খবরা-খবর
শান্তি ও ন্যায়ের জন্য দিল্লীর উদ্যোগ

গত সপ্তাহে দিল্লীতে কপিল মিশ্রের মতো বিজেপি নেতাদের জ্বালা-ধরানো মন্তব্য মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক সাম্প্রদায়িক হিংসায় ইন্ধন জোগায়। উত্তর-পূর্ব দিল্লী, বিশেষ করে যে সব নির্বাচন কেন্দ্রে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছে সেখানে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ লুঠতরাজ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। অন্তত ৩৫ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে একজন পুলিশ কনস্টেবল ও একজন ইনটেলিজেন্স অফিসারসহ কয়েক জন হিন্দু, বেশিভাগই মুসলিম। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশু এবং ৮৫ বছরের এক বৃদ্ধাও আছেন যাকে তার নিজের বাড়িতেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে।

দিল্লী পুলিশের ভূমিকা ছিল সাম্প্রদায়িক হিংসোন্মত্ত জনতাকে আগলে রাখা, মদত দেওয়া এমনকি তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া পর্যন্ত। দিল্লী পুলিশ বিজেপি নেতাদের গ্রেফতারের জন্য আঙুলটিও তোলেনি যারা প্রকাশ্যে হিংসার হুমকি দিয়েছিল। বরং পুলিশ দাঙ্গাকারীদের পরিচিতি গোপন রাখার জন্য সিসিটিভি-র ক্যামেরাগুলোকে নষ্ট করে ফেলেছে, ইসলাম-বিতৃষ্ণা সূচক কুমন্তব্য করেছে, প্রকাশ্যে মুসলিমদের অপমান করেছে, মেরেছে, মিথ্যা অজুহাতে তাদের  গ্রেফতার করেছে। আর মুসলিম বাড়িগুলিতে চড়াও হয়ে মুসলিম-বিরোধী জনতাকে সেখানে লুঠপাট করার সুযোগ করে দিয়েছ।

এই পরিপ্রেক্ষিতে, সিপিআই(এমএল) কর্মীরা হিংসার শিকার মানুষজনকে উদ্ধার করা ও ত্রাণ দেওয়া, ঘৃণার কারবারি এবং দাঙ্গাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য চাপসৃষ্টি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি এবং অবশ্যই দিল্লীর বাকি অংশে হিংসা যাতে আর না ছড়াতে পারে তার জন্য প্রতিরোধ গড়ার উদ্দেশ্যে, অন্যান্য বাম ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের সঙ্গে একযোগে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

২৫ ফেব্রুয়ারী সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরোর সদস্য এবং অ্যাপোয়া-সচিব কবিতা কৃষ্ণাণ, উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ ও মহিলা-অধিকার কর্মীদের এক প্রতিনিধিদলে যোগ দিয়ে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। প্রতিনিধিদল দিল্লী সরকারের কাছে আরও নজরে পড়ার মতো, আরও অনেক বেশি তৎপরতায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলিষ্ঠ আবেদন জানান যাতে হিংসা বন্ধ হয়, আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও শান্তি ফিরে আসে এবং অসুরক্ষিত, দুর্বল,অসহায় নাগরিকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা যায়।

সেখানে আলোচিত প্রস্তাবগুলি হল:

(১) উপদ্রুত অঞ্চলগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী এবং বিধায়কদের পরিদর্শনে যাওয়া যাতে সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্বল মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে নৈতিক নেতৃত্বের এক কড়া বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। (২) মুখ্যমন্ত্রী এবং বিধায়কদের পক্ষ থেকে প্রতিটি মহল্লায় নাগরিকদের কাছে অতি সক্রিয়তার সঙ্গে শান্তি সুনিশ্চিত করা ও প্রতিটি মহল্লায় প্রতিটি সম্প্রদায় থেকে দুর্বল সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার আর্জি জানিয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ভিডিও বার্তা ও আবেদন প্রকাশ করা। (৩) মুখ্য শান্তি-রক্ষা কেন্দ্র ও নিরাপদ আবাসসমূহ (দিল্লী সরকারের বর্তমান পরিকাঠামোর অপ্রতুলতায়)। (৪) এস ও এস কলগুলি (যেগুলি দিল্লী সরকারের তরফ থেকে সরাসরি পুলিশকে পাঠাতে হবে) নেওয়ার জন্য হেল্পলাইন (এক বা একাধিক)।

এই প্রতিনিধিদল, অধিকতর শঙ্কা জনক প্রাথমিক রিপোর্ট এসেছে যেসব অঞ্চল থেকে তার কয়েকটিতে সরকারের হস্তক্ষেপের অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন জানিয়ে সাম্প্রতিকতম তথ্য পেশ করেছে;

যেমন মুস্তাফাবাদে এ আই হিন্দ হাসপাতালে গুলিতে আহতদের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ও সার্জনদের (শল্যচিকিৎসক) পৌঁছাতে দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে।

প্রতিনিধিদল আশা প্রকাশ করেছে যে ‘আপ’ সরকার দিল্লীতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া, (হিংসার) ক্রমবৃদ্ধিকে কঠোরভাবে রোখা এবং শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অনেক বেশি তৎপর ভূমিকা নেবে।

এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন ফারা নাকভি, বৃন্দা গ্রোভার, কবিতা কৃষ্ণাণ, ভাষা সিং, আয়েশা কিদোয়াই, সরোজিনী নাদিমপল্লী, নভশরণ সিং, তানিয়া ভার্গব, প্রতীক্ষা বক্সী, ইন্দিরা উন্নিনায়ার, রত্না আপ্পেন্দার, মায়া জন এবং পুনম কৌশিক।

kavita

 

২৬ ফেব্রুয়ারী দিল্লীর নাগরিকরা শান্তি ও ন্যায়ের জন্য যন্তর মন্তরে ধর্ণা অবস্থান করেন। এই অবস্থান পরিচালনা করেন কবিতা কৃষ্ণাণ (অ্যাপোয়া), এ আর সিন্ধু (সিটু) এবং অ্যানী রাজা (এন এফ আই ডব্লু)।

কানোয়ান-ই-মোহব্বত থেকে নভশরণ বলেন কীভাবে নাগরিক সমাজের কর্মীরা চিকিৎসক দল, আইনজীবী, প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহকারী দলের উপস্থিতি সুনিশ্চিত করার জন্য এবং একই সাথে হিংসার শিকার মানুষজনের ত্রাণ ও উদ্ধারের জন্য রাতভর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বৃন্দা গ্রোভার বলেন, ১৯৮৪-ই হোক বা আজ ২০২০-ই হোক — দিল্লী পুলিশ অযোগ্য ছিল না — উপরতলা থেকে তাদের উপর নির্দেশ ছিল মুসলিমদের আক্রমণকারী জনতাকে সুবিধা করে দেওয়ার। শশীকান্ত সেন্থিল, যিনি সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আইএএস থেকে পদত্যাগ করেছেন, ব্যাঙ্গালোর থেকে দিল্লী এসেছিলেন ত্রাণের উদ্দেশ্যে এবং এই সমাবেশে বক্তব্য রাখার জন্য।

সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং সিপিআই সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা বিজেপি’র ঘৃণার কারবারিদের গ্রেপ্তারে ও হিংসাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করেন। সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, এই হিংসা ছিল বিজেপির দিল্লী নির্বাচনের জনাদেশকে নাকচ করার চেষ্টা।

sit

 

তিনি আরও বলেন, সিপিআই(এমএল) এবং তার ছাত্র ও যুব সংগঠন, তার ট্রেড ইউনিয়নগুলি হিংসাকে রোখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে। আর তার সাথে সমাজের গভীর থেকে গভীরে থাকা সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ভাবনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। সিপিআই(এম)-এর বৃন্দা কারাত বিভিন্ন হাসপাতালে হিংস্র তাণ্ডবের শিকার আহতদের দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা শোনান। সৈয়দা হামিদ এবং গওহর রাজা কবিতা আবৃত্তি করেন; সাংওয়ারী শান্তি সম্প্রীতি ও ন্যায়ের আবেদন রেখে গান গেয়েছেন।

এই সমাবেশ থেকে কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর এবং বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী অন্যান্যদের গ্রেফতার, অমিত শাহ ও দিল্লীর পুলিশ প্রধানের পদত্যাগ এবং অবিলম্বে হিংসা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। হিংসার শিকার যারা তাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। এই সমাবেশ সংকল্প নিয়েছে গোটা দিল্লী জুড়ে, প্রত্যেকে তাদের নিজেদের মহল্লায়, কর্মস্থলে শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য, সংখ্যালঘু মুসলিমরা যাতে নিজেদের সুরক্ষিত ভাবতে পারেন এবং দিল্লীতে কোনোমতেই ১৯৮৪ (দিল্লী) বা ২০০২ (গুজরাট)-এর পুনরাবৃত্তি হবে না তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবে।

jantar mantar

 

খণ্ড-27
সংখ্যা-6