ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে দিল্লির উত্তরপুর্বে যমুনা বিহার, মৌজপুর, জাফরাবাদ, জোহরাপুরী,ভজনপুরা অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন যখন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে মারমুখী হিংস সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণে, বিদ্বেষের আগুনে পুড়ে গেছে মসজিদ-মাজার দোকানপাট, ঘরবাড়ি। স্বজন হারানো শোকে মুহ্যমান দিল্লির যমুনার ওপারের অঞ্চল, তখন দিল্লীর দক্ষিণ দিকে কেমন আছেন শাহীনবাগে অবস্থানকারী শত শত মহিলা? যারা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আড়াইমাস ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের এনআরসি বিরোধী আন্দোলন।
২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা নাগাদ গিয়েছিলাম শাহীনবাগ। দূর থেকেই ভেসে আসছিল মাইকের আওয়াজ। দিল্লীর আইসার ছাত্র কমরেড আসীফের সহায়তায় পরিচয় হতে লাগলো অনেকের সাথে। বাংলা থেকে গিয়েছি বলে গলা জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন রাজিয়া। প্রথমেই নজর কাড়লো ফতেমা শেখ আর সাবিত্রী ফুলের লাইব্রেরীর পাশে লাগানো একটি পোস্টার, যাতে একটি হিজাব পরা মহিলা হাত উঁচু করে বলছেন ‘উই রিড উই লিড’, অর্থাৎ আমরা পড়াশুনা করি এবং নেতৃত্বও দিই। লাইব্রেরীতে দেওয়ালে লাগানো বড় ফেস্টুন তাতে লেখা “লড়ো পড়ার জন্য, পড়ো সমাজকে বদলানোর জন্য”। সেই ফেস্টুনের নীচে বসে একটি ৭/৮ বছরের কিশোর এত হট্টগোলের মধ্যে মনযোগ দিয়ে অংক কষে চলেছে। আশেপাশে অনেকেই নানা বই হাতে পড়াশুনা করছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে রাজিয়া জানালেন আজ এত মহিলা ঘরের চার দেওয়াল থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। তারা কিছুতেই সরবে না যতদিন না এই কালা কানুন বাতিল হচ্ছে। এই আন্দোলন তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। আগে কোনোদিন আমি বাড়ির বাইরে এরকমভাবে পা রাখেনি। আমাদের যে সন্তানেরা পড়াশুনা করতে চায় অথচ পারছে না, তাদেরকে পড়াশুনা করাবার জন্যই আমরা একটা স্কুল খুলেছি ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে, এরপরেও আমি এই বাচ্চাদের মধ্যে কাজটা চালিয়ে নিয়ে যাব। রাজিয়াই পরিচয় করিয়ে দিলো আন্দোলনের নেত্রী শাহীনের সাথে। কালো বোরখার ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন চোখজানালেন এই বিজেপি সরকার আমাদের নানা জাতি, নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি করতে চাইছে। বাংলা থেকে শাহীনবাগে আন্দোলনের পাশে থাকা অমিতা বাগকে জড়িয়ে ধরে শাহীনা বলেন এই দিদি আমাদের সাথে প্রথম দিন থেকে আছে, আমরা হিন্দু মুসলিম একসাথে এই লড়াই লড়ছি, আর এস এস গুজরাটে দাঙ্গা করছে, এখন দিল্লীতে করলো, ওদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কিছু অবশিষ্ট নেই।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, বেটি পড়াও-বেটি বাঁচাও, কিন্তু জামিয়ায় ছাত্রীদের যেভাবে মারা হল তাতে বোঝা গেলো উনি আসলে কি চান। বেটিরা না বাঁচলে পড়বে কি করে? আসলে ওরা চায় যাতে ছাত্রছাত্রীরা যাতে পড়াশুনা না করে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা সব আওয়াজকে দাবিয়ে রাখা যাবে। আমি আগে কোনোদিন এইসব কাজ করিনি, কিন্তু বুঝেছি আজ যদি বাইরে বেরিয়ে না আসি তাহলে এই সরকারকে রোখা যাবে না। তাই আমি মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করি, এবং ভাইদেরকেও বোঝাই আমাদের কেন এখন প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী জানালেন আমরা স্কুলে যাওয়া বাচ্চারা যদি বুঝতে পারি এই আইন দেশের ভালো করবে না তাহলে মোদী কেন বুঝছে না?
আরও অনেকের সাথে কথা বলার জন্য অবস্থান মঞ্চের কাছে এলাম। স্টেজের সামনের দিকে বাঁশ দিয়ে আলাদা করে দুদিকে সার বেঁধে মহিলারা বসে আছেন, তাদের কারোর কোলে যেমন আছে ছোট্ট শিশু, তেমনি সেই অবস্থানে রয়েছেন ৮০/৯০ বছরের দাদিরাও। আর বাঁশের বাইরে প্রচুর পুরুষ দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে এ লড়াই একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার জন্য তারা প্রস্তুত। অন্যসময় শাহীনবাগের যে জনসমুদ্র চোখে পরে তা ওইদিন একটু কম চোখে পরলেও কমরেড আসিফ জানালেন এই কয়েকদিনের মর্মান্তিক আতঙ্ক ঘিরে রয়েছে মানুষের মধ্যে। আরএসএস-এর লোকজন মিটিং করছে হামলা করবে বলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা থ্রেট ভিডিও। আমার হাতে ক্যামেরা দেখে অনেকেই আপত্তি জানালেন, কারণ বাজারি মিডিয়া তাদের সম্পর্কে অনেক ভুল তথ্য প্রচার করছে। কিন্তু শাহীনাই আন্দোলনকারীদের সাথে আলাপ করিয়ে বলল দিদি আমাদের লোক। পরিচয় করিয়ে দিলো ঋতু কৌশিক, শাবিনা খান, রুবি আর দাদির সাথে। একসাথে ওরা তখন চিড়ে ভাজা খাচ্ছিল। আমাকে বলল কথা পরে হবে আগে আসুন কিছু খেয়ে নিন। কিছুক্ষণের পরিচয়ে এরকম ভালোবাসার ছোঁয়া একমাত্র আন্দোলনের সাথীরাই দিতে পারে। খাওয়া শেষ করে শাবিনা জানালেন তিনি দ্বিতীয় দিন থেকে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, তার বাড়ি কাছেই, মেয়েরা এখানে অবস্থান শুরু করেছে দেখে তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি, তাঁর স্বামীও তাকে সম্পুর্ণভাবে সহযোগিতা করছেন। আমাদের নামে কত খারাপ খারাপ কথা বলা হয়েছে, কত চেষ্টা হয়েছে এই আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু দেখুন আজও আমরা টিকে আছি, সারা ভারতে মেয়েরা আজ আমাদের দেখে পথে নেমেছে। দেশে এত বেকারির সমস্যা, সেই সব নিয়ে না ভেবে আজ এই সরকার বলছে জামা কাপড় দেখে মানুষ বিচার করবে। আমরা সবাই মিলে একদিন টিপ পরেছিলাম, কারণ টিপ খুব সুন্দর লাগে দেখতে, করুক মোদি এইবার বিচার আমরা কোন ধর্মের? দু’মাস ধরে অনশনে রয়েছেন মেহেরুন্নিসা। তিনি বললেন এনপিআর (এনপিআর) লাগু করতে দেবো না তাই আমার এই অনশন। আমি আর কতদিন আছি, কিন্তু নতুন প্রজন্মের জন্য, গরীব মানুষদের জন্য, পুরো ভারতবর্ষের জন্য আমার এই লড়াই”।
সবার শেষে দেখা হল দাদির সাথে। দাদি দৃঢ়চিত্তে জানালেন “যতক্ষন না আমাদের লিখে দেওয়া হচ্ছে ‘সিএএ’-‘এনপিআর’ বাতিল হচ্ছে ততক্ষন আমরা এইখান থেকে নড়বো না। এই দেশ আমাদের সবার। আজ দেশের কি হাল করেছে এই সরকার? দাঙ্গা করে আমাদের শেষ করে দিতে চাইছে। হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিষ্টান ভারতের চার সিপাই। এদের আলাদা করতে দেবো না। এই মোদি তিন তালাককে অপরাধীকরণ করেছে, নোট বন্দী করেছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে, এইসব দেশের মানুষ বরদাস্ত করবে না, আর মানুষ যখন বরদাস্ত করছে না তখন মোদি তুমি নিজের জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি যাও। জনগণ তোমাদের থেকে মুক্তি পাবে”। পাশ থেকে কয়েকজন আন্দোলনকারী দাদি’র সুরে সুর মিলিয়ে বলে উঠলো ‘মোদি-অমিত ওয়াপস যাও’। দাদি এও জানালেন আমাদের পশ্চিমবাংলায় যেখানে যেখানে এনআরসি বিরোধী অবস্থানে মানুষ বসে রয়েছেন তারা যেন তাদের প্রতিজ্ঞা থেকে এক পা ও না সরে দাঁড়ায়। শাহীনবাগ জন্ম দিয়েছে এক অন্য রাজনীতির, শাহীনবাগ এক সাহসের নাম।এরকম সংগ্রামী মহিলাদের মাঝ থেকে ফিরতে মন চায়না কিন্তু তবুও ফিরতে হল। ফিরতে ফিরতে শুনতে পেলাম মাইকে ভেসে আসছে ‘হাম লড়েঙ্গে’, সাথে সাথে শাহিনবাগের মাঠে প্রতিধ্বনিত হল ‘হাম জিতেঙ্গে’ শ্লোগান।
- মিতালী