মোদি সরকার ভারতবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলে ‘আচ্ছে দিন’ উপহার দেবেন। বাস্তবত তিনি ক্ষমতায় বসার পর থেকে ঘৃণা, আতংক আর হিংসা ছাড়া দেশবাসীকে কিছুই উপহার দিতে পারেননি। তার সরকার সবচেয়ে মোক্ষম আঘাতটা দিয়েছিল ২০১৬-এর ৮ নভেম্বর দেশের প্রায় ৮৬শতাংশ প্রচলিত মুদ্রা বাতিল করে, বিমুদ্রাকরণের মাধ্যমে। আউটলুক পত্রিকার একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে : ২০১৭ সালে সরকার যখন ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করে তখন অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে কাগুজে নোট ছাপার জন্যে খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭৯৬৫ কোটি টাকা। এই তথ্য সরকার নিজেই সংসদে জানিয়েছিল [আউটলুক, নভেম্বর ২৫, ২০১৯]। এরপর মোদি সরকারের জিএসটি তথা ‘এক জাতি এক কর’-এর নীতি আর্থিক সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করল। ফলস্বরূপ ভারতীয় অর্থনীতিতে গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্বের অভিশাপ নেমে এসেছে। বর্তমানে তা আরও বাড়ছে। এনএসএসও-র দেওয়া এই তথ্যকে সরকার প্রথমে চেপে গেলেও পরে তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। শুধু গত তিন বছরে ৯০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন।
একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অভূতপূর্ব সুদের হার হ্রাসের ধাক্কায় প্রবীণ নাগরিক-সহ স্থির সুদের আয়ের উপর নির্ভরশীল অধিকাংশ ভারতবাসীর দিন সংকুলান যেখানে ক্রমশ যথেষ্ট কঠিনতর হচ্ছে, অন্যদিকে বাজারে সুদের হার যথেষ্ট হ্রাস পাওয়া সত্বেও বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ছে না। সম্প্রতি এনএসএসও রিপোর্ট আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছে। তারা জানিয়েছে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের মানুষের পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা কমেছে ৮.৮ শতাংশ। ১৯৭২ সালের পর গ্রামীণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার এই অবনমন এই প্রথমবার ঘটলো। গ্রাম-শহর মিলিয়ে এই ক্রয় ক্ষমতার হ্রাস ঘটেছে ১৩ শতাংশ।
টমাস পিকেটি এবং তার সহযোগীদের তৈরি বিশ্ববৈষম্যের তথ্যভান্ডারের (ওয়ার্ল্ড ইন ইকুইলিটি ডেটাবেস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৯ শতাংশ ধনীর হাতে ছিল দেশের সম্পদের মোট ৫৮ শতাংশ, ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ শতাংশে। অর্থাৎ দেশের ৯১ শতাংশ মানুষের আয় ক্রমহ্রাসমান। ক্রেডিট সুইস রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে প্রথমবারের মোদি সরকারের জমানায়। গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড হেলথ রিপোর্ট অনুযায়ী ধনী-দরিদ্র বৈষম্যে ভারতের স্থান এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মাত্র মোট সম্পদের ৪.৮ শতাংশ।
৭ লক্ষের উপর কলকারখানা নতুন করে বন্ধ হয়েছে স্রেফ বিগত ৫ বছরে। ১৯৮০-৮১-তে ১০০ একক মূল্য উৎপাদনে শ্রমিকের মজুরির ভাগ ছিল ২৮.৫ শতাংশ। ২০১২-১৩-তে তা নেমে দাঁড়ায় ১১ শতাংশে। পরবর্তীকালে তা কমে ৯ শতাংশে এসে ঠেকেছে (সূত্রঃ আইএলও, এশিয়া প্যাসিফিক ওয়ার্কিং পেপার সিরিজ) অর্থাৎ শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত মূল্যের ৯০ শতাংশ পুঁজিপতি শ্রেণী একাই আত্মসাৎ করে।
ফিনান্স বিল ২০১৭-এর মধ্যে দিয়ে ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম রাজনৈতিক দলের বিদেশ থেকে পাওয়া অর্থের কোনো হিসেব নেওয়া হবেনা এই আইন পাশ করিয়ে বিদেশ থেকে অর্থ আমদানি এবং দুর্নীতিকে পুরোপুরি আইনসিদ্ধ এবং বৈধ করা হলো।
সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভোগেন এদেশের নাগরিকরা। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের অর্ধেকের বেশি নারীই এদেশে অপুষ্টিতে ভোগেন। ৫ বছরের কম শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যাও সারা পৃথিবীর মধ্যে এদেশেই সবচাইতে বেশি। জিআইআই (গ্লোবাল ইনোভেশান ইনডেকস)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে আমরা ১১৯টি দেশের মধ্যে ১০৩ নম্বরে। দৈনিক শিশুমৃত্যুর হার ৩০০০। এগুলি নিছক মৃত্যু নয় বরং বলা ভালো কাঠামোগত হিংসার (স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স) ফলশ্রুতি। খিদের এতই দাপট যে পেটে খিদে নিয়ে প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যান এদেশের ২০ কোটি মানুষ। কাঠামোগত সন্ত্রাসের আরেকটা উদাহরণ হলো কৃষকের আত্মহত্যা। খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে ২০১৬ সালে সারা দেশে মোট ১১,৩৭৯টি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ ওই বছর প্রতি মাসে গড়ে ৯৪৮ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। আর দৈনিক সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৩১। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পৰ্যন্ত দেশে মোট ৩,৩৩,৪০৭ জন কৃষক আত্মহত্যার তথ্য এনসিআরবি-র কাছে নথিভুক্ত হয়েছে।
জীবনধারণের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য বলছে ২২৪ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৬৪ নম্বরে। আঞ্চলিকভাবে পাকিস্তান ছাড়া আর সব দেশের নিচে। ২০১৬-তে যক্ষ্মারোগে, মালটি ড্রাগ রেজিসট্যান্স-এ বিশ্বে প্রথম। পাঁচ বছরের নীচে ডায়েরিয়ায় শিশুমৃত্যুর হারে নাইজেরিয়ার সাথে আমরা যুগ্ম প্রথম। জিএইচআই (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেকস)-এ ১১৯টি দেশের মধ্যে আমরা ১০৩-এ। ২০১৭-য় অপুষ্টিতে আমরা শীর্ষে। পরিবেশ দূষণে আমরা? সারাবিশ্বের জঘন্যতম ১৫টি দূষিত শহরের মধ্যে ১৪-টিই আমার দেশের! ২০১৮-য় কুড়ি লক্ষ অকালমৃত্যুর কারণ ছিল দূষিত পরিবেশ। ইপিআই (এনভার্নমেন্টাল পারফরম্যান্স ইন্ডেক্স) অনুযায়ী বিশ্বে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৭৭-এ! জলের পরিস্থিতি ১৯৫০-এ মাথাপিছু জলের পরিমাণ ৫০০০ কিউবিক মিটার থেকে বর্তমানে ১১৪০ সেমি (১০০০ সেমি সর্বনিম্ন সীমা)! এইচসিআই (ওয়ার্ল্ড হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেকস)-এর শিক্ষাগত অবস্থার মানদন্ডে ১৫৮টি দেশের মধ্যে আমরা ১১৫ নম্বরে। ২০১৭তে আমরা এক ঝটকায় ১২ ধাপ নীচে নেমে এসেছি, এমনকি নেপাল-শ্রীলঙ্কার থেকেও নীচে। আইসিটি ডেভালপমেন্ট ইনডেকস অনুযায়ী ১৭৬টি দেশের মধ্যে ১৩৪ নম্বরে ! অথচ টিটিএন/পিআর-এর রিপোর্ট জানাচ্ছে ৩ বছরে মোদির শুধু বিমান খরচই ২৫৫ কোটি টাকা!
এক দশকে দলিত নির্যাতন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ, এমনটাই বলছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো। ২০০৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত রিপোর্ট বলছে, প্রতি ১৫ মিনিটে অপরাধের শিকার হন দলিতরা। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন ধর্ষিতা হন ৬ জন দলিত মহিলা। এক দশকে দলিত নির্যাতন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ।
লোকসভায় বিজেপির সাংসদ তরুণ বিজয় জানাচ্ছেন মোদিজীর ‘স্বচ্ছ ভারতে’ প্রতি বছর মাথায় করে মলমূত্র পরিষ্কার করতে গিয়ে এই কাজের সাথে যুক্ত ২২৩২৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ, যখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউএপিএ সরকার যেখানে ২০১৩-১৪ সালে ৫৫ কোটি টাকা মাথায় করে মলবহনকারীদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ করেছিল, মোদি সরকার তার জমানায় মাথায় করে মল বহনকারীদের পুর্নবাসনে এক পয়সাও খরচ করেনি!
তবু আমরা বলতে পারি, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ যুগলবন্দি মিথ্যাবচন কদাপি বলেন না! শুধু তাঁরা যা বলেন তার অর্থের মধ্যে কিছু ফ্যালাসি থেকে যায়, যা আমাদের মতো মধ্যমেধার মানুষজন হয়তো বুঝে উঠতে পারিনা। এই যেমন তিনি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসার আগে বলেছিলেন ‘আচ্ছে দিন’ আনবেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে বললেন ‘ম্যায় হুঁ চৌকিদার’। ‘আচ্ছে দিনের’ গল্প কেন ‘চৌকিদারের’ গল্পে বদলে যাচ্ছে এই বলে আমরা হই হই করে উঠলাম। কিন্তু হায়! আমরা তো তাঁকে বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলাম! তিনি বিগত ৫ বছর ধরে প্রতিশ্রুতি মতন ‘আচ্ছে দিন’ এনেছেন। তবে সেটা আমজনতার জন্য ‘আচ্ছে দিন’ নয়, কর্পোরেট পুঁজির জন্য ‘আচ্ছে দিন’। তিনি জনতার প্রতি নয় কর্পোরেট পুঁজির প্রতিই দায়বদ্ধ, আর দায়বদ্ধ সংঘপরিবারের কাছে। কারণ, তাদের কল্যাণেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে আজ সমাসীন। কীভাবে কর্পোরেট পুঁজির কাছে তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন? ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের চিত্র দিয়েই তা পরিষ্কার যা আমরা উপরে দেখিয়েছি। ধনবৈষম্যে ভারতের স্থান রাশিয়ার পরেই, বিশ্বে দ্বিতীয়। এটা গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্টের তথ্য। একবার ভাবুন তো ধনী ব্যক্তিদের জন্য কতখানি ‘আচ্ছে দিন’ এনে দিয়েছেন মোদি-শাহ যুগলবন্দি! এরপর যখন প্রথম ৫ বছর অতিক্রমের দোরগোড়ায়, তখন মোদি স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে ‘চৌকিদার’ দাবি করলেন। এর মানে যদি আমরা করি যে মোদি ‘দেশরক্ষক’ হিসাবে ‘চৌকিদার’ দাবি করছেন তাহলে তা হবে মূর্খের স্বর্গে বাস করা। যদি আমরা আবেগতাড়িত হয়ে বলতে শুরু করি যে ‘মোদির আমলেই সবচেয়ে বেশি সম্পদ বাইরে পাচার হয়েছে’; যদি আমরা দাবি করি যে ‘মোদির আমলে সমস্ত দুর্নীতিকে বৈধ করে দেওয়া হয়েছে’ বা ‘মোদির আমলে দেশের যাবতীয় সম্পদ কর্পোরেটদের পায়ের তলায় সঁপে দেয়া হয়েছে’; অথবা মোদির আমলে ব্যংক লুটেরারা প্রকাশ্যে ব্যাংক লুট করে অন্য দেশে কেটে পড়েছে; তবে তা দিয়ে চৌকিদারত্বের দাবিকে খণ্ডন করা যাবে না। কারণ, মোদি তো কর্পোরেট পুঁজির সম্পদরক্ষার ‘চৌকিদার’! সেই অর্থে মোদি নিজেকে ঠিকই দাবি করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এতো কিছু চেষ্টার পরও, মোদি সরকার দেশের অর্থনীতির সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করতে পারছেন না। শুধুমাত্র জনগণ নয় শাসকশ্রেণীর তথাকথিত উন্নয়নের মানদণ্ডগুলোও অর্থাৎ এককথায় বাজার অর্থনীতির মানদণ্ডগুলোও বড্ড বেয়ারা তথ্য দিচ্ছে যে! তারা জানাচ্ছে সামনে বিরাট আর্থিক সংকট দেশকে গ্রাস করতে চলেছে। কর্পোরেট কর কমানোর মধ্যে দিয়ে জনগণের উপর করের বোঝা বাড়িয়ে; জনগণকে কর্মক্ষেত্র থেকে ছাঁটাই করে; খুচরো ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে লাটে তুলে দিয়ে; জনগণের মজুরি সহ অন্যান্য যাবতীয় অধিকারগুলো খর্ব করে; উন্নয়নের নামে তাদের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করেও শিল্পকে চাঙ্গা করা যাচ্ছে না। চিত্রটা কী রকম একটু দেখা যাক। গত ১৮ নভেম্বর ২০১৯-এর আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় বলছে : ‘টাকার দামের পতন অব্যাহত, ইহা সমস্যার একটি প্রকাশমাত্র। কেন টাকার দাম পড়িতেছে, সেই কারণ সন্ধান করিলে একটি স্পষ্ট উত্তর মিলিবে—ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উপর বিশ্বমঞ্চে ভরসা কমিতেছে। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কও বিপুল পরিমাণ ডলার ঘরে তুলিয়াছে, অর্থাৎ টাকার ভবিষ্যতের উপর দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কেরও বিশেষ আস্থা নাই। আস্থা হারাইবার কারণ প্রকট—অর্থব্যবস্থার সর্বাঙ্গে গতিভঙ্গের ঘুণ ধরিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের সূচক নিম্নমুখী, বিদ্যুতের চাহিদা নাই। অক্টোবর মাসে পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার কার্যত শূন্যে ঠেকিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে গতিভঙ্গের সকল লক্ষণ স্পষ্ট। অন্যদিকে খুচরা পণ্যের মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার গত ষোলো মাসে সর্বোচ্চ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সহনসীমার ঊর্ধ্বে। আপাত জটিল ধাঁধা—যেখানে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৪০ মাসের তলানিতে, সেখানে খুচরা পণ্যে এমন মূল্যবৃদ্ধি হইতেছে কীভাবে? উত্তর আছে হিসাবের পদ্ধতিতে। পাইকারি মূল্যসূচকে খাদ্যপণ্যের গুরুত্ব ১৫ শতাংশ, খুচরা মূল্যসূচকে সেই গুরুত্ব ৪৫ শতাংশের বেশি। শুধুমাত্র খাদ্যপণ্যের পাইকারি মূল্যসূচকের মূল্যবৃদ্ধির হার সেপ্টেম্বরে ছিল ৫.০৮ শতাংশ, অক্টোবরে তাহা বাড়িয়া হইয়াছে ৭.৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ শিল্পক্ষেত্র ধুঁকিতেছে, কিন্তু বাজারে খাদ্যমূল্য অগ্নিমূল্য। সাধারণ মানুষ দুই অস্ত্রেই ঘায়েল হইতেছেন। তাহার উপর টাকার দামের নিম্নগতি অব্যাহত থাকিলে পেট্রোপণ্য সহ আরও অনেক কিছুরই দাম বাড়িবে, তাহার আঁচ আসিয়া লাগিবে সাধারণ মানুষের গায়ে। নরেন্দ্র মোদি ভারতের অর্থব্যবস্থাকে যে চক্রব্যুহের মধ্যে আনিয়া ফেলিয়াছেন তাহা হইতে বাহির হইবার পথ তাঁহারা জানেন বলিয়া বিশ্বাস হয় না’ (আনন্দবাজার, ১৮ নভেম্বর ২০১৯)। এদিকে সরকারের অন্দরে কাঁপুনি ধরিয়ে মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে তারা জানিয়েছে, ভারতীয় অর্থনীতিতে মন্দা আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে। তারা আরো জানিয়েছে চলতি অর্থবর্ষে অর্থাৎ ২০১৯–২০ সালে ভারতের জিডিপি হার কমে ৫.৬ শতাংশে নামবে যেখানে শুরুতে ভাবা হয়েছিল ভারতে জিডিপি হার ২০১৯–২০২০ সালে ৫.৮ শতাংশ হবে। সম্প্রতি প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা গিয়েছে জিডিপি-র পরিমাণ বর্তমানে নিম্নমুখী হয়ে ৪.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এর পরিমাণ আরও কমে ১.৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে!
শিল্পসংস্থাগুলিতে ছাঁটাই ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৪ সালে কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতে বিনিয়োগের অংক ছিল জিডিপির ৩৪.৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০.৭ শতাংশে। ইউএপিএ আমলে এই অনুপাত ছিল গড়ে ৩৯ শতাংশ, মোদির জমানায় তা কমে হয়েছে গড়ে ৩১.৮ শতাংশ। এটা দেখাচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যে আমাদের দ্রুত অধোগতির দিকটাকে। ২০১৪ সালে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য গড়ে ১৩/১৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল, মোদি-১ জমানায় তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১.৬ শতাংশে। এর ফলে বিদেশি মূল্যের ঘাটতি বেড়েছে ২.৯ শতাংশ । তাই ডলারের দাম ক্রমবর্ধমান। এদিকে বিগত ৩০ বছরের হিসাবে যা হয়নি তাই করতে চলেছে রিজার্ভ ব্যাংক। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ১.১৫ বিলিয়ন ডলারের সোনা বিক্রি করে ফেলেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
শিল্পে লগ্নি তলানিতে। এর সঙ্গে গাড়ি নির্মাতা, যন্ত্রাংশ সংস্থা, ডিলার ও অসংগঠিত ক্ষেত্র, সর্বত্র কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে দ্রুতগতিতে। শুধু গাড়ি শিল্পে গত কয়েক মাসের মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন ৩.৫ লক্ষের বেশি মানুষ । তাদের মধ্যে ২.৫ লক্ষ ডিলার কর্মী। যন্ত্রাংশ শিল্পে ১ লক্ষ। গাড়ি সংস্থাগুলিতে অন্তত ১৫ হাজার। গত ত্রৈমাসিকে বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা মারুতি সুজুকিতে বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। বিপুল কমেছে নিট মুনাফা। অন্যান্য গাড়ি সংস্থাগুলির অবস্থাও তথৈবচ। অবিলম্বে চাহিদার উন্নতি না হলে আগামী দিনে ১০ লক্ষ কর্মী কাজ হারাতে পারেন। ফলে এই মুহূর্তে গাড়ি সংস্থাগুলি গাড়ি শিল্পকে বাঁচাতে বিপুল ত্রাণ সাহায্যের দাবি করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। ভারতের জিডিপিতে মোটরগাড়ি শিল্পের অবদান হল ৭ শতাংশ এবং এই ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ ভাবে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লক্ষ শ্রমিক এর সাথে যুক্ত। মোটর গাড়ি, শীততাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র এবং ঠাণ্ডা মেশিন অথবা টিভি ও ওয়াশি্ং মেশিনের মত ব্যয়বহুল ভোগ্যপণ্যের বিক্রি যথেষ্ট কমার পাশাপাশি বিস্কুটের বিক্রিও কমে গেছে। পার্লে এবং ব্রিটানিয়া কোম্পানিও শ্রমিক ছাঁটাই করছে।