আজকের দেশব্রতী : ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ (অনলাইন সংখ্যা)
gggggggggeeee

বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্বযুদ্ধগুলির ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর পৃথিবী সম্ভবত ২০২০-র চেয়ে কঠিন দুঃসময়ের বছর আর দেখেনি। জনস্বাস্থ্যের এক অস্বাভাবিক বিপর্যয় সারা বিশ্বে দশ লক্ষেরও বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক সামাজিক জীবন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কার্যত সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কারণ, একের পর এক দেশগুলো টানা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস, বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন আরোপ করে অতিমারী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। ভারতে জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভয়ঙ্কর অপ্রতুলতা এবং মোদী-মডেল লকডাউনের চূড়ান্ত নিষ্ঠুর, দমনমূলক ও স্বেচ্ছাচারী চরিত্রের জন্য ভারতকে অতিমারী এবং লকডাউন — দু’টি ক্ষেত্রেই চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আর তাই, বছর শেষ হতে চললেও বিপর্যয় কমার কোনো লক্ষণ নেই।

ভারতবর্ষের মানুষ যখন অতিমারী আর প্রাণশক্তি নিংড়ে নেওয়া লকডাউনের মিলিত বিধ্বংসী প্রভাবে চোখে সরষে ফুল দেখছেন, মোদী সরকার তখন সংকটকে সুযোগ করে তোলার শ্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছে। সঠিকভাবে রহস্য উন্মোচনের পর এই নয়া স্লোগানের আসল মানেটা ধরা পড়েছে — ‘ধনী ও ক্ষমতাশালীদের সুযোগ-সৌভাগ্য সৃষ্টির জন্য সাধারণ মানুষের কষ্টকে গুরুভার করে তোল’! আর এই কাজটা একেবারে ‘নিখুঁত’ ভাবে করার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রকে নির্লজ্জভাবে ‘স্যানিটাইজ’ করা হল এবং ‘সুযোগ’ নেওয়ার উপযোগী করে তোলা হল। গণতন্ত্রের উপর এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-কে আর কোনো কিছু এত জীবন্তভাবে বর্ণনা করতে পারবে না যেমনটা ধরা পড়েছে মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইন লাগু করার মরিয়া চেষ্টায় — ভারতবর্ষের গোটা কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের স্বার্থ ও মতামতকে চূড়ান্ত অগ্রাহ্য করে। পাঞ্জাবের কৃষক সম্প্রদায়, যাদের একদিন ভারতের শাসক শ্রেণী দেশের ‘সবুজ বিপ্লবের  অগ্রদূত’ বলে প্রশংসা করেছিল, তারা আজ মোদীর ‘নয়া ভারতে’ দেশবিরোধী অবাঞ্ছিত ‘পরম শত্রু’ বলে ঘোষিত!

অতিমারীর চরম পর্যায়ের মাঝামাঝি, জুন মাসের গোড়ায় সরকার প্রথম তিনটি অধ্যাদেশ প্রকাশ্যে এনেছিল এবং পাঞ্জাবের কৃষকরা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। গোটা পাঞ্জাব দ্রুত এই প্রতিবাদী কৃষকদের পাশে সমাবেশিত হয়েছিল এবং আকালি দলের মন্ত্রী দিল্লীতে মোদীর মন্ত্রীসভা থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাঞ্জাব বিধানসভা দলমত নির্বিশেষে ঐকমত্য হয়ে অধ্যাদেশগুলো খারিজ করেছিল এবং এমনকি বিজেপি নেতারাও তাদের নিজেদের দল থেকে ইস্তফা দিতে শুরু করেছিলেন। সেই প্রতিবাদকে আদৌ গ্রাহ্য না করে, উল্টে মোদী সরকার বিল নিয়ে এল এবং সংসদে বুলডোজার চালিয়ে বিলগুলি আইনে পরিণত করেছে। আর এখন, যখন গোটা দেশ জুড়ে কৃষকরা এই কর্পোরেট-তোষণকারী আইনগুলি বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন, তখন সরকার সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বাতিল করে দিল! এর মধ্যে, নতুন কৃষি আইনের ‘ভরসায়’ ‘আদানি গোষ্ঠী দেশের সমস্ত অঞ্চলে নিজেদের কৃষিব্যবসা পরিকাঠামো গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে — তারও ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কর্পোরেট স্যাঙাতদের সাথে সরকারের অবৈধ যোগসাজসে ছক আগে থেকেই কষা ছিল, অধ্যাদেশগুলো এবং সন্দেহজনকভাবে পাশ হওয়া আইনগুলো সেই ছককে বিধিবদ্ধ করেছে মাত্র।

নাগরিক আন্দোলনের উদ্দীপক আহ্বান নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২০ সাল যখন মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে ‘শাহীনবাগ’-এর নাম ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছিল। আর শাহীনবাগের চেতনা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক যখন অতিমারী ও লকডাউননের ধ্বংসাত্মক জোড়া ফলার সাঁড়াশি আক্রমণে দীর্ঘায়িত প্রতিবন্ধকতা এবং মোদী সরকার ও সঙ্ঘ বাহিনীর এক সুপরিকল্পিত হত্যাভিযানের মাধ্যমে প্রতিবাদীদের গুঁড়িয়ে দেওয়া, বদনাম রটানো ও দানবীয় আইনে তাদের শাস্তি দেওয়ার ষড়যন্ত্র মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে কীভাবে শাহীনবাগের চেতনাকে নতুন করে জ্বালিয়ে তোলা যায়, আদৌ তা যাবে কি না, ঠিক তখনই কৃষকরা ট্রাক্টর আর ট্রলি চেপে, জলকামানকে তুচ্ছ করে, খুঁড়ে রাখা রাস্তা অতিক্রম করে,  কাঁটাতারের অবরোধ ভেঙে হাজির হলেন এবং দিল্লী ঘিরে তাদের তাঁবুর খুঁটি গাড়লেন। তাঁরা শুধু যে আমাদের  কিসান শাহীনবাগ উপহার দিলেন তাই-ই নয়, পুলিশি নির্যাতনে কৃষক আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিজেপি’র চক্রান্তকেও নস্যাৎ করলেন, তাঁরা ১৮৫৭-র চেতনাকে নতুন করে জ্বালিয়ে তুললেন যখন কৃষকরা সৈনিকের পোশাকে দিল্লীর অভিমুখে দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলেন আর ব্রিটিশ কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ আবার ভারতীয় কৃষকরা আরেক বার দিল্লি ঘিরলেন, এবার ফ্যাসিবাদী শাসকদের রুখতে এবং ভারতকে বেলাগাম আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজের পদানত করার কুৎসিত অভিসন্ধিকে খারিজ করতে!

dddaeeee

 

শাহীনবাগ থেকে সিঙ্ঘু সীমানা এবং টিকরি সীমানার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, ২০২০ সাল ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এক গৌরবময় বছর হয়ে উঠেছে। ভারতের উত্তরাধিকারকে ফ্যাসিবাদী রসাতলে ঠেলে দেওয়াকে মানুষ যে রুখে দিতে পারেন — জনতার আত্মঘোষণার সেই অমিত শক্তি সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে এই বছর! মোদী সরকার শাহীনবাগকে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক বিপথগামী আন্দোলন বলে হাজির করে কোণঠাসা করা, অপবাদ দেওয়া এবং চূর্ণ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এখন তারা কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধেও একই ষড়যন্ত্র আঁটছে — বলছে এটা নাকি খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী আর পাঞ্জাবের ধনী কৃষকদের শক্তি প্রদর্শনের এক সমাবেশ। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অবশ্যই এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করে দিতে হবে, শুধু দিল্লী ঘিরে প্রতিরোধকে শক্তিশালী করেই নয়, ভারতের প্রতিটি কোণায় কোণায় এই চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সমস্ত অংশের দেশব্যাপী সমাবেশের সঙ্গে দিল্লীর এনআরসি-প্রতিরোধকে সহায়তা করার মধ্য দিয়েও। গত ২৬ নভেম্বর ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট এবং ৮ ডিসেম্বর ভারত বন্ধে যে সাড়া পাওয়া গেছে তা, বিভিন্ন অংশের জনগণের সংগ্রামগুলির এক বিন্দুতে এসে মিলিত হওয়ার মহান সম্ভাবনাকেই স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল, প্রতিরোধের চেতনাকে নির্বাচনী পরিসরে সঞ্চারিত করার ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনাকে নির্দেশ করছে!

আসুন, কৃষকদের প্রতিরোধের দৃপ্ত আওয়াজের মধ্যে আমরা ২০২১-এর আগমন ঘোষণা করি। সরকারকে কৃষক-বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারে বাধ্য করা শুধুমাত্র ভারতের কৃষকদের জন্যই নয়, কর্পোরেট-আগ্রাসন ও ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সমস্ত স্তরের মানুষের জন্যই হবে এক বিরাট জয়। আর এই জয়, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভোট-যুদ্ধ সহ আগামী দফার বিধানসভা নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের কার্যকরী হাতিয়ার হয়ে উঠবে। ভারতের লড়াকু বাহাদুর কৃষকরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠুন! গণতন্ত্রের জন্য ভারতের সংগ্রাম জয়যুক্ত হোক!

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়)    

deeeeggg

২০২০ পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করছি ২০২১ বর্ষে। অতিমারী সংকট, সেই গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন  কর্মসংস্থান ও আরও কিছু ব্যাপক সংকটের যোগফলে ২০২০-র জনজীবন জেরবার হয়েছে। রুজি-রোজগার ফিরে আসার কিছু কিছু ক্ষেত্র খুললেও বেকারি আর গরিবী দূরীকরণের ন্যূনতম ছন্দ আসার সম্ভাবনা বহু দূরে। রাজ্য সরকার  ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প চালু করেছে। চলার পথে বোঝা যাবে উপশম মিলবে কেমন। প্রাপ্য আদায়ের চাপ রেখে চলতে হবে। তবে মাথায় রাখতে হবে কেন্দ্রের মোদী-অমিত শাহ’দের জমানা সমস্ত দিক থেকেই সর্বনাশা অবস্থা তৈরি করছে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য অবশ্য ‘প্রতিশ্রুতি’ ফেরী করছে এখানে ক্ষমতায় আনলে ‘সোনার বাংলা’ বানিয়ে দেবে! কথায় আছে, দূরাত্মার ছলের অভাব হয়না। তাই বিশেষ করে বাংলার কাছে ২০২১-এর গুরুত্ব ভীষণভাবেই আলাদা। আর ক’মাস পরেই হবে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন, হবে পেছনে অনেক অমীমাংসিত ফয়সালার জের নিয়ে। তবু যে প্রশ্নগুলো আজ সবচেয়ে জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে তা হল, বাংলা আর “বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের” বহুত্বের জন্য লড়াইয়ের মাভূমি থাকবে কিনা, জনগণের প্রকৃত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অধিকারের জন্য রণভূমি থাকবে কিনা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির পরিবেশ থাকবে কিনা? নাকি বাংলার দখল নেবে গণতন্ত্রের ভেকধারী সর্বগ্রাসী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্তের দল! আম্বানী-আদানি’দের কোম্পানিরাজের দালাল বিজেপি! আগ্রাসী যুদ্ধটা শুরু করে দিয়েছে ওরা, সঙ্গে কুখ্যাত আরএসএস এবং তাদের আই টি সেল, কোটি কোটি টাকা, মিডিয়া চ্যানেল সমেত মজুদ অঢেল সমস্ত যুদ্ধোপকরণ। বাড়তি কৌশল নিয়েছে রাজ্যের শাসকদলের ঘর ভেঙ্গে ‘নিজেদের’ অর্থাৎ কেন্দ্রের শাসকদলের ঘর বাড়ানোর। ভয়-টোপের নানা প্যাঁচে-ডীলে কিছু কিছু ‘গদ্দার’ও জুটেও যাচ্ছে, যদিও পরিণাম বুঝিয়ে দেবে সংখ্যায় ‘গন্ডার’ কত আর ‘গরু’ কত! তবে এই পয়লা নম্বরের শত্রুদলকে আর এতটুকু হাল্কা করে দেখার কোনো মানে হয় না। বিজেপি নিজের আধিপত্য কায়েমের উদ্দেশ্যে তার বিপরীতে মূলত দু’রকম অবস্থা চায়। একদিকে সমাজে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি ছড়ানোর ওপর নির্ভর করতে, অন্যদিকে তার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে তার পছন্দ অনুসারে বিভাজিত করে রাখতে। কিন্তু বিজেপিকে রুখে দেওয়ার নীতিগত প্রশ্নে আর বিভ্রম দ্বিধান্বিত থাকলে চলবে না। জঘন্য গেরুয়া ষড়যন্ত্র ও কুৎসার শিকার হওয়া এমনকি স্বয়ং অমর্ত্য সেনও জোর দিচ্ছেন এই অভিমতের সপক্ষে। রাজ্যের বাম-গণতান্ত্রিক-উদারবাদী-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে এই অভিন্নমতে সহমত হয়ে উঠতে হবে। এই সহাবস্থানকে রূপ দিতে উপায় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র থাকুক, কিন্তু ছোট-বড়-মাঝারি সব উদ্যোগকে আগে “বিজেপি হটাও” পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করার দায় দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঐ মূল শত্রুদল এতটুকু ছাড় পেয়ে যায় এমন কোন বিমূর্ত ‘উচ্চ মার্গী’ বিতর্ক থেকে বিরত থাকা উচিত।

মেরুকরণকে তীব্র ও ব্যাপক করে তুলতে বিজেপি বহুরূপী কৌশল নিচ্ছে। তারই অঙ্গ হল, আবারও সিএএ-র জুজু দেখানো, রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে আসার ফাঁকে কর্মরত কেন্দ্রের ‘নিয়া’র (এনআইএ) অফিসারদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর রুদ্ধদ্বার বৈঠক, রাজ্যের আইন শৃংখলার প্রশ্ন তুলে কিছু আইপিএস অফিসারদের কেন্দ্রে তলব করা, বিজেপি রাজ্য সভাপতির তরফে অহরহ ‘ধরো-মারো’ রব তুলে বাজার গরম করা, রাজভবনকে কার্যত বিজেপির অফিসে পরিণত করা, রাজ্যপালের বস্তুত বিজেপি নেতারূপী ভূমিকায় নেমে পড়া, বিশ্বভারতীকে এক অনুচর উপাচার্য ও আধিকারিকবর্গকে হাতিয়ার করে বিদ্বেষ-বিভাজনের দর্শন-মতাদর্শ ও রাজনীতি প্রচারের ঘাঁটি বানানো, যারাই পথের কাঁটা তাদেরই শান্তিনিকেতন ছাড়া করার পন্থা নেওয়া। রবিঠাকুরের ‘গুজরাটপ্রিয়তা’র ‘কহানী’ শোনাচ্ছেন মোদী। অমর্ত্য সেন ওদের চক্ষুশূল, তাই তাঁকে আজ দেগে দিচ্ছে বিশ্বভারতীর ‘জমি চোর’! কারণ, অমর্ত্য সেন বরাবরই সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে আসছেন। তিনি কখনই “কর্পোরেট পোস্টার” মোদীকে ক্ষমতায় দেখতে চাননি। গান্ধীর গুজরাট আর মোদীর গুজরাটের বৈপরীত্যকে ডেঁটে তুলে ধরেন। তাছাড়া তাঁর ‘প্রতীচি’ সংস্থা মোদীর ‘উন্নয়ন মডেল’-এর সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও দলিতদের অধিকার লুন্ঠণকান্ডের লাগাতার উন্মোচন করে আসছে। বিজেপির গাত্রদাহ এইসব কারণেই। নারীসমাজকে বিজেপি অনুশাসিত রাখতে চায় খাপ পঞ্চায়েতী মডেলে, এপ্রশ্নে তাদের কাছে পুরুষতন্ত্রের ‘পসন্দ্-না পসন্দ্’ই বিচারের একমাত্র মানদন্ড। তারই ন্যক্কারজনক নমুনা মিলল দলবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিজেপি সাংসদের পক্ষ থেকে তুরন্ত স্ত্রীকে বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠানোয়।

‘ইনটেলেকচুয়াল আউটরিচ’ থেকে ‘আমার বুথ সবচেয়ে মজবুত’ — হরেক প্রকল্প নামাচ্ছে বিজেপি। ওদের বিরুদ্ধে তাই চাই পাল্টা রাজনৈতিক প্রতিরোধ, রাজ্য স্তর থেকে বুথ স্তর পর্যন্ত। “বিজেপিকে ভোট নয়” — এটাই হোক ২০২১-এর নির্বাচনের মূল আওয়াজ।

gggeegggg

দেশের কৃষকদের চরম অপমান করে মোদী সরকার এখন কৃষক-সম্মান নিধি প্রকল্পে সংকটগ্রস্ত কৃষকদের অনুদানের ঢাকঢোল বাজাচ্ছেন! একদিকে কেন্দ্রের মন্ত্রীরা কৃষক আন্দোলনকে “পিকনিক” বলে বিদ্রুপ করছে, অপরদিকে পশ্চিবঙ্গকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে মোদী বলছেন যে, বাংলায় কৃষক সম্মাননিধি (পিএম কিষাণ) প্রকল্পে কৃষকদের বছরে ৬ হাজার টাকার অনুদান দেওয়া হচ্ছে না। বলছেন, এই রাজ্যের কৃষকরা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জবাবে তৃণমূল সরকার বলেছে তারা কৃষকবন্ধু প্রকল্পে এ রাজ্যের কৃষকদের বছরে একর পিছু সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, জমির পরিমান কম থাকলে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা দিচ্ছে। বাস্তবে কেন্দ্রীয় সহায়তা হলো দৈনিক ১৬ টাকা ৪৩ পয়সা। আর রাজ্যের কৃষকবন্ধু প্রকল্পে ৫ হাজার টাকা পেয়েছে কেবল তারাই যাদের এক একর জমি রয়েছে। বলা হচ্ছে ৭২ লক্ষ কৃষক এই প্রকল্পে টাকা পেয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে ৮৬ ভাগ কৃষকই ক্ষুদ্র প্রান্তিক বর্গের। তারা পেয়েছে ২ হাজার টাকা, অর্থাৎ দৈনিক ৫ টাকা ৪৭ পয়সা। লক্ষ লক্ষ ভাগ চুক্তি চাষিরা কিছুই পায়নি। এই যৎসামান্য “সহায়তা” নিয়ে কেন্দ্র বনাম রাজ্যের চাপান উতোর চলছে। এর মাধ্যমেই নাকি ক্ষুধার রাজ্যে কৃষকের স্বার্থে তথাকথিত উন্নয়নের প্রতিযোগিতা চলবে!

এটা সর্বজনবিদিত যে নয়া কৃষি আইনে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি উৎপাদন ও কৃষি পণ্যের বণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করছে। কেবলমাত্র রাজস্বের ক্ষতি নয়, কেড়ে নেওয়া হচ্ছে রাজ্যের অধিকার। কারন সংবিধানে কৃষি রয়েছে যুগ্ম তালিকায়। নিশ্চিতভাবে এটা বিজেপির দ্বারা দেশের সংবিধানকে ধ্বংস করার আরও একটি নমুনা। কারণ, ভারতের মতো বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশে কৃষিব্যবস্থার অসম বিকাশের কারনে কৃষি ক্ষেত্রে রাজ্যেরও ক্ষমতা থাকা জরুরি। কেন্দ্র সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। বিগত দিনগুলিতে কৃষিতে বিনিয়োগ ক্রমশ কমিয়ে এনে এখন আম্বানী-আদানী কর্পোরেটরাজ কায়েম করছে। এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে দেশব্যাপী অভূতপূর্ব কৃষক প্রতিরোধ। চলমান আন্দোলনে মোদী সরকার প্রবল চাপের মুখে পড়েছে। কিন্তু তৃণমূল সরকার কি করছে? তারা ঐ কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে বন্ধ রেখে চরম কৃষক-বিরোধী মোদী সরকারকে এ রাজ্যের বুকে “কৃষক-দরদী” সাজার সুযোগ করে দিচ্ছে। এভাবে অন্যান্য বহু ক্ষেত্রের মতো তৃণমূলের গাজোয়ারী-স্বৈরাচারী অপশাসনে রাজ্যে ফ্যাসিবাদের পথকে সুগম করে দিচ্ছে। তৃণমূল যদি কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনের প্রকৃত বিরোধিতা করতে চায় তাহলে এ রাজ্যে তারা কৃষক স্বার্থে আলাদা আইন করার প্রচেষ্টা করছে না কেন? অন্যান্য ফসলের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, প্রকৃত গরিব মাঝারি চাষিদের থেকে রাজ্য সরকার সময় মতো ধান সংগ্রহ করছে না কেন? এ রাজ্যের চাষিরা অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেন? কিষাণ মান্ডিতে কেন মহাজন দালালরা আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে, যেখানে নানান অজুহাতে চাষিদের ঢুকতেই দেওয়া হয় না?

কিন্তু আসল প্রশ্নটা হলো শাসকের ছুঁড়ে দেওয়া এই রুটির টুকরো বা যৎসামান্য আর্থিক অনুদান কিংবা খয়রাতি সাহায্য কি কৃষকরা আদৌ চেয়েছে? মোটেই নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সারা দেশের কৃষকরা দীর্ঘ দিন ধরে দাবি তুলেছে, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) চাই, সঠিকভাবে হিসাব করে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম চাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র মধ্য চাষিরা চেয়েছে কৃষি উপকরণের দাম কমাও, কম সুদে কৃষি ঋণ দাও! ঋণমুক্তি চাই! কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছে। রাজ্য সরকারও ঘোষিত দামে ফসল কিনছে না। এসবের যোগফলে ঋণগ্রস্ত কৃষকের লোকসানের পরিমান হয়ে উঠছে বিপুল! ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়ে কৃষককে সম্মানের নামে চরম অপমান করা হচ্ছে বা বন্ধু সেজে দেওয়া হচ্ছে ধোঁকা। গালভরা অনুদান প্রকল্পের বিজ্ঞাপনের আড়ালে চাপা দেওয়া হচ্ছে ফসলের ন্যয্য দাম পাওয়ার অধিকারের প্রশ্নটাকে। সরকারী প্রকল্পকে অনুগ্রহ বা দান হিসাবে দেখিয়ে ওরা ফয়দা তুলতে চাইছে ভোটের বাক্সে। এই তথাকথিত অনুদান ও কৃষকের প্রকৃত লোকসান — এ দুটোকে পাশাপাশি রেখে তুলনামূলক ভাবে বিচার করে দেখা যেতে পারে। যেমন এক বিঘা জমিতে ভালো ফলনে ৮ কুইঃ ধান উৎপাদন হয়। সঠিকভাবে ( C2+ ৫০%) বা উৎপাদন খরচের দেড়গুণ ধরে হিসাব করলে তার দাম হয় কুইঃ পিছু ২৪০০ টাকা। কেন্দ্র সরকার দর নির্ধারণ করেছে ১৮৬৫ টাকা। অর্থাৎ ৮ কুইঃ ধানে চাষির লোকসান ৪ হাজার ২৮০ টাকা।

অপর দিকে রাজ্য সরকার ধান না কেনায় কুইঃ পিছু ১৮৬৫ টাকার বদলে সেই ধান চাষি অভাবী বিক্রি করছে সর্বাধিক ১৩০০ টাকায়। সবমিলিয়ে এক একর জমিতে চাষির লোকসান কমবেশি ১৭ হাজার ৮৪০ টাকা। অপর দিকে রাজ্য সরকার ধান না কেনায় কুইন্টাল পিছু ১৮৬৫ টাকার বদলে সেই ধান চাষি অভাবী বিক্রি করছে সর্বাধিক ১৩০০ টাকায়। সবমিলিয়ে এক বিঘা জমিতে চাষির লোকসান কমবেশি ২১ হাজার ২০০ টাকা। আর রাজ্য সরকার তাকে দিচ্ছে মাত্র ৫ হাজার টাকা! কেন্দ্র দেবে বলছে ৬ হাজার টাকা! সবটা পেলেও কেবল একটা ফসলেই কৃষকদের বড় ধরনের লোকসান! তাহলে এই অনুদান প্রকল্পে কৃষকের প্রকৃত লাভ কোথায়? আসলে এই ভাবে সরকার কৃষকদের বোকা বানিয়ে, ভোটের সস্তা রাজনীতি করতে চাইছে।

এবারে ঘোষিত ও প্রকৃত এমএসপি-র পার্থক্যটা বিচার করে দেখা যাক। মোদি সরকার এ বছর প্রতি কুইন্টাল ধানের গড় উৎপাদন ব্যায় ১২৪৫ টাকা ধার্য করেছে। যেখানে গত বছর সি-২ অনুযায়ী ধানের উৎপাদন ব্যায় কুইন্টাল প্রতি ছিলো ১৭২২ টাকা, এর সাথে ৫০% মুনাফা যুক্ত করলে গত বছরই ধানের প্রকৃত সহায়কমূল্য কুইন্টাল প্রতি ২৫৮৩ টাকা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু উৎপাদন খরচের হিসাবে কারচুপি করা হয়েছে। কেবল সার, বীজ ও পারিবারিক শ্রমের দামকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। কিন্তু জমির খাজনা ও সুদ সহ ঋণ শোধের দায়কে (C2) রাখা হয়েছে হিসাবের বাইরে।

পাঞ্জাবের কৃষিমন্ত্রক গত বছর ধানের গড় সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ২৭৪০ টাকা ধার্য করেছিল। কেরল সরকার কৃষকদের ধান কিনছে প্রতি কুইন্টাল ২৬৯০ টাকায়। অন্যদিকে ছত্তিশগড় সরকারও গত বছর থেকে কৃষকদের ধান কিনছে কুইন্টাল প্রতি ২৫০০ টাকা হারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিনছে ১৮১৫ টাকা, তার সাথে পরিবহন বাবদ ২০ টাকা যোগ করে, ১৮৩৫ টাকা কুইন্টাল দরে। এক বছর পর, যখন ফসল উৎপাদনের ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন মোদি সরকার ধানের সর্বনিম্ন সমর্থন মূল্য কুইন্টাল প্রতি ১৮৬৮ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা গত বছরের মোট ব্যয়ের সাথে ৫০% মুনাফার হিসাবে প্রতি কুইন্টালে ৫৬০ টাকা কম। নয়া কৃষি আইনে এই ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য বা এমএসপি তুলে দেওয়া হবে। এর বিপরীতে মোদীর কর্পোরেট তোষণের নমুনা হলো এ বছর কৃষিপণ্যের ব্যবসার জন্য বড় পুঁজিপতিদের আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ সেচ, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কৃষিপণ্য ক্রয় ও তার ব্যবস্থাপনা, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি এসব ক্ষেত্রে ব্যায়বরাদ্দ ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মধ্যে মোদী সরকারের স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে শৌচাগার নির্মানে দেখা যাচ্ছে ৯০ ভাগই অব্যবহৃত। জনধন যোজনারও ৮০ ভাগ এ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ঢোকেনি। ফসল বীমা যোজনায় ২০১৭-১৮ সালে বড় বীমা কোম্পানিগুলি ২৫০০ কোটি টাকা লাভ করেছে। মোদীর গুজরাট মডেলের চিত্র বিচার করে দেখা যাচ্ছে ২০০১-২০১১ সালে ৩.৩৫ লক্ষ কৃষক হারিয়ে গেছে, বিপরীতে নথীভূক্ত ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়েছে ১৭লক্ষ, এটাই হলো রপ্তানিমুখী কৃষির ফলাফল। এ পথেই নাকি ওরা “সোনার বাংলা” বানাবে!

- জয়তু দেশমুখ     

ddddrddd

কৃষকদের ডাকে প্রতারক মোদির বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে “থালি বাজাও” কর্মসূচী পালিত হল পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চলে

দিল্লীর কৃষকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৬ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় পালবাজার মোড়ে থালা বাজিয়ে, সেই বাজনার তালে তালে স্লোগান দিয়ে মোদীর মন কি বাত ভাষণের বিরুদ্ধে প্রচার করলেন যাদবপুরের সাথিরা। দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ব্যাপক মানুষের। আগে থাকতেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো পথসভা। সভায় বক্তব্য রাখেন কিসান মহাসভার রাজ্য সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, যাদবপুর পার্টি কমিটির তমাল চক্রবর্তী এবং দুই ছাত্র নেতা আকাশ দেশমুখ ও ঋতম মাজি। প্রায় দু ঘন্টা ধরে কৃষি ও কৃষকের প্রশ্নে, মোদী সরকারের কোম্পানিরাজ কায়েম করা, কালোবাজারি মজুতদারী বৈধ করা, খাদ্য সুরক্ষা নিরাপত্তা ধ্বংস করার বিরুদ্ধে বক্তব্য বহু মানুষ দাঁড়িয়ে শোনেন। চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক মানুষের সমর্থন-সহমর্মিতা রয়েছে তা বোঝা যায়। এর পাশাপাশি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে মোদী সরকারের ফ্যাসিস্ট রাজ কায়েমের বিরুদ্ধে নানান দিক থেকে বক্তারা সোচ্চার হন। এই কর্মসূচী সকলকেই উজ্জীবিত করেছে।

দার্জিলিং জেলার ফাঁসীদেওয়া ব্লকের রাঙাপানি অঞ্চলে এক মিছিল পরিক্রমা করে। মিছিল শেষে রাঙাপানি মোড়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য সদস্য বাসুদেব বসু। মিছিলের নেতৃত্ব দেন সারা ভারত কিসান মহাসভার জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, গ্রামীণ মজুর সমিতির নেতা শরৎ সিংহ, শ্রমিক নেতা দীপক ঘোষ। শেষে নরেন্দ্র মোদির কুশপুতুল পোড়ানো হয়।

rrr

 

আন্দোলনরত কৃষকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোতরং ২ নং কলোনি বাজারে থালা বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘মন কি বাত’ বয়কট করে বিক্ষোভ দেখায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন।কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে, শিক্ষা চাকরি স্বাস্থ্যের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে আইসা ও আরওয়াইএ সহ বিভিন্ন গণসংগঠন বেহালার বকুলতলা থেকে মিছিল করে ও সরশুনায় পথসভা হয়।

পাণ্ডুয়ার বেড়েলা – কোচমালি গ্রাম পঞ্চায়েতের কোচমালি রায়পাড়ায় কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে থালি বাজাও কর্মসূচী হয়।

বজবজে সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির কর্মসূচী

দিল্লিতে অবস্থানরত কৃষকদের কৃষি আইন বাতিল এর দাবির সমর্থনে এবং আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর বজবজে মহিলা সমিতির কর্মসূচী পালিত হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদিকা কমরেড কাজল দত্ত, কমরেড দেবযানী গোস্বামী,কমরেড অনিন্দিতা মালিক সহ আরো অনেকে।

গত ২৬ ডিসেম্বর সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে বাখরাহাট বাজারে কৃষক আন্দোলনের শহীদ সাথীদের শ্রদ্ধা জানানো হয়।উপস্থিত ছিলেন সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির দঃ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদিকা কমরেড কাজল দত্ত, কমরেড পূর্ণিমা হখলদার, কমরেড শিপ্রা সরদার সহ আরো অনেকে।

ggaee

নদীয়ায় গণ অবস্থান ও প্রচার কর্মসূচী

৩০ ডিসেম্বর নদীয়ার নাকাশীপাড়া বিধানসভার অন্তর্গত বেথুয়াডহরীতে দিল্লীতে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে দীর্ঘ সময় ধরে এক গণ অবস্থান সংগঠিত হলো। জনবহুল এই গঞ্জে স্থানীয় বহু মানুষ দাঁড়িয়ে বক্তাদের বক্তব্য শোনেন। দিল্লী আন্দোলনে প্রয়াত শহীদদের প্রতিকৃতি সম্মলিত শহীদ স্মারকে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পথ চলতি বহু মানুষ সহমর্মিতা জ্ঞ্যাপন করেন। গত ২৩ ডিসেম্বর ধুবুলিয়া নেতাজীপার্কে অনুরূপ অবস্থান কর্মসূচী সমগ্র এলাকায় ব্যাপক প্রচার পায়। এই দুটি কর্মসূচীতে গ্রামাঞ্চলের কৃষক কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। আগামীদিনে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক আন্দোলনের প্রচারকে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কর্মসূচীগুলিতে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) নদীয়া জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, এআইকেএম রাজ্য সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, আয়ারলার রাজ্য নেতা কাজল দত্তগুপ্ত, এআইসিসিটিইউ নেতা জীবন কবিরাজ, আরওয়াইএ নেতা সন্তু ভট্টাচার্য, জেলা পার্টির নেতা পরিক্ষিৎ পাল, এআইকেএম নেতা কৃষ্ণ প্রামানিক প্রমুখ।

গত ২৬ ডিসেম্বর চাকদা এলাকায় শহর এবং পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে এক প্রচার গাড়ি বিভিন্ন এলাকায় পরিক্রমা করে।

gddd

 

বর্ধমানের কালনা আগ্রাদহ বাজারে সভা হয়।

কালনার অকালপৌষে সভা

২৭ ডিসেম্বর পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২নং ব্লকের অকালপৌষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ডে দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের প্রয়াত কৃষক শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। শহীদদের ছবির ব্যানার সামনে রেখে শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও এক মিনিট নিরবতা পালন করা হল। তারপর কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইন বাতিল ও বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা কমিটির সদস্য কমরেড কুনাল বক্সী, কমরেড অশোক চৌধুরী ও রফিকুল ইসলাম। সভা পরিচালনা করেন কমরেড প্রদ্যুত ঘোষ।

ggg

কুসুমগ্রাম বাজারে গণঅবস্থান

পুর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর বিধানসভার কুসুমগ্রাম বাজারে ৩০ ডিসেম্বর এআইকেএম, আয়ারলা ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মন্তেশ্বর লোকাল কমিটির উদ্যোগে অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অবস্থান বিক্ষোভ চলে। অবস্থান মঞ্চে দিল্লীর আন্দোলনের প্রয়াত কৃষক শহীদদের ছবির ব্যানার রাখা হয়। কমরেড অশোক চৌধুরীর গণসঙ্গীতের মাধ্যমে কর্মসূচীর সূচনা হয়। বক্তব্য রাখেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক কমরেড আনসারুল আমান মন্ডল, এআইকেএম নেতা কমরেড মনসুর মন্ডল, যুব নেতা কমরেড মাহবুব মন্ডল ও কমরেড অশোক চৌধুরী। অবস্থানে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড সলিল দত্ত ও আয়ারলার রাজ্য সভাপতি কমরেড সজল পাল। দাবি ওঠে কেন্দ্রের কৃষক-বিরোধী নয়া কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে। গরিব মানুষের সমস্ত ধরনের ঋণ মকুব করতে হবে। বছরে ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। বক্তারা কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদী সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপ তুলে ধরেন। কৃষি আইনের বিভিন্ন কৃষকবিরোধী দিক তুলে ধরেন এবং কর্পোরেট নির্ভরতার দিকগুলো তুলে ধরেন। বিদ্যুৎ বিল গরিব মানুষের উপর যে অর্থনৈতিক চাপ নামিয়ে আনবে সে দিকগুলো তুলে ধরেন। কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিল করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানান। শেষে জেলা কমিটির সদস্য কমরেড শিবু সাঁতরার জ্বালাময়ী শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে কর্মসূচীর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

খড়দহে সভা

রবিবার ২৭ ডিসেম্বর পার্টির খড়দহ শাখার উদ্যোগে স্থানীয় রহড়া বাজারে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে প্রচার সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিব শংকর গুহ রায়, সুজিত ঘোষ, সুব্রত  দাশগুপ্ত, অর্চনা ঘটক, শিক্ষক পার্থ রায় প্রমুখরা বক্তব্য রাখেন।

কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম

কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে যাদবপুর সান্ধ্য বাজারে এক প্রতিবাদী সংস্কৃতিক সভার আয়োজন করা হয়। আয়োজক, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ অন্তর্ভূক্ত “সংযোগ” সাংস্কৃতিক সংস্থা। সভায় বক্তা ছিলেন সুনীল মন্ডল ও বিরেন ব্যানার্জী। কবিতা পাঠ করেন স্বপ্না চক্রবর্তী ও পার্থ গুহ। স্বরচিত গণসংগীত পরিবেশন করেন প্রণব মুখার্জী, সুব্রত ভট্টাচার্য, নীতীশ রায়। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কান্ডীর সাংস্কৃতিক সংস্থা।

৩০ ডিসেম্বর বাঘাযতীন বাসষ্ট্যান্ডে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে এ্ক প্রতিবাদী  সভার আয়োজন করা হয়। সভার উদ্যোক্তা ছিলেন বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন সাংস্কৃতিক সংগঠন।এই” সংহতি সভা”য় বক্তব্য রাখেন সুপ্রতীপ দেবদাস, অধ্যাপক মানস ঘোষ, ধীরাজ বোস, দিল্লি আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শি ফারুক ইসলাম প্রমুখ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শোভনা নাথ। সভায় প্রতিবাদী ছবি আঁকেন চিত্রশিল্পীরা। সভাটি সুপ্রতিপ দেবদাসের সুচারু পরিচালনায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

ইতোমধ্যেই নাট্যকর্মী জয়রাজ কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে শুরু করেছেন কোলকাতা থেকে দিল্লীব্যাপী পদযাত্রা ও প্রচার কর্মসূচী। সামাজিক মাধ্যমে জয়রাজ জানিয়েছেন নানা রাজ্যের ট্রাক ড্রাইভার সহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি সহমর্মিতা জানাচ্ছেন।

আন্দোলনকারী কৃষকদের সমর্থনে রাজবন্দিদের অনশন

কৃষক স্বার্থ বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে মাসাধিক কাল যাবৎ পথে নেমে আন্দোলনকারী কৃষকরা শুধু তাঁদের দাবিতেই থেমে থাকেননি। তাঁরা দেশের বিভিন্ন জেলে আটক থাকা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে গত ২৩ ডিসেম্বর তালোজা জেলে ভীমা কোরেগাঁও এবং এলগার পরিষদ মামলায় কারাবন্দি লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনকারী কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে  জেলের ভেতরেই একদিনের প্রতীকী অনশনে সামিল হয়ে আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করেছেন। এর চারদিন পর দমদম কেন্দ্রীয় জেলে বন্দি রাজনৈতিক বন্দিরা গত ২৭ ডিসেম্বর এই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে একদিনের প্রতীকী অনশন করেছেন। পরেরদিন অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের রাজনৈতিক বন্দিরাও এই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে একদিনের অনশনে সামিল হয়েছেন। এভাবেই আমাদের দেশের কারারুদ্ধ রাজনৈতিক বন্দিরা সরকারের কৃষকস্বার্থ বিরোধী তিনটি বিল প্রত্যাহারের দাবির প্রতি নৈতিক সমর্থন জ্ঞাপন করে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

pat

বিহারে রাজভবন অভিযান

সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ডাকে ২৯ ডিসেম্বর পাটনায় হাজারে হাজারে কৃষক রাজভবন অভিযানে সামিল হন। সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য সম্পাদক কুনাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি মারফত বিহারের কৃষকদের এই ঐতিহাসিক অভিযানকে অভিনন্দিত করে তিনটি কালা কৃষি আইনকে বাতিল, বিদ্যুৎ বিল ২০২০-র প্রত্যাহার, মান্ডি ব্যবস্থার পুনপ্রতিষ্ঠা এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ভিত্তিতে ধান সহ অন্যান্য ফসল ক্রয়ের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা প্রদানের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার আবেদন রাখেন। তিনি বলেন, “আজকের এই রাজভবন অভিযান প্রমাণ করলো, পাঞ্জাবের মতো বিহারের কৃষকেরাও মোদী সরকারের ওই তিনটি কৃষি বিরোধী আইনের পুরোপুরি বিরুদ্ধে। বিহারের কোথাও এমএসপি-র ভিত্তিতে ধান ক্রয় করা হয় না। বিহারে মান্ডি ব্যবস্থা গুটিয়ে ফেলা হয়েছে ২০০৬ সালেই। এর বিরুদ্ধেই বিহারের কৃষকেরা তাদের ক্রোধ ব্যক্ত করতে আজ রাজভবন অভিযানে পথে নামেন এবং বিজেপি জেডিইউর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কৃষকদের এই দাবির সামনে সরকারকে মাথা নোয়াতেই হবে।

কৃষকদের শান্তিপূর্ণ রাজভবন অভিযানের উপর যে পুলিশী দমন নেমে আসে কমঃ কুনাল তার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বিক্ষোভরত কৃষকদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়ার বদলে সরকার তাদের উপর লাঠি গুলি চালিয়েছে। সরকারী এই নিপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। পুলিশী দমনের দরুন বেশ কিছু কৃষকের গুরুতরভাবে আহত হওয়ার রিপোর্ট এসেছে।

বিধান সভার সংসদীয় দলের নেতা মেহবুব আলাম, এআইকেএম-এর জাতীয় পরিষদের নেতা সুদামা প্রসাদ, আরওয়াইএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি মনোজ মঞ্জিল, আইসার সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভ সহ সিপিআই(এমএল)-এর সমস্ত  বিধায়ক, কৃষক, ছাত্র ও মহিলা সংগঠনের কর্মীরা এই রাজভবন অভিযানে সামিল হন। ভূতপূর্ব বিধায়ক এবং এআইএআরএলএ-র সাম্মানিক সভাপতি রামেশ্বর প্রসাদ-এর মতো প্রবীণ নেতাও নবীনদের সাথে পা মেলান কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে।

ddddddd

চলমান কৃষক আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে নয়া কৃষি আইন থাকলেও, কৃষকদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল বিদ্যুৎ বিল (সংশোধনী) ২০২০ প্রত্যাহার। বর্তমান নিবন্ধে আমরা এই স্বল্পালোচিত বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করব। ওয়াকিবহাল মহলের আশঙ্কা এই বিলটি পাশ হলে দেশের কৃষকদের উপর বার্ষিক ১ লক্ষ কোটি টাকার অতিরিক্ত বোঝা চাপবে।

আলোচনার সুবিধার্থে এই প্রস্তাবিত বিলটি বিদ্যুৎ-এর দামের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন চায় তা প্রথমে দেখে নেব। বর্তমানে যারা ধনী (বিদ্যুৎ খরচ তারাই বেশি করে) তাদের বিদ্যুতের দাম  বেশি দিতে হয় এবং যারা গরিব (বিদ্যুৎ-এর খরচ তাদের কম) তারা তুলনায় কম দাম দেয়। একইভাবে গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষ এবং কৃষকদের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-এর দাম কম হয়। এই বিষয়টাকে বলা হয় ক্রস সাবসিডি। বর্তমান বিলে এই ক্রস সাবসিডির ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বলা হয়েছে গ্রাহককে (সে ধনকুবের হোক বা নিরন্ন চাষি) বিদ্যুৎ পরিবহনের প্রকৃত দাম (cost to serve the consumer) দিতে হবে। এই সংশোধনীর ফলে প্রকৃত অর্থে কৃষক তথা গ্রামীণ গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বেশি দিতে হবে কারণ গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ পরিবহণের খরচ অনেক বেশি। আর বড়ো শিল্পের মালিক তথা ধনী গ্রাহকদের বিদ্যুতের খরচ কম হবে স্বাভাবিক অবস্থায়। ক্রস সাবসিডি ব্যবস্থা চালু থাকায় এতদিন ধনী গ্রাহককে বিদ্যুতের বেশি দাম যা দিতে হত তা গ্রামীণ কৃষক ও দরিদ্র জনতাকে ভর্তুকি দিতে কাজে লাগত। প্রথমেই এই বিলে কলমের এক খোঁচায় গরিবদের জন্য চলে আসা সমস্ত ভর্তুকিকে বাতিল করা হল। তারপর বলা হয়েছে স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে। এখানে ‘cost to serve’ কথাটি থেকে পরিষ্কার বর্তমানের তুলনায় আগামী দিনে গ্রাম ভারতে বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে যাবে। সোজা কথায় কৃষি, গৃহস্থালি, শিল্প যে ক্ষেত্রেরই গ্রাহক হোক না কেন সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে যে ব্যয় হবে তাই গ্রাহককে মেটাতে হবে। এই পলিসিতে গ্রামীণ মানুষকে বিদ্যুতের বেশি দাম দিতে হবে কারণ এদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে কোম্পানিগুলোর ব্যয় তুলনামূলক ভাবে বেশি। দীর্ঘ পরিবহণ ও বিতরণ (transmission and distribution) লাইন ও স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমারের জন্য পরিষেবা খরচ বেশি হয়। অন্যদিকে শিল্প গ্রাহকরা সোজাসুজি হাই টেনশন লাইন থেকে বিদ্যুৎ নেয় বলে নতুন আইনে তাদের কম দাম দিতে হবে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে কৃষক ও গ্রামীণ জনতা এতদিন যে ভর্তুকি পেত তা কি উঠে যাচ্ছে? এখানেও সরকারের তরফে একটা চালাকি লুকিয়ে আছে। বিলে বলা হয়েছে যে, যদি কোন রাজ্য সরকার কোন একটি ক্ষেত্রের গ্রাহকদের সুবিধা দিতে চায় তবে তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা দিতে হবে (direct benefit transfer)। এই প্রশ্নেও কৃষকরা বিরোধিতা করছেন। এই বিল অনুসারে রাজ্য সরকার প্রথমে যাদের ভর্তুকি দরকার তাদের চিহ্নিত করবে। কিন্তু যারা এই ভর্তুকি পাবে তাদের প্রথমে নিজের পয়সায় বিদ্যুতের বিল মিটিয়ে দিতে হবে। আর যদি সেটা সে না দিতে পারে তবে তার বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই ঋণভারে জর্জরিত ক্ষুদ্র কৃষক ও গ্রামীণ দরিদ্র জনতা এর ফলে আরো বিপদে পড়বেন। ভারতে রাজ্যগুলির বর্তমান আর্থিক অবস্থার দিকে নজর ফেরাই তাহলে গ্রাহকদের একটা বড়ো অংশের (কৃষক, শ্রমজীবী পরিবার, সরকারী স্কুল, হাসপাতাল, ক্ষুদ্র শিল্প) ভর্তুকি রাজ্য সরকারগুলি আদৌ দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যাবে। জিএসটি রাজ চালু হবার পরে সমস্ত রাজ্যের আয় কমে গেছে, কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটি বাবদ রাজ্যগুলির প্রাপ্য টাকা দিতে পারছে না – এই অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে ভর্তুকি পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। এই বিষয়টি উপলব্ধি করে আজ বহু রাজ্য সরকারও এই বিলের বিরোধিতা করছে। এছাড়া ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার (ডিবিটি) নীতির দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। যে সমস্ত প্রকল্পে বেনিফিসিয়ারিকে চিহ্নিত করা সহজ (যেমন শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ) সেখানেও মাসের পর মাস টাকা বাকি থাকছে। রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ে অজস্র অভিযোগ। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ডিবিটি চালু হলে একমাত্র যাদের নিজস্ব জমির দলিল আছে তারাই ভর্তুকি পাবে। যারা লিজে জমি নিয়ে চাষ করে বা ভাগচাষি তাদের ভর্তুকি পাওয়ার সুযোগ এই বিলে থাকছে না।

২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষে দেশে যত বিদ্যুৎ বিক্রি হয়েছিল তার মধ্যে ২২.৪% হয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে। সে বছর দেশে বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৬.১৩ টাকা ইউনিট। যদি কৃষকেরা ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ না পেত তাহলে কৃষকদের মেটাতে হত ১,৩২,০০০ কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে নতুন ফর্মুলায় (cost to serve) ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে যাবে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে নতুন বিলে কৃষকদের অতিরিক্ত ১ লক্ষ কোটি টাকা মেটাতে হবে। যদি ধরেও নিই এর একটা অংশ দেরীতে হলেও কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকি বাবদ ফেরত আসবে। তবুও চাষের খরচ অনেকটাই বেড়ে যাবে। যদি একজন কৃষক ৫ অশ্বশক্তি বিশিষ্ট পাম্প প্রতিদিন ৪ ঘন্টা হিসাবে সপ্তাহে দুদিন করে চালায় তবে তাকে বিল মেটাতে হবে ৩,০০০ টাকা যা বর্তমান সময়ের চেয়ে ৫০০% বেশি। যদিও রাজ্য ভেদে এই খরচের কিছু উনিশ–বিশ হবে তবে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর এই বিল ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে। ২০১৮-১৯ সালের আর্থিক বর্ষে ভর্তুকির ৫৫ শতাংশ ছিল ক্রস সাবসিডি ও ৪৫ শতাংশ গেছে সরাসরি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলোর ঘরে। যদি রাতারাতি এই ক্রস সাবসিডি তুলে দেওয়া হয় তাহলে রাজ্যগুলির আর্থিক স্থিতি ভেঙে পড়তে পারে। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন বিদ্যুতের ভর্তুকিতে শুধুমাত্র ধনী কৃষকরাই উপকৃত হন এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ভাগে কিছুই জোটে না। কিন্তু সরকারি তথ্যে একথার সমর্থন মেলে না। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গনাতে ভূগর্ভস্থ জলের ৪০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষকরা পায় যাদের জমির পরিমাণ এক হেক্টরের কম, ৫০ শতাংশ পায় ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকরা। পঞ্জাব ও রাজস্থানে ৩০%-৪০% ভূগর্ভস্থ জল পায় সেই কৃষকরা যাদের জমির পরিমাণ ৪-১০ হেক্টর, আরো ৪০% পায় ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকরা। বরং ভারতে কৃষি সমৃদ্ধ রাজ্যগুলিতে ক্যানেলের জলে বেশি অধিকার ধনী কৃষকদের।

সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি সরকার যে সমস্ত আইন লাগু করেছে তার একটা অন্যতম লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে কেন্দ্রীভূত শাসনের পথ প্রশস্ত করা। কৃষি আইন, নয়া শিক্ষানীতির মতো প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিলও তার ব্যতিক্রম নয়। সংবিধানে বিদ্যুৎ যুগ্ম তালিকায় আছে এবং গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়াটা রাজ্যের উপরেই  বর্তায়। কিন্তু প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন তৈরি করবে কেন্দ্র এবং এক্ষেত্রে রাজ্যের সম্মতি জরুরি নয়। একই ভাবে এই বিলে ‘electricity contract enforce authority’ বলে একটি সংস্থা তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে যা আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণকে আরো দৃঢ় করবে। এই প্রসঙ্গে একটি বহু আলোচিত কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। ৯০’এর দশকে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির চাপে ভারতের শাসকশ্রেণি যে আর্থিক কর্মসূচী চালু করে তাতে বাকি ক্ষেত্রগুলির মতো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমানো ও কর্পোরেট অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত করার কর্মসূচী নেওয়া হয়। ২০০৩ সালে এই ব্যাপারে যে সংশোধন আনা হয় তাতে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উৎপাদন, বিতরণ, সংবহন, বাণিজ্যগুলিকে আলাদা করা ও বেসরকারি বিনিয়োগের পথ খোলা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কর্পোরেটকরণের সবচেয়ে বড়ো কর্মসূচী ছিল মহারাষ্ট্রের এনরন প্রকল্প যা নিয়ে দেশজোড়া বিতর্ক হয়। এরপর ২০১৪, ২০১৮-তেও নানান সংস্কার আনা হয়েছে। বর্তমান সংস্কার সেই ধারাবাহিকতারই অঙ্গ। বর্তমান নিবন্ধে আমরা কৃষির ক্ষেত্রে এই বিল কী সর্বনাশা প্রভার আনবে তা নিয়ে আলোচনা করলাম কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বিদ্যুৎ বিলের জনবিরোধী চরিত্রকে উন্মোচিত করা দরকার।

- সুমনকল্যাণ মৌলিক    

ggggefff

লকডাউনে বিপর্যস্ত দরিদ্র মানুষের উপর চেপে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণের বোঝা ও সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থার কিস্তি আদায়ের জুলুমবাজি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে গত মার্চ-এপ্রিল মাস থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সংগঠিত হতে শুরু করেন, গড়ে ওঠে ঋণ মুক্তি কমিটি (আয়ারলার অন্তর্ভুক্ত)। এই সংগঠনের প্রথম রাজ্য কনভেনশন সংগঠিত হয়ে গেল গত ২৮ ডিসেম্বর চুঁচুড়ায়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২৫০ জন প্রতিনিধি ও সংগঠক উপস্থিত হন এই সম্মেলনে। ঋণভারে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যাকারী সমস্ত মানুষ ও রাজধানীতে নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে থাকাকালীন মৃত অন্নদাতাদের অর্থাৎ রাষ্ট্রের জনবিরোধী নীতির দ্বারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপরে শুরু হয় খসড়া প্রতিবেদন পাঠ ও তার উপরে আলোচনা। বক্তাদের মধ্যে ৯০% ছিলেন মহিলা। এছাড়াও কিছু আইনজীবী, গণআন্দোলনের সংগঠক, শিক্ষক প্রমুখ পরামর্শ ও অনুপ্রেরণামূলক বার্তা রাখেন।

আগে থেকে সতর্ক না হয়ে মাত্র ৪ ঘন্টার নোটিশে নামিয়ে আনা কুপরিকল্পিত লকডাউন গোটা দেশের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের পক্ষে করোনা আক্রান্ত না হলেও বেঁচে থাকা একপ্রকার দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় কেন সরকার অতিমারীর মতো এত বড় বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে না ‘বিপর্যয় মোকাবিলা আইন’-এর ১৩ নং ধারা মোতাবেক তাদের ঋণ মকুব করে? সরকারী তথ্যই বলে দিচ্ছে যে, ১২.২ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন লকডাউনে! অতএব প্রকৃত সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আরো অনেকটা বেশি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো ঋণফাঁদে পড়ে অসহায়, সদস্যরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, কৃষকদের অবস্থাও তথৈবচ, বিপন্ন শহুরে ঋণ নির্ভর বড় অংশের নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষও। মোদী সরকার ‘আত্মনির্ভরশীলতা’-র ঢাকঢোল পেটাতে ব্যস্ত! সংবিধানের ২১ নং ধারা অনুসারে নাগরিকদের জীবন জীবিকার অধিকার নিশ্চিত করার ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই সরকারের নেই। দেশের বরিষ্ঠ আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টেও এসব প্রশ্নে তোলপাড় করছেন, শীর্ষ আদালত দিশেহারা। সরকার মাত্র ৬ মাসের সুদের উপর সুদ মকুব করেই “আর কিছু পারবো না” মনোভাব দেখিয়ে হাত তুলে রেখেছে। তবে এটুকুও হতো না বাংলা, পাঞ্জাব, অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু সহ রাজ্যে রাজ্যে লাগাতার ঋণ মুক্তি আন্দোলন শুরু না হলে। অথচ এই সরকারটাই লকডাউনের প্রথমদিকে রামদেব, নীরব মোদী, বিজয় মাল্য সহ ৫০ জন শিল্পপতির ৬৮, ৬০৭ কোটি টাকা লোন মকুব (রাইট অফ) করে দিতে পেরেছে!

এদিকে ঋণগ্রস্ত গরিব মানুষের ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে ঋণ সংস্থার এজেন্টদের হানাদারি, মহিলাদের উদ্দেশ্যে অশালীন কথাবার্তা, পুলিশ দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করানোর বেআইনি হুমকি। কিন্তু যেখানেই মানুষ সংগঠিত ও সচেতন সেখানেই কোম্পানি গুলোর এজেন্ট ও উচ্চতর কর্তাদের সাথে মুখে মুখে তর্ক ও প্রয়োজনে এলাকা ছাড়া করে চলছে জনতার সাহসী প্রতিরোধ। কৃষকদের দাবির সাথে ঋণ মুক্তির দাবিকে যুক্ত করে পোস্টার, হ্যান্ডবিল সহ ব্যাপক প্রচার চালিয়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। এলাকা স্তরে বিডিও, মহকুমা শাসক, জেলাশাসক সর্বত্র বিক্ষোভ, ডেপুটেশন সংগঠিত হয়েছে ঋণ মুক্তি কমিটির তরফে। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাজার হাজার পোস্টকার্ড পাঠানো হয়েছে। মাইক্রো ফিনান্স সংক্রান্ত আইনবিধিকে সামনে এনে এজেন্টদের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে থানা ডেপুটেশন, বন্ধন, উজ্জ্বীবন সহ বিভিন্ন মাইক্রো ফিনান্সের অফিস ঘেরাও অভিযান সংগঠিত হয়েছে। থানায় গণস্বাক্ষর সহ জুলুমকারী এজেন্টদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন গুড়াপ, আরামবাগের মহিলারা। এইসব লড়াই না থাকলে ঐ কঠিন দিনগুলোতে জুলুমবাজির অপমানের জ্বালায় রাজ্য জুড়ে চলতো আত্মহত্যার মিছিল। ঋণ মুক্তি কমিটি এই সত্য তুলে ধরেছে যে, লকডাউনের আগে মার্চ মাসের গোড়া পর্যন্ত যাঁরা (বিশেষত মহিলারা) নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেছেন তাঁরাই আজ কিস্তি দিতে পারছেন না সরকারের সর্বনাশা নীতি ও আকস্মিক কুপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে, কাজেই সরকারকেই তাঁদের সুরক্ষার দায় নিতে হবে। ঋণ জর্জরিত মানুষ আত্মবিশ্বাসের সাথে আজ জেনেবুঝে প্রশ্ন করছেন যে, কোম্পানিগুলো কেবল নিজেদের মুনাফার সংকীর্ণ স্বার্থে কেন বেআইনিভাবে এক একজন ব্যক্তিকে একসাথে ৪/৫টি করে লোন দিয়ে ফাঁদে ফেলেছে? যেখানে ২০১৪ সালের মাইক্রো ফিনান্স সংক্রান্ত আইনি নির্দেশাবলী বলছে, কোনো ব্যক্তির নেওয়া একটি ঋণের অন্তত ৭০% শোধ না না হলে তাকে দ্বিতীয় ঋণ দেওয়া যাবে না এবং একজনকে একসাথে ১.২৫ লক্ষ টাকার বেশি ঋণ দেওয়া চলবে না। সুতরাং আইন ভেঙে মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদেরকে একের পর এক ঋণ নিতে প্রলুব্ধ করে ঋণফাঁদে জড়িয়ে দেওয়ার দায় অবশ্যই কোম্পানিগুলোর, ঋণগ্রহিতার নয়। সুতরাং কেবল সরকারের নয়, কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব হল মেহনতি মানুষকে ঋণছাড় দিতে এগিয়ে আসা।

gggg

 

এইসব প্রশ্ন, আরো বিস্তারিত আইনী পরামর্শ ও বিভিন্ন প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা এবং আগামী পরিকল্পনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো সংগঠনের প্রথম রাজ্য কনভেনশন। ক্ষোভ প্রকাশিত হল রাজ্য সরকারের প্রতিও, কারণ এই সংকটে কেবল স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর একাউন্টে এককালীন ৫ হাজার টাকা দিয়েই দায় সেরেছে মমতা ব্যানার্জীর সরকার। পুজো কমিটিগুলোকে ৫০০০০ টাকা করে সাহায্য করলেও লক্ষ লক্ষ ঋণগ্রস্ত গরিব মানুষের জন্য সরকারের কোনো প্রকল্প নেই। বাড়িতে বাড়িতে এজেন্টদের জুলুমবাজি দেখেও রাজ্য প্রশাসন নির্বিকার! তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কর্ণাটকে মহাজনি জুলুম বন্ধ করতে আইন রয়েছে অথচ এ’রাজ্যে নেই। আগামীদিনে তাই এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কড়া হস্তক্ষেপ দাবি করতে এক রাজ্যব্যাপী ‘কলকাতা চলো’ কর্মসূচীর ডাক দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে, যে কর্মসূচী প্রবল ঠান্ডায় দিল্লির রাস্তায় বসে থাকা কৃষকদের থেকে শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্রের সরকারকেও এই হুঁশিয়ারি পৌঁছে দেবে যে, সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তিকে অবহেলা করলে ফল ভুগতে হবে।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের পাশে সর্বতোভাবে রয়েছে বলে জানিয়েছে। ঋণ মুক্তি কমিটির সমস্ত সদস্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, আসন্ন নির্বাচনগুলিতে তাঁরা প্রতিটা রাজনৈতিক দলের দাবি সনদে এই ঋণ মুক্তির দাবিটা আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখবেন। এই দাবি ইস্তেহারে জায়গা না পেলে একটিও ভোট নয়। আগামীর লড়াইয়ে আরো সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত নেতৃত্বদানের জন্য একটি রাজ্য নেতৃত্বকারী কমিটির প্রাথমিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, যেটি কিছুদিনের মধ্যেই আরো কিছু মানুষকে সামিল করে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে চলেছে। আগামী ৮ জানুয়ারী রাজ্যের সমস্ত ব্লকে ব্লকে দরিদ্র মানুষের ঋণ মুক্তির দাবিতে ও দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে গণ অবস্থান কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে।

- সৌরভ রায়    

gggaammm

পুর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকে ঋণমুক্তি কমিটির নেতৃত্ব বিডিও, থানা ডেপুটেশন, বিক্ষোভ, গণ কনভেনশন, বারবার মিছিল, অবরোধ আন্দোলনের ফলে মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের জুলুম নির্যাতন কমেছি। কিন্ত বর্তমানে লকডাউন শিথিল হওয়ার পর আবার এজেন্টদের জুলুম নির্যাতন বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই, যেহেতু ঋণ মুকুবের প্রশ্নে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই, আবার এজেন্টদের বিভ্রান্তিমুলক প্রচার ও কৌশল অবলম্বন শুরু হয়েছে। যেমন, ‘পুরো কিস্তির টাকা শোধ করতে না পারলেও ১০০/২০০ টাকা দিলেই চাপ কমবে’ ইত্যাদি। তাই অনেকে এভাবেই রেহাই পাওয়ার চেষ্টাও করছেন। শেষ বিচারে আরও বেশি ঋণ ফাঁদে জড়াচ্ছেন। আসলে ঋণমুক্তির আন্দোলনকে দুর্বল করার চক্রান্ত। তাই গত ২৪ ডিসেম্বর জামালপুর ব্লকের বন্ধন ব্যাংকে ঋণমুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে ঘেরাও বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। মিছিল করে বন্ধন ব্যাঙ্কের সামনে জমায়েত হয়। ব্যাংক তাদের গেট বন্ধ করে দিলেন। অনেক সময় বিক্ষোভ অবরোধ চলার পর ঋণ মুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দিতে চায়। কর্তৃপক্ষ ডেপুটেশন নিতে অস্বীকার করেন। পুলিশে খবর দেন। জামালপুর থানার পুলিশ আসে। পুলিশও বলেন আপনারা অগ্রিম জানিয়ে আসেন নাই। তাই ডেপুটেশন নেওয়ার বাধ্যতা নেই। ঋণমুক্তি কমিটির পক্ষ থেকেও আইনের প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ করা হয়। পরে আন্দোলনরত ঋণগ্রস্ত মহিলাদের অনঢ় অবস্থানের ফলে বাধ্য হয়ে ডেপুটেশন গ্রহণ করার ব্যবস্থা করেন। ডেপুটেশনে দাবি ছিল –

১) কিস্তির টাকা শোধ করতে না পারার জন্য ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপর এজেন্টদের জুলুম নির্যাতন, অপমান-অসম্মান বন্ধ করতে হবে।
২) কিস্তির টাকা শোধ ২ বছর স্থগিত রাখতে হবে। এই সময়ের অতিরিক্ত সুদ নেওয়া চলবে না। ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সমস্ত ধরনের গরিবদের ঋণ মুকুবের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।

এই কর্মসূচীর নেতৃত্ব দেন কমরেড কুনাল বক্সী, রহিমা খাতুন ও নিতাই ক্ষেত্রপাল। সামগ্রিকভাবে উপস্থিত থেকে সংগঠিত করেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড সলিল দত্ত।

২৫ ডিসেম্বর খন্ডঘোষ থানার বেরুগ্রামে ঋণমুক্তির দাবিতে গন কনভেনশন সংগঠিত হয়। শতাধিক ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপস্থিতিতে এই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল। কনভেনশনে বিভিন্ন বক্তা এজেন্টদের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং আন্দোলন শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। বক্তব্য রাখেন কমরেড কুনাল বক্সী ও সলিল দত্ত। ২৮ ডিসেম্বর রাজ্য কনভেনশনে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় প্রতিনিধিদের যাওয়ার আহ্বান রাখা হল।

২৬ ডিসেম্বর ঋণমুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে ৬০ জন ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপস্থিতিতে পুর্বস্থলী থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হল। নেতৃত্ব দেন কমরেড অশোক চৌধুরী।

tttraattt

চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের জন্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে কালবিলম্বের কারণে জয়েন্ট মুভমেন্ট কমিটির উদ্যোগে অনির্দিষ্টকালীন গণঅবস্থান তিন সপ্তাহ অতিক্রম করেছে। ত্রিপুরার শিক্ষক কর্মচারী আন্দোলনের ইতিহাসে এই আন্দোলন নয়া ইতিহাস রচনা করেছে। বর্তমান সময়ের নিরিখে আজ এই আন্দোলনস্থল যেন শিক্ষকদের শাহীনবাগে পরিণত হয়েছে। পূর্বতন সরকারের ভুলের কারণে ২০১৪ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে ১০,৩২৩ জন শিক্ষকের চাকরিচ্যুতি রাজ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ও সমাজ জীবনে এক বিপর্যয় নামিয়ে নিয়ে আসে। তারপর এডহক ভিত্তিতে ২০২০-র ৩১ মার্চ পর্যন্ত  শিক্ষকেরা দায় দায়িত্ব পালনের পর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে তাদের চাকরিচ্যুতি ঘটে। ইতিমধ্যে এত বড়ো সংখ্যায় শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতি স্বাভাবিক নিয়মে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বড় ইস্যু হয়ে ওঠে। ২০১৮-র ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে বর্তমান শাসক দল বিজেপি-র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও নেতারা প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের জন্য বিকল্প সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি রাখেন। ভিশন ডকুমেন্টে প্রদত্ত  প্রতিশ্রুতি প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুই বছর ধরে সরকার নীরব। ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আইনের দরজা তাদের জন্য একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০-র ৩১ মার্চের পর থেকে এডহক চাকরি চলে যাওয়ায় চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। তাঁরা আর কোনও উপায় না দেখে আন্দোলনের পথ গ্রহণ করেন। রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করে দেখার জন্য সময় দেন। সর্বশেষ বিধানসভা অভিযানের পর মুখ্যমন্ত্রী দু’মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সেই সময় অতিক্রান্ত। শিক্ষামন্ত্রী চার হাজার শূন্যপদে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা বললেও চাকরিচ্যুতদের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। এই পদ্ধতি তাদের জন্য বিকল্প চাকুরি কোনোভাবেই সুনিশ্চিত করে না। দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনীহা, দোদুল্যমানতা শিক্ষকদের জীবনে হতাশা ও অনিশ্চয়তাকে তীব্র করে তুলেছে। সরকারের অবহেলায় এবং অনীহার কারণে প্রয়াত ৭৭ জন শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন অনুষ্ঠান আজ অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে।

এই উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নে আজ আইনের বিচার যেখানে অবরুদ্ধ, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা সেখানে শুরু। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মানুষের মর্যাদাকে সামাজিক মৌলিক গুণাবলী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আমাদের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায়। জীবনের অধিকার মৌলিক অধিকার, তাকে রক্ষা করা আজ রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

তাই চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের ও তাদের আপনজনের বিপন্ন জীবন বাঁচাতে, তাদের প্রতি ন্যায় ও স্বচ্ছতা দিতে সরকারকে আর কাল বিলম্ব না করে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশান ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি। তেরো হাজার শূন্যপদ পুনরায় সৃষ্টি করে সহজভাবে তাদের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য দাবি জানাচ্ছে। রাজ্যে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও গণতন্ত্র প্রিয় নাগরিকদের তাদের জন্য বিকল্প চাকরির দাবিতে সোচ্চার হয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে বাধ্য করতে এগিয়ে আসার আহ্বান রাখছে।

ddddsssa

গত ২৮ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দশটি আদিবাসী সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি তুলেছে। এখনও পর্যন্ত জনগণনায় আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্মপরিচিতিকে গ্রাহ্য করা হয়নি। ২০২১-এর জনগণনায় ‘অন্যান্য’ কলামটিও তুলে দেওয়া হয়েছে। আরএসএস-এর পক্ষ থেকে আদিবাসীদের ‘হিন্দু’ হিসেবে নথীভুক্ত করানোর জন্য প্রবল চাপও তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু আদিবাসী সংগঠনগুলি স্পষ্ট জানিয়েছে যে, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাওঁ, হো, ভূমিজ, বেদিয়া, শবর, খেরিয়া, মাহালি সহ বিভিন্ন ‘শিডিউল্ড ট্রাইব’ জনগোষ্ঠির সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তাঁরা ‘সারনা’ ধর্মের স্বতন্ত্রতা দাবি করছেন। সারনা ধর্মের নিজস্ব উপাসনা স্থল আছে, জাতবর্ণ ব্যবস্থার অস্তিত্ব সারনা ধর্মে নাই, মূর্তি পূজা নয় প্রকৃতি পূজা করা হয়, পণপ্রথা চলে না, পারস্পরিক সহযোগিতায় গোষ্ঠিবদ্ধ সমাজ আদিবাসীদের। সুপ্রিম কোর্টও বিভিন্ন রায়ে বারবার স্পষ্ট জানিয়েছে যে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, হিন্দু বিবাহ আইন, হিন্দু দত্তক আইন ইত্যাদি হিন্দু ব্যক্তিগত আইনগুলি আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। অনেক রায়ে সারনা ধর্মের উল্লেখ করাও হয়েছে। ফলত আদিবাসীরা কোনও অর্থেই হিন্দু নয়। প্রেস বিবৃতিতে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৫ ও অনুচ্ছেদ ২৬(খ)’এ প্রদত্ত ধর্মাচরণের স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয় যে ২০২১-এ যে জনগণনা হতে চলেছে সেখানে ধর্ম নথিভুক্তির ‘অন্যান্য’ কলামটি তুলে দেওয়া হয়েছে যার ফলে এরাজ্যের পঞ্চাশ লক্ষ আদিবাসী মানুষ অস্বীকৃত থেকে যাবে।

২০১১’র জনগণনায় ‘অন্যান্য’ কলামের হিসেব অনুযায়ি সারনা ধর্ম বিশ্বাসের মানুষের সংখ্যা ৪৯,৫৭,৪৬৭। আদিবাসী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল সান্তাল কাউন্সিল’-এর কার্যকারী সভাপতি নরেশ কুমার মুর্মুর জারি করা প্রেস বিবৃতিটিতে গুরু গোমকে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু সংকলিত ‘হিতাল’ গ্রন্থটিকে সারনা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং জানানো হয় যে মারাং গোমকে জয়পাল সিং মুণ্ডা, সিদো কানহো বিরসা, ফুলো ঝানো তিলকা সহ বহু আদিবাসী মহাজনেরা সারনা ধর্ম প্রচার করেছেন। ২০১১ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে আন্তর্জাতিক ধর্ম সম্মেলনে মুকেশ বিরুয়া সারনা ধর্মের প্রতিনিধিত্বও করে এসেছেন। ইতিমধ্যে, গত ১১ নভেম্বর ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে সারনা ধর্ম কোডের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধির সাথে একপর্ব প্রাথমিক কথা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। আগামি ৩ জানুয়ারি, মারাং গোমকে জয়পাল সিং মুণ্ডার জন্ম দিবসে নেতাজী ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে সকাল ১১টা থেকে ‘সারনা ধর্ম মহাসম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে আদিবাসী সংগঠনগুলি।

dddrrraaeeee

কোভিড ১৯এর থাবায় ক্ষতবিক্ষত গোটা দুনিয়া বিপুল প্রাণহানি ও অর্থনীতির ধ্বংসাবশেষ নিয়ে নতুন আরেকটা বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। গত বর্ষশেষে ভারত দেখেছিল শাহিনবাগ – সিএএ’র বিরুদ্ধে জাগ্রত জনতার, বিশেষত সংখ্যালঘু মহিলাদের অসমসাহসী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী আন্দোলন। আর, এ বছর, প্রবল শীতের ভ্রুকুটিকে ফুৎকারে উড়িয়ে হাজার হাজার কৃষক অবরুদ্ধ করে দিয়েছে দেশের রাজধানী। কৃষক রমনীরাও সামিল ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’। আবালবৃদ্ধবনিতা,  কিশোর কিশোরী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি ট্রাক্টরে চালিয়ে যাচ্ছে পড়াশুনা, যা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেরও নজর কেড়েছে। দুর্ভেদ্য লোহার ব্যারিকেড, কনক্রিট বোল্ডার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো রাজধানী দখলের অদম্য অপ্রতিরোধ্য জেদের সামনে। সমকালীন দুনিয়া এতো বড় কৃষক আন্দোলন দেখেনি এ বিশ্বে, যা ব্যাপ্তিতে দিগন্তপ্রসারী, গভীরতায় অতলস্পর্শী, তাৎপর্যে তুলনাহীন, হিম্মত ও প্রত্যয়ে আসমান ছুঁয়েছে।আর চরম দুর্বিনীত, নৃশংস রাষ্ট্রনায়কেরা হিমশীতল অবিসংবেদী মনোভাব নিয়ে তা উপেক্ষা করার মনোভাব নিয়ে চলেছে।

শুধু আন্দোলনের প্রশ্নেই নয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই উপেক্ষা, অবহেলা, অর্দ্ধসত্য ও মিথ্যাভাষণ। বহু ঢাক-ঢোল পেটানো স্টিমুল্যাস প্যাকেজে জাতীয় আয় বা জিডিপি’র মাত্র ২ শতাংশ বিনিয়োগ করে তাকে ২০ শতাংশ হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে। মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি আনতে দিন কয়েক আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রাঘব বোয়ালেরা ফের জানালেন, আর্থিক বৃদ্ধিতে গতি দিতে চাহিদা বাড়াতে কেন্দ্রীয় সরকারকে ব্যয় বাড়াতে হবে। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবেশ খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে, সাধারণ মানুষের জন্য আবাস প্রকল্পের বিস্তার ঘটাতে। ৪ ডিসেম্বর শীর্ষ ব্যাঙ্কের ঋণ কমিটির বৈঠকের যে কার্যবিবরণী প্রকাশ পায়, তাতেও সরকারকে চাহিদা বাড়ানোর জন্য জোরালো সওয়াল করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, চাহিদা বৃদ্ধির জন্য ফিরিয়ে আনতে হবে কাজের সুযোগ, তৈরি করতে হবে আয় বাড়ানোর রাস্তা। কিছুদিন আগে দেশের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা বলেন, “২০২০-২১’এ ভারতের চলতি বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট উদ্বৃত্ত হওয়ার সম্ভানা আছে”। তিনি আরও বলেন, “এপ্রিল-জুন ২০২০’র ত্রৈমাসিকে আমাদের কোষাগারে ১৯.৮ বিলিয়ান মার্কিন ডলার গচ্ছিত রয়েছে। পরের ত্রৈমাসিকগুলোতে তেমন ভাল ফলাফল না পাওয়া গেলেও আমাদের হেফাজতে থাকবে চলতি অ্যাকাউন্টের উদ্বৃত্ত”। আসলে, মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা এই প্রবণতাকে ‘কম উত্তপ্ত’ (আন্ডার হিটিং) হয়ে ওঠার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার অর্থ, চাহিদায় ধ্বস নেমেছে, আর মোদীর বহু বিজ্ঞাপিত স্টিমুলাস প্যাকেজ এখনো পর্যন্ত চাহিদার মরা গাঙে বান আনতে পারলোনা। আর, বিরোধাভাস এটাই, এই কম উত্তপ্ত আর্থিক পরিমন্ডলেও খুচরো মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৬১ শতাংশ, খাদ্য সামগ্রির ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি ১১.০৭ শতাংশ, যা গরিব জনসংখ্যার উপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ভারতীয় অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দু’টি বৃহত্তম ইঞ্জিন। এই দুটো ক্ষেত্রের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ২০২০’র প্রথম ত্রৈমাসিকে ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, যা দেশের জিডিপির ৫৯ শতাংশ অবদান রাখে, হ্রাস প্রাপ্ত হয় ২৭ শতাংশে। আর, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ৪৭ শতাংশ কমে যায়। ভারতের আমদানি দারুণভাবে সংকুচিত হওয়ায়  নিট রপ্তানি ইতিবাচক হয়। ওই ত্রৈমাসিকে সরকারের খরচ বৃদ্ধি পায় মাত্র ১৬ শতাংশ, আর্থিক বৃদ্ধির উল্লিখিত দু’টি ইঞ্জিনের সংকোচন যা ঐ সামান্য সরকারি খরচ পূরণ করতে ব্যর্থ। কৃষি বাদে অর্থনীতির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোই নিদারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শ্রম নিবিড় ক্ষেত্র, যেমন, নির্মাণ, রিয়াল এস্টেট, খুচরো ব্যবসা, পরিবহন ও ম্যানুফাকচারিং মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে।

এ তথ্য আজ সুবিদিত যে, ভারতের অর্থনীতি এ বছরে গভীর খাদের কিনারে চলে আসে, নজিরবিহীনভাবে মুখ থুবড়ে ২৩.৯ শতাংশে সংকুচিত হওয়ার পর তা প্রবেশ করে মন্দায়। আরও তিনটি ত্রৈমাসিক পর্যন্ত অর্থনীতির এই সংকোচন অবশ্যম্ভাবী, আর গভীর মন্দার কবল থেকে পার পাওয়ার কোন ইঙ্গিতই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। স্বাধীনোত্তর ভারত এখন পর্যন্ত তিনবার পড়েছে মন্দার কবলে – ১৯৫৮, ১৯৬৬, ১৯৮০। বর্তমানে প্রায় সকলেই এ প্রশ্নে একমত যে ভারতের অর্থনীতি অনিবার্যভাবে এগিয়ে চলেছে সারা বছরভোর সংকোচনের দিকে। বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী, রেটিং সংস্থা ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অনুমানকে সংশোধিত করে দেখাচ্ছে যে এই অর্থবছরে ভারতের জিডিপি সংকুচিত হবে ৯ থেকে ১৮ শতাংশ হারে। রেটিং সংস্থা ক্রিসিল দেখিয়েছে, মধ্যবর্তী পর্বে ভারত তার প্রকৃত জিডিপি’র ১৩ শতাংশ খোয়াবে যা আর কোনোদিন পুনরুদ্ধার করা যাবেনা। এর অর্থ হলো, ভারতের অর্থনীতি থেকে উবে যাবে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা, চিরদিনের জন্য। এদিকে সরকার ঘোষিত আত্মনির্ভর প্যাকেজে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ৩ লক্ষ কোটি টাকা।

অর্থশাস্ত্রী কৌশিক বসুর মতে, যে ৯০টি দেশ ত্রৈমাসিক পর্যায়ে আর্থিক বৃদ্ধির হারকে পরিমাপ করে, তার মধ্যে একমাত্র পেরুর অর্থনীতি ভারতের থেকে নীচে – যার সংকোচন ঘটেছে ৩০.২ শতাংশ হারে! ভারতের অর্থনীতি যে ক্রমাগত নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে তিনি চিহ্নিত করেছেন বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক পরিমন্ডল ও অসহিষ্ণুতাকে, যা আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তিকে কলুষিত করেছে, বিদ্যমান সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতাকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ও মূলধারা থেকে তাঁদের ক্রমশঃ বহিষ্কার, ভিন্ন মতাবলম্বী ও বিরোধিতাকে দমন করার যে শাসনশৈলী চলছে তা সমাজ রাজনীতি ও অর্থনীতিকেও রীতিমতো প্রভাবিত করবে বলে জানিয়েছেন। সামনের বছর ভারতের অর্থনীতি ফের মুখ তুলে দাঁড়াবে, আইএমএফ-এর এই মূল্যায়ণের সাথে তিনি একমত নন। বরং তিনি মনে করেন, এই অর্থ বছরে অর্থনীতি আরও সংকুচিত হবে ১২ শতাংশ হারে, আর তা ঠেকাতে অবিলম্বে বড়সড় ফিসকাল স্টিমুলাসের প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি জোর দেন। তার জন্য তিনি এমনকি সাত থেকে আট শতাংশ রাজস্ব ঘাটতির পক্ষেও সওয়াল করেছেন। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভারতই একমাত্র দেশ যে স্টিমুলাস প্যাকেজে নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ করেছে।

সরকারী ভাষ্যকারেরা ক্ষমতার অলিন্দ্য থেকে ঘোষণা করছেন যে দেশের অর্থনীতি নাকি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, কোভিড উত্তর দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে আর্থিক ‘পুনরুজ্জীবন’ ঘটছে তার বিরাট মাত্রায় বৈষম্যকেন্দ্রীক। শ্রম ও পুঁজির সাপেক্ষে তা উৎকটভাবে ঢলে পড়েছে পুঁজির দিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিগত ত্রৈমাসিকে কর্পোরেটদের মুনাফা বেড়েছে সে দেশের জিডিপির চার শতাংশ হারে, অবিশ্বাস্য গতিতে। ভারতে, গত ত্রৈমাসিকে ২৫টি নথিভুক্ত কোম্পানির নিট মুনাফা বেড়েছে ২৫ শতাংশ। আর এই বৃদ্ধি হচ্ছে রাজস্ব সংকোচনের বিনিময়ে, কর্পোরেটরা কর্মীদের মাথা পিছু খরচ কমাতে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে বেতন, মজুরি সংকোচন করছে, বঞ্চিত করছে বিধিবদ্ধ ক্ষতিপূরণ থেকে। ৬০০টি নথিভুক্ত কোম্পানী গত ১০টি ত্রৈমাসিকে কর্মী স্বার্থে সবচেয়ে কম খরচ করেছে। নথিভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফা ২৫ শতাংশ বাড়া আর বিপরীতে জিডিপির ৭.৫ শতাংশ সংকোচন এটাই দেখায় অনথিভুক্ত ছোট মাঝারি কোম্পানিগুলোর মুনাফায় টান পড়ছে, নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের মজুরি ও কর্মসংস্থানের উপর। সরকারি নীতিসমূহ এই কর্পোরেটদের একতরফা মুনাফা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। মোদী সরকার কর্পোরেটদের তোফা দিয়েছে ১,৪৫,০০০ কোটি টাকা – কর ছাড় বাবদ। সেই আর্থিক ছাড় কিন্তু নতুন বিনিয়োগে প্রতিফলিত হলো না। তা নিজ নিজ মূলধন বাড়াতেই ওরা কাজে লাগিয়েছে। সেই টাকা গরিবদের সরাসরি ব্যাঙ্কে বা নিখরচায় রেশন বাবদ বরাদ্দ করা যেতো। আর সেই টাকা খরচ করলে আভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ার পথ প্রশস্থ হতো।

একমাত্র কৃষি ক্ষেত্রটিতে দেখা যাচ্ছে রুপালি রেখা। ২০২০ সালে বিরাট পরিমাণে ১৪৮ মিলিয়ন টন রবি শস্য এবং আনুমানিক (২০২০) ১৪৪ মিলিয়ন টন খারিফ শস্য আমাদের শস্য ভাণ্ডারে গচ্ছিত থাকা সত্ত্বেও অগণন দেশবাসী অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ক্রমেই নেমে যাচ্ছে একেবারে নীচের সারিতে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এফএমসিজি’র চাহিদা বাড়লেও গ্রামাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধি থমকে আছে, যা অচিরেই চাহিদাকে সংকুচিত করবে। অর্থনীতির সামগ্রিক ছবি খুবই বিষন্ন। কারণ, কর্মসংস্থান ও আয়, যে দু’টো গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ডের উপর আর্থিক পুনরুদ্ধার নির্ভর করছে, তার অবস্থা মোটেই ভাল নয়।

সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই জানাচ্ছে, বর্তমানে কর্মহীনতার  হার ৬.৬৮ শতাংশ। যে ১০০ জন কাজ পাচ্ছেন, তার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা মাত্র ১১, আর ১১ জন কাজ হারালে তার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ৪ জন। সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ২০২০’র মধ্যে এক কোটি দশ লক্ষ থেকে এক কোটি বিশ লক্ষ তরুণ শ্রম বাজার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন।

সিএমআইই’র সিইও মহেশ ভ্যাস দেখিয়েছেন, ভারতে মোট ৩.৫ কোটি প্যান্ডেমিকের আগে থেকেই কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন। অতিমারীর পর আরও ২.১ কোটি বেতনভুক কর্মী কাজ হারিয়েছেন, যা আর ফিরে আসবেনা। শহরাঞ্চলে কাজের সুযোগ ক্রমে শুকিয়ে যাওয়ায় ‘ভিড়’ বেড়েছে গ্রামাঞ্চলের কাজে, আর এই ছদ্মবেকারত্ব ভারতের প্রকৃত কর্মহীনতার ভয়াবহ পরিস্থিতিকে ঠিকমতো প্রতিফলিত করছে না।

ddddd

নতুন বছর কি বার্তা বহন করছে?

রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্ধ দম্ভে মশগুল দেশের অধুনা রাষ্ট্র নায়কের রাষ্ট্রীয় কল্পনায় লক্ষ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের স্থান যে নেই তা প্রমাণিত হলো অপরিকল্পিত নির্মম লকডাউন ঘোষণার সময়ে। দেশের খেটে খাওয়া লক্ষ কোটি সম্পদ সৃষ্টিকারী শ্রমিক কৃষককে মোদী সরকার কোনোদিনই হিসাবের মধ্যে রাখল না। অতিমারীর সুযোগে, কর্পোরেট ছাড়া আর কারুর পরামর্শের থোড়াই কেয়ার ও সংসদীয় গণতন্ত্রের নির্দয় প্রহসন করে বুক ফুলিয়ে সেদিন পাশ করানো হলো তিন তিনটি চরম কৃষি-বিরোধী, কৃষকস্বার্থ বিরোধী বিল, যা অচিরেই পরিণত হলো আইনে কাঠপুতুল রাষ্ট্রপতির অতি তৎপরতায়।

কিন্তু, মোদী সেদিন চিনতে পারেনি আসল ভারতবর্ষকে। ভারতের শ্রমিক কৃষককে। লেলিহান অগ্নিশিখার মতো পঞ্চনদের তীরে প্রজ্জ্বলিত সেই মশাল আজ গোটা ভারতব্যাপী প্রবল প্লাবনে পরিণত। সর্বস্তরের মানুষ আজ আন্দোলনরত কৃষকদের পাশে। ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রগাঢ় উৎসবমুখর সারা দেশবাসী। যেন সকলে নেমেছে নতুন এক ভারত নির্মাণে।

এই নবস্পন্দন, এই উদ্ভাসনই লিখবে নতুন বছরে নতুন ভারতের দিনলিপি।

- অতনু চক্রবর্তী      

daaardbbbb

(৩০ ডিসেম্বর ছিল মৃণাল সেনের প্রয়াণ দিবস। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখাটি আমরা প্রকাশ করছি।)

মৃণাল সেনের জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ মে, ওপার বাংলায়। কৈশোর কাটিয়ে চলে আসেন কোলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনো করেন পদার্থবিদ্যা নিয়ে। বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে থেকেছেন সেই সময় থেকেই, অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না।

চলচ্চিত্র নির্মাণ পর্বের আগে চলচ্চিত্র নিয়ে তাত্ত্বিক পড়াশুনো ও লেখালেখি শুরু করেছিলেন মৃণাল সেন। রুডলফ আর্নহেইমের ফিল্ম এসথেটিকস, নীলসনের সিনেমা অ্যাজ এ গ্রাফিক আর্ট এর মতো বই তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। নিয়মিত সিনেমা দেখতেন ফিম সোসাইটিতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ধারাকে এর মধ্যে দিয়ে তিনি আত্মীকরণ করেন। তবে তাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব সম্ভবত ছিল ষাটের দশকে ফরাসী সিনেমার নিউ ওয়েভ ধারার। মনে রাখতে হবে সত্যজিতের সিনেমার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল চল্লিশের দশকের নিও রিয়ালিজমের। নিউ ওয়েভ তার দুদশক পরের সিনেমা আন্দোলন।

মৃণাল সেনের প্রথম দিককার সিনেমায় আখ্যানের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, পরে সেখান থেকে তিনি সচেতনভাবেই খানিকটা সরে আসেন। জঁ লুক গোদারের সিনেমার মতই মৃণাল সেনের সত্তর দশকে নির্মিত বিখ্যাত সিনেমাগুলিতে ন্যারেটিভের ভাঙচুর আমরা দেখতে পাই। সত্তরের উতরোল দিনগুলির সঙ্গে এই চলচ্চিত্র টেকনিক চমৎকার খাপ খেয়েছিল। বস্তুতপক্ষে মৃণাল সেনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল সরাসরি পলিটিক্যাল সিনেমা বানানোর ঋজু সাহস এবং সিনেমার প্রকরণ নিয়ে অজস্র পরীক্ষা নিরীক্ষা।

১৯৫৫ সালে যখন সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী মুক্তি পাচ্ছে, সে সময়েই তাঁর প্রথম ছবি নির্মিত হয়, রাতভোর। পথের পাঁচালীর চূড়ান্ত সাফল্যের উল্টোদিকে এটিকে বেশ অসফল প্রয়াসই বলতে হয়। মৃণাল সেন নিজেই ছবিটিকে আখ্যাত করেন অত্যন্ত জঘন্য বলে। উল্লেখ করার মতো তথ্য হল এই সিনেমায় উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন, যদিও তিনি চলচ্চিত্র মহলে তখন উল্লেখযোগ্য কোনও ব্যক্তি হয়ে ওঠেননি।

১৯৫৯ সালে তৈরি হয় মৃণাল সেনের দ্বিতীয় সিনেমা নীল আকাশের নীচে। এক আন্তর্জাতিক আত্মীয়তাবোধ এই ছবিটির মূল প্রেরণা। ছবিটিতে আমরা দেখি এক চিনা ফেরিওয়ালাকে যে তার রুজি রুটির তাগিদে এদেশের সাথে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে যায় এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক হয়ে পড়ে।

ফেরিওয়ালা চরিত্রকে তার পরের ছবি বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০) এও নিয়ে আসেন মৃণাল সেন। চিনা ফেরিওয়ালা এসেছিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। আর এই সিনেমার বাঙালি ফেরিওয়ালা চরিত্রটি আসে দুর্ভিক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। মৃণাল সেনের অত্যন্ত সাড়াজাগানো এই ছবিটি মূলত একটি পরিবারের গল্প। ফেরিওয়ালা, তার স্ত্রী ও তাদের জীবন সংকটের গল্প। একটি পরিবারের গল্পের মধ্যে দিয়ে দুর্ভিক্ষকালীন সমাজের সংকটিকে ভাষা দেন মৃণাল সেন।

১৯৬১-তে মৃণাল সেন তৈরি করেন পুনশ্চ ছবিটি। পটভূমি সরে আসে গ্রাম থেকে শহরে। মধ্যবিত্ত এক পুরুষ নারীর, প্রেমিক প্রেমিকার এই গল্পে মৃণাল সেন দেখান পুরুষ প্রাধান্যের সমাজে নারীর অর্থিনৈতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা কীভাবে খর্বিত হচ্ছে।

১৯৬২-তে পরের ছবি অবশেষে নির্মিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, প্রেম, বিচ্ছেদের এই কমেডি ছবিটি তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি আগের ছবি পুনশ্চের মতোই।

১৯৬৪-তে পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের অবস্থা নিয়ে প্রতিনিধি নামে আরেকটি ছবি তৈরি করেন মৃণাল সেন। মেয়েদের সামাজিক ভয় ভীতি ভেঙে বেরিয়ে আসার ডাক রয়েছে এখানে।

১৯৬৫-তে মৃণাল সেন বানান আকাশ কুসুম। ছবির স্বপ্নবিলাসী নায়ক অজয় মধ্যবিত্তের বেড়া টপকে উচ্চবিত্ত হয়ে উঠতে চায় খুব দ্রুত। এজন্য বড়লোকের মেয়ের সাথে কৌশলী প্রেম সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। অজয় চরিত্রটি নিয়ে পরিচালক কৌতুকই করেন ছবিতে। কৌশলী প্রেম স্বাভাবিকভাবেই সার্থকতা পায় না। ছবিটি শৈলীগত পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৬৬ সালে কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর কাহিনী অবলল্বনে ওড়িয়া ভাষায় মৃণাল সেন তৈরি করেন মাটির মানুষ ছবিটি। এর পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে স্থাপিত। ওড়িষ্যার এক কৃষক পরিবারে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা কীভাবে যৌথ সংসারে ভাঙন নিয়ে আসছে, জমির দ্বন্দ্ব কীভাবে পারিবারিক সম্পর্কে ছায়া ফেলছে সেটা এখানে অভিব্যক্ত হয়েছে। বড় ভাই নিজে জমির অধিকার ত্যাগ করে, কিন্তু তবু মানসিকতায় সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব আঁকড়ে থাকে। ছোটভাই না চাইলেও সম্পত্তির অধিকারী হয়। সেটা তার সামন্ততন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ের মানসিকতাকে দুর্বল করে না। কৃষক ও কৃষি প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত এই সিনেমাটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী নির্মাণ।

১৯৬৯ সালে বনফুলের কাহিনী অবলল্বনে হিন্দি ভাষায় মৃণাল সেন তৈরি করেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ভুবন সোম। এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় উৎপল দত্তের অসামান্য অভিনয় এবং এর শৈলীগত নিরীক্ষা একে একটি ক্লাসিকে পরিণত করেছে। অনেকে মনে করেন এই ছবিটির মধ্যে দিয়েই হিন্দি প্যারালাল ছবির ধারাটি জন্ম নেয়। ছবিতে রেলের জাঁদরেল অফিসার ভুবন সোম সৎ ও কর্মনিষ্ঠ মানুষ, ভিক্টোরীয় আদর্শবাদের প্রতিনিধি। নিজের ছেলেকেও তিনি নিজের সততা রক্ষার জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারেন। কিন্তু এই সমীহযোগ্য আদলটিকে এরপর মৃণাল সেন ভেঙে দেন। দেখা যায় ক্ষমতা তৃপ্তির জন্য দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দিতে পারেন। রেলের রুটিন কাজের বাইরে গুজরাটে একবার পাখি শিকারে যান ভুবন সোম। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটে এক নারীর লাবণ্যের শিকার হয়ে যান তিনি। সততা রক্ষার রুটিন ভেঙে সেই লাবণ্যময়ীর স্বামীর দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন।

১৯৬৯-এ রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে ইচ্ছাপূরণ নামে এক শিশুচিত্র তৈরি করেন তিনি।এরপরেই শুরু হয় মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র নির্মাণ জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্বটি। আমরা পরপর তাঁর কাছ থেকে পাই ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২), পদাতিক (১৯৭৩), কোরাস (১৯৭৪), একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯)। সত্তর দশকে তৈরি এই পাঁচটি ছবি মৃণাল সেন এর সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম।

dddddd

 

নিঃসন্দেহে সত্তর দশকের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বাস্তবতা মৃণাল সেনের এই নাগরিক ছবিগুলি নির্মাণের পেছনে মূল প্রেরণা হিসেবে সক্রিয় থেকেছে। একদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলন, মুক্তির দশক হিসেবে সত্তর দশককে দেখে ছাত্র যুবর প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি ভাবনাচিন্তা জীবনচর্যা, অন্যদিকে এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য নির্মম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নাগরিক জীবনে অস্থিরতা এই দশকের কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য, যাকে মৃণাল সেন তাঁর এই পর্বের সিনেমায় নিয়ে আসেন।

ইন্টারভিউ ছবিতে আমরা এক যুবককে দেখি যে চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শেষমেষ দেখা যায় একটা স্যুট না থাকার জন্য তার চাকরিটা হল না। ভারতের নয়া শাসনও যে আধা ঔপনিবেশকতার পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে আছে, সেই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার উপস্থাপণ ঘটে এখানে। ছবির শেষে ক্রুদ্ধ যুবকের ম্যানিকুইনের মূর্তি ভাঙা যেন সেই রাজনৈতিক মূর্তি ভাঙা আন্দোলনেরই দ্যোতক, যা ঔপনিবেশিকতার কাঠামো নির্মাণের সহযোগী দেশীয় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার নতুন মূল্যায়ন থেকে উঠে এসেছিল।

পরের ছবি কলকাতা ৭১ তিনটি আলাদা গল্প অবলম্বনে তৈরি। গল্প তিনটির লেখক যথাক্রমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল এবং সমরেশ বসু। গল্প তিনটির পটভূমি যথাক্রমে ১৯৩৩, ১৯৪৩ ও ১৯৫৩ সাল। প্রথম আখ্যানে এক বস্তিবাসী পরিবারের বর্ষার রাতে দুর্ভোগের ছবি, পরের গল্পে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক অনটনের কথা রয়েছে। তৃতীয় গল্পে পাই চালের চোরাচালানকারীদের কথা, যারা সব মূল্যবোধ পেছনে ফেলে যেভাবে হোক বেঁচে থাকতে চায়।

মৃণাল সেনের কোলকাতা ট্রিলজির শেষ ছবিটি হল পদাতিক। তখন নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রথম পর্বটি ধাক্কা খেয়ে গেছে। ছবিতে আমরা দেখি এক যুবককে যে গ্রেপ্তার হবার পর পুলিশের ভ্যান থেকে পালায়। আশ্রয় পায় এক পাঞ্জাবী মহিলার বাড়িতে। এখানে যুবকটির রাজনীতির ধরণ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়। গণসমাবেশের রাজনীতির প্রয়োজনিয়তাকে সে ক্রমশ উপলব্ধি করে।

পরবর্তী কোরাস ছবিটিতে সিনেমার টেকনিক নিয়ে অনেক অভিনব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন মৃণাল সেন। নিও রিয়ালিজম এবং ডকুমেন্টারি ছবির আঙ্গিককে এখানে মেলাতে চেয়েছেন তিনি। রূপকথার ঢঙে ছবিটি তৈরি হয়। দেবতাদের অধিপতি চাহিদার সমস্যার ব্যাপারটা বুঝে শয়ে শয়ে চাকরীর বন্দোবস্ত করেন, কিন্তু হাজারে হাজারে চাকরীপ্রার্থী জুটে যায়। অনেক মানুষ, অনেক মুখ, অনেক সমস্যা। ক্রমেই জনতার মোহভঙ্গ হয়। ক্যামেরাকে সরাসরি লক্ষ্য করে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার আঙ্গিককে এই সিনেমায় ব্যবহার করেছেন মৃণাল সেন।

১৯৭৬-এ হিন্দি ভাষায় “মৃগয়া” ছবিটি তৈরি করেন তিনি। ভুবন সেন আর মৃগয়ার মাঝে ১৯৭২ সালে সুবোধ ঘোষের গোত্রান্তর গল্প অবলম্বনে “এক আধুরী কাহানী” নামেও একটি হিন্দি ছবি বানিয়েছিলেন মৃণাল সেন।

১৯৭৭ সালে প্রেমচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় তৈরি করেন “ওকা উরি কথা”। অত্যন্ত ব্যতিক্রমী বলে বিবেচিত এই সিনেমাটির নায়ক ভেঙ্কায়া একজন শ্রমিক। অভিজ্ঞতা দিয়ে সে বুঝতে পারে তারই শ্রমের মুনাফা লুটছে মালিক। যতই শোষণ বাড়ে, ততই ভেঙ্কায়া প্রতিবাদের নতুন নতুন পরিকল্পনা আঁটে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শ্লেষ, সাময়িক সমঝোতা – সবই তার লড়াইয়ের কৌশল। কলকাতা ট্রিলজীতে উতরোল সমাজ রাজনীতির পটভূমিকায় এক ধরনের প্রত্যক্ষ পলিটিক্যাল সিনেমা বানান মৃণাল সেন। আর ওকা উরি কথাতে সমাজের কাঠামো বিন্যাসের মধ্যেকার রাজনীতিটাকে ধরে অন্য এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল ডিসকোর্স সিনেমা’ নির্মাণের দিকে এগোন।

বাংলা সিনেমার জগতে আবার ফেরেন পরশুরাম ছবির মধ্যে দিয়ে। একদল বস্তিবাসীর জীবনচিত্র নিয়ে তৈরি এই সিনেমা।

১৯৭৯-তে তৈরি মৃণাল সেনের একদিন প্রতিদিন সিনেমাটি একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের অফিস থেকে সময়ে বাড়ি না ফেরা নিয়ে উদ্বেগ দুশ্চিন্তার প্রেক্ষাপটে তৈরি। তখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেমেছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা দুর্ভাবনার রেশ থেকে গেছে। তার সাথেই জড়িয়ে থেকেছে মানসিকতার ক্ষুদ্রতা, অসহায়তা, স্বার্থপরতা।

আশির দশকে তৈরি মৃণাল সেনের ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে আকালের সন্ধানে (১৯৮০), চালচিত্র কলকাতা (১৯৮১) খারিজ, (১৯৮৩) খণ্ডহর (১৯৮৪), জেনেসিস (১৯৮৪) একদিন আচানক (১৯৮৯)। সোভিয়েত ভাঙনের পর উঠে আসা নতুন প্রশ্নচিহ্নগুলি নিয়ে তিনি বানালেন মহাপৃথিবী (১৯৯১)। সাদাত হাসান মান্টোর গল্প অবলম্বনে ১৯৯৩ তে তৈরি হল অন্তরীণ। ২০০২ তে বানান শেষ ছবি আমার ভুবন। তখন তাঁর বয়স প্রায় আশি। এই ছবিটিও কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা চলচ্চিত্রকারের পুরস্কার জিতে নেয়। এই ছবিটিতে আফসার আমেদের গল্প অবলম্বনে মৃণাল সেন দেখান গ্রাম জীবনের আটপৌরে সহজ জীবন ছন্দটিকে। নূরের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সাকিনা বিয়ে করে কৌশিককে। নূর এর পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসে বেশ ধনী হয়ে। অন্যদিকে কৌশিক সাকিনার অনটনের সংসার। নূর প্রাক্তন স্ত্রীর বর্তমান স্বামী কৌশিককে অনটনে সাহায্য সহযোগিতা করে, কোনও বিবাহ বিচ্ছেদের তিক্ততা মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় না। এই অনায়াস জীবনছন্দকে পরাবাস্তবের মতো করে নিয়ে আসা মৃণাল সেনের সিনেমার নতুন দিকচিহ্ন। আশি বছর বয়েসে নির্মিত শেষ সিনেমাতেও তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সাফল্যের ছক মেনে নির্মাণ নয়, ছক ভাঙতে ভাঙতে অহরত নতুন পথের সন্ধানেই ছিল তাঁর সৃজনের মূল আগ্রহ।

মৃণাল সেন তাঁর ছবিতে একটানা গল্পবলার ন্যারেটিভ টেকনিককে বারবার ভেঙেছেন এবং সিনেমার ভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। বামপন্থী ভাবনাচিন্তায় বিশ্বাস রেখে তিনি নানা প্রশ্নে নিরন্তর খোঁজ চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর ছবিতে। সত্তরের কলকাতা ট্রিলজীতে সময়ের ক্ষোভ যন্ত্রণাকে তুলে আনতে তিনি যেমন সফল, তেমনি ভুবন সোম এ সচেতনভাবে অ্যারিস্ট্রোকাট ব্যুরোক্রেসির চকচকে আদলটিকে ভেঙে ফেলতেও পারদর্শী। একদিন প্রতিদিন বা একদিন আচানক-এ যথাক্রমে এক যুবতী মেয়ে ও এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের বাড়ি না ফেরা নিয়ে নানা কথা ভাবনার সূত্রে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সমস্যাগুলিকে তিনি উন্মোচিত করে দেন অনায়াস দক্ষতায়।

জীবৎকালেই বাংলা সিনেমা তথা সংস্কৃতি জগতের লিভিং লিজেন্ডে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। দেশবিদেশের চলচ্চিত্র জগতের নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন, বহুবার তাঁর বিভিন্ন ছবি নানা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। মস্কো, বার্লিন, কান, ভেনিস, শিকাগো, মন্ট্রিয়েল, কায়রো – সমস্ত বিখ্যাত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেই পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবি। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি বাংলা সিনেমার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসেবে তিনি সমাদৃত হবেন দীর্ঘদিন।

– সৌভিক ঘোষাল     

fffgggg

‘রাজর্ষি’ গুরুচাঁদ বলতেন, “রাজনীতি হ’ল জগতের শ্রেষ্ঠ নীতি-কার’ও ব্যক্তিগত বা কোনো দলীয় নীতি নয়। যে নীতির দ্বারা জাগতিক সব কিছুর উপর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মনুষ্যজাতি সুন্দর হতে সুন্দরতর হতে পারে তাই হ’ল ‘রাজনীতি’।” অর্থাৎ রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য মানবজাতি তথা জগতের কল্যাণ। রাজনীতি কোনো ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে পারে না। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাগ্রে ব্যক্তির আত্মশক্তির জাগরণ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চরিত্র গঠনের দ্বারা) যেমন প্রয়োজন তেমনই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের জন্য জাত-পাত নির্বিশেষে সংঘবদ্ধ শক্তি এবং সংগঠন দরকার। হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ ও কাঠামোর ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে ঠাকুর গুরুচাঁদ অনুন্নত শ্রেণির রাজনীতির বনিয়াদ গড়ে তোলেন যা গৃহীর উন্নতির জন্য একান্ত অপরিহার্য। জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন

“শক্তি না দেখিলে কেহ ক’রে না সম্মান।
শক্তিমান হ’তে সবে হও যত্নবান।।”

এই শক্তি হ’ল আত্মশক্তি ও সংঘবদ্ধ শক্তি। ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের খুলনা শহরে যুগনায়ক গুরুচাঁদ ঠাকুরের সভাপতিত্বে নমঃশূদ্র জাতির একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে অনুন্নত শ্রেণীর মানুষ কোন পথে দেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করবে তা নির্ধারিত হয়।

“এই সম্মেলন হ’তে        নমঃশূদ্র কোনপথে
চালনা করিবে রাজনীতি।

যাহা বলে দয়াময়           সভা মধ্যে পাঠ হয়
তা’তে সবে জানাল স্বীকৃতি।।”

এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমবাংলার কাঁচড়াপাড়ায় এক সম্মেলনে “বেঙ্গল ডিপ্রেসড ক্লাসেস এ্যাসোসিয়েশন” নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনে এই সংগঠনের পক্ষ হতে অনুন্নত সম্প্রদায়ের ২৫ জন সদস্য আইনসভায় নির্বাচিত হন। মানুষ তথা দেশের উন্নতির জন্য প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন তিনি। কারণ তিনি জানতেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিষবৃক্ষ ডাল-পালা বিস্তার করে কিভাবে সমাজের উপর চেপে বসেছে। এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎখাত করতে ও মানুষের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্য পূরণ করতে ‘ব্যক্তিস্বার্থহীন’ দল তৈরির কথা তিনিই সর্বপ্রথম বলেন। তিনি বলতেন – “যে জাতির রাজা নাই, সে জাতি তাজা নয়”। জাতিকে জাগাতে রাজশক্তি অবশ্য প্রয়োজন। তিনি আত্মবলে বলিয়ান হয়ে রাজশক্তির অধিকারী হতে বলেছেন। অন্তঃসারশূন্য, স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী কোনো রাজনৈতিক দলের দাসত্ব করতে বলেননি। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে এইরকম একজন ‘রাজনৈতিক গুরু’ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ তো দূর, সার্বিক স্বার্থের কারণে দলীয় স্বার্থকেও তুচ্ছ করা হয়েছে! এই হল ঠাকুর গুরুচাঁদের রাজনৈতিক দর্শন!

অপরপক্ষে, বর্তমান ভারতবর্ষের তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলি যে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে নয় একথা তাদের কার্যকলাপের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়। যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ছলে-বলে-কৌশলে রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করা। প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতেও এঁরা পিছপা হ’ন না। অর্থাৎ এদের রাজনীতি করার উদ্দেশ্য দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। হিন্দু-মুসলীম সম্প্রীতির লক্ষ্যে গুরুচাঁদ ঠাকুর তাই একসময় বলেছিলেন,

“বিশেষত এক কথা কহি সকলেরে।
হিন্দু মুসলমান আছি দেশ ভরে।।
এক ভাষা এক আশা এক ব্যবসাতে।
কেন বা করিবে রণ তাহাদের সাথে।।
দুই ভাই এক ঠাঁই রহ মিলে মিশে।
ভাই মেরে বল কেন মর হিংসা বিষে?”

আমাদের দেশ ‘কৃষি প্রধান দেশ’। আজকে যারা কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের ভোটে রাজশক্তির অধিকারী হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ ও ভোটব্যাংকের হিসাবের বাইরে কিছু দেখতে চান না তাঁরা আর যাইহোক সমাজের মঙ্গলকামী হতে পারেন না। এসব ‘মাটিতে চরণ না পড়া’ মানুষ সম্পর্কেও গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছিলেন

“দেশের পরাণ বলি যদি কিছু রয়।
কৃষক দেশের প্রাণ জানিবে নিশ্চয়।।
‘দেশ-বৃক্ষ-মূল’ বলি কৃষকে জানিবে।
কৃষকের স্কন্ধে সুখে রহিয়াছে সবে।।
মূল দেয় রস বহি শাখা প্রশাখাতে।
‘সুখের কপোত’ সেজে সবে বাঁচে তাতে।।
এ হেন দুর্বৃত্ত দেখ এই সব শাখা।
মূল-মূলে জল দিতে কারও নাই দেখা।।
বিষময় ফল দেখ ফলিয়াছে আজ।
মেরুদন্ডহীন যত শোষক সমাজ।”

আমাদের সার্বিক সচেতনতাই একমাত্র পারে এর গতিরোধ করতে। জানা প্রয়োজন গৃহীর উন্নতি না হলে সমাজের উন্নতি হয় না। আর রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকলে গৃহীর প্রকৃত উন্নতি সম্ভপর নয়। ‘রাজর্ষি’ গুরুচাঁদ সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতা নির্মূল করতে চেয়েছিলেন একেবারে গোড়া হতে। তাঁর দূরদৃষ্টি উপলব্ধি করা যায় এই শাশ্বত বাণীটির মধ্য দিয়ে

“ধনহীন বিদ্যাহীন যারা এই ভবে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে তারা শান্তি নাহি পাবে।।
আত্মোন্নতি অগ্রভাগে প্রয়োজন তাই।
বিদ্যা চাই, ধন চাই, রাজকার্য চাই।।
দুর্বলে সবলে যদি করিবে মিলন।
সবলে বাড়িবে বলে দুর্বলে মরণ।।”

সুতরাং গুরুচাঁদ ঠাকু্রের রাজনৈতিক দর্শন আজ আমাদের দেশে কতখানি বাস্তবসম্মত, সময়োপযোগী ও হিতকর তা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ভাববার অনুরোধ জানাই। বর্তমানে গুরুচাঁদ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়িত করতে হলে যে আত্মশক্তি ও সংঘবদ্ধ শক্তির প্রয়োজন আমরা তা অর্জন করতে পেরেছি কি? যদি না পেরে থাকি, তাহলে সেই আত্মশক্তি ও সংঘবদ্ধ শক্তির জায়গা তৈরি না করে রাজা হবার স্বপ্ন দেখা শুধু হাস্যকর নয়, একখানি বড় প্রশ্ন চিহ্নেরও জন্ম দেয় বইকি।

জয় গুরুচাঁদ। জয় মানবতাবাদ।

- বরুন ভক্ত     

dddeee

দুই শহীদের মা রত্নগর্ভা মাসিমা – মায়া রায়চৌধুরীর প্রয়াণে সত্তর দশকের আন্দোলনের সভ্য, সমর্থক, নেতা কর্মীরা শোকস্তব্ধ। সত্তরের দশকে তাঁর দুই মেধাবি পুত্র প্রদীপ ও প্রবীর রায়চৌধুরী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হয়েছিলেন। প্রদীপের মৃত্যু হয় ১৯৭১ সালে, তাঁকে যাদবপুর থানা লকআপে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। প্রদীপ ছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। প্রবীর (পাখি) ছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র, প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার ছাত্র। প্রবীর এবং আরও চারজন যুব বিপ্লবীকে ১৯৭৫ সালের ৩ মে হাওড়া জেলে পিটিয়ে হত্যা করেছিল জেল কর্তৃপক্ষ। প্রদীপ-প্রবীর দুজনেই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষে সাড়া দিয়েছিলেন। সন্তান হারানোর ব্যথা ভুলেছিলেন মাসিমা হাজারো প্রদীপ-প্রবীরদের মা হয়ে গিয়ে।

গত ২৭ ডিসেম্বর হাওড়ার বেলুড়ের শ্রমজীবী হাসপাতালে মাসিমার প্রয়াণ ঘটে অপরাহ্ন ২টো ৪০ মিনিটে।

স্বামী সদানন্দ রায়চৌধুরীও হয়ে ওঠেন সকলের মেসোমশাই। তাঁর প্রয়াণ ঘটে ২০০৫ সালে। সেই থেকে নরেন্দ্রপুর-রাজপুর সংলগ্ন এক বৃদ্ধাবাসে মাসীমা বাকি জীবন কাটিয়েছেন। ক’দিন আগে তাঁর মাইল্ড স্ট্রোক হলে তাঁকে বেলুড়ের শ্রমজীবী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার সিদ্ধার্থ গুপ্ত ও কুনাল দত্ত প্রমুখরা মাসিমাকে সেখানে ভর্তি করান। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, ৮৬ বছর বয়সে হল তাঁর জীবনাবসান। মাসিমার বৃদ্ধাশ্রম থাকাকালীন তাঁর দেখভাল করতেন অজয়দা (বসু রায়), তাঁর ভাই মিঠু, জলার্ক পত্রিকা সম্পাদক মানব চক্রবর্তী। মাসীমা সন্তান স্নেহে অজয়দাকে, মানবদাকে ভালোবাসতেন। অজয়দার ও তাঁর স্ত্রীর জীবনাবসানের পর সবকিছু দেখতেন তাঁর ভাই মিঠু (যিনি কর্কট রোগে আক্রান্ত)। ক’দিন আগেই সস্ত্রীক দিলীপ সেন (বট), তার পুত্র ও এই প্রতিবেদক বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে মাসীমা খুব খুশি হয়েছিলেন। মাসীমার স্মরণ শক্তি ছিল, গরগর করে বলে দিতেন জন্মস্থান বরিশালের কথা, সেদিনের কথা ও পুত্রদের বন্ধুদের কথা। মীনাক্ষীদি ও রাজশ্রীদিকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। ব্যথা পেয়েছেন মীনাক্ষীর অকাল মৃত্যুতে ও অজয়দার স্ত্রীর মৃত্যুতে। অজয়দার জীবনাবসানের কথা তাঁকে বন্ধুরা জানাননি তিনি সেটি সহ্য করতে পারবেন না বলে। বহু বন্ধু এককালীন বা প্রতি মাসে কিছু পরিমাণ অর্থ নিয়মিত দিতেন তাঁর জীবন নির্বাহের জন্য। মাসীমা প্রত্যেকের খোঁজ খবর নিতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আন্দোলনের প্রত্যেক যোদ্ধাকেই তিনি সন্তান স্নেহে ভালোবাসতেন।

গড়িয়া শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, আইসার হাওড়া জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ নীলাশিস, অঙ্কিত ও অন্য বন্ধুরা, ডাক্তার সিদ্ধার্থ গুপ্ত, কুনাল দত্ত বেলুড় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। মৃতদেহ নিয়ে আসেন মিঠুদার কনিষ্ঠ সন্তান, মাসিমার এক ভাইয়ের সন্তান ও আশীষ। শশ্মানে উপস্থিত ছিলেন মানব চক্রবর্তী, এই প্রতিবেদক ও মাসিমার বোনের মেয়ে ও তাঁর স্বামী এবং অর্জুন (যিনি মাসীমাকে দেখভালও করতেন)। জনগণের স্বার্থে সংগ্রামী সাথিদের উপস্থিতিতে মাসিমা প্রবীর-প্রদীপের অনুপস্থিতিকে ভুলে যেতেন। সত্তর দশকের আন্দোলনে মাসীমার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি রত্নগর্ভা।

- নিত্যানন্দ ঘোষ  

“রাজপুরের বৃদ্ধাবাসে যাওয়ার প্রয়োজন আর রইল না। মাসিমা চিরকালের জন্য চলে গেলেন আজ। সত্তর দশকের শহিদ প্রবীর রায়চৌধুরী (পাখি) আর তার দাদা প্রদীপ রায়চৌধুরী – দুই সন্তানকে হারিয়ে আমাদের মা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তিন-চারদিন আগে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম রাজপুরে। মস্তিষ্কের স্ট্রোক সত্ত্বেও আধবোজা চোখে আমার মাথার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর চুলগুলি সব সাদা হইয়া গেছে। এই ছিল মাসিমার আমাকে বলা শেষ কথা। হয়তো তাঁর ছেলেদের কথা ভাবলেন তিনি তখন। বেঁচে থাকলে তাদেরও কি এই অবস্থা হত না? কতদিন কাছে টেনে নিয়ে তিনি আদর করেছেন বুড়োধাড়ি এই আমাকে, আমার ছোটছেলের বন্ধু, আমার পাখির বন্ধু তুই! আর আমার রাজপুরের বৃদ্ধাবাসে যাওয়ার প্রয়োজন রইল না!”

- মানব চক্রবর্তী   

vsadddar

গত ২২ নভেম্বর  মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রাম ব্লকের কেলাই গ্রামের দীর্ঘ দিনের পার্টি সদস্য কমরেড মালেক সেখ অসুস্থ হয়ে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই কমরেডের স্মরণে গত ২৬ ডিসেম্বর সিপিআ(এমএল) লিবারেশনের খড়গ্রাম লোকাল কমিটির উদ্যোগে ঝিল্লী গ্রাম পঞ্চায়েতের নোনাডাঙ্গা হাইস্কুলে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়। এই গ্রামের আরও ২ জন পার্টি সদস্য, কমরেড মান্নান মন্ডল ও কমরেড এসরাফুল সেখ বিগত দিনে প্রয়াত হয়েছেন। যাদের তখন স্মরণ সভা করা সম্ভব হয়নি। তাই এই তিন জন প্রয়াত কমরেডের স্মরণ সভা সংগঠিত করা হল। সাথে সাথে দিল্লীর কেন্দ্রীয় নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের মধ্যে প্রয়াত শহীদ সংগ্রামীদের স্মরণে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। ২০০ জনের বেশি মানুষ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। তাদের মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড রাজীব রায়, জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য কমরেড অপুর্ব লাহিড়ী, বহরমপুর লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড রবি মন্ডল, কান্দির কমরেড রবিউল সেখ ও রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড সজল পাল।

সভার শুরুতে প্রয়াত কমরেডদের ছবি সামনে রেখে শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও এক মিনিট নিরবতা পালন করা হল। শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন লোকাল কমিটির সদস্য কমরেড হাসান সেখ। বক্তব্য রাখেন কমরেড রাজীব রায়, অপুর্ব লাহিড়ী, সজল পাল, সিপিআই(এম)-এর লোকাল নেতা তানজুল হক ও এলাকার কয়েকজন কমরেড। সভা পরিচালনা করেন জেলা কমিটির সদস্য কমরেড হায়দার সেখ। বক্তারা প্রয়াত তিন জন কমরেডের সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। গরিব গ্রামীণ কমরেডদের স্মরণ সভার গুরুত্ব তুলে ধরেন। উঠে আসে শহীদ সেজাম্মল নিয়ামত ও নুরহকের কথা। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে এই সমস্ত কমরেডদের লড়াইএর কথা। বিশেষ গুরুত্ব পায় কোম্পানির দালাল নরেন্দ্র মোদীর নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবীতে দিল্লীর আন্দোলনের প্রয়াত কৃষক শহীদদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। এবং এই কৃষকদের মৃত্যুর জন্য দায়ী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি ধিক্কার প্রদর্শন করা হল। দাবি করা হয় নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে। বেলা ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত স্মরণ সভা চলে। খাওয়ার বিরতির পর আবার ৭০ জন কর্মীকে নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের দিশা নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ও রাজ্য কমিটির আলোচনা হয়। খড়গ্রাম বিধানসভার সম্ভাব্য সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সম্ভাব্য প্রার্থি কমরেড টুনু বালা দাসের নাম ঘোষণা ও পরিচিতি করানো হয়।

খণ্ড-27
সংখ্যা-47