প্রথম কবিতার বই ‘চালিনেগালু’ (ক্যাম্প ফায়ার) বেরিয়েছিল ১৯৬৮-তে। শেষ সংকলন ‘বীজভূমি’ ২০১৪-য়। এই অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে পাঠকের কাছে ভারভারা রাও পরিচিত প্রতিরোধের কবিতাকার হিসাবে। যাঁরা তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁরাও আজকে তাঁর নাম জানেন – জর্মনির রাইখস্ট্যাগ ট্রায়ালের আদলে সাজানো ভীমা কোরেগাঁও ও প্রধানমন্ত্রী হত্যা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত একজন বন্দী হিসাবে! বন্দিত্ব অবশ্য তাঁর কাছে নতুন কোনও বিষয় নয়, বর্ষীয়ান এই কবি সেই ১৯৭৩ থেকে গ্রেফতার হয়েছেন, বহু দফায় কারাবন্দী থেকেছেন বহু বছর, যতদিন এ’দেশের আর কোনও কবিকে থাকতে হয়নি। প্রাথমিকভাবে যাঁরা তাঁর কবিতাকে জানেন, তাঁদেরও সকলে হয়তো জানেন না তেলুগু সাহিত্যে আলোচক ও প্রাবন্ধিক হিসাবে এই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ কবির জায়গা কতটা উঁচুতে। তেলুগু সংস্কৃতিতে মৌখিক ভাষ্য বিষয়ে তাঁর পোস্ট ডক্টরাল পেপার, এবং পরবর্তীতে তাঁর থিসিস ‘তেলেঙ্গনা মুক্তিসংগ্রাম ও তেলুগু উপন্যাস : সমাজ ও সাহিত্যের আন্তঃসম্পর্কের একটি পাঠ’ সমকালীন মার্কসীয় সাহিত্যচর্চায় মাইলফলক বলে ধরা হয়। ১৯৬৬ থেকে ‘৯২, ভারভারা রাও প্রতিষ্ঠিত, সম্পাদিত স্রুজনা পত্রিকা আধুনিক তেলুগু সাহিত্য চর্চার সবচেয়ে মননশীল সাময়িকী বলে বিবেচিত হয়েছে। সমকালীন বিশ্ব প্রতিরোধ সাহিত্যের সঙ্গে তেলুগু পাঠকদের পরিচয় করিয়ে গেছেন ধারাবাহিকভাবে, জেলে বসেও অনুবাদ করেছেন কেনিয়ার সাহিত্যিক ঙ্গুগি ওয়া থিংগো-র উপন্যাস ‘ডেভিল অন দ্য ক্রস’ বা জেল ডায়েরি ‘ডিটেইনড’। তাঁর নিজের কারাবাসের দিনলিপি (সহচরলু) ‘ক্যাপটিভ ইমাজিনেশন’ নামে অনুদিত হয়ে আন্তর্জাতিক পাঠকের সম্ভ্রম আকর্ষণ করেছে। মার্কসবাদে আস্থাশীল কবি ভারভারা রাও কোনোদিন তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসকে লুকোতে চাননি, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আর দিন বদলের যে কোনো সংগ্রামের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে সমর্থন জুগিয়েছেন, সরব ও সক্রিয় থেকেছেন। ১৯৬৭-তে নকশালবাড়ির ও সেই ধারায় গড়ে ওঠা শ্রীকাকুলামের কৃষক সংগ্রাম যখন ভারতীয় রাজনীতিতে একটি নির্ণায়ক বাঁকবদল ঘটিয়েছিল, অন্ধ্রপ্রদেশের প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীদের বড় অংশটাই সে সময়ে পক্ষ অবলম্বনে দ্বিধা করেননি। মহাকবি শ্রী শ্রী, কুটুম্ব রাও, রামান্না রেড্ডি, রচকোন্ডা বিশ্বনাথ শাস্ত্রীর মতো তেলুগু সাহিত্যের দিকপালদের সাথে মিলে যে তরুণেরা ১৯৭০-এর সেই আগুন ঝরানো সময়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘বিপ্লবী রচয়িতল সংঘম’ (Revolutionary Writers Association নামে যা দেশ জুড়ে পরিচিত) - তাদের দুই অগ্রণী মুখ ছিলেন কবি চেরাবান্দারাজু ও ভারভারা রাও। চেরবন্ডারাজুকে রাষ্ট্র বাঁচতে দেয়নি, একে একে চলে গেছেন অগ্রজেরা, নতুন নতুন কবি ও লেখকেরা এসে দাঁড়িয়েছেন ওই কাতারে – আর সেই সময়ের সঙ্গে আজকের সেতু হিসাবে থেকে গেছেন ভারভারা রাও, দ্রোহকালের ভাষ্যকার হয়ে, অবিচ্ছিন্নভাবে। জীবনের প্রতি গভীরতম ভালোবাসা, ভবিষ্যতের প্রতি অটুট বিশ্বাস আর প্রতিবাদে নিঃশঙ্ক বুক যে দ্রোহী ভাষার জন্ম দেয়, তাকে অবজ্ঞা করা স্বৈরাচারের পক্ষে সত্যিই কঠিন। তাই, আজ আশি পেরোন বয়সে বন্দী রেখে, জেল থেকে জেলে ঘুরিয়ে কবি ভারভারা রাওয়ের জীবনীশক্তিকে নিঙড়ে নেওয়া হচ্ছে, যাতে জেলের বাইরে বের করার আগে তাঁর মৃত্যুশয্যায় শোওয়া নিশ্চিত করা যায়। ঠিক যে পরিণতি হয়েছিল তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা চেরাবান্দারাজুর।
আজ যদি আমরা ভারভারা রাও-এর মুক্তির দাবিতে মুখ না খুলি, তা’হলে কাল ঐ জেলের দেওয়াল চারপাশ থেকে চেপে ধরে আমাদের শ্বাসরুদ্ধ করে দেবে। আমরা, পশ্চিমবাংলার কবি, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা সব সময়েই চেয়েছেন বিদ্রোহের কবিতা মুক্ত হোক। আজ আরো একবার তাঁদের বিবেক জেগে উঠুক ভারভারা রাওয়ের সসম্মান মুক্তির দাবিতে। “কবিকে মুক্ত কর, মুক্ত কর অন্ধকারের এই দ্বারকে” – এই স্বর সমস্বর হয়ে জেগে উঠুক, প্রতিবাদ হয়ে ফেটে পড়ুক, দাবি হয়ে আঘাত করুক শাসকের বধির কানে।
(‘কবিকে মুক্ত কর’ উদ্যোগের পক্ষে এই আহবান রাখা হচ্ছে) কলমে- শুদ্ধব্রত দেব।