ওদের চেনার জন্য পোশাক পরখের প্রয়োজন হয় না। ওরা ঘোষিত ভাবেই মুসলিম এবং অকৃত্রিম ভারতীয়। মুসলিম মহল্লার মহিলা, একেবারে ছোট থেকে বড় সবাই রয়েছে প্রতিবাদে। দিল্লীর ঘিঞ্জি, অপরিচ্ছন্ন, অখ্যাত শাহিনবাগের রাস্তাকেই ওরা আপাতত ওদের ঠিকানা করে তুলেছে। আর ঐ রাস্তায় একনাগাড়ে তিন সপ্তাহেরও বেশি সিএএ-এনআরসি বিরোধী ধর্নায় অবিচল থেকে দিল্লীর ঐ অখ্যাত পাড়াকে তুলে এনেছে সংবাদের শিরোনামে, এবং এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরেও পরিচিতির আলোয়। ওদের বেশির ভাগই খুব সম্ভবত ইংরাজি জানে না, ফলে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের শব্দগুচ্ছের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু সংশোধনের পর মর্মবস্তুতে নাগরিকত্ব আইন যা দাঁড়িয়েছে, দেশব্যাপী চর্চায় এবং পারস্পরিক আলোচনায় অবহিত হয়ে তার গূঢ়মর্মের অনুধাবনে ওদের অসুবিধা হয়নি। ওরা জেনেছে, শরণার্থী দরদই সিএএ আইনের চালিকা নীতি বলে সরকার যা প্রচার করছে তা নির্ভেজাল কপটতা ছাড়া আর কিছু নয়। পড়শি দেশগুলোর নির্যাতিতদের আশ্রয় দিতেই সরকার যদি এত উদগ্ৰীব, তাহলে ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক নির্যাতিতদের তালিকা থেকে মুসলিমরা বাদ কেন? মুসলিমরা কি রাষ্ট্র শক্তির হাতে নির্যাতিত হতে পারে না? অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম তো নির্যাতনের শিকার হয়েই ভারতে ঠাঁই নিয়েছে এবং মানুষের বসবাসের অযোগ্য পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের জন্য কোন মাথাব্যথা তো সরকার দেখায় নি, উল্টে বারবারই বলেছে যে এদেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। সিএএ আইন আপাদমস্তক হিন্দুত্ব চালিত, অসাংবিধানিক এবং জাতিগত দিক থেকে বিভেদ সৃষ্টিকারী। এই আইন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ভারতীয় সংবিধানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতাকে নিশ্চিহ্ন করবে, মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে তোলার, সংখ্যালঘুদের অনুগ্ৰহের উপর তাদের অস্তিত্বকে নির্ভরশীল করে তোলার যে আয়োজন মোদী-শাহ জমানায় চলছে তার অভিমুখকেই আরো শক্তিশালী করবে। এছাড়া, এর দোসর জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) দরিদ্র, দলিত, আদিবাসীদের সঙ্গে মুসলিমদেরও চরম হয়রানির মধ্যে, পূর্বপুরুষরা এদেশের অধিবাসী হওয়ার কাগজ নির্দিষ্ট প্রমাণ যোগাড়ের চরম বিভ্রাটের মধ্যে, রাষ্ট্রহীন অস্তিত্বের নারকীয়তার মধ্যে ঠেলে দেবে। অতএব এই আইন ও এনআরসি-র বিরোধিতায় দাঁড়ানোটা যে কোনো সংবেদনশীল নাগরিকেরই কর্তব্য হয়ে ওঠে। শাহিনবাগের মহিলারাও সেই দায়িত্ববোধে সাড়া দিয়ে সিএএ-এনআরসি বিরোধিতায় সক্রিয় হয়েছেন। “আমরা নাগরিক হিসাবে সমান অধিকার চাই, এবং বন্দী শিবিরে থাকতে বাধ্য হওয়ার ভয়ের বাতাবরণ থেকে মুক্ত হয়েই বাঁচতে চাই”, ধর্নায় অংশ নেওয়া ৩৫ বছরের শবনম খান যখন এই কথাগুলো বলেন, তখন তার মধ্যে এক ভারতীয় নাগরিকের সিএএ এবং এনআরসি সৃষ্ট মর্মযন্ত্রণাই ফুটে ওঠে।
জামিয়া মিলিয়ায় পুলিশের তাণ্ডবে ক্রুদ্ধ হয়ে শাহিনবাগের ১০ জন মহিলা রাস্তাকে প্রতিবাদের যে ক্ষেত্র করে তোলেন তার কলেবর ক্রমশই বাড়তে থাকে। সিএএ-এনআরসি বিরোধিতার গুরুত্বকে উপলব্ধি করে ক্রমেই আরো বেশি সংখ্যক মহিলা প্রতিবাদ ক্ষেত্রকে ভরিয়ে তুলতে থাকেন এবং সেখানে জমায়েত সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে কিছু যুবকের একনিষ্ঠ সহায়তা এবং ব্যাপকতর স্তরের সংহতি লাভ শাহিনবাগ আন্দোলনকে আলোড়নমূলক ও ধারাবাহিক করে তুলতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। স্বেচ্ছাসেবকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে অংশগ্রহণকারীদের আহার জোগানোর রন্ধনশালাকে সচল রেখেছেন। সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রের বহু মানুষ দিন-রাত পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে ভরসা যুগিয়েছেন এবং খাবার সহ দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যুগিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বক্তব্য রাখার জন্য শাহিনবাগে যে মঞ্চ তৈরি করা হয়, সেখান থেকে যেমন স্থানীয় মানুষেরা তাঁদের মনের কথা ব্যক্ত করেছেন, তেমনি ঐ মঞ্চে শামিল হয়েছেন কবি ও অধ্যাপক, গৃহবধূ ও বয়স্ক মানুষ, নাগরিক আন্দোলনের কর্মীরা, জামিয়া ও জেএনইউ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা। নতুন বছর শুরুর দিন হর্ষ মান্দার, কাফিল খান, যোগেন্দ্র যাদবের মতো বিশিষ্ট জনেরা শাহিনবাগের মঞ্চে আন্দোলনের সমর্থনে বক্তব্য রেখেছেন, সবাই মিলে জাতীয় সংগীত গেয়ে বর্ষবরণ করেছেন, ধর্নায় অংশ নেওয়া মহিলাদের অবিচলতা এবং ঠাণ্ডা ও পুলিশি নিপীড়ন ও জীবনের ভয়কে উপেক্ষা করে ধর্না চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্পের প্রশংসা করেন। তবে আন্দোলনকে যে প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়নি এমন নয়। তাঁদের আন্দোলন যেন হিন্দু বনাম মুসলিম সংঘাতে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষিতে পর্যবসিত করতে না পারে কেউ, সে সম্পর্কে তাঁরা সদা সজাগ থেকেছেন। গান্ধী, আম্বেদকর, ভগৎ সিং-এর ছবিকে সামনে রেখে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্যকে প্রকাশ করেছেন, সংবিধানের অলঙ্ঘনীয়তার ঘোষণাকে সুস্পষ্ট করেছেন। কেউ সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিয়ে আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক রং চড়ানোর চেষ্টা করলে তাঁরা সেটাকে আটকেছেন, হঠকারিতার বিপর্যয় সৃষ্টির সম্ভাবনাকে অচিরেই বিনাশ করেছেন। আন্দোলনের মধ্যে থাকা কয়েকজন পুলিশি নিপীড়ন, বিজেপির গুণ্ডাদের আক্রমণের ভয় দেখিয়ে আন্দোলন তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, পিছু হটার সেই প্রচেষ্টাকে গুজব বলে, আন্দোলন ভাঙ্গার অভিসন্ধি বলে তার মোকাবিলা করেছেন। নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাদের পিছনে কোনো রাজনৈতিক দল বা নাগরিক আন্দোলনে নিয়োজিত কোনো গোষ্ঠী নেই। যাঁরা সংবিধানে প্রতিশ্রুত তাঁদের অধিকারকে বিপন্ন করে তোলা সিএএ-এনআরসি-র রূপে সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভকে প্রতিবাদে পরিণত করলেন, তাঁদেরও আন্দোলনের খুব পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এমন নয়। এমনকি তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ এই প্রথম বারের মতো কোনো আন্দোলনে অংশ নিলেন। এ সত্ত্বেও শাহিনবাগ তাদের আন্দোলনকে যে দৃষ্টান্তমূলক করে তুলতে পারল (এই আন্দোলনে প্রৌঢ়দের—ঠাকুমা-দিদিমাদের ভূমিকা স্বতন্ত্র উল্লেখের দাবি রাখে) তার পিছনে নির্ধারক শর্ত হয়ে উঠেছে সিএএ-এনআরসি-র মধ্যে নিহিত সংবিধানে অন্তর্ঘাত হানার সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি এবং তাকে প্রতিহত করতে তাদের জান কবুল করা পণ।
শাহিনবাগের মাথার ওপর খাঁড়ার মত ঝুলে থাকা আশঙ্কাটা অবশেষে বাস্তব রূপ নিল। ধর্নার ২৩তম দিনে পুলিশ এসে ধর্না উঠিয়ে নিয়ে রাস্তা খালি করে দিতে বলল। দুপুরের এই হুমকিতে কাজ না হওয়ায় রাতে আরো বেশি সংখ্যায় পুলিশ এসে ব্যারিকেড ভেঙ্গে দিয়ে আবারও আন্দোলন বন্ধ করার শাসানি দিল। পুলিশের এই তর্জনগর্জন নিষ্ফল বলে প্রতিপন্ন হল। “মোদী এবং অমিত শাহ আমাদের মন থেকে ভয় থাকার ভয়টাকেই দূর করে দিতে সফল হয়ছেন। আমাদের মধ্যে কেউই আর লাঠি খাওয়ার ভয়ে ভীত নয়”, কথাগুলো ধর্নায় অংশগ্রহণকারী ২৮ বছরের পরভিনের। ভয়কে জয় করা শাহিনবাগের মহিলারা পুলিশ-প্রশাসনের অভিপ্রায়কে ব্যর্থ করে দিয়ে ধর্না চালিয়ে যাওয়ার পথেই দৃঢ় থেকেছেন। সিএএ-এনআরসি বিরোধী দীর্ঘতম আন্দোলনের মর্যাদা পাওয়া এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও সংবাদ হয়ে ওঠা শাহিনবাগকে পুলিশ আপাতত জামিয়া-আলিয়া-জেএনইউ-র ধারায় রক্তাক্ত করার পথ থেকে বিরত থেকেছে সম্ভবত এই কারণে যে — সরকার এই মুহূর্তে আর দেশব্যাপী বড় প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে চাইছে না। জনৈক কবি শাহিনবাগ নিয়ে ইংরাজিতে লেখা তাঁর কবিতায় বলেছেন, “আপনি যদি তমসার দেশে আলোর তরঙ্গ দেখতে চান তবে শাহিনবাগে আসুন”, যদি দেখতে চান যেখানে “ভয় শেষ হয়ে স্বাধীনতার শুরু হয়েছে তবে শাহিনবাগে আসুন।” যে অকুতোভয় মহিলারা দিল্লীর অখ্যাত এলাকা শাহিনবাগকে আন্দোলনের এক নজির করে তুললেন, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে প্রেরণা সৃষ্টি করলেন, স্বৈরতন্ত্রর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন, তাঁদের সহস্র সাবাশ প্রাপ্য।