আজকের দেশব্রতী বিশেষ বৈদ্যুতিন সংখ্যা (২১ মে ২০২০)
issue

(নির্দিষ্ট কোনো লেখা পড়ার জন্য সেই হেডিং-এ ক্লিক করুন)

naxalnaxalbari

২৫ মে ২০২০ রাজ্যের সমস্ত জেলায় ও এলাকাগুলিতে নকশালবাড়ির ৫৪তম দিবস পালন করুন।

mlup

 

ind

মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার ঠিক সাত সপ্তাহ পর মোদী দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে আরও একবার ভাষণ দিলেন ১২ মে’র রাত আটটায়। যেদিন ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন সেদিন তিনি জনপ্রিয় হিন্দি প্রবাদ “জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়”-এর উল্লেখ করেছিলেন। আর এর মধ্যে দিয়ে তিনি এটাই বুঝিয়েছিলেন যে, জনগণের জীবন রক্ষার জন্য তাঁর সরকার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। ২৫ মার্চ এবং ১২ মে’র মধ্যে গড়িয়ে যাওয়া সাতটা সপ্তাহে দেখা গেল, কোভিড-১৯-এর কারণে এবং মোদী সরকারের চাপানো অরাজক ও স্বৈর চরিত্রের লকডাউনের ফলে ভারতে শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ মারা যাচ্ছেন।

১২ মে’র ৩৩ মিনিটের ভাষণে এই মৃত্যুগুলোর জন্য দু্ঃখ প্রকাশ করতে তিনি ৩৩ সেকেণ্ড সময়ও ব্যয় করলেন না, যদিও লকডাউন জনিত অধিকাংশ প্রাণহানির জন্য তাঁর সরকারই সরাসরি দায়ী। পরিযায়ী শ্রমিকদের বেড়ে চলা পাহাড়প্রমাণ দুর্দশা নিয়ে তাঁর ভাষণে তিনি যে একটা কথাও বললেন না, তা অত্যন্ত প্রকট ভাবে ফুটে উঠছে। তিনি বস্তুত ভারতে কোভিড-১৯-এর পরিস্থিতি বা নিপীড়নমূলক লকডাউন সৃষ্ট সুবিশাল মানবতাবাদী সংকট নিয়ে কোনো কথাই বললেন না। এই নীরবতা ছিল সুগভীর এবং ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের উল্লেখটাও (যা নিয়ে অর্থমন্ত্রী পরে বিশদে বলবেন বলে তিনি জানালেন) ওই নীরবতা জনিত ক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে পারল না।

প্রধানমন্ত্রীর পুরো ভাষণটাই চালিত ছিল তাঁর কল্পনার আত্মনির্ভরশীল ভারতের স্বপ্নকে ধরে এক নয়া বাচনিকতা নির্মাণের দিকে। তাঁর মতে কোভিড-১৯ অতিমারী একটা সংকট না হয়ে তা হল একটা সুযোগ যাকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে তাঁর সরকার  কিভাবে এগোতে চায় তার রূপরেখাও তিনি হাজির করলেন। তিনি ভারতের পাঁচটা স্তম্ভর কথা বললেন – অর্থনীতি, পরিকাঠামো, প্রযুক্তি, জনসংখ্যায় তরুণদের প্রাধান্য ও চাহিদা। তিনি যেটাকে বলেছেন ভারতের জনসংখ্যার প্রাণবন্ত বিন্যাস তাতে প্রসঙ্গক্রমে পরোক্ষ উল্লেখ ছাড়া ভারতে সম্পদের প্রকৃত স্রষ্টা শ্রমিক ও কৃষকদের ঠাঁই তাঁর স্তম্ভগুলোতে  হয়নি।

migrajt

 

একবারের জন্যও তাঁর মনে হল না যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানে তাঁর সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা তাঁর সমস্ত স্তম্ভগুলোকে চূড়ান্ত প্রহসনে পরিণত করেছে। ভারতের জনসংখ্যায় যুবক শ্রেণীর প্রাধান্যকে ‘জনসংখ্যাগত সুবিধা’ বলে বর্ণনা করাটা একটা গতানুগতিক বুলি হয়ে উঠেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের যে অন্তহীন মিছিল আমরা দেখলাম তা স্মরণকালের মধ্যে শান্তির সময়ে সবচেয়ে ব্যাপক নিষ্ক্রমণ। এদের বেশির ভাগটাই আবার জনসংখ্যার সুবিধাজনক বর্গের মধ্যে পড়বে। তারা শুধু এটুকুই চেয়েছিল যে, ভারতের প্রযুক্তিগত ও পরিকাঠামোগত নৈপুণ্যকে কাজে লাগিয়ে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হোক, মোদী সরকার কিন্তু পঞ্চাশ দিনে এই সামান্য দাবিটুকুও পূরণ করতে পারল না। আর প্রধানমন্ত্রী পাঁচটা স্তম্ভ নিয়ে আমাদের বড়-বড় কথা শোনাচ্ছিলেন।

মোদী চারটে ক্ষেত্রে সাহসী সংস্কার আনার কথা বললেন – জমি, শ্রম, নগদ অর্থ এবং আইন। তাঁর কাছে ভূমি সংস্কারের অর্থ হল যে কোনো এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে কর্পোরেটদের দ্বারা জমি অধিগ্রহণকে সুগম করে তোলা। তাঁর সরকার এর আগে জমি অধিগ্রহণ আইন এবং বন অধিকার আইনে সংশোধন এনে এটা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সর্বব্যাপী প্রতিবাদের মুখে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। কোভিড-১৯-কে ‘মওকা’ মনে করে তিনি কি ওই বকেয়া এজেণ্ডাটাকে হাসিল করতে চাইছেন? শ্রম সংস্কার বলতে তাঁর সরকার কী বোঝে সেটা এখন আমরা খুব ভালো করে জেনে গেছি। শ্রম আইনগুলোকে সংকুচিত করে মনুস্মৃতির ঢঙে চারটে বিধিতে নতুন আদল দেওয়া হচ্ছে এবং বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলো আগামী তিন বছরের জন্য সমস্ত শ্রম আইন মুলতুবি রাখার কথা ঘোষণা করতে শুরু করেছে।

নগদ অর্থের আরও বেশি জোগানের অর্থ হল আরও বেশি ঋণের লভ্যতাকে সম্ভব করে তোলা আর আমরা এটাও জানি যে প্রদত্ত সমস্ত ঋণ কারা পকেটস্থ করছে। ঋণগ্রস্ত কৃষকদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এখন আমরা আবার স্বনিযুক্তি প্রকল্পে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে না পেরে মহিলাদের আত্মহত্যার খবরও ক্রমেই বেশি-বেশি শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু বড়-বড় ঋণ খেলাপিদের ঋণ মাঝে-মধ্যেই ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে, এবং ২০১৪ সালে মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুছে দেওয়া ঋণের মোট পরিমাণ হল ৬,৬০,০০০ কোটি টাকা, যা হল মোদী প্রতিশ্রুত কোভিড-১৯ স্টিমুলাস প্যাকেজের তিন ভাগের এক ভাগ। নগদ অর্থের আরও বেশি যোগান বলতে কি সমস্ত কৃষি ঋণ এবং স্বনিযুক্তি প্রকল্পে নেওয়া ঋণের বাতিল হওয়াকে বোঝাবে, নাকি তার অর্থ হবে ভারতের কর্পোরেটদের জন্য আরও ঋণের ব্যবস্থা? এর উত্তর অনুমান করে নেওয়াটা একেবারেই কঠিন নয়।

del

 

আইনের সংস্কার কোন অভিমুখে হচ্ছে সেটাও আমরা জানতে পারছি। আইন ক্ষেত্রে সংস্কার বলতে সরকার ঔনিবেশিক যুগের মহামারি ব্যাধি আইন বাতিলের কথা বোঝাচ্ছে না, যে আইনের বলেই এখন লকডাউন চলছে, কিংবা বোঝাচ্ছে না দেশদ্রোহ আইনের বাতিলকেও; এই সংস্কার বলতে বোঝানো হচ্ছে ভারতের নাগরিকত্ব আইন অথবা ভূমি ও শ্রম আইনকে নতুন করে রচনা করা যার উদ্দেশ্য হল ভারতে গণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তি এবং আইনি কাঠামোকে দুর্বল করে তোলা।

এই সমস্ত সংস্কারের উদ্দেশ্য হল প্রণালীবদ্ধভাবে ভারতীয় জনগণকে ক্ষমতাহীন করে তোলা এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, এবং ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর বড় অংশকে ক্রীতদাসে পরিণত করা। এটা আত্মনির্ভরশীলতা হতে পারে না, এটা শুধু বিশ্ব পুঁজির কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ভারতের মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদকে তাদের কাছে ইজারা দেওয়া, এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের অবমূল্যায়ন ঘটানো, এটা ভারতকে নিলামে তোলা।

এই প্যাকেজের মধ্যে প্রকৃতই কী আছে তা সামনের দিনগুলোতে সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত হবে। তবে কয়েকটা বিষয় কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গেছে। টাকার এই পরিমাণটা বিরাটভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা হয়েছে, বর্তমানে চালু একগুচ্ছ প্রকল্পের অর্থ এবং আরবিআই-এর জোগানো  অর্থের পরিমাণকেও এর মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। অতি ধনীদের ওপর কর বসিয়ে এই অর্থের জোগান তো হবেই না, বিপরীত দিকে আবার সাধারণ জনগণের বেতন এবং ভাতা ও পেনশনের পরিমাণ হ্রাস করা হচ্ছে। এবং তৃতীয়ত, লকডাউন সময়কালের মজুরি হিসাবে, গ্ৰাসাচ্ছাদন ভাতা, বিনামূল্যে রেশন এবং ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ রূপে এই প্যাকেজের অর্থ সেই সমস্ত মানুষদের কাছে পৌঁছবে না যাদের এই অর্থের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

baby

 

ভারত ইতিমধ্যেই যে পঞ্চাশ দিনের লকডাউন ভোগ করেছে, সেই অভিজ্ঞতার কোনো বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা না করেই মোদী চতুর্থ দফার লকডাউনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতিকে যাতে মন্থর করা যায় এবং সরকার যাতে বিভিন্ন ফ্রন্টের চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় তার প্রস্তুতিকে জোরদার করতে সক্ষম হয়, এই উদ্দেশ্যেই লকডাউন চালু করা হয়েছিল। এই দুটো উদ্দেশ্যের কোনোটাই বলতে গেলে সফল হয়নি। মোদী বলেছেন চতুর্থ দফার লকডাউন আগেরগুলোর থেকে ভিন্ন ধরনের হবে। কিন্তু কোনো শিক্ষাই যখন গ্ৰহণ করা হয়নি, সেক্ষেত্রে এই পর্ব কি আগেরগুলোর তুলনায় বেশি কার্যকরী হতে পারবে? লকডাউন যখন ক্রমশ শিথিল হয়ে আসবে, তখন প্রাপ্ত ইঙ্গিতগুলো থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, জনগণকে উপেক্ষা করার এবং তাদের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করার অভিপ্রায় সরকারের রয়েছে। যে রাষ্ট্র নিজের দায়বদ্ধতাকে পরিত্যাগ করে জনগণের ঘাড়েই দায়ভার চাপায়, সেই রাষ্ট্র কখনই আত্মনির্ভরশীলতার আদর্শ দৃষ্টান্ত হতে পারে না।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২ মে ২০২০)

nurse

 

edi

মোদী সরকার কোবিড সংকটময় অবস্থায় লক ডাউন কায়েমের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সবদিক থেকেই রাষ্ট্রীয় প্রতারণা ও নিষ্ঠুরতায় দেশকে চূড়ান্ত দূর্দশাগ্রস্ত করে তোলার পথে নিয়ে চলেছে। একমাত্র বিজেপি-আরএসএস এবং রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তাদের পরিচালিত সরকার ও তাদের ঘনিষ্ঠ মতাবলম্বী, অনুগ্রহনির্ভর, আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক সহযোগী শক্তিগুলো ছাড়া আর সমস্ত বিরোধী শক্তিসমূহ মোদী সরকারের ক্ষমাহীন চরম অমানবিক আচরণের বিরোধিতায় মুখর।

তবে অন্যান্য কিছু দল পরিচালিত রাজ্য সরকারের আচরণেও এমন কিছু প্রকাশ ঘটে চলেছে যা যথাযথ সমালোচনা ও বিরোধিতার দাবি রাখে। এপ্রসঙ্গে বাংলার তৃণমূল সরকারও অভিযুক্ত। তাই মোদীর তুলোধোনায় বর্শামুখ রেখেও রাজ্যের মমতা সরকার ও শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধেও যেমন প্রয়োজন তেমনি মুক্তকন্ঠে সোচ্চার থাকতে হবে। তবে কোনভাবেই ‘মোদী-দিদি এক হ্যায়’ ধরনের অযৌক্তিক হাস্যকর ‘হল্লাবোল’কে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।

করোনা পরিস্থিতিতে মমতা সরকার নিজেই নিজের মুখোশ খোলার মতো বেশকিছু কারণ ঘটিয়েছে। সবচেয়ে সমালোচনা তীব্র হয়েছে কোবিড বুলেটিন সংক্রান্ত প্রচারে ধোঁয়াশা রাখা নিয়ে, যার ফলে জনমানসে শঙ্কা ছড়াতে থাকে তথ্যের লুকোচাপা চলছে। এই সন্দেহ অবিশ্বাসের বাতাবরণ রাজ্য সরকার এখনও দূর করে উঠতে পারে নি। তার ওপর আকস্মিক ব্যাপক সংকট তৈরী হয়ে গেল কয়েকশ সেবিকারা দলে দলে কাজ ছেড়ে আপন আপন রাজ্যে চলে যাওয়ায়। এরা বাংলার তুলনায় বেশ পশ্চাদপদ ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা তথা সুদূর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির বাসিন্দা এবং প্রায় শত শতাংশ গরিব শ্রেণীর ঘর থেকে তৈরি হওয়া। কোবিড পরিণামে যখন সর্বত্র আশঙ্কা গ্রাস করছে কাজ করেও মজুরি/বেতন না পাওয়ার, উপরন্তু ব্যাপক কাজ ছাঁটাই হওয়ার বিপদের, তখন এই রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে আচমকা ঘনিয়ে এল সম্পূর্ণ বিপরীত ধাক্কা! কিছু ভিন রাজ্যের সেবিকারা ‘স্বেচ্ছায়’ কাজ ছেড়ে চলে গেলেন! কোন সমস্যার সংকটে পড়ে এটা ঘটল যা কিনা বিপজ্জনক বেকারির খাতায় আবার নাম ওঠার পরিণামের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াল! ব্যাপক কোবিড সংক্রমণের ভীতি! নাকি অন্য কোনো রহস্যাবৃত কারণ!

nurse

 

এই ঘটনা ঘটেছে কলকাতা মহানগরীর নামীদামী সব বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সরকারের কাছে কোনো আগাম খবর থাকল না! এক যুদ্ধকালীন সময়ে এ কেমন পর্যবেক্ষণের নমুনা! বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাকে কেবল তোয়াজ করে আসা হয়েছে, তার প্রতিফলে ভুক্তভোগী হতে হবে সংকটাপন্ন রোগীদের। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রচুর অব্যবস্থা, কোবিড মোকাবিলার প্রস্তুতি-পরিকাঠামো তৈরি করার ক্ষেত্রে দেখা তো গেল কি হিমশিম খাওয়া অবস্থা। হাসপাতালের মধ্যে জরুরী কোন দ্বিতীয়, তৃতীয় বিকল্প সম্প্রসারিত বিভাগ তৈরি বা নতুন ছোট ছোট হাসপাতাল ব্যবস্থা করে ফেলার প্রশ্নে পরিকল্পিত প্রয়াসের দৌড় নেই। পরন্তু সমস্যার ওপর সমস্যা এখন ব্যাপক সেবিকা-শূন্য হয়ে পড়ার ঘটনা ও প্রবণতা। পাশাপাশি, বাধ্যতামূলক শারীরিক পরীক্ষা করার প্রশ্নে বৈষম্য ধরা পড়ল রাজ্যে আসা ও ফিরে আসা দু’ধরনের মানুষের প্রতি দুরকম আচরণে। যারা বাংলাদেশ থেকে বিমানে এলেন তাদের বরণ করা হল প্রাথমিক কোবিড পরীক্ষা করে। আর, ভিন রাজ্যগুলো থেকে ফিরে আসা হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেককেই কোনো প্রাথমিক পরীক্ষা না করে চালান করে দেওয়া হল, তারা গরিব মজুর শ্রেণীর বলেই কি তাদের প্রতি এত অসংবেদী অবহেলা!

মমতা সরকার, তৃণমূল কংগ্রেস এইসব প্রশ্নের জবাব দেবে কি! সেই মুখ নেই। পুড়েছে যথেষ্ট।

kal

 

aiarla

আয়ারলার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ১৮ মে রাজ্য জুড়ে বিডিও দপ্তরে গ্রামীণ মেহনতিদের নানান দাবিতে ডেপুটেশন কর্মসূচীর ডাক দিয়েছিল। এদিন ডেপুটেশনে গিয়ে জলপাইগুড়ি সদর বিডিও অফিস থেকে গ্রেফতার হলেন আয়ারলার জাতীয় কার্যকরী কমিটি সদস্য ও রাজ্য নেতা শ্যামল ভৌমিক এবং বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ গোস্বামী। দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজে আক্রান্ত হলেন সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার সহ আয়ারলা নেতৃত্ব। কমরেড শ্যামল ভৌমিকদের বিকাল ৪টে পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত ছাড়তে বাধ্য হয় জলপাইগুড়ি পুলিশ। বজবজে প্রথমে পুলিশের বাধা, পরে তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের হামলার মুখেও ডেপুটেশন কর্মসূচী সফল ভাবে সংগঠিত করেন আয়ারলার রাজ্য নেত্রী দেবযানী গোস্বামী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

Jal

 

এই লকডাউন পর্যায়ে গ্রামে-গ্রামে যে ধর্ণা কর্মসূচী গ্রামাঞ্চলে আমরা শুরু থেকেই সংঘটিত করে চলেছি, সেই ধারাবাহিকতায় গ্রাম থেকে উঠে ব্লক স্তরে বিডিও-র কাছে গ্রামীণ মেহনতিদের এই কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। একই সাথে চলছিল মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে লেখা গ্রামীণ মেহনতিদের এক দাবি সনদে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ।

দাবি ছিল – (১) মেহনতিদের হাতে নগদের যোগান, ১০ হাজার টাকার লকডাউন ভাতা; (২) ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্পে কৃষি ও গ্রামীণ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি; (৩) কমপক্ষে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল মকুব; (৪) বন্ধন সহ সব মাইক্রোফিনান্স, মহাজনী ও অন্যান্য ঋণ মকুব, (৫) সকলের জন্য রেশন ও ১০০ দিনের কাজ, জবকার্ড; (৬) পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপদে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা; (৭) প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের সরকারী সহায়তা; (৮) সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতাদের শাস্তিপ্রদান; (৯) কৃষিক্ষেত্রের বেসরকারীকরণে মোদী সরকারের সাম্প্রতিক বিপদজ্জনক সিদ্ধান্তগুলির বিরোধিতা করা।

budge

কর্মসূচী পালন

মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর, বহরমপুর, জলঙ্গী, রাণীনগর-১, রাণীনগর-২, বেলডাঙ্গা-২, বেলডাঙ্গা-১; পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী-২, কাটোয়া-২, মন্তেশ্বর, রায়না, মেমারী-১ ও কালনা-২ নম্বর ব্লক, বীরভূমের নানুর ব্লক, বাঁকুড়ার সদর, উত্তর ২৪ পরগণার গাইঘাটা, দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজ এবং হুগলির ধনেখালি, পোলবা-দাদপুর, বলাগড় ও পান্ডুয়া ব্লক দপ্তরে আয়ারলা নেতৃত্ব ডেপুটেশন কর্মসূচী সফল করেন। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রাম ও জিয়াগঞ্জ ব্লকের আধিকারিকরা কোভিড-১৯-এর কারণ দেখিয়ে ডেপুটেশন জমা নেন হোয়াটসঅ্যাপ-এর মাধ্যমে।

ধুবুলিয়া ব্লকে ডেপুটেশন কর্মসূচী সংগঠিত হয়। নপাড়া ২ নং অঞ্চলে ১০০ দিনের কাজে তৃণমূলের দুর্নীতির একটি অভিযোগ সম্পর্কে বিক্ষোভ জানানো হয়। বিডিও-র কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

নাকাশীপাড়া ব্লক কর্মসূচীতে গরিব মানুষদের রেশন না পাওয়ার বিষয়টি জোড়ালো হয়ে ওঠে। আবেদন করেও যারা কার্ড পায়নি এমন ব্যাপক সংখ্যক মানুষেরা খাদ্য সরবরাহের দাবীতে তীব্র বিক্ষোভ দেখায়। বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়ার পর তিনি জানান সামনের মাস থেকে রেশন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। সমবেত মানুষদের সামনে বক্তব্য রাখেন আয়ারলার রাজ্য নেতা কাজল দত্তগুপ্ত, এআইকেএম নেতা জয়তু দেশমুখ।

kali


কালীগঞ্জে বিডিও দপ্তরে অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন আলতাফ হোসেন সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ৭০০ গণস্বাক্ষর সহ দাবিপত্র জমা দেওয়া হয়।

চাপড়া ব্লকে বিডিও গেটে তালা লাগিয়ে গোটা বিডিও অফিস চত্তর বন্ধ করে দেওয়ায় ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, ইনসান সেখ সহ অন্যান্যরা ডেপুটেশন জমা দিতে পারেনি। করোনার যুক্তি দেখিয়ে ডেপুটেশন নিতে অস্বীকার করেন নদীয়ার চাপড়া ব্লক আধিকারিক! তবে দাবিগুলি ব্লক অফিসের সামনে তুলে ধরে প্রচার করা হয়।

দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের রাংগাপানি বাজারে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। পরে ফাঁসিদেওয়া বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শনে বক্তব্য রাখেন শরৎ সিংহ ও দীপক ঘোষ।

polba

 

গণস্বাক্ষর সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি ও সদর ব্লক, হুগলির পোলবা-দাদপুর, ধনেখালি, বলাগড়, দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজ, বর্ধমানের পূর্বস্থলী-১, নদীয়ার কালীগঞ্জ ব্লকের নেতৃত্ব।

বিগত ১৩ মে গ্রামে গ্রামে ধর্ণার ডাক দেওয়া হয়েছিল, সেদিনের কর্মসূচীও অত্যন্ত উৎসাহের সাথে সংগঠিত হয় হাওড়ার বাগনানে, বজবজের গ্রামাঞ্চলে, বর্ধমান জেলার একাংশ, হুগলির গ্রামে-গ্রামে।

লকডাউন পরিস্থিতি দেশের গ্রামীণ মেহনতিদের জীবনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করছে। এই অবস্থায় মেহনতিদের জীবন-যন্ত্রণার পাশে থেকে কাজ, খাদ্য, মেহনতি জীবনের নিরাপত্তা, মর্যাদা সহ জীবন সংগ্রামে আয়ারলা অগ্রণী ভূমিকা পালনে দায়বদ্ধ। এই কারণেই লকডাউনের বাধানিষেধের মাঝেও কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির সংগঠকরা আজ প্রতিদিনই প্রতিবাদের সামনের সারিতে; বিপন্ন জনতার সাথে কখনো ত্রাণকার্যে কখনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে।

এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে।

tela

 

teleni

১৮ মে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন ও শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে পার্টির জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম (বাকি সদস্যরা – সুদর্শন বসু, প্রশান্ত নাথ, সমীর ব্যানার্জি ও ভিয়েত) হুগলির ভদ্রেশ্বর তেলিনিপাড়ায় হাজি মহম্মদ মহসিন প্রাইমারী স্কুলের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া দুই শতাধিক মানুষের সাথে দেখা করেন। এঁরা সকলেই মুসলমান। গত ১২ মে এক পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হন এঁরা। কথা শুরুর আগে তাঁদের জন্য কিছু শুকনো খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়। রমজান মাস চলছে এবং সামনেই ঈদের উৎসব, কিন্তু ঘর হারানো এইসব মানুষের চোখে মুখে শুধু আতঙ্ক আর তীব্র ক্ষোভ। প্রশাসনের তরফে মোট তিনটি আশ্রয় শিবিরে এই মানুষদেরকে রাখা হয়েছে। এই স্কুলটি ছাড়াও ফায়জামা ফাইদুল হাইস্কুল, সেখানে আছে প্রায় ৭০ টি পরিবার, আরেকটি স্কুলে অল্প কয়েকটি পরিবার। এই সংকটে কাছে পেয়ে তাঁরা পার্টির কাছে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। শিবিরে জায়গা অপ্রতুল হওয়ার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

dist

 

সমাজকর্মী নাসির বলছিলেন, “এখন সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে শিবিরে যেভাবে মহিলারা বাচ্চা নিয়ে আছেন, সেখানে কোনো শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না”। স্থানীয় যুবক আজমল সামনের বিস্তৃত খোলা জায়গা (যা নর্থ শ্যামনগর মিলের সম্পত্তি) দেখিয়ে বললেন, “এখানে অস্থায়ী ছাউনি করে থাকার ব্যবস্থা করলে, দূরত্বও বজায় থাকতো আর এই প্রচন্ড গরমে মানুষগুলোও স্বস্তি পেতো”। স্কুলে ঢুকে দেখা যায় – একটা ছোট হলঘরে মহিলা, কিশোরীরা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছেন, পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরেও দূরত্ব বজায় রেখে থাকা সম্ভব নয়। দিনের বেলায় অনেক ছেলে ঘরের বাইরে থাকে বলে কিছুটা ফাঁকা!

doc

 

ইদানিংকালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন জায়গার দাঙ্গার সাথে এখানকার ঘটনার একটা অদ্ভুত তাৎপর্যপূর্ণ মিল খুঁজে পাওয়া গেল – সেটা হচ্ছে আক্রমণকারীরা ঘরে আগুন লাগানোর পাশাপাশি সমস্ত নথি আলাদাভাবে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এখানেও যুবক ওয়াসিম বা মোক্তার আলম একই কথা জানালেন যে, তাঁদের কোনো সার্টিফিকেট অবশিষ্ট নেই। যখন আগুন লাগানো বা ভাঙচুর চলছে, তখন পুলিশ বা দমকলকে ফোন করে পাওয়া যায়নি, কেউ ফোন ধরেনি। ফলত বহিরাগতদের ব্যাপক তাণ্ডব ও ক্ষয়ক্ষতির ভালোরকম শিকার তাঁদেরকে হতে হয় বলে তাঁরা জানান। দাঙ্গাকারীরা বেশিরভাগ ছিল বাইরে থেকে আসা তবে এলাকার বিজেপি কর্মীরা মুসলিমদের ঘরগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। ওইদিন গুরুতর আহত মঞ্জুর আলম এবং মহম্মদ এজাজের সঙ্গে দেখা করলে জানা যায়, পুলিশ হাসপাতালে শুধু তাঁদের নামটা জেনেছে, বাকি কিছুই করেনি! অন্যরাও জানালেন যে, থানা এফআইআর নেয়নি, কোনো লিখিত আবেদনও গ্রহণ করেনি। জনসাধারণের জন্য শৌচাগার বা প্রস্রাবগার ব্যবহার করতে গিয়ে মুসলমানেরা বাধার সম্মুখীন হন। এই ঘন অন্ধকারে রূপালি রেখার আভাস দিয়ে নাসিরুদ্দিন জানালেন, স্থানীয় হিন্দু দুধ ব্যবসায়ীরা সেদিন বুক দিয়ে অনেককে আগলেছেন, তাঁদের বাধাতেই দাঙ্গা এই এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারেনি। শিবিরে থাকা মহিলাদের চোখে মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। চোখের সামনে বাড়ি ঘর সংসারের সমস্ত জিনিস পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা ও ক্ষোভের কথা তাঁরা জানালেন। সামনে ঈদ। নতুন জামা কাপড়ের কথা ভাবা এখন তাঁদের কাছে বিলাসিতা, একবার বদল করার মতো কাপড়ও অবশিষ্ট নেই। অত্যাচারিতদের অধিকাংশই নর্থ শ্যামনগর, ভিক্টোরিয়া ও গোঁদলপাড়া জুটমিলের শ্রমিক।

te

 

প্রসঙ্গত গত ১৬ মে যখন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের তথ্যানুসন্ধানী দল প্রথমবার ঐ এলাকা পরিদর্শনে যায় তখনই এই অত্যাচারিত মানুষরা অভিযোগ করেন যে, গত ১২ মে মাত্র তিন ঘণ্টায় ৯, ১০, ১১, ১২নং শ্রমিক লাইনের কোয়ার্টারগুলোতে হামলা, ভাঙচুর, আগুন জ্বালানো, টাকাপয়সা, জিনিস লুঠপাট করা হয় এবং বাসিন্দাদের আক্রমণ করা হয়। বিজেপির প্রত্যক্ষ মদতপুষ্ট সমাজবিরোধী বাহিনী বাড়ি বাড়ি হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে রক্তাক্ত করে। এখনও কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শোনা যাচ্ছে হামলার আগে বহিরাগতরা বন্ধ গোঁদলপাড়া ও ভিক্টোরিয়া জুটমিলের ভেতরে লুকিয়েছিলো! ইতিমধ্যে নর্থ শ্যামনগর জুট মিল খুলেছে, দুই শিফটে কাজ চলছে। ‘করোনা সংক্রমণ মুসলিমদের দ্বারা বাহিত’ – সংঘ পরিবারের এই পরিকল্পিত মিথ্যা প্রচার এই এলাকায় ভাল মাত্রায় ছড়ানো চলছে এবং মিল কর্তৃপক্ষও এই কারণে কোন মুসলিম শ্রমিককে কাজে নিচ্ছে না! আরো অভিযোগ যে, একের পর এক শ্রমিক কোয়ার্টার ভাঙচুর ও জ্বালানো সত্ত্বেও মিল ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে এখনও অবধি কোনো অভিযোগ দায়ের করাই হয়নি। মালিকপক্ষের এই সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব নিয়েও আক্রান্ত শ্রমিকেরা স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।

vio

 

সিপিআই(এম-এল) দলের হুগলি জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার বলেন, “প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে হামলার অভিযোগে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে নানাপ্রকার উস্কানিমূলক প্রচারের জন্যও দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই একইরকম তৎপরতা হামলাকারীদের প্রত্যক্ষ মদতদাতা ও সংগঠক তথা নেপথ্য নায়কদের বিরুদ্ধে কেন নেওয়া হচ্ছে না? সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্রমাগত মিথ্যা ছবি ও ভিডিও প্রচার করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হামলার প্ররোচনা ছড়াতে দেখা গেছে বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং ও লকেট চ্যাটার্জিকে। এবিষয়ের যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। সাংসদ পদে থেকেও এসব করেছেন তাঁরা। তবু বিজেপির মাথাদের বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না! সরকার ও প্রশাসনের কাছে সদুত্তর দাবি করছে সিপিআই(এমএল)।”

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার মানুষদের পাশে আছে ও থাকবে পার্টি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে তাঁদেরকে ভাতে মারার এই ঘৃণ্য চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করবে পার্টি। প্রশাসনের তরফে আরও খাদ্য সরবরাহ করা এবং ভাঙা ও পুড়ে যাওয়া বাড়ির পুনর্নির্মাণের আশু দাবি নিয়ে আন্দোলন এবং ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করতে মিল মালিকের উপর চাপ জারি রাখবে। পুলিশ, প্রশাসন, স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে শ্রম দপ্তর সর্বত্র উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সর্বতো প্রচেষ্টা ও ধারাবাহিক উদ্যোগ জারি থাকবে বলে জানিয়েছেন জেলা সম্পাদক।

ga

 

how

একদিকে করোনা সংকটের জেরে দেশজুড়ে চলা লকডাউন ও তার থেকে তৈরি হওয়া ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দা, চূড়ান্ত সরকারী অবহেলা,ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর অন্য দিকে ঘটে চলেছে একের পর “দুর্ঘটনা” – যা আদতে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় গণহত্যার সামিল। বিশাখাপত্তনমের গ্যাস নিঃসরণ ও ঔরঙ্গাবাদে ঘর ফিরতি নিঃস্ব শ্রমিকদের ট্রেনে পিষে মেরে ফেলার ঘটনায় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ডাকে সামিল হয়ে হাওড়া জেলা জুড়ে প্রদর্শিত হল বিক্ষোভ কর্মসূচী।

বালি – পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে সামিল হয়ে ৯ মে সকাল ১০টায় বালি জোড়া অশ্বত্থতলা মোড়ে প্রতীকী বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত হল। ভাইজ্যাকের গ্যাস দুর্ঘটনা ও ঔরঙ্গাবাদে শ্রমিকদের ট্রেনে পিষে মারার ঘটনার বিরুদ্ধে কালো পতাকা, প্ল্যাকার্ড ও স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন হল। কর্মসূচী সঞ্চালনা করেন নীলাশিস বসু ও সংক্ষিত বক্তব্য রাখেন বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সম্পাদক কমঃ মাধব মুখার্জী।

ঘোড়াঘাটা – আজ সকালে ঘোড়াঘাটা বাজারে অন্ধ্রপ্রদেশে গ্যাস দুর্ঘটনায় ঔরঙ্গাবাদে পরিযায়ী শ্রমিকদের মত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও শেষে নীরবতা পালন করা হয় সিপিআই(এমএল) ও আয়ারলা-র পক্ষ থেকে। উপস্থিত ছিলেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য কমঃ সনাতন মণি।

বাঙালপুর – হাঠুড়িয়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অবস্থান সংগঠিত হল বাঙালপুর পার্টি অফিস সংলগ্ন এলাকায়। উপস্থিত ছিলেন পার্টির লোকাল কমিটির সম্পাদক কমঃ দিলীপ দে ও অন্যান্য নেতৃত্ব ।

জগাছা – এআইসিসিটিইউ ও এআইসিডব্লিউএফ জগাছা আঞ্চলিক কমিটির উদ্যোগে ভাইজ্যাগে গ্যাস দুর্ঘটনা ও ঔরাঙ্গাবাদে শ্রমিকদের  ট্রেনে পিষে মারার ঘটনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও অবস্থান কর্মসুচী পালিত হয়, অবস্থান কর্মসুচিতে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য কমঃ ভোলা নাথ চৌধুরী।

aipf

 

sama

১৬ মে বিকেল পাঁচটায় বারাসাত রেল স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে এআইপিএফ এবং এপিডিআর-এর যৌথ উদ্যোগে কবি ভারভারা রাও, অধ্যাপিকা সোমা সেন, আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ, সাংবাদিক গৌতম নভলখা সহ সমস্ত রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে এক সোচ্চার সমাবেশ হয়। ঐ সমাবেশ থেকে শ্রম আইন শিথিল করে শ্রমিকদের মজুরি-দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলার চক্রান্তের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, দাবি ওঠে আট ঘণ্টার শ্রমসময়কে বারো ঘণ্টায় পরিণত করার ফরমান প্রত্যাহার করতে হবে। জনা তিরিশেক প্রতিবাদী বুকে দাবিপত্র ঝুলিয়ে এই সমাবেশে সামিল হন এবং দীর্ঘক্ষণ শ্লোগান তুলে, বক্তব্য রেখে কর্মসূচী চলে। বক্তব্য রাখেন এআইপিএফ-এর তরফে নির্মল ঘোষ এবং এপিডিআর-এর তরফে বাপ্পা ভুঁইয়া। উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী সোমশঙ্কর, পুষ্পল, লিটিল ম্যাগাজিন সংগঠক সুবীর সাহা, আইসা-সংগঠক অন্বেষা, ‘সাংস্কৃতিক সমসময়’-এক সম্পাদক অশোক চট্টোপাধ্যায়, ‘আজকের দেশব্রতী’র সম্পাদক অনিমেষ চক্রবর্তী, ইফটু, এআইসিসিটিইউ-র প্রতিনিধি সহ এআইপিএফ ও এপিডিআর-এর কর্মীরা। কর্মসূচী চলাকালীন প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন রাস্তায় মানুষজনেরা দাঁড়িয়ে গিয়ে সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন।

cossi

এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত কাশীপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার্স (পার্মানেন্ট) ইউনিয়ন প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্পোরেটায়নের বিরোধিতা করছে।

অতিমারিতে সবাই যখন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিরক্ষা শিল্প কর্পোরেটায়ন করার সিদ্ধান্ত নিল। ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ সালে প্রতিরক্ষা শিল্পের ৪১টা ইউনিট কর্পোরেটায়নের বিরুদ্ধে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘটে সামিল হয়ে ছিলেন। কিন্তু মোদী অমিত শাহেরা কর্পোরেটায়ন করার নীলনক্সা তৈরি করতেই থাকে। তখন প্রতিরক্ষা শিল্পের সাথে যুক্ত কেন্দ্রীয় ফেডারেশনগুলো ২০ আগস্ট-১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এক মাসের ধর্মঘটের আহ্বান করে। সারাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিকরা ধর্মঘটে সামিল হন। কেন্দ্রীয় সরকার ধর্মঘট চলাকালীন জানালো আপাতত কর্পোরেটায়ন করা হবে না। ৫ দিনের মাথায় ইউনিয়ন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়। এখন শ্রমিকরা গৃহবন্দি, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি সরকার নির্লজ্জের মতো প্রতিরক্ষা শিল্পকে কর্পোরেটায়ন করলো। এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার্স (পার্মানেন্ট) ইউনিয়ন প্রতিরক্ষা শিল্পের কর্পোরেটায়নের তীব্র বিরোধিতা করছে। ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন আশা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিগতদিনের মতো এবারও কর্পোরেটায়নের বিরুদ্ধে সব ফেডারেশনগুলো এবং ইউনিয়ন এক সাথে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচী পালন করবে।

এআইসিসিটিইউ
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকমিটি

it

 

sib

এআইসিসিটিইউ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত শিবদাসপুর ইটভাটা মজদুর ইউনিয়ন সরকারী মহলে ইটভাটার শ্রমিকদের নিজের রাজ্যে পাঠাবার জন্য লাগাতার উদ্যোগ নিয়েছে। আজ তাঁরা প্রথম একটা স্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছেছে।

১৪ মে ২০২০ শিবদাসপুর ইটভাটায় রাজ্য সরকার নৈহাটি থানার মাধ্যমে ৪টি বাসে করে আরপিএস এবং এসবিএস ভাটার প্রায় ১৫০ জনের মতো শ্রমিককে ঝাড়খণ্ডে পৌঁছে দিচ্ছেন। বিহার সরকারের অনুমতি এখনো পাওয়া যায়নি, তাই বিহারের বাসিন্দারা এখানেই আছেন। বাকিদের জন্য চেষ্টা চলছে। ইউনিয়ন অন্য রাজ্যের শ্রমিকদের নিজ রাজ্যে ফেরাবার জন্য যা যা করণীয় সব কিছুই করছে ও করবে।

left

 

leftt

কেন্দ্রের মোদী সরকার এবং বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকার শ্রমিকদের অধিকারের ওপর যে তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনছে, তার বিরুদ্ধে দিল্লীতে ১৩ মে প্রতিবাদ সংগঠিত করল বড়-বড় বাম দল এবং কয়েকটি বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। এই নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন সিপিআই(এম-এল)-এর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ও কবিতা কৃষ্ণাণ, সিপিআই(এম)-এর সীতারাম ইয়েচুরি ও তপন সেন, সিপিআই-এর ডি রাজা, লোকতান্ত্রিক জনতা দলের শারদ যাদব এবং আরজেডি দলের রাজ্য সভার সদস্য মনোজ ঝা। তাঁরা সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় অফিস এ কে জি ভবনের বাইরে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখান, তাঁদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল – উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের রাজ্য সরকারগুলোর শ্রম আইন মুলতুবি করে এবং কাজের ঘণ্টাকে বাড়িয়ে জারি করা অধ্যাদেশগুলো অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। লকডাউনের পঞ্চাশ দিন পরও পরিযায়ী শ্রমিকদের জ্বলন্ত ইস্যুগুলো সমাধানে মোদী সরকারের শোচনীয় ব্যর্থতা ও তা করার অনাগ্রহকে নেতৃবৃন্দ ধিক্কার জানান। তাঁরা বলেন, সরকার এই মহামারিকে অছিলা করে সুপরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রকে খর্ব করে তুলছে; ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থসমূহ এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আশু স্বার্থ রক্ষার জন্য তাঁরা বাম কর্মীবাহিনী এবং গণতন্ত্রকামী সমস্ত অংশের কাছে আবেদন জানান।

left

 

দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ধারায় বিভাজন সৃষ্টি করা এবং ঘৃণার প্রচারাভিযান চালিয়ে পরিমণ্ডলকে বিষিয়ে তোলার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান তাঁরা জনগণের কাছে জানান। এই প্রকাশ্য প্রতিবাদের আগে তাঁরা ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে দুটো স্মারকলিপি পাঠান এবং সেগুলোতে দাবি করা হয় – শ্রমিকদের  অধিকার পরিপূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করে সেগুলোকে বলবৎ করতে হবে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে; এছাড়া, মোদী সরকারের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা এবং ডাইনি-খোঁজার রাজনীতিকে অবিলম্বে থামাতে হবে।

sili

 

aicc

করোনা মহামারীর মোকাবিলার নামে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট ও অন্যান্য রাজ্য শ্রম আইনগুলোকে রদ করায় এআইসিসিটিইউ ১২ ও ১৩ মে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে। তামিলনাড়ু কর্নাটক, উত্তরাখণ্ড, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিম বাংলা ও অন্যান্য রাজ্যের সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শত-শত শ্রমিক এই প্রতিবাদে অংশ নেন। লকডাউনের বিধি মেনে যেখানেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিবাদ জানানো সম্ভব ছিল, তা সে বাড়ি, ইউনিয়ন অফিস বা অন্যান্য স্থানই হোক, সেখানেই শ্রমিকরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্ল্যাকার্ডের ছবিও তাঁরা পোস্ট করেন। সংগঠিত প্রতিবাদকে সরাসরি সম্প্রচার করতে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াকেও কাজে লাগানো হয়। শ্রম আইনগুলোকে রদ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তাঁরা বলেন, এই আইনগুলোকে বাতিল করলে তা পুঁজিপতিদের কাছে শ্রমিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করার লাইসেন্স হয়েই উঠবে।

ranch

 

পরিকল্পনাহীনভাবে লকডাউন নামানোয় তা শ্রমিকদের রুটিরুজি ও কাজ কেড়ে নিয়েছিল, এখন আবার তাদের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। লকডাউনে শ্রমিকদের যে মৃত্যুগুলোকে (ঔরঙ্গাবাদ, বিশাখাপত্তনমে এবং বাড়ি ফেরার সময় বিভিন্ন স্থানে রাস্তার দুর্ঘটনায়) এড়ানো যেত, সেগুলো এখন রাষ্ট্র চালিত গণহত্যা রূপেই দেখা দিচ্ছে। খাবার ও জল ছাড়াই শত-শত মাইল পায়ে হেঁটে শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। লকডাউন উঠে গেলে পুঁজিপতিদের যাতে সস্তায় শ্রমিক পেতে অসুবিধা না হয় তার জন্য ট্রেন পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে। প্রতিবাদের পর ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা হলেও শ্রমিকদের কাছ থেকে ভাড়ার সঙ্গে সারচার্জও আদায় করা হয়েছে। শ্রমিকরা খাবার চাইলে বা বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে পুলিশ পৈশাচিক ভাবে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে, যেমনটা দেখা গেছে সুরাট ও অন্যান্য স্থানে। শ্রম আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে অনেক শ্রমিকের মৃত্যুকেই এড়ানো যেত।

nai

 

এই প্রতিবাদগুলোর মধ্যে দিয়ে এই বিষয়টাকেও জোরের সাথে তুলে ধরা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে তাঁদের ভাষণগুলোতে ভুরিভুরি কথা বললেও শ্রমিকদের জন্য কোনো ঘোষণাই তাঁদের ভাষণগুলোতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে এআইসিসিটিইউ নিম্নলিখিত দাবিগুলোকে তুলে ধরেছে:

  • ১। শ্রম আইনগুলোর ওপর আক্রমণকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে;
  • ২। শ্রমিক-বিরোধী সমস্ত অধ্যাদেশ/শ্রম বিধিকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং শ্রমিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করার সমস্ত প্রচেষ্টাকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে;
  • ৩। লকডাউন চলা কালে নিহত সমস্ত শ্রমিকের জন্য এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে;
  • ৪। সমস্ত শ্রমিককে ১০০০০ টাকা লকডাউন ভাতা অথবা সুনির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি (যেটা বেশি হবে) দিতে হবে;
  • ৫। খাদ্য, রেশন, নিরাপত্তা এবং কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে; এফসিআই-এর গুদাম খুলে দিতে হবে;
  • ৬। শ্রমিকদের লে-অফ করা থেকে কারখানা মালিকদের প্রতিহত করতে হবে;
  • ৭। শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে চাইলে শিল্পপতিদের নির্দেশে তাদের আটকানো যাবে না; যে সমস্ত শ্রমিক বাড়ি যেতে চায়, বিনামূল্যে এবং নিরাপদে তাদের বাড়ি ফেরাটাকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
jal

এ রাজ্যের এই কর্মসূচী

দার্জিলিং জেলা বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ সহ অন্যান্য রাজ্যে অর্ডিনান্সের মাধ্যমে শ্রমিকদের কাজের সময় ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করা, অন্য সমস্ত শ্রমকানুনকে আগামী ৩ বছরের জন্য নিস্ক্রিয় করে দাস শ্রমিক করে তোলা, যাদবপুরে বামপন্থী কর্মীদের উপর তৃণমূল বাহিনীর হামলা এবং হুগলীতে গৈরিক বাহিনীর দাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে আজ সমগ্র দেশজোড়া বিক্ষোভের সঙ্গে এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে শিলিগুড়ি হাসপাতাল সংলগ্ন হরেন মুখার্জী রোডে স্লোগান, প্ল্যাকার্ড সহ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। নেতৃত্ব দেন পুলক গাঙ্গুলি, মোজাম্মেল হক, অপু চতুর্বেদী, মীরা চতুর্বেদী, রুবি সেনগুপ্ত, শাশ্বতী সেনগুপ্ত প্রমুখ।

জলপাইগুড়ির কদমতলায় এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে ব্যানার প্ল্যাকার্ড নিয়ে সোচ্চার শ্লোগান বিক্ষোভে সামিল হন প্রদীপ গোস্বামী, শ্যামল ভৌমিক, মুকুল চক্রবর্তীরা।

Nadia

 

নদীয়া জেলায় এআইসিসিটিইউ'র ডাকে ১৩ মে প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচী ধুবুলিয়া ব্লক দপ্তরের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। বিড়ি শ্রমিক, হকার ইউনিয়নের কর্মীরা অংশগ্রহন করে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাও, খাদ্য দাও, অর্থ দাও। ৮ ঘন্টা কাজের অধিকার কেড়ে নিয়ে ১২ ঘন্টা করা চলবে না- ইত্যাদি স্লোগানে, প্ল্যাকার্ডের প্রচারে এলাকা সরগরম হয়ে ওঠে। উপস্থিত ছিলেন পার্টির জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত প্রমূখ। ঐ দিনই কৃষ্ণনগর বাস স্ট্যান্ডে অনুরূপ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। পরিবহন শ্রমিক সহ সমস্ত শ্রমজীবীদের প্রচেষ্টা প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করা হলো কেন? বিভিন্ন দাবি ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ নদীয়া জেলা সম্পাদক অমল তরফদার।

raj

 

pol

আটটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রপতির কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়ে বিরোধী নেতৃবৃন্দ এবং মানবাধিকার কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার এবং প্রতিবাদকারী ও রাজনৈতিক সমালোচকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের রাজনীতির অবসানের দাবি জানিয়েছেন।

সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ১৪ মে একটা বিবৃতিতে বলেছেন, যাদের জেলে থাকার কথা তারা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে; আর সফুরা জারগরের মতো অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে জেলে পোরা হচ্ছে। করোনা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের সমস্ত দেশই এখন জেলগুলোকে কয়েদি শূন্য করার কথা বলছে, আর ভারতে এর বিপরীতটাই ঘটছে। সুধা ভরদ্বাজ, ভারভারা রাও, আনন্দ তেলতুম্বদে, লালু যাদব, মেহেবুবা মুফতি সঈদের মতো রাজনৈতিক বন্দীদের বয়স ৬০-৭০ বছরের বেশি। এই সমস্ত ব্যক্তিদের জেলে আটকে রাখার মধ্যে দিয়ে কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে? সরকারকে এই সমস্ত বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।

সফুরা জাগর, অখিল গগৈ এবং অন্যান্য সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেওয়ার দাবিও কমরেড দীপঙ্কর জানান। করোনা সংকটের সময় সরকার যে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দিল্লী দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ এনে তাদের জেলে পুরছে, সেটা অবশ্যই ধিক্কারযোগ্য। বিহারের জেলে আরওয়াইএ-র জাতীয় সভাপতি অমরজিৎ খুশাওয়া সহ যে সমস্ত দরিদ্র মানুষ বন্দী রয়েছেন তাদের মুক্তি দেওয়া বা প্যারোলে জেলের বাইরে আসতে দেওয়ার দাবিও দীপঙ্কর জানান।

safura

 

রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো স্মারকলিপির একটি অংশে বলা হয়েছে, “দিল্লীতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা পুলিশ সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া মহিলা সহ সুপরিচিত কর্মীদের পুরোদস্তুর সাজানো অভিযোগের ভিত্তিতে দানবীয় ইউএপিএ আইনে গ্ৰেপ্তার করছে এবং পুলিশের অভিপ্রায় হল দিল্লীর সাম্প্রদায়িক হিংসায় জড়িত বলে তাদের দেখানো। এ ছাড়াও, স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ বহু সংখ্যক ছাত্রকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে এবং হুমকি দিচ্ছে। জেএনইউ-তে চালানো হিংসার শিকার হওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিশানা বানানো হচ্ছে আর যে সমস্ত বহিরাগতরা ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের বিরুদ্ধে হিংসা সংঘটিত করল তাদের কাউকেই গ্ৰেপ্তার করা হয়নি। এই ব্যাপারটাও যথেষ্ট আপত্তিকর যে, একদিকে বিশেষ সম্প্রদায়কে নিপীড়নের নিশানা বানানো হচ্ছে, আর অন্যদিকে যারা সাম্প্রদায়িকতা চালিত হিংসা সংঘটিত করেছে, বিভিন্ন ভিডিও রেকর্ডিং থেকে যাদের পরিচিতি জানা যাচ্ছে এবং যাদের মধ্যে শাসক দলের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দও রয়েছে, তারা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

রাষ্ট্রপতিকে ১১ মে পাঠানো স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস, আরএসপি-র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, এলজেডি-র সাধারণ সম্পাদক শারদ যাদব, আরজেডি-র সাংসদ মনোজ ঝা এবং ভি সি কে-র সাংসদ ও সভাপতি থল থিরুমাভালাভান।

kri

 

kri

গ্রীষ্মের প্রবল তাপে, কখনো বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে চাষিরা মাঠে সোনালী ধান ফলিয়েছে, উৎপাদন করেছে বিভিন্ন ধরনের সব্জি। এই করোনা মহামারী লকডাউনের মধ্যে কৃষকরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে খাদ্য যুগিয়ে গেছে। কারণ কৃষিকাজ কখনই থেমে থাকতে পারে না। এ কথা বহুল প্রচারিত যে, কৃষি নাকি আজ আর লাভজনক নয়, কৃষি থেকে আমাদের শিল্পের দিকে এগিয়ে যেতেই হবে। এভাবে কৃষির গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে অবজ্ঞা করা হয়ে থাকে। কিন্তু লকডাউনের সময়কালে খাদ্য সরবরাহের গুরুত্ব নতুন করে টের পাওয়া গেলো। বাস্তবে কৃষিক্ষেত্রই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখলো। গ্রামে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রম সৃষ্টি হওয়ার কারনে যারা ভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়েছিলো তারা এখন পুনরায় গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ফলত গ্রামে শ্রম আরও উদ্বৃত্ত হবে, মজুরি আরও নিম্নগামী হবে, যে কোনো উপায়ে পেটের খিদে মেটানোতে নিযুক্ত থাকাই নিয়তি হয়ে উঠবে, দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হবে। এই বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি কোথায় নিযুক্ত হবে তা নিয়ে কোনও চিন্তা সরকারগুলির আছে কি? এরা তো আমাদের দেশের মূল্যবান শ্রমসম্পদ! এই বিপুল শ্রমশক্তিকে কৃষি ও গ্রামীণ পরিকাঠামো নির্মাণের কাজে ব্যবহার করার কোনো পরিকল্পনা সরকার নিলো কি? দেশের অন্নদাতারা তাঁদের রক্তঘামে উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম পেয়েছে কি? লকডাউনের সময়কালে চাষিদের, পোল্ট্রি বা গবাদি পশু পালকদের যে বিপুল লোকসান হয়েছে তার কোনো ক্ষতিপূরণ সরকার দিলো কি? আদৌ না। উল্টে মোদী সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে কৃষি উন্নয়নের এক “প্যাকেজ” ঘোষণা করলো। এই প্যাকেজেও বাস্তবে দেখা গেলো লকডাউনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চাষিদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে চরম সর্বনাশের পথে। চাষির সর্বনাশ আর কর্পোরেটদের পৌষ মাস। বাণিজ্যিক পুঁজির প্রতিনিধিরা কৃষিজাত পণ্যের যে ফাটকা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কব্জায় চাষিদের ঠেলে দেওয়া হলো। পাইকারি ও খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশ ও তার হাত ধরে বাণিজ্যিক পুঁজির ফাটকা কারবার ভারতে ক্রমশ বেড়েই চলছিলো। এখন করোনা হয়ে উঠেছে শাসকের কাছে একটা হাতিয়ার। এক ধাক্কায় কৃষিকে কর্পোরেটমুখী পুনর্গঠনের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। তার গাল ভরা নাম দেওয়া হলো “কৃষক কল্যাণ”। এক দিকে কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়েই চলেছে, অথচ ফসলের লাভজনক দাম নেই। মাঠে চাষিরা সব্জির যে দাম পাচ্ছে সেটাই সামান্য দুরের শহরে গঞ্জে বিক্রি হচ্ছে ১০ গুণ বেশি দামে! করোনা লকডাউনের শুরু থেকে লাগাতার ১৫/২০ দিন ধরে গ্রামে এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা গেলো, ২ টাকা ৩ টাকা দামে সব্জি বিক্রি হচ্ছে, চাষিরা ফসল বিনা পয়সায় বিলিয়ে দিচ্ছে। এই চাষিরা কোনোরকম ক্ষতিপূরণ পেলো না।

sale

 

এখন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করলেন, কৃষিকে নাকি আত্মনির্ভর করে তুলবেন। আত্মনির্ভর? নাকি বাজারের মুনাফাখোর শক্তিগুলির উপর চূড়ান্ত নির্ভরতা? তিনি ঘোষণা করলেন, কৃষক মান্ডিগুলির কর্তৃত্ব নাকি ভেঙ্গে ফেলা হবে – যাতে নিজেদের পছন্দ অনুসারে চাষিরা তাঁদের ফসল স্বাধীনভাবে বাজারে বিক্রি করতে পারবে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত মান্ডিগুলিতে চাষিরা আর ফসল বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে না। একথার অর্থ আসলে উল্টো। আসলে বলা হচ্ছে যে সরকার আর কৃষকের ফসল কিনতে বাধ্য থাকবে না। কৃষি পণ্যের আন্তঃরাজ্য ব্যবসা এবং ই-ট্রেডিং তথা বানিজ্যের ঢালাও অনুমোদন দেওয়া হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুত করার সীমা তুলে দেওয়া হবে। অবাধ করা হবে কৃষি পণ্যের আমদানি রপ্তানি। তুলে দেওয়া হবে সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যদ্রব্যের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ। এজন্য সংশোধন করা হবে ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। ভালো ভালো কথার আড়ালে এগুলি হলো সেই অতি পরিচিত উদারীকরণ-বেসরকারীকরণের যুক্তিজাল। দেশজুড়ে কৃষকরা যখন চাইছে সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করুক। সঠিক ভাবে উৎপাদন খরচের দেড়গুন দাম হিসাব করুক। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করে সরকার দেড়গুণ দামে ফসল কেনা সুনিশ্চিত করুক, গ্রহণ করুক ঋণমুক্তির দায়। এই দাবিগুলি আজও অধরা হয়ে আছে। এই সমস্ত দাবিতে দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলন চলছে। তা সত্বেও কাগজে কলমে কৃষকের যতটুকু অধিকার ছিলো সেটাকেও আজ সম্পূর্ণ লোপাট করে দেওয়া হবে। কালো বাজারি মজুতদারী আইনি বৈধতা পেয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন গত দুই মাসে ৭৫০০ কোটি টাকা ফসলের সরকারী সংগ্রহে ব্যায় হয়েছে। বাস্তবে এই টাকার সিংহভাগই কৃষকরা পায়নি। কৃষকের থেকে কম দামে ফসল কিনে সরকারকে বিক্রি করে মহাজনরা মুনাফার টাকা পকেটে পুরেছে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে চাষিরা সহায়ক মূল্য কুইন্টাল পিছু ৭০০-৮০০ টাকা কম পেয়েছে। এছাড়া বিপুল পরিমানে কৃষি ঋণ দেওয়া হবে বলা হয়েছে। বাস্তবে ২৫-৩০ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঝণ নেয়। বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠরা রয়েছে মহাজন নির্ভর। এছাড়া প্রচুর প্রকল্পর কথা ঘোষণা করা হয়েছে যেগুলি পুরাতন ঘোষিত প্রকল্প।

paddy

 

কৃষি পণ্যের সরকারী সংগ্রহ ব্যবস্থা এবং ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ জরুরি কেন? কারণ তা কৃষককে অভাবী বিক্রির বিপদ থেকে খানিকটা হলেও রক্ষা করতে পারে। যদি অতিরিক্ত উৎপাদনের কারনে ফসলের দাম কমে যায় তাহলে সেটা চাষিদের ন্যূনতম লাভ করার একটা গ্যারান্টি দিতে পারে। সরকারী সংগ্রহমূল্য বাজারের দামের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে। ৭ রকমের দানা শস্য ৫ রকমের ডাল ও ৮ রকমের তৈলবীজ- মোট ২৪ টি কৃষিপণ্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আওতায় রয়েছে। এই সরকারী সংগ্রহর ব্যবস্থাপনার সাথে গণবণ্টন তথা রেশন ব্যাবস্থা ও মিড-ডে-মিল প্রকল্প অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। শুধু তাই নয় এটা ফসলের দাম না পাওয়ার ঝুঁকির হাত থেকে চাষিদের বাঁচানোর জন্য এক ধরনের বীমা বা সুরক্ষাও বটে। এই গোটা বিষয়টা গ্রাম শহরের দরিদ্র মানুষের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়া চাষিরা যদি লাভজনক দাম পায় সেটা কৃষি উৎপাদনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। এখন যে কেন্দ্রীয় নীতি ঘোষণা করা হলো সেটা অতিমারীজনিত আর্থিক ও শিল্প ক্ষেত্রের মন্দা কাটাতে কৃষিকে লুঠ করার নীল নকশা ছাড়া আর কিছু নয়। পূঁজিপতিদের অতিমুনাফা সৃষ্টির জন্য সমগ্র কৃষক সমাজকেই বলি দেওয়া হলো। কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থ বিগত বাজেটেই ৭৪ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এখন ভর্তুকিশূন্য কৃষি এবং গণবণ্টন ব্যবস্থাকে ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার পথে সরকার এগিয়ে গেলো। ফলে গ্রামীণ মহাজন ফড়ে দালাল মিল মালিক থেকে শুরু করে মনসান্টো, কার্গিল, ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্সের মতো কোম্পানিরা কৃষি ও কৃষকদের লুঠ করার অবাধ স্বাধীনতা পাবে। ইতিপূর্বেই চাষের উপকরণের বাজারে ওদের একচেটিয়া দখলদারী কায়েম হয়ে আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৃষিজমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তনের কথা মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। এতে চুক্তিচাষকে আইনি পরিধির মধ্যে আনা হবে। ফলে দেশী বিদেশী পুঁজিপতিদের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ বৈধতা পাবে। কৃষক পরিণত হবে চুক্তি চাষিতে। বলা হচ্ছে সংস্কারের ফলে কৃষক নাকি স্বাধীনভাবে ফসলের লাভজনক বাজার পাবে। কিন্তু কৃষি পণ্যের অবাধ আমদানী দেশের কৃষককে প্রতিযোগিতায় ছিটকে দূরে ফেলে দেবে। দূধ মাংস চামড়ার ব্যবসা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশ এবং তাদের সাথে গাটছড়া বাঁধা দেশীয় পূঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। দেশের চাষি ফসলের যে দাম পায় তার ডবল দামে বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য আমদানী করা চলতে থাকবে। এসবের ফলে চূড়ান্ত অভাবী বিক্রি-ঋণফাঁদে কৃষকের আত্মহত্যার মিছিল বাড়তেই থাকবে। এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারও কৃষি বিপনন আইন সংশোধন করে কৃষিপণ্য ব্যবসায় বড় পুঁজিপতিদের অনুপ্রবেশের রাস্তা খুলে দিয়েছে। বড় বড় কথার আড়ালে চলছে কৃষকের প্রতি বঞ্চনা আর অবহেলা।

কিন্তু না। বিজেপির লুঠতন্ত্রের এই অশ্বমেধের ঘোড়াকে রুখে দিতে গড়ে উঠবেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকের পাল্টা প্রতিরোধ। এই হৃদয়হীন, অবিসংবেদী, চরম নির্মম সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেই মোকাবিলা করে বাঁচাতে হবে দেশটাকে।

-- জয়তু দেশমুখ

lab

 

law

“বর্তমানের শিথিল শ্রম আইনকে শিথিলতর করলে আর্থিক কর্মকান্ডে গতি আসবে না” – আজিম প্রেমজি, আইটি সংস্থা উইপ্রোর প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার।

প্রথম হোঁচট-টা এবার খেতে হলো।

৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের আন্তর্জাতিক সনদকে বদলে প্রশাসনিক এক আদেশনামায় যোগী আদিত্যনাথ তা ১২ ঘণ্টায় নিয়ে গেছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের নোটিশ পাওয়ার পর উত্তর প্রদেশ সরকার তা তড়িঘড়ি ফেরত নিল।

কিন্তু বহাল থাকলো আরও প্রায় ৩৮ টি শ্রম আইনকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত। “উত্তর প্রদেশ টেম্পোরারি এক্সজেমশন ফর সার্টেন লেবার “লজ অর্ডিন্যান্স, ২০২০” – এই দানবীয় অধ্যাদেশ মারফত এক কলমের খোঁচায় ১০০০ দিন (অর্থাৎ, প্রায় তিন বছরের জন্য) এর জন্য হিমঘরে পাঠিয়ে দিল যাবতীয় শ্রম আইন। এরপর যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হলো। শ্রম আইনকে বাতিল করার প্রতিযোগিতা। উত্তর প্রদেশে বাদে এখন পর্যন্ত ৮টি রাজ্য শ্রম দিবসকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে – গুজরাট-হিমাচল প্রদেশ-হরিয়ানা-ওড়িষ্যা-মহারাষ্ট্র-রাজস্থান-বিহার ও পঞ্জাব। অসম ও ত্রিপুরা ওই পথে হাঁটার তোড়জোড় শুরু করেছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের নোটিশের পর তারা আর কতটা এগোবে তা এখন দেখার আছে।

আগামী তিন বছরের জন্য যোগী আদিত্যনাথ সরকার কবরে পাঠালো এমনকি সেই সমস্ত আইন, যা মৌলিক মানবাধিকারের সাথে যুক্ত। সেগুলো হলো, পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত আইন, ন্যূনতম মজুরি, মাতৃত্বকালীন আইন, গ্রাচ্যুইটি প্রভৃতি। আর, যে সমস্ত আইন বাতিল করেছে সেগুলো হলো ট্রেড ইউনিয়ন আইন, শিল্প বিরোধ আইন, পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইন, কন্ট্রাক্ট শ্রমিক আইন, সম কাজে সম মজুরি প্রভৃতি।

মধ্যপ্রদেশ সরকার ফ্যাক্টরিজ আইনে আমূল বদল ঘটালো। কন্ট্রাক্ট শ্রমিক আইন ও শ্রম বিরোধ আইনে এমন সব পরিবর্তন আনলো, যার ফলে নিয়োগকর্তাকে দেওয়া হলো অবাধে ছাঁটাই করার অধিকার; শ্রম বিরোধ নিরসনের, তার সুষ্ঠু মীমাংসার অত্যন্ত মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেড়ে নেওয়া হলো। ৪৯ জন পর্যন্ত কর্মী সরবরাহকারী কনট্রাক্টরদের কোনো ধরনের লাইসেন্সের প্রয়োজন থাকবে না। ফলে, যে কোনো নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি ছাড়াই তারা তাদের কারবার চালিয়ে যেতে পারবে। কারখানা সংক্রান্ত সমস্ত ধরনের ইন্সপেকশন, আইন প্রনয়নকে বলবৎ করার যাবতীয় বিধি ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দেওয়া হলো। শ্রমিকদের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক অধিকার, যেমন মজুরি, ক্ষতিপূরণ, নিরাপত্তা ইত্যাদি হয়ে দাঁড়ালো অর্থহীন।

মধ্যপ্রদেশ কল্যাণ পর্ষদে নিয়োগকর্তাদের মাথা পিছু শ্রমিকদের জন্য যে ৮০ টাকা জমা দিতে হতো, তা আর দিতে হবে না। সমস্ত দোকান-সংস্থা খোলা থাকবে সকাল ৬.০০ থেকে রাত ১২.০০ পর্যন্ত। গুজরাট সরকার ও ১২০০ দিনের জন্য সমস্ত শ্রম আইনকে স্থগিত রাখলো।

আজ কোভিড-১৯-র সুযোগ নিয়ে ভারতের বৃহৎ কর্পোরেট ঘরানাগুলো পুরোদমে মাঠে নেমে পড়েছে। ভারত সরকারের সচিব হীরালাল সামারিয়া ৫ মে তারিখে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্য সচিবের কাছে একটা প্রশাসনিক নির্দেশিকা পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, প্যান্ডেমিক উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যে বিরাট চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে তাকে যুজতে শ্রম আইন সংস্কারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট, শ্রম দিবসকে ৮ ঘণ্টার থেকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা দরকার। বোঝাই যাচ্ছে, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কাছে শ্রম দিবস সহ অন্যান্য শ্রম সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এই ধরনের নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। আর, শুধু বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার গুলোই নয়, এ প্রশ্নে কংগ্রেস, বিজেডি, নিতীশ কুমার, তেলেঙ্গানার ওয়াই এস রেড্ডী ও সমানভাবে তাল মিলিয়ে চলছে। আর এ ব্যাপারে নীতি আয়োগ শানিয়েছে তার তাত্ত্বিক যুক্তি।

lab

 

নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত শ্রম কানুনের ঢালাও সংস্কারের সপক্ষে নির্লজ্জ ওকালতি করে বলেছেন, “১৯৯১ সালের সংস্কার কর্মসূচীর পর এতোদিন বাদে শ্রম আইনকে আপাদমস্তক বদলে সবচেয়ে দুঃসাহসিক ও বলিষ্ঠ উদ্যোগের সূত্রপাত ঘটালো উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশ। অনেকগুলো আইনকে তুলে, শিল্পকে খোলামেলা পরিবেশে কাজের এক বিরাট সুযোগ করে দেওয়া হলো। কোভিড-১৯ অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করলো লাল ফিতের ফাঁস, ইন্সপেক্টর রাজ, আর যত সব মান্ধাতার আমলের শ্রম আইন”। (ইটস নাও অর নেভার, ১২ মে, টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। ৮ মে, ভারতের প্রথম সারির শিল্প ও ব্যবসায়ী সংগঠন ফিকি-অ্যাসোচাম-সিআইআই সহ ১২ সংগঠন কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রীর সঙ্গে এক টেলি কনফারেন্স করে। সেখানে তারা সম্মিলিতভাবে যে প্রস্তাবগুলো রাখেন তা হলো – আগামী ২-৩ বছরের জন্য গোটা দেশেই সমস্ত শ্রম কানুন স্থগিত রাখা, সমস্ত শিল্প সংস্থায় ৮ ঘণ্টার শ্রমদিবসকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়া, সমস্ত রাজ্যগুলোকে অন্তত এক বছরের জন্য ন্যূনতম মজুরি সংশোধন না করা (অর্থাৎ মজুরি ফ্রিজ করা), লকডাউন পর্যায়ে সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি প্রদানের যে নির্দেশনামা বা অ্যাডভাইজারি জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন বলে করা হয় তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা এবং এবং গোটা পর্যায়ের মজুরির বদলে এপ্রিল-মে মাসে তা লে অফ হিসাবে মান্যতা দেওয়া হোক। সরকারের কাছে উচ্চগ্রামে এই আব্দার ও করা হয়, অবিলম্বে শ্রমিকদের কাজে ফিরে আসার জন্য প্রশাসনিক নির্দেশ যেন জারি করা হয়। আর শ্রমিকরা তা পালন না করলে তার পরিণতির জন্য যেন তারা প্রস্তুত থাকেন। তারা দাবি তোলেন, জাতীয় বিপর্যয় আইনের বদলে এবার থেকে শিল্পগুলোকে চলতে দেওয়া হোক শিল্প – শ্রম আইনের অধীনে। শ্রম আইনকে ঠান্ডা ঘরে পাঠানোর পেছনে বনিক সংগঠন ও কেন্দ্রীয় সরকারের একই যুক্তি – অতিমারীর পর ভেঙে পড়া আর্থিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে এটা নাকি অপরিহার্য এক পূর্বশর্ত।

kan

 

দিল্লি মসনদের নীতিকারদের একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, যে কোভিড-১৯-এর পর বহুজাতিক সংস্থাগুলো নাকি চীনে তার পাত্তারি গুটিয়ে চলে আসবে ভারতে। তাই, বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠলে তো সোনায় সোহাগা। সংবাদ মাধ্যমে একটা খবর প্রকাশিত হয় যে, কোনো এক প্রথম সারির জাপানি বহুজাতিক সংস্থা নাকি যোগী সরকারের এক উচ্চপদস্থ আমলা কে জিজ্ঞেস করেন, চীন থেকে সরে এসে তারা যদি এখানে বিনিয়োগ করেন, তবে কি কি বাড়তি সুযোগসুবিধা সরকার তাদের দেবে। তারপর থেকেই নাকি উত্তরপ্রদেশে শ্রম আইন বদলানোর একটা হিড়িক পড়ে যায়। মোদীর মেক ইন ইন্ডিয়ার পেছনেও ওই একই ভাবনা ছিল। ভারতের তুলনায় চিনের মজুরি বেশি, তাই, চীন থেকে উৎপাদন শিল্পগুলো ভারতে চলে আসবে -- এমন একটা খোয়াব মোদীর আমলাকূল দেখেছিলেন। পরবর্তীতে তা যে কতখানি ভ্রান্ত তা প্রকট হয়ে ওঠে। এমনকি ভিয়েৎনাম-বাংলাদেশে কিছু শিল্প (যেমন পোষাক - বস্ত্র) গেলেও তা এদেশের সীমানা মাড়ায়নি। এই সমস্ত অতি পন্ডিত লোকজনেরা ভুলে যান যে, বিশ্বব্যাঙ্কের বহু আলোচিত সমীক্ষাই দেখিয়েছে, শিল্প স্থাপনের জন্য নিয়োগ কর্তারা যে সমস্ত অনুকূল পরিবেশগুলোও খোঁজেন, সেখানে শিথিল শ্রম আইন রয়েছে পঞ্চম স্থানে। তা সত্ত্বেও নীতি আয়োগের প্রধান অমিতাভ কান্ত তার পূর্বোলিখিত লেখায় প্রস্তাব দিয়েছেন, আগামী তিন বছরের জন্য সমস্ত শ্রম আইন বাতিল থাকুক, তুলে দেওয়া হোক ছাঁটাই-লে অফ-ক্লোজারের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নেওয়ার শর্ত, আর আগাম অনুমতির জন্য বর্তমানে যে সংখ্যাটি ১০০ রয়েছে, তা ১০০০ করা হোক।

ভারতের প্রথম সারির আই টি সংস্থার কর্ণধার আজিম প্রেমজি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “এটা খুবই দুঃখজনক যে বেশ কিছু রাজ্য সরকার, ব্যবসায়ী মহলের সুপারিশে সেই সমস্ত শ্রম আইনকে তুলে দিচ্ছে যেগুলো শ্রমিকদের সুরক্ষিত করে। ... বিগত কয়েক দশক ধরে আইনগুলো এতটাই পাল্টেছে যে এখন আর সেগুলো শিল্পের কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে নেই। ইতিমধ্যেই শিথিল হওয়া আইনগুলোকে শিথিলতর করলে তা আর্থিক কর্মকাণ্ডকে গতি দেবে না, উল্টে তা নিম্ন আয়সম্পন্ন শ্রমিক ও গরিবদের অবস্থাকে আরো সংকটাপন্ন করে তুলবে। শ্রমজীবী মানুষদের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর এই যে প্রকরণ, তা রীতিমতো এক ভুল পদক্ষেপ।” বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর যে আচরণ করা হয়েছে, তাকে তিনি অন্যায্য আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এটা শ্রম ও ব্যবসার মধ্যে গড়ে ওঠা সামাজিক চুক্তির মূলেই আঘাত করেছে। সেজন্য আজ শুরু হয়েছে এই নজিরবিহীন বিপরীত মুখী অভিবাসন। এই আচরণ শুধু অন্যায্যই নয় তা একেবারেই অকার্যকরী। শিল্প ও শ্রমিকদের স্বার্থ গভীর ভাবেই আন্তঃসম্পর্ক যুক্ত। বিশেষ করে, এরকম অভূতপূর্ব আর্থিক সংকটের সময়ে।”

শ্রম আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে নানা মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর্থিক পুনরুজ্জীবনের পথে শ্রম আইন সংশোধনের এই তত্ত্ব যে নেহাতই অসাড়, তা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। তবে এ প্রশ্নে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, আইন আদালতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে প্রশাসনিক স্তরে অর্ডিন্যান্স বা নির্দেশনামার মধ্য দিয়ে আইনসভা যে সমস্ত আইন ও বিধিগুলোকে এতোদিন অনুমোদন দিয়েছিল, আজ এক কলমের খোঁচায় প্রশাসন তা খারিজ করে দিচ্ছে নতুন কোনো আইন তৈরি না করিয়ে। মনে রাখা দরকার, শ্রম বিষয়টা যুগ্ম তালিকায় আছে বটে, কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে রাজ্যগুলো এই অজুহাতে কেন্দ্রীয় শ্রম আইনগুলোকে খারিজ করতে পারে। এরকম ঢালাও ক্ষমতা আইনসভা কিন্তু প্রশাসনকে ন্যস্ত করেনি। যে কোনো নতুন আইন যথাযথ ফোরামগুলোতে ব্যাপক আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি হতে পারে আগের কোনো আইনকে বাতিল করে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, সেখানে আইনসভার কোনো ভূমিকাই নেই। প্রশাসনই আইনসভার উপরে নিজের স্থান করে নিচ্ছে – যা ভয়ংকর এক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। করোনার এই অভূতপূর্ব সংকট জনক পরিস্থিতিতে জাতীয় বিপর্যয় আইনকে কার্যকর করে প্রশাসন তার হাতের মুঠোয় যথেচ্ছ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিচ্ছে, যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের সুযোগটাও নেই।

migrat

 

পাশাপাশি, গোটা শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে একটা পরিকল্পিত আক্রমণ এই বলে শানানো হচ্ছে যে চীন থেকে নতুন কোনো সংস্থার এদেশে বিনিয়োগ করতে আসার পথে যেন শ্রমিকশ্রেণিই দায়ী। আর, তাই এই অবাধ্য শ্রেণিটাকে শায়েস্তা করতে যে কানুনগুলো তাদের সুরক্ষা দিত, সেগুলোকে এবার কেড়ে নাও। শ্রম বিরোধ উত্থাপন ও নিরসন করার এক অত্যন্ত মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করে রাষ্ট্র শ্রমের দর কষাকষির সেই হাতিয়ারকেই ছিনিয়ে নিচ্ছে যাকে ধরে সে বাড়িয়ে নেয় নিজের শ্রেণির দরকষাকষির ক্ষমতা। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা তার শতবার্ষিকীর প্রধান বার্তাই “লেবার গ্যারান্টিস” হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তার সদস্য দেশগুলোর কাছে সে আবেদন রেখেছে, শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, তাদের স্বার্থবাহী মজবুত আইন, সামাজিক সুরক্ষা, শোভন কাজ, কর্মস্থলে নিরাপত্তা -- এক কথায় হিউমান সেন্ট্রিক বা মানবতা কেন্দ্রীক নীতি গুলো কে সামনে আনতে। কোভিড-১৯ উত্তর পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী মানুষের উপর নেমে আসা অশেষ যন্ত্রণা ও বিপর্যয় নিরসনে ত্রিপাক্ষিক ফোরামগুলোকে মজবুত বানানো, শ্রম ও শ্রমিকদের বুনিয়াদি গণতন্ত্রকে আরও উন্নত করার নীতি ঘোষণা করেছে আইএলও।

এটা এক নির্মম সত্য, যে ভারতের বিপুল বিশাল শ্রমজীবী মানুষ কোনো ধরনের শ্রম আইনের আওতায় আসেন না। ২০১৮-১৯-এর আর্থিক সমীক্ষাই জানিয়েছে, দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমশক্তি ইনফর্মাল। অ্যানুয়াল সার্ভে অফ ইন্ডাস্ট্রিজ (এএসআই)-এর সমীক্ষা দেখিয়েছে আমাদের দেশে মজুরির বৃদ্ধি বা ওয়েজ গ্রোথ ক্রমেই নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। ২০০১-০৫-এ যা ছিল ৪ শতাংশ, ২০১১-১৫-তে তা হয় ১১.৭ শতাংশ কিন্তু, ২০১৬-১৮-তে তা কমে দাঁড়ায় ৬.৫ শতাংশ হারে। এএসআই-এর তথ্য এটাও দেখিয়েছে, ২০১৭-১৮-র জিডিপিতে সংগঠিত সেক্টারের মুনাফার অংশ ছিল ৪.৪০ শতাংশ, কিন্তু জিডিপি-তে মজুরির অংশ ছিল মাত্র ১.৩০ শতাংশ। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, যত উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ততো কমেছে শ্রমিকদের মজুরি। এটা শুধু ভারতের নয়, এটা নব্য উদারবাদী অর্থনীতির বিশ্বব্যাপী প্রবণতা। বিগত কয়েক দশক ধরে এই নব্য উদারবাদী অর্থনীতি গড়ে তুলেছে ৬ কোটি ১ লক্ষ কাজ, যার ৯২ শতাংশই ইনফর্মাল। সমস্ত শ্রমকানুন যাদের কাছে মরীচিকা মাত্র। বিশ্ব জুড়েই দেখা গেছে, জিডিপি বৃদ্ধির সাথে মজুরি বৃদ্ধির কোনো সম্পর্কই থাকছে না। আইএলও দেখিয়েছে, শ্রমের উৎপাদনশীলতার সাথে (লেবার প্রডাক্টিভিটি) মজুরি সমানুপাতিক হারে না বাড়ায় জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে মজুরির অংশটা ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে, আর বহু দেশে তা এমনকি ১৯৯০-এর আগের পর্বকাল থেকেও কমেছে। এই বৃদ্ধিকে “মজুরি হীন বৃদ্ধি” বা ওয়েজলেস গ্রোথ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে আই এল ও। ভারতের শ্রম আইন কিন্তু কোনদিনই ঠেকাতে পারলো না মজুরির এই চলমান ধ্বসকে।

crane

 

ঘটনা এটা নয় যে, ভারতে অর্থনীতি গড় গড় করে এগোচ্ছিল, আর কোভিড-১৯ এসে ছারখার করে দিল সেই সাজানো বাগানকে। অতিমারীর আগে গোটা দেশটাই এক নাছোড় মন্দার কবলে পড়েছিল। সমস্ত ক্ষেত্রে আর্থিক শ্লথগতি, মুখ থুবড়ে পড়া উৎপাদন শিল্প, ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব, কৃষি ক্ষেত্রে বিরাট সংকট, রেকর্ড মাত্রায় বিদেশী পুঁজির পলায়ন (গত বছরে ১ থেকে ৪ অক্টোবর মূলধনী বাজার থেকে রেকর্ড মাত্রায় ৩, ৯২৪ কোটি টাকার বিদেশি পুঁজি দেশান্তরী হয়), ইয়েস ব্যাঙ্কের পতন, বিপুল অনাদায়ী ঋণের ভারে ঝুঁকে পড়া ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক, – দেশের অর্থনীতির নাভিশ্বাস উঠেছিল। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না থাকাই ছিল এই আর্থিক সংকটের প্রধানতম কারণ, দেশের শ্রম আইনের কড়াকড়ি নয়। কোভিড-১৯ সেই মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিল। সেই সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অর্থমন্ত্রী শিল্প মহলের জন্য ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন। কিন্তু তাতেও মরা গাঙে বান এলো না। ভারতের শ্রম আইনে কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের অবাধ নিয়োগকে নিয়ন্ত্রিত করার আইন থাকলেও সব কিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিনের পর দিন সরকারী-রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোতে হু হু করে বেড়েছে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক। ছাঁটাই বা লকআউটের বিধি নিষেধ থাকলেও গোটা দেশে ধর্মঘট নয়, বেআইনি লকআউট-ই হয়ে উঠেছে সারা দেশের প্রধান ধারা।

আজকের এই অতিমারী সৃষ্ট গণস্বাস্থ্য সংকট আর্থিক সংকটের পাশাপাশি নির্দয়ভাবে সামনে তুলে ধরলো এক বিরাট মানবিক সংকটকে। আমরা লকডাউনের হাত ধরে দেখলাম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক ট্রাজেডি। আমরা দেখলাম, জাতীয় বিপর্যয় আইন কিভাবে কেড়ে নিল শ্রমিকদের নিজ ঘরে ফেরার একান্ত মৌলিক গণতান্ত্রিক আইনকে। তাঁদের পর্যাপ্ত খাদ্য, বকেয়া মজুরি, পানীয় জল, আশ্রয় স্থল, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলো। অনাহারের জ্বালায়, চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখে লাখে লাখে পরিযায়ী শ্রমিক যখন মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরে ফেরা শুরু করলেন, তখন মালিকদের সংগঠন মাঠে নামলো তাঁদের প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে। সেই আর্থিক কর্মকান্ড শুরু করার তাগিদে। প্রথমে মালিকপক্ষ ঐ অসংগঠিত বিপুল শ্রমশক্তিকে পরিত্যাগ করলো সংগঠিত ও সচেতনভাবে, তারপর এখন সংগঠিত শ্রমশক্তির কাছ থেকে সব কিছু নিঙড়ে আদায় করতে খড়কুটোর মতো যে আইনগুলোকে তাঁরা এতোদিন আঁকড়ে ছিল, সেগুলোকেই ছিনিয়ে নিতে কোমর বেঁধে নামলো।

কোভিড ১৯ দেখালো, সব কিছু থেকে রাষ্ট্রের হাত গুটিয়ে নেওয়ার ফলে কি বিরাট মাশুল গুনতে হলো গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে, গোটা দুনিয়া জুড়ে। চোখে আঙ্গুল তুলে এটাও দেখালো, সব কিছুকে বিসর্জন দিয়ে অন্ধভাবে মুনাফার পেছনে ছোটার নির্মম পরিণতি। যখন নতুন করে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে বাড়াতে আবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর গুরুত্ব সামনে আসতে শুরু করলো তখন মোদী সরকার ফিরে গেল বেলাগাম বে সরকারীকরণ, বিরাষ্ট্রীকরণের। কয়লা, প্রতিরক্ষা তেল থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সমস্ত ক্ষেত্রগুলোর দরজাকে ব্যক্তি পুঁজির কাছে হাটখোলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থনীতিকে আরও গভীর সংকটের কানাগলিতে ফেলে দিল।

-- অতনু চক্রবর্তী

licc

 

package

ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? যদি কিছু মনে না করেন। হ্যাঁ,বলুন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় উত্তর দিলেন। সবাই ওকে মারিয়াম বলে ডাকছিল। খুবই ব্যস্ত। কর্পোরেট হাসপাতালে এধরনের কাজে যুক্ত সিস্টাররা *ফ্লোর ইনচার্জ* হিসাবে পরিচিত। বললেন, একটু দাঁড়ান, আমি আসছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে আমি অপেক্ষা করছি। ফিরে এসে বললেন, হ্যাঁ, বলুন। বললাম, দুটো কথা আছে। একটা কাজের, একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত। কয়েক দিনের যাতায়াতে আমার পরিচয়টা ওর কিছুটা জানা। প্রথমে কাজের কথাটা বলে নিই। আমার এক ঘনিষ্ঠ জনের হার্টের বাইপাস সার্জারি হবার জন্য ভর্তি হয়েছেন ১০ দিন হয়ে গেল। প্রতিদিনই তাঁর ব্লাড, ইউরিন টেস্ট হচ্ছে।রোজই সন্ধ্যায় দেখছি একই রিপোর্ট, ওর কি সেপ্টিসেমিয়া হয়েছে, নাকি কিডনি অকেজো হয়েছে? তাহলে প্রতিদিন টেষ্ট করছেন কেন? তাছাড়া আপনাদের প্যাকেজ অনুসারে ওর তো অপারেশন হয়ে বাড়ি চলে যাবার কথা। আসাম থেকে কমরেড এসেছেন, কলকাতার অত্যন্ত নামী হাসপাতালে দামী চিকিৎসকের আন্ডারে ভর্তি হয়েছেন।বাইপাস সার্জারির রিপোর্ট তো বলছে গ্লোবাল ব্লক। জরুরি অপারেশন করতে হবে। রোজই নখ কাটছে, দাড়ি কাটছে। ভাবখানা এমন যেন এখুনি অপারেশন হবে। এর কারণটা জানতে চাইছিলাম। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মারিয়াম বললেন, খোঁজ নিচ্ছি, আধ ঘণ্টা পরে জানিয়ে দেব। আমি চলে আসার উদ্যোগ নিতেই বললেন, আর একটা ব্যক্তিগত কথা কি বলবেন বলছিলেন না। রাগ করবেন না, বলুন। এবার ঐ অব্যক্ত বেদনার কাহিনী নিয়ে কথা শুরু হল। আচ্ছা, আজ সকাল ৭-১০ মিনিটে আপনার সঙ্গে আমার গুড মর্ণিং বিনিময় হলো, আর এখন বাজে সন্ধ্যা ৭-২৫/২৭। আপনাদের ডিউটি আওয়ার্স কতক্ষণ? মারিয়াম এমনিতেই নীচু স্বরে কথা বলেন, হঠাৎ গলার স্বর আরও নীচু হয়ে গেল, কিছুটা বাকরুদ্ধ হলে যেমন হয়। বললেন, এর কোনো সময়সীমা নেই। আমাদের নিয়ে আসার জন্য সকাল ৬-৩০ টায় মধ্যে হাসপাতালের বাস চলে আসে। ৫ মিনিট দেরি হলেই বাস ছেড়ে চলে যাবে। সকাল ৬-৪৫/৫০ মিনিটে রিপোর্টিং, সকাল ৭ টায় জয়েনিং। আর বিকাল বেলা ফিরিয়ে নিয়ে যাবার বাস প্রতিদিন দেরিতে আসবে। বাস না আসলে পরের ব্যাচকে চার্জ হ্যান্ড ওভার না করে তো যাওয়া যাবে না। মারিয়াম কেরলের মেয়ে। যত বলছিলেন তত গলার স্বর নীচে নামছিল। জিজ্ঞেস করলাম, কেন আপনাদের এ্যাসোসিয়েশন বা ইউনিয়ন নেই? বললেন, একবার আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিছুটা জানাজানি হতেই চাকুরি থেকে বরখাস্ত করার হুমকি এসেছিল। বন্ডেড লেবার তো আমরা। আমরা কেরলের জনা ৫০/৫২, ওড়িশার ১৪/১৫, উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৮/১০ জন। সবাই অবশ্য একই স্টেজে নেই। কেউ কেউ ট্রেনি। যেমন আপনাদের ইন্টার্নশিপ। ওরা চলে যেতে চায়। কেউ কেউ চলে গেছেন, যেমন মনিপুরের বোনেরা। সব মিলিয়ে ১৮৫ জন। ত্রাহি ত্রাহি রব। কেউ কেউ ভয় দেখাচ্ছেন, “বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের” অমুক ধারা, তমুক ধারা প্রয়োগ করা হোক, কেউ কেউ‌ নীতি আদর্শের কথা তুলছেন, “চিপ পলিটিক্স"। রোজই এরা টিভির পর্দায় নীতি আদর্শের জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। আমরা শুনি ও তারিফ করি!

কোনো নীতিআদর্শবান কর্মকর্তা বা চিকিৎসক বন্ধু কি ওদের সাথে কথা বলেছেন একবারও। কেন ওরা এই নিম্ন আয়ের মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তি চায়। একবারও কেউ কি আবাসন নামের যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ওদের থাকতে হয়, দেখে এসেছেন? সময় কোথায়? ততক্ষণে দুটো এ্যঞ্জিওপ্লাস্টি হয়ে যাবে ? বিজ্ঞাপনে থাকবে ৮-১০ হাজার টাকায় সুলভ চিকিৎসা! বাড়ি ফেরার সময় ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। নীতিবানরা একবারও কেউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কে জিজ্ঞেস করেছেন এত ফারাক কেন?

nur

 

মারিয়াম খুব অস্হির হয়ে উঠলেন, “আপনার কাজের কথায় কোনো খোঁজ নেওয়া হলো না”! এবার আমার মুখের রং-টা আরেকটু কালো হলো। সত্যিই তো কোনটা কাজের কথা! মারিয়াম দের প্রতিদিনের জীবন কিভাবে কাটে সেটা জানাটা কাজের কথা নয়? আমি একটু লজ্জায় পড়ে বললাম, ঠিক ‌আছে, অপারেশনে জটিলতা ঠিক কোথায়, আগামীকাল বললেও চলবে। মারিয়ামের উত্তর, “তাতো কাজে অবহেলা হয়ে যাবে” ! একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। গল্প করে অনেকটা সময় চলে গেছে। তাছাড়া আমার তো ডিউটি শেষ হয়ে গেছে। ফেরার পথে একবার নীচে গিয়ে খোঁজ নিয়ে বলব। কাল আবার দেখা হবে। দুজন থাকলে কফি খাওয়াব। দুজনের বেশি গেষ্টকে কফি খাওয়ানোর অনুমতি নেই। মারিয়াম খোঁজ দিয়ে ফেরার বাসে উঠে পড়লো, শুধু বলে গেল অনেক বড় যুদ্ধ করতে হবে।

এবার সেই প্যাকেজের গল্প। কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানলাম, “রেড চাকতি” আসেনি। আপনার পেশেন্টের আবার এঞ্জিওগ্রাম করতে হবে, ২৫০০০ টাকা দ্রুত জমা দিন। একটু উত্তেজিত ভাবে বলেছিলাম, আমার পকেটে সাড়ে পাঁচ টাকা আছে। আচ্ছা, বলুন তো নতুন করে এঞ্জিওগ্রাম করার এ্যাডভাইসটা কে করেছেন? কেন? ডাক্তারবাবু। তিনিও একজন নামী ডাক্তার। ডঃ দেবী শেঠি। সত্যিই তিনি করতে বলেছেন? আর ইউ সিওর? কতবার। এক কথা বলব, উত্তর ভেসে এলো। ও তাই। ঠিক আছে ডঃ শেঠির সাথে একটু বলে টাকাটা জমা দিয়ে দেব। রাত তখন ১২-১০ ডঃ দেবি শেঠি অপারেশন থিয়েটার থেকে নেমে এমার্জেন্সি আউট ডোরে ঢুকালেন। আমার ছোট্ট একটা জিজ্ঞাসা ছিল, কার্ডিও থোরাসিক সার্জেন এঞ্জিওগ্রাম প্রেসক্রাইব করেছেন কিনা? ডঃ শেঠি নম্রভাবেই একটু অপেক্ষা করতে বললেন। একজন মা তাঁর এক ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন, বাচ্চাটার হার্টের ৪টি ভালভই খারাপ। ফ্যালট’স টেট্রোলজি। তিনি আবার ট্যাক্সি করে হাওড়া ফিরবেন। তাঁর দেখানো শেষ হতেই, চেম্বারে আমার প্রবেশ। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে প্রশ্ন। আপনি আমার পেশেন্টের আবার এঞ্জিওগ্রাম করতে বলেছেন। প্রেসক্রিপশন কোথায়? আমি! আমি বলেছি এঞ্জিওগ্রাম করার কথা? “এ হাসপাতাল ছেড়ে না দিলে মান ইজ্জত কিছুই থাকবে না”। বিড়লা কর্পোরেট হাউস পরিচালিত ক্যালকাটা হার্টের কথা বলছি।

তারপর সিস্টেম ম্যানেজার, ফ্লোর ম্যানেজার হয়ে ফাইন্যান্স অফিসার হয়ে যুদ্ধ থামলো। পরের দিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে অপারেশন শুরু হলো। পেশেন্ট এখন সুস্থ। দায় দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন।

নির্মলা সীতারামনের প্যাকেজের গল্প শুনতে শুনতে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিক যেমন ক্লান্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। মারিয়মরাও তেমনই আ‌স্থাহীন ও বিরক্ত। ওরাও তো নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে লেখা পড়া শিখে নার্সিং কাজে দুবাই বা সিঙ্গাপুর চলে যায়, কেউবা বাংলা, ব্যাঙ্গালুরু বা দিল্লীতে। কারও থেকে ওদের নীতি আদর্শ দায়িত্ববোধ কম নয়। ওরা রাত জাগে আর্ত রোগীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে। ওরা লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প। কখনো ঐ ঝাড়ুদার, সাফাই কর্মী, ঐ অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, প্যাথ ল্যাবের বন্ধুদের সাথে কথা বলেছেন কোভিড ১৯ মোকাবিলায় তাঁদের কি মতামত ও অভিজ্ঞতা হলো? এঁদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ছাড়া করোনা মোকাবিলা মুখ থুবড়ে পড়বে। কথা বলুন, মতামত নিন। কারো থেকে ওদের নীতি আদর্শ কম নয়। হুমকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, গালাগালি দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলবেন না।

-- পার্থ ঘোষ

eart

 

env

সার্বিক ভাবে ভারতবর্ষে EIA (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট)-এর আইন আসে ১৯৯৪ সাল নাগাদ যার প্রেক্ষাপটে ছিল ভারতবর্ষের ১৯৮৬ সালের এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন অ্যাক্ট বা পরিবেশ সুরক্ষা আইন এবং ১৯৯২-এ ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত আর্থ সামিট এর রিও ঘোষণাপত্র। ১৯৯৪ এর সেই নোটিফিকেশন পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয় ২০০৬ সালে যা আরও কিছু সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এতদিন কার্যকরী ছিল। এই নোটিফিকেশন অনুযায়ী শিডিউল-১ এ অন্তর্ভুক্ত যেকোনো নতুন শিল্প বা প্রকল্প শুরু করতে গেলে বা চালু প্রকল্পের মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে গেলে অথবা প্রকল্পের বিস্তার বা আধুনিকীকরণের জন্য এমনকি উৎপাদিত পণ্যে কোনো বদল হলেও প্রয়োজনীয় পরিবেশগত ছাড়পত্রের (এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স) জন্য EIA আবশ্যিক। এর মূল উদ্দেশ্য প্রকল্প শুরুর আগেই তার কী কী প্রভাব পরিবেশের উপরে পড়তে পারে তা আগে থেকে যাচাই করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। প্রকল্পগুলিকে (খনি, বাঁধ, বিদ্যুৎ, সেচ, নির্মাণ, সিমেন্ট, ধাতু শিল্প, নদী উপত্যকার প্রকল্প, সড়ক, পরিকাঠামো ইত্যাদি) আকার, আয়তন ও পরিবেশগত প্রভাবের মাত্রা অনুযায়ী শ্রেণীভুক্ত করা হয় এ, বি (বি-১ ও বি-২) ভাগে। সমস্ত পরিবেশ সম্বন্ধীয় খুঁটি নাটি মাথায় রেখে নির্দিষ্ট টার্মস অফ রেফারেন্স (TOR) অনুযায়ী জৈবিক, রাসায়নিক, আর্থ-সামাজিক বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সমীক্ষার পরে রিপোর্টটি প্রকল্পের শ্রেণী অনুযায়ী নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ (কেন্দ্রীয় বা রাজ্য স্তরে)-এর কাছে মূল্যায়নের জন্য জমা পরে এবং বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়া গেলে প্রকল্পটি চালু হতে পারে। ২০১৬ সালে মাইনর মিনারেলের বি-২ শ্রেণীর প্রকল্পগুলির ছাড়পত্রের জন্য জেলা স্তরেও রেগুলেটারি বডি তৈরি করা হয়। এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট এর বিভিন্ন ধাপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল স্ক্রিনিং, স্কোপিং, পাবলিক কন্সাল্টেশন ও এপ্রেইজাল। এই EIA প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল বুনিয়াদি স্তরে যারা প্রকল্পটির দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হতে পারে তাঁদের মতামত।

forest

 

বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারী চলাকালীন বেশির ভাগ দেশ যখন নিজেদের সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে কিভাবে এই বিপদ থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাওয়া যায়, তখন আমাদের দেশের সরকারের হাল হকিকত অন্য কথাই বলছে। লকডাউনের সুযোগ নিয়ে বেনজির উদাহরন পেশ করে চলেছে মোদী সরকার। কখনো এই সংবেদনশীল পরিস্থিতিতেও একের পর এক গণআন্দোলনের নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তার করে কালা কানুন আরোপ করা হচ্ছে কখনো চুপিসারে পেশ হয়ে যাচ্ছে একাধিক জনবিরোধী আইন। শ্রম আইন সংশোধন, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিল লঘু করা যার অন্যতম উদাহরণ। এই তালিকাতেই আরেকটি সংযোজন EIA ২০২০-এর খসড়া প্রতিবেদন। ১২ মার্চ ঠিক লকডাউন চালু হওয়ার দোরগোড়ায় এই খসড়াটি কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক নিয়ে আসে, ২৩ মার্চ এই বিজ্ঞপ্তি ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হয়। নজিরবিহীনভাবে এই লকডাউনের সময়ে সাধারন মানুষকে মাত্র ৬০ দিন সময় দেওয়া হয় এর কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার করার জন্য। ব্যাপক বিরোধিতা ও সমালোচনার মধ্যে পড়ায় পরিবেশ মন্ত্রক গত সপ্তাহে সেই সময়সীমা বাড়িয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত করেছে। এই খসড়া বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার সাথে সাথে শোরগোল পরে যায় দেশের পরিবেশ আইন, অধিকার ও আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবেশ কর্মীদের মধ্যে। বিস্তারিতভাবে এই খসড়া অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে এটি শুধু পরিবেশ বা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ বিরোধীই নয়, দেশের জনগণকে এই পুরো প্রক্রিয়া থেকে বাদ রাখার এক চক্রান্ত। আসুন দেখে নেওয়া যাক কেন এই খসড়া বিজ্ঞপ্তি বাতিল করার দাবি তুলছেন পরিবেশকর্মীরা।

অবৈধ শিল্পকে বৈধতা প্রদান

‘ইস অফ ডুইং বিজনেস’ এর নামে বস্তুত একের পর এক অবৈধ কার্যকলাপকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০২০-এর খসড়ায়। উপযুক্ত পরিবেশগত ছাড়পত্র (এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স) ছাড়াই চালু করে দেওয়া শিল্প বা প্রকল্পগুলি এবং যারা এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্সে নির্দিষ্ট করে দেওয়া নিয়ম ভেঙ্গেছে, এমন সমস্ত শিল্প এতদিন EIA আইন ভায়োলেশন (violation) বা লঙ্ঘনের অধীনে পড়তো, যার ফলে তাদের মোটা অঙ্কের জরিমানা, ক্লিয়ারেন্স বাতিল সহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হত। এই নতুন খসড়ায় এই ‘ভায়োলেশন’কে একপ্রকার আইনি বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ngt

 

ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইব্যুনাল (NGT) ২০১৬ সালে ৩০০টির ও বেশি রাসায়নিক ও অন্যান্য শিল্প (যার মধ্যে ২৩ টি গুজরাতের)-র ছাড়পত্র বাতিল করে কারখানা বন্ধ ও জরিমানার নির্দেশ দেয় কারণ এই প্রত্যেকটি কারখানাই ২০০২ সালে পরিবেশ মন্ত্রক থেকে ‘পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল’ বা উৎপাদন চালু করে দেওয়ার পরে আবেদন করে পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছিল। এই ‘এক্স পোস্ট ফ্যাক্টো’ প্রক্রিয়াকে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে সরাসরি এক প্রহসন হিসেবে আখ্যা দেয়। এই বছরে পয়লা এপ্রিল সুপ্রীম কোর্টও গুজরাটের তিনটি শিল্প প্রকল্পের ‘পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল’ কে অবৈধ ঘোষণা করে বলে, “উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবসময়েই পরিবেশগত যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা প্রয়োজন। সমাজ ও পরিবেশের উপরে শিল্পের প্রভাব মূল্যায়ন ও পরিবেশ আইনের সাথে সাযুজ্য রেখে চলাকে উন্নয়নের পরিপন্থী হিসেবে নয় বরং দেখা উচিত স্থিতিশীল উন্নয়ন, সাম্য ও ন্যায়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা হিসেবে”। অথচ NGT ও সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত রায়কে উড়িয়ে দিয়ে EIA-এর নতুন খসড়ায় এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স নর্ম লঙ্ঘন করা অর্থাৎ ছাড়পত্র ছাড়াই নির্মাণ কাজ বা শিল্প প্রকল্প চালু করা অথবা শিল্পের সম্প্রসারণ করা সমস্ত প্রকল্পগুলিকে ‘পোস্ট ফ্যাক্টো ক্লিয়ারেন্স’-এর জন্য সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ আইনের সাথে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে পরিবেশ মন্ত্রক প্রথমে ২০০২ সালে ও তারপরে ২০১৭ সালে ‘শেষ বারের মতো’ এই পোস্ট ফ্যাক্টো ক্লিয়ারেন্সের অনুমোদন দেওয়ার কথা বলেছিল। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শেষ বার তো দূর, ২০২০-র খসড়ায় পাকাপাকি ভাবে এই বেআইনি প্রকল্পগুলোকে পেছনের দরজা দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পরিবেশ আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাজ শুরু করে দাও, প্রাকৃতিক সম্পদের বেলাগাম শোষণ চালাও, আর পরে টুক করে ‘পরিবেশগত ক্ষতি’র তুল্যমূল্য দেড় থেকে দু’গুণ জরিমানা দিয়ে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে নাও। আর সেই হিসেবেও যে বিস্তর জল মেশানো হবে তা তো সহজেই অনুমেয়। এটাই হতে চলেছে নতুন কানুন!

ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের মতামতকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার চক্রান্ত

পরিবেশগত ছাড়পত্রের ক্ষেত্রে পাবলিক কনসাল্টেশন একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যেখানে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি যে মানুষদের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে, প্রকল্প চালুর আগে অন্তিম সিদ্ধান্ত নেওয়া ও নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে তাঁদের মতামত এবং পাবলিক হেয়ারিং এই দুটি নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। এর আগেও কিছু প্রকল্পকে পাবলিক কনসাল্টেশন এর আওতা থেকে বাদ রাখা হয়েছিল, এবার সেই তালিকাকে আরও লম্বা করে বস্তুত সাধারণ মানুষের অংশীদারিত্বের পুরো প্রক্রিয়াটাকেই লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে সেচ প্রকল্পগুলির আধুনিকীকরণ, সমস্ত আবাসন, নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প, অন্তর্দেশীয় জলপথ, জাতীয় সড়কের এর সম্প্রসারণ ও প্রসার, সীমান্ত এলাকার (সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার অব্দি) জাতীয় সড়ক ও পাইপ লাইন, ১২ নটিক্যাল মাইলের পরে সব অফ শোর প্রকল্প এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা, সুরক্ষা ও কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত যেকোনো ‘স্ট্র্যাটেজিক প্রোজেক্ট’। শেষেরগুলির ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হলেও কোনো তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত হবে না!

eis

 

নতুন খসড়ায় ‘স্ট্র্যাটেজিক প্রোজেক্ট’এর মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করে সরকারের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হল নিজের মর্জিমতো যেকোনো প্রকল্পকে (তা সে সেচ, বিদ্যুৎ, খনি যাই হোক না কেন) ‘স্ট্র্যাটেজিক প্রোজেক্ট’ তকমা লাগিয়ে স্থানীয় মানুষের মতামত অগ্রাহ্য করে পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়ার।

এমনিতেও বর্তমানে পাবলিক কনসাল্টেশন প্রক্রিয়াটি পরিকাঠামোর অভাবের কারণে ও বেশিরভাগ তথ্য সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকায় যথেষ্ট অসংগতিপূর্ণ। একে শক্তিশালী করে অংশীদারিত্বমূলক গনতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করবার বদলে প্রক্রিয়াটিকে আরও শিথিল করে প্রকল্প সম্পর্কে জনগনের মতামত জমা করবার সময় ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ২০ দিন এবং পাবলিক হেয়ারিং এর সময়সীমা ৪৫ থেকে কমিয়ে ৪০ দিন করে দেওয়া হল।

প্রকল্পগুলির শ্রেণীবিভাজন শিথিল করে EIA বাইপাস করবার পরিকল্পনা

কিছু প্রকল্প যেমন ২০০০-১০০০০ সিসিএ সেচ প্রকল্প, নির্দিষ্ট আয়তনের নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি যেগুলো আগে ক্যাটেগরি এ বা বি-১ হিসেবে চিহ্নিত ছিল, নতুন খসড়ায় সেগুলোকে ক্যাটেগরি বি-২ এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অর্থাৎ এই প্রকল্পগুলোর পরিবেশগত প্রভাব খতিয়ে না দেখে, কোন বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যবেক্ষণ ছাড়াই সরাসরি অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হবে। এই নতুন খসড়া আসলে দেশের আবাসন ও নির্মাণ প্রকল্পের কর্পোরেট খেলোয়ারদের কাছে সরকারের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ। মোদী সরকারের আমলে ২০১৬ সালেই সংশোধনী এনে ২০০০০-১৫০০০০ বর্গ মিটার নির্মাণ প্রকল্পগুলিকে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই কাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যা পরে NGT-র হস্তক্ষেপে স্থগিত হয়। ২০২০ র খসড়ায় আইন করে কর্পোরেট নির্মাণ ব্যবসায়ীদের সমস্ত ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্ত করে ছাড় দিয়ে দেওয়া হল ইচ্ছেমত কাজ আর ইচ্ছেমতো মুনাফা করার।

এছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের সংজ্ঞার পরিবর্তন করে প্রকল্পগুলিকে EIA-এর আওতা থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। যেমন ২০০৬ এ ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ এর মধ্যে সমুদ্র ও নদীতল ড্রেজিং উভয়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল, অথচ নতুন বিজ্ঞপ্তিতে কেবল সমুদ্র বন্দর বানানোর জন্য ড্রেজিংকে রেখে নদীর বুকে এ ধরনের কার্যকলাপকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

rad

মনিটরিং ও কমপ্লায়েন্স-এর প্রতি ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা

পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়ার পরে এতদিন প্রকল্পের মালিকদের প্রতি ছয় মাস অন্তর কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট জমা দিতে হত যেখানে দেখা হত পরিবেশগত ছাড়পত্রে নির্দিষ্ট করে দেওয়া শর্ত ও বিধি মেনে চলা হচ্ছে কিনা। সেই নিয়ম বদলে ছ-মাসের বদলে প্রতি এক বছরে দিতে হবে কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট। এই একবছর সময়কালে প্রকল্পটির কারণে যেকোনো পরিবেশগত, সামাজিক, স্বাস্থ্যগত, দূষণজনিত পরিবর্তন ঘটলে, পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং এর অভাবে তা উপেক্ষিত থেকে যাবে, যার ফল পরিবেশের জন্য সুদূরপ্রসারী ও অপরিবর্তনীয় হতে পারে; এর ক্ষতিপূরণ কোনোভাবেই খসড়ায় উল্লেখিত জরিমানা দিয়ে করা সম্ভব নয়। তাছাড়াও এই কমপ্লায়েন্স রিপোর্টটি স্ব-ঘোষিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জমা হয়, ফলে সেখানেও তথ্য গোপনের প্রভূত উদাহরণ দেখা গেছে। এই সমস্যা দূর করাতো দূর অস্ত, উলটে প্রস্তাবিত খসড়ায় প্রক্রিয়াটিকেই আরো দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্তপূরণের প্রতি মনযোগী হওয়ার বদলে কর্পোরেট হাউজগুলির নিজেদের দেওয়া হলফনামার উপরে বেশী নির্ভরশীল এই নয়া EIA বিজ্ঞপ্তি আদতে পরিবেশ বিধির মূলে কুঠারাঘাত করছে।  এমনকি এর আগে কোনো খনন প্রকল্পের পরিবেশ ছাড়পত্রের সর্বোচ্চ মেয়াদ যেখানে ছিল ৩০ বছর তা বাড়িয়ে ৫০ বছর করে দেওয়া হয়েছে।

পরিবেশ সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইনক্লুসিভ মডেলের প্রয়োজন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বনবাসী, কৃষক, মৎসজীবি, মহিলা সহ সমস্ত প্রান্তিক মানুষেরা যেখানে গুরুত্ব পাবেন। অথচ বাস্তবে বারবার ‘উন্নয়নের’ নামে এদেরকেই জল জঙ্গল জমি থেকে উৎখাত করা হয়ে চলেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ও সামাজিক নীতিতে এই অংশের মানুষদের স্থান সবচেয়ে নীচের স্তরে। প্রস্তাবিত EIA নোটিফিকেশনটিতেও পরিবেশ ও পরিবেশ সম্পৃক্ত মানব গোষ্ঠী গৌণ বিষয়, লক্ষ্য আসলে দেশেরপ্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদকে কর্পোরেট স্বার্থে বিনা বাধায় ব্যবহার করে যাওয়া।

আসুন এই পরিবেশ বিরোধী, জন বিরোধী EIA নোটিফিকেশন বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হই। আপনার বিরোধিতা জানিয়ে কেন্দ্র সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকে মেল করুন eia2020-moefcc@gov.in এই ঠিকানায়।

-- মধুরিমা

pacpack

কোভিড-১৯ অতিমারী আক্রান্ত অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য যে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ও পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল তা গত ১৭মে শেষ হয়েছে। একই সাথে ওইদিন লকডাউনের চতুর্থ পর্যায় শুরু হল, ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে। মোদিজী বলেছিলেন, ৪র্থ পর্যায়ের লকডাউন অন্যরকম হবে। তাঁর কথার মর্যাদা রাখতে এবারে সন্ধে ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফু জারি করা হল। গত ৫৪ দিনে রাতে যা ঘটেনি আগামী ১৪ দিনে তেমন কী ঘটবে যার জন্য ১২ ঘণ্টা কারফু তার ব্যাখ্যা অবশ্য দেওয়া হয়নি। তবে সম্রাটরা প্রজাদের অত ব্যখ্যা দেন না।

গত ৩টি পর্যায়ের লকডাউন ও তার থেকে উদ্ভুত অর্থনীতি ও সেই অর্থনীতি সংক্রান্ত ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ নিয়ে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, সেই প্রশ্নগুলিকে উত্থাপন করে নিজেই তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।

pag

 

প্রশ্ন: ২০,০০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজে কী কী অন্তর্ভুক্ত হযেছে?

প্রথমত, মনে রাখতে হবে যে আর্থিক সুরাহার ঘোষণা, আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তা লকডাউন ঘোষণার ২ দিন পর থেকে শুরু হওয়া সমস্ত সরকারি রাজস্ব ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃক গৃহীত অর্থ ব্যবস্থা (মানিটারি) বন্দোবস্তের সমাহার। এর মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৮০০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক সহায়তার মাধ্যমে অর্থনীতিতে নগদ সরবরাহের প্রকল্প আছে যার জন্য সরকারের কোন খরচ কখনো হবে না। এর পাশাপাশি এর মধ্যে ২৬ মার্চ ঘোষিত সরকারের বাজেট অন্তর্ভুক্ত বা নির্মাণ কর্মী তহবিল বা জেলা খনিজ তহবিলের  সর্বমোট প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে, ফলে ওই সময়ে ঘোষিত ১৯৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কেবল ১১৫ হাজার কোটি টাকাকে আর্থিক সুরাহার জন্য ধরা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণায় যা জানা গেছে তাতে ওই টাকাও পুরো খরচ হয়নি।

দ্বিতীয়ত, ১৩ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ধারাবাহিক ঘোষণায় যে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে তার পরিমাণ তিনি বলেছেন, ১১০৩ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারের ঘর থেকে জনসাধারণের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা (এমএসএমইদের জন্য তহবিল সংক্রান্ত ১৪ হাজার কোটি, ইপিএফ-এর জন্য ২, ৫০০ কোটি, পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য শস্যের জন্য ৩, ৫০০ কোটি ও ১০০ দিনের কাজের জন্য ৪০ হাজার কোটি)। মনে রাখা দরকার, আগেই বলা হয়েছে, ১০০ দিনের কাজের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কেবল নিয়মতান্ত্রিকতা, কাজ চাইলে আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার দিতে বাধ্য। বাকি ১০৪৩ হাজার কোটি টাকার সবটাই হয় বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত বরাদ্দ যা কাজ শুরু করলেও কয়েক বছর লাগবে, এবং অধিকাংশ বিভিন্ন ঋণদানের অনুমিত পরিমাণ। এছাড়া, উৎসমূলে কর কাটাতে ছাড় যা সমস্ত করদাতাকেই বছর শেষে মেটাতে হবে (পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি) বা কর্মচারির ইপিএফ না দেওযার সুবিধে, সেই কর্মীর নিজের টাকা ও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় এবং নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রদেয় সমপরিমাণ টাকা (মোট ৬, ৭৫০ কোটি) এগুলিকেও অর্থমন্ত্রী আপন মনে করে প্যাকেজে ঢুকিয়েছেন।

প্রশ্ন:  তাহলে সব মিলিয়ে কত কোটি টাকা রাজকোষ থেকে সরকার দিযেছে বা দিচ্ছে কোভিড ১৯ এ অভাবীদের সাহায্যে? তা জিডিপির কত শতাংশ?

উপরের হিসেব অনুযায়ী ১৭৫ হাজার কোটি টাকা। যদি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিযা রিসার্চের হিসেবকে ধরা হয়, তাহলে পরিমাণটা দাঁড়াবে ২০৩ হাজার কোটি টাকা। বার্কলে রিসার্চের হিসেবকে অনুসরণ করলে অর্থমন্ত্রী নুতন রাজকোষ থেকে সাহায্যের ঘোষণা করেছেন ১৫০ হাজার কোটি টাকা, তার সঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্কের হিসেবে অন্তর্ভুক্ত গরিব কল্যাণ যোজনার ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ জুড়লে হবে ২২৩ হাজার কোটি টাকা। আর্নস্ট ইয়ঙ-এর হিসেবে নুতন বরাদ্দ ১২৩ হাজার কোটি টাকা, তার সঙ্গে ওই ৭৩ হাজার কোটি টাকা জুড়লে দাঁড়ায় ১৯৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে সর্বোচ্চ পরিমাণটি ২২৩ হাজার কোটি টাকা, ২০০০ হাজার কোটি টাকার ১১% মাত্র বা জিডিপির ১.১% র কম। যদিও মোদিজী বলেছিলেন যে, প্যাকেজটি হবে জিডিপির ১০%।

প্রশ্ন: হিসেবগুলির মধ্যে এত তফাত কেন?

কারণ ঠিক কত টাকা এক্ষুণি বা এই বছরে সরকার খরচ করবে বিভিন্ন প্রকল্পে তার কোনো নির্দিষ্ট হিসেব নেই। যেসব পরিকাঠামো হয়তো বছরের পর বছর ধরে তৈরি হবে যেমন কৃষি পরিকাঠামো, তার পুরোটাকেই তো প্যাকেজের মধ্যে ধরা হচ্ছে, বা যে ঋণের ক্ষেত্রে সরকার সুদে ভরতুকি দেবে, যদি ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে পারে, সেই ঋণের সুদে ভরতুকির অঙ্কটাই কেবল সরকারকে দিতে হবে। যেমন এমএসএমইকে ৩ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের টপআপের কথা বলা হয়েছে। সেটাতো তারা নিতেও পারে নাও নিতে পারে। নিলেো সরকার কেবল ঋণ পরিসোধ সংক্রান্ত গ্যারান্টি দেবে ব্যাঙ্কগুলিকে। ফলে সরকারের কোনো খরচ নেই, কিন্তু সরকার পুরো ৩ লক্ষ টাকাই প্যাকেজে ঢুকিয়ে দিযেছে। এই সবভরতুকি বা ছাড় সংক্রান্ত হিসেব বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে করেছে।

migrant

 

প্রশ্ন: মাইগ্রান্ট লেবার বা পরিযায়ী শ্রমিকদের অভাবনীয় কষ্ট পুরো লকডাউন জুড়ে দেখা যাচ্ছে, তারা ঘরে ফেরার পরেও কাজ থাকবে না। ওই শ্রমিকদের ব্যাপারে কোনো বিশেষ ব্যয় আছে?

হ্যাঁ আছে, তবে তা ওই শ্রমিকদের কতটা তাচ্ছিল্য করা হয় তার প্রমাণ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন কত মাইগ্রান্ট শ্রমিক আছে সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। রাজ্যগুলি থেকে প্রাপ্ত হিসেব অনুসারে ৮ কোটি আছে। তাদের জন্য দুমাসের খাদ্য শস্য বরাদ্দ করা হয়েছে, যার জন্য আর্থিক বরাদ্দ ৩.৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে মাথাপিছু ২১৮ টাকা ৭৫ পয়সা।

এছাড়া, ওইসব শ্রমিকদের জন্য ভবিষ্যতে সস্তা ভাড়ায় বাস্থানের জন্য ভেবেছেন তিনি। যখন তাঁরা বাড়ি ফিরতে চাইছেন, তখন বাসস্থানের কথা ভাবা হচ্ছে যেখান থেকে তাঁরা চলে যেতে চাইছেন সেখানে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পরিবহণের সুচারু বন্দোবস্ত করা যখন প্রয়োজনীয় তখন সরকার তাদের বাসস্থানের কথা বলছেন। ৮ কোটি শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে নিজেদের বাসস্থানে ফেরাতে যে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচা হত সেটি করতে কোনো উদ্যোগ নিতে সরকারকে দেখা গেল না।

প্রশ্ন: সরকারতো পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ দেওযার জন্য ১০০ দিনের কাজে ৪০ হাজার কোটি টকা বরাদ্দ করেছে।

প্রথমত, মোদিজী নিজেই এমএনআরইজিএ বা ১০০ দিনের কাজকে চূড়ান্ত বিদ্রুপ করে বলেছিলেন যে, ওটা কংগ্রেস সরকারের ৬০ বছরের অপদার্থতার নজির, সেই হিসেবে তিনি ওই আইনকে রেখে দেবেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তার সরকার আরো অপদার্থ, কাজ দেওয়ার জন্য ওই এমএনআরইজিএর দ্বারস্থ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ১০০ দিনের কাজকে অবহেলা করার ফলেই গত কয়েক ভছরে গ্রাম থেকে অন্যত্র পরিযায়ী শ্রমিকদের যাওয়া বেড়েছে। মোদিজীর ১০০ দিনের কাজ সংক্রান্ত নীতিই পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। বলা যায়, বরাদ্দ বাড়িয়ে মোদি সরকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে।

poor

 

প্রশ্ন: যাই হোক না কেন, অর্থমন্ত্রী মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান আইন (এমএনআরইজিএ) মোতাবেক ১০০ দিনের কাজে ২০২০-২১ এর বাজেট বরাদ্দ ৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১০১ লক্ষ কোটি টাকা করলেন, এর আগে তিনি দৈনিক মজুরি ১৮২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০২ টাকা করেছিলেন। এটা কি গ্রামে ফেরত যাওয়া মজুরদের রোজগার বাড়িয়ে তাঁদের সাহায্য করবে না?

আপাতভাবে এমনটাই মনে হয় যে, এই বর্ধিত বাজেট বরাদ্দ সরকারের বদান্যতা, তাঁরা গ্রামীণ গরিব ও পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভেবে এই বরাদ্দ বাড়ালেন, প্রায় ৬৫%। কিন্তু এমএনআরইজিএ কোনো প্রকল্প নয় যে, বাজেটে না থাকলে সরকার দিতে বাধ্য নয়। ১০০ দিনের কাজে সরকার চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে আইনত বাধ্য। যাদের জব কার্ড আছে তাঁরা কাজ করতে চাইলে তাঁদের ১০০ দিনের কাজ দিতে সরকার বাধ্য নতুবা তাদের বেকার ভাতা দিতে হবে। ফলে যদি ওই বরাদ্দ নাও বাড়াতেন তাহলেও বাজেট ছাপিয়ে যাওয়া টকা সরকারের দেওয়া বাধ্যতামূলক। এমনিতেই গত বছরে যত টাকা সরকার ১০০ দিনের কাজের জন্য দিতে বাধ্য হয়েছে, যা সংশোধিত বাজটে ছিল, তার তুলনায় ১০ হাজার টাকা কম বরাদ্দ করা হযেছিল। এর পরে সরকারের নিজস্ব বক্তব্য (যদিও তা ভুল বা মিথ্যে) অনুযায়ী ২০ টাকা করে দৈনিক মজুরি বাড়ানো হয়েছে ফলে  পূর্বতন বাজেট বরাদ্দে সৃষ্ট করা যেতে পারে এমন কর্মসংস্থান কমেছিল। সেই বাজেট বরাদ্দ ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো তেমন কোনো প্রভাব পরার মতো নয়।

সরকারের হিসেব অনুযায়ী দেখা যাক:

২০১৯-২০-র সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ৭১ হাজার কোটি টাকা
১৮২ টাকা দৈনিক মজুরি হলে কাজের পরিমাণ = ৭১ হাজার কোটি/১৮২ = ৩৯০ কোটি দিন
১০০ দিন করে কাজ হলে  মোট শ্রমিকের সংখ্যা = ৩ কোটি ৯০ লক্ষ
অতিরিক্ত বরাদ্দ সমেত বর্তমান পরিমাণ = ১০১ হাজার কোটি/২০২ = ৫০০ কোটি দিন
১০০ দিন করে কাজ হলে  মোট শ্রমিকের সংখ্যা = ৫ কোটি ]
ফলে, অতিরিক্ত কর্মসংস্থান হবে ১ কোটি ১০ লক্ষ শ্রমিকের।
কিন্তু, অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে।

(যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, সমস্ত শ্রমিক ১০০ দিন কাজ পায় না। কিন্তু তাতো দিতে হবে, যখন কাজের অভাব। দ্বিতীয়ত ২৭ মার্চ অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে, ২০ টাকা করে মজুরি বাড়ানোর ফলে প্রত্যেক মজুর বছরে ২০০০ টাকা বাড়তি পাবেন। ফলে তিনি প্রতি মজুর ১০০ দিন কাজ করে এটাই বলেছিলেন।) ।

pad

 

প্রশ্ন: কৃষি পরিকাঠামোর জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ, ২.৫ কোটি কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বিতরণ করে ২ লক্ষ কোটি টাকা কৃষি ঋণ, চাষির পরিবহন খরচ ও মজুত খরচের অর্ধেক ভরতুকি এগুলি সবই তো কৃষিকে চাঙা করবে, তাছাড়া অত্যাবশ্যক পণ্য আইনকে সংশোধন করে চাল, গম, অন্যান্য দাম শস্য, তৈলবীজ, ভোজ্য তেল, ডাল, আলু, পিঁয়াজে মজুতকে বৈধ করা হল। এতে তো কৃষক বাজারে বেশি দাম পাবে।

কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম কৃষকের সুরাহা করার পক্ষে সব থেকে ভালো। কৃষি-উপকরণে ভরতুকি তুলনামূলকভাবে কমায় ও সারের দাম বাড়ে, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ চাষিরা পায় না, ফলে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা সস্তায় উৎপাদন পরবর্তীতেই ফসল কম দামে মহাজদের বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। সরকার যদি না চাষিদের মাট থেকে ফসল সংগ্রহের বন্দোবস্ত করে তাহলে চাষির পক্সে যথোপযুক্ত দাম পাওযা সম্ভব নয়।  পরিবহণের ওই ভরতুকিও এখন ওই ফঁড়ে বা মিডলম্যানদের কাছেই পৌঁছবে। লকডাউনের ফলে খেতে ফসল রয়ে গেছে, ফঁড়েরা আরো কম দাম দিচ্ছে। সরকারের উচিত ছিল ফসল সংগ্রহে তৎপর হওয়া। তার বদলে ইঙ্গিত দিল যে, ফসল নিজ উদ্যোগে বহন করে গুদামজাত করা হোক সরকার ভর্তুকি দেবে। ভাগচাষিদের জমি নেই তাই তাঁরা কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার যোগ্য নয় কারণ তার জন্য জমির দলিল জমা রাখতে হয়। এমনিতেও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা জমির দলিল হাতছড়া করতে চায় না। এই মুহূর্তে গ্রামে মানুষের কাছে অর্ত নেই। সেই অর্থ সরবরাহ করে চাহিদা তৈরির দরকার ছিল। সে ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী কোনো আগ্রহই দেখালেন না।

অত্যাবশ্যক পণ্য আইনকে সংশোধনতো বৃহৎ চাষি ও ব্যবসায়ীদের সুবিধে করবে। শুনেতো মনে হচ্ছে মোদিজী তার স্যাঙাত আদানি ও রামদেবকে কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ে আরো বেশি করে লাভ করতে দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা  করল। ওই আইন সংশোধনের পরে কৃষিপণ্যের বাজারকে অবাধ করা হবে। পণ্য সংগ্রহে সরকারের ভূমিকা আস্তে আস্তে পুরোপুরি উঠে যাবে। ফলে ফাটকা বাড়বে। তাছাড়া, কৃষকরা যাতে আগাম চুক্তির ভিত্তিতে পণ্য বিক্রি করে দিতে পারে তার বন্দোবস্তও করা হচ্ছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে দাদনপ্রথা চালু হবে। যার ফলে মারাত্মক হতে পারে।

প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনায় পরিকাঠামো উন্নয়ন, পশুপালন, মৌমাছি পালনে উৎসাহ এসব তো উত্তম প্রস্তাব।

এগুলি হলে ভালোই। কিন্তু এগুলিতো এক্ষুণি হচ্ছে না। এই প্রস্তাবও প্রকল্পগুলিতো বাজেটের সময় নেওয়া হয়। এখন তো কোভিড ১৯-এর ফলে যে জরুরি বন্দোবস্ত করা দরকার সে বিষয়ে অর্থদানের কথা ছিল।

প্রশ্ন: ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে যে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার তহবিল প্রদান করা হবে তাতে তো বিপদে পড়া ক্ষেত্রটি চাঙা হবে

মূলত ওই ক্ষেত্রকে তাদের বর্তমান ঋণের টপ আপ হিসেবে ৩ লক্ষ কোটি টাকা কোনো বনন্ধক ছাড়া দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সরকার সেই ঋণের গ্যারান্টি দেবে। কিন্তু সেই সংস্থাগুলি ঋণ নেবে কেন? উৎপাদনের জন্য তো? কিন্তু বাজারে চাহিদা কোথায় যে তাঁরা উৎপাদনে আগ্রহী হবে? আমেরিকায় যেমন ধরণের সংস্থাগুলিকে কর্মীদের কাজে রেখে দেওয়ার শর্তে অর্থ দেওয়া হয়েছে তেমন যদি তাদের টাকা দেওযা হত (ঋণ নয়) তাহলে তা বাজারে চাহিদা তৈরি করত। তাছাড়া, সংস্থাগুলি সরকার ও সরকারি উদ্যোগের কাছে ৫ লক্ষ কোটি টাকা পায় সরবরাহ করা পণ্যের মূল্য হিসেবে। সেই টাকা মিটিয়ে দিলেই সংস্থাগুলির সুরাহা হয়।

kol

 

প্রশ্ন: কোভিড-১৯ এর সময়ে প্রতিরক্ষা শিল্পে ৭৪% বিদেশি বিনিয়োগ বা সমস্ত শিল্পক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করে দেওযা, কয়লার ব্লক বণ্টন করে কয়লা ব্যবসায়ে উৎসাহ প্রদান এগুলি কি কোভিডএর বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইকে সাহায্য করবে?

আত্মনির্ভর ভারতে প্রতিরক্ষা শিল্পে ৭৪% বিদেশি বিনিয়োগ, শুনলে কেমন লাগছে? বিদেশীরা তাঁদের প্রতিরক্ষার বা অস্ত্রশস্ত্রের উন্নততম প্রযুক্তি আমাদের দিয়ে দেবে? খোঁজ নিয়ে দেখুন যে আধুনিক রাফাল কেনা নিয়ে এত অহঙ্কার, তার থেকে উন্নত বিমান ওই ফ্রান্সের কাছে হয়তো বা দাসাউই তৈরি করেছে। ৭৪% বিদেশি বিনিয়োগের ফলে আমরা নির্গাত প্রতিরক্ষায় আমাদের স্বাতন্ত্র্য হারাব।  শিল্পক্ষেত্রকে পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওযার এজেন্ডাটিকে কোভিড ১৯-এর সময়কার সামাজিক দুর্বলতার সময়ে ঘোষণা করে দেওয়া হল। বিবেকবানরা অসুস্থ বা অসহায় অবস্থায় শত্রুকেও আঘাত করে না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের উদাহরণ স্মরণ করুন। কিন্তু চতুর ও বিবেকহীনরা উল্টোটাই করে। কর্ণকে হত্যার ঘটনাকে ভাবুন। এটাও তেমনি, যখন শ্রমিক কৃষক বামপন্থীরাও ঘরবন্দি বা কোভিডের ভয়াবহতার সঙ্গে লড়ছে তখন মোদিজী দেশেের পুঁজিপতিদের জন্য কাজ করে চলেছেন। শ্রম আইনকে লাঘব করে শ্রমিকদের উপর অত্যাচার নামানো হচ্ছে।

প্রশ্ন: কোভিড-১৯ তো একটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যে কতটা বিনিয়োগের কথা এই প্যাকেজে বলা হয়এছে?

স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের গ্যাপ পূরণের জন্য ৮, ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ রাজ্য সরকার বা বেসরকারী সংস্থার বিনিয়োগের ঘাটতি পূরণের জন্য ওই টাকা দেওযা হবে। ফলে মাথাপিছু মাত্র ৬০ টাকার মতো বরাদ্দ। এছাড়া প্রত্যেক জেলা হাসপাতালে সংক্রামক রোগ চিকিৎসা বিভাগ খোলা হবে।

প্রশ্ন: অন্য সকল দেশ কীরকম খরচ করেছে?

রাজকোষ থেকে জিডিপির ১৪.৩% ইতিমধ্যেই খরচ করেছে কর্মসংস্থান বজায় রাখার জন্য বা সরাসরি খরচ করার জন্য দিয়ে।মানিটারি নীতিতে ফেড সুদের হার কমিয়ে ০.২৫%-এ নিয়ে গেছে। ঋণের সুবিধে দিয়েছে। তবে তাকে কোনো জিডিপর হিসেবে বা প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করছে না।

চীন জিডিপির ২.৫% রাজকোষ থেকে বরাদ্দ করেছে, মনিটারি নীতি দ্বারা ঋণ সুবিধেকেও প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করেছে যার পরিমাণ জিডিপির ৪.৯%। সুদের হারেও ১.৫% পর্যন্ত ছাটাই করেছে।

জাপান জিডিপির ২১.১% খরচ করেছে, যার মধ্যে ১৬% কর্মসংস্থান ও ব্যবসায়কে সুরক্ষিত রাখার জন্য। এছাড়া মনিটারি নীতি অনুসরণ করে ছোট ব্বসায়কে ঋণ সুবিধের গুচ্ছ দিয়েছে যা প্যাকেজের অংশ বলে ধরছে না।

জার্মানি জিডিপির ৪.৯% কর্মসংস্থান বজায় রাখার জন্য ও স্বল্পকালিন কর্ম সংস্থানের জন্য খরচ করেছে। এছাড়া ঋণ গ্যারান্টি দিয়েচে যেমন বারত দিয়েছে। কিন্তু সেগুলি খরচ নয়। মনিটারি নীতিও আছে।

প্রশ্ন: সামগ্রিকে এই আত্মনির্ভর ভারত অভিযান প্যাকেজকে কীভাবে দেখা যেতে পারে?

শ্রমিক কৃষক শোষণকারি আত্মপ্রচারক মোদিজীর স্যাঙাত পুঁজিপতিদের মুনাফার জন্য বিদেশী পুঁজি ও প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল ভারত গড়ে তোলার প্যাকেজ।

-- অমিত দাশগুপ্ত

aro

 

arog

এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে একমাত্র আলোচ্য বিষয় করোনা। একদিকে যেমন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা চেষ্টা করছেন করোনায় আক্রান্ত মানুষদের সারিয়ে তুলতে অন্যদিকে তেমনি বিজ্ঞানীরাও চেষ্টা করছেন কী করে প্রতিষেধক তৈরি করা যায়। এর পাশাপাশি প্রযুক্তিবিদেরাও নিজেদের মতো করে ভাবছেন কী করে কোনও প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা যায় যা দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কিছুদিন আগে বলা হয়েছে যে নাগরিকদের একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তাঁদের ফোনে ডাউনলোড করতে হবে তাহলে নাকি বোঝা যাবে কোথায় কোথায় করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিলেন সেখানেও তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করলেন এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কে যার নাম সরকারীভাবে রাখা হয়েছে – আরোগ্য সেতু। এই সেতু বন্ধনের মধ্যে দিয়ে নাকি করোনা সংক্রমণ রোখা যাবে। তৃতীয় দফায় যে লকডাউন ঘোষিত হয়েছে তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারি নয়, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কর্মীদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে নিজেদের ফোনে আরোগ্য সেতু নিতে হবে। বিরোধী দলেরা স্বভাবতই এর বিরোধিতা করেছেন। বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই বিষয়ে চিঠিও গেছে। একদল বলা শুরু করেছেন সেই একই যুক্তি দেখিয়ে যে কারুর যদি লুকোনোর মতো কিছু না থাকে তাহলে আপত্তি কোথায়? এই একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল আধারের সময়ে, একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল নোটবন্দীর সময়ে, কিন্তু সবকটি ক্ষেত্রেই কি এটা প্রমাণিত হয়নি যে আসলে ওগুলো দিয়ে দুর্নীতি কমে না। আরোগ্য সেতুর ক্ষেত্রেও যখন এক যুক্তি দাঁড় করানো হচ্ছে তখন কি এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলাটা সময়ের দাবি হয়ে উঠছে না?

বিতর্কটি বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে কি ভাবে আরোগ্য সেতু কাজ করবে সেই বিষয়টিকে। সরকার বলছে যে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ‘জিওফেন্সিং’ পদ্ধতির সাহায্যে পৃথকীকরণ করতে হবে, তাই এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন দেশের সমস্ত নাগরিকদের নাকি নিজেদের ফোনে এই আরোগ্য সেতু রাখাটা জরুরি। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া এবং বেশ কিছু দেশ এই পদ্ধতি মেনেই কিছুটা সংক্রমণ প্রশমিত করেছে, কিন্তু ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে এই পদ্ধতি কি খুব কার্যকর হবে? নাগরিকেরা কেন এই প্রশ্নটা করছেন না, যে এই অ্যাপ্লিকেশন কি করোনা পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে? এটা কি আসলে বিতর্কটিকে অন্যদিকে চালনা করার জন্য কোনও পদ্ধতি? যেই দেশে স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা সারা দেশের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশের কাছাকাছি সেখানে এই ধরনের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন কতটা ভালো কাজ করবে সেটা কি প্রশ্নাতীত?

প্রথমত যারা এই অ্যাপটি নিজেদের মোবাইলে স্থাপন করবেন, তাঁদের নাম, বয়স, লিঙ্গ এবং ফোন নম্বর দিয়ে নিজেকে নথিভুক্ত করতে হবে। সেই মানুষটির যদি কোনও শারীরিক অসুবিধা থাকে, ধরা যাক তিনি হার্টের রুগী বা ডায়াবেটিক বা অন্য কোনও সমস্যা আছে, সেগুলোও জানাতে হবে। তারপর বলা হবে যে তাঁর ফোনকে চালু রাখতে হবে সারাক্ষণ, যাতে এটা বোঝা সম্ভব হয় যে সেই মানুষটি কোথায় কোথায় যাতায়াত করছেন। অনেকেই বলছেন যে এই আরোগ্য সেতু দিয়ে মানুষকে নজরদারি করা হবে, ফরাসি একজন হ্যাকার দেখিয়ে দিয়েছেন যে এই আরোগ্য সেতুতে নেওয়া নাগরিকদের তথ্য আদৌ সুরক্ষিত নয়, কিন্তু সরকার কোনও কিছুই মানতে রাজি নয়। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন যে সমস্ত কিছু সুরক্ষিত। ঠিক যেমন ভাবে তাঁরা বলেছিলেন যে নোটবন্দীতে কালো টাকা ফিরে আসবে, আধার দিয়ে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হবে ইত্যাদি আজও একইভাবে বলে চলেছেন যে আরোগ্য সেতু নিলেই নাকি মানুষ করোনাকে ঠেকাতে সক্ষম হবে। কিন্তু ঘটনাটা কি সত্যিই তাই? এর পাশাপাশি যেভাবে বেশিরভাগ মানুষ এই আরোগ্য সেতু নিজেদের ফোনে ডাউনলোড করছেন তাতে কি আদৌ মনে হচ্ছে যে মানুষেরা নজরদারি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত? আমাদের মতো দেশে কোনও নাগরিকের কোনও তথ্য যদি কেউ জেনে নেয় বা সেগুলো চুরি হয় এগুলো নিয়ে হয়তো বেশির ভাগ মানুষ চিন্তিতই নন। কিন্তু সত্যিই কি চিন্তার কোনও কারণ নেই? অবশ্যই আছে। ধরা যাক কোনও একজন মানুষ আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করার সময়ে জানালেন যে তিনি বিভিন্ন রোগে এমনিতেই আক্রান্ত। কিংবা ধরা যাক কিছুদিন পরে আক্রান্ত হলেন তাহলে এই আরোগ্য সেতু দিয়ে সরকারের কাছে কিংবা ওই বেসরকারী সংস্থা যদি সেই তথ্য হেলথ ইনশিউরেন্স কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয় তাহলে সেই কোম্পানি নাগরিকদের কাছ থেকে কম প্রিমিয়াম নেবে না বেশি নেবে? এখনকার সময়ে কোনও নাগরিক সাধারণভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ হয়ে বাইরে আসার পর দেখলেন তাঁর শরীরে মধুমেহ বেড়েছে, এবং এর পর থেকে তাঁকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। তাহলে কি ইনশিউরেন্স কোম্পানি তার পরের বছরের প্রিমিয়াম সেই ব্যক্তির থেকে বেশি নেবে? এখনকার সময় হলে না, কিন্তু আরোগ্য সেতু থাকা অবস্থায় সমস্ত তথ্য তো ওদের হাতে তখন কি তাঁরা ছেড়ে দেবেন? কিংবা ধরা যাক একজন নাগরিক কী কী ওষুধ নিয়মিত খান সেটা যদি এই আরোগ্য সেতুর মাধ্যমে জানা যায় তাহলে কি সেই মানুষটি কোনো রোগে আক্রান্ত সেটা বোঝা খুব কঠিন ব্যাপার?

সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই কথা বলেননি, তা হল এই অ্যাপটি একটি সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি। আমাদের মতো দেশে যেখানে শুধু করোনা আক্রান্ত এই সন্দেহে একেক জন মানুষকে গ্রাম ছাড়া করা হয়, বা অবসাদে কোনও কোনও মানুষ আত্মহত্যাও করছেন এই খবরও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এই ‘আরোগ্য সেতু’ অ্যাপটি কি মানুষে মানুষে আরও দূরত্ব বাড়াবে না? একজন মানুষ যদি জানতে পারেন তাঁর পাশের মানুষটি করোনা আক্রান্ত তাহলে কি মব লিঞ্চিঙ বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটবে না সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায়? যে দেশে শুধু খাদ্যাভাসের কারণে একের পর এক গণহত্যা ঘটে, সেখানে কে করোনায় আক্রান্ত, কে সংখ্যালঘুদের কোন সমাবেশে হাজির ছিল সেটাও যদি বোঝা যায় তাহলে একজন নাগরিকের জীবন কি অসুবিধায় পড়তে পারে না?

তাহলে এই প্রযুক্তি দিয়ে যে নজরদারি হবে না সেই কথাটা কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়? যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে স্বাস্থ্য যৌথ তালিকাভুক্ত, কিন্তু এক্ষেত্রে রাজ্যগুলোও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। রাজ্য সরকারগুলি এখনও এরকম কোনও নির্দেশিকা পায়নি যে এই আরোগ্য সেতু সবাইকে নিতে হবে, তাই তাঁরা কি করবে সেটাও এখনও স্বচ্ছ নয়। তাহলে কি এটা বলা অতিশয়োক্তি হবে যে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য একটি কেন্দ্রীভুত তথ্য ভান্ডার বানানো যার মধ্যে দিয়ে সে শুধু নাগরিকদের নজরদারি করবে আর কিছু নয়।

aro

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কি কোনও নাগরিককে বাধ্য করতে পারে এই ধরনের কোনও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিতে? জাতীয় বিপর্যয় আইন ২০০৫-এর যে আইনকে দেখিয়ে এই কথা বলা হচ্ছে যে সতর্কতা মূলক অঞ্চলে বা লাল অঞ্চলে প্রত্যেকটি নাগরিকের যেন আরোগ্য সেতু থাকে সেটা কি এই আইনে বলা যায়? এক কথায় উত্তর না, বলা যায় না। কারণ এই জাতীয় বিপর্যয় আইনও সংবিধানের যৌথ তালিকায় পড়ে, অর্থাৎ কেন্দ্র আইন বলবৎ করতেই পারে, কিন্তু রাজ্যগুলোকে তাঁকে অনুরোধ করতে হবে যাতে রাজ্যগুলো তা মেনে চলে। এক্ষেত্রে আরও একটি বক্তব্য থেকে যায় যে কোনও সরকার কোনও নাগরিককে এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত তথ্য সরকারকে দিতে বলতে পারে না আইনত, এবং কর্মক্ষেত্রেও কোনও কোম্পানির মালিক এই তথ্য চাইতে পারেন না। শুধুমাত্র বেতন সংক্রান্ত কোনও তথ্য ছাড়া অন্য যে কোনও তথ্য কোনও সংস্থার মালিক চাইতে পারেন না। কারণ ২০১৭ সালের যে প্রাইভেসি বিল আনার কথা হয়েছিল, যা আপাতত যৌথ সংসদীয় কমিটির বিবেচনাধীন আছে সেই অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি নাগরিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য একান্তই গোপনীয় এবং ব্যক্তিগত তথ্য। ইচ্ছে করলে যে কোনও নাগরিক তাঁর মালিককে কোর্টে নিয়ে যেতে পারে শুধু মালিক যদি দেখতে চান যে তাঁর কর্মচারির মোবাইল ফোনে আরোগ্য সেতু আছে কি না। ২০১৭ সালে ৯ সদস্যের যে বেঞ্চ প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার রায় দিয়েছিলেন সেই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। তিনি বলেছিলেন যে কোনও আপৎকালীন বা জরুরি পরিস্থিতিতে সরকার তথ্য চাইলেও তাঁকে আগে বলতে হবে যে এই তথ্য তাঁরা অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করবেন না, এবং কোনও নাগরিকের কোনও তথ্য যে তাঁরই তথ্য সেটা তাঁরা বাইরে প্রকাশ করবেন না।

মানবজাতি এই মুহূর্তে একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে। হয়তো বা এই শতকের সবচেয়ে বড় সংকট। শুধু এই দেশের মানুষ নন, বিভিন্ন দেশের মানুষেরা এবং সরকারেরা যে সিদ্ধান্ত নেবেন এই মুহূর্তে তা আগামীদিনে তাঁদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে। শুধুমাত্র আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নয়, আগামীদিনে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি কি হতে চলেছে তা হয়তো এই সময়ে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। একদিন হয়তো এই ‘ঝড় থেমে যাবে পৃথিবী আবার শান্ত হবে’, কিন্তু এখন যে বিকল্পগুলো আমরা বেছে নেবো তার ওপরেই নির্ভর করবে আগামীর সকাল কেমন হবে? বহু আপতকালীন ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যা হয়তো অন্যান্য সময়ে নিতে যথেষ্ট আলাপ আলোচনার প্রয়োজন হতো। অপরিণত এবং ভয়ঙ্কর কিছু প্রযুক্তিকে হয়তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করানোর চেষ্টা হবে। প্রতিটি মানুষ যেন পরীক্ষার জন্য বলি প্রদত্ত গিনি পিগ কিংবা ইঁদুর। এটা কি কেউ কল্পনা করেছিলেন আজ থেকে কিছুদিন আগেও যে বেশিরভাগ মানুষকে ঘরে থেকে কাজ করতে হবে, বা সমস্ত স্কুল কলেজ অনলাইন হয়ে যাবে? কিন্তু এটাই আপাতত সত্যি।

এবার আসা যাক আধারের প্রশ্নে। যখন সর্বোচ্চ আদালতে আধার নিয়ে মামলা হয়েছিল তখন অনেকেই এই মামলাটিকে দেখেছিলেন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য বাইরে যাওয়া বা গোপনীয়তা দিয়ে, কিন্তু আদপে এই মামলাটিকে যদি লড়া যেত পরিচয় দিয়ে, মানে আদৌ আধার কোনও অভিন্ন পরিচয়পত্র নয়, তাহলে হয়তো লড়াইটা জেতা যেত, কিন্তু তা না করে যারা এটার বিরুদ্ধে লড়লেন তাঁরা নিয়ে গেলেন এটিকে গোপনীয়তার দিকে, ফলে সরকারের বিরোধিতা করতেও সুবিধা হল, তাঁরা বললেন যে এই গোপনীয়তার বিষয়টি শুধুমাত্র সমাজের ওপরের স্তরের মানুষদের মাথা ব্যাথা, ফলত এটা নিয়ে সমাজে যাঁদের সত্যি কোনও পরিচয়পত্র নেই তাঁদের এটি প্রয়োজন। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? যখন আধার আনা হয়েছিল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তখন মাত্র দশমিক ০৩ শতাংশ মানুষের কোনও পরিচয়পত্র ছিল না, আর সকলের কোনও না কোনও পরিচয়পত্র ছিল। আদালতে তাই গোপনীয়তার বিষয়টি দাঁড় করানো যায়নি। ওদিকে সরকার থেকে বলা হয় যে গোপনীয়তার বিষয়টি পরে দেখা যাবে। তারপর যখন একে একে রেশন, থেকে ব্যঙ্ক হয়ে মোবাইল ফোনে আধার সংযোগের কথা সামনে আসে তখনও একই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে যদি কোনও কিছু লুকোনোর নাই থাকে তাহলে এতো ভয় কিসের? সেদিনও যে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল আজো একই যুক্তি দেওয়া জরুরি যে ‘আধার কোনও ভাবেই অভিন্ন পরিচয়পত্র নয়, আধার নকল করা সম্ভব সুতরাং কোনোভাবেই কোনও কেন্দ্রীভূত তথ্য ভান্ডার তৈরি করতে আমি একজন ব্যক্তি নাগরিক সাহায্য করবো না যা দিয়ে আমাকে ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে’। আরোগ্য সেতুর ক্ষেত্রেও একই উত্তর দেওয়া জরুরি।

আসলে ভয় পাওয়ানোটা খুব জরুরি, মানুষ এমনিতেই আতঙ্কিত। করোনা নিয়ে সে ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে আছে, তাঁর চাকরি-বাকরি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে এখন যদি ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের ভয় দেখিয়ে বেশিরভাগ মানুষকে এই আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে এই সরকারের কাছে একটা তথ্য ভান্ডার তৈরি হয়ে যাবে যেটার সঙ্গে যদি আধারের তথ্য মিলিয়ে একটা তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা যায়, তাহলে যে বা যারা ওই তথ্যভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ পাবে তাঁরা কতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে সেটা কি সহজেই অনুমেয় নয়? যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে প্যান কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ না করালে প্যান বাতিল হয়ে যাবে, এই ভয় দেখিয়ে বহু মানুষকে আধার করিয়েছে এই সরকার, ঠিক একই রকম ভয় দেখিয়ে চাকরি চলে যেতে পারে এই আরোগ্য সেতু মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নেওয়াবে। অথচ কোনও নাগরিক কি প্রশ্ন করবেন না যে এই সরকার হোয়াটস অ্যাপে একটি সফটওয়ার যার নাম পেগাসাস ঢুকিয়েছিল, এই সরকার বিভিন্ন মানুষের ই-মেল হ্যাক করেছিল, এই সরকার কি করে বলে যে এই আরোগ্য সেতু নজরদারির জন্য নয়? অনেকে বলছেন যে সরকার যদি প্রত্যেক নাগরিককে স্মার্ট ফোন দেয় তাহলে আরোগ্য সেতু নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এই সরকার খাবার দিতে পারুক ছাই না পারুক, সকলের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারুক ছাই না পারুক এই স্মার্ট ফোন দিয়েও দিতে পারে, এবং তারপর যদি আরোগ্য সেতু নেওয়ার পাশাপাশি সকলের মোবাইলের হোয়াটস অ্যাপে অনবরত মিথ্যা খবর আসতে থাকে তখন সেটা মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের আছে তো?

এই মুহূর্তে মানুষের কাছে দু-ধরনের বিকল্প সামনে আছে।
সর্বগ্রাসী নজরদারি বনাম নাগরিকদের আরও ক্ষমতায়ন।
প্রত্যেকটি দেশ নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করবে না সারা বিশ্বব্যাপী একটা সৌভাতৃত্ব তৈরি হবে।

কিন্তু আমরা কি সত্যিই দেখতে চাই এই বিকল্পগুলো নাকি গা ভাসিয়ে দিতে চাই এই গড্ডালিকা প্রবাহে? যদি প্রতিটি মানুষ মনে করেন যে তাঁরা এই নজরদারির আওতায় থাকবেন না, এবং এই বেশ কিছু অভ্যেস থেকে নিজেদের মুক্ত করবেন, তাহলে এটাই কি সেই সময় নয়, যে আমরা অনেক কিছু থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি? করোনায় গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে থাকতে অনেকেই হয়তো অনেক কিছু ছেড়েছেন আগামীতে হয়তো আরও অনেক কিছু ছাড়তে হবে, হয়তো রোজ ভাত নাও জুটতে পারে কারুর কারুর, এখনও যেমন বহু মানুষ খেতে পাচ্ছেন না দুবেলা। সবাই যার যার মতো করে লড়ছেন। এই সাধারণ স্মার্ট ফোনের অভ্যাস কি আমরা ছাড়তে পারবো না? আরোগ্য সেতুর মতো বা আধারের মতো নজরদারির অস্ত্রকে পরাজিত করতে এখন আমাদের কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে শুধু। আসলে যতদিন না এটা পারবো ততদিন আমরা রোজ হারবো, কারণ বিপক্ষের মাঠে বিপক্ষের তৈরি করা খেলার নিয়ম মেনে আজ অবধি কোনোদিন প্রতিপক্ষকে হারানো যায়নি, এই সময়ের ক্ষমতাসীন শক্তিকে তো নয়ই।

-- সুমন সেনগুপ্ত

oil

 

oil

তেলের দামের সঙ্গে জিনিসপত্রের দামের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে – তেলের দাম বাড়লে পরিবহণ ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটে, ফলে পণ্যসমূহের দামও বেড়ে চলে। আর দাম বাড়লে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সেটা একটা আন্দোলনের ইস্যুও হয় – এমনকি ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর কাছেও। তবে দাম বাড়াটা সাধারণ জনগণের কাছে যতই কষ্টের ও ক্ষোভের কারণই হোক, তোলের দাম বাড়াটা কী কেন্দ্র, কী রাজ্য – সমস্ত রাজ্য সরকারগুলোর কাছে একটা আশীর্বাদ হয়েও দেখা দেয়। তেলের বেশি দাম মানে সরকারগুলোর ভাঁড়ারে আরও বেশি রাজস্ব – সরকারগুলো তখন নিশ্চয় একটু মুচকি হাসিও হাসে। বিপরীতে, তেলের দাম কমার মধ্যে জনগণের খুশি হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে – তেলের দাম কমে পরিবহণ ব্যয় হ্রাস পেলে মূল্যস্ফীতির হ্রাসও সম্ভাব্য হতে পারে। তখন কিন্তু সরকারের কপালে ভাঁজ পডে – তার রাজস্ব কমে যাবে। সরকার তখন প্যাঁচ কষতে থাকে – আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও, বিদেশ থেকে তেল কেনার জন্য সরকারের ব্যয় হ্রাস পেলেও দেশের বাজারে পাইকারি ও খুচরো বিক্রির দাম যাতে পড়ে না যায় সেই দিকে সরকার তার নজরকে কেন্দ্রীভূত করতে থাকে। আর এই ব্যাপারে তাদের সহায়ক হয় শুল্ক ও করের হার – কেন্দ্রীয় সরকার উৎপাদন শুল্ক এবং রাজ্যগুলো বিক্রয়ের ওপর করের হারকে বাড়িয়ে চলে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল জনগণকে না দিয়ে রাজস্বের ঘাটতি পূরণই সরকারগুলোর অভীষ্ট হয়ে ওঠে।

pet

 

এই পরিঘটনাটাকেই আমরা বারবার পুনরাবৃত্ত হতে দেখছি মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। করোনার কারণে দেশে-দেশে লকডাউন চালু হওয়ার ফলে তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার জন্যই হোক, আর তেল উৎপাদক দেশগুলো ও রাশিয়ার মধ্যে বনিবনা না হওয়ার ফলেই হোক, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নেমে আসে তলানিতে। এবছরের জানুয়ারী থেকে আড়াই মাসে তেলের দাম নেমে যায় অর্ধেকেরও কমে। যে ব্রেন্ট ক্রুড (সৌদি আরবের বিক্রি করা অপরিশোধিত তেল) জানুয়ারি মাসে বিক্রি হয়েছে ব্যারেল প্রতি ৭২ ডলারে, ৯ মার্চ সেই তেলের দামই কমে হয় ব্যারেল প্রতি ৩৩ ডলার। এবং এই পড়তি প্রবণতা চলতেই থাকে। মোদী সরকার কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার সুফল সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে না দিয়ে উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে দেশের বাজারে তেলের দামকে অপরিবর্তিত, অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার আগে যে অবস্থায় ছিল সেই স্তরেই বেঁধে রাখে। সরকার ১৪ মার্চ পেট্রল ও ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক ৩ টাকা করে বাড়ায়। এর কিছুদিন পরই চালু হবে লাগাতার লকডাউন, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরও পড়ে গেলে লকডাউন চালু থাকা অবস্থায় উৎপাদন শুল্ক বাড়ানোর প্রক্রিয়া যাতে প্রতিহত না হয়, সে জন্য সরকার লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক আগে ২৩ মার্চ অর্থ বিলে সংশোধনী এনে পেট্রল ও ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক আরও বাড়ানোর রাস্তা করে রাখে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যথারীতি আরও কমে ৫ মে বিক্রি হয় ২৩.৮৬ ডলারে এবং সরকারও একটুও দেরি না করে সেদিন রাতেই পেট্রল ও ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক বাড়ায় যথাক্রমে ১০ টাকাও ১৩ টাকা এবং তাদের ঘোষিত লক্ষ্য হয় তেল থেকে অতিরিক্ত ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব তোলা। দেশের বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়াকে আটকাতে উৎপাদন শুল্কের বৃদ্ধিকে কিভাবে কাজে লাগানো হয়েছে তার একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ভারতের এক মহানগরে ২০১৪-র মে মাসে এবং ২০২০-র মার্চ মাসে পেট্রলের খুচরো বিক্রির লিটার প্রতি দাম ছিল যথাক্রমে ৭১.৪১ ও ৭১.৭১ টাকা। অর্থাৎ, উভয় ক্ষেত্রেই বিক্রির দাম প্রায় সমান, কিন্তু উৎপাদন শুল্ক ও রাজ্যের বিক্রয় কর বসার আগে তেলের মূল দামে ফারাক ছিল অনেক – যথাক্রমে ৪৭.১২ ও ৩২.৯৩ টাকা। ২০১৪-র তুলনায় ২০২০-র মূল দাম ১৪ টাকার বেশি কম থাকলেও খুচরো বিক্রির দাম যে কমেনি তার কারণ ২০২০তে উৎপাদন শুল্ক ও রাজ্যের বিক্রয় কর দুইই বেড়েছে – ২০১৪-র ২২.২৯ টাকা থেকে (১০.৩৯ + ১১.৯০) বেড়ে ২০২০-তে হয় ৩৫.২৩ টাকা(১৯.৯৮ + ১৫.২৫)। শুল্কের ভারে জনগণের ঘাড় এইভাবে ভারাক্রান্ত হয়েই চলে। গত ৫ মে উৎপাদন শুল্ক আর এক দফা বাড়ার পর পেট্রল ও ডিজেলে সেগুলোর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে যথেষ্টই বেশি, যথাক্রমে ৩২.৯৮ ও ৩১.৮৩ টাকা।

তেলের দামের বিনিয়ন্ত্রণ ঘটানোর সময় যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে – ভর্তুকি দিয়ে তেলের দামকে আর কমিয়ে রাখা হবে না, তেল কোম্পানিগুলোকে আর ক্ষতির শিকার হতে দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে উপভোক্তাদের তার সুবিধা দেওয়া হবে, আর দাম বাড়লে তাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। কিন্তু তেল সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস হওয়ায় সরকারের নিজের কাছেই এই নীতি আর শিরোধার্য বলে মনে হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে বলা হয়েছিল তিনি দেশের জন্য সৌভাগ্য নিয়ে এসেছেন, যদিও দাম কমার সুবিধা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেননি। তথ্য বলছে, কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি সরকার নয়নয় করে ১২ থেকে ১৪ বার তেলের ওপর উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে। তেলের খুচরো বিক্রির দাম বাড়েনি ঠিকই, কিন্তু কমার সুযোগ থাকলেও কমানো হয়নি। সংকটের বোঝা জনগণের ঘাড়ে পাচার করতেই যে সরকার অভ্যস্ত, সে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমা জনিত সুরাহা জনগণের হাতে তুলে দেবে, এর চেয়ে দুরাশা আর কিছু হতে পারে না। যে সরকারের প্রতিটি মজ্জায় অসংবেদিতার প্রবল উপস্থিতি, সে জনগণকে দুর্ভোগই দিতে পারে।

-- জয়দীপ মিত্র

food

 

karfu

ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকলে বুক জ্বালা করে, গলার কাছে টকটক ভাব, মাঝে মাঝে বমির নামে শুধু জল উগরে আসে। মা বলে খালি পেটে থাকলে পিত্ত পড়ে যায়। আজকাল এই পিত্ত পড়ার পরিমাণটা একটু বেশিই দেখছি চারিদিকে। ইদানিং প্রায় ৯টার মধ্যেই আমাদের পাড়ার প্রায় বাড়ির আলো নিভে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ছে সকলেই তাড়াতাড়ি। পাড়ায় আমার সুনাম বা বদনাম যে আমি ভোররাত পর্যন্ত জেগে থাকি। এই লকডাউন পর্যায়ে নানা জনের নানারকম আব্দারের সঙ্গে আরেকটা আব্দার জুড়ে গেছে, যেটা কার্যত এখন আমার দায়বদ্ধতাই বলা চলে, কাউকে রাত ১২টা, কাউকে বা রাত ১টা, আবার কাউকে ২টা ৩০ মিনিটে ডেকে দিতে হচ্ছে। কাউকে ফোন করে, আবার কারও বাড়িতে গিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে জাগিয়ে দিয়ে আসছি। তারপর তারা কেউ টোটো নিয়ে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে চলে যাচ্ছে ফুল আনতে হাওড়া জগন্নাথ ঘাট, কেউ ধূলাগড় থেকে ফল নিয়ে আসছে, কেউ বৈদ্যবাটি বা তারকেশ্বর চলে যাচ্ছে কয়েকজন মিলে ছোটো হাতি ভাড়া করে নিয়ে আসছে সব্জি বা মাছ। যাতায়াতের পথে পুলিশের হাতে গুঁজে দিতে হচ্ছে কোথাও ৫০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। রাত ১টার পর থেকে জিটি রোড জুড়ে টোটো আর গাড়ির সারি, তার সাথে পাল্লা দিয়ে পুলিশেরও পকেট ভারি হচ্ছে।

সকাল ৭টার মধ্যে ফিরেই বিক্রি করে ফেলতে হবে সব জিনিস ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। নাহলে আবার এলাকার পুলিশের হাঙ্গামা, মারধর, তোলাবাজি। যতটা বিক্রি হয় হল, যা বাঁচল তার অধিকাংশই এই গরমে নষ্ট হচ্ছে, রাখার মতো ব্যবস্থা নেই। প্রত্যেকটা দিন এইভাবে পরিবারগুলোর যাপনের চাকা ঘুরছে ! টিকে থাকতে হবে তো!

আমাদের পাড়ার অধিকাংশই এই লকডাউনে পেটের লকডাউনের বিরুদ্ধে লড়তে বেছে নিয়েছে এই পথ। এই মানুষগুলোর পেটে যে চরা পড়েছে সেখানে রাত্রিকালীন ‘কার্ফ্যু’র কারণে পেটে চরা দীর্ঘতর আর স্থায়ী হতে থাকবে। কেউ কেউ বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে আবার সওয়ার হবে রাতের রাস্তায়; যে পুলিশ এতদিন ৫০ চাইত সে হয়তো এবার ‘কার্ফ্যু’র ভয় দেখিয়ে ১০০০ চাইবে; যে ১০০০ চাইত, সে হয়তো আরও বেশী চাইবে। পেটের জ্বালায় এরপরে যদি কেউ আবারও রাস্তায় বের হতে মরিয়া হয় তখন দাগিয়ে দেওয়া হবে ‘আইন-শৃঙ্খলা মানছে না’, নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা ! কোনো দল আবার ‘দেশদ্রোহী’ তকমা সেঁটে দিতে পারে। শাসক যখন আর্তি কানে তোলে না, তখনই তো হারবার্টদের সশব্দে ফেটে জানান দিতে হয় চুল্লিতে ভাত না ফুটলে শাসককে ফোটানো হবে।

– নীলাশিস বসু

midmiday

অতিমারীর জন্য স্কুল আগেই ছুটি দেওয়া হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী মার্চ মাসে বিদ্যালয় আরও ১৪ দিন চলতে পারত। এপ্রিল মাসে ২১ দিন স্কুল চলার কথা ছিল। কিন্তু সরকার ছুটি ঘোষণা করে দেয়। প্রশ্ন উঠলো মিড ডে মিলের বাচ্চারা খাবে কি? রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিল ছাত্রদের চাল ও আলু দিয়ে দেওয়া হবে। তাই করা হল। চাল এবং আলু প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্রদের হাতে পৌঁছে গেল।

শিশুদের পুষ্টি যোগাতে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য খরচের ৬০:৪০ অনুপাতে আর্থিক দায় নেবে। এই যৎসামান্য টাকা শিশুদের খাওয়াবার জন্যে বরাদ্দ আগেই ছিল। প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে ছাত্রপিছু দৈনিক যথাক্রমে ৪.৪৮ টাকা এবং ৬.৭১ টাকা। এই আনুপাতিক হারে প্রাথমিকে কেন্দ্র দেয় ২.৬৯ টাকা এবং রাজ্যের ভাগে ১.৭৯ টাকা মোট অর্থের পরিমাণ ৪.৪৮ টাকা। উচ্চ প্রাথমিকে কেন্দ্র দেয় ৪.০৩ টাকা এবং রাজ্য ২.৬৮ টাকা মোট অর্থের পরিমাণ ৬.৭১ টাকা। চাল প্রতিটি রাজ্যে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া বিনামূল্যে সরবারহ করে।

চারিদিকে দাবি ওঠে মিড ডে মিলের রান্না বন্ধ করা যাবে না। রাজ্য সরকার দাবি মেনে নেয়। সেই অনুযায়ী প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে ১৪ দিন ও ২১ দিনে দু-দফায় মাথা পিছু প্রথমবার ২ কেজি ও দ্বিতীয়বার ৩ কেজি আলু এবং চাল দেওয়া হল। ৩৫ দিনে প্রাথমিকে ৫ কেজি ও উচ্চ প্রাথমিকে ৫ কেজি মোট ১০ কেজি আলু দেওয়া হয়েছে। এবার আমরা খরচটা একবার দেখে নিই। চাল যেহেতু এফসিআই বরাদ্দ থেকে আসে তাই চালের কোন মুল্য খরচের সাথে যুক্ত করা হল না। আলুর দর বাজারে ২০/২২/২৪ টাকা। কিন্তু স্কুল পেয়েছে ১৮ টাকা দরে।

প্রাথমিকে – আলু ১৮ টাকা × ৫ কেজি = ৯০ টাকা
উচ্চ প্রাথমিক – আলু ১৮ টাকা × ৫ কেজি = ৯০ টাকা।

প্রাথমিকে দৈনিক মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দ ৪.৪৮ টাকা হারে ৩৫ দিনে ১৫৬.৮০ টাকা খরচ হওয়া উচিত ছিল, হয়েছে ৯০.০০ টাকা। মোট উদ্বৃত্ত ৬৬.৮০ টাকা।
উচ্চ প্রাথমিক দৈনিক মাথাপিছু ৬.৭১ টাকা হারে ৩৫ দিনে ২৩৪.৮৫ টাকা খরচ হওয়া উচিত ছিল, হয়েছে ৯০.০০ টাকা। মোট উদ্বৃত্ত ১৪৪.৮৫ টাকা।

জনমানসে প্রশ্ন উঠছে অতিমারির সময় মিড ডে মিল তহবিল থেকে এই উদ্বৃত্ত কয়েক কোটি টাকা যাচ্ছে কোথায়? অর্থের পরিমাণটা কত হতে পারে ভাবতে পারছেন? গড়ে একজন ছাত্র ১৮৩ টাকা হলে, ৩০ লক্ষ ছাত্রে কত কোটি টাকা হতে পারে? সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে নতুন কোনো দুর্নীতির পূর্বাভাস নয়তো?

লকডাউনের সময় সরকারি রেশন, বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে খাদ্যশস্য সাহায্যের উপর নির্ভর করে পরিবারগুলো কষ্ট করে বেঁচে আছে, হাতে কাজ নেই, নগদ অর্থ নেই। সব অর্থনীতিবিদরা বলছেন সাধারণের হাতে নগদ টাকা তুলে দিতে, তাতে যেমন বাজার চাঙ্গা হবে এই মানুষেরাও বাঁচবেন।

রাজ্য সরকার উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে ছাত্রদের অভিভাবকদের হাতে প্রথমিকে ৬৬.৮০ টাকা ও উচ্চ প্রাথমিকে ১৪৪.৮৫ টাকা নগদ তুলে দিতে পারতেন। সরকারের এতে কোন আর্থিক বোঝা বাড়তো না, মিড ডে মিল তহবিল থেকেই এই টাকা খরচ করা যেতে পারতো। অন্যথায় ছাত্রদের ডিম, সোয়াবিন সহ প্রোটিনের ব্যবস্থা করা হোক। লক্ষণীয় ব্যাপার হল কেন্দ্র ও রাজ্যে শাসকরা সুযোগ পেলেই কথার মারপ্যাঁচে সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে প্রতরণা করেই চলে। শিশুদের পুষ্টিতেও তারা ছাড় দেয় না। কী বিচিত্র সব শাসক আমাদের স্বাধীন দেশে!

– নবেন্দু দাশগুপ্ত

লকডাউনে কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি

আমাদের বাঘাযতীন অঞ্চল পুরোনো বামপন্থী এলাকা। পাড়ার কিছু বামমনস্ক মানুষ, যারা এই মুহূর্তে সক্রিয় ভাবে কোন দলে নেই,তাদের সঙ্গে ঠিক করলাম এলাকার রেশন দোকানগুলো ঘুরে দেখব ঠিকঠাক মত মানুষ রেশন পাচ্ছেন কিনা।তখনও অনেক দোকানে মাল এসে পৌঁছায় নি। এর মধ্যে আমাদের রামগড়ের এক মিড ডে মিল- কর্মী ফোনে জানালেন, তিনি রেশন পেয়েছেন,কিন্তু প্রাপ্য থেকে কম। এর প্রতিবাদ করায় দোকান মালিক তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।ফোন পেয়ে ওর কাছে ছুটলাম কিন্তু তখন দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে । আমাদের কাছে নবান্নতে অভিযোগ জানানোর হেল্পলাইনের নম্বর ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়েই ফোন করতে ওপারের ভদ্রলোক বিস্তারিত ভাবে আমাদের অভিযোগ শুনে বললেন, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। তবুও খাদ্যদপ্তরের একটা নম্বর দিয়ে সেখানেও ফোন করতে বললেন। সেখানে অবশ্য কেউ ধরলেন না।পরদিন ঐ মিড ডে মিল কর্মী আবার ফোন করে জানালেন, নবান্ন থেকে তাকে এদিন বিকেলে রেশন দোকান থেকে বাকি মাল(যে পরিমাণটা পান নি) নিয়ে আসতে বলা হয়েছে । বিকেলে ঐ দোকানে যেতে ডিলার ঠিক মত মাল দিয়ে বললেন, নবান্নতে অভিযোগ জানানোর কী দরকার ছিল! মিড ডে মিল কর্মী বললেন, আপনিই তো বাধ্য করলেন। বললেন বিনা পয়সায় যা পাচ্ছেন চুপচাপ নিয়ে যান-- যাই হোক, শুনলাম সকালে খাদ্য দপ্তর থেকে একটা টিম এসে এলাকার সব রেশন দোকান ঘুরে গেছে।আবার আমাদের এই দোকানের (১০০নং ওয়ার্ডে বাঘাযতীন হাসপাতালের গায়ে) সামনেও যাদবপুর থানার এক কনস্টেবলকে মোতায়েন থাকতে দেখলাম । আমার পাড়ার রেশন দোকানেও শুনলাম কাউন্সিলর ঘুরে গেছেন। এক ফোনেই বেশ সাড়া পড়ে গেছে দেখে মিড ডে মিল কর্মীরা তো খুব খুশি । চললাম মিড ডে মিল-এর আরেক দিদির বাড়ি চা খেয়ে ব্যাপারটা সেলিব্রেট করতে।
সেখানে মিড ডে মিলের কর্মীরা হঠাৎ বললেন, "আমরা কি এখন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি না--ধরো এই মুড়ি বিস্কুট--"। রামগড় নাকতলার রান্না-দিদিরা কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন চাঁদা তুলতে। তুলেও ফেললেন ২৩০০ টাকা । আমিও তুললাম।শুধু মুড়ি বিস্কুট কেন, চাল ডাল ও অন্যান্য সামগ্রীর সংস্থানও হয়ে গেল। আমাদের শহীদনগর পার্টি অফিসের কমরেডরা ৬০টি প্যাকেট বানিয়ে দিলেন। বাঘাযতীন স্টেশনলাগোয়া এক গরিব পল্লীর মানুষদের সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় ফুটবলপ্রেমী কিছু তরুণ আমাদের খুব সাহায্য করল।ওরাই প্রয়োজন আছে এমন মানুষদের তালিকা বানিয়ে, কুপন করে, হাতে হাতে বিলিও করে দিল। উপরন্তু বাচ্চাদের হাতেও মুড়ি বিস্কুটের প্যাকেট তুলে দেওয়া হল। সেটা ছিল ১৯ এপ্রিল। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে নেতাজীনগরের মিড ডে মিল কর্মীরাও চাঁদা তোলা থেকে প্যাকেট বিলি পর্যন্ত সব কিছু নিজেরাই করে শ্রীকলোনীর মানুষ দের হাতে সাহায্য তুলে দিলেন। এই ১২ জন রন্ধনকর্মী যারা এ আই সি সি টি ইউ-এর সদস্যও বটে, এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে খুব খুশি। গর্বিতও। তারাও আজ লকডাউনে বিপর্যস্ত। ছ'জনের স্বামীর কাজ চলে গেছে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।এই পরিবারগুলি মোটামুটি বামপন্থী।তাদের অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে 'লিবারেশন'-এর গণসংগঠনে থেকে, তারা নিজেদের 'মানুষ' হিসেবে ভাবতে পারছেন। মতামত দেওয়ার, অধিকার প্রয়োগের কথা ভাবতে পারছেন যে সুযোগ অতীতে ছিল না। অনেক কষ্টের মধ্যে এটাই তাদের লড়াইয়ের প্রেরণা।ভবিষ্যতে তাদের আরও সাহায্যের পরিকল্পনা আছে।
লকডাউনের শুরুতে যখন মানুষ পথের দু'ধারে সব্জি, মাছ--এসব নিয়ে বসে পড়েছিল তখন ভয়াবহতাটা ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন দেখছি স্বামীর পাশে বসা বধূটি আপাদমস্তক ওড়নায় ঢেকে দু'জনের সংসারের ছোট্ট বঁটিতে অনভ্যস্ত হাতে মাছ কাটছে, বাবা-ছেলে ফ্লাস্ক নিয়ে ঘুরে ঘুরে নিচু গলায় চা খাওয়ার অনুরোধ করছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছি এই পরিবারগুলো কাজ হারিয়ে এই সামান্য পসরা নিয়ে পথে নেমেছে। কিন্তু দিন দিন কেনার লোক কমে যাচ্ছে । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সংকট আরেক রকম। খিদে আছে, খাবার নেই। সাহায্য চাওয়া-নেওয়ায় সংকোচ আছে।আর্থিক সংকটে সংসারে চাপা অশান্তি। পারস্পরিক সম্পর্কে চিড় ধরছে।
তবে এত কিছুর মধ্যেও দেখছি, যাদের একসময় আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মনে হত, বিশেষ করে যুব সমাজ, এই লকডাউনে তাদের কিন্তু একেবারে বিপরীত চেহারায় দেখছি। দিনের পর দিন, হয়তো কখনও নিজেদের পকেট থেকেও টাকা দিয়ে, সাহায্য সংগ্রহ করে, তারা খাইয়ে চলেছে হাসপাতালে আটকে পড়া রোগীদের আত্মীয়দের, পথচলতি মানুষ, সবজিবিক্রেতা, ভবঘুরে ও অন্যান্য দুঃস্থ মানুষদের। বৃদ্ধদের রেশন তুলে দিচ্ছে, ওষুধ যোগাড় করে দিচ্ছে । এ ছবিটা একেবারেই নতুন, এ ছবি ভরসা জাগায়। শীলা দে সরকার

 

খণ্ড-27