ভারতের সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ১০০ বছরে পা রাখলো। আর, এআইসিসিটিইউ অতিক্রম করল দীর্ঘ ৩০ বছরের যাত্রাপথ। সারা দেশ জুড়ে নেমে আসা ফ্যাসিস্ট মোদী সরকারের দানবীয় অত্যাচার ও এ যাবৎ অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিভূমিতে বিরাট আঘাত হেনে হিন্দু রাষ্ট্রের অভিমুখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মোদীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আজ জেগে উঠেছে গোটা দেশ। আসমুদ্র-হিমাচল জুড়ে জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা নতুন এক অর্থ, বহুমাত্রিক অনুরণন নিয়ে আছড়ে পড়েছে প্লাবন রূপে। এরকমই এক প্রেক্ষিতে নৈহাটিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এআইসিসিটিইউর দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন।
দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আট শতাধিক প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক নিয়ে ২-৪ মার্চ এই সম্মেলন হবে। এই প্রথম জম্মু কাশ্মীর থেকে প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দেবেন। সন্তোষ কুমারী দেবী, যিনি ভারতের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রথম মহিলা নেত্রী ও সংগঠক ছিলেন, তাঁর নামেই নামাঙ্কিত করা হয়েছে নৈহাটিকে। আর, আমাদের অতি প্রিয় নেতা ধুর্জটি প্রসাদ বক্সী ও স্বপন মুখার্জির নামে উৎসর্গ করা হয়েছে সভাঘর এবং সভামঞ্চ নামাঙ্কিত করা হয়েছে রাজ্য এআইসিসিটিইউ-র প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন বসু এবং উত্তর প্রদেশের বর্ষিয়ান প্রয়াত নেতা হরি সিংকে মনে রেখে।
সম্মেলনের প্রথম দিন সংগঠিত হবে শ্রমিকদের দৃপ্ত মিছিল। তারপর, প্রকাশ্য অধিবেশনে অংশ নেবেন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি কাজ। আমাদের দেশে প্রথম সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র গঠন হওয়ার অনেক আগে থেকেই পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে সহজাত শ্রেণীবোধ থেকে ভারতের শ্রমিক শ্রেণি আন্দোলন, ধর্মঘট সংগঠিত করতে শুরু করে দেয়। ভারতে প্রথম বড় মাপের ধর্মঘট শুরু করেন হাওড়ার রেল শ্রমিকরা, ১৮৬২ সালে, আট ঘন্টা কাজের দাবিতে। ১৮৮২-১৮৯০ পর্যায়ে গোটা দেশ জুড়ে প্রায় ২৫টা ধর্মঘট হয়। এই সময়ে ধর্মঘটগুলোর ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, স্বল্প মেয়াদের (তিন দিনের কম), একটা কারখানা বা একটা ডিপার্টমেন্টে সীমাবদ্ধ থাকতো, আর, সমস্ত ক্ষেত্রে কাজের ঘণ্টা, কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পের দাবিকে কেন্দ্র করেই হতো। সেই সময় মালিকপক্ষ ও সদ্য আত্মপ্রকাশমান শ্রেণিটিকে মোকাবিলা করতে তৈরি করতে লাগলো নিজেদের সংগঠন। এই সময়ে গড়ে ওঠে বম্বে ও বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স, বম্বে মিল মালিকদের সমিতি, ইন্ডিয়ান জুট মিলস এসোসিয়েশন, ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স।
১৯০০-র পর থেকে ব্রিটিশরা ভারতে শিল্প স্থাপনের বড়-সড় কর্মকান্ড গ্রহণ করে। আর, বলা যায়, সেই সময়, অর্থাৎ, ১৯০০-১৯১৪ পর্যায়ে ভারতে শুরু হয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা ও আন্দোলন সংগঠিত করার পালা। ১৯০৫ সালে বিদ্যুৎ প্রচলনের হাত ধরে বাড়তে থাকলো কাজের বোঝা ও শ্রম সময়কে দীর্ঘ করার ব্রিটিশ মালিকদের কৌশল। এর বিরুদ্ধে নানা প্রান্তে শ্রমিকরা ধর্মঘট সংঘটিত করতে জোট বাঁধেন। মাদ্রাজের সরকারি ছাপাখানার প্রেস ও মেশিন সেকশন ১৯০৩ সালে ৬ মাস পর্যন্ত ধর্মঘটে সামিল হন, বাড়তি মজুরি না দিয়ে ওভার টাইম করানোর প্রতিবাদে। ১৯০৫ সালে কলকাতার সরকারি ছাপাখানার প্রায় দু’ হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে সামিল হন। আর এর প্রক্রিয়ায় সর্বভারতীয় স্তরে সর্বপ্রথম ছাপাখানার শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে ওঠে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু হয় ১৯০৮ সালে। বাল গঙ্গাধর তিলককে ২৪ জুন, ১৯০৮ সালে গ্রেপ্তার ও ‘‘দেশদ্রোহের’’ মিথ্যা মামলায় ৬ বছর আটক করার ঘোষণায় শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বম্বের সূতাকলের শ্রমিকরা অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সংগ্রামে পথে নামেন। ২৯ জুন হাজারে হাজারে মানুষ শ্রমিকদের সাথে সামিল হয়ে বম্বের রাজপথে কোর্টের সামনে পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধে নেমে পড়েন। গোটা বম্বে শহরে লক্ষাধিক শ্রমিক, সুতাকল থেকে শুরু করে পোর্ট-ডকের শ্রমিক, রেল শ্রমিক, ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্রের মেহনতি জনতা, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ধর্মঘটে করে পথে নেমে আসেন। ১৩ জুলাই, মামলা শুরু হওয়ার দিনে পুলিশ ও আম জনতার সাথে সংঘর্ষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কোর্ট চত্বরের ধারে কাছে যাতে বিক্ষোভকারীরা পৌঁছাতে না পারে তার জন্য সমস্ত পথ জুড়ে ব্যারিকেড করে রাখে সশস্ত্র বাহিনী। তিলককে ৬ বছরের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত করার বিরুদ্ধে জনতার ক্রোধ ফেটে পড়ে। ২৩ জুলাইয়ের পর থেকে প্রকৃত অর্থে শুরু হয় নজিরবিহীন রাজনৈতিক ধর্মঘট। লক্ষাধিক শ্রমিক ধর্মঘট শুরু করেন, শহুরে মধ্যবিত্ত এর সমর্থনে পাশে দাঁড়ায়, অচিরেই শিল্প ধর্মঘটটি উন্নীত হয় সাধারণ ধর্মঘটে। বম্বের বিভিন্ন রাস্তায় পুলিশ ও ধর্মঘটীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। আন্দোলনের জঙ্গীপনা, সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষের সাথে সেতুবদ্ধন, রাজনৈতিক দাবিতে এই অভূতপূর্ব জাগরণ ছিল কমরেড লেনিনের ভাষায় “ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম রাজনৈতিক ধর্মঘট, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রথম রাজনৈতিক গণজাগরণ’’ যার নেতৃত্বে ছিলেন শ্রমিকশ্রেণী। তিলকের ছ’বছর কারাদন্ডের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী ও আম জনতার ৬ দিনের সাধারণ ধর্মঘট, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পরিণতিতে ২০০- র বেশি শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়।
এরপর আরও বহু রক্তঝরা পথ ধরে এগিয়েছে ভারতের শ্রমিক আন্দোলন। সেই দীর্ঘ আঁকা বাঁকা পথ ধরে, ১৯২০ সালে গড়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রথম কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এআইটিইউসি। এই সংক্ষিপ্ত পরিক্রমার উদ্দেশ্য হল এটা বোঝাতে যে শুধু ভারতেই নয়, পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকেরা বার বার সংগ্রামে নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোনো সংগ্রামী কেন্দ্র থাকলো কি থাকলো না তার উপর নির্ভর না করেই। সহজাত শ্রেণীবোধ থেকে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী তার জন্মলগ্ন থেকেই লড়াইয়ের ময়দানে, সেই সংগ্রাম শাসকের আইনি স্বীকৃতি পেল কি পেল না তার পরোয়া না করেই। কিন্তু, রাজনৈতিক দিশা সম্পন্ন সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র না থাকলে শ্রমিক আন্দোলন স্রেফ মালিকদের বিরুদ্ধেই আর্থিক দাবি দাওয়াতে ঘুরপাক খেতে থাকে, পুঁজিপতি শ্রেণির পাহারাদার রাজনৈতিক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় না। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, আট ঘন্টার দৈনিক শ্রম সময় থেকে শুরু করে যাবতীয় অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে শ্রমিক শ্রেণী রাজপথে মরণপণ লড়াই চালিয়ে, পরবর্তীতে আইনসভা যাকে আইনি মোড়ক দেয়।
আজ আইন সভা কেড়ে নিচ্ছে সমস্ত অর্জিত অধিকারগুলো। ফ্যাসিবাদী সরকার গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকেই আজ লেলিয়ে দিয়েছে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্ট সবচেয়ে বড় আঘাত এনেছে এয়ার ইন্ডিয়ার কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের স্বার্থে ঐতিহাসিক রায়-কে খারিজ করার মাধ্যমে। সুপ্রিম কোর্টের ৫ সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চ রায় দিল যে পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিকদের নিয়োগ করে আইন অমান্য করার “জরিমানা’’ হিসাবে সমস্ত ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ী করার যে আদেশ সুপ্রিম কোর্টের ৩ সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চ দিয়েছিল তা ভুল। যে কাজ বা পেশাগুলোতে এয়ার ইন্ডিয়া কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়োগ করেছিল, পুরোটাকেই বাতিল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। ফলে, ঝুঠা কন্ট্রাক্টে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ প্রমাণিত হলে তাদের স্থায়ী করার পূর্বেকার আইন এইভাবে বাতিল হওয়ায় কর্পোরেট ঘরানা বিরাটভাবে উল্লসিত হয়ে ওঠে। তারপর আরেকটি মারাত্মক রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট উমা দেবী মামলায়। সরকারি দপ্তরে ১৫-২০ বছর ধরে অস্থায়ী বা ক্যাজুয়াল প্রথায় যারা কাজ করতেন, তাদের স্থায়ী করার পূর্বেকার রায় খারিজ করে দিল ৫ সদস্য বিশিষ্ট সুপ্রিম কোর্টের উমা দেবী মামলা। শীর্ষ আদালত জানালো, কত দিন ধরে একজন অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন, সেটা বড় কথা নয়। যেহেতু সরকারী কাজে অস্থায়ী প্রথায় নিয়োগ করাটাই অনুচিত, তাই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই বাতিল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। এই মামলার রায় দেখিয়ে নিয়োগ কর্তারা আজকাল অস্থায়ী বা ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ী করেন না। আর গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল হওয়ার আশংকায় ক্যাজুয়াল কর্মীরাও আইনি পথে যাওয়ার ভরসা পান না। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ ঘোষণা করেছিল সমকাজে সমবেতনের গুরুত্বপূর্ণ রায়। কিন্তু, তারপর থেকে ওই আদেশ আজ পর্যন্ত কোনো প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি মারফত দিনের আলো দেখলো না। এত বড় এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালত কোনো অবস্থান গ্রহণ করলো না। বর্বর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে চারটি শ্রম কোড কেড়ে নিল ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের যাবতীয় অধিকার। তাই, আবার রাজপথের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমেই শ্রমিকদের কেড়ে নিতে হবে সমস্ত অধিকার।
বেপরোয়া গতিতে বেচে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র। ২০২১-এর অর্থবর্ষে বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে রাজকোষে ২.১ লক্ষ কোটি টাকা তুলে আনার পরিকল্পনা রয়েছে মোদী সরকারের। রেলের ঢালাও বেসরকারিকরণ, কয়লা-ইস্পাত-তেল ও গ্যাস — কি নেই এই বিক্রি করার তালিকায়। গত এক বছরে মুকেশ আম্বানির জিও লাভ করলো ৬৩ শতাংশ, অথচ, এ বছরেই লোকসানে মুখ থুবড়ে পড়া সরকারি সংস্থা বিএসএনএল-এর ৭৫ হাজারের বেশি কর্মীকে বাধ্যতামূলকভাবে ধরানো হল স্বেচ্ছাবসরের প্রকল্প। বিশ্বব্যাপী ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধির পরিমন্ডলে আমাদের দেশে তা কেড়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে মোদী সরকার। সামাজিক সুরক্ষাকে তামাশায় পরিণত করা হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ স্কীম কর্মীদের নেই কোনো সামাজিক স্বীকৃতি, নেই আইন মোতাবেক মজুরি।
আজ তাই ফের রুখে দাঁড়াবার সময় এসেছে। শুধুমাত্র নিজেদের দাবিতে আটকে না থেকে গোটা দেশজুড়ে সংবিধানকে রক্ষা করা, নাগরিকত্ব হরণের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের ফ্যাসিস্ট চক্রান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীকে নামতে হবে রাজপথে, নেতৃত্ব দিতে হবে চলমান গণ জাগরণে।
সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের শতবর্ষে ভারতবাসী এটাই আশা রাখে শ্রমিকশ্রেণীর কাছ থেকে।