৪ মার্চ সমাপ্ত হল এআইসিসিটিইউ-র তিন দিনব্যাপী দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন। ২ মার্চ থেকে নৈহাটির বুকে শুরু হওয়া এই সম্মেলনের সূচনা ঘটে এক বর্ণাঢ্য মিছিল ও শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। প্রকাশ্য অধিবেশনে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেতা নেত্রী, বিদেশি প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন, যার রিপোর্ট বিগত সংখ্যার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের মধ্যে এবার উপস্থিত ছিলেন এলপিএফ-এর সাংগঠনিক সম্পাদক ভি ভেলুস্বামী। প্রকাশ্য অধিবেশন পরিচালনা করেন বিদায়ী সর্বভারতীয় সভাপতি প্রবীণ নেতা এনএন ব্যানার্জি।
দেশব্যাপী প্রায় ৬০০ প্রতিনিধির অংশগ্রহণে সর্বভারতীয় সম্মেলন নির্বাচিত করল ১৮৭ সদস্যবিশিষ্ট এক জাতীয় কাউন্সিল, কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি এবং অফিস বেয়ারারদের কমিটি। নব নির্বাচিত সর্বভারতীয় সভাপতি হলেন ভি শংকর, আর সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পুনর্নিবাচিত হলেন রাজিব ডিমরি।
বিভিন্ন ফেডারেশন থেকেই প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশ নেন, যার মধ্যে রয়েছে রেল-স্কিম-নির্মাণ-পুরসভার কর্মীরা। এ ছাড়াও প্রতিরক্ষা-পরিবহনের মতো সংগঠিত ক্ষেত্রের পাশাপাশি বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরাও অংশ নেন এই সম্মেলনে।
কয়েকদিন আলাপ আলোচনা, বিতর্কের পর সম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে বেশ কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করে। শ্রমিক আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করা এবং ধ্বংসকারী সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে পাশ হয় বেশ কিছু প্রস্তাবনা। কাশ্মীরের ঘটনাক্রম নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হয় এবং জেল বন্দি রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষের মুক্তির দাবি তোলে এই সম্মেলন। দিল্লিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গণনিধনে নিহত মানুষদের প্রতি সম্মেলন শোক প্রকাশ করে, যাতে বেশির ভাগ সংখ্যালঘু মানুষ মারা যায় এবং অবিলম্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর পদত্যাগের দাবি জানায়।
সম্মেলন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, ২৬ হাজার টাকা ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানায়, শ্রম কোড বিলগুলোর অবিলম্বে প্রত্যাহারের পাশাপাশি সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলা ও সংখ্যালঘুদের উপর নেমে আসা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট হামলা রুখতে শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। স্কিম কর্মীদের মধ্যে থেকে উঠে আসা বিভিন্ন নেতা নেত্রী তাদের আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। রেলের বিভিন্ন জোন ও উৎপাদন ইউনিটের কর্মীরা বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটকরণের হাত থেকে রেলকে বাঁচাতে গুরুত্ব আরোপ করেন।
ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ, ব্যাঙ্ক-রেল-প্রতিরক্ষা ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ, দেশের সমস্ত সম্পদকে বেচে দেওয়ার মোদী সরকারের চক্রান্তের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই চালাবার সংকল্প নিয়েছে দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন। বিভিন্ন রাজ্য থেকে উঠে আসে সমকাজে সমমজুরী ও কন্ট্রাক্ট প্রথাকে তুলে দেওয়ার দাবি। সর্বত্রই কন্ট্রাকচ্যুয়াল-অস্থায়ী দৈনিক মজুরি প্রাপক শ্রমিকরা উন্নত মজুরি, স্থায়ী কাজ, সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে যে আন্দোলন চালাচ্ছে, তাকে সমর্থন করার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি এই সম্মেলন জানিয়েছে। ভীমা কোড়েগাঁও এর কর্মীদের উপর রাষ্ট্রীয় দমন, দেশদ্রোহী মামলায় যাকে তাকে আটক করা, গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করে এমন সমস্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সম্মেলন সংগ্রাম সংগঠিত করার আওয়াজ তুলেছে। নিয়োগ ও পদন্নোতিতে সংরক্ষণের প্রশ্নে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে সম্মেলনে আলোচনা হয়। প্রতিনিধিরা মনে করেন, এই সমস্ত রায় ও মোদী সরকারের পলিসি সামাজিক ন্যায়ের উপর বিরাট আঘাত নামিয়ে আনবে। সামাজিক ন্যায়ের উপর নেমে আসা আঘাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে সম্মেলন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্রমবর্ধমান ফ্যাক্টরি দুর্ঘটনা, সাফাই কর্মীদের মৃত্যু, কর্মস্থলে এমনকি খনি ও নির্মাণ কাজের জায়গায় একের পর এক দুর্ঘটনা ব্যাপক পরিসর জুড়েই চরমভাবে ধিক্কৃত ও নিন্দিত হয়েছে। সুরক্ষিত কর্মসংস্থানের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, এআইসিসিটিইউ তার পুরোভাগে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মহিলা শ্রমিকদের বিভিন্ন বিষয়, এলজিবিটি আই কিউ সম্প্রদায়ের মানুষজনের মর্যাদাপূর্ণ চাকুরির সুযোগ-সুবিধা নিয়েও আলাপ আলোচনা হয়। কর্মস্থলে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার যে প্রাধান্য থাকছে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত সম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে নিয়েছে।
নানান সংযোজনী সংশোধনী গ্রহণ করার পর সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক রাজিব ডিমরি সংবিধানের উপর আনা কয়েকটি সংশোধনী সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও শ্রমিক স্বার্থবাহী প্রস্তাবনা পেশ করেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
মোদী সরকারের ফ্যাসিস্ট হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সমাপ্তি ভাষণ দেন নব নির্বাচিত সভাপতি ভি শংকর। সম্মেলনকে সফলভাবে সম্পন্ন করতে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে নেপথ্যে থেকে উঃ ২৪ পরগনার সিপিআই(এমএল) নেতা-কর্মী, আইসার ছাত্রছাত্রী, সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের কর্মী সহ সমাজের নানা স্তরের কারিগরেরা দিবারাত্রি নিরলস পরিশ্রম করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। সম্মেলন সেই সমস্ত স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মান জানায়। উদ্দীপ্ত শ্লোগান ও সমবেত আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘোষণা করে ৩ দিনের সর্বভারতীয় সম্মেলন।