স্বাধীনতা মানুষের মনে একটি খোলা জানালা, যেই দিক দিয়ে মানুষের আত্মা ও মানব মর্যাদার আলো প্রবেশ করে। একথাটি হার্বার্ট হুভার এর মতের সঙ্গে একমত পোষণ করে আলোচনা করা যেতে পারে বাংলাদেশের অর্জিত হওয়া ‘স্বাধীনতার ইতিহাস’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার গুরুগম্ভীর আলোচনার ইস্যু ও প্রেক্ষাপট ১ দিন কিংবা ১ মাসে আলোচনা করেই তাকে শেষ করার ইতিহাস নয়। তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে প্রতিটা দিন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমেই বিভিন্ন কর্মে। বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়েই অর্জিত হয় এই স্বাধীনতা, দিনের পর দিন রাতের পর রাত বহু সংগ্রামের মাধ্যমেই পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করেই যেন এ সোনার বাংলা স্বাধীনতা অর্জন করে। আর তাকে রক্ষা কিংবা সুসংহত করার জন্যই জাতীয় জীবনে অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। স্বাধীনতাকে রক্ষা করে তা ফলপ্রসূ করতে হলে প্রয়োজন হয় জাতীয় ঐক্য। কিন্তু এ দেশের সকল জনগণ আজো কি সে ঐক্যটা নিশ্চিত করতে পেরেছে। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বনির্ভরতা অর্জন কিংবা এমন এই দেশে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান সহ চিকিৎসার মান উন্নয়নে সব শ্রেণী পেশার মানুষ একত্রিত হতে পেরেছে। বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতার অভিজ্ঞতা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন হলেও তাকে রক্ষা ও ফলপ্রসূ করার কাজটাও অনেক কঠিন। তাই মিল্টন বলেছিলেন, স্বাধীনতা মানুষের প্রথম এবং মহান একটি অধিকার। সেই অধিকারের জায়গাতেই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকতে হবে। উন্নয়নের প্রতি সকল মানুষের সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ দূর করতে হবে। তবেই তো স্বাধীনতার মূল্যায়ন হবে। এদেশের স্বাধীনতার মর্যাদা সকল জাতিকেই ধরে রাখতে হবে।
ইতিহাসের আলোকেই জানা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, সেই দেশেটির নাম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের এমন এই দিবসটিকে ঘিরেই রচিত হয়েছে ‘স্বাধীনতা’। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথাটি মনে পড়ে, তাহলো – এই দেশের অসংখ্য ‘দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মদান’। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার সমস্ত মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের গ্লানি থেকেই মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙানো স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচাইতেই গৌরবময় এবং পবিত্রতম দিন। সুতরাং ২৬ মার্চ, আমাদের “মহান স্বাধীনতা দিবস’’। বাংলাদেশে ২৬ মার্চ বা স্বাধীনতা দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকেই এ দেশে স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয় ভাবে পালন হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের একটি বিশেষ দিন। এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনার মূল্যায়ন করে চিত্রশিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, কবিতায়, নিবন্ধ বা গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমেই যেন গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তুলেছে। এমন দিন উপলক্ষেই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী’র জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারেও – স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের নানা আয়োজন হয়। তা ছাড়াও দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ সহ আলোচনা অনুষ্ঠান, মত বিনিময় সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। দেশের প্রধান সড়কগুলিতে জাতীয় পতাকা দিয়েও সাজিয়ে থাকে। এইদিনে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেওয়া স্বাধীন-সার্বভৌম এদেশ আজ গর্বের দেশ। বলতেই হয় ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করার এ গৌরবময় দিনটিই যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবেই সমাদৃত।
মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। তার এই জন্মগত অধিকার যখন অন্যের দ্বারা লুণ্ঠিত হয় তখনই সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সব কিছুর বিনিময়েই যেন নিজ স্বাধীনতা এবং স্বদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলেছেন যে, এখনতো চারি দিকে রুচির দুর্ভিক্ষ!! একটা স্বাধীন দেশে সু-চিন্তা আর সু-রুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না। স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনা যদি করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, বাংলার দুঃখী মানুষের ভাগ্যটা আজও অপরিবর্তনীয়। আজও সমাজব্যবস্থাটা মুখ থুবড়েই পড়েছে। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় জীবনে নানা কারণেই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা মাথা তুলেও দাঁড়িয়েছে। কলে-কারখানায়, অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজ এবং খেলার মাঠ সহ ঘরে-বাইরের সর্বত্রই শৃঙ্খলার অভাব প্রকট। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে স্বার্থান্বেষী মানুষ এদেশের স্বাধীনতাকে নষ্ট করেই মেতে উঠেছে ক্ষমতাধর হওয়ার প্রতিযোগিতায়। কল্যাণমুখী রাজনীতিটাও যেন হয়েছে কলুষিত। সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজকে দুর্নীতির থাবা বিস্তার করেছে। তার ফল হয়েছে ভয়াবহ। শিক্ষার ক্ষেত্রে, সমাজ-জীবনের অলিতেগলিতে উচ্ছৃঙ্খলতার ভয়াবহতা বিস্তার ঘটছে। খুনখারাপি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, শ্লীলতাহানি চলে প্রতিদিন। সামাজিক স্বার্থ ভুলেই যেন ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জঘন্য প্রবণতায় সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। স্বাধীন দেশের চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য জাতীয় জীবনের অপমৃত্যুর ঘণ্টা ধ্বনি। একটু ইতিহাসে অগ্রসর যাওয়া যাক, সেই স্বাধীনতা অর্জনকারী মানুষ, আর এই সময়ের মানুষের চিন্তাচেতনার বিস্তর ফারাক। তবুও আমরা স্বাধীন তাই স্বাধীনতার কথা বলতেই হয়। জানা প্রয়োজন যে, – ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর এ বাঙালি জাতি দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শোষকের বর্বরোচিত শোষণের নির্মম শিকার হয়ে ছিল। সেই পরাধীনতার শৃংখলেই যেন আবদ্ধ বাঙালি- ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ’ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যেন মৃত্যুপণ সংগ্রাম শুরু করেছিল। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা।
এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমিকে নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, – বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্ন বীজ মূলত বপন করা হয়ে ছিল সেই – ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময়ে। ১৯৪৭-এর পরবর্তীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন দেখা দিতো ক্রমাগত শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য মূলক আচরণ, ন্যায্য অধিকার প্রদানে অস্বীকৃতিসহ ইত্যাদি বিষয় নিয়েই আন্দোলনের যাত্রা অনেক ত্বরান্বিত হয়ে ছিল। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এমন সংগ্রাম ১৯৭১ সালে এসেই যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেছিল। অতএব বাঙালিরা অনিবার্য মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিল বাংলা ভূখন্ড। ১৯৭১ সালে মার্চ ছিল- উত্তাল, উত্তেজনায় ভরপুর এবং অনেক ভয়ংকর। ২৫ মার্চ রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুুর রহমানকে গ্রেফতার করে খুবদ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আর তিনি গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এই বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ করেও যান। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই যেন – মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সংগঠকবৃন্দ অস্থায়ী মুজিবুনগর সরকার গঠন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধেই তীব্র থেকে তীব্রতর উত্তাল আন্দোলন গড়ে তোলে। এই দেশের সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, বন্ধু রাষ্ট্র সমূহের সর্বাত্মক সহায়তা বা বিশ্বগণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকাসহ ৩০ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে “স্বাধীন হয় বাংলাদেশ”।
এ দেশের তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলে আরো একটু বিস্তারিত আলোচনার দিকে যেতেই হবে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-বেনিয়াদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও যোজন-যোজন দূরত্ব সত্ত্বে শুধুমাত্রই ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশকে নিয়ে গঠিত হয় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান। অদ্ভূত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যেন পাকিস্তানের শাসকদের অনাচার-অত্যাচার চলতে থাকে আর সর্বক্ষেত্রেই অনেক বৈষম্য-বঞ্চনার স্বীকার হয় “বাঙালি জাতি”। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা কেবল অর্থনৈতিক শোষণই নয় বাঙালি সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের ওপরে নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই ‘সর্ব দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি – পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করেছিল।
১৯৫২ সালে উর্দুকে আবারও রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা যেন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতেই ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা ছাত্রজনতাদের মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হয়েছিল : রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত সহ আরও অনেকে। শহিদদের এই পবিত্র রক্তই যেন আজ বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকার ছবিও এঁকে দেওয়া হয়েছে। এই বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের অজস্র রক্তের বিনিময়েই যেন অর্জিত স্বাধীনতা, যা কারো ব্যক্তিগত বা দলগত চোরাবালিতেই যেন পথ না হারায়, সেই প্রচেষ্টায় থাকতে হবে। অন্যথায় এই স্বাধীনতার ভাব-মূর্তি অনেকাংশেই ক্ষুণ্ণ হবে কিংবা বাঙালি জাতির ভাগ্যেও অশনি সংকেত দেখা দিতেই পারে বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাঙালি জাতি যেন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। বলতেই হয় এমন দেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্তপূরণ করার এক বৃহৎ সক্ষমতা অর্জন করেছে। সব জাতি গোষ্ঠীরা মিলে মিশেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই তো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ স্বাধীনতার মূল্যবোধ রক্ষায় যত্নবান হওয়া যাবে। তবেই স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অর্থবহ।
এই দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে অল্প কথায় শেষ করা যাবে না। আরো জানা দরকার ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে ছিল। আর মুসলিম লীগের অসহায় ভরাডুবিতে নড়বড়ে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত। ১৯৫৬ সালেও পুনরায় সরকারী ভাষায় নানা বিতর্ক, আইয়ুব খান-এর অপশাসন, পাঞ্জাবি কিংবা পশতুনদের ঋণ বাঙালিদের ওপর জোর পূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কারণেই যেন বাঙালিদের মনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। ১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি উত্থাপিত হয়ে ছিল। গণ বিক্ষোভ প্রতিহত করতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসনের মাধ্যমে যেন স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপরেই চালাতে থাকে বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার, নিপীড়ন। ১৯৬৮ সালে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কালজয়ী নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মিথ্যা, সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি অপশক্তি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুসহ আর যারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটেই জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরে ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল সমাবেশের ডাক দেন। সমাবেশের ঐতিহাসিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিল, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, আরো বলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান’। এ উদাত্ত আহ্বানের জন্যই যে অপেক্ষা করেছিল বাঙালি। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। সর্বত্রই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।
২৫ মার্চ রাতে ‘‘অপারেশন সার্চলাইট’’-এর পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট একজন রাজনীতিবিদকে হত্যার করবার সিদ্ধান্ত ছিল সেই সামরিক কর্তৃপক্ষের। তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যটাই ছিল যেন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রের প্রধান পরিকল্পনাকারী’ ও লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির একজন আহ্বায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া। সেই সময়েই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল অনেকে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট টার্গেট – মোয়াজ্জেমকে ২৫ মার্চ সূর্য ওঠার আগে তাঁকে যেন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় সেই ঘাতকেরা পিস্তল দিয়ে পরপর ৫ টি গুলি করে এবং তারা মৃতদেহটি সঙ্গে করেও নিয়ে যায়। তাঁর লাশ আর পাওয়া যায়নি। সেই ২৫ মার্চের অন্ধকার রাতে বর্বর পাকিস্তানি পশুশক্তিই নিরস্ত্র-ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যটাই ছিল যেন আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন এবং কল্যাণমুখী, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশের মানুষের “মৌলিক অধিকার কিংবা ন্যায়সংগত অধিকার” নিশ্চিত করবার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়’কে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যটাই এই স্বাধীনতা। শোষণ, বৈষম্য এবং অন্যায় এর অবসান ঘটিয়ে যেন ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল ‘স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য’।
জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। এ দিনটি বাঙালির জীবনে বয়ে আনে আনন্দ-বেদনার অম্ল-মধুর অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়ে যেন স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দটা বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। এমন বাঙালি স্বাধীনতা পেয়েও কিন্তু সুখী-সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বের দুর্বিপাকে এখনও যেন ঘুরপাক খাচ্ছে বাঙালি। দেখা যায়, আজো মূল্যবোধের অবক্ষয়, হিংসাত্মক অপরাজনীতি, লেজুড় বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি কিংবা সীমাহীন দুর্নীতিসহ নানা বিষয়েই যেন স্বাধীনতার স্বপ্ন আজও বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরে আছে। স্বাধীনতার চেতনা দিনে দিনেই ম্লান হয়ে আসছে আর আমরা ক্রমশই যেন পিছিয়ে যাচ্ছি। সংকট গুলো উত্তরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশার কথা হলো, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতার ব্যাপারেই যথেষ্ট আগ্রহী। এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেই এই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। এ জন্যেই এদের হাতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসটিকে তুলে দেয়া জরুরি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধা যারা রয়েছেন, তাদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস সংগ্রহ করে ইতিহাসবিকৃতি রোধে ব্যাপক কাজ করা প্রয়োজন। দল ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চারও প্রয়োজন রয়েছে। গণতন্ত্রকে সর্বস্তরে পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আজও যেন রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব অনেক পীড়াদায়ক। এ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষের শক্তিতে যেন আজও ‘দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি’ নিয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেই দিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে। আমাদের সামনে সম্ভাবনা অসীম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবেই সব সমস্যা মোকাবেলায় সচেষ্ট হই তাহলেই স্বাধীন দেশের “উন্নয়ন বা অগ্রগতি’’ আশা করা যায়। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন যে, আমি আমার নিজের বাংলাদেশকে নিয়ে অসম্ভবরকম আশাবাদী৷ আমাকে যদি একশোবার জন্মাবার সুযোগ দেওয়া হয় আমি একশোবার এই দেশেই জন্মাতে চাইব৷ এই দেশের বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব৷
এই দেশের বাঁশবাগানে জোছনা দেখতে চাইব –
বিভেদ ভুলে আমরা সে পথেই অগ্রসর হব –
এই হোক স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার।