বরফে ঢাকা শিমলায় তুষারপাতের মধ্যে মাথায় ছাতা ও লাল পতাকা নিয়ে ধর্মঘটীরা নামলেন রাজপথে। ধর্মঘটকে সফল করতে। তামিলনাড়ুতে ১৫ হাজার অটোচালক ধর্মঘটে অংশ নিয়ে রাস্তায় বার করেননি অটো। গোটা দেশের ব্যাঙ্কিং পরিষেবাকে স্তব্ধ করে ব্যাঙ্ক শিল্পের কর্মীরা সংযুক্তিকরণ, বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন তাঁদের তীব্র প্রতিবাদ। দেশব্যাপী ১৫ লক্ষ বিদ্যুতকর্মীও সামিল হলেন ধর্মঘটে। জম্মু কাশ্মীরে এই প্রথম এআইসিসিটিইউ-র পতাকা নিয়ে সেখানকার শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ সামিল হলেন ধর্মঘটে। পশ্চিমবঙ্গ-সিকিম-আন্দামান সার্কেলের প্রায় ৯৮ শতাংশ ডাকঘরই বন্ধ ছিল ধর্মঘটের জন্য।
এ রাজ্যের দুটি প্রধান শ্রম নিবিড় শিল্প, চটকল ও চা বাগিচায় ধর্মঘটের প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। কয়লা শিল্পেও তার প্রভাব লক্ষনীয়।
রাজ্যে রাষ্ট্রীয় পরিবহনকে সচল রাখার জন্য পরিবহন দপ্তরের কর্তৃপক্ষ, তৃণমূলী দালাল ট্রেড ইউনিয়নকে নিয়ে ক’দিন ধরে শাসানি ও নানা হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা গেল সল্ট লেকের ডিপো থেকে বেরোল না একটাও সরকারি ভূতলের বাস, বেলঘরিয়া ও বেলগাছিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ডিপো থেকে শেষ পর্যন্ত বেরলো হাতে গোনা কয়েকটি বাস, আর পরিবহন দপ্তরও শেষ অব্দি স্বীকার করেছে যে প্রতিশ্রুতি মতো বেশি সংখ্যায় বাস রাস্তায় বার করা যায়নি।
শিল্পোৎপাদন যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধর্মঘটের ফলে তার প্রমাণ মেলে অন্য দিনের তুলনায় অনেক কম বিদ্যুত ব্যবহারের হিসাবে। আর, পরিশেষে, ক্ষিপ্ত মুখ্যমন্ত্রীর উক্তি, ধর্মঘটকে ‘গুন্ডামীর’ সঙ্গে তুলনা করা, মোদী বিরোধী আন্দোলন এ রাজ্যে না করে দিল্লি বা অন্যত্র করার নিদান থেকেই স্পষ্ট বোঝা গেল যে তিনি এ রাজ্যে মোদী বিরোধী আন্দোলনের পরিসর একাই দখল করে রাখতে চান। সেখানে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দিতে তিনি বিন্দুমাত্র রাজি নন। ৮ জানুয়ারী, সারা ভারত ধর্মঘটের এই কয়েকটি হল টুকরো টুকরো কিছু ছবি।
এবারের ধর্মঘট ডেকেছিল দেশের ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও অন্যান্য ফেডারেশন সমুহ। পাশাপাশি, ওইদিনই সারা ভারতের প্রায় দু’শটি কৃষক সংগঠন ডেকেছিল সারা ভারত গ্রামীণ বনধ। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো ডাক দিয়েছিল সারা ভারত ছাত্র ধর্মঘটের। জেএনইউ-তে এবিভিপি-র নৃশংস হামলার পর যে ছাত্র ধর্মঘট এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা নিয়ে হাজির হয়। তাই, এবারের সাধারণ ধর্মঘটের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল মোদীর ফ্যাসিস্ট জমানার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের শ্রমিক শ্রেণী-কৃষক সমাজ-ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। একে সমর্থন করেন ব্যাপক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, বিভিন্ন স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন, নানা ধরনের সামাজিক নাগরিক সংগঠন। শুধু মাত্র অর্থনৈতিক দাবির মধ্যেই নিহিত ছিল না ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা এই ধর্মঘট। দেশব্যাপী এনআরসি, এনপিআর, সিএএ-র বিরুদ্ধে যে চলমান গণ বিস্ফোরণ নতুন এক ভারতের উন্মেষ ঘটিয়েছে, সেই রাজনৈতিক দাবিটাও এবারের ধর্মঘটের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দাবি হয়ে সামনে আসে। শ্রমিকশ্রেণী এটা বুঝতে শুরু করেছে যে, হকের মজুরি, বহু আন্দোলনের বিনিময়ে অর্জিত অধিকার, শ্রম কানুনকে হরণ করেই মোদী ক্ষান্ত থাকছে না, সে এবার নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে বলে অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। তাই, অন্যান্য দাবির পাশাপাশি নাগরিকত্বের বিষয়টি ব্যাপক সাধারণ মানুষ, বিশেষত শ্রমিকশ্রেণিকে বিরাটভাবে আলোড়িত করে, যা প্রচার আন্দোলনের পর্যায়ে ভাল ভাবেই অনুভূত হয়।
সর্বস্তরে এআইসিসিটিইউ-আইসা-কৃষক সংগঠনের কর্মীরা এই ধর্মঘটকে সফল করতে জান কবুল করে ময়দানে নামেন। ছোট বড় অসংখ্য সভা, মিছিল, প্রচারের সমস্ত রূপগুলোকে গ্রহণ করা, নানা ধরনের পোস্টার-লিফলেট, সোশ্যাল মিডিয়ায় সৃষ্টিশীল প্রচার, এক কথায় গোটা সংগঠন নতুন এক প্রাণ চঞ্চলতায় জেগে ওঠে, যা বিরাট এক প্রাপ্তি। ধর্মঘটের দিনে যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ডে পুলিশী হেনস্তার মুখে মহিলা নেত্রী ইন্দ্রাণী দত্তের সাহসি ভূমিকা ও গ্রেপ্তার বরণ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ নং গেটের সামনে আইসা এসএফআই-এর পথ অবরোধ, উত্তর ২৪ পরগনা, বর্ধমান, হুগলি, নদিয়া প্রভৃতি অনেক স্টেশনে কর্মীদের নিয়ে পার্টি নেতাদের রেল রোকো হচ্ছে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। স্থানীয়স্তরে বিভিন্ন বাম সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ভালোই ভূমিকা রাখে। হাওড়ায় ছাত্র যুবকেরা শ্রমিকদের প্রচার ও মিল বন্ধ করার ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা রাখেন।
এই ধর্মঘটকে বিরোধিতা করে বিজেপি ও তৃণমূল, আর তাদের শ্রমিক সংগঠন। যে বিজেপির বিরুদ্ধে এ রাজ্যে মমতা এতো সোচ্চার, সেই তিনি মোদীর বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক সংগ্রামে বিপরীত অবস্থান নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন তুলে দিলেন।
সারা দেশ জুড়ে নজিরবিহীন ক্যা-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী গণজাগরণের মুখেও অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট শাসক জানিয়ে দিল যে তারা এক ইঞ্চি ও পিছু হটবে না। শাসকের এই উদ্ধত আচরণ আরো প্রকট হল দেশব্যাপী ধর্মঘটের দিনে দু’টো পলিসি ঘোষণার মাধ্যমে। রেল মন্ত্রক জানিয়ে দিল, ১০০টি রুটের ১৫৬টি ট্রেন তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি হাতে। আর, কয়লা শিল্পে দেশি-বিদেশি লগ্নি টানতে কয়লা ক্ষেত্রের দরজা এবার হাট করে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল কেন্দ্রীয় সরকার। এর পর, গ্লেনকোর, অ্যাংলো আমেরিকান, বিএইচপি গ্রুপ, রিও টিন্টো প্রভৃতি সংস্থাগুলো কিনে নেবে কয়লা খনি। ঘোর অস্তিত্বের সংকটে পড়বে কোল ইন্ডিয়ার ভবিষ্যৎ। ৮ জানুয়ারী ছিল দীর্ঘ যুদ্ধের একটা খন্ড লড়াই মাত্র। যে ব্যাপক ঐক্য অর্জিত হল এই ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে, তাকেই সম্বল করে এগিয়ে যেতে হবে মোদীর বিরুদ্ধে বিরাট এক রাজনৈতিক যুদ্ধের লক্ষ্যে।