(কোনো লেখা এককভাবে পড়ার জন্য হেডিং-এর উপর ক্লিক করুন)
আমাদের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতন্ত্রের বয়স নয় নয় করে ৭২-৭৩ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এক আজব রীতি আমাদের পিছু ছাড়েনি। দেশের যেকোনো প্রান্তে ভূমিকম্প হোক, সুপার সাইক্লোন হোক, বন্যা হোক, বা আমপানের মতো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় হোক, তা দেখতে আকাশপথে দিল্লির নর্থ বা সাউথ ব্লকের কোনো সর্বোচ্চ পদাধিকারী পরিদর্শনে আসেন। অবশ্য কবে আসবেন বা আদৌ আসবেন কিনা তা নির্ভর করবে, “এটা পলিটিক্যালি কারেক্ট হবে কিনা”, সহজ ভাষায় বললে, এতে রাজনৈতিক লাভ কতটা হবে তার উপর। রাজ্যের প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গ তখন বিপর্যস্ত মানুষের কথা ছেড়ে কখন ও কোথায় তিনি নামবেন, কে কে তাঁকে স্বাগত জানাতে ফুলের তোড়া ও উত্তরীয় নিয়ে হাজির থাকবেন, হ্যালিপ্যাড কোথায় তৈরি হবে ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে দান, অনুদান ও খয়রাতির ব্যাপার-স্যাপার। এই এলাহি আয়োজনের খরচপত্রের কথা সরিয়ে রেখেও প্রশ্ন জাগে এই দৃষ্টিকটু রীতির অবসান কবে হবে, কীভাবে হবে??
আমফান দুর্গত রাজ্যবাসীর পাশে থাকুন। বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে আপনাদের সাহায্য পাঠাতে পারেন নীচের...
Posted by CPIML Liberation, West Bengal সি পি আই এম-এল লিবারেশন, পশ্চিমবঙ্গ on Sunday, 24 May 2020
আমপান বিধ্বংসী ঝড়ও রাষ্ট্র, প্রশাসন, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, উদ্যোগ কী ধরনের, কতটা কার্যকরী তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। পুঁজির মুনাফা প্রধান যে উন্নয়নের নীতি নিয়ে আমাদের সরকার ও ব্যবস্থাগুলো চলছে তা কতটা অকার্যকারী শুধু সেটুকুই নয়, তা কত নিষ্ঠুর ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে ভরা আমপান তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আমপান বিধস্ত হিঙ্গলগঞ্জের সেই স্কুল ছাত্রীর মর্মস্পর্শী উক্তি, ঝড়ের মুখে সপরিবারে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম শৌচাগারে। কারণ সেটিই আমাদের গৃহের একমাত্র পাকাঘর। এই উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতা কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। এক বিরাট অংশের জনগণের বাৎসরিক উপলব্ধি।
সে কথাই শোনা গেল সাগরদ্বীপের গৃহহারা মহিলাদের কন্ঠে, প্রতি বছর আমাদের ঘর ভাঙবে, তারপর বেঁচে থাকলে ঘর মেরামত। অথচ কত না প্রকল্প হল, ইন্দিরা আবাস যোজনা, নাম পাল্টে সেটাই হল, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা।গত ৫/৭ বছরে গ্রাম ও শহরে স্বল্পবিত্ত মানুষদের ঘর জুগাইবার প্রকল্পগুলির নামের বদলে হইলেও ঘর কত মিলেছে, আমপান তার হিসাব জানিয়ে দিল। একই কথা রাজ্যের জন্যও সত্য। আমার ঠিকানা নাম বদলিয়ে হল গীতাঞ্জলি, তাহারই অন্য নাম বাংলা আবাস যোজনা। আর ২০১১ সালের গৃহস্থালি গণনার থেকে জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ঘাস-খড়-বাঁশ দিয়ে নির্মিত ছাদ যুক্ত গৃহ ১৯ শতাংশ, আরও সকল উপকরণে নির্মিত দেয়াল যুক্ত গৃহ ৬২ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে ছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে সকল দেশবাসীর জন্য পাকা বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। আমপান বিদ্ধস্ত মানুষের মুখে ক্লান্ত হাসির কোন ছবি দেখবেন না। তাঁরা এখন আস্ত টালি, বাঁশ, ত্রিপল বা পলিথিন শিট খোঁজায় ব্যস্ত!!
এবার শুরু হবে ক্ষয়ক্ষতির মাপজোক ও হিসাবপত্র। সাহায্য বা অনুদান বা ঋণের টাকায় যাতে কোনো অপচয় বা বেহিসাবী খরচ না হয় তা নিয়ে আমলাতান্ত্রিক দড়ি টানাটানি। ২০০৯ সালের আয়লার ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও আসেনি। কারণ এতে “রাজনৈতিক লাভ” তেমন আর নেই। আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের টাকা কবে মিলবে, কত মিলবে তা নিয়ে রাজনৈতিক বোঝাপড়া হলে তখন বোঝা যাবে। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের জন্য একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা কেন থাকবে না, সেটাই মূল প্রশ্ন। কত কমিশন হল (সারকারিয়া কমিশন ও তার সুপারিশ বহুল চর্চিত) এদেশে তারপরও কোনো পরিবর্তন হয় না।
একদিকে দেশজুড়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে, মৃত্যুর সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকারের মনোভাব স্পষ্ট হলো গুজরাট হাইকোর্টে রাজ্যের এ্যাডভোকেট জেনারেলের কথায়, “আমরা আর তেমন টেষ্টের উপর জোর দিচ্ছি না, তাহলে ৭০ শতাংশ পজিটিভ বেরোবে”।
এটা শুধু গুজরাটের কথা নয়, এর প্রতিধ্বনি সব রাজ্যেই পাওয়া যাবে। কাজ হারা মানুষের সংখ্যা শহর ও গ্রামে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা কি অবস্থায় ঘরে ফিরছে সকলেই অবগত। ফিরে আসার গোটা পথে হাতে শুধু চার পাঁচটা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট। জ্বর হলে খেয়ে নেবেন; ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরীক্ষা নেই, খাবার জলটুকু পর্যন্ত কেউ দেয়নি। ফিরে আসার পর সরকার জানিয়ে দিয়েছে ঘরে থাকাই ভালো। ঘর কোথায়? সে তো আমপানে উড়ে গেছে, নয়ত মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সরকার কোনো দায় নিতেই রাজি নয়। কেন্দ্র দায় নেয়নি, রাজ্য অপারগ। মাটির কাছে ফিরে আসার পরও বিশ্বাসভঙ্গ। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চারমাস ধরে একই ওষুধ চলছে। রোগের কোনো উপশম নেই, মৃত্যুর মিছিল লম্বা চওড়ায় বড় হচ্ছে। শুধু লকডাউনের বটিকায় যে কোনো কাজ হচ্ছে না, তাতো স্পষ্ট। ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রথম দশের তালিকায় আমাদের নাম এসে গেছে।
আমপানের ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য সকলেই জেনে গেছেন। শতাধিক মানুষের প্রাণ আর দেড়-দু কোটি মানুষের জীবন যন্ত্রণার থেকেও যদি আমরা শিক্ষা নিতে না পারি, তবে আরও বিপর্যয় হয়ত আমার, আপনার ও আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। নদীগুলোর সংস্কার থেকে সুন্দরবন রক্ষার কাজে সরকারের নজর ফেরাতে এখন থেকেই সোচ্চার হতে হবে।
শুধু সরকার ও প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকলে এই বিপন্ন, বিপর্যস্ত সহ নাগরিকদের উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। যে চাষির ধান ও ফসলের ক্ষেতের উপর দিয়ে সমুদ্রের নোনা জল বয়ে যাচ্ছে, তাঁকেও সমান হারে বিদ্যুতের মাশুল গুণতে হবে, সার ও বীজ চড়া দামে কিনতে হবে যেমন শহরবাসীর ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে চরম অকর্মণ্যতার পরও দেশের মধ্যে সবচেয়ে চড়া দামে বিদ্যুৎ বিক্রেতা (ইতিমধ্যে ১৪ বার মাসুল বাড়িয়েছে) শিল্পায়ন ও উন্নয়নের প্রধান পরামর্শদাতাই থেকে যাবেন। সময় এসে গেছে বলার এনাফ ইজ এনাফ।
এরকম এক পরিস্থিতিতে বামপন্থী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও সংগঠনগুলো বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, ছাত্র-যুব এবং নাগরিক সমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। অন্যথায় ত্রাণের নামে, সহায়তার নামে বিভাজনের শক্তিগুলো শিকড় বিস্তারের চেষ্টা চালাবে। ২০০০ সালের গুজরাট ভূমিকম্প ও ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার গভীর সম্পর্ক এবং আদানি-আম্বানিদের উত্থান রহস্য সকলের জানা। বাংলার মানুষ ২০০২ সালের গুজরাট দেখতে রাজি নয়। বাংলা এই বিপর্যয়ের পরও নতুন প্রভাতের স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন সফল কাজে অনেকেই নেমে পড়েছে, আমাদেরও কাঁধ মেলাতে হবে।
- পার্থ ঘোষ
অপরিকল্পিত লকডাউনে একদিকে দেশে খাদ্য, মজুরি, সুরক্ষার অভাবে লম্বা হচ্ছে মৃত্যু মিছিল অন্যদিকে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র সরকার নামিয়ে আনছে একের পর এক জনবিরোধী, শ্রমিক-বিরোধী আইন। এই সময়ে রাজ্য জুড়ে অসহায়, বিপন্ন মানুষের কাছে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রশাসনের থেকে কৃষি ও গ্রামীণ মজুর, পরিযায়ী শ্রমিক, আদিবাসী, অসংগঠিত তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শ্রমিক সহ সমস্ত প্রান্তিক মানুষদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন কমরেডরা। লকডাউন ও বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে লণ্ডভণ্ড দক্ষিণবঙ্গে এই পরিস্থিতিতে দুর্গত মানুষের পাশে সর্বতোভাবে দাঁড়ানোই ছিল এবারের নকশালবাড়ি দিবসের শপথ।
নকশালবাড়ি দিবসে পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অফিসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
২৫ মে ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি দিবসে কলকাতায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য অফিস চত্বরে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু ও প্রবীর দাস।
দার্জিলিং
আপোসহীন নকশালবাড়ির প্রতিস্পর্ধার ধারাবাহিকতায় দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় ৫৪তম নকশালবাড়ি দিবস। অপরিকল্পিত লকডাউনে বিপর্যস্ত দেশের মানুষ, অন্যদিকে ঘূর্ণীঝড় আমফানে বিধ্বস্ত দক্ষিণবঙ্গের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়বদ্ধতা। আরেকদিকে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও কর্পোরেট ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নকশালবাড়ির দিশায় গণ আন্দোলনে গড়ে তোলার সংকল্পে বৃষ্টিস্নাত সকাল থেকে বিকাল আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাকে উপেক্ষা করেই কমরেডরা শিলিগুড়ি থেকে রাঙাপাণি – নকশালবাড়ি থেকে খড়িবাড়ি শহর থেকে গ্রাম জড়ো হয়েছিলেন বিভিন্ন জায়গায়।
শিলিগুড়ির সুভাষপল্লী স্থিত কমরেড চারু মজুমদারের মূর্তির সামনে দার্জিলিং জেলা কমিটির উদ্যোগে ৫৪তম নকশালবাড়ি দিবস পালিত হয়। মাল্যদান শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। শ্লোগান সংকল্পে নকশালবাড়ির আলোকে গণসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে শেষ হয় কর্মসূচী। কর্মসূচীতে শ্রমজীবী মহিলাদের একাংশের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
স্কুলডাঙি দ্রোহকালের জন্মস্থান নকশালবাড়ির স্কুলডাঙিতে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের উত্তাল সময়ের যোদ্ধা জেলা সদস্য খেমু সিং, কান্দরা মুর্মু, নেমু সিং, দেওয়ান মার্ডি, পবিত্র সিংহ, শরত সিংহ, বন্ধু বেক; এ সময়ের সহযোদ্ধা সুমন্তি এক্কা, রমু সিংহ, আন্দোলনের প্রথম শহীদ নেতৃত্ব কমরেড বাবুলাল বিশ্বকর্মকারের ছেলে বিভাস বিশ্বকর্মকার প্রমুখের উপস্থিতিতে কান্দরা মুর্মু রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন। সত্তরের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত শহীদ বেদীতে মাল্যদানের পর সেদিনের যোদ্ধা বর্তমানের অন্যতম প্রবীণ জেলা সদস্য খেমু সিংহের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কর্মসূচী শেষ হয়। খড়িবাড়ির কদুভিটায় প্রবীণ নেতৃত্ব কমরেড শিরিল এক্কা অশক্ত শরীরে বাড়িতে বসেই সাদ্রী ভাষায় সহজ সরল ভাবে নকশালবাড়ি আন্দোলনে কথা, বর্তমান সময়ে তার মর্মবস্তু উপলব্ধি করে বর্তমানের কর্মীদের সেই দিশায় শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। ফাঁসিদেওয়া ব্লকের রাঙাপাণিতেও নেমু সিংহ, পবিত্র সিংহ, শরত সিংহ পঞ বর্মণ প্রমুখের উপস্থিতিতে বর্তমান ফ্যাসিবাদী, সাম্প্রদায়িক শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং বর্তমানে সংকটজনক পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে থেকে মানুষের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় নকশালবাড়ি দিবস।
জলপাইগুড়ি
২৫ মে পার্টি কার্যালয়ে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন জেলা কমিটির বর্ষীয়ন সদস্য সুভাষ দত্ত। উপস্থিত জেলা সদস্য শ্যামল ভৌমিক, প্রদীপ গোস্বামী, মুকুল চক্রবর্তী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক কৃষকদের যে সঙ্কটর মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে সে কথা উল্লেখ করে কেন্দ্র এবং সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং চরম ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক মোদী সরকারের বিরুদ্ধে নকশালবাড়ির দিশায় গণআন্দোলনে গড়ে তোলার আহ্বান রাখেন। দাবি ওঠে কেন্দ্রীয় সরকারকে সাইক্লোন আমফানেকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করে বিধ্বস্ত বাংলার পুনর্নিমাণের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। জলপাইগুড়ি শহর ছাড়া ময়নাগুড়ির চুড়া ভান্ডার সহ গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যথাযথ মর্যাদায় ৫৪তম নকশালবাড়ি শহীদ দিবস পালিত হয়।
হাওড়া
ঐতিহাসিক নকশালবাড়ির ৫৩ তম বছর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হল হাওড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। রক্ত পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে মাল্যদান, নকশালবাড়ির বীর শহীদ সহ বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও বিধ্বংসী আমফান ঝড়ে মৃত মানুষ দের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয়। বালীর জোড়া অশ্বথতলায় শহীদ বেদীর সামনে পতাকা উত্তোলন করেন হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য কমঃ রঘুপতি গাঙ্গুলী, মাল্যদান ও শহীদদের স্মরনে নীরবতা পালনের পরে নকশালবাড়ির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য কমঃ তপন বটব্যাল। সাম্প্রতিক কালে পার্টির কাজের বিস্তারের জায়গা শান্তিরাম রাস্তায় শহীদ বেদী স্থাপন ও পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান কমরেড মনোরঞ্জন ব্যানার্জ্জী। জগাছা অঞ্চলে বিধ্বংসী আমফান ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, ভেঙ্গে যায় লোকাল কমিটির কার্যালয়ে টালির চালের একাংশ। বিপর্যস্ত পার্টি কমরেডরা সমস্ত বাধা দূরে সরিয়ে রেখে উপস্থিত হন ২৫ মে কর্মসুচীতে। রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির জেলা সম্পাদক কমঃ দেবব্রত ভক্ত। এর পর শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয়। ঘোড়াঘাটা বাজারে পতাকা উত্তোলন করেন হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য কমঃ সনাতন মনি, উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য কমরেডরা।
হুগলী
একাধিক জায়গায় কোথাও বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নামা মানুষের পাশে তো কোথাও কৃষিকাজ ও ঘরবাড়ি হারানো কৃষক-ক্ষেতমজুরদের জন্য ত্রাণকার্যে আবার কোথাও টোটোচালক মেহনতি মানুষদেরকে সহযোগিতা —এমনই নানাবিধ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছেন হুগলী জেলার পার্টি কর্মীরা। সেসবের পাশেই যথোচিত শ্রদ্ধার সাথে নকশালবাড়ি দিবস উদযাপিত হল জেলায়।
চুঁচুড়ার জেলা পার্টি অফিসে পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির সূচনালগ্ন থেকে যুক্ত কমরেড খোকন ব্যানার্জি। আমফান দুর্যোগে নিহত মানুষ, লক ডাউনের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতায় দুর্ঘটনায় এবং পথিমধ্যে ও আত্মহত্যায় বাধ্য শ্রমিক এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্ত শহিদদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়। বতর্মান পরিস্থিতিতে আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন বর্ষীয়ান নেতা মানিক দাশগুপ্ত, জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার, নির্মাণ সংগঠক সুভাষ অধিকারী, উপস্থিত ছিলেন বর্ষীয়ান কমরেড কল্যাণ সেন, সুদর্শন বসু, নির্মাণ সংগঠক গোপাল পাল সহ অন্যান্য সদস্যরা।
ধনেখালি ব্লকের মল্লিকপুরে পোলবা-দাদপুরের ও ধনেখালির কমরেডরা পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ করে ‘সেদিনের অনুপ্রেরণা ও আজকের তাৎপর্য’ বিষয়ে আলোচনা করেন। অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন আদিবাসী মঞ্চের কমরেড পাগান মুর্মু, বিশ্বনাথ সরেন, যুব সংগঠক কমরেড সজল দে, শৈলেন মাজি, নন্দলাল মাহেলি, অনিল মাহেলি, ছাত্রী ও মহিলা সংগঠক কমরেড অর্পিতা রায়, ক্ষেতমজুর নেতা কমরেড গোপাল রায়, অজিত শেঠ, সজল অধিকারী সহ দীর্ঘদিনের প্রবীণ অন্যান্য কমরেডরাও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সমগ্র অঞ্চলটি এখন নতুন উদ্যমে দরিদ্র আদিবাসী ও কৃষিজীবি মানুষের রেশন, রোজগার, লোকশিল্পের মর্যাদা ও অধিকার অর্জনের বহুমুখী লড়াইয়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। পাণ্ডুয়া ব্লকের সাঁচিতাড়া অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পার্টি তথা নকশালবাড়ির রাজনীতি আঁকড়ে থাকা দরিদ্র ক্ষেতমজুর কমরেডরা পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণের পরে এই দুর্যোগ কবলিত সময়ে পার্টির ভূমিকা পর্যালোচনা করেন। বৈঁচিতে নকশালবাড়ি দিবস উদযাপিত হয় বুনিয়াদী জনগণের ওপর নির্ভর করে আন্দোলনের গুরুত্ব ও চতুর্থ দফা লকডাউনের শুরুতে মোদির ৩৩ মিনিটের ভাষণের ফ্যাসিবাদী স্বরূপ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে। সভায় সিদ্ধান্ত হয় : আগামী ২৭ তারিখ বিকেল ৩টের সময় “আমফান” ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবি নিয়ে বিডিওর নিকট ডেপুটেশন দেওয়া হবে।
এছাড়াও, বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়া পার্টি ব্রাঞ্চ, ২নং কলোনি বাজার পার্টি অফিসে কোন্নগর-রিষড়া লোকাল কমিটি, দেশবন্ধু পার্কে হিন্দমোটর-কোতরং লোকাল কমিটি ও ভদ্রেশ্বরে অ্যাঙ্গাস পার্টি ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে রক্তপতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ হয়। নকশালবাড়ি কেবল ইতিহাস নয়, নকশালবাড়ি বর্তমান, নকশালবাড়ি মূল্যবোধ এই কথাগুলি সোচ্চারে স্লোগানে উঠে আসে।
নদীয়া
কৃষ্ণনগর জেলা অফিসে উপস্থিত কর্মীরা নকশালবাড়ির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন ও শহরের বুকে আগামী প্রচার কর্মসূচী নিয়ে পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ধুবুলিয়া পার্টি অফিসে পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে মাল্যদান কর্মসূচী সংগঠিত হয়।
নাকাশীপাড়ার গাছা বাজারে এক বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সম্প্রতি ঐ এলাকায় একটি জমির বিষয়কে কেন্দ্র করে পার্টি কর্মীদের উপর বিজেপি হামলা করে ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রচার চালায়। এর বিরুদ্ধে ঐ প্রতিবাদী কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন পার্টির নদীয়া জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, জয়তু দেশমুখ, কাজল দত্তগুপ্ত। এছাড়াও নকশালবাড়ি দিবস উদযাপন কর্মসূচী হয় নবদ্বীপ, তাহেরপুর, পলাশীপাড়া প্রভৃতি স্থানে।
দঃ ২৪ পরগণা
৫৪তম নকশালবাড়ি দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় দঃ ২৪ পরগণা জেলা কার্যালয়ে। রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির দঃ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার। উপস্থিত ছিলেন জেলা কমিটির সদস্যা দেবযানী গোস্বামী, অঞ্জনা মাল, বজবজ শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক অঞ্জন ঘোষ, দেবাশীষ মিত্র, রঞ্জন ঘোষ, নন্দন, বজবজ গ্রাম লোকাল কমিটির পক্ষে শ্যামসুন্দর গোস্বামী এবং ছাত্র-ছাত্রী কমরেডরা। বাখরাহাটে নকশালবাড়ি দিবসে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন লোকাল কমিটির সদস্য ইস্রাফিল সেখ, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন পার্টির লোকাল কমিটির অন্যতম সদস্যা পূর্ণিমা হালদার। সমগ্র কর্মসূচি পরিচালনা করেন পার্টির বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক নিখিলেশ পাল। বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটির সদস্য শুভদীপ পাল ও অন্যন্যরা।
মুর্শিদাবাদ
বহরমপুর শহরের পার্টির জেলা অফিসে নকশালবাড়ির দিবস উদযাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক রাজীব রায়, রাজ্য কমিটির সদস্য সজল পাল, বহরমপুর শহরের সম্পাদক রবি মন্ডল, জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য অপুর্ব লাহিড়ী সহ অন্যন্যরা। শহীদ স্মৃতিতে পুষ্প অর্পণ ও নীরবতা পালনের পরে জেলা কার্যালয়ে নকশালবাড়ি দিবসে পার্টির আহ্বান সম্পর্কিত আলোচনা করেন কমরেড সজল পাল। ২৭ মে এআইকেএসসিসি-র যৌথ কর্মসূটী নিয়েও আলোচনা করা হয়।
কলকাতা
বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনের সামনে পতাকা উত্তোলন করে নকশালবাড়ি সহ সমস্ত গন আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করা হয়। বেহালা আঞ্চলিক কমিটির অন্তর্গত সরশুনা ব্রাঞ্চ ও কালীতলা ব্রাঞ্চের উদ্যোগে নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয় পতাকা উত্তোলন, শহীদ স্মরণ ও নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। আমফান ঝড়কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা সহ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং খাদ্য, পানীয় জল ও ইলেক্ট্রিসিটি সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধি করার দাবি জানানো হয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও পরিযায়ী শ্রমিকদের দাবিগুলিকেও তোলা হয়।
যাদবপুর-এর পালবাজার ও লোকাল কমিটির অফিসে নকশালবাড়ি আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণ করা হয় রক্ত পতাকা উত্তোলন, মাল্যদান ও নিরবতা পালনের মাধ্যমে। এই দিন যাদবপুরের গাঙ্গুলিপুকুর কার্যালয় থেকে লকডাউনে বিপর্যস্ত ৬০ জন মানুষের হাতে খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়। এছাড়াও পার্টির পক্ষ থেকে এই সপ্তাহে এলাকার ২৫০ জন মানুষের ও আম্পানে ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পার্ক-সার্কাস ময়দানের ২০ জন ঝুপড়িবাসীর হাতে রেশন তুলে দেওয়া হয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান
পূর্বস্থলী ২নং ব্লক এর ফলেয়া অফিসে ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের ৫৩তম বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও নকশাল বাড়ীর শহীদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হল। নেতৃত্ব দেন জেলা কমিটির সদস্য কমরেড সমীর বসাক। মেড়তলা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার চণ্ডীপুর গ্রামের চড়কতলায় শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও দ্রোহকালের অমর শহীদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
এছাড়াও কাটোয়া থানার সাহাপুর গ্রামে, সদর ২নং ব্লক এর শক্তিগড়ে, কালনা লোকাল কমিটির উদ্যোগে আগ্রাদহ গ্রামে শহীদদের স্মৃতিসৌধে মাল্যদান ও নকশাবাড়ির বীর শহীদদের স্মরণ করে নীরবতা পালন করা হয়। শ্লোগান ওঠে আমফানে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট স্বার্থে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের পরিবর্তন করা চলবে না। ১০০ দিনের কাজ চালু করতে হবে। বন্ধন সহ সমস্ত ধরনের ঋণ মুকুব করতে হবে। বিদ্যুতের বিল মুকুব করতে হবে। জবকার্ড অ্যাকাউন্ট-এ ১০ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
উত্তর ২৪ পরগণা
বেলঘরিয়ার জেলা কার্যালয়ে সকালে রক্তপতাকা উত্তোলন ও শহিদ স্মরণের মধ্যে দিয়ে নকশাল বাড়ির ৫৩ বছর পালিত হয়। অশোকনগর ও গাইঘাটার চাঁদপাড়া অফিসে শহীদ স্মরণ ও আজকের দিনে নকশালবাড়ি দিবসের তাৎপর্য আলোচিত হয়।
বারাসাতে নকশাল বাড়ি দিবস উদযাপনের কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য অনিমেষ চক্রবর্তী ও জেলা সদস্য নির্মল ঘোষ। সন্ধেবেলা শহীদদের স্মরণ করে নৈহাটি অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থা সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি প্রতিবাদী গণসঙ্গীত উপস্থাপনা করেন।
শ্রম আইন সংশোধন, ১২ ঘণ্টার কাজকে ফিরিয়ে আনা, বিরাষ্ট্রীয়করণ-বেসরকারিকরণ, পরিযায়ী সহ অসংগঠিত শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিতে পশ্চিম বাংলায় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ২৭ মে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হল রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে। এআইকেএসসিসির কমরেডরাও বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সামিল হন।
উত্তর ২৪ পরগণা
কামারহাটি পৌরসভার সামনে শ্রম আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে এবং লকডাউনের মজুরির দাবিতে যৌথ বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করা হয়। বক্তব্য রাখেন নবেন্দু দাশগুপ্ত (এআইসিসিটিইউ), ঝন্টু মজুমদার (সিটু), সাহানাজ আলম (এআইটিইউসি) এবং পরিচালনা করেন শৈবাল ঘোষ (এআইটিইউসি)। অশোকনগরে এআইসিসিটিইউ-র সহ বামপন্থী টেড ইউনিয়নগুলো যৌথভাবে কর্মসূচী পালন করে।
বসিরহাট এআইসিসিটিইউ শ্রম আইন সংস্কার বিরুদ্ধে, নির্মাণ শ্রমিকদের ভাতা ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণার দবিতে টাউন হলের সামনে প্রতিবাদী কর্মসূচী পালন করে। জেলা নেতা কমরেড দেবব্রত বিশ্বাস নেতৃত্ব দেন। অনেক চেষ্টা করেও অন্য ইউনিয়নগুলোর সাথে যোগাযোগ করা যায়নি।
হাওড়া জেলা
২৭ মে সকালে এআইসিসিটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকে হাওড়া জেলা শাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ ও স্মারক লিপি দেওয়া হল। আজকের জেলা শাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ কর্মসুচীতে উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র জেলা কমিটির সদস্য কমঃ ভোলা চৌধুরী সহ কমঃ রতন দত্ত, অজয় কর্মকার, সেখ হায়দার আলি ও দেবব্রত ভক্ত। এই একই কর্মসূচীর অংশ হিসাবে ২৭ মে বিকেল ৫টায় বালি জুট মিলে প্রদর্শিত হয় বিক্ষোভ। বালি মিলের কর্মসূচীতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন কমঃ তপন ঘোষ। মিলের স্থানীয় কমরেডদের সাথেই কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য কমঃ নীলাশিস বসু।
হুগলি জেলা
শ্রম আইন সংশোধন, ১২ ঘণ্টার কাজকে ফিরিয়ে আনা, বিরাষ্ট্রীয়করণ-বেসরকারীকরণ, পরিযায়ী সহ অসংগঠিত শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিতে পশ্চিম বাংলায় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতৃত্বে ২৭ মে প্রতিবাদ কর্মসূচী চুঁচুড়ায় পৌরসভার পিপুলপাতি, ঘড়ির মোড়ে এবং কোদালিয়া পঞ্চায়েতের হুগলি মোড়ে অনুষ্ঠিত হয়। সিটু, ইউটিইউসি, টিইউসিসি এবং এআইসিসিটিইউ-র অন্তর্গত শ্রমিকেরা এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন। লাল ঝান্ডা এবং পোস্টারে দাবিগুলো তুলে ধরে শ্রমিকেরা দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থানে সামিল হন এবং স্লোগানে গলা মেলান। এই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন সিটুর পক্ষ থেকে মলয় সরকার ও মনোদীপ ঘোষ, টিইউসিসিসি-র পক্ষে সুনীল সাহা, ইউটিইউসি-র কিশোর সিং, এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে ভিয়েত ব্যানার্জি এবং কল্যাণ সেন। নির্মাণ শ্রমিক সহ, পরিবহন শ্রমিকেরা যেমন এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তেমনই ব্যাঙ্ক কর্মচারি, শিক্ষক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আজকের প্রতিবাদী কর্মসূচীতে অংশ নেন। এআইসিসিটিইউ-র অন্তর্গত নির্মাণ শ্রমিকেরা ভালো সংখায় উপস্থিতি হয়েছিলেন, ঝান্ডা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন পরিবহন (বাস) শ্রমিক, দীর্ঘ দিনের বাম আন্দোলনের নেতা বর্ষীয়ান সনৎ রায়চৌধুরী এই কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন। পরদিন মহকুমা শাসক এবং জেলাশাসক-এর কাছে আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচী ঘোষণার মধ্যে দিয়ে কর্মসূচী সমাপ্ত হয়।
পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার রিপোর্ট
পূর্ব বর্ধমান জেলার এআইকেএসসিসি-র পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত্তিক ডেপুটেশন দেওয়া হবে। আর শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ব্লকে ডেপুটেশন ও শহর গঞ্জে বিক্ষোভ সংগঠিত হবে। সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন ও সিপিএমের সংগঠন গুলো সব জায়গাতেই ছিল।
কালনা ২নং ব্লক এর বিদ্যুৎ অফিসের সামনের গঞ্জে এআইসিসিটিইউ ও সিটু ইউনিয়ন-এর পক্ষ থেকে যৌথ ভাবে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করা হয়। বিভিন্ন শ্রমিক বিরোধী শ্রম আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে ও বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে অকালপোষ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে এআইকেএসসিসি-র পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দুই ক্ষেত্রেই ভাল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কর্মসূচী সফল হয়।
পূর্বস্থলী ২নং ব্লক অফিসে বেলা ২টার সময় এআইসিসিটিইউ ও সিটুর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। মেড়তলা গ্রাম পঞ্চায়েতে এআইকেএসসিসি-র পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। একই সময় কালেখাতলা ১নং গ্রাম পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন কর্মসূচী সংগঠিত হয়। সদর ২নং ব্লক-এ সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। বর্ধমান শহরে শ্রমিক সংগঠন গুলোর পক্ষ থেকে যৌথ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। মন্তেশ্বর ব্লকের কুসুমগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। মেমারী ১নং ব্লকের নিমো গ্রাম পঞ্চায়েতেও ডেপুটেশন বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। পূর্বস্থলী ১নং ব্লকের নাদনঘাট গ্রাম পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন ও বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়। কাটোয়া থানার অগ্রদ্বীপ অঞ্চলে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়।
মুর্শিদাবাদ জেলার এআইকেএসসিসি র কর্মসূচি কার্যকর করার জন্য সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, ও সিপিএমের সাথে বারবার আলোচনার পর অন্যরা সরাসরি নাকচ করল। সিপিএমের ক্ষেত মজুর ইউনিয়ন-এর নেতা বলল সব ব্লকে বা অঞ্চলে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করে নেওয়া হবে। কিন্ত কোথাও ওদের খবর নেই । আমাদের কর্মীরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ও সাড়া পাই নাই। শেষ মুহূর্তের উদ্যোগে খড়গ্রাম ব্লকের ঝিল্লী গ্রাম পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন বিক্ষোভ সংগঠিত করা সম্ভব হল। নেতৃত্ব দেন হায়দার সেখ ও হাসান সেখ।
বীরভূমের বোলপুর শহরে শ্রমিক সংগঠন গুলোর পক্ষ থেকে যৌথ বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয়। রামপুরহাট শহরেও বিক্ষোভ সংগঠিত হয় ।
প্রতিরক্ষা শিল্প শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতিবাদ
ন্যাশানাল প্রোগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লয়িজ ফেদারেশনের তরফেও প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করা হয়। গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে কর্মসূচী শুরু হয় শহীদবেদীতে মালা দিয়ে। কালো ব্যাজ পরে পোস্টার সহযোগে বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরে প্রতিবাদ কর্মসূচী চলে। ঠিক হয়েছে ২৮ মে সারা দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পে প্রতিবাদ হবে ও কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করে কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হবে। প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্পোরেটাইজেশনের প্রস্তাব প্রত্যাহার ও এফ ডি আই এর মাত্রা ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করার বিরুদ্ধে দাবি সেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে। থাকবে আধুনিক প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রপাতির দাবিও।
কোবিডের পর আমপান, পরের পর বিধ্বংসী সংক্রমণ ও দুর্যোগের ঘনঘটা। একে চলছে চূড়ান্ত অপরিকল্পিত লকডাউন চাপানো দুর্বিষহ অবস্থা, এর মধ্যেই তার ওপর ধেয়ে এল বিধ্বংসী ঘূর্ণীঝড়। সব মিলে বাংলার জনজীবন এককথায় বর্ণনাতীত বিধ্বস্ত। একদিকে আয় নেই, কাজ নেই, ঘরবন্দী হয়ে থাকার যন্ত্রণা; সরকারী পর্যাপ্ত খাদ্যত্রাণ নেই, নগদ আর্থিক অনুদান নেই; জুটছে কেবল নির্দয় উপেক্ষা, নয়তো ন্যক্কারজনক পুলিশী উৎপীড়ন; অন্যদিকে ঝড়-জলের ঘূর্ণী তুফানে ঘর-গেরস্থালি, মাঠের ফসল, সবকিছু শেষ হয়ে গেল। জীবন গেছে ঠিকমতো হিসাব করলে কম-বেশি একশ। দক্ষিণবঙ্গে এক বিশাল অংশে নগরজীবন থেকে গ্রামজীবনে নেমে এল কল্পনাতীত শিউরে ওঠা অন্ধকার। একদিকে লাগাতার বিদ্যুৎ নেই, জলের জন্য হাহাকার, অন্যদিকে জলোচ্ছাসে বানভাসি বসতে-শিবিরে এক মুঠো চিড়ে-মুড়ি জোটা জীবন নিয়ে ভেসে থাকা, এমন অবস্থাতেই নিশিদিন কেটেছে, কাটছে। আমপানের ক্ষত থেকে দেরীতে হলেও নগর-শহরকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তোলা শুরু হয়েছে, কিন্তু গ্রামীণ ক্ষতের যে ব্যাপকতা বিভীষিকা যে ব্যাপক মাত্রায় প্রতিকারের পদক্ষেপ করার জরুরি গুরুত্ব দাবি করে তার কণামাত্র এখনও নেওয়া শুরু হয়নি। গত দুমাস ধরে সরকারী ফরমান জারী রয়েছে করোনার হাত থেকে জীবন ও দেশকে বাঁচাতে থাকতে হবে ঘরে। আমপানের ঝড়ে সব হারিয়ে সেই ঘর-ছাড়া হওয়াই হল পরিণতি! নগর-শহরে বিদ্যুৎ ও জল বিহীন ঘরে থাকাই হয়ে উঠেছিল দুঃসহ, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে আমজনতা নেমে আসে রাস্তায়, প্রতিবাদে অবরোধে। এই সবই নজীরবিহীন।
নজীরবিহীন দৃশ্য এটাও যে, আমপানের ধ্বংসলীলা পরিমাপে আকাশপথে যুগল পরিক্রমা সারলেন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। একে ঠিক কি বললে যথার্থ গণ্য করা হবে, ‘জাতীয় বিপর্যয়’ নাকি ‘বিরল বিপর্যয়’, তা নিয়ে মতবৈচিত্র থাকুক, কিন্তু এহেন নজীরবিহীন বিপর্যয় ও তার পরিণতিতে ক্ষয়ক্ষতির বিশালতাকে এতটুকু কমিয়ে দেখানো বরদাস্ত করা যায় না। ক্ষতিপূরণের আর্থিক প্যাকেজের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দায় যে পঁচাত্তর শতাংশ, এর অন্যথা হতে দেওয়া চলবে না। এ নিয়ে আইনি বা নিয়মরীতির কূটকচালি চলতে দেওয়া যায় না। মুখ্যমন্ত্রীর প্রাথমিক হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক কথা দিয়েছেন মাত্র এক হাজার কোটি টাকার অর্থ সাহায্যের! এ নিয়ে একমাত্র বিজেপি ছাড়া ক্ষোভে ফেটে পড়েছে প্রায় সমস্ত বিরোধী দল। বোধহয় প্রতিক্রিয়ার এই আঁচ পেয়ে ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল, ধ্বংসাবস্থা মাপতে। রাজ্যের মুখ্যসচিব অবশেষে দাবি করেছেন আমপানের ক্ষতি কবলিত হয়েছে ষোলটি জেলা। তার মধ্যে বলাবাহুল্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি জেলা – উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুর এবং কলকাতা। আক্রান্ত জনসংখ্যা আনুমানিক প্রায় ছয় কোটি। তবে ব্লকের সংখ্যা অস্পষ্ট। ত্রাণ বাবদ রাজ্য সরকার গঠন করেছে এক হাজার কোটি টাকার তহবিল। কেন্দ্র-রাজ্যের প্রাথমিক প্যাকেজ সমান-সমান।
সে তো জানা গেল। কিন্তু আমপানের ধাক্কা সামলানোর পরিকল্পনা-প্রস্তুতির প্রশ্নে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হল। বিপদের আঁচ ও খবর বেশ কিছুদিন আগে থাকতেই ছিল, কিন্তু বোঝা গেল সরকার সময় থাকতে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। সর্বার্থেই পোষণ করা হয়েছিল সহজে সামলে দেওয়ার আত্মদম্ভী মনোভাব। ধ্বংসভূমিতে দাঁড়িয়ে সাফাই গাওয়া হচ্ছে, বিপদ যে এমন মারাত্মক হবে আগে কল্পনা করা যায়নি। গলদের প্রকৃত কারণ হল, ভাবার সেই চেষ্টাই ছিল না। যে সরকারের নিজের ভাবনাই কূয়োর ব্যাঙের মতো সে আবার বিপদ থেকে রক্ষা করবে কী করে? সরকারের ভাবনা যদি নাগরিকের ভাবনাকে ছাপিয়ে ভাবতে না চায় তাহলে আর কী নিরাপত্তা দেবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিভিন্ন জেলায় প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে নিরাপদ স্থানান্তরিত করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা দশ লক্ষাধিক। কোবিড পরিস্থিতি যখন উপরন্তু আমপান দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত হল তখন তার মোকাবিলায় সরকারী ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট অফিসার ও কর্মচারিদের উপস্থিতি একশ শতাংশ করা হল না কেন? উড়িষ্যা থেকে গাছ কাটার লোকের বা সেনার সাহায্য আরও আগে চাওয়ার কথা ভাবা যায়নি কেন? চিন্তার ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতার মূলে রয়েছে, ‘সর্বোপরি রয়েছেন ‘মাননীয়া’, ঠিক মেলাবেন তিনি, মেলাবেন’ গোছের দায়সারা অবস্থান নিয়ে চলার আচার।
কলকাতার বিপর্যয়ের জন্য তৃণমূল দুষছে সিইএসসি-কে, সিইএসসি দোষ দিচ্ছে রাজ্য প্রশাসনকে। ঘটনা হল, রাজ্য সরকার নিজে ছিল অপ্রস্তুত, তাই সিইএসসি-র প্রস্তুতি প্রসঙ্গেও বিশেষ মাথাব্যথা দেখায়নি, যা বুঝিয়েছে তাইই বুঝে বসেছিল। সিইএসসি-র গ্রাহক সংখ্যা তেত্রিশ লক্ষ। একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হলেও তার ওপর সরকারের তত্ত্বাবধান থাকবে না! এই চাপান-উতোরের আঁচ ওঠার পাশাপাশি অন্য একটা বিতর্কের আঁচও উঠছে। রক্তচোষার মতো একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে বিদ্যুৎ ক্ষমতা থাকাই কি কাল হল না? যে বিদ্যুৎ কিনা অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রের বিষয়। তৃণমূল দায়টা চালান করছে বিগত বাম আমলের দিকে। যেহেতু হস্তান্তর করা হয়েছিল সেই সময়ে। কিন্তু এ দায় মমতা সরকার অস্বীকার করবে কী করে? যেহেতু এই আমল সিইএসসি-র প্রতি একই অবস্থান বজায় রেখে আসছে, শুধু তাই নয়, গোয়েঙ্কা কর্তৃপক্ষকে বিভূষিতও করেছে। এখন সংকটে পড়ে সরকার ও সিইএসসি লিপ্ত হচ্ছে দায় না নেওয়ার পারস্পরিক খেয়োখেয়িতে। ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতাপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিও। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে কর্মচারিদের কোনও দোষ নেই, তারা চেষ্টা চালিয়েছেন যথাসাধ্য, কিন্তু সংখ্যায় তারা আর কত, খুবই সীমিত, প্রতিষ্ঠান পাল্লা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে কর্মী সংকোচনের পলিসি। তার পরিণামে পরিকাঠামো ও প্রস্তুতি প্রক্রিয়া ভেঙ্গে পড়াই ছিল অনিবার্য এবং সেটাই ঘটেছে। আর সরকারের নজরদারী ঠেকেছে প্রতিষ্ঠানের কানাগলিতে।
মাঝখান থেকে রাজ্য বিজেপি বলছে, 'সি ই এস সি-কে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে'। আশ্চর্যের কিছু নয়। বেসরকারীকরণের সবচেয়ে কট্টর প্রবক্তা বিজেপির পক্ষে এমনটাই বলা স্বাভাবিক। আরও এই কারণে যে, ওত্ পেতে আছে পরের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে। আমপান ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হওয়া নিয়ে বিজেপি বাজার গরম করছে খুব, কিন্তু আদৌ তুলছে না এই প্রসঙ্গ যে, ক্ষতিপূরণও করা উচিত ব্যাপকভাবে, এর সিংহভাগ দায়দায়িত্ব পালন করা উচিত কেন্দ্রীয় সরকারেরই, তার টাকার অঙ্কটা মোটেই এক হাজার কোটি টাকায় আটকে থাকতে পারে না, রাজ্য সরকারের নির্ণয় অনুযায়ী অর্থের পরিমাণ মিটিয়ে দেওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, বাংলার এই দুঃসময়ে আর বিলম্ব না করে কোবিড, রাজস্ব এবং জি এস টি বাবদ রাজ্যের সমস্ত পাওনা দিয়ে দেওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ১২ মে’র ভাষণে যখন কোভিড-১৯ মহামারীর সংকটকে একটা সুযোগ রূপে গণ্য করার জ্ঞানগর্ভ বাণী বিলোচ্ছিলেন এবং তার সাথে আত্মনির্ভরশীল ভারত নিয়ে তাঁর হালফিলের মন্ত্রণার রূপরেখাকে তুলে ধরছিলেন, তখন তিনি বেশ বড় একটা অঙ্কের উল্লেখও করলেন। তিনি ২০ লক্ষ কোটি টাকা (২৬৫ বিলিয়ন ডলার) বা ভারতের জিডিপি-র ১০ শতাংশের একটা প্যাকেজের ঘোষণা করলেন। এরপর পাঁচদিন ধরে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ও তাঁর সহকারী অনুরাগ ঠাকুর (যিনি তাঁর গোলি মারো উক্তির জন্যই সমধিক খ্যাত) এই প্যাকেজের সবিস্তার বর্ণনা দিলেন। এবং তা একটা বড় প্রতারণা হয়েই দেখা দিল যার শিকার ভারত আগে আর কখনও হয়নি।
যদি অঙ্কগুলোর কথা ধরা হয় তবে এটা বিশাল আকারের পরিসংখ্যানগত একটা ধাপ্পা। গোটা পরিমাণটা শেষমেষ গিয়ে দাঁড়ায় ২০৯৭০৫৩ কোটিতে। এর মধ্যে ধরা রয়েছে ইতিপূর্বেই মার্চ মাসের শেষে সরকারের ঘোষণা করা ১৯২৮০০ কোটি টাকা (কর ছাড় ৭৮০০ কোটি, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কোভিড ১৯-এর জন্য ১৫০০০ কোটির প্যাকেজ এবং প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ প্যাকেজের ১৭০০০০ কোটি), এবং নীতির পরিমার্জনার মাধ্যমে আরবিআই-এর জোগানো ৮০১৬০৩ কোটি। অতএব পাঁচ দফায় ঘোষণা করা মোট প্রকৃত পরিমাণটা মোটামুটি হল ১১ লক্ষ কোটির বা মোদী ঘোষিত প্যাকেজের অর্ধেক।
ওই প্যাকেজের নির্দিষ্ট বিষয়গুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাবেন আরও বড় ধাক্কা আপনার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। আশু পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নিজে ব্যয় করবে, প্যাকেজে বলতে গেলে সেরকম খুব একটা কিছু নেই। এর অনেকটাই হল ব্যাঙ্কগুলো যে ঋণ দেবে তার পরিমাণ, যার জন্য জামিনদার হবে সরকার। এরপর রয়েছে কর ফেরতের ১৮০০০ কোটি টাকা, যে টাকাটা সরকারকে করদাতাদের দিতে হবে, অথবা চালু প্রকল্পগুলোতে সরকারের দেয় টাকা, যেগুলোর কোনোটাকেই কোনো বিশেষ প্যাকেজ বলা যাবে না। বস্তুত, এ বছরের জন্য সরকারের নগদ ব্যয়ের পরিমাণ খুব বেশি হলে হবে ২.৪০ লক্ষ কোটি টাকা (কেউ কেউ আবার এই খরচের আনুমানিক পরিমাণটাকে মাত্র ১.৫০ লক্ষ কোটি টাকায় নির্দিষ্ট করেছেন)।
প্যাকেজের দাবি তা সমাজের প্রতিটি অংশ এবং অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রের স্বার্থকেই দেখেছে। তবে প্যাকেজ থেকে লক্ষণীয়ভাবে বাদ পড়েছে মোদী যেটাকে বলেছেন ‘জনসংখ্যার প্রাণবন্ত অংশ’ – ভারতের ছাত্র ও যুবক সম্প্রদায়। অন্যান্য বেশিরভাগ অংশগুলোকে ছুঁয়ে যাওয়া হলেও তাদের জ্বলন্ত এবং মূল দাবিগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকার এতদিন সরাসরি সুবিধা হস্তান্তরের কথা বড়মুখ করে বলত। এখন যেটার দরকার তা হল – সমস্ত ক্ষতিগ্ৰস্ত পরিবারগুলোর কাছে অন্তত তিন মাস অথবা যতদিন লকডাউন চলবে ততদিন নগদ টাকা সরাসরি হস্তান্তর করা, কিন্তু প্যাকেজে এরকম কোনো সংস্থান নেই। প্যাকেজে অবশেষে রেশন কার্ড না থাকা জনগণের, বিশেষভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার কথা স্বীকার করা হলেও তা কিন্তু রেশনের সর্বজনীন লভ্যতার গ্যারান্টি দেয়নি। আর রেশনে যে পরিমাণ জিনিস দেওয়ার কথা বলা হয়েছে – মাথাপিছু ৫ কেজি দানা শস্য ও পরিবার পিছু ১ কেজি ডাল – সে সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো। পরিযায়ী শ্রমিকরা যাতে সস্তায় বাড়ি ভাড়া পেতে পারে, সে ধরনের প্রকল্প রূপায়ণের কথা প্যাকেজে বলা হয়েছে, কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের গুরুতর সংকট নিয়ে নীরবতা অত্যন্ত প্রকট ভাবে ফুটে উঠেছে, যে সংকট লকডাউন ঘোষণার সাথে সাথেই ফেটে পড়ে।
প্যাকেজের অংশ রূপে দুটো ঘোষণার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে যেগুলো নাকি বিরাট পরিবর্তন এনে দেবে – একটা ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি সংস্থাগুলো (এমএসএমই) সম্পর্কে এবং অন্যটা নতুন কেন্দ্রীয় আইনের অধীনে কৃষিপণ্যের অবাধ আন্তরাজ্য ব্যবসা নিয়ে। এমএসএমই-র সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করে তার মধ্যে উৎপাদন ও পরিষেবা উভয় ক্ষত্রের সেই সমস্ত সংস্থাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ কোটি এবং যাদের ব্যবসার বার্ষিক পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা। বিস্তৃততর সংজ্ঞার অধীনে পড়া সংস্থাগুলোর জন্য ৩ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে যে ঋণ নিতে গেলে কোনোকিছু বন্ধক দিতে হবে না, এবং এর মাধ্যমে ৪৫ লক্ষ সংস্থার সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এমএসএমই-গুলো বরং চায় সরকার এবং বেসরকারী ক্ষেত্রের কাছে তাদের পাওনা ৫ লক্ষ কোটি টাকা তারা মিটিয়ে দিক, যে বকেয়ার কথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বয়ং নীতীন গডকড়িই স্বীকার করেছেন। এমএসএমই-দের অন্য দাবিটা হল লকডাউন পর্বে শ্রমিকদের দেওয়ার জন্য তাদের মজুরি সহায়তা দেওয়া হোক। কিন্তু এমএসএমই-দের যুক্তিযুক্ত দাবিকে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে সরকার এখন চুপিসারে সেই নির্দেশিকাটাকেই তুলে নিয়েছে যেটাতে লকডাউন চলার সময় শ্রমিকদের মজুরি প্রদানকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কৃষিপণ্যের আন্তরাজ্য অবাধ বাণিজ্যকে সক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে যে কেন্দ্রীয় আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা বস্তুত ধনী চাষি এবং কৃষি বাণিজ্যে নিযুক্ত কর্পোরেট সংস্থাগুলোরই একটা বড় দাবি। কৃষক এবং ভাগচাষিদের দাবি বরং হল – সরকার এমন একটা দামে তাদের কাছ থেকে ফসল কেনা নিশ্চিত করুক যাতে চাষের খরচের অন্তত দেড়গুণ দাম পাওয়াটা সুনিশ্চিত হয়। প্রস্তাবিত নতুন আইন গোটা কৃষি অর্থনীতির উদারিকরণ ঘটাতে বড় ভূমিকা নেবে; এবং এর সাথে যদি কর্পোরেটদের জমি অধিগ্রহণকে সহজসাধ্য করে তোলার প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলোকে যোগ করা হয় তবে এর অর্থ হবে কৃষি জমিকে বড় আকারে ভিন্ন কাজে লাগানো এবং কর্পোরেট চাষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেখানে কৃষক ক্রমেই আরও বেশি করে চুক্তি চাষিতে পরিণত হবে।
এই প্যাকেজের মধ্যে বেসরকারিকরণ এবং প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগে মদত দেওয়ার জন্য অন্যান্য পদক্ষেপের উল্লেখও রয়েছে, যথা, কয়লার বাণিজ্যিক খনন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্র এবং বিমান বন্দরের বেসরকারিকরণ, প্রতিরক্ষা শিল্পগুলোতে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগকে ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করা, মহাকাশ গবেষণায় বেসরকারী ক্ষেত্রের অংশগ্রহণকে বাড়িয়ে তোলা, ইত্যাদি। পরিহাসের ব্যাপার হল, এই সমস্ত পদক্ষেপকেই আত্মনির্ভরশীল ভারতের মোড়কে পেশ করা হচ্ছে।
প্যাকেজ যেমন পরিসংখ্যানগত কারচুপি ও প্রতারণার অপরাধে কলঙ্কিত হয়েছে, তেমনি তা দুটি দিক থেকে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ বলেও দেখা দিচ্ছে। প্রথমত, ভারতকে কোভিড-১৯ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হলে যে সমস্ত জ্বলন্ত ইস্যুর সমাধান দরকার, প্যাকেজ সেগুলোর বিহিত করতে অস্বীকার করেছে। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ হানা দেওয়ার আগে থেকেই অর্থনৈতিক সংকোচন ও মন্দা ঘনিয়ে উঠছিল, এবং কোভিড-১৯ পরবর্তী পর্যায়ে তার আরও তীব্র হয়ে ওঠাটা অবধারিত বলে দেখা যাচ্ছে। প্যাকেজ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সমাধানেও ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১৯-এর মে মাসে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পরপরই মোদী সরকার আগস্ট মাসে আরবিআই-এর উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে বিশাল পরিমাণের ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা নিয়েছিল, এবং এর প্রায় সবটাই বিপুল পরিমাণের কর ছাড়ের মাধ্যমে কর্পোরেট ক্ষেত্রকে বিলিয়ে দিয়েছিল।
জিডিপির সংকোচন অনিবার্য বলে যখন দেখা যাচ্ছে – জিডিপি-র ক্ষয় সুনিশ্চিতভাবে সম্ভবত ১০ শতাংশের বেশি হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে – এবং মন্দাও অবধারিতভাবেই গভীরতর হতে চলেছে, তখন আয়ের ব্যবস্থা করে তার ভিত্তিতে চাহিদাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপেরই প্রয়োজন। ধনীদের ওপর কর বসানো এবং দরকার হলে টাকা ছাপানোর মতো পথে রাজস্ব বাড়িয়ে তুলে রাষ্ট্রের ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটানোটাই সংকট মোকাবিলার একমাত্র উপায় বলে দেখা যাচ্ছে। সরকার এ দুটোর কোনোটাই করছে না। বিদেশী বিনিয়োগ সহ বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা, শ্রম আইনগুলোর বিলোপ ঘটানো, পরিবেশের রক্ষাকবচগুলোকে দুর্বল করে তোলা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব শ্রমের ওপর কর্পোরেটদের অনায়াস ও বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণকে সহজসাধ্য করে তোলা – সরকারের পদক্ষেপগুলো এই লক্ষ্যেই চালিত হচ্ছে। সুবিশাল সংকটের বর্তমান সন্ধিক্ষণে এই ধরনের পদক্ষেপগুলো অবান্তর এবং সর্বনাশা বলেই প্রতিপন্ন হবে।
কোনো-কোনো ভাষ্যকার এই প্যাকেজকে মোদীর ১৯৯১-এর ক্ষণ বলে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে দিয়ে তাঁরা সেই সময়ে নরসিমা রাও সরকারের দ্বারা অপ্রত্যাশিতভাবে উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক নীতি গ্ৰহণের বিষয়টাকেই বুঝিয়েছেন, যে নীতি আমদানির দাম মেটানোর জন্য ভারতের বিদেশী মুদ্রার অপ্রতুলতার সমাধান রূপে গৃহীত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরিণতিতে সেই সময়টা নয়া-উদারবাদী নীতিমালার তীব্রতর হয়ে ওঠার বিশ্বজোড়া লগ্নই হয়ে উঠেছিল। ওই নীতিমালার পরিণামে কল্যানমূলক পরিষেবা প্রদানের অর্থনৈতিক ভূমিকা থেকে জগৎ জুড়েই রাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণ ঘটেছিল, আর দেখা গিয়েছিল একের পর এক দেশে তথাকথিত অবাধ ও অবারিত বাজারের জন্য বিশ্ব পুঁজির সম্প্রসারণবাদী বিপুল আগ্ৰাসী অভিযান। নাওমি ক্লেইন এটাকে সর্বনাশা পুঁজিবাদের শক থেরাপির তরঙ্গ বলে বর্ণনা করেছেন।
ভারত আজ মানবতার এক ভয়ঙ্কর সংকটে নিমজ্জিত, যেখানে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে সারা দেশে লকডাউন নামানোর ফলে দেখা দিয়েছে গণ ক্ষুধা ও শোচনীয় দারিদ্র এবং চরম অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও বিপর্যয়। এটা যথার্থই এক বৈশ্বিক সংকট যা বিশ শতকের প্রথমার্ধে সংঘটিত দুটি বিশ্ব যুদ্ধ প্রসূত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গেই তুলনীয়। এই বিপর্যয় একদিক থেকে আবার আরও স্বতন্ত্র ও পরিব্যাপ্ত, কেননা আজকের এই অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গেই চলছে বিশ্বব্যাপী এক মহামারির প্রকোপ। এই মহামারি শুধু যে কর্পোরেট চালিত বিশ্বায়নের কাঠামোর সামনেই এক বড় প্রশ্নচিহ্নকে তুলে ধরেছে তা নয়, পুঁজিবাদের বুনিয়াদী সৌধ এবং যেভাবে তা জনগণ ও প্রকৃতির স্বার্থের চেয়ে মুনাফার ওপর অগ্ৰাধিকার দেয় ও তার পিছনে ছোটে, তাকেও এক বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। সারা দুনিয়াতেই জনগণ আজ চলতি অগ্ৰাধিকারগুলোকে পাল্টে দিয়ে জনস্বাস্থ্য, মানুষের বেঁচে থাকা এবং পরিবেশের সুরক্ষার প্রয়োজনগুলোকে অর্থনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় করে তোলা নিয়ে চর্চা করছেন। এই সময়টাকে উদারিকরণ ও বেসরকারিকরণের ব্যর্থ এজেণ্ডাটাকেই আরও জোরদার করে তোলার একটা সুযোগ বলে বর্ণনা করা এবং তাকেই আবার ভারতের আত্মনির্ভতার উত্থান বলে অভিহিত করাটা এক গুরুতর অপরাধ ছাড়া অন্য কিছু নয়। ‘আত্ম নির্ভরশীলতার’ এই বাগজাল আসলে রাষ্ট্রের নিজের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করাটাকে, নির্মম লকডাউন ও ক্রমবর্ধমান দুর্দশার কবলগ্ৰস্ত শতকোটির অধিক জনগণের বিপন্নতায় হাত গুটিয় থাকার ফিকিরকে কথার মারপ্যাঁচে ব্যক্ত করার এক কুৎসিত কসরত। এই প্যাকেজ প্রতারণা ও সর্বনাশের এক নির্ঘণ্ট; এই পথধারাকে পাল্টানো এবং এক বিকল্প প্যাকেজের জন্য আমাদের চাপ বাড়িয়ে চলতে হবে, যে বিকল্প প্যাকেজের মধ্যে থাকবে জনগণের আশু প্রয়োজন মেটানোর ঠিকানা এবং তা জনগণের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থকেও চরিতার্থ করবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ মে ২০২০)
শিলিগুড়ি : করোনার অজুহাতে শ্রম আইন তুলে দেওয়া, শ্রম দিবস ১২ ঘণ্টা করে দেওয়া, সমস্ত সরকারী সংস্থাগুলির বেসরকারীকরণ, বিরাষ্ট্রীয় করণের বিরুদ্ধে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারী খরচায় নিজ নিজ জায়গায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন-এর আহ্বানে দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসে শিলিগুড়ি শহরে বিক্ষোভ প্রতিবাদ মিছিল শেষে এসডিও-কে স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয়। সে সময় পুলিশ জোর করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব সমন পাঠক, অপু চতুর্বদী, রাণা বোস জয় লোধদের গ্রেপ্তার করে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে অভিজিৎ মজুমদার, মোজাম্মেল হক, অপু চতুর্বেদী, সিটুর সমন পাঠক সহ অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতৃবৃন্দ।
ফাঁসিদেওয়া: এআইসিসিটিইউ এবং সিআইটিইউ পক্ষে ফাঁসিদেওয়া বিডিও-কে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। দাবিগুলির সপক্ষে বিডিও অফিসের সামনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলে শ্লোগান-অবস্থান।
নেতৃত্বে ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে পবিত্র সিংহ, শরত সিংহ, দীপক ঘোষ, সিআইটিইউ-র সুশীল দেবনাথ প্রমুখ।
একদিনের ঝড়ে বিধ্বস্ত কলকাতা সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গের জনজীবন। যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন! একে অপরিকল্পিত লকডাউন, তার উপর মাথা গোঁজার জায়গাটুকু হারিয়ে বিপন্ন অসহায় অবস্থা সাধারণ খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষগুলোর – এমতো অবস্থায় কোনো ফাঁকা আওয়াজ বা ভিক্ষা নয়, সাইক্লোন আমফানকে অবিলম্বে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করে ঝড় বিধ্বস্ত বাংলার পুনর্নিমাণে কেন্দ্রীয় সরকারকে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে, এই দাবিতে শিলিগুড়িতে শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখানো হয়। নেতৃত্বে দেন জেলা কমিটির সদস্য পুলক গাঙ্গুলী, ব্রাঞ্চ সদস্য নীলিমা সরকার, গঙ্গা রায়, ভাগ্য মন্ডল, মণি ভট্টাচার্য, ছবি দত্ত, শেফালি মজুমদার, রুবী সেনগুপ্ত, শাশ্বতী সেনগুপ্ত প্রমুখ।
দঃ ২৪ পরগণা জেলা কার্যালয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন পার্টির দঃ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকার, জেলা কমিটির সদস্যা কমরেড দেবযানী গোস্বামী, কমরেড অঞ্জনা মাল,বজবজ শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড অঞ্জন ঘোষ, কমরেড দেবাশীষ মিত্র, কমরেড নন্দন, আইসার কমরেডরা এবং আরো অনেকে।
নজরুল প্রথমত একজন কবি কিন্তু তিনি শুধুই একজন কবি নন। তিনি সংগ্রামী, বিদ্রোহী। কবিতাকে তিনি সংগ্রামের, দ্রোহের ভাষা হিসেবে দেখতেন। তাঁর বিদ্রোহ পরাধীনতার বিপক্ষে, শোষণ, শাসন, অন্যায়ের বিপক্ষে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আর জাতপাতের বিরুদ্ধে। শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে তো বটেই। নারী পুরুষ অসাম্যও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। এগুলির বিরুদ্ধে দ্রোহকে নজরুল তাঁর কবি জীবনের একেবারে প্রথম পর্ব থেকেই নিজস্ব অভিজ্ঞান করে তুলেছিলেন। সেকারণেই তিনি পরিচিত হয়ে যান বিদ্রোহী কবি হিসেবে। যে কবিতার সূত্রে তাঁর এ পরিচয় প্রাপ্তি, সেই বিখ্যাত লাইনগুলিকে আর একবার স্মরণ করা যাক –
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না –
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
দ্বিধাহীনভাবে নজরুল তাঁর কবি জীবনের শুরুতেই এখানে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন তাঁর লেখালেখির উদ্দেশ্য।
নজরুলের কবিতা গান স্বাধীনতা সংগ্রামে খুব কাজে লেগেছিল, মানুষকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করত তাঁর লেখা আর সুর – এ আমরা জানি। শুধু তাঁর বই নিষিদ্ধ করেই শাসক নিশ্চিন্ত হতে পারেনি৷ অগ্নিবীণার কবিকে স্থিমিত করতে চেয়ে তাঁকেও জেলে পাঠিয়েছিল। তবুও থামানো যায়নি তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে। অনেকে সেই সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন – নজরুলের কবিতা যুগের প্রয়োজন মিটিয়ে কতখানি চিরকালীন হতে পারবে। এই প্রসঙ্গে শাশ্বত রাবীন্দ্রিক উচ্চারণের প্রসঙ্গও টানা হয়েছিল। নজরুল এই সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তাঁর আমার কৈফিয়ৎ কবিতায়। সমকালীন জীবনযন্ত্রণাকে ভাষা দিতেই তাঁর কবিতা লেখা। এই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য। সেই প্রাথমিক উদ্দেশ্য পালন করেই তিনি খুশি। তাঁর কবিতা মহাকালের দরবারে নান্দনিকতার কোন স্তরে অবস্থান করল, তা নিয়ে তিনি আদৌ ভাবিত নন –
বন্ধুগো আর বলিতে পারিনা, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসেনাক মাথায়, বন্ধু, বড় দুঃখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও বন্ধু যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করিনা, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার উপর জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে!
প্রার্থনা ক’রো – যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
আমরা আজ তাঁর লেখা ফিরে পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি, তাঁকে যুগের কবি হিসেবে চিহ্নিত করে যারা নান্দনিকতার বিচারসভা বসিয়েছিলেন, তাদের দৃষ্টিকোণ কতখানি খণ্ডিত ছিল। শিল্প সাহিত্য নান্দনিকতার বাঁধা গত মেনে চলে না। নজরুলের কাব্যে যে হৈ চৈ আর উচ্চকিত উচ্চারণ আছে, সেটা শুধু সমকালীন বাস্তবতাকে ধারণ করতেই কাজে লাগেনি। কবিতার ধারা যে নতুনত্বের প্রয়াসী, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় সেই নতুনত্ব সঞ্চারের ক্ষেত্রে তাঁর কবিতার এই বিশেষ রীতি অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ নামক প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন যে রবি প্রতিভার বলয়ের মধ্যেই যখন কালিদাস রায়, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, যতীন্দ্রমোহন বাগচীরা হারিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এই বিদ্রোহের ভিন্নতর উচ্চারণই নজরুলকে স্বতন্ত্র পথ খননে, নিজস্ব কবিতার ভাষা খুঁজে পেতে সাহায্য করল। নজরুল শুধু শাসকের চাপিয়ে দেওয়া আইন কানুন, দৃষ্টিকোণটিকেই ভাঙেননি, কবিতার প্রচলিত ধরন ও ব্যাকরণকে ভেঙেই নতুন নান্দনিকতা তৈরি করেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে।
নজরুল সাম্যের কথা বলেছিলেন সরাসরি। তাঁর “গাহি সাম্যের গান” কবিতাটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ম্যানিফেস্টো ধরনের।
গাহি সাম্যের গান–
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি? – পারসি? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বলো আরও!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক –
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও, য্ত শখ –
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? – পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!
নানা লেখায় অর্থনৈতিক সাম্য, ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত উদার মানবতাবাদ, জাতপাতহীন, লিঙ্গ বৈষম্যহীন, শ্রেণি শোষণহীন সমাজ তৈরির স্বপ্ন তিনি প্রকাশ করেছেন। এই স্বপ্ন নিয়েই বন্ধু মুজফফর আহমেদের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। এই পথকেই মনে করেছিলেন মুক্তির দিশা।
পুরনো আধিপত্যবাদ ও গোঁড়ামি ভেঙে তুরষ্কে কামাল পাশা যখন ইসলামিক দুনিয়াকে আধুনিক প্রগতির সঙ্গে সমন্বিত করছেন, তখন এই দেশ থেকে যাঁরা তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানান, নজরুল ছিলেন তাঁদের প্রথম সারিতে। তাঁর কামাল পাশা কবিতাটি গোঁড়ামিমুক্ত আধুনিক নজরুলের আরেকটি দিককে আমাদের সামনে উপস্থিত করে।
ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই !
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর সে সামাল সামাল তাই !
কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !
হো হো কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !
নজরুল সংগ্রামী, বিদ্রোহী। আবার নজরুল মরমীও। এই মরমী নজরুলের ছবি রয়েছে তাঁর গানে। যে নজরুল ইসলামিক ঐতিহ্য থেকে অজস্র প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন, আরবী ফারসী তুর্কি শব্দে সাজিয়ে তোলেন তাঁর রচনাকে, সেই নজরুলই অক্লেশে কালি আর কৃষ্ণকে নিয়ে লিখতে পারেন মরমীয়া গান। এই উদারতার নামই নজরুল যাকে আমাদের সাম্প্রদায়িক হিংসা বিধ্বস্ত ভারতে আজ বড় প্রয়োজন।
-- সৌভিক ঘোষাল
এক সপ্তাহ হয়ে গেল ঝড় আমফান বা উমফুন কলকাতা সহ এরাজ্যের দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির উপর দিয়ে বয়ে গেছে। মানতেই হবে জীবিত রাজ্যবাসীর জীবনে এটি সবথেকে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্বিপাক। এর আগে কোনো ঝড়, ভূমিকম্প এমনকি বন্যাও এই পরিমাণ মানুষকে এক রাতে বিপর্যস্ত করেনি। শোনা যাচ্ছে রাজ্যের ৬০% অধিবাসীই নাকি আপফানের আক্রমণে আহত, কমবেশি। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, ঝড়ে আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে কোটি কোটি নাগরিকের। ক্ষতির পরিমাণ লক্ষ কোটি টাকার উপর, এখনো অপরিমেয়। অবশ্যম্ভাবীভাবেই অধিবাসীদের সমস্ত ক্ষতি পূরণ করা হবে না। নুতন করে প্রায় শূন্য থেকে শুরু করবেন বহু সহনাগরিক। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে। এই ক্ষতিপূরণের দায় কার? ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির না রাষ্ট্রের? যারা মারা গেছেন তাঁদের পরিবারকে দুই ও/বা আড়াই লাখ এবং আহতদের পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওযা যৎকিঞ্চিৎ হলেও তার মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র দুর্যোগের ফলে উদ্ভুত ক্ষতি মেটানোর দায় স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং, ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের যতদূর সম্ভব পূর্বাবস্থায় পুনর্বাসনের দায়ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। যে সমস্ত শহর বা শহর সন্নিকটবর্তী বসবাসকারী সুধীজন নিজগৃহে বিদ্যুৎ ও জলসরবরাহের দীর্ঘকালিন বিঘ্ন ঘটার দরুণ প্রভূত বিচলন দুর্ভোগ ও যাতনার শিকার হয়ে রাস্তা অবরোধ করছেন ও রাজ্য সরকার, পুর কর্তৃপক্ষ এবং বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থাকে দায়ী সাব্যস্ত করছেন, এবং যথার্থ কাজই করছেন, নিজগৃহে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থা ফেরার পরে তাঁদের পুনরায় রাস্তায় নামা উচিৎ ওইসব ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত অঞ্চলের নিরাশ্রয়, ফসল ধ্বংসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত, বিদ্যুৎহীন নাগরিকদের সুষ্ঠু যতদূর সম্ভব পূর্বাবস্থায় পুনর্বাসনের দাবিতে। হয়তো কেউ বলবেন এটি রাজ্য সরকারের দায়িত্ব, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে, প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হয়, দেশপ্রেম তথা রাষ্ট্রপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হয়, বহুক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহ তথা দেশদ্রোহের দায়ে জেলে যেতে হয়, আর যে ঝড়ের উৎপত্তি ও গতি রাজ্য নিরপেক্ষ তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের পুনর্বাসনের দায় যদি দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের না হয় তাহলে তেমন দেশ থাকার দরকার কী?
ঝড় বিদায় নেওযার এক সপ্তাহ পরেও কলকাতা শহরের বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও পানীয় জল পরিষেবা স্বাভাবিক হয়নি। প্রথম ৪ দিন তো পুরো শহর জুড়েই হাহাকার চলেছে। সকলেই দায় এড়িয়েছেন কিংবা দায় চাপিয়েছেন একে অন্যের ঘাড়ে। প্রায় সাতদিন আগে থেকে আবহাোযা দফতরের তরফে ঝড়ের পূর্বাভাস ও তদনুযায়ী ঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সত্বেও কেন যথাবিহিত প্রস্তুতি ছিল না? অবশ্যই শাসক দল, সরকার, পুরসভা ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থাকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যতে না ঘটে তার জন্য বন্দোবস্ত করতে হবে। কিন্তু ঘটনাটি ঘটল কেন, এমন কোনো যথাযথ প্রস্তুতি কি নেওয়া সম্ভব যার দ্বারা ঝড়ে বিদ্যুত বিপর্যয় হবে না বা হলেও অব্যবহিত পরেই পরিবহণ, জলসরবরাহ, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট প্রভৃতি অনায়াসে সুব্যস্থিত হবে? মনে রাখা দরকার দেশ জুড়ে সমস্ত পরিষেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা সমেত, বানিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। যেটুকু বাকি আছে তাও বর্তমান পর্যায়ের ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের ঘোষণা অনুযায়ী তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। বহু মানুষই সরকারী ক্ষেত্রের অদক্ষতা ও বেসরকারী ক্ষেত্রের কর্মদক্ষতা নিয়ে সরব থাকেন। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে বেসরকারী বানিজ্যিক মুনাফার লক্ষ্যে চালিত পরিষেবাগুলি কর্মদক্ষতা দেখাতে অযোগ্য হিসেবেই সাব্যস্ত হয়। কারণ বেসরকারী সংস্থাগুলি মুনাফা সর্বাধিক করতে চায়। ফলে বাধ্য না হলে তারা অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা রাখতে চায় না। কিন্তু জরুরি পরিষেবাকে বিপর্যয়ের সময়ে বজায় রাখতে গেলে অতিরিক্ত ক্ষমতা বজায় রাখতেই হবে। কলকাতা, হাওড়া ও হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তাকে সিইএসসি। মুখ্যমন্ত্রী ও তার সরকার সিইএসসির গাড়ে দায় চাপিয়ে পাপস্খালন করল। ওদিকে দুর্যোগ আক্রান্ত উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায়, যেখানে বিদ্যুত সরবরাহের দায় রাজ্যসরকারের অধীন কর্পোরেট সংস্থা এসইডিসিএল-এর উপরে ন্যস্ত সেইসব স্থানের বহু গ্রাম শহরে যে আগামী কতদিন বিদ্যুৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে সে ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করল না। মনে রাখা দরকার এসইডিসিএল-ও কিন্তু বাণিজ্যিক সংস্থা ও মুনাফাই তার সাফল্যের মাপকাঠি। ব্যাপক বিস্তৃত এই অঞ্চলগুলিতে সুপার সাইক্লোন এলে বিদ্যুৎ সরবরাহকে ঝড় পরবর্তীতে ব্যবস্থিত করতে যে পরিমাণ সাজ সরঞ্জাম ও শ্রমিক বহাল রাখা দরকার তা কখনোই রাখা হয় না কারণ সেক্ষেত্রে মুনাফা কমে যাবে। নিত্য নৈমিত্তিক যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয় তাকে কিছু সমযের মধ্যে, শহরাঞ্চলে কয়েক ঘণ্টা ও গ্রামাঞ্চলে দু-একদিনের মধ্যে, মেরামত করার জন্যই বন্দোবস্ত থাকে। বিদ্যুৎ যোগাযোগের মেরামত যথেষ্ট ঝুঁকি সম্পন্ন ও অভিজ্ঞ শ্রমিকের প্রয়োজন। ফলে সাত দিনের প্রস্তুতিতে নিয়োগ করা সম্ভব নয়। এছাড়া, এখন চুক্তির ভিত্তিতে কাজের যুগ। সিইএসসি নিজেদের শ্রমিকের বদলে কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে কাজ করায়, সস্তায় হয় বলে। লকডাউনে কাজ না থাকায় শ্রমিকদের মজুরি জোটেনি কন্ট্রাক্টরের কাছে। তাঁরা বাড়ি ফিরে গেছেন। ফলে একেই কমজোরি মেরামত ব্যবস্থা আরো দুর্বল হয়েছে। একটি অতি জরুরি পরিষেবাকে কেবল মুনাফার দৃষ্টিতে দেখলে যে অনাছিস্টি হতে পারে তা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।
কলকাতা পুরসভাও সারা শহরে গাছ কাটার জন্য মাত্র ২২টি বৈদ্যুতিক করাত কিনে রেখেছে। স্বাভাবিক সময়ে হয়তো তাই যথেষ্ট। কিন্তু আমফান পরবর্তী পরিস্থিতিতে যেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে তখন ২২টি করাত দিয়ে দ্রুত গাছ কাটা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেই ওই ব্যয় সঙ্কোচনের তত্ত্ব কাজ করেছে। হয়তো বা অতিরিক্ত করাত বরাত দিয়ে কিছু পাওয়া যেতে পারত কিন্তু সেটা চালানোর প্রশিক্ষিত কর্মীতো পাওযা যেত না। ফলে, সেই এক অর্থনৈতিক মুনাফা সর্বাধিকীকরণের প্রশ্ন, যদিও পুরসভা বাণিজ্যিক সংস্থা নয়, কিন্তু দেশের সমস্ত পরিষেবাকে যদি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হতে থাকে, পুরপরিষেবাও সেই দৃষ্টিভঙ্গীতেই পরিচালিত হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ১৯৯১ সালের নয়া অর্থনৈতিক নীতির পর থেকে পুর পরিষেবার বিষয়সমূহকে, যেমন জল, বাণিজ্যকীকরণ করার কথা বলা হয়েছে। এই ধরনের পরিষেবা যত বেশি বানিজ্যকীকরণ হবে ততই, সেখানে বিপর্যয়ের সময়ে কর্মী ও যন্ত্রের অপ্রতুলতা ঘটবে। ফলে বিপর্যয় পরবর্তী কষ্ট বাড়বে।
বিদ্যুৎ পরিষেবার ক্ষেত্রে যদি সমস্ত ব্যবস্থাটি মাটির তলার তার দিয়ে যেত তাহলে ঝড়ের দাপটে পরিষেবার বিঘ্ন কম হত। এমনটা ভাবাই যায়। কিন্তু তা আমাদের আলোচনার মূল ভিত্তিটাকে ব্যর্থ করে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেবল ঝড় নয়, তা ভূমিকম্প, বন্যাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটবে তাকে সামাল দিতেও প্রভূত বন্দোবস্ত রাখতে হবে যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অব্যবহৃত থাকবে ও যার জন্য কৃত ব্যয়কে অনাবশ্যক বলে মনে হবে। সেই তথাকথিত অনাবশ্যক ব্যয় কখনোই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিচালিত সংস্থা করবে না।
এটা অবশ্যই সত্য যে, তৃণমূল কংগ্রেস শাসক দল হিসেবে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এই পরিস্থিতির মোকাবিলায়। সেটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ও তাঁদের নেতা-কর্মীরা সমস্ত দুর্বিপাকের মধ্যে মুনাফার খোঁজ করে। যেমন নরেন্দ্র মোদি- সীতারামণরা কোরোনার দুর্বিপাকে আবিশ্ব জর্জরিত থাকার সময়ে কীভাবে বেসরকারী ক্ষেত্রের কাছে ভারতে অর্থনীতিকে আরো উন্মুক্ত করা যায় তার রাস্তা তৈরি করল, অমিত শাহ গণআন্দোলনের কর্মীদের গ্রেফতারের চক্রান্ত করল, তেমনি তৃণমূলের নেতা কর্মীরা প্রচুর গাছ রাস্তায় উপড়ে পড়াতে সেই গাছ বিক্রির টাকা থেকে কমিশনের স্বপ্ন দেখল। লকডাউনের সময়ে বামপন্থীরা যখন ত্রাণ নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে, তৃণমূলীরা তখন কলকাতা কর্পোরেশনের ১০৫নং ওয়ার্ডে সিপিআইএমএলের স্থানীয় সম্পাদকের উপরে হামলা করছে। একইভাবে ঝড়ের দুর্গতিতে, বামপন্থীরা যেখানে সামান্য হলেও শক্তি ধরেন, সেইসব স্থানে গাচ বা রাস্তা পরিস্কারে হাত লাগান, কিন্তু তৃণমূলীরা ক্ষমতায় থাকা সত্বেও কায়িক শ্রম থেকে বিরত থেকে বিদ্যুৎ কর্মীদের উপরে হামলা করেন, কলকাতা কর্পোরেশনের ৯২নং ওয়ার্ডের বামপন্থী মহিলা কাউন্সিলরের উপরে চড়াও হয়।
তৃণমূল সরকারের এই সার্বিক দুর্নীতি ও অদক্ষতা অবশ্যই পরিস্থিতিকে জটিল করেছে, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়োত্তর পরিস্থিতিকে সামাল দেওযার উপযুক্ত পরিকাঠামোগত বন্দোবস্ত না থাকার কারণ অনেক গভীরে, অর্থনীতির সার্বিক বাণিজ্যিকীকরণের মধ্যে নিহিত আছে।
--- অমিত দাশগুপ্ত
ওরা প্রাণপণ যুঝে ছিল সন্ধ্যে থেকে মধ্যরাত। ভয়াবহ গর্জনের মধ্যে রোগা শরীরগুলো লুটোপুটি খাচ্ছিল। নিষ্প্রদীপ রাতের নিকষ আঁধারে ওরা একা একা যুঝে যাচ্ছিল। রাতশেষে স্তব্ধ তছনছ ভোরের আলো সাক্ষী রইল সেই দৃশ্যের – পরাহত বিধ্বস্ত অনেকেই গোড়া উপড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে নোংরা জলে, কাদা মাখামাখি হয়ে। তীব্র অপরাধ বোধে ভোগা দুটো দিন পার করে অবশেষে সেই নিষ্ঠুর অনিবার্যতাকে মেনে নিতে হল। কুড়ুলের এলোপাথাড়ি কোপে আধ ঘণ্টায়, তখনও সজীব সেই প্রাণ, কয়েক টুকরো কাঠের গুঁড়িতে পরিণত হয়ে গেল। নেমে এসেছে কেমন একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা। পাখিদের দিনভর জলসা নেই। কাঠবেড়ালিদের অনন্ত ছুটোছুটি আর কিচির মিচির নেই। বেজীপরিবারকেও দেখা যাচ্ছে না। শুধু কাকেদের কর্কশ ডাকের বাস্তবতা যেন শূন্যতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ তো গেল শহরতলির গেরস্থের আঙিনার কথা।
সুপার সাইক্লোন আমফান গোটা দক্ষিণ বঙ্গকেই তছনছ করে দিয়ে গেছে। অসংখ্য নদী বাঁধ ভেঙে গেছে।ক্ষেতের ফসল জলের তলায়। বিঘের পর বিঘে সবজি চাষ নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েক লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ত্রাণ শিবিরে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে হাজার হাজার ঘর বাড়ি। সরকারি হিসেবেই এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৮৬ জন। বালক বালিকাও আছে তাদের মধ্যে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সবুজের। ঝড়বিধ্বস্ত জেলাগুলোতে অসংখ্য গাছ পড়ে গেছে।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বিপন্ন, দিঘার ঝাউবীথির সৌন্দর্যও কেড়ে নিয়েছে আমফান। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।সেখানে ৪.৬৭ একর জুড়ে থাকা, ২৭০ বছরের পুরোনো পৃথিবীর বৃহত্তম বটগাছটিও ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে গেছে অন্যান্য দুর্লভ বহু গাছ। যশোর রোডের যেসব শতাব্দী-প্রাচীন গাছ বাঁচানোর জন্যে পরিবেশ কর্মীরা দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, এমনকি আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছেন, রেহাই পায়নি তারাও ঝড়ের তাণ্ডব থেকে।
কলকাতার ২%-এরও কম অঞ্চল সবুজ আবৃত। সেই বৃহত্তর কলকাতায় সিএমসি’র হিসেব অনুযায়ী ৫০০০ (পরিবেশবিদদের মতে ১০০০০)-এরও বেশি গাছ উপড়ে গেছে। মহানগরের গলি থেকে রাজপথে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার ছিন্নমূল গাছ। এইসব গাছের অনেকগুলিই প্রাচীন-পঞ্চাশেরও বেশি বয়েস তাদের। আর এরা রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়ার মতো নরম গাছও নয়। পথের দু'ধারের তরুবীথির প্রায় এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর নেচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জানিয়েছে, একটি পঞ্চাশ বছরের পুরোনো বটগাছ বছরে পরিবেশে যে অবদান রাখে তার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের মত বিষাক্ত গ্যাস থেকে বাতাসকে মুক্ত করা, অক্সিজেনের যোগান দেওয়া, পশু পাখিদের আশ্রয় দিয়ে জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করা, ভূমিক্ষয় রোধ করা -- এসব কিছুই সেই অবদানের মধ্যে পড়ে। পরিবেশবিদরা বলছেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছের ক্ষতিপূরণ করতে অন্তত দশটি গাছ বসাতে হবে।কলকাতার হারানো সবুজ ফিরে পেতে তবুও দশ থেকে পনেরো বছর লেগে যারে।
কাল হোক, পরশু হোক--লকডাউন উঠবে। মহানগরের রাস্তায় ছুটবে প্রায় আট লাখ গাড়ি। কিন্তু দূষণরোধী বন্ধুরা আর তখন থাকবে না সবুজ ছায়া বিস্তার করে। তাই আচমকাই অনিবার্য ভাবে বেড়ে যাবে বাতাসের দূষণমাত্রা। এই অশনি সংকেত কি আমাদের হুঁশ ফেরাবে?
-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
করোনা ভাইরাস প্রতিহতে লকডাউনের দাপাদাপি সকলের মুখে মুখে। আবার কাশ্মীরে আগস্ট, ২০১৯ থেকে নিরাপত্তার নামে লকডাউন প্রয়োগের ইতিহাসও টাটকা।
মানব ইতিহাসে সংক্রামক রোগ প্রতিহতে চীনে লকডাউনের ব্যবহার প্রথম শুরু হয়, সফলতাও আসে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অন্যান্য পন্থার সাথে কখনো কখনো লকডাউনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু সমস্যা হল অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে। লকডাউন সত্ত্বেও আমেরিকা, ইউরোপে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা আটকাতে সাফল্য এলো না। আবার কোনো কোনো দেশ লকডাউনের সাহায্য ছাড়াই সফল হল।
সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদ্ধতির ধারণা মহামারীর ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায়। যেমন, পঞ্চদশ শতাব্দীতে, রোগীকে আলাদাভাবে রাখা ( আইসোলেসন) বা ষোড়শ শতকে, সুস্থ মানুষকে রোগের ছোয়াছুঁয়ি থেকে দূরে (কনফাইনমেন্ট) রাখা ইত্যাদি। জনস্বাস্থ্য(পাবলিক হেলথ) সম্পর্কিত ধারণা বিকাশের সাথে সাথে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানে আরো কিছু শব্দ যুক্ত হয়েছে। যেমন, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং এবং তার উন্নত রূপ কোয়ারিন্টিন ও লকডাউন। শব্দগুলি শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্য বিষয়ক (পাবলিক হেলথ মেজার)। তাই যে দেশে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য পরিকাঠামো ও পরিকল্পনা বর্তমান, একমাত্র সেখানেই এই উপায়গুলির সুশৃঙ্খল ও সফল প্রয়োগ সম্ভব।
ক) পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য :
রাষ্ট্র এই জনমুখী পরিষেবার পরিচালক ও নিয়ন্তক। লক্ষ্য, কমিউনিটিকে ভিত্তি করে সকলের জন্য স্বাস্থ্য ও তার সুরক্ষা। এই পরিষেবার বিশেষ দিক হছে কমিউনিটির সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ। এপিডিমিওলজিস্ট ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা এই বিভাগের অন্তর্গত ও উপদেষ্টা। তাঁরাই এপিডেমিক রুখতে সারা বছর ধরেই বিভিন্ন পরিকল্পনা, আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং কমিউনিটিকে স্বাস্থ্য সচেতন ও সক্রিয় করেন। কমিউনিটিতে কোনো বিশেষ রোগের প্রবণতা, প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা, ইমিউনিটির মাত্রা, ইত্যাদি সব তাঁদের নখদর্পণে থাকে।
জনস্বাস্থ্যের ধারণা শুরু হয় ১৮৪০, ইংল্যান্ডে; কলেরা এপিডেমিক থেকে। জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কল্যাণেই, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, এমনকি ভারতের অঙ্গরাজ্য কেরল দ্রুততার সঙ্গে করোনা প্রবাহকে থামাতে সক্ষম হয়েছে।
খ) কিউরেটিভ মেডিসিন (রোগ নিরাময় বিজ্ঞান): রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা। এই বিভাগকে কেন্দ্র করেই স্পেশ্যালিটি, সুপার স্পেশ্যালিট, ঝাঁ চকচকে চিকিৎসা কেন্দ্র বা হাসপাতাল। এরই ভুলভুলাইয়ায় চিকিৎসার জন্য মানুষ ছুটছে শহর থেকে শহরে, দেশের ভিতর ও বাইরে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই শাখাটি স্বাস্থ্য বাণিজ্যের প্রাণ ভোমরা। ব্যবসায়িক দিক থেকে এই চিকিৎসা বিজ্ঞান যে দেশে যত পরিব্যাপ্ত, করোনা মোকাবিলায় সেই দেশের বিপর্যয় তত বেশি।
কিন্তু আমরা কী দেখলাম? করোনা প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনায় মিডিয়ায় তুফান তুলছেন, পত্রপত্রিকায় লিখছেন, সরকারকে উপদেশ দিচ্ছেন পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের বদলে কিউরেটিভ মেডিসিনের নানা শাখার দিকপালেরা।পাবলিক হেলথ সম্বন্ধে যাঁদের অভিজ্ঞতা ও অধ্যাবসায় প্রায় শূন্য। ব্যাপক হারে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করেই চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে।
তাইওয়ান: (স্বাস্থ্যে খরচ: ২০১৭ ,জিডিপি র ৬.৪%)
করোনা প্রতিরোধে তাইওয়ানের সাফল্যে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের(হু) কাছে নিউজিল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী তাইওয়ানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তার কারণ ছিল তাইওয়ানে বিভিন্ন পদক্ষেপের সাথে অনেক এপিডেমিওলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং লকডাউন প্রয়োগ না করার জন্য।
ভিয়েতনাম: (স্বাস্থ্যে খরচ: ২০১৭, জিডিপি র ৭.৫%)
সাফল্যের আরেক দাবিদার। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেখানে স্বাধীনতার (১৯৭৫) প্রথম থেকেই নজরকাড়া।৷ ফলে মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা মর্যাদাপূর্ণ। করোনায় মৃত্যু ভিয়েতনামে শূন্য। যেটা উল্লেখযোগ্য, ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একজন এপিডেমিওলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অভিজ্ঞ ও গবেষক। রোগ নির্ণয়ে গণহারে পরীক্ষার বদলে স্যানিটাইজেশন, সামাজিক দূরত্ব ও কোয়ারিন্টিনকে তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন। শুধু দুটি স্থানে লকডাউন। আর প্রথম থেকেই থেকে উড়ানের আসা যাওয়া বন্ধ।
দক্ষিণ কোরিয়া : (স্বাস্থ্য খাতে: জিডিপি-র ৮.১% )
গণহারে পরীক্ষা করে আক্রান্তদের পৃথকীকরণ, রুগীর নিকটস্থদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে কোয়ারিন্টিনে রাখাতে এঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে কোনো শহরকে লকডাউন এখানে করা হয়নি।
মৃত্যু: ২৬০ (১৩ মে পর্যন্ত)।
চীন : (স্বাস্থ্যে খরচ : ২০১৮, জিডিপি-র ৬.৫৭%)।
এখান থেকেই, বলা হচ্ছে কোভিডের শুরুয়াত। একমাত্র উহান ও তার লাগোয়া অঞ্চলে করোনাকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা এবং অন্যান্য রাজ্যে ব্যাপক হারে না ছড়াতে দেয়ার সাফল্যে অনেকেই সন্দিগ্ধ। আসলে আমাদের কোনো বাস্তব ধারণাই নেই, পাবলিক হেলথ সিস্টেম শক্তিশালী হলে কত দ্রুততার সাথে অসাধ্য সাধিত হতে পারে। চীন সেই দৃষ্টান্ত।
চীনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রথম থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে প্রিভেনটিভ ও কমিউনিটি চিকিৎসা (১৯৪৯-৭৮)। ১৯৮০-র দশক থেকে চীন বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করলে সরকার প্রিভেনটিভ চিকিৎসা থেকে হাত গুটাতে শুরু করে। “ফেলো কড়ি মাখো তেল” ভিত্তিতে শুরু হয় ব্যয় বহুল চিকিৎসা। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গুরুত্বহীন হয়ে যায় (১৯৭৯-২০০৩)। ২০০২, সার্স-১ করোনা ভাইরাসের আক্রমণ সব হিসাব পাল্টে দিল। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্জন্ম ঘটলো। বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে। তৈরি হল জনস্বাস্থ্যের জরুরি বিভাগ (পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি) শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত; দেশজুড়ে দ্রুততম উপায়ে সংক্রমণের খবর দেওয়া নেওয়ার নেট ওয়র্ক। ২০০৯ থেকে শহর ও গ্রামের প্রত্যেককে বিনামূল্যে বেসিক পাবলিক হেলথ সার্ভিস দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং উন্নত মানের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে নিয়ে করোনার গতি রোধে চীন তাই সফল। বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে বেশ কিছু শহরে চীন লকডাউন লাগু করে। মনে রাখতে হবে, করোনার প্রথম পরীক্ষাগার চীন। ভাইরাসকে চেনা ও তার সংক্রমন পদ্ধতি বুঝতে সময় চলে যায় প্রায় এক মাস। ততক্ষণে “কমিউনিটি ট্রান্সমিশন” শুরু হয়ে গেছে। ২০ জানুয়ারী চীন নিশ্চিত হয়, ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। অন্য দেশকে আবিষ্কার বিজ্ঞানের এই কঠিন সময়টুকু অতিক্রম করতে হয়নি।
ভারত : (স্বাস্থ্যে খরচ: ২০২০, জিডিপি-র ১.২৯ %)
কেরল রাজ্য ছাড়া ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা মর্মান্তিকভাবে অবহেলিত ও উদ্বেগজনক। ৩০ জানুয়ারী হু কোভিডকে গ্লোবাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে। সেদিনই কেরালায় প্রথম করোনা রুগী চিহ্নিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকেই ভারতের এই অঙ্গ রাজ্যে করোনার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ শুরু হয়। কন্টাক্ট ট্রেসিং করে তিন হাজার জনকে কোয়ারিন্টিন করা হয়। সেখান থেকে ৪৫ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ৫ মার্চ, হু’র ডিরেক্টর জেনারেল টুইট করলেন, কোভিড-১৯ সব দেশের কাছেই বিপদজনক। প্রতিটি দেশের সরকার যেন খোলা মনে, দ্রুততার সাথে তাদের জরুরি পরিকল্পনা ও পরিষেবাকে সক্রিয় করেন। ১০ মার্চ হু করোনাকে প্যান্ডেমিক ঘোষণা করে। সেদিনই কেরল সরকার স্কুল কলেজ বন্ধের নির্দেশ দেন। ১২ মার্চ ভারতে করোনার হিসাব ছিল : মৃত ০২; আক্রান্ত ৮১। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিরুত্তাপ। হু’র পরামর্শকে তুড়ি মেরে, ১৩ মার্চ তিনি জানালেন, করোনার কোনো ইমার্জেন্সি নেই। আবার ঠিক সাত দিনের মধ্যেই জনতা কার্ফু এবং তার পরপরই নাটকীয়ভাবে লকডাউন ঘোষণা করলেন ২৪ মার্চ। কাকপক্ষীকে আঁধারে রেখে দেশের ২৯টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে একসাথে। শাঁখের করাতের মতো প্রথমে বিপদ ঘটালেন করোনাকে প্রতিরোধ না করে, পরে বিপদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেন লকডাউনের অবিমৃষ্য সিদ্ধান্তে।
নিজেদের বাসগৃহ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা, কয়েক কোটি (১১ কোটি ৩০ লক্ষ) মজুরের জীবনকে ভাসিয়ে দেওয়া হলো বাণের জলে। দীর্ঘকাল ধরে কৃষি উৎপাদনে ধুঁকতে থাকা কৃষি ভারতকে পরিযায়ী শ্রমিকরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। হঠাৎ চাপানো লকডাউনে একদিকে অসংগঠিত শ্রমিকদের বিপর্যয়, অপরদিকে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় উৎপন্ন কৃষি পণ্যের বাজারে ধ্বস, গ্রাম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষের গ্রাসে ঠেলে দিল ।
ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে মুহূর্তের মধ্যে ১৩৫ কোটি মানুষকে গৃহবন্দী করা হল। কিন্তু আমরা দেখেছি লকডাউন না করেও দেশকে করোনা মুক্ত রাখা যায়।
প্রতিরোধের প্রাথমিক উপায়গুলিকে সময় মতো গুরুত্ব না দিয়ে এক লাফে যুদ্ধং দেহি মনোভাব। শুরু হয়ে গেল রাস্তায় পুলিশের টহল ও শাসানি। ঘরে ঘরে আতঙ্ক! কমিউনিটির অংশগ্রহণের বদলে “কমিউনিটির গ্রহণ”। দেখলাম, অসহায়, ক্ষুধার্ত জনতার দুর্গম পথচলা মারী ও মরণকে সাথে নিয়ে। বুঝলাম লকডাউনের ঝাঁকি করোনাকে নয়, সাধারণ ভারতবাসীকে।
মরণাতঙ্কের আবহে আমআদমি যখন করোনা সমস্যা সমাধানে দিশেহারা, কয়েক হাজার কোটির সম্পদ লুটে নিয়ে নীরব, মালিয়ার দল দায় মুক্ত হয়ে সুখ নিদ্রায়। শাহিনবাগের শামিয়ানা ভেঙে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন সরকার পক্ষ। এনআরসি-র বিক্ষোভ থামিয়ে কপালের ঘাম মোছে স্বরাষ্ট্র দপ্তর। একের পর এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কারারুদ্ধ। অব্যাহত সাম্প্রদায়িক বিষোদ্বমন ও আক্রমণ। মে দিবসের অর্জিত অধিকার ভূলুণ্ঠিত ভারত সরকারের পদতলে। জীবন্মৃত, গৃহবন্দী জনতা প্রমাদ গোনে হৃত স্বাধীনতার।
অণু জীবের ক্রম বিবর্তনের কারণে বিভিন্ন রূপের আত্মপ্রকাশ। নবাগত জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক নির্মাণ সময় সাপেক্ষ। কিন্তু প্রতিরোধের বিজ্ঞান জানা স্বত্বেও যদি তার প্রয়োগে রাষ্ট্র নির্বিকার থাকে কিংবা অপপ্রয়োগ করে তবে সে দায় রাষ্ট্রের পরিচালকদের।
করোনার বিরুদ্ধে লকডাউন ভারতের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাসে বিষ্ময়সূচক ও প্রশ্ন চিহ্ন রেখে গেল।
-- ডাঃ সমীর দাশগুপ্ত
সব আতংকের অবসান ঘটিয়ে সুপার সাইক্লোন আম্পান কিছুটা দুর্বল হয়ে বাংলাদেশকে আঘাত করেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমরা ভাবলাম, যাক বাবা! এবারের মতো বেঁচে গেলাম। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেকে বললেন, এবারও সুন্দরবন বুক দিয়ে আগলে রাখলো বাংলাদেশকে। বাস্তবেও তাই। সুন্দরবন বার বার ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন থেকে রক্ষা করে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলকে। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন করে রক্ষা করেছিলো বুলবুল, ফনী, আইলা, সিডর-এর আঘাত থেকে। এবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ৪০০ কিলোমিটার ব্যাসের সাইক্লোন আম্পানের গতিবেগ ২২৫ কিলোমিটারের বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রমের সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। গতি কমে যাওয়ার কারণ সুন্দরবন। ভারতের সমুদ্র উপকূল দিঘা, কাকদ্বীপ ও সুন্দরবন অংশে তাণ্ডব চালিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা দিয়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে আম্পান। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ আর বাংলাদেশের অংশ রাজনৈতিক ভূগোল বিবেচনা করেনি, অনুসরণ করেছে প্রাকৃতিক নিয়ম। বাতাসের ঝড়ো গতি আর দমকা হাওয়াকে ঠেকিয়ে দিয়েছে ঘন অরন্যের গোলপাতা, কেওড়া, সুন্দরী গাছেরা মিলে। আর দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতিকে বুঝতে হলে দেখতে হবে ভাল করে আর জানতে হবে তার নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম না বুঝে প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করলে তার ফল ভাল হয় না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে মুনাফার পিছনে ছুটতে ছুটতে মানুষকে পিছনে ফেলে দিলে তাঁকে উন্নয়ন বলে কিনা সে প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে আজ।
সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় প্রকৃতির শক্তিশালী নিয়ামকগুলোর মধ্যে অন্যতম। একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় যে পরিমাণ শক্তির জন্ম দেয় ও নির্গত করে তা পারমাণবিক বোমার চাইতেও বহুগুণ শক্তিশালী। সমুদ্রের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়ে ঘূর্ণিঝড় অগ্রসর হতে থাকে স্থলভাগের দিকে এবং আছড়ে পরে। উৎপত্তিস্থল অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়কে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হলে একে বলে টাইফুন। ভারত মহাসাগর ও অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে সৃষ্টি হলে সেটাকে বলা হয় সাইক্লোন। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়কে বলে হারিকেন। বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর গড়ে ৩০ টি করে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় যা সাইক্লোন বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি মাঝারি শক্তির এবং দু-একটি প্রচণ্ড শক্তির হয়ে থাকে।প্রকৃতিতে ঘূর্ণিঝড় স্বাভাবিক ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানিরা বলছেন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যত বাড়ছে, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং শক্তিও ততই বাড়ছে। আবার উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা, ফলে অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্ক করছেন এই বলে যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ভবিষ্যতে লাগামহীন হয়ে পড়বে। আর বঙ্গোপসাগরের আশেপাশের অঞ্চল হবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলোর একটি। বৈশ্বিক উষ্ণতার লাগাম টেনে ধরতে হবে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু কে বা শোনে সে কথা!
সুন্দরবন যে মায়ের মতো আগলে রাখে, রক্ষা করে সমুদ্রের রুদ্র রুপের আক্রমণ থেকে তা আমরা দেখি কিন্তু মনে রাখি না। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মৃত্যু বরণ করেছিল প্রায় ৫ লাখ মানুষ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলে। মৃত্যু বরণ করে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। প্রায় সমান শক্তি নিয়ে ২০০৭ সালে সিডর আঘাত হানে খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাট বরগুনা অঞ্চলে। এতে মৃত্যু বরণ করে সাড়ে তিনহাজার মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যার পার্থক্যের কারণ হল, চট্টগ্রাম নোয়াখালী হাতিয়া সন্দীপ অঞ্চলে সুন্দরবন নেই, বাতাসের এবং জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা ঠেকাবার মতো কোনো প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল নেই সে অঞ্চলে। সে কারনেই সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে এই যুক্তি করা হয়েছিল যে সুন্দরবন থেকে হিসেব করা যায় এমন দৃশ্যমান আয় শুধু হয় না, ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে তার হিসাবটাও করা দরকার। তাহলে বুঝতে কষ্ট হবে না সে আমাদের কতখানি এবং কী দেয়। সুন্দরবন সংলগ্ন জেলা উপজেলাগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ শ্রমজীবী, বনজীবী সুন্দরবনে যায় গোলপাতা, মাছ, কাঠ, মধু আহরণের জন্য। দিনে গড়ে ৫০০ টাকার সম্পদ নিয়ে এলেও তার বাজার মূল্য দাঁড়ায় দিনে ২৫ কোটি আর বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা। এতো গেল সাধারণ দরিদ্র মানুষের আয়ের কথা, অসাধারণ এবং বড় ব্যবসায়ীদের আয় কত? পর্যটন থেকে আয় কত? এসব হিসেবের সঙ্গে প্রাকৃতিক প্রহরী হিসেবে সম্পদ রক্ষা করে কত, তা যুক্ত করলে সুন্দরবন কে ধংসের যে কোন কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা সবার দায়িত্ব হয়ে পড়া উচিত।
রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ওরিয়নের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুন্দরবন ঘিরে ১৫০টির বেশি শিল্প স্থাপনা নিয়ে প্রতিবাদের একটাই লক্ষ্য ছিল সাময়িক মুনাফার জন্য প্রকৃতির এবং মানুষের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বন্ধ করা। নির্বিচারে বন উজাড়, বসতি স্থাপন, দখল, নদী ভরাট, দিন রাত পণ্যবাহী নৌযান চলাচল প্রভৃতি কারনে সুন্দরবন আয়তনে শুধু ছোট হয়ে যাচ্ছে তাই নয়, এর প্রকৃতিতেও পরিবর্তন আসছে। কমে যাচ্ছে মাছ, গাছ, বাঘ, কুমির, ডলফিন। বন্য প্রাণির অবস্থা দেখে বোঝা যায় বনের অবস্থা কেমন! প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের পর ভেঙ্গে যাওয়া বেড়ি বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা, গাফিলতি এবং দুর্নীতি হলেও মহাপ্রাণ সুন্দরবন যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে এবং পরবর্তী ঝড়ের মোকাবিলা করে। কিন্তু মানুষের নির্বিচার হামলা ও আক্রমণের সামনে সে হয়ে পড়ে অসহায়। এবারও আম্পানের ছোবল থেকে আমাদেরকে রক্ষার পর সুন্দরবনকে রক্ষার ব্যাপারে কী সরকার ও বন দুর্বৃত্তদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে না?
আম্পানের মতো করোনার সংক্রমণ কি আমাদের উন্নয়নের আড়ালে চাপা পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্গতির ব্যাপারে সচেতন করবে? করোনা দুর্যোগে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, হাসপাতাল, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর এসবের স্বল্পতার চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের স্বল্পতাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। জনগণের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার দিন দিন সংকুচিত হতে হতে কী অবস্থায় উপনীত হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা, বিক্ষোভ, আন্দোলন হলেও কর্ণপাত করেনি রাষ্ট্র পরিচালকরা। বরং স্বাস্থ্য বাণিজ্যের অমানবিক চেহারা দেখেছে জনসাধারণ। ১০০ টাকা চিকিৎসার খরচ হলে তার ৭০ টাকাই দিতে হয় মানুষের নিজের পকেট থেকে। আর বেসরকারী বাণিজ্যিক হাসপাতাল দেখে বুঝতে অসুবিধা হতো এসব কি হাসপাতাল না পাঁচ তারকা হোটেল। বিলাসিতার সব আয়োজন থাকলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যে সহজলভ্য ছিল না অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুতে তা অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাজেটের মূল টাকার যোগানদার সাধারণ মানুষ। তাদের চিকিৎসার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ে না দীর্ঘদিন ধরে। দেশের ক্ষমতাসীন ব্যক্তি আর ধনবান ব্যাক্তিদের চিকিৎসার কেন্দ্র ছিল বিদেশের বিখ্যাত হাসপাতালগুলো। ফলে দেশের মানুষের চিকিৎসা নিয়ে ভাবনা তাদের ছিল না বরং এটাকে ব্যবসায়ীদের অনিয়ন্ত্রিত মুনাফা অর্জনের খাতে পরিণত করার আগ্রহ ও উদ্যোগ ছিল প্রবল। গত কয়েক বছর ধরে বাজেটে ৫ শতাংশের নিচে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, আবার যা বরাদ্দ করা হতো তার অনেকটা দুর্নীতি অপচয়ের খাল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ফলাফল দেখা গেল। কর্তা ব্যক্তিদের ৩৭ লাখ টাকার পর্দা কেনার আগ্রহ যতটা, ভেন্টিলেটর কেনার বা সংগ্রহ করার উদ্যোগ ততটা ছিল না। বর্তমান বাজার দরেও পর্দার বাজেট দিয়ে ১৫টা ভেন্টিলেটর কেনা যেত আর দেশে বানালে ৩৫টা সংগ্রহ করা যেত। মানুষ বাঁচাতে কোনটা বেশি প্রয়োজন আর মুনাফা বাড়াতে কী পরিকল্পনা করা দরকার এই বিরোধে মানুষ পরাস্ত হয়েছে এতদিন।
তাহলে এখন কী হবে বা কী করা হবে? কিছু কি শিখলাম করোনা সৃষ্ট বিপর্যয়ে বা আম্পানের আঘাতে? ব্যক্তিকে সব কিছুর জন্য দায়ী করে বা ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করে ব্যবস্থার ত্রুটিকে আড়াল করে সমস্যার সমাধান হবে না। গ্রামাঞ্চলে একটি বহুল প্রচলিত গল্প আছে। একজন নৌকার মাঝি নদী পারাপারে বেশি আয়ের আশায় ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি যাত্রী তুলেছে নৌকায়। নদী পার হওয়ার সময় মাঝামাঝি এসে হঠাৎ ঝড়ে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম। নৌকার বোঝা হালকা করার জন্য মালপত্র ফেলে বাঁচার আশায় সবাই যখন হায় হায় করছে তখন মাঝি দেবীর উদ্দেশে বলল, মা জননী আমার অপরাধ হয়েছে, এবারের মতো মাফ করে দাও। আমি তোমার জন্য জোড়া পাঁঠা বলি দেব। যাক! একসময় ঝড় থেমে গেল। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এর কিছুদিন পরে সেদিনের এক যাত্রী জিজ্ঞেস করলো, মাঝি পাঁঠা বলি দিয়েছিলে? মাঝি বলল, না। যাত্রী বলল, কী ব্যাপার! তুমি মানত করে তা আবার ভঙ্গ করলে? নির্বিকার মুখে মাঝি বলল, “দেবী, ঝড় পাঠাইয়া ডর দেখাইছিল আমি লোভ দেখাইয়া তারে শান্ত করছি। কাটাকাটি হইয়া গেছে।”
প্রকৃতি নাকি সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কী শিখলাম আমরা করোনা ও আম্পানের কাছ থেকে। করোনা ও আম্পানের ভয় কি তেমনি প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসে কাটাকাটি হয়ে যাবে? মুনাফার সমাজে মানুষ উপেক্ষিত হতেই থাকবে এবং প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে হাতের সম্বল হারিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে।
-- রাজেকুজ্জামান রতন
ঐতিহাসিক সুনিল অমৃত বঙ্গোপসাগরকে বর্ণনা করেছেন এভাবে - এক বিস্তীর্ণ জলরাশি, যা জানুয়ারিতে একেবারে শান্ত এবং নীল; আর গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে এটির রূপ একেবারে ভিন্ন। ফুঁসতে থাকা ঘোলা জলের সমূদ্র।
বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে রেখেছে যে তটরেখা, সেখানে বাস করে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। বিশ্বের ইতিহাসে যতসব ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে এই বঙ্গোপসাগরে।
‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের ৩৫টি সবচাইতে ভয়ঙ্কর মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। এই তালিকার ২৬টি ঘুর্ণিঝড়ই বঙ্গোপসাগরে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান, যেটি বুধবার বিকেল নাগাদ বাংলাদেশ এবং ভারতের উপকূলে আঘাত হানবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটি হবে এধরনের ২৭তম ঘূর্ণিঝড়।
ভারতের আবহাওয়া দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ঘূর্ণিঝড়টি যখন উপকূলে আঘাত হানবে, তখন এটি ভয়ংকর শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘন্টায় ১৯৫ কিলোমিটার (১২১ মাইল)। জলোচ্ছাস হবে প্রায় দোতলা বাড়ির উচ্চতায়।
আবহাওয়াবিদদের মতে, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠে অবতল আকৃতির অগভীর বে বা উপসাগরে। মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র বাতাস যখন এরকম জায়গায় সাগরের পানিকে ঠেলতে থাকে, তখন ফানেল বা চোঙার মধ্যে তরল যে আচরণ করে, এখানেও তাই ঘটে। সাগরের ফুঁসে উঠা পানি চোঙা বরাবর ছুটতে থাকে।
“এরকম ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের টেক্সটবুক উদাহারণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর,” বলছেন আবহাওয়াবিদ এবং ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের একজন লেখক বব হেনসন।
তবে বঙ্গোপসাগরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বাড়তি কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন সমূদ্রের উপরিতল বা সারফেসের তাপমাত্রা। বলছেন ভারতের আবহাওয়া দফতরের প্রধান ডি. মহাপাত্র। এটি পরিস্থিতিকে আরও বিপদজনক করে তোলে। “বঙ্গোপসাগর খুবই উষ্ণ এক সাগর”, বলছেন তিনি।
পৃথিবীর নানা অঞ্চলে আরো অনেক উপসাগর আছে যেখানে উপকূল বরাবর এই ধরনের জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি আছে। যেমন লুইজিয়ানার গালফ কোস্ট।
“কিন্তু বিশ্বের আর যে কোন উপকূলের চাইতে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূল এই ধরনের সার্জ বা জলোচ্ছ্বাসের সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে আছে”, বলছেন বব হেনসন।
আর এই উপকূলজুড়ে যেরকম ঘনবসতি, সেটা ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বের প্রতি চারজন মানুষের একজন থাকে বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশগুলিতে।
সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় বহু ধরনের বিপদ নিয়ে আসে। প্রথমত, প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে সামূদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ধেয়ে আসবে। আর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রচন্ড ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হবে, যাতে বন্যা দেখা দেবে।
বঙ্গোপসাগরে বা আরব সাগরে যেসব ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, প্রতি দশ বছরে তার মাত্র একটি হয়তো এরকম প্রচন্ড ক্ষমতা বা শক্তির ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।
ঊনিশশো সত্তর সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ভোলায় যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচাইতে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। এতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ। এই ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তার উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক ৪ মিটার বা ৩৪ ফুট।
ইতিহাসবিদ ডক্টর সুনিল অমৃত, যিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, তিনি বলছেন বঙ্গোপসাগরে সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি ঘনঘন প্রচণ্ড মাত্রার ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে।
২০০৮ সালের মে মাসে বার্মার উপকূলে আঘাত হেনেছিল সাইক্লোন নার্গিস। সেই সাইক্লোনে অন্তত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এবং ২০ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিল।
একজন সাংবাদিক এই ঘূর্ণিঝড়ের বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে : “মনে হচ্ছে যেন কাগজের ওপর আঁকা একটি ছবির ওপর কেউ এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েছে। অনেক যত্ন করে আঁকা লাইনগুলো (বদ্বীপের নদীপথ) মুছে গেছে। যে কাগজের ওপর ছবিটি আঁকা হয়েছিল সেটি যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।”
ভারতের সর্বশেষ কোন সুপার সাইক্লোন আঘাত হেনেছিল ১৯৯৯ সালে। তখন উড়িষ্যা রাজ্যে প্রায় দশ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
(লেখাটি বিবিসি বাংলা থেকে গৃহীত।)
-- সৌতিক বিশ্বাস
এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের নিয়ম অনুযায়ী কর্মীরা মূল বেতন ও মহার্ঘভাতা (বেসিক ও ডিএ) যুক্ত করে যে বেতন পান তার ১২ শতাংশ টাকা পিএফ খাতে জমা দেন। নিয়োগকারীও সমপরিমাণ টাকা জমা দেন। অবসরের সময় কর্মীরা পিএফ-এ জমা টাকা সুদ সমেত ফেরত পান। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ১৩ মে ঘোষণা করলেন, মাসিক ১৫০০০ টাকার উপর বেতন পান এমন বেসরকারী ক্ষেত্রের কর্মীদের এবং নিয়োগকর্তাকে প্রভিডেন্ট ফান্ডে মাসিক জমার হার ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হল। ১৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার ফের ঘোষণা করলো কর্মী চাইলে ১০ শতাংশের বেশি পিএফ ফান্ডে জমা দিতে পারেন। নিয়োগ কর্তার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, তারা ১০ শতাংশ হারের জমা দেবেন। আগামী তিন মাস – জুন, জুলাই আগস্ট এই নিয়ম চলবে। প্রভিডেন্ট ফান্ড রুলস অনুযায়ী যেখানে ২০ জনের কম কর্মী কাজ করেন এমন সংস্থা, রুগ্ন সংস্থা (বিআইএফআর-এ আছে), এবং জুট, বিড়ি, ইটভাটা, ছোবড়া, গুয়ার গাম প্রভৃতি শিল্পে ১০ শতাংশ হারে প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা দেওয়ার রীতি আছে। স্বাভাবিকভাবে এই সব প্রতিষ্ঠানে ২ শতাংশ ছাড়ের গল্প নেই। সরকারী ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কর্মীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন নিয়োগকারী পিএফ জমার থেকে ২ শতাংশ ছাড় পাওয়ার ফলে শিল্প সংস্থার হাতে অতিরিক্ত ৬৭৫০ কোটি টাকা আসবে। ইপিএফ-এ কর্মীদের জমার হার কমিয়ে দেওয়ায় মানুষের নগদে আয় বাড়বে। এবার পিএফ জমার হিসাবটা দেখে নেওয়া যাক। প্রতিমাসে ১৫০০০ টাকা সিলিং ধরে নিয়োগকারী ১২ শতাংশ হারে পিএফ-এ জমা দেন, তার ভাগ হল – পিএফ খাতে ৩.৬৭ শতাংশ হারে ৫৫০ টাকা এবং পেনশন খাতে ৮.৩৩ শতাংশ হারে ১৮০০ অর্থাৎ মোট ২৩৫০ টাকা এবং কর্মীরাও সম পরিমাণ ২৩৫০ টাকা জমা দেন। উভয় মিলে মোট অর্থের পরিমাণ ৪৭০০ টাকা যা ভবিষ্যতের জন্য প্রতিমাসে পিএফ দপ্তরে জমা পড়ে এবং প্রতিমাসে গড় আয়ের উপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ জুড়তে থাকে।
কর্মীরা নিজেদের উপার্জিত অর্থ থেকে সঞ্চয়ের জন্যে প্রতিমাসে পিএফ তহবিলে ১২ শতাংশ টাকা জমা করতেন, সরকার তাকে বাধ্য করলো ১০ শতাংশ করতে। সরকার এখানে পরের ধনে পোদ্দারি করলো। কর্মীরা উপার্জিত অর্থ থেকে ২ শতাংশ টাকা প্রতিমাসে সঞ্চয় করতেন, তা তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। এই ২ শতাংশ অর্থ বেতনের সাথে নগদে যুক্ত করে হাতে দেওয়া হবে। আপনার অর্থ আপনাকেই দিয়ে সদম্ভে ঘোষণা করা হল আপনার আয় বেড়েছে এবং আপনি অতিরিক্ত খরচ করতে পারবেন। অন্যদিকে নিয়োগকর্তা যে ২ শতাংশ টাকা পিএফ-এ কম জমা দিচ্ছে তা বেতন বাবদ কর্মীদের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো নির্দেশ সরকার দিল না। এর ফলে শ্রমিকের আয়ের ২ শতাংশ ছাঁটাই হল। এই আর্থিক ক্ষতি পূরণের জন্য কোনো দায় নিয়োগকর্তার থাকছে না। এক কথায় শ্রমিকদের আর্থিক ক্ষতি বাড়বে এবং শিল্পপতিদের আর্থিক যোগান বাড়বে।
শ্রমিকদের অর্জিত বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা পড়ে। শ্রমিকদের পিএফ থেকেই নিয়োগ কর্তাকে ২ শতাংশ ছাড় দেওয়া হল এবং শ্রমিককে ২ শতাংশ অতিরিক্ত ক্যাশ নিতে বাধ্য করলো। এখানে দেখা যাচ্ছে আমানত ও বেতনে সরাসরি ২ শতাংশ কমে যাচ্ছে। এর সাথে ঐ ২ শতাংশের উপর ৮.৫০ শতাংশ হারে সুদ বাবদ আয়ও কমে যাবে। অবসরের সময় পিএফ ও পেনশনে অনেকটাই কমে যাবে।
আবার এই অতিমারীকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিদের আর একবার প্রতারণা করা হল। বলা হল কর্মীরা ইচ্ছে করলে পিএফ-এ গচ্ছিত অর্থ থেকে অফেরতযোগ্য অগ্রীম হিসেবে ৭৫ শতাংশ টাকা তুলে নিতে পারবেন। লকডাউনে বেশিরভাগ শ্রমিক বেতন/মজুরি পাননি অনেকেই বাধ্য হয়ে পিএফ-এ জমা টাকা তুলে নিয়েছেন। সব কিছু হিসাব করলে দেখা যাবে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ শ্রমিক কর্মচারিদের জন্য অপেক্ষা করছে। তিন মাস ২ শতাংশ টাকা কম জমা হল, পিএফ থেকে জমানো ৭৫ শতাংশ টাকা আগেই তুলে নিলেন, ফলে সুদের টাকার পরিমাণও কমবে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনে খুব সামান্য টাকা অবসরের পর পিএফ থেকে হাতে পাবেন এবং পেনশনও অনেক কম পাবেন। কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনের সময়েও শ্রমিক কর্মচারিদের সঙ্গে প্রতারণা ও অমানবিক আচরণ করে চলেছে।
-- নবেন্দু দাশগুপ্ত
লকডাউন-এর প্রতিকূলতার মধ্যেও গ্রামাঞ্চলে গ্রামীণ গরিব মেহনতিদের স্বার্থে ও প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। নির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে সরকারের কাছে লাগাতার চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এইসব আন্দোলন আরও বৃহত্তর পরিধিতে এগিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাথে সাথে সরকারের বর্তমান নতুন নতুন সংস্কারগুলোতে জোরালো হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে সংস্কারের সুফল আদায়ের জন্য জনগণকে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেই কিছু আদায় করতে হবে।
যেমন ধরুন ‘জয় বাংলা’ প্রকল্প তাতে নতুন করে আনা ‘৭ বন্ধু’ ও ‘জয় জোহার’ প্রকল্প সহ আরও কয়েকটি
১) মানবিক প্রকল্প, (২) লোক প্রসার প্রকল্প, (৩) বার্ধক্য ও বিধবা পেনশন স্কীম (W&CD), (৪) বার্ধক্য ও বিধবা পেনশন স্কীম (P&RD, UD & MA), (৫) কৃষকদের বাধক্য পেনশন, (৬) শিল্পী ও তাঁতীদের বার্ধক্য পেনশন। এই আটটি প্রকল্পকে যুক্ত করে জয় বাংলা প্রকল্প শুরু হয়েছে। ১ এপ্রিল থেকেই কার্যকরী হয়েছে। এই প্রকল্পের উপভোক্তাদের বহু গরিব মানুষ গ্রামগঞ্জে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক গরিব মানুষগুলো তাদের প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্র বিশেষ করে SC/ST শংসাপত্র জোগাড় করার সমস্যার ফলে অসুবিধায় পড়ছে। এই ক্ষেত্রে শাসক পার্টির ধান্দাবাজরা অনেক সময়ই দলবাজি দুর্নীতি ভাওতাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ। পঞ্চায়েত ভিত্তিক বিডিও অফিস থেকে লকডাউন পরিস্থিতির জন্য VRP মানে ভিলেজ রিসোর্স পার্সনস্ নিযুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু মানুষ সরাসরি বিডিও অফিসে আসা সমস্যা তাই এই VRP-দের মাধ্যমে গ্রামের খোঁজ খবর নেওয়া এবং গ্রামের বিভিন্ন ধরনের কাজ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা-২নং ব্লক-এর সিপিআই(এম-এল) এবং আয়ারলা-এআইকেএম কর্মীরা এই লকডাউন পরিস্থিতির সময় সমস্ত প্রতিকুলতার মোকাবিলা করে নিজেদের সংগঠন আছে এমন গ্রামের বাহিরে ও নতুন নতুন গ্রামের গরিব মেহনতিদের মধ্যে সরকার ঘোষিত সমস্ত সংস্কারের সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যপক উদ্যোগ নেয়। কমরেডরা লকডাউন-এর নিয়ম মেনেই গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে গরিব মানুষের মধ্যে জয়বাংলা প্রকল্প বিশেষ করে জয়জোহার ও তপশীল বন্ধু প্রকল্পের ফর্ম পূরণ করার উদ্যোগ নেয়। ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে দেখা যায় বহু লোকের কাষ্ট শংসাপত্র নেই। বয়সের প্রমাণপত্র নিয়ে বিভিন্ন রকম জটিলতা। এই সমস্ত বিষয় ঠিক করার জন্য উদ্যোগ শুরু হয়। কমরেডদের মধ্যে কাজ গুলো ভাগ করে নেওয়া হয়। কঠিন কষ্টকর প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে বহু মানুষ বিশেষ করে আদিবাসীদের থেকে ভালো সংখ্যক বৃদ্ধা ও বৃদ্ধের পেনশন আদায় করতে সক্ষম হন। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে VRP সদস্যদের ও কাজে লাগানোর ফলে অনেক সময় কাজটা ত্বরান্বিত হয়। প্রায় শতাধিক মানুষের পেনশন আদায় করা সম্ভব হয়। হাজারের উপর মানুষের প্রচেষ্টা ফরম পূরণ করা হয়। যদিও প্রচেষ্টা ফরম-এর ভবিষ্যত অনিশ্চিত। ১০০ দিনের কাজের জন্য ৪(ক) ফর্ম পূরণ চলছে। এই সমস্ত কাজের মাধ্যমেই নিজেদের সংগঠনের গ্রামের বাহিরে নতুন করে ৪টি গ্রামের জনগণের মধ্যে সংগঠনের বিস্তার ঘটছে। সমসাময়িক পার্টির বিভিন্ন কর্মসূচীতে এই সমস্ত গ্রাম থেকে ভাল সংখ্যক মহিলাদের ও অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে।
বর্তমান লকডাউন এর পরিস্থিতির মধ্যে সরকার আর ও বিভিন্নধরনের সংস্কার নামাচ্ছে। যেমন নতুন করে জব কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের 8(E) ফর্ম জমা দিলে নতুন জব কার্ড পাওয়া যাবে। যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার ৪০ হাজার কোটির বরাদ্দ বাড়িয়েছে। তাই ৪(ক) ফর্ম পূরণ করার উদ্যোগ বাড়াতে হবে। গরিব মেহনতি হকারদের জন্য ১০ হাজার টাকার ঋণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন করে কেসিসি কার্ড দেওয়ার কথা উঠছে। নতুন লোন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রেশন কার্ড নেই এমন পরিবারকে কুপন দেওয়ার কথা। এসএসওয়াই-এর ২৫ টাকা কিস্তির টাকা সরকার দেবেন ঘোষণা করেছেন। মাটির সৃষ্টি প্রকল্পে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের যুক্ত করার কথা। কৃষকদের সমবায় করবে বলছে। ফসলের ক্ষতিপূরণ ও শস্যবীমার আদায়ের প্রশ্ন। সব ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। জনগণের জীবন-জীবিকার ও অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করার সাথে সাথে মনে রাখতে হবে এই আন্দোলন গুলোর মোকাবিলার জন্য শাসকরা সংস্কার আনবে। আবার সেই সংস্কারের হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে গণভিত্তি বিস্তারিত করে আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেই এগিয়ে যেতে হবে। শাসক রা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সুযোগে নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করে এবং স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালায়। সর্বহারা পার্টিকে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষতিপূরণ, ত্রাণ ও অনুদান আদায়ের মাধ্যমেই জনগনকে শাসকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
-- সজল পাল
দেশে ২ মাসের বেশি সময় ধরে করোনা মোকাবিলায় লকডাউন চলছে। লকডাউনের দ্বিতীয় পর্ব থেকেই শহর হাওড়া সহ বেশকিছু এলাকায় রেড জোন ঘোষণা হয়েছে। জেলা হাসপাতাল সহ কয়েকটি হাসপাতালের ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হন। এর মধ্যেই সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য কমিটির নেওয়া কর্মসূচীগুলি হাওড়া জেলাতেও যথাসাধ্য পালন করা হয়। করোনা অতিমারী ও লকডাউনের ফলে গ্রামীণ এলাকার গরিব ও মেহনতি মানুষের কাজ নেই, চলছে চরম আর্থিক সংকট। মহিলা সমিতির বেশিরভাগ সদস্যই শ্রমজীবী। গ্রামীণ এলাকার এই মহিলারা, মিড ডে মিল ও অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা, আশা কর্মীরা নিজেদের সাধ্যমত এই সংকটগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করেছেন ও বিপন্ন মানুষদের তা বিলি করেন।
স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে আশা কর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন। তারা সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ডিউটি করছেন। বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৫০টি বাড়িতে যেতে হচ্ছে। এই কাজে যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। কোথাও কোথাও তাদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রেও তাদের ডিউটি দিতে হয় এবং তা দিনে বা রাতে ১২ ঘণ্টা করে। আশা কর্মীরা এত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন, অথচ তাদের সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জামের ব্যবস্থা নেই। ডিউটি করে যাওয়ার পাশাপাশি আশা কর্মীরা সুরক্ষা সরঞ্জাম ও অন্যান্য কিছু আর্থিক দাবি, যেমন অতিরিক্ত ভাতা ইত্যাদি নিয়ে বিডিও-র কাছে ডেপুটেশন দিয়েছেন। দাবি ছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যও।
এর মধ্যেই সরকার মদের দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের কী লাভ হল জানি না, কিন্তু সরকারের রাজকোষে বেশ কিছু টাকা জমা পড়েছে। আর মদ কেনার টাকার জন্য গরিব ঘরের স্ত্রী ও মায়েদের ওপর অত্যাচার আবার শুরু হল। দু-একটা গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনার ক্ষেত্রে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহিলা সমিতি হস্তক্ষেপ করে ও তা বন্ধ করে।
এর মধ্যে আমফান সুপার সাইক্লোন গোটা দক্ষিণ বঙ্গকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। হাওড়া জেলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহিলা সমিতির সদস্যরা করোনার পাশাপাশি ঝড়বিধ্বস্ত অঞ্চলের বিপন্ন মানুষদের পাশে সাধ্যমত দাঁড়ানোর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে চলেছেন।
-- কল্যাণী গোস্বামী
গত ২৬ মে কমরেড অঞ্জলি দাস আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫ বছর! হুগলি জেলার ধনিয়াখালি ব্লকের বেলমুড়ি গ্রামের ক্ষেতমজুর পরিবার থেকে আসা অঞ্জলি দাস ছিলেন আমাদের লড়াইয়ের এক সৈনিক। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস যখন রাজ্যজুড়ে সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছে, ধনেখালি ব্লকে বামফ্রন্ট ভুক্ত বামদলগুলির কোন প্রার্থী দিতে পারেনি, সেই পরিস্থিতিতে কমরেড অঞ্জলি সমস্ত সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই সময় কমরেড অঞ্জলিদি, গোলাপিদি, ধোনিদি রূপাদিদের মতো ক্ষেতমজুর পরিবারের মহিলাদের সম্মিলিত লড়াই ভোলার নয় । ফিডার রোডে কমরেড চারু মজুমদারের মূর্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর পুরো পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। অঞ্জলি দাস ও তাঁর স্বামী রবিন দাস ছিলেন পার্টির প্রতি নিবেদিত এক পরিবারের দুই কমরেড, শাসকদলের অত্যাচারকে যাঁরা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেন। তাঁদের বাড়িতে পার্টির বহু মিটিং হয়েছে। মহিলা সমিতি, ক্ষেত মজুর সংগঠন এবং পার্টি সংগঠনের সামনের সারির কর্মী ছিলেন তিনি। তাঁর দু-দশকের সংগ্রামী জীবন আমাদের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যাবে। পার্টির জেলা কমিটি কমরেড রবিন দাস, পুত্র এবং ধনেখালি তথা জেলার পার্টি সদস্যদের শোকের সমান অংশীদার। কমরেড অঞ্জলি দাস লাল সেলাম !
হুগলি জেলা কমিটি
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
কলকাতা গ্যাস ওয়ার্কাস ইউনিয়নের (এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত) সাথী দেবকান্ত ঝা করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল ২৬ মে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ২৭ মে ভোরে তিনি মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ইউনিয়নের সম্পাদক সহ কয়েকজন সদস্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিহারের বাসিন্দা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর। কমরেড দেবকান্ত ঝার প্রয়াণে এআইসিসিটিইউ এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশন গভীর শোক প্রকাশ করে এবং তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানায়।
নদীয়া জেলার গাছা শালিগ্রাম পশ্চিমপাড়ার পার্টির ঘনিষ্ঠ সমর্থক ওসমান সেখ গতকাল রাতে প্রয়াত হয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন হার্টের রোগে ভূগছিলেন, লকডাউনের সময়কালে এবং তারও আগে একাধিকবার হাসপাতালে চিকিৎসা করান। ভুলুসাহেবের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পার্টির সমস্ত কর্মকান্ডে যুক্ত থাকতেন। কমরেড ওসমান সেখ লাল সেলাম।