-এর ২০২তম জন্মদিবস উদযাপন করেন মাল্যদান স্মরণ সভা ও কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এর লেখাটার পাঠ করার মাধ্যমে।
৬ মে আরওয়াইএ-র ১০০ ঘণ্টার অবস্থান আন্দোলন-এর সংহতিমুলক বিক্ষোভ, অবস্থান কর্মসূচী সংগঠিত করা হয় পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে। কালনা ২নং ব্লক-এর অকালপোষ অঞ্চলের আগ্রাদহ এবং নাদনঘাট থানার ইসলাম পুর গ্রামে। পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারী খরচে দ্রুত ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সমস্ত গরিব পরিবারের একাউন্টে ১০ হাজার টাকার লকডাউন ভাতা দিতে হবে। রেশন কার্ড নেই এমন পরিবার সহ সমস্ত গরিব পরিবারের জন্য মাথাপিছু ১৫কেজি চাল/আটা সহ ডাল তেল আলু মসলা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গরিব মানুষের জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল মুকুব করতে হবে -- দাবিতে অবস্থান কর্মসূচীগুলি পালিত হয়।
লকডাউনে মানুষ খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। সিপিআই (এমএল) লিবারেশন বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটি এই সঙ্কটের সময় অঞ্চলে পার্টি ও ইউনিয়নের সদস্য ও সমর্থকদের পাশে থাকার অঙ্গীকার হিসাবে সামান্য খাদ্য সামগ্রী কিছু পরিবারের হাতে তুলে দিতে পেরেছে।
পার্টির জেলা কার্যালয় থেকে খাদ্য সামগ্রী বিলি করা হয়। সুশৃঙ্খলভাবে লকডাউনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাহায্য তুলে দেওয়া হয়। প্রচারসর্বস্বতা নয়, আন্তরিকতা নিয়েই কমরেডরা এগিয়ে এসেছেন।
পার্টির ত্রাণ বিলি কর্মসূচীতে উৎসাহিত হয়ে একটি পাড়া থেকে কিছু যুবক আসেন, তারা তাদের মতো করে পার্টি অফিস থেকে ত্রাণ বিলি করতে চান, তাদের ত্রাণ বিলি করার অনুমতি দেওয়া হয়। তারা বেশকিছু গরিব মানুষের হাতে খাদ্য সামগ্রী তুলে দেন। যেহেতু পার্টি কার্যালয় থেকে সব কিছু করা হয়েছে, এর ফলে স্থানীয় মানুষের কাছে পার্টির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। স্থানীয় পার্টি কর্মীরা বাইরের কোনো সহযোগিতা ছাড়াই অল্প কয়েকদিনে নিজেরা টাকা তুলে এই কাজ করেছেন।
বর্তমানে রেশন কিছুটা নিয়মিত হচ্ছে, অন্য কিভাবে সাহায্য করা যায়, তা ভাবনায় আছে। কোভিড-১৯-এ এ পর্যন্ত বেলঘরিয়ায় ১০ জন সংক্রমিত হয়েছেন, একজনের মৃত্যু হয়েছে, ৪ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন – এরকম পরিস্থিতিতে স্থানীয় পার্টি কর্মীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঝুঁকি পূর্ণ কাজ করে চলেছেন।
খড়দহ
খড়দায় গত ১০ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে চার দিনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এবং সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির আঞ্চলিক শাখার যৌথ উদ্যোগে সমস্যাপীড়িত মানুষদের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়।এদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় রন্ধনকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, পরিচারিকা এবং রিকশা ও ভ্যান চালকেরা। শারীরিক দূরত্ব মেনে এই সাহায্য বিলি চলে।
এলাকার পার্টি সদস্য, সমর্থক ও দরদী এবং মহিলা সমিতির সদস্যদের অকুণ্ঠ আর্থিক সহায়তায় ও রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতায় (প্যাকেজিং ও বিলি) এই কর্মসূচী সম্ভব হয়।
উত্তরবঙ্গে আশা কর্মীদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা বা উৎসাহিত করা হচ্ছে, অথচ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তাঁদের যে কাজ করতে হচ্ছে তার জন্য যা যা প্রাপ্য তা দেওয়ার কথা কেউ ভাবছে না!
লক ডাউন যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে আশা কর্মীদের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজের চাপও তত বাড়ছে। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে, প্রতিদিন ৫০-৬০টা বাড়ি ভিজিট করতে হয় তাও আবার পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্টস (পিপিই) ছাড়াই। ইতিমধ্যে কোভিড আক্রান্ত হয়ে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা এরাজ্যে ঘটেছে। এর ফলে প্রসূতিদের পরিচর্যার ব্যাপারে আশা কর্মীদের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আবার পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরতে শুরু করেছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯-এর কাজে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকার জন্যে ফরম্যাটে উল্লিখিত অন্যান্য কাজ তাঁরা করতে পারছে না ফলে সে বাবদ টাকা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এক কথায়, আশাদের কাজের চাপ ও ঝুঁকি বেড়েছে কিন্তু আয় অনেক কমেছে।
আশা কর্মীরা প্রায় সকলেই অত্যন্ত গরিব সমাজ থেকে আসে। সকলেরই পরিবারের অন্যান্যরা মূলত দিনমজুর, লক ডাউনে সব ঘরবন্দি। এই অবস্থায় বর্তমান যৎসামান্য ভাতায় সংসার চালানো আশাকর্মীদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়েছে।
সমস্ত স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য শুধু হাততালি নয়, তাঁদের বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করা হোক, যাতে তাঁরা আরো ভালোভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতে বড় ভূমিকা নিতে পারেন।
* যাঁরা এত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের শুধু জীবনবীমা নয়, স্বাস্থ্যবীমাও করা হোক।
* কোভিড-১৯-এর কাজে নিযুক্ত আশা কর্মীদের অবিলম্বে সম্পূর্ণ পিপিই কিট দিতে হবে।
* অবিলম্বে ১০ হাজার টাকা লক ডাউন ভাতা দিতে হবে।
* আশা কর্মীদের সম্মান ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে।
এই মর্মে ডিএম এবং সিএমওএইচ-কে সারা বাংলা সংগ্রামী আশা কর্মী ইউনিয়ন (এআইসিসিটিইউ-র অন্তর্ভুক্ত)-এর হুগলি জেলা কমিটির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিকদের কাছেও দাবিপত্র পেশ করা হয়।
- চৈতালি সেন, ৮ মে, চন্দননগর
উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি জেলার বেলা খারা গ্ৰামে উচ্চ বর্ণের গুণ্ডারা একটা ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং তার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত ২৭ এপ্রিল সকাল নটার সময় দলিত সম্প্রদায়ের চারটে ছেলে গরু চরাচ্ছিল। তাদের একজনের একটা গরু প্রমোদ বাজপেয়ীর মাঠে ঢুকে যায়। অমিত শুক্লা বলে উচ্চ বর্ণের জনৈক ব্যক্তি ওই ছেলেদের সেখানে আটকে প্রমোদ বাজপেয়ী ও সিদ্ধার্থ বাজপেয়ীকে খবর দেয়। এরপর ওই তিনজন মিলে লাঠি দিয়ে, লাথি চালিয়ে, ঘুঁষি পাকিয়ে ছেলেগুলোকে মারতে থাকে। দলিত ছেলেগুলোর নাম ছিল – রাম শঙ্কর, উদয় ভান, অর্জুন কুমার এবং রাম কেশ। রাম শঙ্কর ছুটে পালাতে গেলে প্রমোদ ও সিদ্ধার্থ মোটর বাইক নিয়ে তাড়া করে ওকে ধরে ফেলে এবং নির্মম ভাবে মারতে থাকে। পুলিশকে ফোনে ঘটনাটা জানানো হলে তারা সেখানে আসে এবং ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়। এরপর ওই চারটে ছেলের পরিবারের লোকজন ২৮ এপ্রিল থানায় গিয়ে ঘটনাটার একটা রিপোর্ট দেয় এবং ছেলেগুলোর ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা করার লিখিত আবেদন জমা দেয়। রিপোর্টও দেওয়া হয় না, আবার ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হয় না, যদিও রাম শঙ্করের অবস্থা গুরুতর ছিল।
এরপর ২৯ এপ্রিল চারটে দলিত পরিবারকে থানায় ডাকা হলে ওরা আহত ছেলেগুলোকে নিয়ে থানায় যায়। যারা ছেলেগুলোর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তারাও থানায় হাজির থাকে। আহত ছেলেগুলো এবং পরিবারের লোকজনদের সারাদিন থানায় বসিয়ে রাখার পর বাড়ি চলে যেতে বলা হয়। ছেলেগুলোর বাড়ির লোকেরা বারবার ডাক্তারি পরীক্ষা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলা সত্ত্বেও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
মে মাসের ৩/৪ তারিখে রাম শঙ্করের অবস্থা সংকটজনক হয়ে উঠলে পরিবারের লোকজন একটা অ্যম্বুলেন্স যোগাড় করে ওকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে জেলা হাসপাতালে পাঠোনো হলে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে বলা হয়।
যাদের ওপর নির্যাতন চালানো হল তারা দরিদ্র ভূমিহীন দলিত। পুলিশ যদি ঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিত, অভিযোগ দায়ের করত এবং রাম শঙ্করের চিকিৎসার ব্যবস্থা করত, তাহলে রাম শঙ্কর খুব সম্ভবত বেঁচে যেত। দরিদ্র বলে পুলিশ তাদের কথা শোনেনি আর উচ্চ বর্ণের পয়সা ও ক্ষমতার জোরের জন্য অপরাধকে উপেক্ষা করে। আর এসবের সম্মিলিত ফল হল ছেলেটার মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর একটা রিপোর্ট দেওয়া হলেও নির্যাতকরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং এখন আবার দলিত পরিবারগুলোকে হুমকি দিচ্ছে।
সিপিআই(এম-এল)-এর উত্তরপ্রদেশ শাখা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে, যে পুলিশরা ঘটনা ঘটার পর রিপোর্ট দিতে এবং ছেলেটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে অবহেলা করেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি রেখেছে। সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষে বিজয় বিদ্রোহী ও শামসের সিং শোকগ্ৰস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানিয়েছেন।
আটকে পড়া সমস্ত শ্রমিকদের নিরাপদে ঘরে ফেরানোর লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি। সিপিআই(এম-এল), এআইসিসিটিইউ ও আয়ারলা এই ইস্যুটা লাগাতার তুলে গেলেও সরকার অনমনীয় ভাবে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটাকে অবজ্ঞা করে চলেছে। চাপের মুখে পড়ে সরকার ট্রেন/বাস চালানোর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই পর্যাপ্ত নয় বলে দেখা যাচ্ছে। শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনাটা এমন ভাবে ছকা হয়েছে যাতে বহু সংখ্যক শ্রমিকই ফেরার তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। স্বরাষ্ট্র সচিব একটা ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন যে, শ্রমিকদের ফেরানো সম্পর্কিত নির্দেশাবলী ‘নিয়মিত’ পরিযায়ীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এখন আবার ব্যবসায়ী লবির চাপে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো আটকে থাকা শ্রমিকরা যেখানে রয়েছে সেখানেই তাদের রেখে দেওয়ার মতলব ভাঁজছে। উদ্দেশ্য, কিছু জায়গায় এখন কারখানা খোলা, নির্মাণ কাজ চালানোর অনুমতি মেলায় শিল্পপতি, নির্মাণ কাজের উদ্যোক্তারা যাতে শ্রমিকদের শোষণ করতে পারে।
রাজস্থান সরকারের শ্রম দপ্তর একটা নির্দেশিকা দিয়ে বলেছে, নিয়োগকর্তার নির্দেশে সাড়া দিয়ে যারা কাজে যোগ দেবে না তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু, অধিকাংশ শ্রমিকই আগে ঘরে ফিরতে চান এবং এখনও তাঁদের খাবারের অভাব ও অনাহারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কর্ণাটকে রাজ্য সরকার শ্রমিকদের ফেরার জন্য নির্দিষ্ট ট্রেন বাতিল করেছে, এবং নির্মাণ ক্ষেত্রের নিয়োগকর্তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করার পরই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওই পদক্ষেপ করেন। এআইসিসিটিইউ-এর পক্ষ থেকে কর্ণাটক হাইকোর্টে করা মামলা ও দেশজুড়ে চলা প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে অবশ্য কর্ণাটক সরকার ট্রেন বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
এর আগে তবলিগি জামাতের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল; এখন আবার বিভিন্ন স্থানে বিহারি পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থার শিকার করে তোলা হচ্ছে। কর্ণাটকে তাদের ‘করোনা বোমা’ বলে বিদ্রুপ করা হচ্ছে।
কর্ণাটকে এখন নীতীশ-বান্ধব বিজেপি সরকার, এ সত্ত্বেও সেখানে বিহারি শ্রমিকদের ওপর হেনস্থা চালানো হচ্ছে কেন? বিহারের জনগণের কাছে সুশীল মোদী ও নীতীশ কুমারকে এর জবাব দিতে হবে। শ্রমিকরা ঘিঞ্জি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয় বলে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অধিকার কারুরই থাকতে পারে না। পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরার যথাযথ ব্যবস্থা কর্ণাটক সরকার করেনি কেন? ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থেকে নীতীশ কুমার এই ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছে কেন? বিহার বিধানসভায় সিপিআই(এম-এল) বিধায়ক দলের নেতা মেহবুব আলম বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা একটা চিঠিতে এই প্রশ্নগুলো তুলে ধরেছেন।
তবলিগি জামাতের করোনা আক্রান্ত কিছু সদস্য রোগ থেকে সেরে উঠে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসার জন্য নিজেদের প্লাজমা দান করছেন। কিন্তু এই অতিমারি সৃষ্ট বিপর্যয়ের সময়েও বিজেপি-সংঘ তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো থেকে বিরত হচ্ছে না।
বিজেপি নেতৃবৃন্দ এবং এবং তাদের প্রচার যন্ত্র দাবি করছে যে, ট্রেনে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে রেল কোন ভাড়া আদায় করছে না। বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। একটা ‘শ্রমিক স্পেশ্যাল’ শ্রমিকদের নিয়ে ভিওয়ান্দি থেকে উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর আসছিল। ট্রেনে ৯০টা আসন ফাঁকা ছিল। ওই ট্রেনে চাপবার জন্য ১০০ জন শ্রমিক স্টেশনে পৌঁছলে তাদের চাপতে দেওয়া হয় না, কারণ, টিকিটের দাম মেটানোর টাকা তাদের কাছে ছিল না। অতিরিক্ত ৫০ টাকা সারচার্জও তাদের থেকে আদায় করা হচ্ছিল।
সিপিআই(এম-এল)-এর বিহার সম্পাদক কুনাল প্রশ্ন তুলেছেন, পিএম কেয়ারস-এর তহবিল কিসের জন্য গঠিত হয়েছে? পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা ও তাদের চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কেন পিএম কেয়ারস থেকে খরচ করছে না? তিনি আরও বলেন, দিল্লী এবং পাটনা উভয় স্থানেই যখন বিজেপি-জেডিইউ-এর ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার চলছে, তখন পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে এত দেরি হচ্ছে কেন তার জবাব নীতীশ কুমার ও সুশীল মোদীকে দিতে হবে। সিপিআই(এম-এল) আরও দাবি জানিয়েছে -- পরিযায়ী শ্রমিকদের ১০,০০০ টাকা লকডাউন ভাতা দিতে হবে, তিন মাস বিনা মূল্যে রেশন দিতে হবে এবং নিরাপদে শ্রমিকদের দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে।
সিপিআই(এম-এল)-এর দিল্লী সম্পাদক রবি রাই জানিয়েছেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কোন ট্রেন দিল্লী থেকে যাত্রা করেনি। তিনি আরও বলেছেন, কর্ণাটক থেকে খবর পাওয়া গেল যে, শ্রমিকদের নিয়ে যে ট্রেনের আসার কথা ছিল তা বাতিল করা হয়েছে। একই পরিস্থতি গুজরাটেরও। কর্পোরেট লবির চাপেই এটা করা হচ্ছে, লকডাউন বিধি শিথিল হলে যাতে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায়। সংকটের সময় এই শ্রমিকদের দুর্দশার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল, আর আজ যখন সেই অসহায় শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে চাইছে তখন তাদের জোর করে আটকে রাখা হচ্ছে।
অপরিকল্পিত ভাবে নামানো লকডাউনের পরিণামে সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক সংকট শ্রমিকদের ক্রীতদাসত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সিপিআই(এম-এল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুচেতা দে এটাকে ক্রীতদাসে পরিণত করা বলে অভিহিত করেন এবং শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
সিপিআই(এম-এল), সিপিআই, সিপিএম, ফরোয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি -- এই পাঁচ বাম দল গত ৫ মে মার্ক্সের-এর ২০২তম জন্ম বার্ষিকীতে বিহারে রাজ্যব্যাপী ধর্ণা সংগঠিত করে। শ্রমিকদের থেকে ভাড়া আদায়ের সরকারি নির্দেশিকাকে ধিক্কার জানিয়ে বাম দলগুলো এটাকে মানবতা বিরোধী বলে অভিহিত করে। সমস্ত লকডাউন বিধি মেনে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত এই ইস্যুতে প্রতিবাদ জানানো হয়।
বাম দলগুলো হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট সংখ্যায় পিপিই সরবরাহের দাবি জানায় এবং সেনাবাহিনীর দ্বারা হেলিকপ্টার থেকে হাসপাতালগুলোতে পুষ্পবৃষ্টির মতো অনর্থক দেখনদারি কাজে জনগণের অর্থের অপচয়ের নিন্দা করেন। এই সংকটের সময় ৬,৮০০ কোটি টাকা দিয়ে সরকার যে দুটো বিশেষ বিমান কিনছে, বাম দলগুলো সেই পদক্ষেপকেও ধিক্কার জানায়।
সম্প্রতি আবার খবরের শিরোনাম হল নীরব মোদী, মেহুল চোক্সী, বিজয় মাল্যরা। এরা হল সেই বিজেপি ঘনিষ্ঠ হীরে ব্যবসায়ী, সুসময়ের সম্রাটরা যারা জালিয়াতির মাধ্যমে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলোর টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়েছে, বা যেমন বলা হয়ে থাকে, তাদের পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক তাদের খাতা থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ৬৮,৬০৭ কোটি টাকার অপরিশোধিত ঋণ মুছে দিয়েছে। ব্যাঙ্কের খাতায় থাকা অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) পরিমাণ থেকে ঋণ মুছে দেওয়ার এই কথাটা সরকার নিজে থেকে প্রকাশ করেনি। তথ্য জানার অধিকার আইনের আশ্রয় নিয়ে সকেত গোখলে নামে জনৈক ব্যক্তি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন জানালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানায়, ২০১৯-২০ অর্থ বর্ষের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কর্তৃক তাদের হিসাবের খাতা থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ হল ৬৮,৬০৭ কোটি টাকা। সেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের একটা তালিকাও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেয়। মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ বেশি, তালিকায় থাকা এমন কয়েক জনের উল্লেখ এখানে করা হচ্ছে কোম্পানির নাম ও মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ
১। মেহুল চোক্সীর গীতাঞ্জলি জেমস ৫৪৯২ কোটি
২। সন্দীপ ঝুনঝুনওয়ালা ও সঞ্জয় ঝুনঝুনওয়ালার আরইআই এগ্র, ৪৩১৪ কোটি টাকা
৩। যতীন মেহেতার উইনসাম ডায়মণ্ড অ্যাণ্ড জুয়েলারি, ৪০৭৬ কোটি টাকা
৪। বিক্রম কোঠারির পান পরাগ খ্যাত রোটোম্যাক গ্লোবাল প্রাঃ লিঃ, ২৮৫০ কোটি টাকা
৫। বিজয় মাল্যর কিংফিশার এয়ারলাইনস, ১৯৪৩ কোটি টাকা
৬। জিলি ইন্ডিয়া (মেহুল চোক্সিদের) ১৪৪৭ কোটি
৭। নক্ষত্র ব্র্যাণ্ডস (মেহুল চোক্সীদের) ১১০৯ কোটি
ব্যাঙ্কের টাকা লুট করে পালিয়ে যাওয়ার আরও একটা আখ্যানের উন্মোচন ঘটেছে অতি সম্প্রতি। বাসমতি চাল রপ্তানির কারবার ছিল রামদেব ইন্টারন্যাশান্যাল-এর। এসবিআই, কানাড়া ব্যাঙ্ক, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, আইডিবিআই, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এবং কর্পোরেশন ব্যাঙ্ক -- এই ছটা ব্যাঙ্ক থেকে ৪১৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ না করে দুবাই পালিয়ে গেছে কোম্পানির ডিরেক্টর সুরেশ কুমার, নরেশ কুমার ও সঙ্গীতা। পালানোর আগে ওরা এদেশে থাকা ওদের প্রায় সমস্ত সম্পত্তিই বিক্রি করে দেয়। তারা যে নেই সে কথা জানা যায় ২০১৬ সালেই। এ সত্ত্বেও সিবিআই-এর কাছে এসবিআই অভিযোগ জানায় এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারী। আর, সিবিআই পলাতক ডিরেক্টরদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে ২৮ এপ্রিল। ঋণ গ্ৰহিতাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এ কথা জানার পর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে এসবিআই-এর লেগে গেল চার চারটে বছর! একটু অনুসন্ধান চালালে পলাতক ডিরেক্টরদের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সংযোগ খুঁজে পাওয়াটা বোধকরি অসম্ভব হবে না।
এই অপরিশোধিত ঋণ এনপিএ-র হিসাব থেকে মুছে দেওয়া প্রসঙ্গে বিরোধী দল কংগ্ৰেস বলেছে যে, মোদী জমানার প্রথম পাঁচ বছরে মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৬.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা। এবং এই পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ বা বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি। এই সুবিশাল পরিমাণ ঋণ অপরিশোধিত থাকায় ব্যাঙ্কগুলোর এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে, যার ভারে ব্যাঙ্কগুলো নুয়ে পড়ছে এবং আর্থিক ক্ষেত্রের কর্মকাণ্ডও ধাক্কা খাচ্ছে। বিরোধী নেতারা আরও বলছেন, যারা পলাতক, জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাঙ্কগুলোকে যারা প্রতারিত করেছে তাদের ক্ষেত্রে এনপিএ-র ভার কমানোর নামে ঋণকে মুছে দেওয়াটা সঠিক পদক্ষেপ নয়। অপরিশোধিত ঋণ হিসাবে ব্যাঙ্কের খাতায় দেখিয়ে যাওয়াটাই যথাযথ হবে। আর অপরিশোধিত ঋণের জমে পাহাড় হওয়ার পিছনে যে সরকার-ব্যাবসা গাঁটছড়া তথা দোসর শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের প্রত্যক্ষ মদতের অবদান যথেষ্ট রয়েছে তা নিয়ে এখন বোধকরি আর কেউ প্রশ্ন তুলবেন না।
ঋণ শোধ না করা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মদত দেওয়ার অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠায় মোদী মন্ত্রীসভার সদস্যরা, বিজেপি নেতারা সেই বরাবরের যুক্তিই দিচ্ছেন যে, এনপিএ-র পরিমাণ থেকে অপরিশোধিত ঋণ মুছে দেওয়ার অর্থ ঋণ মুকুব করা নয়। এর পরও ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু অপরিশোধিত ঋণ একবার মুছে দিলে সেই ঋণ আবার আদায় করার আগ্ৰহ কতটা থাকে এবং কতটাই বা সম্ভব হয়? যে ৬.৬৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ পাঁচ বছরে মুছে দেওয়া হয়েছে তার অন্তত কিছু পরিমাণেরও আদায় যে হয়েছে তার কোনো নজির সরকার কিন্তু হাজির করতে পারছে না। এছাড়া আরও যুক্তি দেওয়া হয় যে, অপরিশোধিত ঋণের জন্য ব্যালান্স শিটে সংস্থান করার পরই ব্যাঙ্ক ঋণ মুছে এনপিএ-র পরিমাণকে কমানোর পথে যায়। সে ক্ষেত্রেও তো ব্যাঙ্কের লাভের পরিমাণ কমে যায় এবং ব্যালান্স শিটের ওপর চাপ বাড়ে। ব্যাঙ্কের কার্যকলাপকে সচল রাখা এবং ঋণের আবেদনকারীদের ঋণ পাওয়াকে অব্যাহত রাখার জন্য সরকার ২০১৫ সাল থেকে ব্যাঙ্কগুলোতে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা ঢেলেছে, আর এর সবটাই সাধারণ জনগণের টাকা। ব্যাঙ্কের হিসাবনিকাশ পরিষ্কার করতে ঋণকে মুছে দিয়ে এনপিএ-র ভার কমানোর এই পদক্ষেপ আসলে ব্যাঙ্ক থেকে আপনার-আমার, সাধারণ জনগণের টাকাকেই সাফ করে দেওয়া।
অপরিশোধিত ঋণ তথা এনপিএ-র সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠার পিছনে ক্রোনি পরিঘটনা তথা সরকার-ব্যবসায়ী গাঁটছড়ার অবদানের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই ক্রোনি পরিঘটনা আসলে শাসক দল ও কর্পোরেটদের পরস্পরকে মদত যোগানো, পরস্পরের মধ্যে লেনদেন-এর সম্পাদন। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষভাবে শাসক দলকে টাকা দেয়, আর শাসক দলও তার বিনিময়ে তাদের ভালো রকম সুবিধা পাইয়ে দেয়। অর্থ প্রদানের মধ্যে দিয়ে শাসকদের সঙ্গে অর্জন করা ঘনিষ্ঠতা শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গৃহীত ঋণ পরিশোধ না করা সম্পর্কে এক প্রত্যয়ের জন্ম দেয়। তারা মনে করে, ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ শোধ না করলেও তাদের শাস্তির মুখে তো পড়তেই হবে না, বরং বিপদ থেকে তাদের উদ্ধারের ব্যবস্থাও হবে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সীদের বিদেশে পালিয়ে যেতে দেওয়ার অভিযোগের মধ্যে দিয়ে যে বিষয়টির বিশ্বাসযোগ্যতা জোরালো হচ্ছে। কংগ্ৰেসের বিরুদ্ধে শিল্পপতি-ব্যবসায়ী সখ্যতার অভিযোগ জোরালোভাবেই উঠেছিল, আর আজ বিজেপি যেন এই ক্রোনি পরিঘটনা লালনপালনের সাক্ষাৎ প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। কর্পোরেটদের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হওয়াকে, তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়াকে ওরা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দিয়েছে, যার নাম হল ইলেক্টোরাল বণ্ড। ইলেক্টোরাল বণ্ড যে ভারতীয় নির্বাচনে কালো টাকার খেলাকে জোরালো করে তুলবে, সে সম্পর্কে আরবিআই ও নির্বাচন কমিশন সতর্ক করা সত্ত্বেও মোদী সরকার ভারতের জনগণের কাছে সে কথা গোপন করে, সংসদের কাছে এ সম্পর্কে মিথ্যাচার করে এবং বণ্ড প্রকল্প চালু করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই বণ্ড প্রকল্প অর্থদাতা ও প্রাপকের পরিচয় ভারতীয় জনগণের কাছে গোপন রাখে, নির্বাচনে অর্থ জোগানকে সম্পূর্ণ রূপে অস্বচ্ছ করে তোলে এবং কর্পোরেট ও বিদেশী সংস্থার গোপন অর্থ জোগানকে মসৃণ করে। এই পথে দুর্নীতিও সুগম হয়। ইলেক্টোরাল বণ্ডের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কালো টাকা, শেল কোম্পানিগুলোর টাকা পৌঁছানোর প্রশস্ত পথকে বিজেপির দুয়োরের দিকেই এগিয়ে যেতে দেখা গেছে। কেননা, ইলেক্টোরাল বণ্ডের মধ্যে দিয়ে প্রাপ্য টাকার ৯৫ শতাংশেরই লাভবান সে হয়েছে। অপরিশোধিত কর্পোরেট ঋণের মাত্রা যদি ক্রমবর্ধমান হতে থাকে তবে তার পিছনে রাজনীতি-কর্পোরেট গাঁটছড়ার ভূমিকা অবিসংবাদী হয়েই দেখা দিচ্ছ। মোদী জমানায় অপরিশোধিত ঋণ তথা এনপিএ ফুলে ফেঁপে উঠেছে শুধু তাই নয়, ব্যাঙ্কের টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়াকেও প্রতারকরা একটা জলভাত ব্যাপার করে তুলেছেন। ফলত, “না খায়ুঙ্গা, না খানে দুঙ্গা” মার্কা জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম তার অপরূপ শোভা নিয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী ভারতবর্ষ সহ সারা দুনিয়ার পক্ষাঘাতগ্রস্ত, অকার্যকর ও অমানবিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বরূপ প্রকাশ করে দিয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার করোনা পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা এবং হু (W.H.O)-র প্রশংসা আদায় করলেও বাস্তব চিত্র বড় করুণ। সাম্প্রতিকালে অওরঙ্গাবাদে মালগাড়ির নীচে ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে পিষে দেওয়ার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। লকডাউনের মধ্যে গোটা দেশেই খেটে খাওয়া মানুষের জীবন কী সঙ্গিন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তার ইঙ্গিত দিয়ে গেল এই ঘটনা! এই লেখাতে আমরা কর্ণাটকের পরিযায়ী শ্রমিকদের করুণ অবস্থা আর কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের উপর আলোকপাত করব।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, কর্ণাটকের অভ্যন্তরের ও বাইরের রাজ্যগুলি থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ১৫ লক্ষের কাছাকাছি। বলা বাহুল্য সংখ্যাটা এখন অনেক বেশি। এই মজুরেরা শ্রমজীবী শ্রেণির সবচেয়ে নিপীড়িত অংশের মধ্যে পরিগণিত হয়, আর শ্রম আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের কাজ করানো হয়।
আন্তঃস্বদেশী অভিবাসী কর্মী আইন, ১৯৭৯ অনুযায়ী অভিবাসী শ্রমিকদের একই ধরনের কাজের জন্য স্থানীয় শ্রমিকদের সমান মজুরি অথবা ১৯৪৮-এর ন্যুনতম মজুরি আইন অনুযায়ী ন্যুনতম মজুরি পাওয়া উচিত।
এছাড়া স্থানচ্যুতি ভাতা, চিকিৎসা সুবিধা সহ বিভিন্ন সু্যোগ-সুবিধার কথাও বলা আছে ঐ আইনে। বলা বাহুল্য, অন্যান্য শ্রম আইনের মতো এই অভিবাসী আইনও অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।
রাজ্য জুড়ে শিল্প অঞ্চলগুলিতে, নির্মাণ শিল্পে, বিশেষত বেঙ্গালুরু এবং ম্যাঙ্গালুরুতে অভিবাসী শ্রমিকদের এক বড় অংশ কাজ করে। এছাড়াও গৃহশ্রমিক হিসাবে, বস্ত্র শিল্পে, চাল কল, রঙের কারখানা ও গ্রামীন ক্ষেত্রে কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে এক বড় অংশের অভিবাসী শ্রমিক কাজ করে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিবাসী কর্মীরা কোডাগু, হাসান এবং চিকামাগলুরু জেলা সহ কর্ণাটকের বিভিন্ন জেলায় চাষ আবাদের কাজে যুক্ত রয়েছে।
রুটি রুজির তাগিদে অন্যত্র পাড়ি দেওয়া কর্ণাটকের এই শ্রমিকদের মধ্যে ৬ লাখের বেশি কর্ণাটকের গ্রামাঞ্চল থেকে ও ৪ লাখের বেশি কর্ণাটকের শহরাঞ্চল থেকে আগত। অন্যদিকে ভারতের অন্য রাজ্য থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ শহরাঞ্চল থেকে আসা, আর ২ লাখের বেশি গ্রামাঞ্চল থেকে আগত। ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, কেরালা সহ বিভিন্ন রাজ্যর শ্রমিকরা এখানে কাজ করতে আসে।
কোনোক্রমে দিন গুজরান করা এই শ্রমিকদের অবস্থা লক ডাউনের দরুণ এক অসহনীয় অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। করোনা মোকাবিলায় লক ডাউন কত দূর আবধি প্রয়োজন ছিল, এ নিয়ে আলোচনা অন্যত্র করব, তবে এটা বলাই যায় যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা কিউবার মত উন্নতমানের চিকিৎসা পরিকাঠামো না থাকা ভারতকে দীর্ঘমেয়াদী লক ডাউনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর, যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রান্তিক মানুষরা চূড়ান্ত উপেক্ষিত হয়, তারা যে এই লকডাউন পর্বে মোটেই গুরুত্ব পাবে না, সেটাই স্বাভাবিক। মোদী সরকার করোনা মোকাবিলায় মুখে ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করলেও, তার বাস্তব প্রতিফলন খুবই সীমিত। লকডাউনের কারণে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ নেই, তাই হাতে টাকাও নেই। মোদী সরকারের ঘোষণা নিঃসার, মালিকদের বাধ্য সে করবে না, আর তার বদলে শ্রমিকদের হাতে টাকাও সে তুলে দেবে না। কিছু জায়গায় সরকারী উদ্যোগে খাবার পৌঁছলেও পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে ৯৫ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে সরকারী উদ্যোগে খাবার পৌঁছয়নি। এনজিও, ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বাম গণসংগঠন ও অন্য গণসংগঠনগুলির আন্তরিক উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
কেরলের সরকার কিছু ক্ষেত্রে সফল, কিন্তু বাকি রাজ্য সরকারগুলির ব্যর্থতা পরিষ্কার।
গত ২২ মার্চ লকডাউন ঘোষণার পর যানবাহন না চলায় পরিযায়ী শ্রমিকরা আটকে পড়ে। একটা সময় পর ক্ষুধার জালায় অতিষ্ঠ হয়ে শ্রমিকদের এক বড় অংশ পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়ে কয়েকশো মাইল পাড়ি দিয়ে ঘরে ফেরার জন্য। কর্ণাটকে ৭ এপ্রিল বেঙ্গালুরু থেকে ২৩০ কিমি হেঁটে ঘরে ফেরার পথে বেলারিতে এক মহিলা নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অনেককে মাঝ পথে আটকে দেওয়া হয় এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সাময়িক বাসস্থানে তাদের জায়গা হয়। প্রসঙ্গত বলি, ২৯শে মার্চ ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্য সরকারগুলির কাছে আদেশনামা (নং 40/3/2020/DM-I(A)) পাঠায়। এই আদেশনামা অনুসারে যে সমস্ত গরিব মানুষ লকডাউনের কারণে আটকে পড়েছে তাদের জন্য ঐসব রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের সরকারের খাবার ও সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথা। পরিযায়ী শ্রমিকরা যারা ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে, তাদের ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে রাখার ব্যবস্থা করার কথা। এই আদেশনামা অনুযায়ী শিল্প বা বাণিজ্য সংস্থাগুলি এই লকডাউন পর্বে শ্রমিকদের বেতন দিতে বাধ্য থাকবে, আর কাউকে ছাঁটাই করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তব ছিল অনেকাংশেই ভিন্ন, যার জন্য দায়ী কেন্দ্র রাজ্য উভয় সরকার। মনে রাখতে হবে রেশন ব্যবস্থায় খাদ্যশস্য আহরণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, তেমনই বন্টনের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।
নায়ান্দাহালি শ্রমিক কলোনিতে থাকা এক নির্মাণ শ্রমিকের জবানবন্দি অনুযায়ী তারা পাঁচ মাস ধরে বেতন পায়নি। সরকার মাথা পিছু এককালীন ৫,০০০ টাকা দেওয়ার ঘোষণা করলেও তা যৎসামান্য, আর পরিযায়ী নির্মাণ শ্রমিকরা অনেকেই নথিভুক্ত নয়।
সামাজিক সংকট ঘনীভুত হতে পারে দেখে ২৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভিন্ন এক আদেশনামায় পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বাস ও ট্রেনের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেয় আর রেল দপ্তর সেই অনুযায়ী বিশেষ শ্রমিক ট্রেনের ব্যবস্থা করে সেই জায়গাগুলির মধ্যে যেখানে উৎপত্তি এবং গন্তব্যস্থলের রাজ্য সরকারগুলিও ট্রেন চালানর সিদ্ধান্তে অনুমোদন দেয়। কর্ণাটক সরকার ১ মে বাস, ট্রেন চালু করার পক্ষে সিদ্ধান্ত জানায় এবং সেই মতো বেঙ্গালুরু থেকে কর্ণাটকের অন্যত্র বেশ কিছু বাস চালু করা হয়। দুঃখের বিষয় ভাড়া ঘোষণা করা হয় স্থিরীকৃত ভাড়ার দুই গুণ, যেখানে ব্যয়ভার বহন করা উচিত ছিল সরকারের। কোনো বাস চলবে সে সম্পর্কে স্বচ্ছতা না থাকায়, ২ মে ম্যাজেষ্টিক-মুল বাস ডিপোতে হাজার খানেক শ্রমিক জড়ো হয়ে ফিরে আসে। এরা ছিল সবাই ক্ষুধার্ত আর সামাজিক ভাবে রাষ্ট্র্রীয় বঞ্চনার দরুণ নিপীড়িত। করোনা বনাম ক্ষুধার লড়াই – যা আসলে পুঁজিবাদী লাভের স্বার্থে পরিচালিত রাষ্ট্রের বঞ্চনার সাথে নিপীড়িত মানুষের লড়াই – তাতে ক্ষুধার পরাজয় হচ্ছিল। ‘যত বেশী অত্যাচার, তত বেশী প্রতিরোধ’ – এই পরিমাণে না হলেও প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছিল। এআইসিসিটিউ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সহ অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন ও পিইউসিএল নানান পর্বে শ্রম দপ্তরকে ই-মেল মারফত ও ফোনে চাপ সৃষ্টি করে এবং কোর্টে কেস ফাইল হয়। চাপের মুখে সরকার বিনামূল্যে আন্তঃজেলা বাস চালু করার কথা বললেও সমস্যা ছিল প্রচুর – স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থা ছিল না, আন্তঃরাজ্য ট্রেনের ভাড়া ছিল প্রচুর। তা স্বত্ত্বেও শ্রমিকদের ঘরে ফেরার যতটুকু সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল, তা ধ্বংস হয়ে গেল যখন ৬ মে ইয়েদুরাপ্পা ঘোষণা করলেন যে শ্রমিকদের ফেরানোর জন্য বিশেষ ট্রেন চালানো যাবে না। আসলে বিল্ডার কোম্পানির মালিকদের চাপে কাজ শুরু করার জন্য সরকার তার সিদ্ধান্ত বদল করে। ৪০ দিন আটকে থাকা শ্রমিকরা যখন ফেরার প্রত্যাশায় মুখিয়ে ছিলেন, তখনই ইয়েদুরাপ্পা সরকারের এমন সিদ্ধান্তে চরম বিপাকে পড়েন তাঁরা। সমাজের নানা স্তর থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে। ইয়েদুরাপ্পা সরকারের প্রবল সমালোচনা করে বিরোধী দলগুলো। উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলোর শ্রমিকরা যারা ফিরে আসার কথা ভাবছিলেন তারা তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এই পর্বে স্বাধীন উদ্যোগে ১২০০ ব্যক্তি ও সংগঠনের সই স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদ পত্র মুখ্যমন্ত্রীকে পেশ করা হয়।
গণসংগঠনগুলির মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী ভুমিকা ছিল এআইসিসিটিউ-এর। তাদের উদ্যোগে সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে কেস ফাইল হয়। শ্রমিকদের পক্ষে সওয়াল করেন ক্লিফটন ডি রোজারিও, জাইশীণ-এর মতো উকীলরা। ক্লিফটন রোজারিও এআইসিসিটিউ-এর কেন্দ্রীয় সম্পাদক এবং সিপিআই(এম এল) লিবারেশনের কর্ণাটক রাজ্য সম্পাদক। তাদের যুক্তি ছিল ধারালো -- পরিযায়ী শ্রমিকরা দাস নয় যে তাদের বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হবে। যদি শিল্পের জন্য তাদের উপস্থিতি এতো জরুরি হত, তাহলে তাদের এত দূর্দশাগ্রস্ত অবস্থা হবার কথা নয়। আদালতের রায় না বেরোলেও সরকার আবার পিছু হঠে। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে শেষমেশ পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করল কর্নাটক সরকার। জানিয়ে দিল, খুব শ্রীঘ্রই শ্রমিকদের ফেরানো শুরু হবে। এ ছিল সার্বিকভাবে শ্রমিক আন্দোলনের জয়। লেখাটার বিষয় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে, কিন্তু স্থানীয় প্রান্তিক শ্রমিকদের অবস্থাও শোচনীয়। বস্ত্র, চা, পাট শিল্পে লকডাউন পর্বে কাজ ছাড়া বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
করোনা নামক সংক্রামক ব্যধি যার দরুণ সমগ্র বিশ্বে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে, শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর অবস্থা বেসামাল, তা মোকাবিলা ভারত সরকারের পক্ষেও সহজ নয়, সেটা মাথায় রেখেও বলতে হছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিলের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের কথা আনেকাংশেই অন্তঃসারশূন্য। মনে রাখতে হবে এই শ্রমিকরা ক্ষুধার তাড়নায় এমনকি পায়ে হেঁটে ফেরার জন্য মরিয়া হয়েছে। অমানবিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মেহনতি মানুষের নিষ্পেষণ এবং শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ঢালাও বেসরকারীকরণ-এর জন্য দায়ী, দায়ী সারা বিশ্বের মালিককূল আর তাদের প্রতিনিধি শাসক দলগুলি। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে বর্তমান বিজেপি সরকার পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং আরো অনেক জোরালো ভাবে। আম্বানি, আদানি সহ সব বৃহৎ পুঁজির মুনাফা বজায় রাখতে যতটা সক্রিয় তার সিকিভাগ সহানুভূতিও যদি প্রান্তিক মানুষরা পেত! আর, উগ্র মেকি জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারিগর এই মোদী সরকারের সময়ে ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া শিল্পপতিদের ঋণ মকুব করে দেওয়ার পরিমাণ পূর্বতন জমানার থেকে অনেক বেশি। এই সংকটের সময়েও শ্রম আইন সংশোধন করা হয় মালিকের মুনাফা বাড়ানোর জন্য। আর লক ডাউনকে ব্যবহার করে এনআরসি-সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের, বা আনন্দ তেলতুম্বড়ে, কাফিল খানদের জেলে পোরা এবং দীর্ঘমেয়াদী সাম্প্রদায়িক প্রচার মোদী সরকারের আমানবিক, ফ্যাসিবাদী চরিত্র দেখিয়ে দেয়। করোনা এবং রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে তাই আজকের জয় - কর্ণাটক সরকারের ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত লাগু করা -- সামান্য হলেও মালিকী জুলুমের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর জয়। আগামী দিনগুলিতে জারি থাকুক এই লড়াই।
-- সংগ্রাম সরকার
দেশের সকল মোদি ভক্তরাই জানেন যে, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। ফলে গত মঙ্গলবার (১২ মে, ২০২০) রাত আটটায় (আবার মঙ্গলবার রাত আটটা! নোটবন্দির রাত আটটা, ঘরবন্দির রাত আটটা, সবই মঙ্গলবার) দেশের ‘প্রধান সেবক’ যখন জানালেন যে আমরা এক আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তুলব, ভারতে ‘অচ্ছে দিন’-এর কথা এখন অতীত, তখন বুঝলাম যে দারুণ কিছু ঘোষণা হতে চলেছে। এর আগে ২৪ মার্চ, মঙ্গলবার রাত আটটার ঘরবন্দির ঘোষণার পরে সবাই বুঝতে পেরেছিলাম যে, সর্বহারা শ্রমিক বলতে কী বোঝায়! ‘একিশ’ বছর যাতে ভারত পিছিয়ে না যায়, সেই জন্যে ‘একিশ’ দিনের জন্য ঘরবন্দি থাকার আদেশ দেওয়া প্রধান সেবক ভুলেই মেরে দিয়েছিলেন যে, শহরগুলিতে কয়েক কোটি শ্রমিক আছে যাদের বন্দি থাকার মতো ঘরই নেই, আর পেট ভরানোর মতো কাজ ও খাবার থাকবে না ওই প্রধান সেবকের ঘরবন্দির আদেশের ফলে। সেই সব শ্রমিকের ধারাবাহিক অবাধ্যতা জানিয়ে দিল, এ দেশে দুটি ভারত আছে। এক ভারত ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে অট্টালিকায় থেকে, আরেক ভারত ওয়াক টু হোম-এ চলেছে পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করে। তাই আত্মনির্ভর ভারতের শ্লোগান দেওয়া প্রধান সেবকের কথায় ভাবলাম, হয়তো তিনি ওই সরকারের ঔদাসীন্যকে উপেক্ষা করে বাস ট্রেন না পেয়ে নিজেদের পায়ের উপর ভরসা করা প্রকৃত আত্মনির্ভর কোটি কোটি শ্রমিকের কথা বলছেন। কিন্তু ৩৫ মিনিটের বক্তৃতায় একবারও তিনি পরিযায়ী, অভিবাসী বা মাইগ্রান্ট শ্রমিকের কথা উচ্চারণ করলেন না, দুঃখ প্রকাশ করলেন না রেললাইনে ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণ দেওয়া ১৬ জন হাঁটতে থাকা শ্রমিকদের কথা, একবারও সেই ১২ বছরের ৩-৪ দিন হাঁটা ১২ বছরের শিশু শ্রমিক জামালো মাকড়ামের কথা উচ্চারিত হল না তাঁর মুখ থেকে। তবে শুনলাম সারা বিশ্বের এই অস্থির সময়ে শোকাবহ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি ভারতকে একবিংশ শতকে শ্রেষ্ঠ বানাতে বদ্ধপরিকর। কোন রাষ্ট্রনায়ক যে সারা পৃথিবীর দু:সময়কে সুযোগ হিশেবে ভাবতে পারেন এই ভেভে আতঙ্কিত হয়েছি, কারণ তিনি আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ঘোষণা করলেন যে, ২০ লক্ষ কোটি টাকার আত্মনির্ভরশীল ভারত প্যাকেজ উপহার দেবে তাঁর সরকার। তবে সাসপেন্সে রাখলেন সকলকে, আগামী দিনে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করবেন সে প্যাকেজ। এও বললেন যে, ঘরবন্দির ৪র্থ পর্যায় চলবে। মানে, উনি যে ২১ দিনের কথা বলেছিলেন সেটা মিথ্যে তো আগেই প্রমাণিত হয়েছে, এখন সেটা ৫৪ দিনকে টপকে হয়তো ৭৪ দিনের পথে অগ্রসর হবে, সেবিষয়েও নির্দিষ্ট ঘোষণা পরে হবে। অর্থাৎ, ৩৫ মিনিটে যা জানা গেল, তা মিনিট পাঁচেকেই জানা যেত। যদি দেশের ২০ কোটি মানুষও ওই বক্তৃতা শুনে থাকেন তাহলে সেই হিসেবে ১০ কোটি মানব ঘন্টা বা, অন্তত ১ কোটি মানব দিবস নষ্ট হল। ন্যূনতম মজুরি হারেও যার মূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি। রাজার খেয়ালে এরকম কতই না নষ্ট হয়।
এরপরে জানা গেল যে, অর্থমন্ত্রী ১৩ মে বিকেল ৪টের সময় ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ উন্মোচিত করবেন। তিনি ও তাঁর শাগরেদ, গোলি মারো শালোকো খ্যাত অনুরাগ সিং দ্বিভাষিক ছবির মত ঘোষণা করতে থাকলেন। তাঁরা এমএসএমই অর্থাৎ মাইক্রো, স্মল এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজের (অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) জন্য ৬টি ঘোষনা করলেন। প্রথমটি বেশ বড়সড় পরিমাণের। ৩ লক্ষ কোটি টাকার। তবে সরকার কিছু দেবে না, ব্যাঙ্ক ও অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নিকারি সংস্থাগুলি ৪৫ লক্ষ এমএসএমইকে তাদের বকেয়া ঋণের সীমার অতিরিক্ত ২০% জরুরি ঋণসীমা হিশেবে প্রদান করবে। যে সমস্ত সংস্থার ২৫ কোটি টাকা অবধি ঋণ আছে ও বিক্রির পরিমাণ ১০০ কোটি টকার মধ্যে তারা এই সুযোগ পাবে। ওই ঋণের সময়কাল ৪ বছর ও মূলধন পরিশোধের উপর ১২ মাসের মরেটোরিয়াম থাকবে। তবে সুদ ওই ১২ মাসেও দিতে হবে। অর্তমন্ত্রী বলেছেন, ৪৫ লক্ষ এমএসএমই এর ফলে উপকৃত হবে। তাহলে প্রত্যেক সংস্থা গড়ে ৬ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকার অতিরিক্ত ঋণসীমা পেতে পারবে। ওই সামান্য অর্থে সংস্থাগুলির দুরবস্থার কী সুরাহা হবে তা বোঝা গেল না। তবে এর জন্য সরকারের কোনো টাকাই খরচ হবে না। ব্যাঙ্কগুলিকে ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে হবে, তবে সরকার ওই ঋনের গ্যারান্টর হবে। দ্বিতীয় ঘোষণাটি হল, রুগ্ন এমএসএমইদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার অধস্তন ঋণ। যে সমস্ত এমএসএমই কর্মরত অবস্থায় এনপিএর অন্তর্ভুক্ত তাদের জন্য শেয়ারের বন্দোবস্ত করা হবে। ব্যাঙ্ক এমএসএমইদের ঋণ দেবে যা মালিক শেয়ারে রূপান্তরিত করবে। ক্রেডিট গ্যারান্টি ফান্ড ট্রাস্ট ফর মাইক্রো এন্ড স্মল এন্টারপ্রাইজেস (সিজিটিএমএসই) ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণের জন্য আংশিক নিশ্চয়তা প্রদান করবে। সরকার সিজিটিএমএসইকে ৪ হাজার কোটি টাকা দেবে। ফলে এই প্রকল্পে সরকারের খরচ ৪ হাজার কোটি টাকা। তৃতীয়ত, ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল তৈরি করা হবে যা এমএসএমইগুলিতে ৫০ হাজার কোটি টাকার শেয়ারের বন্দোবস্ত করবে। চতুর্থত, এমএসএমইর সংজ্ঞাতে পরিবর্তন এনে আগে যে সর্বোচ্চ সীমা ছিল ১০ কোটি টাকা যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ (পরিষেবা ক্ষেত্রে ৫ কোটি টাকা), তাকে বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ বা ১০০ কোটি টাকা অবধি বিক্রিতে পরিবর্তন করা হল। ফলে অনেক তুলনামূলক বড় সংস্থা এমএসএমই-তে পরিণত হবে। ফলে প্রথম বিষয় হিসেবে উল্লেখিত ৩ লক্স কোটি টাকাট ঋণের দাবিদার ারো অনেকে হবে। ফলে ওই ৬৬৭ হাজার ঋণের পরিমাণটিও কমবে। তবে এই চতুর্থ বিষয়টির জন্য সরকারের খরচ নেই। পঞ্চমত, এমএসএমইদের কাজের সুবিধের জন্য ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত সরকারি টেন্ডারের জন্য গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হবে না। এর জন্য সরকারের খরচ নেই। ষষ্ঠত, এমএসএমইদের যোগানের জন্য দেয় অর্থ সরকার ও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলি ৪৫ দিনের মধ্যে মিটিয়ে দেবে। এর জন্যেও কোন খরচ নেই। ফলে এমএসএমই খাতে সরকারের মোট খরচ ১৪ হাজার কোটি টাকাল তবে প্যাকেজে তাকে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী জানান, কর্মচারি ভবিষ্যনিধি খাতে (ইপিএফ)-এ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ের করমচারিদের জন্য নিয়োগকর্তা ও কর্মচারির প্রদেয় অর্থ আরো ৩ মাস, জুন-আগস্ট পর্যন্ত দেওয়া হবে। এরজন্য সরকারের ২,৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এছাড়া অন্যান্য কর্মচারিদের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা ও কর্মচারিদের বিধিবদ্ধ ইপিএফ দেয় ১২% থেকে কমিয়ে ১০% করা হবে ৩ মাসের, জুন-আগস্ট, জন্য। এর ফলে যেটি হল যে, কর্মচারিদের তহবিলে কম টাকা জমা পড়বে। ইপিএফ অবসরের পরে কর্মচারিদের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য তহবিল। তাকে এভাবে কমানো অবশ্যই কর্মচারি স্বার্থ বিরোধী। এর জন্য সরকারের কোনো খরচ নেই। কিন্তু দেখানো হচ্ছে যে, এর ফলে ৬৭৫০ কোটি টাকার নগদ যোগান বাড়বে। ফলে ইপিএফ খাতে সরকারের খরচ ২,৫০০ কোটি টাকা। তবে সরকারি প্যাকেজে তা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ৯, ২৫০ কোটি টাকা হিসেবে।
তিন নম্বরে এসেছে অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি সংস্থা/গৃহ অর্থলগ্নি সংস্থা/অতিক্ষুদ্র অর্থলগ্নি সংস্থা র জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ নগদ সরবরাহ প্রকল্প। এক্ষেত্রে সরকার ওইসব সংস্তাকে বাজার থেকে ঋণ সংগ্রহে সাহায্য করবে। তাদের ঋণকে সরকার নিশ্চয়তা প্রদান করবে। এর জন্য সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় নেই। নিম্ন মানের ঋণ মানের অনুরূপ অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি সংস্থা/গৃহ অর্থলগ্নি সংস্থা/অতিক্ষুদ্র অর্থলগ্নি সংস্থার ৪৫ হাজার কোটি টাকার আংশিক ঋণ নিশ্চয়তা প্রকল্পে সরকারঋণপ[ত্রের ক্ষতির প্রথম ২০% র দায় বহন করার নিশ্চয়তা সরকার প্রদান করবে। এব্যাপারেও কোনো বযয় সরকারের তরফে নেই। ফলে অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি সংস্থা/গৃহ অর্থলগ্নি সংস্থা/অতিক্ষুদ্র অর্থলগ্নি সংস্থার জন্য সরকারের মোট ব্যয় শূন্য, এবং তাকে দেখানো হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকায়।
চতুর্থ এসেছে বিদ্যুত বণ্টন সংস্তাগুলিতে নগদ সরবরাহ। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রদেয় নিশ্চয়তার ভিত্তিতে ৯০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেবে পাওযার ফিনান্স কর্পোরেশন ও রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন কর্পোরেশন। এক্ষেত্রেও কোনো ব্যয় কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। যদিও প্যাকেজে ৯০ হাজার কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পাঁচ নম্বরে এসেছে, কন্ট্রাক্টরদের চুক্তির সময়সীমা ৬ মাস বাড়ানো ও তাদের কাজের সাপেক্ষে প্রদত্ত ব্যাঙ্ক গ্যারান্টির আংশিক মুক্তি করে তাদের নগদ বাড়ানো। গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু সময়সীমার ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। এবিষয়েও সরকারের কোনো খরচ নেই।
ষষ্ঠ বিষয় হিশেবে সুদ, পেশাগত ফি, চুক্তিগত প্রদেয় ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে উৎস মূলে কর আদায়ের পরিমাণে বর্তমান হারের থেকে এক চতুর্থাংশ কম হারে কর আদায়ের কথা বলা হয়েছে। সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী এর ফলে ৫০ হাজার কোটি টাকার নগদ সরবরাহ বাড়বে। তবে যেহেতু অগ্রিম করের হারে কোনো ছাড় দেওয়া হযনি তাই ওই পরিমাণটিও মনে হচ্ছে বাড়িয়ে দেখানো। তবে যাই হোক এক্ষেত্রেও সরকারের কোনো ব্যয় হবে না।
ফলে ১৩ মে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় আর্থিক প্যাকেজে সরকারের মোট ব্যয় ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, কিন্তু প্যাকেজ অনুযায়ী তার পরিমাণ ৫ লক্ষ ৯৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
এর আগে অর্থমন্ত্রী ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় সরকারের দাবি ছিল ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, যা আদতে বাজেট বহির্ভুত হিসেবে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি নয়। এছাড়া করদাতাদের প্রাপ্য ১৮ হাজার কোটি টাকার কর ফেরতকেও কোভিড-১৯ এর জন্য সরকারি ব্যয় বলে দেখানো হয়েছে। জরুরি স্বাস্থ্য সাড়া হিসেবে ১৫ হাজার কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। ফলে সরকারের তরফে মোট ১ লক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয়কে ২ লক্ষ ৩ হাজার কোটি টাকা হিসেবে দেখানো হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে গৃহীত নগদ সরবরাহের বিভিন্ন প্রস্তাবে অনুমিত (তবে কার্যকরী হয়েছে এমনটা নয়) ৫ লক্ষ ২৪ হাজার ৫০ কোটি টাকাকেও কোভিড-১৯ এর জন্য প্যাকেজ হিসেবে ধরা হয়েছে। সম্ভবত, রিজার্ব ব্যাঙ্কের আরো কিছু সাময়িক সুবিধে যেমন ইএমআইের ক্ষেত্রে মরেটোরিয়ামকেও ধরে পরিমাণটা ছয় লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছে দেওয়া হবে। ফলে এ পর্যায়ের প্যাকেজ ঘোষণার আগেই আট কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা হয়ে গেছে, সরকারি হিসেব অনুযায়ী। যদিও সরকারের অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল সাকুল্যে এক লক্ষ পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী পূর্ববর্তী প্যাকেজসমূহ ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রদত্ত নগদ সুবিধেগুলি কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার অন্তর্ভুক্ত। ফলে ১৩ মে পর্যন্ত মোট ঘোষণা হয়েছে প্রায় চোদ্দ লক্ষ কোটি টাকার। যদিও তার জন্য সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে সাকুল্যে এক লক্ষ একুশ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা। সরাসরি ভুখা কর্মহীন জনতার হাতে পৌঁছেছে একটি গ্যাস সিলিন্ডার (সর্বত্র নয়), পরিবার পিছু ১৫০০ করে টাকা (মহিলাদের জনধন হিসেব খাতায়, সকলের তা নেই), দিব্যাঙ্গ ও বয়স্কদের জন্য জনপিছু ১ হাজার টাকা, রেশন দোকান মারফত কিছু চাল ডাল (বন্টনের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় স্তরেই অকর্মণ্যত, দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ)। অভিবাসী বা পরিযায়ী বা মাইগ্রান্ট শ্রমিকদের জন্য কোন ঘোষণা এখনো পর্যন্ত হয়নি। তাঁরা এখনো বিপুল সংখ্যায় শহরগুলিতে রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের জন্য হাপিত্যেস করছেন। কোনো প্যাকেজের স্তোক বাক্যের বদলে তাদের জন্য যদি একটি ট্রেনের টিকিট দেওয়া হয় তাঁরা অন্তত পরিবার পরিজনের কাছে ফেরতে পারেন। ওযার্ক ফ্রম হোমের বিলাস তাঁদের জন্য নয় তা তাঁরা জানেন, ওয়াক টু হোমের স্বাধীনতাও তাঁদের নেই, একটি ট্রেনের টিকিট তাদের দাবি। ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজে ১০০ কোটি টাকার বিক্রির বা ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সংস্থার শ্রীবৃদ্ধি হোক কিন্তু শ্রমিকদের নিজ ভূমে ফেরার ব্যবস্থাকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না কি?
সব শেষে একটি কথা; প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভরতার জন্য ২০ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা ঘোষণা করেছেন। সরকারী খাজানা থেকে ২০ কোটি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারের কাছে পরিবার পিছু ১ লক্ষ টাকা পৌঁছে দিন তাঁদের ব্যাঙ্ক হিসেবে, তাঁদের খরচের জন্য, যে চাহিদা অর্থনীতিতে তৈরি হবে তার দ্বারাই আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব এই কোভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট।
-- অমিত দাশগুপ্ত
২০১৬ সালে ‘লকার রুম বান্টার’ বা ‘বন্ধ ঘরের খিল্লি’ শব্দবন্ধ বহুলভাবে রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সে সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ধনী ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে যেখানে তাঁকে কুৎসিত নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করতে দেখা যায়। নির্বাচনী বাধ্যবাধকতার চাপে ট্রাম্পকে তাঁর মন্তব্যের জন্য তখন ক্ষমা চাইতে হয়। কিন্তু তিনি নিজের মন্তব্যের সমর্থনে “লকার রুম বান্টার” অর্থাৎ বন্ধ ঘরের খিল্লির কথা তোলেন। বলেন, তাঁর মন্তব্য ছেলেদের ব্যাক্তিগত পরিসরে বন্ধুদের নিভৃত আলাপচারিতায় নিতান্তই স্বাভাবিক। এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে বহু জল গড়িয়ে গেছে।ধনপতি ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আমেরিকার সর্বাধিকার-বলে বিশ্ব পুঁজিবাদের দ্রষ্টা পদে আসীন। তাঁর সুহৃৎ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, গত ফেব্রুয়ারী মাসের শুরুতে এই পুঁজিপতি পুরুষতান্ত্রিক ব্যাক্তির আতিথেয়তায় খরচ করেছেন সরকারী তহবিলের ১০০ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারী মাসের গোড়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO কোভি-১৯ মহামারী সম্পর্কে সতর্কবার্তা জারি করলেও আমাদের দেশের সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ ছিল শূন্য। ফেব্রুয়ারী মাসে ট্রাম্পকে নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত যখন মোদী-শাহ তখন অনতিদূরে দেশের রাজধানীতে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর উসকানিতে শুরু হলো সংখ্যালঘু-সম্প্রদায়-নিধন যজ্ঞ। সিএএ-এনারসি-বিরোধী জমায়েতকে উদ্দ্যেশ্য করে উচ্চবর্ণ কপিল মিশ্র হুঙ্কার দিল, “হয় তোমরা জমায়েত খালি কর, নয় আমরা খালি করার ব্যাবস্থা করে নিচ্ছি”। এবং তা কার্যকর করতে পাশের রাজ্য থেকে ঘাতকবাহিনী মোবিলাইজ করল তারা। মারা গেলেন শয়ে শয়ে গরিব মানুষ। তাদের বাড়ি পুড়লো ঘটি-বাটি সমেত, মুসলিম মহিলারা যৌন-হেনস্থার শিকার হলেন, বলাৎকারের শিকার হলেন। গণহত্যার সত্য ধামাচাপা দেওয়ায় বিশেষজ্ঞ শাহ-মোদী। করোনার অজুহাতে বন্ধ করতে চাইলেন সমস্ত নাগরিক প্রতিবাদ। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে দেশ জুড়ে দায়ের হলো অপরিকল্পিত লকডাউন। আজ দুমাস সেই অপরিকল্পিত লকডাউন চলছে। মোদিজী জনগণের কাঁধে একের পর এক ‘টাস্ক’ চাপিয়ে দায় সারছেন। অন্যদিকে দেশের নিপীড়িত জনতা কাজের আস্তানা ছেড়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন শত শত মাইল পথ, ঘরের পথে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। রেশনে চাল নেই, ওষুধ কেনার টাকা নেই, হাতে কাজ নেই। দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতির মৃত্যুতে শিলমোহড় পড়ার অপেক্ষা নিয়ে লকডাউন চলছে। আর এই লকডাউনের মাঝে ফিরে এলো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের একদা আলোচিত লকার রুমের মস্করার প্রসঙ্গ। গত ২ মে থেকে ৪ মে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘বয়েজ লকার রুম’ বিস্ফোরণ ঘটাল মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর চেতনে। দিল্লির অন্যতম অভিজাত স্কুলগুলির ১০-১১ ক্লাসের ছাত্রদের বানানো একটি ইন্সটাগ্রাম গ্রুপের কথোপকথন প্রকাশ করলেন কয়েকজন নারী। সেই তথাকথিত ব্যক্তিগত কথোপকথনে লিপিবদ্ধ ছিল সেইসব ধনী পরিবারে বড়ো হওয়া ছেলেদের নিজেদের সহপাঠী মেয়েদের প্রতি হিংসার উল্লাসভাস্য। ঘনিষ্ঠ পরিসরে এই ছেলেরা শেয়ার করেছেন তাদের চেনা অচেনা বিভিন্ন নারীর ব্যাক্তিগত ছবি। আর এই নারীদের নিয়ে চলেছে ধর্ষণের পরিকল্পনা। এক বন্ধু অপর বন্ধুকে উৎসাহ দিচ্ছে ধর্ষণের, আবার কখনো বা একত্রে ছক বানাচ্ছে গণধর্ষণ সংগঠিত করার। ভারতীয় যুবদের এহেন হিংস্র চেহারা দেখে মানুষ ঠিকঠাক সামলে ওঠার আগেই একের পর এক ভাস্যে প্রকাশ্যে আসতে থাকে এমন অনেকগুলি লকার রুমের কথোপকথনের ইতিবৃত্ত। কলকাতার প্রগতিশীল আখ্যায়িত যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রের বানানো ‘মডেল ইউনাইটেড নেশনস’ ওরফে মান-এর গুগল ড্রাইভে শেয়ার হয়েছে একাধিক মহিলার ব্যাক্তিগত ছবি। প্রগতিশীলতার চূড়ায় বসে থাকা ছাত্রেরা মহিলাদের ব্যাক্তিগত ছবি ‘উপভোগ’ করে থেমে থাকেননি। এই ছবি ব্যবহার করেই হুমকি চলেছে, ছবি ব্যাক্তিগত রাখার পরিবর্তে এরা যৌন সম্পর্ক দাবি করেছেন এই মেয়েদের কাছ থেকে। আরএক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘এসআরএম ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-র ছাত্রদের বানানো অনুরূপ একটি চ্যাট গ্রুপ ‘এসআরএম বিউটিস’-এর অনুরূপ কথোপকথন শেয়ার হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসছে একের পর এক মনখারাপ করা অভিজ্ঞতা। নারীর বয়ানে উঠে আসা এইসব অগণিত ভাষ্যে তাঁদের নিছক যৌনতার বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার, ধর্ষিত হওয়ার, অবদমিত হওয়ার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় হল, এই অপরাধীরা সকলেই তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রেমিক অথবা জ্যেষ্ঠ স্থানীয় কোনো ব্যাক্তি। ক্ষমতার পরিভাষায় বাঁধা সম্পর্কের কৌশলে অপরাধীরা আড়াল করতে চেয়েছে তাদের হিংসা। এই সম্মিলিত হিংসা উদাহরণযোগ্য বটে কিন্তু আকস্মিক নয়। এরূপ নিভৃত পরিসরের পরিহাসগুলি আমাদের অজানা নয়। পরিচিত বন্ধু, প্রতিবেশি, সহপাঠী, সহযাত্রীদের বিভিন্ন আলোচনার টুকরো পৌঁছয় আমাদের মেয়েদের কানে। নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে না পারার ব্যর্থতাকে সাথে নিয়ে এই আলোচনা চলে ভিন্ন লকার-রুমের আলাপচারিতায়। নারীর পোশাক, নারীর সঙ্গী, পেশা, বা সামান্য মতামত সমাজের পিতৃতান্ত্রিক লছমনরেখা পেরলেই নেমে আসে মুহুর্মুহু প্রশ্ন, তিরস্কার বা ঘেন্না। নিয়মভাঙ্গা, গণ্ডি পেরনো মেয়েরা হয় একঘরে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছেও মানব সভ্যতায় নারীকে বেঁচে থাকার নিঃশর্ত স্বাধীনতা পেতে লড়ে যেতে হয় সমাজের শৃঙ্খল মুক্তির লক্ষ্যে। এই নিরন্তর লড়াইয়ের শত্রু পুঁজির নৃশংস দালাল ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র।
পরিবার, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র -- মানুষের জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি ধর্ষণ সংস্কৃতিতে পুষ্ট। লিঙ্গ নির্ধারিত সামাজিক ভূমিকা মানুষ শিখতে শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানগুলির আঙিনায়। পরবর্তীতে ঐতিহ্য বজায় রাখার দায়বদ্ধতায় বা সমাজে গৃহীত হওয়ার তাড়নায় এই স্রোতে ভাসেন মানুষ। ধর্ষণ সংস্কৃতি অর্থাৎ ধর্ষণকে টিকিয়ে রাখার সংস্কৃতি বহমান বর্তমান সমাজের বুকে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নিরন্তর ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে। সামনে দিয়ে চলে যাওয়া মহিলাকে লক্ষ্য করে প্রকট অথবা চাপা উক্তি, বাসে কনুইয়ের ঠেলা, অন্তর্বাস বেরিয়ে পড়লে চাপা হাসি, মহিলার একাধিক পুরুষ বন্ধু থাকা নিয়ে ঠাট্টা, যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মহিলাদের নিকৃষ্ট ঠাওরানো, পুরুষ বন্ধুর মেয়েলি হওয়ার জন্য হাসির পাত্র হয়ে ওঠা, পুরুষ তার নারী সঙ্গীকে মর্যাদা দিলে টিপ্পনি -- এসব তো বন্ধ ঘরে নয় প্রকাশ্য দৈনন্দিন জীবনেই অহরহ পাই আমরা। এগুলিরই স্বাভাবিক বিবর্তন ‘বয়েজ লকার রুমে’ চলা হিংস্রতার উন্মত্ত উল্লাস। ধর্ষণ-সংস্কৃতি তো মঙ্গল গ্রহ থেকে আসে না। এই সহিংসতার নির্মাণ সামাজিক ও রাজনৈতিক। একা একা একে ভাঙাও যায় না। ব্যাক্তির জীবনধারা তার চেতনকে তৈরি করে। ব্যক্তি পরিসরে চলা আলোচোনা, মতামত, সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গুণমান প্রতিফলন ঘটে ব্যাক্তির মধ্যে। সমষ্টির প্রগতির সাথে ব্যাক্তির প্রগতি ঘটে একইসঙ্গে ব্যাক্তির প্রগতির সাথে সমষ্টির প্রগতি হয়। তাই শুধুমাত্র ব্যাক্তিকে অপরাধী ঠাউরে ধর্ষণ-সঙ্কৃতিকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী সমাজের অন্যতম চালিকা শক্তি এই হিংসার সংস্কৃতি যার মাধ্যমে নারীর গর্ভ ও শ্রমকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে রেখে শোষণ-ব্যবস্থাকে নিরন্তর পুনরুৎপাদন করা হয়। ভারতে জাত ব্যবস্থাও টিঁকে থাকে ও পুনরুৎপাদিত হয় এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। বন্ধ চ্যাটরুমে মস্করাচ্ছলে স্কুলছাত্রদের হিংস্র কথোপকথন দেখিয়ে দেয় আমাদের সমাজের কত গভীরে এই নারীবিদ্বেষী হিংস্রতা লালন করি আমরা।
-- সম্প্রীতি মুখার্জী
স্পার্টাকাস জানতেন যে প্রশ্নগুলি বিভিন্ন, কিন্তু উত্তর সবসময়ই এক। আচমকা লক ডাউনের ধাক্কায় কাজ হারাল কারা? – শ্রমিক
আটকে পড়ল কারা, কাদের জোর করে আটকে রাখা হল? – শ্রমিক;
বছরের পর বছর শ্রম দিয়েও বুভুক্ষু অবস্থায় লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে কারা? – শ্রমিক;
ক্ষুধার তাড়না আর পরিবারের ভালোবাসার টানে গরে ফিরতে হাজার মাইল পথ হাঁটছে কারা? – শ্রমিকেরা;
দম ফুরিয়ে রাস্তায় মারা যাচ্ছে কারা? করা গাড়ি উল্টে মারা যাচ্ছে? – শ্রমিক;
স্যানাইটিজেশনের নামে শরীরে কীটনাশক স্প্রে নিতে বাধ্য হল কারা? – শ্রমিকেরা;
কাদের লাঠিপেটা করা হল? বাচ্চার দুধ আর রেশন চাওয়ায় কারা পুলিশের হামলা সইল? – শ্রমিক;
অসহ্য অপমানে আত্মহত্যা করল কারা? – শ্রমিক;
কারোনার পরীক্ষা করাতে এখানে ওখানে হন্যে হয়ে ছুটোছুটি করতে হয়েছে কাদের? – শ্রমিকদের;
কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা না থাকায় গাছে চড়ে বসবাস করতে বাধ্য হল কারা? – শ্রমিক;
ডিটেনশন ক্যাম্পের মতো আটক করে রাখা হল কাদের? – শ্রমিকদের;
মুরগির খাঁচার মত ঘরে গাদাগাদি করে আছে বলে দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করা হল কাদের? – শ্রমিকদের;
মালট্রেনের চাকায় পিশে গেল কাদের জীবন? – শ্রমিকের;
কারা এইসব নগর আর মেট্রো তৈরি করেছে? আমাদের বাড়িঘর তৈরি করেছে, সাফাই করেছে, আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং খাদ্য উৎপন্ন করেছে আর বয়ে নিয়ে এসেছে কারা? – শ্রমিক;
এবং তারপর একদিন সরকার বৈঠকে বসল সেইসব মালিকদের সাথে যারা ছুটির মৌতাতে কাটিয়েছে মহামারি-লকডাউন এবং এখন বলছে ওদের মুনাফার ‘ক্ষতি’ শ্রমিকদেরই পূরণ করতে হবে!
৮ ঘণ্টার পারিশ্রমিক দিয়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে বলা হচ্ছে কাকে? – শ্রমিককে;
কাদের অধিকার তিন বছরের জন্য স্থগিত করে দেওয়া হল? – শ্রমিকের;
স্পার্টাকাস, একশ ছাব্বিশ বছর পর আরেক মে দিবসের সমকালে, শিকাগো শহর থেকে অনেক অনেক মাইল দূরে নতুন করে আবার দাসে পরিণত করা হচ্ছে আপনাকে।
স্পার্টাকাস, বিদ্রোহে রুখে দাঁড়িয়ে একথা আপনি জেনে গেছিলেন যে, এই বিশ্ব কেবলমাত্র শ্রমিকেরাই বদলাতে পারে।
- রাধিকা মেনন
বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আনিসুজ্জামান প্রয়াত হলেন ১৪ মে, ২০২০ তারিখে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল চুরাশি বছর। ৫২ র ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী আনিসুজ্জামানের জন্ম হয় ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাটে। কোলকাতার পাক সার্কাস হাইস্কুলে তাঁর পড়াশুনো শুরু। পরে পরিবারের সঙ্গে তিনি চলে যান খুলনা জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৯ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষাকতা শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার পর পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণা করেন আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিষয় ছিল “বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল”। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি পড়িয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গবেষণার কাজ ও অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আনিসুজ্জামান যুক্ত ছিলেন নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান ষ্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনষ্টিটিউট অব এশিয়ান ষ্টাডিজ কলকাতা, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নথ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনষ্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি শিল্পকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা যামিনী এবং বাংলা মাসিকপত্রকালি ও কলম এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলার অগ্রগণ্য প্রাবন্ধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে আছে “মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য” (১৯৬৪) “মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র” (১৯৬৯) পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪) আমার একাত্তর (১৯৯৭) মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮) আমার চোখে (১৯৯৯)। তাঁর শিক্ষক মহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মুনীর চৌধুরীর জীবনীগ্রন্থও তিনি রচনা করেছিলেন। তাঁর সম্পাদনাতেও অনেকগুলি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭০ সালে তিনি পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কার, ১৯৯৩ সালে পান আনন্দ পুরষ্কার।
ঢাকার বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর অবদান ছিলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থ এবং কোষগ্রন্থ প্রণয়নে এই সময়ে ঢাকার বাংলা একাডেমি উল্লেখযোগ্য নজির রাখে। এই সমস্ত কাজে দুই বাংলার সারস্বত সমাজকে তিনি একসঙ্গে এনেছিলেন।
কদিন আগে আমরা হারিয়েছিলাম কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক রুশ ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ হরি বাসুদেবনকে। তাঁর অনতি পরেই আমরা হারালাম অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। আরো রিক্ত হলো বাংলার সাংস্কৃতিক জগত।
বাংলার বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী আনিসুজ্জামানের প্রতি রইলো আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) লিবারেশন
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি
১৪/০৫/২০২০
একই দিনে চলে গেলেন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের দুই স্তম্ভ। বাংলাদেশের আনিসুজ্জামান এবং এই বাংলার দেবেশ রায়। দুজনেই ছিলেন চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী। এমন ধরনের লেখক যাঁদের লেখার মূল ভিত্তি গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসা।
আনিসুজ্জামানের মতো দেবেশ রায়ও ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক। সৃজনশীল কথাসাহিত্য ও মননশীল গবেষণা কর্মকে মেলানোর এক বিস্ময়কর দক্ষতা পাওয়া যায় তাঁর লেখালেখির মধ্যে।
দেবেশ রায় ঊনিশ শতকের বাংলা সাংবাদিক গদ্য বা রবীন্দ্রনাথের আদি গদ্য নিয়ে যে বইগুলি লিখেছেন সেগুলিই যে শুধু পূর্ণাঙ্গ গবেষণা গ্রন্থ তা নয়। তাঁর যে কথাসাহিত্যের জগত, সেটিও ব্যাপক গবেষণা কর্মের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়ে উঠত। এর প্রমাণ রয়েছে তাঁর তিস্তাপারের বৃত্তান্ত বা বরিশালের যোগেন মণ্ডলের মতো মহাকাব্যিক রচনাগুলিতে।
উপন্যাস প্রকরণটি নিয়ে তিনি ভেবেছেন গভীরভাবে। এর ছাপ রয়েছে “উপন্যাস নিয়ে” বা “উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে”র মতো বইগুলিতে। এ কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস তাত্ত্বিক রুশ লেখক মিখাইল বাখতিনের উপন্যাস ভাবনা নিয়ে যাঁরা বাংলায় আলোকসম্পাতি লেখা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে দেবেশ রায় অগ্রগণ্য।
বহুস্বর বা পলিফনি এবং নানামাত্রিক সংলাপের বিনিময় বা ডায়ালজিক বৈশিষ্ট্য কীভাবে উপন্যাসের আত্মা নির্মাণ করে, তার ব্যাখ্যা সূত্র হাজির করতে করতে দেবেশ রায় আধুনিক সময় ও শিল্প সাহিত্যের মৌলিক নন্দনতত্ত্বকে বিশ্লেষণের জায়গায় চলে যান।
ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষটি বরাবরই নীচুতলার মানুষের সংগ্রামকে ছুঁয়ে থেকেছেন জীবন ভাবনায়। না হলে তিস্তার ধারের বাঘারুদের এইরকম জীবন্ত রূপায়ণ সম্ভব হত না। বাঘারুদের চোখ দিয়ে উন্নয়নকে, তার শ্রেণি দৃষ্টিকোণটিকে প্রশ্ন করতে শেখান তিনি।
২০১০ সালে প্রকাশিত হল দেবেশ রায়ের সুবৃহৎ উপন্যাস “বরিশালের যোগেন মণ্ডল”। নিকট ইতিহাসকে অবলম্বন করে লেখা এই উপন্যাসের কালপর্ব মোটামুটিভাবে স্বাধীনতার আগের দুটি দশক। সময়টা একদিকে যেমন ঘটনাবহুল, তেমনি নানা বিতর্কের আধার। যোগেন মণ্ডল বাংলার রাজনীতি বা ইতিহাসের আলোচনায় মাঝে পরিণত হয়েছিলেন এক বিস্মৃত মানুষে। খুব সম্প্রতি তাকে নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে। আর সেই চর্চায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাধারার পাশাপাশি দেবেশ রায়ের এই উপন্যাসটির একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে।
দেবেশ রায় গোটা আখ্যান জুড়ে অনুপুঙ্খ বিস্তারে দেখাতে থাকেন যোগেন মণ্ডল বরিশালের মাটি থেকে উঠে এসে কীভাবে গোটা উপমহাদেশের রাজনীতিতে বড়সড় প্রভাব ফেলছেন। বিশেষত বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন কীভাবে তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের সময়ে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, তখন যোগেন মণ্ডলের বয়েস ৩৩। আইনসভায় প্রবেশের পর যোগেন্দ্রনাথ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেন। বিভিন্ন দলের (বা নির্দল) প্রতিনিধি হিসেবে মোট ৩১ জন তপশিলী প্রার্থী আইনসভায় বিজয়ী হয়ে এসেছিলেন। দল-নিরপেক্ষভাবে তপশিলী প্রতিনিধিদের একটি মঞ্চে যোগেন মণ্ডল সমন্বিত করেন। বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের জাতের স্বার্থে যেন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন - এটাই ছিল এই সমন্বয়ের মূল লক্ষ্য। তাঁর ঘোষণা ছিল নমঃশূদ্রদের স্বার্থে কাজ হলে তাঁরা সরকারকে রাখবেন, নচেৎ তার বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার ফেলে দেবার চেষ্টা করবেন। দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাসে দেখিয়েছেন বাংলার আইনসভায় নমঃশূদ্র ব্লকের এটাই ছিল প্রথম স্বাধীন আত্মঘোষণা।
দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপক্লিষ্ট সময়ের ছবি সাহিত্যে কীভাবে ধরা পড়েছে, তার পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরেন সম্পাদক দেবেশ রায়। তাঁর সম্পাদিত এবং সাহিত্য অকাদেমী থেকে প্রকাশিত দু-খণ্ডের সংকলন গ্রন্থ “রক্তমণির হীরে”র একটি খণ্ডে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের থেকে চয়ন, অন্যটি বাংলা ছাড়া বাকি ভারতের সাহিত্য থেকে চয়ন। দেবেশ রায়ের মূল্যবান ভূমিকা বিষয়টির অসামান্য প্রবেশক হিসেবে আমাদের সামনে থাকে। একই কথা বলা যায় দস্তয়েভস্কির “অপরাধ ও শাস্তি” উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থটিতে তাঁর লেখা ভূমিকাটি প্রসঙ্গে।
দেবেশ রায় একই সঙ্গে ছিলেন সাহিত্যিক ও সাহিত্য চিন্তক। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্যের পথচলা। অসুস্থ হবার আগে অবধি সেই সক্রিয়তা বজায় ছিল ছয় দশক ধরে। বাংলা সাহিত্যের মননশীল পাঠককে বারবার ফিরে যেতেই হবে তাঁর সৃজনের কাছে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন এর পক্ষ থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক তথা চিন্তাবিদ দেবেশ রায়ের প্রয়াণে আমরা গভীর শোক ব্যক্ত করছি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি
১৪/০৫/২০২০
চলে গেলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হরিশংকর বাসুদেবন। শুধু ভারত নয় গোটা বিশ্বের বামপন্থা তথা কমিউনিজমের ইতিহাসচর্চায় তিনি এক বিরাট স্তম্ভ বলে পরিগণিত হতেন। ২০১৭ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করে “হিস্ট্রি অব কমিউনিজম” নামের তিন খণ্ডের বিখ্যাত বইটি। সেখানে বিশ্বের অন্যান্য কৃতবিদ্য পণ্ডিতদের পাশে লিখেছিলেন হরি বাসুদেবনও। ভারতের কমিউনিজমের ইতিহাস লেখার ভার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকেই অর্পণ করেন।
অধ্যাপক বাসুদেবন কেমব্রিজের ক্রাইস্টস কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু বিদেশে না থেকে দেশের ইতিহাসচর্চাকে সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে নিয়ে ফিরে আসেন ভারতে। অধ্যাপনা শুরু করেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন খুব জনপ্রিয় এক শিক্ষক। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল রুশ ইতিহাস, বিশ্বের ইতিহাসে রুশ সমাজতন্ত্রের প্রভাব, রুশ-ভারত সম্পর্ক এবং সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতি। ভারত ও রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সামরিক প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে হরি বাসুদেবনের গবেষণা গোটা পৃথিবীতেই এই সংক্রান্ত বিশিষ্ট কাজের উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত সমাদৃত। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ওপর রুশ বিপ্লব কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাই নিয়ে ২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল রিভিউতে তাঁর লেখা প্রবন্ধ বেশ আলোড়ন তুলেছিল। রাশিয়ার পাশাপাশি চিন সংক্রান্ত চর্চাতেও তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট পণ্ডিত। ২০১৫ সাল থেকে আমৃত্যু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিনা সেন্টারের ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। ছিলেন কোলকাতার ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের বর্তমান সভাপতিও।
৪ মে তারিখে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে থাকার পর অবশেষে ৯ মে শনিবার অধ্যাপক হরি বাসুদেবন প্রয়াত হলেন। মাত্র আটষট্টি বছর বয়সে তাঁর এই অকাল প্রয়াণ সাধারণভাবে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এবং বিশেষভাবে বামপন্থার ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এক বিরাট ক্ষতি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) লিবারেশন এর তরফ থেকে আমরা এই কৃতবিদ্য ইতিহাসবিদের প্রয়াণে শোক জ্ঞাপণ করছি। তাঁর লেখালেখি ও ইতিহাস অনুসন্ধান আমাদের পথ চলায় সাহায্য করবে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) লিবারেশন
১০ মে, ২০২০
‘হ্যারি’-র পুরো নাম যে হরিশঙ্কর তা জানতে পারলাম চিরকালের জন্য ও আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত ওর মৃত্যুসংবাদ জ্ঞাপনের দৌলতে। ওর নাম যে হরি (উচ্চারণ অনেকটা ইংরেজি hurry-র কাছাকাছি) তা নামের বানান Hari থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু আমি এবং আমাদের বন্ধু-মহলের অনেকেই ওকে ডাকতাম ‘হ্যারি’ (Harry) বলে। ওর চলনবলন, দুরন্ত ইংরেজি উচ্চারণের সঙ্গে হয়ত হরি নামটা ঠিক খাপ খেত না। ইংরেজিয়ানাটা ছিল এতটাই ওর মজ্জাগত, একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার।
হরি বাসুদেবনের (Hari Vasudevan) সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেই আশির দশকের গোড়ার দিকে (১৯৮২)। তখন আমি সদ্য দেশের রাজধানীর পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরেছি। আর, হরি এ শহরে পা রেখেছে বছর চারেক আগেই (১৯৭৮), কেম্ব্রিজে পড়াশুনার (বিএ থেকে পিএচডি) পালা শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। যোগাযোগটা হয়েছিল মনে হয় ওর ছোট ভাই রবির (Ravi) মধ্যস্থতায়, যদিও রবি তখন ছিল (এখনো থাকে) দিল্লিতে। দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিল্ম থিয়োরিস্ট (আমার মতে), রবি বাসুদেবনের সাথে আমার দোস্তি যৌবনের শুরু থেকেই। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় আমরা দু’জনেই হয়ে পড়েছিলাম সিনেমা-উন্মাদ। দিনের পর দিন পাগলের মতো ছবি দেখা, সারারাত ধরে সেই ছবির মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ, আলোচনা-তর্ক, এর সাথে ‘সেলুলয়েড’ ফিল্ম সোসাইটির দায়িত্ব সামলানো, ‘ফিল্ম-আইকন’ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদনা এবং প্রকাশনার কাজ ইত্যাদি দু’জনে একসাথে করার সুবাদে রবি আর আমার বন্ধুত্বের বন্ধন জমাট, শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছিল।
হয়ত, সেই কারণেই হরির কথা লিখতে বসে মনে পড়ছে রবির কথা। রবিকে বাদ দিয়ে আমি হরিকে ভাবতে পারি না। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছিল অদ্ভুত সাদৃশ্যও, যেন একজন আরেকজনের প্রতিচ্ছবি। শুধু চেহারার মিল নয়, সেই একইরকম কথা বলার ভঙ্গী, একইরকম প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তব্য রাখা, একইরকম বাকপটুতা। দু’জনেরই চোখেমুখে অগাধ পড়াশুনা ও বুদ্ধির ছাপ, দু’জনের মধ্যেই স্বাভাবিক রসবোধ ও উন্নত, সংস্কৃতিমান রুচির অভিব্যক্তি।
প্রথম সাক্ষাৎটা হয়েছিল আমার বাড়িতে। হরি আসার আগে, মনে পড়ছে, আমি কিছুটা সন্দিহানই ছিলাম। একে বন্ধুর অগ্রজ, তায় উঠতি অধ্যাপক, তার ওপর বিলেত-ফেরত। কে জানে কেমন হবে মানুষটি! হরি পৌঁছাবার কিছুক্ষনের মধ্যেই কিন্তু আমার আশঙ্কা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। ফ্রেঞ্চকাট, মোটা ফ্রেমের চশমা, সুদর্শন; তার সাথে প্রাণখোলা হাসি, সূক্ষ্ম রসিকতা – সব মিলিয়ে হরির মধ্যে একজন মনোহরণকারী যুবকেরই সন্ধান পেয়েছিলাম। নিমেষেই আমরা বন্ধুত্বে জড়িত হতে পেরেছিলাম।
কোনও সিরিয়াস কথা হয়নি সেদিন। এটা-ওটা, কলকাতার স্ট্রীট ফুড, লোডশেডিং, আবহাওয়া, ক্রিকেট এসবই ছিল ঘণ্টা তিনেকের কথোপকথনের বিষয়বস্তু। এর পর নানান জায়গায়, নানান পরিস্থিতিতে হরির সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন গড়িয়াহাট মোড়ে আমাকে দেখতে পেয়ে ভিড় মিনিবাস থেকে সীট ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল। হরি এরকমই।
ওর জীবনসঙ্গিনী ছিলেন তপতী গুহ ঠাকুরতা -- আর্ট হিস্টোরিয়ান এবং ইদানিংকালে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্স-এর অধিকর্তা। তপতী আবার আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার বোন। সুতরাং, হরির সাথে, কখনো সপরিবারে, দেখা হতই। ছোটখাটো আড্ডাও হয়ে যেত অনেক সময়ে। কিন্তু জ্ঞানগম্ভীর ও তাত্ত্বিক বিষয় কিংবা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা কখনো হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না।
হরি ছিল ইউরোপীয় ইতিহাস, বিশেষ করে রুশীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ। শুনেছি, এ বিষয়ে এদেশে ও-ই ছিল শেষ কথা। ১৯০৫-র বিপ্লব ও ১৯১৭-র দু’দুটি বিপ্লব, বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ার পরিস্থিতি, লেনিনের মৃত্যুর পর ক্ষমতার লড়াই, স্তালিন-ট্রটস্কি দ্বন্দ্ব, যৌথ খামার ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে বর্ণিত সোভিয়েত সমাজ ও নারীর ক্ষমতায়ন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার গৌরবোজ্জল ভূমিকা, সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ অভিযান, স্তালিনের জীবনাবসান ও ক্রুসচভের উত্থান, চীন-রাশিয়া বৈরিতা, রাশিয়ায় পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তন এবং অবশেষে নব্বইয়ের দশকের দোরগোড়ায় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের করুণ পরিণতি – ইচ্ছে ছিল এসব নিয়ে হরির বক্তব্য শুনব একদিন। সেটা আর হয়ে উঠল না। সংবাদপত্রে অথবা ওয়েবসাইটে কদাচিৎ ওর যেক’টা লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছিল, তাতে এ বিষয়গুলির উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। লেখাগুলি ছিল বিপ্লবের অনেক আগে, উনিশ শতকের রাশিয়া সংক্রান্ত অথবা একেবারে হাল আমলের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। তবে, ইয়েলৎসিনের প্রতিবিপ্লবী ক্যু (১৯৯০) সম্পর্কে সংবাদপত্রে একটি চমৎকার লেখা, মনে আছে, বেশ সাড়া ফেলেছিল।
আসলে, হরি ছিল আদ্যপান্ত নিরপেক্ষ একাডেমিক। কোনও মতাদর্শগত অবস্থান ওর না-পসন্দ। যে কোনও বিতর্ক থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করত। ওর সুযোগ্য ছাত্র এবং ইতিহাসের শিক্ষক বেঞ্জামিন জাকারিয়া ঠিকই বলেছেন যে হরি ছিলেন অ-কমিউনিস্ট (non-communist), কিন্তু কমিউনিস্ট-বিরোধী (anti-communist) নন। বেঞ্জামিন আরও বলেছেন, হরি ছিলেন একজন ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবি, উত্তর-ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার ধারার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
হরি ফ্রানজ ফ্যানো হয়ে ওঠেনি। প্রতিরোধের তত্ত্ব নির্মান এবং সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মের প্রতি অনীহা ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে ওর মধ্যে কোনও দ্বিধা ছিল না, বিদ্বেষ-বিভাজন কিংবা ঘৃণা-হিংসার রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পথে নামতেও দেখা গেছে ওকে। এইতো, হরি-তপতীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল গত ডিসেম্বর মাসে মধুসূদন মঞ্চের সামনে অনুষ্ঠিত সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী একটি প্রতিবাদী জমায়েতে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকায় হরির কাছে সময়ও ছিল অল্প। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট ফর এসিয়ান স্টাডিজ-এর ডিরেক্টর, ইন্সটিটিউট ফর ডেভেলাপমেন্ট স্টাডিজ-এর প্রেসিডেন্ট, এনসিআরটি-র টেক্সটবুক ডেভেলাপমেন্ট কমিটি-র চেয়ারম্যান, অবসার্ভার রিসার্চ গ্রুপ-এর ডিস্টিডিস্টিংগুইশড ফেলো ইত্যাদি নানান প্রতিষ্ঠানের নানান গুরুত্বপূর্ণ পদের দায় ওকে সামলাতে হয়েছে। পূর্বতন ইউপিএ সরকারের বিদেশ নীতি ও রুশ-ভারত সম্পর্ক নির্ধারণেও হরির পরামর্শ ছিল অবধারিত। শুনেছি, ভারত ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে গবেষনাও শুরু করেছিল, কাজও নাকি এগিয়েছিল অনেকটাই। এছাড়া, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের রাশিয়া কানেকশন সম্পর্কিত নানা ডক্যুমেন্টস উদ্ধারের কাজেও হরি হাত লাগিয়েছিল।
হরির আসল নেশা ছিল ওর পেশাই। ছাত্র পড়ানোতেই ওর আনন্দ। ওর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্ররা জানিয়েছে, স্যার ছাত্রদের তার সমকক্ষ মনে করতেন, ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে কোনও ফাঁটল উনি মেনে নিতে পারতেন না। তাই ওর চলে যাওয়াটা ওর ছাত্ররা মেনে নিতে পারছে না। ছাত্র-শিক্ষকের মাঝের ফাঁটল এখন কে বোজাবে? এভাবে অসময়ে হরির চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল শিক্ষা জগতের।
আর, আমি হারালাম আমার এক বন্ধুকে। করোনার কাছে হেরে গিয়ে আমাদের ‘হ্যারি’ চলে যাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
– সুমিত
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীতে ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হয় ৮ মার্চ ২০২০। এরপর থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠক শেষে বিশেষজ্ঞরা যখন বলেছেন ‘সারাবিশ্ব এই মহামারীর ঝুঁকিতে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়’ তখন সরকার ২৫ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
২৪ মার্চ ২০২০ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা সাধারণ ছুটির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রয়োজনে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু রাখা যাবে। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন কিন্তু কারখানা বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত রইলেন। বেতন দেওয়ার বোঝাটা সরকারের মাধ্যমে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে গার্মেন্টস মালিকদের দুই সংগঠন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ‘আরো বড়’ প্যাকেজ দাবি করে বললো ‘বিজিএমইএ’র কারখানা বন্ধের বা খোলার এখতিয়ার নেই। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। এ অবস্থায় কারখানা বন্ধ করা হবে না -- জানালেন রুবানা হক। ২৬ মার্চ বিজিএমইএ সরকারী ছুটির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার আহ্বান জানান এবং রুবানা হক বলেন মার্চের বেতন মালিকেরা দেবেন, এপ্রিলের বেতন প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা থেকে দেওয়া হবে।
গার্মেন্টস কর্মীরা ফেব্রুয়ারী মাসের বেতন মার্চের ১০/১২ তারিখে পেয়েছে। কিন্তু ওভারটাইমের কোনো টাকা পায়নি। ১৫ দিন বিনা মজুরিতে কাটলেই শ্রমিকের হাতে আর টাকা থাকে না। গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ ঘোষণা করলেও বেতন হবে কি না তা কেউই জানে না। হাতে টাকা নেই, চারিদিকে করোনা আতঙ্ক। সব মিলিয়ে দিশেহারা শ্রমিক। তাদের তো রেশনের ব্যবস্থাও নেই। মধ্যবিত্তের মতো সঞ্চয় সম্পদ কিছুই নেই। তারপরেও যেসব কারখানা ছুটির আওতায় পড়ল সেই শ্রমিক রিক্ত হস্তে ফিরে গেল গ্রামে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন মার্চ মাসের বেতনসহ আরও ২ মাসের বেতন অগ্রীম দেওয়ার জন্য মালিকপক্ষকে অনুরোধ জানালেও তাতে কর্ণপাত করা হলো না।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় কারখানা বন্ধের কোনো নির্দেশনা ছিল না। বিধায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা খোলা যাবে; এই প্রেক্ষিতে যারা পিপিই, মাস্ক, স্যানিটাইজার সহ করোনা প্রতিরোধী সামগ্রী উৎপাদন করছে সেসব কারখানা বন্ধের কোনো নির্দেশনা এল না। শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হলো। এর মধ্যেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম সহ বড় বড় শহরগুলো লকডাউন করে দেয়া হলো।
লকডাউন পরিস্থিতিতেই দলে দলে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ঢাকার আশেপাশের ও দূরবর্তী জেলা থেকে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে, অটোরিকশায় ও ভ্যানে করে অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফিরেন। কারণ তাদের বলা হয়েছিল ফ্যাক্টরি খুলবে এবং তাদের বেতন দেয়া হবে। যে করোনার উদ্বেগ থেকে বাঁচতে তারা শহরের ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে গ্রামে গিয়েছিলেন সেখানেই আবার ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। তাদের ঢাকায় ফেরার অমানবিক দৃশ্য নিয়ে যখন সমালোচনার ঝড় বইল ঠিক তখনই ঢাকা পুরোপুরি লকডাউন করে দেয়া হলো। তাদের ছুটি বাড়ানোর নোটিশ পেলেও তারা গ্রামে ফিরতে পারলেন না। কেউবা আবার পণ্যবাহী পরিবহনের কাপড়ের নীচে, ড্রামের ভিতর নিজেদের ঢুকিয়ে লুকিয়ে ঢাকা ছাড়লেন। কারণ বাসার মালিকরাও এ মুহূর্তে তাদের থাকতে দিচ্ছে না। পোশাক শ্রমিকরা যেন মাঠের খেলোয়াড় তাদের মাঠে ছেড়ে দিয়ে সরকার ও মালিকরা বড় বড় ভবনে বসে খেলা দেখছে। তারা মরলেই কী, বাঁচলেই কী?
২৬ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং পরে মেয়াদ ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পুনরায় ২৬ এপ্রিল কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক আনার জন্য বিআরটিসি’র কাছে বাস বরাদ্দ চান বিজিএমইএ। তারা আরও জানায় ২০ এপ্রিলের মধ্যে সব শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হবে এবং তারা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানা লে-অফ ঘোষণা করলে তাদের শ্রমিকদের লে-অফের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সরকারের হুশিয়ারীর পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩৭০টি কারখানার মালিক কোনো বেতন পরিশোধ করেনি। চলমান সংকটের মধ্যেই ৫৫টি কারখানার ২৬ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।
২৬ এপ্রিল থেকে কারখানায় আসার জন্য বিভিন্ন কারখানার মালিক শ্রমিকদের ফোন দিয়ে তাদের আসতে বলে। কাজ বাঁচানোর তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। ২৬ এপ্রিল থেকে শুধু ঢাকার শ্রমিকদের দিয়ে কিছু কারখানা চালানো হবে। তবে ধীরে ধীরে এখন সবগুলো খুলে দেয়া হয়েছে এবং ৯০%-এর বেশি শ্রমিক নানা ঝুঁকি নিয়েই কারখানায় যোগ দিয়েছে।
সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্যায়ক্রমে চার দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হলেও পোশাক শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে পেটের তাগিদে কাজে যোগ দিলো। কাজে যোগ দেওয়ার আগে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব নিয়ম রক্ষার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কারখানায় ঢোকার সময় সামান্য ডেটল মেশানো পানি, কোনো ক্ষেত্রে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার পর ভেতরে ঢুকে কোনো রকম শারীরিক দূরত্ব না মেনেই কাজ করে চলছে লাখো শ্রমিক। একটা পোশাক বানানোর পর অন্তত সেটা কম হলেও দশজনের হাতে হাতে ঘুরছে। এতেও সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিটি ফ্লোরে ২০টি করে টয়লেট আছে। সেখানে দশটি পুরুষ এবং দশটি নারী শ্রমিকদের জন্য। এখানেও সংক্রমণ এড়ানো অসম্ভব। কাজ শেষে প্রতিটি কর্মী সেই ঘিঞ্জি বাসায় বাস করছে ৭/৮ জন করে। কোনোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ২৬ এপ্রিলের পর এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক শ্রমিক সংক্রমিত হয়েছে।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার পরই এখানে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। ঠিক একইভাবে সব জায়গাতেই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। দিন দিন সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদিকে গার্মেন্টসের উচ্চপদের অফিসাররা মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হেলমেট, পিপিই পরে এসি রুমে বসে সেলফি তুলে ষ্ট্যাটাস দিচ্ছেন ‘সেফটি ফাস্ট’।
আক্রান্ত কর্মীদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে ডাক্তাররা পর্যন্ত তাদের ধারে কাছে আসছেন না। এভাবে প্রতিটি কারখানায় আক্রান্ত হচ্ছে কর্মীরা। কিন্তু কোনো চিকিৎসা তো দূরের কথা কাজের টাকাও পাচ্ছেন না তারা। উপরন্তু বিভিন্নভাবে তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বেতন কেটে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এপ্রিলে মাত্র ৬০% বেতন দেওয়া হবে। যেখানে সরকারী কর্মচারিরা সাধারণ ছুটির সময় বাড়িতে বসে পূর্ণ বেতন পাচ্ছেন সেখানে পোশাক শ্রমিকদের সাথে করা হচ্ছে বৈষম্যমূলক আচরণ। ব্যবসায়ী দ্বারা পরিবেষ্টিত সরকার শুধু মুনাফা দেখছেন মানুষ দেখছেন না। একটা লাশ হয়তো সরকারের কাছে একটি সংখ্যা কিন্তু তার প্রিয়জনের কাছে পুরো পৃথিবী। সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ঘোষণা যে নেহাতই কথার কথায় পরিণত হয়েছে তা এখন আর অপ্রকাশিত নেই কোথাও। গার্মেন্টস মালিকদের পর এবার সরকার অন্য ব্যবসায়ীদের চাপের কাছেও নতি স্বীকার করেছে।
করোনা বিরোধী এ সময়েও তথ্যের বিপরীতে অপতথ্যের বিশাল রমরমা। সরকারী প্রচারণাও এর ব্যতিক্রম নয়। অপ্রতুল তথ্যের বিষয়টি সঠিক তথ্য ও পর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে মোকাবেলা করা যায়। কিন্তু মিথ্যা বাক্য বিন্যাসে আর বানোয়াট বক্তব্যে অপপ্রচার চালিয়ে তারা আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা আড়াল করছে। করোনায় অসহায় মৃত্যু দেখছি। কিন্তু থেমে নেই আমাদের উচ্ছৃঙ্খলতা, হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, লুট, আত্মসাৎ, প্রতিহিংসা পরাণয়তা।
করোনা পরবর্তী সময়ে নতুন বিশ্ব দেখার আশা করছেন সবাই। বিশ্ব নাকি বদলে যাবে। কেমন হবে সেই বিশ্ব? এত মৃত্যু, এত কান্না, এত দীর্ঘশ্বাসে কি আমরা শুদ্ধ হবো? করোনা ভাইরাসের মতো নিমূর্ল হয়ে যাবে এই করোনা ভাইরাসরূপী মানুষগুলো!
করোনা দুর্যোগে গার্মেন্টস শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষ আরো একবার এই অমানবিক নিষ্ঠুর রাষ্ট্র, সরকার ও মালিকদেরকে চিনে নিয়েছে।
-- স্নিগ্ধা সুলতানা ইভা
লেখক: বাংলাদেশ শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর যুগ্ম সম্পাদক
ঢাকা ১১/০৫/২০২০